পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ
জিহাদের আভিধানিক অর্থ : ’জিহাদ’ শব্দটি ’আরবী ’জাহাদা’ শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ ’দুই পক্ষের মধ্যে পারস্পরিক ক্রিয়া’। ’আরবদের কাছে শাব্দিকভাবে ’জিহাদ’-এর অর্থ হলো ’কোনো কাজ বা মত প্রকাশ করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা বা কঠোর সাধনা করা’। তাছাড়াও ’জিহাদ’ শব্দটি আভিধানিক দিক থেকে আরো অন্যান্য অর্থেও ব্যবহৃত হয়। যেমন :
১ اَلْجَدُّ ’’আল জাদ্দু’’ বা প্রচেষ্টা ব্যয় করা।
২. اَلطَّاقَةُ ’’আত্ব ত্বা-কাতু’’ বা কঠোর সাধনা করা।
৩. اَلسَّعْىُ ’’আস্ সা’ইউ’’ বা চেষ্টা করা।
৪. اَلْمُشَقَّةُ ’’আল মুশাক্কাতু’’ বা কষ্ট বহন করা।
৫. بَذْلُ القُوَّةِ ’’বাযলুল ক্যুওয়াহ্’’ বা শক্তি ব্যয় করা।
৬. اَلنِّهايَةُ والغَايَةُ ’’আন্ নিহায়াতু ওয়াল গায়াহ’’ বা শেষ পর্যায়ে পৌঁছা।
৭. اَلْاَرْضُ الصُّلْبَةْ ’’আল আরদুস্ সুলবাহ্’’ বা শক্তভূমি।
৮. اَلْكِفَاحْ ’’আল কিফা-হ’’ বা সংগ্রাম করা।
মোটকথা, শাব্দিক অর্থে ’জিহাদ’-এর সংজ্ঞা হলো, অন্তত দু’টি পক্ষের মধ্যে সর্বাত্মক চেষ্টা ও সক্ষমতার প্রকাশ ঘটানো।
শাব্দিক অর্থ মোতাবেক, এই সর্বাত্মক প্রচেষ্টা সশস্ত্র কিংবা নিরস্ত্র উভয়ই হতে পারে; অর্থ ব্যয় করেও হতে পারে, ব্যয় না করেও হতে পারে। একইভাবে, দু’টো পরস্পরবিরোধী প্রবৃত্তির মধ্যেও পরস্পরকে দমানোর জিহাদ (সর্বাত্মক প্রচেষ্টা) হতে পারে। এই জিহাদ (সর্বাত্মক প্রচেষ্টা) কেবল কথার মাধ্যমেও হতে পারে, অথবা কোনো একটি কাজ না করা বা কোনো একটি বিশেষ কথা না বলার মাধ্যমেও হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, কোনো ব্যক্তিকে যদি তার পিতামাতা আদেশ করে আল্লাহকে অমান্য করার জন্য আর সেই ব্যক্তি যদি পিতামাতার নির্দেশ অমান্য করে ও সবর অবলম্বন করে, তবে তা-ও জিহাদ। আবার কোনো ব্যক্তি যদি প্রবৃত্তির তাড়নাকে অগ্রাহ্য করে হারাম কাজ থেকে বিরত থাকার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়, তবে তা-ও জিহাদ।
’জিহাদ’ শব্দের এই শাব্দিক ব্যাখ্যা অনুযায়ী মুসলিমদের জিহাদের প্রতিপক্ষ হতে পারে নিজের প্রবৃত্তি, শায়ত্বন, দখলদার কিংবা কাফির শক্তি। পাশাপাশি, এই ব্যাখ্যা অনুযায়ী জিহাদ হতে পারে আল্লাহর পথেও (জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ)। তাই এই জিহাদ হতে পারে আল্লাহকে খুশি করার জন্য, আবার হতে পারে শায়ত্বনকে খুশি করার জন্যও। যেমন : কাফিরদের জিহাদ হলো শায়ত্বনকে খুশি করার জন্য। কাফির পিতারা তাদের মু’মিন সন্তানদের সত্য বিশ্বাসকে পরিত্যাগ করানোর জন্য যেসব কাজ করতো, সেগুলোকে কুরআনে জিহাদ বলা হয়েছে :
﴿وَإِنْ جَاهَدَاكَ عَلٰى أَنْ تُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِه عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا وَصَاحِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوفًا وَاتَّبِعْ سَبِيلَ مَنْ أَنَابَ إِلَيَّ ثُمَّ إِلَيَّ مَرْجِعُكُمْ فَأُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ﴾
’’তোমার পিতামাতা যদি জিহাদ (সর্বাত্মক প্রচেষ্টা) করে যে, তুমি আমার সাথে এমন কিছু শরীক কর যে সম্বন্ধে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তবে তাদেরকে অমান্য কর।’’ (সূরা লুকমান ৩১ : ১৫)
জিহাদের পারিভাষিক সংজ্ঞা : হানাফী মাযহাবের আইন গ্রন্থ ’বাদাউস্ সানায়ী’-হতে জানা যায়, জিহাদের শাব্দিক অর্থ চেষ্টা করা। শার’ঈ অর্থে জিহাদ হলো নফস্, অর্থ ইত্যাদি সবকিছু দিয়ে যুদ্ধের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা ও শক্তি খাটানো।’ অপর হানাফী গ্রন্থ شرح الوقاية-এর গ্রন্থকার বলেনঃ
اَلْجِهَادُ هُوَ الدُّعَاءُ إِلَى الدِّيْنِ الْحَقِ وَالْقِتَالُ مَنْ لَمْ يَقْبَلْهُ.
অর্থাৎ جِهَاد হচ্ছে সত্য দ্বীনের প্রতি আহবান করা এবং তা অগ্রাহ্যকারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা।
শাফি’ঈ মাযহাবের আইনগ্রন্থ ’আল ইকনা’-তে বলা হয়েছে, ’জিহাদ হলো আল্লাহর রাস্তায় লড়াই করা।’ আল-শিরাজী তাঁর ’আল মুহাজাব’-এ বলেন, ’জিহাদ হলো ক্বিতাল (যুদ্ধ)’।
সহীহুল বুখারীর ব্যাখ্যাকার ইমাম ইবন হাজার (রহঃ) ’ফাতহুল বারী’-তে বলেন, জিহাদ এর শার্’ঈ অর্থ হলো: وَشَرْعًا بَذْل الْجَهْد فِي قِتَال الْكُفَّار অর্থাৎ- ’’কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা-সংগ্রাম করা’’।
মালিকী মাযহাবের আইনগ্রন্থ ’মানহুল জালীল’-এ জিহাদকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এভাবে -
قِتَالُ مُسْلِمٍ كَافِرًا غَيْرَ ذِي عَهْدٍ لِإِعْلَاءِ كَلِمَةِ اللّٰهِ
’আল্লাহর কালিমাকে সর্বোচ্চে করার জন্য কাফিরদের (যাদের সঙ্গে মুসলিমদের চুক্তি নেই) সঙ্গে মুসলিমদের লড়াই .....।’
হাম্বালী মাযহাবের আইনগ্রন্থ ’আল মুগনী’-তে ইবনু কুদামাহ্ও ভিন্ন কোনো সংজ্ঞা দেননি। ’কিতাবুল জিহাদ’ অধ্যায়ে তিনি বলেন, যা কিছুই যুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত সেটা ফরযই ’আইন বা ফরযই কিফায়াহ্ যা-ই হোক না কেন, অথবা এটা মু’মিনদেরকে শত্রু থেকে রক্ষা করা হোক বা সীমান্ত রক্ষা হোক- সবকিছুই জিহাদের অন্তর্ভুক্ত। তিনি আরো বলেন, ’শত্রুরা এলে সীমান্তরক্ষীদের ওপর জিহাদ করা ফরযই ’আইন হয়ে যায়। যদি শত্রুদের আগমন স্পষ্ট হয়ে যায়, তাহলে আমীরের নির্দেশ ছাড়া সীমান্তরক্ষীরা তাদেরকে মোকাবেলা না করে আসতে পারবে না। কারণ একমাত্র আমীরই যুদ্ধের ব্যাপারে নির্দেশ দিতে পারেন।’
এছাড়া সহীহুল বুখারী, সহীহ মুসলিম, মিশকাতসহ সকল হাদীস গ্রন্থে ’কিতাবুল জিহাদ’ অধ্যায়ে কেবল সশস্ত্র যুদ্ধ বিষয়ক হাদীসই স্থান পেয়েছে।
কুরআন ও হাদীসে জিহাদ শব্দের ব্যবহার : মক্কায় সশস্ত্র যুদ্ধের অনুমতি ছিল না, তাই মাক্কী সূরাহ্সমূহে ’জিহাদ’ শব্দটি শার্’ঈ অর্থে ব্যবহৃত হয়নি; বরং শাব্দিক অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন: সূরা লুকমানের ১৫নং আয়াত, যা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। এরূপ আরো উদাহরণ হলো:
﴿وَمَنْ جَاهَدَ فَإِنَّمَا يُجَاهِدُ لِنَفْسِه إِنَّ اللّٰهَ لَغَنِيٌّ عَنِ الْعَالَمِينَ﴾
’’আর যে ব্যক্তি সাধনা (জিহাদ) করে, সে তো নিজেরই জন্য সাধনা করে। আল্লাহ্ তো বিশ্বজগত থেকে অমুখাপেক্ষী।’’ (সূরা আল ’আনকাবূত ২৯ : ৬)
﴿وَوَصَّيْنَا الْإِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ حُسْنًا وَإِنْ جَاهَدَاكَ لِتُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا إِلَيَّ مَرْجِعُكُمْ فَأُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ﴾
’’আমি মানুষকে স্বীয় মাতা-পিতার সাথে সদ্ব্যবহার করতে আদেশ দিয়েছি, তবে তারা যদি তোমার ওপর চাপ (জিহাদ) দেয়, আমার সাথে এমন কিছু শরীক করতে যে সম্বন্ধে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, এক্ষেত্রে তুমি তাদের আনুগত্য করবে না।’’ (সূরা আল ’আন্কাবুত ২৯ : ৮)
﴿وَالَّذِينَ جَاهَدُوا فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا وَإِنَّ اللهَ لَمَعَ الْمُحْسِنِينَ﴾
’’আর যারা আমার উদ্দেশে কষ্ট সহ্য (জিহাদ) করে, আমি অবশ্যই তাদেরকে আমার পথে পরিচালিত করব। নিশ্চয় আল্লাহ নেককারদের সাথে আছেন।’’ (সূরা আল ’আন্কাবূত ২৯ : ৬৯)
﴿فَلَا تُطِعِ الْكَافِرِينَ وَجَاهِدْهُمْ بِه جِهَادًا كَبِيرًا﴾
’’অতএব আপনি কাফিরদের আনুগত্য করবেন না এবং তাদের সঙ্গে কুরআনের সাহায্যে কঠোর সংগ্রাম (জিহাদ) চালিয়ে যান।’’ (সূরা আল ফুরকান ২৫ : ৫২)
মদীনায় অবতীর্ণ ২৬টি আয়াতে জিহাদের বিষয়টি এসেছে এবং এগুলোর অধিকাংশই সুস্পষ্টভাবে ’যুদ্ধ’ (ক্বিতাল) অর্থ বহন করে। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
﴿لَا يَسْتَوِي الْقَاعِدُونَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ غَيْرُ أُولِي الضَّرَرِ وَالْمُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللهِ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ فَضَّلَ اللهُ الْمُجَاهِدِينَ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ عَلَى الْقَاعِدِينَ دَرَجَةً وَكُلًّا وَعَدَ اللهُ الْحُسْنٰى وَفَضَّلَ اللهُ الْمُجَاهِدِينَ عَلَى الْقَاعِدِينَ أَجْرًا عَظِيمًا﴾
’’সমান নয় সেসব মু’মিন যারা বিনা ওযরে ঘরে বসে থাকে এবং ওই সব মু’মিন যারা আল্লাহর পথে নিজেদের জান ও মাল দিয়ে জিহাদ করে। যারা স্বীয় জান ও মাল দিয়ে জিহাদ করে, আল্লাহ তাদের মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছেন তাদের ওপর যারা ঘরে বসে থাকে। আর প্রত্যেককেই আল্লাহ কল্যাণের ওয়া’দা করেছেন। আল্লাহ মুজাহিদীনদের মহান পুরস্কারের শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন যারা ঘরে বসে থাকে তাদের ওপর।’’
(সূরা আন্ নিসা ৪ : ৯৫)
এই আয়াতে পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে যে, জিহাদ মানে যুদ্ধের জন্য বের হওয়া এবং ঘরে থাকার চেয়ে সেটা উত্তম।
﴿انْفِرُوا خِفَافًا وَثِقَالًا وَجَاهِدُوا بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ فِي سَبِيلِ اللهِ ذٰلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ﴾
’’তোমরা অভিযানে বের হয়ে পড়, হালকা অথবা ভারী অবস্থায়; এবং জিহাদ করো আল্লাহর পথে নিজেদের মাল দিয়ে এবং নিজেদের জান দিয়ে। এটাই তোমাদের জন্য শ্রেয়, যদি তোমরা জানতে।’’
(সূরা আত্ তওবা্ ৯ : ৪১)
ঐতিহাসিক তাবূক যুদ্ধের সময় প্রেক্ষাপটে এই আয়াত নাযিল হয়। তাবূক যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল খেজুর কাটার মৌসুমে। তখন গরমও ছিল খুব বেশি। তাই কেউ কেউ ক্ষেত-খামার, ধন-সম্পদ নষ্ট হয়ে যাওয়ার অজুহাতে, কেউ পারিবারিক কাজের অজুহাতে, কেউ বা অসুস্থতার বাহানা তুলে যুদ্ধে না যাওয়ার অনুমতি চাইলো। আল্লাহ তখন এই আয়াত নাযিল করে তাদের প্রার্থনা বাতিল করে দিলেন এবং ইচ্ছুক-অনিচ্ছুক, খুশি-অখুশি, সশস্ত্র-নিরস্ত্র, ধনী-গরিব সবার জন্য যে কোনো অবস্থায় যুদ্ধে যাওয়া ফরয করে দিলেন। এখানে ’জিহাদ’ শব্দটি পরিষ্কারভাবে ’যুদ্ধ’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
একই অর্থ রয়েছে এই সূরার ৮৮ নম্বর আয়াতে, ’’কিন্তু রসূল ও যারা তাঁর সঙ্গে ঈমান এনেছে, তারা জিহাদ করেছে নিজেদের মাল ও নিজেদের জান দিয়ে, তাদেরই জন্য রয়েছে যাবতীয় কল্যাণ এবং তারাই প্রকৃত সফলকাম।’’ (সূরা আত্ তওবা্ ৯ : ৮৮)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শত শত হাদীসে ’জিহাদ’-কে শার’ঈ অর্থে অর্থাৎ যুদ্ধ ও যুদ্ধের উপায়-উপকরণ অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন : আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ
مَثَلُ الْمُجَاهِدِ فِي سَبِيلِ اللّٰهِ كَمَثَلِ الصَّائِمِ الْقَائِمِ الْقَانِتِ بِآيَاتِ اللّٰهِ لَا يَفْتُرُ مِنْ صِيَامٍ وَلَا صَلَاةٍ حَتّٰى يَرْجِعَ الْمُجَاهِدُ فِي سَبِيلِ اللّٰهِ تَعَالٰى.
আল্লাহর রাস্তায় মুজাহিদের তুলনা ওইরূপ সায়িম (রোযাদার), যে সালাতে দাঁড়িয়ে আল্লাহর আয়াত তিলাওয়াত করে যাচ্ছে, যে তার সওম ও সালাত আদায়ে বিন্দুমাত্র ক্লান্তি প্রকাশ করে না; (সে এরূপ সাওয়াব পেতেই থাকবে) যতক্ষণ না আল্লাহ তা’আলার রাস্তায় মুজাহিদ ফিরে আসে।
(বুখারী হাঃ ২৭৮৭, মুসলিম হাঃ ৪৯৭৭)
এ হাদীসে পরিষ্কারভাবেই ’মুজাহিদ’ বলতে যোদ্ধাকে বোঝানো হয়েছে- যে যোদ্ধা ’যতক্ষণ না ফিরে আসে’ ততক্ষণ পর্যন্ত হাদীসে বর্ণিত সাওয়াবসমূহ পেতেই থাকে। অন্য হাদীসে ’আবদুল্লাহ বিন হুবশী বলেন,
قِيلَ فَأَيُّ الْجِهَادِ أَفْضَلُ قَالَ مَنْ جَاهَدَ الْمُشْرِكِينَ بِمَالِه وَنَفْسِه قِيلَ فَأَيُّ الْقَتْلِ أَشْرَفُ قَالَ مَنْ أُهَرِيقَ دَمُه وَعُقِرَ جَوَادُه
লোকেরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করলো, ’কোনো জিহাদ উত্তম?’ তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জবাব দেন, জীবন ও সম্পদ দিয়ে মুশরিকদের বিরুদ্ধে লড়াই করা। আবার জিজ্ঞেস করা হলো, কী ধরনের মৃত্যুবরণ করা উত্তম? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জবাব দিলেন, ওই ব্যক্তি যার রক্ত প্রবাহিত করা হয় এবং সাথে তার সওয়ারী ঘোড়ার পাও কেটে ফেলা হয়। (আবূ দাঊদ, হাঃ ১৪৫১; নাসিরুদ্দীন আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন)
আরেক হাদীসে ইবনু ’আব্বাস বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ
لَمَّا أُصِيبَ إِخْوَانُكُمْ بِأُحُدٍ جَعَلَ اللَّهُ أَرْوَاحَهُمْ فِي جَوْفِ طَيْرٍ خُضْرٍ تَرِدُ أَنْهَارَ الْجَنَّةِ تَأْكُلُ مِنْ ثِمَارِهَا وَتَأْوِي إِلٰى قَنَادِيلَ مِنْ ذَهَبٍ مُعَلَّقَةٍ فِي ظِلِّ الْعَرْشِ فَلَمَّا وَجَدُوا طِيبَ مَأْكَلِهِمْ وَمَشْرَبِهِمْ وَمَقِيلِهِمْ قَالُوا مَنْ يُبَلِّغُ إِخْوَانَنَا عَنَّا أَنَّا أَحْيَاءٌ فِي الْجَنَّةِ نُرْزَقُ لِئَلَّا يَزْهَدُوا فِي الْجِهَادِ وَلَا يَنْكُلُوا عِنْدَ الْحَرْبِ فَقَالَ اللَّهُ سُبْحَانَه أَنَا أُبَلِّغُهُمْ عَنْكُمْ
যখন উহুদ যুদ্ধে তোমাদের ভাইয়েরা নিহত হলো, আল্লাহ তাদের রূহগুলোকে সবুজ পাখির পেটের ভিতরে ভিতরে স্থাপন করে মুক্ত করে দেন। তাঁরা জান্নাতের ঝরণা ও উদ্যানসমূহ থেকে নিজেদের রিযক আহরণ করেন, অতঃপর তাঁরা সেই আলোকধারায় ফিরে আসেন, যা তাঁদের জন্য আল্লাহর ’আরশের নিচে টাঙিয়ে দেয়া হয়েছে। যখন তাঁরা নিজেদের আনন্দ ও শান্তিময় জীবন প্রত্যক্ষ করলেন, তখন বললেন, ’আমাদের আত্মীয়-স্বজনরা পৃথিবীতে আমাদের মৃত্যুতে শোকার্ত; আমাদের অবস্থা সম্পর্কে কি কেউ তাদের জানিয়ে দিতে পারে, যাতে তারা আমাদের জন্য দুঃখ না করে এবং তারাও যাতে জিহাদে (অংশগ্রহণের) চেষ্টা করে।’ তখন আল্লাহ তা’আলা বললেন, ’তোমাদের এ সংবাদ তাদেরকে পৌঁছে দিচ্ছি।’ এরই প্রেক্ষিতে সূরা আ-লি ’ইমরান-এ নাযিল হয় :
﴿وَلَا تَحْسَبَنَّ ٱلَّذِينَ قُتِلُواْ فِى سَبِيلِ ٱللّٰهِ أَمْوَاتاً بَلْ أَحْيَاءٌ عِندَ رَبِّهِمْ يُرْزَقُونَ﴾
’’আর যারা আল্লার পথে শহীদ হয়, তাদেরকে তুমি মৃত মনে করো না। বরং তারা নিজেদের পালনকর্তার নিকট জীবিত ও জীবিকাপ্রাপ্ত’’- (সূরা আ-লি ’ইমরন ৩ : ১৬৯)। (আবূ দাঊদ, হাঃ ২৫২২)
প্রকৃতপক্ষে সশস্ত্র যুদ্ধে অর্থাৎ জিহাদে মৃত্যুবরণ করা খোদ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এরই একান্ত বাসনা ছিল :
وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِه لَوْلَا أَنَّ رِجَالًا مِنْ الْمُؤْمِنِينَ لَا تَطِيبُ أَنْفُسُهُمْ أَنْ يَتَخَلَّفُوا عَنِّي وَلَا أَجِدُ مَا أَحْمِلُهُمْ عَلَيْهِ مَا تَخَلَّفْتُ عَنْ سَرِيَّةٍ تَغْزُو فِي سَبِيلِ اللّٰهِ وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِه لَوَدِدْتُ أَنِّي أُقْتَلُ فِي سَبِيلِ اللّٰهِ ثُمَّ أُحْيَا ثُمَّ أُقْتَلُ ثُمَّ أُحْيَا ثُمَّ أُقْتَلُ ثُمَّ أُحْيَا ثُمَّ أُقْتَلُ.
সেই সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ, যদি কিছু মু’মিন এমন না হতো যারা আমার সাথে জিহাদে অংশগ্রহণ না করাকে আদৌ পছন্দ করবে না, অথচ তাদের সবাইকে আমি সওয়ারী দিতে পারছি না, এই অবস্থা না হলে আল্লাহর পথে যুদ্ধরত কোনো ক্ষুদ্র সেনাদল হতেও দূরে থাকতাম না। সেই সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ, আমার কাছে অত্যন্ত পছন্দনীয় হলো, আমি আল্লাহর পথে নিহত হই, অতঃপর জীবন লাভ করি। আবার নিহত হই আবার জীবন লাভ করি এবং আবার নিহত হই তারপর আবার জীবন লাভ করি। আবার নিহত হই। (বুখারী হাঃ ২৭৯৭, মুসলিম হাঃ ৪৯৬৭)
৩৭৮৭-[১] আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং তার রসূলের প্রতি ঈমান আনে, সালাত কায়িম করবে, রমাযানের সিয়াম পালন করবে, আল্লাহর পথে জিহাদ করবে বা স্বীয় জন্মভূমিতে অবস্থান করে- তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো আল্লাহর ওপর হক ও দায়িত্ব হয়ে যায়। অতঃপর লোকেরা (সাহাবায়ে কিরাম) বললেন, আমরা কি জনগণের মাঝে এ সুসংবাদ জানিয়ে দিব না? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, আল্লাহর পথে জিহাদকারীদের জন্য আল্লাহ তা’আলা জান্নাতে একশ’ মর্যাদা প্রস্তুত করে রেখেছে। প্রতি দু’ শ্রেণীর মর্যাদার মাঝে দূরত্বের পরিমাণ আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর মধ্যবর্তী দূরত্বের সমান। সুতরাং তোমরা যখন আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করবে, তখন তার নিকট (জান্নাতুল) ফিরদাওস প্রার্থনা করবে। কেননা তা জান্নাতের মধ্যম ও সর্বোত্তম জান্নাত। তার উপরিভাগে আল্লাহর ’আরশ এবং সেখান থেকে জান্নাতের ঝর্ণাসমূহ প্রবাহিত হয়। (বুখারী)[1]
اَلْفَصْلُ الْأَوَّلُ
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَأَقَامَ الصَّلَاةَ وَصَامَ رَمَضَانَ كَانَ حَقًّا عَلَى اللَّهِ أَنْ يُدْخِلَهُ الْجَنَّةَ جَاهَدَ فِي سهل اللَّهِ أَوْ جَلَسَ فِي أَرْضِهِ الَّتِي وُلِدَ فِيهَا» . قَالُوا: أفَلا نُبشِّرُ النَّاسَ؟ قَالَ: «إِنَّ فِي الْجَنَّةِ مِائَةَ دَرَجَةٍ أَعَدَّهَا اللَّهُ لِلْمُجَاهِدِينَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ مَا بَيْنَ الدَّرَجَتَيْنِ كَمَا بَيْنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ فَإِذَا سَأَلْتُمُ اللَّهَ فَاسْأَلُوهُ الْفِرْدَوْسَ فَإِنَّهُ أَوْسَطُ الْجَنَّةِ وَأَعْلَى الْجَنَّةِ وَفَوْقَهُ عَرْشُ الرَّحْمَنِ وَمِنْهُ تُفَجَّرُ أنهارُ الجنَّةِ» . رَوَاهُ البُخَارِيّ
ব্যাখ্যা: ‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি ঈমান আনবে, সালাত কায়িম করবে এবং সিয়াম পালন করবে, আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন’’ এ বাক্যে ইসলামের রুকন ও সালাত এবং সিয়ামের মতো বাহ্যিক ‘আমল হওয়া সত্ত্বেও হজ্জ/হজ ও যাকাতের কথা আলোচনা না করার কারণ :
ইবনু বাত্ত্বল বলেনঃ ‘‘যাকাত ও হজে/হজ্জের আলোচনা না করার কারণ হচ্ছে তা তখনও ফরয হয়নি’’। ইমাম ইবনু হাজার আল ‘আস্ক্বালানী বলেনঃ বরং বর্ণনাকারীদের কোনো একজনের কাছ থেকে এর উল্লেখ বাদ পড়ে গেছে। কেননা তিরমিযীতে মু‘আয বিন জাবাল -এর হাদীসে হজে/হজ্জের কথা উল্লেখ রয়েছে এবং তিনি উক্ত হাদীসে বলেছেনঃ ‘‘আমি জানি না (আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যাকাতের উল্লেখ করেছেন কিনা’’। তাছাড়া উক্ত হাদীসটি ইসলামের রুকনসমূহ বর্ণনা প্রসঙ্গে নয়। সুতরাং যদি তা সংরক্ষিত হয়ে থাকে তাহলে হাদীসে যা উল্লেখ রয়েছে (সালাত ও সিয়াম) তাতেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত, যেহেতু এ ‘আমল অধিকাংশ সময় বার বার করা হয়ে থাকে। আর যাকাত তো কেবল তার ওপরই ফরয, যে শর্তানুসারে নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদের মালিক। আর হজ্জ/হজ তো বিলম্ব করার অবকাশের সাথে জীবনে মাত্র একবার আদায় করা ওয়াজিব।
(ফাতহুল বারী ৬ষ্ঠ খন্ড, হাঃ ২৭৯০)
(جَاهَدَ فِي سَبِيلِ اللّٰهِ أَوْ جَلَسَ فِي أَرْضِهِ الَّتِي وُلِدَ فِيهَا) ‘‘(আল্লাহ তা‘আলা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন) চাই সে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করুক কিংবা তার মাতৃভূমিতে বসে থাকুক, যেখানে সে জন্মলাভ করেছে’’ এ বাক্যে ঐ ব্যক্তির জন্য সান্তনা ও আশার বাণী রয়েছে যে জিহাদ থেকে বঞ্চিত হয়েছে, এই মর্মে যে, সে তার ‘আমলের প্রতিদান থেকে বঞ্চিত হবে না। বরং তার ঈমান ও অন্যান্য আবশ্যকীয় ফরযসমূহ দৃঢ়ভাবে পালনের সাওয়াব তাকে জান্নাতে পৌঁছে দিবে, যদিও জান্নাতে মুজাহিদদের মর্যাদার তুলনায় তার মর্যাদা কম হবে। (ফাতহুল বারী ৬ষ্ঠ খন্ড, হাঃ ২৭৯০)
‘‘তারা বললঃ আমরা কি মানুষকে সুসংবাদ দিব না?’’ তিরমিযীর বর্ণনামতে মু‘আয বিন জাবাল এবং ত্ববারানীর বর্ণনামতে আবুদ্ দারদা এ কথা বলেছিলেন। তিরমিযীর বর্ণনায় রয়েছে, মু‘আয বিন জাবাল বলেন, আমি বললামঃ
ألا أخبر بهذا الناس ؟ فقال رسول الله ﷺ ذر الناس يعملون فإن الجنة مائة درجة
‘‘অর্থাৎ- আমি কি মানুষকে এ সংবাদ দিব না? তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ মানুষকে (চলমান গতিতে) ‘আমল করতে দাও। কেননা জান্নাতে রয়েছে একশত মর্যাদার স্তর।’’ (ফাতহুল বারী ৬ষ্ঠ খন্ড, হাঃ ২৭৯০)
(مَا بَيْنَ الدَّرَجَتَيْنِ كَمَا بَيْنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ) ‘‘দু’টি স্তরের মাঝে ব্যবধান আকাশ ও জমিনের মাঝের ব্যবধানের ন্যায়’’। একটি হাদীসের বর্ণনায় আছে, আকাশ ও জমিনের মাঝে দূরত্ব পাঁচশত বছরের রাস্তা। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
‘আল্লামা ইবনু হাজার আল ‘আসক্বালানী তার ফাতহুল বারীতে উল্লেখ করেন যে, ইমাম তিরমিযী মুহাম্মাদ বিন জুহাদাহ এর সূত্রে বর্ণনা করেন: ‘‘প্রত্যেক দুই স্তরের মাঝে একশত বছরের ব্যবধান’’। আর একই সূত্রে ত্ববারানী বর্ণনা করেন যে, উভয়ের মাঝে পাঁচশত বছরের ব্যবধান। আর উভয় বর্ণনা যদি বিশুদ্ধ হয়ে থাকে তাহলে দূরত্বের পরিমাণে বছর সংখ্যার ভিন্নতা ভ্রমণের গতির ভিন্নতার কারণে। (ফাতহুল বারী ৬ষ্ঠ খন্ড, হাঃ ২৭৯০)
‘‘কেননা তা (জান্নাতুল ফিরদাওস) হচ্ছে জান্নাতসমূহের মধ্যে সবচাইতে মধ্যম এবং সর্বোচ্চ জান্নাত’’ বাক্যে ‘আওসাতুল জান্নাহ্’ তথা ‘মধ্যম জান্নাত’ এর অর্থ হলো সর্বোত্তম জান্নাত। যেমন : আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে ইরশাদ করেন : ‘‘আর অনুরূপভাবে আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি উত্তম জাতি হিসেবে। (সূরা আল বাকারা ২ : ১৪৩)
আর ‘‘ওয়া আ‘লাহা’’ তথা ‘সর্বোচ্চ জান্নাত’ এ অংশকে পূর্বের অংশের সাথে (আতফ) মিলানো হয়েছে তাকীদ বা অর্থকে শক্তিশালী করার জন্য। (ফাতহুল বারী ৬ষ্ঠ খন্ড, হাঃ ২৭৯০)
ইমাম ইবনু হিব্বান বলেনঃ ‘‘আওসাত বলতে (জান্নাতুল ফিরদাওসের) প্রশস্ততা এবং আ‘লা বলতে তার উপরে অবস্থিত হওয়া বুঝানো হয়েছে।’’ (ফাতহুল বারী ৬ষ্ঠ খন্ড, হাঃ ২৭৯০)
‘‘আর সেখান থেকে জান্নাতের নহরসমূহ প্রবাহিত হয়’’, অর্থাৎ- জান্নাতুল ফিরদাওস থেকে জান্নাতের চারটি নহর প্রবাহিত হয়। (ফাতহুল বারী ৬ষ্ঠ খন্ড, হাঃ ২৭৯০)
জান্নাতের চারটি নহর হচ্ছে পানি, দুধ, শরাব (মদ) ও মধুর নহর। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
জান্নাতুল ফিরদাওস এমন এক বাগান যেখানে সকল প্রকার নি‘আমাতের সমাহার ঘটেছে। আলোচ্য হাদীসে মুজাহিদীনদের মর্যাদা বা ফাযীলাতের কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। হাদীসটিতে জান্নাতের বড়ত্ব এবং তন্মধ্যে বিশেষভাবে জান্নাতুল ফিরদাওসের মহত্ব বর্ণনা করা হয়েছে। উক্ত হাদীসে এ বিষয়েও ইঙ্গিত রয়েছে যে, মুজাহিদের মর্যাদা মুজাহিদ ব্যতীত অন্যরাও তাদের একনিষ্ঠ নিয়্যাত কিংবা নেক ‘আমল দ্বারা কখনো কখনো লাভ করতে সক্ষম হবে। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘‘জান্নাতুল ফিরদাওস মুজাহিদীনদের জন্য প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে’’ এ কথার ঘোষণা দেয়ার পরও সকলকেই জান্নাতুল ফিরদাওস লাভের জন্য প্রার্থনা করতে বলেছেন। (আল্লাহই সর্বাপেক্ষা অধিক জানেন)। (ফাতহুল বারী ৬ষ্ঠ খন্ড, হাঃ ২৭৯০)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ
৩৭৮৮-[২] উক্ত রাবী [আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ)] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহর পথে মুজাহিদদের তুলনা ঐরূপ সায়িমের (রোযাদারের) ও সালাত আদায়রত অবস্থায় তিলাওয়াতকারীর ন্যায়, যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় মুজাহিদের ঘরে ফিরে না আসা পর্যন্ত সিয়াম পালনে ও সালাত আদায়ে নিমগ্ন থাকে। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
اَلْفَصْلُ الْأَوَّلُ
وَعَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَثَلُ الْمُجَاهِدِ فِي سَبِيلِ اللَّهِ كَمَثَلِ الصَّائِمِ الْقَائِمِ الْقَانِتِ بِآيَاتِ اللَّهِ لَا يَفْتُرُ مِنْ صِيَامٍ وَلَا صَلَاةٍ حَتَّى يَرْجِعَ الْمُجَاهِدُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ»
ব্যাখ্যা: আলোচ্য হাদীসে আল্লাহর কালিমাকে বিজয়ী করার জন্য যারা জিহাদ করে, তাদের মর্যাদা ও তাদের কাজের মহত্ব বর্ণনা করা হয়েছে। এ হাদীসে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারী ব্যক্তির সাদৃশ্য দেয়া হয়েছে এমন এক ব্যক্তির সাথে; যে অবিরত সালাত, সিয়াম ও কুরআন তিলাওয়াতে মগ্ন থাকে এবং কখনোই ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত হয় না।
(مَثَلُ الْمُجَاهِدِ فِى سَبِيلِ اللّٰهِ كَمَثَلِ الصَّائِمِ الْقَائِمِ الْقَانِتِ بِاٰيَاتِ اللّٰهِ) এ বাক্যে মুজাহিদের সাদৃশ্য দেয়া হয়েছে সিয়াম পালনকারী, ক্বিয়ামকারী এবং আল্লাহর আয়াতসমূহ পাঠকারীর সাথে্। মুয়াত্ত্বা মালিক ও ইবনু হিব্বান-এর বর্ণনানুসারে ‘‘তার সাদৃশ্য সর্বদায় সিয়াম এবং ক্বিয়ামকারীর সাথে, যে উক্ত মুজাহিদের জিহাদের ময়দান থেকে প্রত্যাবর্তন করা পর্যন্ত অবিরত সালাত ও সিয়াম পালনে মগ্ন থাকে; কখনোই ক্লান্ত হয় না।’’ মুসনাদে আহমাদ ও মুসনাদুল বায্যারে নু‘মান বিন বাশীর থেকে মারফূ‘ সূত্রে বর্ণিত, ‘‘আল্লাহর রাস্তায় মুজাহিদের দৃষ্টান্ত দিনে সিয়াম পালনকারী এবং রাতভর ক্বিয়াম তথা সালাত আদায়কারী ব্যক্তির সাথে।’’ (ফাতহুল বারী ৬ষ্ঠ খন্ড, হাঃ ২৭৮৭)
‘আল কায়িম’ তথা ক্বিয়ামকারী বলতে দাঁড়ানো অবস্থায় সালাত আদায়কারী ব্যক্তি উদ্দেশ্য; বসা অবস্থায় সালাত আদায়কারী নয়। ‘আল কানিত বি আয়াতিল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহর আয়াতসমূহ তিলাওয়াতকারী বা পাঠকারী। কারো মতে এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে সালাতে কুরআন তিলাওয়াতকারী ব্যক্তি। নিহায়াহ্ গ্রন্থকার বলেনঃ ‘‘কুনূত শব্দটি হাদীসে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। যথা : আনুগত্য, খুশূ তথা বিনয়-নম্রতা, সালাত, দু‘আ, ‘ইবাদাত, ক্বিয়াম, দীর্ঘ ক্বিয়াম ও নিরবতা।’’ (মিরকাতুল মাফাতীহ)
আলোচ্য হাদীসে অবিরত সিয়াম এবং ক্বিয়ামকারীকে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারীর সাথে তুলনা করা হয়েছে প্রত্যেক স্থিরতা ও নড়াচড়ায় সাওয়াব লাভের দিক থেকে। অর্থাৎ যে ব্যক্তি সর্বদা সিয়াম ও ক্বিয়াম করে এবং একটি মুহূর্তও ‘ইবাদাত করতে ক্লান্তি অনুভব করে না, তার সাওয়াব চলমান থাকে। ঠিক তেমনিভাবে মুজাহিদের একটি মুহূর্তও নষ্ট হয় না; বরং সদা-সর্বদাই সাওয়াব অর্জিত হতে থাকে। (ফাতহুল বারী ৬ষ্ঠ খন্ড, হাঃ ২৭৮৭)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ
৩৭৮৯-[৩] উক্ত রাবী [আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ)] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আল্লাহ তা’আলার পথে বের হয় তথা দায়িত্বগ্রহণ করে, এই মুজাহিদ আমার ও আমার রসূলের প্রতি ঈমান ও বিশ্বাসের সত্যতা স্বীকারের তাকীদেই স্বীয় ঘর হতে আমার পথে বের হয়েছে, তাকে আমি অবশ্যই পরিপূর্ণ সাওয়াব দান করবো অথবা গনীমাতের মালসহ ঘরে ফিরিয়ে আনবো অথবা তাকে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করাব। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
اَلْفَصْلُ الْأَوَّلُ
وَعَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «انْتَدَبَ اللَّهُ لِمَنْ خَرَجَ فِي سَبِيلِهِ لَا يُخْرِجُهُ إِلَّا إِيمَانٌ بِي وَتَصْدِيقٌ بِرُسُلِي أَنْ أَرْجِعَهُ بِمَا نَالَ مِنْ أَجْرٍ وَغَنِيمَةٍ أَوْ أُدْخِلَهُ الْجَنَّةَ»
ব্যাখ্যা: আলোচ্য হাদীসে ঈমান ও ইখলাসের সাথে জিহাদের উদ্দেশে বের হওয়ার ফযীলত সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে, যার ভাবার্থ হচ্ছে- যে ব্যক্তি কেবলমাত্র আল্লাহর প্রতি ঈমান ও রসূলের রিসালাতকে সত্যায়ন করা অবস্থায় জিহাদের উদ্দেশে বের হবে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে শাহাদাতের মর্যাদা প্রদানপূর্বক জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, অথবা নেকী ও গনীমাতের সম্পদ সহকারে তাকে নিজ আবাসস্থলে ফিরিয়ে দিবেন।
(انْتَدَبَ اللهُ لِمَنْ خَرَجَ فِي سَبِيلِه) এ বাক্যে ‘ইন্তাদাবাল্লাহু’ অর্থ হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলা জিম্মাদারী বা দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, ডাকে সাড়া দিয়েছেন। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
অর্থাৎ- যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের উদ্দেশে বের হয়েছে আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য (তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানোর কিংবা নেকী ও গনীমাতের সম্পদ সহকারে বাড়ি ফিরিয়ে দেয়ার) দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন।
(لَا يُخْرِجُه إِلَّا إِيمَانٌ بِي وَتَصْدِيقٌ بِرُسُلِي) অর্থাৎ- আমার প্রতি ঈমান এবং আমার রসূলগণের বিশ্বাস ছাড়া অন্য কিছু তাকে (জিহাদের উদ্দেশে) বের করেনি। এ বাক্যে ‘রসূল’ শব্দের বহুবচন তথা ‘রুসুল’ শব্দ ব্যবহার করার কারণ দু’টি হতে পারে। (ক) এতে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, রসূলগণের মধ্যে কোনো একজনের প্রতি বিশ্বাস করা সকলের প্রতি বিশ্বাস করার শামিল। (খ) অথবা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সম্মানার্থে বহুবচন ব্যবহার করা হয়েছে (‘আরবী ভাষার রীতি অনুসারে কোনো একক ব্যক্তির সম্মানার্থে বহুবচন শব্দ ব্যবহার করা হয়ে থাকে), কেননা তিনি সকল নাবী রসূলদের স্থলাভিষিক্ত। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
(أَنْ أُرْجِعَه بِمَا نَالَ مِنْ أَجْرٍ أَوْ غَنِيمَةٍ أَوْ أُدْخِلَهُ الْجَنَّةَ) অর্থাৎ- আল্লাহ তা‘আলা মুজাহিদের জন্য এ দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন যে, তাকে অর্জিত নেকী কিংবা গনীমাত সহকারে ফিরিয়ে দিবেন, অথবা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। জিহাদের জন্য বহির্গমনকারীর জন্য আল্লাহ তা‘আলা এ জিম্মাদারী গ্রহণ করেছেন যে, সে সকল অবস্থায় কল্যাণ হাসিল করবে। এ ক্ষেত্রে সে নিম্নোক্ত তিনটি অবস্থার কোনো এক অবস্থায় কল্যাণপ্রাপ্ত হবে। সেগুলো হলো:
১. হয় সে শাহাদাতের মর্যাদা লাভে ধন্য হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করবে।
২. অথবা আল্লাহর কাছ থেকে সাওয়াব বা নেকী হাসিল করে প্রত্যাবর্তন করবে।
৩. কিংবা সাওয়াব হাসিলের পাশাপাশি গনীমাতের সম্পদসহ ফিরে আসবে।
(শারহে মুসলিম ১৩শ খন্ড, হাঃ ১৮৭৬)
‘‘আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন’’ এ কথার দু’টি অর্থ হতে পারে।
১. নিহত হওয়ার চিহ্ন বা নিদর্শন সহকারে তাকে (সরাসরি) জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। আর এ মর্যাদা শহীদদের জন্য বিশেষিত, যেমনিভাবে শাহাদাত বরণের পর রিযকপ্রাপ্ত হওয়া তাদের আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ অর্থাৎ- ‘‘আর যারা আল্লাহর পথে জীবন দিয়েছে, তাদেরকে তুমি মৃত মনে করো না, বরং তারা তাদের রবের নিকট জীবিত। তাদেরকে রিযক দেয়া হয়’’। (সূরা আ-লি ‘ইমরান ৩ : ১৬৯)
২. পুনরুত্থানের পর আল্লাহ তা‘আলা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। আর এক্ষেত্রে খাস করে শহীদদের জান্নাতে প্রবেশ করানোর কথা বলার কারণ হচ্ছে তার শাহাদাত বরণ করাই তার সকল গুনাহের কাফ্ফারা-যদিও গুনাহের পরিমাণ অধিক হয়- তবে সেই গুনাহ ব্যতীত, যা দলীল দ্বারা সাব্যস্ত। আর তার যে জিহাদের জন্য বের হয়ে আর ফিরে আসলো না; বরং শাহাদাত বরণ করল, তার অর্জিত নেকীর সাথে তার কৃত পাপের তুলনাই চলে না। আবূ কাতাদাহ কর্তৃক বর্ণিত নিম্নোক্ত হাদীসটি উল্লেখিত ব্যাখ্যাটি সমর্থন করে।
قال جاء رجل إلى رسول الله ﷺ فقال : يا رسول الله أرأيت إن قتلت في سبيل الله صابرا محتسبا مقبلا غير مدبر أيكفر الله عني خطاياي قال رسول الله ﷺ نعم فلما ولى الرجل ناداه رسول الله ﷺ أو أمر به فنودي له فقال رسول الله ﷺ كيف قلت فأعاد عليه قوله فقال رسول الله ﷺ نعم إلا الدين كذلك قال لي جبريل عليه السلام
অর্থাৎ- আবূ কাতাদাহ বলেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর রসূল! আপনার মতামত কি? আমি ধৈর্যধারণ করে, সাওয়াবের আশায়, সম্মুখগামী হয়ে এবং পৃষ্ঠপ্রদর্শন না করে যদি আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হই, তাহলে আল্লাহ কি আমার গুনাহসমূহ মিটিয়ে দিবেন? আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘‘হ্যাঁ’’। লোকটি যখন চলে গেল আল্লাহর রসূল তাকে ডাকলেন, অথবা ডেকে আনতে কাউকে আদেশ দিলেন, অতঃপর ডেকে আনা হলো। তখন তিনি বললেন, তুমি কিভাবে (কথাটি) বলেছিলে? লোকটি আবার তার কথা পুনরাবৃত্তি করল। তখন আল্লাহর রসূল বললেনঃ ‘‘হ্যাঁ (অর্থাৎ তা সকল গুনাহের কাফফারা হবে), তবে ঋণ ব্যতীত। জিবরীল (আঃ) আমাকে এমনটিই বললেন’’- (নাসায়ী, হাঃ ৩১৫৬, আলবানীর মতে হাদীসটি সহীহ)। (মুনতাকাল আখবার হাঃ ১০১০)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ
৩৭৯০-[৪] উক্ত রাবী [আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ)] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ সেই মহান সত্তার শপথ, যার হাতে আমার জীবন, যদি কিছু সংখ্যক মু’মিন আমার সাথে জিহাদে অংশগ্রহণ করতে না পারার ফলে তাদের মন দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে এবং আমিও তাদের জন্য প্রয়োজনীয় বাহন সরবরাহ করতে পারছি না। যদি এরূপ সংকটাপন্ন না দেখা দিত, তবে আমি আল্লাহর পথে জিহাদের উদ্দেশে প্রেরিত প্রতিটি সেনাবাহিনীর সাথে অবশ্য গমন করতাম, কোনোটি হতে পিছনে থাকতাম না। যার হাতে আমার প্রাণ, সেই মহান সত্তার কসম করে বলছি, আমার কাছে অত্যন্ত প্রিয় বস্তু হলো- আমি আল্লাহর পথে শহীদ হই, অতঃপর আমাকে পুনরায় জীবিত করা হলে আমি আবার যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়ে যাই, এবং পুনরায় আমাকে জীবিত করা হোক এবং আবার যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হই, আবার জীবিত করা হোক, আবার শহীদ হই, পুনরায় জীবিত করা হোক, পুনরায় শহীদ হই। (বুখারী, মুসলিম)[1]
اَلْفَصْلُ الْأَوَّلُ
وَعَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَوْلَا أَنَّ رِجَالًا مِنَ الْمُسْلِمِينَ لَا تَطِيبُ أَنْفُسُهُمْ أَنْ يَتَخَلَّفُوا عَنِّي وَلَا أَجِدُ مَا أَحْمِلُهُمْ عَلَيْهِ مَا تَخَلَّفْتُ عَنْ سَرِيَّةٍ تَغْزُو فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَوَدِدْتُ أنْ أُقتَلَ فِي سَبِيل الله ثمَّ أُحْيى ثمَّ أُقتَلُ ثمَّ أُحْيى ثمَّ أُقتَلُ ثمَّ أُحْيى ثمَّ أقتل»
ব্যাখ্যা: অত্র হাদীসটিতে জিহাদে অংশগ্রহণ করা এবং আল্লাহর রাস্তায় শাহাদাত বরণ করার ফযীলত সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এ হাদীসটিতে আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে জিহাদে অংশগ্রহণের জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেছেন এবং শাহাদাত লাভে ধন্য হওয়ার জন্য কামনা পোষণ করেছেন।
আল্লাহর নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী: ‘‘মু’মিনদের মধ্যে একদল লোক আমার কাছ থেকে (যুদ্ধ যেতে না পেরে সে) অনুপস্থিত থাকার কারণে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হবে, আর আমিও এমন (অধিক) বাহন পাচ্ছি না, যাতে তাদের আরোহণ করাবো- অবস্থা যদি এমন না হত, তাহলে আমি কোনো একটি সারিয়া থেকেও অনুপস্থিত থাকতাম না যেটি আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করে’’ এ বাক্যে মু’মিনদের কিছু লোক বলতে দরিদ্র লোকেদের বুঝানো হয়েছে, যারা অর্থের অভাবে সওয়ারী বা বাহন সংগ্রহ করতে না পারার কারণে জিহাদের ময়দান থেকে অনুপস্থিত থাকে। সারিয়া হচ্ছে অল্পসংখ্যক সৈন্যের ছো্ট বাহিনী। (মিরকাতুল মাফাতীহ ৩২৫)
সওয়ারী এবং সফরের অন্যান্য পাথেয় না থাকায় তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণে অক্ষম ছিল। এদিকে সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতার কারণে আল্লাহর নাবীও তাদেরকে বাহন দিতে সক্ষম ছিলেন না। হুমাম-এর বর্ণনায় স্পষ্ট ভাষায় রয়েছে, ‘‘কিন্তু আমার প্রশস্ততা বা সামর্থ্যও নেই যে, তাদেরকে সওয়ারী দিব। আর তাদেরও সামর্থ্য নেই যে, তারা আমার অনুসরণ করে পিছু পিছু আসবে। আর আমার (যুদ্ধে চলে যাওয়ার) পর তাদের মানসিক অবস্থাও ভালো থাকবে না।’’ (ফাত-ল বারী ৬ষ্ঠ খন্ড, হাঃ ২৭৯৭)
অত্র হাদীসে ‘‘আল্লাহর রাস্তায় নিহত হই, আবার জীবিত হই, আবার নিহত হই’’ এ কথাটি আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিনবার বলেছেন। আর শেষবার শুধু বলেছেন ‘‘নিহত হই’’, কিন্তু এরপর ‘‘আবার জীবিত হই’’ কথাটির পুনরাবৃত্তি করেননি। এখান থেকে শাহাদাত বরণের গুরুত্ব ও এর মর্যাদার প্রতি স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
ইমাম নববী বলেনঃ এ হাদীসে সুন্দর নিয়্যাতের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে, এ হাদীসে আরো রয়েছে উম্মাতের প্রতি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দয়া ও সহানুভূতির বর্ণনা। এ হাদীস অনুসারে আল্লাহর রাস্তায় শাহাদাত কামনা মুস্তাহাব এবং এ কথা বলা জায়িয যে, আমি অমুক কল্যাণ লাভের আশা পোষণ করি বা আকাঙ্ক্ষা করি- যদিও জানা থাকে যে, তা অর্জন অসম্ভব। এ হাদীস থেকে আরো বুঝা যায় যে, কখনো কখনো কতিপয় কল্যাণকর কাজ পরিহার করতে হয় অধিক প্রাধান্যযোগ্য কল্যাণকর কাজের জন্য, অথবা কোনো ক্ষতিকে প্রতিহত করার জন্য। সাধারণত যা অর্জন করা বা লাভ করা সম্ভব নয়, এমন জিনিসের আশা-আকাঙ্ক্ষা করাও উক্ত হাদীস অনুসারে জায়িয। (ফাতহুল বারী ৬ষ্ঠ খন্ড, হাঃ ২৭৯৭)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ
৩৭৯১-[৫] সাহল ইবনু সা’দ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহর পথে এক দিনের সীমান্ত পাহারা দেয়া, দুনিয়া ও দুনিয়াতে যা কিছু আছে (তার থেকে) সর্বাপেক্ষা উত্তম। (বুখারী, মুসলিম)[1]
اَلْفَصْلُ الْأَوَّلُ
وَعَنْ سَهْلِ بْنِ سَعْدٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «رِبَاطُ يَوْمٍ فِي سَبِيلِ اللَّهِ خَيْرٌ مِنَ الدُّنْيَا وَمَا عَلَيْهَا»
ব্যাখ্যা : উল্লেখিত হাদীসে মুসলিমদের সংরক্ষণের জন্য আল্লাহর রাস্তায় পাহাড়াদারের দায়িত্ব পালনের ফযীলত বর্ণনা করা হয়েছে। «رباط» ‘রিবাত্ব’ শব্দের অর্থ হচ্ছে পাহাড়া দেয়া। নিহায়াহ্ গ্রন্থকার বলেনঃ মূলত রিবাত্ব হচ্ছে শত্রুপক্ষের সাথে জিহাদের উদ্দেশে সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে, ঘোড়া লালন-পালন ও বেঁধে রাখার মাধ্যমে এবং তা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত ও অনড় থাকা। (তুহফাতুল আহওয়াযী হাঃ ১৬৬৪)
যে স্থান দিয়ে শত্রুপক্ষের আক্রমণের সম্ভাবনা রয়েছে, তা প্রতিহত করার জন্য আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশে উক্ত স্থানে অবস্থান নেয়াটাই হচ্ছে ‘রিবাত্ব’। ‘‘দুনিয়া এবং তার উপর যা কিছু আছে তা থেকে উত্তম’’ এ কথা দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে, এর প্রতিদান দুনিয়া এবং তাতে যা আছে, সব কিছু থেকে উত্তম। অর্থাৎ- দুনিয়ার যত সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করা হয়েছে তার প্রতিদানের তুলনায়ও আল্লাহর রাস্তায় একদিন পাহাড়া দেয়ার প্রতিদান অধিক। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ
৩৭৯২-[৬] আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহর পথে একটি সকাল বা একটি বিকাল অতিবাহিত করা, দুনিয়া ও তার সমুদয় সমস্ত সম্পদ হতে সর্বোত্তম। (বুখারী, মুসলিম)[1]
اَلْفَصْلُ الْأَوَّلُ
وَعَنْ أَنَسٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَغَدْوَةٌ فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَوْ رَوْحَةٌ خَيْرٌ مِنَ الدُّنْيَا وَمَا فِيهَا»
ব্যাখ্যা: আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে সময় ব্যয় করার অত্যধিক ফাযীলাতের বর্ণনা দিতে গিয়েই আলোচ্য হাদীসটির অবতারণা। উক্ত হাদীসে আল্লাহর রাস্তায় একটি সকাল বা একটি বিকাল অতিবাহিত করার অফুরন্ত নেকীর কথা আলোচনা করা হয়েছে।
(لَغَدْوَةٌ فِي سَبِيلِ اللّٰهِ أَوْ رَوْحَةٌ خَيْرٌ مِنْ الدُّنْيَا وَمَا فِيهَا) এ বাক্যে ‘‘গদ্ওয়াতুন’’ শব্দটি ‘‘গাইন’’ বর্ণে ফাতহাহ্ দিয়ে পড়তে হবে। এর অর্থ হচ্ছে দিনের শুরু অংশে সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলতে শুরু করার পূর্ব সময় পর্যন্ত কোথাও ভ্রমণ করা। আর ‘‘রওহাতুন’’ অর্থ হচ্ছে সূর্য ঢলার পর থেকে দিনের শেষ ভাগ পর্যন্ত ভ্রমণ বা সফর করা।
এক সকাল আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করলে হাদীসে উল্লেখিত নেকী অর্জিত হবে, অনুরূপ এক বিকাল ব্যয় করলেও তা অর্জিত হবে। আর এ কথা স্পষ্ট বুঝা যায় যে, এ নেকী অর্জিত হওয়া শুধুমাত্র কোনো ভূখণ্ডে অবস্থানের সাথে বিশেষিত নয়; বরং যুদ্ধের ময়দানের দিকে যাওয়ার পথে প্রত্যেক সকাল ও বিকাল কাটানোর বিনিময়ে এই নেকী অর্জিত হবে এবং যুদ্ধের ময়দানেও একইভাবে এই নেকী অর্জিত হবে। কেননা উপরোল্লিখিত সকল অবস্থায় সকাল ও বিকালের সময় ব্যয় করা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করা সকাল ও বিকাল বলে বিবেচিত হবে।
হাদীসের ভাবার্থ হচ্ছে, ‘‘নিশ্চয় আল্লাহর রাস্তায় সকাল ও বিকেলের সময় ব্যয় করার ফযীলত এবং তার সাওয়াব কেউ দুনিয়ার সকল নি‘আমাত বা ধন-সম্পদের মালিক হওয়ার পর তা ভোগ করার সুযোগ থাকলেও তার চেয়েও উত্তম। কেননা দুনিয়ার এ সকল ভোগ্যসামগ্রী ক্ষণস্থায়ী, আর পরকালীন প্রতিদান স্থায়ী- যা কখনোই বিলীন হবে না।’’ (শারহে মুসলিম, খন্ড ১৩, হাঃ ১৮৮১)
সুতরাং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের কাজে একটি সকাল বা বিকাল ব্যয় করার মর্যাদার সাথে দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী ভোগ-বিলাসের কোনো তুলনা নেই।
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ
৩৭৯৩-[৭] সালমান ফারিসী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, আল্লাহর পথে একদিন বা একরাত সীমানা পাহারা দেয়া, একমাসের সওম পালন ও সালাত আদায় করা হতে উত্তম। আর ঐ প্রহরী যদি এ অবস্থায় মারা যায়, তবে তার কৃতকর্মের এ পুণ্য ’আমলের সাওয়াব অবিরত পেতে থাকবে, তার জন্য সর্বক্ষণ রিযক (জান্নাত হতে) আসতে থাকবে এবং সে কবরের কঠিন পরীক্ষা হতে মুক্তি পাবে। (মুসলিম)[1]
اَلْفَصْلُ الْأَوَّلُ
وَعَن سلمانَ الفارسيِّ قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: «رِبَاطُ يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ فِي سَبِيلِ اللَّهِ خَيْرٌ مِنْ صِيَامِ شَهْرٍ وَقِيَامِهِ وَإِنْ مَاتَ جَرَى عَلَيْهِ عَمَلُهُ الَّذِي كَانَ يَعْمَلُهُ وَأُجْرِيَ عَلَيْهِ رِزْقُهُ وَأَمِنَ الْفَتَّانَ» . رَوَاهُ مُسْلِمٌ
ব্যাখ্যা : আলোচ্য হাদীসটিতে আল্লাহর রাস্তায় একদিন একরাত পাহাড়া দেয়ার ফযীলত সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। "رباط" রিবাত্ব এর পরিচয় দিতে গিয়ে ইমাম সুয়ূত্বী বলেন, ‘‘মুসলিম ও কাফিরদের মাঝে কোনো এক স্থানে মুসলিমদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য পাহাড়া দেয়ার কাজে নিয়োজিত হওয়াই রিবাত্ব।’’ (মিরকাতুল মাফাতীহ)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী, ‘‘যদি সে মারা যায় তাহলে তার ঐ ‘আমলের সাওয়াব জারী বা চলমান থাকবে, যা সে করত’’ এ কথাটি আল্লাহর রাস্তায় পাহাড়া দেয়ার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তির স্পষ্ট ফযীলত ও মর্যাদার বর্ণনা। আর মৃত্যুর পরেও ‘আমল চলমান বা জারী থাকার ফযীলত শুধুমাত্র তার সাথেই বিশেষিত, যাতে অন্য কোনো ব্যক্তি অংশীদার নয়। সহীহ মুসলিম ব্যতীত অন্যান্য হাদীসগ্রন্থের বর্ণনায় এ কথা স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘‘প্রত্যেক মৃত ব্যক্তির ‘আমলের পরিসমাপ্তি ঘটে, তবে রিবাত্বকারী ব্যতীত (অর্থাৎ তার ‘আমলের সাওয়াব চলমান থাকে)। কেননা তার ‘আমল কিয়ামত পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে থাকে।’’
হাদীসের বাণী, ‘‘তার রিযক জারী রাখা হবে’’ এটি শহীদদের ব্যাপারে অবতীর্ণ আল্লাহর নিম্নোক্ত উক্তিটির অনুরূপ : ‘‘যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়েছে তাদেরকে কখনো মৃত মনে করো না। বরং তারা তাদের রবের নিকট জীবিত এবং তাদের রিযক দেয়া হচ্ছে’’- (সূরা আ-লি ‘ইমরান ৩ : ১৬৯)।
‘‘সে ফিতনা থেকে নিরাপদ থাকবে’’ এ কথার অর্থ হচ্ছে সে কবরের যাবতীয় ফিতনা তথা পরীক্ষা বা শাস্তি থেকে নিরাপদ থাকবে।’’ (শারহে মুসলিম ১৩ খন্ড, হাঃ ১৯১৩)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ
৩৭৯৪-[৮] আবূ ’আবস্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহর পথে যে বান্দার পদদ্বয় ধূলায় ধূসরিত হয়, জাহান্নামের আগুন তার পদদ্বয় স্পর্শ করবে না। (বুখারী)[1]
اَلْفَصْلُ الْأَوَّلُ
وَعَن أبي عَبْسٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَا اغْبَرَّتْ قَدَمَا عَبْدٍ فِي سَبِيلِ الله فَتَمَسهُ النَّار» . رَوَاهُ البُخَارِيّ
ব্যাখ্যা: আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করতে গিয়ে পায়ে যে ধূলোবালি লেগে যায়, এর বিনিময়েও যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীর জন্য রয়েছে মর্যাদা ও সম্মান। এ সংক্রান্ত ফযীলত সম্পর্কেই আলোচ্য হাদীসটি উল্লেখ করা হয়েছে।
‘‘আল্লাহর রাস্তায় কোনো বান্দার দুই পা ধূলোমলিন হলে জাহান্নামের আগুন তাকে স্পর্শ করবে না’’ এ বাক্যে ‘‘আল্লাহর রাস্তা’’ বলতে বুঝানো হয়েছে ‘ইলম অর্জন, জামা‘আতে সালাত আদায়ের জন্য যাওয়া, অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়া, জানাযায় উপস্থিত হওয়া ইত্যাদি। তবে ব্যবহারিক অর্থে এ ক্ষেত্রে জিহাদের পথ উদ্দেশ্য। আবার কারো কারো মতে এ ক্ষেত্রে হজে/হজ্জের জন্য পথ চলা উদ্দেশ্য। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
জিহাদে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তির শরীরে উল্লেখিত ধূলোবালির উপস্থিতি থাকলে জাহান্নামের আগুনের স্পর্শ অস্তিত্বহীন হবে- অর্থাৎ স্পর্শ করতে পারবে না। এ কথার মাধ্যমে আল্লাহর রাস্তায় অর্থ ও শ্রম ব্যয় করার অত্যধিক মর্যাদার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। কেননা পায়ে ধূলোর স্পর্শ লাগার কারণে যদি তার জন্য জাহান্নামের আগুন হারাম হয়ে যায়, তাহলে যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় প্রাণপন চেষ্টা চালিয়ে যাবে এবং নিজের সমুদয় শক্তি সামর্থ্য এ পথে ব্যয় করবে তার মর্যাদা কতই না উঁচু। (ফাতহুল বারী ৬ষ্ঠ খন্ড, হাঃ ২৮১১)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ
৩৭৯৫-[৯] আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কাফির ও তার (মুসলিম মুজাহিদের) হত্যাকারী কক্ষনো জাহান্নামে একত্রিত হবে না। (মুসলিম)[1]
اَلْفَصْلُ الْأَوَّلُ
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «لَا يَجْتَمِعُ كَافِرٌ وَقَاتِلُهُ فِي النَّارِ أبدا» . رَوَاهُ مُسلم
ব্যাখ্যা: উক্ত হাদীসে জিহাদের ময়দানে কোনো কাফিরকে হত্যার ফযীলত সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। হাদীসে উল্লেখিত ফযীলতটি যুদ্ধের ময়দানে কাফিরের হত্যাকারীর সাথে বিশেষিত। আর এটিকে তার গুনাহসমূহের কাফফারা হিসেবে গণ্য করা হবে, ফলে জাহান্নামের আগুনে তাকে শাস্তি দেয়া হবে না। (শারহে মুসলিম খন্ড ১৩, হাঃ ১৮৯১)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী : ‘‘জাহান্নামের আগুনে কাফির এবং তার হত্যাকারী কখনই একত্রিত হবে না’’ এ কথা থেকে এটাও বুঝা যায় যে, যদি হত্যাকারী ব্যক্তি (অন্য কোনো কারণে) শাস্তি পাওয়ার যোগ্য হয়েও থাকে, তবে তাকে জাহান্নামের অগ্নি ভিন্ন অন্য শাস্তি দেয়া হবে। যেমন প্রথম অবস্থায় তাকে জান্নাতে প্রবেশরুদ্ধ করে আ‘রাফে আবদ্ধ রাখা হতে পারে। তবে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে না। অথবা তাকে জাহান্নামের আগুনে শাস্তি দেয়া হলেও কাফিরদের শাস্তির জায়গা ব্যতীত অন্য স্থানে শাস্তি দেয়া হবে- এ ক্ষেত্রে তারা উভয়ে একই স্থানে একত্রিত হবে না। [আল্লাহই এ ব্যাপারে সর্বাধিক অবগত আছেন] (‘আওনুল মা‘বূদ ৫ম খন্ড, হাঃ ২৪৯২)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ
৩৭৯৬-[১০] উক্ত রাবী [আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ)] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মানুষের মধ্যে সর্বোত্তম জীবনযাপন করে ঐ ব্যক্তি, যে আল্লাহর পথে স্বীয় ঘোড়ার লাগাম ধরে তার পিঠের উপর বসে অপেক্ষারত থাকে। যখনই কোনো ভয়ভীতির সংকেত শুনতে পায়, তৎক্ষণাৎ সে দ্রুতবেগে তার দিকে ধাবিত হয় এবং তাকে হত্যা করে বা মৃত্যু সম্ভাবনাময় স্থানে খুঁজতে থাকে। আর ঐ ব্যক্তির জীবন (সর্বোত্তম) কিছু বকরীর একটি পাল বা ছোট একটি বকরীর পাল নিয়ে কোনো পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থান নেয় বা কোনো সমতল ভূমিতে বকরী চরায় এবং শেষ নিঃশ্বাস থাকা তথা মৃত্যু পর্যন্ত সালাত কায়িম করে, যাকাত আদায় করে এবং সর্বদা স্বীয় প্রতিপালকের ’ইবাদাতে মশগুল থাকে। এসব মানুষেরাই সর্বোত্তম জীবন যাপনের অধিকারী হয়ে থাকে। (মুসলিম)[1]
اَلْفَصْلُ الْأَوَّلُ
وَعَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مِنْ خَيْرِ مَعَاشِ النَّاسِ لَهُمْ رَجُلٌ مُمْسِكٌ عِنَانَ فَرَسِهِ فِي سَبِيلِ اللَّهِ يَطِيرُ عَلَى مَتْنِهِ كُلَّمَا سَمِعَ هَيْعَةً أَوْ فَزْعَةً طَارَ عَلَيْهِ يَبْتَغِي الْقَتْلَ وَالْمَوْتَ مَظَانَّهُ أَوْ رَجُلٌ فِي غُنَيْمَةٍ فِي رَأْسِ شَعَفَةٍ مِنْ هَذِهِ الشَّعَفِ أَوْ بَطْنِ وَادٍ مِنْ هَذِهِ الْأَوْدِيَةِ يُقِيمُ الصَّلَاةَ وَيُؤْتِي الزَّكَاةَ وَيَعْبُدُ الله حَتَّى يَأْتِيَهُ الْيَقِينُ لَيْسَ مِنَ النَّاسِ إِلَّا فِي خير» . رَوَاهُ مُسلم
ব্যাখ্যা: আলোচ্য হাদীসে দুই শ্রেণীর ব্যক্তিকে কল্যাণের উপর অধিষ্ঠিত বলে ঘোষণা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে প্রথম শ্রেণী জিহাদে অংশগ্রহণের জন্য সদা প্রস্তুত থাকে এবং শাহাদাতের কামনায় ছুটে যায় ময়দানে।
আর অপর শ্রেণী জিহাদে অংশগ্রহণে যদিও অপারগ, কিন্তু আল্লাহর ‘ইবাদাত উপাসনা থেকে কখনো বিমুখ থাকে না; বরং সদা ‘ইবাদাতে মশগুল থাকে। এ দুই শ্রেণীর ব্যক্তিই কল্যাণের উপর রয়েছে বলে হাদীসে বর্ণনা করা হয়েছে।
(خَيْرِ مَعَاشِ النَّاسِ) দ্বারা মানুষের জীবনযাত্রার মধ্যে জীবনযাপনের সর্বোত্তম অবস্থা বুঝানো হয়েছে।
(يَطِيرُ عَلَى مَتْنِه) অর্থাৎ উক্ত ঘোড়ার পিঠের উপর সওয়ার হয়ে খুব দ্রুত বেগে এগিয়ে যায়।
(كُلَّمَا سَمِعَ هَيْعَةً أَوْ فَزْعَةً طَارَ عَلَيْهِ) অর্থাৎ যখনই সাহায্যের আবেদন বা ভয়ঙ্কর আওয়াজ শুনতে পায়, তখনই তার ঘোড়ার উপর সওয়ার হয়ে দ্রুত গতিতে যুদ্ধের জন্য এগিয়ে যায়। هَيْعَةً শব্দ দ্বারা শত্রুবাহিনীর উপস্থিতির কারণে যে (সাহায্যের আকুতি সম্বলিত) শব্দ বা আওয়াজ (মানুষের মুখ থেকে) বেরিয়ে আসে তাই বুঝানো হয়। আর فَزْعَةً অর্থ ভয়ঙ্কর আওয়াজ বা শত্রুর দিকে ছুটে যাওয়া।
(يَبْتَغِى الْقَتْلَ وَالْمَوْتَ مَظَانَّه) এ বাক্যে বুঝানো হয়েছে যে, ঐ ব্যক্তির শাহাদাত লাভের অত্যধিক আকাঙ্ক্ষা থাকার কারণে সে জিহাদের ময়দানে সব জায়গায় এই কামনাই করবে। হাদীসের এ অংশে জিহাদের মর্যাদা এবং সেক্ষেত্রে শাহাদাত বরণের প্রতি আকাঙ্ক্ষার ফযীলত বর্ণনা করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রথম ব্যক্তি জিহাদের ময়দানে ঝাপিয়ে পড়ার জন্য সদা প্রস্তুত। আর এ শ্রেণীর মানুষ কল্যাণের উপর অধিষ্ঠিত। দ্বিতীয় শ্রেণীর ব্যক্তি হচ্ছে ঐ ব্যক্তি যে তার মেষপাল নিয়ে নির্জনে পাহাড়ের উচ্চ শৃঙ্গে অথবা কোনো সমতল ভূমিতে অবস্থানরত অবস্থায় আল্লাহর ‘ইবাদাতে মগ্ন থাকে। সেও কল্যাণের উপর রয়েছে।
এখানে غُنَيْمَةٍ শব্দটি ‘গানাম’ এর তাসগীর। এর অর্থ কিছু বকরী বা একপাল বকরী। আর شَعَفَةٍ এর অর্থ হলো أعلى الجبل তথা ‘পাহাড়ের চূড়া বা শীর্ষস্থান’। (শারহে মুসলিম ১৩শ খন্ড, হাঃ ১২৫, ১৮৮৯)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ
৩৭৯৭-[১১] যায়দ ইবনু খালিদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি কোনো মুজাহিদকে যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহ করে দিল, সে যেন নিজেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করল। আর যে ব্যক্তি কোনো মুজাহিদের অবর্তমানে তার পরিবার-পরিজনের তত্ত্বাবধান করল, সেও যেন স্বয়ং যুদ্ধে অংশগ্রহণ করল। (বুখারী, মুসলিম)[1]
اَلْفَصْلُ الْأَوَّلُ
وَعَن زيد بن خالدٍ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «مَنْ جَهَّزَ غَازِيًا فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَقَدْ غَزَا وَمَنْ خَلَفَ غَازِيًا فِي أَهْلِهِ فقد غزا»
ব্যাখ্যা: আল্লাহর রাস্তার জিহাদ করার জন্য কোনো মুজাহিদের সরঞ্জাম প্রস্তুত করে দিয়ে তাকে যুদ্ধের জন্য সহায়তা করা এবং কোনো মুজাহিদের জিহাদের ময়দানে থাকাকালীন সময়ে তার পরিবারের ন্যায়সঙ্গত দেখাশোনা করার মর্যাদা ও ফযীলত আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করার সমপরিমাণ।
فقد غزا ‘‘সে স্বয়ং যেন জিহাদ করল বা যুদ্ধ করল’’ এ কথার অর্থ স্পষ্ট করতে গিয়ে ইমাম ইবনু হিব্বান বলেনঃ ‘‘এর অর্থ হচ্ছে, সাওয়াব বা নেকীর দিক থেকে (যোদ্ধাকে প্রস্তুতকারী বা তার পরিবারের দেখাশোনার দায়িত্ব পালনকারী) ব্যক্তি স্বয়ং জিহাদকারী ব্যক্তির সমান, যদিও সে প্রকৃতপক্ষে জিহাদে অংশগ্রহণ করেনি।’’ (ফাতহুল বারী ৬ষ্ঠ খন্ড, হাঃ ২৮৪৩)
হাদীসে উল্লেখিত এই প্রতিদান বা সাওয়াব প্রত্যেক স্তরের জিহাদের জন্যই প্রযোজ্য- চাই তা পরিমাণে কম হোক বা বেশী। আর প্রত্যেক ঐ ব্যক্তির জন্যও এ সাওয়াব রয়েছে, যে ঐ যোদ্ধার পরিবারের প্রয়োজনগুলো মিটিয়ে দিবে, তাদের জন্য নিজের সম্পদ থেকে খরচ করবে এবং তাদের সার্বিক ব্যাপারে সাহায্য করবে। আর এ ক্ষেত্রে তার কর্মের কম বেশীর কারণে সাওয়াবের কম বেশী হবে।
আলোচ্য হাদীসে ঐ সকল ব্যক্তির প্রতি ইহসান বা সদাচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে, যারা মুসলিম উম্মাহর জন্য কোনো কল্যাণকর কাজে নিয়োজিত অথবা যারা মুসলিম উম্মাহর কোনো অতিব গুরুত্বপূর্ণ কাজ আঞ্জাম দিতে ব্যস্ত। (শারহে মুসলিম ১৩শ খন্ড, হাঃ ৩৭৯৭)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ
৩৭৯৮-[১২] বুরায়দাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ঘরে অবস্থানকারী পুরুষগণের নিকট মুজাহিদের সহধর্মিণীদের সম্মান ও মর্যাদা তাদের মাতৃসম। যদি ঘরে অবস্থানকারী কোনো ব্যক্তি কোনো মুজাহিদের পরিবারের তত্ত্বাবধানে থেকে তাদের ব্যাপারে খিয়ানাত করে, তবে খিয়ানাতকারীকে কিয়ামতের দিন আটকিয়ে মুজাহিদকে বলা হবে তুমি তার নেক ’আমল যত পরিমাণ ইচ্ছা আদায় করে নাও। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, এবার তোমাদের কি ধারণা? (মুসলিম)[1]
اَلْفَصْلُ الْأَوَّلُ
وَعَنْ بُرَيْدَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «حُرْمَةُ نِسَاءِ الْمُجَاهِدِينَ عَلَى الْقَاعِدِينَ كَحُرْمَةِ أُمَّهَاتِهِمْ وَمَا مِنْ رَجُلٍ مِنَ الْقَاعِدِينَ يَخْلُفُ رَجُلًا مِنَ الْمُجَاهِدِينَ فِي أَهْلِهِ فَيَخُونُهُ فِيهِمْ إِلَّا وُقِفَ لَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فيأخذُ مِنْ عَمَلِهِ مَا شَاءَ فَمَا ظَنُّكُمْ؟» . رَوَاهُ مُسلم
ব্যাখ্যা: উক্ত হাদীসটিতে মুজাহিদগণের স্ত্রীদের সম্মান এবং তাদের অবর্তমানে তাদের পরিবারের ব্যাপারে খিয়ানাতকারীদের ভয়াবহতার কথা আলোকপাত করা হয়েছে।
(حُرْمَةُ نِسَاءِ الْمُجَاهِدِينَ عَلَى الْقَاعِدِينَ كَحُرْمَةِ أُمَّهَاتِهِم) ‘‘মুজাহিদগণের স্ত্রীগণ যারা যুদ্ধ থেকে অনুপস্থিত রয়েছে তাদের ওপর নিজেদের মায়ের মতো হারাম’’ এ বাক্যে মুজাহিদগণের স্ত্রীদের সাথে কোনো অনৈতিক কাজ করা থেকে বিরত থাকার প্রতি সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে এবং তাদের অধিকারসমূহ আদায়ে যত্নবান হওয়ার জন্য যুদ্ধ থেকে অনুপস্থিত ব্যক্তিদের প্রতি দায়িত্বারোপ করা হয়েছে।
যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে অনুপস্থিত ব্যক্তি যদি কোনো মুজাহিদের পরিবারের দায়িত্ব নেয়, অতঃপর পরিবারের খিয়ানাত করে, তাহলে কিয়ামতের দিন উক্ত মুজাহিদ দাঁড়াবে এবং তার ‘আমল নিয়ে নিবে। এখানে মুজাহিদের পরিবার বলতে বুঝানো হয়েছে তার স্ত্রী, কন্যা ও বাড়িতে বসবাসরত অন্যান্য নিকটাত্মীয়কে। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
(فَيَأْخُذُ مِنْ عَمَلِه مَا شَاءَ فَمَا ظَنُّكُم) তথা ‘‘সে তার ‘আমল থেকে যা ইচ্ছা নিয়ে নিবে, অতএব এ ব্যাপারে তোমাদের ধারণা কি?’’ এ কথার অর্থ হচ্ছে, তোমরা ঐ মুজাহিদের উক্ত খিয়ানাতকারীর নেক ‘আমল থেকে ইচ্ছামত নিয়ে নেয়ার আগ্রহ ও আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে কি ধারণা করছ? আর এ ক্ষেত্রে অধিকহারে নিয়ে নেয়া সম্পর্কেই বা তোমাদের কি ধারণা রয়েছে? অর্থাৎ- যদি সম্ভব হয় তাহলে তার কোনো নেক ‘আমলই বাকী রাখবে না; বরং সব ‘আমল ছিনিয়ে নিবে (আল্লাহই সর্বাধিক অবগত)। (শারহে মুসলিম ১৩শ খন্ড, হাঃ ১৩৯, ১৮৯৭)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ
৩৭৯৯-[১৩] আবূ মাস্’ঊদ আল আনসারী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, জনৈক ব্যক্তি স্বীয় উষ্ট্রীর নাকে লাগামসহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এনে বলল, এ উষ্ট্রী আল্লাহর পথে দান করলাম। তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাকে বললেন, তোমাকে তার বিনিময়ে কিয়ামতের দিনে সাতশত লাগামসহ উষ্ট্রী প্রদান করা হবে। (মুসলিম)[1]
اَلْفَصْلُ الْأَوَّلُ
وَعَن أبي مَسْعُود الْأنْصَارِيّ قَالَ: جَاءَ رَجُلٌ بِنَاقَةٍ مَخْطُومَةٍ فَقَالَ: هَذِهِ فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَكَ بِهَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ سَبْعمِائة نَاقَة كلهَا مخطومة» . رَوَاهُ مُسلم
ব্যাখ্যা: আলোচ্য হাদীসে আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধের সরঞ্জাম বা পাথেয় দান করার ফযীলত সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। খিতাম পরিহিত একটি উট নিয়ে একজন সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এসে তা আল্লাহর রাস্তায় সাদাকা করলে তিনি এর ফযীলত বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘‘এর বিনিময়ে তোমাকে কিয়ামতের দিন সাতশত খিতাম পরিহিত উটনী দেয়া হবে’’। এখান থেকে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের জন্য দান করার ফযীলত প্রমাণিত হয়।
(نَاقَةٍ مَخْطُومَةٍ) তথা খিতাম পরিহিত উটনী বলতে এমন উটনী বুঝানো হয়েছে, যাকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় আটকে রাখা হয়েছে। সেটি হলো কোনো একটি রশির একদিকে বৃত্তের মতো বানিয়ে, অতঃপর অপর পার্শ্বকে ঐ পার্শ্বের বৃত্তের সাথে আটকিয়ে কোনো উটনীকে মাথায় আটকিয়ে রাখা বা বেঁধে রাখা। এ প্রক্রিয়াটিকেই খিতাম বলা হয়। তবে এটি লিযাম নয়। কারণ লিযাম হচ্ছে নাকের ভিতর দিয়ে রশি ঢুকিয়ে আটকানো বা বাঁধা। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ
৩৮০০-[১৪] আবূ সা’ঈদ আল খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুযায়ল গোত্রের বানী লিহ্ইয়ান-এর বিরুদ্ধে একদল সেনা পাঠিয়ে বললেন, প্রত্যেক গোত্রের প্রতি দু’জনের মধ্যে হতে একজন অভিযানে যেতে প্রস্তুত হও, পুণ্যলাভ তোমাদের উভয়কে দেয়া হবে। (মুসলিম)[1]
اَلْفَصْلُ الْأَوَّلُ
وَعَنْ أَبِي سَعِيدٍ: أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بَعَثَ بَعْثًا إِلَى بَنِي لِحْيَانَ مِنْ هُذَيْلٍ فَقَالَ: «لينبعثْ مِنْ كلِّ رجلينِ أحدُهما والأجرُ بَينهمَا» . رَوَاهُ مُسلم
ব্যাখ্যা: (لِيَنْبَعِثْ مِنْ كُلِّ رَجُلَيْنِ أَحَدُهُمَا) অর্থাৎ- প্রতি দুই ব্যক্তির মধ্যে একজন যেন শত্রুর সাথে যুদ্ধের জন্য বের হয় আর অপরজন যেন তার অপর সাথীর দায়িত্ব এবং সকল কল্যাণকর দিক খেয়াল করার জন্য নিজ এলাকায় অবস্থান করে। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
সকল ‘উলামায়ে কিরাম এ ব্যাপারে একমত যে, বানী লিহইয়ান তৎকালীন সময়ে কাফির সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল, ফলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য সেনাদল পাঠিয়েছিলেন। প্রত্যেক দুই ব্যক্তির মধ্যে একজন বের হওয়ার নির্দেশ দেয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে, গোত্রের অর্ধেক সংখ্যক লোক জিহাদের উদ্দেশে বের হওয়া।
(وَالأَجْرُ بَيْنَهُمَا) অর্থাৎ- যুদ্ধের সাওয়াব উভয়ের জন্য সমান। জিহাদে অংশগ্রহণের সাওয়াবে যুদ্ধ থেকে অনুপস্থিত ব্যক্তি তখনই অংশীদার হবে, যখন সে মুজাহিদের পরিবারের যথাযথভাবে দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করবে, যেমনটি আমরা পূর্বেই অবগত হয়েছি। (শারহে মুসলিম ১৩শ খন্ড, হাঃ ১৩৭, ১৮৯৬; মিরকাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ
৩৮০১-[১৫] জাবির ইবনু সামুরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ নিশ্চয় এ দীন (ইসলামী জীবন বিধান) সর্বদা সুপ্রতিষ্ঠিত থাকবে এবং একদল মুসলিম কিয়ামত দিবস পর্যন্ত এই দীনের জন্য সংগ্রাম করতে থাকবে। (মুসলিম)[1]
اَلْفَصْلُ الْأَوَّلُ
وَعَنْ جَابِرِ بْنِ سَمُرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَنْ يَبْرَحَ هَذَا الدِّينُ قَائِمًا يُقَاتِلُ عَلَيْهِ عِصَابَةٌ مِنَ الْمُسْلِمِينَ حَتَّى تقوم السَّاعَة» . رَوَاهُ مُسلم
ব্যাখ্যা: উক্ত হাদীসে কিয়ামতের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত জিহাদের মাধ্যমে দীন প্রতিষ্ঠিত থাকার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। আর এ কথাও স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, মুসলিমদের একটি দল কিয়ামতের পূর্ব পর্যন্ত জিহাদ করে যাবে। এ হাদীসের ভাবার্থ হলো পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠ কখনই জিহাদ থেকে মুক্ত থাকবে না। যদি কোনো স্থানে জিহাদ নাও চালু থাকে তাহলে অন্য কোথাও না কোথাও ঠিকই চালু থাকবে। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
ইমাম ত্বীবী বলেনঃ ‘‘এখানে এ অর্থও লুক্কায়িত রয়েছে যে, তারা দীন-ইসলামের শত্রুদের সাথে যুদ্ধে জয়ী হতে থাকবে। অর্থাৎ মুসলিমদের এ দলটির জিহাদ করার কারণে দীন সদা-সর্বদা বিজয়ী ও প্রতিষ্ঠিত থাকবে। আর আমার ধারণামতে সিরিয়ার সাহায্যপ্রাপ্ত দলটিই হচ্ছে সেই দল। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
হাদীসে বর্ণিত (حَتّٰى تَقُومَ السَّاعَةُ) তথা ‘‘কিয়ামত সংঘটিত হওয়া পর্যন্ত’’ এ কথা বলতে বুঝানো হয়েছে কিয়ামতের নিকটবর্তী সময় পর্যন্ত। আর সে সময়টি হচ্ছে বিশেষ বাতাস প্রবাহিত হওয়ার সময় পর্যন্ত। (শারহে মুসলিম ১৩শ খন্ড, হাঃ ১৯২২)
আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী উল্লেখিত দলটি সম্পর্কে হাদীসশাস্ত্রে অগাধ জ্ঞানের অধিকারী ইমাম বুখারী (রহঃ) বলেনঃ ‘‘তারা হচ্ছে আহলুল ‘ইলম তথা ওয়াহীর জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তিবর্গ’’। আর ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) বলেন, এ দল যদি আহলুল হাদীস না হন, তাহলে আমি জানি না যে, তারা কারা। (অর্থাৎ তাঁর মতে এ দল হলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীস চর্চাকারী এবং ‘আমলে বাস্তবায়নকারী দল)। (শারহে মুসলিম ১৩শ খন্ড, হাঃ ১৯২২)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ
৩৮০২-[১৬] আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কোনো ব্যক্তি যদি আল্লাহর পথে আহত হয়, তবে আল্লাহই প্রকৃতপক্ষে জানেন যে, কে তার পথে হতাহত হয়েছে। কিয়ামতের দিনে সে এরূপ অবস্থায় আগমন করবে যে, তার ক্ষতস্থান হতে রক্ত প্রবাহিত হয়ে বের হতে থাকবে এবং তার বর্ণ রক্তের মতো হবে আর তার সুগন্ধি হবে মিশকের সুঘ্রাণের ন্যায়। (বুখারী, মুসলিম)[1]
اَلْفَصْلُ الْأَوَّلُ
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَا يُكَلَّمُ أَحَدٌ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَاللَّهُ أَعْلَمُ بِمَنْ يُكَلَّمُ فِي سَبِيلِهِ إِلَّا جَاءَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَجُرْحُهُ يَثْعَبُ دَمًا اللَّوْنُ لَوْنُ الدَّمِ والريحُ ريحُ المسكِ»
ব্যাখ্যা: উপরোক্ত হাদীসে ঐ ব্যক্তির কিয়ামতের দিন মর্যাদাবান হওয়ার সুসংবাদ রয়েছে, যে দুনিয়াতে থাকাবস্থায় আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম করতে গিয়ে নিজ শরীরে কোনো আঘাত পেয়েছে। উক্ত ক্ষতস্থান থেকে কিয়ামতের দিন রক্তক্ষরণ হবে এবং তার সুগন্ধি হবে মৃগ নাভীর মতো। পরোক্ষভাবে এখানে উক্ত মুজাহিদের মর্যাদার কথা আলোচনা করা হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী : (لَا يُكْلَمُ أَحَدٌ فِىْ سَبِيلِ اللّٰهِ) এ কথার অর্থ হলো যে কোনো ব্যক্তি যদি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করতে গিয়ে উক্ত আঘাত পায় তাহলে সে উল্লেখিত মর্যাদার অধিকারী হবে। এ ক্ষেত্রে ঐ ব্যক্তি উক্ত আঘাতে মারা যাক বা বেঁচে থাকুকু উভয় ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য হবে। (তুহফাতুল আহওয়াযী ৫ম খন্ড, হাঃ ১৬৫৭)
হাদীসে উল্লেখিত বাণী, (وَاللّٰهُ أَعْلَمُ بِمَنْ يُكْلَمُ فِىْ سَبِيلِه) তথা ‘‘আল্লাহই অধিক অবগত আছেন ঐ ব্যক্তির ব্যাপারে, যে কেবল তার রাস্তায় আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে’’ এ কথার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইমাম নববী বলেন, ‘‘এটা যুদ্ধক্ষেত্রে ইখলাস তথা আল্লাহর জন্য ‘আমলের একনিষ্ঠতা নিশ্চিত করার জন্য সতর্কবাণী। কেননা হাদীসে বর্ণিত ফাযীলাতের হকদার কেবল ঐ ব্যক্তিই হবে, যে একনিষ্ঠভাবে এ কাজ করেছে এবং আল্লাহর কালিমাকে সুউচ্চ করার জন্যই যুদ্ধ করেছে’’। (তুহফাতুল আহ্ওয়াযী ৫ম খন্ড, হাঃ ১৬৫৭)
ইমাম নববী-এর মতে, কিয়ামতের দিন মুজাহিদের ক্ষতস্থান থেকে রক্তক্ষরণের কারণ বা রহস্য হচ্ছে, মুজাহিদ ব্যক্তির সাথে তার আল্লাহর আনুগত্যের কাজে নিজেকে আত্মনিয়োগ করার এবং উক্ত কাজের ফযীলত অর্জনের সাক্ষী বা প্রমাণ রাখা। (তুহফাতুল আহওয়াযী ৫ম খন্ড, হাঃ ১৬৫৭)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ
৩৮০৩-[১৭] আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কোনো ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশের পরে পুনরায় দুনিয়ায় ফিরে আসতে চাইবে না যদিও সে পার্থিব যাবতীয় সম্পদ প্রাপ্তির সুযোগ পায়। অবশ্য শহীদ ব্যক্তি দুনিয়ায় ফিরে আসতে চাইবে এ উদ্দেশে যে, দুনিয়ায় এসে সে পুনরায় দশবার শাহাদাত লাভের প্রত্যাশা করে এ সদিচ্ছার কারণে, সে জান্নাতে শাহীদের যে মর্যাদা তা প্রত্যক্ষ করবে। (বুখারী, মুসলিম)[1]
اَلْفَصْلُ الْأَوَّلُ
وَعَنْ أَنَسٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَا مِنْ أَحَدٍ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ يُحِبُّ أَنْ يُرْجَعَ إِلَى الدُّنْيَا وَلَهُ مَا فِي الْأَرْضِ مِنْ شَيْءٍ إِلَّا الشَّهِيدُ يَتَمَنَّى أَنْ يُرْجَعَ إِلَى الدُّنْيَا فَيُقْتَلَ عَشْرَ مَرَّاتٍ لِمَا يَرَى مِنَ الْكَرَامَةِ»
ব্যাখ্যা: জান্নাতে প্রবেশের পর পুনরায় দুনিয়াতে ফিরে আসার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করা এক অবাক বিস্ময়। পার্থিব ভোগ-উপকরণের তুলনায় বহুগুণ বেশী নি‘আমাত পাওয়া সত্ত্বেও কেবল আল্লাহর রাস্তায় শাহাদাত বরণকারীগণই পুনরায় দুনিয়ায় ফিরে এসে আবারো আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করবেন। কারণ তারা আল্লাহর কাছে শহীদ হওয়ার যে মর্যাদা অর্জন করেছেন তা অতুলনীয় এবং অনন্য, যা অন্য কেউ অর্জন করতে সক্ষম হয়নি।
ইবনু বাত্ত্বল বলেনঃ ‘‘এ হাদীসটি শাহাদাতের ফাযীলাতের বর্ণনার ক্ষেত্রে সর্বোৎকৃষ্ট ও সর্বোচ্চ মানের হাদীস। নেক ‘আমলগুলোর মধ্যে জিহাদ ব্যতীত আর এমন কোনো ‘আমল নেই যাতে বান্দা তার নিজের জীবন বিসর্জন দেয়। আর এজন্যই তার সাওয়াবও মহান ও ব্যাপক’’। (ফাতহুল বারী ৬ষ্ঠ খন্ড, হাঃ ২৮১৭)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ
৩৮০৪-[১৮] মাসরূক (রহঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ’আব্দুল্লাহ ইবনু মাস্’ঊদ (রাঃ)-কে এ আয়াতের মর্মার্থ জিজ্ঞেস করলাম, ’’যারা আল্লাহর পথে শহীদ হয়েছে, তাদেরকে তোমরা মৃত মনে করো না; বরং তারা জীবিত এবং তারা তাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে রিযকপ্রাপ্ত’’- (সূরা আ-লি ’ইমরান ৩ : ১৬৯)। জবাবে তিনি বলেন, আমরা এ আয়াত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করলে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছিলেন যে, শহীদগণের রূহ সবুজ পাখির পেটে অবস্থান করে এবং তোমাদের সাথে ’আর্শে ফানুস ঝুলিয়ে দেয়া হয়। অতঃপর তারা জান্নাতে মনের ইচ্ছানুসারে উড়ে বেড়াবে, অতঃপর আবার ঐ ফানুসে ফিরে আসবে।
এমতাবস্থায় তাদের প্রতিপালক তাদের সম্মুখে বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলবেন, তোমাদের কোনো কিছুর আকাঙ্ক্ষা আছে কি? তারা বলবে, আর কিসের আকাঙ্ক্ষা করব? (আমরা পরিপূর্ণ নি’আমাতে আছি) কেননা আমরা জান্নাতের যথেচ্ছাভাবে ভ্রমণ করছি। এভাবে তিনি তাদেরকে তিনবার জিজ্ঞেস করেন, তারাও একই উত্তর পুনরাবৃত্তি করলেন। যখন তারা বুঝতে পারবে যে, তাদের উদ্দেশে একই কথা বার বার জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, তখন তারা বলবে, হে আমার রব্! আমাদের রূহকে পুনরায় আমাদের পার্থিব দেহে ফিরিয়ে দাও, যাতে পুনরায় আমরা তোমার পথে লড়াই করে শাহাদাত লাভ করতে পারি। অতঃপর আল্লাহ তা’আলা যখন তাদের অন্তরের ইচ্ছা বুঝতে পারেন, এদের আর কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই, তখন ঐ অবস্থায় তাদের চিরস্থায়ীভাবে রেখে দেন। (মুসলিম)[1]
اَلْفَصْلُ الْأَوَّلُ
وَعَنْ مَسْرُوقٍ قَالَ: سَأَلْنَا عَبْدَ اللَّهِ بْنَ مسعودٍ عَنْ هَذِهِ الْآيَةِ: (وَلَا تَحْسَبَنَّ الَّذِينَ قُتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَمْوَاتًا بَلْ أَحْيَاءٌ عِنْدَ ربِّهم يُرزقون)
الْآيَةَ قَالَ: إِنَّا قَدْ سَأَلْنَا عَنْ ذَلِكَ فَقَالَ: أَرْوَاحُهُمْ فِي أَجْوَافِ طَيْرٍ خُضْرٍ لَهَا قَنَادِيلُ مُعَلَّقَةٌ بِالْعَرْشِ تَسْرَحُ مِنَ الْجَنَّةِ حَيْثُ شَاءَتْ ثُمَّ تَأْوِي إِلَى تِلْكَ الْقَنَادِيلِ فَاطَّلَعَ إِلَيْهِمْ رَبُّهُمُ اطِّلَاعَةً فَقَالَ: هَلْ تَشْتَهُونَ شَيْئًا؟ قَالُوا: أَيَّ شَيْءٍ نَشْتَهِي وَنَحْنُ نَسْرَحُ مِنَ الْجنَّة حيثُ شِئْنَا ففعلَ ذلكَ بهِمْ ثَلَاثَ مَرَّاتٍ فَلَمَّا رَأَوْا أَنَّهُمْ لَنْ يُتْرَكُوا مِنْ أَنْ يَسْأَلُوا قَالُوا: يَا رَبُّ نُرِيدُ أَنْ تُرَدَّ أَرْوَاحُنَا فِي أَجْسَادِنَا حَتَّى نُقْتَلَ فِي سبيلِكَ مرَّةً أُخرى فَلَمَّا رَأَى أَنْ لَيْسَ لَهُمْ حَاجَةٌ تُرِكُوا . رَوَاهُ مُسلم
ব্যাখ্যা: আলোচ্য হাদীসে শাহীদের মৃত্যু পরবর্তী এবং কিয়ামতের পূর্ববর্তী সময়ে মর্যাদাবান হওয়ার প্রমাণ রয়েছে। মৃত্যুর পরপরই তাদের আত্মা সবুজ পাখীর ভিতরে সঞ্চারিত করা হবে এবং সে জান্নাতে অবাধে ঘুরে বেড়াবে। এ মর্যাদা কেবল আল্লাহর রাস্তায় শাহীদের জন্যই।
হাদীসের বাণী, «أرواحهم في أجواف طير خضر لها قناديل معلقة بالعرش تسرح من الجنة حيث شاءت ثم تأوي إلى تلك القناديل» এ উক্তিটিতে এ কথার প্রমাণ রয়েছে যে, জান্নাত পূর্ব থেকেই আল্লাহ কর্তৃক সৃষ্ট, যার অস্তিত্ব এখন বিদ্যমান। এটিই আহলুস্ সুন্নাহ্ ওয়াল জামা‘আতের ‘আকীদা। এটা সেই জান্নাত, যেখান থেকে আদম (আঃ)-কে বের করা হয়েছিল। এটাই সেই জান্নাত, যেথায় পরকালে মু’মিনদের পুরস্কৃত করা হবে এবং নি‘আমাতসমূহ প্রদান করা হবে। এ ব্যাপারে আহলুস্ সুন্নাহর ইজমা সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু মু’তাজিলা ও একদল বিদ্‘আতী সম্প্রদায়ের মতে, জান্নাত বর্তমানে অস্তিত্বহীন, কিয়ামতের পুনরুত্থানের পর তাকে অস্তিত্বে আনা হবে। তারা আরো বলে যে, আদম (আঃ)-কে যে জান্নাত থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল, তা অন্য এক জান্নাত। অথচ কুরআন ও সুন্নাহর অকাট্য দলীলসমূহের আলোকে আহলুস্ সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের মতটিই অধিকতর শক্তিশালী হিসেবে প্রমাণিত হয়।
কাযী ‘ইয়ায বলেনঃ ‘‘এ হাদীস প্রমাণ করে যে, রূহসমূহ কখনও শেষ হয়ে যায় না; বরং আপন অবস্থায় বাকী থাকে, অতঃপর সৎকর্মশীল হলে পুরস্কৃত করা হবে আর পাপী হলে শাস্তি দেয়া হবে। (শারহে মুসলিম ১৩শ খন্ড, হাঃ ১৮৮৭)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ
৩৮০৫-[১৯] আবূ কাতাদাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কিরামের মাঝে দাঁড়িয়ে খুৎবা দিলেন, সর্বোত্তম ’আমল হলো আল্লাহর পথে জিহাদ করা ও আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা। তখন জনৈক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রসূল! আপনার কি অভিমত, আমি যদি আল্লাহর পথে লড়াই করে মৃত্যুবরণ করি, তবে কি আমার যাবতীয় অপরাধ ক্ষমা করা হবে? উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, হ্যাঁ, তুমি যদি দৃঢ়ভাবে সাওয়াবের প্রত্যাশায় যুদ্ধের মাঠ থেকে পৃষ্ঠপ্রদর্শন না করে আক্রমণে অগ্রসর হয়ে নিহত হও। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অপর ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি যেন কি প্রশ্ন করেছ? সে বলল, আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমি যদি আল্লাহর পথে শহীদ হই তবে কি আমার সমস্ত পাপ-মার্জনা মাফ করে দেয়া হবে? উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, হ্যাঁ, অবশ্যই ঋণগ্রস্ত হওয়া ব্যতীত তুমি যদি সাহসিকতার সাথে সাওয়াবের আশায় শত্রুর আক্রমণে অগ্রগামী অবস্থায় শহীদ হও। জিবরীল (আঃ) আমাকে এরূপেই বললেন। (মুসলিম)[1]
اَلْفَصْلُ الْأَوَّلُ
عَن أَبِي قَتَادَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَامَ فِيهِمْ فَذَكَرَ لَهُمْ أَنَّ الْجِهَادَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَالْإِيمَانَ بِاللَّهِ أَفْضَلُ الْأَعْمَالِ فَقَامَ رَجُلٌ فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ أَرَأَيْتَ إِنْ قُتِلْتُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ يُكَفَّرُ عَنَى خَطَايَايَ؟ فَقَالَ لَهُ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «نِعْمَ إِنْ قُتِلْتَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَأَنْتَ صَابِرٌ مُحْتَسِبٌ مُقْبِلٌّ غَيْرُ مُدْبِرٍ» . ثُمَّ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «كَيْفَ قُلْتَ؟» فَقَالَ: أَرَأَيْتَ إِنْ قُتِلْتُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَيُكَفَّرُ عَنِّي خَطَايَايَ؟ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «نَعَمْ وَأَنْتَ صَابِرٌ مُحْتَسِبٌ مُقْبِلٌ غَيْرُ مُدْبِرٍ إِلَّا الدَّيْنَ فَإِنَّ جِبْرِيلَ قَالَ لِي ذَلِكَ» . رَوَاهُ مُسْلِمٌ
ব্যাখ্যা: আলোচ্য হাদীসেও আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের মর্যাদা আলোচনা করা হয়েছে। এখানে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়ন করাকে সর্বোকৃষ্ট ‘আমল হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
আলোচ্য হাদীসে বর্ণিত উক্তি, (مُقْبِلٌ غَيْرُ مُدْبِرٍ) বলতে বুঝানো হয়েছে ঐ ব্যক্তিকে যে সদা সর্বদা জিহাদের জন্য অগ্রগামী ছিল এবং কখনই পিছু হটেনি। আর যে একবার সামনে আগ্রসর হয় আর অন্যসময় পিছু হটে, তার ক্ষেত্রে এ মর্যাদা বা সাওয়াব প্রযোজ্য হবে না। আর ‘মুহতাসিব’ বলতে বুঝানো হয়েছে ঐ ব্যক্তিকে যে মুখলিস তথা আল্লাহর জন্য স্বীয় কর্মকে একনিষ্ঠ করে এবং তাতে আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে শরীক করে না। (শারহে মুসলিম ১৩শ খন্ড, হাঃ ১৮৮৫)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ
৩৮০৬-[২০] ’আব্দুল্লাহ ইবনু ’আমর ইবনুল ’আস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহর পথে শহীদ হলে শুধুমাত্র ঋণ ব্যতীত সকল কিছু ক্ষমা করে দেয়া হয়। (মুসলিম)[1]
اَلْفَصْلُ الْأَوَّلُ
وَعَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «الْقَتْلُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ يُكَفِّرُ كُلَّ شَيْءٍ إِلَّا الدّين» . رَوَاهُ مُسلم