পরিচ্ছেদঃ ২. প্রথম অনুচ্ছেদ - কিরাআতের ভিন্নতা ও কুরআন সংকলন প্রসঙ্গে
২২১১-[১] ’উমার ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি হিশাম ইবনু হাকীম ইবনু হিযামকে ’সূরা আল ফুরকান’ পাঠ করতে শুনলাম। আমি যেভাবে (কুরআন) পড়ি, তা হতে (তার পড়া) ভিন্ন ধরনের, অথচ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে আমাকে এ সূরা পড়িয়েছেন। তাই আমি এর কারণে ব্যস্ত হতে উদ্যত হলাম। কিন্তু সালাত শেষ করা পর্যন্ত তাকে সুযোগ দিলাম। সালাত শেষ হবার পরই তার চাদর তার গলায় পেঁচিয়ে আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে নিয়ে বললাম, হে আল্লাহর রসূল! আপনি আমাকে যেভাবে ’সূরা আল ফুরকান’ পড়িয়েছেন তার থেকে ভিন্নরূপে আমি হিশামকে ’সূরা আল ফুরকান’ পড়তে শুনলাম।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ’উমারকে বললেন, তাকে ছেড়ে দাও। হিশামকে বললেন, হিশাম! তুমি ’সূরা আল ফুরকান’ পড়ো তো দেখি। হিশাম এ সূরাটি সেভাবেই পড়ল আমি তাকে যেভাবে পড়তে শুনেছি। তার পড়া শুনে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ এভাবেও এ সূরা নাযিল হয়েছে। এরপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাকে বললেন, এখন তুমিও পড়ো দেখি! আমিও সূরাটি পড়লাম। আমার পড়া শুনে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, এ সূরাটি এভাবেও নাযিল হয়েছে। বস্ত্তত এ কুরআন সাত রীতিতে নাযিল করা হয়েছে। তাই তোমাদের যার জন্য যে কিরাআত সহজ হয় সেভাবেই তোমরা পড়বে। (বুখারী, মুসলিম; কিন্তু পাঠ [শব্দ] মুসলিমের)[1]
بَابُ اِخْتِلَافِ الْقِرَاءَاتِ وَجَمْعِ الْقُرْاٰنِ
وَعَنْ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: سَمِعْتُ هِشَامَ بْنَ حَكِيمِ بْنِ حِزَامٍ يقْرَأ سُورَة الْفرْقَان على غير مَا أقرؤوها. وَكَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَقْرَأَنِيهَا فَكِدْتُ أَنْ أَعْجَلَ عَلَيْهِ ثُمَّ أَمْهَلْتُهُ حَتَّى انْصَرَفَ ثُمَّ لَبَّبْتُهُ بِرِدَائِهِ فَجِئْتُ بِهِ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ. فَقلت يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنِّي سَمِعْتُ هَذَا يَقْرَأُ سُورَةَ الْفُرْقَانِ عَلَى غَيْرِ مَا أَقْرَأْتَنِيهَا. فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَرْسِلْهُ اقْرَأ فَقَرَأت الْقِرَاءَةَ الَّتِي سَمِعْتُهُ يَقْرَأُ. فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «هَكَذَا أُنْزِلَتْ» . ثُمَّ قَالَ لي: «اقْرَأ» . فَقَرَأت. فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «هَكَذَا أنزلت إِن الْقُرْآنَ أُنْزِلَ عَلَى سَبْعَةِ أَحْرُفٍ فَاقْرَءُوا مَا تيَسّر مِنْهُ» . مُتَّفق عَلَيْهِ. وَاللَّفْظ لمُسلم
ব্যাখ্যা: কুরআন নাযিল হয়েছে সাত রীতিতে। আবার কোন বর্ণনায় রয়েছে কুরআন তিন পদ্ধতিতে নাযিল হয়েছে।
আবূ শামাহ বলেন, হয়তো কুরআন প্রথমে তিন রীতিতে এবং পরে সাত রীতিতে নাযিল হয়েছে। কেউ বলেছেন, এখান থেকে নির্দিষ্ট সংখ্যা ধর্তব্য নয়। বরং এর দ্বারা সহজতা, প্রশস্ততা, সম্মান ও দয়া উদ্দেশ্য।
‘উলামাগণ سبعة أحرف-এর অর্থ ও ব্যাখ্যা নিয়ে অনেক মতামত ব্যক্ত করেছেন।
‘আল্লামা সুয়ূত্বী (রহঃ) তাঁর اتقان গ্রন্থে বলেন, এ হাদীসের অর্থের ব্যাপারে চল্লিশটি মত রয়েছে, তন্মধ্যে একটি মত হচ্ছে, حرف-এর অর্থ নির্ণয় করা কঠিন। কেননা حرف বলতে সাধারণ বানানো অক্ষর উদ্দেশ্য হতে পারে। আবার শব্দকে বুঝায় অর্থকে ও বুঝায় আবার ‘‘দিক’’ এর অর্থ দিয়ে থাকে। তিনি বলেন, পছন্দনীয় অভিমত হচ্ছে এটা متشابهة-এর অন্তর্ভুক্ত। এর সঠিক ব্যাখ্যা বলা যায় না।
কেউ কেউ সাত হরফ বলতে সাতটি গোত্র উদ্দেশ্য। যেমন- কুরায়শ, হাওয়াযিন, তামীম, হুযায়ল, আযদ, রবী‘আহ্, সা‘দ বিন বাকর ইত্যাদি। ইমাম ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেন, সাত হরফ বলতে সাতটি ধরন উদ্দেশ্য। যদি একটি রীতিতে পড়তে বলা হত তাহলে কারীদের নিকটে কঠিন হতো। তাই যাতে তারা তাদের সহজ ভাষাতে কুরআন তিলাওয়াত করতে পারে সেজন্য এই প্রশস্ততা দান করা হয়েছে।
কেউ কেউ সাতটি গোত্র বা সাতটি ভাষাকে মেনে নিতে চাননি। তারা বলেন, ‘উমার ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) ও হিশাম বিন হাকীম (রাঃ) উভয়েই কুরায়শ বংশের একই গোত্রের একই ভাষার অথচ তাদের পড়ার ধরন দুই ধরনের।
এ ধরনের মতভেদের সমাধানে ইমাম ইবনু হাজার (রহঃ) বলেন, سبعة أحرف এর দ্বারা একই অর্থের বিভিন্ন শব্দ উদ্দেশ্য। যেমন أقبل – هلم - تعالى ইত্যাদি।
ইবনু ‘আবদুল বার (রহঃ) বলেন, অধিকাংশ ‘আলিম এ মতটি গ্রহণ করেছেন। সাত ধরনের শব্দ মানে সাত ধরনের পরিবর্তন; যেমন-
১. হরকতের বিভিন্নতা, যেমন- يُضَارُّ ও يُضَارَّ।
২. فعل গত পরিবর্তন যথা: فعل الأمر -_ بَاعِدْ এবং فعلى الماضى _ بَعُدَ।
৩. নুক্তার পরিবর্তন। যথা: نُنْسَزُهَا ও نُنْسَرُهَا।
৪. নিকটবর্তী মাখরাজের হরফের পরিবর্তন করে। যথা: طلح منضود ও طلع منضود।
৫. تقديم ও تأخير এর পরিবর্তন। যথা: وجاءت سكرة بالموت بالحق কে جاءت سكرة الحق بالموت পড়া।
৬. অক্ষর কম-বেশি করে। যথা: والذكر والأنثى বা وما خلق الذكر والأنثى।
৭. অন্য সমার্থবোধক শব্দ ব্যবহার করা। যথা: كالعهن المنفوش [القارعة: 5] বা والصوف المنفوش।
আবার সাত প্রকার থেকে أمثال ও اهد، نهى، وعد،وعيد، قصص، حلال، حرام, محكم، متشابه হতে পারে।
ইমাম নাবাবী (রহঃ) বলেছেন, ‘আরবরা বিভিন্ন ভাষার অধিকারী ছিল। তাই তাদের মাঝে إدغام وإظهار وتفخيم وترقيق وإمالة وإشباع ইত্যাদির ক্ষেত্রে উচ্চারণগত পার্থক্য ছিল। তাই আল্লাহ তা‘আলা তাদের পড়ার সহজতার জন্য এই প্রশস্ততা দান করেছেন। প্রথমে কুরআন কুরায়শদের ভাষায় নাযিল করেছেন। এরপর যখন অন্যান্য ‘আরবরা ইসলাম গ্রহণ করল তখন আল্লাহ তা‘আলা তাদের ভাষা অনুযায়ী পড়ার জন্য অনুমতির ব্যবস্থা করেন।
মতানৈক্যের কারণ: ইবনু আবী হাশিম বলেন, সাহাবীগণ কুরআন শুনে বিনা নুকতায় লিখত। তাদের নিকট থেকে বিভিন্ন এলাকার মানুষ গ্রহণ করত। তাদের নিকটে যেরূপ কুরআন থাকত সেটার ব্যতিক্রমটিকে বর্জন করত। এটা ‘উসমান (রাঃ)-এর নির্দেশের কারণে। ফলে কারীদের মাঝে কিরাআতের ভিন্নতা দেখা দেয়।
হাফেয ইবনু হাজার (রহঃ) একটি গ্রহণযোগ্যতা বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশে সর্বসম্মতিক্রমে একটি মাসহাফ লিখিত হয়। কিন্তু তাতে কিছু বর্ণের ভিন্নতা ছিল। এছাড়া যা অন্য কিরাআত আছে সেগুলোকে আল্লাহ মানুষের সুবিধার জন্য সহজভাবে বিভিন্নভাবে পড়ার বৈধতা দান করেন। কিন্তু যখন ‘উসমানের আমলে কোন মানুষ অন্য কারো পঠনকে অস্বীকার করল এবং কাফির বলে অভিহিত করতে শুরু করল তখন ‘উসমান একটি রীতিতে কুরআন সংকলন করলেন অন্যগুলোকে ছেড়ে দিলেন কিন্তু অন্যভাবে পড়ার বৈধতা থাকল। তাই মহান আল্লাহ বললেন, فَاقْرَءُوا مَا تَيَسَّرَ مِنْهُ অর্থাৎ- ‘‘যেভাবে সহজ সেভাবে পড়’’- (সূরা আল মুযযাম্মিল ৭৩ : ২০)।
পরিচ্ছেদঃ ২. প্রথম অনুচ্ছেদ - কিরাআতের ভিন্নতা ও কুরআন সংকলন প্রসঙ্গে
২২১২-[২] ’আবদুল্লাহ ইবনু মাস্’ঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি এক লোককে কুরআন পড়তে শুনলাম। অথচ আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে অন্যভাবে তা পড়তে শুনেছি। আমি তাকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে নিয়ে গেলাম। তাঁকে এ খবর জানালাম। আমি তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চেহারায় বিরক্তির ভাব লক্ষ্য করলাম। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তোমরা দু’জনই শুদ্ধ পড়েছ। এ নিয়ে তোমরা কলহ বিবাদ করো না। তোমাদের আগের লোকেরা কলহ-বিবাদে লিপ্ত হয়ে ধ্বংস হয়ে গিয়েছেন। (বুখারী)[1]
بَابُ اِخْتِلَافِ الْقِرَاءَاتِ وَجَمْعِ الْقُرْاٰنِ
وَعَنِ ابْنِ مَسْعُودٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: سَمِعْتُ رَجُلًا قَرَأَ وَسَمِعْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقْرَأُ خِلَافَهَا فَجِئْتُ بِهِ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَأَخْبَرْتُهُ فَعَرَفْتُ فِي وَجهه الْكَرَاهِيَة فَقَالَ: «كِلَاكُمَا مُحْسِنٌ فَلَا تَخْتَلِفُوا فَإِنَّ مَنْ كَانَ قبلكُمْ اخْتلفُوا فهلكوا» . رَوَاهُ البُخَارِيّ
ব্যাখ্যা: কারী বলেছেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চেহারা অসন্তুষ্টির বা অপছন্দের চিহ্ন দেখা গেছে সাহাবীদের মাঝে আহলে কিতাবের মতভেদের ন্যায় বিতর্ক দেখা যাওয়ার ভয়ে। কারণ সব সাহাবী ন্যায়পরায়ণ। আর তাদের বর্ণনাও সঠিক। ইমাম ত্বীবী (রহঃ) বলেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তারা দু’জনের ঝগড়ার কারণে তার চেহারায় অপছন্দের ছাপ ফুটে উঠেছিল।
কুসত্বুলানী (রহঃ) বলেন, যদি কেউ প্রশ্ন করে যে তাদের দু’জনের ব্যাপারে অসন্তুষ্ট হলেও কিভাবে তাদেরকে محسن বা সঠিক বলে আখ্যায়িত করলেন। তবে উত্তরে বলা যাবে محسن এজন্য বললেন যে, ইবনু মাস্‘ঊদ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শোনার পর আবার সঠিকতা অনুসন্ধান করতে চেয়েছেন এবং সেই ব্যক্তিটি ভালভাবে পড়েছে। আর উভয়ে ঝগড়া করার কারণে অপছন্দ করেছেন। কারণ তাদের উচিত ছিল প্রত্যেকের কিরাআতকে স্বীকৃতি দেয়া এবং এর কারণ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট জানতে চাওয়া।
কারী বলেন, ইবনু মাস্‘ঊদ কুরআনের বিভিন্ন পঠন পদ্ধতির বৈধতা সম্পর্কে অবগত হওয়ার আগেই এই রকম বিতর্কে জড়িয়ে ছিলেন। তিনি বলেন, ইবনু মাস্‘ঊদ লোকটিকে নিয়ে আসার কারণে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অপছন্দ করেন। কেননা তার উচিত ছিল লোকটির ব্যাপারে ভাল ধারণা করা এবং লোকটির কিরাআতের বিষয়ে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট জানতে চাওয়া। অথবা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সামনে যখন ‘উমার এ ধরনের বিষয় নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন তখন তিনি তার ওপর ধৈর্য ধারণ করেছিলেন, কারণ তার রাগ সম্পর্কে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জানা ছিল। কিন্তু ইবনু মাস্‘ঊদ -এর এত রাগ না থাকা সত্ত্বেও ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়ার কারণে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চেহারায় অপছন্দের ছাপ ফুটে উঠেছিল।
ইবনু মালিক বলেন, লোকটির সাথে ইবনু মাস্‘ঊদ-এর মতভেদের কারণে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মুখমন্ডলে অপছন্দের ছাপ দেখা গেছে। কারণ বিভিন্নভাবে কুরআন তিলাওয়াত জায়িয। আর কোন পদ্ধতিতে অস্বীকার করা যেন কুরআনকে অস্বীকার করা। আর এটা না জায়িয।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মাতদেরকে ইখতেলাফ করতে নিষেধ করেছেন। কুসতুলানী (রহঃ) لا تختلفوا এর ব্যাখ্যায় বলেছেন, তোমরা এমন এখতেলাফ করো না যা তোমাদেরকে কুফরী অথবা বিদ্‘আতে নিমজ্জিত করে। যেমন স্বয়ং কুরআন সম্পর্কে মতানৈক্য করা। অথবা যাতে ফিতনার বা সন্দেহের মধ্যে মানুষ পড়ে যায় এমন ইখতেলাফ করা।
পরিচ্ছেদঃ ২. প্রথম অনুচ্ছেদ - কিরাআতের ভিন্নতা ও কুরআন সংকলন প্রসঙ্গে
২২১৩-[৩] উবাই ইবনু কা’ব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি মসজিদে আছি, এমন সময় এক লোক মসজিদে এসে সালাত আদায় করতে শুরু করল। সে এমন পদ্ধতিতে কিরাআত পড়ল যা আমার জানা ছিল না। এরপর আর একজন লোক এলো। সে প্রথম ব্যক্তির কিরাআতের ভিন্ন ধরনে পড়ল। সালাত শেষে আমরা সকলে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট গেলাম। আমি বললাম, হে আল্লাহর রসূল! এ ব্যক্তি সালাতে এভাবে কিরাআত পড়েছে, যা আমার জানা নেই। আবার দ্বিতীয় ব্যক্তি এসে ওর চেয়ে ভিন্নভাবে কিরাআত পড়ল। এসব কথা শুনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে হুকুম দিলেন, আবার কুরআন পড়তে। তারা আবার পড়ল। পড়া শুনে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) উভয়ের পাঠকেই ঠিক বললেন। এ কথা শুনে আমার মনে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি এমন এক সন্দেহের জন্ম দিলো যা জাহিলিয়্যাতের সময়েও আমার মধ্যে ছিল না। সন্দেহের ছায়া আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে লক্ষ্য করে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমার সিনার উপর হাত মারলেন। এতে আমি ঘামে ভিজে গেলাম।
আমি এতই ভীত হলাম, যেন আমি আল্লাহকে দেখছি। এ সময় তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাকে বললেন, হে উবাই! আমার কাছে ওহী পাঠানো হয়েছিল এক রীতিতে কুরআন পাঠের। কিন্তু আমি আল্লাহর নিকট আবেদন করলাম। (হে আল্লাহ!) আপনি আমার উম্মাতের জন্য কুরআন পাঠ পদ্ধতি সহজ করে দিন। আল্লাহ দ্বিতীয়বার বললেন, তবে দু’ রীতিতে কুরআন পড়ো। আমি আবার নিবেদন করলাম, (হে আল্লাহ!) আপনি আমার উম্মাতের জন্য কুরআন পাঠ আরো সহজ করে দিন। তিনি তৃতীয়বার আমাকে বলে দিলেন, তাহলে সাত রীতিতে কুরআন পড়ো। কিন্তু তোমার প্রতিটি নিবেদনের পরিবর্তে আমি তোমাকে যা দিয়েছি এর বাইরেও আরো নিবেদন অধিকার তোমার রইল। তুমি তা চাইতে পারো। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, তখন আমি বললাম, হে আল্লাহ! আপনি আমার উম্মাতকে ক্ষমা করুন। হে আল্লাহ! আপনি আমার উম্মাতকে ক্ষমা করুন। আর তৃতীয় আবেদনটি আমি এমন এক দিনের জন্য পিছিয়ে রাখলাম যেদিন সব সৃষ্টি আমার সুপারিশের দিকে চেয়ে থাকবে। এমনকি ইব্রাহীম (আঃ)-ও। (মুসলিম)[1]
بَابُ اِخْتِلَافِ الْقِرَاءَاتِ وَجَمْعِ الْقُرْاٰنِ
وَعَنْ أُبَيِّ بْنِ كَعْبٍ قَالَ: كُنْتُ فِي الْمَسْجِدِ فَدَخَلَ رَجُلٌ يُصَلِّي فَقَرَأَ قِرَاءَةً أَنْكَرْتُهَا عَلَيْهِ ثُمَّ دَخَلَ آخَرُ فَقَرَأَ قِرَاءَةً سِوَى قِرَاءَةِ صَاحِبِهِ فَلَمَّا قَضَيْنَا الصَّلَاةَ دَخَلْنَا جَمِيعًا عَلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقُلْتُ إِنَّ هَذَا قَرَأَ قِرَاءَةً أَنْكَرْتُهَا عَلَيْهِ وَدخل آخر فَقَرَأَ سوى قِرَاءَة صَاحبه فَأَمَرَهُمَا النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَرَآ فَحَسَّنَ شَأْنَهُمَا فَسَقَطَ فِي نَفْسِي مِنَ التَّكْذِيبِ وَلَا إِذْ كُنْتُ فِي الْجَاهِلِيَّةِ فَلَمَّا رَأَى رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَا قَدْ غَشِيَنِي ضَرَبَ فِي صَدْرِي فَفِضْت عَرَقًا وكأنما أنظر إِلَى الله عز وَجل فَرَقَا فَقَالَ لِي: «يَا أُبَيُّ أُرْسِلَ إِلَيَّ أَن اقْرَأِ الْقُرْآنَ عَلَى حَرْفٍ فَرَدَدْتُ إِلَيْهِ أَنْ هَوِّنْ عَلَى أُمَّتِي فَرَدَّ إِلَيَّ الثَّانِيَةَ اقْرَأْهُ عَلَى حَرْفَيْنِ فَرَدَّدَتْ إِلَيْهِ أَنْ هَوِّنْ عَلَى أُمَّتِي فَرَدَّ إِلَيَّ الثَّالِثَةِ اقْرَأْهُ عَلَى سَبْعَةِ أَحْرُفٍ وَلَكَ بِكُلِّ رَدَّةٍ رَدَدْتُكَهَا مَسْأَلَةٌ تَسْأَلُنِيهَا فَقُلْتُ اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِأُمَّتِي اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِأُمَّتِي وَأَخَّرْتُ الثَّالِثَةَ لِيَوْمٍ يَرْغَبُ إِلَيَّ الْخَلْقُ كُلُّهُمْ حَتَّى إِبْرَاهِيم صلى الله عَلَيْهِ وَسلم» . رَوَاهُ مُسلم
ব্যাখ্যা: রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উভয়ের ভিন্ন ভিন্ন কিরাআতকে শুদ্ধ বলার কারণে উবাই বিন কা‘ব-এর অন্তরে অবিশ্বাস ও খটকার সৃষ্টি হয়েছে। কারণ তার ধারণা ছিল যে, আল্লাহর বাণী একই পদ্ধতিতে পড়তে হবে। প্রত্যেকের ইচ্ছানুযায়ী পড়া ঠিক নয়। আর এজন্য তার মনে ইসলাম গ্রহণের পূর্বের চাইতে বেশি সংশয় তৈরি হয়েছে। কেননা ইসলাম গ্রহণের পূর্বে সে তো রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে অবজ্ঞা প্রদর্শন করত। ফলে তাকে মিথ্যা মনে করা খটকা সৃষ্টি হওয়া অসম্ভব মনে করত না। কিন্তু যখন ইসলাম গ্রহণ করেছে তখন তার প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস তৈরি হয়েছে এবং তাকে চিনতে পেরেছে। এরপর তার সম্পর্কে মনে সন্দেহ সৃষ্টি হওয়া যেন বড় ব্যাপার। তাই তিনি জোর দিয়ে বলেছেন জাহিলী যুগের চাইতে আমার অন্তরে তাকে অস্বীকার করার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
ইমাম ত্বীবী (রহঃ) বলেছেন, উবাই বিন কা‘ব ছিলেন উঁচু স্তরের সাহাবী ও দৃঢ় বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত। আসলে তাদের দু’জনের ভিন্ন কিরাআতকে শুদ্ধ বলায় উবাই-এর অন্তরে শয়তানের কুমন্ত্রণা সৃষ্টি হয়েছে। অতঃপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাতের দ্বারা প্রহারের বারাকাতে তার ভয়-ভীতি ঘামের সাথে বের হয়ে গেল। তিনি দৃঢ় বিশ্বাসী হলেন। এ সময় তিনি যেন শায়ত্বনী কুমন্ত্রণার কারণে লজ্জিত হয়ে ভয়ে আল্লাহর দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তৃতীয় প্রার্থনা পিছিয়ে দিয়েছেন কিয়ামতের দিনে আবেদন করার জন্য। তৃতীয় আবেদনটি হচ্ছে الشفاعة الكبراى (বড় সুপারিশ)। সমস্ত সৃষ্টি জীবের এই সুপারিশের প্রয়োজন রয়েছে। এমনকি ইব্রাহীম (আঃ)-এরও প্রয়োজন আছে। এ উক্তি দ্বারা ইব্রাহীম (আঃ)-এর মর্যাদা অন্যান্য নাবীদের ওপর ও আমাদের নাবীর শ্রেষ্ঠত্ব সকল নাবী-রসূলের ওপর প্রমাণিত হয়।
পরিচ্ছেদঃ ২. প্রথম অনুচ্ছেদ - কিরাআতের ভিন্নতা ও কুরআন সংকলন প্রসঙ্গে
২২১৪-[৪] ’আবদুল্লাহ ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ জিবরীল (আঃ) আমাকে এক রীতিতে কুরআন পড়ালেন। আমি তাকে এর পাঠ রীতির সংখ্যা বৃদ্ধি করে আনতে আল্লাহর নিকট ফেরত পাঠালাম। আল্লাহ আমার জন্য এ রীতি বৃদ্ধি করতে লাগলেন। অতঃপর এ পাঠ সাত রীতিতে গিয়ে পৌঁছল।
বর্ণনাকারী ইবনু শিহাব যুহরী বলেন, বিশ্বস্ত সূত্রে আমার নিকট খবর পৌঁছেছে যে, এ সাত রীতি অর্থের দিক দিয়ে একই। এর দ্বারা হালাল হারামে কোন পার্থক্য পড়েনি। (বুখারী, মুসলিম)[1]
بَابُ اِخْتِلَافِ الْقِرَاءَاتِ وَجَمْعِ الْقُرْاٰنِ
وَعَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قَالَ: إِنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «أَقْرَأَنِي جِبْرِيل على حرف فَرَاجعه فَلم أزل استزيده ويزيدني حَتَّى انْتهى إِلَى سَبْعَةِ أَحْرُفٍ» . قَالَ ابْنُ شِهَابٍ: بَلَغَنِي أَنَّ تِلْكَ السَّبْعَةَ الْأَحْرُفَ إِنَّمَا هِيَ فِي الْأَمْرِ تَكُونُ وَاحِدًا لَا تَخْتَلِفُ فِي حَلَالٍ وَلَا حرَام
ব্যাখ্যা: কুরআন প্রথমত এক পদ্ধতিতে পড়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু পরবর্তীতে উম্মাতের নিকটে সহজসাধ্য করার জন্য রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিবরীল-এর মাধ্যমে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করেন। তাই আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে তাদের সুবিধানুযায়ী পড়ার জন্য প্রশস্ততা দান করেছেন। এক বর্ণনায় রয়েছে যা সুলায়মান বিন সারদ-এর তিনি বর্ণনা করেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, হে উবাই! আমার নিকটে দু’জন মালাক (ফেরেশতা) আসলো তাদের একজন বলল, তুমি এক রীতিতে পড়। অপর মালাক বলল, তাকে এর চাইতে বেশি সুযোগটা দাও। আমি বললাম, আমাকে এর চাইতে বেশি সুযোগ দেয়া হোক। অতঃপর বলল, দুই রীতিতে পড়। এরপর বেশি সহজ করতে বললে একজন মালাক বলল, আপনি সাতভাবে পড়ুন।
বায়হাক্বী (রহঃ) বলেছেন, একটি শব্দ দুই তিন থেকে সাত পদ্ধতিতে পড়া যায় যাতে সজহভাবে বা কষ্ট ছাড়াই পড়া সুবিধা হয়। ইমাম ত্বহাবী (রহঃ)-এর নিকটে সাতভাবে পড়া বলতে হালালকে হারাম বা হারামকে হালাল করা যাবে না। এই পরিবর্তন শুধু শব্দের ভিতরে হবে অর্থে নয়। অর্থাৎ- শব্দের অর্থ ঠিক রেখে রূপ পরিবর্তন করা কুরআন মাজীদে জায়িয।
মাওয়ার্দী স্পষ্টভাবে বলেছেন, যে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিরাআতের ক্ষেত্রে একটি অক্ষরকে অন্য একটি অক্ষরের সাথে পরিবর্তন করার ইঙ্গিত প্রদান করেছেন। আর মুসলিমগণ امثال -এর আয়াতকে أحكام-এর সাথে পরিবর্তন করা হারাম মর্মে ঐকমত্য পোষণ করেছেন।
আহমাদ ও বায়হাক্বী বলেছেন, مثبت-কে منفي এবং حلال-কে হারামে পরিবর্তন করা কুরআনে জায়িয নয়। আল্লাহ তা‘আলার বাণীঃ وَلَوْ كَانَ مِنْ عِنْدِ غَيْرِ اللهِ لَوَجَدُوا فِيهِ اخْتِلَافًا كَثِيرًا ‘‘যদি তা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নিকট হতে আসতো, তবে তাতে তারা অবশ্যই বহু অসঙ্গতি পেত’’- (সূরা আন্ নিসা ৪ : ৮২)। আর এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে হওয়াই এতে সামান্যতম মতভেদ পাওয়া যাবে না।