পরিচ্ছেদঃ ১১. প্রথম অনুচ্ছেদ - ইহরাম অবস্থায় যা থেকে বেঁচে থাকতে হবে
২৬৭৮-[১] ’আব্দুল্লাহ ইবনু ’উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। জনৈক লোক রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে এসে জিজ্ঞেস করলো, মুহরিম কোন্ ধরনের পোশাক পরবে? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, জামা, পাগড়ি, পাজামা, টুপী, মোজা পরবে না। তবে যে লোকের জুতা নেই সে মোজা পরতে পারবে কিন্তু পায়ের গোড়ালির নিচ হতে মোজাদ্বয়কে কেটে দিবে। এমন কোন কাপড়ও পরবে না যাতে জা’ফারানের ও ওয়ার্স-এর রং রয়েছে। (বুখারী, মুসলিম; বুখারীর এক বর্ণনায় আরো একটু বেশি আছে- মুহরিম নারী বোরকা পরবে না, হাত মোজাও পরবে না।)[1]
بَابُ مَا يَجْتَنِبُهُ الْمُحْرِمُ
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ: أَنَّ رَجُلًا سَأَلَ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَا يلبس مِنَ الثِّيَابِ؟ فَقَالَ: «لَا تَلْبَسُوا الْقُمُصَ وَلَا الْعَمَائِمَ وَلَا السَّرَاوِيلَاتِ وَلَا الْبَرَانِسَ وَلَا الْخِفَافَ إِلَّا أَحَدٌ لَا يَجِدُ نَعْلَيْنِ فَيَلْبَسُ خُفَّيْنِ وليقطعهما أَسْفَل الْكَعْبَيْنِ وَلَا تَلْبَسُوا مِنَ الثِّيَابِ شَيْئًا مَسَّهُ زَعْفَرَانٌ وَلَا وَرْسٌ» . مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ وَزَادَ الْبُخَارِيُّ فِي رِوَايَةٍ: «وَلَا تَنْتَقِبُ الْمَرْأَةُ الْمُحْرِمَةُ وَلَا تلبس القفازين»
ব্যাখ্যা: (عَنْ عَبْدِ اللّٰهِ بْنِ عُمَرَ: أَنَّ رَجُلًا) হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেন, কোন সনদেই এ লোকটির নাম খুঁজে পাইনি।
(سَأَلَ رَسُوْلَ اللّٰهِ ﷺ: مَا يَلْبِسُ) এখানে ما টি হরফে ইসতিফহাম তথা প্রশ্নবোধক অব্যয় অথবা মায়ে মাওসূলাহ্ অথবা سأل ক্রিয়ার দ্বিতীয় (مفعول) কর্ম- এই তিন পদ্ধতির প্রয়োগ হতে পারে। আর لبس এ শব্দটি যখন سَمِعَ يَسْمَعُ বাব থেকে ব্যবহৃত হয় তখন এর অর্থ পরিধান করা আর যদি (ضَرَبَ يَضْرِبُ) থেকে আসে তাহলে সন্দেহ, সংমিশ্রণ ঘটা এ ধরনের অর্থ হয়।
(الْمُحْرِمُ) হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেন, সমস্ত ‘আলিম এ ব্যাপারে একমত যে, এখানে المحرم দ্বারা পুরুষই উদ্দেশ্য মহিলা এখানে অন্তর্ভুক্ত হবে না। ‘আল্লামা ইবনুল মুনযির (রহঃ) বলেন, হজ্জের ক্ষেত্রে পুরুষ মহিলার কাপড় একই হবে শুধুমাত্র জা‘ফারান ও ওয়ারস্ মিশ্রিত কাপড়ের ক্ষেত্রে একটু পার্থক্য থাকে।
(مِنَ الثِّيَابِ) এখানে বলা হচ্ছে কোন্ প্রকার কাপড় পরবে? এ কথা আর মুসনাদে আহমাদ (২য় খণ্ড পৃষ্ঠা ৫৪) ‘উবায়দুল্লাহর সনদে এবং পৃষ্ঠা ৬৫ টি তে আইয়ূব থেকে, তবে দু’টি সানাদই মিলেছে নাফি‘-এর নিকট গিয়ে। আর এ বর্ণনাটি থেকে বুঝা যায় এ প্রশ্ন তিনি ইহরাম বাঁধার পূর্বেই করেছিলেন। ইমাম বায়হাক্বী (রহঃ)-এর বর্ণনায় ‘আবদুল্লাহ বিন ‘আওন তিনি নাফি' থেকে, তিনি ইবনু ‘উমার থেকে এ সূত্রে বর্ণিত হাদীসে আছে, ইবনু ‘উমার (রাঃ) বলেন, ‘‘মদীনার মসজিদের কোন এক দরজায় দাঁড়িয়ে একটি লোক বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! ما يلبس المحرم؟ তথা মুহরিম কি কি কাপড় পরিধান করবেন? বায়হাক্বী (রহঃ)-এর অন্য বর্ণনায় আইয়ূব, তিনি নাফি' থেকে, তিনি ইবনু ‘উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে نادى رجل رسول الله صلى الله عليه وسلم তথা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুৎবা দিচ্ছিলেন এই স্থানে তথা মসজিদে নাবাবীর সম্মুখভাগে দাঁড়িয়ে। সুতরাং এ বর্ণনা থেকে বুঝা যায় প্রশ্নটি তিনি করেছিলেন মদীনায়।
আর রাবীর কথা (ما يلبس المحرم من الثياب) এটাই এ ক্ষেত্রে প্রসিদ্ধ বর্ণনা যা বর্ণিত হয়েছে নাফি‘ ইবনু ‘উমার -এর সূত্রে এবং এটাকে আবূ ‘আওয়ানাহ্ ইবনু জুরায়জ-এর সূত্রে নাফি‘ থেকে যে শব্দে বর্ণনা করেছেন তা হলো (ما يترك المحرم) তথা মুহরিম কি কি কাপড় পরিধান থেকে বিরত থাকবেন। তবে ইমাম ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) বর্ণনাটি শায বলেছেন।
এ ক্ষেত্রে মতবিরোধ মূলত ইবনু জুরায়জকে নিয়ে নাফি'-কে নিয়ে নয়।
(لَا تَلْبَسُوا) বুখারী (রহঃ)-এর অন্য বর্ণনায় لا يلبس শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এ উত্তরটি এ বিষয়ে বর্ণিত দু’ধরনের প্রশ্নের একটির সাথে সামঞ্জস্য হয় সে প্রশ্নটি হলো, ما يترك المحرم অথবা ما يجتنبى المحرم؟ তবে অধিকাংশ এবং সর্বাধিক সহীহ বর্ণনায় যে প্রশ্নটি এসেছে তা হলো (ما يلبس المحرم؟) তথা মুহরিম কি কি পরিধান করবে? আর এ প্রশ্নের উত্তর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দিয়েছেন পরিধানে নিষিদ্ধ বিষয়সমূহ উল্লেখ করে, অর্থাৎ- এখানে প্রশ্ন হয়েছে কি কি পরিধান করবে উত্তরও সে অনুপাতে এটা পরবে ওটা পরবে এমন হওয়া দরকার ছিল কিন্তু তা না হয়ে হয়েছে এমন যে শুধু বলা হয়েছে সেগুলোর নাম যা পরিধান নিষেধ। এর রহস্য পরিধান বর্ণনা করতে গিয়ে ‘উলামায়ে কিরাম বলেন, মুহরিমের জন্য নিষিদ্ধ বিষয়ের সংখ্যা কমগুলো উল্লেখ করে বেশিগুলোকে জায়িয বলা হয়েছে। কারণ, যেগুলো নিষিদ্ধ তা ব্যতীত অন্যান্যগুলো বৈধ।
আর যদি বৈধগুলোর নাম উল্লেখ করা হতো তখন কথা বেশি হতো। এখান থেকে আরো বুঝা যায় যে, প্রশ্নকর্তা প্রশ্ন ঠিক মতো করতে পারেননি। কারণ তার উচিত ছিল নিষিদ্ধগুলো সম্পর্কে প্রশ্ন করা। অলংকার শাস্ত্রের কিছু বিদ্বান এ ধরনের প্রশ্নে এ ধরনের উত্তরকে اسلوب الحكيم বলে আখ্যা দিয়েছেন। এ জাতীয় ব্যবহার কুরআনে কারীমেও লক্ষ্য করা যায় যেমন, মহান আল্লাহ বলেন,
يَسْأَلُونَكَ مَاذَا يُنْفِقُوْنَ قُلْ مَا أَنْفَقْتُمْ مِنْ خَيْرٍ فَلِلْوَالِدَيْنِ
অর্থাৎ- ‘‘তারা তোমাকে জিজ্ঞেস করে তারা কি খরচ করবে তুমি বলে দাও যা খরচ করবে তা পিতা-মাতার জন্য।’’ (সূরা আল বাক্বারাহ্ ২ : ২১৫)
অত্র আয়াতে জিজ্ঞেস করা হয়েছে খরচের বিষয়বস্ত্ত সম্পর্কে আর উত্তর দেয়া হয়েছে খরচের স্থান সম্পর্কে। কেননা, এখানে প্রশ্নকর্তাকে বুঝানো হচ্ছে খরচের বিষয়বস্ত্তর চেয়ে খরচের স্থান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা বেশি প্রয়োজন ছিল।
(الْقُمُصَ) এটা এক ধরনের কাপড় যা বর্ম হিসেবে পরিচিত। ইবনুল হুমাম তার ফাতহুল কাদীরের ‘‘খরচ’’ অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন ‘‘درع’’ তথা বর্ম ও قمص (জামা) প্রায় একই বিষয়, কেবল পার্থক্য হলো জামার ক্ষেত্রে কাঁধের নিকট আর বর্মের ক্ষেত্রে বক্ষের নিকট পকেট লাগানো থাকে। অত্র হাদীস قميص তথা জামা এবং পরবর্তী سروايلات তথা পায়জামার কথা উল্লেখ করে মূলত এ ধরনের সব পোশাক যা শরীরকে বেষ্টন করে রাখে অথবা যা সেলাই করা যেমনঃ জুব্বা, জামা, আলখেল্লা, ট্রাউজার ও হাতমোজা থেকে নিষেধ করা হয়েছে।
‘আল্লামা ইমাম নাবাবী (রহঃ) বলেন,
قال العلماء : الحكمة فى تحريم اللباس المذكور فى الحديث على المحرم ولباسة الازار والرداء ان يبعد عن الترفه ويتصف بصفة الخاشع الذليل..........الخ
অর্থাৎ- ‘উলামায়ে কিরাম বলেন, হাদীসে উল্লেখিত পোশাকগুলো হারাম করে মুহরিমের জন্য শুধুমাত্র লুঙ্গী ও চাদর পরিধানের কথার রহস্য হলো যাতে করে মুহরিম আনন্দ থেকে নিজেকে গুটিয়ে রেখে ভয়ভীতি সহকারে আল্লাহকে স্মরণ করে বেশি বেশি যিকরে লিপ্ত থাকতে পারে, মৃত্যুর কথা স্মরণ করতে পারে কাফনের কাপড়ের কথা এবং কাল ক্বিয়ামতের দিন খালি গাঁয়ে খালি পায়ে আল্লাহর দরবারে হাজির হতে হবে- এ কথা স্মরণ করতে পারে। অপরদিকে সুগন্ধি ও স্ত্রী ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞার কারণ হলো, যাতে করে সে দুনিয়াবী চাকচিক্য পরিত্যাগ করতে পারে আর যেহেতু সুগন্ধি ব্যবহারে স্ত্রী সহবাসের চাহিদা জাগে যা হাজীদের জন্য নিষেধ। সুতরাং ঐ মুহূর্তটিতে কেবলই পরকালের চিন্তাই যেন করতে পারে, তাই উল্লেখিত বিষয়গুলো মুহরিমের জন্য হারাম করা হয়েছে।
পরিচ্ছেদঃ ১১. প্রথম অনুচ্ছেদ - ইহরাম অবস্থায় যা থেকে বেঁচে থাকতে হবে
২৬৭৯-[২] ’আব্দুল্লাহ ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে এক বক্তৃতায় বলতে শুনেছি, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ মুহরিম যদি জুতা না পায় তবে মোজা পরতে পারবে এবং সেলাইবিহীন লুঙ্গি না পায় তবে পাজামা পরতে পারবে। (বুখারী, মুসলিম)[1]
بَابُ مَا يَجْتَنِبُهُ الْمُحْرِمُ
وَعَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَخْطُبُ وَهُوَ يَقُولُ: «إِذَا لَمْ يَجِدِ الْمُحْرِمُ نَعْلَيْنِ لَبَسَ خُفَّيْنِ وَإِذَا لَمْ يَجِدْ إِزَارًا لَبَسَ سَرَاوِيل»
ব্যাখ্যা: (إِذَا لَمْ يَجِدِ الْمُحْرِمُ نَعْلَيْنِ لَبِسَ خُفَّيْنِ) অর্থাৎ- মুহরিম যদি দু’ জুতা না পায় বা পরতে না পারে তাহলে অধিকাংশ ‘উলামার মত হচ্ছে তিনি দু’টি মোজা পায়ের তলদেশ থেকে ছেড়ে তা ব্যবহার করবেন তবে ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল বলেছেন ভিন্ন কথা।
(وَإِذَا لَمْ يَجِدْ إِزَارًا لَبَسَ سَرَاوِيْلَ) অর্থাৎ- যখন লুঙ্গি পাবে না তখন পায়জামা পরবে। এখান থেকে বুঝা যায় লুঙ্গি না পাওয়া গেলে পায়জামা পরা বৈধ এবং সেক্ষেত্রে কোন ফিদিয়া দেয়া আবশ্যক হবে না। এটাই মত দিয়েছেন ইমাম আহমাদ ও ইমাম শাফি‘ঈ (রহঃ), তবে ইমাম আবূ হানীফা বলেছেন পায়জামা সাধারণতই তথা সব সময়েই নিষেধ আর এ ধরনের বক্তব্য ইমাম মালিক (রহঃ)-এরও। তার এরূপ বক্তব্য দেয়ার কারণ সম্ভবত তার নিকট ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত হাদীসটি পৌছায়নি। যেমনঃ তার প্রমাণ মুয়াত্ত্বায় পাওয়া যায়, ইমাম মালিক-কে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘‘মুহরিম যখন লুঙ্গি না পাবে তখন পায়জামা পরবে’’ নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিল এমনটা উল্লেখ করেছেন- এ ব্যাপারে আপনার মতামত কি? তখন তিনি বলেছিলেন,
لم اسمع بهذا ولا ارى ان يلبس المحرم سروايل لأن رسول الله ﷺ نهى
অর্থাৎ- আমি এমন কথা শুনিনি আর আমি মনে করি না যে, মুহরিম পায়জামা পরতে পারেন কারণ এ ব্যাপারে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিষেধ আছে। যে হাদীসটি ইবনু ‘উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত। সুতরাং যদি লুঙ্গি না পাওয়া গেলে পায়জামা পরার বিধান থাকতো তাহলে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা জানিয়ে দিতেন।
ইমাম ইবনু ‘আবদুল বার (রহঃ) বলেন, ‘আত্বা বিন আবী রিবাহ, শাফি‘ঈ ও তার ছাত্ররা, সাওরী, আহমাদ বিন হাম্বল, ইসহাক বিন রহ্ওয়াহি, আবূ সাওর ও দাঊদ সবাই বলেছেন, اذا لم يجد المحرم ازارا لبس السروايل ولا شيئ عليه অর্থাৎ- মুহরিম যদি লুঙ্গি না পায় তাহলে পায়জামা পরবে এতে তার কোন ফিদিয়া দিতে হবে না। আর ইমাম নাবাবী (রহঃ) বলেছেন- এটাই জমহূর ‘উলামায়ে কিরামের ফাতাওয়া।
পরিচ্ছেদঃ ১১. প্রথম অনুচ্ছেদ - ইহরাম অবস্থায় যা থেকে বেঁচে থাকতে হবে
২৬৮০-[৩] ইয়া’লা ইবনু উমাইয়্যাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা জি’রানাহ্ নামক স্থানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে ছিলাম। তখন তাঁর নিকট একজন বেদুঈন আসলো। তার পরনে ছিল জুব্বা আর শরীরে ছিল সুগন্ধি ছিটানো। সে বললো, হে আল্লাহর রসূল! আমি ’উমরা করার জন্য ইহরাম বেঁধেছি আর আমার গায়ে এসব আছে। তার কথা শুনে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তোমার শরীরে যে সুগন্ধি রয়েছে তা তিনবার করে ধুয়ে ফেলো, আর জুব্বা খুলে ফেলো। অতঃপর হজে যা কর ’উমরাতেও তাই কর। (বুখারী, মুসলিম)[1]
بَابُ مَا يَجْتَنِبُهُ الْمُحْرِمُ
وَعَنْ يَعْلَى بْنِ أُمَيَّةَ قَالَ: كُنَّا عِنْدَ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بالجعرانة إِذْ جَاءَ رَجُلٌ أَعْرَابِيٌّ عَلَيْهِ جُبَّةٌ وَهُوَ مُتَضَمِّخٌ بِالْخَلُوقِ فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنِّي أَحْرَمْتُ بِالْعُمْرَةِ وَهَذِهِ عَلَيَّ. فَقَالَ: «أَمَا الطِّيبُ الَّذِي بِكَ فَاغْسِلْهُ ثَلَاثَ مَرَّاتٍ وَأَمَّا الْجُبَّةُ فَانْزِعْهَا ثُمَّ اصْنَعْ فِي عُمْرَتِكَ كَمَا تَصْنَعُ فِي حَجِّكَ»
ব্যাখ্যা: (يَعْلَى بْنِ أُمَيَّةَ) তার পূর্ণ নাম ইয়া‘লা বিন উমাইয়্যাহ্ বিন আবী ‘উবায়দুল্লাহ বিন হাম্মাম আত্ তামীমী, তিনি ছিলেন কুরায়শ মিত্র ইয়া‘লা বিন মুনাইয়্যাহ্ নামে পরিচিত। মুনাইয়্যাহ্ তার মাতা আবার কেউ কেউ বলেছেন তার পিতার মাতা- দাদী। তার উপনাম আবূ খালফ, আবার কেউ কেউ বলেছেন আবূ খালিদ, আবার কেউ বলেছেন আবূ সাফওয়ান। মক্কা বিজয়কালে ইসলাম গ্রহণ করেন তিনি একাধারে ত্বয়িফ হুনায়ন, তাবূক যুদ্ধে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে অংশগ্রহণ করেন। তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও ‘উমার থেকে হাদীস বর্ণনা করেন আবার তার নিকট থেকে তার ছেলেরা সফ্ওয়ান মুহাম্মাদ ‘উসমান ও অন্যান্যরা হাদীস বর্ণনা করেন। আবূ বাকর (রাঃ) তাকে রিদ্দার সময় কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেন, অতঃপর ‘উমার (রাঃ)-এর সময় তিনি ইয়ামানের কিছু অংশে নিয়োগ পান এবং নিজের জন্য একটি ভূখণ্ড দখল করে নিলে তাকে বরখাস্ত করা হয়। অতঃপর ‘উসমান (রাঃ)-এর সময় ইয়ামানের সান্‘আতে কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান। ‘উসমান (রাঃ)-এর শাহাদাতের বছর হজ্জ/হজ করেন। উষ্ট্রের যুদ্ধে ‘আয়িশাহ্ (রাঃ)-এর পক্ষে যুদ্ধ করেন, অতঃপর সিফফীনের যুদ্ধে ‘আলী (রাঃ)-এর পক্ষে যুদ্ধে অংশ নেন। তিনি ছিলেন দানশীল। তার বর্ণিত হাদীস সংখ্যা ১৯টি, হিজরী ৪৩ সনে তিনি মারা যান।
(كُنَّا عِنْدَ النَّبِىِّ ﷺ بِالْجِعِرَّانَةِ) অর্থাৎ- ‘উমরা করার মুহূর্তে ৮ম জিরীতে মক্কা বিজয়ের পরে যুলকাদা মাসে এ ‘উমরার নাম হলো ‘উমরাতুল জি‘রানাহ্। আর জি‘রানাহ্ ত্বায়িফ ও মক্কার মাঝে অবস্থিত একটি স্থানের নাম, এটা মক্কার বেশ নিকটে অবস্থিত। এ শব্দটি উচ্চারণের ক্ষেত্রে দু’টি প্রসিদ্ধ উচ্চারণ লক্ষ্য করা যায় প্রথমটি ‘আয়ন-কে সাকিন দিয়ে جعرانة আর দ্বিতীয়টি হলো ‘‘আয়ন’’-কে যের এবং ‘‘রা’’-কে তাশদীদ দিয়ে جعرانة পড়া। তবে প্রথম কিরাআতটিই বেশি প্রচলিত এবং বেশি শুদ্ধ।
ইমাম শাফি‘ঈসহ অধিকাংশ ভাষাবিদ দু’ভাবেই উচ্চারণ করেন। ইবনুল আসীর (রহঃ) বলেন, এ স্থানটি মক্কার নিকটবর্তী এবং হিল্ল-এ অবস্থিত এবং ইহরামের মিকাতের স্থান। ‘আল্লামা মুল্লা ‘আলী কারী হানাফী (রহঃ) ‘উমরার ইহরাম বেঁধেছেন। ইহরাম বাঁধার স্থান হিসেবে ‘‘তান্‘ঈম’’ নামক স্থানের চেয়ে এ স্থানটি বেশি ভাল- এ কথাই বলেছেন ইমাম শাফি‘ঈ (রহঃ)। ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ) বলেছেন, ‘‘তান্‘ঈম’’ই ইহরাম বাঁধার জন্য উত্তম। কারণ তান্‘ঈম থেকে ইহরাম বাঁধার বিষয় নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বক্তব্যমূলক হাদীস রয়েছে আর নিয়ম হলো নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বক্তব্যমূলক হাদীস এবং কর্মমূলক হাদীস যখন বিরোধপূর্ণ হবে তখন বক্তব্যমূলক হাদীস প্রাধান্য পাবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘আয়িশাহ্ (রাঃ) তান্‘ঈম থেকে ইহরাম বাঁধতে বলেছেন।
(إِذْ جَاءَ رَجُلٌ أَعْرَابِىٌّ) শব্দটিকে اعراب-এর দিকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এরা হলো যারা গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করে। এদেরকে বেদুঈন বলা হয়।
হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেন, আমি এ লোকটির নাম সম্পর্কে অবগত হতে পারিনি। তবে ফাতহুল বারীর মুক্বদ্দামাতে বলা হয়েছে বস্ত্ততঃ এ লোকটি স্বয়ং এ হাদীসের বর্ণনাকারী ইয়া‘লা বিন উমাইয়্যাহ্ নিজেই। যেমনটি বর্ণনা করেছেন ইমাম তাহাবী শু‘বাহ্ থেকে, শু‘বাহ্ কাতাদা থেকে, কাতাদা ‘আত্বা থেকে, বর্ণনাটি হলো- নিশ্চয়ই একজন লোক যার নাম ইয়া‘লা বিন উমাইয়্যাহ্ ইহরাম বাঁধলেন জুব্বা গায়ে দিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জুব্বা খুলে ফেলতে বললেন। তবে তিনি যে কেন তার নাম অস্পষ্ট রেখেছেন সে ব্যাপারে আল্লাই ভাল জানেন।
(كَمَا تَصْنَعُ فِىْ حَجِّكَ) ‘আল্লামা বাজী (রহঃ) বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথা প্রমাণ করে যে, তিনি জানতেন প্রশ্নকারী হজ্জের কৃতকলাপ সম্পর্কে অবহিত। কেননা যদি তিনি না জেনে থাকেন তাহলে এ ধরনের কথা বলা সঠিক হতো না।
‘আল্লামা বাজী (রহঃ) আরো বলেন, ‘উলামাগণ নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এ কথা নিয়ে মতবিরোধ করেছেন, ইবনুল ‘আরাবী (রহঃ) বলেন, জাহিলী যুগে তারা হজ্জের ইহরামের সময় কাপড় খুলে রাখতো এবং সুগন্ধি বর্জন করতো ঠিক তবে হজ্জের ক্ষেত্রে এ কাজে শিথিলতা প্রদর্শন করতো। তাই এ হাদীসের মাধ্যমে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বুঝিয়ে দিলেন হজ্জ/হজ ও ‘উমরার মধ্যে পার্থক্য করা ঠিক নয়।
পরিচ্ছেদঃ ১১. প্রথম অনুচ্ছেদ - ইহরাম অবস্থায় যা থেকে বেঁচে থাকতে হবে
২৬৮১-[৪] ’উসমান (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ইহরাম অবস্থায় বিয়ে করবে না, বিয়ে দেবে না এবং বিয়ের প্রস্তাবও দিবে না। (মুসলিম)[1]
بَابُ مَا يَجْتَنِبُهُ الْمُحْرِمُ
وَعَنْ عُثْمَانَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَا يَنْكِحُ الْمُحْرِمُ وَلَا يُنكِحُ وَلَا يَخْطُبُ» . رَوَاهُ مُسلم
ব্যাখ্যা: অত্র হাদীসটি প্রমাণ করছে মুহরিমের জন্য বিবাহ করা বা অপর কাউকে বিবাহ দিয়ে দেয়া কোনটাই বৈধ নয়- এটাই অধিকাংশ ‘আলিমের মতামত। ইমাম নাবাবী (রহঃ) তার শারহুল মুহাযযাবে অধিকাংশ সাহাবী, তাবি‘ঈ ও তাবি তাবি‘ঈ-এর মতামতও এটা বলেছেন। তিনি আরো বলেছেন এ মতামত ‘উমার বিন খাত্ত্বাব, ‘উসমান, ‘আলী, যায়দ বিন সাবিত, ইবনু ‘উমার, সা‘ঈদ বিন মুসাইয়্যিব, সুলায়মান বিন ইয়াসার, যুহরী, মালিক, আহমাদ, শাফি‘ঈ, ইসহাক, দাঊদসহ আরো অনেকের।
মুসলিমের ব্যাখ্যায় ইমাম নাবাবী (রহঃ) বলেছেনঃ ইমাম মালিক, শাফি‘ঈ ও ইমাম আহমাদ (রহঃ) বলেছেন, (لا يصح نكاح المحرم) অর্থাৎ- মুহরিমের বিবাহ বৈধ হবে না। কিন্তু ইমাম আবূ হানীফা, হাকাম বিন ‘উতায়বাহ্, সুফিয়ান সাওরী, ইব্রাহীম নাখ্‘ঈ, ‘আত্বা, হাম্মাদ বিন আবী সুলায়মান, ‘ইকরামাহ্, মাসরুকসহ অনেকে বলেছেন মুহরিমের বিবাহ বৈধ। আর কেউ কেউ বলেছেন, এটা ইবনু ‘আব্বাস, ইবনু মাস্‘ঊদ, আনাস ও মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ)-এরও উক্তি। আর এ দিকেই ঝুকে গিয়েছেন ইমাম বুখারী (রহঃ), কেননা তিনি ‘‘মানাসিক’’ অধ্যায়ে বাব রচনা করেছেন, (باب تزويبج المحرم) এবং ‘‘নিকাহ’’ অধ্যায়ে (باب نكاح المحرم)-এর মাধ্যমে অধ্যায় রচনা করেছেন। হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেন, ইমাম বুখারীর এই বাব তথা অধ্যায় রচনা দেখেই অনুমান করা যায় যে, তিনি মুহরিমের বিবাহ বৈধের মতাবলম্বী ছিলেন।
প্রথম মতের প্রবক্তাদের দলীল হলো, ‘উসমান ও ইবনু ‘উমার (রাঃ)-এর বর্ণিত হাদীস, নিশ্চয়ই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ (لا ينكح المحرم ولا ينكح ولا يخطب ولا يخطب عليه) অর্থাৎ- মুহরিম বিবাহ করতে পারবে না কাউকে বিবাহ দিতেও পারবে না। অনুরূপ বিবাহের পয়গাম পাঠাতেও পারবে না এবং তাকেও কেউ বিবাহের পয়গাম দিতে পারবে না।
দ্বিতীয় মতের প্রবক্তাদের দলীল দিয়েছে, ইবনু ‘আব্বাস -এর বর্ণিত হাদীসের মাধ্যমে। কেননা সেখানে স্পষ্ট রয়েছে, (ان رسول الله ﷺ تزوج منمونة وهو محرم) অর্থাৎ- নিশ্চয়ই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মায়মূনাহ্-কে বিবাহ করেছেন মুহরিম অবস্থায়। আর মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘‘নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মাঝে উত্তম আদর্শ নিহিত রয়েছে।’’ (সূরা আল আহযাব ৩৩ : ২১)
জেনে রাখা প্রয়োজন যে, হাদীসে উল্লেখিত لا ينكح ولا ينكح এ দু’টি শব্দই হারামের জন্য এসেছে। সকলের ঐকমত্যে তবে لا يخطب বিবাহের পয়গামও পাঠানো যাবে না, এটিকে তাহরীমের ফায়দা দিবে নাকি নাহিয়ে তানযীহী তথা মাকরূহের ফায়দা দিবে- এ নিয়ে ‘উলামায়ে কিরামের মাঝে মতবিরোধ আছে। তিন ইমামের নিকট তা মাকরূহে ফায়দা দিবে ইমাম আবূ হানীফার ও তাই মত। কিন্তু আমাদের কথা হলো উপরোক্ত সবগুলো সিগাহতে যে নাহীর শব্দ আছে তা তাহরীমের ফায়দা দিবে। সুতরাং মুহরিমের জন্য যেমন কোন মহিলাকে বিবাহের পয়গাম পাঠানো হারাম অনুরূপ মুহরিমা নারীর জন্য অপর কোন পুরুষকে বিবাহের পয়গাম পাঠানো হারাম। তাই বিবাহের হারাম আর বিবাহের পয়গাম পাঠানোর হারাম একই হুকুমের অন্তর্ভুক্ত হবে। যেহেতু সিগাহ একই। সুতরাং যদি কেউ একটিকে হারাম আর অপরটিকে মাকরূহ বলে তাহলে তার দলীল লাগবে, কিন্তু দলীল নেই। কোন কোন শাফি‘ঈ মতাবলম্বী আবার কুরআনের আয়াতের মাধ্যমে বিবাহের পয়গাম পাঠানোকে হারাম না বলে মাকরূহ বলতে চান আর তা হলো, মহান আল্লাহ তা‘আলার বাণী,
كُلُوْا مِنْ ثَمَرِهٖ إِذَا أَثْمَرَ وَاٰتُوْا حَقَّهٗ يَوْمَ حَصَادِه
অর্থাৎ- ‘‘গাছগুলো ফল দিলে তোমরা খাও এবং যাকাত দাও।’’ (সূরা আল আন্‘আম ৬ : ১৪১)
তার অর্থ এখানে মা‘তুফ আর মা‘তুফ ‘আলায়হির হুকুম ভিন্ন হচ্ছে, কারণ খাওয়া ওয়াজিব নয় কিন্তু যাকাত ওয়াজিব তাই এখানেও বিবাহ করা হারাম হতে পারে কিন্তু পয়গাম পাঠানো হারাম হবে না কারণ মা‘তুফ ও মা‘তুফ আলায়হির হুকুম ভিন্ন ভিন্নও হতে পারে। শাফি‘ঈ মতাবলম্বীদের এ গবেষণার কোন মূল্য নেই বরং আমরা সুন্নাহকেই আকড়ে ধরবো।
ইহরাম অবস্থায় বিবাহ বৈধ কিনা- এ বিষয়ে মতবিরোধ থাকলেও বিবাহ না করার মতই অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত। এদিকে যারা বিবাহ বৈধ বলেন তারা বিভিন্নভাবে উত্তর দেয়ার প্রয়াস পান। যেমনঃ
১. তারা বলেন, ইবনু ‘আব্বাস-এর হাদীসটি বেশি সহীহ এবং শক্তিশালী কারণ সেটা বুখারী ও মুসলিমের বর্ণনা। অপরদিকে ‘উসমান (রাঃ)-এর হাদীসটি ইমাম মুসলিমের একার বর্ণনা, তাই এখানে ইবনু ‘আব্বাস-এর বর্ণিত হাদীসটি অগ্রাধিকার পাবে।
এদের উত্তরে আমরা বলি, ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ)-এর হাদীস হলো নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কর্মগত হাদীস আর উসমান (রাঃ)-এর হাদীস নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বক্তব্যমূলক হাদীস, আর আমরা জানি কর্মমূলক হাদীস আর বক্তব্যমূলক হাদীস বিরোধপূর্ণ হলে বক্তব্যমূলকটি প্রাধান্য পায়, তাই এখানে ‘উসমান (রাঃ)-এর হাদীসটি প্রাধান্য পাবে। যদিও সানাদগত ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ)-এর হাদীস শক্তিশালী।
হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেন, ‘উসমান -এর হাদীসটি প্রাধান্য পাবে কারণ সেটা একটি মৌলিক নিয়মের কথা বলছে আর ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ)-এর হাদীস একটি নির্দিষ্ট ঘটনা যা অনেকগুলো বিষয়ের সম্ভাবনা রাখে।
২. তারা বলে থাকেন, ‘উসমান -এর হাদীসে নিকাহ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো وطأ الزوجة তথা স্ত্রী সহবাস যা ইহরাম অবস্থায় সকলের ঐকমত্যে হারাম। এখানে নিকাহ দ্বারা ‘আক্বদ উদ্দেশ্য নয়। এর উত্তরে আমরা বলবো, আপনাদের কথাটি ঠিক নয়। ঠিক না হওয়ার প্রথম কারণ হলো সরাসরি ঐ হাদীস দু’টি ইঙ্গিত যা প্রমাণ করছে এখানে নিকাহ দ্বারা عقد النكاح তথা বিবাহের বন্ধনই উদ্দেশ্য وطأ তথা স্ত্রী সহবাস উদ্দেশ্য নয়।
১নং ইঙ্গিতঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কথা لا ينكح ই দলীল যে এখানে নিকাহ দ্বারা বিবাহ উদ্দেশ্য وطأ তথা স্ত্রী সহবাস উদ্দেশ্য নয়, কারণ ওলী যখন বিবাহ করিয়ে দিবে তার পরে তা স্বামী স্ত্রী সহবাস চাইবে। কিন্তু এখানে তো ওলীর বিবাহ করিয়ে দেয়াকেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
২য় ইঙ্গিতঃ لا يخطب বিবাহের পয়গাম দিবে না- এ শব্দটিই প্রমাণ করছে পূর্বোক্ত নিকাহ শব্দের অর্থ মূলত عقد النكاح তথা বিবাহের বন্ধন وطأ তথা সহবাস নয়।
আর দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে আবান বিন ‘উসমান তথা হাদীসের বর্ণনাকারীই তার অর্থ সম্পর্কে অধিক জ্ঞাত আর সেই আবান বিন ‘উসমানই لا ينكح-এর অর্থ لا يزوج করেছেন এবং এটা অথবা আরো ভালোভাবে জানতে পারি এ হাদীসের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জানি আর তা হলো ‘উমার বিন ‘উবায়দুল্লাহর ছেলে তলহা বিন ‘উমার যখন শায়বাহ্ বিন জুবায়র-এর মেয়েকে বিবাহ করলো ইহরাম অবস্থায় তখন এ বিবাহের ঘোরবিরোধিতা করা হলো এবং ‘উসমান (রাঃ) থেকে বর্ণিত ইহরাম অবস্থায় বিবাহ নিষেধের হাদীসটি বর্ণনা করে শুনানো হলো এবং সবাই তখন এ হাদীস দ্বারা বিবাহের বন্ধনই বুঝেছিলেন وطأ তথা স্ত্রী সহবাস বুঝেনি।
তৃতীয় কারণ হচ্ছে, ইমাম আহমাদ (রহঃ) ইবনু ‘উমার থেকে বর্ণনা করেন, ইবনু ‘উমার (রাঃ)-কে এ মর্মে প্রশ্ন করা হলো যে, কোন মহিলাকে যদি কোন পুরুষ ‘উমরা অথবা হজ্জের ইহরাম অবস্থায় বিবাহ করতে চায় তাহলে তা বৈধ হবে কি না? উত্তরে তিনি বললেন, (لا تتزوج وانت محرم فان رسول الله ﷺ نهى عنه) অর্থাৎ- তুমি মুহরিম অবস্থায় বিবাহ করিও না, কারণ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটা করতে নিষেধ করেছেন। সুতরাং এ হাদীস থেকেও বুঝা গেল نكاح দ্বারা উদ্দেশ্য عقد النكاح তথা বিবাহের চুক্তি وطأ তথা সহবাস নয়।
পরিচ্ছেদঃ ১১. প্রথম অনুচ্ছেদ - ইহরাম অবস্থায় যা থেকে বেঁচে থাকতে হবে
২৬৮২-[৫] ’আব্দুল্লাহ ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মায়মূনাহ্ (রাঃ)-কে ইহরাম অবস্থায় বিয়ে করেছিলেন। (বুখারী, মুসলিম)[1]
بَابُ مَا يَجْتَنِبُهُ الْمُحْرِمُ
وَعَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ: أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ تَزَوَّجَ مَيْمُونَةَ وَهُوَ محرم
ব্যাখ্যা: (تَزَوَّجَ مَيْمُوْنَةَ) মায়মূনাহ্ (রাঃ) তিনি উম্মুল মু’মিনীন বিনতু হারিস আল হিলালিয়্যাহ্ (রাঃ) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সর্বশেষ স্ত্রী, যার সাথে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মিলন ঘটেছে। তিনি তাকে সপ্তম হিজরীতে বিবাহ করেন। তিনি ‘‘সারিফ’’ নামক স্থানে মৃত্যুবরণ করেন। ৫১ বছর বয়স পর্যন্ত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেখানে অবস্থান করেন।
‘আবদুল্লাহ বিন ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে গ্রহণযোগ্য বর্ণনাকারীদের সূত্রে বর্ণিত আছে, নিশ্চয়ই ইবনু ‘আব্বাস বলেছেন, (تزوج رسول الله ﷺ ميمونة وهو محرم) অর্থাৎ- নিশ্চয়ই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মায়মূনাহ্ (রাঃ)-কে বিবাহ করেছিলেন মুহরিম অবস্থায়। ইতিপূর্বে অতিবাহিত হয়েছে যে, এর দু’টি শক্তিশালী ‘‘শাহিদ’’ আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) ও ‘আয়িশাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে। তবে পরবর্তীতে বর্ণিত ইয়াযীদ বিন আসম মায়মূনাহ্ (রাঃ) থেকে যে হাদীসটি রয়েছে তা এ হাদীসের বিপরীত এবং তা আবূ রাফি‘ থেকেও বর্ণিত হয়েছে, হাদীসটি হলো, (تزوج رسول الله ﷺ ميمونة وهو حلال)
অর্থাৎ- রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মায়মূনাহ (রাঃ)-কে বিবাহ করেন হালাল অবস্থায়। এ বর্ণনাটির স্বপক্ষে আরো একটি হাদীস রয়েছে ইবনু সা‘দ মায়মূনাহ্ বিন মিহরান থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, সফিয়্যাহ্ বিনতু শায়বাহ্ যখন বৃদ্ধা তখন আমি তার নিকট গিয়ে প্রশ্ন করলাম যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি মায়মূনাহ্ (রাঃ)-কে মুহরিম অবস্থায় বিবাহ করেছিলেন? তিনি উত্তরে বলেছিলেন না, আল্লাহর শপথ! তারা দু’জনে হালাল অবস্থায়ই বিবাহ করেছিলেন। (মাজমাউয্ যাওয়ায়িদ খণ্ড ৪র্থ, পৃষ্ঠা ২৬৮)
উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে বুঝা যায় মায়মূনাহ্ (রাঃ)-কে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিবাহ কি হালাল অবস্থায় ছিল না মুহরিম অবস্থায় ছিল? এ বিষয় নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে, ‘আল্লামা ইবনুল ক্বইয়্যিম (রহঃ) বলেন, এ বিষয়ে তিন রকমের কথা পাওয়া যায় প্রথম কথাটি যা মায়মূনাহ্ (রাঃ) এবং হাদীস বর্ণনাকারী আবূ রাফি'-এর ভাষ্য থেকে পাওয়া, তথ্যানুযায়ী সেটি হচ্ছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বিবাহ করেছিলেন ‘উমরা থেকে হালাল হওয়ার পর। এটাই অধিকাংশ বর্ণনাকারীর মত।
দ্বিতীয় কথা, যা আহলে কূফা, ইবনু ‘আব্বাস ও একদল ‘আলিমের ভাষ্যমতে যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বিবাহ করেছিলেন ইহরাম বাঁধা অবস্থায়।
তৃতীয় কথা হলো নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বিবাহ করেছিলেন ইহরাম বাঁধার পূর্বে।
ইতিপূর্বে আমাদের আলোচনা অতিবাহিত হয়ে গেছে যে, যে সমস্ত ‘আলিম ইহরাম অবস্থায় বিবাহ করা বৈধ বলে ফাতাওয়া দেন তাদের অন্যতম দলীল হলো ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ)-এর এ হাদীস। এ মতের বিপরীত অবস্থানকারীগণ বিভিন্ন উত্তর প্রদান করে থাকেন। যেমনঃ তারা বলে থাকেন যা বর্ণিত হয়েছে তিরমিযীতে যে, (تزوجها حلالا وظهرا مر تزويجها وهو محرم وبنى بها وهو حلال بسرف فى طريق مكة) অর্থাৎ- বিবাহের ‘আক্বদ হয়েছিল হালাল অবস্থায় তবে বিবাহের খবর চারদিকে যখন ছড়িয়ে পড়ে তখন তিনি মুহরিম অবস্থায় ছিলেন বাসর করেছেন মক্কার পথে সারিফ নামক স্থানে হালাল অবস্থায়।
দ্বিতীয় উত্তর হচ্ছে ইবনু ‘আব্বাস -এর কথা (تزوجها وهو محرم) এর অর্থ হলো, তিনি তাকে হারাম মাসে বিবাহ করেছেন। মুহরিম অবস্থায় নয়। আর সেটা যিলকদ মাস ‘উমরাতুল কাযা-এর মাস এমনটাই বলেছেন ইমাম বুখারী (রহঃ) তার কিতাবুল মাগাযীতে ‘উমরাতুল কাযা’ অধ্যায়ে।
এ বিশাল মতবিরোধপূর্ণ মাস্আলাতে মায়মূনাহ্ ও আবূ রাফি'-এর বর্ণনাটিই অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত, কারণ তারা ঘটনার বাস্তবসাক্ষী আর দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে ঐ সময় ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) হাদীস বর্ণনা করার বয়সে উপনীত হননি, তাই তার হাদীসের উপর তাদের হাদীস বর্ণিত হাদীস স্বভাবতই প্রাধান্য পেতে পারে। (আল্লাহ অধিক অবগত আছেন)
পরিচ্ছেদঃ ১১. প্রথম অনুচ্ছেদ - ইহরাম অবস্থায় যা থেকে বেঁচে থাকতে হবে
২৬৮৩-[৬] উম্মুল মু’মিনীন মায়মূনাহ্ (রাঃ)-এর ভাগিনা ইয়াযীদ ইবনু আসম (রহঃ) তাঁর খালা মায়মূনাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মায়মূনাহ্ (রাঃ)-কে হালাল অবস্থায় (ইহরাম অবস্থায় নয়) বিয়ে করেছিলেন। (মুসলিম)[1]
بَابُ مَا يَجْتَنِبُهُ الْمُحْرِمُ
وَعَنْ يَزِيدَ بْنِ الْأَصَمِّ ابْنِ أُخْتِ مَيْمُونَةَ عَنْ مَيْمُونَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ تَزَوَّجَهَا وَهُوَ حَلَالٌ. رَوَاهُ مُسْلِمٌ
قَالَ الشيخُ الإِمَام يحيى السّنة: وَالْأَكْثَرُونَ عَلَى أَنَّهُ تَزَوَّجَهَا حَلَالًا وَظَهَرَ أَمْرُ تَزْوِيجِهَا وَهُوَ مُحْرِمٌ ثُمَّ بَنَى بِهَا وَهُوَ حَلَال بسرف فِي طَرِيق مَكَّة
ব্যাখ্যা: (يَزِيدَ بْنِ الْأَصَمِّ) তার পূর্ণনাম ইয়াযীদ বিন আল আসম বিন ‘উবায়দ বিন মু‘আবিয়াহ্ বিন ‘উবাদাহ্ বিন আল বাক্কা আসম-এর নাম হলো ‘আমর এবং আবূ ‘আওফ আল বাকাঈ আল কূফী। তাকে তার খালা উম্মুল মু’মিনীন মায়মূনাহ্ (রাঃ) লালন-পালন করেন, তার মাতার নাম বারযাহ বিনতু হারিস মায়মূনাহ্ (রাঃ)-এর বোন। হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেন, তিনি সিক্বাহ রাবী মধ্যস্তরের তাবি‘ঈ ১০৩ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন ‘আল্লামা আল ওয়াকীদী বলেন, তিনি ৭৩ বছরের জীবন পেয়েছিলেন।
(تَزَوَّجَهَا وَهُوَ حَلَالٌ) অর্থাৎ- মুহরিম অবস্থা ব্যতীত বিবাহ করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন ইহরাম বাঁধার পূর্বে বিবাহ করেছেন এমনটাই বর্ণনা করেছেন ইমাম মালিক (রহঃ) রবী‘আহ্ থেকে, রবী‘আহ্ সুলায়মান বিন ইয়াসার থেকে তবে বর্ণনাটি ‘‘মুরসাল’’। সে হাদীসে পাওয়া যায় বিবাহ হয়েছিল মদীনায়, আবার কেউ বলেছেন বিবাহ হয়েছিল ‘উমরা থেকে হালাল হওয়ার পর মক্কায় অথবা সারিফ নামক স্থানে, যাই হোক না কেন হাদীসটি পূর্বে বর্ণিত ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ)-এর হাদীসের বিপরীত।
যারা ইহরাম অবস্থায় বিবাহ বৈধ বলেন, তারা মূলত দু’ভাবে তা বলে থাকেন।
১। ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ)-এর হাদীস থেকে ইয়াযীদ বিন আসম (রাঃ)-এর হাদীসের উপর প্রাধান্য দেয়ার মাধ্যমে আর এ প্রাধান্যটি কয়েকটি কারণে হতে পারে।
(ক) ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ)-এর বর্ণিত হাদীস যেহেতু ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম উভয়ের বর্ণনা, তাই সেটা সানাদগত দিক থেকে বেশি শক্তিশালী। অপরদিকে ইয়াযীদ বিন আসম সহ অন্যান্যদের বর্ণিত হাদীস এমনটি নয়, কারণ সেটা ইমাম বুখারী (রহঃ) বর্ণনা করেননি। এর উত্তর পূর্বে অতিবাহিত হয়েছে আর তা হলো যদিও ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ)-এর হাদীস মুত্তাফাক্ব ‘আলায়হি হওয়ার কারণে হাদীসটি বিশুদ্ধতার শীর্ষ পর্যায়ে পৌঁছেছে ঠিক কিন্তু এর অর্থ এটা নয় যে, সেটা ইয়াযীদ বিন আসমসহ অন্যান্যদের বর্ণিত হাদীসের উপরে উঠে গেছে ও মায়মূনাহ্ (রাঃ) যারা এ ঘটনার বাস্তবসাক্ষী তাদের কথাই এখানে প্রাধান্য পাবে।
(খ) ইয়াযীদ বিন আসম-এর তুলনায় ইবনু ‘আব্বাস অনেক অনেক বেশি (সিক্বাহ্) নির্ভরযোগ্য, তাই ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ)-এর হাদীসই প্রাধান্য পাবে।
(গ) ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ)-এর বর্ণিত হাদীসটি অতিরিক্ত একটি বিষয়কে সাব্যস্ত করে। আর তা হলো ইহরাম অবস্থায়। ইবনু আসম এর হাদীসটি ইহরাম অবস্থার বিপরীত। আরো প্রকাশ থাকে যে, ইতিবাচক হাদীসটি নেতিবাচক হাদীসটির উপর প্রাধান্য পাবে।
(ঘ) ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ)-এর বর্ণিত হাদীসটি মুহকাম। এতে ন্যূনতম কোন ব্যাখ্যার সম্ভাবনা রাখে না। যেমনটি ইবনু আসম এর হাদীসটি রাখে। ইবনু আসম এর বর্ণিত হাদীসটি ব্যাখ্যাসাপেক্ষ, যাতে বিবাহের খুতবাহ্ ও বিবাহের বিষয়টি প্রকাশ পায় হালাল অবস্থায়। অর্থাৎ- মক্কা থেকে মদীনায় ফেরার পথে সারিফ নামক স্থানে।
(ঙ) বিবাহের বিষয়টির সম্পূর্ণ দায়িত্ব ছিল ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ)-এর ওপর। আর ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) ছিলেন এই বিবাহের ওয়াকীল বা অভিভাবক। আর ওয়াকীলই বেশী জানে মু’কাল থেকে। অর্থাৎ- ‘আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) ছিলেন এই বিবাহের প্রত্যক্ষদর্শী যে, বিবাহ হালাল অবস্থায় হয়েছিল নাকি, হারাম অবস্থায় হয়েছিল।
(চ) ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ)-এর হাদীসটি ক্বিয়াস সমর্থিত। কেননা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এই বিবাহের বন্ধনটি ছিল অন্যান্য সকল মানুষের বিবাহের বন্ধনের মতই।
২। যারা বলেছেন যে, ইহরাম অবস্থায় বিবাহ বৈধ এবং ‘আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস -এর হাদীসটিকে ইবনু আসম -এর হাদীসের উপর প্রাধান্য দিয়েছেন তাদের দ্বিতীয় মতঃ ইবনু আসম এর হাদীসের মধ্যে النكاح والتزويج ‘‘নিকাহ ও তাযবীজ’’ শব্দ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো সহবাস বা মিলন বিবাহের বন্ধন উদ্দেশে নয়।
‘আল্লামা মুল্লা ‘আলী কারী (রহঃ) বলেনঃ ‘‘তাযবীজ’’ শব্দ দ্বারা সহবাস উদ্দেশ্য।
এজন্য দেখা যায় এ বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে ‘আমর বিন দীনার ইমাম যুহরী (রহঃ)-কে বলেছেন, ইয়াযীদ বিন আসম একজন গ্রাম্য মানুষ সে আর কিইবা বুঝবে? আপনি কি তাকে ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ)-এর সমপর্যায়ভুক্ত করছেন? ইয়াযীদ বিন আসম কখনোই জ্ঞান-গরীমায় ও হিফযে ইবনু আব্বাস (রাঃ)-এর সমপর্যায়ের হবেন না। তাই ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ)-এর বর্ণিত হাদীস এখানে প্রাধান্য পাবে।
এর উত্তর দিয়েছেন ইমাম ইবনু হাযম। তিনি বলেছেন, ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ)-কে ইয়াযীদ-এর ওপর অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে এটা ঠিক আছে। কিন্তু এখানে সমস্যা একটু রয়ে গেছে সেটা হলো ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) ইয়াযীদ বিন আসম-এর চেয়ে বেশি ভাল হলেও এখানে তার হাদীস প্রাধান্য পাবে না কারণ কম বয়সী ছোট ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ)-কে আমরা উম্মুল মু’মিনীন মায়মূনাহ্ (রাঃ)-এর চেয়ে উপযুক্ত বলতে পারছি না। এক্ষেত্রে ইয়াযীদ কর্তৃক মায়মূনাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীসই সঠিক এবং ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ)-এর হাদীস সন্দেহযুক্ত, এর কারণ হলো মায়মূনাহ্ (রাঃ) হলেন এর বাস্তবসাক্ষী আর ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) শুধুমাত্র বর্ণনাকারী। আবার মায়মূনাহ্ একজন পূর্ণ বয়ঃপ্রাপ্ত মহিলা অপরদিকে ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ)-এর বয়স তখন মাত্র ১০ বছর।
[উভয় হাদীসের মধ্যে সমন্বয়ের কয়েকটি দিকঃ
১। এই ঘটনা যাকে কেন্দ্র করে তিনি হলেন উম্মুল মু’মিনীন মায়মূনাহ্ (রাঃ)। আর তিনি নিজেই বলেছেনঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বিবাহ করেছেন এমতাবস্থায় যে, তখন তিনি ছিলেন হালাল।
২। এ বিবাহের ঘটক ছিলেন আবূ রাফি‘ঈ; আর তিনি নিজেই বলছেন যে, আমি উভয়ের (মায়মূনাহ্ ও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিবাহের মাঝে সমন্বয়কারী) ঘটক হিসেবে ছিলাম। আর আল্লাহর নাবী বিবাহ করেছেন এমন অবস্থায় তিনি ছিলেন হালাল।
৩। ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ)-এর মতে মুহরিম বলা হয় এমন ব্যক্তিকে, যে মক্কায় প্রবেশ করার পূর্বেই হাদী বা কুরবানীর জন্তুকে মক্কায় পাঠিয়ে দেয়। আর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো আগেই হাদী পাঠিয়ে ছিলেন।
৪। এখানে মুহরিম দ্বারা উদ্দেশ্য হলো- যে মক্কায়, অর্থাৎ- হারাম এলাকায় প্রবেশ করল সেই মুহরিম। অর্থাৎ- রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মায়মূনাহ্ (রাঃ)-কে বিবাহ করেছেন এমন অবস্থায় তিনি হেরেমের সীমানার মধ্যে প্রবেশকারী। অর্থাৎ- তিনি মুহরিম অবস্থায় ছিলেন না।] (সম্পাদক)
পরিচ্ছেদঃ ১১. প্রথম অনুচ্ছেদ - ইহরাম অবস্থায় যা থেকে বেঁচে থাকতে হবে
২৬৮৪-[৭] আবূ আইয়ূব আল আনসারী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইহরাম অবস্থায় নিজের মাথা ধুতেন। (বুখারী, মুসলিম)[1]
بَابُ مَا يَجْتَنِبُهُ الْمُحْرِمُ
وَعَن أَبِي أَيُّوبَ: أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَغْسِلُ رَأْسَهُ وَهُوَ مُحْرِمٌ
ব্যাখ্যা: এ হাদীস থেকে বুঝা যায়, মুহরিমের জন্য গোসল করা বৈধ এবং মাথা ধোয়া চুল ভিজানো ইত্যাদিও জায়িয। এখানে একটি ঘটনা উল্লেখ করতে হয় এ হাদীস প্রসঙ্গে যা ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম (রহঃ) বর্ণনা করেছেন ‘আবদুল্লাহ বিন হুনায়ন থেকে যে, একদা ‘আবদুল্লাহ বিন ‘আব্বাস ও মিসওয়ার বিন মাখরামাহ্ (রাঃ) মতবিরোধে লিপ্ত হলেন আব্ওয়া নামক স্থানে। আর তা হলো ইবনু ‘আব্বাস বলেন, মুহরিমের জন্য মাথা গোসল করানো জায়িয আছে আর মিসওয়ার বলেন, জায়িয নেই। ‘আবদুল্লাহ বিন হুনায়ন বলছেন ঘটনার এক পর্যায়ে ‘আবদুল্লাহ বিন ‘আব্বাস (রাঃ) এ বিষয়ে সঠিক জ্ঞান জানার জন্য আমাকে আবূ আইয়ূব আল আনসারী (রাঃ)-এর নিকট পাঠালেন, আমি সেখানে যেয়ে দেখলাম তিনি কাপড় দিয়ে চারপাশ ঘিরে রেখে গোসল করছেন আমি তাকে সালাম দিলাম, তিনি বললেন, কে? আমি বললাম ‘আবদুল্লাহ বিন হুনায়ন, আমাকে ‘আবদুল্লাহ বিন ‘আব্বাস (রাঃ) পাঠিয়েছেন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুহরিম অবস্থায় কিভাবে গোসল করতেন- এটা জিজ্ঞেস করার জন্য।
অতঃপর আবূ আইয়ূব আল আনসারী (রাঃ) তার হাত কাপড়ের উপর রাখলেন এবং মাথার কাপড় আস্তে আস্তে টানতে লাগলেন এবং এক পর্যায়ে তার মাথা দেখতে পেলাম, অতঃপর তিনি একজন লোককে বললেন তার মাথায় পানি ঢালতে এ অনুপাতে তার মাথায় পানি ঢালা হলো এবং তিনি তার দু’হাতে মাথা নাড়াতে শুরু করেন এবং হাত দিয়ে মাথার সামনে একবার এবং পিছনে একবার নিয়ে যান এবং বলেন, এভাবেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে করতে দেখেছি।
এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রহঃ) যে অধ্যায়ে নিয়ে এসেছেন তার নাম দিয়েছেন (باب الاغسال للمحرم) তথা মুহরিমের জন্য গোসল অধ্যায়। হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেন, এ গোসলটি মূলত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য এবং ফরয গোসল ও মুহরিমের জন্য অবধারিত।
পরিচ্ছেদঃ ১১. প্রথম অনুচ্ছেদ - ইহরাম অবস্থায় যা থেকে বেঁচে থাকতে হবে
২৬৮৫-[৮] ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইহরাম অবস্থায় শিঙ্গা লাগিয়েছেন। (বুখারী, মুসলিম)[1]
بَابُ مَا يَجْتَنِبُهُ الْمُحْرِمُ
وَعَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ: احْتَجَمَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَهُوَ محرم
ব্যাখ্যা: ‘আল্লামা হাযিমী সহ অনেক ‘আলিমের মতামত হলো এ শিঙ্গা লাগানোর সময়টি ছিল বিদায় হজ্জের দিন।
(وَهُوَ مُحْرِمٌ) সহীহুল বুখারীতে অতিরিক্ত এসেছে, (فى راسه من وجع كان به تماء يقال له لحى جمل) অর্থাৎ- শিঙ্গাটা লাগিয়েছিলেন মাথায় আঘাতজনিত কারণে পানি দ্বারা যাকে ‘‘লুহা জামাল’’ বলা হয়। অন্য সনদে ইবনু ‘আব্বাস থেকে মু‘আল্লাক সূত্রে বর্ণনা এসেছে,
(ان رسول الله ﷺ احتجم وهو محرم فى راسه من شقيقة كانت به)
অর্থাৎ- রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইহরাম অবস্থায় শিঙ্গা লাগিয়েছিলেন মাথায় ‘‘শাক্বীক্বাহ্’’-এর কারণে। শাক্বীক্বাহ্ অর্থ وجع يأخذ فى احد نبى الرأس او فى مقدمه অর্থাৎ- এমন ব্যথা যা মাথার এক পাশে অথবা মাথার সম্মুখভাগে। অপর একটি হাদীস যেটি ইবনু হায়নাহ্ বর্ণনা করেছেন তৃতীয় পরিচ্ছেদে হাদীসটি আসবে তাতে রয়েছে মাথার মধ্যভাগের কথা।
আর আনাস (রাঃ)-এর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ণিত হাদীস যা তৃতীয় পরিচ্ছেদে রয়েছে সেখানে রয়েছে পায়ের উপরিভাগে ব্যথা পাওয়ার কারণে সেখানে তিনি শিঙ্গা লাগিয়েছিলেন এবং জাবির (রাঃ) কর্তৃক হাদীস যেটি ইমাম আহমাদ ও ইমাম নাসায়ী বর্ণনা করেছেন সেখানে রয়েছে, তিনি পিঠে শিঙ্গা লাগিয়েছেন। যাই হোক উপরোক্ত মতবিরোধের সমাধাকল্পে ‘উলামায়ে কিরাম বলেছেন, বস্ত্তত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শিঙ্গা লাগানো একবার ছিল না তা ছিল কয়েকবার।
এ হাদীস থেকে বুঝা যায় মুহরিমের জন্য শিঙ্গা লাগানো বৈধ আছে- এর সমর্থনে ইমাম বুখারী (রহঃ) তারজামাতুল বাব তথা অধ্যায় রচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, (باب الحجامة للمحرم) হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ)-এর অর্থ করেছেন باب الحجامة للمحرم অর্থ হলো (هل يجوز الحجامة للمحرم) অর্থাৎ- মুহরিমের জন্য শিঙ্গা লাগানো কি বৈধ আছে নাকি নেই? এ বর্ণনাগুলোর প্রত্যেকটিতে উদ্দেশ্য মাহজূম তথা শিঙ্গা যাকে লাগানো হয়েছে الحاجم তথা শিঙ্গা যিনি লাগিয়ে দিয়েছেন তিনি উদ্দেশ্য নন।
‘আল্লামা ইবনু কুদামাহ্ (রহঃ) তাঁর ‘আল মুগনী’ নামক কিতাবে (৩য় খণ্ড পৃষ্ঠা ৩০৫) বলেন, অতঃপর শিঙ্গা যদি লাগানোর ফলে একটি চুলও না কাটে তাহলে তা বৈধ হবে কোন প্রকার ফিদিয়া ব্যতীত আর এটাই জমহূর ‘উলামায়ে কিরামের ফাতাওয়া। ইমাম মালিক (রহঃ) বলেছেন, বিশেষ কারণ ব্যতীত শিঙ্গা লাগাবে না। তবে হাসান বাসরী (রহঃ) মনে করেন শিঙ্গা লাগালে জরিমানা দিতে হবে।
‘আল্লামা ‘আয়নী (রহঃ) বলেন, যে কোন অবস্থাতেই শিঙ্গা লাগানো বৈধতার ফাতাওয়া দিয়েছেন ‘আত্বা, মাসরূক, ইব্রাহীম নাখ্‘ঈ, ত্বাউস, সাওরী, আবূ হানীফা, শাফি‘ঈ, আহমাদ, ইসহাক। আর এক দল বলেছেন, বিশেষ কারণ ব্যতীত শিঙ্গা লাগানো নিষেধ, ইবনু ‘উমার (রাঃ) থেকে কথার বর্ণনা পাওয়া যায়। আর এটাই ইমাম মালিক (রহঃ)-এর অভিমত।
ইমাম নাবাবী (রহঃ) বলেছেন, সকলের ঐকমত্যে মাথা বা শরীরের অন্য যে কোন অঙ্গে শিঙ্গা লাগানো বৈধ যদি কোন অসুবিধা থাকে। এ ক্ষেত্রে যদি চুলও কেটে যায় তাহলেও কোন অসুবিধা নেই। তবে চুল কাটানোর কারণে ফিদিয়া দেয়া আবশ্যক হবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘‘অর্থাৎ- তোমাদের মধ্যে যে অসুস্থ থাকবে অথবা তার মাথায় যখন হবে সে ফিদিয়া দিবে।’’ (সূরা আল বাক্বারাহ্ ২ : ১৯৬)
আর অত্র হাদীস (যার ব্যাখ্যা আমরা করছি) সে হাদীসটির অর্থ এমন হবে যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার মাথার মধ্যভাগে শিঙ্গা লাগিয়েছেন তার অসুবিধার কারণে এবং তিনি কোন চুল কাটেননি। কিন্তু প্রয়োজন ছাড়াই যদি মুহরিম মাথার বা অন্য কোথাও শিঙ্গা লাগায় আর তাতে যদি তার চুল কেটে যায় তাহলে শিঙ্গা লাগানো হারাম হবে যেহেতু মুহরিম অবস্থায় চুল কাটা নিষেধ। আর যদি চুল না কাটে যেমন সে এমন জায়গায় শিঙ্গা লাগালো যেখানে কোন চুল নেই তাহলে অধিকাংশ ‘আলিমের মতে তাকে কোন ফিদিয়া দিতে হবে না। আর ইবনু ‘উমার (রাঃ) ও ইমাম মালিক (রহঃ)-এর নিকট এটা মাকরূহের অন্তর্ভুক্ত হবে। ইমাম হাসান বাসরী (রহঃ) বলেন, চুল না কাটলে, এখানে তাকে ফিদিয়া দিতে হবে। আমাদের (জমহূর) এক্ষেত্রে দলীল হল সে ফিদিয়া দিবে না এ কারণে যে, কোন হাদীস এমন নেই যে ইহরাম অবস্থায় রক্ত বের হলে ফিদিয়া দিতে হবে। তবে দাঊদ আয্ যাহিরীর মতানুসারীরা শুধু মাথার চুলকে নির্দিষ্ট করেছেন।
মোট কথা হচ্ছে এখানে জমহূরের মতই প্রাধান্য কারণ, এ সম্পর্কে যতগুলো রিওয়ায়াত এসেছে তার একটিতেও এ কথা বর্ণিত হয়নি যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিঙ্গা লাগানোর ফলে চুল কেটে গেলে ফিদিয়া দিয়েছেন।
আর যারা ফিদিয়া আবশ্যকের মতাবলম্বী তাদের দলীল মহান আল্লাহর বাণী, অর্থাৎ- ‘‘কুরবানীর পশু তার স্বীয় স্থানে পৌঁছার পূর্বে তোমরা মাথা হলক করিও না।’’ (সূরা আল বাক্বারাহ্ ২ : ১৯৬)
এ আয়াতের ব্যাপকতার মাধ্যমে অর্থাৎ- এখানে যেহেতু মাথা হলক করা নিষেধ আছে তাই শিঙ্গা লাগাতে গিয়ে একটি চুলও যদি কাটা যায় তাহলে ফিদিয়া দিতে হবে। তাদের এ ফাতাওয়া ঠিক নয়, কারণ আয়াতটি শুধু একটি চুল কাটলেই ফিদিয়া দিতে হবে এমন কথা বলছে না বরং সমস্ত মাথা হলক করলে ফিদিয়া দেয়ার কথা বলছে। সুতরাং কিংয়দংশ হলকের সাথে ফিদইয়ার কোন সম্পর্ক নেই। তবে মাথার কতটুকু হলক করলে ফিদিয়া দিতে হবে এ বিষয়টি নিয়ে ‘আলিমদের মাঝে বিরোধ আছে। তাই ইমাম শাফি‘ঈ (রহঃ) বলেছেন, তিনটি চুল বা ততোধিক চুল কাটলে ফিদিয়া আবশ্যক হবে।
ইমাম আহমাদ (রহঃ)-এর এক বর্ণনায়ও তাই আছে। তবে অন্য বর্ণনায় আছে চারটি চুলের কথা। ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ)-এর মত হলো যদি মাথার এক চতুর্থাংশ হলক করে তাহলে ফিদিয়া দিবে। ইমাম মালিক (রহঃ) বলেছেন, ফিদিয়া দিতে হবে যদি চাকচিক্যের উদ্দেশে বা اماطة الأذى তথা ময়লা দূর করার জন্য মাথা হলক করে থাকে এ ক্ষেত্রে চুলের সংখ্যা অনির্ধারিত। (আল্লাহ অধিক অবগত আছেন)
পরিচ্ছেদঃ ১১. প্রথম অনুচ্ছেদ - ইহরাম অবস্থায় যা থেকে বেঁচে থাকতে হবে
২৬৮৬-[৯] ’উসমান (রাঃ) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে ঐ ব্যক্তির ব্যাপারে বর্ণনা করেন, যে ব্যক্তি ইহরাম অবস্থায় চোখে ব্যথা অনুভব করে সে মুসাববার দিয়ে পট্টি বাঁধবে। (মুসলিম)[1]
بَابُ مَا يَجْتَنِبُهُ الْمُحْرِمُ
وَعَن عُثْمَان حَدَّثَ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي الرَّجُلِ إِذَا اشْتَكَى عَيْنَيْهِ وَهُوَ محرمٌ ضمدهما بِالصبرِ. رَوَاهُ مُسلم
ব্যাখ্যা: (فِى الرَّجُلِ) এখানে পুরুষের সাথে মহিলাও অন্তর্ভুক্ত হবে।
(ضَمَّدَهُمَا) এ শব্দটি বাবে তাফ্‘ঈল থেকে নির্গত এবং তা ماضى তথা অতীতকালীন অর্থবোধক শব্দ। ‘আল্লামা মুল্লা ‘আলী কারী হানাফী (রহঃ) বলেন, মিশকাতের মূল পাণ্ডুলিপিতে ضمد তথা ‘আমর অর্থাৎ- নির্দেশসূচক শব্দের ব্যবহার আছে এবং নির্দেশসূচক শব্দটি আবশ্যকের অর্থ না দিয়ে বৈধতার অর্থ বুঝাবে।
আমি বলব, [‘উবায়দুল্লাহ মুবারকপূরী (রহঃ)] শব্দটি باب نصر অথবা ضرب থেকে ماضى তথা অতীতকালীন ক্রিয়া হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। বলা হয়ে থাকে, ضمد الجرح يضمد অর্থাৎ- ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেস লাগিয়েছে। এ হচ্ছে ضمد শব্দের আসল ব্যাখ্যা, অতঃপর সেটা ঔষধ তরল পদার্থের সাথে মিশানো তারপর ক্ষতস্থানে লাগানো ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত হয়।
(بِالصَّبْرِ) শব্দটি صبر অথবা صبر সাকিন দেয়া চলে এ দু’ভাবেই পড়া যায়। আল কামূস গ্রন্থকার বলেন, কবিতার পংতির মিল করার মতো জরুরী কারণ ব্যতীত باء এ সাকিন পড়া বৈধ নয়। এ শব্দটির অর্থ হচ্ছে عصاره شجر مر তথা তিক্ত গাছের রস।
বাহরুল জাওয়াহির গ্রন্থকার (রহঃ) বলেন, যেমন সু’সিন নামক এক প্রকার গাছ যা লাল ও হলুদের মাঝামাঝি রংয়ের।
উর্দূ ভাষায় একে ঈলূআ বলা হয়। এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, ‘সাবির’ নামক এ দ্রব্যটিকে পানির সাথে মিশিয়ে চোখে ড্রপ হিসেবে ব্যবহার করা অথবা এ দুয়ের মাধ্যমে সুরমা বানিয়ে তা চোখে লাগানো।
এ হাদীস থেকে বুঝা যায়, চোখে সাবির বা এ জাতীয় জিনিসের মাধ্যমে ড্রপ ব্যবহার করা জায়িয আছে। ইমাম নাবাবী (রহঃ) বলেন, ‘উলামায়ে কিরামের ঐকমত্যে সুগন্ধি ব্যতীত চোখে সাবির বা এ জাতীয় জিনিস ব্যবহার করা যায় এতো কোন ফিদিয়া দিতে হবে না, তবে সুগন্ধি যদি প্রয়োজন মনে করে তাহলে তা করতে পারে, এর জন্য ফিদিয়া আবশ্যক হবে।
আর এ বিষয়েও ঐকমত্য আছে যে, মুহরিমের জন্য সুরমা যা সুগন্ধিবিহীন তা ব্যবহার করা জায়িয এক্ষেত্রে কোন ফিদিয়া দেয়া লাগবে না তবে যদি সৌন্দর্যের জন্য দেয় তাহলে ইমাম শাফি‘ঈ (রহঃ) এটাকে মাকরূহ বলেছেন। অপর একদল ‘আলিম যাদের অন্যতম হলেন, ইমাম আহমাদ ও ইসহাক (রহঃ) এটাকে সম্পূর্ণভাবে নিষেধ করেছেন। ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ)-এর মতো এক্ষেত্রে শাফি‘ঈ (রহঃ)-এর মত।
পরিচ্ছেদঃ ১১. প্রথম অনুচ্ছেদ - ইহরাম অবস্থায় যা থেকে বেঁচে থাকতে হবে
২৬৮৭-[১০] মহিলা সাহাবী উম্মুল হুসায়ন (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি উসামাহ্ ও বিলাল (রাঃ)-কে দেখেছি তাদের একজন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উটনীর লাগাম ধরে রেখেছে আর অপরজন কাপড় উপরে উঠিয়ে রোদ্র হতে তাঁকে ছায়া দিচ্ছে জামারাতুল ’আক্বাবায় পাথর মারা পর্যন্ত। (মুসলিম)[1]
بَابُ مَا يَجْتَنِبُهُ الْمُحْرِمُ
وَعَنْ أُمِّ الْحُصَيْنِ قَالَتْ: رَأَيْتُ أُسَامَةَ وَبِلَالًا وَأَحَدُهُمَا آخِذٌ بِخِطَامِ نَاقَةِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَالْآخَرُ رَافِعٌ ثَوْبَهُ يَسْتُرُهُ من الْحَرِّ حَتَّى رَمَى جَمْرَةَ الْعَقَبَةِ. رَوَاهُ مُسْلِمٌ
ব্যাখ্যা: (عَنْ أُمِّ الْحُصَيْنِ) উম্মুল হুসায়ন (রাঃ) হলেন ইসহাক-এর কন্যা, মহিলা সাহাবী কিন্তু তাঁর নাম জানা যায়নি।
(رَأَيْتُ أُسَامَةَ) উসামাহ্ হলেন যায়দ ইবনু হারিসাহ্-এর সন্তান এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মুক্ত দাস। (وَبِلَالًا) বিলাল হলেন রিবাহ্-এর সন্তান এবং আবূ বাকর সিদ্দীক্ব (রাঃ)-এর দাস। (وَأَحَدُهُمَا) মুল্লা ‘আলী কারী বলেনঃ প্রকাশ থাকে যে, তিনি হলেন বিলাল। (وَالْاٰخَرُ) অন্যজন হলেন উসামাহ্। (يَسْتُرُه) অর্থাৎ- রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মাথা থেকে উপরে কাপড় ঝুলিয়ে দেয়ার মাধ্যমে ছায়া দিচ্ছিলেন।
(مِنَ الْحَرِّ) অন্য বর্ণনায় এসেছেন, (رافع ثوبه على رأس رسول الله ﷺ من الشمس) অর্থাৎ- তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সূর্যের কিরণ থেকে রক্ষা করার জন্য তার কাপড় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মাথার উপর উঁচু করে ধরেছেন।
ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) আবূ উমামাহ্ থেকে বর্ণনা করেন, আবূ উমাম তার কাছ থেকে বর্ণনা করেন যিনি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে দেখছেন যে, (راح إلى منى يوم التروية والى جانبه بلال، بيده عود........الخ)
নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তারবিয়ার দিন মিনায় প্রস্থান করেন তার পাশে বিলাল ছিলেন তার হাতে একটি কাঠের লাঠি ছিল লাঠির উপর একট টুকরা কাপড় ছিল-এর মাধ্যমে তিনি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ছায়া দিচ্ছিলেন।
সুতরাং এ হাদীস থেকে বুঝা গেল, মুহরিমকে কাপড় বা এ জাতীয় জিনিসের মাধ্যমে ছায়া প্রদান করা বৈধ চাই সে সওয়ারী হোক বা হেঁটে যাক- এটাই ইমাম আবূ হানীফা, শাফি‘ঈসহ অধিকাংশ ‘উলামায়ে কিরামের মতামতের মতের স্বপক্ষে, উপরোক্ত উম্মুল হুসায়ন ও আবূ উমামার বর্ণিত হাদীসকে তারা দলীল হিসেবে পেশ করেছেন। তবে ইমাম মালিক ও ইমাম আহমাদ (রহঃ) বলেছেন, শুধুমাত্র নিচ দিয়ে হেঁটে গেলে ছায়া প্রদান বৈধ আছে। সুতরাং সওয়ারী অবস্থায় ছায়া দিলে ফিদিয়া দিতে হবে। তবে ইমাম আহমাদের অন্য বর্ণনায় রয়েছে, কোন ফিদিয়া দিতে হবে না। তবে যদি কোন তাঁবুর নিচে বসে অথবা ছাদের নিচে বসে ছায়া গ্রহণ করে তাহলে তা জায়িয হবে- এ ব্যাপারে সকলের ঐকমত্য রয়েছে।
ছায়া গ্রহণ নিষেধ প্রসঙ্গে ইমাম আহমাদ ও মালিক (রহঃ)-এর দলীল বায়হাক্বীতে ইবনু ‘উমার (রাঃ) থেকে সহীহ সূত্রে বর্ণিত হাদীস, ‘‘নিশ্চয়ই ইবনু ‘উমার (রাঃ) একজন লোককে দেখলেন ইহরাম অবস্থায় সওয়ারীর পিঠে উঠে কোন কিছুর মাধ্যমে ছায়া গ্রহণ করছে ফলে তিনি তাকে নিষেধ করলেন এবং বললেন, (اضح لمن احرمت له) অর্থাৎ- ‘যার জন্য হারাম করা হয়েছিল তা বৈধ করলে’।’’
‘আল্লামা শানক্বীতী (রহঃ) বলেনঃ সামিয়ানা, তাঁবু গাছ, কাপড় ইত্যাদির মাধ্যমে ছায়া গ্রহণ বৈধ, এতে সবার ঐকমত্য রয়েছে ইমাম মালিক (রহঃ) থেকে গাছের উপর কাপড় লটকিয়ে ছায়া গ্রহণে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। ‘আবদুল মালিক বিন মাজিশূন (রহঃ) সেটাকে গাছের উপর ক্বিয়াস করে বৈধ বলেছেন এবং এটাই বেশি গ্রহণযোগ্য।
এ বিষয়ে সঠিক কথা হলো যে কোন অবস্থাতেই مطلقا তথা সাধারণভাবেই ছায়া গ্রহণ বৈধ উপরোক্ত হাদীসের মাধ্যমে এটা প্রমাণিত আর যেহেতু এ বিষয়ে সুন্নাতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্পষ্ট। সুতরাং তা আকড়ে ধরাই উৎকৃষ্ট সমাধান। সেটা বাদ দিয়ে কোন মুজতাহিদের কথার দিকে যাওয়া জায়িয হবে না। তিনি যত বড়ই জ্ঞানী হোন না কেন?
অন্য রিওয়ায়াতে রয়েছে যে, (رافع ثوبه على رأس رسول الله - ﷺ - من الشمس) অর্থাৎ- ‘‘সূর্যের তাপ থেকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে রক্ষা করার জন্য তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) স্বীয় কাপড় তাঁর মাথার উপর উঁচু করে ধরে ছিলেন।’’
ইমাম আহমাদ (রহঃ) আবূ উমামাহ্ (রহঃ) থেকে বর্ণিত,
رأى النبي - ﷺ- (راح إلى منى يوم التروية وإلى جانبه بلال، بيده عود عليه ثوب يظلل به رسول الله - ﷺ-)
নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তারবিয়ার দিন মিনার দিকে রওয়ানা হলেন। তাঁর পাশে ছিলেন বিলাল (রাঃ), তার হাতে একটি লাকড়ি ছিল যাতে একটি কাপড় ছিল, তা দিয়ে তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ছায়া দিচ্ছিলেন।
এ হাদীস প্রমাণ করে যে, মুহরিম ব্যক্তির মাথার উপরে কাপড় বা অন্য কোন জিনিসের মাধ্যমে ছায়ার ব্যবস্থা করা বৈধ আছে। এই মত পোষণ করেছেন ইমাম আবূ হানীফা ও ইমাম শাফি‘ঈ (রহঃ), আর অধিকাংশ ‘আলিমগণও এই দুই হাদীসের মাধ্যমে দলীল গ্রহণ করেছেন (অর্থাৎ- উম্মুল হুসায়ন ও আবূ উমামাহ্ (রাঃ)-এর বর্ণিত)। আর আমি (মুবারকপূরী) মালিক ও আহমাদ (রহঃ)-এর মত হল, শুধুমাত্র অবতরণের সময় ছাড়া অন্য কোন সময় মুহরিমের জন্য ছায়ার ব্যবস্থা করা বৈধ নয়। ইমাম আহমাদ (রহঃ) হতে অন্য রিওয়ায়াতে বর্ণিত হয়েছে যে, যদি ছায়ার ব্যবস্থা করে তার জন্য কোন মুক্তিপণ দিতে হবে না। তবে যদি ছাদের নিচে অথবা তাঁবুর নিচে হয় তাহলে বৈধ রয়েছে।
ইমাম মালিক ও আহমাদ (রহঃ) দলীল গ্রহণ করেছেন, ছায়া নিষেধ হওয়ার ব্যাপারে ইমাম বায়হাক্বীর সহীহ সনদে বর্ণিত হাদীস দ্বারা, যা বর্ণনা করেছেন ইবনু ‘উমার (রাঃ) থেকে।
ইমাম শাওকানী (রহঃ) বলেনঃ ইবনু ‘উমার (রাঃ)-এর কথার দ্বারা যে জওয়াব দেয়া হয়েছে তাতে কোন নিষেধের প্রমাণ নেই। আর জাবির-এর হাদীসটি যা বর্ণনা করেছেন ইমাম বায়হাক্বী, তা য‘ঈফ হওয়া সত্ত্বেও এ প্রমাণ বহন করে না যে, ছায়ার ব্যবস্থা করা নিষেধ। আর তাতে যা রয়েছে তা হল উত্তম।
ইমাম নাবাবী (রহঃ) বলেনঃ জাবির-এর হাদীসটি য‘ঈফ হওয়া সত্ত্বেও এতে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। অনুরূপভাবে ‘উমারের কাজ ও কথার মাঝে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। যদি থাকত তাহলে উম্মুল হুসায়ন বর্ণিত হাদীসটিই তার ওপর প্রাধান্য পেত।
‘আল্লামা শানক্বীত্বী (রহঃ) বলেনঃ মালিকীদের নিকটে মুহরিম ব্যক্তির মাথার উপর ছায়ার ব্যবস্থা করা বৈধ নয়, যদি করে তাহলে ফিদিয়া দিতে হবে। আর এ ব্যাপারে যারা বলেছেন ফিদিয়া দেয়া আবশ্যক নয়, তাদের নিকটে এটাই সঠিক। আর উম্মুল হুসায়ন (রাঃ) বর্ণিত হাদীস যাতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মাথার উপর কাপড় দিয়ে ছায়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, এমতাবস্থায় তিনি পাথর নিক্ষেপ করছিলেন। অনুসরণের ক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাতই অধিক উত্তম। মালিকীদের নিকটে বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য মুহরিম ব্যক্তি মাথার উপর কাপড় ঝুলাতে পারে।
পরিচ্ছেদঃ ১১. প্রথম অনুচ্ছেদ - ইহরাম অবস্থায় যা থেকে বেঁচে থাকতে হবে
২৬৮৮-[১১] কা’ব ইবনু ’উজরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় পৌঁছার আগে হুদায়বিয়ায় তাঁর (কা’ব-এর) নিকট দিয়ে গেলেন। তখন তিনি (কা’ব) ইহরাম অবস্থায় একটি হাঁড়ির তলায় আগুন ধরাচ্ছে, আর তার মুখমণ্ডল বেয়ে উকুন ঝরছিল। এটা দেখে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তোমার (গায়ের) পোকা কি তোমাকে কষ্ট দিচ্ছে? তিনি (কা’ব) বললেন, জি, হ্যাঁ। তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তাহলে তুমি তোমার মাথা মুণ্ডন করে ফেলো এবং ছয়জন মিসকীনকে এক ’ফারাক্ব’ খাবার খাওয়াও কিংবা তিনদিন সিয়াম পালন কর অথবা একটি পশু কুরবানী কর। বর্ণনাকারী বলেন, এক ’ফারাক্ব’ তিন সা’-এর সমতুল্য। (বুখারী, মুসলিম)[1]
بَابُ مَا يَجْتَنِبُهُ الْمُحْرِمُ
وَعَنْ كَعْبِ بْنِ عُجْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَرَّ بِهِ وَهُوَ بِالْحُدَيْبِيَةَ قَبْلَ أَنْ يَدْخُلَ مَكَّةَ وَهُوَ مُحْرِمٌ وَهُوَ يُوقِدُ تَحْتَ قِدْرٍ وَالْقَمْلُ تهافت عَلَى وَجْهِهِ فَقَالَ: «أَتُؤْذِيكَ هَوَامُّكَ؟» . قَالَ: نَعَمْ. قَالَ: «فَاحْلِقْ رَأْسَكَ وَأَطْعِمْ فَرَقًا بَيْنَ سِتَّةِ مَسَاكِينَ» . وَالْفَرَقُ: ثَلَاثَةُ آصُعٍ: «أَوْ صُمْ ثَلَاثَةَ أَيَّام أوانسك نسيكة»
ব্যাখ্যা: ইবনু ‘আবদুল বার আহমাদ বিন সালিহ আল মিসরী থেকে বর্ণনা করে বলেছেন, ফিদ্ইয়ার ক্ষেত্রে কা‘ব বিন ‘উজরার হাদীসটিই সুন্নাত এটাই ‘আমলযোগ্য। সাহাবীদের মধ্যে কেবল তিনিই এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন আর তার থেকে কেবল ইবনু আবী লায়লা ও ইবনু মা‘ক্বিল- এ দু’জন বর্ণনা করেছেন। তিনি আরো বলেন, এটা সুন্নাত আহলে কূফা থেকে আহলে মাদিনী এ ‘আমল গ্রহণ করেছেন।
ইমাম যুহরী (রহঃ) বলেন, এ বিষয়টি সম্পর্কে আমি আমাদের ‘উলামায়ে কিরামদের জিজ্ঞেস করেছিলাম এমনকি সা‘ঈদ বিন মুসাইয়্যিবকেও কিন্তু ক’জন মিসকীনকে খাওয়াতে হবে ফিদ্ইয়ার জন্য তা কেউ বর্ণনা করেননি। হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেন, ইবনু সালিহ যা বলেছেন তাতে সমস্যা আছে। কেননা এ রিওয়ায়াতটি কা‘ব বিন ‘উজরা ছাড়াও সাহাবীদের একটি দল বর্ণনা করেছেন। অতঃপর তিনি তাদের উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, উল্লেখিত ব্যক্তিরা ছাড়াও কা‘ব থেকে এ রিওয়ায়াতটি আবূ ওয়ায়িল বর্ণনা করেছেন। যেটি ইমাম নাসায়ীর বর্ণনায় আছে আর ইমাম ইবনু মাজাহ মুহাম্মাদ বিন কা‘ব আল কুরাযীর সূত্রে, ইমাম আহমাদ ইয়াহ্ইয়া বিন জা‘দাহ্-এর সূত্রে।
মুল্লা ‘আলী কারী হানাফী (রহঃ) বলেছেনঃ (ان النبى ﷺ مر به) এখানে বর্ণনাটি অর্থগত হয়েছে। আমি (‘উবায়দুল্লাহ মুবারকপূরী) বলব, অন্য বর্ণনায় আছে, (وقف عل رسول الله ﷺ بالحديبية) অর্থাৎ- তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এসেছিলেন হুদায়বিয়ার সময়।
অপর বর্ণনায় আছে, (اتى على رسول الله ﷺ زمن الحديبية) অর্থাৎ- কা‘ব বিন ‘উজরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট আসলেন হুদায়বিয়ার সময়।
কোন রিওয়ায়াতে আছে, (أتيت رسول الله ﷺ فقال : ادنه فدنوت، فقال : ادنه، فدنوت) অর্থাৎ- আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট আসলাম তিনি আমাকে বললেন, তুমি নিকটে আসো, সুতরাং আমি নিকটে আসলাম তিনি আমাকে আবার বললেন, আরো নিকটে আসো, ফলে আমি আরো নিকটে আসলাম।
কোন রিওয়ায়াতে আছে, (حملت الى رسول الله صلى الله عليه وسلم والقمل يتاثر على وجهى)
অর্থাৎ- আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট আসলাম আর এমতাবস্থায় আমার চেহারায় উকুন হাঁটছিল তখন তিনি বললেন, তোমার অনেক কষ্ট হচ্ছে। অন্য রিওয়ায়াতে আছে, তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে মুহরিম অবস্থায় সাক্ষাৎ করলেন, আর এমতাবস্থায় উকুন তার মাথা ও দাড়ি দিয়ে হাঁটছিল- এটা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানতে পারলেন এবং নাপিত ডেকে তার মাথা হলক করে দিলেন।
(فَاحْلِقْ رَأْسَكَ) এখানে নির্দেশটি (إباحة) তথা বৈধতার অর্থ দিবে এমনই বলেছেন মুল্লা ‘আলী কারী হানাফী (রহঃ) অন্য বর্ণনায় আছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে আদেশ করলেন মাথা মুণ্ডন করতে।
‘আল্লামা বাজী (রহঃ)-এর নির্দেশ ওয়াজিব ও মানদূবের দাবী করলেও, এখানে সম্ভবত নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ মাথা হলকের কাজটিকে মানদূবই বলেছেন। আর মানদূব হওয়াই শ্রেয় মনে করেছেন। কেননা আমরা অপর বর্ণনায় পাই যে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মানুষকে নিষেধ করেছেন নিজের ওপর অতিরিক্ত বোঝা নিতে, যা সে বহন করতে পারবে না। এজন্য আমরা দেখতে পাই হাওলাহ্ বিনতু তুয়াইত-এর জন্য রাতে না ঘুমিয়ে ‘ইবাদাত করতে নিষেধ করেছেন। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, (اكلفوا من العمل ما تطيقون) অর্থাৎ- তোমাদের সাধ্যমতে তোমরা ‘আমল করি।
এখানে (فرقا) ‘‘ফারাক্ব’’ অর্থ হলো مكيال معروف بالمدينة মদীনায় পরিচিত এক প্রকার ওযন যা ১৬ রিতল সমপরিমাণ। হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেন, যখন এটা জানতে পারা গেছে যে, এক ‘‘ফারাক্ব’’ সমপরিমাণ তিন সা', তাহলে বুঝা গেল যে, এক সা' সমান ৫ রিতল ও এক-তৃতীয়াংশ। তবে তার বিপরীত কেউ বলেছেন, এক সা' সমপরিমাণ ৮ রিতল।
‘আল্লামা ত্বীবী (রহঃ) বলেন, সুতরাং প্রতিটি মিসকীন পাবে অর্ধ সা'- এক্ষেত্রে তাদেরকে প্রদত্ত পরিমাণসম হওয়া জরুরী।
‘আল্লামা বদরুদ্দীন ‘আয়নী (রহঃ) বলেছেন, ৬ জন মিসকীনদের যে খাদ্য দিতে বলা হয়েছে তার কম দিলে বৈধ হবে না- এটাই অধিকাংশ ‘আলিমের কথা, তবে ইমাম হানীফা (রহঃ) থেকে বর্ণনা করা হয়েছে যে, এসব খাদ্য একজন মিসকীনকে দিলেও তা যথেষ্ট হবে।
(أَوْ صُمْ ثَلَاثَةَ أَيَّامِ)-এর ব্যাখ্যাঃ এ কথাটি কুরআনে কারীমের (ففدية من صيام) এর ব্যাখ্যা স্বরূপ।
ইবনুত্ তীন সহ অন্যান্যরা বলেছেন, এখানে শারী‘আত প্রণেতা একটি সওমকে এক সা'-এর স্থলাভিষিক্ত করেছেন, অপরদিকে রমাযান মাসের একটি সওমকে এক মুদ সমপরিমাণ করা হয়েছে। অনুরূপভাবে যিহার তথা স্বামীর পক্ষ থেকে স্ত্রীকে ‘‘মা’’-এর পিঠের সাথে সাদৃশ্য দেয়া এবং রমাযান মাসে দিনে স্ত্রী সহবাসের ক্ষেত্রে এবং শপথ ভঙ্গের কাফফারার ক্ষেত্রে যে সওম রাখতে হয় তাকে তিন মুদ-এর এবং এক-তৃতীয়াংশের সমতুল্য বলা হয়েছে। সুতরাং এখান থেকে বুঝা গেল, শারী‘আত কর্তৃক নির্ধারিত কোন বিষয়ে ক্বিয়াসের কোন দখল নেই যেখানে যা নির্ধারিত সেখানে তাই মানতে হবে। হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) তাঁর ‘ফাতহুল বারী’-তে এমনটাই বলেছেন।
এ হাদীস থেকে আরো বুঝা গেল যে, মাথার চুল হলক করার জন্য যে ফিদিয়া আবশ্যক হয়েছে তা যদি কেউ সওমের মাধ্যমে আদায় করেন তাহলে তাকে তিনটি সওম রাখতে হবে। অবশ্য ইতিপূর্বে হাসান বাসরী (রহঃ) থেকে বর্ণনা গেছে সেখানে রয়েছে, দশদিন সওম পালনের কথা।
‘আল্লামা ইবনু কাসীর (রহঃ) এ প্রসঙ্গে বলেছেন, হাসান (রহঃ)-এর হাদীসটি একটি বিরল কথা এতে সমস্যা রয়েছে কেননা কা‘ব বিন ‘উজরাহ্ (রাঃ)-এর হাদীস থেকে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে, তিনদিন সওম পালনের কথা দশদিন নয়।
ইবনু ‘আবদুল বার (রহঃ) বলেছেন, তার ‘‘আল ইসতিযকার’’ নামক কিতাবে হাসান বাসরী (রহঃ) ‘ইকরামাহ্ এবং নাফি' থেকে দশদিন সাওম পালনের যে কথা এসেছে তা কেউ সমর্থন করেননি।
এ ক্ষেত্রে আরেক মাসআলাহ্ হলো, এ সওম রাখার বিষয়ে অর্থাৎ- তা মক্কাতে অবস্থানকালেই রাখতে হবে না বাড়িতে এসে রাখতে হবে- এ ব্যাপারে চার ইমামসহ অন্যান্যদের ঐকমত্যে যেখানে খুশি সেখানেই রাখা যাবে, তবে খাদ্য খাওয়ানোর বিষয়ে মতপার্থক্য আছে। ইমাম শাফি‘ঈ ও ইমাম আহমাদ বলেছেন, হারামের অবস্থানের সময়েই খাওয়াতে হবে। তবে ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ) ও ইমাম মালিক (রহঃ) বলেছেন, যেখানে খুশি সেখানেই খাওয়াতে পারবে।