পরিচ্ছেদঃ ২. প্রথম অনুচ্ছেদ - কিরাআতের ভিন্নতা ও কুরআন সংকলন প্রসঙ্গে
২২১১-[১] ’উমার ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি হিশাম ইবনু হাকীম ইবনু হিযামকে ’সূরা আল ফুরকান’ পাঠ করতে শুনলাম। আমি যেভাবে (কুরআন) পড়ি, তা হতে (তার পড়া) ভিন্ন ধরনের, অথচ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে আমাকে এ সূরা পড়িয়েছেন। তাই আমি এর কারণে ব্যস্ত হতে উদ্যত হলাম। কিন্তু সালাত শেষ করা পর্যন্ত তাকে সুযোগ দিলাম। সালাত শেষ হবার পরই তার চাদর তার গলায় পেঁচিয়ে আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে নিয়ে বললাম, হে আল্লাহর রসূল! আপনি আমাকে যেভাবে ’সূরা আল ফুরকান’ পড়িয়েছেন তার থেকে ভিন্নরূপে আমি হিশামকে ’সূরা আল ফুরকান’ পড়তে শুনলাম।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ’উমারকে বললেন, তাকে ছেড়ে দাও। হিশামকে বললেন, হিশাম! তুমি ’সূরা আল ফুরকান’ পড়ো তো দেখি। হিশাম এ সূরাটি সেভাবেই পড়ল আমি তাকে যেভাবে পড়তে শুনেছি। তার পড়া শুনে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ এভাবেও এ সূরা নাযিল হয়েছে। এরপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাকে বললেন, এখন তুমিও পড়ো দেখি! আমিও সূরাটি পড়লাম। আমার পড়া শুনে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, এ সূরাটি এভাবেও নাযিল হয়েছে। বস্ত্তত এ কুরআন সাত রীতিতে নাযিল করা হয়েছে। তাই তোমাদের যার জন্য যে কিরাআত সহজ হয় সেভাবেই তোমরা পড়বে। (বুখারী, মুসলিম; কিন্তু পাঠ [শব্দ] মুসলিমের)[1]
بَابُ اِخْتِلَافِ الْقِرَاءَاتِ وَجَمْعِ الْقُرْاٰنِ
وَعَنْ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: سَمِعْتُ هِشَامَ بْنَ حَكِيمِ بْنِ حِزَامٍ يقْرَأ سُورَة الْفرْقَان على غير مَا أقرؤوها. وَكَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَقْرَأَنِيهَا فَكِدْتُ أَنْ أَعْجَلَ عَلَيْهِ ثُمَّ أَمْهَلْتُهُ حَتَّى انْصَرَفَ ثُمَّ لَبَّبْتُهُ بِرِدَائِهِ فَجِئْتُ بِهِ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ. فَقلت يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنِّي سَمِعْتُ هَذَا يَقْرَأُ سُورَةَ الْفُرْقَانِ عَلَى غَيْرِ مَا أَقْرَأْتَنِيهَا. فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَرْسِلْهُ اقْرَأ فَقَرَأت الْقِرَاءَةَ الَّتِي سَمِعْتُهُ يَقْرَأُ. فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «هَكَذَا أُنْزِلَتْ» . ثُمَّ قَالَ لي: «اقْرَأ» . فَقَرَأت. فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «هَكَذَا أنزلت إِن الْقُرْآنَ أُنْزِلَ عَلَى سَبْعَةِ أَحْرُفٍ فَاقْرَءُوا مَا تيَسّر مِنْهُ» . مُتَّفق عَلَيْهِ. وَاللَّفْظ لمُسلم
ব্যাখ্যা: কুরআন নাযিল হয়েছে সাত রীতিতে। আবার কোন বর্ণনায় রয়েছে কুরআন তিন পদ্ধতিতে নাযিল হয়েছে।
আবূ শামাহ বলেন, হয়তো কুরআন প্রথমে তিন রীতিতে এবং পরে সাত রীতিতে নাযিল হয়েছে। কেউ বলেছেন, এখান থেকে নির্দিষ্ট সংখ্যা ধর্তব্য নয়। বরং এর দ্বারা সহজতা, প্রশস্ততা, সম্মান ও দয়া উদ্দেশ্য।
‘উলামাগণ سبعة أحرف-এর অর্থ ও ব্যাখ্যা নিয়ে অনেক মতামত ব্যক্ত করেছেন।
‘আল্লামা সুয়ূত্বী (রহঃ) তাঁর اتقان গ্রন্থে বলেন, এ হাদীসের অর্থের ব্যাপারে চল্লিশটি মত রয়েছে, তন্মধ্যে একটি মত হচ্ছে, حرف-এর অর্থ নির্ণয় করা কঠিন। কেননা حرف বলতে সাধারণ বানানো অক্ষর উদ্দেশ্য হতে পারে। আবার শব্দকে বুঝায় অর্থকে ও বুঝায় আবার ‘‘দিক’’ এর অর্থ দিয়ে থাকে। তিনি বলেন, পছন্দনীয় অভিমত হচ্ছে এটা متشابهة-এর অন্তর্ভুক্ত। এর সঠিক ব্যাখ্যা বলা যায় না।
কেউ কেউ সাত হরফ বলতে সাতটি গোত্র উদ্দেশ্য। যেমন- কুরায়শ, হাওয়াযিন, তামীম, হুযায়ল, আযদ, রবী‘আহ্, সা‘দ বিন বাকর ইত্যাদি। ইমাম ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেন, সাত হরফ বলতে সাতটি ধরন উদ্দেশ্য। যদি একটি রীতিতে পড়তে বলা হত তাহলে কারীদের নিকটে কঠিন হতো। তাই যাতে তারা তাদের সহজ ভাষাতে কুরআন তিলাওয়াত করতে পারে সেজন্য এই প্রশস্ততা দান করা হয়েছে।
কেউ কেউ সাতটি গোত্র বা সাতটি ভাষাকে মেনে নিতে চাননি। তারা বলেন, ‘উমার ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) ও হিশাম বিন হাকীম (রাঃ) উভয়েই কুরায়শ বংশের একই গোত্রের একই ভাষার অথচ তাদের পড়ার ধরন দুই ধরনের।
এ ধরনের মতভেদের সমাধানে ইমাম ইবনু হাজার (রহঃ) বলেন, سبعة أحرف এর দ্বারা একই অর্থের বিভিন্ন শব্দ উদ্দেশ্য। যেমন أقبل – هلم - تعالى ইত্যাদি।
ইবনু ‘আবদুল বার (রহঃ) বলেন, অধিকাংশ ‘আলিম এ মতটি গ্রহণ করেছেন। সাত ধরনের শব্দ মানে সাত ধরনের পরিবর্তন; যেমন-
১. হরকতের বিভিন্নতা, যেমন- يُضَارُّ ও يُضَارَّ।
২. فعل গত পরিবর্তন যথা: فعل الأمر -_ بَاعِدْ এবং فعلى الماضى _ بَعُدَ।
৩. নুক্তার পরিবর্তন। যথা: نُنْسَزُهَا ও نُنْسَرُهَا।
৪. নিকটবর্তী মাখরাজের হরফের পরিবর্তন করে। যথা: طلح منضود ও طلع منضود।
৫. تقديم ও تأخير এর পরিবর্তন। যথা: وجاءت سكرة بالموت بالحق কে جاءت سكرة الحق بالموت পড়া।
৬. অক্ষর কম-বেশি করে। যথা: والذكر والأنثى বা وما خلق الذكر والأنثى।
৭. অন্য সমার্থবোধক শব্দ ব্যবহার করা। যথা: كالعهن المنفوش [القارعة: 5] বা والصوف المنفوش।
আবার সাত প্রকার থেকে أمثال ও اهد، نهى، وعد،وعيد، قصص، حلال، حرام, محكم، متشابه হতে পারে।
ইমাম নাবাবী (রহঃ) বলেছেন, ‘আরবরা বিভিন্ন ভাষার অধিকারী ছিল। তাই তাদের মাঝে إدغام وإظهار وتفخيم وترقيق وإمالة وإشباع ইত্যাদির ক্ষেত্রে উচ্চারণগত পার্থক্য ছিল। তাই আল্লাহ তা‘আলা তাদের পড়ার সহজতার জন্য এই প্রশস্ততা দান করেছেন। প্রথমে কুরআন কুরায়শদের ভাষায় নাযিল করেছেন। এরপর যখন অন্যান্য ‘আরবরা ইসলাম গ্রহণ করল তখন আল্লাহ তা‘আলা তাদের ভাষা অনুযায়ী পড়ার জন্য অনুমতির ব্যবস্থা করেন।
মতানৈক্যের কারণ: ইবনু আবী হাশিম বলেন, সাহাবীগণ কুরআন শুনে বিনা নুকতায় লিখত। তাদের নিকট থেকে বিভিন্ন এলাকার মানুষ গ্রহণ করত। তাদের নিকটে যেরূপ কুরআন থাকত সেটার ব্যতিক্রমটিকে বর্জন করত। এটা ‘উসমান (রাঃ)-এর নির্দেশের কারণে। ফলে কারীদের মাঝে কিরাআতের ভিন্নতা দেখা দেয়।
হাফেয ইবনু হাজার (রহঃ) একটি গ্রহণযোগ্যতা বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশে সর্বসম্মতিক্রমে একটি মাসহাফ লিখিত হয়। কিন্তু তাতে কিছু বর্ণের ভিন্নতা ছিল। এছাড়া যা অন্য কিরাআত আছে সেগুলোকে আল্লাহ মানুষের সুবিধার জন্য সহজভাবে বিভিন্নভাবে পড়ার বৈধতা দান করেন। কিন্তু যখন ‘উসমানের আমলে কোন মানুষ অন্য কারো পঠনকে অস্বীকার করল এবং কাফির বলে অভিহিত করতে শুরু করল তখন ‘উসমান একটি রীতিতে কুরআন সংকলন করলেন অন্যগুলোকে ছেড়ে দিলেন কিন্তু অন্যভাবে পড়ার বৈধতা থাকল। তাই মহান আল্লাহ বললেন, فَاقْرَءُوا مَا تَيَسَّرَ مِنْهُ অর্থাৎ- ‘‘যেভাবে সহজ সেভাবে পড়’’- (সূরা আল মুযযাম্মিল ৭৩ : ২০)।