পরিচ্ছেদঃ ১১. প্রথম অনুচ্ছেদ - ইহরাম অবস্থায় যা থেকে বেঁচে থাকতে হবে
২৬৮৮-[১১] কা’ব ইবনু ’উজরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় পৌঁছার আগে হুদায়বিয়ায় তাঁর (কা’ব-এর) নিকট দিয়ে গেলেন। তখন তিনি (কা’ব) ইহরাম অবস্থায় একটি হাঁড়ির তলায় আগুন ধরাচ্ছে, আর তার মুখমণ্ডল বেয়ে উকুন ঝরছিল। এটা দেখে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তোমার (গায়ের) পোকা কি তোমাকে কষ্ট দিচ্ছে? তিনি (কা’ব) বললেন, জি, হ্যাঁ। তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তাহলে তুমি তোমার মাথা মুণ্ডন করে ফেলো এবং ছয়জন মিসকীনকে এক ’ফারাক্ব’ খাবার খাওয়াও কিংবা তিনদিন সিয়াম পালন কর অথবা একটি পশু কুরবানী কর। বর্ণনাকারী বলেন, এক ’ফারাক্ব’ তিন সা’-এর সমতুল্য। (বুখারী, মুসলিম)[1]
بَابُ مَا يَجْتَنِبُهُ الْمُحْرِمُ
وَعَنْ كَعْبِ بْنِ عُجْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَرَّ بِهِ وَهُوَ بِالْحُدَيْبِيَةَ قَبْلَ أَنْ يَدْخُلَ مَكَّةَ وَهُوَ مُحْرِمٌ وَهُوَ يُوقِدُ تَحْتَ قِدْرٍ وَالْقَمْلُ تهافت عَلَى وَجْهِهِ فَقَالَ: «أَتُؤْذِيكَ هَوَامُّكَ؟» . قَالَ: نَعَمْ. قَالَ: «فَاحْلِقْ رَأْسَكَ وَأَطْعِمْ فَرَقًا بَيْنَ سِتَّةِ مَسَاكِينَ» . وَالْفَرَقُ: ثَلَاثَةُ آصُعٍ: «أَوْ صُمْ ثَلَاثَةَ أَيَّام أوانسك نسيكة»
ব্যাখ্যা: ইবনু ‘আবদুল বার আহমাদ বিন সালিহ আল মিসরী থেকে বর্ণনা করে বলেছেন, ফিদ্ইয়ার ক্ষেত্রে কা‘ব বিন ‘উজরার হাদীসটিই সুন্নাত এটাই ‘আমলযোগ্য। সাহাবীদের মধ্যে কেবল তিনিই এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন আর তার থেকে কেবল ইবনু আবী লায়লা ও ইবনু মা‘ক্বিল- এ দু’জন বর্ণনা করেছেন। তিনি আরো বলেন, এটা সুন্নাত আহলে কূফা থেকে আহলে মাদিনী এ ‘আমল গ্রহণ করেছেন।
ইমাম যুহরী (রহঃ) বলেন, এ বিষয়টি সম্পর্কে আমি আমাদের ‘উলামায়ে কিরামদের জিজ্ঞেস করেছিলাম এমনকি সা‘ঈদ বিন মুসাইয়্যিবকেও কিন্তু ক’জন মিসকীনকে খাওয়াতে হবে ফিদ্ইয়ার জন্য তা কেউ বর্ণনা করেননি। হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেন, ইবনু সালিহ যা বলেছেন তাতে সমস্যা আছে। কেননা এ রিওয়ায়াতটি কা‘ব বিন ‘উজরা ছাড়াও সাহাবীদের একটি দল বর্ণনা করেছেন। অতঃপর তিনি তাদের উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, উল্লেখিত ব্যক্তিরা ছাড়াও কা‘ব থেকে এ রিওয়ায়াতটি আবূ ওয়ায়িল বর্ণনা করেছেন। যেটি ইমাম নাসায়ীর বর্ণনায় আছে আর ইমাম ইবনু মাজাহ মুহাম্মাদ বিন কা‘ব আল কুরাযীর সূত্রে, ইমাম আহমাদ ইয়াহ্ইয়া বিন জা‘দাহ্-এর সূত্রে।
মুল্লা ‘আলী কারী হানাফী (রহঃ) বলেছেনঃ (ان النبى ﷺ مر به) এখানে বর্ণনাটি অর্থগত হয়েছে। আমি (‘উবায়দুল্লাহ মুবারকপূরী) বলব, অন্য বর্ণনায় আছে, (وقف عل رسول الله ﷺ بالحديبية) অর্থাৎ- তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এসেছিলেন হুদায়বিয়ার সময়।
অপর বর্ণনায় আছে, (اتى على رسول الله ﷺ زمن الحديبية) অর্থাৎ- কা‘ব বিন ‘উজরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট আসলেন হুদায়বিয়ার সময়।
কোন রিওয়ায়াতে আছে, (أتيت رسول الله ﷺ فقال : ادنه فدنوت، فقال : ادنه، فدنوت) অর্থাৎ- আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট আসলাম তিনি আমাকে বললেন, তুমি নিকটে আসো, সুতরাং আমি নিকটে আসলাম তিনি আমাকে আবার বললেন, আরো নিকটে আসো, ফলে আমি আরো নিকটে আসলাম।
কোন রিওয়ায়াতে আছে, (حملت الى رسول الله صلى الله عليه وسلم والقمل يتاثر على وجهى)
অর্থাৎ- আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট আসলাম আর এমতাবস্থায় আমার চেহারায় উকুন হাঁটছিল তখন তিনি বললেন, তোমার অনেক কষ্ট হচ্ছে। অন্য রিওয়ায়াতে আছে, তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে মুহরিম অবস্থায় সাক্ষাৎ করলেন, আর এমতাবস্থায় উকুন তার মাথা ও দাড়ি দিয়ে হাঁটছিল- এটা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানতে পারলেন এবং নাপিত ডেকে তার মাথা হলক করে দিলেন।
(فَاحْلِقْ رَأْسَكَ) এখানে নির্দেশটি (إباحة) তথা বৈধতার অর্থ দিবে এমনই বলেছেন মুল্লা ‘আলী কারী হানাফী (রহঃ) অন্য বর্ণনায় আছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে আদেশ করলেন মাথা মুণ্ডন করতে।
‘আল্লামা বাজী (রহঃ)-এর নির্দেশ ওয়াজিব ও মানদূবের দাবী করলেও, এখানে সম্ভবত নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ মাথা হলকের কাজটিকে মানদূবই বলেছেন। আর মানদূব হওয়াই শ্রেয় মনে করেছেন। কেননা আমরা অপর বর্ণনায় পাই যে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মানুষকে নিষেধ করেছেন নিজের ওপর অতিরিক্ত বোঝা নিতে, যা সে বহন করতে পারবে না। এজন্য আমরা দেখতে পাই হাওলাহ্ বিনতু তুয়াইত-এর জন্য রাতে না ঘুমিয়ে ‘ইবাদাত করতে নিষেধ করেছেন। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, (اكلفوا من العمل ما تطيقون) অর্থাৎ- তোমাদের সাধ্যমতে তোমরা ‘আমল করি।
এখানে (فرقا) ‘‘ফারাক্ব’’ অর্থ হলো مكيال معروف بالمدينة মদীনায় পরিচিত এক প্রকার ওযন যা ১৬ রিতল সমপরিমাণ। হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেন, যখন এটা জানতে পারা গেছে যে, এক ‘‘ফারাক্ব’’ সমপরিমাণ তিন সা', তাহলে বুঝা গেল যে, এক সা' সমান ৫ রিতল ও এক-তৃতীয়াংশ। তবে তার বিপরীত কেউ বলেছেন, এক সা' সমপরিমাণ ৮ রিতল।
‘আল্লামা ত্বীবী (রহঃ) বলেন, সুতরাং প্রতিটি মিসকীন পাবে অর্ধ সা'- এক্ষেত্রে তাদেরকে প্রদত্ত পরিমাণসম হওয়া জরুরী।
‘আল্লামা বদরুদ্দীন ‘আয়নী (রহঃ) বলেছেন, ৬ জন মিসকীনদের যে খাদ্য দিতে বলা হয়েছে তার কম দিলে বৈধ হবে না- এটাই অধিকাংশ ‘আলিমের কথা, তবে ইমাম হানীফা (রহঃ) থেকে বর্ণনা করা হয়েছে যে, এসব খাদ্য একজন মিসকীনকে দিলেও তা যথেষ্ট হবে।
(أَوْ صُمْ ثَلَاثَةَ أَيَّامِ)-এর ব্যাখ্যাঃ এ কথাটি কুরআনে কারীমের (ففدية من صيام) এর ব্যাখ্যা স্বরূপ।
ইবনুত্ তীন সহ অন্যান্যরা বলেছেন, এখানে শারী‘আত প্রণেতা একটি সওমকে এক সা'-এর স্থলাভিষিক্ত করেছেন, অপরদিকে রমাযান মাসের একটি সওমকে এক মুদ সমপরিমাণ করা হয়েছে। অনুরূপভাবে যিহার তথা স্বামীর পক্ষ থেকে স্ত্রীকে ‘‘মা’’-এর পিঠের সাথে সাদৃশ্য দেয়া এবং রমাযান মাসে দিনে স্ত্রী সহবাসের ক্ষেত্রে এবং শপথ ভঙ্গের কাফফারার ক্ষেত্রে যে সওম রাখতে হয় তাকে তিন মুদ-এর এবং এক-তৃতীয়াংশের সমতুল্য বলা হয়েছে। সুতরাং এখান থেকে বুঝা গেল, শারী‘আত কর্তৃক নির্ধারিত কোন বিষয়ে ক্বিয়াসের কোন দখল নেই যেখানে যা নির্ধারিত সেখানে তাই মানতে হবে। হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) তাঁর ‘ফাতহুল বারী’-তে এমনটাই বলেছেন।
এ হাদীস থেকে আরো বুঝা গেল যে, মাথার চুল হলক করার জন্য যে ফিদিয়া আবশ্যক হয়েছে তা যদি কেউ সওমের মাধ্যমে আদায় করেন তাহলে তাকে তিনটি সওম রাখতে হবে। অবশ্য ইতিপূর্বে হাসান বাসরী (রহঃ) থেকে বর্ণনা গেছে সেখানে রয়েছে, দশদিন সওম পালনের কথা।
‘আল্লামা ইবনু কাসীর (রহঃ) এ প্রসঙ্গে বলেছেন, হাসান (রহঃ)-এর হাদীসটি একটি বিরল কথা এতে সমস্যা রয়েছে কেননা কা‘ব বিন ‘উজরাহ্ (রাঃ)-এর হাদীস থেকে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে, তিনদিন সওম পালনের কথা দশদিন নয়।
ইবনু ‘আবদুল বার (রহঃ) বলেছেন, তার ‘‘আল ইসতিযকার’’ নামক কিতাবে হাসান বাসরী (রহঃ) ‘ইকরামাহ্ এবং নাফি' থেকে দশদিন সাওম পালনের যে কথা এসেছে তা কেউ সমর্থন করেননি।
এ ক্ষেত্রে আরেক মাসআলাহ্ হলো, এ সওম রাখার বিষয়ে অর্থাৎ- তা মক্কাতে অবস্থানকালেই রাখতে হবে না বাড়িতে এসে রাখতে হবে- এ ব্যাপারে চার ইমামসহ অন্যান্যদের ঐকমত্যে যেখানে খুশি সেখানেই রাখা যাবে, তবে খাদ্য খাওয়ানোর বিষয়ে মতপার্থক্য আছে। ইমাম শাফি‘ঈ ও ইমাম আহমাদ বলেছেন, হারামের অবস্থানের সময়েই খাওয়াতে হবে। তবে ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ) ও ইমাম মালিক (রহঃ) বলেছেন, যেখানে খুশি সেখানেই খাওয়াতে পারবে।