বিতর মূলতঃ এক রাক‘আত। কারণ যত ছালাতই আদায় করা হোক এক রাক‘আত আদায় না করলে বিতর হবে না। এ মর্মে অনেক ছহীহ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু এক রাক‘আত বলে কোন ছালাতই নেই, এই কথাই সমাজে বেশী প্রচলিত। উক্ত মর্মে কিছু উদ্ভট বর্ণনাও উল্লেখ করা হয়।

(أ) عَنْ أَبِىْ سَعِيْدٍ أَنَّ النَّبِىَّ نَهَى عَنِ الْبُتَيْرَاءِ أَنْ يُّصَلِّىَ الرَّجُلُ وَاحِدَةً يُوْتِرُ بِهَا.

(ক) আবু সাঈদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) এক রাক‘আত বিতর পড়তে নিষেধ করেছেন। তাই কোন ব্যক্তি যেন এক রাক‘আত ছালাত আদায় করে বিজোড় না করে।[1]

তাহক্বীক্ব : আব্দুল হক্ব বলেন, উক্ত বর্ণনার সনদে ওছমান বিন মুহাম্মাদ বিন রবী‘আহ রয়েছে।[2] ইমাম নববী বলেন, এক রাক‘আত বিতর নিষেধ মর্মে মুহাম্মাদ বিন কা‘ব-এর হাদীছ মুরসাল ও যঈফ।[3] উক্ত বর্ণনা গ্রহণযোগ্য না হলেও ‘হেদায়ার’ ভাষ্য গ্রন্থ ‘আল-ইনাইয়াহ’ কিতাবে তাকে খুব প্রসিদ্ধ বলে দাবী করা হয়েছে। অর্থাৎ এক রাক‘আত বিতর পড়ার বিরোধিতা করা হয়েছে।[4]

(ب) عَنْ حُصَيْنٍ قَالَ بَلَغَ ابْنَ مَسْعُوْدٍ أَنَّ سَعْدًا يُوْتِرُ بِرَكْعَةٍ قَالَ مَا أَجْزَأْتُ رَكْعَةً قَطُّ

(খ) হুছাইন (রাঃ) বলেন, ইবনু মাসঊদ (রাঃ)-এর কাছে যখন এই কথা পৌঁছল যে, সা‘দ (রাঃ) এক রাক‘আত বিতর পড়েন। তখন তিনি বললেন, আমি এক রাক‘আত ছালাতকে কখনো যথেষ্ট মনে করিনি’।[5] অন্যত্র সরাসরি তাঁর পক্ষ থেকে বর্ণনা এসেছে, عَنِ ابْنِ مَسْعُوْدٍ مَا أَجْزَأْتُ رَكْعَةً قَطُّ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, আমি কখনো এক রাক‘আত ছালাত যথেষ্ট মনে করি না’।[6]

তাহক্বীক্ব : ইমাম নববী (রাঃ) উক্ত আছার উল্লেখ করার পর বলেন, এটি যঈফ ও মাওকূফ। ইবনু মাসঊদের সাথে হুছাইনের কখনো সাক্ষাৎ হয়নি। ইবনু হাজার আসক্বালানীও তাই বলেছেন।[7]

(ج) قَالَ أَبُوْ حَنِيْفَةَ لاَ يَصِحُّ الْإِيْتَارُ بِوَاحِدَةٍ وَلاَ تَكُوْنُ الرَّكْعَةُ الْوَاحِدَةُ صَلاَةً قَطُّ.

(গ) আবু হানীফা (রহঃ) বলেন, ‘এক রাক‘আত বিতর পড়া ঠিক নয়। তাছাড়া ছালাত কখনো এক রাক‘আত হয় না’।[8]

তাহক্বীক্ব : উক্ত বক্তব্যের কোন সত্যতা নেই। তাছাড়া রাসূল (ছাঃ) যেহেতু এক রাক‘আত বিতর পড়েছেন এবং পড়তে বলেছেন, সেহেতু অন্য কারো ব্যক্তিগত কথার কোন মূল্য নেই।

জ্ঞাতব্য : ইমাম ত্বাহাবী বলেন, ‘বিতর ছালাত এক রাক‘আতের অধিক। এক রাক‘আত বিতর সম্পর্কে কোন হাদীছ বর্ণিত হয়নি।[9] হেদায়া কিতাবে বিতর সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে, কিন্তু এক রাক‘আত বিতর সম্পর্কে কোন কথা উল্লেখ করা হয়নি। শুধু তিন রাক‘আতের কথা বলা হয়েছে।[10] মাওলানা মুহিউদ্দ্বীন খান তার ‘তালীমুস্-সালাত’ বইয়ে বিতর সম্পর্কে আলোচনা করেছেন প্রায় ছয় পৃষ্ঠা। কিন্তু কোথাও এক রাক‘আত বিতর-এর কথা উল্লেখ করেননি।[11] ড. ইলিয়াস ফায়সাল ‘নবীজীর নামায’ বইয়ে লিখেছেন, ‘বিতর সর্বনিম্ন তিন রাকাআত। আমরা জানি যে, দু’ রাকাআতের নিচে কোনো নামায নেই। .. হাদীস শরীফ থেকে বোঝা যায় যে, বিতর হল সর্বনিম্ন তিন রাকাআত’।[12] ‘মাযহাব বিরোধীদের স্বরূপ সন্ধানে’ বইয়ে ৩২০ থেকে ৩৩২ পৃষ্ঠা পর্যন্ত বিতর সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু কোথাও এক রাক‘আত বিতরের কথা বলা হয়নি। বরং বিভিন্নভাবে চেষ্টা করা হয়েছে যে, তিন রাক‘আতের কম বিতর পড়া যায় না। ভাবখানা এমন যে, তারা জানেন না বা হাদীছে কোন দিন দেখেননি যে বিতর ছালাত এক রাক‘আতও আছে।

আমরা শুধু এতটুকু বলব যে, সাধারণ মুছল্লীদেরকে যে কৌশলেই ধোঁকা দেয়া হোক, আল্লাহ সে বিষয়ে সর্বাধিক অবগত। কেউই তাঁর আয়ত্বের বাইরে নয়। অতএব সাবধান!

[1]. ইবনু আব্দিল বার্র, আত-তামহীদ, আল-আহকামুল উস্তা ২/৫০ পৃঃ; আলোচনা দ্রঃ টীকা, মুওয়াত্ত্বা মালেক, তাহক্বীক্ব : ড. তাক্বিউদ্দীন আন-নাদভী হা/২৫৮।

[2]. فى إسناده عثمان بن محمد بن ربيعة والغالب على حديثه الوهم আল-আহকামুল উস্তা ২/৫০ পৃঃ।

[3]. حديث محمد بن كعب في النهي عن البتيراء مرسل ضعيف ...নববী, খুলাছাতুল আহকাম হা/১৮৮৮; কাশফুল খাফা।

[4]. اُشْتُهِرَ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نَهَى عَنْ الْبُتَيْرَاءِ হেদায়াহ ২/১৮৪ পৃঃ।

[5]. ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল কাবীর হা/৯৪২২।

[6]. খুলাছাতুল আহকাম ফী মুহিম্মাতিস সুনান ওয়া ক্বাওয়াইদিল ইসলাম হা/১৮৮৯।

[7]. তাহক্বীক্ব মুওয়াত্ত্ব মুহাম্মাদ ২/২২ পৃঃ।

[8]. ছহীহ মুসলিম শরহে নববী ১/২৫৩ পৃঃ, হা/১৭৫১-এর হাদীছের আলোচনা দ্রঃ।

[9]. ত্বাহাবী হা/১৭৩৯-এর আলোচনা দেখুন أَنَّ الْوِتْرَ أَكْثَرُ مِنْ رَكْعَةٍ وَلَمْ يُرْوَ فِى الرَّكْعَةِ شَيْءٌ।

[10]. হেদায়া ১/১৪৪-১৪৫ পৃঃ।

[11]. ঐ, পৃঃ ১৬৯-১৭৪।

[12]. ঐ, পৃঃ ২৪১।
এক রাক‘আত বিতর পড়ার ছহীহ হাদীছ সমূহ

عَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ كَانَ رَسُوْلُ اللهِ يُصَلِّى مِنَ اللَّيْلِ مَثْنَى مَثْنَى وَيُوْتِرُ بِرَكْعَةٍ.

ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) রাত্রে দুই দুই রাক‘আত করে ছালাত আদায় করতেন এবং এক রাক‘আত বিতর পড়তেন।[1] রাসূল (ছাঃ) এক রাক‘আত বিতর পড়ার নির্দেশও দিয়েছেন। যেমন-

عَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ الْوِتْرُ رَكْعَةٌ مِنْ آخِرِ اللَّيْلِ.

ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘বিতর এক রাক‘আত শেষ রাত্রে’।[2]

عَنِ ابْنِ عُمَرَ أَنَّ رَجُلًا سَأَلَ رَسُوْلَ اللهِ عَنْ صَلَاةِ اللَّيْلِ فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ عَلَيْهِ السَّلَام صَلَاةُ اللَّيْلِ مَثْنَى مَثْنَى فَإِذَا خَشِيَ أَحَدُكُمْ الصُّبْحَ صَلَّى رَكْعَةً وَاحِدَةً تُوْتِرُ لَهُ مَا قَدْ صَلَّى.

ইবনু ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বিতর ছালাত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। উত্তরে তিনি বলেন, ‘রাত্রির ছালাত দুই দুই রাক‘আত করে। সুতরাং তোমাদের কেউ যখন সকাল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করবে, তখন সে যেন এক রাক‘আত পড়ে নেয়। তাহলে সে এতক্ষণ যা পড়েছে তার জন্য সেটা বিতর হয়ে যাবে’।[3]

عَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَاةُ اللَّيْلِ مَثْنَى مَثْنَى وَالْوِتْرُ رَكْعَةٌ وَاحِدَةٌ.

ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘রাত্রির ছালাত দুই দুই রাক‘আত। আর বিতর এক রাক‘আত’।[4]

عَنْ أَبِىْ أَيُّوْبَ الأَنْصَارِىِّ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ الْوِتْرُ حَقٌّ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ فَمَنْ أَحَبَّ أَنْ يُوْتِرَ بِخَمْسٍ فَلْيَفْعَلْ وَمَنْ أَحَبَّ أَنْ يُوْتِرَ بِثَلاَثٍ فَلْيَفْعَلْ وَمَنْ أَحَبَّ أَنْ يُوْتِرَ بِوَاحِدَةٍ فَلْيَفْعَلْ.

আবু আইয়ুব আনছারী (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, বিতর পড়া প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তির উপর বিশেষ কর্তব্য। সুতরাং যে পাঁচ রাক‘আত পড়তে চায়, সে যেন তাই পড়ে। আর যে তিন রাক‘আত পড়তে চায় সে যেন তা পড়ে এবং যে এক রাক‘আত পড়তে চায় সে যেন তাই পড়ে।[5]

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ مَسْعُوْدٍ عَنِ النَّبِىِّ قَالَ إِنَّ اللهَ وِتْرٌ يُحِبُّ الْوِتْرَ فَأَوْتِرُوْا يَا أَهْلَ الْقُرْآنِ.

আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ বিজোড়। তিনি বিজোড়কে পসন্দ করেন। সুতরাং হে কুরআনের অনুসারীরা! তোমরা বিতর পড়’।[6]

সুধী পাঠক! উপরিউক্ত হাদীছগুলো থাকতে কেন বলা হয় যে, এক রাক‘আত কোন ছালাত নেই? সর্বশেষ হাদীছটিতে সরাসরি আল্লাহর সাথে তুলনা করা হয়েছে। কিন্তু আল্লাহ এক বিজোড়, না তিন, না পাঁচ বিজোড় তা কি বলার অপেক্ষা রাখে? হাদীছের গ্রন্থগুলো বিভিন্ন মাদরাসায় পড়ানো হয়, বরকতের জন্য ‘খতমে বুখারী’ নামে লোক দেখানো অনুষ্ঠানও করা হয়। কিন্তু উক্ত হাদীছগুলো কি তাদের চোখে পড়ে না? এটা অবশ্যই মাযহাবী নীতিকে ঠিক রাখার অপকৌশল মাত্র। রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছকে যদি এভাবে অবজ্ঞা ও গোপন করা হয়, তবে ক্বিয়ামতের মাঠে কে উদ্ধার করবে? যে সমস্ত ব্যক্তি ও মাযহাবের পক্ষে ওকালতি করা হচ্ছে তারা কি বিচারের দিন কোন উপকারে আসবে?

ঢাকার ‘জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়া’-এর শিক্ষক মাওলানা আব্দুল মতিন ‘দলিলসহ নামাযের মাসায়েল’ বইয়ে বিতর ছালাত সম্পর্কে ৯৮-১৩১ পৃষ্ঠা পর্যন্ত অনেক আলোচনা করেছেন। ছলে বলে কৌশলে মিথ্যা ও উদ্ভট তথ্য দিয়ে প্রচলিত তিন রাক‘আত বিতরকে প্রমাণ করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন। আর এক রাক‘আত বিতরের হাদীছগুলো সম্পূর্ণই আড়াল করেছেন। একজন সচেতন পাঠক পড়লেই বুঝতে পারবেন কিভাবে তিনি প্রতারণার জাল বিস্তার করেছেন। দুনিয়াতে রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছ গোপন করলেও পরকালে তাঁর কথা ঠিকই মনে পড়বে। কিন্তু কোন লাভ হবে কি? আল্লাহ বলেন, ‘যালিম সেদিন তার হাত দুইটি দংশন করবে আর বলবে, হায়! আমি যদি রাসূলের পথে চলতাম। হায়! দুর্ভোগ আমার, অমুককে যদি সাথী হিসাবে গ্রহণ না করতাম। আমাকে তো সে বিভ্রান্ত করেছিল- আমার নিকট বিধান আসার পর। শয়তান মানুষের জন্য মহাপ্রতারক’ (ফুরক্বান ২৭-২৯)। অতএব লেখকের চিন্তা করা উচিৎ তিনি কাকে অনুসরণ করে পথ চলছেন!

[1]. বুখারী হা/৯৯৫, ১ম খন্ড, পৃঃ ১৩৬, (ইফাবা হা/৯৪১, ২/২২৭ পৃঃ), ‘বিতর’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-২; মুসলিম হা/১৭৯৭, ১/২৫৪ পৃঃ, (ইফাবা হা/১৫৮৮) ‘মুসাফিরের ছালাত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-২০; তিরমিযী হা/৪৬১; ইবনু মাজাহ হা/১১৭৪।

[2]. ছহীহ মুসলিম হা/১৭৯৩-৯৯ (৭৫২), ১ম খন্ড, পৃঃ ২৫৭, (ইফাবা হা/১৬২৭-১৬৩৩), ‘মুসাফিরের ছালাত’ অধ্যায়-৭, ‘রাত্রির ছালাত দুই দুই রাক‘আত’ অনুচ্ছেদ-২০; মিশকাত হা/১২৫৫, পৃঃ ১১; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১১৮৬, ৩য় খন্ড, পৃঃ ১৩১।

[3]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ; ছহীহ বুখারী হা/৯৯০, ১ম খন্ড, পৃঃ ১৩৫, (ইফাবা হা/৯৩৭, ২/২২৫ পৃঃ), ‘বিতর ছালাত’ অধ্যায়-২০, অনুচ্ছেদ-১; ছহীহ মুসলিম হা/১৭৮২, ১৭৮৪, ১৭৮৫, ১৭৮৬, ১/২৫৭ পৃঃ, (ইফাবা হা/১৬১৮-১৬২১); মিশকাত হা/১২৫৪, পৃঃ ১১১; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১১৮৫, ৩য় খন্ড, পৃঃ ১৩০।

[4]. ছহীহ নাসাঈ হা/১৬৯৩, ১/১৯০ পৃঃ, ‘রাতের ছালাত’ অধ্যায়, ‘এক রাক‘আত বিতর’ অনুচ্ছেদ।

[5]. আবুদাঊদ হা/১৪২২, ১/২০১ পৃঃ; নাসাঈ হা/১৭১২, ১/১৯২ পৃঃ; ছহীহ ইবনু হিববান হা/২৪১১; মিশকাত হা/১২৬৫, পৃঃ ১১২; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১১৯৬, ৩/১৩৫ পৃঃ, ‘বিতর ছালাত’ অনুচ্ছেদ।

[6]. আবুদাঊদ হা/১৪১৬, ১/২০০ পৃঃ; ইবনু মাজাহ হা/১১৭০; তিরমিযী হা/৪৫৩; মিশকাত হা/১২৬৬, পৃঃ ১১২; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১১৯৭, ৩/১৩৫ পৃঃ।
(২) তিন রাক‘আত বিতর পড়ার সময় দুই রাক‘আতের পর তাশাহ্হুদ পড়া

তিন রাক‘আত বিতর একটানা পড়তে হবে। মাঝখানে কোন বৈঠক করা যাবে না। এটাই সুন্নাত। কিন্তু অধিকাংশ মুছল্লী মাঝখানে বৈঠক করে ও তাশাহ্হুদ পড়ে। মুহিউদ্দ্বীন খান লিখেছেন, ‘প্রথম বৈঠকে কেবল আত্তাহিয়্যাতু পড়ে দাঁড়িয়ে যাবে। দুরূদ পড়বে না এবং সালাম ফিরাবে না। যেমন মাগরিবের নামাযে করা হয়, তেমনি করবে’।[1] অথচ উক্ত আমলের পক্ষে কোন ছহীহ দলীল নেই।

(أ) عَنِ ابْنِ مَسْعُوْدٍ قَالَ الْوِتْرُ ثَلاثُ رَكَعَاتٍ كَصَلاةِ الْمَغْرِبِ.

(ক) ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, মাগরিবের ছালাতের ন্যায় বিতরের ছালাত তিন রাক‘আত।[2]

তাহক্বীক্ব : ইবনুল জাওযী বলেন, এই হাদীছ ছহীহ নয়।[3]

(ب) عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرَ كَانَ يَقُوْلُ صَلَاةُ الْمَغْرِبِ وِتْرُ صَلَاةِ النَّهَارِ

(খ) আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রা) বলেন, মাগরিবের ছালাত দিনের বিতর ছালাত।[4]

তাহক্বীক্ব : অনেকে উক্ত বর্ণনা উল্লেখ করে বিতর ছালাত মাগরিব ছালাতের ন্যায় প্রমাণ করতে চান। অথচ তা ত্রুটিপূর্ণ। বর্ণনাটি কখনো মারফূ‘ সূত্রে এসেছে, কখনো মাওকূফ সূত্রে এসেছে। তবে এর সনদ যঈফ। মুহাদ্দিছ শু‘আইব আরনাঊত বলেন, ঐ অংশটুকু ছহীহ নয়।[5]

(ج) عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ مَسْعُوْدٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ وِتْرُ اللَّيْلِ ثَلاَثٌ كَوِتْرِ النَّهَارِ صَلاَةِ الْمَغْرِبِ.

(গ) ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, রাত্রির তিন রাক‘আত বিতর দিনের বিতরের ন্যায়। যেমন মাগরিবের ছালাত।[6]

তাহক্বীক্ব : ইমাম দারাকুৎনী হাদীছটি বর্ণনা করে বলেন, ইয়াহইয়া ইবনু যাকারিয়া যাকে ইবনু আবীল হাওয়াজিব বলে। সে যঈফ। সে আ‘মাশ ছাড়া আর কারো নিকট থেকে মারফূ হাদীছ বর্ণনা করেনি।[7] ইমাম বায়হাক্বী বলেন, ইয়াহইয়া ইবনু যাকারিয়া ইবনু হাযিব কূফী আ‘মাশ থেকে মারফূ সূত্রে বর্ণনা করেছে। কিন্তু সে যঈফ। তার বর্ণনা আ‘মাশ থেকে বর্ণিত অন্যান্য বর্ণনার বিরোধিতা করে।[8] এছাড়াও ইমাম দারাকুৎনী উক্ত বর্ণনার পূর্বে তার বিরোধী ছহীহ হাদীছ উল্লেখ করেছেন। সেখানে মাগরিবের মত করে বিতর পড়তে নিষেধ করা হয়েছে। যেমন-

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ عَنْ رَسُوْلِ اللهِ قَالَ لاَ تُوْتِرُوْا بِثَلاَثٍ أَوْتِرُوْا بِخَمْسٍ أَوْ سَبْعٍ وَلاَ تُشَبِّهُوْا بِصَلاَةِ الْمَغْرِبِ.

আবু হুরায়রাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, তোমরা (মাগরিবের ছালাতের ন্যায়) তিন রাক‘আত বিতর পড় না, পাঁচ, সাত রাক‘আত পড়। আর মাগরিবের ছালাতের ন্যায় আদায় কর না’। ইমাম দারাকুৎনী উক্ত হাদীছকে ছহীহ বলেছেন।[9]

বিশেষ জ্ঞাতব্য : ‘মাযহাব বিরোধীদের স্বরূপ সন্ধানে’ ও ‘নবীজীর নামায’ শীর্ষক বইয়ে যঈফ হাদীছটি দ্বারা দলীল পেশ করা হয়েছে। কিন্তু ছহীহ হাদীছটি সম্পর্কে কোন কিছু বলা হয়নি। এটা দুঃখজনক।[10] ওবাইদুল্লাহ মুবারকপুরী (রহঃ) বলেন,

لَمْ أَجِدْ حَدِيْثاً مَرْفُوْعاً صَحِيْحاً صَرِيْحاً فِىْ إِثْبَاتِ الْجُلُوْسِ فِى الرَّكْعَةِ الثَّانِيَةِ عِنْدَ الْإِيْتَارِ بِثَلاَثٍ

‘তিন রাক‘আত বিতরে দ্বিতীয় রাক‘আতে বৈঠক করার পক্ষে আমি কোন মারফূ ছহীহ দলীল পাইনি’।[11]

[1]. তালীমুস্-সালাত, পৃঃ ১৭১।

[2]. ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল কাবীর হা/৯৩১১; মাজমাউল বাহরাইন হা/১০৮৭।

[3]. -هَذَا حَدِيْثٌ لاَيَصِحُّ তানক্বীহ, পৃঃ ৪৪৭।

[4]. মালেক, মুওয়াত্ত্বা হা/২৫৪।

[5]. তাহক্বীক্ব মুসনাদে আহমাদ হা/৫৫৪৯ - صحيح دون قوله " صلاة المغرب وتر صلاة النهار فأوتروا صلاة الليل " فقد رواه عدة موقوفا।

[6]. দারাকুৎনী হা/১৬৭২; ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল কাবীর হা/৯৩০৯ ও ৯৩১০; বায়হাক্বী, আস-সুনানুল কুবরা ৩/৩১।

[7]. يَحْيَى بْنُ زَكَرِيَّا هَذَا يُقَالُ لَهُ ابْنُ أَبِى الْحَوَاجِبِ ضَعِيْفٌ. وَلَمْ يَرْوِهِ عَنِ الأَعْمَشِ مَرْفُوعًا غَيْرُهُ -সুনানু দারাকুৎনী হা/১৬৭২; তানক্বীহ, পৃঃ ৪৪৭।

[8]. وقد رفعه يحيى ابن زكريا بن ابي الحاجب الكوفي عن الاعمش وهو ضعيف وروايته تخالف رواية الجماعة عن الاعمش -বায়হাক্বী, আস-সুনানুল কুবরা ৩/৩১।

[9]. দারাকুৎনী ২/২৪ পৃঃ, সনদ ছহীহ كُلُّهُمْ ثِقَاتٌ; ত্বাহাবী হা/১৭৩৯ لَا تُوتِرُوْا بِثَلَاثِ رَكَعَاتٍ تَشَبَّهُوْا بِالْمَغْرِبِ ।

[10]. মাযহাব বিরোধীদের স্বরূপ সন্ধানে, পৃঃ ৩২৪; নবীজীর নামায, পৃঃ ২৪৯।

[11]. মির‘আতুল মাফাতীহ হা/১২৬২-এর আলোচনা দ্রঃ।
এক সঙ্গে তিন রাক‘আত বিতর পড়ার ছহীহ দলীল

(أ) عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ كَانَ رَسُوْلُ اللهِ يُوْتِرُ بِثَلاَثٍ لاَ يَقْعُدُ إِلاَّ فِىْ آخِرِهِنَّ.

(ক) আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) তিন রাক‘আত বিতর পড়তেন। তিনি শেষের রাক‘আতে ব্যতীত বসতেন না।[1]

বিশেষ সতর্কতা : মুস্তাদরাকে হাকেমে বর্ণিত لاَ يَقْعُدُ (বসতেন না) শব্দকে পরিবর্তন করে পরবর্তী ছাপাতে لاَيُسَلِّمُ(সালাম ফিরাতেন না) করা হয়েছে। কারণ পূর্ববর্তী সকল মুহাদ্দিছ لاَ يَقْعُدُ দ্বারাই উল্লেখ করেছেন।[2] আরো দুঃখজনক হল- আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী (রহঃ) নিজে স্বীকার করেছেন যে, আমি মুস্তাদরাক হাকেমের তিনটি কপি দেখেছি কিন্তু কোথাও لاَيُسَلِّمُ (সালাম ফিরাতেন না) শব্দটি পাইনি। তবে হেদায়ার হাদীছের বিশ্লেষক আল্লামা যায়লাঈ উক্ত শব্দ উল্লেখ করেছেন। আর যায়লাঈর কথাই সঠিক।[3]

সুধী পাঠক! ইমাম হাকেম (৩২১-৪০৫ হিঃ) নিজে হাদীছটি সংকলন করেছেন আর তিনিই সঠিকটা জানেন না!! বহুদিন পরে এসে যায়লাঈ (মৃঃ ৭৬২ হিঃ) সঠিকটা জানলেন? অথচ ইমাম বায়হাক্বী (৩৮৪-৪৫৮ হিঃ)ও একই সনদে উক্ত হাদীছ উল্লেখ করেছেন। সেখানে একই শব্দ আছে। অর্থাৎ لاَ يَقْعُدُ (বসতেন না) আছে। একেই বলে মাযহাবী গোঁড়ামী। অন্ধ তাকলীদকে প্রাধান্য দেয়ার জন্যই হাদীছের শব্দ পরিবর্তন করা হয়েছে।

(ب) عَنِ بْنِ طَاوُوسَ عَنْ أَبِيْهِ أَنَّهُ كاَنَ يُوْتِرُ بِثَلاَثٍ لاَ يَقْعُدُ بَيْنَهُنَّ.

(খ) ইবনু ত্বাঊস তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূল (ছাঃ) তিন রাক‘আত বিতর পড়তেন। মাঝে বসতেন না।[4]

(ج) عَنْ قَتَادَةَ قال كَانَ رَسُوْلُ اللهِ يُوْتِرُ بِثَلاَثٍ لاَ يَقْعُدُ إِلاَّ فِىْ آخِرِهِنَّ.

(গ) ক্বাতাদা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) তিন রাক‘আত বিতর পড়তেন। শেষের রাক‘আতে ছাড়া তিনি বসতেন না।[5]

(د) عَنْ أُبَىِّ بْنِ كَعْبٍ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ كَانَ يُوْتِرُ بِثَلاَثِ رَكَعَاتٍ كَانَ يَقْرَأُ فِى الأُولَى بِ (سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الأَعْلَى) وَفِى الثَّانِيَةِ بِ (قُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُوْنَ) وَفِى الثَّالِثَةِ بِ (قُلْ هُوَ اللهُ أَحَدٌ) وَيَقْنُتُ قَبْلَ الرُّكُوْعِ فَإِذَا فَرَغَ قَالَ عِنْدَ فَرَاغِهِ سُبْحَانَ الْمَلِكِ الْقُدُّوْسِ ثَلاَثَ مَرَّاتٍ يُطِيْلُ فِىْ آخِرِهِنَّ.

(ঘ) উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) তিন রাক‘আত বিতর পড়তেন। প্রথম রাক‘আতে ‘সাবিবহিসমা রাবিবকাল আ‘লা’ দ্বিতীয় রাক‘আতে ‘কুল ইয়া আইয়ুহাল কাফেরূন’ এবং তৃতীয় রাক‘আতে ‘কুল হুওয়াল্লা-হুল আহাদ’ পড়তেন এবং তিনি রুকূর পূর্বে কুনূত পড়তেন। অতঃপর যখন তিনি শেষ করতেন তখন শেষে তিনবার বলতেন ‘সুবহা-নাল মালিকিল কুদ্দূস’। শেষবার টেনে বলতেন।[6] উক্ত হাদীছও প্রমাণ করে রাসূল (ছাঃ) একটানা তিন রাক‘আত পড়েছেন, মাঝে বৈঠক করেননি।

(ه) عَنْ عَطاَءَ أَنَّهُ كَانَ يُوْتِرُ بِثَلاَثٍ لاَ يَجْلِسُ فِيْهِنَّ وَ لاَ يَتَشَهَّدُ إِلاَّ فِىْ آخِرِهِنَّ.

(ঙ) আত্বা (রাঃ) তিন রাক‘আত বিতর পড়তেন কিন্তু মাঝে বসতেন না এবং শেষ রাক‘আত ব্যতীত তাশাহহুদ পড়তেন না।[7] এমন কি পাঁচ রাক‘আত পড়লেও রাসূল (ছাঃ) এক বৈঠকে পড়েছেন।

(و) عَنْ عَائِشَةَ أَنَّ النَّبِىَّ كَانَ يُوْتِرُ بِخَمْسٍ وَلاَ يَجْلِسُ إِلاَّ فِىْ آخِرِهِنَّ.

(চ) আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) পাঁচ রাক‘আত বিতর পড়তেন। কিন্তু তিনি শেষ রাক‘আতে ছাড়া বসতেন না।[8]

সুধী পাঠক! যারা হাদীছ বর্ণনা করেছেন তারাই সমাধান পেশ করেছেন। সুতরাং তিন রাক‘আত বিতর পড়ার ক্ষেত্রে মাঝে তাশাহ্হুদ পড়া যাবে না; বরং একটানা তিন রাক‘আত পড়তে হবে। তারপর তাশাহ্হুদ পড়ে সালাম ফিরাতে হবে।

জ্ঞাতব্য : তিন রাক‘আত বিতর পড়ার ক্ষেত্রে দুই রাক‘আত পড়ে সালাম ফিরিয়ে পুনরায় এক রাক‘আত পড়া যায়। তিন রাক‘আত বিতর পড়ার এটিও একটি উত্তম পদ্ধতি।[9] উল্লেখ্য যে, তিন রাক‘আত বিতরের মাঝে সালাম দ্বারা পার্থক্য করা যাবে না মর্মে যে হাদীছ বর্ণিত হয়েছে তা যঈফ।[10]

[1]. মুস্তাদরাক হাকেম হা/১১৪০; বায়হাক্বী হা/৪৮০৩, ৩য় খন্ড, পৃঃ ৪১; সনদ ছহীহ, তা’সীসুল আহকাম ২/২৬২ পৃঃ।

[2]. হাকেম হা/১১৪০; ফাৎহুল বারী হা/৯৯৮-এর আলোচনা দ্রঃ; আল-আরফুশ শাযী ২/১৪ পৃঃ।

[3]. আল-আরফুয যাশী শারহু সুনানিত তিরমিযী ২/১৪- وأما أنا فوجدت ثلاث نسخ للمستدرك وما وجدت فيها ما أخرج الزيلعي بلفظ لا يسلم وإنما وجدت فيها وكان لا يقعد وظني الغالب أن لفظ لا يسلم لا بد من أن يكون في مستدرك الحاكم ، فإن الزيلعي متثبت في النقل।

[4]. মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক হা/৪৬৬৯, ৩য় খন্ড, পৃঃ ২৭।

[5]. মা‘রেফাতুস সুনান ওয়াল আছার হা/১৪৭১, ৪/২৪০; বিস্তারিত দ্রঃ ইরওয়াউল গালীল হা/৪১৮-এর আলোচনা।

[6]. নাসাঈ হা/১৬৯৯, ১/১৯১ পৃঃ, সনদ ছহীহ।

[7]. মুস্তাদরাক হাকেম হা/১১৪২।

[8]. নাসাঈ হা/১৭১৭, ১/১৯৩ পৃঃ, সনদ ছহীহ; শারহুস সুন্নাহ ১/২৩১ পৃঃ।

[9]. বুখারী হা/৯৯১, ১ম খন্ড, পৃঃ ১৩৫, (ইফাবা হা/৯৩৭, ২/২২৫); সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৯৬২; সনদ ছহীহ, ইরওয়াউল গালীল হা/৪২০-এর আলোচনা দ্রঃ, ২/১৪৮ পৃঃ; দেখুনঃ আলবানী, ক্বিয়ামু রামাযান, পৃঃ ২২; মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ হা/৬৮৭১, ৬৮৭৪- عَنْ عَائِشَةَ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يُوْتِرُ بِرَكْعَةٍ وَكَانَ يَتَكَلَّمُ بَيْنَ الرَّكْعَتَيْنِ وَالرَّكْعَةِ।

[10]. ইওয়াউল গালীল হা/৪২১, ২/১৫০ পৃঃ; আহমাদ হা/২৫২৬৪।
(৩) কুনূত পড়ার পূর্বে তাকবীর দেওয়া ও হাত উত্তোলন করে হাত বাঁধা

বিতর ছালাতে ক্বিরাআত শেষ করে তাকবীর দিয়ে পুনরায় হাত বাঁধার যে নিয়ম সমাজে চালু আছে তা ভিত্তিহীন। অথচ মাওলানা মুহিউদ্দ্বীন খান লিখেছেন, ‘তৃতীয় রাকআতে কেরাআত সমাপ্ত করে রুকুতে যাওয়ার পূর্বে কান পর্যন্ত হাত তুলে আল্লাহ আকবার বলবে। এরপর হাত বেঁধে নিয়ে দোআ কুনূত পাঠ করবে। এটা ওয়াজিব’।[1] অথচ উক্ত দাবীর পক্ষে কোন ছহীহ দলীল নেই।

عَنِ ابْنِ مَسْعُوْدٍ أَنَّهُ كَانَ يَقْنُتُ فِي الْوِتْرِ وَكَانَ إِذَا فَرَغَ مِنَ الْقِرَاءَةِ كَبَّرَ وَرَفَعَ يَدَيْهِ ثُمَّ قَنَتَ.

ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বিতর ছালাতে কুনূত পড়তেন। আর তিনি যখন ক্বিরাআত শেষ করতেন, তখন তাকবীর দিতেন এবং দুই হাত তুলতেন। অতঃপর কুনূত পড়তেন।[2]

তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি ভিত্তিহীন। আলবানী (রহঃ) বলেন,

لَمْ أَقِفْ عَلَى سَنَدٍ عِنْدَ الْأَثْرَمِ لِأَنَّنِّىْ لَمْ أَقِفْ عَلَى كِتَابِهِ...وَغَالِبُ الظَّنِّ أَنَّهُ لاَ يَصِحُّ

আছরামের সনদ সম্পর্কে আমি অবগত নই। এমনকি তার কিতাব সম্পর্কেও অবগত নই।... আমার একান্ত ধারণা, এই বর্ণনা সঠিক নয়।[3] উল্লেখ্য যে, উক্ত ভিত্তিহীন বর্ণনা দ্বারাই ড. ইলিয়াস ফায়সাল দলীল পেশ করেছেন।[4] আরো উল্লেখ্য যে, উক্ত বর্ণনার মধ্যে পুনরায় হাত বেঁধে কুনূত পড়ার কথা নেই। এ মর্মে কোন দলীলও নেই। অথচ এটাই সমাজে চলছে। বরং এটাকে ওয়াজিব বলা হয়েছে।

[1]. তালীমুস্-সালাত, পৃঃ ১৭১।

[2]. মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ হা/৭০২১-২৫; মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক হা/৫০০১।

[3]. ইরওয়াউল গালীল হা/৪২৭, ২/১৬৯ পৃঃ।

[4]. নবীজীর নামায, পৃঃ ২৪৬২৪৭।

বিতর ছালাতে কুনূত পড়ার পর মুখে হাত মাসাহ করার কোন ছহীহ হাদীছ নেই। উক্ত মর্মে যে বর্ণনাগুলো এসেছে সেগুলো সবই যঈফ।

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَبَّاسٍ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ قَالَ لاَ تَسْتُرُوا الْجُدُرَ مَنْ نَظَرَ فِىْ كِتَابِ أَخِيْهِ بِغَيْرِ إِذْنِهِ فَإِنَّمَا يَنْظُرُ فِى النَّارِ سَلُوا اللهَ بِبُطُوْنِ أَكُفِّكُمْ وَلاَ تَسْأَلُوْهُ بِظُهُوْرِهَا فَإِذَا فَرَغْتُمْ فَامْسَحُوْا بِهَا وُجُوْهَكُمْ.

আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, তোমরা দেওয়ালকে পর্দা দ্বারা আবৃত কর না। যে ব্যক্তি অনুমতি ব্যতীত তার ভাইয়ের চিঠির প্রতি লক্ষ্য করবে সে (জাহান্নামের) আগুনের দিকে লক্ষ্য করবে। তোমরা তোমাদের হাতের পেট দ্বারা আল্লাহর কাছে চাও, পিঠ দ্বারা চেও না। আর যখন দু‘আ শেষ করবে তখন তোমরা তোমাদের মুখমণ্ডল মাসাহ করবে’।[1]


তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি যঈফ। এর সনদে আব্দুল মালেক ও ইবনু হিসান নামে দুইজন দুর্বল রাবী রয়েছে।[2] স্বয়ং ইমাম আবুদাঊদ উক্ত হাদীছ উল্লেখ করে মন্তব্য করেন, ‘এই হাদীছ অন্য সূত্রেও মুহাম্মাদ ইবনু কা‘ব থেকে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু এর প্রত্যেক সূত্রই দুর্বল। এটিও সেগুলোর মত। তাই এটাও যঈফ’।[3] উল্লেখ্য যে, উক্ত মর্মে আরো কয়েকটি বর্ণনা আছে সবই যঈফ।[4]


ইমাম মালেক (রহঃ)-কে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি একে প্রত্যাখ্যান করেন এবং বলেন, আমি এ সম্পর্কে কিছু জানি না। আব্দুল্লাহ বিন মুবারক, সুফিয়ান (রহঃ) থেকেও অনুরূপ বক্তব্য এসেছে।

ইমাম আবুদাঊদ (রহঃ) মুখে হাত মাসাহ করা সংক্রান্ত হাদীছ উল্লেখ করে বলেন, ‘এই হাদীছ অন্য সূত্রেও মুহাম্মাদ ইবনু কা‘ব থেকে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু প্রত্যেকটিই সীমাহীন দুর্বল। এই সূত্রও সেগুলোর মত। তাই এটাও যঈফ’।[5] অন্যত্র তিনি বলেন, ইমাম আহমাদ (রহঃ)-কে বিতরের দু‘আ শেষ করে মুখে দু’হাত মাসাহ করা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে আমি কিছু শুনিনি।[6] ইমাম বায়হাক্বী (রহঃ) বলেন, ‘এটা এমন একটি আমল যা ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত নয়; আছার দ্বারাও সাব্যস্ত হয়নি এবং ক্বিয়াস দ্বারাও প্রমাণিত হয়নি। সুতরাং উত্তম হল, এটা না করা’।[7] ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন,

وَأَمَّا رَفَعَ النَّبِىُّ يَدَيْهِ فِى الدُّعَاءِ فَقَدْ جَاءَ فِيْهِ أَحَادِيْثٌ كَثِيْرَةٌ صَحِيْحَةٌ وَأَمَّا مَسَحَهُ وَجْهَهُ بِيَدَيْهِ فَلَيْسَ عَنْهُ فِيْهِ إِلَّا حَدِيْثٌ أَوْ حَدِيْثَانِ لَايَقُوْمُ بِهَا حُجُّةٌ.

‘দু‘আয় রাসূল (ছাঃ) দুই হাত তুলেছেন মর্মে অনেক ছহীহ হাদীছ এসেছে। কিন্তু তিনি দুই হাত দ্বারা তার মুখ মাসাহ করেছেন মর্মে একটি বা দু’টি হাদীছ ছাড়া কোন বর্ণনা নেই। যার দ্বারা দলীল সাব্যস্ত করা যায় না’।[8] শায়খ আলবানী (রহঃ) এ সংক্রান্ত হাদীছগুলো পর্যালোচনা শেষে বলেন, ‘দু‘আর পর মুখে দু’হাত মাসাহ করা সম্পর্কে কোন ছহীহ হাদীছ নেই’।[9]

[1]. আবুদাঊদ, পৃঃ ২০৯, হা/১৪৮৫; আলবানী, ইরওয়াউল গালীল, ২/১৮০, হা/৪৩৪; মিশকাত হা/২২৪৩, পৃঃ ১৯৫ (আংশিক)।

[2]. যঈফ আবুদাঊদ, পৃঃ ১১২, হা/১৪৮৫; ইরওয়া ২/১৮০ পৃঃ।

[3]. আবুদাঊদ হা/১৪৮৫, পৃঃ ২০৯।

[4]. আবুদাঊদ হা/১৪৯২, পৃঃ ২০৯; ইবনু মাজাহ, পৃঃ ৮৩, হা/১১৯৩ ও ৩৯৩৫; তাবারাণী, হাকেম ১/৫৩৬; তিরমিযী, ২/১৭৬ পৃঃ, হা/৩৩৮৬।

[5]. رُوِىَ هَذَا الْحَدِيْثُ مِنْ غَيْرِ وَجْهٍ عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ كَعْبٍ كُلُّهَا وَاهِيَةٌ وَهَذَا الطَّرِيْقُ أَمْثَالًُهَا وَهُوَ ضَعِيْفٌ أَيْضًا -আবুদাঊদ হা/১৪৮৫, পৃঃ ২০৯।

[6]. سَمِعْتُ أَحْمَدَ وَسُئِلَ عَنِ الرَّجُلِ يَمْسَحُ وَجْهَهُ بِيَدَيْهِ إِذَا فَرَغَ فِى الْوِتْرِ؟ فَقَالَ لَمْ أَسْمَعْ فِيْهِ شَيْئًا -আলবানী, ইরওয়াউল গালীল ২/১৭৯-৮২।

[7]. فَهُوَ عَمَلٌ لَمْ يَثْبُتْ بِخَبَرٍ صَحِيْحٍ وَلَا أَثَرٍ ثَابِتٍ وَلَاقِيَاسٍ فَالْأَوْلَى أَنْ لَّايَفْعَلَهُ -আলবানী, ইরওয়াউল গালীল ২/১৭৯-৮২, হা/৪৩৪-এর আলোচনা দ্রঃ।

[8]. মাজমূউ ফাতাওয়া ২২ খন্ড, পৃঃ ৫১৯।

[9]. وَلَايَصِحُّ حَدِيْثٌ فِىْ مَسْحِ الْوَجْهِ بِالْيَدَيْنِ بَعْدَ الدُّعَاءِ -আলবানী, মিশকাত হা/২২৫৫ -এর টীকা দ্রঃ, ‘দু‘আ সমূহ’ অধ্যায়।

বিতরের কুনূত দুই নিয়মে পড়া যায়। শেষ রাক‘আতে ক্বিরাআত শেষ করে হাত বাঁধা অবস্থায় দু‘আয়ে কুনূত পড়া।[1] অথবা ক্বিরাআত শেষে হাত তুলে দু‘আয়ে কুনূত পড়া। রুকূর আগে বিতরের কুনূত পড়া সুন্নাত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) রুকূর আগে বিতরের কুনূত পড়তেন।

عَنْ أُبَيِّ بْنِ كَعْبٍ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ كَانَ يُوْتِرُ بِثَلَاثِ رَكَعَاتٍ كَانَ يَقْرَأُ فِي الْأُولَى بِسَبِّحْ اسْمَ رَبِّكَ الْأَعْلَى وَفِي الثَّانِيَةِ بِقُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُوْنَ وَفِي الثَّالِثَةِ بِقُلْ هُوَ اللهُ أَحَدٌ وَيَقْنُتُ قَبْلَ الرُّكُوْعِ فَإِذَا فَرَغَ قَالَ عِنْدَ فَرَاغِهِ سُبْحَانَ الْمَلِكِ الْقُدُّوْسِ ثَلَاثَ مَرَّاتٍ يُطِيْلُ فِيْ آخِرِهِنَّ.

উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ) বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) তিন রাক‘আত বিতর ছালাত আদায় করতেন। প্রথম রাক‘আতে সূরা আ‘লা, দ্বিতীয় রাক‘আতে সূরা কাফেরূন এবং তৃতীয় রাক‘আতে সূরা ইখলাছ পাঠ করতেন। আর তিনি রুকূর পূর্বে কুনূত পড়তেন। যখন তিনি ছালাত থেকে অবসর হতেন তখন বলতেন, ‘সুবহা-নাল মালিকিল কুদ্দূস’। শেষের বারে টেনে বলতেন।[2]

عَنْ أُبَيِّ بْنِ كَعْبٍ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ كَانَ يُوْتِرُ فَيَقْنُتُ قَبْلَ الرُّكُوْعِ.

উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) যখন বিতর পড়তেন তখন রুকূর পূর্বে কুনূত পড়তেন।[3]

আল্লামা ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী আগে কুনূত পড়াকেই উত্তম বলেছেন।[4] তবে অনেক বিদ্বান রুকূর পরে পড়ার কথাও বলেছেন।[5]

[1]. আলবানী, ইরওয়াউল গালীল ২/৭১ পৃঃ, ২/১৮১ পৃঃ।

[2]. নাসাঈ হা/১৬৯৯, ১/১৯১ পৃঃ, সনদ ছহীহ।

[3]. ইবনু মাজাহ হা/১১৮২, পৃঃ ৮৩, সনদ ছহীহ; ইরওয়াউল গালীল হা/৪২৬।

[4]. মির‘আতুল মাফাতীহ ৪/২৮৭ পৃঃ, হা/১২৮০-এর আলোচনা দ্রঃ- قلت: يجوز القنوت في الوتر قبل الركوع وبعده والأولى عندى أن يكون قبل الركوع لكثرة الأحاديث في ذلك وبعضها جيد الإسناد ولا حاجة إلى قياس قنوت الوتر على قنوت الصبح مع وجود الأحاديث المروية في الوتر من الطرق المصرحة بكون القنوت فيه قبل الركوع।

[5]. আলবানী, ক্বিয়ামু রামাযান, পৃঃ ৩১।
(৫) বিতরের কুনূতে ‘আল্লাহুম্মা ইন্না নাস্তাঈনুকা ও নাস্তাগফিরুকা.... মর্মে ‘কুনূতে নাযেলার’ দু‘আ পাঠ করা

অধিকাংশ মুছল্লী বিতরের কুনূতে যে দু‘আ পাঠ করে থাকে, সেটা মূলতঃ কুনূতে নাযেলা।[1] রাসূল (ছাঃ) বিতর ছালাতে পড়ার জন্য হাসান (রাঃ)-কে যে দু‘আ শিক্ষা দিয়েছিলেন, তা মুছল্লীরা প্রত্যাখ্যান করেছে। অতএব বিতরের কুনূত হিসাবে রাসূল (ছাঃ)-এর শিক্ষা দেওয়া দু‘আ পাঠ করতে হবে।

عَنْ أَبِى الْحَوْرَاءِ السَّعْدِىِّ قَالَ قَالَ الْحَسَنُ بْنُ عَلِىٍّ رضى الله عَنْهُمَا عَلَّمَنِىْ رَسُوْلُ اللهِ كَلِمَاتٍ أَقُوْلُهُنَّ فِى الْوِتْرِ اللَّهُمَّ اهْدِنِىْ فِيْمَنْ هَدَيْتَ وَعَافِنِىْ فِيْمَنْ عَافَيْتَ وَتَوَلَّنِىْ فِيْمَنْ تَوَلَّيْتَ وَبَارِكْ لِىْ فِيْمَا أَعْطَيْتَ وَقِنِىْ شَرَّ مَا قَضَيْتَ فَإِنَّكَ تَقْضِىْ وَلاَ يُقْضَى عَلَيْكَ وَإِنَّهُ لاَ يَذِلُّ مَنْ وَالَيْتَ تَبَارَكْتَ رَبَّنَا وَتَعَالَيْتَ.

আবুল হাওরা সা‘দী (রাঃ) বলেন, হাসান ইবনু আলী (রাঃ) বলেছেন, রাসূল (ছাঃ) আমাকে কতিপয় বাক্য শিক্ষা দিয়েছেন। সেগুলো আমি বিতর ছালাতে বলি। সেগুলো হল- ‘হে আল্লাহ! আপনি আমাকে হেদায়াত দান করুন, যাদের আপনি হেদায়াত করেছেন তাদের সাথে। আমাকে মাফ করে দিন, যাদের মাফ করেছেন তাদের সাথে। আমার অভিভাবক হন, যাদের অভিভাবক হয়েছেন তাদের সাথে। আপনি যা আমাকে দান করেছেন তাতে বরকত দান করুন। আর আমাকে ঐ অনিষ্ট হতে বাঁচান, যা আপনি নির্ধারণ করেছেন। আপনিই ফায়ছালা করে থাকেন, আপনার উপরে কেউ ফায়ছালা করতে পারে না। নিশ্চয়ই ঐ ব্যক্তি লাঞ্ছিত হয় না, যাকে আপনি বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করেছেন। হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি বরকতময়, আপনি সুউচ্চ’।[2] উল্লেখ্য যে, বিতরের কুনূত জামা‘আতের সাথে পড়লে শব্দগুলো বহুবচন করে পড়া যাবে।[3]

জ্ঞাতব্য : অনেকে কুনূতে বিতর ও কুনূতে নাযেলা একাকার করে ফেলেছেন।[4] অথচ কুনূতে নাযেলা ফরয ছালাতের জন্য। দুঃখজনক হল- মাযহাবী বিদ্বেষের কারণে এর প্রচলন করা হয়েছে।

[1]. বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা ২/২১০-২১১ পৃঃ; সনদ হাসান, ইরওয়াউল গালীল ২/১৭০ পৃঃ; মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ ২/২১৩ পৃঃ; বায়হাক্বী হা/৩১৪৪ ও ৩১৪৩, ২/২৯৮-২৯৯, সনদ ছহীহ, ইরওয়া হা/৪২৮, ২/১৭১ পৃঃ।

[2]. আবুদাঊদ হা/১৪২৫, ১/২০১; তিরমিযী হা/৪৬৪, ১/১০৬; নাসাঈ হা/১৭৪৫; মিশকাত হা/১২৭৩, পৃঃ ১১২, সনদ ছহীহ। ইবনু মাজাহ হা/১১৭৮।

[3]. আহমাদ, ইরওয়া হা/৪২৯; বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা হা/৩২৬৬।

[4]. তালীমুস্-সালাত, পৃঃ ১৭২-১৭৩; নবীজীর নামায, পৃঃ ২৪৩-২৪৪।

অনেক মসজিদে ফজর ছালাতে নিয়মিত কুনূত পড়া হয়। দু‘আ হিসাবে ‘কুনূতে নাযেলা’ না পড়ে বিতরের কুনূত পড়া হয়। এটা আরো দুঃখজনক। কুনূতে নাযেলা প্রত্যেক ফরয ছালাতে পড়া যায়। সে অনুযায়ী ফজর ছালাতেও পড়বে।[1] কিন্তু নির্দিষ্ট করে নিয়মিত শুধু ফজর ছালাতে পড়া যাবে না। কারণ এর পক্ষে যতগুলো হাদীছ বর্ণিত হয়েছে সবই যঈফ। যেমন-

(أ) عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ مَا زَالَ رَسُوْلُ اللهِ يَقْنُتُ فِى الْفَجْرِ حَتَّى فَارَقَ الدُّنْيَا.

(ক) আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) মৃত্যু পর্যন্ত ফজরের ছালাতে কুনূত পড়েছেন।[2]

তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি যঈফ। উক্ত বর্ণনার সনদে আবু জা‘ফর রাযী নামে একজন মুযতারাব রাবী আছে। সে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম বর্ণনা করেছে।[3]

(ب) عَنْ أُمِّ سَلَمَةَ قَالَتْ نَهَى رَسُوْلُ اللهِ عَنِ الْقُنُوْتِ فِى الْفَجْرِ.

(খ) উম্মু সালামা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ফজরের ছালাতে কুনূত পড়তে নিষেধ করেছেন।[4]

তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি জাল। ইমাম দারাকুৎনী বলেন, মুহাম্মাদ ইবনু ইয়ালী, আমবাসা ও আব্দুল­াহ ইবনু নাফে সকলেই যঈফ। উম্মে সালামা থেকে নাফের শ্রবণ সঠিক নয়।[5] ইবনু মাঈন বলেন, সে হাদীছ জাল করত। ইবনু হিববান বলেন, সে জাল হাদীছ বর্ণনাকারী। যেগুলোর কোন ভিত্তি নেই।[6] অতি বাড়াবাড়ি করে উক্ত হাদীছ জাল করে নিষেধের দলীল তৈরি করা হয়েছে।

অতএব ফজর ছালাতে নিয়মিত কুনূত পড়া থেকে বিরত থাকতে হবে। নিয়মিত পড়াটা ছাহাবীদের চোখেই বিদ‘আত বলে গণ্য হয়েছে। যেমন-

عَنْ أَبِىْ مَالِكٍ الأَشْجَعِىِّ قَالَ قُلْتُ لأَبِىْ يَا أَبَةِ إِنَّكَ قَدْ صَلَّيْتَ خَلْفَ رَسُوْلِ اللهِ وَأَبِىْ بَكْرٍ وَعُمَرَ وَعُثْمَانَ وَعَلِىِّ بْنِ أَبِىْ طَالِبٍ هَا هُنَا بِالْكُوْفَةِ نَحْوًا مِنْ خَمْسِ سِنِيْنَ أَكَانُوْا يَقْنُتُوْنَ قَالَ أَىْ بُنَىَّ مُحْدَثٌ.

আবু মালেক আশজাঈ (রাঃ) বলেন, আমি আব্বাকে বললাম, আপনি তো রাসূল (ছাঃ), আবুবকর, ওমর ও ওছমান (রাঃ)-এর পিছনে ছালাত আদায় করেছেন। এমনকি কূফাতে আলী (রাঃ)-এর পিছনে পাঁচ বছর ছালাত আদায় করেছেন। তারা কি কুনূত পড়তেন? তিনি বললেন, হে বৎস! এটা বিদ‘আত।[7]

[1]. আবুদাঊদ হা/১৪৪৩, ১/২০৪ পৃঃ; মিশকাত হা/১২৯০, পৃঃ ১১৪।

[2]. আব্দুর রাযযাক ৩/১১০; দারাকুৎনী ২/৩৯; বায়হাক্বী, আস-সুনানুল কুবরা ২/২০১; আহমাদ হা/১২৬৭৯, ৩/১৬২।

[3]. সিলসিলা যঈফাহ হা/৫৫৭৪; তানক্বীহ, পৃঃ ৪৪৯।

[4]. দারাকুৎনী ২/৩৮; বায়হাক্বী, আস-সুনানুল কুবরা ২/২১৪।

[5]. দারাকুৎনী হা/১৭০৭-এর আলোচনা দ্রঃ محمد بن يعلى وعنبسة وعبد الله بن نافع كلهم ضعفاء ولا يصح لنافع سماع من أم سلمة.।

[6]. صاحب أشياء موضوعة وما لاأصل له-তানক্বীহ, পৃঃ ৪৫১।

[7]. তিরমিযী হা/৪০২; মিশকাত হা/১২৯২; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১২১৯, ৩/১৪৪ পৃঃ; ইরওয়াউল গালীল হা/৪৩৫, সনদ ছহীহ।

রাতে ঘুম থেকে উঠে ছালাত আদায়কে ‘তাহাজ্জুদ’ বলে। মূলতঃ তাহাজ্জুদ, ক্বিয়ামুল লায়েল, তারাবীহ, ক্বিয়ামে রামাযান সবই ‘ছালাতুল লায়েল’ বা রাতের ছালাত। রাতের শেষ অংশে পড়লে তাকে ‘তাহাজ্জুদ’ বলা হয় এবং প্রথম অংশে পড়লে ‘তারাবীহ’ বলা হয়। প্রথম রাতে তারাবীহ পড়লে শেষ রাতে তাহাজ্জুদ পড়তে হয় না। রাসূল (ছাঃ) একই রাত্রে তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ দু’টিই পড়েছেন মর্মে কোন প্রমাণ নেই।[1]

রাসূল (ছাঃ) তাহাজ্জুদের ছালাতে উঠে আকাশের দিকে তাকিয়ে সূরা আলে ইমরানের ১৯০ আয়াত থেকে সূরার শেষ অর্থাৎ ২০০ আয়াত পর্যন্ত পাঠ করতেন। অতঃপর মিসওয়াক করে ওযূ করতেন।[2] ছালাত শুরু করার পূর্বে ‘আল্লাহু আকবার’, ‘আল-হামদুলিল্লাহ’, সুবহানাল্লা-হি ওয়া বিহামদিহী, সুবহা-নাল মালিকিল কুদ্দূস, আস্তাগফিরুল্লাহ, লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহু, আল্লাহুম্মা ইন্নী আঊযূবিকা মিন যীকিদ্দুনিয়া ওয়া মিন যীক্বি ইয়াওমিল ক্বিয়ামাহ’ বলতেন। উক্ত বাক্যগুলো প্রত্যেকটিই দশবার দশবার করে বলতেন।[3] নিম্নের দু‘আটিও পড়া যায়। তবে আরো দু‘আ আছে।[4]

لآ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لآ شَرِيْكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ، سُبْحَانَ اللهِ وَالْحَمْدُ ِللهِ وَلآ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَاللهُ أَكْبَرُ وَلآ حَوْلَ وَلآ قُوَّةَ إِلاَّ بِاللهِ.

উচ্চারণ : লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াহ্দাহু লা শারীকা লাহু। লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদু ওয়াহুয়া ‘আলা কুল্লি শাইয়িন ক্বাদীর। সুবহা-নাল্লা-হি ওয়াল হামদু লিল্লা-হি ওয়ালা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াল্লা-হু আকবার; ওয়ালা হাওলা ওয়ালা কুউওয়াতা ইল্লা বিল্লা-হ। অতঃপর বলবে, ‘রবিবগফির্লী’।[5] উল্লেখ্য যে, রাসূল (ছাঃ) তাহাজ্জুদের ছালাতে বিভিন্ন ‘ছানা’ পড়েছেন।[6]

তাহাজ্জুদ ছালাতের নিয়ম :

(ক) তাহাজ্জুদ শুরু করার পূর্বে দু’রাক‘আত সংক্ষিপ্তভাবে পড়ে নিবে।[7] (খ) অতঃপর দুই দুই রাক‘আত করে ৮ রাক‘আত পড়বে এবং শেষে একটানা তিন রাক‘আত বিতর পড়বে, মাঝে বৈঠক করবে না।[8] অথবা দুই দুই রাক‘আত করে দশ রাক‘আত পড়বে। শেষে এক রাক‘আত বিতর পড়বে।[9] রাসূল (ছাঃ) নিয়মিত উক্ত পদ্ধতিতেই ছালাত আদায় করতেন। তবে কখনো কখনো বিতর ছালাতের সংখ্যা কম বেশী করে রাতের ছালাতের রাক‘আত সংখ্যা কম বেশী করতেন। কারণ রাতের পুরো ছালাতই বিতর। দুই রাক‘আত করে পড়ে শেষে এক রাক‘আত পড়লেই সব বিতর হয়ে যায়।[10] আর তিনি ১৩ রাক‘আতের বেশী পড়েছেন মর্মে কোন ছহীহ দলীল পাওয়া যায় না।[11] (গ) যদি কেউ প্রথম রাতে এশার পরে বিতর পড়ে ঘুমিয়ে যায়, তবে শেষ রাতে শুধু তাহাজ্জুদ পড়বে। তখন আর বিতর পড়তে হবে না। কারণ এক রাতে দুইবার বিতর পড়তে হয় না।[12] (ঘ) বিতর ক্বাযা হয়ে গেলে সকালে অথবা যখন স্মরণ বা সুযোগ হবে, তখন পড়ে নেয়া যাবে’।[13] (ঙ) যদি কেউ আগ রাতে বিতরের পর দু’রাকআত নফল ছালাত আদায় করে এবং শেষরাতে তাহাজ্জুদের জন্য উঠতে সক্ষম না হয়, তাহলে উক্ত দু’রাক‘আত ছালাত তার জন্য যথেষ্ট হবে’।[14] (চ) রাতের নফল ছালাত নিয়মিত আদায় করা উচিৎ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘তুমি ঐ ব্যক্তির মত হয়ো না, যে রাতের নফল ছালাতে অভ্যস্ত ছিল। কিন্তু পরে ছেড়ে দিয়েছে’।[15] নিয়মিত রাতের ছালাত আদায়কারী ব্যক্তি বিতর পড়ে শুয়ে গেলে এবং ঘুম বা অন্য কোন কারণে তাহাজ্জুদ পড়তে না পারলে দিনের বেলায় দুপুরের আগে তা পড়ে নিতে পারবে।[16] (ছ) তাহাজ্জুদ ছালাতে ক্বিরাআত কখনো সশব্দে কখনো নিঃশব্দে পড়া যায়।[17]

[1]. মুসলিম হা/১৭১৮, ১/২৫৪ পৃঃ, (ইফাবা হা/১৫৫৫), ‘মুসাফিরের ছালাত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১৪; বুখারী হা/২০১০, ১/২৬৯ পৃঃ; মিশকাত হা/১৩০১, পৃঃ ১১৫; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১২২৭, ৩/১৫১ পৃঃ; আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী, আল-আরফুয যাশী শরহে তিরমিযী ১ম খন্ড, পৃঃ ১৬৬; ফায়যুল বারী ২য় খন্ড, পৃঃ ৪২০; মির‘আত ৪/৩১১ পৃঃ, হা/১৩০৩-এর আলোচনা দ্রঃ, ‘ছালাত’ অধ্যায়, ‘রামাযান মাসে রাত্রি জাগরণ’ অনুচ্ছেদ।

[2]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, বুখারী হা/১১৯৮, ১/১৫৯ পৃঃ; মুসলিম হা/১৮৩৫, ১/২৬০ পৃঃ; মিশকাত হা/১১৯৫, পঃ ১০৬, ‘ছালাত’ অধ্যায়, ‘রাতের ছালাত’ অনুচ্ছেদ।

[3]. আবুদাঊদ হা/৭৬৬, ১/১১১ পৃঃ, সনদ ছহীহ; মিশকাত হা/১২১৬, পৃঃ ১০৮।

[4]. মুসলিম হা/১৮৩৫, ১/২৬০ পৃঃ, (ইফাবা হা/১৬৫৮); মিশকাত হা/১১৯৫, পৃঃ ১০৬; আবুদাঊদ হা/৮৭৪; মিশকাত হা/১২০০।

[5]. বুখারী হা/১১৫৪, ১/১৫৫ পৃঃ, (ইফাবা হা/১০৮৭, ২/৩১২ পৃঃ), ‘তাহাজ্জুদ’ অধ্যায়; মিশকাত হা/১২১৩, ‘রাত্রিতে উঠে কি বলবে’ অনুচ্ছেদ।

[6]. মুসলিম হা/১৮৪৭, ১/২৬৩ পৃঃ, ‘মুসাফিরের ছালাত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-২৬; মিশকাত হা/১২১২; আবুদাঊদ হা/৭৭৫; মিশকাত হা/১২১৭।

[7]. মুসলিম হা/১৮৪২-৪৩, ১/২৬২ পৃঃ, (ইফাবা হা/১৬৭৫-১৬৭৬), ‘মুসাফিরের ছালাত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-২৬; মিশকাত হা/১১৯৩-৯৪, ৯৭, ‘রাতের ছালাত’ অনুচ্ছেদ।

[8]. বুখারী হা/১১৪৭, ২০১৩, ১/২৬৯ পৃঃ; মুসলিম হা/১৭৫৭।

[9]. মুসলিম হা/১৭৫১ ও ১৭৫২, ১/২৫৩ পৃঃ, ‘মুসাফিরের ছালাত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১৭।

[10]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ; ছহীহ বুখারী হা/৯৯০, ১ম খন্ড, পৃঃ ১৩৫, (ইফাবা হা/৯৩৭, ২/২২৫ পৃঃ), ‘বিতর ছালাত’ অধ্যায়-২০, অনুচ্ছেদ-১; ছহীহ মুসলিম হা/১৭৮২, ১৭৮৪, ১৭৮৫, ১৭৮৬, ১/২৫৭ পৃঃ, (ইফাবা হা/১৬১৮-১৬২১); মিশকাত হা/১২৫৪, পৃঃ ১১১; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১১৮৫, ৩য় খন্ড, পৃঃ ১৩০ এবং বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১১৮৮, ৩/১৩১ পৃঃ।

[11]. আবুদাঊদ হা/১৩৬২, ১/১৯৩ পৃঃ; মিশকাত হা/১২৬৪, পৃঃ ১১২; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১১৯৫, ৩/১৩৫ পৃঃ, ‘বিতর’ অনুচ্ছেদ; উল্লেখ্য যে, ‘১১ রাক‘আতের বেশী পড়’ মর্মে হাকেমে যে অংশটুকু এসেছে তার সনদ যঈফ ও মুনকার।- হাকেম হা/১১৩৭; ক্বিয়ামে রামাযান পৃঃ ১৭; ছালাতুত তারাবীহ, পৃঃ ৯৯ ও ১১২।

[12]. আবুদাঊদ হা/১৪৩৯, ১/২০৩ পৃঃ; নাসাঈ হা/১৬৭৯, সনদ ছহীহ।

[13]. আবুদাঊদ হা/১৪৩১, ১/২০৩ পৃঃ; সনদ ছহীহ, ইওয়াউল গালীল হা/৪৪২; মিশকাত হা/১২৭৯ ‘বিতর’ অনুচ্ছেদ।

[14]. দারেমী হা/১৬৪৭; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৯৯৩; মিশকাত হা/১২৮৬, পৃঃ ১১৩ সনদ ছহীহ; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১২১৩, ৩/১৪১ পৃঃ।

[15]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, বুখারী হা/১১৫২, ১/১৫৪ পৃঃ, ‘তাহাজ্জুদ’ অধ্যায়; মুসলিম হা/২৭৯০; মিশকাত হা/১২৩৪, পৃঃ ১০৯, ‘রাত্রি জাগরণে উৎসাহ প্রদান’ অনুচ্ছেদ।

[16]. মুসলিম হা/১৭৭৩, ১৭৭৭, ১/২৫৬ পৃঃ, ‘মুসাফিরের ছালাত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১৮; মিশকাত হা/১২৫৭, পৃঃ ১১১, ‘বিতর’ অনুচ্ছেদ। রাসূল (ছাঃ) উক্ত ছালাত ১২ রাক‘আত পড়েছেন (তন্মধ্যে তাহাজ্জুদের ৮ রাক‘আত ও ছালাতুয যোহা ৪ রাক‘আত)। -মির‘আতুল মাফাতীহ ৪/২৬৬।

[17]. আবুদাঊদ হা/২২৬; তিরমিযী হা/৪৪৯; মিশকাত হা/১২০২-০৩, ‘রাত্রির ছালাত’ অনুচ্ছেদ।
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১০ পর্যন্ত, সর্বমোট ১১ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 পরের পাতা »