পরিচ্ছেদঃ ১. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - (কুরআন অধ্যয়ন ও তিলাওয়াতের আদব)
২১৯৮-[১২] আবূ সা’ঈদ আল্ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি একবার দরিদ্র মুহাজিরদের একদলের মধ্যে বসলাম। তারা নিজেদের পোশাক স্বল্পতার জন্য একে অন্যের সাথে মিশে মিশে বসেছিলেন। এ সময় একজন আমাদের সামনে কুরআন পাঠ করছিল। এ সময় হঠাৎ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এখানে এসে উপস্থিত হলেন এবং আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে গেলেন। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসে দাঁড়ালে কুরআন পাঠক চুপ হয়ে গেল। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তখন আমাদেরকে সালাম দিলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, কী করছিলে তোমরা? জবাবে আমরা বললাম, আল্লাহর কিতাব শুনছিলাম। এ কথা শুনে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ আল্লাহ তা’আলার শুকর, যিনি আমার উম্মাতের মধ্যে এ ধরনের লোক সৃষ্টি করে দিয়েছেন, যাদের সাথে শারীক হবার জন্য আমি আদিষ্ট হয়েছি।
বর্ণনাকারী আবূ সা’ঈদ আল্ খুদরী (রাঃ) বলেন, এরপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাদের মধ্যে বসে নিজেকে আমাদের অন্তর্ভুক্ত করে নেন। এরপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর হাত দিয়ে (ইশারা করে) বললেন, তোমরা গোল হয়ে বসো। (বর্ণনাকারী বলেন এ কথা শুনে) তারা গোল হয়ে বসলেন। তাদের চেহারা রসূলের মুখোমুখি হয়ে গেল। তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, হে গরীব মুহাজিরের দল! তোমরা কিয়ামতের দিন পূর্ণ জ্যোতির সুখবর গ্রহণ কর। তোমরা ধনীদের অর্ধেক দিন পূর্বে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর এ অর্ধেক দিনের (পরিমাণ) হলো পাঁচশ বছর। (আবূ দাঊদ)[1]
عَن أبي سعيد الْخُدْرِيّ قَالَ: جَلَست فِي عِصَابَةٍ مِنْ ضُعَفَاءِ الْمُهَاجِرِينَ وَإِنَّ بَعْضَهُمْ لِيَسْتَتِرُ بِبَعْضٍ مِنَ الْعُرْيِ وَقَارِئٌ يَقْرَأُ عَلَيْنَا إِذْ جَاءَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَامَ عَلَيْنَا فَلَمَّا قَامَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ سَكَتَ الْقَارِئُ فَسَلَّمَ ثُمَّ قَالَ: «مَا كُنْتُمْ تَصْنَعُونَ؟» قُلْنَا: كُنَّا نَسْتَمِعُ إِلَى كتاب الله قَالَ فَقَالَ: «الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي جَعَلَ مِنْ أُمَّتِي مَنْ أُمِرْتُ أَنْ أَصْبِرَ نَفْسِي مَعَهُمْ» . قَالَ فَجَلَسَ وَسَطَنَا لِيَعْدِلَ بِنَفْسِهِ فِينَا ثُمَّ قَالَ بِيَدِهِ هَكَذَا فَتَحَلَّقُوا وَبَرَزَتْ وُجُوهُهُمْ لَهُ فَقَالَ: «أَبْشِرُوا يَا مَعْشَرَ صَعَالِيكِ الْمُهَاجِرِينَ بِالنُّورِ التَّامِّ يَوْمَ الْقِيَامَةِ تَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ قَبْلَ أَغْنِيَاءِ النَّاسِ بِنصْف يَوْم وَذَاكَ خَمْسمِائَة سنة» . رَوَاهُ أَبُو دَاوُد
ব্যাখ্যা: এ হাদীস থেকে প্রতীয়মান হয় যে, কুরআন পাঠের সময় সালাম প্রদান করা মাকরূহ। কেননা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআনের পাঠক চুপ হওয়ার পর সালাম করেছেন। দীনী আলোচনা মাজলিসের শার‘ঈ পদ্ধতি হলো গোলাকার হয়ে বসা যেমন আলোচ্য হাদীসে পাওয়া গেল। তাই রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের মাঝে এমনভাবে উপবিষ্ট হলেন যেন সবাই তার নিকট সমান। এভাবে দীনী আলোচনা করলে আল্লাহ নূরকে পরিপূর্ণ করে দেন, এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, نُورُهُمْ يَسْعٰى بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَبِأَيْمَانِهِمْ يَقُوْلُوْنَ رَبَّنَا أَتْمِمْ لَنَا نُوْرَنَا ‘‘(সেদিনের ভয়াবহ অন্ধকার থেকে মু’মিনদের রক্ষার ব্যবস্থা হিসেবে) তাদের নূর দৌড়াতে থাকবে তাদের সামনে আর তাদের ডান পাশে। তারা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের নূরকে আমাদের জন্য পরিপূর্ণ করে দাও’’- (সূরা আত্ তাহরীম ৬৬ : ৮)। গরীব লোকেরা ধনীদের অর্ধ দিবস তথা পাঁচশত বছর পূর্বে জান্নাতে প্রবেশ করবে। কেননা কুরআনে এসেছে وَإِنَّ يَوْمًا عِنْدَ رَبِّكَ كَأَلْفِ سَنَةٍ مِمَّا تَعُدُّونَ ‘‘তোমার প্রতিপালকের একদিন তোমাদের গণনায় এক হাজার বছরের সমান’’- (সূরা আল হজ ২২ : ৪৭)। এ ব্যাপারে বিভিন্ন রিওয়ায়াত রয়েছে, যেমন কোন হাদীসে ৪০ বছর পূর্বের কথা বলা হয়েছে। যদিও এর বিভিন্ন বর্ণনা রয়েছে, তবে এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো অনেক দিন পূর্বে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে। আবার কেউ সমন্বয় এভাবে করেছেন যে, ব্যক্তি হিসেবে দিনের সংখ্যা কম বেশি হবে। আর এটা এজন্য যে, ধনীরা আল্লাহর সামনে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হবে। বলা হবে কিভাবে কোথা হতে সম্পদ অর্জন করেছে এবং কোথায় তা ব্যয় করেছে।
পরিচ্ছেদঃ ১. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - (কুরআন অধ্যয়ন ও তিলাওয়াতের আদব)
২১৯৯-[১৩] বারা ইবনু ’আযিব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ’তোমাদের মিষ্টি স্বর দিয়ে কুরআনকে সুন্দর করো।’ (আহমদ, আবূ দাঊদ, ইবনু মাজাহ ও দারিমী)[1]
وَعَنِ الْبَرَاءِ بْنِ عَازِبٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «زَيِّنُوا الْقُرْآنَ بِأَصْوَاتِكُمْ» . رَوَاهُ أَحْمَدُ وَأَبُو دَاوُدَ وَابْنُ مَاجَهْ وَالدَّارِمِيُّ
ব্যাখ্যা: কুরআন মাজীদকে সুন্দর কণ্ঠে তিলাওয়াত করা শারী‘আতের নির্দেশ। কুরআনকে সুর দিয়ে পড়লে আরো সুন্দর হয়। এ ব্যাপারে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ (فإن الصوت الحسن يزيدالقرآن حسناً) অর্থাৎ- সুমধুর কণ্ঠ কুরআনের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। আর তা নিষিদ্ধ নয়, কেননা সৌন্দর্য বর্ধক জিনিস সেই বস্ত্তরই অন্তর্ভুক্ত। আল মানাবী (রহঃ) বলেন, আসলে উপরোক্ত হাদীস দ্বারা তারতীল সহ কুরআন তিলাওয়াতের উপর উদ্ধুদ্ধ করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন, وَرَتِّلِ الْقُرْاٰنَ تَرْتِيلًا ‘‘আর ধীরে ধীরে সুস্পষ্টভাবে কুরআন পাঠ কর’’- (সূরা আল মুযযাম্মিল ৭৩ : ৪)। অর্থাৎ- কুরআন তাজবীদসহ চিন্তা বিমুগ্ধ করুন স্বরে পাঠ কর। সুন্দর কালামুল্লাহকে সুর করে পড়লে মানুষ বিমোহিত হয়ে পড়ে। একদা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবূ মূসা -এর তিলাওয়াত শুনে বললেন, (لقد أوتيت مزماراً من مزامير آل داود) তোমাকে দাঊদ (আঃ)-এর কণ্ঠস্বর দেয়া হয়েছে।
পরিচ্ছেদঃ ১. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - (কুরআন অধ্যয়ন ও তিলাওয়াতের আদব)
২২০০-[১৪] সা’দ ইবনু ’উবাদাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি কুরআন শিখে ভুলে গিয়েছে, সে কিয়ামতের দিন অঙ্গহানি অবস্থায় আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করবে। (আবূ দাঊদ, দারিমী)[1]
وَعَنْ سَعْدِ بْنِ عُبَادَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسلم: «مَا من امْرِئٍ يَقْرَأُ الْقُرْآنَ ثُمَّ يَنْسَاهُ إِلَّا لَقِيَ اللَّهَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَجْذَمَ» . رَوَاهُ أَبُو دَاوُدَ والدارمي
ব্যাখ্যা: কুরআন শিক্ষা করার পর ভুলে যাওয়া গোনাহের কাজ। কুরআন শিক্ষার বিভিন্ন ধরন হতে পারে যেমন দেখে পড়া, মুখস্থ রাখা, অর্থ বুঝা। যাই হোক না কেন তা ভুলে গেলে তার কাবীরাহ্ গুনাহ হবে বলে ইমাম রাফি‘ঈ মত প্রকাশ করেন। কেউ কেউ বলেন, এখানে কুরআন ভুলে যাওয়া মানে কুরআনের তিলাওয়াত ও তার প্রতি ‘আমল থেকে বিরত থাকা। কুরআন ভোলা ব্যক্তি কিয়ামতের দিন আল্লাহর সামনে কর্তিত হাত নিয়ে সাক্ষাৎ করবে। أجذم এর অর্থ কেউ সর্বাঙ্গহীন, কেউ দলীলহীন, কেউ কাটা হাত, কেউ কল্যাণের পথচ্যুত বলে ব্যাখ্যা করেছেন। আসলে সবগুলো অর্থ প্রায় কাছাকাছি। মোটকথা এর জন্য কঠিন শাস্তি রয়েছে।
হাফেয ইবনু হাজার আসকালানী বলেন, কুরআন ভোলা ব্যক্তির পাপের ব্যাপারে সালাফে সলিহীনের মাঝে মতানৈক্য রয়েছে। কেউ বলেন কাবীরাহ্ গুনাহ হবে, কেউ বলেন পাপ হবে, যেমন মাওকূফ সূত্রে বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে, (ما من أحد تعلم القرآن ثم نسيه إلا بذنب)। আবূ ‘উবাদাহ্ الضحاك بن مزاحم সূত্রে বলেন, কুরআন ভোলা বড় বিপদ বা গুনাহ। কেননা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, عرضت على ذنوب أمتي فلم أر ذنباً أعظم من سورة القرآن أويتها رجل ثم نسيها (হাদীসটির সানাদ য‘ঈফ)। সাহাবী আবূ ‘আলিয়্যাহ্ বলেন, كنا نعد من أعظم الذنوب أن يتعلم الرجل القرآن ثم ينام عنه حتى ينساه অর্থাৎ- আমরা সবচাইতে বড় পাপ বলে আখ্যায়িত করতাম কোন ব্যক্তির কুরআন শিক্ষা গ্রহণের পর অবহেলাবশত তা ভুলে গেলে। কুরআন তিলাওয়াত বিমুখতা ভুলে যাবার কারণ। আর ভুলে যাওয়া তার যত্নহীনতা ও তুচ্ছজ্ঞান প্রমাণ করে।
পরিচ্ছেদঃ ১. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - (কুরআন অধ্যয়ন ও তিলাওয়াতের আদব)
২২০১-[১৫] ’আবদুল্লাহ ইবনু ’আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি তিন দিনের কমে কুরআন পড়েছে, সে কুরআন বুঝেনি। (তিরমিযী, আবূ দাঊদ, দারিমী)[1]
وَعَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «لَمْ يَفْقَهْ مَنْ قَرَأَ الْقُرْآنَ فِي أَقَلَّ مِنْ ثَلَاث» . رَوَاهُ التِّرْمِذِيّ وَأَبُو دَاوُد والدارمي
ব্যাখ্যা: হাদীসের বাহ্যিক অর্থ থেকে বুঝা যায় যে, তিন দিনের কমে কুরআন খতম করা মাকরূহ। এ মতের উপর অধিকাংশ ‘আলিম, মুহাদ্দিস ফাতাওয়া প্রদান করেছেন। এর কমে খতম করলে কুরআনকে বুঝতে পারবে না এবং তার প্রতিপাদ্য বিষয়াদি অনুধাবন করতে সক্ষম হবে না। তবে তার সাওয়াব হবে। তিন দিনের কমে খতম না করার আরো অনেক বর্ণনা রয়েছে, যথাঃ (عن عائشة إنها قالت ولا أعلم نبي الله قرأ القرآن كله في ليلة) অর্থাৎ- আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে গোটা কুরআন এক রাতে পড়ার কথা সম্পর্কে অবগত নই। তিনি আরো বলেন যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন দিনের কমে কুরআন খতম করতেন না।
‘আবদুল্লাহ বিন মাস্‘ঊদ বলেন, তোমরা তিন দিনের কমে কুরআন পড়ে শেষ করো না।
ইমাম ত্ববারানী (রহঃ) তাঁর ‘আল কাবীর’ গ্রন্থে বলেন, তোমরা তিন দিনের কমে কুরআন পড়ো না, বরং সাত দিনে খতম কর।
সালাফগণ এ নিয়ে মতানৈক্য করেছেন তাদের অনেকে তিন দিনের কমে পড়াকে মাকরূহ বলেছেন, যাদের মধ্যে রয়েছেন ইমাম আহমাদ, ইসহাক বিন রহ্ওয়াইহি, আবূ ‘উবায়দ প্রমুখ। কোন জাহিরী মতাবলম্বী এটাকে হারাম বলেছেন, তবে কোন বিদ্বান এটার রুখসাত দিয়েছেন তারা দলীল হিসেবে ‘উসমান-এর হাদীস যথাঃ (إنه كان يقرأ القرآن في ركعة يوتر بها) এবং সা‘ঈদ বিন জুবায়র-এর হাদীস যথা (أنه قرأ القرآن في ركعة في الكعبة) উল্লেখ করেন।
হাফেয ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) আহমাদ, ইসহাক-এর মতটি গ্রহণ করে ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার-এর হাদীস পেশ করেন।
ইমাম নাবাবী (রহঃ) বলেন, অধিকাংশ ‘আলিমের অভিমত হলো যে, এর কোন নির্দিষ্ট মেয়াদ নেই। এটা পাঠকের উৎসাহ, আগ্রহ, চাহিদা, শক্তির উপর নির্ভরশীল। ব্যক্তি বিশেষ অবস্থার কারণে পড়ার সময় বিভিন্ন রকম হতে পারে। সুতরাং যেই ব্যক্তির দ্রুত পড়ার সাথে সাথে আয়াতের ভাবার্থ, তাৎপর্য, মাহাত্ম্য পূর্ণরূপে বুঝতে পারবে সে তাড়াতাড়ি পড়বে। আর এর ব্যতিক্রম হলে সে ধীরে ধীরে পড়বে। মির্‘আতুল মাফাতীহ গ্রন্থকার বলেন, আমার নিকটে আহমাদ, ইসহাক-এর মতটি পছন্দনীয়। কেননা ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার ও ‘আয়িশাহ্ এর হাদীস সর্বাধিক অনুসরণযোগ্য।
পরিচ্ছেদঃ ১. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - (কুরআন অধ্যয়ন ও তিলাওয়াতের আদব)
২২০২-[১৬] ’উকবাহ্ ইবনু ’আমির (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ উচ্চস্বরে কুরআন পড়া প্রকাশ্যে সদকা করার মতো। আর চুপে চুপে কুরআন পড়া চুপে চুপে সদকা করার মতো। (তিরমিযী, আবূ দাঊদ ও নাসায়ী। ইমাম তিরমিযী বলেন, এ হাদীসটি হাসান ও গরীব।)[1]
وَعَنْ عُقْبَةَ بْنِ عَامِرٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «الْجَاهِرُ بِالْقُرْآنِ كالجاهر بِالصَّدَقَةِ ولامسر بِالْقُرْآنِ كَالْمُسِرِّ بِالصَّدَقَةِ» . رَوَاهُ التِّرْمِذِيُّ وَأَبُو دَاوُدَ وَالنَّسَائِيُّ وَقَالَ التِّرْمِذِيُّ: هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ غَرِيبٌ
ব্যাখ্যা: বাহ্যিকভাবে হাদীসের অর্থ হলো উচ্চৈঃস্বরে কুরআন পড়ার চাইতে চুপি স্বরে পড়ার উত্তম, যেমন গোপনে সদাকাহ্ করা উত্তম। এ মতটি ইমাম তিরমিযী ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, বিজ্ঞ ‘আলিমগণ এভাবেই হাদীসের ব্যাখ্যা করেছেন। যেন মানুষ অহংকার থেকে নিরাপদ থাকে, কারণ যে গোপনে কোন ‘আমল করে তার অহংকারের ভয় থাকে না যা প্রকাশ্যে করলে হয়ে থাকে। আসলে উঁচু আওয়াজে কুরআন পড়া ও নিম্নস্বরে পড়া উভয় পক্ষে হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
উভয়ের মাঝে সমাধানকল্পে ইমাম তিরমিযী বলেন,
(إن الأسرار أبعد من الرياء فهو أفضل في حق من يخاف ذلك، فإن لم يخف الرياء فالجهر أفضل بشرط أن لا يؤذي غيره)
অর্থাৎ- নীরবে পড়া রিয়া বা লৌকিকতা থেকে অধিক দূরের বিষয়। আর যার রিয়ার আশংকা আছে তার জন্য নীরবে পড়া উত্তম। কিন্তু যার এই ভয় নেই তার উঁচু স্বরে পড়া বেশি ভাল, তবে এর দ্বারা মুসল্লি, ঘুমন্ত ব্যক্তির যেন কষ্ট না হয়। অর্থাৎ- যেখানে লৌকিকতা, মুসল্লির কষ্টের সম্ভাবনা রয়েছে সেথায় নীরবে পড়া উত্তম। এছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে স্বরবে পড়া উত্তম। এর প্রতি ‘আমল করা উল্লেখযোগ্য কাজ। কেননা এর মাধ্যমে মানুষ মনোযোগ সহকারে শোনার, শিক্ষার, অনুসরণ করার উপকার পায়। উপরন্তু এটি একটি ধর্মের প্রতীক। আর এর দ্বারা পাঠকের কলব জাগ্রত হয়, তার চেতনা চিন্তার জন্য পুঞ্জীভূত হয় কেননা এটা ঘুমকে দূরীভূত করে। এসব নিয়্যাতে উঁচু স্বরে কুরআন পড়া উত্তম কাজ।
পরিচ্ছেদঃ ১. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - (কুরআন অধ্যয়ন ও তিলাওয়াতের আদব)
২২০৩-[১৭] সুহায়ব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে লোক কুরআনে বর্ণিত হারামকে হালাল মনে করেছে সে কুরআনের উপর ঈমান আনেনি। (তিরমিযী; তিনি বলেছেন, এ হাদীসের সানাদ দুর্বল।)[1]
وَعَنْ صُهَيْبٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَا آمَنَ بِالْقُرْآنِ مَنِ اسْتَحَلَّ مَحَارِمَهُ» . رَوَاهُ التِّرْمِذِيُّ وَقَالَ: هَذَا حَدِيثٌ لَيْسَ إِسْنَادُهُ بِالْقَوِيّ
ব্যাখ্যা: محارم শব্দটি محرم এর বহুবচন। যার অর্থ নিষিদ্ধ কাজ, নিষেধ। এখানে উদ্দেশ্য হলো কুরআন মাজীদ সব হুকুম আহকাম সংক্রান্ত নিষিদ্ধ বিষয় রয়েছে তা হালাল মনে করা হচ্ছে কুফরী। ইমাম ত্বীবী (রহঃ) বলেন, এখানে কুরআনের সম্মান ও মাহাত্ম্যের জন্য কুরআনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ কর্তৃক হারামকৃত জিনিসকে হালাল মনে করবে সে স্বভাবিকভাবেই কাফির। কেউ বলেছেন, সে অকাট্যভাবে কাফির বলে বিবেচিত হবে।
পরিচ্ছেদঃ ১. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - (কুরআন অধ্যয়ন ও তিলাওয়াতের আদব)
২২০৪-[১৮] লায়স ইবনু সা’দ (রহঃ) ইবনু আবূ মুলায়কাহ্ (রহঃ) হতে, তিনি ইয়া’লা ইবনু মুমাল্লাক (রহঃ) হতে বর্ণনা করেছেন যে, ইয়া’লা একদিন উম্মুল মু’মিনীন উম্মু সালামাহ্ (রাঃ)-কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কুরআন পাঠ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। উম্মু সালামাহ্ (রাঃ)-কে শুনাতে দেখা গেল, রসূলের কুরআন পাঠ অক্ষর অক্ষর পৃথক করে প্রকাশ করছেন। (তিরমিযী, আবূ দাঊদ, নাসায়ী)[1]
وَعَنِ اللَّيْثِ بْنِ سَعْدٍ عَنِ ابْنِ أَبِي مليكَة عَنْ يَعْلَى بْنِ مُمَلَّكٍ أَنَّهُ سَأَلَ أُمَّ سَلَمَةَ عَنْ قِرَاءَةِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَإِذَا هِيَ تَنْعَتُ قِرَاءَةً مُفَسَّرَةً حَرْفًا حَرْفًا. رَوَاهُ التِّرْمِذِيّ وَأَبُو دَاوُد وَالنَّسَائِيّ
ব্যাখ্যা: উম্মু সালামাহ্ (রাঃ) বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কিরাআত ছিল স্পষ্ট ও সুমধুর। তার কিরাআতে একটির সাথে আরেকটির সংমিশ্রণ হত না। তিনি এমনভাবে আলাদা আলাদা করে পড়তেন যে, তাঁর কিরাআতের হরফগুলো গণনা করা যেত।
ইমাম ত্বীবী (রহঃ) বলেন, অতিরিক্ত তাড়াতাড়ি করে কুরআন পড়া মাকরূহ মর্মে ‘আলিমদের ঐকমত্য হয়েছে। তারা বলেন, বিনা তারতীলে দুই জুয বা পারা কুরআন পড়ার চাইতে ঐ সময়ে তারতীলসহ স্পষ্টভাবে একপারা পড়া বেশি উত্তম। আর কুরআন অনুধাবন করার জন্য তারতীলসহ কুরআন পড়া মুস্তাহাব। কারণ এটা কুরআনের মাহাত্ম্য বর্ণনা ও সম্মানের নিকটতম পন্থা এবং অন্তরে বেশি ক্রিয়াশীল। এজন্য অনারবী ব্যক্তির জন্য স্পষ্টভাবে তারতীলসহ কুরআন পড়া মুস্তাহাব। আল জাযরী (রহঃ) তাঁর النشر ‘আন্ নাশর’ গ্রন্থে বলেন, তারতীলসহ কুরআন পড়া মর্যাদার দিক থেকে অধিকতর সম্মানিত। আর সাওয়াব বেশি হয় সংখ্যায় বেশি তিলাওয়াত করলে। কারণ একটি হরফে দশটি নেকি হয়।
পরিচ্ছেদঃ ১. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - (কুরআন অধ্যয়ন ও তিলাওয়াতের আদব)
২২০৫-[১৯] ইবনু জুরায়জ (রহঃ) ইবনু আবূ মুলায়কাহ্ (রহঃ) হতে, তিনি উম্মুল মু’মিনীন উম্মু সালামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন। উম্মু সালামাহ্ (রাঃ) বলেছেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাক্যের মধ্যে পূর্ণ থেমে কুরআন তিলাওয়াত করতেন। তিনি বলতেন, ’আলহাম্দু লিল্লা-হি রব্বিল ’আ-লামীন’, এরপর থামতেন। তারপর বলতেন, ’আর্ রহমা-নির রহীম’, তারপর বিরতি দিতেন। (তিরমিযী। তিনি বলেছেন, এ হাদীসের সানাদ মুত্তাসিল নয়। কারণ আগের হাদীসে লায়স একে ইবনু আবূ মুলায়কাহ্ হতে এবং তিনি ইয়া’লা ইবনু মামলাক হতে আর ইয়া’লা উম্মু সালামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন। [অথচ এখানে ইয়া’লা-এর উল্লেখ নেই] তাই উপরের লায়স-এর বর্ণনাটি অধিক নির্ভরযোগ্য।)[1]
وَعَنِ ابْنِ جُرَيْجٍ عَنِ ابْنِ أَبِي مُلَيْكَةَ عَنْ أُمِّ سَلَمَةَ قَالَتْ: كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُقَطِّعُ قِرَاءَتَهُ يَقُولُ: الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ ثُمَّ يَقِفُ ثُمَّ يَقُولُ: الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ ثُمَّ يَقِفُ. رَوَاهُ التِّرْمِذِيُّ وَقَالَ: لَيْسَ إِسْنَادُهُ بِمُتَّصِلٍ لِأَنَّ اللَّيْثَ رَوَى هَذَا الْحَدِيثَ عَنِ ابْنِ أَبِي مُلَيْكَةَ عَنْ يَعْلَى بْنِ مَمْلَكٍ عَنْ أُمِّ سَلَمَةَ وَحَدِيثُ اللَّيْث أصح
ব্যাখ্যা: ইমাম বায়হাক্বী বলেছেন, প্রতি আয়াতের শেষে ওয়াকফ করা বা থামা সুন্নাত যদিও তার পরবর্তী আয়াতের সাথে এর সম্পর্ক থাকে। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিটি আয়াতকে আলাদা আলাদা করে পড়তেন। ইমাম আহমাদ, আবূ দাঊদ, হাকিম প্রত্যেক আয়াতের মাথায় থেমে যেতেন যদিও তার পরবর্তী আয়াতের সাথে এর সম্পর্ক থাকত। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি আয়াত পড়তেন, তারপর অল্প সময় কিরাআত থেকে বিরত থাকতেন, এরপর পরের আয়াত পড়তেন। এভাবে সম্পূর্ণ সূরা পড়তেন।
কারীদের পরিভাষায় وقف হলো কিছু সময়ের জন্য শব্দ উচ্চারণ করা থেকে আওয়াজ বন্ধ করা যাতে স্বাভাবিকভাবে কিরাআত শুরু করার উদ্দেশে শ্বাস গ্রহণ করতে পারে। কিরাআত হতে বিমুখ হওয়ার উদ্দেশে নয়। আর এটা আয়াতের শেষে অথবা মাঝে হবে। কিন্তু এটা শব্দের মধ্যে এবং যা কোন রীতি সম্বলিত তাতে নয়।
কারীগণ কিরাআত শুরু ও শেষ করার প্রকারভেদ নিয়ে বিভিন্ন রকম মতভেদ প্রকাশ করেছন, ইবনুল আনবারী (রহঃ) বলেন, ওয়াকফ তিন ধরনেরঃ
১. تام (পরিপূর্ণ) ২. حسن (ভাল) ৩. قبيح (মন্দ)
আবার কেউ বলেন, ওয়াকফ চার প্রকার-
1. قبيح متروك
2. تام مختار
3. كاف جائز
4. حسن مفهوم
ইবনু জাযরী (রহঃ) বলেন, ওয়াকফ এর প্রকারভেদের নির্দিষ্ট কোন সীমা বা নিয়ম-নীতি নেই। তবে তিনি এগুলোর পর্যালোচনা করে মোটামুটি একটি নিয়ম বলেছেন তা হলো যদি ওয়াকফের পরবর্তী বাক্যের সাথে এর শাব্দিক কোন সম্পর্ক থাকে অর্থগত নয় তবে এটাকে حسن বলা হয়।
জমহূর কারীর মতানুযায়ী যে সব আয়াতের শেষের সাথে পরের অংশের সম্পর্ক রয়েছে সে ক্ষেত্রে মিলিয়ে পড়া উত্তম।
ইবনুল জাযরী (রহঃ) বলেন, আয়াতকে আলাদা করার উদ্দেশ্য প্রতিটি আয়াতের শেষে থামা মুস্তাহাব। আবার কেউ বলেছেন, এটা সুন্নাত।
ইমাম বায়হাক্বী (রহঃ) তাঁর الشعب গ্রন্থে এবং ইমাম ইবনুল কইয়্যিম (রহঃ) তাঁর زاد المعاد (যাদুল মা‘আদ) গ্রন্থে বলেছেনঃ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পথ ও সুন্নাতের সর্বাধিক অনুসরণের নিয়ম হচ্ছে প্রতিটি আয়াতের শেষে থেমে যাওয়া যদিও এর পরবর্তী অংশের সাথে এর সম্পর্ক থাকে। ইবনুল কইয়্যিম (রহঃ) বলেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিটি আয়াতের শেষে ওয়াকফ করতেন।
‘আল্লামা যুহরী (রহঃ) বলেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কিরাআত আয়াত-আয়াত করে পড়তেন। আর এটাই সর্বোত্তম ওয়াক্ব্ফের স্থান যদিও পরবর্তী আয়াতের সাথে সম্পর্ক রয়েছে।
‘আল্লামা শায়খ ‘আবদুল হক দেহলভী (রহঃ) তাঁর أشعة اللمعات গ্রন্থে বলেন, এ ধরনের আয়াতকে মিলিয়ে পড়া অগ্রাধিকারযোগ্য মত। তবে আয়াতের শেষে থেমে যাওয়া ও আয়াতের প্রথম থেকে শুরু করা সুন্নাত।