পরিচ্ছেদঃ ২. প্রথম অনুচ্ছেদ - ক্ষমা ও তাওবাহ্
হাফেয বলেনঃ الاستغفار শব্দটি الغفران থেকে, যার মূল الغفر আর তা হল কোন জিনিসকে এমন কিছু পরিধান করানো যা তাকে ময়লাযুক্ত হওয়া থেকে রক্ষা করবে। আর আল্লাহর তরফ থেকে বান্দাকে ক্ষমা করা বলতে বান্দাকে তাঁর শাস্তি থেকে রক্ষা করা।
কারী বলেন, الاستغفار শব্দটি কখনো তাওবাকে শামিল করে আবার কখনো তাওবাকে শামিল করে না। এ জন্য الاستغفار শব্দের পর التوبة শব্দ উল্লেখ করা হয়েছে। অথবা الاستغفار তথা ক্ষমা প্রার্থনা জবান দিয়ে হয়, পক্ষান্তরে তওবা্ অন্তর দিয়ে হয় আর তা হল অবাধ্যতা থেকে আনুগত্যের দিকে প্রত্যাবর্তন করা আর আল্লাহর তরফ থেকে বান্দাকে ক্ষমা করা বলতে ইহকালে বান্দার গুনাহ কাউকে অবহিত করা থেকে গোপন করে রাখা এবং পরকালে সে গুনাহের কারণে তাকে শাস্তি না দেয়া।
ইমাম ত্বীবী বলেন, শারী’আতের পরিভাষায় তওবা্ হল, পাপ দোষণীয় হওয়ার কারণে তা বর্জন করা, এবং কৃত বাড়াবাড়ির কারণে লজ্জিত হওয়া, অভ্যস্ত বিষয় বর্জন ও কর্মের ক্ষতিপূরণে নিজেকে দৃঢ় করে এমন কাজ করা। এটি রাগিবের উক্তি। ইমাম নাবাবী এক্ষেত্রে একটু বেশি বলেছেন, তিনি বলেন, গুনাহ যদি আদম সন্তানের সাথে সম্পর্কিত হয় তাহলে তার আরেকটি শর্ত আছে। আর তা হল, অবিচার করা পরিমাণ বিষয় তার মালিকের কাছে ফেরত দিতে হবে অথবা তার কাছ থেকে ক্ষমা নিতে হবে।
ইবনুল কইয়্যিম মাদারিজুস্ সালিকীন-এ ১ম খণ্ড- ১৬৯ পৃষ্ঠাতে সাধারণ তাওবার তাফসীরের আলোচনাতে বলেন, অনেক মানুষ তাওবার তাফসীর করে থাকেন কোন গুনাহ দ্বিতীয়বার না করার ব্যাপারে দৃঢ়তা ব্যক্ত করা এবং অবিলম্বে সে কাজ থেকে সরে আসা। অতীতের কাজের ব্যাপারে লজ্জিত হওয়া আর যদি ঐ গুনাহটি আদম সন্তানের অধিকার সংক্রান্ত হয় তাহলে চতুর্থ আরেকটি বিষয় প্রয়োজন তা হল আদম সন্তান থেকে ক্ষমা নেয়া।
কতকে এ বিষয়টি তাওবার ক্ষেত্রে উল্লেখ করেছেন বরং একে শর্ত করেছেন। আমার কাছে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের কালামের ক্ষেত্রে তওবা্ হল, তা যেমন অনেক মানুষের উল্লেখিত সংজ্ঞাকে শামিল করে তেমনিভাবে নির্দেশিত কাজের ব্যাপারে দৃঢ়তাকে ও তা আঁকড়িয়ে ধরাকে শামিল করে। সুতরাং শুধুমাত্র কোন কাজ করা থেকে সরে আসা, কোন কাজ না করার ব্যাপারে দৃঢ়তা ব্যক্ত করা, কোন কৃতকর্মের ব্যাপারে লজ্জিত হওয়ার মাধ্যমে তওবা্ সংঘটিত হয় না বরং যতক্ষণ না কর্তার তরফ থেকে নির্দেশিত কাজের ব্যাপারে দৃঢ়তা পাওয়া যায়। এটিই হল তাওবার প্রকৃত রূপ। আর তা হল দু’টি বিষয়ের সমষ্টির নাম। কিন্তু তওবা্ যখন নির্দেশিত কাজের সাথে শামিল হবে তখন তা পূর্বে অনেকের উল্লেখিত সংজ্ঞার ভাষ্য হবে আর যখন তা আলাদাভাবে আসবে তখন তা দু’টি বিষয়কে শামিল করবে আর তা ঐ তাকওয়া শব্দের মতো যা একাকী বা আলাদা প্রয়োগ হলে তা আল্লাহর নির্দেশিত কাজ করা এবং নিষেধ করা কাজ বর্জন করাকে বুঝায়।
পক্ষান্তরে তা নির্দেশিত কাজের সাথে শামিল হওয়ার সময় নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকাকে দাবী করবে। কেননা তাওবার প্রকৃত রূপ হল আল্লাহ যা ভালবাসেন সে কাজ অবলম্বন এবং তিনি যা অপছন্দ করেন তা বর্জনের মাধ্যমে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন। সুতরাং প্রিয় বস্ত্তর দিকে প্রত্যাবর্তন করা তাওবার একটি অংশ এবং অপছন্দনীয় জিনিস হতে ফিরে আসা তাওবার আরেকটি অংশ আর এজন্য আল্লাহ সাধারণ সফলতাকে তাওবার মাধ্যমে নির্দেশিত কাজ করা ও নিষিদ্ধ কাজ বর্জন করার সাথে সম্পৃক্ত করেছেন, যেমন আল্লাহ বলেন, ’’হে মু’মিনগণ! তোমরা সকলে আল্লাহর কাছে তওবা্ কর যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার’’- (সূরা আন্ নূর ২৪ : ৩১)। সুতরাং প্রত্যেক তওবাকারী সফলকাম। আর নির্দেশিত কাজ করা এবং নিষিদ্ধ কাজ বর্জন করা ছাড়া কেউ সফলকাম হতে পারবে না। আল্লাহ আরো বলেন, ’’আর যারা তওবা্ করেনি তারাই অবিচারকারী’’- (সূরা আল হুজুরাত ৪৯ : ১১)। নির্দেশিত কাজ বর্জনকারী যালিম যেমন নিষিদ্ধ কাজ সম্পাদনকারী যালিম। আর দু’টি বিষয়কে সমন্বয়কারী তওবা্ এর মাধ্যমে যুলমের অপসারণ হয়। তিনি বলেন, তওবাকারীকে তওবাকারী বলে নামকরণ করার কারণ তওবাকারী আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজ থেকে তাঁর নির্দেশিত কাজের দিকে প্রত্যাবর্তন এবং তাঁর অবাধ্যতা থেকে আনুগত্যের দিকে ফিরে আসে।
আল্লাহ তওবাকারী ও পবিত্রতা অর্জনকারীদেরকে ভালবাসেন। আল্লাহ কেবল তাকে ভালবাসেন যে তাঁর নির্দেশিত বিষয় সম্পাদন করে এবং তাঁর নিষেধ করা বিষয় থেকে দূরে থাকে। সুতরাং তওবা্ হল, বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণভাবে আল্লাহর নিষেধ করা বিষয় থেকে ফিরে আসা এবং তাঁর পছন্দনীয় বিষয়ের দিকে প্রত্যাবর্তন করা। এমতাবস্থায় তাওবার নামের মাঝে ইসলাম, ঈমান, ইহসানও প্রবেশ করবে এবং তওবা্ পূর্বোক্ত সকল সংজ্ঞাগুলোকে শামিল করবে।
তওবা্ দ্বারা বান্দা আল্লাহর অনুগত হয়। আর এ আনুগত্যের স্তর চারটিঃ
প্রথম স্তরঃ সৃষ্টির মাঝে অংশিদারিত্ব আর তা হল প্রয়োজনের অনুগত এবং আল্লাহর প্রতি মুখাপেক্ষীতা। সুতরাং আকাশবাসী এবং জমিনবাসী সকলেই তাঁর নিকট মুখাপেক্ষী তাঁর নিকট নিঃস্ব। আর তিনি আল্লাহই একমাত্র সত্তা যিনি তাদের থেকে অমুখাপেক্ষী। আকাশবাসী এবং জমিনবাসী প্রত্যেকেই তার কাছে চায় পক্ষান্তরে তিনি কারো কাছে চান না।
দ্বিতীয় স্তরঃ আনুগত্য ও দাসত্বের স্তর আর তা স্বেচ্ছাধীন অনুগত আর এটি হল তার অনুগতদের সাথে নির্দিষ্ট আর এটি দাসত্বের গোপন।
তৃতীয় স্তরঃ ভালবাসার অনুগত কেননা যে ভালবাসে সে প্রিয় সত্তার অনুগত। সত্তার প্রতি ব্যক্তির ভালবাসার পরিমাণ অনুপাতে তার ভালবাসা সাব্যস্ত হয় সুতরাং ভালবাসাকে ভিত্তি দেয়া হয়েছে ভালবাসার পাত্রের প্রতি বিনয় প্রদর্শনের উপর।
চতুর্থ স্তরঃ অবাধ্যতা ও অপরাধের বশ্যতা।
সুতরাং এ চারটি স্তর যখন একত্রিত হয় তখন বিনয় নম্রতা একমাত্র আল্লাহর জন্য ও পূর্ণাঙ্গভাবে সাব্যস্ত হয়। কেননা ব্যক্তি তার ভয়ে, আশংকায়, ভালবাসায়, প্রত্যাবর্তন, আনুগত্যের সাথে এবং তার দিকে মুখাপেক্ষী হয়ে বিনয় প্রকাশ করে।
২৩২৩-[১] আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহর কসম! আমি প্রতিদিন সত্তরবারেরও বেশি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই ও তওবা্ করি। (বুখারী)[1]
بَابُ الْاِسْتِغْفَارِ وَالتَّوْبَةِ
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «وَاللَّهِ إِنِّي لِأَسْتَغْفِرُ اللَّهَ وَأَتُوبُ إِلَيْهِ فِي الْيَوْمِ أَكْثَرَ مِنْ سبعينَ مرَّةً» . رَوَاهُ البُخَارِيّ
ব্যাখ্যা: (إِنِّىْ لِأَسْتَغْفِرُ اللّٰهَ وَأَتُوبُ إِلَيْهِ) এখানে استغفار এর হুবহু শব্দ উদ্দেশিত হওয়ার সম্ভাবনা রাখছে আর ‘আবদুল্লাহ বিন ‘উমার (রাঃ) থেকে মুজাহিদের জাইয়িদ (উত্তম) সানাদে নাসায়ী সংকলন করেছেন তা একে সমর্থন করছে। আর তা হল নিশ্চয়ই ‘আবদুল্লাহ বিন ‘উমার (রাঃ) রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বৈঠক থেকে দাঁড়ানোর পূর্বে একশত বার (استغفر الله الذى لا إله إلا هو الحى القيوم وأتوب إليه) এ দু‘আটি বলতে শুনেছেন। সম্ভাবনা রয়েছে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দু‘আটির দ্বারা ক্ষমা অনুসন্ধান করতেন এবং তাওবার ব্যাপারে দৃঢ়তা ব্যক্ত করতেন ও তাওবাহ্ করতেন। আর অচিরেই ‘আবদুল্লাহ ‘উমার (রাঃ)-এর হাদীস কর্তৃক দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের শেষে যা আসছে তা একে সমর্থন করছে। সে হাদীসে ‘আবদুল্লাহ বিন ‘উমার (রাঃ) বলেন, নিশ্চয়ই আমরা বৈঠকে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য (رب اغفرلى وتب على إنك أنت التواب الغفور) এ দু‘আটি একশতবার গণনা করতাম। একে আহমাদ, তিরমিযী, আবূ দাঊদ, নাসায়ী ও ইবনু মাজাহ মুহাম্মাদ বিন সূকহ্’র সানাদে সংকলন করেছেন আর সূকহ্ নাফি' থেকে আর নাফি' ‘আবদুল্লাহ বিন ‘উমার থেকে বর্ণনা করেন।
(أَكْثَرَ مِنْ سَبْعِيْنَ مَرَّةً) এভাবে বুখারীতে শু‘আয়ব-এর বর্ণনাতে আছে, শু‘আয়ব যুহরী থেকে আর যুহরী আবূ সালামাহ্ থেকে, আবূ সালামাহ্ আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে। তিরমিযীতে এবং ইবনুস্ সিন্নীতে মা‘মার-এর বর্ণনাতে আছে, মা‘মার যুহরী থেকে যুহরী আবূ সালামাহ্ থেকে বর্ণনা করেন। তাতে আছে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি দিনে সত্তরবার ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকি। অনুরূপভাবে আবূ ইয়া‘লা আল বাযযার ‘ত্ববারানী’ গ্রন্থে আনাস-এর হাদীসে এসেছে। সুতরাং এখানে সংখ্যা আধিক্যতা উদ্দেশ্য হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ‘আরবরা সাত, সত্তর, সাতশত সংখ্যাকে আধিক্যতার স্থলে প্রয়োগ করে থাকে। নির্দিষ্ট সংখ্যা উদ্দেশ্য হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিতাবের বর্ণনাতে أكثر শব্দটি অস্পষ্ট। সুতরাং তা ইবনু ‘উমারের উল্লেখিত হাদীস দ্বারা ব্যাখ্যাকৃত হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে, আর নিশ্চয়ই তা শতকে পৌঁছবে। নাসায়ীতে মুহাম্মাদ বিন ‘আমর-এর বর্ণনাতে আছে, তিনি আবূ সালামাহ্ থেকে আর তিনি আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন। ইবনু মাজাতে (إنى لأستغفر الله وأتوب إليه كل يوم مائة مرة) অবশ্যই আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা ও তার কাছে তাওবাহ্ করে থাকি, প্রত্যেক দিন একশতবার আর আগার্-এর আগত হাদীসে আছে, (وإنى لأستغفر الله كل يوم مائة مرة) আর নিশ্চয়ই আমি প্রত্যেক দিন আল্লাহর কাছে একশতবার তাওবাহ্ করে থাকি। তিনটি বর্ণনা উল্লেখের পর ইমাম শাওকানী বলেন, সর্বাধিক সংখ্যাকে গ্রহণ করাই উচিত হবে আর তা হল শতকের বর্ণনা। সুতরাং ব্যক্তি প্রত্যেক দিন একশত বার (اللهم إنى أستغفرك فاغفرلى وأتوب إليك فتب على) পাঠ করে তাহলে সে চাওয়ার দু’টি প্রান্তকে অবলম্বন করল। আর আল্লাহ সুবহানাহূ ওয়াতা‘আলা বলেন, غَافِرِ الذَّنْبِ وَقَابِلِ التَّوْبِِ ‘‘গুনাহ ক্ষমাকারী ও তাওবাহ্ কবূলকারী’’- (সূরা গাফির/আল মু’মিন ৪০ : ৩)।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে ক্ষমা প্রার্থনা সংঘটিত হওয়া মুশকিল, কেননা তিনি গুনাহ থেকে সুরক্ষিত। পক্ষান্তরে ক্ষমা প্রার্থনা অবাধ্যতায় লিপ্ত হওয়াকে দাবী করে। এ প্রশ্নের কয়েকটি উত্তর দেয়া হয়েছে। তন্মধ্যে একটি হল, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ক্ষমা প্রার্থনা দ্বারা উদ্দেশ্য হল তার ঐ প্রকৃত ক্ষমা প্রার্থনা যা আগত আগার্-এর হাদীসে সংঘটিত হয়েছে। এর ব্যাখ্যা হল, ইবনুল জাওযীর উক্তি আর তা হল মানবিক বৈশিষ্ট্যের অপরাধ যা থেকে কেউ বাঁচতে পারে না, নাবীগণ যদিও কাবীরাহ্ গুনাহ থেকে বাঁচতে পারে কিন্তু তারা সগীরাহ্ গুনাহ থেকে বাঁচতে পারে না আর তা ইচ্ছার বিপরীতে অবস্থিত, তবে প্রাধান্যযোগ্য কথা হল সগীরাহ্ গুনাহ থেকেও নাবীগণ বেঁচে থাকা। সে উত্তরগুলোর আরেকটি হল, ইবনু বাত্ত্বাল-এর উক্তি আর তা হল আল্লাহ নাবীদেরকে আল্লাহর পরিচিতি থেকে যা দান করেছেন তার কারণে তারা মানুষের মাঝে ‘ইবাদাতে সর্বাধিক চেষ্টাকারী। তারা সর্বদা তার কৃতজ্ঞতায় লিপ্ত। তারা তার কাছে অক্ষমতা স্বীকারকারী।
নিশ্চয়ই আল্লাহর উদ্দেশে যা ওয়াজিব এমন হক আদায়ের ক্ষেত্রে ক্ষমা প্রার্থনা অক্ষমতার অন্তর্ভুক্ত। আরো সম্ভাবনা রয়েছে, একজন নাবীর ক্ষমা প্রার্থনা মূলত বৈধ বিষয়াবলী তথা খাওয়া, পান করা, সহবাস করা, ঘুম, শান্তি নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে অথবা কথোপকথনের কারণে, তাদের কল্যাণের দিকে দৃষ্টি দেয়া, কখনো তাদের শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করা, কখনো শত্রুর সাথে কোমল আচরণ করা এবং অন্যান্য কাজ করা যা তাকে আল্লাহর যিকিরের প্রতি ব্যস্ত হওয়া ও তার নিকট অনুনয়-বিনয় করা থেকে বাধা দেয় এবং এমন সকল কাজ বিচক্ষণতার সাথে লক্ষ্য করে সুউচ্চ স্থানের দিকে লক্ষ্য করে তা পাপ মনে করা আর এ কারণে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। আর সে উত্তরগুলো থেকে আরেকটি হল নিশ্চয়ই ক্ষমা প্রার্থনা উম্মাতকে শিক্ষাদান ও শারী‘আত প্রণয়নের উদ্দেশে। অথবা তার উম্মাতের গুনাহের কারণে, সুতরাং তা উম্মাতের জন্য সুপারিশ স্বরূপ।
পরিচ্ছেদঃ ২. প্রথম অনুচ্ছেদ - ক্ষমা ও তাওবাহ্
২৩২৪-[২] আগার আল মুযানী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমার অন্তরে মরিচা পড়ে, আর (ওই মরিচা পরিষ্কার করার জন্য) আমি দিনে একশ’বার করে ইস্তিগফার করি। (মুসলিম)[1]
بَابُ الْاِسْتِغْفَارِ وَالتَّوْبَةِ
وَعَنِ الْأَغَرِّ الْمُزَنِيِّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «إِنَّهُ لَيُغَانُ عَلَى قَلْبِي وَإِنِّي لَأَسْتَغْفِرُ اللَّهَ فِي الْيَوْم مائَة مرّة» . رَوَاهُ مُسلم
ব্যাখ্যা: কারী বলেন, ‘আরবদের মাঝে বলা হয় غين عليه অর্থাৎ- বস্ত্তটি তার উপর আচ্ছাদন করে নিয়েছে।
(عَلٰى قَلْبِىْ) অর্থাৎ- যা অন্তরকে আচ্ছাদন করে নেয়, ভুল এবং খাদ্য সম্বন্ধীয় বিষয়, জৈবিক চাহিদা সম্বন্ধীয় বিষয় ও অনুরূপ চাহিদা সম্বন্ধীয় বিষয় নাফসের অনুকূলের দিকে দৃষ্টি দেয়ার কারণে যা হতে মানুষ মুক্ত থাকতে পারে না। নিশ্চয়ই তা আবরণ ও মেঘমালার মত যা অন্তরকে আচ্ছাদন করে নেয় ফলে তার মাঝে ও উচ্চ পরিষদবর্গের মাঝে আড়াল সৃষ্টি করে, অতঃপর অন্তর স্বচ্ছকরণ ও আচ্ছাদনকে দূরীকরণের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আর তা যদিও গুনাহ নয় কিন্তু তা তার সমস্ত অবস্থার প্রতি সম্বন্ধ করে ঘাটতি ও মানবিক নিম্ন অবস্থার দিকে অবতরণ যা গুনাহের সাথে সাদৃশ্য রাখে ফলে তার পক্ষে ক্ষমা প্রার্থনা করা উপযোগী হয়ে যায়।
‘উবায়দুল্লাহ মুবারকপূরী বলেন, আমি বলব, বিদ্বানগণ এ হাদীসের অর্থ বর্ণনা ও ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে নিশ্চল হয়ে গেছেন। এমনকি ইমাম সুয়ূত্বী বলেন, এ হাদীস মুতাশাবিহ হাদীসের অন্তর্ভুক্ত যার অর্থ জানা যায় না। এ হাদীসের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে আসমা‘ঈ অভিধানের সামনে থমকে গেছেন এবং বলেছেন, ব্যাপারটি যদি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অন্তর ছাড়া অন্যের অন্তর সম্পর্কে হত, অবশ্যই তার ব্যাপারে আমি উক্তি করতাম এবং তার ব্যাখ্যা করতাম তবে ‘আরবগণ الغين বলতে পাতলা মেঘমালাকে বুঝায়।
সিনদী বলেন, এর প্রকৃত রূপকে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অন্তরের দিকে দৃষ্টি দিয়ে জানা যায় না, আর নিশ্চয়ই রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সম্মান অনেক ধারণাতে যা জাগ্রত হয় তার অপেক্ষা মহত্তর ও সুমহান। সুতরাং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দিকে তা সোপর্দ করে দেয়াই উত্তম। আর তা হল নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিশেষ একটি অবস্থা অর্জন হত যা ক্ষমা প্রার্থনার দিকে আহবান করত। অতঃপর তিনি প্রত্যেক দিন একশতবার ক্ষমা প্রার্থনা করতেন। সুতরাং তিনি ছাড়া অন্যের ক্ষেত্রে কি পরিমাণ ক্ষমা প্রার্থনা করা প্রয়োজন হতে পারে? এ বিষয়ে আল্লাহই সর্বাধিক জ্ঞাত।
(فِى الْيَوْمِ مِائَةَ مَرَّةٍ) মানাবী বলেন, এখানে مائة বা শতবার দ্বারা আধিক্যতা বুঝানো হয়েছে। সুতরাং এটি سبعين বর্ণনার পরিপন্থী নয়।
পরিচ্ছেদঃ ২. প্রথম অনুচ্ছেদ - ক্ষমা ও তাওবাহ্
২৩২৫-[৩] উক্ত রাবী [আগার আল মুযানী (রাঃ)] হতে এ হাদীসটিও বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ হে মানবমন্ডলী! আল্লাহর কাছে তওবা্ করো। আর আমিও প্রতিদিন একশ’বার করে আল্লাহর কাছে তওবা্ করি। (মুসলিম)[1]
بَابُ الْاِسْتِغْفَارِ وَالتَّوْبَةِ
وَعَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «يَا أَيُّهَا النَّاسُ تُوبُوا إِلَى اللَّهِ فَإِنِّي أَتُوبُ إِلَيْهِ فِي الْيَوْمِ مائةَ مرِّةٍ» . رَوَاهُ مُسلم
ব্যাখ্যা: (يَا أَيُّهَا النَّاسُ تُوبُوا إِلَى اللّٰهِ) উল্লেখিত বাণীতে আল্লাহর অপর বাণী وَتُوْبُوا إِلَى اللَّهِ جَمِيْعًا أَيُّهَ الْمُؤْمِنُونَ ‘‘আর হে বিশ্বাসীরা! তোমরা সকলে আল্লাহর কাছে তাওবাহ্ কর’’- (সূরা আন্ নূর ২৪ : ৩১) এর দিকে। সুতরাং তাওবাহ্ সকল মানুষের ওপর আবশ্যক। ইমাম নাবাবী (রহঃ) বলেন, তাওবার ব্যাপারে এ নির্দেশটি আল্লাহ তা‘আলার ‘‘আর হে বিশ্বাসীরা! তোমরা সকলে আল্লাহর কাছে তাওবাহ্ কর’’ এ বাণী এবং আল্লাহ তা‘আলার ‘‘হে বিশ্বাসীরা! তোমরা সকলে আল্লাহর কাছে যথার্থ তাওবার কর’’- (সূরা আত্ তাহরীম ৬৬ : ৮) আয়াতের অনুকূল। ‘উবায়দুল্লাহ মুবারকপূরী বলেন, আমি বলব, তাওবার আবশ্যকতা আগার-এর এ হাদীস, অন্যান্য হাদীসসমূহ এবং উল্লেখিত আয়াতদ্বয় দ্বারা স্পষ্ট।
কারী বলেন, (يَا أَيُّهَا النَّاسُ تُوبُوا إِلَى اللّٰهِ) আল্লাহ তা‘আলার এ বাণীতে বাহ্যিক দৃষ্টিতে الناس দ্বারা মু’মিনগণ উদ্দেশ্য। আর তা আল্লাহ তা‘আলার وَتُوْبُوْا إِلَى اللّٰهِ جَمِيعًا أَيُّهَ الْمُؤْمِنُوْنَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ (সূরা আন্ নূর ২৪ : ৩১) এ বাণীর কারণে। নিশ্চয়ই প্রত্যেক ব্যক্তি তার স্বস্থান থেকে তার পূর্ণাঙ্গতা সংরক্ষণের জন্য তাওবার মুখাপেক্ষী। আয়াত ও হাদীসে এ ব্যাপারে দলীল আছে। আর প্রত্যেকেই ‘ইবাদাত সম্পাদনে কমতি করে যেমন আল্লাহ তার তাকদীরে লিখেছেন। আল্লাহ বলেন, كَلَّا لَمَّا يَقْضِ مَا أَمَرَه অর্থাৎ- ‘‘আল্লাহ তাকে যে নির্দেশ দিয়েছেন তা সে পালন করেনি’’- (সূরা ‘আবাসা ৮০ : ২৩) এর উপর আরো প্রমাণ বহন করছে। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর (فإنى أتوب إليه) এ বাণী। অর্থাৎ- আল্লাহর কাছে উপস্থিত হওয়া এবং তাঁর কাছে চাওয়ার জন্য উপযুক্ত বা তাঁর সামনে নিঃস্বতা প্রকাশের জন্য উপযুক্ত এমনভাবে প্রত্যাবর্তন করি (فى اليوم مائة مرة) অর্থাৎ- রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি দিনে একশতবার ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকেন তাহলে অন্যদের পক্ষে এক মুহূর্তে হাজারবার ক্ষমা প্রার্থনা করা প্রয়োজন।
পরিচ্ছেদঃ ২. প্রথম অনুচ্ছেদ - ক্ষমা ও তাওবাহ্
২৩২৬-[৪] আবূ যার গিফারী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তা’আলার নাম করে যেসব হাদীস বর্ণনা করেছেন তার একটি হলো তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন যে, আল্লাহ তাবারক ওয়াতা’আলা বলেনঃ হে আমার বান্দাগণ! আমি আমার ওপর যুলম করাকে হারাম করে দিয়েছি। (যুলম করা আমার জন্য যা, তোমাদের জন্যও তা) তাই আমি তোমাদের জন্যও যুলম করা হারাম করে দিয়েছি। অতঃপর (পরস্পরের প্রতি) যুলম করো না। হে আমার বান্দাগণ! তোমাদের প্রত্যেকেই পথভ্রষ্ট। কিন্তু আমি যাকে পথ দেখাই (সে-ই পথের সন্ধান পায়)। সুতরাং তোমরা আমার নিকট পথের সন্ধান কামনা কর, তাহলে আমি তোমাদেরকে পথের সন্ধান দেবো। হে আমার বান্দাগণ! তোমাদের প্রত্যেকেই ক্ষুধার্ত। কিন্তু আমি যাকে খাবার দেই (সে খাবার পায়)। তাই তোমরা আমার কাছে খাবার চাও। আমি তোমাদেরকে খাবার দেবো। হে আমার বান্দাগণ! তোমাদের প্রত্যেকেই উলঙ্গ। কিন্তু আমি যাকে পোশাক পরাই (সে পোশাক পরে)। তাই তোমরা আমার নিকট পোশাক চাও। আমি তোমাদেরকে (পোশাক) পরাব। হে আমার বান্দাগণ! তোমরা রাতদিন গুনাহ (অপরাধ) করে থাকো। আর আমি তোমাদের সকল গুনাহ মাফ করে দেই। সুতরাং তোমরা আমার নিকট ক্ষমা চাও, আমি তোমাদেরকে ক্ষমা করে দেবো।
হে আমার বান্দাগণ! তোমরা ক্ষতিসাধন করার সাধ্য রাখো না যে, আমার ক্ষতি করবে। এভাবে তোমরা আমার কোন উপকার করারও শক্তি রাখো না যে, আমার কোন উপকার করবে। তাই হে আমার বান্দাগণ! যদি তোমাদের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সকল মানুষ ও জিন্ তোমাদের মধ্যে হতে সর্বাপেক্ষা পরহেযগার ব্যক্তির অন্তরের মতো অন্তর নিয়ে পরহেযগার হয়ে যায়। তাও আমার সাম্রাজ্যের কিছুমাত্র বৃদ্ধি করতে পারবে না। হে আমার বান্দাগণ! যদি তোমাদের প্রথম ও শেষ পর্যন্ত সকল মানুষ ও জিন্ তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা অত্যাচারী-অনাচারী ব্যক্তির অন্তরের মতো অন্তর নিয়েও অত্যাচার-অনাচার করে তাদের এ কাজও আমার সাম্রাজ্যের কিছুমাত্র ক্ষতি বৃদ্ধি করতে পারবে না। হে আমার বান্দাগণ! যদি তোমাদের প্রথম ও শেষ পর্যন্ত সকল মানুষ ও জিন্ একই মাঠে দাঁড়িয়ে একসাথে আমার কাছে প্রার্থনা করে। আর আমি তোমাদের প্রত্যেককে তাদের চাওয়া জিনিস দান করি তাহলে আমার কাছে যা আছে, তার কিছুই কমাতে পারবে না। শুধু এতখানি ছাড়া যতটি একটি সূঁই যখন সমুদ্রে ডুবিয়ে আবার উঠিয়ে নেয়া হলে যতটুকু সমুদ্রের পানি কমায়। হে আমার বান্দাগণ! এখন বাকী রইল তোমাদের (কৃতকর্মের) ’আমল, যা আমি যথাযথভাবে সংরক্ষণ করব। অতঃপর এর প্রতিদান আমি পরিপূর্ণভাবে দেবো। সুতরাং যে ব্যক্তি কোন ভাল (ফল) লাভ করে, সে যেন আল্লাহর শুকর আদায় করে। আর যে মন্দ (ফল) লাভ করে, সে যেন নিজেকে ছাড়া অন্যকে দোষারোপ না করে (কেননা তা তারই কৃতকর্মের ফল)। (মুসলিম)[1]
بَابُ الْاِسْتِغْفَارِ وَالتَّوْبَةِ
وَعَنْ أَبِي ذَرٍّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِيمَا يَرْوِي عَنِ اللَّهِ تَبَارَكَ وَتَعَالَى أَنَّهُ قَالَ: «يَا عِبَادِي إِنِّي حَرَّمْتُ الظُّلْمَ عَلَى نَفْسِي وَجَعَلْتُهُ بَيْنَكُمْ مُحَرَّمًا فَلَا تَظَالَمُوا يَا عِبَادِي كُلُّكُمْ ضَالٌّ إِلَّا مَنْ هَدَيْتُهُ فَاسْتَهْدُونِي أَهْدِكُمْ يَا عِبَادِي كُلُّكُمْ جَائِعٌ إِلَّا مَنْ أَطْعَمْتُهُ فَاسْتَطْعِمُونِي أُطْعِمْكُمْ يَا عِبَادِي كُلُّكُمْ عَارٍ إِلَّا مَنْ كَسَوْتُهُ فَاسْتَكْسُونِي أَكْسُكُمْ يَا عِبَادِي إِنَّكُمْ تُخْطِئُونَ بِاللَّيْلِ وَالنَّهَارِ وَأَنَا أَغْفِرُ الذُّنُوبَ جَمِيعًا فَاسْتَغْفِرُونِي أَغْفِرْ لَكُمْ يَا عِبَادِي إِنَّكُمْ لَنْ تَبْلُغُوا ضَرِّي فَتَضُرُّونِي وَلَنْ تَبْلُغُوا نَفْعِي فَتَنْفَعُونِي يَا عِبَادِي لَوْ أَنَّ أَوَّلَكُمْ وَآخِرَكُمْ وإنسكم وجنكم كَانُوا أَتْقَى قَلْبِ رَجُلٍ وَاحِدٍ مِنْكُمْ مَا زَادَ ذَلِكَ فِي مُلْكِي شَيْئًا يَا عِبَادِي لَوْ أَنَّ أَوَّلَكُمْ وَآخِرَكُمْ وَإِنْسَكُمْ وَجِنَّكُمْ كَانُوا عَلَى أفجر قلب وَاحِد مِنْكُم مَا نقص مِنْ مُلْكِي شَيْئًا يَا عِبَادِي لَوْ أَنَّ أَوَّلَكُمْ وَآخِرَكُمْ وَإِنْسَكُمْ وَجِنَّكُمْ قَامُوا فِي صَعِيدٍ وَاحِدٍ فَسَأَلُونِي فَأَعْطَيْتُ كُلَّ إِنْسَانٍ مَسْأَلَتَهُ مَا نَقَصَ ذَلِكَ مِمَّا عِنْدِي إِلَّا كَمَا يَنْقُصُ الْمِخْيَطُ إِذَا أُدْخِلَ الْبَحْرَ يَا عِبَادِي إِنَّمَا هِيَ أَعمالكُم أحصها عَلَيْكُمْ ثُمَّ أُوَفِّيكُمْ إِيَّاهَا فَمَنْ وَجَدَ خَيْرًا فَلْيَحْمَدِ اللَّهَ وَمِنْ وَجَدَ غَيْرَ ذَلِكَ فَلَا يَلُومن إِلَّا نَفسه» . رَوَاهُ مُسلم
ব্যাখ্যা: (قَالَ: يَا عِبَادِىْ) ইমাম ত্বীবী বলেন, জিন্ এবং মানব উভয়কে সম্বোধন করা হয়েছে, তাদের মাঝে পাপ-পুণ্য পর্যায়ক্রম হওয়ার কারণে। অত্র সম্বোধনে মালায়িকাহ্ও (ফেরেশতারাও) সম্বোধিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সুতরাং গোপনীয়তা লাভের দিক থেকে মালায়িকার আলোচনা জীনদের মাঝে অন্তর্ভুক্ত করে করা সম্ভব। আর এ সম্বোধন প্রয়োগ হওয়ার ক্ষেত্রে তা পাপ প্রকাশ এবং তার সম্ভাব্যতার উপর অবস্থান করবে না। গ্রন্থকার বলেন, আমাদের শায়খ (ইমাম ত্বীবী) বলেন, তবে প্রথম সম্ভাবনাটি প্রকাশমান।
(حَرَّمْتُ الظُّلْمَ عَلٰى نَفْسِىْ) অর্থাৎ- যুলম বা অবিচার আমার জন্য হারাম করেছি।
ইমাম নাবাবী (রহঃ) বলেন, বিদ্বানগণ বলেন, (حَرَّمْتُ الظُّلْمَ عَلٰى نَفْسِىْ) এর অর্থ হল আমি অন্যায় থেকে পবিত্র। আর আল্লাহর ক্ষেত্রে যুুলম অসম্ভব। আর আল্লাহ কিভাবে সীমালঙ্ঘন করবেন অথচ তার ওপর এমন কেউ নেই যার আনুগত্য তাকে করতে হবে, আর কিভাবে তিনি অন্যের মালিকানাতে হস্তক্ষেপ করবেন অথচ সমগ্র বিশ্ব তার মালিকানাতে। আভিধানিক অর্থে তাহরীমের মূল হল বিরত থাকা। কোন কিছু থেকে বিরত থাকার সাথে হারামের সাদৃশ্য থাকার কারণে অবিচার থেকে আল্লাহর পবিত্র হওয়াকে হারাম বলা হয়েছে।
(فَلَا تَظَالَمُوا) অর্থাৎ- আল্লাহ তাঁর বান্দাদের ওপর অবিচারকে হারাম করে দিয়েছেন এবং তারা পরস্পর একে অপরের প্রতি অবিচার করবে- এ থেকে আল্লাহ নিষেধ করেছেন। সুতরাং প্রত্যেক বান্দার ওপর আবশ্যক একে অন্যের প্রতি অবিচার না করা।
(يَا عِبَادِىْ كُلُّكُمْ ضَالٌّ إِلَّا مَنْ هَدَيْتُه) অর্থাৎ- যে ব্যক্তির সুপথের দিশা অর্জন হয়েছে তা কেবল আল্লাহর তরফ থেকে, তার নিজের তরফ থেকে নয়। এমনিভাবে খাদ্য, বস্ত্র যার যতটুকু অর্জিত হয়েছে তা কেবল আল্লাহর তরফ থেকে নিজের তরফ থেকে নয়। আর এ বিশ্বাস দাবী করছে সকল সৃষ্টি তাদের দীন ও দুনিয়াতে কল্যাণ আনয়ন ও ক্ষতি প্রতিহতকরণে আল্লাহর মুখাপেক্ষী। আর নিশ্চয়ই বান্দাগণ এ সবের কিছুই নিজেরা করার ক্ষমতা রাখে না। আর নিশ্চয়ই আল্লাহ সুপথের দিক নির্দেশনা ও দানের মাধ্যমে যাকে দয়া করেননি দুনিয়াতে সে এ দু’টি জিনিস থেকে মাহরুম হবে।
মাযূরী বলেন, এর বাহ্যিক দিক হল, নিশ্চয়ই তাদেরকে পথভ্রষ্টতার উপরে সৃষ্টি করা হয়েছে তবে আল্লাহ যাকে সুপথের দিক নির্দেশনা দিয়েছেন সে ছাড়া। প্রসিদ্ধ হাদীসে আছে, প্রত্যেক ভূমিষ্ঠ সন্তান সনাতন ধর্মের উপর জন্মগ্রহণ করে। তিনি বলেন, অতঃপর প্রথমটি দ্বারা উদ্দেশ্য হল, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে তাদের কাছে পাঠানোর পূর্বে তারা যে অবস্থার উপর ছিল সে ব্যাপারে তাদের বর্ণনা দেয়া অথবা যদি তাদেরকে ও তাদের স্বভাবে যে প্রবৃত্তি, আরাম ও অবকাশগত ঢিলেমি আছে তা ছেড়ে দেয়া হয় অবশ্যই তারা পথভ্রষ্ট হবে আর এ দ্বিতীয়টিই হল সর্বাধিক স্পষ্ট। মানাবী বলেন, كلكم ضال অর্থাৎ- তোমাদের প্রত্যেকেই পথভ্রষ্ট, অর্থাৎ- রসূলদেরকে প্রেরণ করার পূর্বে তোমাদের প্রত্যেকেই শারী‘আত সম্বন্ধে উদাসীন ছিলে, তবে আল্লাহ যাকে ঈমান আনার তাওফীক দিয়েছেন সে হিদায়াত পেয়েছে।
কারী বলেন, এটি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর (كل مولود يولد على الفطرة) অর্থাৎ- ‘‘প্রত্যেক ভূমিষ্ঠ সন্তান সনাতন ধর্মের উপর জন্ম গ্রহণ করে’’ এ উক্তির পরিপন্থী না। কেননা الفطرة দ্বারা তাওহীদ উদ্দেশ্য। আর الضلالة দ্বারা ঈমানের বিধিবিধান ও ইসলামের দণ্ডবিধির বিশ্লেষণ সম্পর্কে অজ্ঞ থাকা উদ্দেশ্য। আর এ ব্যাপারে আল্লাহর বাণী, وَوَجَدَكَ ضَالًّا فَهَدٰى অর্থাৎ- ‘‘আর তিনি আপনাকে পথহারা পেয়েছেন, অতঃপর পথপ্রদর্শন করেছেন।’’ (সূরা আয্ যুহা- ৯৩ : ৭)
ইবনু রজব বলেন, কতক মনে করেন নিশ্চয়ই রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর (كلكم ضال إلا من هديته) এ বাণী নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে ‘ইয়ায-এর (আল্লাহ বলেন, ‘‘আমি আমার বান্দাদেরকে তাওহীদবাদী করে সৃষ্টি করেছি’’) এ হাদীসের পরিপন্থী এবং অন্য বর্ণনাতে (মুসলিমদের থেকে শয়তান পৃথক হয়ে গেছে) এ বাণীর পরিপন্থী। অথচ এরূপ নয়। কেননা আল্লাহ আদম সন্তানদের সৃষ্টি করে তাদেরকে ইসলাম গ্রহণের উপযোগী করেছেন এবং তার দিকে তাদেরকে ঝুকিয়ে দিয়েছেন এবং ক্ষমতা দ্বারা তাদেরকে ইসলাম গ্রহণের জন্য প্রস্ত্তত করেছেন কিন্তু বান্দার জন্য আবশ্যক কর্মের মাধ্যমে ইসলামকে শিখে নেয়া, কেননা বান্দা শিক্ষা গ্রহণের পূর্বে মূর্খ থাকে তখন সে কিছু জানে না। যেমন আল্লাহ বলেন, وَاللهُ أَخْرَجَكُمْ مِنْ بُطُوْنِ أُمَّهَاتِكُمْ لَا تَعْلَمُوْنَ شَيْئًا অর্থাৎ- আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের মাতার পেট থেকে বের করেছেন এমতাবস্থায় তোমরা কিছু জানতে না’’- (সূরা আন্ নাহল ১৬ : ৭৮)। আর তার নাবীকে বলেন, وَوَجَدَكَ ضَالًّا فَهَدٰى অর্থাৎ- ‘‘আর তিনি আপনাকে পথহারা পেয়েছেন, অতঃপর পথপ্রদর্শন করেছেন।’’ (সূরা আয্ যুহা- ৯৩ : ৭)
অত্র আয়াতে وَوَجَدَكَ দ্বারা উদ্দেশ্য হল, কিতাব এবং কৌশলের যা কিছু আল্লাহ নাবীকে শিক্ষা দিয়েছেন তার পূর্বে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা জানতেন না। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘‘আর এমনিভাবে আমি আপনার প্রতি আমার তরফ থেকে রূহ তথা কুরআন প্রত্যাদেশ করেছি ইতিপূর্বে আপনি জানতে না কিতাব কি ও ঈমান কি কিন্তু আমি একে করেছি জ্যোতিস্বরূপ, আমার বান্দাদের থেকে যাকে ইচ্ছা এর মাধ্যমে আমি তাকে পথপ্রদর্শন করি।’’ (সূরা আশ্ শূরা ৪২ : ৫২)
(يَا عِبَادِىْ كُلُّكُمْ جَائِعٌ إِلَّا مَنْ أَطْعَمْتُه) অর্থাৎ- ‘‘হে আমার বান্দাগণ! তোমাদের সকলেই ক্ষুধার্ত তবে আমি যাকে খাইয়েছি সে ছাড়া।’’ ‘আলকামাহ্ বলেন, এটা এ কারণে যে, মানুষ কোন কিছুর মালিক নয় আর রিযক্বের ভাণ্ডার আল্লাহর হাতে। সুতরাং আল্লাহ অনুগ্রহপূর্বক যাকে খাওয়াবেন না আল্লাহর ন্যায়-ইনসাফ হিসেবে সে ক্ষুধার্ত থাকবে। কেননা কাউকে খাওয়ানো তার ওপর আবশ্যক না। এখন কেউ যদি বলেন কি করে এটা হতে পারে অথচ আল্লাহ বলেছেন, وَمَا مِنْ دَابَّةٍ فِي الْأَرْضِ إِلَّا عَلَى اللهِ رِزْقُهَا অর্থাৎ- ‘‘পৃথিবীতে যত প্রাণী আছে সকল প্রাণীর খাদ্যভার একমাত্র আল্লাহর ওপর’’- (সূরা হূদ ১১ : ৬)। উত্তরে বলা হবে, এটা আল্লাহর তরফ থেকে অনুগ্রহ। মূলত প্রাণীর ব্যাপারে আল্লাহর ওপর কোন দায়িত্ব আছে এমন না। অতঃপর যদি বলা হয়, খাদ্যদানকে কিভাবে আল্লাহর দিকে সম্বন্ধ করা হল? অথচ আমরা স্বচক্ষে পেশা, কর্ম এবং উপার্জনের বিভিন্ন মাধ্যম দ্বারা খাদ্যসমূহ আগমন করতে দেখতে পাই। উত্তরে বলা হবে, তা আল্লাহর ক্ষমতা ও তাঁর গোপন কৌশলের মাধ্যমে প্রকাশ্য উপকরণসমূহের মাধ্যমে অর্জিত হয়।
কারী বলেন, (إِلَّا مَنْ أَطْعَمْتُه) অর্থাৎ- যাকে আমি খাওয়াব, যার রিযককে আমি প্রশস্ত করে দেব এবং যাকে আমি ধনী করব একমাত্র সেই তো পাবে।
(فَاسْتَطْعِمُونِىْ) অর্থাৎ- তোমরা খাদ্য ও খাদ্যের সহজতা আমার থেকে অনুসন্ধান কর। (أُطْعِمْكُمْ) অর্থাৎ- আমি তোমাদের জন্য খাদ্য অর্জনের উপকরণ সহজ করে দিব।
(أَكْسُكُمْ) অর্থাৎ- আমি তোমাদের জন্য তোমাদের লজ্জাস্থান ঢাকা সহজ করে দিব এবং তোমাদের থেকে তোমাদের লজ্জাস্থান প্রকাশ পাওয়ার অপমান দূর করে দিব।
(فَتَنْفَعُونِىْ) ‘‘অতঃপর তোমরা আমার উপকার করবে’’। অর্থাৎ- বান্দাগণ আল্লাহর কোন ধরনের উপকার ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখে না, কেননা আল্লাহ তিনি নিজে ধনী, প্রশংসিত, বান্দার আনুগত্যের প্রয়োজন তাঁর নেই। আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের মাধ্যেমে তার কোন উপকার সাধিত হয় না, বরং তারা নিজেরাই একে অপরের মাধ্যমে পরস্পর লাভবান হয়। তাদের অবাধ্যতার কারণে আল্লাহ ক্ষতিগ্রস্ত হন না, তারা নিজেরাই কেবল অবাধ্যতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হন। আল্লাহ বলেন, অর্থাৎ- ‘‘আর যারা কুফরীতে তরান্বিত করে নিশ্চয়ই তারা আল্লাহর ক্ষতি সাধন করতে পারবে না’’- (সূরা আ-লি ‘ইমরান ৩ : ১৭৬)। আর আল্লাহ মূসা (আঃ) সম্পর্কে বর্ণনা দিতে যেয়ে বলেন, মূসা (আঃ) বলেছেনঃ অর্থাৎ- ‘‘তোমরা এবং সমস্ত জমিনবাসী যদি কুফরী কর তাহলে জেনে রেখ অবশ্যই আল্লাহ অমুখাপেক্ষী, ধনী’’- (সূরা ইব্রাহীম ১৪ : ৮)।
কারী বলেন, অর্থাৎ- তোমাদের দ্বারা আমার কোন ক্ষতি করা এবং উপকার করা সম্ভব হবে না, কেননা তোমরা সকলে যদি আমার চূড়ান্ত ‘ইবাদাত করার দিকে সংঘবদ্ধ হও তাহলেও আমার রাজত্বে কোন উপকার পৌঁছানো সম্ভব হবে না আর যদি তোমরা আমার কোন চূড়ান্ত অবাধ্যতার উপর একত্রিত হও তাহলেও তোমরা আমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। বরং ‘‘যদি ভাল ‘আমল কর তাহলে তোমাদের নিজেদের উপকারার্থেই তা করলে আর যদি মন্দ ‘আমল কর তাহলে তোমাদের নিজেদের অকল্যাণের জন্যই তা করলে’’- (সূরা বানী ইসরাঈল ১৭ : ৭)। আর এটি হল আল্লাহর (لو أن أولكم وأخركم-থ حديث قدسى) এ বাণীর মর্ম।
(كَانُوْا عَلٰى اَفْجَرِ قَلْبِ وَاحِدٍ مِنْكُمْ) অর্থাৎ- তোমরা যদি তোমাদের মধ্য থেকে সর্বাধিক ভীতিপূর্ণ ব্যক্তির হৃদয়ের উপর অবস্থান করে চূড়ান্ত আল্লাহ ভীতির অধিকারী হয়ে যাও। কবাযী বলেন, অর্থাৎ- তোমরা যদি কোন ব্যক্তির সর্বাধিক আল্লাহ ভীতি অবস্থার উপর অবস্থান কর, অর্থাৎ- তোমাদের থেকে প্রত্যেকেই এ অবস্থার উপর অবস্থান করে এভাবে মিরকাতে আছে।
(مَا زَادَ ذٰلِكَ فِىْ مُلْكِىْ شَيْئًا) অর্থাৎ- তোমরা আমার উপকার করার জন্য উপকার করার অবস্থানেই পৌঁছাতে পারবে না।
(مَا نَقَصَ مِنْ مُلْكِىْ شَيْئًا) অর্থাৎ- সামান্যতমও কমাতে পারবে না। অত্র হাদীসে شيئا অর্থাৎ- নাকেরা বা অনির্দিষ্ট বিশেষ্য আনা হয়েছে অতি নগণ্য বুঝানোর জন্য। আর এটা বুঝা যাচ্ছে, আগত হাদীসে এর পরিবর্তে (جناح بعوضة) দ্বারা। আর এটি আল্লাহর (لن تبلغوا ضرى فتضرونى) ‘‘তোমরা কখনো আমার ক্ষতিসাধন করার জন্য আমার ক্ষতি সাধন করার স্থানে পৌঁছাতে পারবে না।’’ এ বাণীর দিকে প্রত্যাবর্তন করছে। অর্থাৎ- আল্লাহর রাজত্ব সৃষ্টজীবের আনুগত্যের কারণে বৃদ্ধি পায় না যদিও তাদের প্রত্যেকেই পুণ্যবান হয়ে যায় এবং অবাধ্যদের অবাধ্যতার কারণে রাজ্যে কোন কিছু হ্রাসও পায় না যদিও জিন্ ও মানব প্রত্যেকইে অবাধ্য হয়ে যায়। কেননা আল্লাহ সুবহানাহূ সত্তাগতভাবে অন্যান্যদের থেকে অমুখাপেক্ষী। তাঁর গুণাবলী, তাঁর কর্মে ও তাঁর সত্তাতে রয়েছে সাধারণ পূর্ণাঙ্গতা। সুতরাং তাঁর রাজত্ব পূর্ণাঙ্গ রাজত্ব। তাঁর রাজত্বে কোন দিক দিয়ে কোন কারণে অপূর্ণাঙ্গতা নেই।
(فِىْ صَعِيدٍ وَاحِدٍ) অর্থাৎ- একই জমিনে একই স্থানে। ইবনু হাজার আসকালানী বলেন, الصعيد শব্দটি মাটি ও ভূ-পৃষ্ঠ উভয় অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে এবং এখানে ভ-ূপৃষ্ঠ উদ্দেশ্য।
(فَسَأَلُونِىْ) অর্থাৎ- তারা প্রত্যেকে আমার কাছে চায়। ইমাম ত্বীবী বলেন, চাওয়াকে একই স্থানে একত্রিত হওয়ার সাথে আওতাভুক্ত করে দেয়া হয়েছে। কেননা যার কাছে একত্রিতভাবে চাওয়া হয় সেই চাওয়া তাকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দেয় এবং তা চাওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বারোপ করে এবং তার কাছে তাদের লক্ষ্যের সফলতা এবং তাদের দাবী উদ্ধার করা কঠিন হয়ে যায়।
(فَأَعْطَيْتُ كُلَّ إِنْسَانٍ) অতঃপর আমি প্রত্যেক মানুষকেই দান করি, এমনিভাবে প্রত্যেক জিনকেও।
(مَا نَقَصَ ذٰلِكَ مِمَّا عِنْدِىْ) ‘‘এতে আমার নিকট যা আছে তার কিছুই কমবে না’’ এর দ্বারা তাঁর ক্ষমতার পূর্ণাঙ্গতা এবং তাঁর রাজত্বের পূর্ণাঙ্গতা উদ্দেশ্য। তাঁর রাজত্ব এবং তাঁর ধনভাণ্ডার শেষ হবে না এবং দানের কারণে তা কমবে না। যদিও পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল মানুষকে, একই স্থানে তারা যা চায় সব কিছু দেয়া হয়।
(إِذَا أُدْخِلَ الْبَحْرَ) একটি সুঁই যখন সমুদ্রে ডুবিয়ে আবার উঠিয়ে নেয়া হলে সমুদ্রের পানি যতটুকু কমায়। এখানে এ দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করা হয়েছে নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট যা কিছু তা কমে না এ বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘‘তোমাদের কাছে যা কিছু আছে তা শেষ হয়ে যাবে আর আল্লাহর কাছে যা কিছু আছে তা অবশিষ্ট থাকবে’’- (সূরা আন্ নাহল ১৬ : ৯৬)। কেননা সমুদ্রে যখন কোন সুঁই প্রবেশ করানোর পর বের করা হবে তখন এ কারণে সমুদ্রে কিছু কমবে না। ত্বীবী বলেন, সুঁই সমুদ্র থেকে যা কমায় তা যখন অনুভূতিশীল না, জ্ঞানের কাছে তা যখন গণ্য না বরং তা না কমার হুকুমের মাঝে গণ্য তখন তা সৃষ্টিজীবের প্রয়োজনাদি পূর্ণাঙ্গভাবে দান করার সাথে আরো বেশি অনুভূতিশীল ও সাদৃশ্যপূর্ণ। কেননা তাঁর কাছে যা আছে তা কমে না।
নাবাবী বলেন, বিদ্বানগণ বলেছেন, এ উপমা অবলম্বন একটি বিষয় বুঝিয়ে দেয়ার নিকটবর্তী একটি মাধ্যম। এর অর্থ হল, প্রকৃতপক্ষে তা কিছু কমায় না। যেমন অন্য হাদীসে এসেছে, কোন খরচ তাকে কমায় না। কেননা আল্লাহর কাছে যা আছে তাতে অসম্পূর্ণতা প্রবেশ করে না। অসম্পূর্ণতা কেবল প্রবেশ করে ধ্বংসশীল সীমাবদ্ধ জিনিসের মাঝে। আর আল্লাহর দান তাঁর রহমাত ও তাঁর অনুগ্রহের অন্তর্ভুক্ত। আর এ দু’টি হল সিফাতের কদীম যাতে অসম্পূর্ণতা প্রবেশ করতে পারে না। অতঃপর সমুদ্রে সুঁইয়ের মাধ্যমে উপমা পেশ করা হয়েছে, কেননা স্বল্পতার ক্ষেত্রে উপমা হিসেবে যা বর্ণনা করা হয় তার মাঝে এটি চূড়ান্ত পর্যায়। উদ্দেশ্য হল মানুষ যা স্বচক্ষে দেখে তা উপলব্ধি করার কাছাকাছি করে দেয়া। কেননা সমুদ্র দর্শনীয় জিনিসের মাঝে সর্বাধিক বড়, পক্ষান্তরে সুঁই অস্তিত্বশীল জিনিসের মাঝে সর্বাধিক ছোট। সেই সাথে তা মসৃণ। পানি তার সাথে সম্পৃক্ত হয় না।
(فَمَنْ وَجَدَ خَيْرًا) অর্থাৎ- যে ব্যক্তি তার রবের পক্ষ থেকে কল্যাণের তাওফীক পাবে এবং নিজের তরফ থেকে কল্যাণের কাজ পাবে। (فليحمد الله) অর্থাৎ- আল্লাহ তাকে কল্যাণকর কাজে তাওফীক দেয়ার কারণে সে যেন আল্লাহর প্রশংসা করে, কেননা তিনি পথপ্রদর্শক।
(وَمِنْ وَجَدَ غَيْرَ ذٰلِكَ) অর্থাৎ- যে ব্যক্তি অকল্যাণকর কিছু পাবে, অকল্যাণ সম্পর্কে স্পষ্ট কিছু বলা হয়নি তা তুচ্ছ হওয়ার জন্য এবং তার সংস্পর্শ থেকে বেঁচে থাকার লক্ষ্যে।
(فَلَا يَلُوْمَنَّ إِلَّا نَفْسَه) ‘‘সে যেন নিজেকে ব্যতীত অন্য কাউকে দোষারোপ না করেন’’। কেননা অকল্যাণ তার নিজ থেকে প্রকাশ পেয়েছে অথবা সে তার এ পথভ্রষ্টতার উপর আছে যে দিকে আল্লাহর (كلكم ضال তোমাদের প্রত্যেকেই পথভ্রষ্ট) এ বাণী দ্বারা ইঙ্গিত করা হয়েছে। এটি কারীর উক্তি। ‘আলক্বমাহ্ বলেন, নিশ্চয়ই ঐ আনুগত্যসমূহ যার ওপর সাওয়াব দেয়া হয় এবং আল্লাহর তাওফীক্বে ঐ কল্যাণ যার কারণে আল্লাহর প্রশংসা করা আবশ্যক এবং ঐ অবাধ্যতার কাজসমূহ যার ওপর শাস্তি আরোপ করা হয় এবং অকল্যাণ আরোপ করা হয়। যদিও সে অবাধ্যতার বিষয়গুলো আল্লাহর তাকদীর এবং বান্দাকে তার লাঞ্ছিত করার নিমিত্তে হয়ে থাকে তবুও তা বান্দার অর্জন। সুতরাং মন্দ উপার্জনের ক্ষেত্রে তার বাড়াবাড়ির কারণে সে যেন নিজকে তিরস্কার করে।
পরিচ্ছেদঃ ২. প্রথম অনুচ্ছেদ - ক্ষমা ও তাওবাহ্
২৩২৭-[৫] আবূ সা’ঈদ আল খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ বনী ইসরাঈলের মধ্যে জনৈক ব্যক্তি নিরানব্বই জন মানুষ হত্যা করেছিল। তারপর সে শার’ঈ বিধান জানার জন্য একজন আল্লাহভীরুর কাছে জিজ্ঞেস করল, এ ধরনের মানুষের জন্য তাওবার কোন অবকাশ আছে কিনা? তিনি বললেন, নেই। তারপর সে তাকেও (’আলিমকেও) হত্যা করল। এভাবে সে লোকদেরকে অনবরত জিজ্ঞেস করতে থাকল। এক ব্যক্তি শুনে বলল, অমুক গ্রামে গিয়ে অমুককে জিজ্ঞেস করো। এমন সময়েই সে মৃত্যুমুখে পতিত হলো এবং মৃত্যুর সময় সে ওই গ্রামের দিকে নিজের সিনাকে বাড়িয়ে দিলো। তারপর রহমতের মালাক (ফেরেশতা) ও ’আযাবের মালাক পরস্পর ঝগড়া করতে লাগল, কারা তার রূহ নিয়ে যাবে। এমন সময় আল্লাহ তা’আলা ওই গ্রামকে বললেন, তুমি মৃত ব্যক্তির কাছে আসো। আর নিজ গ্রামকে বললেন, তুমি দূরে সরে যাও। অতঃপর আল্লাহ মালায়িকাহকে (ফেরেশতাদের) বললেন, তোমরা উভয় দিকের পথের দূরত্ব পরিমাপ করে দেখো। মাপের পর মৃতকে এ গ্রামের দিকে এক বিঘত নিকটে পাওয়া গেল। সুতরাং তাকে ক্ষমা করে দেয়া হলো। (বুখারী, মুসলিম)[1]
بَابُ الْاِسْتِغْفَارِ وَالتَّوْبَةِ
وَعَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: كَانَ فِي بَنِي إِسْرَائِيلَ رَجُلٌ قَتَلَ تِسْعَةً وَتِسْعِينَ إِنْسَانًا ثُمَّ خَرَجَ يَسْأَلُ فَأَتَى رَاهِبًا فَسَأَلَهُ فَقَالَ: أَلَهَ تَوْبَةٌ قَالَ: لَا فَقَتَلَهُ وَجَعَلَ يَسْأَلُ فَقَالَ لَهُ رَجُلٌ ائْتِ قَرْيَةَ كَذَا وَكَذَا فَأَدْرَكَهُ الْمَوْتُ فَنَاءَ بِصَدْرِهِ نَحْوَهَا فَاخْتَصَمَتْ فِيهِ مَلَائِكَةُ الرَّحْمَةِ وَمَلَائِكَةُ الْعَذَابِ فَأَوْحَى اللَّهُ إِلَى هَذِهِ أَنْ تَقَرَّبِي وَإِلَى هَذِهِ أَنْ تَبَاعَدِي فَقَالَ قِيسُوا مَا بَيْنَهُمَا فَوُجِدَ إِلَى هَذِهِ أَقْرَبَ بِشِبْرٍ فَغُفِرَ لَهُ
ব্যাখ্যা: (كَانَ فِىْ بَنِىْ إِسْرَائِيلَ رَجُلٌ) হাফেয বলেন, আমি লোকটির নাম সম্পর্কে অবগত হতে পারিনি এবং ঘটনাতে উল্লেখ করা কোন লোকের নাম সম্পর্কে অবগত হতে পারিনি।
(قَتَلَ تِسْعَةً وَتِسْعِينَ إِنْسَانًا) আবূ মু‘আবিয়াহ্ বিন আবূ সুফ্ইয়ান-এর হাদীসে ত্ববারানী একটু বেশি উল্লেখ করেছেন আর তা হল হাদীসে হত্যাকারী নিহতদের প্রত্যেককে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছিলেন।
(ثُمَّ خَرَجَ يَسْأَلُ) ‘‘অতঃপর সে বেরিয়ে জিজ্ঞেস করতে থাকলো’’। অর্থাৎ- তাওবাহ্ ও ক্ষমা প্রার্থনা করার সুযোগ আছে কিনা। আর মুসলিমে কাতাদাহ্ থেকে হিশাম-এর এক বর্ণনাতে আছে, লোকটি পৃথিবীবাসীদের মাঝে সর্বাধিক জ্ঞানী ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। অতঃপর তাকে এক পাদ্রী সম্পর্কে বলে দেয়া হল।
(فَأَتٰى رَاهِبًا) বলতে আল্লাহ ভীতিসম্পন্ন, ‘ইবাদাতকারী ও সৃষ্টি থেকে যিনি আলাদা থাকেন, খিষ্টানদের ধর্মযাজক। আর হাদীসে ইঙ্গিত আছে, উল্লেখিত ঘটনাটি ঈসা (আঃ)-কে পৃথিবী থেকে উঠিয়ে নেয়ার পর ঘটেছিল। কেননা সন্ন্যাসী পন্থার আবিষ্কার তার পরে হয়েছিল যেমন কুরআনে এ ব্যাপারে ভাষ্য এসেছে।
(فَسَأَلَه فَقَالَ: أَلَهَ تَوْبَةٌ) অর্থাৎ- এ ধরনের অপরাধের পর এ ধরনের কর্মের জন্য কি কোন তাওবাহ্ আছে? (أَلَهَ تَوْبَةٌ) কারী বলেন, মিশকাতের এক কপিতে আছে (ألى توبة) ‘‘আমরা কি তাওবাহ্ করার কোন সুযোগ আছে’’। ‘উবায়দুল্লাহ মুবারকপূরী বলেন, আমি বলব, বূলাক-এর (জায়গা) ১২৯৪ সনের ছাপা অনুযায়ী আমাদের কাছে বিদ্যমান মাসাবীহের এক কপিতে আছে (فقال له هل لى توبة) অর্থাৎ- অতঃপর লোকটি পাদ্রীকে বলল, আমার কি কোন তাওবার সুযোগ আছে? ‘আয়নী এবং কুসতুলানী-এর মূলকপিতে আছে, (ففال له هل من توبة) ‘আয়নী বলেন, অতঃপর লোকটি পাদ্রীকে বলল, আমার কি তাওবাহ্ করার কোন সুযোগ আছে? মুসলিমের এক বর্ণনাতে আছে, নিশ্চয়ই লোকটি নিরানব্বই লোককে হত্যা করেছে, এখন তার কি কোন তাওবাহ্ করার সুযোগ আছে?
(قالا) অর্থাৎ- নিরানব্বই জন ব্যক্তি হত্যা করার পর তার বা তোমার তাওবাহ্ করার কোন সুযোগ নেই। পাদ্রীর মনে লোকটির ব্যাপারে ব্যাপক ভয়ের কারণে এবং এত অধিক পরিমাণ লোককে অন্যায়ভাবে হত্যা করার পর তার তাওবাহ্ যদি গ্রহণ করা হয় তাহলে তা অসম্ভবপর ব্যাপার মনে করে লোকটিকে তিনি এমন ফাতাওয়া দিয়েছিলেন। (فقتله) অর্থাৎ- পাদ্রীকে হত্যা করে একশত হত্যা পূর্ণ করল। কারী বলেন, সম্ভবত লোকটি তার এ ধারণার কারণে এমন কাজ করেছিল যে, তার তাওবাহ্ কবূল করা হবে না যদিও তার কাছে প্রাপ্যদাবীদাররা তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যান।
এক মতে বলা হয়েছে, পাদ্রীর ফাতাওয়া লোকটির নিকট এ ভাব প্রকাশ করেছে যে, তার কোন মুক্তি নেই। সুতরাং সে রহমাত থেকে নিরাশ হয়ে গেল, অতঃপর আল্লাহ তাকে অনুভূতি শক্তি দিলে সে কৃতকর্মের উপর লজ্জিত হয়ে সে সম্পর্কে প্রশ্ন করতে লাগল।
(وَجَعَلَ يَسْأَلُ) অতঃপর লোকটি যার কাছে যেয়ে তার তাওবাহ্ কবূল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবে, এমন লোকের অন্বেষণে জিজ্ঞেস করতে থাকলো। অবশেষে লোকটি এক ‘আলিম ব্যক্তিকে বলল, ‘‘নিশ্চয়ই আমি একশত লোককে হত্যা করেছি এখন আমার কি কোন তাওবাহ্ আছে?’’ এ কথা বলার পর ‘আলিম ব্যক্তি বলল, হ্যাঁ, আপনার ও আপনার তাওবার মাঝে কে বাধা দিবে? হিশাম-এর বর্ণনাতে আছে, অতঃপর লোকটি পৃথিবীর সর্বাধিক জ্ঞানী সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তাকে এক বিদ্বান ব্যক্তি সম্পর্কে বলে দেয়া হল, অতঃপর লোকটি বিদ্বান ব্যক্তির কাছে বলল, নিশ্চয়ই সে একশত জন লোককে হত্যা করেছে, এখন কি তার কোন তাওবার সুযোগ আছে? উত্তরে ‘আলিম ব্যক্তি বলল, হ্যাঁ, তার মাঝে ও তাওবার মাঝে কোন জিনিস বাধা দিবে?
(ائْتِ قَرْيَةَ كَذَا) অর্থাৎ- তুমি এমন গ্রামে যাও যার অধিবাসীগণ সৎ এবং আল্লাহর কাছে তাওবাহ্ করে ও তাদের সাথে ‘ইবাদাত কর অতঃপর লোকটি ঐ গ্রামের দিকে যেতে থাকলো। হিশাম-এর বর্ণনাতে আছে, লোকটি এ রকম গ্রামের দিকে চলল, অর্থাৎ- ‘‘যে গ্রামের কিছু বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছিল’’। কেননা সে গ্রামে কিছু মানুষ আছে তারা আল্লাহর ‘ইবাদাত করে। সুতরাং তাদের সাথে আল্লাহর ‘ইবাদাত কর এবং তোমার গ্রামের দিকে প্রত্যাবর্তন করিও না, কেননা তা মন্দ গ্রাম। অতঃপর সে চলতে থাকলো এমনকি যখন সে অর্ধপথ অতিক্রম করল তখন তাকে মৃত্যু গ্রাস করল। আর এ গ্রামের নাম ছিল নুসরা, পক্ষান্তরে যে গ্রামের দিক থেকে এসেছিল সে তার নাম কুফরাহ্। যেমন ত্ববরানীতে ‘আবদুল্লাহ বিন ‘আমর ইবনুল ‘আস (রাঃ)-এর হাদীস জাইয়িদ সানাদে আছে। নাবাবী বলেন, তার উক্তি (انطلق إلى أرض كذا الخ) অর্থাৎ- সে এ ধরনের গ্রামের দিকে চলল শেষ পর্যন্ত। এতে আছে তাওবাহকারীর ঐ সমস্ত স্থান থেকে আলাদা থাকা মুস্তাহাব যাতে গুনাহ সংঘটিত হয়েছে এবং ঐ বন্ধু থেকে আলাদা থাকা যারা এ ব্যাপারে সহযোগিতা যোগায় এবং তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা যতক্ষণ তারা এ অবস্থার উপর থাকে। আর তাদের পরিবর্তে ভালো, সৎ, বিদ্বান, আল্লাহভীরু ‘ইবাদাতকারীদের বন্ধুত্ব গ্রহণ করা এবং এর মাধ্যমে তার তাওবাতে গুরুত্ব দেয়া।
(فَأَدْرَكَهُ الْمَوْتُ) অর্থাৎ- অতঃপর মরণের আলামাত বা মরণ যন্ত্রণা তাকে গ্রাস করল, অর্থাৎ- লোকটি ঐ গ্রামের দিকে যেতে ইচ্ছা করে তার মাঝপথে পৌঁছল তখন মরণ তাকে পেয়ে গেল।
(فَنَاءَ بِصَدْرِه) অর্থাৎ- অতঃপর সে তার বক্ষকে ঐ গ্রামের দিকে হেলিয়ে দিল তাওবার জন্য যে গ্রামের দিকে যাচ্ছিল।
(فَاخْتَصَمَتْ فِيهِ مَلَائِكَةُ الرَّحْمَةِ وَمَلَائِكَةُ الْعَذَابِ) হিশাম-এর বর্ণনাতে একটু বেশি এসেছে, তাতে আছে, অতঃপর রহমাতের মালায়িকাহ্ (ফেরেশতারা) বলল, লোকটি তাওবাহ্ করার উদ্দেশে তার অন্তরকে আল্লাহমুখী করে এসেছে। পক্ষান্তরে ‘আযাবের মালায়িকাহ্ (ফেরেশতা) বলল, নিশ্চয়ই সে কোন ভালো ‘আমল করেনি। অতঃপর তাদের কাছে মানুষের আকৃতিতে একজন মালাক (ফেরেশতা) এলো, অতঃপর মালায়িকাহ্ (ফেরেশতা) তাকে তাদের মাঝে স্থাপন করল, অতঃপর মানুষরূপী মালাক দলকে বলল, তোমরা দু’ জমির মাঝে মেপে দেখ মৃত লোকটি যে জমির অধিক নিকটবর্তী হবে তাকে ঐ জমির লোক হিসেবেই গণ্য করা হবে। নাবাবী বলেন, দুই গ্রামের মাঝে মালায়িকাহর (ফেরেশতার) মাপা এবং মালাক দল যাকে তাদের মাঝে ফায়সালাকারী নিয়োগ করেছিল তার ফায়সালা ঐ ব্যাপারে সম্ভাবনা রাখছে যে, মালাক দলের কাছে মৃত লোকটির অবস্থা সংশয়পূর্ণ ছিল এবং তার ব্যাপারে মতানৈক্য হওয়ার সময় আল্লাহ মালাক দলকে নির্দেশ করেছিল তাদের পাশ দিয়ে যারা অতিক্রম করবে তাদের একজনকে বিচারক নিয়োগ করতে। অতঃপর একজন মালাক মানুষের আকৃতিতে অতিক্রম করলে মালাক দল তাকে ঐ ফায়সালার ব্যাপারে প্রস্তাব দেয়।
(فَوُجِدَ إِلٰى هٰذِه) অর্থাৎ- ঐ গ্রামের দিকে যে দিকে লোকটি যাওয়ার ইচ্ছা করেছিল আর তার নাম হল নুসরাহ্।
(وَإِلٰى هٰذِه) অর্থাৎ- ঐ গ্রামের দিকে তাওবার উদ্দেশে যে গ্রাম থেকে বের হয়েছিল আর তার নাম কুফ্রাহ্ এবং বুখারীতে (وأوحى) এসেছে।
(أَنْ تَبَاعَدِىْ) অর্থাৎ- মৃত ব্যক্তি থেকে দূর হও।
(فَوُجِدَ إِلٰى هٰذِه أَقْرَبَ) হিশাম-এর বর্ণনাতে আছে, অতঃপর মালায়িকাহ্ (ফেরেশতা) মেপে মৃত লোকটিকে ঐ জমির অধিক নিকটবর্তী পেল যে জমির দিকে সে যাওয়ার ইচ্ছা করেছিল।
পরিচ্ছেদঃ ২. প্রথম অনুচ্ছেদ - ক্ষমা ও তাওবাহ্
২৩২৮-[৬] আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ঐ সত্তার কসম যাঁর হাতে আমার জীবন! যদি তোমরা গুনাহ না করতে, তাহলে আল্লাহ তা’আলা তোমাদেরকে সরিয়ে এমন জাতিকে সৃষ্টি করতেন যারা গুনাহ করত ও আল্লাহ তা’আলার কাছে ক্ষমা চাইত। আর আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে ক্ষমা করে দিতেন। (মুসলিম)[1]
بَابُ الْاِسْتِغْفَارِ وَالتَّوْبَةِ
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَوْ لَمْ تُذْنِبُوا لَذَهَبَ اللَّهُ بِكُمْ وَلَجَاءَ بِقَوْمٍ يُذْنِبُونَ فَيَسْتَغْفِرُونَ اللَّهَ فَيَغْفِرُ لَهُمْ» . رَوَاهُ مُسلم
ব্যাখ্যা: (وَلَجَاءَ بِقَوْمٍ) অর্থাৎ- অবশ্যই তোমাদেরকে নিয়ে চলে যেতেন এবং তোমাদেরকে ধ্বংস করে দিতেন এবং তোমাদের মধ্য থেকেই বা তোমাদের ছাড়া অন্যদের থেকে অন্য আরেকটি সম্প্রদায় বের করতেন। (يُذْنِبُونَ) অর্থাৎ- তাদের থেকে গুনাহ প্রকাশ পাওয়া সম্ভব হত।
(فَيَغْفِرُ لَهُمْ) অর্থাৎ- غفار এবং غفور সিফাতের কারণে আল্লাহ তাদের ক্ষমা করবেন। এ ব্যাপারে আল্লাহ বলেন, ‘‘তোমরা তোমাদের পালনকর্তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর, নিশ্চয়ই তোমাদের পালনকর্তা অত্যন্ত ক্ষমাশীল’’- (সূরা নূহ ৭১ : ১০)। উপাস্যগত বৈশিষ্ট্যের আবশ্যকতার কারণে মানব জাতির মাঝে অবাধ্যতার উপস্থিতি। অর্থাৎ- তোমরাও যদি মালায়িকাহর (ফেরেশতাদের) মতো গুনাহমুক্ত থাকতে তাহলে আল্লাহ তোমাদের এ পৃথিবী থেকে নিয়ে চলে যেতেন এবং এমন জাতি নিয়ে আসতেন যাদের থেকে গুনাহ সংঘটিত হত যাতে الغفران এবং العفو গুণের অর্থ নষ্ট না হয়। সুতরাং এ হাদীসে গুনাহে ডুবে যাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করা হয়নি।
তুরবিশতী বলেনঃ এ হাদীস থেকে উদ্দেশ্য হল, নিশ্চয়ই আল্লাহ যেমন দয়াকারীর প্রতি দয়া করতে ভালবাসেন তেমনি পাপীর পাপ এড়িয়ে চলাও পছন্দ করেন। আর এর উপর প্রমাণ বহন করে আল্লাহর একাধিক নাম, গাফফার, তাওয়াব, হালীম এবং ‘আফুব্যু। সুতরাং আল্লাহ এমন নন যে, বান্দাদেরকে গুনাহ থেকে বিরত থাকতে মালায়িকাহর (ফেরেশতার) মতো তাদেরকে একই গুণের উপর সৃষ্টি করবেন। বরং তাদের মাঝে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন যে তার স্বভাব অনুযায়ী প্রবৃত্তির দিকে ঝুকবে ফিতনাহগ্রস্ত হবে এবং প্রবৃত্তির প্রতি সংশয়পূর্ণ হবে। অতঃপর তাকে তা থেকে বেঁচে থাকতে তাকে দায়িত্ব দিবেন, অপরাধী হওয়া থেকে তাকে সতর্ক করবে। পরীক্ষায় পতিত করার পর তাকে তাওবার সাথে পরিচিত করবো। সুতরাং বান্দা যদি আল্লাহর সাথে কৃত প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করে তাহলে তার পুণ্য আল্লাহর কাছে থাকবে। পক্ষান্তরে পথ ভুল করলে তার সামনে তাওবাহ্ করার সুযোগ থাকবে।
সুতরাং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এ হাদীস দ্বারা উদ্দেশ্য হলো আল্লাহ তা‘আলা মালায়িকাহ্ (ফেরেশতা)’কে যে বৈশিষ্ট্যের উপর তৈরি করেছেন তোমাদেরকে যদি সে বৈশিষ্ট্যের উপর তৈরি করা হত, তাহলে অবশ্যই আল্লাহ এমন জাতি নিয়ে আসতেন যাদের দ্বারা গুনাহ সম্পাদিত হত। অতঃপর আল্লাহ কৌশলের চাহিদা মোতাবেক তাদের কাছে ঐ সমস্ত গুণাবলী নিয়ে প্রকাশ পেতেন, কেননা তিনি গাফফার যার বৈশিষ্ট্য ক্ষমা করা, যেমনি তিনি রাজ্জাক যার বৈশিষ্ট্য দান করা।
পরিচ্ছেদঃ ২. প্রথম অনুচ্ছেদ - ক্ষমা ও তাওবাহ্
২৩২৯-[৭] আবূ মূসা আল আশ্’আরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলা রাতে নিজের হাত বাড়িয়ে দেন, যাতে দিনের বেলায় গুনাহকারীর তওবা্ করতে পারেন। আবার দিনের বেলায় তিনি তার হাত বাড়িয়ে দেন, যাতে রাতের বেলায় গুনাহকারীর তওবা্ করতে পারেন। এভাবে তিনি হাত প্রসারিত করতে থাকবেন যতদিন না সূর্য পশ্চিম দিকে উদিত হবে। (মুসলিম)[1]
بَابُ الْاِسْتِغْفَارِ وَالتَّوْبَةِ
وَعَنْ أَبِي مُوسَى رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «إِنَّ اللَّهَ يَبْسُطُ يَدَهُ بِاللَّيْلِ لِيَتُوبَ مُسِيءُ النَّهَارِ وَيَبْسُطُ يَدَهُ بِالنَّهَارِ لِيَتُوبَ مُسِيءُ اللَّيْلِ حَتَّى تَطْلُعَ الشَّمْسُ مِنْ مَغْرِبِهَا» . رَوَاهُ مُسْلِمٌ
ব্যাখ্যা: (إِنَّ اللّٰهَ يَبْسُطُ يَدَه) বলা হয়েছে, হাদীসাংশে হাত প্রশস্ত করা এর দ্বারা উদ্দেশ্য অনুসন্ধান করা। কেননা মানুষের স্বভাব হল তাদের কেউ যখন কারো কাছ থেকে কিছু সন্ধান করে তখন সে তার দিকে নিজ হাতের তালুকে বিস্তৃত করে, অর্থাৎ- আল্লাহ পাপীদেরকে তাওবার দিকে আহবান করছেন।
(لِيَتُوبَ مُسِىْءُ النَّهَارِ) অর্থাৎ- তাদের শাস্তির ব্যাপারে তিনি তাড়াতাড়ি করেন না বরং তাদেরকে তিনি ঢিল দেন যাতে তারা তাওবাহ্ করে।
(وَيَبْسُطُ يَدَه بِالنَّهَارِ لِيَتُوبَ مُسِىْءُ اللَّيْلِ) নাবাবী বলেন, এর অর্থ হল, তিনি পাপীদের থেকে দিনে রাত্রে তাওবাহ্ গ্রহণ করবেন যতক্ষণ পর্যন্ত পশ্চিম দিক থেকে সূর্য না উদিত হবে। আর তিনি তার তাওবাহ্ গ্রহণ কোন সময়ের সাথে নির্দিষ্ট করেননি। সুতরাং তাওবাহ্ গ্রহণের ক্ষেত্রে হাত বিস্তৃতকরণ রূপকার্থবোধক। মাযুরী বলেন, হাত বিস্তৃতকরণ দ্বারা তাওবাহ্ গ্রহণ উদ্দেশ্য। হাদীসে কেবল হাত বিস্তৃতকরণ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, কেননা ‘আরবরা যখন কোন জিনিসের প্রতি সন্তুষ্ট থাকে তখন সে তার হাতকে তা গ্রহণের জন্য বিস্তৃত করে এবং যখন কোন জিনিসকে অপছন্দ করে তখন তার হাতকে সে জিনিস থেকে গুটিয়ে নেয়। অতএব তাদেরকে ইন্দ্রিয়ানুভূত বিষয় দ্বারা সম্বোধন করা হয়েছে যা তারা বুঝে আর তা রূপকার্থবোধক, কেননা আল্লাহর ক্ষেত্রে দোষণীয় হাত সাব্যস্ত করা অসম্ভব, আল্লাহর হাত আল্লাহর মতো।
(حَتّٰى تَطْلُعَ الشَّمْسُ مِنْ مَغْرِبِهَا) অর্থাৎ- ‘‘তখন তাওবার দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে’’। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘‘যেদিন আপনার পালনকর্তার কিছু নিদর্শন আগমন করবে তখন কোন আত্মার ঈমান আনয়ন তার কোন কাজে আসবে না’’- (সূরা আল আন্‘আম ৬ : ১৮৫)।
ইবনুল মালিক বলেন, এ হাদীসের অর্থ এবং এর মতো অন্যান্য হাদীস ঐ ব্যাপারে প্রমাণ বহন করছে যে, পশ্চিম দিকে সূর্য উদিত হওয়ার পর থেকে নিয়ে কিয়ামাত সংঘটিত হওয়া পর্যন্ত তাওবাহ্ গ্রহণ করা হবে না।
পরিচ্ছেদঃ ২. প্রথম অনুচ্ছেদ - ক্ষমা ও তাওবাহ্
২৩৩০-[৮] ’আয়িশাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ বান্দা যখন গুনাহ করার পর তা স্বীকার করে (অনুতপ্ত হয়) আর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায়। আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। (বুখারী, মুসলিম)[1]
بَابُ الْاِسْتِغْفَارِ وَالتَّوْبَةِ
وَعَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا قَالَتْ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسلم: «إِنَّ الْعَبَدَ إِذَا اعْتَرَفَ ثُمَّ تَابَ تَابَ الله عَلَيْهِ»
ব্যাখ্যা: (إِنَّ الْعَبَدَ إِذَا اعْتَرَفَ) অর্থাৎ- ‘‘তার গুনাহের ব্যাপারে যখন স্বীকার করবে’’। কারী বলেন, অর্থাৎ- বান্দা তার দোষী সাব্যস্ত হওয়ার ব্যাপারে স্বীকার করবে এবং তার গুনাহ সে জানবে।
(ثُمَّ تَابَ) অর্থাৎ- তার গুনাহ হতে আল্লাহর কাছে তাওবাহ্ করবে।
কারী বলেন, বান্দা যখন তাওবার সকল রুকন বাস্তবায়ন করবে।
(تَابَ الله عَلَيْهِ) অর্থাৎ- আল্লাহ তার তাওবাহ্ গ্রহণ করবেন। আর তা মূলত ‘‘তিনিই তার বান্দাদের থেকে তাওবাহ্ কবূল করেন’’- (সূরা আশ্ শূরা ৪২ : ২৫) আল্লাহর এ বাণীর কারণে। ত্বীবী বলেন, এর হাক্বীকত হল নিশ্চয়ই আল্লাহ তার দয়া সহকারে তার বান্দার কাছে ফিরবেন।
হাদীসটি অপবাদজনিত দীর্ঘ একটি হাদীসের অংশ যার পূর্বের অংশ হল, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ হে ‘আয়িশাহ্! তোমার সম্পর্কে আমার কাছে এ রকম এ রকম কথা পৌঁছেছে, অর্থাৎ- ‘আয়িশাহ্ (রাঃ)-কে যে ব্যাপারে অপবাদ দেয়া হয়েছে সে ব্যাপারে ইঙ্গিত। সুতরাং তুমি যদি নির্দোষী হও তাহলে অচিরেই আল্লাহ তোমাকে অপবাদ থেকে মুক্ত করবেন আর যদি তুমি গুনাহে জড়িত হয়ে থাক তাহলে আল্লাহর কাছে তাওবাহ্ কর এবং ক্ষমা প্রার্থনা কর, কেননা বান্দা যখন তার গুনাহ সম্পর্কে স্বীকারোক্তি দেয় ... হাদীসের শেষ পর্যন্ত।
পরিচ্ছেদঃ ২. প্রথম অনুচ্ছেদ - ক্ষমা ও তাওবাহ্
২৩৩১-[৯] আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি পশ্চিম দিক হতে সূর্য উদয়ের (কিয়ামতের) আগে তওবা্ করবে আল্লাহ তা’আলা তার তওবা্ কবূল করবেন। (মুসলিম)[1]
بَابُ الْاِسْتِغْفَارِ وَالتَّوْبَةِ
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَنْ تَابَ قَبْلَ أَنْ تَطْلُعَ الشَّمْسُ مِنْ مَغْرِبِهَا تَابَ الله عَلَيْهِ» . رَوَاهُ مُسلم
ব্যাখ্যা: অত্র হাদীসটি [অর্থাৎ- ‘‘যেদিন আপনার পালনকর্তার কিছু নির্দশন আগমন করবে তখন কোন আত্মার ঈমান আনয়ন তার কোন কাজে আসবে না’’- (সূরা আল আন্‘আম ৬ : ১৫৮)] আল্লাহর এ বাণীর ব্যাখ্যা। তবে আয়াতটি ঈমান কবূল না হওয়ার সাথে নির্দিষ্ট। পক্ষান্তরে হাদীসটি স্বাভাবিকভাবে তাওবাহ্ গ্রহণ না হওয়ার উপর প্রমাণ বহন করছে, চাই তাওবাহ্ কুফরীর ক্ষেত্রে হোক চাই অবাধ্যতার ক্ষেত্রে হোক। আর এ ব্যাপারে বিদ্বানদের মাঝে মতানৈক্য রয়েছে। সুতরাং চিন্তার প্রয়োজন। এভাবে লাম্‘আতে আছে।
(تَابَ الله عَلَيْهِ) অর্থাৎ- আল্লাহ তার তাওবাহ্ গ্রহণ করেছেন, তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন। ইমাম নাবাবী (রহঃ) বলেন, পশ্চিম দিক হতে সূর্য উদিত হওয়া তাওবাহ্ গ্রহণের সীমা।
বিশুদ্ধ হাদীসে এসেছে, নিশ্চয়ই তাওবাহ্ গ্রহণের একটি খোলা দরজা আছে, সর্বদা তাওবাহ্ গ্রহণ হতেই থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত দরজা বন্ধ না করা হবে। অতঃপর যখন পশ্চিম দিক হতে দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে এবং যে ব্যক্তি ইতোপূর্বে তাওবাহ্ করেনি তার তাওবাহ্ গ্রহণ বাধাপ্রাপ্ত হবে। আর এটি হল আল্লাহর [অর্থাৎ- ‘‘যেদিন আপনার পালনকর্তার কিছু নির্দশন আগমন করবে তখন কোন আত্মার ঈমান আনয়ন তার কোন কাজে আসবে না। যদি ইতোপূর্বে সে ঈমান এনে না থাকে অথবা তার ঈমানের সমর্থনে কোন কল্যাণ উপার্জন করে না থাকে’’- (সূরা আল আন্‘আম ৬ : ১৫৮)] এ বাণীর মর্মার্থ।
তাওবার দ্বিতীয় একটি সীমা আছে, আর তা হল মৃত্যুশয্যায় শায়িত ব্যক্তি তার গলাতে মৃত্যুর গড়গড়া আসার পূর্বে তাওবাহ্ করা। যেমন বিশুদ্ধ হাদীসে এরূপ এসেছে। গড়গড়া হল আত্মা ছিনিয়ে নেয়ার মুহূর্ত। সুতরাং ঐ মুহূর্তে তাওবাহ্ বা কোন কিছু গ্রহণ করা হবে না। কেননা এগুলো বিবেচনার বিষয় অদৃশ্যের প্রতি ঈমান আনার ক্ষেত্রে। আর এমন মুহূর্তে তার কৃত কোন ওয়াসিয়্যাত এবং অন্য কোন কিছু বাস্তবায়ন করা হবে না।
পরিচ্ছেদঃ ২. প্রথম অনুচ্ছেদ - ক্ষমা ও তাওবাহ্
২৩৩২-[১০] আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলা তার বান্দার তওবা্ করায় অত্যন্ত আনন্দিত হন যখন সে তাঁর কাছে তওবা্ করে। তোমাদের মধ্যে ওই ব্যক্তির খুশীর চেয়ে অধিক খুশী হন, যে ব্যক্তির আরোহণের বাহন মরুভূমিতে তার কাছ থেকে ছুটে পালায়, আর এ বাহনের উপর আছে তার খাবার ও পানীয়। এ কারণে সে হতাশ-নিরাশ হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় আরোহণের বাহন সম্পর্কে একেবারেই নিরাশ হয়ে একটি গাছের কাছে এসে সে এর ছায়ায় শুয়ে পড়ে। এমন সময় সে হঠাৎ দেখে, বাহন তার কাছে এসে দাঁড়ানো। সে বাহনের লাগাম ধরে আর আনন্দে আবেগআপ্লুত হয়ে বলে উঠে, হে আল্লাহ! তুমি আমার বান্দা আর আমি তোমার প্রভু। সে আনন্দের আতিশয্যে এ ভুল করে। (মুসলিম)[1]
بَابُ الْاِسْتِغْفَارِ وَالتَّوْبَةِ
وَعَنْ أَنَسٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَلَّهُ أَشَدُّ فَرَحًا بِتَوْبَةِ عَبْدِهِ حِينَ يَتُوبُ إِلَيْهِ مِنْ أَحَدِكُمْ كانَ رَاحِلَتُهُ بِأَرْضٍ فَلَاةٍ فَانْفَلَتَتْ مِنْهُ وَعَلَيْهَا طَعَامُهُ وَشَرَابُهُ فَأَيِسَ مِنْهَا فَأَتَى شَجَرَةً فَاضْطَجَعَ فِي ظِلِّهَا قَدْ أَيِسَ مِنْ رَاحِلَتِهِ فَبَيْنَمَا هُوَ كذلكَ إِذ هُوَ بِهَا قَائِمَةً عِنْدَهُ فَأَخَذَ بِخِطَامِهَا ثُمَّ قَالَ مِنْ شِدَّةِ الْفَرَحِ: اللَّهُمَّ أَنْتَ عَبْدِي وَأَنَا رَبُّكَ أَخْطَأَ مِنْ شِدَّةِ الْفَرَحِ . رَوَاهُ مُسلم
ব্যাখ্যা: (أَشَدُّ فَرَحًا) এক মতে বলা হয়েছে, এ রকম ক্ষেত্রে আনন্দ বলতে সন্তুষ্টি, দ্রুত কবূল এবং উত্তম প্রতিদানকে বুঝায়। (بِتَوْبَةِ عَبْدِه) অর্থাৎ- তিনি তার মু’মিন বান্দার তাওবায় সর্বাধিক সন্তুষ্ট ও সর্বাধিক গ্রহণকারী।
(حِينَ يَتُوبُ إِلَيْهِ مِنْ أَحَدِكُمْ) অর্থাৎ- ‘‘তোমাদের কারো আনন্দ ও সন্তুষ্টি অপেক্ষা’’। একমতে বলা হয়েছে, আদম সন্তানের গুণসমূহের ক্ষেত্রে পরিচিত আনন্দ, আল্লাহর ওপর প্রয়োগ বৈধ নয়। কেননা তা এমন আনন্দ যা বিজয় লাভের সময় কোন ব্যক্তি নিজ অন্তরে অনুভব করে থাকে, যার মাধ্যমে ব্যক্তির ঘাটতি পূর্ণতা লাভ করে, অথবা এর মাধ্যমে ব্যক্তি তার ত্রুটিকে বাধা দেয় অথবা এর মাধ্যমে ব্যক্তি তার নিজ থেকে ক্ষতি অথবা ঘাটতিকে প্রতিহত করে। আর এটা আল্লাহর জন্য প্রযোজ্য নয়, কেননা তিনি সত্তাগতভাবে পরিপূর্ণ, অস্তিত্বের দিক দিয়ে অমুখাপেক্ষী, যার সাথে কোন ঘাটতি বা অসম্পূর্ণতা শামিল হয় না। অতএব এর অর্থ কেবল সন্তুষ্টি। সালাফগণ এ থেকে এবং এ ধরনের অন্যান্য বাণী থেকে ‘আমলসমূহের ক্ষেত্রে উৎসাহিতকরণ এবং আল্লাহর কৃপা সম্পর্কে খবর প্রদান উদ্দেশ্য করেছেন। তারা আল্লাহর জন্য এ সকল গুণাবলী সাব্যস্ত করেছেন এবং আল্লাহ তার সৃষ্টজীবের গুণাবলী থেকে পবিত্র তাদের বিশ্বাস থাকার কারণে এ সমস্ত গুণাবলীর ব্যাখ্যা নিয়ে তাঁরা ব্যস্ত হননি।
পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি তা‘বীল বা অপব্যাখ্যা নিয়ে ব্যস্ত হয়েছে তার দু’টি পন্থা আছে। দু’টির একটি হল, নিশ্চয়ই তাশবীহ বা সাদৃশ্য যৌগিকের এককের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে তা জ্ঞানগত যৌগিক। বরং সামষ্টিকভাবে সারাংশ গ্রহণ করা হবে আর তা চূড়ান্ত সন্তুষ্টি। তাশবীহ-এর দৃষ্টিতে এর প্রকাশ কেবল শ্রোতার অন্তরে সন্তুষ্টির অর্থ স্থির করা ও পরিকল্পনা করা। আর দু’টি পথের দ্বিতীয়টি হল, উপমা পেশকরণ আর তা হল মুশাব্বাহের জন্য এমন অবস্থাসমূহ পরিকল্পনা করা যে অবস্থাগুলো মুশাব্বাহবিহীর আছে আর সে অবস্থাগুলো থেকে মুশাব্বাহের জন্য উপস্থাপন করা, যা সময়ে সময়ে তার সাথে অনুকূল। আর তা এমনভাবে যে, সেগুলো থেকে কোন বিশৃঙ্খলা হয় না, অর্থাৎ- নিশ্চয়ই তা উপমা পেশকরণ অধ্যায়ের আওতাভুক্ত। আর তা হল অর্জিত অবস্থাকে সন্তুষ্টি সম্পাদনের সাথে সাদৃশ্য দেয়। হাদীসে উল্লেখিত ধরনে যারা সফলতায় রয়েছে তাদের অবস্থার সাথে তাওবাহকারী বান্দার প্রতি অগ্রগামী হওয়াকে সাদৃশ্য দেয়া। অতঃপর মুশাব্বাহকে ছেড়ে মুশাব্বাহবিহীকে উল্লেখ করা।
কুরতুবী (রহঃ) বলেন, এটা এমন এক উদাহরণ যার মাধ্যমে আল্লাহ কর্তৃক তার তাওবাহকারী বান্দার তাওবাহ্ দ্রুত গ্রহণের বর্ণনাকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। আর নিশ্চয়ই তিনি বান্দার প্রতি ক্ষমা নিয়ে আগমন করেন এবং যার ‘আমলের প্রতি সন্তুষ্টি হন তার সাথে যথার্থ লেনদেন করেন। এ উপমার করণ হল নিশ্চয়ই শয়তানের কব্জাতে এবং বন্দিদশাতে পড়ে অবাধ্যতার দরুন এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। কখনো ধ্বংসের মুখোমুখী হয়। অতঃপর আল্লাহ যখন তার প্রতি দয়া করেন এবং তাকে তাওবাহ্ করার তাওফীক দেন তখন সে ঐ অবাধ্যতার অকল্যাণ থেকে বেরিয়ে আসে, শয়তানের বন্দিদশা এবং ঐ ধ্বংস থেকে মুক্তি পায় যার উপক্রম সে হয়েছিল। অতঃপর আল্লাহ তার করুণা ও ক্ষমা নিয়ে বান্দার দিকে অগ্রগামী হয়। পক্ষান্তরে ঐ আনন্দ যা সৃষ্টিজীবের গুণাবলীর অন্তর্ভুক্ত তা আল্লাহর ক্ষেত্রে অসম্ভব। কিন্তু এ আনন্দ শেষ ফলাফলের মুহূর্তে আর তা হল যার প্রতি আনন্দ প্রকাশ করা হয়েছে তার অভিমুখী হওয়া এবং তার জন্য সুউচ্চ স্থান অনুমোদন করা। আর এটি আল্লাহর ক্ষেত্রে সঠিক। সুতরাং ফারহ বা আনন্দ বলে আনন্দের শেষ ফলাফলকে বুঝানো হয়েছে।
আল্লাহর সন্তুষ্টি সম্পর্কে ফারহ তথা আনন্দের প্রয়োগ রূপকার্থে। কখনো কখনো বস্ত্ত সম্পর্কে তার কারণ দ্বারা বিশ্লেষণ করতে হয় অথবা তার থেকে অর্জিত অবস্থা সম্পর্কে। কেননা যে কোন কিছুর প্রতি আনন্দিত হয় তিনি তার কর্তাকে চাওয়া অনুযায়ী দান করেন সে যা অনুসন্ধান করে তা তার জন্য ব্যয় করে। সুতরাং ফারহ বা আনন্দ দ্বারা আল্লাহর দান এবং তার করুণার প্রশস্ততা সম্পর্কে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
ইমাম ত্বীবী বলেনঃ এর উদ্দেশ্য পূর্ণ সন্তুষ্টি। কেননা পরিচিত ফারহ বা আনন্দ আল্লাহর উপর প্রয়োগ করা বৈধ নয়। পূর্ববর্তী আহলে হাদীসগণ এ ধরনের উদাহরণ থেকে সৎকর্মসমূহে উৎসাহ প্রদান এবং সৃষ্টির গুণাবলী থেকে পবিত্র হওয়ার সাথে সাথে বান্দার উপর আল্লাহর অনুগ্রহের উন্মোচন বুঝাতেন এবং তারা এ শব্দসমূহের অর্থ ও এ নিরাপদ পথ সম্পর্কে অনুসন্ধান চালায়নি। এর থেকে পণ্ডিতের পা পিছলে যাবে এটা খুব কম। তুরবিশতী বলেন, অতঃপর এ উক্তি এবং এর মত আরো উক্তি যা আল্লাহর দিকে সম্বন্ধ করা হয়েছে। অথচ আল্লাহ জানেন, নিশ্চয়ই এটি এ স্থান ছাড়া যা গত হয়েছে তাতে আদম সন্তানের গুণাবলী সম্পর্কে মানুষ পরস্পর যা জানে তার অন্তর্ভুক্ত। নিশ্চয়ই নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন অদৃশ্যময় উদ্দেশ্য বর্ণনার ইচ্ছা করেন তখন ঐ ব্যাপারে ঐ বিষয়ের জন্য কোন অর্থবোধক শব্দ তার অনুগত না হলে তখন সে ক্ষেত্রে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুযোগ রয়েছে এমন এক শব্দ নিয়ে আসার যা উদ্দেশিত অর্থ অপেক্ষা নিম্ন স্তরের। নিশ্চয়ই আদম সন্তান থেকে তাওবাহ্ আল্লাহর নিকট সর্বোত্তম স্থানে সংঘটিত হয় নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন এ বিষয়ে বর্ণনা করার ইচ্ছা করলেন তখন সে সম্পর্কে الفرح (আনন্দ) শব্দ দিয়ে প্রকাশ করেছেন যা তারা তাদের নিজেদের মাঝে অর্থের দিক নির্দেশনা পায়। আর ওটা মূলত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের জানিয়ে দেয়ার পর যে, ঐ সমস্ত শব্দের প্রয়োগ আল্লাহর গুণাবলীর ক্ষেত্রে জায়িয নয়। আর ঐ সমস্ত শব্দ বলতে তারা তাদের নিজেদের গুণাবলীর ক্ষেত্রে পারস্পরিক যা জেনে থাকে। আর কারো পক্ষে তার কথাবার্তায় এ ধরনের শব্দ গ্রহণ ও সুযোগ গ্রহণ করা একমাত্র নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাড়া অন্য কারো পক্ষে তা হবে না। কেননা তিনি এ ব্যাপারে আল্লাহর অনুমতি ছাড়া সামনে বাড়তেন না। আর এটা এমন মর্যাদা যা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাড়া অন্যের জন্য প্রযোজ্য নয়।
‘উবায়দুল্লাহ মুবারকপূরী (রহঃ) বলেন, আমি বলব, প্রত্যেক ঐ সমস্ত গুণ যে ব্যাপারে স্বয়ং আল্লাহ বা তার রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ণনা দিয়েছেন তা প্রকৃত গুণ রূপক না। আল্লাহ তিনি শুনেন, দেখেন, তিনি যা চান সে ব্যাপারে কথা বলেন এবং যখন চান কথা বলেন, সন্তুষ্ট হন, রাগান্বিত হন, আশ্চর্যান্বিত হন, তার বান্দার তাওবায় আনন্দিত হন। এসব কিছুরই অর্থ জানা তবে তার ধরন অজানা। সুতরাং আমরা এ সমস্ত কিছু তার জন্য সাব্যস্ত করব, তার ধরন বর্ণনা করব না, সৃষ্টজীবের গুণাবলীর সাথে তাঁকে সাদৃশ্য দিব না, তাঁর অপব্যাখ্যা করব না এবং তাঁর অর্থের ত্রুটি করব না।
(كانَ رَاحِلَتُه) কারী বলেন, মিশকাতের অন্য এক কপিতে আছে, (كانت راحلته) ‘উবায়দুল্লাহ মুবারকপূরী বলেন : আমি বলব, সহীহ মুসলিমে যা আছে তা হল, (كان راحلته) মুনযীর এবং জাযারী এভাবে নকল করেছেন রাহিলাহ্ বলতে ঐ উট যার উপর মানুষ আরোহণ করে ও সামগ্রী বহন করে।
(طَعَامُه وَشَرَابُه) অর্থাৎ- বাহন চলে যাওয়ার কারণে চূড়ান্ত বিপদের দিকে চিন্তা হবে এবং পাথেয়, পানি না থাকার কারণে নিজের ধ্বংসের আশংকা।
(ثُمَّ قَالَ مِنْ شِدَّةِ الْفَرَحِ: اَللّٰهُمَّ أَنْتَ عَبْدِىْ وَأَنَا رَبُّكَ أَخْطَأَ مِنْ شِدَّةِ الْفَرَحِ) অর্থাৎ- আল্লাহ তার বাহন তার কাছে ফিরিয়ে দিয়ে তার প্রতি যে দয়া করেছেন সে কারণে প্রশংসা করার ইচ্ছা করল এবং বলতে ইচ্ছা করল, হে আল্লাহ! তুমি আমার প্রভু আমি তোমার বান্দা। অর্থাৎ- সঠিক পদ্ধতি থেকে তার জবান বিচ্যুত হল, ভুল করে বসল এবং ব্যাপক আনন্দের কারণে বলল, হে আল্লাহ! তুমি আমার বান্দা এবং আমি তোমার প্রভু। অতঃপর নিশ্চয়ই এ লোকটির আনন্দ চূড়ান্ত পর্যায়ের এমনিভাবে বান্দার তাওবাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি। ‘ইয়ায বলেন, এ রকম অবস্থাতে হতভম্ব হয়ে মানুষ যা বলে তার কারণে তাকে পাকড়াও করা হবে না। এর প্রমাণ নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এ ঘটনা বর্ণনা করা।
পরিচ্ছেদঃ ২. প্রথম অনুচ্ছেদ - ক্ষমা ও তাওবাহ্
২৩৩৩-[১১] আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কোন বান্দা গুনাহ করে বলে, ’হে আমার রব! আমি গুনাহ করে ফেলেছি। তুমি আমার এ গুনাহ ক্ষমা করে দাও।’ তখন আল্লাহ তা’আলা বলেন, (হে আমার মালায়িকাহ্ (ফেরেশতা)!) আমার বান্দা কি জানে, তার একজন ’রব’ আছেন? যে ’রব’ গুনাহ মাফ করেন অথবা (এর জন্য) তাকে শাস্তি দেন? (তোমরা সাক্ষী থেক) আমি তাকে মাফ করে দিলাম। অতঃপর যতদিন আল্লাহ চাইলেন, সে গুনাহ না করে থাকল। তারপর আবার সে গুনাহ করল ও বলল, ’হে রব’! আমি আবার গুনাহ করে ফেলেছি। আমার এ গুনাহ মাফ করো। তখন আল্লাহ তা’আলা বলেন, আমার বান্দা কি জানে, তার একজন ’রব’ আছেন, যে রব গুনাহ মাফ করেন অথবা এর জন্য শাস্তি দেন। আমি আমার বান্দাকে মাফ করে দিলাম। অতঃপর আল্লাহ যতদিন চাইলেন, সে কোন গুনাহ না করে থাকল। তারপর সে আবারও গুনাহ করল এবং বলল, হে রব! আমি আবার গুনাহ করেছি। তুমি আমার এ গুনাহ ক্ষমা করো। তখন আল্লাহ তা’আলা বলেন, আমার বান্দা কি জানে, তার একজন ’রব’ আছেন, যে রব গুনাহ মাফ করেন অথবা অপরাধের জন্য শাস্তি দেন? আমি আমার বান্দাকে ক্ষমা করলাম। সে যা চায় করুক। (বুখারী, মুসলিম)[1]
بَابُ الْاِسْتِغْفَارِ وَالتَّوْبَةِ
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنَّ عَبْدًا أَذْنَبَ ذَنْبًا فَقَالَ: رَبِّ أَذْنَبْتُ فَاغْفِرْهُ فَقَالَ رَبُّهُ أَعَلِمَ عَبْدِي أَنَّ لَهُ رَبًّا يَغْفِرُ الذَّنْبَ وَيَأْخُذُ بِهِ؟ غَفَرْتُ لِعَبْدِي ثُمَّ مَكَثَ مَا شَاءَ اللَّهُ ثُمَّ أَذْنَبَ ذَنْبًا فَقَالَ: رَبِّ أَذْنَبْتُ ذَنْبًا فَاغْفِرْهُ فَقَالَ رَبُّهُ: أَعَلِمَ عَبْدِي أَنَّ لَهُ رَبًّا يَغْفِرُ الذَّنْبَ وَيَأْخُذُ بِهِ؟ غَفَرْتُ لِعَبْدِي ثُمَّ مَكَثَ مَا شَاءَ اللَّهُ ثُمَّ أَذْنَبَ ذَنبا قالَ: رب أذنبت ذَنبا آخر فَاغْفِر لِي فَقَالَ: أَعَلِمَ عَبْدِي أَنَّ لَهُ رَبًّا يَغْفِرُ الذَّنْبَ وَيَأْخُذُ بِهِ؟ غَفَرْتُ لِعَبْدِي فَلْيَفْعَلْ مَا شَاءَ
ব্যাখ্যা: (فَلْيَفْعَلْ مَا شَآءَ) অর্থাৎ- এমন গুনাহ করতে থাকুক যার পর বিশুদ্ধ তাওবাহ্ থাকে। হাদীসটিতে আছে দ্বিতীয়বার পাপের কারণে প্রথমবারের বিশুদ্ধ তাওবার কোন ক্ষতি সাধন করবে না। বরং তাওবাহ্ তার বিশুদ্ধতার উপর অব্যাহত থাকবে এবং ব্যক্তি দ্বিতীয় অবাধ্যতা থেকে তাওবাহ্ করবে। আর মুনযিরী এমনটিই বলেছেন, (فَلْيَفْعَلْ مَا شَآءَ) এর অর্থ ব্যক্তির অবস্থা যখন এমন হবে যে, সে গুনাহ করবে অতঃপর তাওবাহ্ করবে এবং ক্ষমা প্রার্থনা করবে তখন সে যা ইচ্ছা তা যেন করে। কেননা যখনই সে গুনাহ করবে তখন তার তাওবাহ্ ও ক্ষমা প্রার্থনা তার ঐ গুনাহ মোচনের কারণ হবে, তখন গুনাহ তার ক্ষতি সাধন করবে না। ব্যক্তি গুনাহ করবে, অতঃপর ঐ গুনাহ থেকে অন্তর দ্বারা ক্ষমা প্রার্থনা না করে শুধু মৌখিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করবে। অতঃপর গুনাহতেই আবার লিপ্ত হবে নিশ্চয়ই এ বাক্য দ্বারা তা উদ্দেশ্য নয়। কেননা এ ধরনের তাওবাহ্ মিথ্যাবাদীদের তাওবাহ্।
‘উবায়দুল্লাহ মুবারকপূরী বলেন, আমি বলব, (فَلْيَفْعَلْ مَا شَآءَ) অর্থাৎ- সে যা ইচ্ছা তাই করুক। এ বাণীর অর্থ অনেকের কাছে জটিল হয়ে পড়েছে যেমননিভাবে হাত্বিব বিন বালতা‘আহ্-এর হাদীসে উল্লেখিত বাণীর অর্থ জটিল অনুভূত হয়েছে। কেননা বাণীটির বাহ্যিক রূপ দেখে মনে হচ্ছে বাদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারীদের জন্য প্রত্যেক ধরনের ‘আমল বৈধ এবং ‘আমলসমূহ থেকে তারা যা চায় তা তাদের ইচ্ছাধীন অথচ তা নিষিদ্ধ। এ সম্পর্কে কয়েকভাবে উত্তর দেয়া হয়েছে। আর সে উত্তরসমূহ থেকে ফাওয়ায়িদ গ্রন্থের ১৬ পৃষ্ঠাতে যা বলেছেন, তা এই নিশ্চয়ই এটা এমন এক সম্প্রদায়কে সম্বোধন যাদের ব্যাপারে আল্লাহ জেনেছেন যে, নিশ্চয়ই তারা তাদের ধর্ম থেকে আলাদা হবে না বরং তারা ইসলামের উপর মারা যাবে তবে কখনো কখনো তারা খারাপ কাজে জড়িত হবে যেমন অন্যান্যরা মন্দ গুনাহের কাজে জড়িত হয়ে থাকে। তবে আল্লাহ তাদেরকে গুনাহের উপর স্থায়ীভাবে ছেড়ে রাখবেন না। বরং তাদেরকে খাঁটি তাওবাহ্ করা, ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং পুণ্য কাজ করার তাওফীক দিবেন যা ঐ গুনাহের প্রভাবকে মুছে দিবে। আর এ ব্যাপারে তাদেরকে নির্দিষ্ট করা হয়েছে অন্যদেরকে নয়, কেননা এটি তাদের মাঝে সুনিশ্চিত হয়ে গেছে। তাদেরকে ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে আর তাদের মাধ্যমে সম্পাদিত হয় এমন উপকরণসমূহ দ্বারা অর্জিত ক্ষমা এ ক্ষমা থেকে বাধা দিতে পারবে না যে, তা ক্ষমার প্রতি নির্ভরশীল হয় ফরযসমূহ নষ্ট করে দেয়ার দাবী করে না। নির্দেশসমূহের সম্পাদনের উপর স্থায়িত্ব হওয়া ছাড়াই যদি ক্ষমা অর্জন হত তাহলে অবশ্যই তারা এরপর সালাত, সিয়াম, হজ, যাকাত ও জিহাদের প্রতি প্রয়োজনমুখী হত না, অথচ এটা অসম্ভব গুনাহের পর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ওয়াজিব হল তাওবাহ্ করা। সুতরাং ক্ষমার শামিল ক্ষমার উপকরণসমূহ নষ্ট করে দেয়াকে আবশ্যক করে না। এর দৃষ্টান্ত হল, অন্য হাদীসে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর (বান্দা গুনাহ করে অতঃপর বলে হে আমার প্রভু আমি গুনাহ করেছি, সুতরাং তুমি আমাকে তা ক্ষমা কর, অতঃপর আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন) এ উক্তি। আর এ হাদীসে আছে, (قد غفرت لعبدى فليعمل ما شاء) অর্থাৎ- ‘‘আমি আমার বান্দাকে ক্ষমা করে দিলাম, সুতরাং সে যা চায় তা করুক।’’ অত্র হাদীসে আল্লাহর তরফ থেকে বান্দাকে হারাম ও অপরাধে লিপ্ত হওয়ার জন্য অনুমতি দেয়া হয়নি।
হাদীসটি কেবল ঐ ব্যাপারে প্রমাণ বহন করে যে, বান্দাকে ততক্ষণ পর্যন্ত ক্ষমা করে দেয়া হবে যতক্ষণ সে গুনাহ করার পর তাওবাহ্ করতে থাকবে। আর এ বান্দাকে এ ক্ষমার ব্যাপারে নির্দিষ্ট করার কারণ হল, আল্লাহ এ বান্দার ব্যাপারে জেনে নিয়েছেন যে, সে কোন গুনাহের উপর স্থায়ী হবে না। বরং যখন সে পাপ করবে তখনই তাওবাহ্ করবে। এমনিভাবে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাদেরকে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন অথবা খবর দিয়েছেন যে, তাকে ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এ ধরনের উক্তি থেকে ঐ সাহাবী বা অন্য কোন সাহাবী এ ধরনের মনে করেননি যে, তাকে তার গুনাহ এবং অবাধ্যতা ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে এবং ওয়াজিবসমূহ ছেড়ে দেয়ার ব্যাপারে তার প্রতি উদারতা প্রকাশ করা হয়েছে। বরং এ সুসংবাদ পাওয়ার পরে পূর্বাপেক্ষা চেষ্টা, সাধনা, সতর্কতা ও ভয়ে আরো বেশি কঠোর ছিল। যেমন জান্নাতের সংবাদ প্রাপ্ত দশজন। আর এদের মাঝে আবূ বাকর ছিলেন অধিক সতর্ক ও ভয়কারী, এমনিভাবে ‘উমার (রাঃ)-ও ছিলেন। কারণ তারা জানতেন সাধারণ সুসংবাদ কিছু শর্ত এবং মরণ অবধি সেগুলোর উপর স্থায়ী হওয়ার দ্বারা গন্ডিবদ্ধ এবং সেগুলোর প্রতিবন্ধকসমূহ থেকে বিরত থাকা। তাদের কেউ এ ক্ষেত্রে কর্মে স্বেচ্ছাচারিতার ব্যাপারে অনুমতি প্রদান বুঝেননি।
পরিচ্ছেদঃ ২. প্রথম অনুচ্ছেদ - ক্ষমা ও তাওবাহ্
২৩৩৪-[১২] জুনদুব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ জনৈক ব্যক্তি বলল, আল্লাহর কসম! আল্লাহ তা’আলা অমুক ব্যক্তিকে ক্ষমা করবেন না। তখন আল্লাহ তা’আলা বললেন, এমন কে আছে যে আমাকে কসম দিতে পারে যে, (আমার নামে শপথ করতে পারে) আমি অমুককে ক্ষমা করব না। যাও, আমি তাকে মাফ করে দিলাম এবং তোমার ’আমল নষ্ট করে দিলাম। বর্ণনাকারী বলেন, তিনি এ বাক্য অথবা অনুরূপ বাক্য বলেছেন। (মুসলিম)[1]
بَابُ الْاِسْتِغْفَارِ وَالتَّوْبَةِ
وَعَنْ جُنْدُبٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حَدَّثَ: أَنَّ رَجُلًا قَالَ: وَاللَّهِ لَا يَغْفِرُ اللَّهُ لِفُلَانٍ وَأَنَّ اللَّهَ تَعَالَى قَالَ: مَنْ ذَا الَّذِي يَتَأَلَّى عَلَيَّ أَنِّي لَا أَغْفِرُ لِفُلَانٍ فَإِنِّي قَدْ غَفَرْتُ لِفُلَانٍ وَأَحْبَطْتُ عَمَلَكَ . أَوْ كَمَا قَالَ. رَوَاهُ مُسلم
ব্যাখ্যা: (أَنَّ رَجُلًا) নিশ্চয়ই ব্যক্তিটি এ উম্মাত বা এ উম্মাত ছাড়া অন্য উম্মাত হওয়ারও সম্ভাবনা রাখছে।
(قَالَ: وَاللّٰهِ لَا يَغْفِرُ اللّٰهُ لِفُلَانٍ) লোকটি অপর সম্পর্কে এ ধরনের মন্তব্য করেছিল অপরের গুনাহকে বেশি বা বড় মনে করে অথবা লোকটি নিজের সম্মানার্থে এ ধরনের কথা বলেছিল যখন সে অন্যকে ক্ষতিসাধন করতে দেখেছিল। যেমন কতিপয় সূফীপন্থী মূর্খদের থেকে এমন কথা প্রকাশ পেয়ে থাকে। ‘আল্লামা কারী এমনটিই বলেছেন।
(قَالَ: مَنْ ذَا الَّذِىْ يَتَأَلّٰى عَلَىَّ) অর্থাৎ- কে আমার ওপর ফায়সালা করে এবং আমার নামে শপথ করে?
(أَنِّىْ لَا أَغْفِرُ لِفُلَانٍ) ‘‘আমি অমুককে ক্ষমা করব না’’ এটি অস্বীকারসূচক প্রশ্ন। সুতরাং কোন ব্যক্তির জন্য জান্নাত অথবা জাহান্নামের অথবা ক্ষমাপ্রাপ্ত না হওয়ার ব্যাপারে দৃঢ়তা প্রকাশ করা বৈধ নয়, তবে যে ব্যক্তির ব্যাপারে কুরআন ও হাদীসের ভাষ্য এসেছে তার কথা আলাদা।
(فَإِنِّىْ قَدْ غَفَرْتُ لِفُلَانٍ) অর্থাৎ- তোমার অপমানার্থে আমি অমুককে ক্ষমা করে দিলাম।
(وَأَحْبَطْتُ عَمَلَكَ) ‘‘আমি তোমার ‘আমল নষ্ট করে দিলাম’’। মাযহার বলেন, অর্থাৎ- আমি তোমার কসমকে বিনষ্ট করে দিলাম এবং তোমার শপথকে মিথ্যায় পরিণত করলাম। আর এটা ঐ হাদীসের কারণে যে হাদীসে আছে, যে ব্যক্তি আল্লাহর বিরুদ্ধে শপথ করবে আল্লাহ তাকে মিথ্যুকে পরিণত করবেন। অর্থাৎ- যে ব্যক্তি এভাবে ফায়াসালা করবে এবং শপথ করবে যে, আল্লাহর শপথ! অবশ্যই আল্লাহ অমুককে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন। আল্লাহ এ ধরনের ব্যক্তি কসমকে বাতিল করবেন এবং শপথকে মিথ্যা সাব্যস্ত করবেন। সুতরাং মু‘তাযিলাদের পথ অবলম্বনের কোন সুযোগ নেই যে, কাবীরাহ্ গুনাহকারী কাবীরাকে হালাল না মনে করা সত্ত্বেও সে জাহান্নামে স্থায়ী হবে যেমন কুফরীর কারণে ‘আমল বাতিল হয়ে যায়।
ইমাম নাবাবী বলেন, হাদীসে বিনা তাওবাতে গুনাহ মাফ হওয়ার ক্ষেত্রে আহলুস্ সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের দলীল আছে, আর তা যখন আল্লাহ চাইবেন। আর মু‘তাযিলা সম্প্রদায় এ হাদীসের মাধ্যমে কাবীরাহ গুনাহের কারণে ‘আমল ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে প্রমাণ গ্রহণ করেছেন। আহলুস্ সুন্নাতের মাযহাব হল, কুফরী ছাড়া ‘আমলসমূহ ধ্বংস হয় না। আর এ ‘আমল ধ্বংস হওয়াকে ঐ কথার উপর ব্যাখ্যা করা হবে, পাপের কারণে তার পুণ্যসমূহ ঝড়ে গেছে। সুতরাং একে রূপকভাবে ‘আমল ধ্বংস করা বুঝানো হয়েছে। আরো সম্ভাবনা রয়েছে যে, তার হতে অন্য কোন বিষয় সংঘটিত হয়েছে যা কুফরীকে আবশ্যক করে দিয়েছে। আরো সম্ভাবনা রয়েছে এটি আমাদের পূর্ববর্তীদের শারী‘আতে ছিল আর এটা ছিল তাদের হুকুম।
(أَوْ كَمَا قَالَ) বর্ণনাকারীর সন্দেহ, অর্থাৎ- আমি যা উল্লেখ করেছি তা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বা অন্য কেউ বলেছেন অথবা অনুরূপ বলেছেন। আর এটা অর্থগত বর্ণনার ব্যাপারে সতর্কতা স্বরূপ যাতে কেউ তা শব্দগত বর্ণনা মনে না করে। নাবাবী বলেন, বর্ণনাকারী এবং হাদীস পাঠকের জন্য উচিত হবে যখন কোন শব্দ তার কাছে সন্দেহপূর্ণ হবে তখন সন্দেহ স্বরূপ তা পাঠকালে তার পেছনে (أَوْ كَمَا قَالَ) ভাষ্যটুকু বলবে অথবা (أو نحو هذا) অংশটুকু বলতে হবে। যেমন সহাবায়ে কিরাম এবং তাদের পরবর্তীরা এরূপ করেছেন। আর আল্লাহই সর্বাধিক জানেন।
পরিচ্ছেদঃ ২. প্রথম অনুচ্ছেদ - ক্ষমা ও তাওবাহ্
২৩৩৫-[১৩] শাদ্দাদ ইবনু আওস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা সাইয়্যিদুল ইসতিগফার এভাবে পড়বে,
’’আল্ল-হুম্মা আনতা রব্বী, লা- ইলা-হা ইল্লা- আন্তা খলাকতানী, ওয়া আনা- ’আবদুকা, ওয়া আনা- ’আলা- ’আহদিকা, ওয়া ওয়া’দিকা মাস্তাত্ব’তু, আ’ঊযুবিকা মিন শার্রি মা- সনা’তু, আবূউলাকা বিনি’মাতিকা ’আলাইয়্যা, ওয়া আবূউ বিযাম্বী ফাগফিরলী, ফাইন্নাহূ লা- ইয়াগফিরুয্ যুনূবা ইল্লা- আনতা’’
(অর্থাৎ- হে আল্লাহ! তুমি আমার প্রভু, তুমি ছাড়া কোন মা’বূদ নেই; তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছ, আমি তোমার বান্দা, আমি আমার সাধ্যানুযায়ী তোমার চুক্তি ও অঙ্গীকারের উপর প্রতিষ্ঠিত আছি। আমি আমার কৃতকর্মের মন্দ পরিণাম হতে তোমার নিকট আশ্রয় চাচ্ছি। আমি স্বীকার করি, আমার প্রতি তোমার দানকে এবং স্বীকার করি আমার গুনাহকে। অতএব তুমি আমাকে ক্ষমা করো। কেননা তুমি ছাড়া গুনাহ মাফ করার আর কেউ নেই।)।
অতঃপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, যে ব্যক্তি এ সাইয়্যিদুল ইসতিগফারের উপর বিশ্বাস স্থাপন করে দিনে পড়বে আর সন্ধ্যার আগে মৃত্যুবরণ করবে সে জান্নাতবাসীদের অন্তর্ভুক্ত হবে। আর যে এ দু’আ রাতে পড়বে আর সকাল হবার আগে মৃত্যুবরণ করবে সে জান্নাতবাসীদের অন্তর্ভুক্ত হবে। (বুখারী)[1]
بَابُ الْاِسْتِغْفَارِ وَالتَّوْبَةِ
وَعَنْ شَدَّادِ بْنِ أَوْسٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: سَيِّدُ الِاسْتِغْفَارِ أَنْ تَقُولَ: اللَّهُمَّ أَنْتَ رَبِّي لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ خَلَقْتَنِي وَأَنَا عَبْدُكَ وَأَنَا عَلَى عَهْدِكَ وَوَعْدِكَ مَا اسْتَطَعْتُ أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا صَنَعَتُ أَبُوءُ لَكَ بِنِعْمَتِكَ عَلَيَّ وَأَبُوءُ بِذَنْبِي فَاغْفِرْ لِي فَإِنَّهُ لَا يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا أَنْتَ . قَالَ: «وَمَنْ قَالَهَا مِنَ النَّهَارِ مُوقِنًا بِهَا فَمَاتَ مِنْ يَوْمِهِ قَبْلَ أَنْ يُمْسِيَ فَهُوَ مِنْ أَهْلِ الْجَنَّةِ وَمَنْ قَالَهَا مِنَ اللَّيْلِ وَهُوَ مُوقِنٌ بِهَا فَمَاتَ قَبْلَ أَنْ يُصْبِحَ فَهُوَ مِنْ أَهْلِ الْجَنَّةِ» . رَوَاهُ البُخَارِيّ
ব্যাখ্যা: (سَيِّدُ الِاسْتِغْفَارِ) ‘আযীযী বলেন, অর্থাৎ- ক্ষমা প্রার্থনার শব্দাবলীর মাঝে এটি সর্বোত্তম, অর্থাৎ- আল্লাহর নিকট সাওয়াবের দিক দিয়ে অধিক। ‘উবায়দুল্লাহ মুবারকপূরী বলেন, আমি বলব, ইমাম বুখারী তাঁর (সর্বোত্তম ক্ষমা প্রার্থনার অধ্যায়) এ উক্তি দ্বারা এ হাদীসটির অধ্যায় বেঁধেছেন। হাফেয বলেন, সর্বোত্তম তা শব্দ দ্বারা অধ্যায় বেঁধেছেন অথচ হাদীসটি শুরু হয়েছে السيادة বা নেতৃত্ব শব্দ দ্বারা। সুতরাং তিনি যেন এর মাধ্যমে ঐ দিকে ইঙ্গিত করেছেন যে, السيادة বা নেতৃত্ব দ্বারা الأفضلية বা সর্বোত্তম উদ্দেশ্য। এর উদ্দেশ্য হল যে ব্যক্তি ক্ষমা প্রার্থনার এ দু‘আটি পাঠ করবে তার জন্য দু‘আটি অধিক উপকারী হবে। অর্থাৎ- এর মাধ্যমে উপকার এবং সাওয়াব ক্ষমা প্রার্থনাকারীর জন্য। স্বয়ং استغفار তথা ক্ষমা প্রার্থনার জন্য না। অর্থাৎ- এ শব্দ দ্বারা ক্ষমা প্রার্থনাকারী অন্য শব্দ দ্বারা ক্ষমা প্রার্থনাকারী অপেক্ষা অধিক সাওয়াব লাভ করবে। আর মাদানী অপেক্ষা মক্কা শ্রেষ্ঠ হওয়ার মতো। অর্থাৎ- মক্কাতে ‘ইবাদাতকারীর সাওয়াব মাদানীতে ‘ইবাদাতকারী অপেক্ষা বেশি। এ استغفار এ ধরনের হওয়ার কারণ জ্ঞান দ্বারা অনুভব করা যায় না। তা কেবল ঐ সত্তার কাছে সোপর্দকৃত যিনি ‘আমল অনুযায়ী সাওয়াব নির্ধারণ করেছেন।
ইমাম ত্বীবী (রহঃ) বলেন, এ দু‘আটি তাওবার সকল অর্থকে শামিল করার কারণে একে এ নামে নামকরণ করা হয়েছে।
(فَاغْفِرْ لِىْ فَإِنَّه لَا يَغْفِرُ الذُّنُوْبَ إِلَّا أَنْتَ) এ বাণী থেকে গ্রহণ করা হয় যে, যে ব্যক্তি তার গুনাহের ব্যাপারে স্বীকার করবে তাকে ক্ষমা করে দেয়া হবে। আর অপবাদারোপিত দীর্ঘ হাদীসে স্পষ্ট এসেছে। আর তাতে আছে যেমন চারটি হাদীস পূর্বে গত হয়েছে। (العبد إذا اعترف بذنبه وتاب تاب الله إليه) অর্থাৎ- ‘‘বান্দা যখন তার গুনাহ স্বীকার করবে এবং তাওবাহ্ করবে তখন আল্লাহ তার তাওবাহ্কে গ্রহণ করবেন।’’ আর এ স্বীকারোক্তি বান্দার এবং তার প্রভুর মাঝে সীমাবদ্ধ, মানুষের কাছে তা প্রকাশ করা উচিত নয়। কেননা বান্দা যখন কোন গুনাহ করে তা গোপন করতে সক্ষম হয় তখন আল্লাহ তা মানুষের কাছে গোপন করতে ভালবাসেন।
(مِنَ النَّهَارِ) অর্থাৎ- দিনের কোন অংশে। নাসায়ীর বর্ণনাতে আছে, অতঃপর সে যদি তা সকালে উপনীত হওয়াবস্থায় পাঠ করে। তিরমিযীতে আছে, তোমাদের যে কেউ সন্ধ্যায় উপনীত হওয়াবস্থায় এ দু‘আ পাঠ করবে। অতঃপর সকালে উপনীত হওয়ার পূর্বে তার নির্দিষ্ট মৃত্যু সময় ঘনিয়ে আসবে অথবা যে ব্যক্তি সকালে উপনীত হওয়া অবস্থায় এ দু‘আ পাঠ করবে, এরপর সন্ধ্যায় উপনীত হওয়ার পূর্বে তার নির্দিষ্ট মৃত্যু সময় ঘনিয়ে আসবে।
(مُوقِنًا بِهَا) অর্থাৎ- খাঁটি অন্তরে, পুণ্যের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে।
কারী বলেন, অর্থাৎ- সংক্ষিপ্ত অথবা বিস্তারিতভাবে সকল প্রমাণযোগ্য বিষয়ের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে।
(فَهُوَ مِنْ أَهْلِ الْجَنَّةِ) অর্থাৎ- সে বিশ্বাসী অবস্থায় মারা যাবে, অতঃপর সে জান্নাতে প্রবেশ করবে অথবা শাস্তি ভোগ করার পর জান্নাতে প্রবেশ করবে অথবা শাস্তি ছাড়াই অথবা তা উত্তম পরিসমাপ্তির প্রতি শুভসংবাদ।
তিরমিযীর বর্ণনাতে আছে, (إلا وجبت له الجنة) অর্থাৎ- ‘‘তার জন্য জান্নাত আবশ্যক হয়ে যাবে’’। নাসায়ীর বর্ণনাতে আছে, (دخل الجنة) অর্থাৎ- ‘‘সে জান্নাতে প্রবেশ করবে’’। সিনদী বলেন, সূচনাতেই সে জান্নাতে প্রবেশ করবে অন্যথায় প্রত্যেক মু’মিন তার ঈমানের দরুন জান্নাতে প্রবেশ করবে এটি আল্লাহর তরফ থেকে কৃপা। কিরমানী বলেন, যদি বলা হয় মু’মিন ব্যক্তি এ দু‘আটি পাঠ না করেই শুরুতে সে জান্নাতের অধিবাসী। আমি বলব, সে জাহান্নামে প্রবেশ না করেই শুরুতেই সে জান্নাতে প্রবেশ করা উদ্দেশ্য। কেননা অধিকাংশ সময় এ দু‘আর প্রকৃত অবস্থার প্রতি বিশ্বাসী ব্যক্তি সামষ্টিকভাবে মু’মিন, সে আল্লাহর অবাধ্য হয় না। অথবা আল্লাহ এ ক্ষমা প্রার্থনার বারাকাতে তার গুনাহ মোচন করেছেন। যদি কেউ বলে যে, এ দু‘আটি سيد الاستغفار হওয়ার হিকমাত কি? আমি বলব, এ দু‘আ এবং এর মতো অন্যান্য দু‘আ দ্বারা ‘ইবাদাতের বিভিন্ন উপায় উদ্ভাবন উদ্দেশ্য। আর আল্লাহই এ সম্পর্কে সর্বাধিক জানেন। তবে এতে পূর্ণাঙ্গ গুণাবলীর মাধ্যমে আল্লাহর জিকির আছে এবং বান্দার নিজের সংকীর্ণ অবস্থার বর্ণনা আছে, এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। আর তা হল এমন এক সত্তার জন্য চূড়ান্ত পর্যায়ের বিনয় যার অধিকার একমাত্র তিনি ছাড়া কেউ রাখেন না।