পরিচ্ছেদঃ ৭. তৃতীয় অনুচ্ছেদ - মোহর
৩২০৮-[৭] উম্মু হাবীবাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি ’আব্দুল্লাহ ইবনু জাহশ-এর (বিবাহিতা) স্ত্রী ছিলেন। তার স্বামী ’আব্দুল্লাহ ইবনু জাহশ হাবশায় (পূর্ব নাম আবিসিনিয়া, বর্তমানে ইথিওপিয়া) মৃত্যুবরণ করেন। অতঃপর হাবশার সম্রাট নাজাশী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে উম্মু হাবীবাহ্ (রাঃ)-কে বিবাহ দেন এবং তাঁর পক্ষ হতে চার হাজার দিরহাম মোহর হিসেবে দান করেন।
অপর বর্ণনায় আছে, চার দিরহাম (মোহর দিয়েছেন), অতঃপর শুরাহবীল ইবনু হাসানাহ্-এর সাথে উম্মু হাবীবাহ্ (রাঃ)-কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খিদমাতে পাঠিয়ে দেন। (আবূ দাঊদ, নাসায়ী)[1]
عَنْ أُمِّ حَبِيبَةَ: أَنَّهَا كَانَتْ تَحْتَ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ جَحْشٍ فَمَاتَ بِأَرْضِ الْحَبَشَةِ فَزَوَّجَهَا النَّجَاشِيُّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَأَمْهَرَهَا عَنهُ أَرْبَعَة آلَاف. وَفِي رِوَايَة: أَرْبَعَة دِرْهَمٍ وَبَعَثَ بِهَا إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَعَ شُرَحْبِيل بن حَسَنَة. رَوَاهُ أَبُو دَاوُد وَالنَّسَائِيّ
ব্যাখ্যা: উম্মু হাবীবাহ্ বিনতু আবূ সুফ্ইয়ান ছিলেন রসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর সম্মানিত স্ত্রীদের একজন। তার আসল নাম ছিল রমালাহ্, কেউ কেউ বলেছেন তার নাম ছিল হিন্দ। মায়ের নাম ছিল সফিয়্যাহ্ বিনতু আবুল ‘আস, স্বামীর নাম ‘উবায়দুল্লাহ ইবনু জাহ্শ। অত্র হাদীসে স্বামীর নাম ‘আবদুল্লাহ উল্লেখ হয়েছে, এটা সঠিক নয় বরং ‘উবায়দুল্লাহই সঠিক।
উম্মু হাবীবাহ্ (রাঃ)-এর স্বামী ‘উবায়দুল্লাহ-এর সাথে হাবশায় দ্বিতীয়বারের মতো হিজরত করেন। স্বামী সেখানে গিয়ে ইসলাম ত্যাগ করে খৃষ্টধর্ম গ্রহণ কনে এবং মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু এই মহীয়সী রমণী ইসলামের উপর অটল ও অবিচল থাকেন, অতঃপর হাবশার বাদশাহ নাজাশী নিজে অভিভাবক হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে তার বিবাহ সম্পাদন করে দেন।
নাজাশী হাবাশার বাদশাহর উপাধি, তার আসল নাম হলো আমিন আসহামাহ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দা‘ওয়াত পত্র পেয়ে তিনি নিজ জন্মভূমিতেই ইসলাম গ্রহণ করে মুসলিম হয়েছিলেন, কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে সাক্ষাতের সুযোগ পাননি। কেউ কেউ তাকে সাহাবীদের অন্তর্ভুক্ত করেন তা সঠিক নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং ইসলামের প্রতি ছিল তার অপরিসীম ভালোবাসা। তাই মক্কার কুরায়শদের অত্যাচার থেকে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুইবার মুসলিমদেরকে তার রাজ্যে পাঠিয়েছিলেন, তিনিও মাযলূম মুসলিমদের রাষ্ট্রীয়ভাবে আশ্রয় ও নিরাপত্তা দিয়ে ধন্য করেছিলেন।
বাদশাহ নাজাশী উম্মু হাবীবাহ্ (রাঃ)-এর যাবতীয় মোহর স্বয়ং নিজেই আদায় করেন। এই মোহরের পরিমাণ ছিল চার হাজার দিরহাম মতান্তরে চার হাজার দীনার, মতান্তরে চার দিরহাম।
উম্মু হাবীবাহ্ (রাঃ)-এর বিবাহের স্থান এবং সময় নিয়ে কিছুটা মতপার্থক্য রয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন, নবূওয়াতের ষষ্ঠ বছরে হাবশাতেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে তার বিবাহ সম্পাদিত হয়েছে। এক বর্ণনায় রয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘আমর ইবনু উমাইয়াহ্ আয্ যামিরী -কে উম্মু হাবীবাহ্ (রাঃ)-এর বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে নাজাশীর নিকট প্রেরণ করেন। এ প্রস্তাব পেয়ে বাদশাহ নিজেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে তাকে বিয়ে দিয়ে দেন এবং চারশত দীনার মোহর তার নিজের পক্ষ থেকে পরিশোধ করে দেন। অতঃপর বেশ কিছু উপঢৌকন সহ শুরাহবীল ইবনু হাসানাহ্-এর সাথে তাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খিদমাতে প্রেরণ করেন।
আরো বর্ণিত আছে, একদা বাদশাহ নাজাশী উম্মু হাবীবাহ্ (রাঃ)-এর নিকট আবরাহা নামক দাসীকে প্রেরণ করলেন, দাসী গিয়ে তাকে বললেন, বাদশাহ আপনাকে বলেছেন, ‘‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার নিকট পত্র লিখে পাঠিয়েছেন, আমি যেন তোমাকে (তার সাথে) বিয়ে দিয়ে দেই।’’
খালিদ ইবনু সা‘ঈদ ছিলেন উম্মু হাবীবাহ্ -এর পিতার চাচাত ভাই, সেই ভিত্তিতে দূর সম্পর্কীয় চাচা। বিয়ের প্রস্তাব শুনেই উম্মু হাবীবাহ্ (রাঃ) তার ঐ চাচাকে ডেকে এনে বিয়ের কার্য সম্পাদনের জন্য উকীল নিযুক্ত করলেন, আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে তার বিয়ের এই সুসংবাদ দানের কারণে আনন্দে বাদশাহর দাসী আবরাহাকে নিজের হাতের দু’টি চুড়ি এবং আংটি খুলে বখশিস দিলেন।
সন্ধ্যায় বাদশাহ নাজাশী বিয়ের আয়োজন করলেন, এজন্য তিনি জা‘ফার ইবনু আবূ ত্বালিব এবং সেখানে অবস্থানরত মুসলিমদের উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ প্রদান করলেন। যথাসময়ে লোকজন উপস্থিত হলে বাদশাহ উম্মু হাবীবাহ্ (রাঃ)-এর বিবাহের খুৎবা নিজেই পাঠ করলেন।
খুৎবার কিছু অংশ ছিল নিম্নরূপঃ
اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ الْمَلِكِ الْقُدُّوسِ السَّلَامِ الْمُؤْمِنِ الْمُهَيْمِنِ الْعَزِيزِ الْجَبَّارِ أَشْهَدُ أَنْ لَّا إِلٰهَ إِلَّا اللّٰهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُه وَرَسُولُه أَرْسَلَه بِالْهُدٰى وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَه عَلَى الدِّينِ كُلِّه وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ، أَمَّا بَعْدُ فَقَدْ أَجَبْتُ إِلٰى مَا دَعَا إِلَيْهِ رَسُولُ اللّٰهِ - ﷺ - وَقَدْ أَصْدَقْتُهَا أَرْبَعَمِائَةٍ دِينَارٍ ذَهَبًا
খুৎবা শেষে বাদশাহ উপস্থিত সকলের জন্য প্রচুর স্বর্ণমুদ্রা ঢেলে দিলেন। এরপর খালিদ ইবনু সা‘ঈদ কথা বললেন এবং বাদশাহর খুৎবার ন্যায় খুৎবা পাঠ করলেন, অতঃপর বললেন, হে বাদশাহ নামদার! আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপনাকে যেদিকে আহবান করেছেন আপনি সাড়া দিয়েছেন এবং আবূ সুফ্ইয়ান-এর কন্যা উম্মু হাবীবাহ্ -কে তার সাথে বিবাহ সম্পাদন করে দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা তার রসূলকে বরকত দান করুন।
এ বক্তব্য শুনে বাদশাহ্ খালিদ ইবনু সা‘ঈদকেও প্রচুর স্বর্ণমুদ্রা দিলেন, এবং তিনি এগুলো গ্রহণ করলেন। অনুষ্ঠানাদি শেষ হলে লোকেরা চলে যেতে চাইলে বাদশাহ তাদের নিবৃত করে বললেনঃ আপনারা বসুন, নাবীদের সুন্নাত হলো কোনো বিবাহ সম্পাদন করলে সেখানে আপ্যায়ন করা। সুতরাং আমি একজন নাবীর বিয়ে সম্পাদন করলাম, তাই আপনারা কিছু খানা খেয়ে যাবেন। এরপর তিনি খানা হাজির করলেন এবং লোকেদের খেতে দিলেন, সকলেই খানা খেয়ে (রাজদরবারে অনুষ্ঠিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে উম্মু হাবীবাহ্ -এর বিবাহের) অনুষ্ঠান থেকে বিদায় গ্রহণ করলেন। ঐতিহাসিক ও তাফসীরকার ‘আল্লামা তাবারীর বর্ণনা মতে, এ ঘটনা নবূওয়াতের সপ্তম বর্ষে সংঘটিত হয়েছিল।
উম্মু হাবীবাহ্ -এর এই বিবাহের সময় তার পিতা আবূ সুফ্ইয়ান মুশরিক এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন।
কেউ কেউ এই বিয়ে উম্মু হাবীবাহ্-এর হাবাশাহ থেকে মদীনায় ফেরার পর হয়েছে বলে দাবী করেছেন, তবে প্রথম মতটিই অধিক প্রসিদ্ধ।
বাদশাহ তার দেশে আশ্রিত মুসলিমদের খুব খাতির নাওয়ায করেছেন, তাদের বিন্দু পরিমাণ কষ্টও সহ্য করেননি। তিনি বলেছেন, আমি একজন মুসলিমকে সামান্য একটু কষ্ট দেয়ার বিনিময়ে এক পর্বত পরিমাণ স্বর্ণ লাভকেও প্রিয় মনে করি না। (‘আওনুল মা‘বূদ ৪র্থ খন্ড, হাঃ ২১০৭; মিরকাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ ৭. তৃতীয় অনুচ্ছেদ - মোহর
৩২০৯-[৮] আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আবূ ত্বলহাহ্ উম্মু সুলায়ম (রাঃ)-কে বিয়ে করেন, তাদের মোহর ছিল ইসলাম গ্রহণ। উম্মু সুলায়ম (রাঃ) আবূ ত্বলহাহ্ (রাঃ)-এর পূর্বে ইসলাম কবুল করেন। অতঃপর আবূ ত্বলহাহ্ তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। উম্মু সুলায়ম (রাঃ) বলেন, আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি; যদি তুমি ইসলাম কবুল কর তবে তোমার সাথে বিয়ে হতে পারে। অতঃপর আবূ ত্বলহাহ্ ইসলাম গ্রহণ করেন। এ ইসলাম গ্রহণ তাঁদের বিয়ের মোহর বলে গণ্য হয়। (নাসায়ী)[1]
وَعَنْ أَنَسٍ قَالَ: تَزَوَّجَ أَبُو طَلْحَةَ أُمَّ سُلَيْمٍ فَكَانَ صَدَاقُ مَا بَيْنَهُمَا الْإِسْلَامَ أَسْلَمَتْ أُمُّ سُلَيْمٍ قَبْلَ أَبِي طَلْحَةَ فَخَطَبَهَا فَقَالَتْ: إِنِّي قَدْ أَسْلَمْتُ فَإِنْ أَسْلَمْتَ نَكَحْتُكَ فَأَسْلَمَ فَكَانَ صدَاق مَا بَينهمَا. رَوَاهُ النَّسَائِيّ
ব্যাখ্যা: আবূ ত্বলহাহ্-এর আসল নাম হলো যায়দ ইবনু সাহল আল আনসারী আন্ নাজ্জারী। আবূ ত্বলহাহ্ হলো তার কুন্ইয়াত বা উপনাম, উপনামেই তিনি সমাধিক প্রসিদ্ধ। তিনি আনাস ইবনু মালিক-এর মায়ের স্বামী। তিনি ছিলেন নামকরা তীরন্দাজদের অন্যতম। সেনাদলের ভিতর আবূ ত্বলহার আওয়াজের জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর ভূয়সী প্রশংসাবাণী উচ্চারণ করেছেন।
আনাস-এর মা উম্মু সুলায়ম ছিলেন মিলহান-এর কন্যা। তার আসল নামের ব্যাপারে মতপার্থক্য রয়েছে। মালিক ইবনু নযর প্রথম তাকে বিবাহ করেন, সেখানে তার ঘরে আনাস জন্মগ্রহণ করেন। এই মালিক আনাস-এর মাকে রেখে মুশরিক অবস্থায় নিহত হলে তার মা ইসলাম গ্রহণ করেন। অতঃপর আবূ ত্বলহাহ্ তাকে বিবাহের প্রস্তাব দেন, কিন্তু আবূ ত্বলহাহ্ মুশরিক থাকায় তিনি তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং তাকে ইসলাম গ্রহণে আহবান জানান। এ আহবানে সাড়া দিয়ে আবূ ত্বলহাহ্ ইসলাম গ্রহণ করলেন; উম্মু সুলায়ম তাকে বললেন, ঠিক আছে আমি তোমাকে বিবাহ করব, তোমার ইসলাম গ্রহণের কারণে আমি তোমার নিকট থেকে কোনো মোহরও গ্রহণ করব না।
অতঃপর আবূ ত্বলহাহ্ তাকে বিবাহ করলেন, আর তাঁর ইসলাম গ্রহণই হলো তাদের দু’জনের মাঝের বিবাহের মুহরানা। উম্মু সুলায়ম আবূ ত্বলহার আগেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
এ হাদীসে ইশারা রয়েছে যে, দীনী উপকারিতা বা উপকারলাভ মোহর (বিনিময়) হতে পারে এবং কুরআন শিক্ষা দেয়াও এ অর্থে ব্যবহার বৈধ হতে পারে। (মিরকাতুল মাফাতীহ)