পরিচ্ছেদঃ ৭. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - উত্তম সদাক্বার বর্ণনা
১৯৩৮-[১০] আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, হে আল্লাহর রসূল! কোন্ সদাক্বাহ্ (সাদাকা) বেশী উত্তম? তিনি বললেন, কম সম্পদশালীর বেশী (কষ্টশ্লিষ্ট করে) সদাক্বাহ্ (সাদাকা)। সদাক্বাহ্ (সাদাকা) দেয়া শুরু করবে তাদেরকে দিয়ে যাদের দেখাশুনা তোমার দায়িত্ব। (আবূ দাঊদ)[1]
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ أَيُّ الصَّدَقَةِ أَفْضَلُ؟ قَالَ: «جُهْدُ الْمُقِلِّ وَابْدَأْ بِمَنْ تَعُولُ» . رَوَاهُ أَبُو دَاوُد
ব্যাখ্যা: অত্র হাদীস ও পূর্বোক্ত ‘স্বচ্ছল অবস্থায় দান করা অধিক উত্তম দান’ হাদীসের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করতে গিয়ে বলা যায় দানের ক্ষেত্রে দানকারী, তার ভরসার দৃঢ়তা ও বিশ্বাসের দুর্বলতার ভিত্তিতে ফাযীলাত বিভিন্ন হয়। ইমাম বায়হাক্বী (রহঃ) বলেন, দানকারীর অসচ্ছল অবস্থা, অভাব-অনটনে ধৈর্য ধারণ করা না করা এবং কম সম্পদে তুষ্ট থাকা না থাকার উপর নির্ভর করে। এ অধ্যায়ে বর্ণিত হাদীসসমূহ সে অর্থই প্রমাণ করে। আল্লামা শাওকানী (রহঃ) উপর্যুক্ত দু’ ধরনের হাদীসের মধ্যকার বৈপরীত্য উল্লেখ করে বলেন, বর্তমান হাদীসের সমর্থনে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَيُؤْثِرُوْنَ عَلى أَنْفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ
অর্থাৎ ‘‘আর তারা তাদেরকে নিজেদের ওপর অগ্রাধিকার দেয় নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও।’’ (সূরাহ্ আল হাশর ৫৯ : ৯)
পূর্বোক্ত স্বচ্ছল অবস্থায় দান করার হাদীসের সমর্থনে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَلَا تَجْعَلْ يَدَكَ مَغْلُولَةً إِلى عُنُقِكَ وَلَا تَبْسُطْهَا كُلَّ الْبَسْطِ
অর্থাৎ ‘‘তুমি তোমার হাত তোমার গ্রীবায় আবদি করে রেখ না এবং তা সম্পূর্ণ প্রসারিতও করো না।’’ (সূরাহ্ আল ইসরা/ইসরাঈল ১৭ : ২৯)
এ দু’ হাদীসের মধ্যে সমন্বয়ে বলা যায়, কেউ যদি তার সমস্ত সম্পদ দান করে ফেললে মানুষের কাছে হাত পাততে হবে/ভিক্ষা করে চলতে হবে এমতাবস্থায় তার জন্য স্বচ্ছল অবস্থায় দান করা অধিক উত্তম। আবার কেউ যদি অভাব-অনটনে ধৈর্যধারণ করে তার অতি প্রয়োজনীয় সম্পদ থেকে দান করে তাহলে তা হবে সর্বোত্তম দান।
এমনও হতে পারে যে, স্বচ্ছলতা/ধনাঢ্যতা বলতে অন্তরের ধনাঢ্যতা বুঝানো হয়েছে। যেমনভাবে বুখারী-মুসলিমে আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) বর্ণিত হাদীসে এসেছে- ‘‘ধন-সম্পদের আধিক্যই ধনাঢ্যতা নয়, অন্তরের ধনাঢ্যতাই আসল ধনাঢ্যতা।’’ (স্বচ্ছলতা বলতে অন্তরের ধনাঢ্যতা বুঝালে আর কোন বৈপরীত্য থাকে না।)
পরিচ্ছেদঃ ৭. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - উত্তম সদাক্বার বর্ণনা
১৯৩৯-[১১] সালমান ইবনু ’আমির (রাঃ)হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মিসকীনকে সদাক্বাহ্ (সাদাকা) করা এক প্রকার, আর নিকটাত্মীয়ের কাউকে সদাক্বাহ্ (সাদাকা) দেয়া দু’ প্রকার সাওয়াবের কারণ। এক রকম সাওয়াব নিকটাত্মীয়ের হক আদায় এবং অন্য রকম সাওয়াব সদাক্বাহ্ (সাদাকা) করার জন্য। (আহমাদ, তিরমিযী, নাসায়ী, ইবনু মাজাহ ও দারিমী)[1]
وَعَنْ سَلْمَانَ بْنِ عَامِرٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: الصَّدَقَةُ عَلَى الْمِسْكِينِ صَدَقَةٌ وَهِيَ عَلَى ذِي الرَّحِمِ ثِنْتَانِ: صَدَقَةٌ وَصِلَةٌ . رَوَاهُ أَحْمَدُ وَالتِّرْمِذِيُّ وَالنَّسَائِيُّ وَابْنُ مَاجَهْ وَالدَّارِمِيُّ
ব্যাখ্যা: এখানে ‘সদাক্বাহ্ (সাদাকা)’ বলতে ফরয ও মুস্তাহাব সকল দানকে বুঝাচ্ছে। এ হাদীস দ্বারা আরো প্রমাণ হয় যে, নিকটাত্মীয়দের যাকাত দেয়া সাধারণভাবে বৈধ। আল্লামা শাওকানী বলেন, এ হাদীস দ্বারা প্রমাণ হয় যে, নিকটাত্মীয় হোক সে ভরণ-পোষণ আবশ্যক এমন ব্যক্তিদের মধ্য থেকে কিংবা অন্যদের মধ্য থেকে, তাদেরকে যাকাত দেয়া বৈধ। কারণ অত্র হাদীসে ‘‘সদাক্বাহ্ (সাদাকা)’’ বলতে নির্দিষ্ট করে নফল সদাক্বাহ্ (সাদাকা) বুঝানো হয়নি। তবে ইবনুল মুনযির থেকে ‘সন্তানদেরকে যাকাত দেয়া যাবে না’ মর্মে ইজমা বর্ণিত হয়েছে।
আত্মীয়দের দান করলে দু’টি সাওয়াব। একটি দানের সাওয়াব অপরটি আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করার সাওয়াব। এর দ্বারা মূলত আত্মীয়দেরকে দান করার প্রতি উৎসাহ দেয়া হয়েছে এবং এর প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এ হাদীস দ্বারা আরো প্রমাণ হয়, আত্মীয়দেরকে দান করা সর্বোত্তম। কারণ তাতে দু’টি সাওয়াব। আর এ কথা সুস্পষ্ট ও সন্দেহাতীত যে, একটির থেকে দু’টি উত্তম।
পরিচ্ছেদঃ ৭. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - উত্তম সদাক্বার বর্ণনা
১৯৪০-[১২] আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, (একদিন) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খিদমাতে এক ব্যক্তি এসে বললো, (হে আল্লাহর রসূল!) আমার কাছে একটি দীনার আছে। (এ কথা শুনে) তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ এ দীনারটি তুমি তোমার সন্তানের জন্য খরচ করো। সে বলল, আমার আরো একটি দীনার আছে। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ এটি তুমি তোমার পরিবারের জন্য খরচ করো। লোকটি বলল, আমার আরো একটি দীনার আছে। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ এটা তোমার খাদিমের জন্য খরচ করো। সে বলল, আমার আরো একটি দীনার আছে। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ (এবার) তুমি এ ব্যাপারে বেশী জান (কাকে দেবে)। (আবূ দাঊদ, নাসায়ী)[1]
وَعَن أَي هُرَيْرَةَ قَالَ: جَاءَ رَجُلٌ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ: عِنْدِي دِينَار فَقَالَ: «أَنْفِقْهُ عَلَى نَفْسِكَ» قَالَ: عِنْدِي آخَرُ قَالَ: «أَنْفِقْهُ عَلَى وَلَدِكَ» قَالَ: عِنْدِي آخَرُ قَالَ: «أَنْفِقْهُ عَلَى أَهْلِكَ» قَالَ: عِنْدِي آخَرُ قَالَ: «أَنْفِقْهُ عَلَى خَادِمِكَ» . قَالَ: عِنْدِي آخَرُ قَالَ: «أَنْت أعلم» . رَوَاهُ أَبُو دَاوُد وَالنَّسَائِيّ
ব্যাখ্যা: নিজের ওপর খরচ করার অর্থ হলো ঐ অর্থ দ্বারা নিজের প্রয়োজন পূরণ করো। সন্তানের উপর খরচ করার আদেশ দ্বারা প্রমাণ হয় যে, অস্বচ্ছল সন্তানের প্রয়োজনে খরচ করা পিতার জন্য আবশ্যক। যদি সে সন্তান ছোট হয় তাহলে তো তার ওপর খরচ করা সর্বসম্মতভাবে পিতার জন্য আবশ্যক। আর যদি সন্তান বড় (প্রাপ্তবয়স্ক/উপার্জনক্ষম) হয় তাহলে তার ওপর খরচ করা পিতার জন্য আবশ্যক দায়িত্ব কি-না তা নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে।
ত্বীবী বলেন, স্ত্রীর পূর্বে সন্তানের কথা বলা হয়েছে এজন্য যে, ভরণ-পোষণ প্রাপ্তির প্রয়োজনের দিক থেকে স্ত্রীর থেকে সন্তান বেশি অগ্রগণ্য। কারণ স্ত্রীকে যদি স্বামী ত্বলাক্বও দেয় তাহলেও স্ত্রী অন্য কারো সাথে বিবাহিত হতে পারবে। (সন্তানের এরূপ কোন বিকল্প নেই)
ভরণ-পোষণ প্রদানের ক্ষেত্রে কে অগ্রাধিকার পাবে? স্ত্রী না সন্তান? এ ব্যাপারে বর্ণনার ভিন্নতা রয়েছে। ইমাম শাফি‘ঈ, আবূ দাঊদ ও হাকিম (রহঃ)-এর বর্ণনা মতে সন্তানকে স্ত্রীর ওপর অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। অপরদিকে ইমাম আহমাদ, নাসায়ী, ইবনু হিব্বান (রহঃ)-এর বর্ণনার স্ত্রীকে সন্তানের ওপর অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে।
ইবনু হাযম বলেন, ইয়াহইয়া আল্ কাত্তান ও আস্ সাওরীর বর্ণনায় বৈপরীত্য রয়েছে। ইয়াহ্ইয়ার বর্ণনায় স্ত্রীকে সন্তানের ওপর অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। আর সাওরীর বর্ণনায় সন্তানকে স্ত্রীর ওপর অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে যেহেতু দু’ ধরনের বর্ণনাই রয়েছে সেহেতু কোন একটি অগ্রাধিকার না দিয়ে দু’টোকেই সমান্তরালে রাখা উচিত। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এ কথা বিশুদ্ধ সানাদে প্রমাণিত যে, ‘‘তিনি যখন (গুরুত্বপূর্ণ) কথা বলতেন তখন তা তিনবার বলতেন’’। হতে পারে এ ক্ষেত্রেও রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার সন্তানকে আরেকবার স্ত্রীকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন।
লেখক বলেন, সহীহ মুসলিমে জাবির (রাঃ) থেকে যে হাদীস বর্ণিত হয়েছে তাতে দেখা যায়, কোন রকম দ্বিধা ছাড়াই সন্তানের ওপর স্ত্রীকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। এ বর্ণনা পূর্বোক্ত বর্ণনা দু’টোর যে কোনটির উপর অগ্রাধিকার পাবে।
অত্র হাদীসের সর্বশেষে ‘‘তুমি অধিক জানো’’ দ্বারা বুঝাচ্ছে যে, তোমার আত্মীয়, প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথীদের মধ্য থেকে তোমার দান পাওয়ার কে বেশি হকদারে সে সম্পর্কে তুমিই অধিক জানো।
পরিচ্ছেদঃ ৭. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - উত্তম সদাক্বার বর্ণনা
১৯৪১-[১৩] ’আবদুল্লাহ ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমি কি তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম মানুষ কে তা বলব না? সে হলো ঐ ব্যক্তি, যে আল্লাহর পথে ঘোড়ার লাগাম ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি কি তোমাদেরকে ঐ ব্যক্তির মর্যাদার কাছাকাছি লোকের কথা জানাব? ওই ব্যক্তি সেই যে তার কিছু বকরী নিয়ে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে আল্লাহর হক আদায় করতে থাকে। আমি কী তোমাদেরকে খারাপ লোক সম্পর্কে জানাব? সে ঐ ব্যক্তি যার কাছে আল্লাহর কসম দিয়ে দিয়ে চাওয়া হয়। কিন্তু সে তাকে কিছুই দেয় না। (তিরমিযী, নাসায়ী, দারিমী)[1]
وَعَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «أَلَا أُخْبِرُكُمْ بِخَيْرِ النَّاسِ؟ رَجُلٌ مُمْسِكٌ بِعِنَانِ فَرَسِهِ فِي سَبِيلِ اللَّهِ. أَلَا أُخْبِرُكُمْ بِالَّذِي يَتْلُوهُ؟ رَجُلٌ مُعْتَزِلٌ فِي غُنَيْمَةٍ لَهُ يُؤَدِّي حَقَّ اللَّهِ فِيهَا. أَلَا أُخْبِرُكُمْ بِشَرِّ النَّاسِ
رَجُلٌ يُسْأَلُ بِاللَّهِ وَلَا يُعْطِي بِهِ» . رَوَاهُ التِّرْمِذِيُّ وَالنَّسَائِيُّ وَالدَّارِمِيّ
ব্যাখ্যা: মু‘তাযিল (مُعْتَزِلٌ) ‘‘পৃথক ব্যক্তি’’ বলতে লোকালয় থেকে দূরে কোন খোলা প্রান্তর কিংবা মরুভূমিতে বসবাসরত ব্যক্তিকে বুঝাচ্ছে। সেখানে সে আল্লাহর হক আদায় করে। মালিক-এর বর্ণনায় রয়েছে, সে সেথায় সালাত (সালাত/নামায/নামাজ) আদায় করে, যাকাত প্রদান করে, এক আল্লাহর ‘ইবাদাত করে এবং তাঁর সাথে কাউকে অংশীদার স্থাপন করে না। আল-বাজী বলেন, এ ব্যক্তির অবস্থান মুজাহিদের অবস্থানের পরেই। কারণ এ ব্যক্তি ফরয ‘ইবাদাতসমূহ আদায় করে, ‘ইবাদাতের ক্ষেত্রে আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ হয় এবং সকল রকম রিয়া (লোক দেখানো ‘আমল) ও সুম্‘আহ্ (লোক শুনানো ‘আমল) থেকে দূরে থাকে। যেহেতু সে গোপনে, লোকচক্ষুর আড়ালে ‘ইবাদাত করে সেহেতু তার কোন প্রসিদ্ধি হয় না। আর ঐ ব্যক্তি কাউকে কষ্টও দেয় না। তার কথা কেউ বেশি স্মরণও করে না। তবুও তার মর্যাদা মুজাহিদের মর্যাদার সমপর্যায়ে নয়। কারণ মুজাহিদ সকল মুসলিমের পক্ষ থেকে প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং কাফিরদের সাথে জিহাদ করে যতক্ষণ না তারা ইসলামে প্রবেশ করে। এতে করে তার কর্মফলের উপকারিতা অন্যদের মাঝেও পৌঁছে অপরদিকে লোকালয় থেকে পৃথক ব্যক্তির কর্মফল থেকে অন্যরা সুফল ভোগ করতে পারে না।
সহীহুল বুখারীতে আবূ সা‘ঈদ আল খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীসে দেখা যায়, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করা হয়, হে আল্লাহর রসূল! সর্বোত্তম ব্যক্তি কে? রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ঐ মু’মিন ব্যক্তি, যে তার জান ও সম্পদ নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করে। সাহাবীগণ আবার জিজ্ঞেস করলেন, তারপর (সর্বোত্তম ব্যক্তি) কে? উত্তরে তিনি বলেন, ঐ মু’মিন, যে জনপদের মধ্য থেকে কোন জনপদে অবস্থান করে আল্লাহর ব্যাপারে তাক্বওয়া অবলম্বন করে এবং জনগণ তার থেকে কোন ক্ষতির সম্মুখীন হয় না।
আলোচ্য হাদীস দ্বারা জনবিচ্ছিন্ন ও একাকী থাকার ফাযীলাত প্রমাণিত হয়। কারণ এ ব্যক্তি গীবত, অযথা কথা বা এ জাতীয় খারাপ বিষয়াবলী থেকে মুক্ত থাকে।
কিন্তু জমহূর (অধিকাংশ) ‘আলিমগণ মনে করেন, এ ফাযীলাত ঐ ব্যক্তি তখন পাবেন যখন ফিত্নাহ্ (ফিতনা) ছড়িয়ে পড়বে। এ প্রসঙ্গে আত্ তিরমিযীতে মারফূ' সানাদে হাদীস বর্ণিত হয়েছে। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘যে মু’মিন ব্যক্তি জনগণের সাথে মেলামেশা করে এবং তাদের দেয়া কষ্টে ধৈর্যধারণ করে সে ব্যক্তি ঐ ব্যক্তি হতে বেশি সাওয়াব পাবেন যে মু’মিন ব্যক্তি মানুষের সাথে মেলামেশা করে না এবং মানুষের দেয়া কষ্টে ধৈর্যধারণ করে না।’’
ইমাম শাফি‘ঈসহ অধিকাংশ ‘আলিম-এর মতে ফিতনাহ থেকে নিরাপদ থাকার আশা করার শর্তে জনপদে মানুষের সাথে মিলেমিশে থাকা সর্বোত্তম। সংসারত্যাগীদের কিছু দলের মতে নির্জনবাস সর্বোত্তম। তারা এ হাদীস দ্বারাই তাদের মতের স্বপক্ষে দলীল পেশ করে। জমহূর ‘আলিমগণ সন্ন্যাসীদের মতের জবাবে বলেন, ফিতনাহ্ ও যুদ্ধের সময় নির্জনবাস বিধেয় এবং তখন বৈধ যখন মানুষ নিরাপদবোধ করে না কিংবা মানুষের নির্যাতনে ধৈর্যধারণ করতে পারে না। নাবীগণ, অধিকাংশ সাহাবী, তাবিঈ, ‘আলিম, জাহিদ, জুমু‘আহ্, জামা‘আত, জানাযা, রোগীর সেবায়, যিকিরের (জিকিরের) বৈঠকে ও অন্যান্য ক্ষেত্রে উপস্থিত হয়ে জনগণের সাথে মেলামেশায় উপকারিতা লাভ করেছেন।
পরিচ্ছেদঃ ৭. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - উত্তম সদাক্বার বর্ণনা
১৯৪২-[১৪] উম্মু বুজায়দ (রাঃ)হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ সাহায্যপ্রার্থীকে কিছু দিয়ে বিদায় করবে। যদি তা আগুনে ঝলসানো একটি খুরও হয়। (মালিক, নাসায়ী, তিরমিযী এবং আবূ দাঊদ এ হাদীসের সমার্থবোধক বর্ণনা করেছেন)[1]
وَعَن أم بحيد قَالَتْ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «رُدُّوا السَّائِلَ وَلَوْ بِظِلْفٍ مُحْرَقٍ» . رَوَاهُ مَالِكٌ وَالنَّسَائِيُّ وَرَوَى التِّرْمِذِيُّ وَأَبُو دَاوُدَ مَعْنَاهُُُُُُُ
ব্যাখ্যা: হাদীসটির মর্মার্থ হলো, তোমরা ভিক্ষুককে বঞ্চিত করো না। অর্থাৎ একেবারে খালি হাতে ফেরত দিও না। বরং একটি পোড়া খুর (পশুর পায়েরর নিম্নের খুর) হলে তাকে দাও। অর্থাৎ তুমি তোমার নিকট যা সহজ হয় তাই দাও, সেটা পরিমাণে কম হোক না কেন।
পরিচ্ছেদঃ ৭. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - উত্তম সদাক্বার বর্ণনা
১৯৪৩-[১৫] ’আবদুল্লাহ ইবনু ’উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আল্লাহর কসম দিয়ে তোমার কাছে আশ্রয় চায়, তাকে আশ্রয় দেবে। যে তোমার কাছে আল্লাহর কসম দিয়ে চায়, তাকে কিছু দিবে। আর যে ব্যক্তি তোমাকে দা’ওয়াত দেয় তার দা’ওয়াত কবূল করবে। যে তোমার ওপর ইহসান করে, তাকে বিনিময় দিবে। যদি বিনিময় আদায়ের মতো কিছু না থাকে, তার জন্য দু’আ করো যতদিন পর্যন্ত তুমি না বুঝো যে, তার ইহসানের বিনিময় আদায় হয়েছে। (আহমাদ, আবূ দাঊদ, নাসায়ী)[1]
وَعَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَنِ اسْتَعَاذَ مِنْكُمْ بِاللَّهِ فَأَعِيذُوهُ وَمَنْ سَأَلَ بِاللَّهِ فَأَعْطُوهُ وَمَنْ دَعَاكُمْ فَأَجِيبُوهُ وَمَنْ صَنَعَ إِلَيْكُمْ مَعْرُوفًا فَكَافِئُوهُ فَإِنْ لَمْ تَجِدُوا مَا تُكَافِئُوهُ فَادْعُوا لَهُ حَتَّى تُرَوْا أَنْ قَدْ كَافَأْتُمُوهُ» . رَوَاهُ أَحْمَدُ وَأَبُو دَاوُد وَالنَّسَائِيّ
ব্যাখ্যা: যখন কোন ব্যক্তি আল্লাহর নামে তোমাদের বা অন্য কারো অনিষ্ট/ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য আহবান করে যেমন, কেউ যদি এমন বলে যে, হে অমুক! আল্লাহর নামে তোমার নিকট চাইছি যে, তুমি আমাকে অমুকের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করো। তাহলে তোমরা আল্লাহর নামের সম্মানে তার আহবানে সাড়া দিও এবং তাকে রক্ষা করো। কেউ যদি আল্লাহর নামে কিছু চায় তাহলেও আল্লাহর নামের সম্মানে এবং আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি দয়া করে হলেও তোমরা তাকে কিছু দিও। কেউ যদি তোমাদেরকে দা‘ওয়াত দেয় তাহলে সে দা‘ওয়াত কবূল করবে। বিশেষ করে সেটি যদি ওয়ালীমার দা‘ওয়াত হয় তাহলে সে দা‘ওয়াত কবূল করা ওয়াজিব। অন্য কিছুর দা‘ওয়াত হলে তা কবূল করা মুস্তাহাব। কারো মতে দা‘ওয়াত কবূল করতে যদি কোন শার‘ঈ বাধা না থাকে তাহলে সকল দা‘ওয়াত কবূল করা ওয়াজিব।
আর যদি কেউ কথা বা কাজের মাধ্যমে তোমাদের প্রতি ইহসান/উপকার করে তাহলে তোমরাও ঐ উপকারের সমপরিমাণ অথবা তার থেকেও উত্তম প্রতিদান তাদেরকে দিবে। তোমরা যদি সম্পদ দ্বারা প্রতিদান দিতে না পারো তাহলে উপকারীর জন্য দু‘আ করবে। অর্থাৎ দু‘আ দ্বারা প্রতিদান দিবে। যাতে তোমরা জানতে পারো যে, তোমরা প্রতিদান দিয়েছ। অর্থাৎ তোমরা বারবার দু‘আ করবে এবং তাদের প্রতিদান দেয়ার জন্য তোমরা ততক্ষণ সর্বাত্মক চেষ্টা করবে যতক্ষণ তোমরা জানতে পারবে যে, তোমরা তার হক আদায় করেছ।
‘উসামাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীসে জানা যায় যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কারো প্রতি যদি কোন উপকার করা হয় তাহলে উপকার ভোগকারী ব্যক্তি যেন উপকারীকে (جَزَاكَ الله خَيْرًا) ‘‘আল্লাহ তোমাকে উত্তম প্রতিদান প্রদান করুন’’। সে যদি এটা বলে তাহলে এটিই হবে সর্বোচ্চ কৃতজ্ঞতা- (আত্ তিরমিযী)। এ হাদীস প্রমাণ করে যে, কেউ যদি উপকারী ব্যক্তিকে একবার (جَزَاكَ الله خَيْرًا) বলেন, তাহলে সে উপকারীর প্রতিদান প্রদান করল যদিও তার হক আরো বেশি থাকে না কেন।
পরিচ্ছেদঃ ৭. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - উত্তম সদাক্বার বর্ণনা
১৯৪৪-[১৬] জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহর জাতের দোহাই দিয়ে জান্নাত ছাড়া অন্য কিছু চেয়ো না। (আবূ দাঊদ)[1]
وَعَنْ جَابِرٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَا يُسْأَلُ بِوَجْهِ اللَّهِ إِلَّا الْجنَّة» . رَوَاهُ أَبُو دَاوُد
ব্যাখ্যা: ‘‘আল্লাহর নামে জান্নাত ব্যতীত কিছু চাওয়া যায় না’’ এর অর্থ হলো- জান্নাত মানুষের নিকট চাওয়া যায় না। এ বিষয়টির দু’টি দিক রয়েছে, (এক) আল্লাহর নামে মানুষের নিকট কিছু চাওয়া যাবে না। (দুই) আল্লাহর নিকট দুনিয়ার কোন তুচ্ছ জিনিস চাওয়া উচিত না। তার নিকট তার নামে শুধু জান্নাতই চাওয়া উচিত। মূলত এখানে আল্লাহর নিকট বেশি বেশি জান্নাত চাওয়ার প্রতি উৎসাহ দেয়া উদ্দেশ্য। ইমাম ত্বীবী বলেন, তোমরা আল্লাহর নামে মানুষের নিকট কিছু প্রার্থনা করো না। যেমন- কেউ যেন এ কথা না বলে যে, আমাকে আল্লাহর নামে বা আল্লাহর ওয়াস্তে কিছু দাও। কারণ আল্লাহর নাম সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ, যে নাম দ্বারা পৃথিবীর ভোগ্য তুচ্ছ বিষয়াবলী চাওয়া তার নামের মর্যাদার জন্য হানিকর। (উল্লেখ্য যে, জান্নাতের তুলনায় পৃথিবীর সকল কিছুই তুচ্ছ ও নগণ্য।) তাই তোমরা আল্লাহর নামে জান্নাত চাও। আল্লামা মুল্লা ‘আলী ক্বারী বলেন, আল্লাহর নামে জান্নাত ব্যতীত কিছু চাওয়া উচিত নয়। তাই কেউ যখন জান্নাত চাইবে তখন সে এ দু‘আ বলবে, (اَللّهُمَّ إِنَّا نَسْأَلُكَ بِوَجْهِكَ الْكَرِيْمِ أَنْ تُدْخِلَنَا جَنَّةَ النَّعِيْمِ)
(উল্লেখ্য যে, আল্লাহর নামে কেউ যদি কোন মানুষের কাছে কিছু চায় তাহলে তার উচিত তাকে তা দেয়া। কারণ এখানে আল্লাহর নামের মর্যাদা জড়িত। এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে যে, আল্লাহর নামে মানুষের কাছে চাইতে এখানে নিষেধ করা হয়েছে। আল্লাহর নিকট চাইতে নিষেধ করা হয়নি, এমনকি অন্য হাদীসে জুতোর ফিতা হারিয়ে গেলেও তা আল্লাহর নিকট চাওয়ার কথা বর্ণিত হয়েছে। তাই সকল কিছুই আল্লাহর নিকট চাইতে হবে তবে আল্লাহর নামে জান্নাত ব্যতীত কিছু চাওয়া উচিত নয়। -অনুবাদক)