পরিচ্ছেদঃ ৪. প্রথম অনুচ্ছেদ - বিচারকার্য এবং সাক্ষ্যদান
’আল্লামা ত্বীবী (রহঃ) বলেনঃ বিচারকের নিকট যে মুকদ্দামাহ্ পেশ করা হয় তাকে বিচার বলে। আযহারী (রহঃ) বলেনঃ কোনো বিষয়ে বিচারকার্য শেষ করাকে কাযাউ বা বিচারকার্য বলা হয়।
কুরআন কারীমে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ ’’আমি বনী ইসরাঈলের নিকট ফায়সালা করেছিলাম’’- (সূরা বনী ইসরাঈল ১৭ : ৪)। হাকিম-কে কাযী বলা হয় এ কারণে যে, তিনি আইন-কানুন মেনে বিচার ফায়সালা করে থাকেন। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
৩৭৫৮-[১] ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ লোকেদের কোনো দাবির ভিত্তিতেই যদি তাদের পক্ষে রায় দেয়া হয়, তাহলে অনেকেই পরস্পরের মধ্যে লোকেদের জান ও মাল (মিথ্যা দাবি করে) আত্মহরণ করতে থাকবে। এজন্য বিবাদীর ওপর কসম অবধারিত। (মুসলিম)
তবে মুসলিম-এর শারহেন্ নববীতে আছে, তিনি বলেন, বায়হাক্বীর বর্ণনাতে হাসান অথবা সহীহ সানাদ দ্বারা আরো অতিরিক্ত শব্দ ইবনু ’আব্বাস থেকে মারফূ’ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। আর তা হলো- সাক্ষ্য-প্রমাণ বাদী পক্ষ দাখিল করবে আর বিবাদী বা প্রতিপক্ষের ওপর কসম অত্যাবশ্যকীয় হবে।[1]
بَابُ الْأَقْضِيَةِ وَالشَّهَادَاتِ
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «لَوْ يُعْطَى النَّاسُ بِدَعْوَاهُمْ لَادَّعَى نَاسٌ دِمَاءَ رِجَالٍ وَأَمْوَالَهُمْ وَلَكِنَّ الْيَمِينَ عَلَى الْمُدَّعَى عَلَيْهِ» . رَوَاهُ مُسْلِمٌ وَفِي «شَرْحِهِ لِلنَّوَوِيِّ» أَنَّهُ قَالَ: وَجَاءَ فِي رِوَايَةِ «الْبَيْهَقِيِّ» بِإِسْنَادٍ حَسَنٍ أَوْ صَحِيحٍ زِيَادَةٌ عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ مَرْفُوعًا: «لَكِنَّ الْبَيِّنَةَ على المدَّعي واليمينَ على مَنْ أنكر»
ব্যাখ্যা: হাদীসটি বিচারকার্য সম্পাদনের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ গাইডলাইন। এতে বলা হয়েছে, বিচারকার্যকে কোনো মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর ছেড়ে দেয়া যাবে না, বরং বিচারকার্য সম্পাদনে বিচারকরা সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করবেন।
হাদীস থেকে বুঝা যায়:
(ক) মনমত তথা মনে যা চায় সেরূপ বিচার করা বৈধ নয়।
(খ) বিচার হবে শারী‘আহ্নীতি অনুসরণের মাধ্যমে।
(গ) মানুষের রক্ত ও সম্পদ রক্ষা করা এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।
(ঘ) যদি কেউ কোনো জিনিসের দাবী করে তাহলে তাকে অবশ্যই দলীল পেশ করতে হবে- আর যে অস্বীকার করবে তাকে শপথ করতে হবে।
অত্র হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম নববী (রহঃ) বলেছেনঃ হাদীসটি একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম বলে দিচ্ছে বিচারকার্য সম্পাদনের ক্ষেত্রে। সুতরাং এ হাদীসে রয়েছে কোনো মানুষের শুধুমাত্র তার দাবীর প্রেক্ষিতেই তার স্বপক্ষে বিচার করা বৈধ হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত সে দলীল বা তার সঠিকতা প্রমাণ না করতে পারে। এর রহস্য বা কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই বলেছেন, যদি প্রমাণবিহীন ফায়সালা করা হয় তাহলে সবাই বিনা প্রমাণে অপর মানুষের রক্ত ও সম্পদ দাবী করে বসবে। (ফাতহুল বারী ৮ম খন্ড, হাঃ ৪৫৫২; শারহে মুসলিম ১২শ খন্ড, হাঃ ১৭১১; মিরকাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ ৪. প্রথম অনুচ্ছেদ - বিচারকার্য এবং সাক্ষ্যদান
৩৭৫৯-[২] ইবনু মাস্’ঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি মিথ্যা কসম করে কোনো মুসলিমের অর্থ-সম্পদ আত্মসাৎ করতে চায়, কিয়ামতের দিন সে এমন অবস্থায় আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ লাভ করবে যে, আল্লাহ তা’আলা তার ওপর অত্যন্ত ক্রোধান্বিত থাকবেন। অতঃপর এ কথার প্রেক্ষিতে আল্লাহ তা’আলা এ আয়াত নাযিল করলেনঃ ’’যারা আল্লাহ তা’আলার সাথে কৃত অঙ্গীকার ও তাঁর নামে করা কসম তুচ্ছমূল্যে (পার্থিব হাসিলের বিনিময়) বিক্রি করে দেয়.....’’- (সূরা আ-লে ’ইমরান ৩ : ৭৭)। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
بَابُ الْأَقْضِيَةِ وَالشَّهَادَاتِ
وَعَنِ ابْنِ مَسْعُودٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَنْ حَلَفَ عَلَى يَمِينِ صَبْرٍ وَهُوَ فِيهَا فَاجِرٌ يَقْتَطِعُ بِهَا مَالَ امْرِئٍ مُسْلِمٍ لَقِيَ اللَّهَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَهُوَ عَلَيْهِ غَضْبَانُ» فَأَنْزَلَ اللَّهُ تَصْدِيقَ ذَلِكَ: (إِنَّ الَّذِينَ يشترونَ بعهدِ اللَّهِ وأيمانِهمْ ثمنا قَلِيلا)
إِلَى آخر الْآيَة
ব্যাখ্যা: ‘আব্দুল্লাহ বিন মাস্‘ঊদ কর্তৃক এ হাদীসটি বিচারকার্যে মিথ্যা কথা বলার মাধ্যমে অপরের হক ছিনিয়ে নেয়ার বিরুদ্ধে কঠোর হুশিয়ারীমূলক। ইমাম নববী (রহঃ) বলেনঃ হাদীসে উল্লেখিত (يَمِينِ صَبْرٍ) (ইয়ামীনি সব্র) দ্বারা উদ্দেশ্য হলো স্থির বা দৃঢ়তার সাথে কৃত শপথ। এ শপথকে (مَصْبُورَ) তথা দৃঢ়করণ শপথও বলা হয়, অথবা এখানে শপথকারীকে ধৈর্যধারণকৃত বলা যেতে পারে যেহেতু এটা সে নিজের ওপর আবশ্যক করে নিয়েছে। (يَمِينِ صَبْرٍ) দ্বারা উদ্দেশ্য আরো পরিষ্কার করে এভাবে বলা যায় যে, আইনের দৃষ্টিতে রাষ্ট্রকর্তৃপক্ষ কোনো ব্যক্তি আইনানুগভাবে সুষ্ঠু বিচারকার্যের স্বার্থে যদি শপথ করতে বলে।
কেউ কেউ বলেছেন, মুসলিমের মাল-সম্পদ হরণের ঘৃণ্য উদ্দেশ্য নিয়ে ইচ্ছাকৃত মিথ্যা শপথের নামে (يَمِينِ صَبْرٍ) হাদীসটি উল্লেখিত فَاجِرٌ (ফাজির) শব্দের অর্থ হলো মিথ্যবাদী। হাদীসে উল্লেখিত মুসলিমের সস্পদ দ্বারা কেউ যিম্মীর সম্পদ উদ্দেশ্য করে তাহলে তা ভুল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
‘আল্লামা ত্বীবী (রহঃ) বলেছেনঃ সাক্ষ্যদানকালে মিথ্যা বলা কঠিনতম পাপাচারের অন্তর্ভুক্ত। কেননা এ ধরনের অপরাধী অপরাধের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায়।
ক) অন্যায়ভাবে অপরের সম্পদ হরণ।
খ) যে বিষয়টি সংরক্ষণের চরম গুরুত্ব দেয়া আবশ্যক ছিল তার প্রতি চরম অজ্ঞতা করা আর সেটি ইসলাম সংরক্ষণের দায়িত্ব ও আখিরাতকে গুরুত্ব প্রদান- এটি মানতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
গ) অন্যায় ও মিথ্যা শপথের প্রচলন ঘটালো।
এ ধরনের ব্যক্তির শাস্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে সে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে, এমতাবস্থায় আল্লাহ তার ওপর রাগান্বিত থাকবেন। আল্লাহ তার প্রতি দয়ার দৃষ্টি দিবেন না। ‘আল্লামা ত্বীবী (রহঃ) বলেছেনঃ আল্লাহ তার থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন।
এ হাদীসের সত্যায়ন পাওয়া যায় মহাগ্রন্থ আল কুরআনের সূরা আ-লি ‘ইমরান-এর ৭৭ নং আয়াতের মাঝে যেখানে আল্লাহ তা‘আলা সুস্পষ্টভাবে বলেছেনঃ ‘‘নিশ্চয় যারা আল্লাহর সাথে কেউ কৃত ওয়া‘দাকে সুলভমূল্যে বিক্রয় করে দেবে তাদের আখিরাতে কোনো অংশ নেই আল্লাহ তাদের সাথে কথা বলবেন না কিয়ামতে তাদের দিকে রহমাতের দৃষ্টি দিবেন না তাদেরকে পবিত্রও করবেন না, তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি’’। (ফাতহুল বারী ৮ম খন্ড, হাঃ ৪৫৫০; শারহে মুসলিম ২য় খন্ড, হাঃ ১৩৭; তুহফাতুল আহওয়াযী ৭ম খন্ড, হাঃ ৩০১২; মিরকাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ ৪. প্রথম অনুচ্ছেদ - বিচারকার্য এবং সাক্ষ্যদান
৩৭৬০-[৩] আবূ উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি কসমের মাধ্যমে কোনো মুসলিমের হক আত্মসাৎ করলো, আল্লাহ তা’আলা তার জন্য জাহান্নাম অবধারিত করে দিয়েছেন এবং তার জন্য জান্নাত হারাম করেছেন। অতঃপর জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রসূল! যদি তা নগণ্য কিছু হয়? তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ যদিও তা পিলু গাছের একটি ডালও হয় (’পিলু’ গাছ মিসওয়াক হিসেবে ব্যবহৃত হয়)। (মুসলিম)[1]
بَابُ الْأَقْضِيَةِ وَالشَّهَادَاتِ
وَعَنْ أَبِي أُمَامَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَنِ اقْتَطَعَ حَقَّ امْرِئٍ مُسْلِمٍ بِيَمِينِهِ فَقَدْ أَوْجَبَ اللَّهُ لَهُ النَّارَ وَحَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ» فَقَالَ لَهُ رَجُلٌ: وَإِنْ كَانَ شَيْئا يسير يَا رَسُولَ اللَّهِ؟ قَالَ: «وَإِنْ كَانَ قَضِيبًا من أَرَاك» . رَوَاهُ مُسلم
ব্যাখ্যা: অন্যায় শপথ করে মানুষের মাল সম্পদ জবর-দখল করার ভয়াবহতা বর্ণনাকারী অত্র হাদীসটির ব্যাখ্যাকার ‘আল্লামা মুল্লা ‘আলী কারী আল হানীফাহ্ (রহঃ) বলেনঃ অত্র হাদীস ‘‘সম্পদ নিয়ে নেয়’’ এর অর্থ হলো সম্পদের একটি বিরাট অংশ নিয়ে নেয়। ‘আল্লামা তূরিবিশতী-এর বরাত দিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘‘হক’’ ‘‘মাল’’ এর চেয়ে ব্যাপক অর্থ প্রদানকারী একটি শব্দ।
ইমাম নববী (রহঃ) বলেনঃ মৃত পশুর চামড়া নিয়ে নিলেও তা হারাম হবে যেহেতু তাও ‘‘হক’’ শব্দটি অন্তর্ভুক্ত করে। অনুরূপভাবে ঘোড়া চালানোর জিন এমনকি পশুর মাল যা দ্বারা উপকার লাভ সম্ভব এমন জিনিস মিথ্যা শপথ দ্বারা নিলে তাও হারাম হবে।
‘আল্লামা ত্বীবী (রহঃ) বলেনঃ আল্লাহ তার নিকট থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন এবং তাকে স্থায়ীভাবে জাহান্নামী করে দিবেন। কেউ বলেন, এর ব্যাখ্যা দু’ ধরনের হতে পারে। প্রথমতঃ যদি কেউ এ ধরনের মিথ্যা সাক্ষী দেয়াকে হালাল মনে করে, অতঃপর তার সাথে জড়িত হয় এবং এ অবস্থায় তার মৃত্যু হয় তাহলে সে চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবে। দ্বিতীয়তঃ সে জাহান্নামী হবে তবে আল্লাহ তা‘আলা ইচ্ছা করলে তাকে ক্ষমা করে দিবেন। (শারহে মুসলিম ২য় খন্ড, হাঃ ১৩৭; আল মুনতাকা ৭ম খন্ড, হাঃ ১৩৯২; মিরকাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ ৪. প্রথম অনুচ্ছেদ - বিচারকার্য এবং সাক্ষ্যদান
৩৭৬১-[৪] উম্মু সালামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমি তো একজন মানুষ মাত্র। তোমরা বিভিন্ন বিবাদ-মীমাংসা নিয়ে আমার নিকট আসো। আর সম্ভবত তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ সাক্ষী-প্রমাণ উপস্থাপনের ক্ষেত্রে অন্যের চেয়ে বেশি সচেতন ও পারদর্শী। অতঃপর আমি তোমাদের বিষয়াদি শুনার সময় যা উপলব্ধি করি তদানুযায়ী বিচার-ফায়সালা করি। অতএব আমি কোনো ব্যক্তির জন্য তার মুসলিম ভাইয়ের হক থেকে কোনো কিছু (ভুলক্রমে) ফায়সালা দিয়ে দেই, তাহলে সে যেন তা গ্রহণ না করে। কেননা আমি তার জন্য একখন্ড আগুনের টুকরাই ফায়সালা করলাম। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
بَابُ الْأَقْضِيَةِ وَالشَّهَادَاتِ
وَعَنْ أُمِّ سَلَمَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ وَإِنَّكُمْ تَخْتَصِمُونَ إِلَيَّ وَلَعَلَّ بَعْضَكُمْ أَنْ يَكُونَ أَلْحَنَ بِحُجَّتِهِ مِنْ بَعْضٍ فَأَقْضِي لَهُ عَلَى نَحْوِ مَا أَسْمَعُ مِنْهُ فَمَنْ قَضَيْتُ لَهُ بِشَيْءٍ مِنْ حَقِّ أَخِيهِ فَلَا يَأْخُذَنَّهُ فَإِنَّمَا أَقْطَعُ لَهُ قِطْعَةً مِنَ النَّار»
ব্যাখ্যা: অত্র হাদীস থেকে বুঝা যায়-
(ক) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের মতই মানুষ। মহান আল্লাহ সূরা কাহফ-এর ১১০ নং আয়াতে বলেন, অর্থাৎ ‘‘হে নাবী! আপনি বলে দিন আমি তোমাদের মতই একজন মানুষ (পার্থক্য এটুকু যে,) আমার নিকট আল্লাহর নিকট থেকে ওয়াহী আসে তোমাদের আসে না।’’
খ) নাবী-রসূলগণও মা’সূম নন তবে তাদের ভুল হলে সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ সংশোধন করিয়ে দিতেন।
গ) কুরআন ও হাদীস থেকে তারাই হিদায়াত পায় যাদের অন্তরে আল্লাহর ভয় আছে।
ঘ) বিচারকার্যে বাদী-বিবাদীর মধ্যে একে অপরের চেয়ে অপেক্ষাকৃত বেশী যুক্তি উপস্থাপনকারী, ভাষায় দক্ষ হতে পারে, মিথ্যা কথার ফুলঝুড়ি দিয়ে অপরের সম্পদ গ্রহণ কোনোভবেই বৈধ নয়।
ঙ) বিচারকের জন্য অবধারিত যে, তিনি বাদী-বিবাদী উভয়ের কথা শুনেই বিচার করবেন। একপক্ষের কথা শুনে বিচারের রায় প্রদান কোনভাবে গ্রহণীয় নয়।
এক্ষেত্রে একটি হাদীস খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত যেখানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ হাকিম যদি ন্যায়বিচারের চেষ্টা করে সফল হয় তাহলে তার দ্বিগুণ সাওয়াব আর যদি সফল না হয় তাহলে এক সাওয়াব, তাই সকল বিচারপতিদের উচিত ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হওয়া।
অত্র হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম নববী (রহঃ) বলেছেনঃ অত্র হাদীস থেকে বুঝা যায়, মানুষের বাস্তবিক অবস্থা আরো বুঝা যায় সে গায়েব জানে না, তাই বাহ্যিক দলীলাদি দেখেই তাকে ফায়সালা দিতে হয়।
(ফাতহুল বারী ১২শ খন্ড, হাঃ ৬৯৬৭; শারহে মুসলিম ১২শ খন্ড, হাঃ ১৭১৩; তুহফাতুল আহওয়াযী ৪র্থ খন্ড, হাঃ ১৩৩৯; ‘আওনুল মা‘বূদ ৬ষ্ঠ খন্ড, হাঃ ৩৫৮০; মিরকাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ ৪. প্রথম অনুচ্ছেদ - বিচারকার্য এবং সাক্ষ্যদান
৩৭৬২-[৫] ’আয়িশাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলার নিকট সবচেয়ে নিকৃষ্ট লোক হলো অতিমাত্রায় ঝগড়াটে, অর্থাৎ বেশী বেশী সর্বদা ঝগড়া করে। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
بَابُ الْأَقْضِيَةِ وَالشَّهَادَاتِ
وَعَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا قَالَتْ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «إِنَّ أَبْغَضَ الرِّجَالِ إِلَى اللَّهِ الْأَلَدُّ الخَصِمُ»
ব্যাখ্যা: أَلَدُّ الخَصِمُ ‘‘আলাদ্দুল খসিম’’ শব্দটির অর্থ চরম বিতার্কিক যার সাথে কেউ তর্ক করে পারে না। কুরআনে মাজীদে সূরা আল বাকারা-এর ২০৪ নং আয়াতে এসেছে, এ শ্রেণীর লোকের আলোচনা মহান আল্লাহ বলেন, অর্থাৎ ‘‘মানুষের মধ্যে এক শ্রেণীর মানুষ রয়েছে যার কথা খুবই চমৎকার এবং অন্তরের বিষয় সম্পর্কে আল্লাহকে সাক্ষী মানে আর সে হচ্ছে সবচেয়ে বড় বিতার্কিক।’’
অত্র হাদীসটির সমর্থনে তাম্মাম মু‘আয বিন জাবাল থেকে আরো একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন যেখানে বলা হয়েছে,
أَبْغَضُ الْخَلْقِ إِلَى اللّٰهِ مَنْ آمَنَ، ثُمَّ كَفَرَ অর্থাৎ সর্বনিকৃষ্ট সৃষ্টি আল্লাহর নিকটে সে যে ঈমান আনয়ন করলো, তারপর কাফির হয়ে গেল।
অত্র হাদীসটিতে মুখের জোর খাটিয়ে অন্যের হক মারাকে কুফরী হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে।
‘উকায়লী ও দায়লামী ‘আয়িশাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন,
أَبْغَضُ الْعِبَادِ إِلَى اللّٰهِ مَنْ كَانَ ثَوْبَاهُ خَيْرًا مِنْ عَمَلِه أَنْ تَكُونَ ثِيَابُه ثِيَابَ الْأَنْبِيَاءِ وَعَمَلُه عَمَلَ الْجَبَّارِينَ
অর্থাৎ আল্লাহর নিকট সর্বাধিক নিকৃষ্ট বান্দা সে যার বাহির ভিতরের চেয়ে ভালো, তার কাপড় নাবীদের আর ‘আমল যালিমদের।
অত্র হাদীস থেকে বুঝা যায়, অন্যায়ভাবে মুখের জোর খাটিয়ে মানুষের হক মেরে খেলে কিয়ামতে কঠিন পরিস্থিতির স্বীকার হতে হবে। আল্লাহ সবাইকে হিফাযাত করুন। আমীন। (ফাতহুল বারী ৫ম খন্ড, হাঃ ২৪৫৭; শারহে মুসলিম ১৬শ খন্ড, হাঃ ২৬৬৮; তুহফাতুল আহওয়াযী ৭ম খন্ড, হাঃ ২৯৭৬; মিরকাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ ৪. প্রথম অনুচ্ছেদ - বিচারকার্য এবং সাক্ষ্যদান
৩৭৬৩-[৬] ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি কসম ও এক সাক্ষীর মাধ্যমে বিচার-ফায়সালা করেছেন। (মুসলিম)[1]
بَابُ الْأَقْضِيَةِ وَالشَّهَادَاتِ
وَعَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ: أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسلم قضى بِيَمِين وَشَاهد. رَوَاهُ مُسلم
ব্যাখ্যা: অত্র হাদীসে বিচারকার্যে সাক্ষী প্রয়োজন দু’জন যদি একজন না পাওয়া যায়, তাহলে শপথ দ্বারা এক সাক্ষীর ঘাটতি পূরণ করতে হবে। এটা বুঝা যায় যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন।
আল্ মুযহির বলেনঃ অত্র হাদীসে বাদীর সাক্ষী ছিল একজন তাই তাকে নাবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শপথ করতে বললেন যাতে তার এক সাক্ষীর ঘাটতি পূর্ণ হয়। এ শপথটি তার একজন সাক্ষীর পরিবর্তে। সুতরাং যখন সে শপথ করল তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার পক্ষে রায় দিলেন। এ মতই পোষণ করেছেন ইমাম শাফি‘ঈ, মালিক এবং ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ)। অপরদিকে ইমাম আবূ হানীফাহ্ (রহঃ) বলেছেন, একজন সাক্ষী আর একটি শপথের মাধ্যমে ফায়সালা বৈধ নয় বরং দু’জন সাক্ষী আবশ্যক। যেহেতু মহান আল্লাহ বলেনঃ ‘‘তোমরা দু’জন সাক্ষী সন্ধান কর যদি না পাও তাহলে একজন পুরুষ ও দু’জন নারী’’- (সূরা আল বাকারা ২ : ২৮৬)। (শারহে মুসলিম ১২শ খন্ড, হাঃ ১৭১২; ‘আওনুল মা‘বূদ ৬ষ্ঠ খন্ড, হাঃ ৩৬০৭; মিরকাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ ৪. প্রথম অনুচ্ছেদ - বিচারকার্য এবং সাক্ষ্যদান
৩৭৬৪-[৭] ’আলকমাহ্ ইবনু ওয়ায়িল (রহঃ) তাঁর পিতা হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, একদিন হাযরামাওত এবং কিনদাহ্ গোষ্ঠীর জনৈক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট উপস্থিত হলো। অতঃপর হাযরামী গোষ্ঠীর লোকটি বললঃ হে আল্লাহর রসূল! এই ব্যক্তি আমার জমি জোর-জবরদস্তিভাবে দখল করে নিয়েছে। তখন কিনদী গোষ্ঠীর লোকটি বলল, উক্ত জমির মালিক আমি এবং তা আমারই তত্ত্বাবধানে আছে। তাতে ঐ লোকটির কোনো অধিকার নেই। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হায্রামীকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কি কোনো দলীল-প্রমাণ আছে? সে বলল, না। তাহলে বিবাদীর (প্রতিপক্ষের) কসমই তোমার প্রাপ্য।
হাযরামী লোকটি বললঃ হে আল্লাহর রসূল! সে অসৎলোক। কিসের উপর কসম করছে, সে তার কোনো পরোয়া করে না, তার মধ্যে কোনো আল্লাহভীতি নেই। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ তার ব্যাপারে তোমার জন্য তাছাড়া আর কোনো পথও খোলা নেই। অতঃপর সে কিনদী লোকটি যখন কসম করতে চাইল, তখন সে পিঠ ফিরে গেল। এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ যদি এ লোকটি প্রকৃতপক্ষে জোরপূর্বকভাবে অপরের সম্পত্তি ভোগ করার জন্য কসম করে, তাহলে সে আল্লাহর সাথে এমন অবস্থায় সাক্ষাৎ করবে যে, আল্লাহ তা’আলা এ লোকটির প্রতি অসন্তুষ্ট থাকবেন। (মুসলিম)[1]
بَابُ الْأَقْضِيَةِ وَالشَّهَادَاتِ
وَعَنْ عَلْقَمَةَ بْنِ وَائِلٍ عَنْ أَبِيهِ قَالَ: جَاءَ رَجُلٌ مِنْ حَضْرَمَوْتَ وَرَجُلٌ مِنْ كِنْدَةَ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ الْحَضْرَمِيُّ: يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّ هَذَا غَلَبَنِي عَلَى أَرْضٍ لِي فَقَالَ الْكِنْدِيُّ: هِيَ أَرْضِي وَفِي يَدِي لَيْسَ لَهُ فِيهَا حَقٌّ فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِلْحَضْرَمِيِّ: «أَلَكَ بَيِّنَةٌ؟» قَالَ: لَا قَالَ: «فَلَكَ يَمِينُهُ» قَالَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّ الرَّجُلَ فَاجِرٌ لَا يُبَالِي عَلَى مَا حَلَفَ عَلَيْهِ وَلَيْسَ يَتَوَرَّعُ منْ شيءٍ قَالَ: «ليسَ لكَ مِنْهُ إِلَّا ذَلِكَ» . فَانْطَلَقَ لِيَحْلِفَ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَمَّا أَدْبَرَ: «لَئِنْ حَلَفَ عَلَى مَالِهِ لِيَأْكُلَهُ ظُلْمًا لَيَلْقَيَنَّ اللَّهَ وَهُوَ عَنهُ معرض» . رَوَاهُ مُسلم
ব্যাখ্যা: হাদীসের ব্যাখ্যায় ‘আল্লামা ত্বীবী (রহঃ) বলেনঃ অত্র হাদীসে বলা হয়েছে, যারা অন্যায়ভাবে মানুষের সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখবে তাদের দিকে কিয়ামতের দিন তাকাবেন না, এর উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহ তাদেরকে লাঞ্ছিত করবেন যেমন অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, মহান আল্লাহ বলেনঃ ‘‘আল্লাহ তাদের সাথে কথা বলবেন না এবং তাদের দিকে রহমাতের দৃষ্টি দিবেন না।’’ (সূরা আ-লি ‘ইমরান ৩ : ৭৭) [না‘ঊযুবিল্লাহ]
হাদীসের উল্লেখযোগ্য শিক্ষা:
১) যার হাতে সম্পদ আছে তার শক্তি বেশী।
২) বিবাদীকে অবশ্যই শপথ করতে হবে।
৩) যদি বাদী তার স্বপক্ষে দলীল উপস্থাপনে সক্ষম হয় তাহলে মাল বিবাদীর হাতে থাকলেও তা বাদীর হয়ে যাবে।
৪) মিথ্যা শপথ আর সত্য শপথের বিচার কার্যে কোনো পার্থক্য থাকে না কারণ মিথ্যা বলছে কি না এটাতো বিচারক মিথ্যাবাদীর বুক ফেড়ে দেখতে পারবেন না। তাই অদৃশ্যেও বিষয় নয় বরং বাহ্যিক না বুঝা যায় তার উপর ভিত্তি করেই বিচারপতি তার রায় প্রদান করবেন। (শারহে মুসলিম ২য় খন্ড, হাঃ ৬১; মিরকাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ ৪. প্রথম অনুচ্ছেদ - বিচারকার্য এবং সাক্ষ্যদান
৩৭৬৫-[৮] আবূ যার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কোনো ব্যক্তি যদি এমন জিনিসের দাবী করে, যে জিনিসের প্রকৃত (মালিক) সে নয়, সে আমার দলভুক্ত নয়। সে যেন তার বাসস্থান জাহান্নামে নির্দিষ্ট করে নেয়। (মুসলিম)[1]
بَابُ الْأَقْضِيَةِ وَالشَّهَادَاتِ
وَعَنْ أَبِي ذَرٍّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ أَنَّهُ سَمِعَ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: «مَنِ ادَّعَى مَا لَيْسَ لَهُ فَلَيْسَ مِنَّا وَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ» . رَوَاهُ مُسْلِمٌ
ব্যাখ্যা: অত্র হাদীসটিতে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি এমন কিছু দান করবে যা তার নয় তাহলে সে আমাদের দলভুক্ত নয় এবং সে তার স্থান জাহান্নামে করে নিল।
অত্র হাদীসের অংশ (فَلَيْسَ مِنَّا)-এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, (فَلَيْسَ مِنَّا) مَعْشَرِ أَهْلِ الْجَنَّةِ অর্থাৎ- সে জান্নাতীদের দলভুক্ত নয়। পরবর্তী অংশে বলা হয়েছে, ‘‘সে যেন তার থাকার স্থান জাহান্নামে করে নেয়’’ এ অংশটুকু বাহ্যিকভাবে নির্দেশবাচক হলেও বস্তুত তা বিবৃতিমূলক, অর্থাৎ যে এমন করবে তার থাকার জায়গা জাহান্নাম। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ ৪. প্রথম অনুচ্ছেদ - বিচারকার্য এবং সাক্ষ্যদান
৩৭৬৬-[৯] যায়দ ইবনু খালিদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমি কি তোমাদেরকে বলে দিবো না, সর্বোত্তম সাক্ষ্যদানকারী কারা? সে ব্যক্তিই উত্তম সাক্ষ্যদানকারী, যাকে চাওয়ার আগে স্বীয় সাক্ষী প্রদান করে। (মুসলিম)[1]
بَابُ الْأَقْضِيَةِ وَالشَّهَادَاتِ
وَعَنْ زَيْدِ بْنِ خَالِدٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «أَلَا أُخْبِرُكُمْ بِخَيْرِ الشُّهَدَاءِ؟ الَّذِي يَأْتِي بشهادتِه قبلَ أنْ يسْأَلهَا» . رَوَاهُ مُسلم
ব্যাখ্যা: অত্র হাদীসে সত্য সাক্ষী প্রদানের প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। ইমাম নববী (রহঃ) বলেনঃ অত্র হাদীসের দু’টি ব্যাখ্যা হতে পারে, এর মধ্যে সর্বাধিক সহীহ মত হচ্ছে ইমাম মালিক ও ইমাম শাফি‘ঈ-এর ছাত্ররা যে মত পোষণ করেছেন আর সেটি হচ্ছে কোথাও কোনো বিচার কাজ হচ্ছে দেখা যাচ্ছে বাদী-বিবাদীর কেউ সত্য সাক্ষীর অভাবে পরাজিত হচ্ছে আর মাজলিসে এমন একজন লোক রয়েছে যে প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে অভিহিত, এমতাবস্থায় তার নিকট সাক্ষী না চাওয়া হলেও সে যদি এটাকে আমানত মনে করে সাক্ষী দেয় তাহলে সে সর্বোত্তম সাক্ষী হবে। এ হাদীসের দ্বিতীয় আরেকটি ব্যাখ্যা হলো, মানুষের হাকের বিষয়ের সাক্ষী যেমন ত্বলাকের সাক্ষী, স্বাধীন করানোর সাক্ষী, জমি-জমা ওয়াক্ফ করার সাক্ষী, সাধারণ ওয়াসিয়্যাতের সাক্ষী, হাদ্দসমূহের সাক্ষী ইত্যাদি। যেমন- পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেনঃ অর্থাৎ ‘‘তোমরা আল্লাহর জন্য সাক্ষী কায়িম কর।’’ (সূরা আত্ব তালাক ৬৫ : ২)
অত্র হাদীসটি পরবর্তী হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক নয় যেখানে বলা হয়েছে, সাক্ষী না চাইলেও সাক্ষী দিবে। কারণ অত্র হাদীসটি হলো সত্য সাক্ষ্য প্রদানের আর পরের হাদীসটি হলো মিথ্যা সাক্ষী প্রদানের।
(শারহে মুসলিম ১২শ খন্ড, হাঃ ১৭১৯; ‘আওনুল মা‘বূদ ৬ষ্ঠ খন্ড, হাঃ ৩৫৯৩; তুহফাতুল আহওয়াযী ৬ষ্ঠ খন্ড, হাঃ ২২৯৫; আল মুনতাকা ৭ম খন্ড, হাঃ ১৩৮১; মিরকাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ ৪. প্রথম অনুচ্ছেদ - বিচারকার্য এবং সাক্ষ্যদান
৩৭৬৭-[১০] ইবনু মাস্’ঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমার যুগের মানুষ সর্বোত্তম। তারপর তাদের পরবর্তী যুগের লোকেরা এবং এরপর তাদের পরবর্তী যুগের লোকেরা। অতঃপর এমন সব লোকের আগমন ঘটবে যাদের প্রত্যেকের সাক্ষ্য কসমের অগ্রগণ্য হবে এবং কসম সাক্ষ্য হতে অগ্রগণ্য হবে। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
بَابُ الْأَقْضِيَةِ وَالشَّهَادَاتِ
وَعَنِ ابْنِ مَسْعُودٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «خَيْرُ النَّاسِ قَرْنِي ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ ثُمَّ يَجِيءُ قَوْمٌ تَسبِقُ شَهَادَة أحدِهمْ يَمِينه وَيَمِينه شَهَادَته»
ব্যাখ্যা: এ হাদীসটিতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিয়ামত পর্যন্ত মানুষের মধ্যে একটি নির্দেশনা দিয়ে দিলেন যে, মানুষের মধ্যে সর্বোত্তম মানুষ হলেন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগের মানুষ অর্থাৎ সাহাবীগণ, অতঃপর উত্তম মানুষ হলেন তৎপরবর্তী লোকেরা অর্থাৎ তাবি‘ঈগণ, এরপর উত্তম মানুষ হলেন তাবি-তাবি‘ঈগণ। অত্র হাদীটিতে বলা হয়েছে, সর্বোত্তম যুগ, আমার যুগ এখানে ‘যুগ’ দ্বারা উদ্দেশ্য কি? তা নিয়ে বিজ্ঞজনের মাঝে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন ৩০ বছর, কেউ বলেছেন ৪০ বছর, কেউ বলেছেন ৬০ বছর, কেউ বলেছেন ৭০ বছর, কেউ বলেছেন ৮০ বছর, কেউ বলেছেন ১০০ বছর এর কথা ব্যক্ত করেছে।
অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার একটি বাচ্চার মাথায় হাত দিয়ে বলেছিলেন, তুমি একযুগ বেঁচে থাক, পরবর্তীতে দেখা গেল বাচ্চাটি ১০০ বছর জীবিত ছিল। এখান থেকে দলীল নিয়ে কেউ কেউ একযুগ সমান সমান ১০০ বছর এর উল্লেখ করেছন।
হাদীসটিতে একশ্রেণীর মানুষের কথা উল্লেখ করা হয়েছে যারা সাক্ষী না চাওয়া হলেও তারা সাক্ষী দিবে এর অর্থ হলো তারা মিথ্যা সাক্ষী দিবে। এমনটিই ব্যাখ্যা করেছেন কাযী ‘ইয়াযসহ অন্যান্য ‘উলামায়ে কিরাম। (শারহে মুসলিম ১৬শ খন্ড, হাঃ ২৫৩৩; তুহফাতুল আহওয়াযী ৬ষ্ঠ খন্ড, হাঃ ২৩০৩; মিরকাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ ৪. প্রথম অনুচ্ছেদ - বিচারকার্য এবং সাক্ষ্যদান
৩৭৬৮-[১১] আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। (একদিন) নিশ্চয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক গোত্রের ওপর কসম করার নির্দেশ দিলেন। অতঃপর তারা সকলেই (কসমের জন্য) স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এলো। অতএব তিনি তাদের মধ্যে কে কসম করবে, সে ব্যাপারে লটারী করার হুকুম দিলেন। (বুখারী)[1]
بَابُ الْأَقْضِيَةِ وَالشَّهَادَاتِ
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَرَضَ عَلَى قَوْمٍ الْيَمِينَ فَأَسْرَعُوا فَأَمْرَ أَنْ يُسْهَمَ بَيْنَهُمْ فِي اليَمينِ أيُّهُمْ يحْلِفُ. رَوَاهُ البُخَارِيّ
ব্যাখ্যা: বিচারকার্য সম্পাদনের জন্য অত্র হাদীসটি মাইলফলক। যেখানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লটারীর মাধ্যমে বিচার করেছেন।
প্রখ্যাত ‘আলিমী দীন আল্ মুযহির (রহঃ) বলেনঃ এ রকম বিচারের পদ্ধতি হলো দু’ব্যক্তি জিনিসের দাবীদার জিনিসটি রয়েছে তৃতীয় ব্যক্তির নিকটে দু’জনের, একজনেরও কোনো প্রমাণ নেই অথবা দু’জনেরই প্রমাণ রয়েছে। তৃতীয় ব্যক্তি বলছেন, আমি জানি না জিনিসটি কার? অর্থাৎ জিনিসটি কি এদের দু’জনের কারো নাকি অন্য কারো। এমতাবস্থায় তাদের মাঝে তিনি লটারী করবেন, লটারীতে যার নাম উঠবে তাকে শপথ করতে বললেন, শপথ করলে তার পক্ষে রায় দিবেন। এভাবে ফায়সালার পক্ষে অবস্থান ‘আলী (রাঃ)-এর। ইমাম শাফি‘ঈ বলেনঃ জিনিসটি তৃতীয় ব্যক্তির হাতে থাকবে। ইমাম আবূ হানীফাহ্ (রহঃ) বলেনঃ জিনিসটি দু’ খন্ড করে দু’জনকে দিয়ে দিতে হবে। (ফাতহুল বারী ৫ম খন্ড, হাঃ ২৬৭৪; মিরকাতুল মাফাতীহ)