নিঃসন্দেহে ক্বদ্বা ও ক্বদর সাব্যস্ত করা এবং এতোদুভয়ের প্রতি বিশ্বাস করা ও তার অন্তর্ভুক্ত যাবতীয় বিষয়ের প্রতি ঈমান আনয়ন করা ঈমানের বিরাট একটি রুকন। জিবরীল আলাইহিস সালাম যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ঈমান সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন, তখন তিনি জবাব দিয়েছেন যে,
(أَنْ تُؤْمِنَ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَتُؤْمِنَ بِالْقَدَرِ خَيْرِهِ وَشَرِّهِ)
‘‘তুমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করবে (১) আল্লাহ পাকের উপর (২) তার ফেরেস্তাদের উপর (৩) তার কিতাবসমূহের উপর (৪) তার রসূলদের উপর (৫) আখেরাত বা শেষ দিবসের উপর এবং (৬) তাক্বদীরের ভাল-মন্দের উপর’’।[2]
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿إِنَّا كُلَّ شَيْءٍ خَلَقْنَاهُ بِقَدَرٍ﴾‘‘আমি প্রত্যেক জিনিসকে একটি পরিমাপ অনুযায়ী সৃষ্টি করেছি’’।[3] (সূরা কামার: ৪৯)
القدر শব্দটি قدرت الشيئ إذا أحطت بمقداره এর মাসদার। অর্থাৎ আমি জিনিসটির পরিমাণ-পরিমাপ নির্ধারণ করলাম। এ কথা আপনি তখনই বলে থাকেন, যখন উক্ত জিনিসের পরিমান-পরিমাপ সম্পর্কে আপনার পূর্ণ জ্ঞান থাকে।
এখানে القدر দ্বারা সৃষ্টিজগৎ অস্তিত্ব লাভ করার পূর্বেই সে সম্পর্কে আদিতে আল্লাহ তা‘আলার পরিপূর্ণ ইলম থাকা উদ্দেশ্য। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা অবগতি, নির্ধারণ ও ইচ্ছা ব্যতীত কোনো কিছুই সৃষ্টি হয় না। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মাযহাব হলো তাক্বদীরের ভালো-মন্দ ও মিষ্ট-তিক্ততার প্রতি ঈমান আনয়ন করাকে الإيمان بالقدر বলা হয়। তাক্বদীরের প্রতি ঈমান আনয়নের চারটি স্তর রয়েছে। যথা:
প্রথম স্তর: প্রত্যেক জিনিস অস্তিত্ব লাভ করার পূর্বেই আদিতে সে সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলার ইল্মের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। অর্থাৎ তিনি সকল বস্তুকে স্বীয় জ্ঞানের মাধ্যমে পরিবেষ্টন করে আছেন, -এ কথার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। আসমান ও যমীনে সরিষার দানা পরিমাণ বস্তুও তার জ্ঞানের বাইরে নয়। সৃষ্টি করার পূর্ব হতেই তিনি সকল বস্তু সম্পর্কে অবগত আছেন। তাদের রিযিক, বয়স, কথা, কাজ, চলাচল, অবস্থান, গোপন-প্রকাশ্য, তাদের মধ্যে কে জান্নাতী এবং কে জাহান্নামী তাও তিনি জানেন। বান্দাগণ আমল করার পূর্বেই তিনি তাদের আমলসমূহ সম্পর্কে অবগত থাকা এর অন্তর্ভুক্ত।
দ্বিতীয় স্তর: দ্বিতীয় স্তর হলো প্রথম স্তরে বর্ণিত সকল বিষয় আল্লাহ তা‘আলা লাওহে মাহফুযে লিখে দিয়েছেন। অর্থাৎ এ কথার উপর ঈমান আনয়ন করা এবং বিশ্বাস স্থাপন করা যে, আল্লাহ তা‘আলা ঐ সমুদয় বস্তুই লিখে রেখেছেন, যা হবে বলে তার জ্ঞানের আওতায় ছিল। লাওহে মাহ্ফুয ও কলমের প্রতি ঈমান আনয়নও উপরোক্ত বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত।
তৃতীয় স্তর: প্রত্যেক সৃষ্টির প্রতি আল্লাহ তা‘আলা ইচ্ছা এবং তার উপর তার পরিপূর্ণ ক্ষমতার প্রতি ঈমান আনয়ন করা।[4]
চতুর্থ স্তর: এ বিশ্বাস করা যে, আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক জিনিষের সৃষ্টিকর্তা। আরো বিশ্বাস করা যে, তিনিই একমাত্র সৃষ্টিকর্তা। তিনি ছাড়া বাকি সবকিছুই সৃষ্টি।[5]
[1]. আল্লামা শাইখ মুহাম্মাদ ইবনে সালেহ আল-উছাইমীন রহিমাহুল্লাহ বলেন, القضاء ও القدر এর মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে কি না, এ ব্যাপারে আলেমগণ মতভেদ করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, أزل বা আদিতে আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক সবকিছু নির্ধারণ করে রাখাকে কদর বলা হয়। আর যথাসময়ে তা সৃষ্টির ফায়ছালাকে ক্বদ্বা বলা হয়। আল্লাহ যখন নির্দিষ্ট কোনো জিনিস অমুক সময় হবে বলে নির্ধারণ করেন, তখন তাকে কদর বলা হয়। আর যখন ঐ জিনিসটি সৃষ্টি করার নির্দিষ্ট সময় এসে উপস্থিত হয়, তখন তার ফায়ছালা করা এবং অস্তিত্বে নিয়ে আসাকে ক্বদ্বা বলা হয়। কুরআনুল কারীমে এর অনেক উদাহরণ রয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَقُضِيَ الْأَمْرُ ‘‘তখন সবকিছুর ফায়ছালা হয়ে যাবে’’। (সূরা আল-বাকারা: ২১০) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,﴾ وَاللَّهُ يَقْضِي بِالْحَقِّ ﴿ ‘‘আল্লাহ সঠিকভাবে ফায়ছালা করেন’’। (সূরা গাফের: ২০) এ রকম আয়াত আরো রয়েছে। সুতরাং কদর হলো আদিতেই আল্লাহর নির্ধারণের নাম। আর ক্বদ্বা হলো সংঘটিত হওয়ার সময় সে সম্পর্কে ফায়ছালা করার নাম।
কেউ কেউ বলেছেন, ক্বদ্বা ও কদরের অর্থ একই। তবে প্রাধান্যপ্রাপ্ত কথা হলো, উভয় শব্দকে একসঙ্গে উল্লেখ করা হলে উভয়ের মধ্যে পার্থক্য হবে। আর যদি উভয়টিকে আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়, তাহলে উভয়টি দ্বারা একই অর্থ বুঝতে হবে। ঈষৎ পরিবর্তনসহ শাইখের কথা এখানেই শেষ।
কেউ কেউ বলেছেন, ভবিষ্যতে সৃষ্টিসমূহের যা কিছু হবে সে সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলার অবগতিকে কদর বলা হয়। আর আল্লাহ তা‘আলার ইলম ও ইচ্ছা অনুযায়ী সবকিছু সৃষ্টি করাকে ক্বদ্বা বলা হয়। (আল্লাহ তা‘আলাই সর্বাধিক অবগত)
[2]. সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: কিতাবুল ঈমান।
[3]. অর্থাৎ দুনিয়ার প্রত্যেক বস্তুরই একটি পরিমাণ আছে। সে অনুসারে প্রত্যেক বস্তু একটি নির্দিষ্ট সময় অস্তিত্ব লাভ করে, একটি বিশেষ রূপ ও আকৃতি গ্রহণ করে। একটি বিশেষ সীমা পর্যন্ত ক্রমবিকাশ লাভ করে, একটি নির্দিষ্ট সময়কাল পর্যন্ত টিকে থাকে এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ে তার পরিসমাপ্তি ঘটে। স্বভাবগত নিয়ম-নীতি অনুসারে এ দুনিয়ারও একটি 'তাকদীর' বা পরিমাণ আছে। সে অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তা চলছে এবং একটি নির্দিষ্ট সময়েই তার চলার পরিসমাপ্তি ঘটবে। এর পরিসমাপ্তির জন্য যে সময় নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে তার এক মুহূর্ত পূর্বে এর পরিসমাপ্তি ঘটবে না কিংবা এক মুহূর্ত পরে তা অবশিষ্টও থাকবে না। এ পৃথিবী অনাদি ও চিরস্থায়ী নয় যে, চিরদিনই তা আছে এবং চিরদিন থাকবে। কিংবা কোনো শিশুর খেলনাও নয় যে, যখনই তোমরা চাইবে তখনই তিনি এটিকে ধ্বংস করে দেখিয়ে দিবেন। (আল্লাহ তা‘আলাই সর্বাধিক অবগত)
[4]. তিনি যা করার ইচ্ছা করেন, তা অবশ্যই বাস্তবায়িত হয়। যা কিছু সৃষ্টি হয়েছে এবং যা সৃষ্টি হবে, সে ক্ষেত্রে আল্লাহর ইচ্ছা ও ক্ষমতা এ দু’টির একটি অন্যটির জন্য আবশ্যক। আর যা সৃষ্টি হয়নি এবং যা সৃষ্টি হবেনা, সে ক্ষেত্রে আল্লাহর ইচ্ছা ও ক্ষমতা -এ দু’টির একটির জন্য অন্যটি জরুরী নয়। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা যা করতে চেয়েছেন তাঁর কুদরতের মাধ্যমে তা অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে। আর যা তিনি করতে ইচ্ছা করেন নি, তা বাস্তবায়িত হয়নি। তিনি ইচ্ছা করেন নি, এ জন্যই বাস্তবায়িত হয় নি; এ জন্যে নয় যে, তিনি সেটি করতে সক্ষম নন। এ ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَا كَانَ اللَّهُ لِيُعْجِزَهُ مِنْ شَيْءٍ فِي السَّمَوَاتِ وَلاَ فِي الأَرْضِ إِنَّهُ كَانَ عَلِيمًا قَدِيرًا﴾
‘‘আল্লাহ এমন নন যে, আকাশমন্ডলী এবং পৃথিবীর কোনো কিছু তাকে অক্ষম করতে পারে। তিনি সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান’’। (সূরা ফাতির: ৪৪)
[5]. আসমান-যমীন এবং এতোদুভয়ের মধ্যবর্তী স্থানের ছোট-বড় সকল বস্তুরই সৃষ্টিকর্তা তিনি। এ সমস্ত সৃষ্টির চলাচল এবং অবস্থানও তিনি সৃষ্টি করেছেন। তিনি পবিত্র। তিনি ছাড়া কোন সৃষ্টিকর্তা নেই। তিনিই একমাত্র প্রতিপালক।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿أَلَمْ تَعْلَمْ أَنَّ اللَّهَ يَعْلَمُ مَا فِي السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ إِنَّ ذَٰلِكَ فِي كِتَابٍ إِنَّ ذَٰلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرٌ﴾
‘‘তুমি কি জানো না, আকাশ ও পৃথিবীর প্রত্যেক জিনিসই আল্লাহ জানেন? সবকিছু একটি কিতাবে লিখিত আছে। আল্লাহর জন্য এটা মোটেই কঠিন নয়’’। (সূরা হজ্জ: ৭০)
তৃতীয় স্তরের দলীল হলো আল্লাহ তা‘আলার বাণী, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَا تَشَاءُونَ إلاَّ أَنْ يَشَاءَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِيْنَ﴾
‘‘সৃষ্টিজগত সমূহের মহান প্রভু আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতিরেকে তোমরা অন্য কোনো কিছুরই ইচ্ছা পোষণ করতে পারো না’’। (সূরা তাকভীর: ৩০) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,
﴿إِنَّ اللَّهَ يَفْعَلُ مَا يُرِيدُ﴾
‘‘আর আল্লাহ ইচ্ছা করলে তারা পরস্পর যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত হতো না; কিন্তু আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তাই সম্পন্ন করে থাকেন’’। (সূরা আল-হজ: ২৫৩)
তাক্বদীরের চতুর্থ স্তরের দলীল হলো, আল্লাহ তা‘আলার বাণী,
﴿اللَّهُ خَالِقُ كُلِّ شَيْءٍ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ وَكِيلٌ﴾
‘‘আল্লাহ সবকিছুর স্রষ্টা এবং তিনিই সবকিছুর ব্যবস্থাপক’’। (সূরা যুমার: ৬২) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,وَهُوَ الْخَلَّاقُ الْعَلِيمُ ‘‘আর তিনি মহাস্রষ্টা, সর্বজ্ঞ’’। (সূরা ইয়াসীন: ৮২)
(১) সমস্ত সৃষ্টির প্রত্যেক বিষয়কে একসঙ্গে একত্রিতকারী ব্যাপক তাক্বদীর: এ প্রকার তাক্বদীর লাওহে মাহফুযে লিপিবদ্ধ আছে। কিয়ামত পর্যন্ত প্রত্যেক জিনিসের তাক্বদীর লাওহে মাহফুযে লিপিবদ্ধ রয়েছে। ইমাম আবু দাউদ স্বীয় সুনান গ্রন্থে উবাদাহ ইবনে সামিত রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেন, আমি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন,
(إِنَّ أَوَّلَ مَا خَلَقَ اللَّهُ الْقَلَمَ فَقَالَ: لَهُ اكْتُبْ قَالَ: رَبِّ وَمَاذَا أَكْتُبُ قَالَ: اكْتُبْ مَقَادِيرَ كُلِّ شَيْءٍ حَتَّى تَقُومَ السَّاعَةُ)
‘‘আল্লাহ তা‘আলা কলম সৃষ্টি করে সর্বপ্রথম তাকে বললেন, লিখো। কলম বললো, হে আমার প্রভু! কী লিখবো? আল্লাহ বললেন, কিয়ামত পর্যন্ত প্রত্যেক জিনিষের তাক্বদীর লিখো’’।[1] এ প্রকার তাক্বদীর সমস্ত সৃষ্টির জন্য।
(২) সমস্ত সৃষ্টির প্রত্যেক বিষয়কে একত্রিতকারী তাক্বদীর: ইহা কয়েক শ্রেণীতে বিভক্ত।
(ক) التقدير العمري তাক্বদীরে উমুরী বা সারা জীবনের তাক্বদীর: যেমন আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদের হাদীছে এসেছে, মায়ের পেটে থাকা অবস্থাতেই শিশুর উপর যে চারটি বাক্য লিখে দেয়া হয়, তাই হচ্ছে তাক্বদীরে উমুরী। লিখে দেয়া হয় তার রিযিক, তার বয়স, তার আমল এবং তার হতভাগ্য হওয়া কিংবা সৌভাগ্যবান হওয়ার কথা।
(খ) التقدير الحولي তাক্বদীরে হাওলী বা সারা বছরের তাক্বদীর: লাইলাতুল কদরে বাৎসরিক তাক্বদীর লিখিত হয়। তাতে সারা বছরের সকল বিষয় ও ঘটনা একসাথে লেখা হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿إِنَّا أَنزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنذِرِينَ فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ أَمْرًا مِنْ عِنْدِنَا إِنَّا كُنَّا مُرْسِلِينَ﴾
‘‘আমি একে নাযিল করেছি এক বরকতময় রাতে। নিশ্চয় আমি সতর্ককারী। এ রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয়ের ফায়ছালা করা হয় আমার আদেশক্রমে। আমিই প্রেরণকারী’’। (সূরা দুখান: ৩-৫)
(গ) التقدير اليومي তাক্বদীরে ইয়াওমী বা দৈনন্দিন তাক্বদীর: হায়াত, মওত, সম্মান, অপমান ইত্যাদি আরো যা প্রতিদিন নির্ধারণ করা হয়, তাই দৈনন্দিন তাক্বদীর। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴾ ﴿كُلَّ يَوْمٍ هُوَ فِي شَأْنٍ‘‘তিনি প্রতিদিন কোনো না কোনো মহান কার্যে রত আছেন’’। (সূরা আর্-রাহমান: ২৯)
আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, আল্লাহর সৃষ্টিসমূহের মধ্য হতে অন্যতম একটি সৃষ্টি হচ্ছে লাওহে মাহ্ফুয। সাদা মুক্তা দিয়ে তিনি এটি তৈরি করেছেন। তার উভয় পার্শ্ব তৈরি করা হয়েছে লাল রঙের হিরা দিয়ে। কলমটি হচ্ছে নূরের তৈরী, কালিও নূরের। সেটার প্রশস্ততা হচ্ছে আসমান-যমীনের মধ্যকার প্রশস্ততার সমান। আল্লাহ তা‘আলা তাতে দৈনিক তিনশ ষাটবার দৃষ্টি দেন। প্রত্যেকবার দৃষ্টি দেয়ার সময় কাউকে জীবিত রাখেন, কারো মৃত্যু ঘটান, কাউকে সম্মানিত করেন, কাউকে অপমানিত করেন এবং তিনি যা চান তাই করেন।
এটিই হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার এই বাণী, ﴾ ﴿كُلَّ يَوْمٍ هُوَ فِي شَأْنٍ ‘‘তিনি প্রতিদিন কোনো না কোনো মহান কাজে রত আছেন’’, এর মর্মার্থ। (সূরা আর্-রাহমান: ২৯) ইমাম আব্দুর রায্যাক, ইবনুল মুনযির, তাবারানী এবং হাকেম এই হাদীছ বর্ণনা করেছেন।
প্রত্যেক মুসলিমের উপর সমস্ত সৃষ্টির প্রত্যেক বিষয়কে একসঙ্গে একত্রিতকারী তাক্বদীর এবং তার সমস্ত বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা ওয়াজিব। এগুলো থেকে যে ব্যক্তি কোনো কিছুকে অস্বীকার করবে, সে তাক্বদীরের প্রতি ঈমান আনয়নকারী বলে গণ্য হবে না। সে ঈমানের একটি রুকন অস্বীকারকারী হিসাবে গণ্য হবে। যেমন পথভ্রষ্ট কাদারীয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা তাক্বদীর অস্বীকার করে থাকে। তাক্বদীর অস্বীকার করার ক্ষেত্রে তারা দু’টি শ্রেণীতে বিভক্ত।
তাদের মধ্যে এক শ্রেণীর লোক তাক্বদীর অস্বীকার করার ক্ষেত্রে অত্যাধিক সীমালংঘন করেছে। এমনকি তারা সৃষ্টিজগতের বিষয়গুলো সংঘটিত হওয়া ও অস্তিত্ব লাভ করার পূর্বে সে সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলার জ্ঞান থাকার কথাও অস্বীকার করেছে। সেই সঙ্গে সৃষ্টির সবকিছু লাওহে মাহফুযে লিখে রাখাও অস্বীকার করেছে। তারা বলে থাকে, আল্লাহ তা‘আলা আদেশ-নিষেধ করেছেন। তিনি জানেন না, কে এগুলো মানবে আর কে তা মানবে না। তাদের মতে আল্লাহর ইলমের সাথে এমন কিছু যুক্ত হয়, যা পূর্বে তার ইলম ও তাক্বদীরের মধ্যে ছিল না। সম্ভবত কাদারীয়া সম্প্রদায়ের এই শ্রেণীর লোক বিলুপ্ত হয়ে গেছে কিংবা বিলুপ্ত হওয়ার দ্বারপ্রামেত্ম পৌঁছে গেছে।
কাদারীয়া সম্প্রদায়ের যে ফির্কা এখনো বাকি আছে তারা আল্লাহ তা‘আলার ইলমকে স্বীকার করে। কিন্তু তারা বান্দার কাজ-কর্ম তাক্বদীরের অন্তর্ভুক্ত হওয়াকে অস্বীকার করে। তারা মনে করে বান্দারা নিজেরাই তাদের কাজ-কর্ম স্বতন্ত্রভাবে সৃষ্টি করে। আল্লাহ তা‘আলা তা সৃষ্টি করেন না এবং সেটা সৃষ্টি করার ইচ্ছাও পোষণ করেন না। এটিই হলো মু‘তাযিলাদের মাযহাব। তাক্বদীর সাব্যস্ত করতে গিয়ে কাদারীয়াদের সম্পূর্ণ বিপরীত একটি সম্প্রদায় মারাত্মক বাড়াবাড়ি করেছে। এমনকি তারা বান্দার কাজ করার ক্ষমতা ও স্বাধীনতাকে নাকোচ করেছে। তাদের কথা হলো বান্দার কাজে সে বাধ্য। এ জন্যই এ সম্প্রদায়কে জাবরীয়া বলা হয়।[2]
অনেক দলীল-প্রমাণ দ্বারা উভয় মাযহাবই বাতিল সাব্যস্ত হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿لِمَنْ شَاءَ مِنْكُمْ أَنْ يَسْتَقِيمَ (28) وَمَا تَشَاءُونَ إِلَّا أَنْ يَشَاءَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ﴾
‘‘তোমাদের মধ্যে যে সরলপথে চলতে চায় তার জন্য এ কুরআন উপদেশ স্বরূপ। আর বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে তোমরা কোনো ইচ্ছা করতে পারো না’’। (সূরা তাকভীর: ২৮-২৯)
আল্লাহ তা‘আলার বাণী, ‘‘তোমাদের মধ্যে যে সরলপথে চলতে চায়’’ এর দ্বারা জাবরীয়াদের প্রতিবাদ করা হয়েছে। কেননা এখানে আল্লাহ তা‘আলা বান্দার জন্য ইচ্ছা সাব্যস্ত করেছেন। কিন্তু জাবরীয়ারা বলে যে, বান্দা তার কাজে বাধ্য। কাজ করা বা না করায় তাদের কোনো স্বাধীনতা ও ইচ্ছা নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আর বিশ্বজাহনের প্রতিপালক আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে তোমরা কোনোই ইচ্ছা করতে পারো না’’। এখানে কাদারীয়াদের প্রতিবাদ করা হয়েছে। তারা বলে থাকে আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছার উপর নির্ভর করা ব্যতীতই বান্দা কাজ করার স্বতন্ত্র ইচ্ছা রাখে। এটি একটি বাতিল কথা। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বান্দার ইচ্ছাকে স্বীয় ইচ্ছার সাথে যুক্ত করে দিয়েছেন।
এটিই হলো ক্বদ্বা ও ক্বদরের ব্যাপারে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মাযহাব। তারা তাক্বদীর অস্বীকারকারী কাদারিয়া (মু‘তাযিলা) সম্প্রদায়ের ন্যায় শৈথিল্য প্রদর্শন ও ঢিলামি করেনি এবং জাবরীয়াদের ন্যায় তাক্বদীর সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করেনি।
উম্মতের সালাফ ও ইমামদের মাযহাব হলো, তারা বলে সকল প্রকার সৎ কাজ, পাপাচার, কুফুরী ও ফিতনা-ফাসাদ আল্লাহর ফায়ছালা ও নির্ধারণ অনুযায়ীই হয়ে থাকে। তাদের বিশ্বাস হলো, আল্লাহ ব্যতীত আর কোনো স্রষ্টা নেই। তাই তিনি বান্দা ও তাদের সমস্ত কর্মেরও স্রষ্টা। তারা ভালো-মন্দ, উৎকৃষ্ট-নিকৃষ্ট যা কিছু করে তারও স্রষ্টা। তবে বান্দা তার কাজে সম্পূর্ণরূপে বাধ্য নয়; বরং সে কাজ করার ক্ষমতা রাখে, ইচ্ছা রাখে এবং তা সম্পন্নকারীও বটে। শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া রহিমাহুল্লাহ বলেন, সমস্ত কাজ-কর্ম, আনুগত্য ও পাপাচার বান্দার দ্বারা হয়ে থাকে। অর্থাৎ বান্দার দ্বারা তা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তার ইচ্ছা ও ক্ষমতা দ্বারা অর্জিত হয়। বান্দার কাজ-কর্ম দ্বারা তাকে বিশেষিত করা হয়, বান্দাই তা চালু করে এবং এগুলোর হুকুম-আহকাম তার দিকেই প্রত্যাবর্তন করে।
আর বান্দার কাজ-কর্মগুলো আল্লাহর পক্ষ থেকে হয় এ অর্থে যে, বান্দার মধ্যে তিনি তা সৃষ্টি করেছেন, বান্দার কাজ হিসাবে তাকে নির্ধারণ করেছেন এবং তার উপার্জন হিসাবে স্থির করেছেন। যেমন তিনি সমস্ত উপায়-উপকরণ ও কাজ-কর্ম এবং তার ফলাফল সৃষ্টি করছেন। সুতরাং আল্লাহর পক্ষ হতে বান্দার কাজ-কর্ম হয় মানে তিনি তার স্রষ্টা। আর বান্দার পক্ষ হতে তা হয় মানে বান্দার শক্তি দ্বারা যেহেতু তা সম্পন্ন ও অর্জিত হয়, তাই তার কাজকে তার সাথে প্রতিষ্ঠিত বিশেষণ হিসাবে গণ্য করা হয়। যেমন আমরা বলে থাকি, এ ফলটি অমুক গাছের, এ ফসল অমুক যমীন থেকে। এসব কথার অর্থ হলো, এগুলো অমুক গাছ ও অমুক যমীন থেকে উৎপন্ন হয়েছে। অনুরূপ এগুলো আল্লাহর পক্ষ হতেও। এ কথার অর্থ হলো, তিনি এগুলো সৃষ্টি করেছেন। উভয় কথার মধ্যে কোনো বৈপরীত্য নেই। ইমাম সাফারায়েনী রহিমাহুল্লাহ বলেন, আহলুস সালাফ ও আহলুস সুন্নাতের গবেষক আলেমদের মতে আল্লাহ তা‘আলা বান্দার ক্ষমতা, ইচ্ছা ও কাজ-কর্ম সৃষ্টি করেন। বান্দা প্রকৃত পক্ষেই তার কাজ-কর্ম সম্পাদনকারী এবং সে তা উদ্ভাবনকারী। আল্লাহ তা‘আলা তাকে তার কর্ম সম্পাদনকারী ও উদ্ভাবনকারী বানিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَا تَشَاءُونَ إِلَّا أَنْ يَشَاءَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ﴾
‘‘আর বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে তোমরা কোনো ইচ্ছা করতে পারো না’’। (সূরা তাকভীর: ২৮-২৯)
আল্লাহ তা‘আলা এখানে বান্দার ইচ্ছা সাব্যস্ত করেছেন এবং সংবাদ দিয়েছেন যে, বান্দার ইচ্ছা আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছা ব্যতীত কার্যকর হয় না। কাজ-কর্ম সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে বান্দার ইচ্ছা সাব্যস্ত করার ব্যাপারে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের এটি সুস্পষ্ট বক্তব্য। আর তা আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত হতেই পারে না। ইমাম সাফারায়েনীর বক্তব্য এখানেই শেষ।
[1]. তিরমিযী, অধ্যায়: আবওয়াবুল কাদ্র। তিরমিযী বলেন: হাদীছটি হাসান গরীব। তবে ইমাম আলবানী (রহি.) সহীহ বলেছেন। দেখুন সিলসিলা ছহীহা: (১/৩০৭) আল্লাহর আরশ পানির উপরে থাকার অর্থ হলো সপ্তম আকাশের উপরে রয়েছে পানি। আর সেই পানির উপর আল্লাহর আরশ। এখনো আরশ স্বীয় অবস্থানেই রয়েছে।
[2]. কাদারীয়াদের মতে বান্দার কাজ বান্দা নিজেই সৃষ্টি করে; তাতে আল্লাহর কোনো ইচ্ছা নেই। সে হিসেবে তারা আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছাকে দুইভাগে তথা ইরাদায়ে কাওনীয়া (সৃষ্টিগত ইচ্ছা) এবং ইরাদায়ে শরঈয়া (শরীয়াতের আদেশগত ইচ্ছা) এই দুইভাগে বিভক্ত করাকে সমর্থন করে না। তারা বলে থাকে আল্লাহ তা‘আলা শুধু সকল মানুষ থেকে ঈমান আনয়নেরই ইচ্ছা করেছেন এবং আদেশ দিয়েছেন। কিন্তু বান্দা ঈমানের পরিবর্তে যেই কুফরী ও পাপাচারে লিপ্ত হয়, বান্দা নিজেই সৃষ্টি করে; আল্লাহ তা‘আলা নন। জাবরীয়াদের মাযহাব এর সম্পূর্ণ বিপরীত। তারা বলে, বান্দা কিছুই করে না। ভালো-মন্দ সবকিছু আল্লাহ তা‘আলাই বান্দাকে দিয়ে করে থাকেন। এমনকি বান্দার কোনো ইচ্ছা ও স্বাধীনতা নেই। উভয় দলের কথাই কুরআন, সুন্নাহ এবং বিবেক-বুদ্ধির দলীল দ্বারা প্রত্যাখ্যাত।
ক্বদ্বা ও ক্বদরের প্রতি ঈমান আনয়নের বিরাট ফলাফল রয়েছে। এর মাধ্যমেই ঈমানের বাকিসব রুকন সহকারে মানুষের ঈমান পরিপূর্ণ হয়। ক্বদ্বা ও ক্বদরের প্রতি ঈমান আনয়ন করা ঈমানের ছয়টি রুকনের অন্তর্ভুক্ত। ক্বদ্বা ও ক্বদর বা তাক্বদীরের প্রতি ঈমান আনয়ন না করলে কারো ঈমান সঠিক হবে না। আল্লাহর কিতাব ও রসূলের সুন্নাতের বিবরণ অনুযায়ী ক্বদ্বা ও ক্বদরের প্রতি বিশ্বাস না করলে কেউ ঈমানদার হতে পারবে না।
তাক্বদীরের প্রতি ঈমান আনয়নের মাধ্যমেই মানুষের অন্তর প্রশান্তি লাভ করে, প্রফুলস্ন হয় এবং পার্থিব জীবনের বিপদাপদ ও কষ্টের সম্মুখীন হলে অস্থির-উদ্বিগ্ন হয় না। কেননা বান্দা যখন বিশ্বাস করবে, যে মুছীবতে সে আক্রান্ত হয় তা আল্লাহর পক্ষ হতে নির্ধারিত, তা হবেই, তা প্রতিহত করার ক্ষমতা কেউ রাখে না এবং রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ বাণী উপলব্ধি করবে যেখানে তিনি বলেছেন,
«واعْلَمَ أَنَّ مَا أَصَابَكَ لَمْ يَكُنْ لِيُخْطِئَكَ وَمَا أَخْطَأَكَ لَمْ يَكُنْ لِيُصِيبَكَ»
‘‘হে বৎস! তুমি এ কথা বিশ্বাস করবে যে, তোমার জীবনে যা ঘটেছে তা ঘটারই ছিল। আর যা ঘটেনি তা কোনো দিন ঘটার ছিল না’’।
এ বিশ্বাস করার মাধ্যমেই অন্তরে স্থিরতা অর্জিত হয় এবং হৃদয় প্রশান্তি লাভ করে। যারা ক্বদ্বা (ফায়ছালা) ও ক্বদরে (ভাগ্যে) বিশ্বাস করে না, তারা এর বিপরীত। তারা বিপদাপদ ও মুছীবতে আক্রান্ত হয়ে উদ্বিগ্ন ও দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় তারা অস্থির হয়ে যায়। ফলে তার জীবন যাপন বিরক্তিকর ও অসহনীয় হয়ে উঠে। এমনকি স্বাভাবিক জীবন-যাপন করা তাদের কাছে ভারি হয়ে যায় বলে তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য আত্ম-হত্যা করার চেষ্টা করে। পার্থিব জীবনের কঠিন বাস্তবতা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য এবং ভবিষ্যৎ জীবনকে অন্ধকারাচ্ছন্ন মনে করে যারা আত্মহত্যা করে তাদের মধ্যে এটিই লক্ষণীয়। কারণ তারা তাক্বদীরের প্রতি ঈমান আনয়ন করে না। ফলে তারা তাদের খারাপ আকিদার অপরিহার্য ফলাফল হিসাবেই আত্মহত্যার মত অন্যায় কাজের প্রতি অগ্রসর হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿مَا أَصَابَ مِن مُّصِيبَةٍ فِى الأَرْضِ وَلاَ فِى أَنْفُسِكُمْ إلاَّ فِى كِتَابٍ مِّن قَبْلِ أَن نَّبْرَأَهَا إنَّ ذَلِكَ عَلَى اللهِ يَسِيرٌ لِّكَيْلاَ تَأْسَوْاْ عَلَى مَا فَاتَكُمْ وَلاَ تَفْرَحُواْ بِمَا آتَاكُمْ وَاللهُ لاَ يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ﴾
‘‘পৃথিবীতে এবং তোমাদের উপর যে বিপদ আসে তা সৃষ্টি করার পূর্বেই একটি কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে। নিশ্চয়ই এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ। যাতে তোমরা যা হারাও তার জন্য দুঃখিত না হও এবং তিনি তোমাদেরকে যা দিয়েছেন তার জন্য উল্লাসিত না হও। আল্লাহ কোন উদ্ব্যত অহংকারীকে পছন্দ করেন না’’। (সূরা আল হাদীদ: ২২-২৩)
আল্লাহ তা‘আলা এখানে সংবাদ দিয়েছেন যে, যমীনে এবং মানুষের শরীরের যেসব মুছীবত হয়, তা তিনি আগেই নির্ধারণ করে রেখেছেন। সুতরাং সেটা নির্ধারিত ও লিপিবদ্ধ আছে। আমরা সেটা প্রতিরোধ করার যতই চেষ্টা করি না কেন, তা সংঘটিত হবেই। অতঃপর তিনি আমাদেরকে সেটা অবগত করার হিকমত হলো, যাতে আমরা প্রশান্তি লাভ করি, অধৈর্য না হই, মুছীবতে পড়ে আফসোস না করি এবং সুখ-শান্তি, আরাম-আয়েশ, ধন-সম্পদ ইত্যাদির নিয়ামত লাভ করে এত আনন্দিত না হই, যা আমাদেরকে শেষ পরিণামের কথা ভুলিয়ে দেয়। বরং মুছীবতের সময় আমাদের সবর করা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ না হওয়া আবশ্যক। সেই সঙ্গে সুখ-সমৃদ্ধির সময় আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা আবশ্যক এবং তার পাকড়াও থেকে যেন নিজেদেরকে সম্পূর্ণ নিরাপদ না মনে করা জরুরী। মোটকথা উভয় অবস্থাতেই আমরা আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক রাখবো।
ইকরিমা রহিমাহুল্লাহ বলেছেন, প্রত্যেকেই আনন্দিত ও দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়। তোমরা আনন্দের সময় আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো এবং দুঃখের সময় সবর করো।
এ থেকে বুঝার সুযোগ নেই যে, বান্দা অকল্যাণ থেকে বাঁচার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করে এবং কল্যাণকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করে ক্বদ্বা ও ক্বদরের উপর ভরসা করে হাত গুটিয়ে বসে থাকবে। যেমন কিছু অজ্ঞ লোক ধারণা করে থাকে। এটি মারাত্মক বোকামি। বরং আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে উপায়-উপকরণ অবলম্বন করার হুকুম করেছেন এবং অলসতা ও উপায়-উপকরণের প্রতি অবহেলা করতে নিষেধ করেছেন। উপায়-উপকরণ অবলম্বন করার পরও যদি উদ্দেশ্যের বিপরীত ফলাফল অর্জিত হয় তাহলে আমাদের করণীয় হলো, আমরা অধৈর্য-অস্থির হবো না। বিশ্বাস করবো এটিই নির্ধারিত ফায়ছালা। এ ছাড়া অন্য কিছু নির্ধারিত থাকলে তা অবশ্যই হতো।
সহীহ মুসলিমে আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত হয়েছে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
«الْمُؤْمِنُ الْقَوِىُّ خَيْرٌ وَأَحَبُّ إِلَى اللَّهِ مِنَ الْمُؤْمِنِ الضَّعِيفِ وَفِى كُلٍّ خَيْرٌ احْرِصْ عَلَى مَا يَنْفَعُكَ وَاسْتَعِنْ بِاللَّهِ وَلاَ تَعْجِزْ وَإِنْ أَصَابَكَ شَىْءٌ فَلاَ تَقُلْ لَوْ أَنِّى فَعَلْتُ كَانَ كَذَا وَكَذَا. وَلَكِنْ قُلْ قَدَرُ اللَّهِ وَمَا شَاءَ فَعَلَ فَإِنَّ لَوْ تَفْتَحُ عَمَلَ الشَّيْطَانِ»
‘‘শক্তিশালী মুমিন আল্লাহর নিকট দুর্বল মুমিনের চেয়ে উত্তম ও প্রিয়। তবে প্রত্যেকের মধ্যেই কল্যাণ রয়েছে। যে জিনিস তোমার উপকার করবে, তা অর্জন করার জন্য আগ্রহী হও এবং আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাও। আর এ রকম যেন না হয় যে, তাক্বদীরের উপর ভরসা করে হাত গুটিয়ে অপারগ-অক্ষম হয়ে বসে থাকবে। কল্যাণকর ও উপকারী জিনিস অর্জনে সর্বোচ্চ চেষ্টা করার পরও যদি তোমার উপর কোনো বিপদ এসে পড়ে, তবে কখনও এ কথা বলোনা, আমি যদি এ রকম করতাম, তাহলে অবশ্যই এমন হতো; বরং তুমি বলো, আল্লাহ যা তাক্বদীরে রেখেছেন এবং তিনি যা ইচ্ছা করেছেন তাই হয়েছে। কেননা যদি কথাটি শয়তানের জন্য কুমন্ত্রণার পথ খুলে দেয়’’।[1]
তাক্বদীরের উপর ঈমান রাখা, কল্যাণ অর্জন করতে এবং অকল্যাণ বিদূরিত করতে উপায়-উপকরণ অবলম্বন করার সাথে সাথে বান্দা নিজ কাজ-কর্মের হিসাব নিজেই নিবে এবং ভুল-ত্রুটি সংশোধন করবে। বিশ্বাস করবে যে, তার নিজের গুনাহর কারণেই বিপদাপদ ও মুছীবত আসে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَا أَصَابَكُم مِّن مُّصِيبَةٍ فَبِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيكُمْ وَيَعْفُو عَن كَثِيرٍ﴾
‘‘তোমাদের উপর যে মুছীবতই এসেছে তা তোমাদের কৃতকর্মের কারণে এসেছে। বহু সংখ্যক অপরাধকে তো আল্লাহ ক্ষমা করে থাকেন’’ (সূরা শূরা: ৩০)
ক্বদ্বা ও ক্বদরের প্রতি ঈমানের অন্যতম সুফল হলো এর মাধ্যমেই বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতি ও সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার সময় সুদৃঢ় থাকা যায় এবং পার্থিব জীবনের দুঃখ-কষ্টকে এমন অবিচল হৃদয় ও দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে গ্রহণ করা যায়, যাকে কঠিন বিপদাপদ নড়াতে পারে না এবং প্রচ- ঝড়-তুফানেও সে অনড় থাকে। কেননা সে জানে যে, এ পার্থিব জগত হলো পরীক্ষাগার ও পরিবর্তনশীল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿الَّذِي خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيَاةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا وَهُوَ الْعَزِيزُ الْغَفُورُ﴾
‘‘তিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন, তোমাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য, কে তোমাদের মধ্যে আমলের দিক দিয়ে সর্বোত্তম। আর তিনি পরাক্রমশালী ও ক্ষমাশীল’’। (সূরা মূলক: ২) আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ حَتَّى نَعْلَمَ المُجَاهِدِينَ مِنُكُمْ وَالصَّابِرِينَ وَنَبْلُوَ أَخْبَارَكُمْ﴾
‘‘আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করবো যে পর্যন্ত না জানতে পারি তোমাদের জেহাদকারীদেরকে, সবরকারীদেরকে এবং যতক্ষণ না আমি তোমাদের অবস্থানসমূহ যাচাই করি’’। (সূরা মুহাম্মাদ: ৩১)
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তার সাহাবীগণ কতই না কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন এবং তারা কতনা কঠিন বিপদাপদের সম্মুখীন হয়েছেন! কিন্তু তারা সত্য খাঁটি ঈমান ও অবিচল প্রত্যয়ের মাধ্যমে এগুলোর মোকাবেলা করেছেন। ফলে তারা সমুজ্জল সফলতা লাভ করতে সক্ষম হয়েছেন। ক্বদ্বা ও ক্বদরের প্রতি সুগভীর-সুদৃঢ় বিশ্বাসের কারণেই তাদের দ্বারা সম্পূর্ণ প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবেলা করে উজ্জল সাফল্য লাভ করা সম্ভব হয়েছিল। সে সঙ্গে তারা আল্লাহ তা‘আলার এই বাণী পুরোপুরি উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿قُل لَّن يُصِيبَنَا إِلَّا مَا كَتَبَ اللَّهُ لَنَا هُوَ مَوْلَانَا وَعَلَى اللَّهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُونَ﴾
‘‘তাদের বলো, আল্লাহ আমাদের জন্য যা লিখে দিয়েছেন, তা ছাড়া আর কোনো কিছুই আমাদের হয় না। আল্লাহই আমাদের অভিভাবক এবং ঈমানদারদের তার উপরই ভরসা করা উচিত’’। (সূরা আত তাওবা: ৫১)
ক্বদ্বা (ফায়ছালা) ও ক্বদরের (ভাগ্যের) প্রতি ঈমান আনয়নের আরেকটি সুফল হলো এটি মানুষের দুঃখ-কষ্টকে অনুদানে রূপান্তরিত করে দেয় এবং মুছীবতকে বিনিময়ে পরিণত করে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿مَا أَصَابَ مِنْ مُصِيبَةٍ إِلا بِإِذْنِ اللَّهِ وَمَنْ يُؤْمِنْ بِاللَّهِ يَهْدِ قَلْبَهُ وَاللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ﴾
‘‘আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত কোনো বিপদ আসে না এবং যে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস করে, তিনি তার অন্তরকে সৎ পথ প্রদর্শন করেন। আল্লাহ সর্ববিষয়ে সম্যক পরিজ্ঞাত। (সূরা তাগাবুন: ১১)
আলকামা রহিমাহুল্লাহ বলেন, এখানে ঐ ব্যক্তির কথা বলা হয়েছে, যে মুছীবতে আক্রান্ত হয়ে বিশ্বাস করে যে, তা আল্লাহর পক্ষ হতে। অতঃপর সে তাকে আল্লাহর ফায়ছালা বলে মনে করে সন্তুষ্ট থাকে ও মেনে নেয়।
উপরোক্ত আয়াতে কারীমার অর্থ হলো, মুছীবতে আক্রান্ত হয়ে কেউ যদি বিশ্বাস করে, এটি আল্লাহর পক্ষ হতে নির্ধারিত। অতঃপর সবর করে, ছাওয়াব প্রত্যাশা করে এবং আল্লাহর ফায়ছালা মেনে নেয়, আল্লাহ তা‘আলা তার অন্তরকে সঠিক পথে পরিচালনা করেন এবং দুনিয়ার যে নিয়ামত ছুটে যায়, তার বিনিময়ে তাকে অন্তরের হিদায়াত ও সত্য ঈমান দান করেন। তার থেকে যা কিছু ছিনিয়ে নেয়া হয় তার বদলে কখনো কখনো আল্লাহ তা‘আলা অনুরূপ কিছু দান করেন অথবা তারচেয়ে উত্তম কিছু দান করেন। আল্লাহ তা‘আলার ফায়ছালা ও নির্ধারণ অনুযায়ী যেসব বালা-মুছীবত আসে সে ক্ষেত্রে বান্দার কোনো হাত থাকে না। তবে বান্দা যেন নিজে এটি আসার কারণে পরিণত না হয়। যেমন সে আল্লাহর কোনো আদেশ বাস্তবায়নে ত্রুটি করলো কিংবা তার কোনো নিষেধ থেকে দূরে থাকার ক্ষেত্রে ত্রুটি-বিচ্যুতি করলো। সুতরাং এ ক্ষেত্রে বান্দার উচিত সে আল্লাহ তা‘আলার ফায়ছালা ও নির্ধারণের প্রতি ঈমান আনয়ন করবে এবং তার যে ভুলের কারণে মুছীবতটি এসেছে, তা সংশোধন করে নিবে।
কতিপয় মানুষ ক্বদ্বা (ফায়ছালা) ও ক্বদরের (ভাগ্যের) দলীল দিয়ে যখন পাপাচারে লিপ্ত হয় কিংবা ওয়াজিব কাজ ছেড়ে দেয় তখন তারা এতে মারাত্মক ভুল করে। তারা বলে এটি আমাদের উপর নির্ধারিত। এই বলে তারা পাপাচারে লিপ্ত হয় এবং গুনাহ থেকে তাওবা করে না। যেমন মুশরিকরা বলেছিল,
﴿لَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا أَشْرَكْنَا وَلَا آبَاؤُنَا وَلَا حَرَّمْنَا مِنْ شَيْءٍ كَذَلِكَ كَذَّبَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ حَتَّى ذَاقُوا بَأْسَنَا قُلْ هَلْ عِنْدَكُمْ مِنْ عِلْمٍ فَتُخْرِجُوهُ لَنَا إِنْ تَتَّبِعُونَ إِلَّا الظَّنَّ وَإِنْ أَنْتُمْ إِلَّا تَخْرُصُونَ﴾
‘‘আল্লাহ যদি ইচ্ছা করতেন, তাহলে আমরা এবং আমাদের বাপ-দাদারা শিরক করতাম না এবং কোনো কিছুই হারাম করতাম না। এভাবেই তাদের পূর্ববর্তীগণও মিথ্যা মনে করেছিল। অবশেষে তারা আমার শাস্তি ভোগ করেছিল। বলো, তোমাদের নিকট কোনো ইলম আছে কি? থাকলে তা আমাদের নিকট পেশ করো। তোমরা কেবল ধারণা অনুসরণ করে থাকো এবং তোমরা শুধু অনুমান ভিত্তিক কথাই বলে থাকো’’। (সূরা আল আন‘আম ১৪৮)।
ক্বদ্বা ও ক্বদর সম্পর্কে এটি ছিল তাদের খুব নিকৃষ্ট বুঝ। কেননা তাক্বদীর দ্বারা দলীল পেশ করে বিপদাপদ ও পাপাচারের দিকে এগিয়ে যাওয়া বৈধ নয়। তবে মুছীবত এসে গেলে তাক্বদীর দ্বারা দলীল পেশ করা যাবে। পাপাচার করে ক্বদ্বা ও ক্বদর দিয়ে দলীল দেয়া খুব নিকৃষ্ট কাজ। এতে করে তাওবার পথ বন্ধ হয়ে যায় এবং আদিষ্ট সৎ আমল বর্জন করা হয়। কিন্তু মুছীবত এসে যাওয়ার সেটার মাধ্যমে দলীল গ্রহণ করা ভালো। কেননা তখন ক্বদ্বা ও ক্বদরের দ্বারা দলীল গ্রহণ মুছীবতগ্রস্থকে সবর ও ছাওয়াবের প্রত্যাশা করতে উৎসাহ দেয়।
ক্বদ্বা ও ক্বদরের প্রতি ঈমান মানুষকে কাজের প্রতি উৎসাহ দেয়, সৎ আমলে উদ্বুদ্ধ করে এবং তার মধ্যে শক্তি ও সাহস যোগায়। আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধরত বীর পুরুষেরা নির্ভয়ে জিহাদের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যায়। তারা মৃত্যুকে ভয় করে না। কারণ তারা বিশ্বাস করে যে, মৃত্যু থেকে পলানোর কোনো সুযোগ নেই। তা যখন আগমন করবে তখন তাকে পিছিয়ে দেয়া কিংবা সংরক্ষিত দূর্গ ও সেনাবাহিনী দিয়ে ঠেকানো যাবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿أَيْنَمَا تَكُونُوا يُدْرِكْكُمُ الْمَوْتُ وَلَوْ كُنْتُمْ فِي بُرُوجٍ مُشَيَّدَة﴾
‘‘তোমরা যেখানে থাকো না কেন, মৃত্যু তোমাদের নাগাল পাবেই। যদিও তোমরা সুউচ্চ সুদৃঢ় দুর্গে অবস্থান করো’’। (সূরা আন নিসা: ৭৮) আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿قُلْ لَوْ كُنْتُمْ فِي بُيُوتِكُمْ لَبَرَزَ الَّذِينَ كُتِبَ عَلَيْهِمُ الْقَتْلُ إِلَى مَضَاجِعِهِمْ﴾
‘‘বলো, তোমরা যদি নিজেদের ঘরেও থাকতে তথাপি যাদের ভাগ্যে মৃত্যু লেখা ছিল, তারা তাদের বধ্যভূমির পানে বের হয়ে পড়তো’’। (সূরা আলে-ইমরান: ১৫৪)
এভাবেই মুজাহিদ যখন তাক্বদীরের প্রতি ঈমানের প্রবল অনুপ্রেরণা উপলব্ধি করবে, তখন সে শত্রুদের মোকাবেলায় বিজয় অর্জন এবং ইসলাম ও মুসলিমদের শক্তি অর্জন না হওয়া পর্যন্ত জিহাদ চালিয়ে যাবে।
এমনি ক্বদ্বা (ফায়ছালা) ও ক্বদরের প্রতি ঈমান আনয়নের মাধ্যমে উৎপাদন ও সমৃদ্ধি অর্জিত হয়। কেননা বিশ্বাসী যখন বিশ্বাস করে যে, লোকেরা কেবল তার ঐ পরিমাণ ক্ষতিই করতে পারে, যা আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য লিখে দিয়েছেন এবং তারা কেবল ঐ পরিমাণ উপকারই করতে পারে, যা আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য নির্ধারণ করেছেন, তখন একে অন্যের উপর নির্ভর করবে না, সৃষ্টিকে ভয় করবে না এবং মানুষের উপর নির্ভরশীল হবে না। সে কেবল আল্লাহ তা‘আলার উপর নির্ভর করে উন্নতি, উৎপাদন ও উপার্জনের পথে অগ্রসর হবে। কল্যাণ, সমৃদ্ধি, অগ্রগতি ও উন্নতি অর্জনের পথে অগ্রসর হয়ে যখন অবনতির সম্মুখীন হবে এবং লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে ব্যর্থ হবে, তখন সে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা হতে পিছিয়ে পড়বে না এবং নিরাশ হবে না। সে কখনো এ কথা বলবেনা যে, আমি যদি এমন করতাম, তাহলে এমন হতো, ওমন হতো। বরং সে বলবে এটিই আল্লাহর নির্ধারণ। তিনি যা ইচ্ছা তাই করেছেন। সেই সঙ্গে আল্লাহর উপর ভরসা রেখে প্রচেষ্টা চালানো অব্যাহত রাখবে। তবে একই সঙ্গে ভুল-ত্রুটি সংশোধন করবে ও আত্মসমালোচনা করবে। এর মাধ্যমেই সামাজিক কাঠামো ঠিক থাকবে এবং সমাজিক কল্যাণ অব্যাহত থাকবে। আল্লাহ তা‘আলা সত্য বলেছেন,
﴿وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُ إِنَّ اللَّهَ بَالِغُ أَمْرِهِ قَدْ جَعَلَ اللَّهُ لِكُلِّ شَيْءٍ قَدْراً ﴾
‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর নির্ভর করে আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট। নিশ্চয়ই আল্লাহ তার ইচ্ছা পূরণ করবেনই। আল্লাহ স্থির করেছেন প্রত্যেক জিনিসের মাত্রা’’। (সূরা তালাক: ৩) আল্লাহ রাববুল আলামীনের জন্যই সমস্ত প্রশংসা।
[1]. সহীহ মুসলিম, হা/২৬৬৪, অধ্যায়: শক্তিশালী হওয়া এবং অপারগতা প্রকাশ বর্জনের আদেশ। ইবনে মাজাহ হা/৭৯।