পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - হাওযে কাওসার ও শাফাআতের বর্ণনা
কুরতুবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর দুটি হাওয থাকবে। একটি পুলসিরাতের পূর্বে অবস্থানের জায়গায়, অন্যটি থাকবে জান্নাতে। উভয় হাওযের নাম কাওসার। তাদের ভাষায় কাওসার অর্থ অধিক কল্যাণ। সঠিক কথা হলো হাওযের ব্যবস্থা হবে মীযানের পূর্বে। কারণ মানুষেরা কবর থেকে পিপাসার্ত হয়ে বের হবে। অতঃপর তারা নবীদের অবস্থানস্থলে হাওয থাকবে। আমি বলি, জামি’তে রয়েছে, হে নবী (সা.) আপনার জন্য হাওযে কাওসার রয়েছে। তারা গর্ব করে বলবে যে, কারা বেশি আগমন করেছে? আমি আশা করি যে, আমি তাদের মাঝে সর্বাধিক সংখ্যা নিয়ে আগমনকারী হব।
রাগিব (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, (الشَّفْعُ) বলা হয় কোন জিনিসকে অনুরূপ জিনিসের সাথে যুক্ত করা এখান থেকে (الشَّفَاعَةُ) নির্গত হয়েছে। আর তা বলা হয় অন্যকে সাহায্য করার জন্য তার সাথে যোগদান করা তার থেকে গোপন হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাধারণের তুলনায় বেশি মর্যাদাবান ব্যক্তির যুক্ত হওয়া তার চাইতে কম মর্যাদার লোকের সাথে শাফা’আত সংঘটিত হবে কিয়ামতে। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
৫৫৬৬-[১] আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: (মি’রাজের রাত্রে) জান্নাত ভ্রমণকালে অকস্মাৎ আমি একটি নহরের কাছে উপস্থিত হলাম, যার উভয় পার্শ্বে শূন্যগর্ভ মুক্তার গুম্বুজ সাজানো রয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে জিবরীল! এটা কী? তিনি বললেন, এটাই সেই কাওসার যা আপনার প্রভু আপনাকে দান করেছেন। তার মাটি মিশকের মতো সুগন্ধময়। (বুখারী)
الفصل الاول (بَاب الْحَوْض والشفاعة )
عَنْ أَنَسٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: بَيْنَا أَنَا أَسِيرُ فِي الجنَّةِ إِذا أَنا بنهر حافتاه الدُّرِّ الْمُجَوَّفِ قُلْتُ: مَا هَذَا يَا جِبْرِيلُ؟ قَالَ: الْكَوْثَرُ الَّذِي أَعْطَاكَ رَبُّكَ فَإِذَا طِينُهُ مِسْكٌ أذفر . رَوَاهُ البُخَارِيّ
رواہ البخاری (6581) ۔
(صَحِيح)
ব্যাখ্যা: রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর এই ভ্রমণ ছিল মি'রাজের রজনীতে যা সহীহুল বুখারীতে সূরাহ্ আল কাওসার-এর তাফসীরে বিদ্যমান রয়েছে। অবশ্য ইমাম দাউদী (রহিমাহুল্লাহ)-এর ধারণা এটা কিয়ামতে সংঘটিত হবে। তিনি বলেন, যদি এটা ঠিক হয় তবে বুঝা যাচ্ছে যে, নিশ্চয় হাওয এমন যাকে মানুষেরা জান্নাতে থাকা নদী ব্যতীত অন্য হাওযকে ছেড়ে আসবে। অথবা তারা জান্নাতের বাহিরে থেকে ভিতরে নহরকে দেখতে পাবে।
এ ব্যাখ্যা বিনা প্রয়োজনে অদ্ভুত কষ্টের নামান্তর। এটা বাদ দিয়ে বলা যায় যে, জান্নাতের বাহিরে থাকা হাওযটা বিস্তৃত হয়ে এসেছে জান্নাতের অভ্যন্তর থেকে। তাহলে এতে কোন জটিলতা থাকবে না।
শূন্যগর্ভ মোতির গম্বুজ পরিবেষ্টিত নহর দেখে রাসূলুল্লাহ (সা.) জিবরীল-কে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কি?
আল্লাহ তা'আলা রাসূলুল্লাহ (সা.)- কে যে হাওযে কাওসার দান করেছেন যা সূরায়ে কাওসারে উল্লেখ হয়েছে জিবরীল সেদিকে ইশারা করে বললেন, এটা সেই নহর। আল্লাহ তা'আলা বলেন, “নিশ্চয় আমি আপনাকে কাওসার দান করেছি....।” (সূরাহ আল কাওসার)
‘কাওসার’ হলো প্রভূত কল্যাণ, এ কল্যাণ রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর বিশেষ মর্যাদা। রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর প্রতি আল্লাহ তা'আলার বিশেষ মর্যাদা হলো আল কুরআন, নুবুওয়্যাত ও রিসালাত, উম্মতের আধিক্যতা এবং অন্যান্য উচ্চ মর্যাদাসমূহ। যেমন মাকামে মাহমূদ, প্রশংসার দীর্ঘ পতাকা এবং হাওয, এসবই কাওসার শব্দের অন্তর্ভুক্ত।
এখানে উল্লেখ আছে, (فَإِذَا طِينُهُ مِسْكٌ أذفر) তার মাটি মিশকের ন্যায় সুঘ্রাণযুক্ত। কোন কোন বর্ণনায় (طِيبه)-এর পরিবর্তে (طِيبه) 'তার সুগন্ধি মিশকের ন্যায় উল্লেখ রয়েছে। ইমাম বায়হাকী (রহিমাহুল্লাহ) 'আবদুল্লাহ ইবনু মুসলিম তিনি আনাস (রাঃ)-এর সূত্রে (طِينُه)-এর পরিবর্তে (تُرَابُهُ) 'তার ধুলা উল্লেখ করেছেন। (মিরকাতুল মাফাতীহ, ফাতহুল বারী ১১খণ্ড, ৫৩৩ পৃ., হা, ৬৫৮১)
(فَإِذَاطِيبُهُ) হুদবাহ সন্দেহে পড়েছেন সেটা (طِيب) হবে না (طِين) হবে? কিন্তু আবূল ওয়ালীদ সন্দেহাতীতভাবে বলেছেন যে, সেটা নূন সহকারে অর্থাৎ (طِين) হবে, এটাই নির্ভরযোগ্য। (ফাতহুল বারী হা. ৬৫৮১)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - হাওযে কাওসার ও শাফাআতের বর্ণনা
৫৫৬৭-[২] ’আবদুল্লাহ ইবনু ’আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: আমার হাওযের প্রশস্ততা এক মাসের পথের সমপরিমাণ এবং তার চতুর্দিকও সমপরিমাণ আর তার পানি দুধ অপেক্ষাও অধিক সাদা এবং তার ঘ্রাণ মৃগনাভি অপেক্ষাও অধিক সুগন্ধিময়, আর তার পানপাত্রসমূহ আকাশের তারকার মতো। যে তা থেকে একবার পান করবে সে আর কখনো তৃষ্ণার্ত হবে না। (বুখারী ও মুসলিম)
الفصل الاول (بَاب الْحَوْض والشفاعة )
وَعَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «حَوْضِي مَسِيرَةُ شَهْرٍ وَزَوَايَاهُ سَوَاءٌ مَاؤُهُ أَبْيَضُ مِنَ اللَّبَنِ وَرِيحُهُ أَطْيَبُ مِنَ الْمِسْكِ وَكِيزَانُهُ كَنُجُومِ السَّمَاءِ مَنْ يَشْرَبُ مِنْهَا فَلَا يظمأ أبدا» . مُتَّفق عَلَيْهِ
متفق علیہ ، رواہ البخاری (6579) و مسلم (27 / 2292)، (5971) ۔
(مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ)
ব্যাখ্যা: এখানে হাওযে কাওসারের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ বা তার পরিধির বিবরণ প্রদান করা হয়েছে, যা চতুর্ভুজ আকারে ধরলে প্রত্যেক পাড়ের দূরত্ব এক মাসের পথ। কেউ কেউ এর গভীরতাকেও সমপরিমাণ বলে মনে করেন। আরবীতে (سَوَاءٌ) শব্দ দ্বারা পরিমাপের সকল দিককেই অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
হাওযে কাওসারের পানি দুধের চেয়েও অধিক সাদা। ইমাম নবাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, أَبْيَضُ শব্দটি ইসমে তাফযীলের সাধারণ অর্থে না এসে (اشد أَبْيَض) এর অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, যা ‘ইলমে নাহু-এর একটি ব্যতিক্রম নিয়ম। তার পানি মৃগণাভী অপেক্ষা বেশি সুঘ্রাণযুক্ত বা খুশবুদার হবে যা মানুষের হৃদয়কে প্রশান্ত করে দিবে। তার কিনারায় রক্ষিত পানপাত্ৰসমূহ হবে আকাশের তারকার ন্যায় অসংখ্য এবং উজ্জ্বল। যে ব্যক্তি এ নহরের পানি পান করতে পারবে সে আর কখনো হাশরের পিপাসায় পিপাসিত হবে না। মূলত এটি জান্নাতের একটি পানীয় যা হাশরের ময়দানে নবী (সা.) নিজ হাতে কুরআন সুন্নাহর সঠিক অনুসারীদের পান করাবেন। বিদ্আতীরাও এ পানি পান করতে হাওযে কাওসারের দিক এগিয়ে যাবে, নবী (সা.) তাদের পান করানোর জন্য উদ্যত হবেন, এমন সময় তাদের এবং পানির মাঝে পর্দা পড়ে যাবে। মালায়িকাহ্ (ফেরেশতাগণ) নবী (সা.) -কে উক্ত পানি পান করাতে দিবেন না। পরের হাদীসে এর বিস্তারিত বিবরণ এসেছে। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ, ফাতহুল বারী ১১শ খণ্ড, ৫৩ পৃ., হা. ৬৫৭৯, শারহুন নাবাবী ১৫শ খণ্ড, হা. ২২৯২)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - হাওযে কাওসার ও শাফাআতের বর্ণনা
৫৫৬৮-[৩] আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: আমার হাওযের (উভয় পার্শ্বের) দূরত্ব আয়লাহ ও ’আদন-এর মধ্যবর্তী দূরত্ব থেকেও অধিক। তার পানি বরফের চেয়ে অধিক সাদা এবং দুধমিশ্রিত মধুর তুলনায় অনেক মিষ্ট। তার পানপাত্রসমূহ নক্ষত্রের সংখ্যা অপেক্ষা অধিক। আর আমি আমার হাওযের কাওসারে আগমন করা থেকে লোকেদেরকে (অন্যান্য উম্মতদেরকে) তেমনিভাবে বাধা দেব, যেমনিভাবে কোন লোক তার নিজের হাওয থেকে অন্যের উটকে পানি পানে বাধা দিয়ে থাকে। সাহাবীগণ প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! সেদিন কি আপনি আমাদেরকে চিনতে পারবেন? তিনি (সা.) বললেন, হ্যাঁ, সেদিন তোমাদের বিশেষ চিহ্ন থাকবে যা অন্যান্য উম্মাতের কারো জন্য হবে না। তোমরা আমার কাছে এমন অবস্থায় আসবে যে, তোমাদের মুখমগুল এবং হাত-পা উযূর কারণে উজ্জ্বল থাকবে। (মুসলিম)
الفصل الاول (بَاب الْحَوْض والشفاعة )
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «إِنَّ حَوْضِي أَبْعَدُ مِنْ أَيْلَةَ مِنْ عَدَنٍ لَهُوَ أَشَدُّ بَيَاضًا مِنَ الثَّلْجِ وَأَحْلَى مِنَ الْعَسَلِ بِاللَّبَنِ وَلَآنِيَتُهُ أَكْثَرُ مِنْ عَدَدِ النُّجُومِ وَإِنِّي لَأَصُدُّ النَّاسَ عَنْهُ كَمَا يَصُدُّ الرَّجُلُ إِبِلَ النَّاسِ عَنْ حَوْضِهِ» . قَالُوا: يَا رَسُولَ اللَّهِ أَتَعْرِفُنَا يَوْمَئِذٍ؟ قَالَ: «نَعَمْ لَكُمْ سِيمَاءُ لَيْسَتْ لِأَحَدٍ مِنَ الْأُمَم تردون عليّ غرّاً من أثر الْوضُوء» . رَوَاهُ مُسلم
رواہ مسلم (36 / 247)، (581) ۔
(صَحِيح)
ব্যাখ্যা: অত্র হাদীসের ব্যাখ্যার কিয়দংশ পূর্বের হাদীসের ব্যাখ্যায় অতিবাহিত হয়েছে, তার পূনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন। এখানে হাওযে কাওসারের দৈর্ঘ্য বা প্রস্থের দূরত্ব আয়লাহ্ হতে ‘আদন-এর দূরত্বের চেয়েও বেশি উল্লেখ করা হয়েছে। আয়লাহ্ হলো সিরিয়ার শেষ প্রান্তের একটি শহর যা ইয়ামান সাগরের নিকটে অবস্থিত। আর ‘আদন হলো ভারত মহাসাগরের সন্নিকটে ইয়ামানের প্রান্তসীমা। কোন কোন হাদীসে দূরত্বের সীমা বর্ণনা করতে গিয়ে আরো কয়েকটি স্থানের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, যেমন ‘আদন থেকে আম্মান, আয়লা থেকে সন্'আ ইত্যাদি। এসবগুলো স্থানের দূরত্ব মোটামুটি একই আর তা হলো প্রায় একমাসের পথ বা তার চেয়ে একটু বেশি।
অতএব বর্ণনার ভিন্নতা দোষণীয় কিছু নয়। শ্রোতা সাধারণের অবস্থার আলোকে তাদের পরিচিত স্থানের ধারণা দিয়ে দূরত্ব বুঝানোই উদ্দেশ্য। কাযী ইয়ায (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, এটা তো নিছক দৃষ্টান্ত মাত্র।
রাসূলুল্লাহ (সা.) ও কতিপয় মানুষকে এখানে অর্থাৎ হাওযের পাড়ে আসতে বাধা দিবেন এবং তাদের তাড়িয়ে দিবেন। এরা হলো মুনাফিক, মুরতাদ। সামনের হাদীস থেকে বুঝা যায়, তারা বিদ'আতী। রাখাল যেমন অন্যের উটকে নিজের ঘাস-পানির হাওয বা বাসনে অংশগ্রহণের ভয়ে তাড়িয়ে দিয়ে থাকে। রাসূলুল্লাহ (সা.) ও ঠিক তেমনিভাবে তাদের তাড়িয়ে দিবেন। কতিপয় সাহাবী জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল ! সেদিন কি আপনি আমাদের চিনতে পারবেন? এর অর্থ হলো সেদিন কি আপনি আমাদেরকে ঐ সকল মুনাফিক, মুরতাদ, বিদ্আতীদের মধ্য থেকে চিনে আলাদা করতে পারবেন এবং আপনার ঐ হাওযে কাওসারের পানি পান করাবেন? উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, হ্যাঁ। তিনি (সা.) আরো বললেন, সেদিন তোমাদের বিশেষ চিহ্ন বা নিদর্শন থাকবে, যেমন আল্লাহ তা'আলা বলেন,
(سِیۡمَاهُمۡ فِیۡ وُجُوۡهِهِمۡ مِّنۡ اَثَرِ السُّجُوۡدِ) “চিহ্নসমূহ তাদের মুখমণ্ডলের উপর সিজদার কারণে পরিস্ফুট হয়ে আছে...।” (সূরা আল ফাতহ ৪৮: ২৯)
যে চিহ্ন অন্য কোন উম্মতের মধ্যেই আর নেই। এছাড়াও তোমরা আমার নিকট দিয়ে এমন অবস্থায় অতিক্রম করবে যে, তোমাদের মুখমণ্ডল ও হাত-পা গুলো উযুর কারণে উজ্জ্বল হয়ে চমকাতে থাকবে। যা দেখে আমি তোমাদের অন্যদের থেকে বাছাই করে নিব।
অন্যান্য নবীদের শারী'আতেও উযূর বিধান ছিল এবং তাদের উম্মতগণ হয়তো বা উযূ করেছেন কিন্তু কোন নবীর উম্মতের মধ্যেই ঐ উজ্জ্বলতা প্রকাশ পাবে না, তবে নবীগণের মর্যাদা অনেক উর্ধ্বে, অতএব তাদের কথা স্বতন্ত্র। (মিরকাতুল মাফাতীহ, শারহুন নাবাবী ৩য় খণ্ড, ১১৭ পৃ., হা, ২৪৭)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - হাওযে কাওসার ও শাফাআতের বর্ণনা
৫৫৬৯-[৪] অপর এক বর্ণনায় আছে, আনাস (রাঃ) বলেন, উক্ত হাওযে সোনা ও রূপার এত অধিক পানপাত্র থাকবে, যার সংখ্যা হবে আকাশের তারকারাজির মতো (অগণিত)।
الفصل الاول (بَاب الْحَوْض والشفاعة )
وَفِي رِوَايَةٍ لَهُ عَنْ أَنَسٍ قَالَ: «تَرَى فِيهِ أَبَارِيقَ الذَّهَبِ وَالْفِضَّةِ كَعَدَدِ نُجُومِ السَّمَاءِ»
رواہ مسلم (43 / 2303)، (6000) ۔
(صَحِيح)
ব্যাখ্যা: আনাস (রাঃ)-এর সূত্রে সহীহ মুসলিমের অন্য বর্ণনায় হাওযের কিনারায় রক্ষিত পানপাত্রগুলোর বিবরণ এসেছে এই যে, সেগুলো স্বর্ণ ও রৌপ্যের তৈরি আর সংখ্যা হলো আকাশের নক্ষত্র সমপরিমাণ। আল্লামাহ্ মুল্লা আলী ক্বারী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, একাধিক গুণের ও মূল্যমানের পানপাত্র পানকারী আওলিয়া, স্বালিহীন ইত্যাদির মর্যাদার তারতম্যের কারণেই ভিন্ন ভিন্ন হবে। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - হাওযে কাওসার ও শাফাআতের বর্ণনা
৫৫৭০-[৫] অন্য এক বর্ণনায় আছে, সাওবান (রাঃ) বলেন, [রাসূলুল্লাহ (সা.) -কে জিজ্ঞেস করা হলো] তার পানীয় কেমন হবে? তিনি (সা.) বললেন, দুধের চেয়ে অধিক সাদা এবং মধু অপেক্ষা অধিক সুমিষ্ট। তাতে জান্নাত হতে আগত দুটি জলধারা প্রবাহিত হতে থাকবে। এটার একটি সোনার অপরটি চাঁদির।
الفصل الاول (بَاب الْحَوْض والشفاعة )
وَفِي أُخْرَى لَهُ عَنْ ثَوْبَانَ قَالَ: سُئِلَ عَنْ شَرَابِهِ. فَقَالَ: أَشَدُّ بَيَاضًا مِنَ اللَّبَنِ وَأَحْلَى مِنَ الْعَسَلِ يَغُتُّ فِيهِ مِيزَابَانِ يَمُدَّانِهِ مِنَ الْجَنَّةِ: أَحَدُهُمَا مِنْ ذَهَبٍ وَالْآخَرُ مِنْ ورق
رواہ مسلم (37 / 2301)، (5990) ۔
(صَحِيح)
ব্যাখ্যা: সহীহ মুসলিমে সাওবান (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) -কে ঐ হাওযের পানির গুণাবলি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলো, উত্তরে তিনি (সা.) বললেন, সেটা দুধের চেয়েও অধিক সাদা এবং মধুর চেয়ে অধিক মিষ্ট। এ পানি জান্নাতের মূল হাওয থেকে দুটি স্বর্ণ ও রৌপ্যের জলপ্রবাহ দিয়ে এসে হাওযে স্বজোরে পতিত হচ্ছে। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)।
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - হাওযে কাওসার ও শাফাআতের বর্ণনা
৫৫৭১-[৬] সাহল ইবনু সা’দ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: আমি তোমাদের পূর্বেই হাওযে কাওসারের কাছে পৌছব। যে ব্যক্তি আমার কাছে পৌছবে, সে তার পানি পান করবে। আর যে একবার পান করবে, সে আর কখনো পিপাসার্ত হবে না। আমার কাছে এমন কিছু লোক আসবে যাদেরকে আমি চিনতে পারব এবং তারাও আমাকে চিনতে পারবে। অতঃপর আমার ও তাদের মাঝে আড়াল করে দেয়া হবে। তখন আমি বলব, তারা তো আমার উম্মত। তখন আমাকে বলা হবে, আপনি জানেন না, আপনার অবর্তমানে তারা যে কি সকল নতুন নতুন মত পথ তৈরি করেছে। তা শুনে আমি বলব, যারা আমার অবর্তমানে আমার দীনকে পরিবর্তন করেছে, তারা দূর হোক (অর্থাৎ এ ধরনের লোক আমার শাফা’আত ও আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হবে। (বুখারী ও মুসলিম)
الفصل الاول (بَاب الْحَوْض والشفاعة )
وَعَنْ سَهْلِ بْنِ سَعْدٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنِّي فَرَطُكُمْ عَلَى الْحَوْضِ مَنْ مَرَّ عَلَيَّ شَرِبَ وَمَنْ شَرِبَ لَمْ يَظْمَأْ أَبَدًا لَيَرِدَنَّ عَلَيَّ أَقْوَامٌ أَعْرِفُهُمْ وَيَعْرِفُونَنِي ثُمَّ يُحَالُ بَيْنِي وَبَيْنَهُمْ فَأَقُولُ: إِنَّهُمْ مِنِّي. فَيُقَالُ: إِنَّكَ لَا تَدْرِي مَا أَحْدَثُوا بَعْدَكَ؟ فَأَقُولُ: سُحْقًا سحقاً لمن غير بعدِي . مُتَّفق عَلَيْهِ
متفق علیہ ، رواہ البخاری (6583 ۔ 6584) و مسلم (26 / 2290)، (5968) ۔
(مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ)
ব্যাখ্যা: হাওযে কাওসার জান্নাতের একটি নহর; আল্লাহ তা'আলা তা মুহাম্মাদ (সা.)-কে দান করেছেন। কিয়ামতের দিন পিপাসিত উম্মতকে তিনি তা থেকে পান করাবেন। এজন্য রাসূলুল্লাহ (সা.) সর্বাগ্রে হাওযের নিকট উপনীত হবেন। কাযী ‘ইয়ায (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, হাদীসে বাহ্যিক অর্থ প্রমাণ করে এই পানি পান হাশরের হিসাবের পর এবং জাহান্নাম থেকে অব্যাহতির পর।” তবে এটা সত্য যে, তা জান্নাতে প্রবেশের পূর্বেই হবে, কারণ জান্নাতে প্রবেশের পর তার আর কোন পিপাসা থাকবে না। কাযী ‘ইয়ায় (রহিমাহুল্লাহ)-এর বক্তব্যে প্রশ্ন জাগে হিসাবের পর যারা জাহান্নাম থেকে অব্যাহতি পাবে তারা তো প্রকৃতপক্ষে সফলতাই অর্জন করেছে, এমন লোকেদের হাওযে কাওসারের পানির ঘাট থেকে দূরে তাড়িয়ে দেয়া কি বিস্ময়কর নয়?
দীনের মধ্যে যারা ইহদাস করেছে অথাৎ নতুন বিষয়ের উদ্ভব ঘটিয়েছে, বিদ্আত করেছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদের পানির ঘাটে পৌছতে দিবেন না বরং তাড়িয়ে দিবেন। সুহকান শব্দটি শাস্তির দু'আ অর্থ রহমত থেকে দূরে থাক। (মিরকাতুল মাফাতীহ, ফাতহুল বারী ১৩খণ্ড, ০৫ পৃ., হা. ৭০৪৯; ইবনু মাজাহ হা, ৪৩০৪)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - হাওযে কাওসার ও শাফাআতের বর্ণনা
৫৫৭২-[৭] আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী (সা.) বলেছেন: কিয়ামতের দিন ঈমানদারদেরকে (হাশরের ময়দানে) আটক করে রাখা হবে। এমনকি তাতে তারা ভীষণ চিন্তাযুক্ত ও অস্থির হয়ে বলবে, যদি আমরা আমাদের প্রভুর কাছে কারো দ্বারা সুপারিশ করাই তাহলে হয়তো আমাদের বর্তমান অবস্থা থেকে মুক্তি লাভ করে আরাম পেতে পারি। তাই তারা আদম আলায়হিস সালাম-এর কাছে গিয়ে বলবে, আপনি সমস্ত মানবমণ্ডলীর পিতা। আল্লাহ স্বীয় হাতে আপনাকে সৃষ্টি করেছেন ও জান্নাতে বসবাস করতে দিয়েছিলেন, মালায়িকার (ফেরেশতাদের) দিয়ে সিজদাহ্ করিয়েছিলেন এবং সমস্ত জিনিসের নাম আপনাকে শিখিয়েছিলেন, আপনি আমাদের জন্য আপনার প্রভুর কাছে সুপারিশ করুন, যাতে তিনি আমাদেরকে এ কষ্টদায়ক স্থান হতে মুক্ত করে প্রশান্তি দান করেন। তখন আদম আলায়হিস সালাম বলবেন, আমি তোমাদের এ কাজের যোগ্য নই। নবী (সা.) বলেন, তখন তিনি গাছ থেকে (ফল) খাওয়ার গুনাহের কথা যা থেকে তাঁকে বারণ করা হয়েছিল, স্মরণ করবেন। (তিনি বলবেন,) বরং তোমরা পৃথিবীবাসীর জন্য প্রেরিত আল্লাহ তা’আলা সর্বপ্রথম নবী নূহ আলায়হিস সালাম-এর কাছে যাও।
অতএব তারা সকলে নূহ আলায়হিস সালাম-এর কাছে গেলে তিনি তাদেরকে বলবেন, আমি তোমাদের এ কাজের উপযুক্ত নই এবং সাথে সাথে তিনি তার ঐ গুনাহের কথা স্মরণ করবেন, অজ্ঞতাবশত নিজের ছেলেকে পানিতে না ডুবানোর জন্য স্বীয় প্রভুর কাছে যে প্রার্থনা করেছিলেন। তখন তিনি বলবেন, বরং তোমরা আল্লাহর খলীল ইবরাহীম আলায়হিস সালাম-এর কাছে যাও।
তিনি (সা.) বলেন, এবার তারা ইবরাহীম আলায়হিস সালাম-এর কাছে আসবে তখন তিনি বলবেন, আমি তোমাদের এ কাজের উপযুক্ত নই এবং তিনি তাঁর তিনটি মিথ্যা উক্তির কথা স্মরণ করে বলবেন, বরং তোমরা মূসা আলায়হিস সালাম-এর কাছে যাও। তিনি আল্লাহ তা’আলার এমন এক বান্দা যাকে আল্লাহ তাওরাত কিতাব দিয়েছেন। তার সাথে কথা বলেছেন এবং তাঁকে নৈকট্য দান করে হিকমার অধিকারী বানিয়েছেন। নবী (সা) বলেন, তখন সকলে মূসা (আঃ) -এর কাছে আসলে তিনি বলবেন, আমি তোমাদের এ কাজের উপযুক্ত নই। তিনি তখন সেই প্রাণনাশের গুনাহের স্মরণ করবেন, যা তার হাতে ঘটেছিল, বরং তোমরা আল্লাহর বান্দা ও রাসূল এবং তার কালিমাহ ও রূহ ’ঈসা আলায়হিস সালাম-এর কাছে যাও।
তিনি (সা.) বলেন, তখন তারা সকলে ’ঈসা আলায়হিস সালাম-এর কাছে আসবে। তিনি বলবেন, আমি তোমাদের এ কাজের উপযুক্ত নই। তোমরা বরং মুহাম্মাদ (সা.) -এর কাছে যাও। তিনি আল্লাহর এমন এক বান্দা, যাকে আল্লাহ তা’আলা তার আগের ও পরের সকল গুনাহ মাফ করে দিয়েছেন। তিনি (সা.) বলেন, তারা আমার কাছে আসবে, তখন আমি আমার রবের কাছে তাঁর নিকট উপস্থিত হওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করব, আমাকে তাঁর কাছে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হবে। আমি যখন তাকে দেখব, তখনই তাঁর উদ্দেশ্যে সিজদায় পড়ে যাব, আল্লাহ তা’আলা যতক্ষণ আমাকে চাবেন এ অবস্থায় রাখবেন। তারপর বলবেন, হে মুহাম্মাদ! মাথা উঠাও। আর বল, তোমার কথা শুনা হবে। তুমি সুপারিশ কর, তা গ্রহণ করা হবে। আর প্রার্থনা কর, যা চাবে দেয়া হবে।
তিনি (সা.) বলেন, তখন আমি মাথা উঠাব এবং আমার প্রভুর এমনভাবে প্রশংসা-স্তুতি বর্ণনা করব, যা তিনি সেই সময় আমাকে শিখিয়ে দেবেন। অতঃপর আমি শাফা’আত করব, কিন্তু এ ব্যাপারে আমার জন্য একটি সীমা নির্দিষ্ট করে দেয়া হবে। আমি তখন আল্লাহর কাছ থেকে উঠে আসব এবং ঐ নির্দিষ্ট সীমার লোকদেরকে জাহান্নামে থেকে বের করে জান্নাতে প্রবেশ করাব। তারপর আমি পুনরায় ফিরে এসে আমার রবের দরবারে তাঁর কাছে হাজির হওয়ার অনুমতি চাব, আমাকে অনুমতি দেয়া হবে। যখন আমি তাকে দেখব, তখনই তার উদ্দেশে সিজদায় পড়ে যাব এবং আল্লাহ তা’আলা যতক্ষণ চাইবেন আমাকে এ অবস্থায় থাকতে দেবেন।
তারপর বলবেন, হে মুহাম্মাদ! মাথা উঠাও। আর বল, তোমার কথা শুনা হবে। সুপারিশ কর, গ্রহণ করা হবে। আর তুমি প্রার্থনা কর, যাই চাবে, তা দেয়া হবে। তখন আমি মাথা উঠাব এবং আমার প্রভুর এমন প্রশংসা ও স্তুতি বর্ণনা করব, যা আমাকে তখন শিখিয়ে দেয়া হবে। এরপর আমি শাফা’আত করব, কিন্তু আমার জন্য এ ক্ষেত্রে একটি সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হবে। তখন আমি আমার প্রভুর নিকট থেকে বের হয়ে আসব এবং ঐ নির্দিষ্ট লোকগুলোকে জাহান্নাম হতে বের করে জান্নাতে প্রবেশ করাব।
তারপর তৃতীয়বার ফিরে এসে আমার প্রভুর কাছে উপস্থিত হওয়ার অনুমতি চাব। আমাকে তার কাছে উপস্থিত হওয়ার অনুমতি দেয়া হবে। যখন আমি তাকে (রবকে) দেখব, তখনই সিজদায় পড়ে যাব। আল্লাহর যতক্ষণ ইচ্ছা আমাকে এ অবস্থায় রেখে দেবেন। তারপর বলবেন, হে মুহাম্মাদ! মাথা উঠাও। বল, যা বলবে তা শুনা হবে। শাফা’আত কর, তোমার শাফা’আত গ্রহণ করা হবে। আর প্রার্থনা কর, যা প্রার্থনা করবে তা দেয়া হবে। তিনি (সা.) বলেন, তখন আমি মাথা তুলব এবং আমার প্রভুর এমন প্রশংসা-গুণকীর্তন করব, যা তিনি আমাকে সে সময় শিখিয়ে দেবেন। তিনি (সা.) বলেন, তারপর আমি শাফা’আত করব। এ ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলা আমার জন্য একটা সীমা নির্দিষ্ট করে দেবেন। তখন আমি সেই সান্নিধ্য থেকে বাইরে আসব এবং তথায় যেয়ে তাদেরকে জাহান্নাম থেকে বের করে জান্নাতে প্রবেশ করাব। অবশেষে কুরআন যাদেরকে আটকে রাখবে অর্থাৎ যাদের জন্য কুরআনের ঘোষণা অনুযায়ী চিরস্থায়ী জাহান্নামবাসী নির্ধারিত হয়ে গেছে তারা ছাড়া আর কেউই জাহান্নামে থাকবে না।
বর্ণনাকারী আনাস (রাঃ) বলেন, অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা.) এর কুরআনের এ আয়াত (عَسٰۤی اَنۡ یَّبۡعَثَکَ رَبُّکَ مَقَامًا مَّحۡمُوۡدًا) “আপনার প্রভু শীঘ্রই আপনাকে ’মাকামে মাহমূদে পৌছিয়ে দেবেন”- (সূরাহ্ বানী ইসরাঈল ১৭: ৭৯); তিলাওয়াত করে বললেন, এটাই সেই ’মাকামে মাহমূদ তোমাদের নবীকে যার অঙ্গীকার দেয়া হয়েছে। (বুখারী ও মুসলিম)
الفصل الاول (بَاب الْحَوْض والشفاعة )
وَعَنْ أَنَسٍ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: يُحْبَسُ الْمُؤْمِنُونَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ حَتَّى يُهَمُّوا بِذَلِكَ فَيَقُولُونَ: لَوِ اسْتَشْفَعْنَا إِلَى رَبِّنَا فَيُرِيحَنَا مِنْ مَكَانِنَا فَيَأْتُونَ آدَمَ فَيَقُولُونَ: أَنْتَ آدَمُ أَبُو النَّاسِ خَلَقَكَ اللَّهُ بِيَدِهِ وَأَسْكَنَكَ جَنَّتَهُ وَأَسْجَدَ لَكَ مَلَائِكَتَهُ وَعَلَّمَكَ أَسْمَاءَ كُلِّ شَيْءٍ اشْفَعْ لَنَا عِنْدَ رَبِّكَ حَتَّى يُرِيحَنَا مِنْ مَكَانِنَا هَذَا. فَيَقُولُ: لَسْتُ هُنَاكُمْ. وَيَذْكُرُ خَطِيئَتَهُ الَّتِي أَصَابَ: أَكْلَهُ مِنَ الشَّجَرَةِ وَقَدْ نُهِيَ عَنْهَا - وَلَكِنِ ائْتُوا نُوحًا أَوَّلَ نَبِيٍّ بَعَثَهُ اللَّهُ إِلَى أَهْلِ الْأَرْضِ فَيَأْتُونَ نُوحًا فَيَقُولُ: لَسْتُ هُنَاكُمْ - وَيَذْكُرُ خَطِيئَتَهُ الَّتِي أَصَابَ: سُؤَالَهُ رَبَّهُ بِغَيْرِ عِلْمٍ - وَلَكِنِ ائْتُوا إِبْرَاهِيمَ خَلِيلَ الرَّحْمَنِ. قَالَ: فَيَأْتُونَ إِبْرَاهِيمَ فَيَقُولُ: إِنِّي لَسْتُ هُنَاكُمْ - وَيَذْكُرُ ثَلَاثَ كِذْبَاتٍ كَذَبَهُنَّ - وَلَكِنِ ائْتُوا مُوسَى عَبْدًا آتَاهُ اللَّهُ التَّوْرَاةَ وَكَلَّمَهُ وَقَرَّبَهُ نَجِيًّا. قَالَ: فَيَأْتُونَ مُوسَى فَيَقُولُ: إِنِّي لَسْتُ هُنَاكُمْ - وَيَذْكُرُ خَطِيئَتَهُ الَّتِي أَصَابَ قَتْلَهُ النَّفْسَ - وَلَكِنِ ائْتُوا عِيسَى عَبْدَ اللَّهِ وَرَسُولَهُ وَرُوحَ اللَّهِ وَكَلِمَتَهُ قَالَ: فَيَأْتُونَ عِيسَى فَيَقُولُ: لَسْتُ هُنَاكُمْ وَلَكِنِ ائْتُوا مُحَمَّدًا عبدا غفر اللَّهُ لَهُ ماتقدم مِنْ ذَنْبِهِ وَمَا تَأَخَّرَ . قَالَ: فَيَأْتُونِي فَأَسْتَأْذِنُ عَلَى رَبِّي فِي دَارِهِ فَيُؤْذَنُ لِي عَلَيْهِ فَإِذَا رَأَيْتُهُ وَقَعْتُ سَاجِدًا فَيَدَعُنِي مَا شَاءَ اللَّهُ أَنْ يَدَعَنِي فَيَقُولُ: ارْفَعْ مُحَمَّدُ وَقُلْ تُسْمَعْ وَاشْفَعْ تُشَفَّعْ وَسَلْ تُعْطَهْ . قَالَ: فَأَرْفَعُ رَأْسِي فأثني على رَبِّي بثناء تحميد يُعَلِّمُنِيهِ ثُمَّ أَشْفَعُ فَيَحُدُّ لِي حَدًّا فَأَخْرُجُ فَأُخْرِجُهُمْ مِنَ النَّارِ وَأُدْخِلُهُمُ الْجَنَّةَ ثُمَّ أَعُودُ الثَّانِيَةَ فَأَسْتَأْذِنُ عَلَى رَبِّي فِي دَارِهِ. فَيُؤْذَنُ لِي عَلَيْهِ فَإِذَا رَأَيْتُهُ وَقَعْتُ سَاجِدًا. فَيَدَعُنِي مَا شَاءَ اللَّهُ أَنْ يَدَعَنِي ثُمَّ يَقُولُ: ارْفَعْ مُحَمَّدُ وَقُلْ تُسْمَعْ وَاشْفَعْ تُشَفَّعْ وَسَلْ تُعْطَهْ. قَالَ: فَأَرْفَعُ رَأْسِي فَأُثْنِي عَلَى رَبِّي بِثَنَاءٍ وَتَحْمِيدٍ يُعَلِّمُنِيهِ ثُمَّ أَشْفَعُ فَيَحُدُّ لِي حَدًّا فَأَخْرُجُ فَأُخْرِجُهُمْ مِنَ النَّارِ وَأُدْخِلُهُمُ الْجَنَّةَ ثُمَّ أَعُودُ الثَّالِثَةَ فَأَسْتَأْذِنُ عَلَى رَبِّي فِي دَاره فيؤذي لِي عَلَيْهِ فَإِذَا رَأَيْتُهُ وَقَعْتُ سَاجِدًا فَيَدَعُنِي مَا شَاءَ اللَّهُ أَنْ يَدَعَنِي ثُمَّ يَقُولُ: ارْفَعْ مُحَمَّدُ وَقُلْ تُسْمَعْ وَاشْفَعْ تُشَفَّعْ وَسَلْ تُعْطَهْ . قَالَ: «فَأَرْفَعُ رَأْسِي فَأُثْنِي عَلَى رَبِّي بثناءوتحميد يُعَلِّمُنِيهِ ثُمَّ أَشْفَعُ فَيَحُدُّ لِي حَدًّا فَأَخْرُجُ فَأُخْرِجُهُمْ مِنَ النَّارِ وَأُدْخِلُهُمُ الْجَنَّةَ حَتَّى مَا يَبْقَى فِي النَّارِ إِلَّا مَنْ قَدْ حَبَسَهُ الْقُرْآنُ» أَيْ وَجَبَ عَلَيْهِ الْخُلُودُ ثُمَّ تَلَا هَذِه الْآيَة (عَسى أَن يَبْعَثك الله مقَاما مَحْمُودًا) قَالَ: «وَهَذَا الْمقَام المحمود الَّذِي وعده نَبِيكُم» مُتَّفق عَلَيْهِ
متفق علیہ ، رواہ البخاری (6565) و مسلم (322 / 193)، (475) ۔
(مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ)
ব্যাখ্যা: আল্লাহ তা'আলা প্রত্যেক নবীকে দুনিয়াতে একটি করে দু'আ কবুলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সেই সুযোগে প্রত্যেকেই নিজ নিজ সুবিধা ও চাহিদা মোতাবেক তা পূরণ করে নিয়েছেন; আমাদের নবী মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন, আমি আমার সেই সুযোগটি কিয়ামতের জন্য রেখে দিয়েছি সেটি হলো তার উম্মতের জন্য “শাফাআত”। কিয়ামতের দিন তিনি তা ব্যবহার করবেন, আল্লাহ তা'আলা তার সেই শাফাআত কবুল করবেন।
কিয়ামতের দিন কোন নবীই আল্লাহর কাছে যাওয়া, তার সাথে কথা বলা এবং উম্মাহর জন্য শাফাআতের সাহস করবেন না। কেবলমাত্র আমাদের নবীই আল্লাহর সাথে কথা বলবেন এবং শাফাআত করবেন, আর তার শাফা'আত কবুলও করা হবে।
প্রথমেই লোকেরা আদি পিতা আদম-এর কাছে যাবে, কেননা আল্লাহর কাছে তার বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। লোকেরা সেই মর্যাদাগুলো উল্লেখ করে তাকে আল্লাহর সাথে কথা বলা এবং তাদের জন্য সুপারিশের অনুরোধ করবে, কিন্তু তিনি আল্লাহ তা'আলার একটি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার কারণে এত ভীত এবং লজ্জিত হবেন যে, আল্লাহর কাছে যেতেই সাহস করবেন না। তিনি তার পরবর্তী নবীর নাম নিয়ে বলবেন, তোমরা তার নিকটে যাও। লোকেরা পর্যায়ক্রমে হাদীসে বর্ণিত নবীগণের নিকট যাবে কিন্তু প্রত্যেক নবীই ওযর পেশ করবেন, অতঃপর আমাদের নবীর নিকট বলার সাথে সাথে তিনি সম্মত হবেন এবং শাফা'আতের নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত আল্লাহর সমীপে সিজদায় পড়ে থাকবেন। এই সিজদায় পড়ে থাকার সময় হবে দীর্ঘ। হাদীসের ভাষায় রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন: (فَإِذَا رَأَيْتُهُ وَقَعْتُ سَاجِدًا فَيَدَعُنِي مَا شَاءَ اللَّهُ أَنْ يَدَعَنِي) “আমি যখন আল্লাহ তা'আলাকে দেখব তখন সিজদায় পড়ে যাব, তিনি আমাকে (এই সিজদার মধ্যে) যতক্ষণ ইচ্ছা ফেলে রাখবেন।"
এই দীর্ঘ সময় আল্লাহ তা'আলা তার সাথে কথাও বলবেন না এবং সিজদাহ্ থেকে মাথাও উঠাতে বলবেন না। সে দীর্ঘ সময় যে কত দীর্ঘ হবে তার কোন ইয়ত্তা নেই।
এরপর আল্লাহ তা'আলা তাকে মাথা উঠাতে বলবেন এবং তার চাওয়া পূরণের ও শাফা'আত গ্রহণের ওয়াদা দিবেন। সে মতে নবী (সা.) শাফা'আত করবেন এবং আল্লাহ তা'আলার দেয়া নির্দিষ্ট সংখ্যক জাহান্নামীকে জাহান্নাম থেকে উঠিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। এভাবে তিনি তিনবার আল্লাহর নিকট গিয়ে সিজদায পড়বেন এবং পূর্বের ন্যায় আল্লাহ তা'আলার অনুমতিসাপেক্ষে শাফা'আত করবেন। এ শাফা'আতে কেউ আর জাহান্নামে অবশিষ্ট থাকবে না কেবল কুরআন যাদের আটকিয়ে রেখেছে তারা ছাড়া অর্থাৎ যারা চিরস্থায়ী জাহান্নামী হিসেবে পূর্ব থেকে নির্ধারিত হয়ে গেছে। তারা ছাড়া জাহান্নামে আর কোন লোক বাকী থাকবে না, তারা হলো কাফির ও মুশরিক।
রাসুসুল্লাহ (সা.) -এর বাণী: “কিন্তু কুরআন কাদের আটকিয়ে রাখবে”-এর ব্যাখ্যা এটাও যে, আল কুরআন কিয়ামতের দিন আল্লাহর দরবারে বান্দার পক্ষে অথবা বিপক্ষে সাক্ষ্য দান করবে, সে সাক্ষ্যের ভিত্তিতে বান্দার জান্নাত ও জাহান্নাম নির্ভর করবে।
নবী (সা.) -এর শাফা'আতের এই একক মর্যাদাকেই আল্লাহ তা'আলার প্রতিশ্রুত মাকামে মাহমূদ নামে অভিহিত করা হয়। যেমন আল্লাহর বাণী, “সত্বর আপনার প্রতিপালক আপনাকে মাকামে মাহমূদ তথা প্রশংসিত স্থানে পৌছাবেন” (সূরা বানী ইসরাঈল ১৭:৭৯)
(মিরক্বাতুল মাফাতীহ, ফাতহুল বারী ১১খণ্ড, ৪৮৮ পৃ., হা. ৬৫৬৫, ইবনু মাজাহ ৩য় খণ্ড, ৫৪১ পৃ., হা. ৪৩১২) |
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - হাওযে কাওসার ও শাফাআতের বর্ণনা
৫৫৭৩-[৮] উক্ত রাবী [আনাস (রাঃ)] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ যখন কিয়ামত সংঘটিত হবে, তখন মানুষ একে অপরে সমবেত অবস্থায় উদ্বেলিত ও উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়বে। তাই তারা সকলে আদম ’আলায়হিস সালাম-এর কাছে গিয়ে বলবে, আমাদের জন্য আপনার প্রভুর কাছে শাফা’আত করুন। তিনি বলবেন, আমি এ কাজের উপযুক্ত নই, বরং তোমরা ইবরাহীম আলায়হিস সালাম-এর কাছে যাও। তিনি আল্লাহর খলীল। তাই তারা ইবরাহীম আলায়হিস সালাম-এর কাছে যাবে। তিনি বলবেন, আমি এ কাজের যোগ্য নই, বরং তোমরা মূসা আলায়হিস সালাম-এর কাছে যাও। কারণ তিনি কালীমুল্লাহ (যিনি আল্লাহর সাথে কথোপকথন করেছেন)। এবার তারা মুসা আলায়হিস সালাম-এর কাছে যাবে। তিনি বলবেন, আমি এ কাজের যোগ্য নই, বরং তোমরা ’ঈসা আলায়হিস সালাম-এর কাছে যাও। কারণ তিনি আল্লাহর আত্মা ও কালিমাহ্। তখন তারা ’ঈসা আলায়হিস সালাম-এর কাছে যাবে। তিনিও বলবেন, আমি এ কাজের যোগ্য নই। তোমরা বরং মুহাম্মাদ (সা.) -এর কাছে যাও।
তখন তারা সকলে আমার কাছে আসবে। তখন আমি বলব, আমিই এ কাজের জন্য। এবার আমি আমার প্রভুর কাছে অনুমতি প্রার্থনা করব। আমাকে অনুমতি দেয়া হবে। এ সময় আমাকে প্রশংসা ও স্তুতির এমন সব বাণী ইলহাম করা হবে, যা এখন আমার জানা নেই। আমি ঐ সকল প্রশংসা দিয়ে আল্লাহর প্রশংসা করব এবং তার উদ্দেশে সিজদায় পড়ে যাব। তখন বলা হবে, হে মুহাম্মাদ। মাথা উঠাও। বল, তোমার বক্তব্য শুনা হবে। প্রার্থনা কর, যা চাবে তা দেয়া হবে। আর শাফা’আত কর, গ্রহণ করা হবে। তখন আমি বলব, হে প্রভু! আমার উম্মত, আমার উম্মত। (অর্থাৎ আমার উম্মতের উপর রহম করুন, আমার উম্মতকে ক্ষমা করুন) বলা হবে, যাও, যাদের হৃদয়ে যবের দানা পরিমাণ ঈমান আছে তাদেরকে জাহান্নাম থেকে বের করে আন। তখন আমি গিয়ে তাই করব। অতঃপর ফিরে আসব এবং ঐ প্রশংসা বাণী দিয়ে আল্লাহর প্রশংসা করব, তারপর সিজদায় পড়ে যাব। তখন বলা হবে, হে মুহাম্মাদ! মাথা উঠাও। বল, তোমার বক্তব্য শুনা হবে। চাও, যা চাবে তা দেয়া হবে। আর শাফা’আত কর গ্রহণ করা হবে। তখন আমি বলব, হে আমার প্রভু! আমার উম্মত আমার উম্মত! (আমাকে) বলা হবে, যাও যাদের হৃদয়ে এক অণু বা সরিষা পরিমাণ ঈমান আছে, তাদেরকে জাহান্নাম থেকে বের করে আন। অতএব আমি গিয়ে তাই করব। তারপর আবার ফিরে আসব এবং উক্ত প্রশংসা বাণী দিয়ে আল্লাহর প্রশংসা করব এবং সিজদায় পড়ে যাব। তখন আমাকে বলা হবে, হে মুহাম্মাদ! মাথা উঠাও। বল, তোমার কথা শুনা হবে, যাও যাদের হৃদয়ে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরিমাণ ঈমান আছে, তাদের সকলকেই জাহান্নাম থেকে বের করে আন। তখন আমি গিয়ে তাই করব।
তিনি (সা.) বলেন, অতঃপর আমি চতুর্থবার ফিরে আসব এবং ঐ সকল প্রশংসা বাণী দিয়ে আল্লাহর প্রশংসা করব এবং সিজদায় পড়ে যাব। তখন বলা হবে, হে মুহাম্মাদ! মাথা উঠাও এবং বল, তোমার কথা শুনা হবে। চাও, যা চাইবে তা দেয়া হবে। সুপারিশ কর, তোমার শাফা’আত গ্রহণ করা হবে। আমি বলব, হে প্রভু! যারা শুধু লা- ইলা-হা ইল্লাল্ল-হ’ বলেছেন, আমাকে তাদের জন্যও শাফা’আত করার অনুমতি দিন। তখন আল্লাহ তা’আলা বলবেন, আমার ’ইযযত ও জালাল এবং আমার শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্বের শপথ করে বলছি, যারা লা- ইলা-হা ইল্লাল্ল-হ’ বলেছে, আমি নিজেই তাদেরকে জাহান্নাম থেকে বের করব। (বুখারী ও মুসলিম)
الفصل الاول (بَاب الْحَوْض والشفاعة )
وَعَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِذَا كَانَ يَوْمُ الْقِيَامَةِ مَاجَ النَّاسُ بَعْضُهُمْ فِي بَعْضٍ فَيَأْتُونَ آدم فَيَقُولُونَ: اشفع لنا إِلَى رَبِّكَ فَيَقُولُ: لَسْتُ لَهَا وَلَكِنْ عَلَيْكُمْ بِإِبْرَاهِيمَ فَإِنَّهُ خَلِيلُ الرَّحْمَنِ فَيَأْتُونَ إِبْرَاهِيمَ فَيَقُولُ لَسْتُ لَهَا وَلَكِنْ عَلَيْكُمْ بِمُوسَى فَإِنَّهُ كَلِيمُ الله فَيَأْتُونَ مُوسَى فَيَقُولُ لَسْتُ لَهَا وَلَكِنْ عَلَيْكُمْ بِعِيسَى فَإِنَّهُ رُوحُ اللَّهِ وَكَلِمَتُهُ فَيَأْتُونَ عِيسَى فَيَقُولُ لَسْتُ لَهَا وَلَكِنْ عَلَيْكُمْ بِمُحَمَّدٍ فَيَأْتُونِّي فَأَقُولُ أَنَا لَهَا فَأَسْتَأْذِنُ عَلَى رَبِّي فَيُؤْذَنُ لِي وَيُلْهِمُنِي مَحَامِدَ أَحْمَدُهُ بِهَا لَا تَحْضُرُنِي الْآنَ فَأَحْمَدُهُ بِتِلْكَ الْمَحَامِدِ وَأَخِرُّ لَهُ سَاجِدًا فَيُقَالُ يَا مُحَمَّدُ ارْفَعْ رَأْسَكَ وَقُلْ تُسْمَعْ وَسَلْ تُعْطَهْ وَاشْفَعْ تشفع فَأَقُول يارب أُمَّتِي أُمَّتِي فَيُقَالُ انْطَلِقْ فَأَخْرِجْ مَنْ كَانَ فِي قَلْبِهِ مِثْقَالَ شَعِيرَةٍ مِنْ إِيمَانٍ فَأَنْطَلِقُ فأفعل ثمَّ أَعُود فأحمده بِتِلْكَ المحامدوأخر لَهُ سَاجِدًا فَيُقَالُ يَا مُحَمَّدُ ارْفَعْ رَأْسَكَ وَقُلْ تُسْمَعْ وَسَلْ تُعْطَهْ وَاشْفَعْ تُشَفَّعْ فَأَقُولُ يارب أُمَّتِي أُمَّتِي فَيُقَالُ انْطَلِقْ فَأَخْرِجْ مَنْ كَانَ فِي قَلْبِهِ مِثْقَالُ ذَرَّةٍ أَوْ خَرْدَلَةٍ مِنْ إِيمَانٍ فَأَنْطَلِقُ فَأَفْعَلُ ثُمَّ أَعُودُ فَأَحْمَدُهُ بِتِلْكَ المحامدوأخر لَهُ سَاجِدًا فَيُقَالُ يَا مُحَمَّدُ ارْفَعْ رَأْسَكَ وَقُلْ تُسْمَعْ وَسَلْ تُعْطَهْ وَاشْفَعْ تُشَفَّعْ فَأَقُولُ يارب أُمَّتِي أُمَّتِي فَيُقَالُ انْطَلِقْ فَأَخْرِجْ مَنْ كَانَ فِي قَلْبِهِ أَدْنَى أَدْنَى أَدْنَى مِثْقَالِ حَبَّةِ من خَرْدَلَةٍ مِنْ إِيمَانٍ فَأَخْرِجْهُ مِنَ النَّارِ فَأَنْطَلِقُ فأفعل ثمَّ أَعُود الرَّابِعَة فأحمده بِتِلْكَ المحامدوأخر لَهُ سَاجِدًا فَيُقَالُ يَا مُحَمَّدُ ارْفَعْ رَأْسَكَ وَقُلْ تُسْمَعْ وَسَلْ تُعْطَهْ وَاشْفَعْ تُشَفَّعْ فَأَقُولُ يارب ائْذَنْ لِي فِيمَنْ قَالَ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ قَالَ لَيْسَ ذَلِكَ لَكَ وَلَكِنْ وَعِزَّتِي وَجَلَالِي وَكِبْرِيَائِي وَعَظَمَتِي لَأُخْرِجَنَّ مِنْهَا مَنْ قَالَ لَا إِلَه إِلَّا الله . مُتَّفق عَلَيْهِ
متفق علیہ ، رواہ البخاری (7510) و مسلم (326 / 193)، (475) ۔
(مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ)
ব্যাখ্যা: অত্র হাদীসের বিষয়বস্তু পূর্বের হাদীসের মতই। হাদীসের দীর্ঘ বর্ণনা ও স্পষ্টতা সর্বজনবিদিত, অতএব ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন।
কিয়ামতের দিন এমন ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হবে যে মানুষের দিক-বিদিক জ্ঞান থাকবে না। মানুষ দিশেহারা হয়ে এদিক-সেদিক ছুটাছুটি করতে থাকবে, অতঃপর কিছু মানুষ পরামর্শ করে আদি পিতা আদম এর কাছে আসবে এবং বলবে, আপনি আমাদের জন্য আল্লাহর কাছে একটু শাফা'আত বা সুপারিশ করুন, তিনি যেন দ্রুত হিসাবের নির্দেশ করেন যাতে আমরা একটু শান্তি পাই অথবা আমাদের প্রতিফল যাই হোক এটা পেয়ে যাই এবং হাশরের ময়দানের এই দুঃসহ যন্ত্রণা থেকে অব্যাহতি পাই। আদম 'আলায়হিস সালাম বলবেন, আমি এ কাজের উপযুক্ত নই বরং তোমরা ইবরাহীম-এর কাছে যাও তিনি আল্লাহর খলীল। লোকেরা ইবরাহীম-এর কাছে যাবে তিনিও একই কথা বলবেন। এভাবে বিভিন্ন নবীদের কাছে মানুষ যাবে কিন্তু কেউ শাফাআতের সাহস করবেন না। সকল নবী নিজ নিজ ভুলের কথা স্মরণ করে ভীত এবং লজ্জিত হয়ে আল্লাহর সামনে যেতে সাহস করবেন না।
অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, তারা সবাই বলবেন, আল্লাহ তা'আলা আজ এত রাগান্বিত হয়েছেন যা ইতোপূর্বে আর কখনো হননি এবং হবেন না। অতএব তার সামনে যেতে পারব না। অবশেষে লোকেরা যখন নবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর কাছে আসবে তিনি বলবেন, হ্যাঁ, আমিই এ কাজের জন্য উপযুক্ত। অতঃপর তিনি (সা.) আল্লাহর নিকট যাওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করবেন, ফলে তাকে অনুমতি দেয়া হবে। রাসূলুল্লাহ (সা.) এ আল্লাহর সমীপে গিয়ে এমন প্রশংসা করবেন, যে প্রশংসায় আল্লাহ তাআলা খুশি হয়ে যাবেন। অতঃপর সিজদায় পড়বেন আল্লাহ তা'আলা তাকে মাথা উঠাতে বলবেন আর বলবেন, তুমি বল তোমার কথা শুনা হবে। প্রার্থনা কর (যা চাইবে) দেয়া হবে, আর শাফা'আত কর কবূল করা হবে।
রাসূলুল্লাহ (সা.) তখন বলবেন, হে প্রভু! আমার উম্মত, আমার উম্মত। অর্থাৎ তাদের ক্ষমা কর তাদের প্রতি রহম কর। আল্লাহ বলবেন, যাও তোমার উম্মতের যাদের অন্তরে একটি যবের দানা পরিমাণ ঈমান রয়েছে তাদের জাহান্নাম থেকে বের কর। এভাবে তিনবার শাফা'আত করবেন এবং যার অন্তরে একটি সরিষা দানার ক্ষুদ্রতম অংশ পরিমাণ ঈমানও থাকবে তাকেও জাহান্নাম থেকে বের করবেন। চতুর্থবার আল্লাহর নবী (সা.) এই জীবনে একবার যারা লা- ইলাহা ইল্লাল্প-হ' পাঠ করেছে তাদের জন্য সুপারিশের অধিকার প্রার্থনা করবেন। আল্লাহ বলবেন, এ অধিকার আপনার নয় বরং আমার। আমার ‘ইয্যত, মহত্ব, বড়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের শপথ-যারা লা- ইলা-হা ইল্লাল্লহ পাঠ করেছে আমি নিজেই তাদের জাহান্নাম থেকে বের করব। অতঃপর আল্লাহ তা'আলা স্বয়ং নিজেই জাহান্নাম থেকে তাদের বের করবেন। কাযী ‘ইয়ায (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, এটা আল্লাহ তা'আলার মহত্ব ও নামের মহান মর্যাদার প্রতিশ্রুতি, এ মর্যাদা অন্য কারো থাকতে পারে না। আল্লামাহ্ ত্বীবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আমল ছাড়া শুধুমাত্র বিশ্বাসের ভিত্তিতে জাহান্নাম থেকে মুক্তির ব্যবস্থা আল্লাহ তা'আলার জন্য একান্ত, আর রাসূলুল্লাহ (সা.) ও-এর ক্ষেত্রে শাফা'আতের বিশেষত্বের বিষয়টি বিশ্বাসের সাথে খুব নগণ্য হলেও আমলের শর্তে বিভিন্ন স্তরের মুমিনের বেলায় প্রযোজ্য। অতএব উভয়ের আলাদা-আলাদা বিশেষত্ব সুস্পষ্ট। (মিরকাতুল মাফাতীহ, শারহুন নাবাবী ৩য় খণ্ড ৫১ পৃ., হা. ৩২২)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - হাওযে কাওসার ও শাফাআতের বর্ণনা
৫৫৭৪-[৯] আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) নবী (সা.) হতে বর্ণনা করেন। তিনি (সা.) বলেছেন: আমার শাফা’আত লাভের ব্যাপারে কিয়ামতের দিন সেই ব্যক্তিই সর্বাপেক্ষা সৌভাগ্যবান হবে, যে তার অন্তর বা মন থেকে একান্ত সচ্ছতা সহকারে ’লা- ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ’ বলেছে। (বুখারী)
الفصل الاول (بَاب الْحَوْض والشفاعة )
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: أَسْعَدُ النَّاسِ بِشَفَاعَتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ مَنْ قَالَ: لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ خَالِصا من قلبه أونفسه رَوَاهُ البُخَارِيّ
رواہ البخاری (99) ۔
(صَحِيح)
ব্যাখ্যা: কিয়ামতের দিন আল্লাহর নবীর শাফা'আত পাওয়ার মূল যোগ্যতা ও শর্ত হবে ঈমান, যার মূলমন্ত্র হলো ‘লা- ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ। ঈমান বাড়ে এবং কমে। অতএব এক যাররা পরিমাণ ঈমান থাকলেও সে সর্বশেষে শাফা'আতের আওতায় পড়বে। যে ব্যক্তি খালেস অন্তরে এই ‘লা- ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ’ পাঠ করবে যাতে কোন প্রকার লৌকিকতা, কপটতা, সন্দেহ এবং শির্ক থাকবে না; কিয়ামতের দিন প্রথম পর্যায়েই সে শাফা'আত পেয়ে ধন্য হবে।
মু'মিনেরা প্রত্যেকেই শাফা'আতের সৌভাগ্য লাভ করবে, কিন্তু হাদীসে বর্ণিত খালেস অন্তরের মু'মিনগণ শাফা'আতের অধিক মাত্রা পেয়ে ধন্য হবে। তারা হাশরের ময়দানের মহাভীতিকর পরিস্থিতিতে (আরশের ছায়াতলে অথবা বিশেষ রহমতের আশ্রয় পাওয়ার) সুপারিশপ্রাপ্ত হবে, যা অন্যেরা পাবে না।
কাযী ‘ইয়ায (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, (أَسْعَدُ) ‘অধিক সৌভাগ্যবান'-এর দ্বারা এখানে উদ্দেশ্য: (أَاَسَّعَيْدُ) ‘সৌভাগ্যবান অর্থাৎ এটা সাধারণ সৌভাগ্যবান অর্থে ব্যবহৃত হবে। যেহেতু আহলে তাওহীদ ছাড়া কেউ শাফা'আতের মর্যাদা লাভ করতে পারবে না। অথবা এর দ্বারা উদ্দেশ্য ঐ ব্যক্তি যার ‘আমলের দ্বারা রহমত প্রাপ্তির অধিকারী এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তির নিশ্চয়তা পাওয়া যায় না। সে আমার শাফা'আত পেয়ে ধন্য হবে।
আল্লামাহ্ ত্বীবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, ইতোপূর্বে অতিবাহিত হয়েছে যে, শাফা'আত লাভের সৌভাগ্য তথা ঈমানের ফলশ্রুতিতে এবং তার জন্য অধিক আশা রাখার কারণে হবে অথবা আমলের কারণে হবে।
আর ‘আমল এবং ইয়াক্বীনের মারাতিব বা স্তর বিভিন্ন রয়েছে। অতএব স্তর ভিত্তিতেই মর্যাদার কম বেশি হবে। এজন্য (خَالِصًا) শব্দের তাক্বীদ (قَلْبِهِ) দ্বারা করা হয়েছে। অর্থাৎ (خَالِصًاكَائِنًامِنْ قَلْبِهِ) অন্তরের অন্তঃস্থল থেকেই যদি লা- ইলা-হা ইল্লাল্ল-হ হয় তবে সে শাফাআতের সর্বোচ্চ সৌভাগ্য লাভ করবে।
(মিরক্বাতুল মাফাতীহ, ফাতহুল বারী ১ম খণ্ড হা. ৯৯, ২৩৫ পৃ.)।
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - হাওযে কাওসার ও শাফাআতের বর্ণনা
৫৫৭৫-[১০] উক্ত রাবী [আবূ হুরায়রাহ (রাঃ)] হতে বর্ণিত। একদিন নবী (সা.) -এর কাছে কিছু মাংস আনা হলো এবং তাঁর জন্য বাজুর (রান) মাংসটিই পেশ করা হলো। মূলত তিনি (সা.) এ মাংস (খেতে) খুব পছন্দ করতেন। কাজেই তিনি তা থেকে দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেলেন। তারপর বললেন, কিয়ামতের দিন আমি হব সকল মানুষের সরদার, যেদিন মানবমণ্ডলী রাব্বুল আলামীনের সামনে দণ্ডায়মান হবে এবং সূর্য থাকবে (মাথার) খুব কাছে। হতাশা ও দুশ্চিন্তায় মানুষ এমন এক করুণ অবস্থায় পৌছবে, যা সহ্য করার শক্তি তাদের থাকবে না। তখন তারা (পরস্পরে) বলাবলি করবে, তোমরা কি এমন কোন ব্যক্তিকে খোঁজ করে পাও না, যিনি তোমাদের প্রভুর কাছে তোমাদের জন্য সুপারিশ করবেন?
তখন তারা আদম ’আলায়হিস সালাম-এর কাছে আসবে। এরপর বর্ণনাকারী আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ)- এর শাফা’আত সম্পর্কীয় হাদীসটি (পূর্বে বর্ণিত হয়েছে) বর্ণনা করেন। তিনি (সা.) বলেন, তখন আমি ’আরশের নিচে যাব এবং আমার প্রভুর উদ্দেশ্যে সিজদায় লুটিয়ে পড়ব। তখন আল্লাহ তা’আলা তাঁর হামদ ও সানার এমন কিছু উত্তম বাক্য আমার হৃদয়ে ঢেলে দেবেন যা আমার পূর্বে কারো জন্য উন্মুক্ত করেননি।
অতঃপর আল্লাহ তা’আলা বলবেন, হে মুহাম্মাদ। আপনার মাথা উঠান। আপনি প্রার্থনা করুন, যা চাবেন তা দেয়া হবে। সুপারিশ করুন, আপনার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে। নবী (সা.) বলেন, তখন আমি মাথা উঠাব এবং বলব, হে আমার প্রভু! আমার উম্মত, হে আমার প্রভু! আমার উম্মত, হে আমার প্রভু! আমার উম্মত। তখন আমাকে বলা হবে, হে মুহাম্মাদ! আপনার উম্মতের যাদের কাছ থেকে কোন বিচার নেয়া হবে না তাদেরকে আপনি জান্নাতের দরজাসমূহের ডানদিকের দরজা দিয়ে প্রবেশ করিয়ে দিন এবং তারা সে সকল দরজা ছাড়াও অন্যান্য দরজা দিয়ে অপরাপর লোকেদের সাথে প্রবেশ করারও অধিকার রাখে। অতঃপর নবী (সা.) বলেন, সেই সত্তার শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ! জান্নাতের দরজাসমূহের উভয় পাটের দূরত্ব, যেমন মক্কাহ্ ও হিজ্বর নামক স্থানের মাঝের দূরত্ব পরিমাণ। (বুখারী ও মুসলিম)
الفصل الاول (بَاب الْحَوْض والشفاعة )
وَعَنْهُ قَالَ أَتَى النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِلَحْمٍ فَرُفِعَ إِلَيْهِ الذِّرَاعُ وَكَانَتْ تُعْجِبُهُ فَنَهَسَ مِنْهَا نَهْسَةً ثُمَّ قَالَ: «أَنَا سَيِّدُ النَّاسِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يَوْمَ يَقُومَ النَّاسُ لِرَبِّ الْعَالمين وتدنو الشَّمْس فَيبلغ مِنَ الْغَمِّ وَالْكَرْبِ مَا لَا يُطِيقُونَ فَيَقُولُ النَّاس أَلا تنْظرُون من يشفع لكم إِلَى ربكُم؟ فَيَأْتُونَ آدَمَ» . وَذَكَرَ حَدِيثَ الشَّفَاعَةِ وَقَالَ: «فَأَنْطَلِقُ فَآتِي تَحْتَ الْعَرْشِ فَأَقَعُ سَاجِدًا لِرَبِّي ثُمَّ يَفْتَحُ اللَّهُ عَلَيَّ مِنْ مَحَامِدِهِ وَحُسْنِ الثَّنَاءِ عَلَيْهِ شَيْئًا لَمْ يَفْتَحْهُ عَلَى أَحَدٍ قَبْلِي ثُمَّ قَالَ يَا مُحَمَّدُ ارْفَعْ رَأْسَكَ وَسَلْ تُعْطَهْ وَاشْفَعْ تُشَفَّعْ فَأَرْفَعُ رَأْسِي فَأَقُولُ أُمَّتِي يارب أمتِي يارب فَيُقَالُ يَا مُحَمَّدُ أَدْخِلْ مِنْ أُمَّتِكَ مَنْ لَا حِسَابَ عَلَيْهِمْ مِنَ الْبَابِ الْأَيْمَنِ مِنْ أَبْوَابِ الْجَنَّةِ وَهُمْ شُرَكَاءُ النَّاسِ فِيمَا سِوَى ذَلِكَ مِنَ الْأَبْوَابِ» . ثُمَّ قَالَ: «وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ إِنَّ مَا بَيْنَ الْمِصْرَاعَيْنِ مِنْ مَصَارِيعِ الْجَنَّةِ كَمَا بَيْنَ مَكَّةَ وَهَجَرَ» . مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ
متفق علیہ ، رواہ البخاری (4712) و مسلم (327 / 194)، (480) ۔
(مُتَّفق عَلَيْهِ)
ব্যাখ্যা: একদিন রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর নিকট কিছু ভুনা গোশত আনা হলো, রাসূলুল্লাহ (সা.) বকরীর সামনের রানের গোশত বেশি পছন্দ করতেন বলে তার সামনে বকরীর সামনের একখানা রান তুলে ধরা হলো।
(فَنَهَسَ مِنْهَا) তিনি (সা.) তা থেকে দাঁত দিয়ে কেটে কেটে বা টুকরা টুকরা করে খেতে লাগলেন। (نَهَس) শব্দটি (نَهَش) ও পড়া যায়। কাযী ইয়ায (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, অধিকাংশ বর্ণনায় নুকতাবিহিন শীন অক্ষর যোগে পঠিত হয়েছে, কিন্তু ইবনু হামান-এর বর্ণনায় নুকতাসহ ‘শীন’ যোগে পঠিত হয়েছে। এর অর্থ দাঁতের কিনারা দিয়ে ধরা বা মাড়ির দাঁতে কামড়ানো।
রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর বাণী: (أنَاسَيِّدُالنَّسِ) “আমি মানবজাতির সর্দার”-এর অর্থ আমি নবী এবং তাদের উম্মতসহ সকলের সর্দার। যেহেতু কিয়ামতের দিন সকলেই আমার শাফা'আতের মুখাপেক্ষী হবে।
এটা আল্লাহর নিকট আমার কারামতের কারণেই হবে। মানুষ যখন নিরুপায় হয়ে যাবে তখন আমার কাছে আসবে শাফাআতের জন্য, আর আমিই সর্বপ্রথম শাফা'আত করব। যেমন অন্য হাদীসে এসেছে, “আমি কিয়ামত দিবসে আদম সন্তানের সর্দার হব এতে আমার কোন গর্ব নেই। আর আমার হাতেই থাকবে প্রশংসার পতাকা তাতে আমার কোন গর্ব নেই। কোন নবীই আমার পতাকার নীচে আশ্রয় নেয়া ছাড়া থাকবে না।
আমি প্রথম ব্যক্তি যার জন্য সর্বপ্রথম জমিন বিদীর্ণ হবে, এতে আমার কোন গর্ব নেই। আমিই সর্বপ্রথম শাফা'আতকারী হব এবং প্রথম ব্যক্তি হব যার শাফা'আত কবুল করা হবে এতেও আমার কোন গর্ব নেই।” (আহমাদ হা, ৪৩০৮, তিরমিযী হা. ৩৬১৫)
‘আল্লামাহ্ ত্বীবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, (وْمَ يَقُومَ النَّاسُ لِرَبِّ الْعَالمين) বাক্যটি পূর্বে উল্লেখিত (يَوْمَ الْقِيَامَةِ) বাক্য থেকে বদল হয়েছে।
ইবনুল মালিক (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, সম্ভবত কোন প্রশ্নকারীর প্রশ্ন- কিয়ামত কি? এর উত্তরে বলা হয়েছে- “যেদিন সমস্ত মানুষ বিশ্ব প্রতিপালক (আল্লাহ)-এর সমীপে দণ্ডায়মান হবে। (يَوْمَ) শব্দটি উহ্য (اعْنِىْ) ক্রিয়া থেকে কর্ম হিসেবে (نَصَبْ) হয়েছে।
(وتدنو الشَّمْس....) “সূর্য মানুষের নিকটে পৌছে যাবে"-এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, মানুষ সূর্যের প্রচণ্ড তাপের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী দাঁড়ানোর ফলে অধৈর্য ও অস্থির হয়ে যাবে, উপরন্ত ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়বে। এহেন পরিস্থিতিতে মানুষের মধ্য থেকে একে অপরকে বলবে, চিন্তা কর অথবা খুঁজে দেখ তো আমাদের এই দুঃসহ অবস্থা থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশ করার মতো কোন লোক পাওয়া যায় কিনা? অতঃপর লোকেরা আদম আলায়হিস সালাম-এর নিকট আসবে। এরপর বর্ণনকারী আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) শাফা'আতের দীর্ঘ হাদীস বর্ণনা করেন যা ইতোপূর্বে অতিবাহিত হয়েছে। অর্থাৎ বিভিন্ন নবীদের কাছে যাওয়া এবং তাদের নিকট সুপারিশের আবেদন করা। অবশেষে লোকেরা মুহাম্মাদ (সা.) -এর নিকট যাবে, তিনি তাদের আবেদনে সাড়া দিয়ে আল্লাহর আরশের নীচে গিয়ে সিজদায় পড়ে যাবেন। এ সিজদায় আল্লাহ তা'আলা খুশি হবেন, ফলে তার অন্তরে এমন সব প্রশংসার বাণী ও ভাষা উদয় করে দিবেন যা কাউকে দেয়া হয়নি। আল্লাহর নবী সেই বাক্যগুলো দিয়ে যখন আল্লাহর প্রশংসা করবেন তখন আল্লাহ তা'আলা তার মাথা উঠাতে বলবেন এবং চাহিদা পূরণ করা ও শাফা'আত কবুল করার ওয়াদা করবেন। এ সময় তিনি (সা.) মাথা উঠিয়ে “ইয়া রব্বী উম্মতী’ ‘ইয়া রব্বী উম্মতী’ বলে তিনবার আল্লাহকে আহ্বান জানাবেন।
‘আল্লামাহ্ মুল্লা আলী ক্বারী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, তিনবার করে ‘ইয়া রব্বী উম্মতী' বলা তাগিদ হিসেবে অথবা মুবালাগাহ্ হিসেবে অথবা পাপীদের স্তরের প্রতি ইশারা করে বলবেন। এ আহ্বানের পরে আল্লাহ তা'আলা তাঁকে বলবেন, তোমার উম্মতের যাদের কোন হিসাব-নিকাশ নেই এবং তারা জান্নাতে সবগুলো দরজা দিয়ে প্রবেশের অধিকার রাখে এতদসত্ত্বেও তাদের ডানদিকের দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করাও, এটা তাদের জন্য খাস। এরা কখনো আল্লাহর সাথে শরীক করেনি অবৈধ ঝাড়-ফুক করেনি এবং কোন কিছুকে অশুভ লক্ষণ মনে করেনি। নবী জান্নাতের দরজার পরিধি বর্ণনা করেন যে, তার একপাট থেকে অন্যপাটের ব্যবধান মক্কাহ্ থেকে হিজর পর্যন্ত। হিজর হলো বাহরাইনের একটি প্রসিদ্ধ জনপদ। কেউ কেউ বলেছেন, এটা মদীনার একটি গ্রাম বা জনপদ। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ, শারহুন নাবাবী ৩য় খণ্ড, হা. ৩২৭, তুহফাতুল আহওয়াযী ৫ম খণ্ড ২৮৩ পৃ., হা. ১৮৩৭)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - হাওযে কাওসার ও শাফাআতের বর্ণনা
৫৫৭৬-[১১] হুযায়ফাহ্ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সা.) এ থেকে শাফা’আতের হাদীস বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন, তিনি (সা.) বলেছেন: আমানত ও আত্মীয়তাকে পাঠানো হবে, তখন উভয়টি পুলসিরাতের ডানে ও বামে উভয় পার্শ্বে দাঁড়াবে। (মুসলিম)
الفصل الاول (بَاب الْحَوْض والشفاعة )
وَعَنْ حُذَيْفَةَ فِي حَدِيثِ الشَّفَاعَةِ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «وَتُرْسَلُ الْأَمَانَةُ وَالرَّحِمُ فَتَقُومَانِ جَنَبَتَيِ الصِّرَاطِ يَمِينًا وَشِمَالًا» رَوَاهُ مُسلم
رواہ مسلم (329 / 195)، (482) ۔
(صَحِيح)
ব্যাখ্যা: আমানত এবং রেহেম বা আত্মীয়তার সম্পর্ক- এ দুটি বস্তুর রয়েছে মহান মর্যাদা। কিয়ামতের দিন এ দু'টিকে বিরাট মর্যাদা ও অধিকার দিয়ে পুলসিরাতের নিকট পাঠানো হবে, তারা পুলসিরাতের ডানপার্শ্বে ও বামপার্শে দাঁড়াবে এবং তাদের অধিকারের ব্যাপারে বান্দাকে ধরবে, কে আমানত রক্ষা করেছে, আর কে খিয়ানত করেছে, আর কে আত্মীয়তা সম্পর্ক বজায় রেখেছে, আর কে ছিন্ন করেছে। অতঃপর উভয়ে আমানত রক্ষাকীর পক্ষে এবং আত্মীয়তা রক্ষাকারীর পক্ষে বাদানুবাদ তথা যুক্তিতর্ক পেশ করবে, আর যে এগুলোর হক নষ্ট করবে তার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিবে। কেউ কেউ বলেছেন, তাদের জন্য মালাক (ফেরেশতা) প্রেরণ করা হবে যারা তাদের পক্ষে অথবা বিপক্ষে যুক্তি-তর্ক পেশ করবেন।
‘আল্লামাহ্ ত্বীবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, আমানত দ্বারা এখানে আমানতে উযমা বা মহা আমানতও উদ্দেশ্য হতে পারে, সেটা হলো আল কুরআন অথবা তার নির্দেশাবলী। যেমন আল্লাহর বাণী, “আমি এই আমানত পেশ করেছিলাম। আসমানসমূহ, জমিন এবং পর্বতমালার সম্মুখে, অনন্তর তারা ঐ আমানত গ্রহণ করতে অস্বীকার করল....।” (সূরা আল আহযাব ৩৩: ৭২)
আর সিলায়ে রেহমী বা আত্মীয়তার সম্পর্ক দ্বারা সবচেয়ে বড় সম্পর্ক রক্ষা উদ্দেশ্য আর তা হলো আল্লাহর এই বাণীর মধ্যে নিহিত, “হে মানবমণ্ডলী! তোমরা তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় কর, যিনি একটি মাত্র প্রাণ থেকে তোমাদের সৃষ্টি করেছেন.... আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যার নামে তোমরা পরস্পরের নিকট স্বীয় অধিকারের দাবী করে থাক এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক (বিনষ্ট করা) হতেও ভয় কর....।” (সূরা আন্ নিসা ৩: ১)।
অতএব হাদীসের অর্থ হলো আল্লাহর নির্দেশসমূহের তা'যীম করা এবং তার সৃষ্টিকে মুহাব্বাত করা। এটা যেন ইসলামের দুই পার্শ্বকে অন্তর্ভুক্ত করে নেয় আর তা হলো সিরাতে মুস্তাকীম এবং ঈমান ও দীনের দুই প্রান্ত। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)।
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - হাওযে কাওসার ও শাফাআতের বর্ণনা
৫৫৭৭-[১২] আবদুল্লাহ ইবনু ’আমর ইবনুল আস (রাঃ) হতে বর্ণিত। একদিন নবী (সা.) ইবরাহীম আলায়হিস সালাম-এর উক্তি সংবলিত এ আয়াতটি তিলাওয়াত করলেন, (অর্থাৎ) “হে প্রভু! এ সকল মূর্তিগুলো বহু মানুষকে বিভ্রান্ত ও গোমরাহ করেছে, অতএব যে আমার অনুকরণ করবে সে-ই আমার দলভুক্ত, কিন্তু কেউ আমার অবাধ্য হলে তুমি তো ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু”- (সূরাহ ইব্রাহীম ১৪: ৩৬)।
আর ’ঈসা আলায়হিস সালাম-এর উক্তিও পাঠ করলেন, অর্থাৎ “যদি তুমি তাদেরকে শাস্তি দাও, তারা তো তোমারই বান্দা”- (সূরাহ্ আল মায়িদাহ্ ৫:১১৮)। অতঃপর নবী (সা.) নিজের হস্তদ্বয় উঠিয়ে এ ফরিয়াদ করতে লাগলেন, হে আল্লাহ! আমার উম্মত, আমার উম্মত। (তুমি তাদেরকে ক্ষমা কর) এই বলে তিনি কাঁদতে লাগলেন। তখন আল্লাহ তা’আলা জিবরীল (আঃ)-কে বললেন, তুমি মুহাম্মাদ (সা.) -এর কাছে যাও এবং তাঁকে প্রশ্ন কর তিনি (সা.) কেন কাঁদছেন? অবশ্য আল্লাহ তা’আলা ভালোভাবেই জানেন, তাঁর কান্নার কারণ কী? তখন জিবরীল (আঃ) তাঁকে প্রশ্ন করলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তাঁকে তাই অবগত করলেন যা তিনি বলেছিলেন, অতঃপর আল্লাহ
তা’আলা জিবরীল (আঃ)-কে পুনরায় বললেন, মুহাম্মাদ (সাঃ) -এর কাছে যাও এবং তাঁকে বল, আমি আপনাকে আপনার উম্মতের ব্যাপারে সন্তুষ্ট করে দেব এবং আপনাকে কষ্ট দেব না। (মুসলিম)
الفصل الاول (بَاب الْحَوْض والشفاعة )
وَعَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ تَلَا قَوْلَ اللَّهِ تَعَالَى فِي إِبْرَاهِيمَ: [رَبِّ إِنَّهُنَّ أَضْلَلْنَ كَثِيرًا مِنَ النَّاسِ فَمَنْ تَبِعَنِي فَإِنَّهُ مني] وَقَالَ عِيسَى: [إِن تُعَذبهُمْ فَإِنَّهُم عِبَادك] فَرَفَعَ يَدَيْهِ فَقَالَ «اللَّهُمَّ أُمَّتِي أُمَّتِي» . وَبَكَى فَقَالَ اللَّهُ تَعَالَى: «يَا جِبْرِيلُ اذْهَبْ إِلَى مُحَمَّدٍ وَرَبُّكَ أَعْلَمُ فَسَلْهُ مَا يُبْكِيهِ؟» . فَأَتَاهُ جِبْرِيلُ فَسَأَلَهُ فَأَخْبَرَهُ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِمَا قَالَ فَقَالَ اللَّهُ لِجِبْرِيلَ اذْهَبْ إِلَى مُحَمَّدٍ فَقُلْ: إِنَّا سَنُرْضِيكَ فِي أمَّتك وَلَا نسوؤك . رَوَاهُ مُسلم
رواہ مسلم (346 / 202)، (499) ۔
(صَحِيح)
ব্যাখ্যাঃ রাসূলুল্লাহ (সা.) ইবরাহীম (আঃ)-এর উক্তি সম্বলিত আয়াতটি ঘটনা বর্ণনা হেতু অথবা সূরা তিলাওয়াতকালে পাঠ করছিলেন। ইবরাহীম (আঃ) মূর্তিগুলোর প্রতি ইশারা করে দু'আ করছিলেন, “হে আমার প্রতিপালক! এ সমস্ত প্রতিমা বহু সংখ্যক মানুষকে পথভ্রষ্ট করে ফেলেছে, অতএব যে আমার অনুসরণ করবে সে আমার দলভুক্ত, কিন্তু কেউ আমার অবাধ্য হলে তুমি তো ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।”
ইবরাহীম (আঃ)-এর কথা, "এ সমস্ত প্রতিমাগুলো বহু মানুষকে পথভ্রষ্ট ও গোমরাহ করে ফেলেছে।” এর অর্থ হলো এ সকল প্রতিমা পথভ্রষ্ট ও গোমরাহের কারণে হয়েছে।
“যে আমার অনুসরণ করবে” এর অর্থ হলো যে তাওহীদের ক্ষেত্রে, ইখলাসের ক্ষেত্রে এবং তাওয়াক্কুলের ক্ষেত্রে আমার অনুসরণ করবে। সে সকল বিষয়ে আমার অনুসারী দলভুক্ত বা সম্প্রদায়ভুক্ত হবে।
“আর কেউ আমার অবাধ্য হলে তুমি তো ক্ষমাশীল পরম দয়ালু”, এর অর্থ হলো- “হে আল্লাহ! তুমি তো শিরক ছাড়া যাকে চাও তার সব গুনাহ ক্ষমা করে থাক, আর যাকে চাও তার প্রতি স্বীয় অনুগ্রহে রহম কর। এমনকি শিরককারীর প্রতিও তুমি অনুগ্রহ হলে তাকে ঈমান গ্রহণের তাওফীক দান করে থাক এবং সকর্মপরায়ণশীল করে দিয়ে থাক।”
রাসূলুল্লাহ (সা.) ও ঈসা (আঃ)-এর দু'আ সম্বলিত উক্তিটিও তিলাওয়াত করলেন। 'ঈসা (আঃ) দু'আ করেছেন, “(হে আল্লাহ!) তুমি যদি তাদের শাস্তি দাও তবে তারা তো তোমারই বান্দা আর যদি তুমি তাদের ক্ষমা করে দাও তবে তুমি তো পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।”
অর্থাৎ কোন কিছুই তোমাকে পরাভূত করতে পারে না, তুমি মহাশক্তিমান কুদরতওয়ালা; তুমি যা ইচ্ছা তাই কর। তুমি এমন ফায়সালাকারী যে ফায়সালা কেউ খণ্ডন করতে পারে না।
অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা.) আল্লাহর দরবারে তার হাত দু'খানি উত্তোলন করে বললেন, “আল্ল-হুম্মা উম্মাতী উম্মাতী, হে আল্লাহ! আমার উম্মত, আমার উম্মত। অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমার উম্মতকে ক্ষমা কর, আমার উম্মতের প্রতি রহম কর। এ বাক্যটি একাধিকবার উল্লেখের উদ্দেশ্য হলো সম্ভবত আবেদনটি গুরুত্বের সাথে পেশ করা অথবা পূর্বাপর সকল উম্মতকে শামিল করা। (وبكى) এ সময় রাসূলুল্লাহ (সা.) কাঁদলেন, কেননা নবী (সা.) যে আয়াত পাঠ করলেন তাতে তার স্মরণ হলো ইবরাহীম খলীল আলায়হিস সালাম-এর কথা এবং ঈসা আলায়হিস সালাম-এর কথা, তারা উভয়ই তাদের উম্মতদের জন্য আল্লাহ তা'আলার নিকট সুপারিশ করেছেন। এতে আল্লাহর নবীর হৃদয় তার উম্মতের জন্য বিগলিত হয়ে গেল, ফলে তিনি কাঁদলেন।
আল্লাহ তা'আলা নবী মুহাম্মাদ-এর কান্নার কারণ জানা সত্ত্বেও জিবরীলকে পাঠিয়ে দিয়ে তার কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করতে বললেন, জিবরীল আলায়হিস সালাম এসে জিজ্ঞেস করলে রাসূলুল্লাহ (সা.) তা বললেন, অর্থাৎ তিনি তার উম্মতের জন্য কাঁদছিলেন। জিবরীল আল্লাহ তা'আলার কাছে এসে কান্নার কারণ জানালে আল্লাহ তা'আলা জিবরীলকে বললেন, তুমি মুহাম্মাদের কাছে ফিরে গিয়ে বল, আমি (আল্লাহ) তার সকল উম্মাতের ব্যপারে তাকে সন্তুষ্ট করব, অসন্তুষ্ট করব না বা তাকে চিন্তিত ও দুঃখিত করে রাখব না। আপনার সন্তুষ্টির জন্য আপনার উম্মতকেও ক্ষমা করব এবং তাদের প্রতি রহম করব।
মহান আল্লাহর বাণী:
(وَ لَسَوۡفَ یُعۡطِیۡکَ رَبُّکَ فَتَرۡضٰی) “আর সত্বর আল্লাহ আপনাকে (এরূপ বস্তু) দান করবেন যা পেয়ে আপনি সন্তুষ্ট হবেন।” (সূরাহ্ আহ্ যুহা- ৯৩:৫)
‘আল্লামাহ্ নাবাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, এ হাদীসটি বিভিন্ন ফায়দা সম্বলিত হাদীস। সেগুলোর কতিপয় হলো-
(এক) উম্মতের প্রতি রাসূলুল্লাহ (সা.) চূড়ান্ত ভালোবাসার পরিচয় বর্ণনা করা এবং তাদের বিপদ ও মুসীবতকালে তাতে দেখাশুনা ও যত্নশীল থাকার দৃষ্টান্ত পেশ করা।
(দুই) এ উম্মতের মহাসুসংবাদ পেশ করা, যেমন মহান আল্লাহর ওয়াদা: (سَنُرْ ضِيكَ فِىْ أمَّتك وَلَانَسُوْؤُكَ) আমি আপনার উম্মতের ব্যাপারে আপনাকে সন্তুষ্ট করব, আপনাকে অসন্তুষ্ট রাখব না। এ উম্মাতের জন্য এ হাদীস সর্বোচ্চ খুশির ও সন্তুষ্টির হাদীস।
(তিন) আল্লাহ তা'আলার নিকট আমাদের নবীর মহান মর্যাদা বর্ণনা করা।
(মিরক্বাতুল মাফাতীহ, শারহুন নাবাবী ৩য় খণ্ড, ৭০ পৃ, হা. ৩৪৬)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - হাওযে কাওসার ও শাফাআতের বর্ণনা
৫৫৭৮-[১৩] আবূ সাঈদ আল খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। একদিন কতিপয় লোক প্রশ্ন করল, হে আল্লাহর রাসূল! কিয়ামতের দিন কি আমরা আমাদের প্রভুকে দেখতে পাব? তিনি (সা.) বললেন, হ্যাঁ, মেঘমুক্ত দ্বিপ্রহরের আকাশে তোমরা সূর্য দেখতে কি কষ্ট পাও? এবং মেঘমুক্ত আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ দেখতে কি তোমাদের কোন সমস্যা হয়? তারা বলল, না, হে আল্লাহর রাসূল। তিনি (সা.) বললেন, কিয়ামতের দিন আল্লাহকে দেখতে তোমাদের এর চেয়ে বেশি কোন সমস্যা হবে না যা এ দুটিকে দেখতে তোমাদের হয়ে থাকে। যখন কিয়ামত সংঘটিত হবে, তখন একজন ঘোষক ঘোষণা দেবে, প্রত্যেক উম্মত, যে যার ইবাদত করত সে যেন তার অনুসরণ করে। তখন যারা আল্লাহকে ছাড়া মূর্তি-প্রতিমা ইত্যাদির ইবাদত করত, তাদের একজনও অবশিষ্ট থাকবে না, বরং সকলেই জাহান্নামের মধ্যে গিয়ে পড়বে। শেষ পর্যন্ত এক আল্লাহর ’ইবাদতকারী ভালো ও গুনাহগার ছাড়া সেখানে আর কেউই বাকি থাকবে না। এরপর রাবুল আলামীন তাদের নিকট এসে বললেন, তোমরা কার অপেক্ষায় আছ? প্রত্যেক উম্মত, যে যার ইবাদত করত, সে তো তারই অনুসরণ করেছে। তারা বলবে, হে আমাদের প্রভু। আমরা তো সেই সকল লোকেদেরকে দুনিয়াতেই বর্জন করেছিলাম যখন আজকের তুলনায় তাদের কাছে আমাদের বেশি প্রয়োজন ছিল। আমরা কক্ষনো তাদের সঙ্গে চলিনি। (বুখারী ও মুসলিম)
الفصل الاول (بَاب الْحَوْض والشفاعة )
وَعَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ أَنَّ أُنَاسًا قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ هَلْ نَرَى رَبَّنَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ؟ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «نَعَمْ هَلْ تُضَارُّونَ فِي رُؤْيَةِ الْقَمَرِ لَيْلَةَ الْبَدْرِ صَحْوًا لَيْسَ فِيهَا سَحَابٌ؟» قَالُوا: لَا يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ: مَا تَضَارُّونَ فِي رُؤْيَةِ اللَّهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِلَّا كَمَا تُضَارُّونَ فِي رُؤْيَةِ أَحَدِهِمَا إِذَا كَانَ يَوْمُ الْقِيَامَةِ أَذَّنَ مُؤَذِّنٌ لِيَتَّبِعْ كُلُّ أُمَّةٍ مَا كَانَتْ تَعْبُدُ فَلَا يَبْقَى أَحَدٌ كَانَ يعبد غيرالله مِنَ الْأَصْنَامِ وَالْأَنْصَابِ إِلَّا يَتَسَاقَطُونَ فِي النَّارِ حَتَّى إِذَا لَمْ يَبْقَ إِلَّا مَنْ كَانَ يَعْبُدُ اللَّهَ مِنْ بَرٍّ وَفَاجِرٍ أَتَاهُمْ رَبُّ الْعَالَمِينَ قَالَ: فَمَاذَا تَنْظُرُونَ؟ يَتْبَعُ كُلُّ أُمَّةٍ مَا كَانَت تعبد. قَالُوا: ياربنا فَارَقْنَا النَّاسَ فِي الدُّنْيَا أَفْقَرَ مَا كُنَّا إِلَيْهِم وَلم نصاحبهم
متفق علیہ ، رواہ البخاری (806) و مسلم (229 / 182)، (451) ۔
(متفّق عَلَيْهِ)
ব্যাখ্যা: আল্লাহ তা'আলা একাধিক জায়াগায় তার সাথে সাক্ষাতের কথা বলেছেন, সেই প্রেক্ষিতে সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ (সা.) -কে প্রশ্ন করেছিলেন, হে আল্লাহর রাসূল! কিয়ামতের দিন আমরা কি আমাদের রবকে দেখতে পাব? রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, হ্যাঁ, তোমরা তোমাদের রবকে দেখতে পাবে।
‘আল্লামাহ্ সুয়ূত্বী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, কিয়ামতের অবস্থানস্থলে প্রত্যেক নর-নারীর পক্ষেই আল্লাহকে দেখা সম্ভব হবে; এমনকি বলা হয় কাফির-মুশরিক এবং মুনাফিকদেরও সাক্ষাৎ হাসিল হবে। অতঃপর তাদের থেকে আড়াল হয়ে যাবে যাতে তাদের আফসোসের কারণ হয়। মুল্লা আলী ক্বারী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, আমি বলি এ বিষয়ে আল্লাহ তা'আলার বাণী (নিম্নে) নিয়ে স্বতন্ত্র আলোচনা রয়েছে:
(کَلَّاۤ اِنَّهُمۡ عَنۡ رَّبِّهِمۡ یَوۡمَئِذٍ لَّمَحۡجُوۡبُوۡنَ) “কক্ষনো না, তারা সেদিন তাদের প্রতিপালক থেকে পর্দার আড়ালে থাকবে।” (সূরাহ্ আল মুতাফফিফীন ৮৩: ১৫)
রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর বাণীও সামনে আসছে, কেবল আল্লাহর ইবাদতকারীরাই অবশিষ্ট থাকবে অতঃপর তাদের সামনে আল্লাহ রাব্বুল 'আলামীন আগমন করবেন। অর্থাৎ একনিষ্ঠ ইবাদতকারীরাই কেবল আল্লাহ তা'আলার দর্শন লাভে ধন্য হবেন।
আল্লাহর দর্শনের স্বাদ এমন হবে যে, মানুষ তার ক্লেশ ক্লান্তি সব ভুলে যাবে। (জান্নাতীগণ জান্নাতে আল্লাহকে দেখে জান্নাতের আরাম-আয়েশের কথাও ভুলে যাবে)
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা'আতের সর্ববাদী সম্মত মত হলো নবী-রাসূলগণ এবং সকল যুগের উম্মাতের সিদ্দীকগণ ও এ উম্মতের নেককার মু'মিনগণ আল্লাহর দর্শন লাভে ধন্য হবেন। এ উম্মাতের নারীদের ব্যাপারে তিনটি মত রয়েছে- ১) তারা দেখতে পাবে না, ২) তারাও দেখতে পাবে, ৩) ঈদ বা এ রকম কোন বিশেষ দিনে দেখতে পাবে।
মালায়িকার (ফেরেশতাদের ব্যাপারে দুটি মত- ১) তারা তাদের রবকে দেখতে পাবে না, ২) তারাও দেখতে পাবে।
জিনদের ব্যাপারেও অনুরূপ ইখতিলাফ রয়েছে। (মু'মিনাহ্ নারীদের দর্শনের ব্যাপারে পুরুষদের থেকে আলাদা ভাবার কোন কারণ নেই, অতএব তারাও পুরুষের মতই আল্লাহর দর্শন লাভে ধন্য হবে।) [সম্পাদক]
কিয়ামতের দিন মু'মিনগণ আল্লাহকে এমনভাবে দেখবে যেভাবে মেঘমুক্ত আকাশে দ্বিপ্রহরকালে সূর্যকে এবং পূর্ণিমার রাতে চাঁদকে বিনা ক্লেশে দর্শন করা যায়।
সূর্য এবং চন্দ্রের দৃষ্টান্ত একটা অবহিত মাত্র, অন্যথায় মুমিনদের আল্লাহর দর্শন হবে চূড়ান্ত আলোকরশ্মিতে আর এ আলো মু'মিনদের নেকির স্তর হিসেবে কম বেশি হবে।
কিয়ামতের দিবসে আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন ঘোষক ঘোষণা দিবেন, “তোমরা যে যার ইবাদত করতে সে আজ তার অনুসরণ কর এবং তার সাথে চলে যাও। ফলে আল্লাহ ছাড়া অন্যের ‘ইবাদতকারী সবাই নিজ নিজ মা'বুদের সাথে চলে যাবে এবং জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। একমাত্র আল্লাহর ইবাদতকারীরা হাশরের ময়দানে অবশিষ্ট থাকবে, এর মধ্যে নেককার গুনাহগার সবাই থাকবে।”
(إصنام)-এর অর্থ মূর্তি (أنصاب) শব্দটি (نصب)-এর বহুবচন, অর্থ ঐ পাথর যা পূজার জন্য স্থাপন করা হয় এবং তার উপর দেবতাদের সন্তুষ্টির উদ্দেশে পশু যাবাহ করা হয়। অনুরূপ পাথর অথবা বৃক্ষ যাই হোক না কেন তাকে পূজার জন্য অথবা সম্মানের জন্য স্থাপন করা হলেই সেটা (نُصُبٌ)।
(أَتَاهُمْ رَبُّ الْعَالَمِينَ) তাদের নিকট রাব্বুল আলামীন উপস্থিত হবেন, এর অর্থ হলো তার নির্দেশ আসবে, যেমন পরবর্তী বাক্যে রয়েছে: আল্লাহ বলবেন, তোমরা কার প্রতিক্ষা করছ? ঈমানদারেরা যা উত্তর দিবে হাদীসে তা এসেছে। কেউ কেউ বলেছেন, আল্লাহ স্বয়ং নিজেই আগমন করবেন তবে মালাক (ফেরেশতা)-এর রূপ ধারণ করে। কাযী ‘ইয়ায (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, আল্লাহর পক্ষ থেকে মালায়িকাহ্ (ফেরেশতাগণ) আসবেন, আমার মতে এ ব্যাখ্যাটাই হাদীসের সাথে অধিক সাদৃশ্যশীল।
মালাকরূপ আগমনকারী যখন বলবে: আমি তোমাদের রব্ আর লোকেরা তাকে মাখলুক সদৃশ অবলোকন করবে তখন তারা তা থেকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করবে এবং তাকে রব বলে স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানাবে, তারা জানবে ইনি তাদের রব নন।
যা হোক আল্লাহ মুমিনদের বলবেন, প্রত্যেকেই তো যে যার উপাসনা করেছে তাদের সাথে চলে গেছে। তারা বলবে, আমরা দুনিয়াতেই তাদের বর্জন করেছি, তাদের সাথে আমরা কখনো চলিনি এবং তারা যেসব মূর্তি ও দেবতার ‘ইবাদত করেছে আমরা করিনি, অতএব এখানে তাদের অনুসরণ করার প্রশ্নই আসে না, বরং আমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করেছি আপনার সন্তুষ্টির লক্ষ্যে তাদের সাথে শত্রুতা পোষণ করেছি। অথচ দুনিয়ায় নানা পার্থিব প্রয়োজনে তাদের সাথে সম্পর্কের বেশি প্রয়োজন ছিল। এমতাবস্থায় আখিরাতের এই দিনে আমরা কিভাবে তাদের সাথে চলতে পারি? (মিরক্বাতুল মাফাতীহ, শারহুন নাবাবী ৩য় খণ্ড হা. ২৯৯)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - হাওযে কাওসার ও শাফাআতের বর্ণনা
৫৫৭৯-[১৪] আর আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ)-এর বর্ণনায় আছে, তখন তারা বলবে, যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের রব আমাদের কাছে না আসেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা এ স্থানে অপেক্ষা করব। যখন আমাদের রব আসবেন, তখন আমরা তাকে চিনতে পারব। আর আবূ সাঈদ (রাঃ)-এর বর্ণনাতে আছে, আল্লাহ তআলা প্রশ্ন করবেন, তোমাদের এবং তোমাদের প্রভুর মধ্যে এমন কোন চিহ্ন আছে কি, যাতে তোমরা তাকে চিনতে পারবে? তারা বলবে, হ্যা, তখন আল্লাহ তা’আলা স্বীয় পায়ের নলা উন্মোচিত করবে। তখন যে ব্যক্তি সচ্ছতার সাথে আল্লাহ তা’আলাকে সিজদাহ্ করত, শুধু তাকেই আল্লাহ তা’আলা সিজদার অনুমতি দেবেন। আর যারা কারো প্রভাবে বা ভয়ে কিংবা মানুষকে দেখানোর জন্য সিজদাহ্ করত, তারা থেকে যাবে। তাদের মেরুদণ্ডের হাড়কে আল্লাহ তা’আলা একটি তক্তার মতো শক্ত করে দেবেন, বরং যখনই সিজদাহ্ করতে চাবে, তখনই পিছনের দিকে চিৎ হয়ে পড়ে যাবে। অতঃপর জাহান্নামের উপর দিয়ে পুলসিরাত পাতা হবে এবং শাফা’আতের অনুমতি দেয়া হবে। তখন নবী-রাসূলগণ (স্ব-স্ব উম্মতের জন্য) এ ফরিয়াদ করবেন, হে আল্লাহ! নিরাপদে রাখ! নিরাপদে রাখ! এ পুলসিরাতের উপর দিয়ে মু’মিনদের কেউ চোখের পলকে, কেউ বিদ্যুতের গতিতে, কেউ বাতাসের গতিতে, কেউ পাখির গতিতে এবং কেউ দ্রুতগামী ঘোড়ার গতিতে আবার কেউ উটের গতিতে অতিক্রম করবে। কেউ নিরাপদে বেঁচে যাবে। আবার কেউ এমনভাবে পার হয়ে আসবে যে, তার দেহ ক্ষত-বিক্ষত হবে এবং কেউ খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে জাহান্নামে পড়বে।
অবশেষে মু’মিনগণ যখন জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করবে। সেই মহান সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ! তোমাদের যে কেউ নিজের অধিকারের দাবিতে কত কঠোর, তা তো তোমাদের কাছে পরিষ্কার। কিন্তু কিয়ামতের দিন মু’মিনগণ তাদের সেই সকল ভাইদের মুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে আরো অধিক ঝগড়া করবে, যারা তখনো জাহান্নামে পড়ে রয়েছে। তারা বলবে, হে আমাদের প্রভু! এ সকল আমাদের সাথে সিয়াম রাখত, সালাত আদায় করত এবং হজ্জ আদায় করত। (অতএব তুমি তাদেরকে মুক্তি দাও) তখন আল্লাহ তা’আলা বলবেন, যাও তোমরা। যাদেরকে চিন তাদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করে আন, তাদের চেহারা-আকৃতি পরিবর্তন করা জাহান্নামের আগুনের উপর হারাম করা হবে। তখন তারা জাহান্নাম থেকে বহু সংখ্যক লোককে বের করে আনবে। অতঃপর বলবে, হে আমাদের প্রভূ! এখন সেখানে এমন আর একজন লোকও অবশিষ্ট নেই যাদেরকে বের করার জন্য আপনি আদেশ দিয়েছেন। তখন আল্লাহ তা’আলা বলবেন, আবার যাও, যাদের হৃদয়ে এক দানার পরিমাণ ঈমান পাবে তাদের সকলকে বের করে আন। তাতেও তারা বহু সংখ্যক লোককে বের করে আনবে।
তারপর আল্লাহ তা’আলা বলবেন, আবার যাও, যাদের হৃদয়ে অর্ধ দীনার পরিমাণ ঈমান পাবে তাদের সকলকে বের করে আন। অতএব তাতেও বহু সংখ্যককে বের করে আনবে। অতঃপর আল্লাহ তা’আলা বলবেন, আবারো যাও, যাদের হৃদয়ে এক বিন্দু পরিমাণ ঈমান পাবে তাদের সকলকে বের করে আন। এবারও তারা বহু সংখ্যককে বের করে এনে বলবে, হে আমাদের প্রভু! ঈমানদার কোন ব্যক্তিকেই আমরা আর জাহান্নামে রেখে আসিনি।
তখন আল্লাহ তা’আলা বলবেন, মালায়িকাহ্ (ফেরেশতাগণ), নবীগণ এবং মুমিনগণ সকলেই শাফা’আত করেছেন, এখন এক ’আরহামুর রহিমীন’ তথা আমি পরম দয়ালু ছাড়া আর কেউই অবশিষ্ট নেই- এই বলে তিনি মুষ্টিভরে এমন একদল লোককে জাহান্নাম থেকে বের করবেন যারা কখনো কোন ভালো কাজ করেনি। যারা জ্বলে-পুড়ে কালো কয়লা হয়ে গেছে। অতঃপর তাদেরকে জান্নাতের সম্মুখ ভাগের একটি নহরে নিক্ষেপ করবেন, যার নাম হলো ’নহরে হায়াত’। এটাতে থেকে তারা স্রোতের ধারে যেমনভাবে ঘাসের বীজ গজায় তেমনিভাবে বের হয়ে আসবে এবং তারা মুক্তার মতো (চকচকে অবস্থায় বের হবে) তাদের স্কন্দ্বে সিলমোহর থাকবে। জান্নাতবাসীগণ তাদের দেখে বলবে, এরা পরম দয়ালু আল্লাহর আজাদকৃত। আল্লাহ তাআলা তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করিয়েছেন, অথচ তারা পূর্বে কোন ’আমল বা কল্যাণকর কাজ করেনি। অতঃপর তাদেরকে বলা হবে, এই জান্নাতে তোমরা যা দেখছ, তা তোমাদেরকে দেয়া হলো এবং এর সাথে অনুরূপ পরিমাণ আরো দেয়া হলো। (বুখারী ও মুসলিম)
الفصل الاول (بَاب الْحَوْض والشفاعة )
وَفِي رِوَايَةِ أَبِي هُرَيْرَةَ فَيَقُولُونَ: هَذَا مَكَانُنَا حَتَّى يَأْتِيَنَا رَبُّنَا فَإِذَا جَاءَ رَبُّنَا عَرَفْنَاهُ وَفِي رِوَايَةِ أَبِي سَعِيدٍ: فَيَقُولُ هَلْ بَيْنَكُمْ وَبَيْنَهُ آيَةٌ تَعْرِفُونَهُ؟ فَيَقُولُونَ: نَعَمْ فَيُكْشَفُ عَنْ سَاقٍ فَلَا يَبْقَى مَنْ كَانَ يَسْجُدُ لِلَّهِ مِنْ تِلْقَاءِ نَفْسِهِ إِلَّا أَذِنَ اللَّهُ لَهُ بِالسُّجُودِ وَلَا يَبْقَى مَنْ كَانَ يَسْجُدُ اتِّقَاءً وَرِيَاءً إِلَّا جَعَلَ اللَّهُ ظَهْرَهُ طَبَقَةً وَاحِدَةً كُلَّمَا أَرَادَ أَنْ يَسْجُدَ خَرَّ عَلَى قَفَاهُ ثُمَّ يُضْرَبُ الْجِسْرُ عَلَى جَهَنَّمَ وَتَحِلُّ الشَّفَاعَةُ وَيَقُولُونَ اللَّهُمَّ سَلِّمْ سَلِّمْ فَيَمُرُّ الْمُؤْمِنُونَ كَطَرَفِ الْعَيْنِ وَكَالْبَرْقِ وَكَالرِّيحِ وَكَالطَّيْرِ وَكَأَجَاوِيدِ الْخَيْلِ وَالرِّكَابِ فَنَاجٍ مُسَلَّمٌ وَمَخْدُوشٌ مُرْسَلٌ وَمَكْدُوسٌ فِي نَارِ جَهَنَّمَ حَتَّى إِذَا خَلَصَ الْمُؤْمِنُونَ مِنَ النَّارِ فَوَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ مَا مِنْ أحد مِنْكُم بأشدَّ مُناشدةً فِي الْحق - قد تبين لَكُمْ - مِنَ الْمُؤْمِنِينَ لِلَّهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ لِإِخْوَانِهِمُ الَّذِينَ فِي النَّارِ يَقُولُونَ رَبَّنَا كَانُوا يَصُومُونَ مَعَنَا وَيُصَلُّونَ وَيَحُجُّونَ فَيُقَالُ لَهُمْ: أَخْرِجُوا مَنْ عَرَفْتُمْ فَتُحَرَّمُ صُوَرَهُمْ عَلَى النَّارِ فَيُخْرِجُونَ خَلْقًا كَثِيرًا ثُمَّ يَقُولُونَ: رَبَّنَا مَا بَقِيَ فِيهَا أَحَدٌ مِمَّنْ أَمَرْتَنَا بِهِ. فَيَقُولُ: ارْجِعُوا فَمَنْ وجدْتُم فِي قلبه مِثْقَال دنيار مِنْ خَيْرٍ فَأَخْرِجُوهُ فَيُخْرِجُونَ خَلْقًا كَثِيرًا ثُمَّ يَقُولُ: ارْجِعُوا فَمَنْ وَجَدْتُمْ فِي قَلْبِهِ مِثْقَالَ نِصْفِ دِينَارٍ مِنْ خَيْرٍ فَأَخْرِجُوهُ فَيُخْرِجُونَ خَلْقًا كَثِيرًا ثُمَّ يَقُولُ: ارْجِعُوا فَمَنْ وَجَدْتُمْ فِي قَلْبِهِ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ مِنْ خَيْرٍ فَأَخْرِجُوهُ فَيُخْرِجُونَ خَلْقًا كَثِيرًا ثُمَّ يَقُولُونَ: رَبَّنَا لَمْ نَذَرْ فِيهَا خَيِّرًا فَيَقُولُ اللَّهُ شُفِّعَتِ الْمَلَائِكَةُ وَشُفِّعَ النَّبِيُّونَ وَشُفِّعَ الْمُؤْمِنُونَ وَلَمْ يَبْقَ إِلَّا أَرْحَمُ الرَّاحِمِينَ فَيَقْبِضُ قَبْضَةً مِنَ النَّارِ فَيُخْرِجُ مِنْهَا قَوْمًا لَمْ يَعْمَلُوا خَيْرًا قَطُّ قَدْ عَادُوا حُمَمًا فَيُلْقِيهِمْ فِي نَهْرٍ فِي أَفْوَاهِ الْجَنَّةِ يُقَالُ لَهُ: نَهْرُ الْحَيَاةِ فَيَخْرُجُونَ كَمَا تَخْرُجُ الْحِبَّةُ فِي حَمِيلِ السَّيْلِ فَيَخْرُجُونَ كَاللُّؤْلُؤِ فِي رِقَابِهِمُ الْخَوَاتِمُ فَيَقُولُ أَهْلُ الْجَنَّةِ: هَؤُلَاءِ عُتَقَاءُ الرَّحْمَن أدخلهم الْجنَّة بِغَيْر عمل وَلَا خَيْرٍ قَدَّمُوهُ فَيُقَالُ لَهُمْ لَكُمْ مَا رَأَيْتُمْ وَمثله مَعَه . مُتَّفق عَلَيْهِ
متفق علیہ ، رواہ البخاری (7439) و مسلم (302 / 183)، (454) ۔
(متفّق عَلَيْهِ)
ব্যাখ্যা: আবূ হুরায়রাহ (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হাশরের ময়দানে মুমিনদের বলবেন, তোমরা এখানে কার প্রতিক্ষা করছ? মুমিনগণ বলবেন, এটা আমাদের অবস্থানস্থল, আমরা এখানেই অবস্থান করব যতক্ষণ না আমাদের রব আমাদের নিকট আগমন করেন। এ সময় আল্লাহ তা'আলা তার পায়ের নলা তাদের সামনে প্রকাশ করবেন অর্থাৎ তিনি তার নূরের তাজাল্লী প্রকাশ করবেন।
মু'মিনদের প্রথম দর্শন অস্বীকার সম্ভবত তাদের সাথে মুনাফিকরা থাকবে সেজন্য, কেননা তারা আল্লাহকে দর্শনের হাক্ব রাখে না। মুনাফিকরা যখন পৃথক হয়ে যাবে তখন মু'মিনদের সামনে থেকে পর্দা উঠিয়ে দেয়া হবে। অতঃপর তারা যখন আল্লাহকে দর্শন করবে তখন বলবে, হ্যা, আপনি আমাদের রব। আবূ সাঈদ (রাঃ)-এর অন্য বর্ণনায় আছে, আল্লাহ বলবেন, তোমাদের আল্লাহকে চেনার কি কোন নিদর্শন আছে? মুমিনেরা উত্তর দিবে, হ্যা, আছে; এমন সময় আল্লাহ তা'আলা তার পায়ের নলা উন্মোচিত করে দিবেন। মুমিনেরা তা দর্শন মাত্রই চিনতে পারবেন এবং আল্লাহর অনুগ্রহে বা অনুমতিসাপেক্ষে সিজদায় পড়ে যাবেন। এ সময় মুনাফিক অপরের দ্বারা প্রভাবিত, রিয়াকার ইত্যাদি ব্যক্তিরাও সিজদার চেষ্টা করবে কিন্তু সিজদাহ করতে গিয়ে পিছনের দিকে উল্টে পড়ে যাবে। আল্লাহ বলেন, “সেদিন পায়ের গোছা উন্মুক্ত করা হবে এবং লোকেদের সিজদার প্রতি আহ্বান করা হবে, তখন তারা সিজদাহ্ দিতে পারবে না।” (সূরাহ্ আল কলাম ৬৮: ৪২)
ইমাম নবাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, এ হাদীসের মাধ্যমে অনেকে ধারণা করে যে, মুনাফিকরাও আল্লাহকে দেখবে, যেহেতু তারা মুমিনদের সাথেই রয়ে গেছে; অতঃপর আল্লাহ সিজদার মাধ্যমে তাদের পরীক্ষা গ্রহণ করবেন। যে সিজদাহ্ করতে পারবে সে খাটি মু'মিন, আর যে তাতে সক্ষম হবে না সে হবে মুনাফিক।
এরপর আল্লাহ তা'আলা জাহান্নামের উপর ব্রীজ স্থাপন করবেন। একেই বলা হয় পুলসিরাত। প্রত্যেক ব্যক্তিকেই এই পুল পার হয়ে যেতে হবে। মুমিনেরা তাদের ‘আমল ও ঈমান অনুসারে কেউ চোখের পলকে, কেউ বিদ্যুৎ গতিতে, কেউ বাতাসের গতিতে, কেউ পাখির গতিতে, কেউ দ্রুতগামী ঘোড়ার এবং কেউ উটের গতিতে পার হবে। কেউ নিরাপদেই পার হবে, কেউ পার হবে এমনভাবে তার দেহ ক্ষত বিক্ষত হয়ে যাবে, কেউ তো ক্ষত-বিক্ষত হয়ে জাহান্নামে পড়েই যাবে।
এ সময় আল্লাহ তা'আলা নবী-রাসূল এবং মুমিনদের শাফা'আতের অনুমতি দিবেন। তারা বলবেন, “আল্ল-হুম্মা সাল্লিম আল্ল-হুম্মা সাল্লিম”, হে আল্লাহ! শান্তি দাও, হে আল্লাহ! শান্তি দাও। যে সকল মু'মিন জাহান্নাম থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছে অথবা পুলসিরাত পাড়ি দিয়ে জাহান্নাম থেকে নিরাপদ হয়ে গেছে তারা জাহান্নামে পড়ে থাকা মুমিনদের মুক্তির জন্য জোর দাবী পেশ করতে থাকবে। তারা বলবেন, হে আল্লাহ! এরা আমাদের সাথে আমাদের ন্যায় সালাত আদায় করেছে, সিয়াম পালন এবং সঠিক হজ্জ পালন করেছে, অতএব তাদের মুক্তি দাও। তখন মুমিনদের বলা হবে ঠিক আছে যাও সালাত, সওম, হজ্জ ইত্যাদি পালনকারী হিসেবে যাদের চিনতে পার তাদেরকে জাহান্নাম থেকে বের কর।
জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত সালাত আদায়কারী মু'মিনগণের সর্বাঙ্গ পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও সিজদার জায়গাগুলো পুড়বে না, ফলে ঐ সকল চিহ্ন দেখে বহু সংখ্যক জাহান্নামীদেরকে তারা বের করে এনে বলবেন, হে আল্লাহ! জাহান্নামে এ গুণের আর কোন মুমিন অবশিষ্ট নেই। অর্থাৎ সালাত আদায়কারী, সিয়াম পালনকারী, হজ্জ পালনকারী আর কেউ বাকী নেই। আল্লাহ তা'আলা বলবেন, আবার যাও দেখ যাদের অন্তরে এক দীনার পরিমাণ খায়র বা কল্যাণ পাও তাদের বের করে আন।
কাযী ইয়ায (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, (خير) (খায়র) শব্দের অর্থ ইয়াকীন। সহীহ হলো নিরেট ঈমানের পর অতিরিক্ত কোন নেক কর্ম। এবারও তারা গিয়ে বহু মানুষকে বের করে আনবেন। আল্লাহ তা'আলা মু'মিনদের আবার বলবেন, যাদের অন্তরে অর্ধ দীনার পরিমাণ খায়র রয়েছে তাদের বের কর, অতঃপর তাদের বের করা হবে। এদের সংখ্যাও হবে অনেক। আবার বলা হবে, ফিরে যাও যার অন্তরে এক যাররা পরিমাণ খায়র পাও তাকেও বের কর। এবারও অনেক মানুষকে বের করা হবে। তারা বলবেন, হে আল্লাহ! আমরা খায়র থাকা কোন ব্যক্তিকে রেখে আসিনি।
এরপর আল্লাহ তাআলা বলবেন, সবাই শাফা'আত করেছে এখন কেবল বাকি আমি আরহামুর রহীমীন, যার রহমত সমগ্র স্থানে পরিব্যপ্ত এবং সকল কিছু তার রহমতে ধন্য। এ বলে আল্লাহ তা'আলা মুষ্ঠিভরে এমন একদল লোককে জাহান্নাম থেকে বের করবেন যারা কখনও কোন خير (খায়র) নেক আমল করেনি। শুধু ঈমানের বিশ্বাসটুকুই তাদের ছিল, নেক ‘আমল বলতে কিছুই ছিল না।
তাদের আদৌ কোন নেক আমল না থাকা এবং ঈমান অতীব সূক্ষ্ম এবং হালকা থাকায় নবী-রাসূল এবং মু'মিনগণের দৃষ্টিতে তা আসেনি, ফলে তারা তাদের জন্য শাফা'আত করতে পারেননি। অবশেষে আহকামুল হাকিমীন তাদের মধ্যে ঐ লুক্কায়িত ঈমান দেখে জাহান্নাম থেকে বের করবেন।
এদের জাহান্নাম থেকে বের করে জান্নাতের দরজার সামনে উপস্থিত করা হবে, “হায়াত’ নামক নহরে গোসল করিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। এদের গর্দানে জাহান্নাম থেকে মুক্তির মোহর অঙ্কিত থাকবে, যা দেখে জান্নাতের সকল লোক তাদের চিনতে পারবে যে, এরা দয়াময় রহমানের অনুগ্রহপ্রাপ্ত এবং বিনা আমালে জান্নাতপ্রাপ্ত লোক।
তারা জান্নাতে প্রবেশ করলে আল্লাহ তা'আলা বলবেন, তোমরা যে জান্নাত দেখছ, অর্থাৎ তোমাদের দৃষ্টিসীমার মধ্যে এর বাগ-বাগিচা, বালাখানা ও হুর গেলেমান যা রয়েছে এটা তোমাদের জন্য এবং এর সমপরিমাণ আরো। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ, শারহুন নাবাবী ৩য় খণ্ড, হা. ২৯৯)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - হাওযে কাওসার ও শাফাআতের বর্ণনা
৫৫৮০-[১৫] উক্ত রাবী [আবূ সাঈদ আল খুদরী (রাঃ)] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: যখন জান্নাতীগণ জান্নাতে এবং জাহান্নামীগণ জাহান্নামে প্রবেশ করবে তখন আল্লাহ তা’আলা বলবেন, যার হৃদয়ে সরিষার দানা পরিমাণ ঈমান আছে, তাকে জাহান্নাম থেকে বের করে আন। তাদেরকে এমন অবস্থায় বের করা হবে যে, তারা পুড়ে কালো কয়লায় পরিণত হয়ে গেছে। অতঃপর তাদেরকে ’হায়াত’ নামক নহরে ফেলে দেয়া হবে। তাতে তারা স্রোতের ধারে যেন ঘাসের বীজ উদ্গত হয় তেমনি স্বচ্ছ-সুন্দর হয়ে উঠবে। তোমরা কি দেখনি, উক্ত গাছগুলো হলুদ রং জড়িত অবস্থায় অংকুরিত হয়? (বুখারী ও মুসলিম)
الفصل الاول (بَاب الْحَوْض والشفاعة )
وَعَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِذَا دَخَلَ أَهْلُ الْجَنَّةِ الْجَنَّةَ وَأَهْلُ النَّارِ النَّارَ يَقُولُ اللَّهُ تَعَالَى: مَنْ كَانَ فِي قَلْبِهِ مِثْقَالُ حَبَّةٍ مِنْ خَرْدَلٍ مِنْ إِيمَانٍ فَأَخْرِجُوهُ فَيَخْرُجُونَ قَدِ امْتَحَشُوا وَعَادُوا حُمَمًا فَيُلْقَوْنَ فِي نَهْرِ الْحَيَاةِ فَيَنْبُتُونَ كَمَا تَنْبُتُ الْحِبَّةُ فِي حَمِيلِ السَّيْلِ أَلَمْ تَرَوْا أَنَّهَا تَخْرُجُ صَفْرَاءَ مُلْتَوِيَةً . مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ
متفق علیہ ، رواہ البخاری (6560) و مسلم (204 / 184)، (457) ۔
(متفّق عَلَيْهِ)
ব্যাখ্যা: জান্নাতীরা জান্নাতে এবং জাহান্নামীরা জাহান্নামে প্রবেশের পর আল্লাহ বলবেন, যাদের অন্তরে সরিষা দানা পরিমাণ ঈমান আছে তাদের বের কর। এ নির্দেশ নবী রাসূল, ফেরেশতা এবং অন্যান্য যারা শাফা'আতের অধিকার লাভ করবেন তাদের প্রতি করা হবে। সামনে আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ)-এর বর্ণনায় এর বিস্তারিত বিবরণ আসছে। বলা হয় এ হাদীস থেকে প্রকাশ পায় যে, দয়াময় রহমান যাদের মুষ্ঠিতে ভরে জাহান্নাম থেকে বের করবেন তারা মু'মিন কিন্তু সম্পূর্ণ আ'মলবিহীন। উম্মাতের সর্ববাদী সম্মত মতে তারা কাফির ছিল না, যেটা অনেকেই মনে করে থাকেন। তাদের এমন অবস্থায় বের করা হবে যে তারা পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে।
রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর বাণী: (قَدِ امْتَحَشُوا) তারা পুড়ে কয়লায় পরিণত হয়ে গেছে। এটাকে কর্তৃবাচ্য অথবা কর্ম বাচ্য উভয়ই ধরা হয়ে থাকে। এটা চামড়া এবং হাড়ের উপরিভাগ পুড়ে ফেলানোর অর্থে ব্যবহৃত হয়। ‘আল কামূস’ নামক বিশ্ববিখ্যাত অভিধান গ্রন্থে (إحْتَحَشَ) শব্দটি (إِحْتَرَقَ) পুড়িয়ে ফেলা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। ইবনু হাজার আসকালানী (রহিমাহুল্লাহ) (إحْتَحَشَ) শব্দটিকে (إِحْتَرَقَ)-এর ওযনে এবং অর্থে ধরেছেন। কেউ এর ‘তা বর্ণে পেশ এবং ‘হা বর্ণে যের দিয়ে পাঠ করে থাকেন। কিন্তু অভিধানে এটাকে স্বকর্মক ক্রিয়া হিসেবে জানা যায় না। ইমাম নবাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, “তা বর্ণে, ‘হা' বর্ণে এবং ‘শীন বর্ণে যবর দিয়ে পাঠ-ই বিধেয়।
এ পদ্ধতিতেই বিভিন্ন রিওয়ায়াতে বর্ণিত হয়েছে। আল্লামাহ্ খত্ত্বাবী, হারুবী প্রমুখ এভাবেই হরকত দান করেছেন। জাহান্নামে পুড়ে পুড়ে তারা কয়লা হয়ে যাবে জাহান্নাম থেকে উঠিয়ে যখন তাদের হায়াত নদীতে ফেলা হবে তখন তাদের দেহ ড্রেনের দুই পাশের কর্দমাক্ত বা ভিজা পানিতে অঙ্কুরিত শস্য দানার মতো হলুদ, কোমল ও মসৃণ হয়ে যাবে। (মিরকাতুল মাফাতীহ, ফাতহুল বারী ১১খণ্ড ৪৮৪ পৃ., হা. ৬৫৬০)।
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - হাওযে কাওসার ও শাফাআতের বর্ণনা
৫৫৮১-[১৬] আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। লোকেরা প্রশ্ন করল, হে আল্লাহর রাসূল! কিয়ামাতের দিন আমরা কি আমাদের প্রভুকে দেখতে পাব? অতঃপর আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হাদীসের অবশিষ্ট অংশ থেকে আবূ সাঈদ আল খুদরী (রাঃ) -এর বর্ণিত হাদীসের অর্থানুরূপ বর্ণনা করেছেন। তবে আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ ) (كَشْفِ السَّاقِ) “আল্লাহ তা’আলা পায়ের নলা উন্মুক্ত করবেন তিনি এ কথাটি উল্লেখ করেননি। আর তিনি (সা.) বলেছেন: জাহান্নামের উপর পুলসিরাত স্থাপন করা হবে। সে সময় রাসূলদের মধ্যে আমি এবং আমার উম্মতই সর্বপ্রথম তা অতিক্রম করব। সেদিন (পুল অতিক্রমকালে) রাসূলগণ ছাড়া আর কেউই কথা বলবে না।
আর রাসূলগণও শুধু বলতে থাকবেন, আল্ল-হুম্মা সাল্লিম, সাল্লিম। অর্থাৎ হে আল্লাহ নিরাপদে রাখ। হে আল্লাহ নিরাপদে রাখ। আর জাহান্নামের মধ্যে সাদানের কাঁটার মতো আংটা থাকবে, সে সমস্ত আংটাগুলোর বিশালত্ব সম্পর্কে একমাত্র আল্লাহই জানেন। ঐ আংটাগুলো মানুষদেরকে তাদের ’আমল অনুপাতে আঁকড়ে ধরবে। অতএব কিছু সংখ্যক লোক নিজ ’আমলের কারণে ধ্বংস হবে এবং কিছু লোক টুকরা টুকরা হয়ে যাবে। আবার পরে মুক্তি পাবে।
অবশেষে যখন আল্লাহ তা’আলা বান্দাদের বিচার-ফায়সালা শেষ করবেন এবং (নিজের দয়া ও অনুগ্রহে) কিছুসংখ্যক ঐ সকল জাহান্নামবাসীকে মুক্তি দেয়ার ইচ্ছা করবেন, যারা এ সাক্ষ্য দিয়েছে যে, এক আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত আর কোন মা’বুদ নেই’, তখন মালায়িকাহ্ (ফেরেশতাদের)-কে আদেশ করবেন যে, যারা একমাত্র আল্লাহ তা’আলার ইবাদত করছে, তাদেরকে জাহান্নাম থেকে বের করে আন। তখন তারা ঐ সকল লোক যাদের কপালে সিজদার চিহ্ন রয়েছে তা দেখে সনাক্ত করবেন এবং তাদের জাহান্নাম থেকে বের করে আনবেন। আর আল্লাহ তা’আলা সিজদার চিহ্নসমূহ পুড়িয়ে দগ্ধ করা আগুনের জন্য হারাম করে দিয়েছেন। ফলে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত প্রতিটি আদম সন্তানের সিজদার স্থানটি ছাড়া তার সারা দেহ অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় জাহান্নাম থেকে বের করা হবে যে, তারা একেবারে কালো কয়লা হয়ে গেছে। তখন তাদের ওপর সঞ্জীবনী পানি ঢেলে দেয়া হবে। এর ফলে তারা এমনভাবে তরতাজা ও সজীব হয়ে উঠবে, যেমন কোন বীজ প্রবহমান পানির ধারে উদ্দাত হয়।
সে সময় জাহান্নামবাসীদের মধ্যে থেকে সর্বশেষে জান্নাতে প্রবেশকারী এক লোক জান্নাত ও জাহান্নামের মধ্যবর্তী স্থানে থেকে যাবে, যার মুখ হবে জাহান্নামের দিকে। সে বলবে, হে আমার প্রভু! জাহান্নামের দিক হতে আমার মুখখানা ফিরিয়ে দিন। কেননা জাহান্নামের গরম বাতাস আমাকে অত্যধিক কষ্ট দিচ্ছে এবং অগ্নিশিখা আমাকে জ্বালিয়ে দিচ্ছে। তখন আল্লাহ তা’আলা বলবেন, তবে কি যা তুমি চাচ্ছ, যদি তোমাকে আমি দান করি তাহলে আরো অন্য কিছুও তো চাইতে পার? তখন সে বলবে, না, তোমার সম্মানের শপথ করে বলছি, আমি আর কিছুই চাইব না। তখন সে আল্লাহ তা’আলাকে আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী ওয়াদা ও প্রতিশ্রুতি প্রদান করবে। তখন আল্লাহ তা’আলা তার মুখকে জাহান্নামের দিক থেকে ফিরিয়ে দেবেন। যখন সে জান্নাতের দিকে মুখ করবে এবং তার চাকচিক্য ও শ্যামল দৃশ্য দেখবে আল্লাহ যতক্ষণ তাকে চুপ রাখতে চাইবেন ততক্ষণ সে চুপ করে থাকবে।
অতঃপর বলবে, হে আমার প্রভু! আমাকে জান্নাতের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিন। এ কথা শুনে মহামহিম বারাকাতময় আল্লাহ বলবেন, তুমি কি ওয়াদা ও প্রতিশ্রুতি দাওনি যে, তুমি একবার যা চেয়েছ তা ছাড়া কখনো আর কিছুই চাইবে না? তখন সে বলবে, হে আমার প্রভু! তুমি আমাকে তোমার সৃষ্টিকুলের মধ্যে সর্বাধিক হতভাগা বানিয়ো না। তখন আল্লাহ তা’আলা বলবেন, আচ্ছা, তোমাকে যদি এ সকল কিছু দেয়া হয়, তাহলে আবার অন্য আর কিছু চাবে না তো? সে বলবে, না, তোমার সম্মানের শপথ! এটা ছাড়া আমি আর কিছুই চাইব না। তারপর সে আল্লাহ তা’আলাকে এই মর্মে ওয়াদা ও প্রতিশ্রুতি প্রদান করবে যা আল্লাহ তা’আলা ইচ্ছা করবেন। তখন তাকে জান্নাতের দরজার কাছে এগিয়ে দেয়া হবে। যখন সে জান্নাতের দরজার কাছে পৌছবে, তখন তার মধ্যকার আরাম আয়েশ ও আনন্দের প্রাচুর্য দেখতে পাবে এবং আল্লাহ তা’আলা যতক্ষণ চুপ রাখতে চাবেন ততক্ষণ সে চুপ থাকবে। অতঃপর সে বলবে, হে আমার প্রভু! আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দিন। তখন মহামহিম বারাকাতময় আল্লাহ বলবেন, আফসোস হে আদম সন্তান! তুমি কি মারাত্মক ওয়াদা ভঙ্গকারী! তুমি কি এই মর্মে প্রতিশ্রুতি দাওনি যে, আমি যা কিছু দেব তা ছাড়া অন্য কিছুই চাবে না? তখন সে বলবে, হে আমার প্রভু! আমাকে তোমার সৃষ্টির মাঝে সকলের চেয়ে দুর্ভাগা করো না। এই বলে সে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে থাকবে। এমনকি তার এ মিনতি দেখে আল্লাহ তা’আলা হেসে উঠবেন।
যখন হেসে ফেলবেন তখন তাকে জান্নাতে প্রবেশের অনুমতি দিয়ে বলবেন, এখন চাও (তোমরা যা কিছু চাওয়ার আছে) তখন সে আল্লাহ তা’আলার কাছে অন্তর খুলে চাবে। এমনকি যখন তার আকাঙ্ক্ষা শেষ হয়ে যাবে, তখন আল্লাহ তা’আলা তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলবেন, এটা চাও, ওটা চাও। এমনকি সেই আকাঙ্ক্ষাও যখন শেষ হয়ে যাবে, তখন আল্লাহ তা’আলা বলবেন, এ সকল কিছুই তোমাকে দেয়া হলো এবং সাথে সাথে আরো অনুরূপ পরিমাণ দেয়া হলো।
আর আবূ সাঈদ (রাঃ)-এর রিওয়ায়াতে আছে- আল্লাহ তা’আলা বলবেন, যাও, তোমাকে এ সমস্ত কিছু তো দিলামই এবং এর দশগুণ পরিমাণও এর সাথে দিলাম। (বুখারী ও মুসলিম)
الفصل الاول (بَاب الْحَوْض والشفاعة )
وَعَن أبي هُرَيْرَة أَنَّ النَّاسَ قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ هَلْ نَرَى رَبَّنَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ؟ فَذَكَرَ مَعْنَى حَدِيثِ أَبِي سَعِيدٍ غَيْرَ كَشْفِ السَّاقِ وَقَالَ: يُضْرَبُ الصِّرَاطُ بَيْنَ ظَهْرَانَيْ جَهَنَّمَ فَأَكُونُ أَوَّلَ مَنْ يَجُوزُ مِنَ الرُّسُلِ بِأُمَّتِهِ وَلَا يَتَكَلَّمُ يَوْمَئِذٍ الرُّسُلُ وَكَلَامُ الرُّسُلِ يَوْمَئِذٍ: اللَّهُمَّ سَلِّمْ سَلِّمْ. وَفِي جهنمَ كلاليب مثلُ شوك السعدان وَلَا يَعْلَمُ قَدْرَ عِظَمِهَا إِلَّا اللَّهُ تَخْطَفُ النَّاسَ بِأَعْمَالِهِمْ فَمِنْهُمْ مَنْ يُوبَقُ بِعَمَلِهِ وَمِنْهُمْ مَنْ يُخَرْدَلُ ثُمَّ يَنْجُو حَتَّى إِذَا فَرَغَ اللَّهُ مِنَ الْقَضَاءِ بَيْنَ عِبَادِهِ وَأَرَادَ أَنْ يُخْرِجَ مِنَ النَّارِ مَنْ أَرَادَ أَنْ يُخْرِجَهُ مِمَّنْ كَانَ يَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ أَمر الْمَلَائِكَة أَن يخرجُوا من يَعْبُدُ اللَّهَ فَيُخْرِجُونَهُمْ وَيَعْرِفُونَهُمْ بِآثَارِ السُّجُودِ وَحَرَّمَ اللَّهُ تَعَالَى عَلَى النَّارِ أَنْ تَأْكُلَ أَثَرَ السُّجُودِ فَكُلُّ ابْنِ آدَمَ تَأْكُلُهُ النَّارُ إِلَّا أَثَرَ السُّجُودِ فَيَخْرُجُونَ مِنَ النَّارِ قَدِ امْتَحَشُوا فَيُصَبُّ عَلَيْهِمْ مَاءُ الْحَيَاةِ فَيَنْبُتُونَ كَمَا تَنْبُتُ الْحِبَّةُ فِي حَمِيلِ السَّيْلِ وَيَبْقَى رَجُلٌ بَيْنَ الجنَّةِ والنارِ وَهُوَ آخرُ أهلِ النارِ دُخولاً الْجَنَّةَ مُقْبِلٌ بِوَجْهِهِ قِبَلَ النَّارِ فَيَقُولُ: يَا رب اصرف وَجْهي عَن النَّار فَإِنَّهُ قد قَشَبَنِي رِيحُهَا وَأَحْرَقَنِي ذَكَاؤُهَا. فَيَقُولُ: هَلْ عَسَيْتَ إِنْ أَفْعَلْ ذَلِكَ أَنْ تَسْأَلَ غَيْرَ ذَلِكَ؟ فَيَقُول: وَلَا وعزَّتكَ فيُعطي اللَّهَ مَا شاءَ اللَّهُ مِنْ عَهْدٍ وَمِيثَاقٍ فَيَصْرِفُ اللَّهُ وَجْهَهُ عَنِ النارِ فإِذا أقبلَ بِهِ على الجنةِ وَرَأى بَهْجَتَهَا سَكَتَ مَا شَاءَ اللَّهُ أَنْ يَسْكُتَ ثُمَّ قَالَ: يَا رَبِّ قَدِّمْنِي عِنْدَ بَابِ الجنةِ فَيَقُول الله تبَارك وَتَعَالَى: الْيَسْ أَعْطَيْتَ الْعُهُودَ وَالْمِيثَاقَ أَنْ لَا تَسْأَلَ غَيْرَ الَّذِي كُنْتَ سَأَلْتَ. فَيَقُولُ: يَا رَبِّ لَا أَكُونُ أَشْقَى خَلْقِكَ. فَيَقُولُ: فَمَا عَسَيْتَ إِنْ أُعْطِيتُ ذَلِكَ أَنْ تَسْأَلَ غَيْرَهُ. فَيَقُولُ: لَا وَعِزَّتِكَ لَا أَسْأَلُكَ غَيْرَ ذَلِكَ فَيُعْطِي رَبَّهُ مَا شَاءَ مِنْ عَهْدٍ وَمِيثَاقٍ فَيُقَدِّمُهُ إِلَى بَابِ الْجَنَّةِ فَإِذَا بَلَغَ بَابَهَا فَرَأَى زَهْرَتَهَا وَمَا فِيهَا مِنَ النَّضْرَةِ وَالسُّرُورِ فَسَكَتَ مَا شَاءَ اللَّهُ أَنْ يَسْكُتَ فَيَقُولُ: يَا رَبِّ أَدْخِلْنِي الْجَنَّةَ فَيَقُولُ اللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى: وَيْلَكَ يَا ابْنَ آدَمَ مَا أَغْدَرَكَ أَلَيْسَ قَدْ أَعْطَيْتَ الْعُهُودَ وَالْمِيثَاقَ أَنْ لَا تَسْأَلَ غَيْرَ الَّذِي أُعْطِيتَ. فَيَقُولُ: يَا رَبِّ لَا تَجْعَلْنِي أَشْقَى خَلْقِكَ فَلَا يَزَالُ يَدْعُو حَتَّى يَضْحَكَ اللَّهُ مِنْهُ فَإِذَا ضَحِكَ أَذِنَ لَهُ فِي دُخُولِ الْجَنَّةِ. فَيَقُولُ: تَمَنَّ فَيَتَمَنَّى حَتَّى إِذَا انْقَطَعَتْ أُمْنِيَّتُهُ قَالَ اللَّهُ تَعَالَى: تَمَنَّ مِنْ كَذَا وَكَذَا أَقْبَلَ يُذَكِّرُهُ رَبُّهُ حَتَّى إِذَا انْتَهَتْ بِهِ الْأَمَانِيُّ قَالَ اللَّهُ: لَكَ ذَلِكَ ومثلُه معَه وَفِي رِوَايَةِ أَبِي سَعِيدٍ: قَالَ اللَّهُ: لَكَ ذلكَ وعشرةُ أمثالِه . مُتَّفق عَلَيْهِ
متفق علیہ ، رواہ البخاری (806) و مسلم (299 / 182)، (451) ۔
(متفّق عَلَيْهِ)
ব্যাখ্যা: ইতোপূর্বে ৫৫৭৯ নং হাদীসে যা অতিবাহিত হয়েছে এখানেও তাই বিবৃত হয়েছে। জাহান্নামের উপর পুলসিরাত ব্রীজ স্থাপন করা হবে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, আমিই সর্বপ্রথম ব্যক্তি যে তার উম্মতসহ ঐ ব্রীজ অতিক্রমকারী হব। অর্থাৎ আমার আগে কোন নবীই তার উম্মতকে নিয়ে ঐ পুলসিরাত পাড়ি দিতে পারবে না। সেই স্থানে রাসূলগণ ছাড়া কেউ আল্লাহর সাথে কথাও বলতে পারবে না। ইবনুল মালিক (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, (يِوْمَئِذٍ) দ্বারা পুলসিরাত পার হওয়ার সময় উদ্দেশ্য, সেখানে মানুষের কথা বলার জায়গা নয়। মহান আল্লাহ বলেন, (هٰذَا یَوۡمُ لَا یَنۡطِقُوۡنَ) “এটা সেদিন হবে যেদিন তারা কথা বলতেও পারবে না।” (সূরা আল মুরসালাত ৭৭: ৩৫)
কিন্তু পাশেই অন্যান্য অবস্থানস্থলে লোকেরা কথা বলবে। সেদিন পুলসিরাতের ঘাটে কথা না বলার বিষয়টি তাগিদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। রাসূলগণ সেখানে শুধু বলতে থাকবেন, “আল্ল-হুম্মা সাল্লিম সাল্লিম”, “হে আল্লাহ! শান্তি দাও, শান্তি দাও।”
জাহান্নামের মধ্যে সাদানের কাঁটার মতো কাটাদার বিরাট বিরাট আংটা থাকবে সেগুলো জাহান্নামের চতুর্দিকে থাকবে। অথবা সেগুলো পুলসিরাতের সাথে ঝুলানো থাকবে, গুনাহগারেরা পুলসিরাত পার হতে কেটে কেটে জাহান্নামের ঐ কাঁটার সাথে আটকে যাবে।
(كَلَالِيْبُ) শব্দটি গায়রি মুনসরিফ, এটা প্রান্তিক জুমু'আহ্, অর্থ চারদিকে লোহার বাকা আলযুক্ত মাথা বের করে তৈরি করা বস্তু। তা দ্বারা মানুষকে আটকানো হবে অথবা গুনাহগারদের মাংসের সাথে আটকিয়ে (জাহান্নামের) তন্দুরে ঝুলিয়ে রাখা হবে।
(شَوْكِ السَّعْدَانِ) “সা'দান বৃক্ষের কাটা” আরবের প্রসিদ্ধ সা'দান বৃক্ষ, যার রয়েছে বড় বড় কাঁটা। এটা গঠনের সাদৃশ্য মাত্র, আকারের নয়, তার আকার বা প্রকাণ্ডতা যে কত বড় তা আল্লাহ তা'আলাই ভালো জানেন। মানুষকে তার খারাপ আমল অনুপাতে ঐ কাঁটা আটকিয়ে ধরবে। কেউ একেবারে আটকে থাকবে এবং ধ্বংস হয়ে যাবে। কেউ আবার কেটে টুকরা টুকরা বা রেযা রেযা হয়ে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে (অবশ্য অনেকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে)।
অতঃপর আল্লাহ তা'আলা বিচার-ফায়সালা শেষ করে একত্ববাদের সাক্ষ্য দানকারী হওয়া সত্ত্বেও খারাপ আমলের কারণে যারা জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হয়েছে তাদের জাহান্নাম থেকে বের করার ইচ্ছা করবেন। আর মালায়িকার (ফেরেশতাগণের) নির্দেশ করবেন যে, যারা এক আল্লাহর ইবাদত করেছে তাদের বের কর। এখানে এক আল্লাহর ইবাদত বলতে তার তাওহীদ স্বীকার করা এবং তাওহীদ চেনা অথবা তাওহীদের দাবী পূরণে যে ইবাদত সঠিক সেই ‘ইবাদত করা। (অনেক মানুষ আছেন যারা অন্তরে তাওহীদের বিশ্বাস ও দাবী সঠিক থাকলেও ‘ইবাদতে শির্ক করে ফেলে, তারা এ সুযোগের অন্তর্ভুক্ত হবে না) মালায়িকাহ্ সিজদার চিহ্ন দেখে দেখে তাদের জাহান্নাম থেকে বের করবেন। যেমন- মহান আল্লাহর বাণী:
(سِیۡمَاهُمۡ فِیۡ وُجُوۡهِهِمۡ مِّنۡ اَثَرِ السُّجُوۡدِ) “তাদের চিহ্নগুলো তাদের মুখমণ্ডলে সিজদার কারণে পরিস্ফুট হয়ে থাকবে।” (সূরা আল ফাতহ ৪৮: ২৯)।
আল্লাহ তা'আলা সিজদার স্থানকে পোড়ানো জাহান্নামের আগুনের উপর হারাম করে দিয়েছেন। ইমাম নাবাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, হাদীসের দ্বারা এ কথা স্পষ্ট যে, জাহান্নামের আগুন সিজদার সাতটি অঙ্গের কোন কিছু ভক্ষণ করতে পারবে না। সে সাতটি অঙ্গ হলো: (নাকসহ) কপাল, দুই হাত, দুই হাঁটু ও দুই পা।
কাযী “ইয়ায (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, সিজদার চিহ্ন বলতে শুধু কপালকেই খাস করা হয়েছে। মুল্লা আলী কারী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, প্রথম মতটিই অধিক যুক্তিযুক্ত। অবশ্য দ্বিতীয় মতটির সপক্ষে হাদীসের প্রমাণ বিদ্যমান রয়েছে।
গুনাহগার সালাত আদায়কারীদের সিজদার চিহ্ন দেখে জাহান্নাম থেকে তুলে তুলে আবে হায়াতে গোসল করিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করানোর পরও এক ব্যক্তি জান্নাত এবং জাহান্নামের মাঝখানে আ'রাফ নামক স্থানে থাকবে। এ ব্যক্তি হবে জাহান্নাম থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত সর্বশেষ ব্যক্তি এবং সর্বশেষে জান্নাতে প্রবেশকারী। এ ব্যক্তির মুখ জাহান্নামের দিকে রাখা হবে। তখন সে মহামহিম দয়াময় আল্লাহর কাছে পর্যায়ক্রমে আবেদন করে এবং আবেদন পূর্ণ হলে আর আল্লাহর কাছে কিছু চাইবে না বলে পাকা ওয়া'দা দিবে, কিন্তু ধীরে ধীরে জান্নাতের দরজায় পৌছে তার নিআমাতরাজি দর্শন করে ধৈর্য ধরে থাকতে পারবে না, অতঃপর জান্নাতে প্রবেশের আবেদন জানাবে। এ বান্দার বার বার ওয়াদা ভঙ্গ এবং জান্নাতে প্রবেশের মিনতি দেখে আল্লাহ তা'আলা হেসে দিবেন এবং জান্নাতে প্রবেশের অনুমতি দিবেন।
জান্নাতে প্রবেশের পর আল্লাহ তা'আলা তাকে বলবেন, তুমি তোমার মনের চাহিদা মতো চাও, সে চাইতে থাকবে, এমনকি তার আকাক্ষা চাহিদা শেষ হয়ে যাবে তখন আল্লাহ তা'আলা তাকে বিভিন্ন নি'আমাতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলবেন, এটা চাও, ওটা চাও। এটাও যখন শেষ হয়ে যাবে তখন আল্লাহ বলবেন, এসবগুলো তোমার অনুরূপ আরো সমপরিমাণ দেয়া হলো।
আবূ সা'ঈদ (রাঃ)-এর বর্ণনায় আছে, তোমার জন্য তোমার চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষা পরিমাণ এবং অনুরূপ আরো দশগুণ দেয়া হলো। (মিরকাতুল মাফাতীহ, ফাতহুল বারী ১১ খণ্ড, ৫০৪ পৃ., শারহুন নাবাবী ৩য় খণ্ড, হা, ২৯৯)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - হাওযে কাওসার ও শাফাআতের বর্ণনা
৫৫৮২-[১৭] ইবনু মাস্’উদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: সর্বশেষ যে লোক জান্নাতে প্রবেশ করবে, সে জাহান্নাম থেকে বের হওয়ার সময় একবার চলবে, একবার সম্মুখের দিকে ঝুঁকে পড়বে এবং আরেকবার আগুন তাকে জ্বালিয়ে দেবে। অতঃপর যখন (এ অবস্থায়) সে জাহান্নামের সীমানা অতিক্রম করে আসবে, তখন তার দিকে তাকিয়ে বলবে, বড়ই কল্যাণময় সেই মহান প্রভু! যিনি আমাকে তোমার থেকে মুক্তি দান করেছেন। নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা আমাকে এমন কিছু দান করেছেন, যা আগের ও পিছনের কোন লোককেই তা প্রদান করেননি। অতঃপর তার সামনে একটি বৃক্ষ প্রকাশ করা হবে। তখন সে বলবে, হে আমার প্রভু! আমাকে ঐ গাছটির কাছে পৌছিয়ে দিন যাতে আমি তার নিচে ছায়া হাসিল করি এবং তার ঝরনা থেকে পানি পান করি। তখন আল্লাহ তা’আলা বলবেন, হে আদম সন্তান! যদি আমি তোমাকে তা প্রদান করি তখন হয়তো তুমি আমার কাছে অন্য কিছু চাইতে থাকবে। সে বলবে, হে আমার প্রভু! আর সে আল্লাহর সাথে এ ওয়াদা-অঙ্গীকার করবে যে, তা ছাড়া সে আর কিছুই চাইবে না। অথচ তার অধৈর্য ও অস্থিরতা দেখে আল্লাহ তা’আলা তাকে অসহায় অবস্থায় পেয়ে তার মনোকাংখা পূরণ করবেন। তখন তাকে উক্ত গাছের কাছে পৌছিয়ে দেবেন। অতঃপর আরেকটি গাছ প্রকাশ পাবে যা প্রথমটি অপেক্ষা উত্তম। তখন সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে ঐ গাছটির কাছাকাছি করে দিন, যেন আমি সেখানে ঝরনার পানি পান করতে পারি এবং তার ছায়ায় বিশ্রাম নিতে পারি, এটা ছাড়া আমি অন্য আর কিছু তোমার কাছে চাব না।
তখন আল্লাহ তা’আলা বলবেন, হে আদম সন্তান। তুমি কি আমার সাথে এই প্রতিশ্রুতি দাওনি যে, তোমাকে যা কিছু দেয়া হয়েছে তুমি তা ছাড়া আর কিছুই চাবে না? আল্লাহ তা’আলা আরো বলবেন, এমনও তো হতে পারে, যদি আমি তোমাকে তার কাছে পৌছিয়ে দেই, তখন তুমি অন্য আরো কিছু চেয়ে বসবে? তখন সে এই প্রতিশ্রুতি দেবে যে, সে তা ছাড়া আর কিছুই চাবে না। আল্লাহ তা’আলা তাকে অক্ষম মনে করবেন। কেননা তিনি ভালোভাবে অবগত আছেন যে, ঐখানে যাওয়ার পর সে যা কিছু দেখতে পাবে, তাতে সে লোভ সামলাতে পারবে না। পরিশেষে আল্লাহ তা’আলা তাকে তার নিকটবর্তী করে দেবেন।
সে তার ছায়ায় আরাম উপভোগ করবে এবং পানি পান করবে। অতঃপর জান্নাতের দরজার কাছে এমন একটি গাছ প্রকাশ করবেন, যা প্রথম দুটির তুলনায় উত্তম। তা দেখে সে বলবে, হে আমার প্রভু! আমাকে ঐ গাছটির কাছে পৌছিয়ে দিন যাতে আমি তার ছায়া উপভোগ করি এবং তার পানি পান করি। তা ছাড়া আর কিছুই তোমার কাছে চাব না।
তখন আল্লাহ তা’আলা বলবেন, হে আদম সন্তান! তুমি কি আমার সাথে এ অঙ্গীকার করনি যে, তোমাকে যা কিছু দেয়া হয়েছে, তুমি তা ছাড়া আর কিছুই চাবে না? সে বলবে, হ্যাঁ, অঙ্গীকার তো করেছিলাম, তবে হে আমার প্রভু! আমার এ আকাঙ্ক্ষাটি পূরণ করে দাও, এরপর আমি আর কিছুই তোমার কাছে চাব না এবং আল্লাহ তা’আলা তাকে অক্ষম জানবেন। কেননা তিনি জানেন, এরপর সে যা কিছু দেখতে পাবে, তাতে সে ধৈর্যধারণ করতে পারবে না। তখন তাকে তার কাছাকাছি করে দেয়া হবে। যখন সে গাছটির কাছে যাবে, জান্নাতবাসীদের শব্দ শুনতে পাবে তখন বলবে, হে আমার প্রভু! আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দিন। তখন আল্লাহ তা’আলা বলবেন, হে আদম সন্তান! আমার কাছে তোমার চাওয়া কখন শেষ হবে? আচ্ছা, তুমি কি এতে সন্তুষ্ট হবে যে, আমি তোমাকে দুনিয়ার সমপরিমাণ জায়গা এবং তার সাথে অনুরূপ জায়গাও তোমাকে জান্নাতে প্রদান করি? তখন লোকটি বলবে, হে প্রভু! তুমি সমস্ত জাহানের প্রভু হয়েও আমার সাথে ঠাট্টা করছ? এ কথা বলার পর ইবনু মাস্’উদ (রাঃ) হাসলেন। অতঃপর বলেন, তোমরা আমাকে কেন প্রশ্ন করছ না যে, আমার হাসার কারণ কী? তখন তারা প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা, বলুন তো আপনি কেন হাসলেন? তিনি বললেন, এভাবে রাসূলুল্লাহ (সা.) হেসেছিলেন।
তখন সাহাবীগণ প্রশ্ন করেছিলেন, হে আল্লাহর রাসূল! কিসে আপনাকে হাসালো? উত্তরে তিনি বললেন, যখন ঐ লোকটি বলল, তুমি রাব্বুল আলামীন হয়েও আমার সাথে ঠাট্টা করছ?’ তখন স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা হেসে ফেলবেন, অতঃপর আল্লাহ তা’আলা বলবেন, আমি তোমার সাথে ঠাট্টা করছি না, বরং আমি যা চাই তা করতে সক্ষম। (মুসলিম)
الفصل الاول (بَاب الْحَوْض والشفاعة )
وَعَنِ ابْنِ مَسْعُودٍ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: آخِرُ مَنْ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ رَجُلٌ يَمْشِي مَرَّةً وَيَكْبُو مَرَّةً وَتَسْفَعُهُ النارُ مرّة فإِذا جاؤوها الْتَفَتَ إِلَيْهَا فَقَالَ: تَبَارَكَ الَّذِي نَجَّانِي مِنْكِ لَقَدْ أَعْطَانِي اللَّهُ شَيْئًا مَا أَعْطَاهُ أَحَدًا مِنَ الْأَوَّلِينَ وَالْآخِرِينَ فَتُرْفَعُ لَهُ شَجَرَةٌ فَيَقُولُ: أَيْ رَبِّ أَدْنِنِي مِنْ هَذِهِ الشَّجَرَةِ فَلْأَسْتَظِلَّ بِظِلِّهَا وَأَشْرَبَ مِنْ مَائِهَا فَيَقُولُ اللَّهُ: يَا ابْنَ آدَمَ لَعَلِّي إِنْ أَعْطَيْتُكَهَا سَأَلْتَنِي غَيْرَهَا؟ فَيَقُولُ: لَا يَا رَبِّ وَيُعَاهِدُهُ أَنْ لَا يَسْأَلَهُ غَيْرَهَا وَرَبُّهُ يَعْذُرُهُ لِأَنَّهُ يَرَى مَا لَا صَبْرَ لَهُ عَلَيْهِ فَيُدْنِيهِ مِنْهَا فَيَسْتَظِلُّ بِظِلِّهَا وَيَشْرَبُ مِنْ مَائِهَا ثُمَّ تُرْفَعُ لَهُ شَجَرَةٌ هِيَ أَحْسَنُ مِنَ الْأُولَى فَيَقُولُ: أَيْ رَبِّ أَدْنِنِي مِنْ هَذِهِ الشَّجَرَةِ لِأَشْرَبَ مِنْ مَائِهَا وَأَسْتَظِلَّ بِظِلِّهَا لَا أَسْأَلُكَ غَيْرَهَا. فَيَقُولُ: يَا ابْنَ آدَمَ أَلَمْ تُعَاهِدْنِي أَنْ لَا تَسْأَلَنِي غَيْرَهَا؟ فَيَقُولُ: لَعَلِّي إِنْ أَدْنَيْتُكَ مِنْهَا تَسْأَلُنِي غَيْرَهَا؟ فَيُعَاهِدُهُ أَنْ لَا يَسْأَلَهُ غَيْرَهَا وَرَبُّهُ يَعْذُرُهُ لِأَنَّهُ يَرَى مَا لَا صَبْرَ لَهُ عَلَيْهِ فَيُدْنِيهِ مِنْهَا فَيَسْتَظِلُّ بِظِلِّهَا وَيَشْرَبُ مِنْ مَائِهَا ثُمَّ تُرْفَعُ لَهُ شَجَرَةٌ عِنْدَ بَابِ الْجَنَّةِ هِيَ أَحْسَنُ مِنَ الْأُولَيَيْنِ فَيَقُولُ: أَيْ رَبِّ أَدْنِنِي مِنْ هَذِهِ فَلِأَسْتَظِلَّ بِظِلِّهَا وَأَشْرَبَ مِنْ مَائِهَا لَا أَسْأَلُكَ غَيْرَهَا. فَيَقُولُ: يَا ابْنَ آدَمَ أَلَمْ تُعَاهِدْنِي أَنْ لَا تَسْأَلَنِي غَيْرَهَا؟ قَالَ: بَلَى يَا رَبِّ هَذِهِ لَا أَسْأَلُكَ غَيْرَهَا وَرَبُّهُ يَعْذُرُهُ لِأَنَّهُ يَرَى مَا لَا صَبْرَ لَهُ عَلَيْهِ فَيُدْنِيهِ مِنْهَا فَإِذَا أَدْنَاهُ مِنْهَا سَمِعَ أَصْوَاتَ أَهْلِ الْجَنَّةِ فيقولُ: أَي رَبِّ أَدْخِلْنِيهَا فَيَقُولُ: يَا ابْنَ آدَمَ مَا يصريني مِنْك؟ أيرضيك أَن أُعْطِيك الدُّنْيَا وَمِثْلَهَا مَعَهَا. قَالَ: أَيْ رَبِّ أَتَسْتَهْزِئُ مِنِّي وَأَنْتَ رَبُّ الْعَالَمِينَ؟ فَضَحِكَ ابْنُ مَسْعُودٍ فَقَالَ: أَلا تسألونيّ ممَّ أضْحك؟ فَقَالُوا: مِم تضحك؟ فَقَالَ: هَكَذَا ضَحِكَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ. فَقَالُوا: مِمَّ تَضْحَكُ يَا رَسُولَ اللَّهِ؟ قَالَ: من ضحك رَبُّ الْعَالَمِينَ؟ فَيَقُولُ: إِنِّي لَا أَسْتَهْزِئُ مِنْكَ وَلَكِنِّي على مَا أَشَاء قدير . رَوَاهُ مُسلم
رواہ مسلم (310 / 187)، (463) ۔
(صَحِيح)
ব্যাখ্যা: পূর্বের হাদীসে সর্বশেষ জাহান্নাম থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত এবং সর্বশেষে জান্নাতে প্রবেশকারী ব্যক্তির বিবরণ বর্ণিত হয়েছে। অত্র হাদীসেও সামান্য বর্ণনা পার্থক্যে অনুরূপ ঘটনাই বর্ণিত হয়েছে।
এ লোক জাহান্নামের সীমানা পার হয়ে এসে জান্নাত ও জাহান্নামের মাঝখানে বসেই আল্লাহর প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে। সে মনে করবে আল্লাহ তা'আলা আমাকে যা দান করেছেন পূর্বাপর কাউকেই তা দান করেননি।
এ ব্যক্তির নিকট পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন আরামদায়ক বৃক্ষ প্রকাশ করা হবে আর সে তা থেকে ফায়দা নেয়ার আবেদন পেশ করবে। সেটা দেয়া হলে সে যেন আর কিছু না চায় সেই ওয়া'দা ও চুক্তির ভিত্তিতে তাকে দেয়া হবে কিন্তু বান্দা সে ওয়াদা বেমালুম ভুলে আবারও পরবর্তী অধিক সুন্দর ও আরামদায়ক বৃক্ষের নিকট যাওয়ার আবেদন করবে। এভাবে আবেদন করতে করতে একসময় সে জান্নাতেই প্রবেশ করে ফেলবে। আল্লাহ তা'আলা সেই জান্নাতে তার চাহিদার চেয়েও অধিক দান করবেন, এমনকি নিম্নের বর্ণনা মতে দশগুণ বেশি। আল্লাহ তা'আলা এ বান্দার চাওয়া-পাওয়া দেখে হাসবেন। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ, শারহুন নাবাবী ৩য় খণ্ড, ৪৩ পৃ. হা. ৩১০)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - হাওযে কাওসার ও শাফাআতের বর্ণনা
৫৫৮৩-[১৮] (সহীহ মুসলিম-এর) অপর এক বর্ণনায় আবূ সাঈদ আল খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। আল্লাহর উক্তি, “হে আদম সন্তান! কবে নাগাদ আমি তোমার চাহিদা থেকে রেহাই পাব? তা থেকে শেষ পর্যন্ত হাদীসের অংশটি তিনি বর্ণনা করেননি। অবশ্য এ কথাগুলো বেশি আছে যে, আল্লাহ তা’আলা তাকে স্মরণ করিয়ে বলবেন, তুমি আমার কাছে এটা চাও, ওটা চাও। সবশেষে যখন তার আকাঙ্ক্ষা ফুরিয়ে যাবে, তখন আল্লাহ তা’আলা বলবেন, যাও, তোমার চাহিদানুযায়ী যা তা তো তোমাকে দিলামই এবং অনুরূপ আরো দশগুণ প্রদান করলাম। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: সে জান্নাতে তার ঘরে প্রবেশ করবে এবং সাথে প্রবেশ করবে হুরুল’ঈন (ডাগর নয়নাবিশিষ্ট) থেকে তার দু’জন স্ত্রী। তখন হূরদ্বয় বলবে, সকল প্রশংসা সেই আল্লাহর জন্য যিনি তোমাকে আমাদের জন্য এবং আমাদেরকে তোমার জন্য জীবিত রেখেছেন। তিনি (সা.) এটাও বলেছেন, তখন লোকটি বলবে, আমাকে যা কিছু দেয়া হয়েছে, তা আর কাউকেও দেয়া হয়নি।
الفصل الاول (بَاب الْحَوْض والشفاعة )
وَفِي رِوَايَة لَهُ عَن أبي سعيدٍ نَحْوَهُ إِلَّا أَنَّهُ لَمْ يَذْكُرْ فَيَقُولُ: يَا ابْنَ آدَمَ مَا يَصْرِينِي مِنْكَ؟ إِلَى آخِرِ الْحَدِيثِ وَزَادَ فِيهِ: وَيَذْكُرُهُ اللَّهُ: سَلْ كَذَا وَكَذَا حَتَّى إِذَا انْقَطَعَتْ بِهِ الْأَمَانِيُّ قَالَ اللَّهُ: هُوَ لَكَ وَعَشَرَةُ أَمْثَالِهِ قَالَ: ثُمَّ يَدْخُلُ بَيْتَهُ فَتَدْخُلُ عَلَيْهِ زَوْجَتَاهُ مِنَ الْحُورِ الْعِينِ فَيَقُولَانِ: الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَحْيَاكَ لَنَا وَأَحْيَانَا لَكَ. قَالَ: فَيَقُولُ: مَا أَعْطَى أَحَدٌ مثلَ مَا أَعْطَيْت
رواہ مسلم (311 / 188)، (464) ۔
(صَحِيح)
ব্যাখ্যা: এ হাদীসের ব্যাখ্যা পূর্বের হাদীসের মতোই। আল্লাহ তা'আলা এই সর্বশেষ জান্নাতে প্রবেশকারীকে জান্নাতের সাধারণ নি'আমাতরাজী দেয়ার পরও নিজের পক্ষ থেকে তাকে জান্নাতের বিভিন্ন নি'আমাতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলবেন, এটা চাও ওটাও। এমনকি তার আশা-আকাঙ্ক্ষা ও চাহিদা শেষ হয়ে গেলে আল্লাহ বলবেন, যাও এগুলো তোমার জন্য এর সাথে আরো এর দশগুণ।
এরপর ঐ বান্দা যখন তার বালাখানায় প্রবেশ করবে তখন তাঁর নিকট হুরুল'ঈন থেকে দু’জন স্ত্রী তার কক্ষে প্রবেশ করবে। তারা বলবে, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি আপনাকে আমাদের জন্য জীবিত করেছেন এবং আমাদেরকে আপনার জন্য জীবিত করেছেন।
এখানে জীবিত করার অর্থ সৃষ্টি করা। জীবিত শব্দটি চিরস্থায়ী জান্নাতে রাখার অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কেননা আল্লাহ তাদেরকে সেখানে মিলিত করে দিয়েছে যেখানে আর কোন মৃত নেই, আনন্দই শুধু কষ্ট নেই, চিরস্থায়ী জীবন আর আনন্দ। আল্লাহ বলেন, (وَ اِنَّ الدَّارَ الۡاٰخِرَۃَ لَهِیَ الۡحَیَوَانُ...)
“নিশ্চয় আখিরাতের জীবনই প্রকৃত জীবন...।” (সূরা আল আনকাবুত ২৯: ৬৪)
এসব পেয়ে লোকটি বলবে, আমাকে যা দেয়া হলো এ পরিমাণ আর কাউকেই দেয়া হয়নি। এ কথা বলবে সে তার ধারণা অনুসারে, অন্যথায় অন্যকে যে আরো বেশি দেয়া হয়েছে কিন্তু সে সম্পর্কে তার ধারণা এবং অবগতি না থাকায় এ কথা বলবে। (মিরকাতুল মাফাতীহ, শারহুন নাবাবী ৩য় খণ্ড, ৪৪ পৃ. হা. ৩১১)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - হাওযে কাওসার ও শাফাআতের বর্ণনা
৫৫৮৪-[১৯] আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী (সা.) বলেছেন: কিছু সংখ্যক লোক তাদের কৃত গুনাহের কারণে শাস্তিস্বরূপ জাহান্নামের আগুনে জ্বলে যাবে। অতঃপর আল্লাহ তা’আলা তাঁর রহমত ও দয়ায় তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। তবে সেখানে তাদেরকে জাহান্নামী বলে ডাকা হবে। (বুখারী)
الفصل الاول (بَاب الْحَوْض والشفاعة )
وَعَن أنس أَن النَّبِي الله صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: لَيُصِيبَنَّ أَقْوَامًا سَفْعٌ مِنَ النَّارِ بِذُنُوبٍ أَصَابُوهَا عُقُوبَةً ثُمَّ يُدْخِلُهُمُ اللَّهُ الْجَنَّةَ بِفَضْلِهِ وَرَحْمَتِهِ فَيُقَالُ لَهُمُ: الجهنميون . رَوَاهُ البُخَارِيّ
رواہ البخاری (6559) ۔
(صَحِيح)
ব্যাখ্যা: অত্র হাদীসটি ইতোপূর্বে বর্ণিত শাফা'আত সংক্রান্ত যত হাদীস অতিবাহিত হয়েছে তার সারসংক্ষেপ কথা। গুনাহগার মু'মিনেরা যারা তাদের পাপের কারণে জাহান্নামে পতিত হবে, তারা ঈমান থাকার কারণে সকলেই আল্লাহর অনুগ্রহে এবং রহমতে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করবে। জাহান্নাম থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত এবং জান্নাত লাভে ধন্য এদেরকে জান্নাতের মধ্যেও জাহান্নামী হিসেবে অভিহিত করা হবে। আল্লামাহ্ ত্বীবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, এ নাম তাদের খাটো করার জন্য নয়, বরং তাদের (অতীতের কথা) স্মরণ করানোর জন্য যাতে তারা খুশি ও আনন্দের পর আরো বেশি আনন্দিত হয়। আর আল্লাহর শাস্তি থেকে মুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে সেটা একটি প্রতীক হয়।
(মিরক্বাতুল মাফাতীহ, ফাতহুল বারী ১১ খণ্ড, ৪৮৪ পৃ., হা. ৬৫৫৯; তুহফাতুল আহওয়াযী ৬ষ্ঠ খণ্ড, ৫১১ পৃ.)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - হাওযে কাওসার ও শাফাআতের বর্ণনা
৫৫৮৫-[২০] ইমরান ইবনু হুসায়ন (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: একদল মানুষকে মুহাম্মাদ (সা.) -এর শাফা’আতে জাহান্নাম থেকে বের করা হবে। অতঃপর তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের নাম রাখা হবে জাহান্নামী। (বুখারী)
অপর এক বর্ণনায় আছে, তিনি (সা.) বলেছেন: আমার উম্মতের একদল লোক আমার সুপারিশে জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করবে। তাদেরকে জাহান্নামী নামে ডাকা হবে।
الفصل الاول (بَاب الْحَوْض والشفاعة )
وَعَنْ عِمْرَانَ بْنِ حُصَيْنٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «يَخْرُجُ أَقْوَامٌ مِنَ النَّارِ بِشَفَاعَةِ مُحَمَّدٍ فَيَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ وَيُسَمَّوْنَ الْجَهَنَّمِيِّينَ» . رَوَاهُ الْبُخَارِيُّ وَفِي رِوَايَةٍ: «يَخْرُجُ قَوْمٌ مِنْ أُمَّتِي مِنَ النَّارِ بِشَفَاعَتِي يُسَمَّوْنَ الْجَهَنَّمِيِّينَ»
رواہ البخاری (6566) و الترمذی (2600) ۔
(صَحِيح)