পরিচ্ছেদঃ ২০. প্রথম অনুচ্ছেদ - রাগ ও অহংকার
৫১০৪-[১] আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। জনৈক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে জিজ্ঞেস করল, আমাকে কিছু উপদেশ দিন। তিনি বললেনঃ তুমি রাগ করবে না। লোকটি কয়েকবার একই কথা পুনরাবৃত্তি করল। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ও প্রত্যেক বারই বললেনঃ তুমি রাগ করো না। (বুখারী)[1]
بَابُ الْغَضَبِ وَالْكِبَرِ
عَن أبي هريرةَ أَنَّ رَجُلًا قَالَ لِلنَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسلم: أوصني. قَالَ: «لَا تغضبْ» . فردَّ ذَلِكَ مِرَارًا قَالَ: «لَا تَغْضَبْ» . رَوَاهُ الْبُخَارِيُّ
ব্যাখ্যাঃ (أَنَّ رَجُلًا) ইমাম আহমাদ, ইবনু হিব্বান এবং ‘ত্ববারানী’র বর্ণনা মতে লোকটির নাম হারিসাহ্ ইবনু কুদামাহ্। এছাড়াও মুহাদ্দিসগণের নিকটে তিনজন সাহাবীর যে কেউ হতে পারেন : ১. ইবনু ‘উমার ২. হারিসাহ্ ইবনু কুদামাহ্ ৩. সুফ্ইয়ান ইবনু ‘আবদুল্লাহ। (ফাতহুল বারী ১০ম খন্ড, হাঃ ৬১১৬; মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
(أوصني) ‘‘আমাকে এমন একটি বিশেষ ‘আমলের ব্যাপারে অবহিত করুন যা ব্যাপকভাবে দুনিয়া এবং আখিরাতে আমার কল্যাণ বয়ে আনবে এবং আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছে দেবে। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
(لَا تغضبْ) ইমাম খত্ত্বাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ ‘‘তুমি রাগ করবে না’’ এ কথার সারমর্ম হলো আপনি রাগ আনয়নকারী সব ধরনের উপকরণ থেকে দূরে থাকুন। যে সকল কথা বা কাজ মানুষকে রেগে যেতে সহায়তা করে সেগুলো থেকে নিজেকে নিরাপদে রাখুন। কারণ রাগ থেকে শত চেষ্টার পরও সম্পূর্ণ মুক্ত থাকা সম্ভব নয়, তাই পারতপক্ষ যতটুকু সম্ভব দূরে থাকাই উত্তম।
কারো মতে, (لَا تغضبْ) বলার কারণ হল- অধিকাংশ সময় রাগের সাথে অহংকার প্রকাশ পায়। কোন বিষয় যদি মতের অমিল হয় তখন মনের রাগ প্রকাশের সময় এক রকমের আত্ম-অহংকার চলে আসে। এর ফলে বিনয়ী ভাব এবং আত্মমর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়।
কেউ কেউ বলেছেনঃ প্রশ্নকারী লোকটি রাগচটা প্রকৃতির ছিলেন। তাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সকল বিষয় খেয়াল করেই প্রত্যেককে উপযুক্ত নাসীহাত প্রদান করতেন।
ইবনু তীন (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ (لَا تغضبْ) কথাটির ভেতরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ একত্রিত করেছেন। কেননা রাগের ফলে মানবজীবনে আত্মীয়তার সম্পর্ক ও বন্ধত্ব নষ্টসহ নানাবিধ অকল্যাণ ও ক্ষতির সম্ভাবনা দেখা দেয়। অবশেষে সামাজিক সম্মান আর ধার্মিকতার চরম অভাব পরিলক্ষিত হয়।
ইমাম বায়যাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দৃষ্টিতে মনে হয়েছে যে, সকল বিপদ আর ফিতনাহ্-ফাসাদের কেন্দ্রস্থল হচ্ছে মানুষের রাগ। যেহেতু প্রশ্নকারী সাহাবী অন্তরের কোমলতা আর সৎ ইচ্ছা নিয়ে নাসীহাত চেয়েছিলেন, তাই আল্লাহর নবী তাকে অযথা রাগ থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিলেন। আর সকল নিকৃষ্ট আচরণের মধ্যে রাগ হলো শীর্ষে। তাই রাগ থেকে নিজেকে হিফাযাত করার অর্থ হলো সবচেয়ে বড় শত্রুকে দমন করা।
ইবনু হিব্বান (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ (لَا تغضبْ) বলার উদ্দেশ্য হলো রাগের অবস্থায় যে কোন ধরনের অন্যায় কাজ না করা। রাগ থেকে বিরত থাকা নয়। যেহেতু রাগ এমন একটি স্বভাব যা দূর করা কারো পক্ষ সম্ভব নয়, তাই এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো রাগের সময় কোন ধরনের অন্যায় অপরাধ না করা। আবার কারো মতে, আল্লাহ তা‘আলা রাগকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং মানুষের সৃষ্টিগত স্বভাবের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। ফলে মানুষ যখন কোন উদ্দেশে সফলতার জন্য চরম আগ্রহী হয়ে উঠে তখন সেই আকাঙক্ষা থেকে এক ধরনের রাগ জেদ আকারে প্রকাশ পায়। তার তীব্রতা চোখে মুখে ফুটে উঠে। চেহারা রক্তিম বর্ণ হয়ে যায়। এ ধরনের রাগ সাধ্যের ভেতরে কোন বস্তুকে পাওয়ার আশায় তৈরি হয়। আর যদি সেটা সাধ্যের বাহিরে হয় তখন দুশ্চিন্তায় চেহারার রং ফ্যাকাশে হয়ে যায়। কখনো লাল বা হলুদ বর্ণ ধারণ করে। এটা হলো মানুষের বাহ্যিক অবস্থা। পক্ষান্তরে অভ্যন্তরীণ অবস্থা এর চাইতেও মারাত্মক। করণ রাগের অবস্থায় অন্তর নামক পবিত্র বস্তুটি হিংসা-বিদ্বেষ আর অসৎ উদ্দেশ্যের জন্ম দেয়। বিভিন্ন উপায়ে মানুষের ক্ষতি করার নীল-নকশা তৈরি করে। তাই রাগের বাহ্যিক অবস্থার চাইতে ভিতরগত অবস্থা নেহায়াত কুৎসিত। কাজেই এদিক থেকে (لَا تغضبْ) উপদেশটি অত্যন্ত জরুরী হিসেবে গণ্য হয়েছে।
একজন গবেষক উল্লেখ করেছেন যে, রাগ হচ্ছে শয়তানের কুমন্ত্রণা। এর মাধ্যমে মানুষ প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে অন্যায়ে জড়িয়ে পড়ে এবং মিথ্যাকে প্রশ্রয় দেয়। অবশেষে অসৎকাজে চরম আগ্রহে আত্মনিয়োগ করে, হিংসা আর কপটতায় অন্তর ভারী হয়ে উঠে। এরপর কুফরী করতে উদ্যত হয় এবং তা করে ফেলে। এজন্যই আল্লাহর নবী তাকে বারবার রাগ থেকে সতর্ক করছিলেন।
‘আল্লামা তূরিবিশতী (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষের চারিত্রিক বিষয়গুলো খেয়াল করতেন। তাঁর কাছে চরিত্রের যে দিকটি অসুস্থ বলে মনে হত সেই স্থানে উপযুক্ত ঔষধ প্রয়োগের চেষ্টা করতেন। ফলে সাহাবীদের জন্য যে বিষয়টি অত্যন্ত জরুরী বলে মনে করতেন সেই বিষয়েই তাদেরকে নাসীহাত প্রদান করতেন। প্রশ্নকারী সাহাবীর ব্যাপারটিও এমন ছিল। তিনি হয়তবা রাগী প্রকৃতির ছিলেন, তাই তাকে রাগ থেকে সতর্ক করলেন।
(ফাতহুল বারী ১০ম খন্ড, হাঃ ৬১১৬; তুহফাতুল আহ্ওয়াযী ৫ম খন্ড, হাঃ ২০২০; মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ ২০. প্রথম অনুচ্ছেদ - রাগ ও অহংকার
৫১০৫-[২] উক্ত রাবী [আবূ হুরায়রা (রাঃ)] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ সে ব্যক্তি শক্তিশালী বীর নয়, যে মানুষকে আছাড় দেয় (পরাস্ত করে); বরং সে ব্যক্তিই প্রকৃত শক্তিশালী বীর, যে রাগের সময় নিজেকে সংবরণ করতে সক্ষম। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
بَابُ الْغَضَبِ وَالْكِبَرِ
وَعَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَيْسَ الشَّدِيدُ بِالصُّرَعَةِ إِنَّمَا الشَّدِيدُ الَّذِي يَمْلِكُ نَفْسَهُ عِنْدَ الْغَضَبِ» . مُتَّفق عَلَيْهِ
ব্যাখ্যাঃ (لَيْسَ الشَّدِيدُ بِالصُّرَعَةِ) এখানে প্রকৃত শক্তিশালী হওয়ার ব্যাপারে যে বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে তা হলো আধ্যাত্মিক বা মনোস্তাত্ত্বিক শক্তি। এ ধরনের শক্তি স্বয়ং আল্লাহ প্রদত্ত। এটি চিরস্থায়ী আর শারীরিক শক্তি হলো ক্ষণস্থায়ী। উক্ত হাদীসে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দৈহিক শক্তিকে আধ্যাত্মিক শক্তির দিকে স্থানান্তরিত করেছেন। এভাবেই তিনি জাগতিক বিষয়ের উপর ধর্মীয় বিষয়কে (আধ্যাত্মিক শক্তিকে) প্রাধান্য দিয়েছেন। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ ২০. প্রথম অনুচ্ছেদ - রাগ ও অহংকার
৫১০৬-[৩] হারিসাহ্ ইবনু ওয়াহ্ব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমি তোমাদেরকে জান্নাতবাসী লোকেদের কথা বলে দেব কি? তারা হলেন বৃদ্ধ ও দুর্বল লোক। তারা যদি আল্লাহর দরবারে কসম করে, তখন আল্লাহ তাদের সে শপথকে সত্যে পরিণত করে দেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আরো বলেছেনঃ আমি কি তোমাদেরকে জাহান্নামবাসী লোকেদের কথা বলে দেব? তারা হলো, মিথ্যা ও তুচ্ছ বস্তু নিয়ে খুব বিবাদকারী, শান্ত মস্তিষ্কে ধন-সম্পদ সঞ্চয়কারী ও অহংকারী। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
মুসলিম-এর এক বর্ণনায় রয়েছে, প্রত্যেক সম্পদ সঞ্চয়কারী কৃপণ, জারজ ও অহংকারী।
بَابُ الْغَضَبِ وَالْكِبَرِ
وَعَنْ حَارِثَةَ بْنِ وَهْبٌ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «أَلَا أُخْبِرُكُمْ بِأَهْلِ الْجَنَّةِ؟ كُلُّ ضَعِيفٍ مُتَضَعِّفٍ لَوْ أَقْسَمَ عَلَى اللَّهِ لَأَبَرَّهُ. أَلَا أُخْبِرُكُمْ بِأَهْلِ النَّارِ؟ كُلُّ عُتُلٍّ جَوَّاظٍ مُسْتَكْبِرٍ» . مُتَّفق عَلَيْهِ. وَفِي رِوَايَة مُسلم: «كل جواظ زنيم متكبر»
ব্যাখ্যাঃ (كُلُّ ضَعِيفٍ مُتَضَعِّفٍ) উক্ত হাদীসাংশে ضَعِيفٍ শব্দ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো সেই ব্যক্তি যে নিজেকে বিনয়ের চাদরে আবৃত করে নম্র হয়ে চলে। বিনয়ীর বেশে চলাফেরার কারণে তার পারিপার্শ্বিক সকল অবস্থাদি দুর্বল বা হালকা মনে হয়। এ অবস্থায় নম্র হয়ে চলার কারণে তাকে বহু স্থানে লাঞ্ছিতও হতে হয়।
আবার কেউ বলেছেন, ضَعِيفٍ দ্বারা নিরহংকার ব্যক্তিকে বুঝানো হয়েছে, যে কোন মানুষকে তুচ্ছজ্ঞান করে না।
(مُتَضَعِّفٍ) ঐ লোককে বলা হয় যে মানুষের সাথে স্বাভাবিক অবস্থায় অত্যন্ত বিনয়ী মহানুভব আর শত্রুর সামনে তেজী ও সাহসী। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেনঃ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ
‘‘...মু’মিনরা শত্রুদের ওপর অত্যন্ত কঠোর আর তারা পরস্পর দয়ালু...।’’ (সূরাহ্ আল ফাত্হ ৪৮ : ২৯)
অনুরূপভাবে আল্লাহ বলেনঃ أَذِلَّةٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ أَعِزَّةٍ عَلَى الْكَافِرِينَ
‘‘মু’মিনরা একে অন্যের ওপর বিনয়ী আর কাফিরদের ওপর অত্যন্ত কঠোর।’’ (সূরাহ্ আল মায়িদাহ্ ৫ : ৫৪)
অতএব এখানে ঐ ব্যক্তির কথা বলা হয়েছে, যে শক্তি ও সাহস থাকার পরও মানুষের সাথে সদয় এবং বিনয়ী। ইমাম নাবাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ এখানে উদ্দেশ্য ঐ ব্যক্তি যাকে লোকেরা দুর্বলভাবে এবং নিচু চোখে দেখে। সামাজিক জীবনে আর্থিক বা শারীরিক অবস্থার ভিত্তিতে তাকে নিচু শ্রেণীর মানুষ হিসেবে গণ্য করে।
(عُتُلٍّ) উক্ত শব্দের ব্যাখ্যায় ‘আলিমদের মাঝে মতভেদ রয়েছে। ইমাম ফাররা (রহিমাহুল্লাহ)-এর মতে (عُتُلٍّ) অর্থ হলো অত্যন্ত ঝগড়াটে লোক।
আবূ ‘উবায়দাহ্ (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ অত্যধিক কঠোর প্রকৃতির লোক; এখানে কাফির উদ্দেশ্য। ইমাম খত্ত্বাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ দয়ামায়াহীন ব্যক্তি। ইমাম ‘আবদুর রাযযাক (রহিমাহুল্লাহ)-এর মতে অশ্লীল কাজে অভ্যস্ত নোংরা ব্যক্তি। ইমাম দাউদিয়্যু (الدَّاوُدِيُّ) (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ বিশাল আকৃতির পেট ও ঘাড়ওয়ালা লোক।
ইমাম হারবী (রহিমাহুল্লাহ)-এর মতে, যে ব্যক্তি নিজে পাপ কাজ করে এবং অপরকে সৎকাজ করতে বাধা দেয়। কারো মতে, পেটুক প্রকৃতির লোক। আবার কারো মতে নাসীহাত শুনার পরও তা মানতে যার অন্তর কঠোর বা বাঁকা।
(جَوَّاظٍ) খত্ত্বাবীর মতে, جَوَّاظٍ বলা হয় সেই ব্যক্তিকে যার দৈহিক আকৃতি ও শক্তি অন্যের তুলনায় বেশী হওয়ার কারণে অহংকার করে চলে। ইবনু ফারিস (রহিমাহুল্লাহ)-এর মতে, অধিক ভক্ষণকারী পেটুক লোক। কারো মতে, এমন লোক যার কখনো অসুখ হয় না। কেউ বলেন, ঐ ব্যক্তিকে جَوَّاظٍ বলা হয় যে নিজেকে এমন সব বস্তু বা গুণাবলীর অধিকারী হিসেবে গর্ব করে যা তার কাছে আদৌ নেই।
(لَوْ أَقْسَمَ عَلَى اللهِ لَأَبَرَّهٗ) ইমাম নাবাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেছেনঃ এখানে এর অর্থ হলো সে যদি (আল্লাহর অনুগ্রহ লাভের আশায়) আল্লাহর ওপর শপথ বা কসম করে থাকে তবে আল্লাহ তা অবশ্যই পূরণ করেন। ইমাম ত্বীবী (রহিমাহুল্লাহ)-ও একই অর্থ নিয়েছেন।
(ফাতহুল বারী ৮ম খন্ড, হাঃ ৪৯১৮; শারহুন নাবাবী ১৭শ খন্ড, হাঃ ২৮৫৩/৪৬; মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ ২০. প্রথম অনুচ্ছেদ - রাগ ও অহংকার
৫১০৭-[৪] ’আবদুল্লাহ ইবনু মাস্’ঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তির অন্তরে একটি সরিষা পরিমাণ ঈমান থাকবে, সে কখনো জাহান্নামে প্রবেশ করবে না এবং যে ব্যক্তির অন্তরে একটি সরিষা পরিমাণ অহংকার থাকবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। (মুসলিম)[1]
بَابُ الْغَضَبِ وَالْكِبَرِ
وَعَنِ ابْنِ مَسْعُودٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَا يَدْخُلُ النَّارَ أحد فِي قلبه مِثْقَال حَبَّة خَرْدَلٍ مِنْ إِيمَانٍ. وَلَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ أَحَدٌ فِي قَلْبِهِ مِثْقَالُ حَبَّةٍ مِنْ خَرْدَلٍ مِنْ كبر» . رَوَاهُ مُسلم
ব্যাখ্যাঃ (لَا يَدْخُلُ النَّارَ أحد فِي قلبه مِثْقَال حَبَّة) উক্ত হাদীসাংশে مِثْقَال حَبَّة এর অর্থ হলো কোন শস্যদানার ওজনের পরিমাণ। তুহফাতুল আহ্ওয়াযীর লেখক মাজমা‘ নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, مِثْقَال শব্দটি মূলত ওজনের পরিমাণ বুঝায়। কম হোক বা বেশী হোক। কিন্তু লোকেরা শুধুমাত্র দীনারের হিসাব সংখ্যায় শব্দটিকে রূপান্তরিত করে ব্যবহার করছে। যা মোটেও উচিত নয়।
(শারহুন নাবাবী ২য় খন্ড, হাঃ ৯১/১৪৭; ‘আওনুল মা‘বূদ ৭ম খন্ড, হাঃ ৪০৮৭; তুহফাতুল আহ্ওয়াযী ৫ম খন্ড, হাঃ ১৯৯৮)
(مِنْ خَرْدَلٍ) বলা হয়েছে, خَرْدَلٍ হলো কালো বর্ণের শস্যদানা যা দেখতে ক্ষুদ্র অণুর মতো। অর্থাৎ একেবারে ছোট। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ; ‘আওনুল মা‘বূদ ৭ম খন্ড, হাঃ ৪০৮৭; তুহফাতুল আহ্ওয়াযী ৫ম খন্ড, হাঃ ১৯৯৮)
(مِنْ كبر) ইমাম খত্ত্বাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ এ অহংকারের ব্যাখ্যা দু’টি পদ্ধতিতে করা যেতে পারে। ১. হতে পারে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শির্ক এবং কুফরীমূলক অহংকারের উদ্দেশ্য করেছেন। কেননা হাদীসের শেষাংশে তিনি বিপরীত প্রতিদান হিসেবে জান্নাতের জন্য ঈমানকে দাঁড় করিয়েছেন আর ঈমানের বিপরীত হচ্ছে শির্ক ও কুফরী। কাজেই এখানে এমন অহংকার উদ্দেশ্য যা শির্ক বা কুফরীর সমতুল্য। এ অবস্থায় কেউ জান্নাতে যাবে না। ২. আল্লাহ সুবহানাহূ যখন কাউকে জান্নাতে প্রবেশ করাতে ইচ্ছা পোষণ করেন তখন তার অন্তর থেকে অহংকার দূর করে দেন। এভাবে সে অহংকার ও হিংসামুক্ত হয়ে জান্নাতে প্রবেশ করে। যেমনটি আল্লাহ বলেছেন, وَنَزَعْنَا مَا فِي صُدُورِهِمْ مِنْ غِلٍّ
‘‘এবং তাদের অন্তরে যে হিংসা বিদ্বেষ ছিল আমি তা দূর করে দেই...।’’ (সূরাহ্ আল আ‘রাফ ৭ : ৪৩)
ইমাম নাবাবী (রহিমাহুল্লাহ) উক্ত ব্যাখ্যা দু’টি সম্পর্কে বলেছেনঃ হাদীসের শেষাংশে যে অহংকারের কথা বলা হয়েছে তা আমাদের কাছে সুপরিচিত। তা হলো মানুষের সামনে নিজেকে বড় মনে করা এবং তাদেরকে অবহেলার চোখে দেখা, এমনকি সৎ বা সঠিক বিষয় সামনে আসলেও তা প্রত্যাখ্যান করে মিথ্যা বা ভুলের উপর অবিচল থাকা। কাযী ‘ইয়ায (রহিমাহুল্লাহ) এ কথাটি পছন্দ করেছেন। কোন কোন মুহাক্কিক বলেছেন যে, কেউ যদি অহংকার করা বৈধ মনে করে তাহলে জাহান্নামে যাওয়াই হবে তার প্রতিদান। তবে যারা আল্লহকে এক বলে স্বীকৃতি প্রদান করেছে তার শাস্তি ভোগ করার পর একবার না একবার জান্নাতে যাবেই। কেউ বলেছেন, (لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ) এর অর্থ হলো প্রথমবারেই মুত্তাক্বীদের সাথে জান্নাতে প্রবেশ করবে না, বরং শাস্তি ভোগের পর জান্নাতে প্রবেশ করবে।
ইমাম খত্ত্বাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ (لَا يَدْخُلُ النَّارَ) এর অর্থ হলো জাহান্নামে প্রবেশ করবে না এমনটি নয় বরং আল্লাহ চাইলে সে জাহান্নামে যেতে পারে।
তুহফাতুল আহওয়াযীর লেখক বলেনঃ مِثْقَال حَبَّة مِنْ إِيمَانٍ এ কথাটিই প্রমাণ করে যে, ঈমান কমে এবং বাড়ে। (‘আওনুল মা‘বূদ ৭ম খন্ড, হাঃ ৪০৮৭; তুহফাতুল আহ্ওয়াযী ৫ম খন্ড, হাঃ ১৯৯৮; মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ ২০. প্রথম অনুচ্ছেদ - রাগ ও অহংকার
৫১০৮-[৫] উক্ত রাবী [’আবদুল্লাহ ইবনু মাস্’ঊদ (রাঃ)] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যার অন্তরে এক বিন্দু অহংকার আছে, সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল : হে আল্লাহর রসূল! সকলেই তো এটা পছন্দ করে যে, তার পোশাক ভালো হোক, জুতো জোড়া ভালো হোক, এসব কি অহংকারের মধ্যে শামিল? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ আল্লাহ তা’আলা নিজেও সুন্দর, তিনি সৌন্দর্যকে পছন্দও করেন। আর অহংকার হলো হককে বাতিল করা এবং মানুষকে হেয় প্রতিপন্ন করা। (মুসলিম)[1]
بَابُ الْغَضَبِ وَالْكِبَرِ
وَعَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنْ كَانَ فِي قَلْبِهِ مِثْقَالُ ذَرَّةٍ مِنَ كِبْرٍ» . فَقَالَ رَجُلٌ: إِنَّ الرَّجُلَ يُحِبُّ أَنْ يَكُونَ ثَوْبُهُ حَسَنًا وَنَعْلُهُ حَسَنًا. قَالَ: «إِنَّ اللَّهَ تَعَالَى جَمِيلٌ يُحِبُّ الْجَمَالَ. الْكِبَرُ بَطَرُ الْحَقِّ وَغَمْطُ النَّاس» . رَوَاهُ مُسلم
ব্যাখ্যাঃ (لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنْ كَانَ فِي قَلْبِه مِثْقَالُ ذَرَّةٍ مِنَ كِبْرٍ) অত্র হাদীসের ব্যাখ্যায় কোন একজন হাদীস বিশারদ উল্লেখ করেছেন যে, এ ধরনের ব্যক্তি চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামে প্রবেশ করবে না। আবূ সা‘ঈদ আল খুদরী (রাঃ) হতেও এ মর্মে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
يخرج من النار من كان فى قلبه مثقال ذرة من إيمان
অর্থাৎ ‘‘যার অন্তরে অণু পরিমাণ ঈমান রয়েছে তাকেও জাহান্নাম থেকে বের করা হবে।’’
অনুরূপভাবে একাধিক তাবি‘ঈ নিমেণাক্ত আয়াতটিকে তাফসীর করে বলেছেন,
رَبَّنَا إِنَّكَ مَنْ تُدْخِلِ النَّارَ فَقَدْ أَخْزَيْتَه
‘‘আল্লাহ আপনি যাকে জাহান্নামে চিরস্থায়ী বাসিন্দা বানিয়েছেন আপনি তাকে অতি লাঞ্ছিত করেছেন...’’- (সূরাহ্ আ-লি ‘ইমরা-ন ৩ : ১৯২)। (তুহফাতুল আহওয়াযী ৫ম খন্ড, হাঃ ১৯৯৯)
(فَقَالَ رَجُلٌ) ইমাম নাবাবী শারহু মুসলিমে উল্লেখ করেছেন লোকটির নাম হলো মালিক ইবনু মুযারা আর্ রহওয়াই।
মিরক্বাতুল মাফাতীহ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে কয়েকজন হতে পারে, তারা হলেন- ১. মু‘আয ইবনু জাবাল ২. ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘আমর ইবনুল ‘আস এবং ৩. রবী‘আহ্ ইবনু ‘আমির।
إِنَّهٗ يُعْجِبُنِي أَنْ يَكُونَ ثَوْبِي حَسَنًا ونعلي حسنا অর্থাৎ মানুষের নজরকাড়া বা দৃষ্টি আকর্ষণ করার মানসিকতাও আমার নেই অহংকার বা দম্ভভরে চলাফেরা করা এবং মানুষের প্রশংসা বা বাহবা শুনার কোনরূপ ইচ্ছাও আমার নেই।
(إِنَّ اللهَ تَعَالٰى جَمِيلٌ يُحِبُّ الْجَمَالَ) অর্থাৎ- আল্লাহ সুবহানাহূ ওয়াতা‘আলা পরিপূর্ণ গুণাবলীর অধিকারী এবং উত্তম কার্য সম্পাদনকারী। ইমাম মালিক (রহিমাহুল্লাহ) বলেছেনঃ আলো এবং সৌন্দর্য উদ্দেশ্য। আবার বলা হয়েছে, তোমাদের সাথে উত্তম আচরণকারী এবং তোমাদের ওপর সুদৃষ্টিদানকারী।
ইমাম মানবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ (إِنَّ اللهَ جَمِيلٌ) দ্বারা আল্লাহ তা‘আলার সত্ত্বাগত সৌন্দর্য, গুণগত এবং কর্মগত সৌন্দর্য বুঝায়। আর يُحِبُّ الْجَمَالَ দ্বারা তোমাদের অবস্থাগত সৌন্দর্য (পরিষ্কার-পরিছন্নমূলক) এবং আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে মুখাপেক্ষী হওয়া থেকে নিজেকে পবিত্র রাখাকে বুঝায়।
(الْكِبَرُ بَطَرُ الْحَقِّ) অর্থাৎ অহংকার হলো সত্যের সৌন্দর্যকে নষ্ট করে কলংকিত করা। আর (وَغَمْطُ النَّاس) এর অর্থ হলো সৃষ্টিজীবকে হেয় প্রতিপন্ন করে ঘৃণার চোখে দেখা। (بَطَرُ) শব্দের মূল অর্থ হলো অত্যধিক পরিমাণে হাসি তামাশায় দিন যাপন করা। এখানে উদ্দেশ্য হলো অর্থের প্রাচুর্যে নোংরা হয়ে যাওয়া। আবার বলা হয়েছে, নি‘আমাতে ডুবে থেকে আল্লাহর সীমালঙ্ঘন করা। উল্লেখিত অর্থ দু’টি পরস্পর সামঞ্জস্যপূর্ণ।
মোটকথা (بَطَرُ الْحَقِّ) দ্বারা উদ্দেশ্য হলো আল্লাহ তা‘আলার তাওহীদ, রিসালাহ্, ‘ইবাদাত ইত্যাদি বিষয়সমূহের মধ্যে যা হক হিসেবে গণ্য করেছেন সেগুলোকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা।
তূরিবিশতী (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ উক্ত হাদীসাংশের ব্যাখ্যা হলো সত্যকে মিথ্যা মনে করে বা অবহেলা করে তা থেকে পিছুটান থাকা। (তুহফাতুল আহওয়াযী ৫ম খন্ড, হাঃ ১৯৯৯; মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ ২০. প্রথম অনুচ্ছেদ - রাগ ও অহংকার
৫১০৯-[৬] আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তিন প্রকার মানুষ আছে, কিয়ামতের দিন যাদের সাথে আল্লাহ তা’আলা কথা বলবেন না এবং তাদেরকে পাপ-পঙ্কিলতা থেকে পবিত্র করবেন না। অন্য এক বর্ণনায় আছে, আল্লাহ তা’আলা তাদের প্রতি রহমতের দৃষ্টি নিক্ষেপ করবেন না। আর তাদেরকে কঠিন শাস্তি দেবেন। তারা হচ্ছে- বৃদ্ধ ব্যভিচারী, মিথ্যাবাদী বাদশাহ ও অহংকারী গরীব। (মুসলিম)[1]
بَابُ الْغَضَبِ وَالْكِبَرِ
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «ثَلَاثَةٌ لَا يُكَلِّمُهُمُ اللَّهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلَا يُزَكِّيهِمْ» . وَفِي رِوَايَةٍ: وَلَا يَنْظُرُ إِلَيْهِمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ: شَيْخٌ زَانٍ وَمَلِكٌ كَذَّابٌ وَعَائِلٌ مُسْتَكْبِرٌ . رَوَاهُ مُسلم
ব্যাখ্যাঃ (لَا يُكَلِّمُهُمُ اللهُ) অর্থাৎ স্বাভাবিকভাবে সন্তুষ্ট মনে কথা বলবেন না বা মোটেই কথা বলবেন না।
(وَلَا يُزَكِّيهِمْ) অর্থাৎ তাদেরকে তাদের কৃত পাপ থেকে পবিত্রও করবেন না এবং অন্যান্য মু’মিনদের সামনে তাদের গুণগানও গাইবেন না।
(شَيْخٌ زَانٍ) এ পর্যায়ের ব্যক্তির ওপর অভিসম্পাতের কারণ হলো ব্যভিচার করা এমনিতেই অত্যন্ত জঘন্য অপরাধ। উপরন্তু কোন যুবক দ্বারা সংগঠিত হলে স্বাভাবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে যুবক হওয়ার কারণে ওযর বা কৈফিয়ত থাকে কিন্তু যদি এটা কোন বৃদ্ধের দ্বারা সংগঠিত হয় তখন এটা মেনে নেয়ার ক্ষেত্রে কোন ওযর থাকে না। কারণ ইতিপূর্বে যৌবনে তার চাহিদা পূরণ হয়েছে। এ অবস্থায় তার দ্বারা এমন কাজ হওয়ার বিকৃত রুচি এবং নেহায়াত কুৎসিত চরিত্রের অধিকারী হিসেবেই প্রমাণ করে। যেহেতু এটা সমাজ সংসারে এবং সভ্য বিবেকে মনুষ্যত্বের পরিপন্থী কাজ, তাই এটা আল্লাহর কাছেও অতি ঘৃণিত অপরাধ।
(وَمَلِكٌ كَذَّابٌ) অর্থাৎ অত্যধিক পরিমাণে মিথ্যার আশ্রয়গ্রহণকারী বাদশা (শাসক)। (وَعَائِلٌ مُسْتَكْبِرٌ) অর্থাৎ- দরিদ্র হয়েও অহংকার পোষণকারী ব্যক্তি। এ ধরনের লোক অভিশপ্ত হওয়ার কারণ হলো অহংকার করার যোগ্যতা তার মধ্যে নেই। যে সমস্ত উপকরণ হাতে থাকলে অহংকার চলে আসে, যেমন- অর্থ-সম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি, শিক্ষা-দীক্ষা, মান-সম্মান ইত্যাদি এগুলোর কোন কিছুই তার কাছে নেই যা তাকে অহংকারী হতে সহায়তা করে, তারপরও সে অহংকার করে। এটা স্বয়ং আল্লাহর কাছে অত্যন্ত নিন্দনীয়। তাই এটাও জঘন্য অপরাধ। বলা হয়েছে (عَائِلٌ) অর্থ হলো ذو العيال তথা সংসারী লোক। তার অহংকার হলো এ রকম যে, হাতে অর্থ নেই, আবার কেউ সাদাকা করলে তা নিবেও না, অন্তরে এক রকম হিংসাও কাজ করে, ফলে পরিবার অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
ইমাম ত্বীবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ যিনা হলো স্বাভাবিক অবস্থায় জঘন্য অপরাধ কিন্তু এটা যদি কোন বৃদ্ধ লোকের কাজ হয় তবে এটা অত্যন্ত জঘন্য হয়। অনুরূপ মিথ্যা কুৎসিত তবে এটা বাদশার কাছ থেকে হলে অত্যন্ত কুৎসিত হয়। অনুরূপভাবে অহংকার ঘৃণিত কাজ আর যদি এটা ফাকীরের কাছ থেকে হয় তবে তার জঘন্যের পরিমাণ আরো বেড়ে যায়।
মোটকথা, আমরা এভাবে বলতে পারি যে, الشَيْخٌ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো বিবাহিত লোক, চাই সে যুবক হোক বা বৃদ্ধ হোক। শারী‘আতের দৃষ্টিতে এটা অত্যন্ত জঘন্য, তাই তার জন্য রজমের শাস্তি আবশ্যক।
আর المَلِكٌ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো ধনী-সম্পদশালী লোক। কেননা ফাকীর দুনিয়াবী প্রয়োজনের উপকার লাভের আশায় মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে ফায়দা লাভ করে, পক্ষান্তরে ধনী লোকের দ্বারা এমনটির প্রয়োজন হয় না। এজন্য ধনী লোকের দ্বারা এমনটি হলে সেটা অত্যন্ত জঘন্য হিসেবে গণ্য হয়।
আর (عَائِلٌ مُسْتَكْبِرٌ) দ্বারা উদ্দেশ্য হলো ঐ ফাকীর লোক, যে অন্যান্য ফাকীরদের ওপর অহংকার করে, সে শক্তি সামর্থ্য থাকার পরও পরিশ্রম করেও অর্থ উপার্জন করতে চায় না। আত্মঅহংকারে ঘরে বসে থাকে। কোন সন্দেহ নেই যে, এ অবস্থায় সে নিজে এবং পরিবারের সবাই ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
(মিরক্বাতুল মাফাতীহ, শারহুন নাবাবী ২য় খন্ড, হাঃ ১০৭/১৭২; তুহফাতুল আহ্ওয়াযী ৪র্থ খন্ড, হাঃ ১৫৯৫)
পরিচ্ছেদঃ ২০. প্রথম অনুচ্ছেদ - রাগ ও অহংকার
৫১১০-[৭] উক্ত রাবী [আবূ হুরায়রা (রাঃ)] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলা বলেন, ’’অহংকার আমার চাদর ও শ্রেষ্ঠত্ব আমার লুঙ্গিস্বরূপ’’। অতএব, যে ব্যক্তি এ দু’টোর কোন একটি আমার কাছ থেকে কেড়ে নেবে, আমি তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব। অন্য এক বর্ণনায় আছে যে, তাকে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করব। (মুসলিম)[1]
بَابُ الْغَضَبِ وَالْكِبَرِ
وَعَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: يَقُولُ اللَّهُ تَعَالَى: الْكِبْرِيَاءُ رِدَائِي وَالْعَظَمَةُ إِزَارِي فَمَنْ نَازَعَنِي وَاحِدًا مِنْهُمَا أَدْخَلْتُهُ النَّارَ . وَفِي رِوَايَةٍ: «قَذَفْتُهُ فِي النَّارِ» . رَوَاهُ مُسلم
ব্যাখ্যাঃ (الْكِبْرِيَاءُ رِدَائِي وَالْعَظَمَةُ إِزَارِي) উল্লেখিত হাদীসাংশে الْكِبْرِيَاءُ শব্দটি আল্লাহর জাত বা সত্তাগত আর الْعَظَمَةُ শব্দটি আল্লাহর সিফাত বা গুণগত।
رِدَائِي এবং إِزَارِي শব্দ দু’টি রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। إِزَارِ এবং رِدَاء তথা লুঙ্গি ও চাদর- এ দু’টি কাপড় মানুষের শরীরে জড়ানো থাকে। এ দু’টি কাপড় হলো কোন মানুষের সৌন্দর্য। অনুরূপভাবে الْكِبْرِيَاءُ ও الْعَظَمَةُ তথা অহংকার ও মহত্ব- এ দু’টি বৈশিষ্ট্য আল্লাহর সাথেই জড়ানো এবং তিনিই এ দু’টোর একমাত্র দাবিদার আর এ দু’টি দ্বারাই তাঁর মর্যাদা এবং সৌন্দর্য প্রকাশ পায়। কাজেই উল্লেখিত হাদীসে উপমা স্বার্থকরূপেই ফুটে উঠেছে।
(শারহুন নাবাবী ১৬শ খন্ড, হাঃ ২৬২০/১৩৬; মিরক্বাতুল মাফাতীহ; ইবনু মাজাহ ৩য় খন্ড, হাঃ ৪১৭৪)
(فَمَنْ نَازَعَنِي وَاحِدًا مِنْهُمَا) অর্থাৎ কেউ যদি উক্ত দু’টি বৈশিষ্ট্য নিজের ভেতরে প্রকাশ করে এবং আল্লাহর সাথে অংশ সাব্যস্ত করতে চায় তাহলে আল্লাহ তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন। কেননা অহংকার হলো আল্লাহর সত্ত্বাগত বৈশিষ্ট্য (যা আল্লাহর দেহে মনে সম্পৃক্ত) আর মহত্ব ও বড়ত্ব আল্লাহর গুণগত বৈশিষ্ট্য, যে দু’টোর অধিকারী একমাত্র আল্লাহই। এখন কেউ যদি নিজের ভেতরে এ দু’টির চর্চা করে, তাহলে সে আল্লাহর সাথে অংশ সাব্যস্ত করে বিধায় আল্লাহ তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)