লগইন করুন
নিঃসন্দেহে ক্বদ্বা ও ক্বদর সাব্যস্ত করা এবং এতোদুভয়ের প্রতি বিশ্বাস করা ও তার অন্তর্ভুক্ত যাবতীয় বিষয়ের প্রতি ঈমান আনয়ন করা ঈমানের বিরাট একটি রুকন। জিবরীল আলাইহিস সালাম যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ঈমান সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন, তখন তিনি জবাব দিয়েছেন যে,
(أَنْ تُؤْمِنَ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَتُؤْمِنَ بِالْقَدَرِ خَيْرِهِ وَشَرِّهِ)
‘‘তুমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করবে (১) আল্লাহ পাকের উপর (২) তার ফেরেস্তাদের উপর (৩) তার কিতাবসমূহের উপর (৪) তার রসূলদের উপর (৫) আখেরাত বা শেষ দিবসের উপর এবং (৬) তাক্বদীরের ভাল-মন্দের উপর’’।[2]
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿إِنَّا كُلَّ شَيْءٍ خَلَقْنَاهُ بِقَدَرٍ﴾‘‘আমি প্রত্যেক জিনিসকে একটি পরিমাপ অনুযায়ী সৃষ্টি করেছি’’।[3] (সূরা কামার: ৪৯)
القدر শব্দটি قدرت الشيئ إذا أحطت بمقداره এর মাসদার। অর্থাৎ আমি জিনিসটির পরিমাণ-পরিমাপ নির্ধারণ করলাম। এ কথা আপনি তখনই বলে থাকেন, যখন উক্ত জিনিসের পরিমান-পরিমাপ সম্পর্কে আপনার পূর্ণ জ্ঞান থাকে।
এখানে القدر দ্বারা সৃষ্টিজগৎ অস্তিত্ব লাভ করার পূর্বেই সে সম্পর্কে আদিতে আল্লাহ তা‘আলার পরিপূর্ণ ইলম থাকা উদ্দেশ্য। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা অবগতি, নির্ধারণ ও ইচ্ছা ব্যতীত কোনো কিছুই সৃষ্টি হয় না। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মাযহাব হলো তাক্বদীরের ভালো-মন্দ ও মিষ্ট-তিক্ততার প্রতি ঈমান আনয়ন করাকে الإيمان بالقدر বলা হয়। তাক্বদীরের প্রতি ঈমান আনয়নের চারটি স্তর রয়েছে। যথা:
প্রথম স্তর: প্রত্যেক জিনিস অস্তিত্ব লাভ করার পূর্বেই আদিতে সে সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলার ইল্মের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। অর্থাৎ তিনি সকল বস্তুকে স্বীয় জ্ঞানের মাধ্যমে পরিবেষ্টন করে আছেন, -এ কথার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। আসমান ও যমীনে সরিষার দানা পরিমাণ বস্তুও তার জ্ঞানের বাইরে নয়। সৃষ্টি করার পূর্ব হতেই তিনি সকল বস্তু সম্পর্কে অবগত আছেন। তাদের রিযিক, বয়স, কথা, কাজ, চলাচল, অবস্থান, গোপন-প্রকাশ্য, তাদের মধ্যে কে জান্নাতী এবং কে জাহান্নামী তাও তিনি জানেন। বান্দাগণ আমল করার পূর্বেই তিনি তাদের আমলসমূহ সম্পর্কে অবগত থাকা এর অন্তর্ভুক্ত।
দ্বিতীয় স্তর: দ্বিতীয় স্তর হলো প্রথম স্তরে বর্ণিত সকল বিষয় আল্লাহ তা‘আলা লাওহে মাহফুযে লিখে দিয়েছেন। অর্থাৎ এ কথার উপর ঈমান আনয়ন করা এবং বিশ্বাস স্থাপন করা যে, আল্লাহ তা‘আলা ঐ সমুদয় বস্তুই লিখে রেখেছেন, যা হবে বলে তার জ্ঞানের আওতায় ছিল। লাওহে মাহ্ফুয ও কলমের প্রতি ঈমান আনয়নও উপরোক্ত বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত।
তৃতীয় স্তর: প্রত্যেক সৃষ্টির প্রতি আল্লাহ তা‘আলা ইচ্ছা এবং তার উপর তার পরিপূর্ণ ক্ষমতার প্রতি ঈমান আনয়ন করা।[4]
চতুর্থ স্তর: এ বিশ্বাস করা যে, আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক জিনিষের সৃষ্টিকর্তা। আরো বিশ্বাস করা যে, তিনিই একমাত্র সৃষ্টিকর্তা। তিনি ছাড়া বাকি সবকিছুই সৃষ্টি।[5]
[1]. আল্লামা শাইখ মুহাম্মাদ ইবনে সালেহ আল-উছাইমীন রহিমাহুল্লাহ বলেন, القضاء ও القدر এর মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে কি না, এ ব্যাপারে আলেমগণ মতভেদ করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, أزل বা আদিতে আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক সবকিছু নির্ধারণ করে রাখাকে কদর বলা হয়। আর যথাসময়ে তা সৃষ্টির ফায়ছালাকে ক্বদ্বা বলা হয়। আল্লাহ যখন নির্দিষ্ট কোনো জিনিস অমুক সময় হবে বলে নির্ধারণ করেন, তখন তাকে কদর বলা হয়। আর যখন ঐ জিনিসটি সৃষ্টি করার নির্দিষ্ট সময় এসে উপস্থিত হয়, তখন তার ফায়ছালা করা এবং অস্তিত্বে নিয়ে আসাকে ক্বদ্বা বলা হয়। কুরআনুল কারীমে এর অনেক উদাহরণ রয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَقُضِيَ الْأَمْرُ ‘‘তখন সবকিছুর ফায়ছালা হয়ে যাবে’’। (সূরা আল-বাকারা: ২১০) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,﴾ وَاللَّهُ يَقْضِي بِالْحَقِّ ﴿ ‘‘আল্লাহ সঠিকভাবে ফায়ছালা করেন’’। (সূরা গাফের: ২০) এ রকম আয়াত আরো রয়েছে। সুতরাং কদর হলো আদিতেই আল্লাহর নির্ধারণের নাম। আর ক্বদ্বা হলো সংঘটিত হওয়ার সময় সে সম্পর্কে ফায়ছালা করার নাম।
কেউ কেউ বলেছেন, ক্বদ্বা ও কদরের অর্থ একই। তবে প্রাধান্যপ্রাপ্ত কথা হলো, উভয় শব্দকে একসঙ্গে উল্লেখ করা হলে উভয়ের মধ্যে পার্থক্য হবে। আর যদি উভয়টিকে আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়, তাহলে উভয়টি দ্বারা একই অর্থ বুঝতে হবে। ঈষৎ পরিবর্তনসহ শাইখের কথা এখানেই শেষ।
কেউ কেউ বলেছেন, ভবিষ্যতে সৃষ্টিসমূহের যা কিছু হবে সে সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলার অবগতিকে কদর বলা হয়। আর আল্লাহ তা‘আলার ইলম ও ইচ্ছা অনুযায়ী সবকিছু সৃষ্টি করাকে ক্বদ্বা বলা হয়। (আল্লাহ তা‘আলাই সর্বাধিক অবগত)
[2]. সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: কিতাবুল ঈমান।
[3]. অর্থাৎ দুনিয়ার প্রত্যেক বস্তুরই একটি পরিমাণ আছে। সে অনুসারে প্রত্যেক বস্তু একটি নির্দিষ্ট সময় অস্তিত্ব লাভ করে, একটি বিশেষ রূপ ও আকৃতি গ্রহণ করে। একটি বিশেষ সীমা পর্যন্ত ক্রমবিকাশ লাভ করে, একটি নির্দিষ্ট সময়কাল পর্যন্ত টিকে থাকে এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ে তার পরিসমাপ্তি ঘটে। স্বভাবগত নিয়ম-নীতি অনুসারে এ দুনিয়ারও একটি 'তাকদীর' বা পরিমাণ আছে। সে অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তা চলছে এবং একটি নির্দিষ্ট সময়েই তার চলার পরিসমাপ্তি ঘটবে। এর পরিসমাপ্তির জন্য যে সময় নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে তার এক মুহূর্ত পূর্বে এর পরিসমাপ্তি ঘটবে না কিংবা এক মুহূর্ত পরে তা অবশিষ্টও থাকবে না। এ পৃথিবী অনাদি ও চিরস্থায়ী নয় যে, চিরদিনই তা আছে এবং চিরদিন থাকবে। কিংবা কোনো শিশুর খেলনাও নয় যে, যখনই তোমরা চাইবে তখনই তিনি এটিকে ধ্বংস করে দেখিয়ে দিবেন। (আল্লাহ তা‘আলাই সর্বাধিক অবগত)
[4]. তিনি যা করার ইচ্ছা করেন, তা অবশ্যই বাস্তবায়িত হয়। যা কিছু সৃষ্টি হয়েছে এবং যা সৃষ্টি হবে, সে ক্ষেত্রে আল্লাহর ইচ্ছা ও ক্ষমতা এ দু’টির একটি অন্যটির জন্য আবশ্যক। আর যা সৃষ্টি হয়নি এবং যা সৃষ্টি হবেনা, সে ক্ষেত্রে আল্লাহর ইচ্ছা ও ক্ষমতা -এ দু’টির একটির জন্য অন্যটি জরুরী নয়। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা যা করতে চেয়েছেন তাঁর কুদরতের মাধ্যমে তা অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে। আর যা তিনি করতে ইচ্ছা করেন নি, তা বাস্তবায়িত হয়নি। তিনি ইচ্ছা করেন নি, এ জন্যই বাস্তবায়িত হয় নি; এ জন্যে নয় যে, তিনি সেটি করতে সক্ষম নন। এ ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَا كَانَ اللَّهُ لِيُعْجِزَهُ مِنْ شَيْءٍ فِي السَّمَوَاتِ وَلاَ فِي الأَرْضِ إِنَّهُ كَانَ عَلِيمًا قَدِيرًا﴾
‘‘আল্লাহ এমন নন যে, আকাশমন্ডলী এবং পৃথিবীর কোনো কিছু তাকে অক্ষম করতে পারে। তিনি সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান’’। (সূরা ফাতির: ৪৪)
[5]. আসমান-যমীন এবং এতোদুভয়ের মধ্যবর্তী স্থানের ছোট-বড় সকল বস্তুরই সৃষ্টিকর্তা তিনি। এ সমস্ত সৃষ্টির চলাচল এবং অবস্থানও তিনি সৃষ্টি করেছেন। তিনি পবিত্র। তিনি ছাড়া কোন সৃষ্টিকর্তা নেই। তিনিই একমাত্র প্রতিপালক।