পরিচ্ছেদঃ ১৬. প্রথম অনুচ্ছেদ - আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ভালোবাসা এবং আল্লাহ তা‘আলার জন্য বান্দার প্রতি ভালোবাসা
৫০০৩-[১] ’আয়িশাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ সকল রূহ্ শরীরে প্রবেশ করার পূর্বে একদল পতাকাধারী সৈন্যের মতো ছিল। যে সব রূহ্ শরীরে প্রবেশ করানোর পূর্বে পরস্পর পরিচিত ছিল, এখনো তারা পরস্পর পরিচিত এবং একে অপরের সাথে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ। আর যে সব রূহ্ ঐ সময় পরস্পর অপরিচিত ছিল, তাদের এখনো পরস্পর মতানৈক্য রয়েছে। (বুখারী)[1]
بَابُ الْحُبِّ فِى اللهِ وَمِنَ اللهِ
عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «الْأَرْوَاحُ جُنُودٌ مُجَنَّدَةٌ فَمَا تَعَارَفَ مِنْهَا ائْتَلَفَ وَمَا تَنَاكَرَ مِنْهَا اخْتَلَفَ» . رَوَاهُ البُخَارِيّ
ব্যাখ্যাঃ (الْأَرْوَاحُ جُنُودٌ مُجَنَّدَةٌ) ইমাম খত্ত্বাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ এর সম্ভাব্য অর্থ এটা হতে পারে যে, এ সমস্ত মানুষের রূহগুলো কল্যাণ অকল্যাণের দিক বিবেচনায় সাদৃশ্যপূর্ণ। মানুষের অবয়ব অনুপাতে তাদের দিকে কল্যাণ প্রসারিত হতে পারে। ঠিক তার মতই অকল্যাণের বিষয়টি। অতএব ঐগুলোর পরস্পরের পরিচিতি তাদেরকে যে বৈশিষ্ট্যের উপর সৃষ্টি করা হয়েছে সে বৈশিষ্ট্যের উপরই হয়ে থাকে। সুতরাং তারা যখন একই বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয় তখন তারা পরস্পর পরস্পরের সাথে পরিচিতি লাভ করে। পক্ষান্তরে তাদের বৈশিষ্ট্য যদি ভিন্ন ভিন্ন হয় তখন তারা পরস্পর অপরিচিত থেকে যায়। এর অর্থ এটা হওয়ারও সম্ভাবনা আছে যে, অদৃশ্যে আল্লাহ রব্বুল ‘আলামীন সৃষ্টিকুলের যে সৃষ্টি শুরু করেছিলেন সে কথাই এখানে বলা হয়েছে। রূহগুলো সৃষ্টি করা হয়েছে শরীরের আগে। যখন রূহগুলো শরীরে প্রবেশ করলো তখন তারা পরিচিতি লাভ করলো। কেউ কেউ বলেছেন, রূহ যখন প্রথম সৃষ্টি করা হয় তখন দু’ প্রকার করে সৃষ্টি করা হয়েছে। (‘আওনুল মা‘বূদ ৮ম খন্ড, হাঃ ৪৮২)
পরিচ্ছেদঃ ১৬. প্রথম অনুচ্ছেদ - আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ভালোবাসা এবং আল্লাহ তা‘আলার জন্য বান্দার প্রতি ভালোবাসা
৫০০৪-[২] ইমাম মুসলিম (রহিমাহুল্লাহ) এ হাদীসটি আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন।
بَابُ الْحُبِّ فِى اللهِ وَمِنَ اللهِ
وَرَوَاهُ مُسلم عَن أبي هُرَيْرَة
পরিচ্ছেদঃ ১৬. প্রথম অনুচ্ছেদ - আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ভালোবাসা এবং আল্লাহ তা‘আলার জন্য বান্দার প্রতি ভালোবাসা
৫০০৫-[৩] আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যখন আল্লাহ তা’আলা কোন বান্দাকে ভালোবাসেন, তখন জিবরীল (আ.)-কে ডেকে বলেন যে, আমি অমুক ব্যক্তিকে ভালোবাসী, তুমিও তাকে ভালোবাসো। রাবী বলেন, অতঃপর জিবরীল (আ.)-ও তাকে ভালোবাসতে থাকেন এবং আকাশে ঘোষণা করে দেন যে, আল্লাহ তা’আলা অমুক ব্যক্তিকে ভালোবাসেন, তোমরাও তাকে ভালোবাসো। তখন আকাশমণ্ডলীর অধিবাসীরাও তাকে ভালোবাসতে শুরু করে। অতঃপর সে বান্দার জন্য জমিনেও স্বীকৃতি স্থাপন করা হয়। আর যখন আল্লাহ তা’আলা কোন বান্দাকে ঘৃণা করেন, তখন জিবরীল (আ.)-কে ডেকে বলেন যে, আমি অমুক বান্দাকে ঘৃণা করি, তুমিও তাকে ঘৃণা করো। রাবী বলেন, অতঃপর জিবরীল (আ.)-ও তাকে ঘৃণা করেন এবং আকাশে ঘোষণা করে দেন যে, আল্লাহ তা’আলা অমুক ব্যক্তিকে ঘৃণা করেন, তোমরাও তাকে ঘৃণা করো এবং আকাশবাসীরাও তার প্রতি ঘৃণা পোষণ করে। অতঃপর তার জন্য জমিনেও ঘৃণা স্থাপন করা হয়। (মুসলিম)[1]
بَابُ الْحُبِّ فِى اللهِ وَمِنَ اللهِ
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنَّ اللَّهَ إِذَا أَحَبَّ عَبْدًا دَعَا جِبْرِيلَ فَقَالَ: إِنِّي أُحِبُّ فُلَانًا فَأَحِبَّهُ قَالَ: فَيُحِبُّهُ جِبْرِيلُ ثُمَّ يُنَادِي فِي السَّمَاءِ فَيَقُولُ: إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ فُلَانًا فَأَحِبُّوهُ فَيُحِبُّهُ أَهْلُ السَّمَاءِ ثُمَّ يُوضَعُ لَهُ الْقَبُولُ فِي الْأَرْضِ. وَإِذَا أَبْغَضَ عَبْدًا دَعَا جِبْرِيلَ فَيَقُولُ: إِنِّي أُبْغِضُ فُلَانًا فَأَبْغِضْهُ. فَيُبْغِضُهُ جِبْرِيلُ ثُمَّ يُنَادِي فِي أَهْلِ السَّمَاءِ: إِنَّ اللَّهَ يُبْغِضُ فَلَانَا فَأَبْغِضُوهُ. قَالَ: فَيُبْغِضُونَهُ. ثُمَّ يُوضَعُ لَهُ الْبَغْضَاءُ فِي الْأَرْضِ . رَوَاهُ مُسلم
ব্যাখ্যাঃ (إِذَا أَحَبَّ عَبْدًا) ‘‘আল্লাহ যখন কোন বান্দাকে ভালোবাসেন’’ কোন কোন সনদে এ ভালোবাসার কারণসহ বিবরণ এসেছে এবং এর দ্বারা কি উদ্দেশ্য তাও এসেছে, যেমন সাওবান থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে, إن العبد ليلتمس مرضاة الله تعالى فلا يزال كذلك অর্থাৎ বান্দা সর্বদা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে ব্যস্ত থাকলে আল্লাহ তা‘আলা জিবরীল (আ.)-কে ডাক দিয়ে বলেন, ওহে জিবরীল! আমার অমুক বান্দা আমার সন্তুষ্টি অর্জনে ব্যস্ত তুমি জানিও দাও আমার রহমত আমার বান্দার অতি নিকটে অবস্থান করছে। ইমাম আহমাদ ও ইমাম ত্ববারানী অত্র হাদীসটিকে বর্ণনা করেছেন। গোলাম সংক্রান্ত অধ্যায়ে আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীসটিও অনুরূপ।
ولا يزال عبدي يتقرب إلي بالنوافل حتى أحبه অর্থাৎ আমার বান্দা নফল ‘ইবাদাতসমূহের মাধ্যমে আমার নৈকট্য অর্জনে ব্যস্ত থাকলে আমি বান্দার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যাই।
فينادي جبريل في أهل السماء الخ ‘‘অতঃপর জিবরীলও আসমানবাসীকে ডাক দিয়ে বলেন যে, অমুক ব্যক্তিকে আল্লাহ ভালোবাসেন।’’ সাওবান (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত হাদীসে اهل السموات السبع তথা সাত আসমানবাসীর কথা আছে।
ثُمَّ يُوضَعُ لَهُ الْقَبُولُ فِي أَهْلِ الْأَرْضِ ‘‘অতঃপর জমিনে তার গ্রহণযোগ্যতা নির্ধারিত হয়ে যায়’’ এ প্রসঙ্গে মহাগ্রন্থ আল-কুরআনুল কারীমে এসেছে, إن الذين آمنوا وعملوا الصالحات سيجعل لهم الرحمن ودا অর্থাৎ নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে এবং সৎ ‘আমল করে রহমান তাদের জন্য ভালোবাসা সৃষ্টি করেন। অত্র হাদীসে কবুল দ্বারা উদ্দেশ্য হলো সকলে তাকে মুহাববাতের চাদরে আঁকড়ে ধরবে, তার দিকে এগিয়ে আসবে, তার প্রতি সন্তুষ্ট হবে। এজন্য বলা হয়ে থাকে যে, মানুষের আন্তরিক ভালোবাসায় সিক্ত হলে এ বিষয়টিই প্রমাণ করে যে আল্লাহ তা‘আলা তাকে ভালোবাসেন। আল্লাহর ভালোবাসার অর্থ হলো আল্লাহ বান্দার কল্যাণ সাধন করেন, আর মালায়িকাহ্’র (ফেরেশতাদের) ভালোবাসার অর্থ হলো তারা এ বান্দার জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেন। বান্দাদের ভালোবাসার অর্থ হলো তার প্রতি তাদের এ বিশ্বাস জন্মে যে, তার কাছ থেকে অনেক কল্যাণ পাওয়া যাবে, তার কাছ থেকে কোন অকল্যাণ আসবে না। (ফাতহুল বারী ১০ম খন্ড, হাঃ ৬০১৪)
পরিচ্ছেদঃ ১৬. প্রথম অনুচ্ছেদ - আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ভালোবাসা এবং আল্লাহ তা‘আলার জন্য বান্দার প্রতি ভালোবাসা
৫০০৬-[৪] আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা’আলা বলবেন, সে লোকেরা কোথায়? যারা আমার ইয্যতের খাতিরে একে অপরকে ভালোবাসত। আজ আমি তাদেরকে আমার ছায়ায় জায়গা দেব। আজ আমার ছায়া ব্যতীত আর কোন ছায়া নেই। (মুসলিম)[1]
بَابُ الْحُبِّ فِى اللهِ وَمِنَ اللهِ
وَعَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنَّ اللَّهَ يَقُولُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ: أَيْنَ الْمُتَحَابُّونَ بِجَلَالِي؟ الْيَوْمَ أُظِلُّهُمْ فِي ظِلِّي يَوْمَ لَا ظِلَّ إِلَّا ظِلِّي . رَوَاهُ مُسْلِمٌ
ব্যাখ্যাঃ في جلالي ‘‘আমার সম্মানে’’ অত্র হাদীসটি হাদীসে কুদসী। এখানে আল্লাহ তা‘আলা বললেন, আমার সম্মানে যারা ভালোবাসে এর অর্থ হলো শুধুমাত্র আল্লাহর সত্ত্বা ও সম্মানের খাতিরে যারা পরস্পর পরস্পরকে ভালোবাসে, এ ভালোবাসায় থাকে না কোন লৌকিকতা ও প্রবৃত্তি অনুসরণের ছাপ। যেমন অন্যত্রে মহান আল্লাহ বলেনঃ وَالَّذِينَ جَاهَدُوا فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَاঅর্থাৎ ‘‘যারা আমার পথে সংগ্রাম করে তাদেরকে আমি আমার সঠিক পথ দেখিয়ে দিব...।’’ (সূরাহ্ আল ‘আনকাবূত ২৯ : ৬৯)
নবী ও শাহীদগণ মর্যাদার উচ্চ আসনে থাকার পরেও পরস্পর পরস্পরকে আল্লাহর জন্য ভালোবাসা স্থাপনকারীদের মর্যাদা অবলোকনে এর প্রতি আশা করবে। অপরদিকে শাহীদগণ মর্যাদার উচ্চাসন লাভ করার পরও আশা করবেন যে, পরস্পর পরস্পরকে আল্লাহর জন্য ভালোবাসা স্থাপন কারীদের এ গুণ তারাও যদি অর্জন করতেন তাহলে তারা দু’ দিক দিয়ে মর্যাদা পেতেন। হাদীসের এ অংশটি দ্বারা নবী ও শাহীদগণের গিবতাহ্ উদ্দেশ্য, ঈর্ষা নয়। আর আল্লাহর জন্য পরস্পর পরস্পরকে ভালোবাসার গুণে গুনান্বিত ব্যক্তিদের মর্যাদার বিবরণ পেশ করা। (তুহফাতুল আহওয়াযী ৬ষ্ঠ খন্ড, হাঃ ২৩৯০)
পরিচ্ছেদঃ ১৬. প্রথম অনুচ্ছেদ - আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ভালোবাসা এবং আল্লাহ তা‘আলার জন্য বান্দার প্রতি ভালোবাসা
৫০০৭-[৫] উক্ত রাবী [আবূ হুরায়রা (রাঃ)] হতে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ এক ব্যক্তি তার কোন মুসলিম ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করার ইচ্ছায় রওয়ানা করল। সে আরেক গ্রামে থাকে। আল্লাহ তা’আলা রাস্তায় তার অপেক্ষায় একজন মালাক (ফেরেশতা) বসিয়ে দিলেন। সে যখন সেখানে পৌঁছল, মালাক জিজ্ঞেস করল, কোথায় যেতে ইচ্ছে করেছ? সে বলল, ঐ গ্রামে আমার ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করতে। মালাক বলল, তার কাছে তোমার কোন পাওনা আছে যে, তুমি তা আনবে? সে বলল, না, আমি শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তাকে ভালোবাসী। তখন মালাক বলল : আমি আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে তোমার কাছে প্রেরিত হয়েছি। আল্লাহ তোমাকে এ সুসংবাদ দিয়েছেন যে, আল্লাহ তা’আলাও তোমাকে অনুরূপ ভালোবাসেন, যেরূপ তুমি তাকে আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টির জন্য ভালোবেসেছ। (মুসলিম)[1]
بَابُ الْحُبِّ فِى اللهِ وَمِنَ اللهِ
وَعَنْهُ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَنَّ رَجُلًا زَارَ أَخًا لَهُ فِي قَرْيَةٍ أُخْرَى فَأَرْصَدَ اللَّهُ لَهُ عَلَى مَدْرَجَتِهِ مَلَكًا قَالَ: أَيْنَ تُرِيدُ؟ قَالَ: أُرِيدُ أَخًا لِي فِي هَذِهِ الْقَرْيَةِ. قَالَ: هَلْ لَكَ عَلَيْهِ مِنْ نِعْمَةٍ تَرُّبُّهَا؟ قَالَ: لَا غَيْرَ أَنِّي أَحْبَبْتُهُ فِي اللَّهِ. قَالَ: فَإِنِّي رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكَ بِأَنَّ اللَّهَ قَدْ أَحَبَّكَ كَمَا أَحْبَبْتَهُ فِيهِ . رَوَاهُ مُسلم
ব্যাখ্যাঃ (فَأَرْصَدَ اللهُ لَهٗ عَلٰى مَدْرَجَتِهِ مَلَكًا) তার চলাচলের রাস্তায় আল্লাহ তা‘আলা একজন মালাক নিযুক্ত করে দিলেন’’ এখানে চলাচলের পথকে المدرجة বলার কারণ হলো মানুষের এর উপর দিয়ে আস্তে আস্তে ক্রমান্বয়ে অগ্রসর হয়।
(بِأَنَّ اللهَ قَدْ أَحَبَّكَ كَمَا أَحْبَبْتَهُ فِيهِ) তুমি যেহেতু আল্লাহর উদ্দেশে তাকে ভালোবেসেছ, তাই আল্লাহ তা‘আলাও তোমাকে ভালোবেসেছেন। ‘আলিমগণ বলেন, ‘আল্লাহ বান্দাকে ভালোবাসেন’ এর অর্থ হলো আল্লাহ বান্দাকে দয়া করেন, তাকে কল্যাণ দান করেন। সুতরাং আল্লাহর ভালোবাসা অর্থ হলো আল্লাহর দয়া। আর বান্দাগণ পরস্পর পরস্পরকে ভালোবাসার অর্থ হলো একে অন্যের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া আল্লাহ এ থেকে মুক্ত। (শারহুন নাবাবী ১৬শ খন্ড, হাঃ ২৫৬৭)
পরিচ্ছেদঃ ১৬. প্রথম অনুচ্ছেদ - আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ভালোবাসা এবং আল্লাহ তা‘আলার জন্য বান্দার প্রতি ভালোবাসা
৫০০৮-[৬] ’আবদুল্লাহ ইবনু মাস্’ঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, জনৈক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খিদমাতে উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রসূল! ঐ ব্যক্তির ব্যাপারে আপনার কি অভিমত? যে কোন কওম বা দলকে ভালোবাসে; কিন্তু তাদের সাথে (কখনো) সাক্ষাৎ হয়নি। তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ সে ব্যক্তি তার সাথেই আছে, যাকে সে ভালোবাসে। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
بَابُ الْحُبِّ فِى اللهِ وَمِنَ اللهِ
وَعَنِ ابْنِ مَسْعُودٍ قَالَ: جَاءَ رَجُلٌ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ كَيْفَ تَقُولُ فِي رَجُلٍ أَحَبَّ قَوْمًا وَلَمْ يَلْحَقْ بِهِمْ؟ فَقَالَ: «المرءُ معَ من أحب» . مُتَّفق عَلَيْهِ
ব্যাখ্যাঃ (أَحَبَّ قَوْمًا) অর্থাৎ কোন ব্যক্তি যদি কোন কওম বা সম্প্রদায়কে ভালোবাসে, এ ভালোবাসা আল্লাহর ওয়াস্তে হওয়া চাই এবং যাকে ভালোবাসবে তার সৎ হওয়া চাই।
(وَلَمْ يَلْحَقْ بِهِمْ) কিন্তু তাদের সাথে তার কখনো সাক্ষাৎ হয়নি। ‘‘মিরকাত’’ গ্রন্থকার এর কয়েকটি অর্থ করেছেন- ১. তাদের সাহচর্য লাভ করেনি, ২. ‘ইলম বা বিদ্যায় তাদের সমপর্যায় পৌঁছেনি। ৩. ‘আমলে তাদের সমকক্ষ হয়নি। ৪. তাদের সাথে মিলিত হয়নি তথা তাদের দেখা পায়নি। তাদের কাজের মতো কাজও করেনি, শুধু তাদেরকে ভালোবাসে। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
(اَلْمَرْءُ مَعَ مَنْ أَحَبَّ) সে ব্যক্তি তার সাথেই আছে, যাকে সে ভালোবাসে, অর্থাৎ সে ব্যক্তি কিয়ামতের মাঠে তার ভালোবাসার ব্যক্তির সাথে সমবেত হবে। তার কাঙিক্ষত ব্যক্তির সে বন্ধুত্ব লাভ করবে। এ মর্মে মহান আল্লাহ বলেনঃ وَمَنْ يُّطِعِ اللهَ وَالرَّسُولَ فَأُولٰئِكَ مَعَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللهُ عَلَيْهِمْ ‘‘আর যে কেউ আল্লাহর হুকুম এবং তার রসূলের হুকুম মান্য করবে, তাহলে যাদের প্রতি আল্লাহর নি‘আমাত দান করেছেন, সে তাদের সঙ্গী হবে’’- (সূরাহ্ আন্ নিসা ৪ : ৬৯)। হাদীসটির এ অংশটুকু দ্বারা সৎ সঙ্গী খুঁজে তাদের সাথে চলার ইঙ্গিত বহন করে। যেমনটি অন্য হাদীসেও বলা হয়েছে- الْمَرْءُ عَلٰى دِينِ خَلِيلِه ‘‘ব্যক্তি তার বন্ধুর দীনের উপর থাকে’’। সুতরাং তোমাদের কোন ব্যক্তি কাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করছে সেটা যেন লক্ষ্য করে। (আবূ দাঊদ হাঃ ৪৮৩৩; আলবানী : হাসান)
আল জামি‘উস্ সগীরে আরেকটি হাদীস এসেছে, (اَلْمَرْءُ مَعَ مَنْ أَحَبَّ) কোন ব্যক্তি যাকে ভালোবাসে তার সাথে সে থাকবে (কিয়ামতের দিন)।
(আল জামি‘উস্ সগীর ৯১৯০, বুখারী ৬১৬৭, মুসলিম ৪/২০৩২, দারিমী ২৭৮৭, আহমাদ ৩/১৬৮)
হাদীস দ্বারা পরোক্ষভাবে বুঝা যায় যে, ‘আলিম-‘উলামা ও সৎ লোকেদেরকে ভালোবাসা জান্নাত লাভের অন্যতম মাধ্যম। পক্ষান্তরে জাহিল ও অসৎ এবং অমুসলিমদেরকে ভালোবাসা জাহান্নামে যাওয়ার অন্যতম কারণ।
পরিচ্ছেদঃ ১৬. প্রথম অনুচ্ছেদ - আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ভালোবাসা এবং আল্লাহ তা‘আলার জন্য বান্দার প্রতি ভালোবাসা
৫০০৯-[৭] আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। একদিন জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল : হে আল্লাহর রসূল! কিয়ামত কখন হবে? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ তোমার জন্য পরিতাপ। কিয়ামতের জন্য তুমি কী প্রস্তুত করেছ? সে জবাবে বলল, আমি কিছুই করিনি, তবে আমি আল্লাহ ও তাঁর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ভালোবাসী। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ তুমি তার সাথেই হবে যাকে তুমি ভালোবাসো। (রাবী) আনাস (রাঃ) বলেনঃ ইসলাম আবির্ভাবের পর মুসলিমদেরকে আমি কোন কথায় এতটা খুশি হতে দেখিনি, যতটা তারা খুশি হয়েছিল রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এ বাণীতে। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
بَابُ الْحُبِّ فِى اللهِ وَمِنَ اللهِ
وَعَنْ أَنَسٍ أَنَّ رَجُلًا قَالَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ مَتَى السَّاعَةُ؟ قَالَ: «وَيْلَكَ وَمَا أَعْدَدْتَ لَهَا؟» قَالَ: مَا أَعْدَدْتُ لَهَا إِلَّا أَنِّي أُحِبُّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ. قَالَ: «أَنْتَ مَعَ مَنْ أَحْبَبْتَ» . قَالَ أَنَسٌ: فَمَا رَأَيْتُ الْمُسْلِمِينَ فَرِحُوا بِشَيْءٍ بَعْدَ الْإِسْلَامِ فَرَحَهُمْ بِهَا. مُتَّفق عَلَيْهِ
ব্যাখ্যাঃ (مَتَى السَّاعَةُ) অর্থাৎ কিয়ামত কোন্ সময়ে সংগঠিত হবে? এ বাক্য দ্বারা কিয়ামতকে অস্বীকার করা বুঝাচ্ছে না বরং কিয়ামতের প্রতি অগাধ বিশ্বাস বুঝাচ্ছে। কিয়ামতের প্রতি দৃঢ় ঈমান থাকার কারণে ও তার ভয়ের কারণে সাহাবী রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে এ প্রশ্নটি করলেন।
(قَالَ: وَيْلَكَ) ‘তুমি ধ্বংস হও’, ‘তোমার জন্য পরিতাপ’ এ শব্দটি কখনো বদ্দু‘আ অর্থে ব্যবহার হয়ে থাকে। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মুখে সাহাবীর জন্য এ কথা বদ্দু‘আ ছিল না। এরপর তাকে পরীক্ষা করার জন্য বললেন, (مَا أَعْدَدْتَ لَهَا) ‘তুমি তার জন্য কি প্রস্তুত করেছ? উত্তরে সাহাবী বললেন, আমি কোন কিছু তৈরি করিনি। (إِلَّا أَنِّي أُحِبُّ اللهَ وَرَسُولَهٗ) তবে আমি আল্লাহ ও তার রসূলকে ভালোবাসী। এখানে সাহাবী কোন অন্য ‘আমলের কথা উল্লেখ করেননি। তিনি কোন অন্তরের ‘ইবাদাত, শারীরিক ‘ইবাদাত, কোন আর্থিক ‘ইবাদাতের কথা উল্লেখ করেননি। কেননা এসবগুলোই হলো ভালোবাসার (مَحَبَّةِ এর) শাখা। আর মুহাব্বাত বা ভালোবাসা হলো সবকিছুর চেয়ে উঁচু স্তরের ‘ইবাদাত। মহান আল্লাহ বলেন, يُحِبُّهُمْ وَيُحِبُّونَه ‘‘তিনি তাদেরকে ভালোবাসেন আর তারাও তাকে ভালোবাসে’’- (সূরাহ্ আল মায়িদাহ্ ৫ : ৫৪)। তিনি আরো বলেন, إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللّٰهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللهُ ‘‘তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসতে চাইলে আমার অনুসরণ কর, তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন’’- (সূরাহ্ আ-লি ‘ইমরা-ন ৩ : ৩১)। আর সাহাবীদের এটা ভালোভাবেই জানা ছিল যে, ভালোবাসা অনুসরণ করা ছাড়া অর্জিত হয় না, আর যে ‘ইবাদাত তাঁর অনুসরণ করা ব্যতীত করা হবে তাতে লাভ হবে না। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
أَنْتَ مَعَ مَنْ أَحْبَبْتَ ‘তার সাথে থাকবে যাকে তুমি ভালোবাস’ এ কথার অর্থ হলো কিয়ামতের দিন তুমি তার সাথে মিলিত হয়ে তাদের দলে থাকবে। এখানে একটা প্রশ্ন থাকে তা হলো মানুষের স্তর তো বিভিন্ন ধরনের, তবে সাথে থাকার বিষয়টি কেমন? এর উত্তরে বলা হয়েছে, সাথে থাকার অর্থ এক জায়গায় তথা কোন জিনিসের মধ্যে একত্রিত হওয়াকে বুঝায়নি। আর সাথে থাকার অর্থ এক জিনিসের মধ্যে একত্রিত হওয়া এটা ওয়াজিব করে না। বরং সকলে যখন জান্নাতে প্রবেশ করবে তখন সাথে থাকার অর্থ সত্যায়িত হবে। যদিও সেখানে অনেক স্তর আছে। (ফাতহুল বারী ১০ম খন্ড, হাঃ ৬১৬৭)
এখানে আল্লাহ তা‘আলা, তাঁর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সৎলোকেদেরকে ভালোবাসার ফাযীলাত বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ ও তাঁর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ভালোবাসা বলতে বুঝায় তাদের আদেশসমূহ পালন করা। তাদের নিষেধসমূহ হতে দূরে থাকা এবং ইসলামী শারী‘আতের শিষ্টাচার অনুযায়ী শিষ্টাচার শিক্ষা করা। (শারহুন নাবাবী ১৬শ খন্ড, হাঃ ২৬৩৯; মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ ১৬. প্রথম অনুচ্ছেদ - আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ভালোবাসা এবং আল্লাহ তা‘আলার জন্য বান্দার প্রতি ভালোবাসা
৫০১০-[৮] আবূ মূসা আল আশ্’আরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ সৎলোকের সাহচর্য ও অসৎলোকের সাহচর্য যথাক্রমে কস্তুরী বিক্রেতা (আতরওয়ালা) ও কর্মকারের হাপরে ফুঁক দেয়ার মতো। কস্তুরী বিক্রেতা হয়তো তোমাকে এমনিতেই কিছু দান করবে অথবা তুমি তার নিকট থেকে কিছু কস্তুরী ক্রয় করবে। আর অন্ততপক্ষ কিছু না হলেও তার সুঘ্রাণ তোমার অন্তর ও মস্তিষ্ককে সঞ্জীবিত করবে। পক্ষান্তরে হাপরে ফুঁকদানকারী তোমার কাপড় জ্বালিয়ে দেবে। আর কিছু না হলেও তার দুর্গন্ধ তুমি পাবে। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
بَابُ الْحُبِّ فِى اللهِ وَمِنَ اللهِ
وَعَنْ أَبِي مُوسَى قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَثَلُ الْجَلِيسِ الصَّالِحِ وَالسَّوْءِ كَحَامِلِ الْمِسْكِ وَنَافِخِ الْكِيرِ فَحَامِلُ الْمِسْكِ إِمَّا أَنْ يُحْذِيَكَ وَإِمَّا أَنْ تبتاعَ مِنْهُ وإِمَّا أَن تجدَ مِنْهُ رِيحًا طَيِّبَةً وَنَافِخُ الْكِيرِ إِمَّا أَنْ يَحْرِقَ ثيابَكَ وإِمَّا أنْ تجدَ مِنْهُ ريحًا خبيثةً» . مُتَّفق عَلَيْهِ
ব্যাখ্যাঃ এখানে সৎ বন্ধুর দৃষ্টান্ত দেয়া হয়েছে আতরওয়ালার সাথে। আতরওয়ালা নিজে আতরের ঘ্রাণ পায়। তার আশপাশের মানুষকেও সে ঘ্রাণে ভরিয়ে তোলে। সৎ সঙ্গ, ‘উলামাগণের সাথে চলার প্রতি দিক নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। কারণ এটি দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ করবে। পক্ষান্তরে অসৎ সঙ্গী ও ফাসিকদের সঙ্গী হতে দূরে থাকতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে, কারণ তারা দীন ও দুনিয়া উভয় ধ্বংস করে। সৎ সঙ্গী কল্যাণকর কিছু দেয়, আর অসৎ সঙ্গী অকল্যাণকর কিছু দেয়, যেমন বাতাস। যখন সে সুঘ্রাণের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয় তখন সে সুঘ্রাণপ্রাপ্ত হয় ও সুঘ্রাণ বিতরণ করে। আর যখন সে খারাপ দুর্গন্ধময় কোন কিছুর উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়, তখন সে দুর্গন্ধ লাভ করে এবং দুর্গন্ধ ছড়িয়ে দেয়। তাই তো মহান আল্লাহ সৎ মুক্তাক্বী সঙ্গী নির্বাচন করার নির্দেশ দিয়ে বলেন- يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَكُونُوا مَعَ الصَّادِقِينَ ‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সঙ্গী হও’’- (সূরাহ্ আত্ তাওবাহ্ ৯ : ১৮৯)। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
كَمَثَلِ صَاحِبِ الْكِيرِ ‘‘হাপরওয়ালার মতো’’। হাদীসের এ অংশটিতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসৎ বন্ধুর দৃষ্টান্ত দিয়েছেন হাপরওয়ালার সাথে, যার কাছ থেকে সর্বদা কিছু না কিছু অপকার হওয়া স্বাভাবিক হয় তার হাফর থেকে আগুনের স্ফুলিঙ্গ এসে তোমার কাপড়ে বা শরীরে পরবে আর না হয় কমপক্ষ ধুয়া এবং দুর্গন্ধ তো পাবেই। (‘আওনুল মা‘বূদ ৮ম খন্ড, হাঃ ৪৮২১)