ক্বদ্বা ও ক্বদরের প্রতি ঈমান আনয়নের বিরাট ফলাফল রয়েছে। এর মাধ্যমেই ঈমানের বাকিসব রুকন সহকারে মানুষের ঈমান পরিপূর্ণ হয়। ক্বদ্বা ও ক্বদরের প্রতি ঈমান আনয়ন করা ঈমানের ছয়টি রুকনের অন্তর্ভুক্ত। ক্বদ্বা ও ক্বদর বা তাক্বদীরের প্রতি ঈমান আনয়ন না করলে কারো ঈমান সঠিক হবে না। আল্লাহর কিতাব ও রসূলের সুন্নাতের বিবরণ অনুযায়ী ক্বদ্বা ও ক্বদরের প্রতি বিশ্বাস না করলে কেউ ঈমানদার হতে পারবে না।
তাক্বদীরের প্রতি ঈমান আনয়নের মাধ্যমেই মানুষের অন্তর প্রশান্তি লাভ করে, প্রফুলস্ন হয় এবং পার্থিব জীবনের বিপদাপদ ও কষ্টের সম্মুখীন হলে অস্থির-উদ্বিগ্ন হয় না। কেননা বান্দা যখন বিশ্বাস করবে, যে মুছীবতে সে আক্রান্ত হয় তা আল্লাহর পক্ষ হতে নির্ধারিত, তা হবেই, তা প্রতিহত করার ক্ষমতা কেউ রাখে না এবং রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ বাণী উপলব্ধি করবে যেখানে তিনি বলেছেন,
«واعْلَمَ أَنَّ مَا أَصَابَكَ لَمْ يَكُنْ لِيُخْطِئَكَ وَمَا أَخْطَأَكَ لَمْ يَكُنْ لِيُصِيبَكَ»
‘‘হে বৎস! তুমি এ কথা বিশ্বাস করবে যে, তোমার জীবনে যা ঘটেছে তা ঘটারই ছিল। আর যা ঘটেনি তা কোনো দিন ঘটার ছিল না’’।
এ বিশ্বাস করার মাধ্যমেই অন্তরে স্থিরতা অর্জিত হয় এবং হৃদয় প্রশান্তি লাভ করে। যারা ক্বদ্বা (ফায়ছালা) ও ক্বদরে (ভাগ্যে) বিশ্বাস করে না, তারা এর বিপরীত। তারা বিপদাপদ ও মুছীবতে আক্রান্ত হয়ে উদ্বিগ্ন ও দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় তারা অস্থির হয়ে যায়। ফলে তার জীবন যাপন বিরক্তিকর ও অসহনীয় হয়ে উঠে। এমনকি স্বাভাবিক জীবন-যাপন করা তাদের কাছে ভারি হয়ে যায় বলে তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য আত্ম-হত্যা করার চেষ্টা করে। পার্থিব জীবনের কঠিন বাস্তবতা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য এবং ভবিষ্যৎ জীবনকে অন্ধকারাচ্ছন্ন মনে করে যারা আত্মহত্যা করে তাদের মধ্যে এটিই লক্ষণীয়। কারণ তারা তাক্বদীরের প্রতি ঈমান আনয়ন করে না। ফলে তারা তাদের খারাপ আকিদার অপরিহার্য ফলাফল হিসাবেই আত্মহত্যার মত অন্যায় কাজের প্রতি অগ্রসর হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿مَا أَصَابَ مِن مُّصِيبَةٍ فِى الأَرْضِ وَلاَ فِى أَنْفُسِكُمْ إلاَّ فِى كِتَابٍ مِّن قَبْلِ أَن نَّبْرَأَهَا إنَّ ذَلِكَ عَلَى اللهِ يَسِيرٌ لِّكَيْلاَ تَأْسَوْاْ عَلَى مَا فَاتَكُمْ وَلاَ تَفْرَحُواْ بِمَا آتَاكُمْ وَاللهُ لاَ يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ﴾
‘‘পৃথিবীতে এবং তোমাদের উপর যে বিপদ আসে তা সৃষ্টি করার পূর্বেই একটি কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে। নিশ্চয়ই এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ। যাতে তোমরা যা হারাও তার জন্য দুঃখিত না হও এবং তিনি তোমাদেরকে যা দিয়েছেন তার জন্য উল্লাসিত না হও। আল্লাহ কোন উদ্ব্যত অহংকারীকে পছন্দ করেন না’’। (সূরা আল হাদীদ: ২২-২৩)
আল্লাহ তা‘আলা এখানে সংবাদ দিয়েছেন যে, যমীনে এবং মানুষের শরীরের যেসব মুছীবত হয়, তা তিনি আগেই নির্ধারণ করে রেখেছেন। সুতরাং সেটা নির্ধারিত ও লিপিবদ্ধ আছে। আমরা সেটা প্রতিরোধ করার যতই চেষ্টা করি না কেন, তা সংঘটিত হবেই। অতঃপর তিনি আমাদেরকে সেটা অবগত করার হিকমত হলো, যাতে আমরা প্রশান্তি লাভ করি, অধৈর্য না হই, মুছীবতে পড়ে আফসোস না করি এবং সুখ-শান্তি, আরাম-আয়েশ, ধন-সম্পদ ইত্যাদির নিয়ামত লাভ করে এত আনন্দিত না হই, যা আমাদেরকে শেষ পরিণামের কথা ভুলিয়ে দেয়। বরং মুছীবতের সময় আমাদের সবর করা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ না হওয়া আবশ্যক। সেই সঙ্গে সুখ-সমৃদ্ধির সময় আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা আবশ্যক এবং তার পাকড়াও থেকে যেন নিজেদেরকে সম্পূর্ণ নিরাপদ না মনে করা জরুরী। মোটকথা উভয় অবস্থাতেই আমরা আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক রাখবো।
ইকরিমা রহিমাহুল্লাহ বলেছেন, প্রত্যেকেই আনন্দিত ও দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়। তোমরা আনন্দের সময় আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো এবং দুঃখের সময় সবর করো।
এ থেকে বুঝার সুযোগ নেই যে, বান্দা অকল্যাণ থেকে বাঁচার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করে এবং কল্যাণকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করে ক্বদ্বা ও ক্বদরের উপর ভরসা করে হাত গুটিয়ে বসে থাকবে। যেমন কিছু অজ্ঞ লোক ধারণা করে থাকে। এটি মারাত্মক বোকামি। বরং আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে উপায়-উপকরণ অবলম্বন করার হুকুম করেছেন এবং অলসতা ও উপায়-উপকরণের প্রতি অবহেলা করতে নিষেধ করেছেন। উপায়-উপকরণ অবলম্বন করার পরও যদি উদ্দেশ্যের বিপরীত ফলাফল অর্জিত হয় তাহলে আমাদের করণীয় হলো, আমরা অধৈর্য-অস্থির হবো না। বিশ্বাস করবো এটিই নির্ধারিত ফায়ছালা। এ ছাড়া অন্য কিছু নির্ধারিত থাকলে তা অবশ্যই হতো।
সহীহ মুসলিমে আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত হয়েছে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
«الْمُؤْمِنُ الْقَوِىُّ خَيْرٌ وَأَحَبُّ إِلَى اللَّهِ مِنَ الْمُؤْمِنِ الضَّعِيفِ وَفِى كُلٍّ خَيْرٌ احْرِصْ عَلَى مَا يَنْفَعُكَ وَاسْتَعِنْ بِاللَّهِ وَلاَ تَعْجِزْ وَإِنْ أَصَابَكَ شَىْءٌ فَلاَ تَقُلْ لَوْ أَنِّى فَعَلْتُ كَانَ كَذَا وَكَذَا. وَلَكِنْ قُلْ قَدَرُ اللَّهِ وَمَا شَاءَ فَعَلَ فَإِنَّ لَوْ تَفْتَحُ عَمَلَ الشَّيْطَانِ»
‘‘শক্তিশালী মুমিন আল্লাহর নিকট দুর্বল মুমিনের চেয়ে উত্তম ও প্রিয়। তবে প্রত্যেকের মধ্যেই কল্যাণ রয়েছে। যে জিনিস তোমার উপকার করবে, তা অর্জন করার জন্য আগ্রহী হও এবং আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাও। আর এ রকম যেন না হয় যে, তাক্বদীরের উপর ভরসা করে হাত গুটিয়ে অপারগ-অক্ষম হয়ে বসে থাকবে। কল্যাণকর ও উপকারী জিনিস অর্জনে সর্বোচ্চ চেষ্টা করার পরও যদি তোমার উপর কোনো বিপদ এসে পড়ে, তবে কখনও এ কথা বলোনা, আমি যদি এ রকম করতাম, তাহলে অবশ্যই এমন হতো; বরং তুমি বলো, আল্লাহ যা তাক্বদীরে রেখেছেন এবং তিনি যা ইচ্ছা করেছেন তাই হয়েছে। কেননা যদি কথাটি শয়তানের জন্য কুমন্ত্রণার পথ খুলে দেয়’’।[1]
তাক্বদীরের উপর ঈমান রাখা, কল্যাণ অর্জন করতে এবং অকল্যাণ বিদূরিত করতে উপায়-উপকরণ অবলম্বন করার সাথে সাথে বান্দা নিজ কাজ-কর্মের হিসাব নিজেই নিবে এবং ভুল-ত্রুটি সংশোধন করবে। বিশ্বাস করবে যে, তার নিজের গুনাহর কারণেই বিপদাপদ ও মুছীবত আসে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَا أَصَابَكُم مِّن مُّصِيبَةٍ فَبِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيكُمْ وَيَعْفُو عَن كَثِيرٍ﴾
‘‘তোমাদের উপর যে মুছীবতই এসেছে তা তোমাদের কৃতকর্মের কারণে এসেছে। বহু সংখ্যক অপরাধকে তো আল্লাহ ক্ষমা করে থাকেন’’ (সূরা শূরা: ৩০)
ক্বদ্বা ও ক্বদরের প্রতি ঈমানের অন্যতম সুফল হলো এর মাধ্যমেই বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতি ও সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার সময় সুদৃঢ় থাকা যায় এবং পার্থিব জীবনের দুঃখ-কষ্টকে এমন অবিচল হৃদয় ও দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে গ্রহণ করা যায়, যাকে কঠিন বিপদাপদ নড়াতে পারে না এবং প্রচ- ঝড়-তুফানেও সে অনড় থাকে। কেননা সে জানে যে, এ পার্থিব জগত হলো পরীক্ষাগার ও পরিবর্তনশীল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿الَّذِي خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيَاةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا وَهُوَ الْعَزِيزُ الْغَفُورُ﴾
‘‘তিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন, তোমাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য, কে তোমাদের মধ্যে আমলের দিক দিয়ে সর্বোত্তম। আর তিনি পরাক্রমশালী ও ক্ষমাশীল’’। (সূরা মূলক: ২) আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ حَتَّى نَعْلَمَ المُجَاهِدِينَ مِنُكُمْ وَالصَّابِرِينَ وَنَبْلُوَ أَخْبَارَكُمْ﴾
‘‘আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করবো যে পর্যন্ত না জানতে পারি তোমাদের জেহাদকারীদেরকে, সবরকারীদেরকে এবং যতক্ষণ না আমি তোমাদের অবস্থানসমূহ যাচাই করি’’। (সূরা মুহাম্মাদ: ৩১)
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তার সাহাবীগণ কতই না কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন এবং তারা কতনা কঠিন বিপদাপদের সম্মুখীন হয়েছেন! কিন্তু তারা সত্য খাঁটি ঈমান ও অবিচল প্রত্যয়ের মাধ্যমে এগুলোর মোকাবেলা করেছেন। ফলে তারা সমুজ্জল সফলতা লাভ করতে সক্ষম হয়েছেন। ক্বদ্বা ও ক্বদরের প্রতি সুগভীর-সুদৃঢ় বিশ্বাসের কারণেই তাদের দ্বারা সম্পূর্ণ প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবেলা করে উজ্জল সাফল্য লাভ করা সম্ভব হয়েছিল। সে সঙ্গে তারা আল্লাহ তা‘আলার এই বাণী পুরোপুরি উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿قُل لَّن يُصِيبَنَا إِلَّا مَا كَتَبَ اللَّهُ لَنَا هُوَ مَوْلَانَا وَعَلَى اللَّهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُونَ﴾
‘‘তাদের বলো, আল্লাহ আমাদের জন্য যা লিখে দিয়েছেন, তা ছাড়া আর কোনো কিছুই আমাদের হয় না। আল্লাহই আমাদের অভিভাবক এবং ঈমানদারদের তার উপরই ভরসা করা উচিত’’। (সূরা আত তাওবা: ৫১)
ক্বদ্বা (ফায়ছালা) ও ক্বদরের (ভাগ্যের) প্রতি ঈমান আনয়নের আরেকটি সুফল হলো এটি মানুষের দুঃখ-কষ্টকে অনুদানে রূপান্তরিত করে দেয় এবং মুছীবতকে বিনিময়ে পরিণত করে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿مَا أَصَابَ مِنْ مُصِيبَةٍ إِلا بِإِذْنِ اللَّهِ وَمَنْ يُؤْمِنْ بِاللَّهِ يَهْدِ قَلْبَهُ وَاللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ﴾
‘‘আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত কোনো বিপদ আসে না এবং যে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস করে, তিনি তার অন্তরকে সৎ পথ প্রদর্শন করেন। আল্লাহ সর্ববিষয়ে সম্যক পরিজ্ঞাত। (সূরা তাগাবুন: ১১)
আলকামা রহিমাহুল্লাহ বলেন, এখানে ঐ ব্যক্তির কথা বলা হয়েছে, যে মুছীবতে আক্রান্ত হয়ে বিশ্বাস করে যে, তা আল্লাহর পক্ষ হতে। অতঃপর সে তাকে আল্লাহর ফায়ছালা বলে মনে করে সন্তুষ্ট থাকে ও মেনে নেয়।
উপরোক্ত আয়াতে কারীমার অর্থ হলো, মুছীবতে আক্রান্ত হয়ে কেউ যদি বিশ্বাস করে, এটি আল্লাহর পক্ষ হতে নির্ধারিত। অতঃপর সবর করে, ছাওয়াব প্রত্যাশা করে এবং আল্লাহর ফায়ছালা মেনে নেয়, আল্লাহ তা‘আলা তার অন্তরকে সঠিক পথে পরিচালনা করেন এবং দুনিয়ার যে নিয়ামত ছুটে যায়, তার বিনিময়ে তাকে অন্তরের হিদায়াত ও সত্য ঈমান দান করেন। তার থেকে যা কিছু ছিনিয়ে নেয়া হয় তার বদলে কখনো কখনো আল্লাহ তা‘আলা অনুরূপ কিছু দান করেন অথবা তারচেয়ে উত্তম কিছু দান করেন। আল্লাহ তা‘আলার ফায়ছালা ও নির্ধারণ অনুযায়ী যেসব বালা-মুছীবত আসে সে ক্ষেত্রে বান্দার কোনো হাত থাকে না। তবে বান্দা যেন নিজে এটি আসার কারণে পরিণত না হয়। যেমন সে আল্লাহর কোনো আদেশ বাস্তবায়নে ত্রুটি করলো কিংবা তার কোনো নিষেধ থেকে দূরে থাকার ক্ষেত্রে ত্রুটি-বিচ্যুতি করলো। সুতরাং এ ক্ষেত্রে বান্দার উচিত সে আল্লাহ তা‘আলার ফায়ছালা ও নির্ধারণের প্রতি ঈমান আনয়ন করবে এবং তার যে ভুলের কারণে মুছীবতটি এসেছে, তা সংশোধন করে নিবে।
কতিপয় মানুষ ক্বদ্বা (ফায়ছালা) ও ক্বদরের (ভাগ্যের) দলীল দিয়ে যখন পাপাচারে লিপ্ত হয় কিংবা ওয়াজিব কাজ ছেড়ে দেয় তখন তারা এতে মারাত্মক ভুল করে। তারা বলে এটি আমাদের উপর নির্ধারিত। এই বলে তারা পাপাচারে লিপ্ত হয় এবং গুনাহ থেকে তাওবা করে না। যেমন মুশরিকরা বলেছিল,
﴿لَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا أَشْرَكْنَا وَلَا آبَاؤُنَا وَلَا حَرَّمْنَا مِنْ شَيْءٍ كَذَلِكَ كَذَّبَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ حَتَّى ذَاقُوا بَأْسَنَا قُلْ هَلْ عِنْدَكُمْ مِنْ عِلْمٍ فَتُخْرِجُوهُ لَنَا إِنْ تَتَّبِعُونَ إِلَّا الظَّنَّ وَإِنْ أَنْتُمْ إِلَّا تَخْرُصُونَ﴾
‘‘আল্লাহ যদি ইচ্ছা করতেন, তাহলে আমরা এবং আমাদের বাপ-দাদারা শিরক করতাম না এবং কোনো কিছুই হারাম করতাম না। এভাবেই তাদের পূর্ববর্তীগণও মিথ্যা মনে করেছিল। অবশেষে তারা আমার শাস্তি ভোগ করেছিল। বলো, তোমাদের নিকট কোনো ইলম আছে কি? থাকলে তা আমাদের নিকট পেশ করো। তোমরা কেবল ধারণা অনুসরণ করে থাকো এবং তোমরা শুধু অনুমান ভিত্তিক কথাই বলে থাকো’’। (সূরা আল আন‘আম ১৪৮)।
ক্বদ্বা ও ক্বদর সম্পর্কে এটি ছিল তাদের খুব নিকৃষ্ট বুঝ। কেননা তাক্বদীর দ্বারা দলীল পেশ করে বিপদাপদ ও পাপাচারের দিকে এগিয়ে যাওয়া বৈধ নয়। তবে মুছীবত এসে গেলে তাক্বদীর দ্বারা দলীল পেশ করা যাবে। পাপাচার করে ক্বদ্বা ও ক্বদর দিয়ে দলীল দেয়া খুব নিকৃষ্ট কাজ। এতে করে তাওবার পথ বন্ধ হয়ে যায় এবং আদিষ্ট সৎ আমল বর্জন করা হয়। কিন্তু মুছীবত এসে যাওয়ার সেটার মাধ্যমে দলীল গ্রহণ করা ভালো। কেননা তখন ক্বদ্বা ও ক্বদরের দ্বারা দলীল গ্রহণ মুছীবতগ্রস্থকে সবর ও ছাওয়াবের প্রত্যাশা করতে উৎসাহ দেয়।
ক্বদ্বা ও ক্বদরের প্রতি ঈমান মানুষকে কাজের প্রতি উৎসাহ দেয়, সৎ আমলে উদ্বুদ্ধ করে এবং তার মধ্যে শক্তি ও সাহস যোগায়। আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধরত বীর পুরুষেরা নির্ভয়ে জিহাদের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যায়। তারা মৃত্যুকে ভয় করে না। কারণ তারা বিশ্বাস করে যে, মৃত্যু থেকে পলানোর কোনো সুযোগ নেই। তা যখন আগমন করবে তখন তাকে পিছিয়ে দেয়া কিংবা সংরক্ষিত দূর্গ ও সেনাবাহিনী দিয়ে ঠেকানো যাবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿أَيْنَمَا تَكُونُوا يُدْرِكْكُمُ الْمَوْتُ وَلَوْ كُنْتُمْ فِي بُرُوجٍ مُشَيَّدَة﴾
‘‘তোমরা যেখানে থাকো না কেন, মৃত্যু তোমাদের নাগাল পাবেই। যদিও তোমরা সুউচ্চ সুদৃঢ় দুর্গে অবস্থান করো’’। (সূরা আন নিসা: ৭৮) আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿قُلْ لَوْ كُنْتُمْ فِي بُيُوتِكُمْ لَبَرَزَ الَّذِينَ كُتِبَ عَلَيْهِمُ الْقَتْلُ إِلَى مَضَاجِعِهِمْ﴾
‘‘বলো, তোমরা যদি নিজেদের ঘরেও থাকতে তথাপি যাদের ভাগ্যে মৃত্যু লেখা ছিল, তারা তাদের বধ্যভূমির পানে বের হয়ে পড়তো’’। (সূরা আলে-ইমরান: ১৫৪)
এভাবেই মুজাহিদ যখন তাক্বদীরের প্রতি ঈমানের প্রবল অনুপ্রেরণা উপলব্ধি করবে, তখন সে শত্রুদের মোকাবেলায় বিজয় অর্জন এবং ইসলাম ও মুসলিমদের শক্তি অর্জন না হওয়া পর্যন্ত জিহাদ চালিয়ে যাবে।
এমনি ক্বদ্বা (ফায়ছালা) ও ক্বদরের প্রতি ঈমান আনয়নের মাধ্যমে উৎপাদন ও সমৃদ্ধি অর্জিত হয়। কেননা বিশ্বাসী যখন বিশ্বাস করে যে, লোকেরা কেবল তার ঐ পরিমাণ ক্ষতিই করতে পারে, যা আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য লিখে দিয়েছেন এবং তারা কেবল ঐ পরিমাণ উপকারই করতে পারে, যা আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য নির্ধারণ করেছেন, তখন একে অন্যের উপর নির্ভর করবে না, সৃষ্টিকে ভয় করবে না এবং মানুষের উপর নির্ভরশীল হবে না। সে কেবল আল্লাহ তা‘আলার উপর নির্ভর করে উন্নতি, উৎপাদন ও উপার্জনের পথে অগ্রসর হবে। কল্যাণ, সমৃদ্ধি, অগ্রগতি ও উন্নতি অর্জনের পথে অগ্রসর হয়ে যখন অবনতির সম্মুখীন হবে এবং লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে ব্যর্থ হবে, তখন সে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা হতে পিছিয়ে পড়বে না এবং নিরাশ হবে না। সে কখনো এ কথা বলবেনা যে, আমি যদি এমন করতাম, তাহলে এমন হতো, ওমন হতো। বরং সে বলবে এটিই আল্লাহর নির্ধারণ। তিনি যা ইচ্ছা তাই করেছেন। সেই সঙ্গে আল্লাহর উপর ভরসা রেখে প্রচেষ্টা চালানো অব্যাহত রাখবে। তবে একই সঙ্গে ভুল-ত্রুটি সংশোধন করবে ও আত্মসমালোচনা করবে। এর মাধ্যমেই সামাজিক কাঠামো ঠিক থাকবে এবং সমাজিক কল্যাণ অব্যাহত থাকবে। আল্লাহ তা‘আলা সত্য বলেছেন,
﴿وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُ إِنَّ اللَّهَ بَالِغُ أَمْرِهِ قَدْ جَعَلَ اللَّهُ لِكُلِّ شَيْءٍ قَدْراً ﴾
‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর নির্ভর করে আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট। নিশ্চয়ই আল্লাহ তার ইচ্ছা পূরণ করবেনই। আল্লাহ স্থির করেছেন প্রত্যেক জিনিসের মাত্রা’’। (সূরা তালাক: ৩) আল্লাহ রাববুল আলামীনের জন্যই সমস্ত প্রশংসা।
[1]. সহীহ মুসলিম, হা/২৬৬৪, অধ্যায়: শক্তিশালী হওয়া এবং অপারগতা প্রকাশ বর্জনের আদেশ। ইবনে মাজাহ হা/৭৯।