পরিচ্ছেদঃ ৩. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - চুল আঁচড়ানো
৪৪৩৭-[১৯] ’আবদুল্লাহ ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের গোঁফ কাটতেন অথবা বলেছেনঃ তা ছাঁটতেন। আল্লাহর বন্ধু ’ইব্রাহীম (আ.)-ও এরূপ করতেন। (তিরমিযী)[1]
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ: كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُصُّ أَوْ يَأْخُذُ مِنْ شَارِبِهِ وَكَانَ إِبْرَاهِيمُ خَلِيلُ الرَّحْمَنِ صَلَوَاتُ الرَّحْمَنِ عَلَيْهِ يَفْعَله. رَوَاهُ التِّرْمِذِيّ
ব্যাখ্যাঃ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গোঁফ কর্তন বা মুণ্ডন করতেন। এটি বর্ণনাকারীর সন্দেহ। তবে আমরা অন্যান্য হাদীসে দেখেছি যে, গোঁফের বেলায় কর্তন ছিল রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ‘আমল। তবে কর্তন বা মুণ্ডন যাই হোক এটি ইবরাহীম (আ.) করতেন বলে হাদীসে উল্লেখ রয়েছে। গোঁফ কর্তন ইবরাহীম (আ.)-এর কর্ম বলে উল্লেখ করার উদ্দেশ্য হলো, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ক্ষেত্রে তাঁর পিতা ইবরাহীম (আ.)-এর অনুকরণ করতেন। (তুহফাতুল আহ্ওয়াযী ৭ম খন্ড, হাঃ ২৭৬০)
পরিচ্ছেদঃ ৩. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - চুল আঁচড়ানো
৪৪৩৮-[২০] যায়দ ইবনু আরকাম (রাঃ) হতে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি গোঁফ ছাঁটে না, সে আমাদের অন্তরভুক্ত নয়। (আহমাদ, তিরমিযী ও নাসায়ী)
وَعَنْ زَيْدِ بْنِ أَرْقَمَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «مَنْ لَمْ يَأْخُذ شَارِبِهِ فَلَيْسَ مِنَّا» . رَوَاهُ أَحْمَدُ وَالتِّرْمِذِيُّ وَالنَّسَائِيُّ
ব্যাখ্যাঃ مَنْ لَمْ يَأْخُذ شَارِبِه فَلَيْسَ مِنَّا অর্থ- যে গোঁফ কর্তন করল না সে আমাদের মধ্য থেকে নয়। এ জাতীয় বাক্য বলে সাধারণত ‘আমাদের দলভুক্ত নয়’ উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। তবে কেবল গোঁফ কর্তন না করার ক্ষেত্রে কেউ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উম্মাত থেকে বা মুসলিমদের দল থেকে বের হয় না; তাই ‘উলামায়ে কিরাম এ হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেনঃ আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়, অর্থাৎ এই কর্মে সে আমাদের মোতাবিক নয়, অথবা এর অর্থ : আমাদের পদ্ধতির যারা পরিপূর্ণ অনুসারী সে তাদের মধ্য থেকে নয়। আবার ধমকি স্বরূপও রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনটি বলতে পারেন। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
‘আল্লামা মুবারকপূরী (রহিমাহুল্লাহ) গোঁফ কর্তনের পরিমাণের ক্ষেত্রে যে মতভেদ উল্লেখ করেন তার সারাংশ হলো, সালাফের অনেকের নিকট গোঁফ একেবারে মূল বা জড় থেকে কাটা এবং মুণ্ডন করে নেয়া উত্তম। তারা তাদের মতের পক্ষ গোঁফ কর্তনের বেলায় রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীস انهكوا الشوارب এবং أحْفُوا الشَّوَارِبَ দিয়ে দলীল পেশ করেন। উভয় শব্দের অর্থ হলো কর্তনে মুবালাগাহ্ বা আধিক্যতা অবলম্বন করা। আর অধিক আধিক্যতা মু-নের মধ্য দিয়ে অর্জন হবে। অপরদিকে ইমাম মালিকসহ অনেকে মুণ্ডন ও একেবারে জড় থেকে কাটা বারণ করেন। তাদের মতে গোঁফ কাচি দিয়ে কেটে ছোট করাটাই সুন্নাত। আবার ইমাম নাবাবী (রহিমাহুল্লাহ) একদল ‘আলিম থেকে উভয় মতের অবকাশ বর্ণনা করেন। অর্থাৎ গোঁফ কর্তন বা মুণ্ডন উভয়টারই সুযোগ রয়েছে। (তুহফাতুল আহ্ওয়াযী ৭ম খন্ড, হাঃ ২৭৬০)
পরিচ্ছেদঃ ৩. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - চুল আঁচড়ানো
৪৪৩৯-[২১] ’আমর ইবনু শু’আয়ব (রহঃ) তাঁর পিতা হতে, তিনি তাঁর দাদা হতে বর্ণনা করেন : নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় দাড়ির প্রস্থ এবং দৈর্ঘ্য হতে ছেঁটে নিতেন। (তিরমিযী এবং তিনি বলেছেনঃ এ হাদীসটি গরীব)[1]
হাদীসটি মাওযূ‘ হওয়ার কারণ, এর সনদে আছে ‘‘উমার ইবনু হারূন আল বালখী’’। তাঁর ব্যাপারে ইবনু মা‘ঈন বলেনঃ মিথ্যুক, খবীস। সলিহ জাযরাহ্ বলেনঃ সে কায্যাব বা মিথ্যুক। বিস্তারিত দেখুন- সিলসিলাতুয্ য‘ঈফাহ্ ১/৪৫৭ পৃঃ, হাঃ ২৮৮।
وَعَنْ عَمْرِو بْنِ شُعَيْبٍ عَنْ أَبِيهِ عَنْ جَدِّهِ: أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَأْخُذُ مِنْ لِحْيَتِهِ مِنْ عَرْضِهَا وَطُولِهَا. رَوَاهُ التِّرْمِذِيُّ وَقَالَ: هَذَا حَدِيثٌ غَرِيبٌ
ব্যাখ্যাঃ (هٰذَا حَدِيثٌ غَرِيبٌ) হাদীসটি দুর্বল। কেননা এর ভিত্তি হলো ‘উমার ইবনু হারূন-এর ওপর। আর মুহাদ্দিসীনে কিরামের মতে তিনি পরিত্যাজ্য। ‘আল্লামা ইবনু হাজার ফাতহুল বারীতে এ হাদীসটি উল্লেখের পর বলেন, হাদীসটি ইমাম তিরমিযী বর্ণনা করেন এবং এর সম্পর্কে বুখারীর মত বর্ণনা করেন যে, ইমাম বুখারী ‘উমার ইবনু হারূন-এর বর্ণনার ক্ষেত্রে বলেন, তার এ হাদীস ছাড়া আমি অন্য কোন মুনকার হাদীস পাইনি। (তুহফাতুল আহ্ওয়াযী ৭ম খন্ড, হাঃ ২৭৬০)
দাড়ি একমুষ্টি পার হলে তা কাটা বৈধ অবৈধের আলোচনা অধ্যায়ের শুরুতে করা হয়েছে। ইবনু ‘উমার (রাঃ) থেকে বিশুদ্ধভাবে প্রমাণের ভিত্তিতে অধিকাংশ ‘আলিম তা কাটা বৈধ মনে করেন। আবার রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এক মুষ্টির উপরে কাটা প্রমাণিত নয় বলে অনেকে তা বৈধ মনে করেন না। বর্ণিত হাদীসটি বিশুদ্ধ হলে এই মতভেদের মীমাংসা হয়ে যেত। কিন্তু হাদীসটি বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় এ হাদীস দিয়ে কেউই দাড়ি এক মুষ্টির উপর হলে কর্তন জায়িয প্রমাণ করেন না। বরং যারা বৈধ হওয়ার পক্ষ তারা ইবনু ‘উমার -এর কর্ম দিয়ে দলীল পেশ করেন। তাই দাড়ি না কাটার মাঝেই অধিক সতর্কতা এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।
পরিচ্ছেদঃ ৩. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - চুল আঁচড়ানো
৪৪৪০-[২২] ইয়া’লা ইবনু মুররাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। একদিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার (শরীরে অথবা কাপড়ের) উপরে খালুক (যা’ফরান দ্বারা তৈরি) সুগন্ধি দেখতে পেলেন। তখন বললেনঃ তোমার কি স্ত্রী আছে? সে বলল : না। তখন তিনি বললেনঃ তা ধুয়ে ফেলো, আবারো ধুয়ে ফেলো, আবারো ধুয়ে ফেলো। অতঃপর আর কখনো তা ব্যবহার করো না। (তিরমিযী ও নাসায়ী)[1]
হাদীসটি য‘ঈফ হওয়ার কারণ, এর সনদে আছে ‘‘আবূ হাফস্ ইবনু ‘উমার’’, যিনি অপরিচিত। আল জারহু ওয়াত্ তাদীল তাহযীবুল কামাল (৩২/৩০০)।
وَعَن يعلى بن
مرّة أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَأَى عَلَيْهِ خَلُوقًا فَقَالَ: «أَلَكَ امْرَأَةٌ؟» قَالَ: لَا قَالَ: «فَاغْسِلْهُ ثُمَّ اغْسِلْهُ ثُمَّ اغْسِلْهُ ثُمَّ لَا تعد» . رَوَاهُ التِّرْمِذِيّ وَالنَّسَائِيّ
ব্যাখ্যাঃ (خَلُوقًا) এক ধরনের সুগন্ধি যাতে রং রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, এক ধরনের সুগন্ধি যাতে হলুদ রং রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, এটি একটি প্রসিদ্ধ রং যা যা‘ফরান ইত্যাদি থেকে তৈরী হয়ে থাকে।
أَلَكَ امْرَأَةٌ؟ তোমার কি স্ত্রী আছে? হাদীসের এ অংশ থেকে অনেকে বিবাহিত ব্যক্তির জন্য রং যুক্ত সুগন্ধি ব্যবহারের বৈধতা দিয়ে থাকেন। আবার কেউ কেউ এর আলোকে অল্প ব্যবহারের অনুমতি দেন, যা ইতোপূর্বে আলোচনা হয়েছে। তবে পুরুষের জন্য লাল বা যা‘ফরান ব্যাপকভাবে নিষেধের হাদীসের আলোকে যারা সর্বাবস্থায় পুরুষের জন্য এই রং অবৈধ বলে মনে করেন, তাদের মতে হাদীসের ব্যাখ্যা হলো, অর্থাৎ তোমার স্ত্রী থাকে এবং স্ত্রীর শরীর বা কাপড় থেকে তোমার শরীরে বা কাপড়ে তোমার অনিচ্ছায় কিছু রং লেগে যায় তবে এতে তুমি অপারগ। মুল্লা ‘আলী কারী (রহিমাহুল্লাহ) এ ব্যাখ্যা উল্লেখ করে বলেনঃ এটাই হাদীসের বাহ্যত মত। পূর্বের হাদীস ও সামনের হাদীস থেকে এই মতই সঠিক বলে বুঝা যায়।
(فَاغْسِلْهُ ثُمَّ اغْسِلْهُ ثُمَّ اغْسِلْهُ) তিনবার ধোয়ার কথা তাকিদ বা গুরুত্ব বুঝানোর উদ্দেশে বলেছেন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনবারের কমে রং না যাওয়াটাই স্বাভাবিক মনে করে এমন নির্দেশ দেয়া হতে পারে। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ ৩. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - চুল আঁচড়ানো
৪৪৪১-[২৩] আবূ মূসা আল আশ্’আরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে (পুরুষের) গায়ে খলূক রঙের সামান্য পরিমাণও লেগে আছে, আল্লাহ তা’আলা এমন ব্যক্তির সালাত কবুল করেন না। (আবূ দাঊদ)[1]
হাদীসটি য‘ঈফ হওয়ার কারণ, এর সনদে আছে ‘‘আবূ জা‘ফার আর্ রাযী’’ নামক একজন বর্ণনাকারী, যিনি য‘ঈফ রাবী। দেখুন- তুহফা ৮/৮১ পৃঃ।
وَعَنْ أَبِي مُوسَى قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَا يَقْبَلُ اللَّهُ صَلَاةَ رَجُلٍ فِي جَسَدِهِ شَيْءٌ مِنْ خَلُوقٍ» . رَوَاهُ أَبُو دَاوُد
ব্যাখ্যাঃ হাদীসটি থেকে লাল বা হলুদ রঙের সুগন্ধি ব্যবহারের উপর কঠোরতা অনুমিত হয়। হাদীসটি ঐ সব ‘আলিমের পক্ষ দলীল যারা বলেন, এ রং কম হোক বেশি হোক সর্বাবস্থায় নিষিদ্ধ। মুল্লা ‘আলী (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ হাদীসের শব্দ (شَيْءٌ مِنْ خَلُوقٍ) কম বেশি সবকে অন্তর্ভুক্ত করে এবং তাদের কথার প্রত্যাখ্যান হয় যারা বলেন, নিষেধাজ্ঞাটি বেশি ব্যবহারের সাথে সংশ্লিষ্ট, কম ব্যবহারে অসুবিধা নেই।
(لَا يَقْبَلُ اللهُ صَلَاةَ) কোন সালাত কবুল করবেন না, অর্থাৎ সালাতের পরিপূর্ণ সাওয়াব পাওয়া যাবে না; কেননা এতে নারীদের সাথে সাদৃশ্য রয়েছে। ইবনুল মালিক বলেনঃ সালাত কবুল করবেন না বলে এ ধরনের রং বিশিষ্ট সুগন্ধি ব্যবহারের উপর কঠোরতা আরোপ করা ও ধমকি দেয়া উদ্দেশ্য। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ; ‘আওনুল মা‘বূদ ৭ম খন্ড, হাঃ ৪১৭৪)
পরিচ্ছেদঃ ৩. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - চুল আঁচড়ানো
৪৪৪২-[২৪] ’আম্মার ইবনু ইয়াসির (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন আমি কোন এক সফর হতে নিজ পরিবারের মধ্যে ফিরে এলাম। সফরকালে আমার উভয় হাত ফেটে গিয়েছিল। সুতরাং আমার পরিবারের লোকেরা তথায় যা’ফরান মিশ্রিত খলূক (সুগন্ধি) লাগিয়ে দিয়েছিল। ভোর বেলায় আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খিদমাতে উপস্থিত হয়ে তাঁকে সালাম করলাম, কিন্তু তিনি আমার সালামের জবাব দিলেন না এবং বললেনঃ তুমি যাও! তোমা হতে তা ধুয়ে ফেলো। (আবূ দাঊদ)[1]
وَعَنْ عَمَّارِ بْنِ يَاسِرٍ قَالَ: قَدِمْتُ عَلَى أَهْلِي مِنْ سَفَرٍ وَقَدْ تَشَقَّقَتْ يَدَايَ فَخَلَّقُونِي بِزَعْفَرَانٍ فَغَدَوْتُ عَلَى النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَسَلَّمْتُ عَلَيْهِ فَلَمْ يَرُدَّ عَلَيَّ وَقَالَ: «اذْهَبْ فَاغْسِلْ هَذَا عَنْكَ» . رَوَاهُ أَبُو دَاوُدَ
ব্যাখ্যাঃ (وَقَدْ تَشَقَّقَتْ يَدَايَ) আমার হাত ফেটে গেছে। হাত ফাটা বলতে শুষ্ক বাতাস ও অধিক পানি ব্যবহারের কারণে সাধারণত যা ফেটে থাকে, যেমন শীতকালে হয়ে থাকে।
(خَلَّقُونِي) তারা আমাকে ‘খলূক’ তথা যা‘ফরান মিশ্রিত সুগন্ধি লাগিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ আমার হাতের ফেটে যাওয়া স্থানে চিকিৎসার কারণে তারা এই সুগন্ধি লাগিয়েছে।
(فَلَمْ يَرُدَّ عَلَيَّ) অর্থাৎ তিনি আমার সালামের উত্তর দিলেন না। সালামের উত্তর না দেয়ার কারণ হলো, যা‘ফরান মিশ্রিত সুগন্ধি দেখে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রাগ। মুল্লা ‘আলী কারী বলেনঃ যারা ‘খলূক’ তথা যা‘ফরান মিশ্রিত সুগন্ধি অল্প ব্যবহারের অনুমোদন দেন, এ হাদীসটি তাদের মতো প্রত্যাখ্যানের বেলায় সবচেয়ে বেশি স্পষ্ট। তবে বর্ণিত সহাবা ওযরের কারণে তা ব্যবহার করেছিলেন। ওযর থাকা সত্ত্বেও তা ধৌত করে ফেলে দেয়ার নির্দেশের কারণ এও হতে পারে যে, হয়ত রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে তার ওযরটি স্পষ্ট হয়নি অথবা ওযরটি এমন সাধারণ ছিল, যার কারণে ‘খালুক’ ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে না। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ; ‘আওনুল মা‘বূদ ৭ম খন্ড, হাঃ ৪১৭২)
পরিচ্ছেদঃ ৩. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - চুল আঁচড়ানো
৪৪৪৩-[২৫] আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ পুরুষদের সুগন্ধি তাই যার গন্ধ ছড়ায় হয় আর রং ভাসে না। আর মহিলাদের সুগন্ধির রং উজ্জ্বল এবং গন্ধ ছড়ায় হয় না। (তিরমিযী ও নাসায়ী)[1]
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «طِيبُ الرِّجَالِ مَا ظَهَرَ رِيحُهُ وَخَفِيَ لَوْنُهُ وَطِيبُ النِّسَاءِ مَا ظَهَرَ لَوْنُهُ وَخَفِيَ رِيحُهُ» . رَوَاهُ التِّرْمِذِيُّ وَالنَّسَائِيُّ
ব্যাখ্যাঃ (طِيبُ الرِّجَالِ مَا ظَهَرَ رِيحُهٗ) ‘ত্বীব’ শব্দটি মাসদার হিসেবে সুগন্ধি ব্যবহার করা অর্থে হতে পারে, আবার স্বয়ং সুগন্ধি যা ব্যবহার করা হয় তা হতে পারে। আর সুবাস প্রকাশিত বলতে, যেমন : গোলাপ জল, মিশক, আম্বর ও কর্পুর ইত্যাদি।
(مَا ظَهَرَ رِيحُهٗ وَخَفِيَ لَوْنُهٗ) যার রং প্রকাশিত কিন্তু সুগন্ধি প্রকাশিত নয়। অর্থাৎ রং দেখা যায়, কিন্তু সুবাস ছড়ায় না, যেমন : মেহেদী, যা‘ফরান ইত্যাদি। শারহুস্ সুন্নাহয় লিখেন, মেয়েদের সুবাস ছড়ায় না এমন রঙের ব্যবহারের নিষেধটি ফুকাহায়ে কিরাম ঘর থেকে বের হওয়ার সময়ে নিয়েছেন বলেই মনে হয়। কেননা মহিলা যখন ঘরে স্বামীর কাছে থাকে তখন তার জন্য যে কোন সুগন্ধি ব্যবহার বৈধ। মহিলাদের জন্য সুবাস ছড়ানো সুগন্ধির ব্যবহারের নিষেধাজ্ঞাটি কেবল ঘর হতে বের হওয়ার সাথে সংশ্লিষ্টের ব্যাপারটি অন্য হাদীস দ্বারাও সমর্থিত। যেমন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- أَيُّمَا امْرَأَةٍ أَصَابَتْ بَخُورًا فَلاَ تَشْهَدْ مَعَنَا الْعِشَاءَ الآخِرَةَ ‘‘যে মহিলাই ‘বাখূর’ (সুগন্ধি কাঠের ধুন থেকে গৃহীত সুগন্ধি) ব্যবহার করবে, সে যেন ‘ইশার সালাতে আমাদের সাথে উপস্থিত না হয়।’’ (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ ৩. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - চুল আঁচড়ানো
৪৪৪৪-[২৬] আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এক প্রকারের বিশেষ সুগন্ধি ছিল, তিনি তা হতে সুগন্ধি ব্যবহার করতেন। (আবূ দাঊদ)[1]
وَعَن أنس قَالَ: كَانَتْ لِرَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ سُكَّةٌ يَتَطَيَّبُ مِنْهَا. رَوَاهُ أَبُو دَاوُدَ
ব্যাখ্যাঃ (سُكَّةٌ) শব্দটি ‘সীন’ অক্ষরে পেশ ও ‘কফ’ হরফে তাশদীদ এবং যবর দিয়ে উচ্চারিত, যা এক প্রকারের মূল্যবান সুগন্ধি। কেউ কেউ বলেন, মিশক থেকে গৃহীত সুগন্ধি। কেউ কেউ বলেন, এটি হলো বিভিন্ন প্রকারের সুগন্ধি থেকে নেয়া খামীর। নিহায়ায় বলেনঃ এটি একটি পরিচিত সুগন্ধি যা অন্য সুগন্ধির সাথে মিশ্রিত করে ব্যবহার করা হয়।
ইবনু হাজার (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ এটি কয়েকটি সুগন্ধি মিলিয়ে বানানো সুগন্ধির নাম। আবার কেউ কেউ বলেন, এখানে ‘সুক্কাহ’ বলে বিশেষ কোন সুগন্ধি বুঝানো হয়নি, বরং সুগন্ধি পাত্র বুঝানো হয়েছে; কেননা সুগন্ধি হলে বলা দরকার ছিল (يَتَطَيَّبُ مِنْهَا) অর্থাৎ তিনি এর মাধ্যমে সুগন্ধি গ্রহণ করতেন। অথচ হাদীসের শব্দ হলো (يَتَطَيَّبُ مِنْهَا) অর্থাৎ তার থেকে সুগন্ধি গ্রহণ করেন। এ থেকে বুঝা যায় এটি সুগন্ধির পাত্র ছিল। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ ৩. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - চুল আঁচড়ানো
৪৪৪৫-[২৭] আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাথায় খুব বেশি তেল ব্যবহার করতেন এবং দাড়ি আঁচড়াতেন। আর প্রায়শ মাথায় একখানা কাপড় রাখতেন। দেখতে তা প্রায় তেলিদের কাপড়ের ন্যায় মনে হত। (শারহুস্ সুন্নাহ্)[1]
হাদীসটি য‘ঈফ হওয়ার করণ, এর সনদে আছে ‘‘ইয়াযীদ ইবনু আবান আর্ রুকাশী’’ নামক বর্ণনাকারী। ইমাম যাহাবী তাকে য‘ঈফ বলেছেন, আর ইমাম নাসায়ী ও অন্য একজন তাকে মাতরূক বলেছেন। বিস্তারিত দেখুন- য‘ঈফাহ্ ২৪৫৬।
وَعَنْهُ قَالَ: كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسلم يُكثر دهن رَأسه وتسريحَ لحيته وَيُكْثِرُ الْقِنَاعَ كَأَنَّ ثَوْبَهُ ثَوْبُ زَيَّاتٍ. رَوَاهُ فِي شرح السّنة
ব্যাখ্যাঃ (يُكْثِرُ دُهْنَ رَأْسِه) অর্থাৎ মাথায় তেল বেশি বেশি লাগাতেন। মাথায় তেল বেশি লাগানোর মাধ্যমে মূলত চুলকে পরিপাটি করে রাখা ও চুলের যত্ন নেয়া উদ্দেশ্য।
(تَسْرِيْحَ) শব্দের অর্থ চিরুনি করা, আঁচড়ানো। অর্থাৎ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর দাড়িকে চিরুনি করে পরিপাটি রাখতে অত্যন্ত যত্নবান ছিলেন।
(يُكْثِرُ الْقِنَاعَ) القناع শব্দের অর্থ ওড়না। তবে এখানে উদ্দেশ্য কাপড়ের টুকরো। অর্থাৎ মাথায় তেল বেশি ব্যবহারের কারণে তেল যাতে পাগড়ীতে না লাগে, তাই পাগড়ীর নিচে একটি কাপড়ের টুকরো থাকতো। পাগড়ী বা টুপিকে তেল থেকে মুক্ত রাখতে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ধরনের কাপড়ের টুকরোর ব্যবহার বেশি করতেন।
(كَأَنَّ ثَوْبَهٗ ثَوْبُ زَيَّاتٍ) তাঁর কাপড় যেন তেল বিক্রেতার কাপড়। তেল বিক্রেতার কাপড়ের সাথে তুলনা করার উদ্দেশ্য হলো, তেল বিক্রেতার কাপড়ে যেমন তেল লেগে থাকে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তেল অধিক ব্যবহারের কারণে তার কাপড়েও তেল লেগে থাকতে দেখা যেত। তবে এখানে কাপড় বলতে মাথায় রাখা সেই কাপড়ের টুকরোটিই উদ্দেশ্য। কেননা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শরীরের কাপড় তৈলাক্ত হওয়া থেকে মুক্ত রাখতেই রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনটি করতেন এবং তিনি কাপড় শরীরের পরিচ্ছন্নতার দিকে সচেতন থাকতেন। অথচ তেল বিক্রেতার কাপড়ের ন্যায় কাপড়ে তেল থাকা কাপড় ময়লাযুক্ত থাকার প্রমাণ বহন করে, যা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চরিত্রের বিপরীত। তাছাড়া বর্ণিত হাদীসেই কাপড়কে তৈলাক্ত হওয়া থেকে মুক্ত রাখার জন্য অতিরিক্ত কাপড়ের টুকরোর অধিক ব্যবহারই এ কথার প্রমাণ বহন করে যে, তেল বিক্রেতার কাপড়ের ন্যায় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই কাপড়ের টুকরোটি দেখা যেত। অন্য কাপড় নয়। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ ৩. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - চুল আঁচড়ানো
৪৪৪৬-[২৮] উম্মু হানী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, (মক্কা বিজয়ের দিন) একদিন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের কাছে আসলেন, এ সময় তাঁর মাথার চুলে চারটি জুলফি ছিল। (আহমাদ, আবূ দাঊদ, তিরমিযী ও ইবনু মাজাহ)[1]
وَعَن أم هَانِئ قَالَتْ: قَدِمَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَيْنَا بِمَكَّةَ قَدْمَةً وَلَهُ أَرْبَعُ غَدَائِرَ. رَوَاهُ أَحْمَدُ وَأَبُو دَاوُدَ وَالتِّرْمِذِيُّ وَابْنُ مَاجَهْ
ব্যাখ্যাঃ (قَدْمَةً) ব্যাকরণের দিক থেকে শব্দটি "قدم" ক্রিয়া এর মাফঊলে মুত্বলাক। অর্থাৎ আমাদের মাঝে একবার আসেন। হিজরত করে মদীনায় যাওয়ার পর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চার বার মক্কায় এসেছিলেন বলে বর্ণনায় পাওয়া যায়। তবে কোন কোন বর্ণনার আলোকে বুঝা যায়, এ আগমনটি ছিল মক্কা বিজয়ের সময়ের আগমন।
(غَدَائِرَ) কোন কোন বর্ণনার শব্দ "ضفائر"। এর অর্থ হলো, চুলের কিছু অংশকে অন্য কিছু অংশের ভিতর প্রবেশ করানো। এর মাধ্যমে চুলকে খোপা বা বেনী আকারে করা হয়। এর উদ্দেশ্য হলো, চুলের ভিতর ময়লা বা ধূলা-বালু প্রবেশ করতে না দেয়া। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ; তুহফাতুল আহ্ওয়াযী ৫ম খন্ড, হাঃ ১৭৮২)
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চুল লম্বা থাকায় ধূলা-বালি প্রবেশ না করার জন্য হয়ত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার চুলকে চারটি গুচ্ছ বা বেনী আকার করে রাখতেন।
পরিচ্ছেদঃ ৩. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - চুল আঁচড়ানো
৪৪৪৭-[২৯] ’আয়িশাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি যখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মাথায় সিঁথি কাটতাম, তাঁর মাথার মধ্যস্থল হতে সিঁথি কাটতাম এবং মাথার সম্মুখের চুল উভয় চক্ষুর মাঝামাঝি স্থান বরাবর হতে (উভয় পার্শ্বে) ছেড়ে দিতাম। (আবূ দাঊদ)[1]
وَعَن عَائِشَة قَالَتْ: إِذَا فَرَقْتُ لِرَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَأْسَهُ صَدَّعْتُ فَرْقَهُ عَنْ يَافُوخِهِ وَأَرْسَلْتُ نَاصِيَتَهُ بَيْنَ عَيْنَيْهِ. رَوَاهُ أَبُو دَاوُدَ
ব্যাখ্যাঃ "يافوخ" শব্দের অর্থ মাথার তালু বা চাঁদি। হাদীসটি ‘আয়িশাহ্ (রাঃ) রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চুলের সিঁথির বর্ণনা দিচ্ছেন। অর্থাৎ সিঁথির এক মাথা তালু আরেক মাথা কপাল। সিঁথিটি তালু থেকে শুরু করে দুই চোখের মাঝখানে কপাল পর্যন্ত এসে শেষ হতো। আর এই লম্বা সিঁথির দুই পাশে চুল থাকতো। একভাগ চুল সিঁথির ডান পার্শ্বে এবং আরেক ভাগ সিঁথির বাম পার্শ্বে। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ; ‘আওনুল মা‘বূদ ৭ম খন্ড, হাঃ ৪১৮৫)
পরিচ্ছেদঃ ৩. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - চুল আঁচড়ানো
৪৪৪৮-[৩০] ’আবদুল্লাহ ইবনু মুগাফফাল (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (প্রত্যহ) মাথা আঁচড়াতে নিষেধ করেছেন। তবে একদিন পর একদিন (অনুমতি রয়েছে)। (তিরমিযী, আবূ দাঊদ ও নাসায়ী)[1]
وَعَن عبد الله بن مغفَّل قَالَ: نَهَى رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنِ التَّرَجُّلِ إِلَّا غِبًّا. رَوَاهُ التِّرْمِذِيُّ وَأَبُو دَاوُد وَالنَّسَائِيّ
ব্যাখ্যাঃ (غِبًّا) বলতে দেরী করা বুঝানো হয়ে থাকে। অতএব হাদীসের মর্ম হলো, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাথার চুলে চিরুনি ঘন ঘন করতে নিষেধ করেছেন। অর্থাৎ ঘন ঘন চুল চিরুনি করা নিষেধ। তবে দেরিতে দেরিতে করতে সমস্যা নেই।
দেরী বিষয়টি আপেক্ষিক। কর্ম ও ব্যক্তি ভেদে কম-বেশ হতে পারে। যেমন, সাক্ষাতের ক্ষেত্রে দেরী কয়েক দিন মাঝে রেখে সাক্ষাত বুঝানো হয়ে থাকে। হাসান বাসরী থেকে বর্ণনা করা হয়, দেরিতে সাক্ষাত বলতে সপ্তাহে একবার সাক্ষাত। ইমাম আহমাদ (রহিমাহুল্লাহ) থেকে দেরীতে চিরুনি বলতে যে ব্যাখ্যা বর্ণনা করা হয় তা হলো একদিন চিরুনি করবে এবং একদিন বাদ দিবে। অর্থাৎ প্রতিদিন না করে একদিন মাঝে রেখে চিরুনি করবে। কেউ কেউ বলেন, এক সময় করবে এক সময় বাদ দিবে।
হাদীসটিতে মূলত চুল চিরুনির কর্মে প্রতিদিন ব্যস্ত থাকতে নিষেধ করা হয়েছে; কেননা এটা এক ধরনের বিলাসিতা। আর অধিক বিলাসিতার নিষেধ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। যেমন সামনের হাদীসেই এর নিষেধাজ্ঞা আসছে। (‘আওনুল মা‘বূদ হাঃ ৭ম খন্ড, ৪৪৪৮)
চুল চিরুনি করা বা চুলের যত্ন নেয়া নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাত এবং তার নির্দেশ। অতএব এখানে নিষেধের অর্থ এটাই যে, চুলের যত্ন নিতে গিয়ে বা চিরুনি করতে গিয়ে চুলের পিছে পড়ে যাওয়া এবং চুল নিয়েই ব্যস্ত থাকা ঠিক নয়। এভাবেই উভয় হাদীসের মাঝে বিরোধ নিরসন হয়ে যাবে।
পরিচ্ছেদঃ ৩. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - চুল আঁচড়ানো
৪৪৪৯-[৩১] ’আবদুল্লাহ ইবনু বুরয়দাহ্ (রহঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন জনৈক ব্যক্তি ফাযালাহ্ ইবনু ’উবায়দ (রাঃ)-কে বলল : কি হলো? আমি আপনাকে এ রকম এলোমোলো চুলে দেখছি কেন? উত্তরে ফাযালাহ্ বললেনঃ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে অত্যধিক বিলাসী হতে নিষেধ করেছেন। ঐ লোকটি আবার জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা! কি ব্যাপার? আমি আপনার পায়ে জুতা দেখছি না কেন? জবাবে তিনি বললেনঃ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে কখনো কখনো খালি পায়ে চলতে আদেশ করেছেন। (আবূ দাঊদ)[1]
وَعَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ بُرَيْدَةَ قَالَ: قَالَ رَجُلٌ لِفَضَالَةَ بْنِ عُبَيْدٍ: مَا لِي أَرَاكَ شَعِثًا؟ قَالَ: إِنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَنْهَانَا عَنْ كَثِيرٍ مِنَ الإِرفاه قَالَ: مَالِي لَا أَرَى عَلَيْكَ حِذَاءً؟ قَالَ: كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَأْمُرُنَا أَنْ نحتفي أَحْيَانًا. رَوَاهُ أَبُو دَاوُد
ব্যাখ্যাঃ (شَعِثًا) অর্থাৎ এলোমেলো বা জট বেঁধে যাওয়া। চুলকে চিরুনি না করা বা চুলের যত্ন না নেয়ার কারণে চুলের মধ্যে ধূলা-বালু লেগে জট বেঁধে যাওয়া বা এলোমেলো হয়ে যাওয়া উদ্দেশ্য। ফাযালাহ্ ইবনু ‘উবায়দ (রাঃ)-এর চুল এলোমেলো দেখে হয়ত উক্ত ব্যক্তি প্রশ্ন করেছিলেন। এর উত্তরে ফাযালাহ্ (রাঃ) বলেন, ‘‘রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে অধিক বিলাসিতা ও প্রাচুর্যতায় লিপ্ত থাকতে নিষেধ করেছেন’’। অধিক প্রাচুর্যতা ও বিলাসিতা থেকে নিষেধ করেছেন শব্দ থেকে বুঝা যায় যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসব কর্মে অর্থাৎ : চুলে তেল লাগানোর ক্ষেত্রে, চুল চিরুনি করার বেলায় প্রাচুর্যতা বা আধিক্য বা সীমা ছাড়িয়ে যাওয়াকে অপছন্দ করতেন। কেননা এটি অনারব তথা কাফিরদের অভ্যাস। এ সবকিছুর ক্ষেত্রে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মধ্যপন্থা অবলম্বনের নির্দেশ দেন।
তবে পবিত্রতা বা পরিচ্ছন্নতা অবলম্বন করা এ হাদীসের অন্তর্ভুক্ত নয়; কেননা তা দীনের অংশ। হাফিয বলেনঃ হাদীসে অধিক প্রাচুর্যতা বলার মাঝে ইঙ্গিত রয়েছে যে, মধ্যম ও স্বাভাবিক প্রাচুর্যতা তিরস্কারের অন্তর্ভুক্ত নয়। এভাবেই উভয় হাদীসের মাঝে অর্থাৎ চুলের যত্ন নিতে উৎসাহমূলক হাদীস এবং নিরুৎসাহিত হাদীসের মাঝে সামঞ্জস্য হয়ে যায়। (‘আওনুল মা‘বূদ ৭ম খন্ড, হাঃ ৪১৫৬)
(نَحْتَفِىْ) ‘আরবী শব্দ ‘ইহতিফা’ থেকে নির্গত। অর্থাৎ খালি পায়ে চলা। অর্থাৎ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে নির্দেশ দেন মাঝে মাঝে খালি পায়ে চলতে। মাঝে মাঝে খালি পায়ে চলতে নির্দেশ দেয়ার কারণ হলো, এতে বিনয় সৃষ্টি হয় এবং আত্ম-অহংকার দূর হয়ে যায়। এছাড়া মাঝে মাঝে খালি পায়ে চললে প্রয়োজন বা অপারগ অবস্থার সম্মুখীন হলে খালি পায়ে চলা যাবে। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ ৩. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - চুল আঁচড়ানো
৪৪৫০-[৩২] আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তির চুল আছে, সে যেন তা যত্ন নেয়া রাখে। (আবূ দাঊদ)[1]
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «مَنْ كَانَ لَهُ شعرٌ فليُكرمه» . رَوَاهُ أَبُو دَاوُد
ব্যাখ্যাঃ (فَلْيُكْرِمْهُ) অর্থাৎ সে যেন তার অর্থাৎ চুলের সম্মান করে। চুলের সম্মান বলতে চুলের যত্ন নেয়া। অর্থাৎ চুলের সৌন্দর্য বর্ধন করা, ধোয়ার মাধ্যমে চুল পরিচ্ছন্ন রাখা, তেল ব্যবহার করা এবং তাকে এলোমেলো না রাখা। কেননা পরিচ্ছন্নতা ও সৌন্দর্যতা পছন্দনীয় বস্তু। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
ইমাম মুনযিরী (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ হাদীসটি বাহ্যত উপরের হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক, যে হাদীসে ঘন ঘন চুল চিরুনি করতে নিষেধ করা হয়েছে এবং যে হাদীসে জীর্ণতার কথা বলা হয়েছে, যদি জীর্ণতার হাদীসকে বিশুদ্ধ ধরা হয়। অতএব উভয় হাদীসের মাঝে এভাবে সামঞ্জস্য হতে পারে যে, ঘন ঘন চিরুনি না করার হাদীস ঐ ব্যক্তির জন্য যে অসুস্থ বা অধিক ঠাণ্ডার কারণে নিয়মিত চুল চিরুনি করতে কষ্ট হয়। অতএব যেটা তার জন্য কষ্টদায়ক সেটার জন্য নিজের ওপর কষ্ট চাপিয়ে নেয়ার প্রয়োজন নেই। বরং মাঝে মাঝে চিরুনি করলেই চলে। আবার এও হতে পারে যে, আবূ কতাদাহ্ দিনে দু’বার মাথায় তেল দেয়াকে সুন্নাত মনে করে নিতে পারেন এবং সুন্নাতের উপর ‘আমল করতে দিনে দু’বার মাথায় তেল দেয়া জরুরী মনে করতেন। তাই রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জানিয়ে দিলেন যে, সুন্নাত হলো মাঝে মাঝে বাদ দেয়া। বিশেষ করে চুলের যত্ন ও চিরুনি যাকে তার কর্মব্যস্ততা থেকে ফিরিয়ে রাখে, তাকে এ কথা জন্য জানিয়ে দেয়া উদ্দেশ্য যে, চুল বারবার চিরুনি করা কোন জরুরী বিষয় নয়। বরং এটি বৈধ। যে চায় করতে পারে। যে চায় না করতেই হবে এমন নয়।
শামসুদ্দীন ইবনুল কইয়্যিম (রহিমাহুল্লাহ) এ হাদীসের ব্যাখ্যায় মুনযির-এর এই বক্তব্য পুরোটা উল্লেখ করেন। এরপর বলেন, এই আমরা এ ধরনের সামঞ্জস্য বিধানের প্রয়োজন দেখি না। বরং সঠিক কথা হলো, চুলের যত্ন নেয়ার হাদীস এবং ঘন ঘন চিরুনি না করার হাদীসের মাঝে কোন ধরনের সংঘর্ষ নেই। কেননা বান্দা চুলের যত্ন নিতে নির্দেশিত। আর বিলাসিতায় আধিক্যতা অবলম্বনে নিষিদ্ধ। তাই সে চুলের যত্ন নিবে তবে বিলাসিতা ও চুল নিয়ে মত্ত থাকাকে তার অভ্যাস বানাবে না। বরং মাঝে মাঝে বাদ দিয়ে চিরুনি করবে। উভয় হাদীসের এভাবে অর্থ নেয়াই উত্তম। (‘আওনুল মা‘বূদ ৭ম খন্ড, হাঃ ৪১৫৯)
পরিচ্ছেদঃ ৩. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - চুল আঁচড়ানো
৪৪৫১-[৩৩] আবূ যার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ বার্ধক্যকে পরিবর্তন করার জন্য সবচেয়ে উত্তম বস্তু হলো মেহেদী ও কাতাম (ঘাস)। (তিরমিযী, আবূ দাঊদ ও নাসায়ী)[1]
وَعَنْ أَبِي ذَرٍّ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «إِنَّ أَحْسَنَ مَا غُيِّرَ بِهِ الشَّيْبُ الْحِنَّاءُ وَالْكَتَمُ» . رَوَاهُ التِّرْمِذِيُّ وَأَبُو دَاوُد وَالنَّسَائِيّ
ব্যাখ্যাঃ (الْحِنَّاءُ وَالْكَتَمُ) ‘হিন্না’ অর্থাৎ মেহেদী। আর كتم শব্দটির ‘ت’ হরফে তাশদীদ অর্থাৎ ‘কাত্তামুন’ এবং তাকে সাকিন করে ‘কাতমুন’ পড়া যায়। তবে ‘কাতমুন’ উচ্চারণই প্রসিদ্ধ বলে উল্লেখ করেন হাদীসের ব্যখ্যাকারগণ। এটি একটি উদ্ভিদ যা রঞ্জকের কাজে ব্যবহৃত হয়। তবে এর দ্বারা কোন রং হয় এ নিয়ে ব্যাখ্যাকারগণদের নিকট বিভিন্ন মতামত পাওয়া যায়। সম্ভবত এই উদ্ভিদের বিভিন্ন প্রকার রয়েছে যার একেকটি একেক রং ধারণ করে বলেই বিভিন্ন মতামতের সৃষ্টি হয়েছে। এই রঞ্জক পদার্থের রং লাল, সবুজ, কালো, লাল সবুজের মাঝামাঝি কালচে রং হয় বলে বিভিন্ন মত রয়েছে। তবে কালো রঙের খিযাব ব্যবহারে আপত্তি রয়েছে বলে আমরা দেখে এসেছি এবং সামনে দেখব। অথচ এ হাদীসে ‘কাতমুন’ দ্বারা চুলের শুভ্রতা পরিবর্তনকে সবচেয়ে ভালো বলা হয়েছে। তাই এখানে কাতমুন দ্বারা সবুজ বা কালচে রঙ ধারণকারী উদ্ভিদ উদ্দেশ্য নিতে হবে। তবে যারা মনে করেন এর রং কালো হয় তাদের কেউ কেউ এ হাদীস দ্বারা কালো খিযাবের বৈধতা দিয়ে থাকেন। আবার কেউ কেউ বলেন, কেবল ‘কাতমুন’ এর রং নিরেট কালো হলেও তাকে মেহেদীর সাথে মিশালে তার রঙটি নিরেট কালো থেকে সরে লাল কালচে রং ধারণ করে। আর হাদীসে মেহেদী এবং কাতাম উভয়টি মিশ্রিত করে ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। আর উভয়টি মিশ্রিত করলে রং নিরেট কালো হয় না। আর নিরেট কালো ব্যতীত অন্য কোন রঞ্জক দ্বারা চুল রং করা নিষিদ্ধ নয়। বরং এর প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। আবার কেউ কেউ মনে করেন, কাতাম বলতে তাকে ‘ওসমাহ্’ উদ্ভিদের সাথে মিশ্রিত করে ব্যবহার। উভয়টি মিশালে রং পুরো কালো হয় বরং লাল কালচে হয়। (‘আওনুল মা‘বূদ ৭ম খন্ড, হাঃ ৪২০১; মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
খিযাব দ্বারা চুলের শুভ্রতা পরিবর্তনের আরো আলোচনা প্রথম অনুচ্ছেদে করা হয়েছে। বিধায় এখানে আর দীর্ঘ করার প্রয়োজন নেই।
পরিচ্ছেদঃ ৩. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - চুল আঁচড়ানো
৪৪৫২-[৩৪] ’আবদুল্লাহ ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ শেষ যামানায় এমন এক সম্প্রদায়ের আবির্ভূত হবে, যারা কবুতরের বক্ষের ন্যায় এ কালো খিযাব ব্যবহার করবে, ফলে তারা জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না। (আবূ দাঊদ ও নাসায়ী)[1]
وَعَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «يَكُونُ قَوْمٌ فِي آخِرِ الزَّمَانِ يَخْضِبُونَ بِهَذَا السَّوَادِ كَحَوَاصِلِ الْحَمَامِ لَا يَجِدُونَ رَائِحَةَ الْجَنَّةِ» . رَوَاهُ أَبُو دَاوُدَ وَالنَّسَائِيُّ
ব্যাখ্যাঃ (كَحَوَاصِلِ الْحَمَامِ) অর্থ কবুতের পাকস্থলীর ন্যায়। তবে এখানে পাকস্থলী বলতে পাকস্থলীর উপরের অংশ তথা বুক বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ কবুতরের বুক যেমন কালো হয় তারা কালো রঞ্জক দিয়ে খিযাব করে চুল ও দাড়িকে তেমন করবে। আবার সব কবুতরের বুক কালো হয় না। তাই এখানে সব কবুতর উদ্দেশ্য নয়। অর্থাৎ কিছু কিছু কবুতরের বুক, যেমন কালো চিকচিকে থাকে তারা এমন কালো রঞ্জক ব্যবহার করবে। কালো খিযাব ব্যবহারের ক্ষেত্রে যারা শক্ত আপত্তি আরোপ করে হারাম বলেন- এ হাদীসটি তাদের স্বপক্ষের একটি দলীল। তবে যারা বৈধতার পক্ষ মত দেন, তারা এ হাদীসটি রহিত মনে করেন। আবার অনেকেই হাদীসটির দুর্বলতা প্রকাশ করেছেন। আবার কেউ কেউ মনে করেন, কালো খিযাবের হারাম হওয়ার ক্ষেত্রে এ হাদীসটি অকাট্য প্রমাণ বহন করে না; কেননা এই হাদীসে শেষ যামানার একদল লোক এই বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হবে বলে জানা যাচ্ছে। তবে তারা জান্নাতের সুগন্ধি না পাওয়া কেবল এ কারণেই বলে হাদীসটি স্পষ্ট প্রমাণ বহন করে না। বরং হাদীসটিতে শেষ যামানার একদল যারা জান্নাতের ঘ্রাণ পাবে না, তাদের এই সিফাত থাকবে বলে বলা হচ্ছে। এ কারণে তারা জাহান্নামে যাবে এর উল্লেখ নেই।
(لَا يَجِدُونَ رَائِحَةَ الْجَنَّةِ) ‘তারা জান্নাতের সুঘ্রাণ পাবে না।’ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে, জান্নাতের সুঘ্রাণ পাঁচশত বছরের দূরত্বের পথ থেকে পাওয়া যায়। অতএব কেবল এই গুনাহর কারণে জান্নাতের ঘ্রাণ না পাওয়ার বিষয়টি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ধমকের স্বরে বলেছেন বলে মনে করেন মুহাদ্দিসীনে কিরাম। অথবা হাদীসটি ঐ ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যে এর ব্যবহারকে বৈধ মনে করবে। অথবা জান্নাতে যাওয়ার পূর্বে কবরে থাকা অবস্থায় সে সুঘ্রাণ পাবে না। (‘আওনুল মা‘বূদ ৭ম খন্ড, হাঃ ৪২০৮; মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ ৩. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - চুল আঁচড়ানো
৪৪৫৩-[৩৫] ’আবদুল্লাহ ইবনু ’উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিবতি চামড়ার তৈরি জুতা পরিধান করতেন এবং ওয়ার্স ঘাস ও যা’ফরান দ্বারা নিজের দাড়িকে হলুদ রঙে রঞ্জিত করতেন। ইবনু ’উমার -ও অনুরূপ করতেন। (নাসায়ী)[1]
وَعَنِ ابْنِ عُمَرَ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَلْبَسُ النِّعَالَ السِّبْتِيَّةَ وَيَصْفِرُّ لِحْيَتَهُ بِالْوَرْسِ وَالزَّعْفَرَانِ وَكَانَ ابْنُ عُمَرَ يَفْعَلُ ذَلِك. رَوَاهُ النَّسَائِيّ
ব্যাখ্যাঃ (السِّبْتِيَّةَ) হলো ঐ চামড়া যা পাকানোর সময় লোম তুলে ফেলা হয়। অর্থাৎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পশম তুলে ফেলা চামড়ার স্যান্ডেল ব্যবহার করতেন।
(بِالْوَرْسِ) ‘ওয়ার্স’ হচ্ছে একটি হলুদ রঞ্জক উদ্ভিদ। এ হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর দাড়িতে খিযাব লাগাতেন। ইবনু ‘উমার আরেকটি বর্ণনায় রয়েছে, ‘‘আমি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে হলুদ রং দ্বারা খিযাব করতে দেখেছি।
অপরদিকে আনাস (রাঃ)-এর বর্ণনা মতে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো খিযাব ব্যবহার করেননি। উভয় বর্ণনার বাহ্যিক বিরোধ সমাধান করতে মুহাদ্দিসীনে কিরাম বলেনঃ আনাস (রাঃ)-এর বর্ণনায় খিযাব ব্যবহার নাকচ করাটি অধিকাংশ দাঁড়ির দিকে লক্ষ্য করে হয়ত তিনি বলেছেন। কেননা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অতি অল্প কয়েকটি দাড়ি বা চুল সাদা হয়েছিল। তাই তাতে খিযাবের কোন প্রয়োজন ছিল না। সেই গুটি কয়েক সাদা চুলে তিনি খিযাব ব্যবহার করলে সেটার কথাই ইবনু ‘উমার বলেছেন। আবার অধিকাংশ চুল যা কালো ছিল সেগুলোতে খিযাব লাগাননি বিধায় আনাস তা নাকচ করেছেন। ইবনু ‘উমার এবং আবূ রামসাহ্ (রাঃ) থেকে খিযাব লাগানোর বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় আনাস (রাঃ)-এর বিবরণে এই মর্মই নিতে হবে। অথবা যারা বলছেন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খিযাব ব্যবহার করেননি তাদের কথার উদ্দেশ্য হবে খিযাব ব্যবহার রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিয়মিত অভ্যাস ছিল না। আর যা বলছেন যারা করেছেন তাদের কথার মর্ম হবে মাঝে মাঝে ব্যবহার করেছেন এর বৈধতা বুঝাবার জন্য। (‘আওনুল মা‘বূদ ৭ম খন্ড, হাঃ ৪২০৬; ফাতহুল বারী ৬ষ্ঠ খন্ড, হাঃ ৫৭২)
পরিচ্ছেদঃ ৩. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - চুল আঁচড়ানো
৪৪৫৪-[৩৬] ’আবদুল্লাহ ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট দিয়ে এমন এক ব্যক্তি অতিক্রম করল যে মেহেদীর দ্বারা খিযাব লাগিয়েছিল। তাকে দেখে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ এটা কতই না চমৎকার! বর্ণনাকারী বলেন, তারপর আরেক ব্যক্তি অতিক্রম করল সে মেহেদী ও কাতাম ঘাস উভয়টি দ্বারা খিযাব করেছিল। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাকে দেখে বললেন, এটা আরো তো উত্তম। অতঃপর আরেক ব্যক্তি অতিক্রম করল, সে হলুদ রং দ্বারা খিযাব লাগিয়েছিল। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাকে দেখে বললেনঃ এটা সর্বাপেক্ষা উত্তম। (আবূ দাঊদ)[1]
হাদীসটি য‘ঈফ হওয়ার কারণ, এর সনদে আছে ‘‘হুমায়দ ইবনু ওয়াহ্ব’’ নামের বর্ণনাকারী। যিনি য‘ঈফুল হাদীস। ইমাম বুখারী তাকে মুনকারুল হাদীস বলেছেন। দেখুন- তাহযীবুল কামাল (১৫৪৩ নং)।
وَعَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ: مَرَّ عَلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَجُلٌ قَدْ خَضَبَ بِالْحِنَّاءِ فَقَالَ: «مَا أَحْسَنَ هَذَا» . قَالَ: فَمَرَّ آخَرُ قَدْ خَضَبَ بِالْحِنَّاءِ وَالْكَتَمِ فَقَالَ: «هَذَا أَحْسَنُ مِنْ هَذَا» ثُمَّ مَرَّ آخَرُ قَدْ خَضَبَ بِالصُّفْرَةِ فَقَالَ: «هَذَا أَحْسَنُ مِنْ هَذَا كُله» . رَوَاهُ أَبُو دَاوُد
ব্যাখ্যাঃ مَا أَحْسَنَ هٰذَا আশ্চর্যবোধক ক্রিয়া। সৌন্দর্যের আধিক্যতা বুঝাতে ব্যবহার করেছেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। হাদীস থেকে কেবল মেহেদী দ্বারা খিযাব করার সৌন্দর্যের প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে এর চেয়ে মেহেদীর সাথে কাতাম মিশ্রিত করে খিযাব করলে তা আরো বেশি সুন্দর। এ হাদীস দ্বারা তাদের প্রত্যাখ্যান হয় যারা মনে করেন মেহেদীর সাথে কাতাম মিশালে রং কালো বর্ণ ধারণ করে। অথচ নিরেট কালো খিযাবের ব্যবহার হাদীসে নিষেধ রয়েছে। আর এখানে মেহেদীর সাথে কাতাম মিশানো খিযাবের প্রশংসা করেছেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। এ দ্বারা বুঝা যায় যে, মেহেদী ও কাতাম মিশালে রং নিরেট কালো হয় না। বরং লালের মাঝে কালচে ভাব আসে।
হাদীসটি থেকে হলুদ খিযাব নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে সবচেয়ে পছন্দ লাগে বলে প্রমাণিত হয়।
(‘আওনুল মা‘বূদ ৭ম খন্ড, হাঃ ৪২০৭; ফাতহুল বারী ৬ষ্ঠ খন্ড, হাঃ ৫৭২)
পরিচ্ছেদঃ ৩. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - চুল আঁচড়ানো
৪৪৫৫-[৩৭] আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা (খিযাব দ্বারা) বার্ধক্যকে পরিবর্তন করে দাও এবং ইয়াহূদীদের সাদৃশ্য গ্রহণ করো না (অর্থাৎ- তারা দাড়ি চুলে খিযাব ব্যবহার করে না)। (তিরমিযী)[1]
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «غَيِّرُوا الشَّيْبَ وَلَا تشبَّهوا باليهودِ» . رَوَاهُ التِّرْمِذِيّ
ব্যাখ্যাঃ বুখারী ও মুসলিমের বর্ণনায় রয়েছে- إِنَّ الْيَهُودَ وَالنَّصَارٰى لاَ يَصْبُغُونَ فَخَالِفُوهُمْ ‘‘নিশ্চয় ইয়াহূদ এবং নাসারারা (খ্রিস্টানেরা) রঞ্জক ব্যবহার করে না। অতএব তোমরা তাদের বিরোধিতা কর।’’
তুহফাতুল আহ্ওয়াযীতে নায়লুল আওত্বার-এর বরাতে লিখেন, এ হাদীসটি প্রমাণ করে যে, রঞ্জক ব্যবহার ও শুভ্রতা পরিবর্তন বৈধ হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে নাসারা ও ইয়াহূদীদের বিরোধিতা। এর মাধ্যমে খিযাব ব্যবহার মুস্তাহাব হওয়ার দিকটিও গুরুত্ব পায়। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আহলে কিতাবদের অনেক বেশি বিরোধিতা করতেন এবং এর নির্দেশ দিতেন। সালাফরাও এ সুন্নাতের অনেক গুরুত্ব দিতেন। এজন্যই ঐতিহাসিকদেরকে তুমি দেখবে যে, তারা তাদের চরিত লিখার সময় বলেন, তিনি খিযাব ব্যবহার করতেন এবং তিনি খিযাব ব্যবহার করতেন না। ইবনুল জাওযী লিখেন : সহাবা ও তাবি‘ঈনদের এক দল খিযাব লাগাতেন। ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল (রহিমাহুল্লাহ) যদি এমন কোন লোককে দেখতেন যে, তার দাড়িতে খিযাব লাগিয়েছে তখন বলতেন, আমি এমন এক লোক দেখছি যে একটি মরে যাওয়া সুন্নাত জীবিত করছে এবং তিনি তা দেখে আনন্দিত হতেন। (তুহফাতুল আহ্ওয়াযী ৫ম খন্ড, হাঃ ১৭৫২)
পরিচ্ছেদঃ ৩. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - চুল আঁচড়ানো
৪৪৫৬-[৩৮],৪৪৫৭-[৩৯] আর নাসায়ী ইবনু ’উমার ও যুবায়র (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন।
وَرَوَاهُ النَّسَائِيّ عَن ابْن عمر وَالزُّبَيْر
ব্যাখ্যাঃ ইমাম আহমাদ যুবায়র (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন। এভাবে তিনি এবং ইবনু হিব্বান আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকেও বর্ণনা করেন। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)