পরিচ্ছেদঃ ৪. প্রথম অনুচ্ছেদ - মুরতাদ এবং গোলযোগ সৃষ্টিকারীকে হত্যা করা প্রসঙ্গে
৩৫৩৩-[১] ’ইকরিমাহ্ (রহঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন জনৈক নাস্তিককে ’আলী (রাঃ)-এর নিকট উপস্থিত করা হলো। তিনি তাদেরকে পুঁড়িয়ে ফেললেন (হত্যা করলেন)। এ সংবাদ যখন ইবনু ’আব্বাস (রাঃ)-এর নিকট পৌঁছল তখন তিনি বললেন, আমি যদি তদস্থলে থাকতাম তাহলে তাদেরকে পোড়াতাম না। কেননা রসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে যে, তোমরা আল্লাহর শাস্তি (আগুন) দ্বারা কাউকে শাস্তি দিয়ো না। নিশ্চয় আমি তাদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাত অনুযায়ী হত্যা করতাম। এ কারণে যে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, যে তার দীনকে পরিবর্তন করে, তাকে হত্যা কর। (বুখারী)[1]
بَابُ قَتْلِ أَهْلِ الرِّدَّةِ وَالسُّعَاةِ بِالْفَسَادِ
عَنْ عِكْرِمَةَ قَالَ: أُتِيَ عَلِيٌّ بِزَنَادِقَةٍ فَأَحْرَقَهُمْ فَبَلَغَ ذَلِكَ ابْنَ عَبَّاسٍ فَقَالَ: لَوْ كُنْتُ أَنَا لَمْ أُحْرِقْهُمْ لِنَهْيِ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَا تُعَذِّبُوا بِعَذَابِ اللَّهِ» وَلَقَتَلْتُهُمْ لِقَوْلِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَنْ بَدَّلَ دِينَهُ فَاقْتُلُوهُ» . رَوَاهُ الْبُخَارِيُّ
ব্যাখ্যা: زَنَادِقَةٌ শব্দটি زيديق এর বহুবচন। আবূ হাতিম আর অন্য কেউ বলেনঃ زنديق শব্দটি ফারসী ও ‘আরবীকৃত, এটা মূলত ছিল زنده كرداي অর্থাৎ কালের স্থায়িত্ব। কেননা তার কর্ম ও জীবন অমর।
কেউ কেউ বলেনঃ সব বিষয়ে সূক্ষ্মদর্শীকে زنديق (যিনদীক) বলা হয়। সা‘লাব বলেন, ‘আরবী ভাষায় زنديق কোনো শব্দ নেই। বরং তারা অধিক ষড়যন্ত্রকারীকে زنديق বলেন।
শাফি‘ঈ ফাকীহদের একটি দল এবং আরো অন্যরা বলেন- যারা ইসলামকে প্রকাশ করে এবং কুফরীকে গোপন রাখে তাকে زنديق বলা হয়।
ইমাম নববী বলেনঃ যে দীনকে গ্রহণ করে না তাকে যিনদীক বলা হয়।
মুহাম্মাদ বিন মা‘ন বলেনঃ যিনদীক হলো দ্বৈতবাদী যারা যুগের স্থায়িত্ব ও একের পর আরেকটি আসার মতবাদে অর্থাৎ পুনর্জন্মে বিশ্বাসী।
শাফি‘ঈদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী যিনদীক হলো মুনাফিক। তবে যিনদীক ও মুনাফিক এক নয়। বরং প্রত্যেক যিনদীক হলো মুনাফিক, কিন্তু প্রত্যেক মুনাফিক যিনদীক নয়। কারণ কিতাব ও সুন্নাহ মোতাবেক মুনাফিক ইসলামকে প্রকাশ করে কিন্তু মূর্তিপূজা ও ইয়াহূদীবাদকে গোপন করে। আর দ্বৈতবাদীরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে কেউ ইসলামকে প্রকাশ করতো না।
হাদীস থেকে প্রতীয়মান হয় যে, কাউকে পুড়িয়ে হত্যা করা যাবে না। কারণ যে হাদীসে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছু নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে পুড়িয়ে হত্যা করতে বলেছিলেন সেই হাদীসে আছে : «إِنَّ النَّارَ لَا يُعَذِّبُ بِهَا إِلَّا اللّٰهُ» ‘‘আল্লাহই আগুন দ্বারা শাস্তি দিবেন।’’
আবূ দাঊদে ইবনু মাস্‘ঊদ-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে : «أَنَّه لَا يَنْبَغِىْ أَنْ يُعَذِّبَ بِالنَّارِ إِلَّا رَبُّ النَّارِ»
অর্থাৎ আল্লাহ ব্যতিরেকে আর কারো জন্য আগুন দ্বারা শাস্তি দেয়া উচিত নয়।
ইমাম আবূ দাঊদ ও ইমাম দারাকুত্বনী نهى-কে النهى التنزيهى বলে অভিহিত করেছেন। যেমন এ ব্যাপারে ইমামদের মাঝে মতভেদ রয়েছে। হাদীসের রক্ষণাবেক্ষণমূলক মত হলো যখন ইমাম এ ব্যাপারে কঠোরতা অবলম্বন করতে চাইবে তখন ইচ্ছা করলে এটা বাস্তবায়ন করতে পারবে। যা অন্যান্য হাদীসে ‘আলী -এর কথায় ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
হাদীসে মুরতাদকে হত্যা করার প্রমাণ পাওয়া যায়। আর মুরতাদ চাই পুরুষ হোক বা মহিলা হোক সে হত্যার যোগ্য। হানাফী মাযহাবের অনুসারীগণ শুধু পুরুষকে হত্যার সাথে খাস করেছেন। আর মহিলাদেরকে হত্যা করতে নিষেধ মর্মে মত পেশ করেছেন। তারা এর দলীল হিসেবে একটি হাদীসকে উল্লেখ করেন। যেমন তাতে বলা হয়েছে, مَا كَانَتْ هٰذِه لِتُقَاتِلَ অর্থাৎ নিহত মহিলাকে দেখে বললেন, একে হত্যা করতে হতো না। অতঃপর মহিলা নিষিদ্ধ হয়ে যায়। হানাফীরা আরো বলেন যে, নিশ্চয় «من» হরফে শর্তটি উপরোক্ত হাদীস থাকার কারণে ব্যাপকভাবে মহিলাকে শামিল করে না।
জুমহূর মুহাদ্দিসীন এই نهى (নিষেধাজ্ঞা)-কে প্রাথমিক মহিলা কাফির যারা হত্যার সাথে সম্পৃক্ত নয় এবং যুদ্ধেও জড়িয়ে পড়েনি তাদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন। আর মহিলা মুরতাদকে হত্যা করার বিষয়ে মু‘আয -এর হাদীসে রয়েছে, যখন তাকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইয়ামানে পাঠালেন তাকে বললেনঃ أَيُّمَا امْرَأَةٍ ارْتَدَّتْ عَنِ الْإِسْلَامِ فَادْعُهَا فَإِنْ عَادَتْ وَإِلَّا فَاضْرِبْ عُنُقَهَا অর্থাৎ যে কোনো মহিলা ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করলে তাকে দা‘ওয়াত দাও, এতে যদি সে ফিরে আসে তাহলে আসলো। অন্যথায় তাকে হত্যা করো। হাদীসটির সানাদ হাসান পর্যায়ের। বিবদমান বিষয়ে এ হাদীসের গন্তব্যে প্রত্যাবর্তন করা ওয়াজিব। আর যিনা, চুরি, মদ্যপান, অপবাদের মতো প্রত্যেক শাস্তির ক্ষেত্রে মহিলা-পুরুষ যুক্ততা উপরোক্ত মহিলা মুরতাদকে হত্যার বিষয়টিকে আরো মজবুত করে দেয়।
আর বলা যায়, নিশ্চয় ইবনু ‘আব্বাস বলেন, মহিলা মুরতাদ হত্যাযোগ্য।
সকল সাহাবা (রাঃ) এবং আবূ বাকর স্বীয় খিলাফাতে মহিলা মুরতাদকে হত্যা করলে কেউ এটাকে মন্দ বলেননি। (ফাতহুল বারী ১২ তম খন্ড, হাঃ ৬৯২২)
আস্ সিনদী (রহঃ) বলেনঃ «مَنْ بَدَّلَ دِينَه» এর ব্যাপকতা পুরুষ-মহিলা উভয়কে শামিল করে। আর যারা যুদ্ধে মহিলা হত্যা নিষেধের কারণে এটাকে শুধু পুরুষের সাথে খাস করেছেন। তাদের এই খাসকরণে দুর্বলতার ইঙ্গিত স্পষ্ট। সুতরাং এ ব্যাপকতা মেনে নেয়া হাদীস পালনের অধিক নিকটতম পথ। আল্লাহই ভালো জানেন। (নাসায়ী ৪র্থ খন্ড, হাঃ ৪০৭১)
পরিচ্ছেদঃ ৪. প্রথম অনুচ্ছেদ - মুরতাদ এবং গোলযোগ সৃষ্টিকারীকে হত্যা করা প্রসঙ্গে
৩৫৩৪-[২] ’আব্দুল্লাহ ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ অবশ্যই আল্লাহ তা’আলা ছাড়া আগুন দিয়ে শাস্তি দেয়ার অধিকার কারো নেই। (বুখারী)[1]
بَابُ قَتْلِ أَهْلِ الرِّدَّةِ وَالسُّعَاةِ بِالْفَسَادِ
وَعَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَبَّاسٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسلم: «إِن النَّارَ لَا يُعَذِّبُ بِهَا إِلَّا اللَّهُ» . رَوَاهُ البُخَارِيّ
ব্যাখ্যা : দগ্ধ করানোর বিষয়ে সালাফীগণ মতভেদ করেছেন। তন্মধ্যে ‘উমার ও ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) কুফরী, যুদ্ধের সময় অথবা ক্বিসাসের ক্ষেত্রে পোড়ানোকে মাকরূহ মনে করেন।
পক্ষান্তরে ‘আলী (রাঃ), খালিদ বিন ওয়ালীদ (রাঃ) ছাড়াও অনেকেই পোড়ানো জায়িয বলেছেন।
আবুল মুযাফফার আল ইসফিরায়লী-এর সিদ্ধান্ত হলো, যাদেরকে ‘আলী পুড়িয়েছিলেন তারা ছিল রাফিযীদের একটা দল। তারা তাদের ‘আক্বীদায় অন্য ইলাহ-এর দাবী করেছিল। এদেরকে সাবাইয়্যাহ্ বলা হয়। এদের নেতা হলো ‘আবদুল্লাহ বিন সাবা।
মুহাল্লাব বলেনঃ এই নিষেধাজ্ঞা হারাম নিষেধাজ্ঞা নয়। বরং এটা বিনয়সূচক নিষেধাজ্ঞা। সাহাবীদের কর্ম পোড়ানোর বৈধতার নির্দেশ করে। খালিদ বিন ওয়ালীদ মুরতাদ মানুষকে পুড়িয়েছিল।
মদীনার অধিকাংশ বিদ্বান দুর্গ ও যানবাহন পোড়ানো জায়িয বলেন। এমন মত পেশ করেন ইমাম নববী ও ইমাম আওযা‘ঈ।
আর ইবনু মুনীর এবং অন্যরা বলেনঃ পোড়ানোর বৈধতার কোনো দলীল নেই। কেননা উরানীনদের ঘটনা ছিল ক্বিসাসের অথবা তা মানসূখ হয়ে গেছে। আর সাহাবীদের বৈধতা আর এক সাহাবীর নিষেধের বিরোধী হয়ে যায়। আর দুর্গ ও যানবাহন পোড়ানোর ঘটনাটি জরুরী প্রেক্ষাপটের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। আর তা হলো শত্রুদের ওপর বিজয় লাভ করা।
আবার কেউ বলেছেন- ঘটনাস্থলে কোনো মহিলা বা কোনো শিশু ছিল না। তবে হাদীসের বাহ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রমাণ করে যে, নিষেধাজ্ঞা ছিল হারাম, যা পূর্বের আলোচনায় মানসূখ হয়েছে। (ফাতহুল বারী ৬ষ্ঠ খন্ড, হাঃ ৩০১৬)
পরিচ্ছেদঃ ৪. প্রথম অনুচ্ছেদ - মুরতাদ এবং গোলযোগ সৃষ্টিকারীকে হত্যা করা প্রসঙ্গে
৩৫৩৫-[৩] ’আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেনঃ শীঘ্রই শেষ যুগে এমন কিছু লোকের উদ্ভব ঘটবে যারা হবে তরুণ যুবক এবং নির্বোধ। তারা সমাজে সর্বোত্তম কথা বলবে কিন্তু তাদের ঈমান তাদের গলধঃকরণ হবে না। তারা দীন হতে এমনভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে যেমন তীর ধনুক ভেদ করে বেরিয়ে যায়। অতএব তোমরা তাদেরকে যেখানে পাও হত্যা কর। কেননা তাদেরকে যারাই হত্যা করবে কিয়ামত দিবসে তারাই পুরস্কৃত হবে। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
بَابُ قَتْلِ أَهْلِ الرِّدَّةِ وَالسُّعَاةِ بِالْفَسَادِ
وَعَنْ عَلِيٍّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: «سَيَخْرُجُ قَوْمٌ فِي آخِرِ الزَّمَانِ حُدَّاثُ الْأَسْنَانِ سُفَهَاءُ الْأَحْلَامِ يَقُولُونَ مِنْ خَيْرِ قَوْلِ الْبَرِيَّةِ لَا يُجَاوِزُ إِيمَانُهُمْ حَنَاجِرَهُمْ يَمْرُقُونَ مِنَ الدِّينِ كَمَا يَمْرُقُ السَّهْمُ مِنَ الرَّمِيَّةِ فَأَيْنَمَا لَقِيتُمُوهُمْ فَاقْتُلُوهُمْ فَإِنَّ فِي قَتْلِهِمْ أَجْرًا لمن قَتلهمْ يَوْم الْقِيَامَة»
ব্যাখ্যা: (حُدَّاثُ الْأَسْنَانِ سُفَهَاءُ الْأَحْلَامِ) অর্থাৎ বয়সে ছোট এবং দুর্বলবুদ্ধি সম্পন্ন, তথা খাটো বুদ্ধির অল্পবয়স্ক। নিহায়াহ্ গ্রন্থে আছে যে, অল্পবয়স্ক বলতে পরোক্ষভাবে যুবকদেরকে বুঝানো হয়েছে।
(مِنْ خَيْرِ قَوْلِ الْبَرِيَّةِ) এর মমার্থ হলো কোনো বিষয়ের বাহ্যিক দিক। যেমন তাদের কথা (لَا حُكْمَ إِلَّا لِلّٰهِ) অর্থাৎ হুকুমাত একমাত্র আল্লাহর। এর উপমা তাদের ব্যবহৃত আল্লাহর কিতাবের প্রতি আহবান করার ক্ষেত্রে পাওয়া যাবে। (শারহে মুসলিম ৭ম খন্ড, হাঃ ১০৬৬)
‘আওনুল মা‘বূদে বলা হয়েছে, (مِنْ خَيْرِ قَوْلِ الْبَرِيَّةِ) অর্থাৎ সৃষ্টিজগত যে সব কল্যাণকর কথা বলে। আবার কেউ বলেন- এর অর্থ হলো কুরআন। আবার কোনো পাণ্ডুলিপিতে আছে এর অর্থ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। এ হাদীসটিতে খারিজীদেরকে এবং অত্যাচারী বাড়াবাড়িকারীদেরকে হত্যা করার নির্দেশ স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয়। এটা ‘আলিমদের ইজমা।
* কাযী বলেনঃ ‘আলিমগণ ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, খারিজীরাও এদের ন্যায় বিদ্‘আতী ও বাড়াবাড়িকারী যারা ইমামকে উপেক্ষা করে বের হয়ে যায়, দলের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে ও জামা‘আতের বিরুদ্ধাচরণ করে। তাদেরকে ভীতিপ্রদর্শনের ও কৈফিয়ত তলবের পর হত্যা করা ওয়াজিব। (শারহে মুসলিম ৭ম খন্ড, হাঃ ১০৬৬)
حَنَاجِرَ শব্দটি حَنْجَرَةٌ এর বহুবচন, এর অর্থ হলো হুলকুম বা কণ্ঠনালী। মুযহির বলেনঃ দীন থেকে বের হওয়ার অর্থ হলো ইমামের আনুগত্য থেকে বের হওয়া যা ফরয। নিহায়াতে বলা হয়েছে, এর অর্থ দীনের মধ্যে দাখিল হওয়া ও তা থেকে বের হওয়া। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ ৪. প্রথম অনুচ্ছেদ - মুরতাদ এবং গোলযোগ সৃষ্টিকারীকে হত্যা করা প্রসঙ্গে
৩৫৩৬-[৪] আবূ সা’ঈদ আল খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমার উম্মাতের মধ্যে দু’টি দল থাকবে। তন্মধ্যে আরও একটি (তৃতীয়) দল আবির্ভূত হবে। উম্মাতের প্রথম দু’টি দলের মাঝে যে দল হাকের অধিক নিকটবর্তী হবে, সে দল তৃতীয় দলকে হত্যা করবে। (মুসলিম)[1]
بَابُ قَتْلِ أَهْلِ الرِّدَّةِ وَالسُّعَاةِ بِالْفَسَادِ
وَعَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «يَكُونُ أُمَّتِي فِرْقَتَيْنِ فَيَخْرُجُ مِنْ بَيْنِهِمَا مَارِقَةٌ يَلِي قَتْلَهُمْ أولاهم بِالْحَقِّ» . رَوَاهُ مُسلم
ব্যাখ্যা: ‘আলী যে একজন ন্যায়পন্থী সঠিক ছিলেন এই হাদীসটি তার স্পষ্ট প্রমাণ। আর অন্য দলটি ছিল মু‘আবিয়াহ্ -এর অনুসারীবৃন্দ। তারা অত্যাচারী বাড়াবাড়িকারী তাবিলকারী ছিল। আর এতে এ কথাও দিবালোকের ন্যায় প্রমাণ হয় যে, নিশ্চয় ‘আলী ও মু‘আবিয়াহ্ উভয়ের দলই মু’মিন। তারা যুদ্ধের কারণে ঈমান থেকে বের হননি এবং পাপও করেননি। এটা আমাদের ও আমাদের অনুরূপদের ‘আকীদা। (শারহে মুসলিম ৭ম খন্ড, হাঃ ১৫২)
পরিচ্ছেদঃ ৪. প্রথম অনুচ্ছেদ - মুরতাদ এবং গোলযোগ সৃষ্টিকারীকে হত্যা করা প্রসঙ্গে
৩৫৩৭-[৫] জারীর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজে/হজ্জে বলেছেনঃ তোমরা আমার অবর্তমানে কাফিরের দলে প্রত্যাবর্তন করো না যে, পরস্পরে বিবাদে লিপ্ত হবে। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
بَابُ قَتْلِ أَهْلِ الرِّدَّةِ وَالسُّعَاةِ بِالْفَسَادِ
وَعَنْ جَرِيرٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي حَجَّةِ الْوَدَاعِ: «لَا تَرْجِعُنَّ بَعْدِي كُفَّارًا يَضْرِبُ بَعْضُكُمْ رِقَاب بعض»
ব্যাখ্যা: (لَا تَرْجِعُنَّ بَعْدِىْ كُفَّارًا) অর্থাৎ তোমরা আমার পরে কুফরীতে প্রত্যাবর্তন করো না। এর সাতটি অর্থ বলা যায়- ১. এটা অন্যায়ভাবে হালালকারীর ক্ষেত্রে কুফরী। ২. এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো নি‘আমাতকে এবং ইসলামী হককে অস্বীকার করা। ৩. সে কুফরীর নিকটবর্তী হয়ে যায় যা কুফরীতে নিয়ে যায় বা পৌঁছে দেয়। ৪. কাফিরদের ন্যায় কার্য সম্পাদন করে। ৫. এর দ্বারা উদ্দেশ্য ঈমানের হাকীকাত তথা মূল বিষয় এর অর্থ হচ্ছে, «لَا تَكْفُرُوا بَلْ دُومُوا مُسْلِمِينَ» তোমরা কুফরী করো না বরং সর্বদা মুসলিম থাকো। ৬. খত্ত্বাবী ও অন্যান্যরা বলেন- كُفَّار দ্বারা উদ্দেশ্য হলো অস্ত্রের পোশাক পরিধান করা। যেমন যখন কেউ অস্ত্র সজ্জিত হয় তখন তাকে বলা হয়- «تَكَفَّرَ الرَّجُلُ بِسِلَاحِه» আযহারী তাঁর ‘‘তাহযীবুল লুগাহ্’’ নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেন, হাতিয়ার বা অস্ত্র পরিধানকারীকে কাফির বলা হয়। ৭. খত্ত্বাবী বলেনঃ এর অর্থ হলো তোমাদের কেউ যেন অন্যকে কাফির না বলে, এতে তারা পরস্পরে একে অন্যের সাথে যুদ্ধ করা হালাল মনে করবে। এসব অর্থের মধ্যে উপযুক্ত অর্থ হলো ৪র্থ মতটি যেটা কাযী ‘ইয়ায-এর পছন্দনীয় মত।
(لَا تَرْجِعُنَّ بَعْدِىْ) এর অর্থ কাযী ‘ইয়ায ও ত্ববারী বলেন- আমার পর বলতে আমার এই স্থান থেকে চলে যাওয়ার পর। অথবা এর অর্থ হবে خلافى তোমাদেরকে যার নির্দেশ দিয়েছি সেটা ব্যতীত অন্য কিছুকে আমার পশ্চাদবর্তী করো না। (শারহে মুসলিম ২য় খন্ড, হাঃ ১১৮)
এই হাদীসের ব্যাখ্যায় তুহফাতুল আহওযায়ীতে বলা হয়েছে, তোমরা আমার মৃত্যুর পর কর্মকা-- কাফিরদের সাদৃশ্যশীল হয়ো না।
الجمع (আল জাম্‘ই) গ্রন্থে বলা হয়েছে : আমার মৃত্যুর পর তোমরা প্রথমত যুদ্ধকে হালাল মনে করো না এবং যুদ্ধক্ষেত্রে কাফিরদের সাথে সাদৃশ্য রেখো না। (তুহফাতুল আহওয়াযী ৬ষ্ঠ খন্ড, হাঃ ২১৯)
পরিচ্ছেদঃ ৪. প্রথম অনুচ্ছেদ - মুরতাদ এবং গোলযোগ সৃষ্টিকারীকে হত্যা করা প্রসঙ্গে
৩৫৩৮-[৬] আবূ বকরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ দু’জন মুসলিম যখন পরস্পরে বিবাদে লিপ্ত হয়ে একজন অপরজনের ওপর অস্ত্র ধারণ করে তাহলে তারা উভয়ে জাহান্নামের দাঁরপ্রান্তে উপনীত হবে। অতঃপর যদি একজন অপরজনকে হত্যা করে বসে, তাহলে তারা উভয়ে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।
অপর বর্ণনাতে রয়েছে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ যখন দু’জন মুসলিম তরবারি নিয়ে পরস্পর মুখোমুখি হয় তখন হত্যাকারী ও নিহত ব্যক্তি উভয়ই জাহান্নামী হয়। আমি বললাম, হত্যাকারীর বিষয়টিতো পরিষ্কার; কিন্তু নিহত ব্যক্তি এমন (জাহান্নামী) হলো কেন? অতঃপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, কেননা সেও তার সঙ্গীকে হত্যা করার আকাঙ্ক্ষায় ছিল। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
بَابُ قَتْلِ أَهْلِ الرِّدَّةِ وَالسُّعَاةِ بِالْفَسَادِ
وَعَنْ أَبِي بَكْرَةَ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «إِذَا الْتَقَى الْمُسْلِمَانِ حَمَلَ أَحَدُهُمَا عَلَى أَخِيهِ السِّلَاحَ فَهُمَا فِي جُرُفِ جَهَنَّمَ فَإِذَا قَتَلَ أَحَدُهُمَا صَاحِبَهُ دَخَلَاهَا جَمِيعًا» . وَفِي رِوَايَةٍ عَنْهُ: قَالَ: «إِذَا الْتَقَى الْمُسْلِمَانِ بسيفهما فَالْقَاتِلُ وَالْمَقْتُولُ فِي النَّارِ» قُلْتُ: هَذَا الْقَاتِلُ فَمَا بَالُ الْمَقْتُولِ؟ قَالَ: «إِنَّهُ كَانَ حَرِيصًا عَلَى قَتْلِ صَاحِبِهِ»
ব্যাখ্যা: আবূ বাকরাহ্ এ হাদীসটি উষ্ট্রের যুদ্ধের সময় আহনাফ বিন কায়সকে লক্ষ্য করে বর্ণনা করেন। এ যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিল ‘আলী ও তার সাহাবীদের সাথে উম্মুল মু’মিনীন ‘আয়িশাহ্ (রাঃ) ও তার সাহাবীদের। এই যুদ্ধকে উষ্ট্রের যুদ্ধ বলার কারণ হলো সেদিন ‘আয়িশাহ্ (রাঃ) উটের উপর সওয়ার ছিলেন। এজন্য এর নাম হয় উষ্ট্রের যুদ্ধ।
(فِى النَّارِ) এর ব্যাখ্যা ‘আল্লামা ইবনু হাজার ‘আস্ক্বালানী বলেনঃ যদি আল্লাহ তাদের জন্য এ বিষয়টি কার্যকর করে থাকেন তবে উভয়ে এমন কার্য সম্পাদন করে যাতে তারা শাস্তির উপযুক্ত হয়ে যাবে।
বাকিল্লানী এ হাদীসকে প্রমাণস্বরূপ পেশ করে বলেন যে, যে ব্যক্তি কোনো পাপ কর্মের ইচ্ছা পোষণ করবে আর তা কাজে পরিণত না করলেও গুনাহগার হবে। কিন্তু যারা এর বিরোধিতা করে তারা এই হাদীসের জবাবে বলেন, এটা কাজের সাথে সম্পৃক্ত। আর যে ব্যক্তি ইচ্ছা পোষণ করে, অতঃপর দৃঢ় সংকল্প করে অথচ করে না, সে গুনাহগার হবে কিনা, মতভেদ রয়েছে।
কুসতুলানীও অনুরূপ মত পোষণ করেন। তিনি বলেনঃ এটা কাজের সাথে জড়িত। আর তা হচ্ছে অস্ত্র নিয়ে পরস্পরের সম্মুখীন হওয়া এবং যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া। ঘাতক ও নিহত ব্যক্তি জাহান্নামে একই স্তরের হওয়া অবশ্যক নয়। সুতরাং ঘাতককে যুদ্ধ করা ও হত্যা করার শাস্তি দেয়া হবে। আর নিহত ব্যক্তিকে শুধু যুদ্ধের জন্য শাস্তি দেয়া হবে। তাই বুঝা গেলো যে, শুধু ইচ্ছা পোষণ করার জন্য শাস্তি দেয়া হয়নি। (‘আওনুল মা‘বূদ ৭ম খন্ড, হাঃ ৪২৬২)
* খত্ত্বাবী বলেনঃ এই শাস্তির বিধান প্রযোজ্য এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রে যে দুনিয়াবী শত্রুতার নিমিত্তে যুদ্ধ করে অথবা রাজত্ব কামনা করে। সুতরাং যে অত্যাচারী অথবা আক্রমণকারীর সাথে যুদ্ধ করে তার ওপর শাস্তি প্রযোজ্য নয়। কেননা এক্ষেত্রে শারী‘আতের নির্দেশ রয়েছে। (ফাতহুল বারী ১২তম খন্ড, হাঃ ৬৮৭৫)
কোনো মুহাদ্দিস বলেনঃ হত্যাকারী ও নিহত উভয়ে জাহান্নামী এক্ষেত্রে কোনো ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। তাদের যুদ্ধ স্বার্থবাদী হওয়ায় উভয়ে জাহান্নামে দাখিল হওয়ার যোগ্য। কখনো এর জন্য শাস্তি দেয়া হয় কখনো আল্লাহ মাফ করে দেন। এটা আহলে হকদের অভিমত।
সাহাবীগণের মাঝে যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল তা এই শাস্তির অন্তর্ভুক্ত নয়। আহলুস্ সুন্নাহ্ ও আহলুল হকদের ‘আকীদা হলো তাদের প্রতি সুধারণা রাখা। আর তাদের মাঝে ঘটে যাওয়া বিষয়াবলীকে এবং তাদের পরস্পর যুদ্ধের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ থেকে বিরত থাকা। তারা ইজতিহাদ করেছেন এবং ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু এগুলো তারা পাপের উদ্দেশে বা দুনিয়া লাভের উদ্দেশে করেননি। বরং তাদের প্রত্যেকেই মনে করতো যে, তারা ন্যায়পন্থী সত্যবাদী এবং প্রতিপক্ষরা অন্যায়কারী ও বাড়াবাড়িকারী। এভাবেই তাদের মাঝে আল্লাহর বিধানের প্রতি প্রত্যাবর্তন করতে গিয়ে যুদ্ধ অবধারিত হয়ে যায়। তাদের কেউ ছিলেন সঠিক, আবার কেউ ভুল-ত্রুটির ক্ষেত্রে অপারগ হওয়াই বেঠিক। কেননা এটা হয়েছে ইজতিহাদের কারণে। আর মুজতাহিদ যখন ভুল করে তখন তার গুনাহ হয় না। আহলুস্ সুন্নাহ্-এর মত হলো ‘আলী ঐ যুদ্ধে সঠিক ও ন্যায়পন্থী ছিলেন। আর সমস্যাটা ছিল সংশয়পূর্ণ। এমনকি সাহাবীদের একটি দল এই বিষয়ে দিশেহারা এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। ফলে তারা উভয় দল থেকে বিরত ছিলেন এবং যুদ্ধে জড়াননি। আর নিশ্চিতভাবে সঠিকতা বুঝতে পারেননি। অবশেষে তারা তাদেরকে সহযোগিতা থেকে পিছু হটেছিলেন। (শারহে মুসলিম ১৮তম খন্ড, হাঃ ১৪)
পরিচ্ছেদঃ ৪. প্রথম অনুচ্ছেদ - মুরতাদ এবং গোলযোগ সৃষ্টিকারীকে হত্যা করা প্রসঙ্গে
৩৫৩৯-[৭] আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট ’উকল সম্প্রদায়ের কিছু লোক উপস্থিত হলো। অতঃপর তারা ইসলাম গ্রহণ করল। কিন্তু মদীনার আবহাওয়া তাদের জন্য অনুপযোগী হলো। অতএব তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাদেরকে সাদাকার উটনীর নিকট গিয়ে তার দুধ ও প্রস্রাব পানের নির্দেশ দিলেন। ফলে তারা নির্দেশ পালনার্থে সুস্থ হয়ে উঠল। কিন্তু তারা সুস্থ হয়ে মুরতাদ হয়ে গেল এবং তারা রাখালদেরকে হত্যা করে উটগুলো হাঁকিয়ে নিল। তিনি (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এ সংবাদ শুনে) তাদের পেছনে লোক পাঠালেন। অতঃপর তাদেরকে ধরে আনা হলে তাদের দু’ হাত ও দু’ পা কেটে ফেললেন এবং তাদের চোখ ফুঁড়ে দিলেন, তারপর তাদের রক্তক্ষরণস্থলে দাগালেন না, যাতে তারা মৃত্যুবরণ করে।
অপর বর্ণনাতে রয়েছে, লোকেরা তাদের চোখে লৌহ শলাকা দিয়ে মুছে দিল। অন্য বর্ণনাতে আছে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) লৌহ শলাকা আনার হুকুম করলেন, যাকে গরম করা হলো এবং তাদের চোখের উপর মুছে দেয়া হলো। অতঃপর তাদেরকে উত্তপ্ত মাটিতে ফেলে রাখলেন। তারা পানি চাইল কিন্তু তাদেরকে পানি পান করানো হয়নি। পরিশেষে তারা এ করুণ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করল। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
بَابُ قَتْلِ أَهْلِ الرِّدَّةِ وَالسُّعَاةِ بِالْفَسَادِ
وَعَن أَنَسٍ قَالَ: قَدِمَ عَلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نَفَرٌ مِنْ عُكْلٍ فَأَسْلَمُوا فَاجْتَوَوُا الْمَدِينَةَ فَأَمَرَهُمْ أَنْ يَأْتُوا إِبِلَ الصَّدَقَةِ فَيَشْرَبُوا مِنْ أَبْوَالِهَا وَأَلْبَانِهَا فَفَعَلُوا فَصَحُّوا فَارْتَدُّوا وَقَتَلُوا رُعَاتَهَا وَاسْتَاقُوا الْإِبِلَ فَبَعَثَ فِي آثَارِهِمْ فَأُتِيَ بِهِمْ فَقَطَعَ أَيْدِيَهُمْ وَأَرْجُلَهُمْ وَسَمَلَ أَعْيُنَهُمْ ثُمَّ لَمْ يَحْسِمْهُمْ حَتَّى مَاتُوا . وَفِي رِوَايَةٍ: فَسَمَّرُوا أَعْيُنَهُمْ وَفِي رِوَايَةٍ: أَمَرَ بِمَسَامِيرَ فَأُحْمِيَتْ فَكَحَّلَهُمْ بِهَا وَطَرَحَهُمْ بِالْحَرَّةِ يَسْتَسْقُونَ فَمَا يُسْقَوْنَ حَتَّى مَاتُوا
ব্যাখ্যা: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট ‘উক্ল ও ‘উরায়নাহ্ গোত্রের লোকজন আগমন করলো, অতঃপর ইসলাম গ্রহণ করলো। কোনো বর্ণনায় ‘উক্ল এবং ‘উরায়নাহ্ উভয়টি উল্লেখ আছে। আবার কোনো বর্ণনায় শুধু ‘উক্ল আছে এবং কোনো বর্ণনায় শুধু ‘উরায়নাহ্ উল্লেখ আছে। যেই বর্ণনায় ‘উক্ল ও ‘উরায়নাহ্ উভয়টি অছে সেটি সর্বাধিক সঠিক।
আবূ আওয়ানাহ্ ও ত্ববারানী বর্ণনা করেন যে, তাদের চারজন ছিল ‘উরায়নাহ্ গোত্রের এবং তিনজন ছিল ‘উক্ল গোত্রের। তারা মদীনায় এসে ইসলাম গ্রহণ করে তথাকার বাতাস ও পানিকে পছন্দসই মনে করলো না। অন্য বর্ণনায় আছে, তারা মদীনার আবহাওয়াকে অস্বাস্থ্যকর মনে করলো। ফলে রোগে আক্রান্ত হওয়ায় তাদের পেট ফুলে যায়। (তুহফাতুল আহওয়াযী ১ম খন্ড, হাঃ ৭২)
তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এই অভিযোগ করলে তিনি দুগ্ধবতী সাদাকার উটের কাছে যেতে বললেন। সহীহ মুসলিম ব্যতীত অন্য বর্ণনায় রসূলের উটের কথা উল্লেখ আছে। উভয় বর্ণনাই সহীহ।
কেউ কেউ সমন্বয়ের ক্ষেত্রে দু‘টি সমাধানের পথ বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একটি উট ছিল যাকে এবং সাদাকার উটকে একই দিকে চরানো হতো। তাই এতদুভয়ের প্রত্যেকটিকে অন্যটির উপর বুঝানো হতো।
কেউ কেউ বলেনঃ বরং প্রত্যেকটি উটই সাদাকার উট। এখানে সম্বন্ধটি হচ্ছে অধীনতার সম্বন্ধ। কারণ তা মালিকের অধিনস্থ থাকে।
ইমাম মালিক, আহমাদ এবং সালাফীদের একটি দল গোশ্ত/গোশত ভক্ষণযোগ্য প্রাণীর মূত্র পবিত্র হওয়ার দলীল হিসেবে এই হাদীসকে পেশ করেন। পক্ষান্তরে ইমাম আবূ হানীফাহ্, শাফি‘ঈ ও আর একটি দল গোশত ভক্ষণযোগ্য হোক না হোক সব প্রাণীর মূত্র অপবিত্র বলে মত পোষণ করেন। তারা এর প্রমাণ স্বরূপ আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত «اسْتَنْزِهُوا مِنَ الْبَوْلِ فَإِنَّ عَامَّةَ عَذَابِ الْقَبْرِ مِنْهُ» হাদীসকে এবং বুখারী ও মুসলিমে ইবনু ‘আব্বাস থেকে বর্ণিত, مَرَّ النَّبِيُّ ﷺ بِقَبْرَيْنِ فَقَالَ إِنَّهُمَا لَيُعَذَّبَانِ وَمَا يُعَذَّبَانِ فِي كَبِيرٍ أَمَّا أَحَدُهُمَا فَكَانَ لَا يَسْتَتِرُ مِنَ الْبَوْل ও আবূ ইয়া‘লা থেকে বর্ণিত «إِنَّ اللّٰهَ لَمْ يَجْعَلْ شِفَاءَ أُمَّتِي فِيمَا حُرِّمَ عَلَيْهَا» হাদীসকে পেশ করেন। বর্ণিত উল্লেখিত হাদীসের উত্তরে তুহফাতুল আহওয়াযী-এর লেখক বলেন- হাদীসে الْبَوْل থেকে উদ্দেশ্য হলো মানুষের পেশাব। কেননা সহীহুল বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে- «كَانَ لَا يَسْتَتِرُ مِنَ بَوْلِه»তিনি শুধু মানুষের পেশাবকে উল্লেখ করেছেন। তাহলে বুঝা গেল, الْبَوْل এর الْ হচ্ছে عهد خارجى। সুতরাং এর «لَا يَسْتَتِرُ مِنَ بَوْل» অর্থ হলো মানুষের পেশাব। সব প্রাণীর পেশাব উদ্দেশ্য নয়। সুতরাং যারা এটাকে ‘আম্ গণ্য করছে এই হাদীসে তাদের কোনো প্রমাণ নেই।
আর আবূ ইয়া‘লা-এর হাদীসের উত্তরে বলেনঃ এ হাদীসটি বেছে নেয়ার স্বাধীনতা বা স্বেচ্ছামূলক অবস্থার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। জরুরী অবস্থার ক্ষেত্রে নয়। সুতরাং বাধ্যগত অবস্থায় এটা হারাম নয়। যেমন মৃত প্রাণীর গোশত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন- قَدْ فَصَّلَ لَكُمْ مَا حَرَّمَ عَلَيْكُمْ إِلَّا مَا اضْطُرِرْتُمْ إِلَيْهِ ‘‘তোমাদের জন্য যা হারাম করা হয়েছে তা তোমাদের জন্য বিশদভাবে বাতলে দেয়া হয়েছে।’’ (সূরা আল আন্‘আম ৬ : ১১৯)
আরো হাদীসে বর্ণিত হয়েছে- «لَا بَأْسَ بِبَوْلِ مَا يُؤْكَلُ لَحْمُه» ‘‘গোশ্ত/গোশত ভক্ষণযোগ্য প্রাণীর মূত্র দোষের কিছু নয়’’ ও জাবির-এর হাদীস «مَا أُكِلَ لَحْمُهُ فَلَا بَأْسَ بِبَوْلِه» ‘‘গোশ্ত/গোশত ভক্ষণযোগ্য প্রাণীর মূত্র দোষের কিছু নয়’’ তবে ত্ববারানী-এর এই হাদীস দু’টি য‘ঈফ। এছাড়া বকরীর আস্থাবলে সালাত আদায় করার অনুমতি হাদীসে রয়েছে। আর পেশাব যদি পবিত্র না হতো তবে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দ্বারা চিকিৎসা নিতে বলতেন না। (তুহফাতুল আহওয়াযী ১ম খন্ড, হাঃ ৭২)
কাযী ‘ইয়ায আপত্তি করে বলেনঃ মুসলিমরা ঐকমত্য করেছেন যে, যার হত্যা ওয়াজিব সে পানি চাইলে তা নিষেধ করা যাবে না। কারণ এতে শাস্তি দ্বিগুণ হয়ে যাবে। এর উত্তরে তিনি বলেন, আমাদের সাথীগণ বলেন- যার নিকটে পবিত্রতা অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় পানি থাকে তার জন্য তৃষ্ণার কারণে মৃত্যুর ভয়ে মুরতাদ কে পানি পান করানো এবং তায়াম্মুম করা জায়িয নয়। তবে তিরস্কৃত অথবা চতুষ্পদ প্রাণীকে পানি পান করানো ওয়াজিব।
ইমাম নববী বলেনঃ যদি মুরতাদ পিপাসায় মরে যায় তবুও সে তায়াম্মুম না করে পানি ব্যবহার করবে।
খত্ত্বাবী বলেনঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সাথে এরূপ আচরণ করেছিলেন এজন্য যে, তিনি এর দ্বারা মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন।
কেউ বলেন, তাদেরকে পিপাসায় কাতর করার রহস্য হলো তারা উটের দুধ পানের নি‘আমাতকে অস্বীকার করেছিল। যা তাদেরকে ক্ষুধামন্দা ও অস্বাস্থ্যকর থেকে রোগ মুক্তি দান করে। এর আর একটি কারণ ছিল যারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পরিবারকে পিপাসার্ত করেছিল তাদের জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বদ্দু‘আ করেছিলেন। সেই ঘটনা নাসায়ীতে বর্ণিত আছে। সুতরাং সম্ভাবনা আছে যে, তারা যে রাত্রের স্বাভাবিক অভ্যাস অনুযায়ী রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট উটের দুধ পাঠানোর নিয়ম চালু করেছিল যেটাকে তারা সেই রাত্রিতে বন্ধ করে দিয়েছিল। যেমন ইবনুল সা‘দ উল্লেখ করেন যা হাফিয ফাতহুল ওয়াদূদে উল্লেখ করেন।
অথবা বলা হয় কিসাস স্বরূপ তাদের সাথে এরূপ আচরণ করা হয়েছিল। কারণ তারা এরূপ আচরণ রাখালদের সাথে করেছিল। অথবা তাদের মারাত্মক অপরাধ করার কারণে তারা ঐ শাস্তির শিকার হয়েছিল যা আবূ কাতাদাহ-এর বক্তব্যের ইঙ্গিতে বুঝা যায়। (‘আওনুল মা‘বূদ ৭ম খন্ড, হাঃ ৪৩৫৬)