পরিচ্ছেদঃ ১. প্রথম অনুচ্ছেদ - ইহরাম ও তালবিয়াহ্
’আল্লামা আলক্বারী বলেনঃ ইহরামের প্রকৃত অর্থ হলো সম্মানিত স্থানে বা কাজে প্রবেশ করা। এর দ্বারা উদ্দেশ্য বিশেষ সম্মানিত কাজ। শারী’আতে হজের জন্য এ ধরনের ইহরাম শর্ত। তবে তা নিয়্যাত ও তালবিয়াহ্ ব্যতীত বাস্তবায়ন হয় না। অতএব ইহরামের উপর তালবিয়ার ’আত্ফটি ’আম-এর উপর খাসে ’আত্ফ।
গুনিয়্যাতুন্ নাসিক-এর লেখক বলেনঃ ইহরামের শাব্দিক অর্থ হলো- হুরসাত তথা সম্মানিত কাজে প্রবেশ করা।
শারী’আতের পরিভাষায় নির্দিষ্ট সম্মানিত কাজে প্রবেশ করা এবং তার ওপর অটল থাকাকে ইহরাম বলে। তবে এ অটল থাকা নিয়্যাত এবং নির্দিষ্ট যিকির ব্যতীত বাস্তবায়িত হয় না। সুস্পষ্ট মুতাওয়াতির বর্ণনা দ্বারা সাব্যস্ত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুলহুলায়ফাহ্ নামক স্থানে পৌঁছে ইহরাম বেঁধেছেন এবং ইহরামের সময় নির্দিষ্ট, ইফরাদ, কিরান বা তামাত্তু’ হজের উল্লেখ করেছেন।
এটাও সাব্যস্ত আছে যে, ইহরাম বাঁধার সময় প্রথম তালবিয়াহ্ হতেই তিনি তা নির্দিষ্ট করেছেন এবং এ সময় তিনি তালবিয়াহ্ পাঠ করেছেন। অতএব যিনি হজ্জ/হজ অথবা ’উমরা এর উদ্দেশে মীকাতে পৌঁছাবেন, তিনি ইহরামের নিয়্যাতে বলবেন (যদি ’উমরার ইচ্ছা করেন) ’’লাব্বায়কা ’উমরাতান’’ অথবা ’’আল্লা-হুম্মা লাব্বায়কা ’উমরাতান’’। হজের নিয়্যাত থাকলে বলবেন ’’লাব্বায়কা হাজ্জান’’ অথবা বলবেন ’’আল্লা-হুম্মা লাব্বায়কা হাজ্জান’’। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাই করেছেন।
২৫৪০-[১] ’আয়িশাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে তাঁর ইহরামের জন্য ইহরাম বাঁধার পূর্বে এবং ইহরাম খোলার জন্যে (দশ তারিখে) বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করার পূর্বে সুগন্ধি লাগাতাম, এমন সুগন্ধি যাতে মিস্ক থাকতো। আমি যেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সিঁথিতে এখনো সুগন্ধি দ্রব্যের উজ্জ্বলতা দেখতে পাচ্ছি অথচ তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইহরাম অবস্থায় ছিলেন। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
بَابُ الْإِحْرَامِ وَالتَّلْبِيَةِ
عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا قَالَتْ: كُنْتُ أُطَيِّبُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِإِحْرَامِهِ قَبْلَ أَنْ يُحْرِمَ وَلِحِلِّهِ قَبْلَ أَنْ يَطُوفَ بِالْبَيْتِ بِطِيبٍ فِيهِ مِسْكٌ كَأَنِّي أَنْظُرُ إِلَى وَبِيصِ الطِّيبِ فِي مَفَارِقِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَهُوَ مُحْرِمٌ
ব্যাখ্যা: كُنْتُ أُطَيِّبُ رَسُوْلَ اللّٰهِ ﷺ لِإِحْرَامِه قَبْلَ أَنْ يُحْرِمَ ‘‘ইহরাম বাঁধার পূর্বে ইহরামের উদ্দেশে আমি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সুগন্ধি লাগিয়ে দিতাম’’। হাদীসের এ অংশ প্রমাণ করে যে, ইহরাম বাঁধার উদ্দেশে ইহরাম বাঁধার পূর্বে সুগন্ধি লাগানো মুস্তাহাব। ইহরাম বাঁধার পরও ঐ সুগন্ধি ক্ষতির কোন কারণ নয়। সুগন্ধির ঘ্রাণ ও তার রং শরীরে লেগে থাকাও কোন ক্ষতির কারণ নয়। তবে ইহরাম পরে নতুন করে সুগন্ধি লাগানো হারাম। এ মতের প্রবক্তা হলেন ইমাম শাফি‘ঈ, আবূ হানীফা, আবূ ইউসুফ, আহমাদ ইবনু হাম্বল। সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাস, ইবনুয্ যুবায়র, ইবনু ‘আব্বাস, ইসহাক ও আবূ সাওর থেকে ইবনুল মুনযির এ অভিমত বর্ণনা করেছেন। ইবনু ‘আব্বাস আবূ সা‘ঈদ খুদরী, ‘আব্দুল্লাহ ইবনু জা‘ফার, ‘আয়িশাহ্, উম্মু হাবীবাহ্ (রাঃ), ‘উরওয়াহ্ ইবনুয্ যুবায়র, কাসিম ইবনু মুহাম্মাদ, শা‘বী, নাসায়ী, খারিজাহ্ ইবনু যায়দ প্রমুখ মনিষীগণ হতেও এ অভিমত বর্ণনা করেছেন।
পক্ষান্তরে একদল ‘উলামা বলেনঃ ইহরামের উদ্দেশে ইহরাম বাঁধার পূর্বে সুগন্ধি ব্যবহার করা বৈধ নয়। যদি কেউ তা লাগিয়ে থাকে অবশ্যই তা ধুয়ে ফেলতে হবে যাতে তার রং ও ঘ্রাণ কিছুই না থাকে। ইমাম মালিক-এর এটিই অভিমত। ইমাম যুহরী ও মুহাম্মাদ ইবনুল হাসানও এ মতের প্রবক্তা।
যারা তা বৈধ মনে করেন ‘আয়িশাহ্ (রাঃ) বর্ণিত অত্র হাদীস তাদের দলীল।
পক্ষান্তরে যারা তা বৈধ নয় বলেন তাদের দলীল ইয়া‘লা ইবনু ‘উমাইয়্যাহ্ বর্ণিত হাদীস তাতে আছে যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রশ্নকারীকে সুগন্ধি ধুয়ে ফেলার নির্দেশ দিলেন। এতে সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় যে, যিনি ইহরামের পূর্বে সুগন্ধি লাগাবেন তা অব্যাহতভাবে রাখার সুযোগ নেই বরং ইহরাম বাঁধার পূর্বেই তা ধুয়ে পরিষ্কার করতে হবে। জমহূর ইয়া‘লা বর্ণিত হাদীসের জওয়াবে বলেনঃ
(১) ইয়া‘লা বর্ণিত ঘটনা ঘটেছিল অষ্টম হিজরীতে জি‘রানাতে। আর ‘আয়িশাহ্ (রাঃ) বর্ণিত হাদীসের ঘটনা ১০ম হিজরীতে বিদায় হজের ঘটনা। আর সর্বশেষ বিষয়টি দলীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য।
(২) ইয়া‘লা বর্ণিত হাদীসে নির্দিষ্ট সুগন্ধি ধোয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে আর তা হলো খালূক। যে কোন সুগন্ধি ধোয়ার নির্দেশ দেয়া হয়নি। সম্ভবতঃ খালূক জা‘ফরান মিশ্রিত থাকার কারণে এ নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যা সুগন্ধির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কেননা পুরুষের জন্য কোন অবস্থাতেই জা‘ফরান ব্যবহার করা বৈধ নয়।
‘আল্লামা শানক্বীত্বী বলেনঃ আমার দৃষ্টিতে জমহূরের অভিমত তথা ইহরাম বাঁধার পূর্বে সুগন্ধি ব্যবহার বৈধ অধিক স্পষ্ট বলে প্রতীয়মান হয়।
(وَلِحِلِّه قَبْلَ أَنْ يَطُوفَ بِالْبَيْتِ) অর্থাৎ- তাওয়াফে ইফাযার পূর্বে রামী জামারাহ্ এবং মাথা মুন্ডানোর পরে তাকে সুগন্ধি লাগিয়েছি। হাদীসের এ অংশ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, রমী জামারার পর ইহরাম অবস্থায় হারামকৃত সবকিছুই হালাল হয়ে যায়। শুধুমাত্র স্ত্রীর সাথে মিলন এবং এর সাথে সম্পৃক্ত কার্যাবলী তাওয়াফ ইফাযাহ্ পর্যন্ত হারাম থাকে।
এ হাদীসটি এও প্রমাণ করে যে, হাজীর জন্য দু’টি হালাল অবস্থা রয়েছে। একটি জামরাতে পাথর নিক্ষেপ ও মাথা মুন্ডানোর পর। আরেকটি তাওয়াফে ইফাযার পর।
পরিচ্ছেদঃ ১. প্রথম অনুচ্ছেদ - ইহরাম ও তালবিয়াহ্
২৫৪১-[২] ’আব্দুল্লাহ ইবনু ’উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে মাথার চুল জড়ানো অবস্থায় তালবিয়াহ্ বলতে শুনেছি,
’’লাব্বায়ক আল্লা-হুম্মা লাব্বায়ক, লাব্বায়কা লা- শারীকা লাকা লাব্বায়ক, ইন্নাল হাম্দা ওয়ান্ নি’মাতা লাকা ওয়াল মুল্ক, লা- শারীকা লাকা’’
অর্থাৎ- ’’হে আল্লাহ! আমি তোমার দরবারে উপস্থিত হয়েছি! আমি তোমার খিদমাতে উপস্থিত হয়েছি। তোমার কোন শারীক নেই। আমি তোমার দরবারে উপস্থিত। সব প্রশংসা, অনুগ্রহের দান তোমারই এবং সমগ্র রাজত্বও তোমারই, তোমার কোন শারীক নেই।’’
এ কয়টি কথার বেশি কিছু তিনি বলেননি। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
بَابُ الْإِحْرَامِ وَالتَّلْبِيَةِ
وَعَنِ ابْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُهِلُّ مُلَبِّدًا يَقُولُ: «لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ لَبَّيْكَ لَا شَرِيكَ لَكَ لَبَّيْكَ إِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ لَا شَرِيكَ لَكَ» . لَا يَزِيدُ عَلَى هَؤُلَاءِ الْكَلِمَاتِ
ব্যাখ্যা: (يُهِلُّ مُلَبِّدًا) তিনি তালবীদ অবস্থায় তালবিয়াহ্ পাঠ করতেন। ‘উলামাহগণ বলেন আঠা বা খাতমী জাতীয় বস্ত্ত দ্বারা মাথার চুল লাগিয়ে রাখাকে তালবীদ বলা হয়। যাতে মাথার চুল পরস্পর মিলিত হয়ে থাকে তা এলোমেলো না হয়ে যায়।
এ থেকে বুঝা যায় যে, ইহরাম অবস্থায় তালবীদ করা মুস্তাহাব।
(لَا يَزِيدُ عَلٰى هَؤُلَاءِ الْكَلِمَاتِ) ‘‘নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তালবিয়াতে হাদীসে বর্ণিত শব্দের চাইতে বেশী কিছু বলতেন না’’। এ বর্ণনাটি নাসায়ীতে আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর তালবিয়াতে ছিল ‘‘লাব্বায়কা ইলাহাল হাক্কি’’-এর বিরোধী নয়। কেননা এ সম্ভাবনা রয়েছে এটি আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) শুনেছেন কিন্তু ইবনু ‘উমার (রাঃ) তা শুনেননি, তবে এটা প্রকাশমান যে, আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) বর্ণিত বাক্যটি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুব কমই বলেছেন। যেহেতু ইবনু ‘উমারের বর্ণিত বাক্যটি অধিক বর্ণিত হয়েছে। ইমাম আহমাদ, মালিক ও মুসলিম নাফি' সূত্রে ইবনু ‘উমার থেকে মারফূ' সূত্রে অত্র হাদীসে বর্ণিত তালবিয়ার শব্দ বর্ণনা করার পর অতিরিক্ত বর্ণনা করেছেন যে, নাফি' বলেনঃ ইবনু ‘উমার তার তালবিয়াতে এ দু‘আর সাথে আরো বাড়িয়ে বলতেন, ‘‘লাব্বায়কা, লাব্বায়কা, লাব্বায়কা, ওয়া সা‘দায়কা, ওয়াল খাইরু বিইয়াদায়কা, লাব্বায়কা, ওয়ার রাগবাউ ইলায়কা ওয়াল ‘আমল’’।
যদি প্রশ্ন করা হয় যে, ইবনু ‘উমার তালবিয়াতে তা কিভাবে বাড়ালেন যা সেটার অন্তর্ভুক্ত নয়। অথচ তিনি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাতের অনুসরণে খুবই কঠোর ছিলেন? এর জওয়াব এই যে, তিনি মনে করতেন যে, বর্ণিত শব্দমালার সাথে কিছু বাড়ানো হলে তা উক্ত শব্দমালাকে রহিত করে না। কোন বস্ত্তর একাকী থাকা যে পর্যায়ের, অন্যের সাথে সে একই পর্যায়ভুক্ত। অতএব নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পঠিত তালবিয়ার সাথে উক্ত শব্দমালাকে বাড়ালে তা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর তালবিয়াতে কোন ব্যাঘাত ঘটাবে না। অথবা তিনি বুঝেছেন যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পঠিত শব্দমালার উপর সংক্ষেপ্ত রাখা জরুরী নয়। কেননা কাজ বেশীর মধ্যেই সাওয়াব বেশী। ‘আল্লামা ‘ইরাকী বলেনঃ যিকিরের ক্ষেত্রে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বলেছেন তার মধ্যে কোন পরিবর্তন না করে যদি অতিরিক্ত শব্দমালা যোগ করা হয় তবে তা দোষণীয় নয়।
জেনে রাখা ভাল যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তালবিয়াতে যে শব্দমালা পাঠ করেছেন তার চাইতে বাড়ানো যাবে কি-না- এ ব্যাপারে ‘উলামাগণের মাঝে দ্বিমত রয়েছে।
কেউ তা মাকরূহ বলেছেন। ইবনু ‘আবদুল বার ইমাম মালিক থেকে তা বর্ণনা করেছেন। ইমাম শাফি‘ঈর একটি অভিমতও এ রকম।
পক্ষান্তরে সাওরী, আওযা‘ঈ ও মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান বলেনঃ তালবিয়াহ্ পাঠকারী তাতে তার পছন্দমত শব্দ বাড়াতে পার। আবূ হানীফা, আহমাদ ও আবূ সাওর বলেনঃ বাড়ানোতে কোন দোষ নেই।
হাফিয ইবনু হাজার বলেনঃ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পঠিত শব্দমালার উপর ‘আমল করা উত্তম। তবে তাতে বাড়ালে কোন দোষ নেই। এটিই জমহূর ‘উলামাগণের অভিমত।
পরিচ্ছেদঃ ১. প্রথম অনুচ্ছেদ - ইহরাম ও তালবিয়াহ্
২৫৪২-[৩] উক্ত রাবী [’আব্দুল্লাহ ইবনু ’উমার (রাঃ)] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (বিদায় হজের সময়) যখন যুলহুলায়ফাহ্ মসজিদের নিকট নিজের পা রিকাবে রাখার পর উটনী তাঁকে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছিল তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তালবিয়াহ্ পাঠ করেছিলেন। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
بَابُ الْإِحْرَامِ وَالتَّلْبِيَةِ
وَعَنْهُ قَالَ: كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا أَدْخَلَ رِجْلَهُ فِي الْغَرْزِ وَاسْتَوَتْ بِهِ نَاقَتُهُ قَائِمَةً أَهَلَّ منَ عندِ مسجدِ ذِي الحليفة
ব্যাখ্যা: নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখন তালবিয়াহ্ পাঠ শুরু করেছেন এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায়-
(১) নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুলহুলায়ফার মসজিদে সালাত (সালাত/নামাজ/নামায) আদায় করার পর তালবিয়াহ্ পাঠ করেছেন। যেমনটি আহমাদ, নাসায়ী, তিরমিযী ও বায়হাক্বী ইবনু ‘আব্বাস থেকে বর্ণনা করেছেন।
(২) যুলহুলায়ফার মসজিদের বাইরে বৃক্ষের নিকট যখন তার বাহন তাকে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে তখন তিনি তালবিয়াহ্ পাঠ করেছেন। বুখারী, মুসলিম ও আহমাদ ইবনু ‘উমার থেকে তা বর্ণনা করেছেন।
(৩) ‘বায়দা’ নামক স্থানে যখন তার বাহন তাকে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে তখন তিনি তালবিয়াহ্ পাঠ করেছেন। এ বর্ণনাগুলোর মধ্যে সমন্বয় এই যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ণিত সকল স্থানেই তালবিয়াহ্ পাঠ করেছেন। যারা তাঁকে যেখানে তা পাঠ করেছেন তারা তাই বর্ণনা করতে দেখেছেন। অতএব অত্র বর্ণনাগুলোর মধ্যে কোন বৈপরীত্য নেই।
ইবনুল ক্বইয়্যিম বলেনঃ নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুলহুলায়ফার মসজিদে যুহরের দু’ রাক্‘আত সালাত (সালাত/নামাজ/নামায) আদায় করার পর মুসল্লাতেই হজ্জ/হজ ও ‘উমরা-এর নিয়্যাত করে তালবিয়াহ্ পাঠ করেন। এরপর বাহনে আরোহণ করে আবার তালবিয়াহ্ পাঠ করেছেন। অতঃপর বায়দা নামক স্থানে যখন তার বাহন তাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে যায় তখনো তিনি তালবিয়াহ্ পাঠ করেছেন।
পরিচ্ছেদঃ ১. প্রথম অনুচ্ছেদ - ইহরাম ও তালবিয়াহ্
২৫৪৩-[৪] আবূ সা’ঈদ আল খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে (হজের উদ্দেশে) বের হলাম এবং উচ্চস্বরে তালবিয়াহ্ বলতে থাকলাম। (মুসলিম)[1]
بَابُ الْإِحْرَامِ وَالتَّلْبِيَةِ
وَعَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ قَالَ: خَرَجْنَا مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نَصْرُخُ بِالْحَجِّ صراخا. رَوَاهُ مُسلم
ব্যাখ্যা: (نَصْرُخُ بِالْحَجِّ صُرَاخًا) আমরা হজের জন্য উচ্চঃশব্দে তালবিয়াহ্ পাঠ করতাম। ইমাম নাবাবী বলেনঃ অত্র হাদীস প্রমাণ করে যে, উচ্চঃশব্দে তালবিয়াহ্ পাঠ করা মুস্তাহাব।
তবে আওয়াজ মধ্যম ধরনের হতে হবে। আর মহিলাগণ শুধু নিজে শুনতে পায় এমনভাবে তালবিয়াহ্ পাঠ করবে তারা আওয়াজ উঁচু করবে না। কেননা উঁচু আওয়াজ তাদের জন্য ফিতনার কারণ হতে পারে।
সকল ‘উলামাগণের মতে পুরুষদের উঁচু আওয়াজে তালবিয়াহ্ পাঠ করা মুস্তাহাব। আহলুয্ যাহিরদের মতে তা ওয়াজিব। এ হাদীস এও প্রমাণ করে যে, ইহরামের শুরুতে তালবিয়াহ্ পাঠ বা ইহরামের নিয়্যাতের প্রাক্কালে স্বশব্দে হজ্জ/হজ বা ‘উমরা-এর নিয়্যাত করা মুস্তাহাব।
পরিচ্ছেদঃ ১. প্রথম অনুচ্ছেদ - ইহরাম ও তালবিয়াহ্
২৫৪৪-[৫] আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি একই সওয়ারীতে আবূ ত্বলহাহর সাথে পিছনে বসেছিলাম, তখন সাহাবীগণ সম্মিলিতভাবে হজ্জ/হজ ও ’উমরার জন্যে উচ্চস্বরে তালবিয়াহ্ পাঠ করছিলেন। (বুখারী)[1]
بَابُ الْإِحْرَامِ وَالتَّلْبِيَةِ
وَعَنْ أَنَسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: كُنْتُ رَدِيفَ أَبِي طَلْحَةَ وَإِنَّهُمْ لَيَصْرُخُونَ بهِما جَمِيعًا: الْحَج وَالْعمْرَة. رَوَاهُ البُخَارِيّ
ব্যাখ্যা: (إِنَّهُمْ لَيَصْرُخُونَ بهِما جَمِيعًا: اَلْحَجِّ وَالْعُمْرَةِ) নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীগণ সমস্বরে একত্রে হজ্জ/হজ ও ‘উমরা-এর তালবিয়াহ্ পাঠ করতেন। অত্র হাদীস প্রমাণ করে যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিরান হজ্জ/হজ করেছেন।
পরিচ্ছেদঃ ১. প্রথম অনুচ্ছেদ - ইহরাম ও তালবিয়াহ্
২৫৪৫-[৬] ’আয়িশাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, বিদায় হজের বছর আমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে (হজের উদ্দেশে) রওয়ানা হলাম। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ শুধু ’উমরার জন্য ইহরাম বেঁধেছিলেন, আবার কেউ কেউ হজ্জ/হজ ও ’উমরা উভয়ের জন্যে ইহরাম বেঁধেছিলেন, আবার কেউ কেউ শুধু হজের জন্য ইহরাম বেঁধেছিলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু হজের জন্য ইহরাম বেঁধেছিলেন। অতঃপর যারা শুধু ’উমরার ইহরাম বেঁধেছিলেন তারা (তাওয়াফ ও সা’ঈর পর) হালাল হয়ে গেলেন (অর্থাৎ- ইহরাম খুলে ফেললেন)। আর যারা শুধু হজ্জ/হজ অথবা হজ্জ/হজ ও ’উমরা উভয়ের জন্য ’ইহরাম’ বেঁধেছিলেন তারা কুরবানীর দিন আসা পর্যন্ত হালাল হননি। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
بَابُ الْإِحْرَامِ وَالتَّلْبِيَةِ
وَعَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ: خَرَجْنَا مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَامَ حَجَّةِ الْوَدَاعِ فَمِنَّا مَنْ أَهَلَّ بِعُمْرَةٍ وَمِنَّا مَنْ أَهَلَّ بِحَجٍّ وَعُمْرَةٍ وَمِنَّا مَنْ أَهَلَّ بِالْحَجِّ وَأَهَلَّ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِالْحَجِّ فَأَمَّا مَنْ أَهَلَّ بِعُمْرَةٍ فَحَلَّ وَأَمَّا مَنْ أَهَلَّ بِالْحَجِّ أَوْ جَمَعَ الْحَجَّ وَالْعُمْرَةَ فَلَمْ يَحِلُّوا حَتَّى كَانَ يَوْمُ النَّحْرِ
ব্যাখ্যা: (خَرَجْنَا) ‘‘আমরা বের হলাম’’। অর্থাৎ- আমরা মদীনাহ্ থেকে বের হলাম। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে যারা বিদায় হজের বৎসর বের হয়েছিলেন তাদের সংখ্যা কত ছিল- এ নিয়ে ‘আলিমদের মাঝে মতভেদ রয়েছে। বলা হয়ে থাকে যে, তাদের সংখ্যা ছিল নব্বই হাজার।
আবার এটাও বলা হয় যে, তাদের সংখ্যা ছিল এক লাখ দশ হাজার। কেউ বলেন তাদের সংখ্যা আরো বেশী ছিল।
তাবূকের যুদ্ধের সময় তাদের সংখ্যা ছিল এক লাখ। বিদায় হজ্জ/হজ তারও এক বৎসর পরে অনুষ্ঠিত হয়। অতএব তাদের সংখ্যা এক লাখের বেশীই ছিল।
নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনাহ্ থেকে কোন দিন বের হয়েছিলেন- এ নিয়ে ও মতভেদ রয়েছে। সঠিক কথা হলো তিনি যিলকদ মাসের চার দিন বাকী থাকতে শনিবার মদীনাহ্ থেকে বের হয়ে যুলহুলায়ফাতে যেয়ে যুহর অথবা ‘আসর-এর সালাত (সালাত/নামাজ/নামায) আদায় করেন।
(عَامَ حَجَّةِ الْوَدَاعِ) ‘‘বিদায় হজের বৎসর’’। এ হজ্জ/হজকে বিদায় হজ্জ/হজ এজন্যই বলা হয় যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাতে লোকজনদেরকে বিদায় জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেনঃ সম্ভবত এরপর আমি আর হজ্জ/হজ করব না। প্রকৃতপক্ষে ঘটেও ছিল তাই। তিনি পুনরায় আর হজ্জ/হজ করার সুযোগ পাননি।
জেনে রাখা ভাল যে, হজ্জ/হজ তিন প্রকারঃ ইফরাদ, তামাত্তু' ও কিরান। ‘উলামাহগণ সকলে একমত যে, তিন প্রকারের যে কোন এক প্রকার হজ্জ/হজ করা বৈধ।
(১) ইফরাদঃ হজ্জের মাসে শুধুমাত্র হজ্জের নিয়্যাতে ইহরাম বেঁধে হজের কার্য সম্পাদন করাকে ইফরাদ হজ্জ/হজ বলে। হজ্জের কাজ সম্পাদন করে কেউ ইচ্ছা করলে ‘উমরা করতে পারে।
(২) তামাত্তুঃ হজের মাসে মীকাত থেকে শুধুমাত্র ‘উমরা এর নিয়্যাতে ইহরাম বেঁধে ‘উমরা এর কাজ সম্পাদন করে হালাল হয়ে যাবে। এরপর ঐ বৎসরই পুনরায় ইহরাম বেঁধে হজের কার্যাবলী সম্পাদন করবে।
(৩) কিরানঃ মীকাত থেকে একই সাথে হজ্জ/হজ ও ‘উমরা-এর জন্য নিয়্যাত করে ইহরাম বেঁধে একই ইহরামে ‘উমরা ও হজ্জের কার্য সম্পাদন করাকে কিরান হজ্জ/হজ বলে।
এ তিন প্রকারের হজের মধ্যে কোন প্রকারের হজ্জ/হজ উত্তম- এ বিষয়ে ‘উলামাগণের মাঝে মতভেদ রয়েছে।
[১] উত্তম হলো ইফরাদ হজ্জঃ ইমাম মালিক ও ইমাম শাফি‘ঈর মত এটিই। এরপর তামাত্তু' এরপর কিরান।
[২] উত্তম হলো তামাত্তু' হজ্জঃ ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বালের অভিমত এটিই। ইমাম শাফি‘ঈর একটি মতও এরূপ পাওয়া যায়।
[৩] উত্তম হলো কিরান হজ্জঃ এটি ইমাম আবূ হানীফার অভিমত। হানাফীদের প্রসিদ্ধ মতানুযায়ী, অতঃপর তামাত্তু', অতঃপর ইফরাদ। ইমাম আবূ হানীফা থেকে একটি মত এরূপ পাওয়া যায় যে, তামাত্তু'-এর চাইতে ইফরাদ উত্তম।
[৪] কুরবানীর পশু সাথে নিলে কিরান উত্তম নচেৎ তামাত্তু' উত্তম। ইমাম আহমাদ থেকে এ মত বর্ণনা করেছেন ‘আল্লামা মারূয।
[৫] ফাযীলাতের দিক থেকে তিন প্রকার হজ্জই সমান। হাফিয ইবনু হাজার আসক্বালানী ফাতহুল বারীতে দাবী করেছেন যে, এটি ইমাম ইবনু খুযায়মার অভিমত।
[৬] তামাত্তু' ও কিরান ফাযীলাতের ক্ষেত্রে সমান। আর এ দু’টো ইফরাদের চাইতে উত্তম। আবূ ইউসুফ থেকে এ অভিমত বর্ণিত হয়েছে।
পরিচ্ছেদঃ ১. প্রথম অনুচ্ছেদ - ইহরাম ও তালবিয়াহ্
২৫৪৬-[৭] ’আব্দুল্লাহ ইবনু ’উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজের সাথে ’উমরারও উপকারিতা লাভ করেছিলেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এভাবে শুরু করেছিলেন যে, প্রথমে ’উমরার তালবিয়াহ্ পাঠ করেছিলেন, এরপর হজের তালবিয়াহ্। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
بَابُ الْإِحْرَامِ وَالتَّلْبِيَةِ
وَعَنِ ابْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قَالَ: تَمَتَّعَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي حَجَّةِ الْوَدَاعِ بِالْعُمْرَةِ إِلَى الْحَجِّ بدأَ فأهلَّ بالعمْرةِ ثمَّ أهلَّ بالحجّ
ব্যাখ্যা: (تَمَتَّعَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ) ‘‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তামাত্তু' হজ্জ/হজ করেছেন’’। (بَدَأَ فَأهَلَّ بِالْعُمْرَةِ ثُمَّ أَهَلَّ بِالْحَجِّ) এ বাক্যটি (تمتع)-এর ব্যাখ্যা। অর্থাৎ- তিনি প্রথমে ‘উমরার জন্য ইহরাম বেঁধেছেন, পরে ‘উমরা-এর সাথে হজ্জের নিয়্যাত করেছেন। সিন্দী বলেনঃ এখানে (تمتع) ‘‘তামাত্তু’’ বলতে কিরান বুঝানো হয়েছে। কেননা সাহাবীগণ কিরানকেও (تمتع) বলে থাকেন। আর অবধারিত যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হজ্জ/হজ কিরান ছিল।
(بَدَأَ بِالْعُمْرَةِ) অর্থাৎ- তিনি ইহরাম বাঁধার সময়ে প্রথমে ‘‘উমরা’’ শব্দ উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন (لبيك عمرة) ‘‘লাব্বায়কা ‘উমরাতান্’’।