লগইন করুন
(১) সমস্ত সৃষ্টির প্রত্যেক বিষয়কে একসঙ্গে একত্রিতকারী ব্যাপক তাক্বদীর: এ প্রকার তাক্বদীর লাওহে মাহফুযে লিপিবদ্ধ আছে। কিয়ামত পর্যন্ত প্রত্যেক জিনিসের তাক্বদীর লাওহে মাহফুযে লিপিবদ্ধ রয়েছে। ইমাম আবু দাউদ স্বীয় সুনান গ্রন্থে উবাদাহ ইবনে সামিত রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেন, আমি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন,
(إِنَّ أَوَّلَ مَا خَلَقَ اللَّهُ الْقَلَمَ فَقَالَ: لَهُ اكْتُبْ قَالَ: رَبِّ وَمَاذَا أَكْتُبُ قَالَ: اكْتُبْ مَقَادِيرَ كُلِّ شَيْءٍ حَتَّى تَقُومَ السَّاعَةُ)
‘‘আল্লাহ তা‘আলা কলম সৃষ্টি করে সর্বপ্রথম তাকে বললেন, লিখো। কলম বললো, হে আমার প্রভু! কী লিখবো? আল্লাহ বললেন, কিয়ামত পর্যন্ত প্রত্যেক জিনিষের তাক্বদীর লিখো’’।[1] এ প্রকার তাক্বদীর সমস্ত সৃষ্টির জন্য।
(২) সমস্ত সৃষ্টির প্রত্যেক বিষয়কে একত্রিতকারী তাক্বদীর: ইহা কয়েক শ্রেণীতে বিভক্ত।
(ক) التقدير العمري তাক্বদীরে উমুরী বা সারা জীবনের তাক্বদীর: যেমন আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদের হাদীছে এসেছে, মায়ের পেটে থাকা অবস্থাতেই শিশুর উপর যে চারটি বাক্য লিখে দেয়া হয়, তাই হচ্ছে তাক্বদীরে উমুরী। লিখে দেয়া হয় তার রিযিক, তার বয়স, তার আমল এবং তার হতভাগ্য হওয়া কিংবা সৌভাগ্যবান হওয়ার কথা।
(খ) التقدير الحولي তাক্বদীরে হাওলী বা সারা বছরের তাক্বদীর: লাইলাতুল কদরে বাৎসরিক তাক্বদীর লিখিত হয়। তাতে সারা বছরের সকল বিষয় ও ঘটনা একসাথে লেখা হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿إِنَّا أَنزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنذِرِينَ فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ أَمْرًا مِنْ عِنْدِنَا إِنَّا كُنَّا مُرْسِلِينَ﴾
‘‘আমি একে নাযিল করেছি এক বরকতময় রাতে। নিশ্চয় আমি সতর্ককারী। এ রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয়ের ফায়ছালা করা হয় আমার আদেশক্রমে। আমিই প্রেরণকারী’’। (সূরা দুখান: ৩-৫)
(গ) التقدير اليومي তাক্বদীরে ইয়াওমী বা দৈনন্দিন তাক্বদীর: হায়াত, মওত, সম্মান, অপমান ইত্যাদি আরো যা প্রতিদিন নির্ধারণ করা হয়, তাই দৈনন্দিন তাক্বদীর। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴾ ﴿كُلَّ يَوْمٍ هُوَ فِي شَأْنٍ‘‘তিনি প্রতিদিন কোনো না কোনো মহান কার্যে রত আছেন’’। (সূরা আর্-রাহমান: ২৯)
আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, আল্লাহর সৃষ্টিসমূহের মধ্য হতে অন্যতম একটি সৃষ্টি হচ্ছে লাওহে মাহ্ফুয। সাদা মুক্তা দিয়ে তিনি এটি তৈরি করেছেন। তার উভয় পার্শ্ব তৈরি করা হয়েছে লাল রঙের হিরা দিয়ে। কলমটি হচ্ছে নূরের তৈরী, কালিও নূরের। সেটার প্রশস্ততা হচ্ছে আসমান-যমীনের মধ্যকার প্রশস্ততার সমান। আল্লাহ তা‘আলা তাতে দৈনিক তিনশ ষাটবার দৃষ্টি দেন। প্রত্যেকবার দৃষ্টি দেয়ার সময় কাউকে জীবিত রাখেন, কারো মৃত্যু ঘটান, কাউকে সম্মানিত করেন, কাউকে অপমানিত করেন এবং তিনি যা চান তাই করেন।
এটিই হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার এই বাণী, ﴾ ﴿كُلَّ يَوْمٍ هُوَ فِي شَأْنٍ ‘‘তিনি প্রতিদিন কোনো না কোনো মহান কাজে রত আছেন’’, এর মর্মার্থ। (সূরা আর্-রাহমান: ২৯) ইমাম আব্দুর রায্যাক, ইবনুল মুনযির, তাবারানী এবং হাকেম এই হাদীছ বর্ণনা করেছেন।
প্রত্যেক মুসলিমের উপর সমস্ত সৃষ্টির প্রত্যেক বিষয়কে একসঙ্গে একত্রিতকারী তাক্বদীর এবং তার সমস্ত বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা ওয়াজিব। এগুলো থেকে যে ব্যক্তি কোনো কিছুকে অস্বীকার করবে, সে তাক্বদীরের প্রতি ঈমান আনয়নকারী বলে গণ্য হবে না। সে ঈমানের একটি রুকন অস্বীকারকারী হিসাবে গণ্য হবে। যেমন পথভ্রষ্ট কাদারীয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা তাক্বদীর অস্বীকার করে থাকে। তাক্বদীর অস্বীকার করার ক্ষেত্রে তারা দু’টি শ্রেণীতে বিভক্ত।
তাদের মধ্যে এক শ্রেণীর লোক তাক্বদীর অস্বীকার করার ক্ষেত্রে অত্যাধিক সীমালংঘন করেছে। এমনকি তারা সৃষ্টিজগতের বিষয়গুলো সংঘটিত হওয়া ও অস্তিত্ব লাভ করার পূর্বে সে সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলার জ্ঞান থাকার কথাও অস্বীকার করেছে। সেই সঙ্গে সৃষ্টির সবকিছু লাওহে মাহফুযে লিখে রাখাও অস্বীকার করেছে। তারা বলে থাকে, আল্লাহ তা‘আলা আদেশ-নিষেধ করেছেন। তিনি জানেন না, কে এগুলো মানবে আর কে তা মানবে না। তাদের মতে আল্লাহর ইলমের সাথে এমন কিছু যুক্ত হয়, যা পূর্বে তার ইলম ও তাক্বদীরের মধ্যে ছিল না। সম্ভবত কাদারীয়া সম্প্রদায়ের এই শ্রেণীর লোক বিলুপ্ত হয়ে গেছে কিংবা বিলুপ্ত হওয়ার দ্বারপ্রামেত্ম পৌঁছে গেছে।
কাদারীয়া সম্প্রদায়ের যে ফির্কা এখনো বাকি আছে তারা আল্লাহ তা‘আলার ইলমকে স্বীকার করে। কিন্তু তারা বান্দার কাজ-কর্ম তাক্বদীরের অন্তর্ভুক্ত হওয়াকে অস্বীকার করে। তারা মনে করে বান্দারা নিজেরাই তাদের কাজ-কর্ম স্বতন্ত্রভাবে সৃষ্টি করে। আল্লাহ তা‘আলা তা সৃষ্টি করেন না এবং সেটা সৃষ্টি করার ইচ্ছাও পোষণ করেন না। এটিই হলো মু‘তাযিলাদের মাযহাব। তাক্বদীর সাব্যস্ত করতে গিয়ে কাদারীয়াদের সম্পূর্ণ বিপরীত একটি সম্প্রদায় মারাত্মক বাড়াবাড়ি করেছে। এমনকি তারা বান্দার কাজ করার ক্ষমতা ও স্বাধীনতাকে নাকোচ করেছে। তাদের কথা হলো বান্দার কাজে সে বাধ্য। এ জন্যই এ সম্প্রদায়কে জাবরীয়া বলা হয়।[2]
অনেক দলীল-প্রমাণ দ্বারা উভয় মাযহাবই বাতিল সাব্যস্ত হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿لِمَنْ شَاءَ مِنْكُمْ أَنْ يَسْتَقِيمَ (28) وَمَا تَشَاءُونَ إِلَّا أَنْ يَشَاءَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ﴾
‘‘তোমাদের মধ্যে যে সরলপথে চলতে চায় তার জন্য এ কুরআন উপদেশ স্বরূপ। আর বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে তোমরা কোনো ইচ্ছা করতে পারো না’’। (সূরা তাকভীর: ২৮-২৯)
আল্লাহ তা‘আলার বাণী, ‘‘তোমাদের মধ্যে যে সরলপথে চলতে চায়’’ এর দ্বারা জাবরীয়াদের প্রতিবাদ করা হয়েছে। কেননা এখানে আল্লাহ তা‘আলা বান্দার জন্য ইচ্ছা সাব্যস্ত করেছেন। কিন্তু জাবরীয়ারা বলে যে, বান্দা তার কাজে বাধ্য। কাজ করা বা না করায় তাদের কোনো স্বাধীনতা ও ইচ্ছা নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আর বিশ্বজাহনের প্রতিপালক আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে তোমরা কোনোই ইচ্ছা করতে পারো না’’। এখানে কাদারীয়াদের প্রতিবাদ করা হয়েছে। তারা বলে থাকে আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছার উপর নির্ভর করা ব্যতীতই বান্দা কাজ করার স্বতন্ত্র ইচ্ছা রাখে। এটি একটি বাতিল কথা। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বান্দার ইচ্ছাকে স্বীয় ইচ্ছার সাথে যুক্ত করে দিয়েছেন।
এটিই হলো ক্বদ্বা ও ক্বদরের ব্যাপারে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মাযহাব। তারা তাক্বদীর অস্বীকারকারী কাদারিয়া (মু‘তাযিলা) সম্প্রদায়ের ন্যায় শৈথিল্য প্রদর্শন ও ঢিলামি করেনি এবং জাবরীয়াদের ন্যায় তাক্বদীর সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করেনি।
উম্মতের সালাফ ও ইমামদের মাযহাব হলো, তারা বলে সকল প্রকার সৎ কাজ, পাপাচার, কুফুরী ও ফিতনা-ফাসাদ আল্লাহর ফায়ছালা ও নির্ধারণ অনুযায়ীই হয়ে থাকে। তাদের বিশ্বাস হলো, আল্লাহ ব্যতীত আর কোনো স্রষ্টা নেই। তাই তিনি বান্দা ও তাদের সমস্ত কর্মেরও স্রষ্টা। তারা ভালো-মন্দ, উৎকৃষ্ট-নিকৃষ্ট যা কিছু করে তারও স্রষ্টা। তবে বান্দা তার কাজে সম্পূর্ণরূপে বাধ্য নয়; বরং সে কাজ করার ক্ষমতা রাখে, ইচ্ছা রাখে এবং তা সম্পন্নকারীও বটে। শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া রহিমাহুল্লাহ বলেন, সমস্ত কাজ-কর্ম, আনুগত্য ও পাপাচার বান্দার দ্বারা হয়ে থাকে। অর্থাৎ বান্দার দ্বারা তা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তার ইচ্ছা ও ক্ষমতা দ্বারা অর্জিত হয়। বান্দার কাজ-কর্ম দ্বারা তাকে বিশেষিত করা হয়, বান্দাই তা চালু করে এবং এগুলোর হুকুম-আহকাম তার দিকেই প্রত্যাবর্তন করে।
আর বান্দার কাজ-কর্মগুলো আল্লাহর পক্ষ থেকে হয় এ অর্থে যে, বান্দার মধ্যে তিনি তা সৃষ্টি করেছেন, বান্দার কাজ হিসাবে তাকে নির্ধারণ করেছেন এবং তার উপার্জন হিসাবে স্থির করেছেন। যেমন তিনি সমস্ত উপায়-উপকরণ ও কাজ-কর্ম এবং তার ফলাফল সৃষ্টি করছেন। সুতরাং আল্লাহর পক্ষ হতে বান্দার কাজ-কর্ম হয় মানে তিনি তার স্রষ্টা। আর বান্দার পক্ষ হতে তা হয় মানে বান্দার শক্তি দ্বারা যেহেতু তা সম্পন্ন ও অর্জিত হয়, তাই তার কাজকে তার সাথে প্রতিষ্ঠিত বিশেষণ হিসাবে গণ্য করা হয়। যেমন আমরা বলে থাকি, এ ফলটি অমুক গাছের, এ ফসল অমুক যমীন থেকে। এসব কথার অর্থ হলো, এগুলো অমুক গাছ ও অমুক যমীন থেকে উৎপন্ন হয়েছে। অনুরূপ এগুলো আল্লাহর পক্ষ হতেও। এ কথার অর্থ হলো, তিনি এগুলো সৃষ্টি করেছেন। উভয় কথার মধ্যে কোনো বৈপরীত্য নেই। ইমাম সাফারায়েনী রহিমাহুল্লাহ বলেন, আহলুস সালাফ ও আহলুস সুন্নাতের গবেষক আলেমদের মতে আল্লাহ তা‘আলা বান্দার ক্ষমতা, ইচ্ছা ও কাজ-কর্ম সৃষ্টি করেন। বান্দা প্রকৃত পক্ষেই তার কাজ-কর্ম সম্পাদনকারী এবং সে তা উদ্ভাবনকারী। আল্লাহ তা‘আলা তাকে তার কর্ম সম্পাদনকারী ও উদ্ভাবনকারী বানিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَا تَشَاءُونَ إِلَّا أَنْ يَشَاءَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ﴾
‘‘আর বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে তোমরা কোনো ইচ্ছা করতে পারো না’’। (সূরা তাকভীর: ২৮-২৯)
আল্লাহ তা‘আলা এখানে বান্দার ইচ্ছা সাব্যস্ত করেছেন এবং সংবাদ দিয়েছেন যে, বান্দার ইচ্ছা আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছা ব্যতীত কার্যকর হয় না। কাজ-কর্ম সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে বান্দার ইচ্ছা সাব্যস্ত করার ব্যাপারে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের এটি সুস্পষ্ট বক্তব্য। আর তা আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত হতেই পারে না। ইমাম সাফারায়েনীর বক্তব্য এখানেই শেষ।
[1]. তিরমিযী, অধ্যায়: আবওয়াবুল কাদ্র। তিরমিযী বলেন: হাদীছটি হাসান গরীব। তবে ইমাম আলবানী (রহি.) সহীহ বলেছেন। দেখুন সিলসিলা ছহীহা: (১/৩০৭) আল্লাহর আরশ পানির উপরে থাকার অর্থ হলো সপ্তম আকাশের উপরে রয়েছে পানি। আর সেই পানির উপর আল্লাহর আরশ। এখনো আরশ স্বীয় অবস্থানেই রয়েছে।
[2]. কাদারীয়াদের মতে বান্দার কাজ বান্দা নিজেই সৃষ্টি করে; তাতে আল্লাহর কোনো ইচ্ছা নেই। সে হিসেবে তারা আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছাকে দুইভাগে তথা ইরাদায়ে কাওনীয়া (সৃষ্টিগত ইচ্ছা) এবং ইরাদায়ে শরঈয়া (শরীয়াতের আদেশগত ইচ্ছা) এই দুইভাগে বিভক্ত করাকে সমর্থন করে না। তারা বলে থাকে আল্লাহ তা‘আলা শুধু সকল মানুষ থেকে ঈমান আনয়নেরই ইচ্ছা করেছেন এবং আদেশ দিয়েছেন। কিন্তু বান্দা ঈমানের পরিবর্তে যেই কুফরী ও পাপাচারে লিপ্ত হয়, বান্দা নিজেই সৃষ্টি করে; আল্লাহ তা‘আলা নন। জাবরীয়াদের মাযহাব এর সম্পূর্ণ বিপরীত। তারা বলে, বান্দা কিছুই করে না। ভালো-মন্দ সবকিছু আল্লাহ তা‘আলাই বান্দাকে দিয়ে করে থাকেন। এমনকি বান্দার কোনো ইচ্ছা ও স্বাধীনতা নেই। উভয় দলের কথাই কুরআন, সুন্নাহ এবং বিবেক-বুদ্ধির দলীল দ্বারা প্রত্যাখ্যাত।