পরিচ্ছেদঃ দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - তাওয়াক্কুল (আল্লাহর ওপর ভরসা) ও সবর (ধৈর্যধারণ) প্রসঙ্গে
৫২৯৯-[৫] ’উমার ইবনুল খত্ত্বাব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) -কে বলতে শুনেছি, [রাসূল (সাঃ) বলেছেন] যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি যথার্থ ভরসা কর তাহলে তিনি তোমাদেরকে অনুরূপ রিযক দান করবেন, যেরূপ পাখিকে রিযক দিয়ে থাকেন। তারা ভোরে খালি পেটে বের হয় এবং দিনের শেষে ভরা পেটে (বাসায়) ফিরে আসে। (তিরমিযী ও ইবনু মাজাহ)
اَلْفصْلُ الثَّنِفْ (بَاب التَّوَكُّل وَالصَّبْر)
عَن عمر بن الْخطاب قَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: لَوْ أَنَّكُمْ تَتَوَكَّلُونَ عَلَى اللَّهِ حَقَّ تَوَكُّلِهِ لَرَزَقَكُمْ كَمَا يَرْزُقُ الطَّيْرَ تَغْدُو خِمَاصًا وَتَرُوحُ بِطَانًا . رَوَاهُ التِّرْمِذِيُّ وَابْنُ مَاجَهْ
حسن ، رواہ الترمذی (2344 وقال : حسن صحیح) و ابن ماجہ (4164) ۔
(صَحِيح)
ব্যাখ্যা : (لَوْ أَنَّكُمْ تَتَوَكَّلُونَ عَلَى اللَّهِ حَقَّ تَوَكُّلِهِ) যদি তোমরা আল্লাহ তা'আলা ওপর যথাযথ ভরসা করতে এবং এ কথা নিশ্চিতভাবে অবগত হতে যে, পৃথিবীতে যা কিছু ঘটে এর কর্তা একমাত্র আল্লাহ। আর রিযকদাতা ও রোধকারী তিনিই, এরপর তোমরা উত্তম পদ্ধতিতে তার ওপর ভরসা করে চেষ্টা চালিয়ে যেতে তাহলে (لَرَزَقَكُمْ كَمَا يَرْزُقُ الطَّيْرَ) তোমরাও রিযকপ্রাপ্ত হতে যেমনটি পাখিকে রিযক দেয়া হয়। সে সকালে খালি পেটে বাসা থেকে বের হয় এবং সন্ধ্যায় পেটপূর্ণ করে আবার বাসায় ফিরে আসে।
ইমাম মুনাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, পাখি সকাল বেলা ক্ষুধার্ত অবস্থায় বেরিয়ে যায় এবং সন্ধ্যায় পেট ভর্তি করে ফিরে আসে। অতএব উপার্জন করাই রিযকদাতা হতে পারে না বরং রিযকদাতা হলেন একমাত্র আল্লাহ। তিনি এ দ্বারা বুঝিয়েছেন যে, ভরসা করা অর্থ কর্মহীন হয়ে বসে থাকা নয়। বরং যে কোন বৈধ পন্থার সাথে সম্পৃক্ত হওয়া আবশ্যক। কেননা পাখিরা রিযকপ্রাপ্ত হয় চেষ্টা ও অন্বেষণের মাধ্যমে। আর এজন্যই ইমাম আহমাদ (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, হাদীসের মাধ্যমে উপার্জন বন্ধ করে বসে থাকার কথা বলা হয়নি। বরং রিযক অন্বেষণ করার প্রতি দিক-নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তিনি (সা.) এর দ্বারা বুঝিয়েছেন, যদি তারা তাদের কর্মস্থলে যাওয়া আসার মাঝে ও চেষ্টা প্রচেষ্টার সাথে আল্লাহর ওপর ভরসা করত এবং এটা অবগত হত যে, কল্যাণ একমাত্র আল্লাহর হাতে, তবে তারাও পাখির মতো নিরাপদে গনীমাতপ্রাপ্ত হয়ে ফিরত। (তুহফাতুল আহওয়ায়ী ৬/২৩৪৪, মিরক্বাতুল মাফাতীহ ৫২৯৯)
পরিচ্ছেদঃ দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - তাওয়াক্কুল (আল্লাহর ওপর ভরসা) ও সবর (ধৈর্যধারণ) প্রসঙ্গে
৫৩০০-[৬] ইবনু মাস্’উদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, হে লোক সকল! যে ব্যাপারে আমি তোমাদেরকে আদেশ করেছি তাছাড়া এমন কোন জিনিসই নেই যা তোমাদেরকে জান্নাতের নিকটবর্তী করবে এবং জাহান্নাম থেকে দূরে রাখবে। আর যা থেকে আমি তোমাদেরকে নিষেধ করেছি তাছাড়া এমন কোন জিনিসই নেই যা তোমাদেরকে জাহান্নাম থেকে দূরে রাখবে। রূহুল আমীন আরেক বর্ণনায় আছে রূহুল কুদুস (জিবরীল আলাইহিস সালাম) আমার অন্তরে এ কথাটি ঢেলে দিয়েছেন যে, কোন দেহ তার (নির্ধারিত) রিযক পরিপূর্ণভাবে ভোগ না করা পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করবে না। সাবধান! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং ধনসম্পদ উপার্জনে উত্তম নীতি অবলম্বন কর। কাঙিক্ষত রিযক পৌছার বিলম্বতা যেন তোমাদেরকে আল্লাহর অবাধ্যতার খোঁজার পথে তা অন্বেষণে উদ্বুদ্ধ না করে। কেননা আল্লাহর কাছে যা নির্ধারিত রিযক আছে তা আল্লাহর আনুগত্য ছাড়া অর্জন করা যায় না। (আল্লামা বাগাবী’র “শারহুস্ সুন্নাহ্” এবং বায়হাক্বী’র শুআবূল ঈমান বর্ণনা করেছেন। তবে (وَإنَّ رُوحَ اوقُدُسِ) “আর নিশ্চয় রূহুল কুদুস (জিবরীল আলায়হিস সালাম)” এ বাক্যটি বায়হাক্বী বর্ণনা করেননি)
اَلْفصْلُ الثَّنِفْ (بَاب التَّوَكُّل وَالصَّبْر)
وَعَنِ ابْنِ مَسْعُودٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَيُّهَا النَّاسُ لَيْسَ مِنْ شَيْءٍ يُقَرِّبُكُمْ إِلَى الْجَنَّةِ وَيُبَاعِدُكُمْ مِنَ النَّارِ إِلَّا قَدْ أَمَرْتُكُمْ بِهِ وَلَيْسَ شَيْءٌ يُقَرِّبُكُمْ مِنَ النَّارِ وَيُبَاعِدُكُمْ مِنَ الْجَنَّةِ إِلَّا قَدْ نَهَيْتُكُمْ عَنْهُ وَإِنَّ الرُّوحَ الْأَمِينَ - وَفِي روايةٍ: وإِن رُوحَ الْقُدُسِ - نَفَثَ فِي رُوعِي أَنَّ نَفْسًا لَنْ تَمُوتَ حَتَّى تَسْتَكْمِلَ رِزْقَهَا أَلَا فَاتَّقُوا اللَّهَ وَأَجْمِلُوا فِي الطَّلَبِ وَلَا يَحْمِلَنَّكُمُ اسْتِبْطَاءُ الرِّزْقِ أَنْ تَطْلُبُوهُ بِمَعَاصِي اللَّهِ فَإِنَّهُ لَا يُدْرَكُ مَا عِنْدَ اللَّهِ إِلَّا بِطَاعَتِهِ «. رَوَاهُ فِي» شرح السّنة «وَالْبَيْهَقِيّ فِي» شعب الإِيمان إِلَّا أَنَّهُ لَمْ يَذْكُرْ: «وَإِنَّ رُوحَ الْقُدُسِ»
اسنادہ ضعیف ، رواہ البغوی فی شرح السنۃ (14 / 303 ۔ 304 ح 4111) و البیھقی فی شعب الایمان (10376 ، نسخۃ محققۃ : 9891) * السند منقطع ، زبید الایامی لم یدرک ابن مسعود و للحدیث شاھدان ضعیفان ۔
ব্যাখ্যা: মানুষকে জান্নাতের নিকটবর্তী করা এবং জাহান্নাম থেকে দূরে থাকার যাবতীয় বিষয়ের দিক নির্দেশনা নবী (সা.) করেছেন। এমনিভাবে মানুষকে জাহান্নামের নিকটবর্তী করে ও জান্নাত থেকে দূরে সরিয়ে দেয় এমন সমস্ত বিষয় থেকে নিষেধ করেছেন। এর মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় যে, যাবতীয় উপকারী ও প্রতিরোধকারী বিষয়ে জ্ঞান কেবল কুরআন ও হাদীস থেকেই শিখতে হবে। এ দুটি ছাড়া অন্য কোন জ্ঞান চর্চা করা অপকারী কাজে জীবন নষ্ট করা।
(أَنَّ نَفْسًا لَنْ تَمُوتَ حَتَّى تَسْتَكْمِلَ رِزْقَهَا) আল্লাহ তা'আলা এই মর্মে প্রত্যাদেশ করেছেন যে, সৃষ্টিকুলে কোন প্রাণী তার জন্য নির্ধারিত রিযক পরিপূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করবে না। যেমন আল্লাহ তা'আলা পবিত্র কুরআনে বলেন, (اَللّٰهُ الَّذِیۡ خَلَقَکُمۡ ثُمَّ رَزَقَکُمۡ ثُمَّ یُمِیۡتُکُمۡ) “আল্লাহই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তোমাদেরকে রিযক দিয়েছেন, অতঃপর তিনি তোমাদের মৃত্যু ঘটাবেন...”- (সূরা আর রূম ৩০ : ৪০)।
(أَلَا فَاتَّقُوا اللَّهَ وَأَجْمِلُوا فِي الطَّلَبِ) সাবধান! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং উত্তম পন্থায় জীবিকা অর্জন কর এবং জীবিকা অর্জনের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করো না। আল্লাহ তা'আলা বলেন, (وَ مَا خَلَقۡتُ الۡجِنَّ وَ الۡاِنۡسَ اِلَّا لِیَعۡبُدُوۡنِ ﴿۵۶﴾ مَاۤ اُرِیۡدُ مِنۡهُمۡ مِّنۡ رِّزۡقٍ وَّ مَاۤ اُرِیۡدُ اَنۡ یُّطۡعِمُوۡنِ ﴿۵۷﴾ اِنَّ اللّٰهَ هُوَ الرَّزَّاقُ ذُو الۡقُوَّۃِ الۡمَتِیۡنُ ﴿۵۸﴾)
“আমি জিন্ ও মানবকে সৃষ্টি করেছি একমাত্র এ কারণে যে, তারা আমারই ইবাদাত করবে। আমি তাদের থেকে রিযক চাই না, আর আমি এও চাই না যে, তারা আমাকে খাওয়াবে। আল্লাহই তো রিযকদাতা, মহা শক্তিধর, প্রবল পরাক্রান্ত।” (সূরাহ্ আহ্ যা-রিয়া-ত ৫১: ৫৬-৫৮)
(أَلَا فَاتَّقُوا اللَّهَ وَأَجْمِلُوا فِي الطَّلَبِ) রিযক প্রাপ্তির বিলম্ব যেন তোমাদেরকে অন্যায়ভাবে, অবৈধ ও হারাম পন্থায় জীবিকা অর্জন করতে প্ররোচিত না করে। কেননা আল্লাহর নিকট যে হালাল রিযক ও জান্নাত রয়েছে তা আনুগত্যের মাধ্যমেই অর্জন করা সম্ভব, অবৈধ পন্থায় নয়।
আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত এখান থেকে দলীল গ্রহণ করেন যে, হালাল ও হারাম সবই রিযক এবং সবকিছু আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে মুতাযিলাগণ বিরোধিতা করেছে। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)।
পরিচ্ছেদঃ দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - তাওয়াক্কুল (আল্লাহর ওপর ভরসা) ও সবর (ধৈর্যধারণ) প্রসঙ্গে
৫৩০১-[৭] আবূ যার (রাঃ) নাবী (সা.) হতে বর্ণনা করেন, তিনি (সা.) বলেছেন: কোন বৈধ বস্তুকে হারাম করা এবং ধনসম্পদকে ধ্বংস করার নাম দুনিয়া বর্জন করা নয়, বরং প্রকৃত দুনিয়া বর্জন হলো, আল্লাহ তা’আলার হাতে যা আছে তা অপেক্ষা তোমার হাতে যা আছে তা বেশি নির্ভরযোগ্য মনে না করা এবং যখন তোমার ওপর কোন বিপদ এসে পড়ে তখন সেই বিপদ তোমার ওপর পতিত না হওয়ার পরিবর্তে সাওয়াবের আশায় তা বাকি থাকার প্রতি আগ্রহ বেশি হওয়া। [তিরমিযী ও ইবনু মাজাহ; আর ইমাম তিরমিযী (রহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, এ হাদীসটি গবীর, বর্ণনাকারী ’আমর ইবনু ওয়াক্বিদ মুনকারুল হাদীস)
اَلْفصْلُ الثَّنِفْ (بَاب التَّوَكُّل وَالصَّبْر)
وَعَنْ أَبِي ذَرٍّ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «الزَّهَادَةُ فِي الدُّنْيَا لَيْسَتْ بِتَحْرِيم وَلَا إِضَاعَةِ الْمَالِ وَلَكِنَّ الزَّهَادَةَ فِي الدُّنْيَا أَنْ لَا تَكُونَ بِمَا فِي يَدَيْكَ أَوْثَقَ بِمَا فِي يَد اللَّهِ وَأَنْ تَكُونَ فِي ثَوَابِ الْمُصِيبَةِ إِذَا أَنْتَ أُصِبْتَ بِهَا أَرْغَبَ فِيهَا لَوْ أَنَّهَا أُبْقِيَتْ لَكَ» رَوَاهُ التِّرْمِذِيُّ وَابْنُ مَاجَهْ وَقَالَ التِّرْمِذِيُّ: هَذَا حَدِيثٌ غَرِيبٌ وَعَمْرُو بْنُ وَاقِدٍ الرَّاوِي مُنكر الحَدِيث
اسنادہ ضعیف جذا ، رواہ الترمذی (2340) و ابن ماجہ (4100) * عمرو بن واقد : متروک ۔
(ضَعِيف)
ব্যাখ্যা : (الزَّهَادَةُ فِي الدُّنْيَا لَيْسَتْ بِتَحْرِيم..) হালালকে হারামে পরিণত করা এবং সম্পদ ধ্বংস করার নাম দুনিয়াবিমুখতা নয়, যেমনটি কতিপয় অজ্ঞ লোকেরা করে থাকে। এই ধারণাবশত হয়েই সে গোশত, মিষ্টি, ফলমূল খাওয়া এবং সুন্দর কাপড় পরিধান করা ও বিবাহ-শাদি ইত্যাদি বৈধ কাজ পরিত্যাগ করে থাকে। অথচ আল্লাহ তা'আলা বলেন, (یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تُحَرِّمُوۡا طَیِّبٰتِ مَاۤ اَحَلَّ اللّٰهُ لَکُمۡ وَ لَا تَعۡتَدُوۡا ؕ اِنَّ اللّٰهَ لَا یُحِبُّ الۡمُعۡتَدِیۡنَ ﴿۸۷﴾)
“হে ঈমানদারগণ! পবিত্র বস্তুরাজি যা আল্লাহ তোমাদের জন্য হালাল করে দিয়েছেন সেগুলোকে হারাম করে নিও না আর সীমালঙ্ন করো না, অবশ্যই আল্লাহ সীমালঙ্নকারীদের ভালোবাসেন না।” (সূরাহ্ আল মায়িদাহ্ ৫: ৮৭)
এমনিভাবে রাসূল (সা.) থেকে প্রমাণিত রয়েছে যে, তিনি এ সমস্ত কাজ করেছেন। তার চেয়ে পরিপূর্ণ অবস্থা আর কারো হতে পারে না।
(وَلَا إِضَاعَةِ الْمَالِ) এমনিভাবে দুনিয়াবিমুখতা অর্থ সম্পদ নষ্ট করা নয়। ফলে সম্পদকে নষ্ট করবে এবং যথাস্থানে তা ব্যয় না করে সাগরে ফেলে দিবে অথবা ধনী-দরিদ্র বিচার না করে সকলকে দিয়ে দিবে এবং প্রয়োজনের মুহূর্তে মানুষের নিকট হাত পাতবে।
(وَلَكِنَّ الزَّهَادَةَ فِي الدُّنْيَا أَنْ لَا تَكُونَ بِمَا فِي يَدَيْكَ أَوْثَقَ بِمَا فِي يَد اللَّهِ) বরং সত্যিকার দুনিয়াবিমুখতা হলো তোমার নিকট যে ধন-সম্পদ ও ব্যবসা-বাণিজ্য রয়েছে তার চেয়ে আল্লাহর তা'আলার নিকট যা কিছু রয়েছে তার প্রতি অধিক আকাক্ষিত হওয়া। যেমন ইবনু মাজার হাদীসে রয়েছে : আল্লাহর নিকট তার ধনভাণ্ডারে প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য যা কিছু রয়েছে তা তোমার কাছে যা আছে তা থেকে অধিক আকাঙ্ক্ষিত বিষয় হওয়া উচিত। অতএব হাদীসের অর্থ হচ্ছে আল্লাহ তা'আলা তোমার জন্য রিযকের যে ওয়াদা করেছেন তার ওপর ভরসা থাকা উচিত এবং এ ধারণা রাখা যে, তিনি তোমাকে এমনভাবে রিযক দিবেন যা তুমি কল্পনাও করতে পারনি এবং এমনভাবে দান করবেন যা তুমি কখনো উপার্জন করতে সক্ষম হওনি। এটা তোমার নিকট যে ধন-সম্পদ, ব্যবসা-বাণিজ্য, মান সম্মান ইত্যাদি যা কিছু আছে তার থেকে অধিক শক্তিশালী ও স্থায়ী। কেননা তোমার সম্পদ একদিন শেষ হয়ে যাবে, ধ্বংস হয়ে যাবে কিন্তু আল্লাহর নিকট যা আছে তা চিরস্থায়ী। যেমন আল্লাহ তা'আলা বলেন, (مَا عِنۡدَکُمۡ یَنۡفَدُ وَ مَا عِنۡدَ اللّٰهِ بَاقٍ ؕ)
“তোমাদের কাছে যা আছে তা শেষ হয়ে যাবে, আর আল্লাহর কাছে যা আছে তা টিকে থাকবে...” (সূরাহ্ আল নাহল ১৬:৯৬)।
(وَأَنْ تَكُونَ فِي ثَوَابِ الْمُصِيبَةِ إِذَا أَنْتَ أُصِبْتَ بِهَا أَرْغَبَ فِيهَا) আর এমন যেন না হয়, তুমি সাওয়াবের আশায় বিপদে পতিত হওয়াকে অধিক কামনা করবে বিপদ না আশা থেকে। অর্থাৎ এমন মনে করবে না বিপদ আসলেই অধিক সাওয়াব হবে আর বিপদ না আসলে তোমারা সাওয়াব ছুটে যাবে। (তুহফাতুল আহ্ওয়াযী ৬/২৩৪০, মিরকাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - তাওয়াক্কুল (আল্লাহর ওপর ভরসা) ও সবর (ধৈর্যধারণ) প্রসঙ্গে
৫৩০২-[৮] ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর সওয়ারীর পিছনে বসছিলাম। তখন তিনি আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, হে ছেলে! আল্লাহর বিধানসমূহ যথাযথভাবে মেনে চল আল্লাহ তোমাকে হিফাযতে রাখবেন। আল্লাহর অধিকার আদায় কর, তবে তুমি আল্লাহকে তোমার সম্মুখে পাবে। আর যখন তুমি কারো কাছে কিছু চাওয়ার ইচ্ছা করবে তখন আল্লাহর কাছেই চাইবে এবং যখন কারো সাহায্য চাইতে হয় তখন আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাইবে। জেনে রাখ, যদি সমস্ত সৃষ্টিজীব একত্র হয়ে তোমার কোন কল্যাণ করতে চায় তবে তারা আল্লাহর নির্ধারিত পরিমাণ ব্যতীত তোমার কোন কল্যাণ করতে পারবে না। পক্ষান্তরে যদি সমস্ত সৃষ্টিজীব সমবেতভাবে তোমার কোন ক্ষতি করতে চায় তবে তারা আল্লাহর নির্ধারিত পরিমাণ ব্যতীত তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। (তোমাদের ভাগ্যের সব কিছু লেখার পর) কলম তুলে নেয়া হয়েছে এবং খাতাসমূহ শুকিয়ে গেছে। (আহমাদ ও তিরমিযী)
اَلْفصْلُ الثَّنِفْ (بَاب التَّوَكُّل وَالصَّبْر)
وَعَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ: كُنْتُ خَلْفَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَوْمًا فَقَالَ: «يَا غُلَامُ احْفَظِ اللَّهَ يَحْفَظْكَ احْفَظِ اللَّهَ تَجِدْهُ تُجَاهَكَ وَإِذَا سَأَلْتَ فَاسْأَلِ اللَّهَ وَإِذَا اسْتَعَنْتَ فَاسْتَعِنْ بِاللَّهِ وَاعْلَمْ أَنَّ الْأُمَّةَ لَوِ اجْتَمَعَتْ عَلَى أَنْ يَنْفَعُوكَ بِشَيْءٍ لَمْ يَنْفَعُوكَ إِلَّا بِشَيْءٍ قَدْ كَتَبَهُ اللَّهُ لَكَ وَلَوِ اجْتَمَعُوا عَلَى أَنْ يَضُرُّوكَ بِشَيْءٍ لَمْ يَضُرُّوكَ إِلَّا بِشَيْءٍ قَدْ كَتَبَهُ اللَّهُ عَلَيْكَ رُفِعَتِ الأقلام وجفَّت الصُّحُف» رَوَاهُ أَحْمد وَالتِّرْمِذِيّ
اسنادہ حسن ، رواہ احمد (1 / 293 ح 2669) و الترمذی (2516 وقال : حسن صحیح) ۔
(صَحِيح)
ব্যাখ্যা: (يَا غُلَامُ) হে বৎস! (غُلَامُ) দ্বারা উদ্দেশ্য ছোট ছেলে, গোলাম বা দাস নয়। অভিধান গ্রন্থে (غُلَامُ) দ্বারা যুবক অর্থ করা হয়েছে অথবা সন্তান জন্মের পর থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত বয়স। ডাক দেয়ার উদ্দেশ্য হলো যাতে সে প্রস্তুত হয় এবং দিক-নির্দেশনাগুলো ভালোভাবে গ্রহণ করে।
(احْفَظِ اللَّهَ يَحْفَظْكَ) আল্লাহর আদেশ ও নিষেধ বাস্তবায়নের মাধ্যমে তাকে হিফাযত কর, তাহলে আল্লাহ তোমাকে দুনিয়াতে বিপদাপদ ও অকল্যাণ থেকে রক্ষা করবেন এবং পরকালে সকল প্রকার শাস্তি থেকে বাঁচিয়ে দিবেন।
(احْفَظِ اللَّهَ تَجِدْهُ تُجَاهَكَ) ‘আল্লামাহ্ ত্বীবী (রহিমাহুল্লাহ)-এর ব্যাখ্যায় বলেন, তুমি আল্লাহ অধিকারকে সংরক্ষণ কর এবং তার সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা কর তাহলে তুমি তাকে তোমার সম্মুখে যাবতীয় অকল্যাণ থেকে সংরক্ষণকারী হিসেবে দেখতে পাবে।
(وَإِذَا سَأَلْتَ فَاسْأَلِ اللَّهَ) অর্থাৎ যখন তুমি কোন কিছু চাওয়ার ইচ্ছা করবে তখন একমাত্র আল্লাহর নিকটেই চাইবে। কেননা দেয়ার মতো যাবতীয় ধনভাণ্ডার তাঁর হাতে রয়েছে। অথবা বান্দার নিকটে নি'আমাত পৌছানো বা না পৌছানো কেবল তার ইচ্ছাতেই হয়ে থাকে। আর তিনিই একমাত্র দাতা ও অভাবমুক্ত সত্তা, যিনি কারো কাছে মুখাপেক্ষী নন। অতএব একমাত্র তারই নি'আমাতের আশা করা উচিত অথবা শাস্তি প্রতিহত কামনা করা উচিত।
(وَإِذَا اسْتَعَنْتَ فَاسْتَعِنْ بِاللَّهِ) অর্থাৎ আনুগত্য এবং দুনিয়া ও আখিরাতের অন্যান্য বিষয়ে সাহায্য কামনা করার ইচ্ছা করলে কেবল তারই নিকট সাহায্য কামনা করবে ও তারই ওপর ভরসা করবে সকল স্থানে ও সকল অবস্থায়।
(رُفِعَتِ الأقلام وجفَّت الصُّحُف) লাওহে মাহফুযে বান্দার তাক্বদীর সম্পর্কে যা লেখার ও নির্ধারণ করার ছিল তা হয়ে গেছে। এরপর কলম উঠিয়ে নেয়া হয়েছে নতুন করে কোন কিছু লেখা থেকে। আর কিয়ামত পর্যন্ত বান্দার তাক্বদীর যা হবে তা লেখা হয়ে পৃষ্ঠা শুকিয়ে গেছে। সেখানে নতুন করে আর কিছু সংযোজন করা হবে না অথবা কোন বিধান পরিবর্তন করাও হবে না।
(رُفِعَتِ الأقلام وجفَّت الصُّحُف) হাদীসাংশ দ্বারা এটাই বুঝানো হয়েছে যে, তাক্বদীরের ফায়সালা, “আল্লাহর ইলম অনুযায়ী নির্ধারণ হয়ে গেছে তা আর পরিবর্তন পরিবর্ধন হবে না।” (তুহফাতুল আহ্ওয়াযী ৬/২৫১৬, মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - তাওয়াক্কুল (আল্লাহর ওপর ভরসা) ও সবর (ধৈর্যধারণ) প্রসঙ্গে
৫৩০৩-[৯] সা’দ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: আদম সন্তানের সৌভাগ্য হলো আল্লাহর ফায়সালার উপর খুশি থাকা, আর আদম সন্তানের দুর্ভাগ্য আল্লাহর কাছে কল্যাণ কামনা ছেড়ে দেয়া। আর এটাও আদম সন্তানের দুর্ভাগ্য যে, সে আল্লাহর ফায়সালায় অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে। [আহমাদ ও তিরমিযী; ইমাম তিরমিযী (রহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, হাদীসটি গরীব]
اَلْفصْلُ الثَّنِفْ (بَاب التَّوَكُّل وَالصَّبْر)
وَعَنْ سَعْدٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مِنْ سَعَادَةِ ابْنِ آدَمَ رِضَاهُ بِمَا قَضَى اللَّهُ لَهُ وَمِنْ شَقَاوَةِ ابْنِ آدَمَ تَرْكُهُ اسْتِخَارَةِ اللَّهِ وَمِنْ شَقَاوَةِ ابْنِ آدَمَ سُخْطُهُ بِمَا قَضَى اللَّهُ لَهُ» . رَوَاهُ أَحْمَدُ وَالتِّرْمِذِيُّ وَقَالَ: هَذَا حَدِيثٌ غَرِيبٌ
اسنادہ ضعیف ، رواہ احمد (1 / 168 ح 1444) و الترمذی (2151) * محمد بن ابی حمید : ضعیف ۔
(ضَعِيف)
ব্যাখ্যা : (مِنْ سَعَادَةِ ابْنِ آدَمَ رِضَاهُ بِمَا قَضَى اللَّهُ لَهُ) আদম সন্তানের সৌভাগ্যের নিদর্শন হচ্ছে সে আল্লাহর কাছে কল্যাণ কামনা করবে, অতঃপর তিনি তার জন্য যা ফায়সালা করেছেন এবং তার ভাগ্যে নির্ধারণ করেছেন তার প্রতি সন্তুষ্ট থাকা। এর বিপরীত দুর্ভাগ্য রয়েছে যেমনটি পরবর্তী বাক্যে বলা হয়েছে,
(وَمِنْ شَقَاوَةِ ابْنِ آدَمَ تَرْكُهُ اسْتِخَارَةِ اللَّهِ وَمِنْ شَقَاوَةِ ابْنِ آدَمَ سُخْطُهُ بِمَا قَضَى اللَّهُ لَهُ) আদম সন্তানের জন্য দুর্ভাগ্য হচ্ছে আল্লাহর কাছে কল্যাণ কামনা না করা এবং তিনি যা ফায়সালা করেছেন তার জন্য রাগান্বিত হওয়া ও সন্তুষ্ট না থাকা। আল্লামাহ্ ত্বীবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন : আল্লাহর ফায়সালার প্রতি সন্তুষ্ট হচ্ছে রাগকে পরিহার করা। আর এটা সৌভাগ্যের নিদর্শন। তিনি দুটি কারণে এটিকে বান্দার সৌভাগ্যের নিদর্শন ধার্য করেছেন-
[এক] যাতে ইবাদতের জন্য সমস্ত সময়কে ব্যয় করতে পারে। কেননা বান্দা যদি আল্লাহর ফয়সালার প্রতি সন্তুষ্ট না থাকে তাহলে সর্বদা চিন্তিত থাকবে। বিভিন্ন কার্যকলাপে মন ব্যস্ত থাকবে এবং বলবে, কেন এমনটি হলো, এমন হলো না কেন?
[দুই] যাতে তার রাগের কারণে তার ওপর আল্লাহর গযব নাযিল না হয়। বান্দার রাগের বহিঃপ্রকাশ হলো আল্লাহ তা'আলা তার জন্য যা ফায়সালা করেছেন তার বিপরীত উল্লেখ করা। আর যে ব্যাপারে তার কল্যাণ ও অকল্যাণ কোনটাই জানা নেই সে ব্যাপারে তার এমন মন্তব্য করা এটা হলে আরো ভালো হত, উত্তম হত। (তুহফাতুল আহ্ওয়াযী ৫/২১৫১, মিরকাতুল মাফাতীহ ৫৩০৩)