পরিচ্ছেদঃ ১০. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - জিহ্বার হিফাযাত, গীবত এবং গালমন্দ প্রসঙ্গে
৪৮৩১-[২০] আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা পরিত্যাগ করবে, অথচ মিথ্যা হলো প্রকৃতই বাতিল, তার জন্য জান্নাতের এক প্রান্তে একটি প্রাসাদ তৈরি করা হবে। যে ব্যক্তি ঝগড়াঝাটি পরিত্যাগ করবে অথচ ন্যায়ত সে ঝগড়ার হকদার, তার জন্য জান্নাতের মাঝখানে একটি প্রাসাদ নির্মাণ করা হবে। আর যে ব্যক্তি নিজের চরিত্রকে উত্তম করবে, তার জন্য জান্নাতের উঁচু এলাকায় একটি প্রাসাদ বানানো হবে। (তিরমিযী। ইমাম তিরমিযী বলেন, এ হাদীসটি হাসান। শারহুস্ সুন্নাহ্য়ও হাসান বলা হয়েছে; কিন্তু মাসাবীহ গ্রন্থকার বলেনঃ হাদীসটি গরীব।)[1]
হাদীসটি য‘ঈফ হওয়ার কারণ, এর সনদে আছে ‘‘সালামাহ্ ইবনু ওয়ারদান’’ নামের বর্ণনাকারী, সে য‘ঈফ। সিলসিলাতুয্ য‘ঈফাহ্ ১০৫৬।
عَنْ أَنَسٍ
رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عَلَيْهِ وَسلم: «من تَرَكَ الْكَذِبَ وَهُوَ بَاطِلٌ بُنِيَ لَهُ فِي ربض الْجنَّة وَمن ترك المراء وَهُوَ مُحِقٌّ بُنِيَ لَهُ فِي وَسَطِ الْجَنَّةِ وَمَنْ حَسَّنَ خُلُقَهُ بُنِيَ لَهُ فِي أَعْلَاهَا» . رَوَاهُ التِّرْمِذِيُّ وَقَالَ: هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ. وَكَذَا فِي شَرْحِ السُّنَّةِ وَفِي الْمَصَابِيحِ قَالَ غَرِيبٌ
ব্যাখ্যাঃ মিথ্যা সর্বদাই পরিহারযোগ্য। সুতরাং এটাকে সাধারণভাবে নেয়াই উচিত। তবে ক্ষেত্রবিশেষ তার বৈধতা সার্বজনীন আলোচনার বিষয় নয়। হাদীসের বাণী, (وَهُوَ بَاطِلٌ) বাক্যটি শর্ত এবং জাযার মাঝে জুমলায়ে মু‘তারাযা বা বিছিন্ন বাক্য। এর মূল প্রতিপাদ্য কথা হলো তা (মিথ্যা) বাতিল। অথবা বাক্যটি জুমলায়ে হালিয়া হয়েছে অর্থাৎ হাল বা অবস্থা হলো এই যে, মিথ্যা বাতিল এতে কোন কল্যাণ নেই (মাত্র তিনটি ক্ষেত্র ব্যতীত)। এই হাল কর্তা এবং কর্ম বা فاعل কিংবা مَفْعُولٍ যে কোন বাক্যটি থেকে হতে পারে।
(ربض الْجنَّة) হলো জান্নাতের অভ্যন্তরের পার্শ্বস্থল। মিথ্যা পরিহারকারীর জন্য জান্নাতের পার্শদেশে বিশেষ একটি মহল তৈরি করা হবে। ‘আরবীতে المراء শব্দের অর্থ الجدال, ঝগড়ায় সর্বদা যে ন্যায় কথা বলা সত্ত্বেও ঝগড়া পরিহার করে চলে তার জন্য জান্নাতের মধ্যস্থলে একটি বিশেষ প্রাসাদ বা মহল তৈরি করে দেয়া হবে। চরিত্র সুন্দর করার অর্থ হলো মিথ্যা বলা থেকে, ঝগড়া থেকে এবং যাবতীয় খারাপ চারিত্রিক অসৎ গুণাবলী থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে সৎকর্ম দ্বারা স্বীয় চরিত্রকে সুন্দর করে সাজিয়ে তোলা, এর জন্য জান্নাতের উচ্চশৃঙ্গে একটি প্রাসাদ নির্মাণ করা হবে। এই উচ্চশৃঙ্গ ইন্দ্রীয়গ্রাহ্য কিংবা অর্থগত দিক থেকেও হতে পারে। এ হাদীস থেকে প্রমাণিত যে, চরিত্র মানুষের উপার্জিত তথা নিজ হাতে গড়া বস্তু, যদিও তাতে প্রকৃতি বা স্বভাবজাত প্রভাব রয়েছে। সহীহ হাদীসে এসেছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বদা দু‘আ করেছেন, اَللّٰهُمَّ حَسِّنْ خُلُقِي كَمَا حَسَّنْتَ خَلْقِي ‘‘হে আল্লাহ! তুমি আমার দেহ অবয়বকে যেভাবে সুন্দর করেছ অনুরূপভাবে আমার চরিত্রকেও সুন্দর করে দাও।’’
সহীহ মুসলিম-এর এক বর্ণনায় এভাবে দু‘আ এসেছে : اَللّٰهُمَّ اهْدِنِي لِأَحْسَنِ الْأَخْلَاقِ لَا يَهْدِي لِأَحْسَنِهَا إِلَّا أَنْتَ ‘‘হে আল্লাহ! আমাকে চরিত্র সুন্দর করার পথ দেখাও, চরিত্র সুন্দর করার পথ তুমি ছাড়া আর কেউই দেখাতে পারে না।’’
হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাযালী (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ المراء হলো মানুষের কথা এড়িয়ে চলা, এতে প্রকাশ্যে ত্রুটি থাক বা আভ্যন্তরীণ ত্রুটি থাক, শাব্দিক ত্রুটি থাক বা আত্মিক ত্রুটি থাক অথবা বক্তার ইচ্ছাগত ত্রুটিই থাক না কেন। তুমি যে কথাই শুনবে তা হয় হক হবে আর না হয় নাহক বা বাতিল। যদি হক হয় তাহলে তুমি তার সত্যায়ন কর আর যদি বাতিল হয় আর সেটা যদি দীন সংক্রান্ত না হয় তাহলে তা থেকে তুমি নিরবতা অবলম্বন কর। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ; তুহফাতুল আহ্ওয়াযী ৫ম খন্ড, হাঃ ১৯৯৩)
পরিচ্ছেদঃ ১০. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - জিহ্বার হিফাযাত, গীবত এবং গালমন্দ প্রসঙ্গে
৪৮৩২-[২১] আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা কি জানো, মানুষকে কোন্ জিনিস সবচেয়ে বেশি জান্নাতের প্রবেশ করাবে? সেটা হলো, আল্লাহভীতি ও উত্তম চরিত্র। তোমরা কি জানো, মানুষকে কোন্ জিনিস সবচেয়ে বেশি জাহান্নামে প্রবেশ করাবে? সেটা হলো, দু’টো গহ্বর; একটি মুখ, অপরটি জননেন্দ্রিয়। (তিরমিযী ও ইবনু মাজাহ)[1]
وعنن أَبِي
هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَتُدْرُونَ مَا أَكْثَرُ مَا يُدْخِلُ النَّاسَ الْجَنَّةَ؟ تَقْوَى اللَّهِ وَحُسْنُ الْخُلُقِ. أَتُدْرُونَ مَا أَكْثَرُ مَا يُدْخِلُ النَّاسَ النَّارَ؟ الْأَجْوَفَانِ: الْفَمُ وَالْفَرْجُ رَوَاهُ التِّرْمِذِيُّ وَابْنُ مَاجَهْ
ব্যাখ্যাঃ কোন্ জিনিস মানুষকে অধিক হারে জান্নাতে প্রবেশ করাবে? এর অর্থ হলো কোন্ বৈশিষ্ট্যগুলো মানুষকে সফলকামী মানুষের সাথে জান্নাতের অধিকারী করবে? রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই তার উত্তর দেন। জান্নাতে প্রবেশের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো : আল্লাহভীতি। আল্লাহভীতির ন্যূনতম পন্থা হলো উত্তম চিন্তা। দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো উত্তম চরিত্র বা উত্তম আচরণ। প্রতিটি সৃষ্টিজীবের সাথে উত্তম আচরণ করা। সৎ চরিত্র এবং উত্তম আচরণের ন্যূনতম পন্থা হলো তাদের কষ্ট দান থেকে বিরত থাকা, আর সর্বোচ্চ পর্যায় হলো যে কষ্ট দেয় তার সাথে ভালো আচরণ করা এবং তার প্রতি ইহসান করা।
এখানে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রশ্নাকারে কথা উপস্থাপনা করার উদ্দেশ্য হলো এ কথার প্রভাব যেন ভালোভাবে মানুষের হৃদয়ে বসে যায়।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনুরূপভাবেই প্রশ্নাকারে উত্থাপন করেছেন যে, কোন বস্তু মানুষকে অধিকহারে জাহান্নামে প্রবেশ করাবে। এখানেও রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই তার উত্তরে বলে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, দু’টি গহ্বর অর্থাৎ মানব দেহের দু‘টি গহবর যা মানুষকে অধিকারে জাহান্নামে প্রবেশ করাবে।
মানবদেহের এ গহ্বর দু’টি হলো মুখ এবং যৌনাঙ্গ। কেননা মানুষ অধিকাংশ সময় এ দু’টির কারণে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর নাফরমানীতে লিপ্ত হয়ে থাকে এবং তার পরিণামে সে জাহান্নামের অধিকারী হয়ে যায়।
‘আল্লামা ত্বীবী (تَقْوَى اللهِ) ‘আল্লাহভীতি’ এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেনঃ এ বাক্যটি আল্লাহর আদেশ পালনের মাধ্যমে এবং নিষিদ্ধ বস্তুসমূহ থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে আল্লাহর সাথে উত্তম মুআমলাহর দিকে ইশারা করছে। অনুরূপ (حُسْنُ الْخُلُقِ) ‘হুসনু খুলুক’ দ্বারা সকল সৃষ্টিজীবের প্রতি উত্তম আচরণের দিকে ইশারা করছে। এ দু’টি উত্তম বৈশিষ্ট্যই মানুষকে জান্নাতের অধিকারী করে থাকে। এর বিপরীতে জাহান্নাম। আল্লাহ তা‘আলা মুখ এবং যৌনাঙ্গকে তার মোকাবেলায় তৈরি করেছেন। জিহ্বাকে মুখের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। শারী‘আতের সকল নির্দেশিত কাজে তার হিফাযাত যেমন জরুরী তেমনি সকল হালাল খাদ্য খাওয়াও তাকওয়ার শীর্ষস্তর।
অনুরূপ যৌনাঙ্গের হিফাযাতও দ্বীনের সবচেয়ে বড় মর্যাদাপূর্ণ একটি স্তর। আল্লাহ মু’মিনদের নিদর্শন ও গুণাবলী বর্ণনা করতে গিয়ে বলেনঃ وَالَّذِينَ هُمْ لِفُرُوجِهِمْ حَافِظُونَ ‘‘আর যারা তাদের যৌনাঙ্গের হিফাযাতকারী’’- (সূরাহ্ আল মু’মিন ৪০ : ০৫)। শাহ্ওয়াত বা প্রবৃত্তির তাড়নার প্রাধান্যকালে যিনার সকল উপকরণ ও সুযোগ থাকা সত্ত্বেও নিজেকে বিরত রাখা সিদ্দীক্বীনদের দরজায় পৌঁছার শামিল। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ; তুহফাতুল আহ্ওয়াযী ৫ম খন্ড, হাঃ ২০০৪)
পরিচ্ছেদঃ ১০. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - জিহ্বার হিফাযাত, গীবত এবং গালমন্দ প্রসঙ্গে
৪৮৩৩-[২২] বিলাল ইবনু হারিস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মানুষ মুখ দিয়ে ভালো কথা বলে; কিন্তু সে এর মর্যাদা জানে না। আল্লাহ তা’আলা তার জন্য তাঁর সন্তুষ্টি লিপিবদ্ধ করেন, যাবৎ না সে আল্লাহ তা’আলার সাথে সাক্ষাৎ করে। অপরদিকে মানুষ মুখ দিয়ে মন্দ কথা বলে; কিন্তু সে জানে না তার পরিণাম কী। আল্লাহ তা’আলা এ কারণে তার ওপর নিজের ক্রোধ ও অসন্তুষ্টি লিপিবদ্ধ করতে থাকেন, যতক্ষণ না সে আল্লাহ তা’আলার সাথে সাক্ষাৎ করে। (শারহুস্ সুন্নাহ্)[1]
ইমাম মালিক, তিরমিযী ও ইবনু মাজাহ (রহিমাহুল্লাহ) অনুরূপ অর্থে বর্ণনা করেছেন।
وَعَن بلالِ
بن الحارثِ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «إِنَّ الرَّجُلَ لَيَتَكَلَّمُ بِالْكَلِمَةِ مِنَ الْخَيْرِ مَا يَعْلَمُ مَبْلَغَهَا يَكْتُبُ اللَّهُ لَهُ بِهَا رِضْوَانَهُ إِلَى يَوْمِ يَلْقَاهُ. وَإِنَّ الرَّجُلَ لَيَتَكَلَّمُ بِالْكَلِمَةِ مِنَ الشَّرِّ مَا يَعْلَمُ مَبْلَغَهَا يَكْتُبُ اللَّهُ بِهَا عَلَيْهِ سَخَطَهُ إِلَى يَوْمِ يَلْقَاهُ» . رَوَاهُ فِي شَرْحِ السُّنَّةِ
وَرَوَى مَالِكٌ وَالتِّرْمِذِيُّ وَابْن مَاجَه نَحوه
ব্যাখ্যাঃ অত্র হাদীসের ব্যাখ্যা অনেকাংশে ৪৮১৩ নং হাদীসের ব্যাখ্যানুরূপ। মানুষ অনেক সময় মুখে এমন কথা উচ্চারণ করে যা খুবই কল্যাণকর কথা এবং আল্লাহর কাছে অতীব পছন্দনীয় বাক্য। কিন্তু সে জানে না আল্লাহ তার ঐ কথার কি মূল্য ও মর্যাদা। উচ্চারণকারী তাকে ক্ষীণ বা ছোট করেই দেখেছে, কিন্তু আল্লাহর নিকট ঐ কথার সাওয়াব তার জন্য দীর্ঘায়িত করে দেন এবং আল্লাহর সাথে তার সাক্ষাত পর্যন্ত স্বীয় সন্তষ্টি তার জন্য অবধারিত করে নেন।
পক্ষান্তরে আল্লাহর অতীব অপছন্দনীয় এবং অসন্তুষ্টির কিছু কথা রয়েছে, যা তার বান্দা উচ্চারণ করে থাকে। উচ্চারণকারী সে নিজেও জানে না যে ঐ কথা আল্লাহর কত অপ্রিয় এবং অনিষ্টকর, ফলে কিয়ামত পর্যন্ত আল্লাহ তার ওপর অসন্তুষ্টির সিদ্ধান্ত লিখে নেন।
আল্লাহর সাথে সাক্ষাত পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলা তার প্রতি সন্তষ্টি লিখে নেন, এর অর্থ হলো আল্লাহ তা‘আলা তাকে নেক কাজের তাওফীক দান করেন, আর কল্যাণকর কাজে তিনি অগ্রণী হয়ে যান, ফলে তিনি জীবদ্দশায় প্রশংসনীয় জীবন পান এবং মৃত্যুর পর বারযাখী জীবনে কবরের ‘আযাব থেকে নিষ্কৃতি লাভ করে থাকেন। তার কবর হয়ে যায় প্রশস্ত এবং আরামদায়ক। তাকে বলা হয় তুমি নব দুলহার ন্যায় ঘুমাও, যাকে পরিবারের সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তি ছাড়া কেউ জাগাতে সাহস করে না। কিয়ামতের দিন সে নেককার সৌভাগ্যশীলদের সাথে উঠবে ফলে আল্লাহ তাকে তার ছায়ায় আশ্রয় দান করবেন। এরপর তাকে চিরস্থায়ী নি‘আমাতের ঘর জান্নাতে স্থান দিবেন, অতঃপর মহান আল্লাহর দীদারে তাকে ধন্য করবেন। এর বিপরীতটাও অনুরূপ, অর্থাৎ খারাপ কথার খারাপ প্রতিদান সে পাবে। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ; তুহফাতুল আহ্ওয়াযী ৬ষ্ঠ খন্ড, হাঃ ২৩১৯)
পরিচ্ছেদঃ ১০. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - জিহ্বার হিফাযাত, গীবত এবং গালমন্দ প্রসঙ্গে
৪৮৩৪-[২৩] বাহয ইবনু হাকীম (রহিমাহুল্লাহ) তাঁর পিতার মাধ্যমে তাঁর দাদা হতে বর্ণনা করেন, তিনি (দাদা) বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ধ্বংস তাদের জন্য, যারা কথা বলে আর জনতাকে হাসানোর জন্য মিথ্যা বলে। তার ওপর ধ্বংস, তার ওপর ধ্বংস। (আহমাদ, তিরমিযী, আবূ দাঊদ ও দারিমী)[1]
وَعَنْ بَهْزِ
بْنِ حَكِيمٍ عَنْ أَبِيهِ عَنْ جده قا ل: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «وَيْلٌ لِمَنْ يُحَدِّثُ فَيَكْذِبُ لِيُضْحِكَ بِهِ الْقَوْمَ وَيْلٌ لَهُ وَيْلٌ لَهُ» . رَوَاهُ أَحْمَدُ وَالتِّرْمِذِيُّ وَأَبُو دَاوُد والدارمي
ব্যাখ্যাঃ আরবীতে (وَيْلٌ) শব্দের অর্থ হলো هَلَاكٌ عَظِيمٌ মহাধ্বংস অথবা (وَيْلٌ) হলো وَادٍ عَمِيقٌ فِي جَهَنَّمَ জাহান্নামের ভিতরের গভীর একটি গর্ত।
মিথ্যা বলা সর্বাস্থায় নিষিদ্ধ, তা হাস্য রসিকতারচ্ছলে হলেও নিষিদ্ধ এবং পাপ। কেউ কাউকে হাসানোর জন্য মিথ্যা কথা বললেও তার পরিণতি কি? তাই অত্র হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। অবশ্য কথা সত্য হলে তা দ্বারা মানুষ হাসানো এই নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত নয় এবং সে এ ধ্বংসের অন্তর্ভুক্ত হবে না। যেমন আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন সময় তার স্ত্রীদের কারো ওপর রাগ করলে ‘উমার (রাঃ) তখন কোন হাসানো (সত্য কথা) বলে তাকে হাসাতেন। এ অবস্থা ঘটনাক্রমে হলে অথবা কখনো কখনো হলে তবে তা নিষিদ্ধ নয় কিন্তু হাস্যরসিকতা কেউ যদি পেশা বানিয়ে নেয় এবং সর্বদাই এতে লিপ্ত থাকে তাহলে তার জন্য হাদীসে বর্ণিত ধ্বংস অবধারিত।
(وَيْلٌ) শব্দটি একাধিকবার উল্লেখ করা হয়েছে তাকীদ হিসেবে অথবা প্রথমটি বারযাখ বা কবরের জীবনে, দ্বিতীয়টি হাশরে এবং তৃতীয়টি জাহান্নামে।
(মিরক্বাতুল মাফাতীহ; তুহফাতুল আহওয়াযী ৬ষ্ঠ খন্ড, হাঃ ২৩১৫; ‘আওনুল মা‘বূদ ৮ম খন্ড, হাঃ ৪৯৮২)
পরিচ্ছেদঃ ১০. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - জিহ্বার হিফাযাত, গীবত এবং গালমন্দ প্রসঙ্গে
৪৮৩৫-[২৪] আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ বান্দা একটি কথা বলে এজন্য যে, সে এটা দ্বারা লোক হাসাবে। সে এ কথার দরুন জাহান্নামের মধ্যে এত দূরে নিক্ষিপ্ত হবে যা আকাশমণ্ডলী ও জমিনের দূরত্বের সমান। বান্দার পা পিছলানোর তুলনায় মুখ পিছলানো ভয়ানক ক্ষতিকর। (বায়হাক্বী’র ’’শু’আবুল ঈমানে’’ বর্ণনা করেছেন।)[1]
وَعَنْ أَبِي
هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «إِنَّ الْعَبْدَ لَيَقُولُ الْكَلِمَةَ لَا يَقُولُهَا إِلَّا لِيُضْحِكَ بِهِ النَّاسَ يَهْوِي بِهَا أَبْعَدَ مَا بَيْنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ وَإِنَّهُ لَيَزِلُّ عَنْ لِسَانِهِ أَشَدَّ مِمَّا يَزِلُّ عَنْ قَدَمِهِ» . رَوَاهُ الْبَيْهَقِيُّ فِي شُعَبِ الْإِيمَانِ
(لم تتمّ دراسته)
ব্যাখ্যাঃ ‘‘বান্দা একটি কথা বলে’’ এ বাক্যে ‘কথা’ বলতে মিথ্যা কথা উদ্দেশ্য, অর্থাৎ মানুষকে হাসানোর জন্য মিথ্যা অথবা অশ্লীল কিংবা অনর্থক কথা বলে থাকে। এ কারণে সে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে এবং সে জাহান্নামের এত গভীর পতিত হবে যে, তার গভীরতা আকাশ পাতালের দূরত্বের সমান হবে। কেউ কেউ বলেছেন, এর অর্থ হলো ঐ মিথ্যা অথবা অনর্থক অশ্লীল হাসানো কথার কারণে সে আল্লাহর রহমত ও কল্যাণ থেকে আকাশমণ্ডলী এবং জমিনের দূরত্ব সমান দূরে সরে পড়বে।
মিথ্যা কথা বলা অথবা অন্য কোন গীবত পরনিন্দা ইত্যাদির ক্ষতি দৈহিক ক্ষতির চেয়ে অধিক ভয়ানক। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ; জামি‘উস সগীর হাঃ ২০৬১)
কবি বলেন, ‘‘তীর দ্বারা আঘাতের ক্ষত এক সময় শুকে যায় কিন্তু জিহ্বার ক্ষত কখনো শুকায় না।’’
পরিচ্ছেদঃ ১০. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - জিহ্বার হিফাযাত, গীবত এবং গালমন্দ প্রসঙ্গে
৪৮৩৬-[২৫] ’আবদুল্লাহ ইবনু ’আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি নিশ্চুপ রইল, সে মুক্তি পেলো। (আহমাদ, তিরমিযী, দারিমী ও বায়হাক্বী’র ’’শু’আবুল ঈমানে’’ বর্ণনা করেছেন)[1]
وَعَنْ عَبْدِ
اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسلم: «من صَمَتَ نَجَا» . رَوَاهُ أَحْمَدُ وَالتِّرْمِذِيُّ وَالدَّارِمِيُّ وَالْبَيْهَقِيُّ فِي شعب الْإِيمَان
ব্যাখ্যাঃ ‘‘যে বিরত থাকলো সে মুক্তি পেল’’ এর অর্থ হলো, যে অশ্লীল ও মিথ্যা কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকলো সে তার পাপ ও শাস্তি থেকে মুক্তি পেল।
ইমাম রাগিব ইস্পাহানী (রহিমাহুল্লাহ) [শব্দ বিজ্ঞানী] বলেনঃ الصَّمْتُ ‘চুপ থাকা’ শব্দটি السُّكُوتِ ‘চুপ থাকা’ বা নীরব থাকা শব্দ হতে অধিক পূর্ণতা প্রকাশকারী শব্দ। কেননা الصَّمْتُ শব্দটি বাকশক্তিসম্পন্ন সত্তা এবং বাকশক্তিহীন সত্ত্বা উভয়ের ক্ষেত্রেই ব্যবহার হয়ে থাকে, পক্ষান্তরে السُّكُوتِ শব্দটি কেবলমাত্র বাকশক্তি সম্পন্ন সত্তার ক্ষেত্রেই ব্যবহার হয়ে থাকে।
ইমাম গাযালী (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এ কথাটি مِنْ فَصْلِ الْخِطَابِ وَجَوَامِعِ الْكَلِمِ وَجَوَاهِرِ الْحِكَمِ এর অন্তর্ভুক্ত, কোন ব্যক্তিই এর অর্থ করে শেষ করতে পারবে না। বহুবিধ অর্থ সমৃদ্ধ বাক্যটির অর্থ অনুসন্ধানে সর্বকালের ‘আলিমগণই শ্রম সাধনা ব্যয় করে চলছেন।
মানুষের জিহ্বার স্খলনজনিত বিপদ অত্যন্ত বড় এবং তার অনিষ্টতা খুব বেশী। কেননা মিথ্যা, গীবত, অপবাদ, অশ্লীল কথা ইত্যাদি মুখ থেকে অবলীলাক্রমে অনায়াসেই বেড়িয়ে পড়ে এবং অন্তরও এতে অগ্রণী হয়, না এগুলোতে কোন বেগ পোহাতে হয় না। আর অন্তর তার একটি মিষ্টতাও অনুভব করে থাকে, অপরদিকে প্রবৃত্তি এবং শয়তানের সহযোগিতা থাকে পুরোদমে। সুতরাং কথা বলাই ঝুঁকিপূর্ণ এবং চুপ থাকাই নিরাপদ।
মানুষের প্রতিটি কথাই রেকর্ড করা হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
مَا يَلْفِظُ مِنْ قَوْلٍ إِلَّا لَدَيْهِ رَقِيبٌ عَتِيدٌ
‘‘মানুষ যে কোন কথাই বলুক না কেন, তা লিপিবদ্ধ করার জন্যে তৎপর প্রহরী (ফেরেশতা) তার নিকটই রয়েছে।’’ (সূরাহ্ কাফ ৫০ : ১৮)
এ আয়াত দ্বারা চুপ থাকার নির্দেশ পাওয়া যায়। মানুষের কথা চার প্রকার, তন্মধ্যে এক প্রকার কথায় শুধু ক্ষতিই বিদ্যমান। দ্বিতীয় এক প্রকারের মধ্যে রয়েছে উপকার, তৃতীয় প্রকার লাভ ক্ষতি মিলে আর চতুর্থ প্রকার যার মধ্যে কোন লাভও নেই কোন ক্ষতিও নেই। যে কথায় শুধু ক্ষতিই তা থেকে নীরব থাক আবশ্যক। অনুরূপ লাভন্ডক্ষতি উভয়টি যেখানে বিদ্যমান, সে কথা থেকেও নীরব থাকা আবশ্যক। আর যে কথায় কোন লাভন্ডক্ষতি কিছুই নেই, নিঃসন্দেহে তা অহেতুক বা বেহুদা কথা, তা বলা সময় অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়, সুতরাং তাও ক্ষতিকর। চতুর্থ আরেকটি প্রকার যাতেও রয়েছে ক্ষতির আশংকা। অতএব চুপ থাকা নিঃসন্দেহে নিরাপদ ও বাঁচার পথ।
মানুষের জিহ্বার অনিষ্টতা সীমাহীন, নিরবতাই তা থেকে মুক্তির একমাত্র পথ।
(মিরক্বাতুল মাফাতীহ; তুহফাতুল আহ্ওয়াযী ৬ষ্ঠ খন্ড, হাঃ ২৫০১)
পরিচ্ছেদঃ ১০. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - জিহ্বার হিফাযাত, গীবত এবং গালমন্দ প্রসঙ্গে
৪৮৩৭-[২৬] ’উকবাহ্ ইবনু ’আমির (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে সাক্ষাৎ করে জিজ্ঞেস করলামঃ (হে আল্লাহর রসূল!) মুক্তির উপায় কি? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ তুমি নিজের জিহ্বাকে আয়ত্তে রাখো, নিজের ঘরে পড়ে থাকো এবং নিজের পাপের জন্য ক্রন্দন করো। (আহমাদ ও তিরমিযী)[1]
وَعَن عُقْبةَ
بن عامرٍ قَالَ: لَقِيتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقُلْتُ: مَا النَّجَاةُ؟ فَقَالَ: «أَمْلِكْ عَلَيْكَ لِسَانَكَ وَلْيَسَعْكَ بَيْتُكَ وَابْكِ عَلَى خَطِيئَتِكَ» . رَوَاهُ أَحْمد وَالتِّرْمِذِيّ
ব্যাখ্যাঃ ‘‘লোকটি প্রশ্ন করেছিল, মুক্তি কিসে বা মুক্তির উপায় কি?’’ অর্থাৎ কোন কাজ করলে আল্লাহর ‘আযাব এবং অসন্তুষ্টি থেকে মুক্তির পাওয়া যাবে? রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তোমার জন্য যে কথায় কোন কল্যাণ নেই সে কথা থেকে বিরত থাক। তোমার জিহ্বার উপর তোমার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা কর।’
‘আল্লামা ত্বীবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জওয়াবটি ছিল একটি বিজ্ঞচিত রীতিতে। লোকটি প্রশ্ন করেছিল মুক্তির হাকীকাত সম্পর্কে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে মুক্তির কারণ বলে দিলেন। কেননা পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এটাই ছিল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে আরো বললেন, তোমার ঘরকে তোমার জন্য প্রশস্ত কর। এর অর্থ হলো তুমি তোমার ঘরেই অবস্থান কর। প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হয়ো না এবং সর্বদা ঘরে অবস্থানে বিরক্ত হয়ো না, বরং এটাকে নিজের জন্য গনীমাত মনে কর। কেননা সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক নানা অনিষ্টতা এবং ফিৎনাহ্ থেকে মুক্তি বা বেঁচে থাকার এটাই প্রকৃষ্ট পন্থা। বলা হয়ে থাকে ‘‘নীরব থাকার জন্য ঘরের প্রকোষ্ঠে অবস্থান আবশ্যক।’’
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকটিকে অতীতের গুনাহের জন্য অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে কান্না-কাটি করে ক্ষমা প্রার্থনার পরামর্শ দিলেন। ‘আল্লামা ত্বীবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ ‘কান্না’ শব্দের মধ্যে রয়েছে লজ্জিত হওয়া এবং অনুশোচনা প্রকাশ করা। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ; তুহফাতুল আহওয়াযী ৬ষ্ঠ খন্ড, হাঃ ২৪০৬)
পরিচ্ছেদঃ ১০. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - জিহ্বার হিফাযাত, গীবত এবং গালমন্দ প্রসঙ্গে
৪৮৩৮-[২৭] আবূ সাঈদ (রাঃ) রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উক্তি বলে বর্ণনা করেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আদম সন্তান সকালে ঘুম থেকে উঠলে, তার সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জিহ্বার কাছে অনুনয়-বিনয় করে বলে, আমাদের ব্যাপারে তুমি আল্লাহকে ভয় করো। কেননা আমরা তোমার সাথে জড়িত। তুমি ঠিক থাকলে আমরাও ঠিক থাকব, আর তুমি বাঁকা পথ অনুসরণ করলে আমরাও বাঁকা পথ অনুসরণ করব। (তিরমিযী)[1]
وَعَن أبي
سعيدٍ رَفَعَهُ قَالَ: إِذَا أَصْبَحَ ابْنُ آدَمَ فَإِنَّ الْأَعْضَاءَكُلَّهَا تُكَفِّرُ اللِّسَانَ فَتَقُولُ: اتَّقِ اللَّهَ فِينَا فَإنَّا نَحْنُ بِكَ فَإِنِ اسْتَقَمْتَ اسْتَقَمْنَا وَإِنِ اعْوَجَجْتَ اعوَججْنا . رَوَاهُ التِّرْمِذِيّ
ব্যাখ্যাঃ সকাল বা প্রভাতকাল হলো সফলতার দরজার চাবি। মানুষের জিহ্বার (ভাষার) আপদ হলো সমাজের সাথে মেলামেশা, লেনদেন সংক্রান্ত কথাবার্তা, আর এই কার্যক্রম শুরু হয় সকাল তথা প্রভাতকাল থেকেই কাজের মধ্যে ইচ্ছা-অনিচ্ছা নানাভাবেই তা থেকে অনুষ্ঠিত হয় মিথ্যা, প্রতারণা, গীবত, অশ্লীল কথা-বার্তা ইত্যাদি। যা তাকে প্রকৃত মুত্তাক্বী হওয়াতে বাধা প্রদান করে থাকে।
মানুষের শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিনয়ের সাথে অনুগত হয়ে জিহ্বার কাছে জিজ্ঞেস করে (বলে), ওহে জিহ্বা! আমাদের হক বিষয়ে তুমি আল্লাহকে ভয় কর, আমরা তো তোমার অনুগত-অনুগামী এবং তোমার সাথে সংশ্লিষ্ট। তুমি যদি সঠিক পথে চল তাহলে আমরা সঠিক পথে চলতে পারব, আর তুমি যদি হাকের উপর অটল-অবিচল থাকতে না পার এবং বক্রপথে চল তাহলে আমরাও হাকের উপর থাকতে সক্ষম হব না বরং বক্র পথে পরিচালিত হব।
অত্র হাদীস দ্বারা বুঝা যায় যে, মানুষের মুখ নিয়ন্ত্রণ থাকলেই সকল পাপ থেকে বাঁচা যায়। কিন্তু অন্য আরেকটি প্রসিদ্ধ হাদীসে রয়েছে, ‘মানব দেহে’ একটি গোশত টুকরা আছে যদি সেটি ভালো থাকে তাহলে সারা দেহই ভালো থাকে আর যদি সেটি নষ্ট হয়ে যায় তাহলে সারা দেহই নষ্ট হয়ে যায়, সেটি হলো কাল্ব (অন্তর)।’
এ দুই হাদীসের বাহ্যিক বিরোধের প্রেক্ষিতে ‘আল্লামা ত্বীবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ জিহ্বা হলো কাল্ব বা অন্তরের মুখপত্র এবং বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের প্রতিনিধি।
অর্থাৎ মানুষের কাল্বই তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ভালো-মন্দের মূল উৎস। জিহ্বা বা ভাষা হলো তার ঘোষক বা প্রকাশক মাত্র। তার দিকে এ সম্পর্ক রূপকার্থে করা হয়েছে।
(মিরক্বাতুল মাফাতীহ; তুহফাতুল আহ্ওয়াযী ৬ষ্ঠ খন্ড, হাঃ ২৪০৭)
পরিচ্ছেদঃ ১০. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - জিহ্বার হিফাযাত, গীবত এবং গালমন্দ প্রসঙ্গে
৪৮৩৯-[২৮] ’আলী ইবনু হুসায়ন (রহঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কোন ব্যক্তির ইসলামের সৌন্দর্য এই যে, সে অনর্থক কথা ও কাজ পরিত্যাগ করবে। (মালিক ও আহমাদ)[1]
وَعَنْ
عَلِيِّ بْنِ الْحُسَيْنِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مِنْ حُسْنِ إِسْلَامِ الْمَرْءِ تَرْكُهُ مَا لَا يَعْنِيهِ» . رَوَاهُ مَالك وَأحمد
ব্যাখ্যাঃ একজন মুসলিমের ঈমান এবং ইসলামের পরিপূর্ণ সৌন্দর্যের সামগ্রিক রূপ হলো- সকল প্রকার অনর্থক অহেতুক কথাবার্তা এবং কর্ম বর্জন করা। সে আল্লাহর সকল নির্দেশের কাছে আত্মসমর্পণ করবে এবং তার উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে। অনুরূপ সে সকল নিষেধাজ্ঞা থেকে সর্বদার জন্য দূরে থাকবে। হাদীসে উল্লেখিত تَرْكُهٗ مَا لَا يَعْنِيهِ এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ‘আল্লামা গাযালী (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ যেক্ষেত্রে তুমি নীরব থাকলে তোমার জীবন এবং সম্পদের কোন ক্ষতি হয় না, সেগুলোও বর্জন করে চলা। যেমন তুমি কোন বৈঠকে তোমার কোন সফরের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে তোমার দেখা নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, খানা-পিনা এবং দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বিদ্বানদের নানা ঘটনা প্রবাহ বর্ণনা করছ। তুমি যখন এগুলো বর্ণনা করবে তখন তাতে থাকবে অতিরঞ্জন, বাড়াবাড়ী, গীবত-নিন্দা ইত্যাদি।
সর্বোপরি ঐ সময়টুকু তুমি তো আল্লাহর জিকর থেকে বিরত থাকলে, যা ছিল তোমার জন্য কল্যাণকর।
হাদীসে উল্লেখ আছে, জান্নাতীগণ দুনিয়ায় আল্লাহর জিকরবিহীন যে সময় কাটিয়েছে তার জন্য যেরূপ আফসোস করবে এরূপ আফসোস আর অন্য কিছুর জন্যই করবে না। সুতরাং কোন কথা না বলে চুপ থাকাই নিরাপদ। এটা ঈমানের হিফাযাত এবং তাকওয়া। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ; তুহফাতুল আহ্ওয়াযী ৬ষ্ঠ খন্ড, হাঃ ২৩১৭)
পরিচ্ছেদঃ ১০. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - জিহ্বার হিফাযাত, গীবত এবং গালমন্দ প্রসঙ্গে
৪৮৪০-[২৯] ইমাম ইবনু মাজাহ (রহিমাহুল্লাহ) আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন।
وَرَوَاهُ
ابْن مَاجَه عَن أبي هُرَيْرَة
পরিচ্ছেদঃ ১০. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - জিহ্বার হিফাযাত, গীবত এবং গালমন্দ প্রসঙ্গে
৪৮৪১-[৩০] আর তিরমিযী ও ’বায়হাক্বী’র শু’আবুল ঈমানে ’আলী (রাঃ) ও আবূ হুরায়রা (রাঃ) উভয় হতে বর্ণনা করেন। (মালিক ও আহমাদ)
وَالتِّرْمِذِيّ
وَالْبَيْهَقِيّ فِي «شعب الْإِيمَان» عَنْهُمَا
পরিচ্ছেদঃ ১০. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - জিহ্বার হিফাযাত, গীবত এবং গালমন্দ প্রসঙ্গে
৪৮৪২-[৩১] আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) এর মধ্য থেকে একজন ইন্তিকাল করেন। তখন জনৈক ব্যক্তি বলল : ’’তুমি জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ করো’’। এটা শুনে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তুমি এ কথা বলছ, অথচ তুমি প্রকৃত ঘটনা জানো না। এমনও হতে পারে যে, সে (মৃত ব্যক্তি) নিরর্থক কথাবার্তা বলেছে অথবা এমন বিষয়ে কার্পণ্য করেছে, যাতে তাঁর কিছু কমে যেত না। (তিরমিযী)[1]
وَعَن أنسٍ
قَالَ: تُوُفِّيَ رَجُلٌ مِنَ الصَّحَابَةِ. فَقَالَ رَجُلٌ: أَبْشِرْ بِالْجَنَّةِ. فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «أوَ لَا تَدْرِي فَلَعَلَّهُ تَكَلَّمَ فِيمَا لَا يَعْنِيهِ أَوْ بخل بِمَا لَا ينقصهُ» . رَوَاهُ التِّرْمِذِيّ
ব্যাখ্যাঃ (تُوُفِّىَ رَجُلٌ مِنَ الصَّحَابَةِ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবীদের মধ্য থেকে জনৈক ব্যক্তি মারা গেলেন। (فَقَالَ رَجُلٌ) তখন এক ব্যক্তি মৃত ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে বললেন। (أَبْشِرْ بِالْجَنَّةِ) তুমি জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ কর। এ মর্মে আল্লাহ বলেনঃ وَأَبْشِرُوا بِالْجَنَّةِ الَّتِي كُنْتُمْ تُوعَدُونَ ‘‘...তোমরা ঐ জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ কর যার প্রতিশ্রুতি তোমাদেরকে দেয়া হয়েছিল’’- (সূরাহ্ ফুস্সিলাত ৪১ : ৩০)।
(তুহফাতুল আহ্ওয়াযী ৬ষ্ঠ খন্ড, হাঃ ২৩১৬)
(فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أوَ لَا تَدْرِي) ‘‘তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তুমি তাকে সুসংবাদ দিচ্ছ কিন্তু তুমি জান না অথবা তুমি এ বিষয়ে কি বলছ তা জান না।’’ এ কথা বলার অর্থ হচ্ছে : তুমি কিভাবে তা জানতে পারলে? অথবা তুমি কিভাবে তা জানলে যা অন্য কেউ জানে না? (فَلَعَلَّهٗ تَكَلَّمَ فِيمَا لَا يَعْنِيهِ) সম্ভবত সে অনর্থক কথা বলেছে, যা তার উপকারে আসবে না, বরং ক্ষতি করবে।
(أَوْ بَخِلَ بِمَا لَا يَنْقُصُه) অথবা সে আর্থিক ‘ইবাদাতের ক্ষেত্রে যা ব্যয় করার দরকার ছিল তাতে কৃপণতা করেছে অথবা ‘ইলমী মাসআলার ক্ষেত্রে অথবা নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস ধার কর্জ দেয়ার ক্ষেত্রে কৃপণতা করেছে যা করা তার জন্য উচিত ছিল না। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ ১০. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - জিহ্বার হিফাযাত, গীবত এবং গালমন্দ প্রসঙ্গে
৪৮৪৩-[৩২] সুফ্ইয়ান ইবনু ’আবদুল্লাহ আস্ সাকাফী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন আমি জিজ্ঞেস করলামঃ হে আল্লাহর রসূল! যে জিনিসগুলো আপনি আমার জন্য ভয়ের বস্তু বলে মনে করেন, তন্মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর কোন্ জিনিসটি? রাবী বলেন, এ কথা শুনে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিজের জিহবা ধরে বললেনঃ ’’এটা’’! [তিরমিযী; আর ইমাম তিরমিযী (রহিমাহুল্লাহ) হাদীসটি সহীহ বলে উল্লেখ করেছেন।][1]
وَعَن
سُفْيَان بن عبد الله الثَّقَفِيّ قَالَ: قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللَّهِ مَا أَخْوَفُ مَا تَخَافُ عَلَيَّ؟ قَالَ: فَأَخَذَ بِلِسَانِ نَفْسِهِ وَقَالَ: «هَذَا» . رَوَاهُ التِّرْمِذِيّ وَصَححهُ
ব্যাখ্যাঃ (مَا أَخْوَفُ مَا تَخَافُ عَلَيَّ؟) ‘‘আপনি কোন্ বিষয়ে আমার ওপর সবচেয়ে বেশি আশঙ্কা করেন?’’ সুফ্ইয়ান বলেনঃ তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার জিহ্বা ধরে বললেন, এটা। অর্থাৎ এটা তোমার জন্য আমি বেশী আশঙ্কা করি। কারণ এ অঙ্গটাই শরীরের সবচেয়ে বেশী কাজ সংঘটিত করে তথা পাপ-পুণ্য সকল ক্ষেত্রেই তার অবদান রয়েছে। যে তার জিহ্বার লাগাম টেনে না ধরে ঢিল দিয়ে রাখে তখন শয়তান তাকে নিয়ে সকল ক্ষেত্রে বিচরণ করে এবং তাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেয়। আর এর অনিষ্টতা থেকে সেই রক্ষা পাবে যে শারী‘আতের লাগাম শক্ত করে ধারণ করবে।
মোটকথা জিহ্বার ভালো মন্দ তার কর্মের উপর নির্ভর করে। ঠিক করে কোন একটির উপর বেশী গুরুত্বারোপ করা কঠিন তবে আল্লাহ যার ভালো কাজ করার তাওফীক দেন তার জন্য ভালো কাজ করা সহজ। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ ১০. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - জিহ্বার হিফাযাত, গীবত এবং গালমন্দ প্রসঙ্গে
৪৮৪৪-[৩৩] ’আবদুল্লাহ ইবনু ’উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যখন বান্দা মিথ্যা বলে, তখন মালাক (ফেরেশতা) মিথ্যার দুর্গন্ধে এক ক্রোশ দূরে চলে যান। (তিরমিযী)[1]
হাদীসটি য‘ঈফ হওয়ার কারণ, এর সনদে ‘‘আবদুর রহীম ইবনু হারূন আল গস্সানী’’ নামের বর্ণনাকারী খুবই য‘ঈফ। আর ‘আবদুল ‘আযীয ইবনু আবী রও্ওয়াদ (رواد) নামের বর্ণনাকারীও মুনকার, হাদীস বর্ণনাকারী য‘ঈফ। দেখুন- য‘ঈফাহ্ ১৮২৮। আল মু‘জামুল আওসাত্ব ৭৩৯৮, আল মু‘জামুল সগীর ৮৫৩, ‘ত্ববারানী’র আল মু‘জামুল কাবীর ৫৭৮, য‘ঈফুল জামি‘ ৬৮০, য‘ঈফ আত্ তারগীব ওয়াত্ তারহীব ১৭৫৮।
وَعَنِ ابْنِ
عُمَرَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «إِذَا كَذَبَ الْعَبْدُ تَبَاعَدَ عَنْهُ الْمَلَكُ مِيلًا مِنْ نَتْنِ مَا جاءَ بِهِ» . رَوَاهُ التِّرْمِذِيّ
ব্যাখ্যাঃ (إِذَا كَذَبَ الْعَبْدُ تَبَاعَدَ عَنْهُ الْمَلَكُ) যখন বান্দা মিথ্যা কথা বলে তখন তার সঙ্গে থাকা সংরক্ষণকারী মালাক ১ মাইল দূরে চলে যায়। (مِيلًا) মাইল হলো, এক ফারসাখের তৃতীয়াংশ অথবা জমিনের নির্ধারিত কিছু অংশ অথবা দৃষ্টিসীমা পরিমাণ অংশ।
(مِنْ نَتْنِ مَا جاءَ بِه) সে মিথ্যা নিয়ে এসেছে তার দুর্গন্ধের কারণে। نَتْنِ হলো فوح এর বিপরীত যার অর্থ সুগন্ধির বিপরীত। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ ১০. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - জিহ্বার হিফাযাত, গীবত এবং গালমন্দ প্রসঙ্গে
৪৮৪৫-[৩৪] সুফ্ইয়ান ইবনু উসায়দ আল হাযরামী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেনঃ সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতা হলো তুমি তোমার কোন মুসলিম ভাইকে কোন কথা বললে এবং সে ওটাকে সত্য বলে জানল। অথচ প্রকৃতপক্ষ তুমি তার সাথে মিথ্যা বলেছ। (আবূ দাঊদ)[1]
হাদীসটি য‘ঈফ হওয়ার কারণ, ‘‘যবারাহ্ (ضبارة) ইবনু মালিক আল হাযরামী’’ নামের বর্ণনাকারী মাজহূল। আর বাক্বিয়্যাহ্ ইবনু ওয়ালীদ একজন মুদাল্লিস রাবী। সে ‘আন দ্বারা হাদীস বর্ণনা করেছে। বিস্তারিত দেখুন- সিলসিলাতুয্ য‘ঈফাহ্ ১২৫১।
وَعَن سُفيان
بن أسدٍ الحضرميِّ قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: «كَبُرَتْ خِيَانَةً أَنْ تُحَدِّثَ أَخَاكَ حَدِيثًا هُوَ لَكَ بِهِ مُصَدِّقٌ وَأَنْتَ بِهِ كاذبٌ» . رَوَاهُ أَبُو دَاوُد
ব্যাখ্যাঃ (كَبُرَتْ خِيَانَةً أَنْ تُحَدِّثَ أَخَاكَ) বড় খিয়ানাত বা বিশ্বাসঘাতকতা হলো তুমি তোমার কোন মুসলিম ভাইকে এমন কথা বলবে। (هُوَ لَكَ بِه مُصَدِّقٌ وَأَنْتَ بِه كاذبٌ) যে কথায় সে তোমার প্রতি নির্ভর করবে এবং তোমার কথাকে বিশ্বাস করবে এবং ধারণা করবে, তুমি মুসলিম হিসেবে মিথ্যা বলতে পার না, ফলে সে তোমার কথায় বিশ্বাস করে অথচ তুমি সে বিষয়ে মিথ্যাবাদী। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ ১০. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - জিহ্বার হিফাযাত, গীবত এবং গালমন্দ প্রসঙ্গে
৪৮৪৬-[৩৫] ’আম্মার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি দুনিয়ায় দ্বিমুখী হবে, কিয়ামতের দিন তার মুখে আগুনের জিহ্বা হবে। (দারিমী)[1]
وَعَن عمار
قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَنْ كَانَ ذَا وَجْهَيْنِ فِي الدُّنْيَا كَانَ لَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ لِسَانَانِ مِنْ نَارٍ» . رَوَاهُ الدَّارمِيّ
ব্যাখ্যাঃ (مَنْ كَانَ ذَا وَجْهَيْنِ فِي الدُّنْيَا كَانَ لَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ لِسَانَانِ مِنْ نَارٍ) যারা দুনিয়াতে ফিতনার উদ্দেশে দ্বিমুখী আচরণ করে। একদলের কাছে গিয়ে এক কথা বলে এবং অন্যদলের কাছে গিয়ে অন্য কথা বলে। কিয়ামতের দিন তার আগুনের দু’টি জিহ্বা থাকবে, কেননা সে দুনিয়াতে প্রত্যেক দলের কাছে আলাদা জিহ্বা ব্যবহার করত। (‘আওনুল মা‘বূদ ৮ম খন্ড, হাঃ ৪৮৬৫)
মিরক্বাতুল মাফাতীহ গ্রন্থকার বলেনঃ হাদীসটির মর্মার্থ এরূপ, যে নিজেকে কোন ব্যক্তির সামনে তার শুভাকাঙক্ষী এবং ভালোবাসার দাবীদার হবে অথচ তার পশ্চাতে তার দোষ-ত্রুটি বলে বেড়াবে।
অথবা, যার দু’জন শত্রু রয়েছে এবং প্রত্যেকের নিকট বন্ধু সাজে ফলে প্রত্যেকে মনে করে সে তাদের বন্ধু অথচ সে একজনের দোষ অন্যের কাছে গিয়ে লাগায়। কিয়ামতের দিন তার আগুনের দু’টি জিহ্বা হবে।
(মিরক্বাতুল মাফাতীহ ‘কিতাবুল আদাব’)
পরিচ্ছেদঃ ১০. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - জিহ্বার হিফাযাত, গীবত এবং গালমন্দ প্রসঙ্গে
৪৮৪৭-[৩৬] ’আবদুল্লাহ ইবনু মাস্’ঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ একজন পূর্ণ মু’মিন তিরস্কার ও অভিসম্পাতকারী এবং অশ্লীল গালমন্দকারী ও অহঙ্কারী হতে পারে না। (তিরমিযী ও বায়হাক্বী’র ’’শু’আবুল ঈমানে’’ বর্ণনা করেছেন।)[1]
وَعَنِ ابْنِ مَسْعُودٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَيْسَ الْمُؤْمِنُ بِالطَّعَّانِ وَلَا بِاللَّعَّانِ وَلَا الْفَاحِشِ وَلَا الْبَذِيءِ» . رَوَاهُ التِّرْمِذِيُّ وَالْبَيْهَقِيُّ فِي «شُعَبِ الْإِيمَانِ» . وَفِي أُخْرَى لَهُ «وَلَا الْفَاحِشِ الْبَذِيءِ» . وَقَالَ التِّرْمِذِيُّ: هَذَا حَدِيث غَرِيب
ব্যাখ্যাঃ (لَيْسَ الْمُؤْمِنُ بِالطَّعَّانِ) কোন পরিপূর্ণ মু’মিন মানুষের দোষ-ত্রুটি উল্লেখ করে কাউকে আঘাত করতে পারে না। (وَلَا بِاللَّعَّانِ) এবং লা‘নাত বা অভিসম্পাতকারী হতে পারে না। (وَلَا الْفَاحِشِ) এবং অশ্লীলভাষী। (وَلَا الْبَذِيءِ) এবং অহঙ্কারী হতে পারে না। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ ১০. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - জিহ্বার হিফাযাত, গীবত এবং গালমন্দ প্রসঙ্গে
৪৮৪৮-[৩৭] ’আবদুল্লাহ ইবনু ’উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ একজন পরিপূর্ণ মু’মিন অধিক অভিসম্পাতকারী হতে পারে না। অপর এক বর্ণনায় আছে, একজন মু’মিনের পক্ষ খুব অভিসম্পাতকারী হওয়া সমীচীন নয়। (তিরমিযী)[1]
وَعَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَا يَكُونُ الْمُؤْمِنُ لعانا» . وَفِي رِوَايَة: «لاينبغي لِلْمُؤمنِ أَن يكون لعانا» . رَوَاهُ التِّرْمِذِيّ
ব্যাখ্যাঃ (لَا يَكُونُ الْمُؤْمِنُ لعانا) কোন মু’মিন তথা পরিপূর্ণ ঈমানদার ব্যক্তি অধিক অভিসম্পাতকারী হতে পারে না যদিও সে কখনো অভিসম্পাত করে থাকে। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, কোন ঈমানদার ব্যক্তির অধিক অভিসম্পাতকারী হওয়া উচিত নয়। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
তুহফাতুল আহ্ওয়াযী গ্রন্থকার বলেনঃ لعانا অর্থ হচ্ছে অধিক অভিসম্পাতকারী আর লা‘নাত অর্থ হচ্ছে আল্লাহর রহমত থেকে দূরে সরে যাওয়ার জন্য দু‘আ করা। শব্দটিকে মুবালাগার শব্দ দ্বারা ব্যবহার করা হয়েছে। কেননা মু’মিন ব্যক্তি কদাচিৎ কাউকে লা‘নাত করে ফেলতে পারে।
(তুহফাতুল আহ্ওয়াযী ৫ম খন্ড, হাঃ ২০১৯)
পরিচ্ছেদঃ ১০. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - জিহ্বার হিফাযাত, গীবত এবং গালমন্দ প্রসঙ্গে
৪৮৪৯-[৩৮] সামুরাহ্ ইবনু জুনদুব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা একে অপরকে ’’তোমার ওপর আল্লাহর অভিসম্পাত হোক’’, ’’আল্লাহর গজব হোক’’ বলে অভিশাপ দেবে না এবং জাহান্নামে প্রবেশের বদ্দু’আও করবে না।
অপর এক বর্ণনায় جَهَنَّمَ-এর শব্দের স্থলে اَلنَّارْ (তথা ’জাহান্নাম’ শব্দটি) উল্লেখ রয়েছে। (তিরমিযী ও আবূ দাঊদ)[1]
وَعَن سَمُرَةَ بْنِ جُنْدُبٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَا تَلَاعَنُوا بِلَعْنَةِ اللَّهِ وَلَا بِغَضَبِ اللَّهِ وَلَا بِجَهَنَّمَ» . وَفِي رِوَايَةٍ «وَلَا بِالنَّارِ» . رَوَاهُ التِّرْمِذِيّ وَأَبُو دَاوُد
ব্যাখ্যাঃ (لَا تَلَاعَنُوا بِلَعْنَةِ اللهِ) কেউ যেন কাউকে লা‘নাত বা অভিশাপ না দেয়। নির্দিষ্ট করে কোন মুসলিম ব্যক্তিকে এ কথা না বলে عَلَيْكَ لَعْنَةُ اللهِ তোমার ওপর আল্লাহর লা‘নাত বা অভিশাপ বর্ষিত হোক।
(وَلَا بِغَضَبِ اللهِ) এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে গজবের দু‘আ না করে। যেমন এ কথা বলে غَضِبَ اللهُ عَلَيْكَ তোমার প্রতি আল্লাহর ক্রোধ নেমে আসুক।
(وَلَا بِالنَّارِ) এবং কাউকে জাহান্নামের আগুনের জন্য দু‘আ করবে না। যেমন- এ কথা বলা : أَدْخَلَكَ اللهُ النَّارَ আল্লাহ তোমাকে জাহান্নামে প্রবেশ করান। এ বিধান নির্দিষ্ট করে কোন ব্যক্তির জন্য প্রযোজ্য, কেননা অনির্দিষ্ট করে কোন সম্প্রদায়ের জন্য লা‘নাত জায়িয, যেমন এ কথা বলা যে, لَعْنَةُ اللهِ عَلَى الْكَافِرِينَ ‘‘কাফিরদের ওপর আল্লাহর লা‘নাত’’ অথবা নির্দিষ্ট করে, যেমন- لَعْنَةُ اللهِ عَلَى الْيَهُودِ ইয়াহূদীকে প্রতি আল্লাহর লা‘নাত অথবা কুফরী অবস্থায় মৃত্যুবরণকারী কোন কাফিরের প্রতি লা‘নাত যেমন- আবূ জাহল। (‘আওনুল মা‘বূদ ৮ম খন্ড, হাঃ ৪৮৯৮)
পরিচ্ছেদঃ ১০. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - জিহ্বার হিফাযাত, গীবত এবং গালমন্দ প্রসঙ্গে
৪৮৫০-[৩৯] আবুদ্ দারদা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ যখন বান্দা কোন বস্তুকে অভিসম্পাত করে, তখন এ অভিসম্পাত আকাশের দিকে উঠে যায়। আর এ অভিসম্পাতের জন্য আকাশের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। অতঃপর ঐ অভিসম্পাত জমিনের দিকে প্রত্যাবর্তন করে। তার জন্য জমিনের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। অতঃপর ডানদিক-বামদিকে যায় এবং যখন সেখানেও কোন রাস্তা না পায়, শেষ পর্যন্ত সে ব্যক্তি বা বস্তুর দিকে প্রত্যাবর্তন করে, যাকে অভিসম্পাত করা হয়েছে। যদি সে অভিসম্পাতের উপযুক্ত হয়, তবে তার ওপর আপতিত হয়। তা না হলে অভিসম্পাতকারীর দিকেই ফিরে আসে। (আবূ দাঊদ)[1]
وَعَنْ أَبِي الدَّرْدَاءِ قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: «إِنَّ الْعَبْدَ إِذَا لَعَنَ شَيْئًا صَعِدَتِ اللَّعْنَةُ إِلَى السَّمَاءِ فَتُغْلَقُ أَبْوَابُ السَّمَاءِ دُونَهَا ثُمَّ تَهْبِطُ إِلَى الْأَرْضِ فَتُغْلَقُ أَبْوَابُهَا دُونَهَا ثُمَّ تَأْخُذُ يَمِينًا وَشِمَالًا فَإِذَا لَمْ تَجِدْ مَسَاغًا رَجَعَتْ إِلَى الَّذِي لُعِنَ فَإِنْ كَانَت لِذَلِكَ أَهْلًا وَإِلَّا رَجَعَتْ إِلَى قَائِلِهَا» . رَوَاهُ أَبُو دَاوُد
ব্যাখ্যাঃ (إِنَّ الْعَبْدَ إِذَا لَعَنَ شَيْئًا صَعِدَتِ اللَّعْنَةُ إِلَى السَّمَاءِ) বান্দা যখন কাউকে লা‘নাত করে তখন উক্ত লা‘নাত শরীরের আকৃতি ধারণ করে ঊর্ধ্বাকাশে আরোহণ করে তখন তার সামনের দিকের আকাশের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। অতঃপর সে নীচের দিকে নেমে আসে, তখন লা‘নাত প্রকাশের স্থান থেকে পৃথিবীর সমস্ত স্তরের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়, ফলে সে আসমান ও জমিনের মাঝখানে ডানে বামে ঘুরতে থাকে। যখন সে যাওয়ার কোন রাস্তা খুঁজে না পায় তখন তার দিকে ফিরে আসে যাকে লা‘নাত করেছিল। যদি সে উক্ত লা‘নাতের উপযুক্ত হয় তাহলে তা তার সাথে যুক্ত হয় এবং বাস্তবায়িত হয়। অন্যথায় তার বক্তার দিকে ফিরে যায়, কেননা সেই তার উপযুক্ত এবং তার অধিকারী। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)