পরিচ্ছেদঃ ১৬. প্রথম অনুচ্ছেদ - নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর দরূদ পাঠ ও তার মর্যাদা
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর দরূদ পাঠের হুকুম, বৈশিষ্ট্য ও তার স্থান।
صَلَاةْ এর অর্থঃ মাজদ ফিরুয আবাদী বলেনঃ আল্লাহর পক্ষ থেকে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর সালাত হলো দু’আ, রহমত, ক্ষমা এবং চমৎকার প্রশংসা অর্থ হবে। হাফিয ইবনু হাজার আবুল আলিয়া থেকে বলেন, আল্লাহর সালাত রসূলের ওপর, এর অর্থ হলো তাঁর প্রশংসা ও মর্যাদা বর্ণনা করা
মালাক (ফেরেশতা) ও অন্যান্যদের পক্ষ থেকে রসূলের ওপর সালাত হলে করে অর্থ আল্লাহর নিকট তাঁর জন্য উচ্চ মর্যাদা ও প্রশংসা কামনা করা।
কারো মতেঃ আল্লাহর সালাত তার সৃষ্টির উপর দু’ভাবেঃ খাস ও ’আম্।
আল্লাহর সালাত নবীগণের ওপর অর্থ প্রশংসা ও মর্যাদা আর বাকী অন্যদের ওপর হলে অর্থ রহমত যা প্রত্যেক বস্তুকে বেষ্টন করে রেখেছে।
হালীমী বলেনঃ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর সালাতের অর্থ হলো তার মর্যাদা সম্মান। সুতরাং আমাদের কথা
اَللّهُمَّ صَلِّ عَلى مُحَمَّدٍ.....
অর্থাৎ- ’’হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সম্মানিত করো’’। আর এ সম্মান হলোঃ তাঁর নাম, যশ, খ্যাতি পৃথিবীতে সুউচ্চ করা, তার আনীত দীনকে বিজয়ী করা, তাঁর শারী’আত সমাজে যেন অনন্তকাল ধরে থাকে। আর আখিরাতে উত্তম প্রতিদান করা, তাঁর উম্মাতের জন্য সুপারিশকে কবূল করা আর মাকামে মাহমূদ (বেহেশতের সর্বোচ্চ স্থান) দিয়ে অনুগ্রহ শুরু করা।
ياَيُّهَا الَّذِيْنَ امَنُوْا صَلُّوْا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوْا تَسْلِيْمًا
’’হে মু’মিনগণ! তোমরা নবীর জন্য দরূদ ও সালাম প্রেরণ করো’’- (সূরাহ্ আল আহযাব ৩৩: ৫৬)।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর দরূদ পাঠ করা কি, মানদুব বা ভালো না, ওয়াজিব? না ফারযে আইন, না ফারযে কিফায়াহ্?
পুনরাবৃত্তি করতে হবে যখনই তার নাম শুনবে না পুনরাবৃত্তি করতে হবে না
আর পুনরাবৃত্তি কোন বৈঠক ও সভায় প্রযোজ্য কি না ইত্যাদি মাস্আলাহ্ বিষয়ে ওলামাদের মাঝে মতপার্থক্য রয়েছে
* জারীর ত্ববারী বলেছেনঃ মুসতাহাব তথা ভালো।
* কারো মতেঃ জীবনে একবার তার প্রতি দরূদ পাঠ করা ওয়াজিব চাই সালাতে হোক আর সালাতের বাইরে হোক যেমন কালিমাহ্ তাওহীদের মত (জীবনে একবার স্বীকৃতি দিলে হবে)।
* আবূ বকর আর্ রাযী হানাফী, ইবনু হাযম উভয় ছাড়া আরো অনেকের নিকট সামষ্টিকভাবে একবার ফরয আর তা কোন সালাত বা যে কোন নির্ধারিত সময়ের সাথে খাস বা জীবনে একবার পড়লে ফরয আদায়ের দায়িত্ব পালন হবে।
তার সামর্থ্যনুযায়ী অতিরিক্ত পড়লে তা মানদুব বা ভালো, এর থেকে বুঝা গেল দ্বিতীয় বৈঠকে দরূদ পাঠ করা সুন্নাত আবূ হানীফাহ্, মালিক এবং সাওরীর এটাই অভিমত।
* ইমাম ত্বহাবীর মতে যখনই কোন ব্যক্তি রসূলের নাম শুনবে বা পড়বে তখনই দরূদ পড়বে যদি কোন বৈঠক ও সমাবেশে একত্রিত হয় তথা পুনরাবৃত্তি করা ওয়াজিব। তবে ফাতাওয়া হলো পুনরাবৃত্তি করা মুসতাহাব। কারণ হাদীসে দরূদ না পড়লে শাস্তি, দুর্ভাগ্য, নাক ধূলায় ধূসরিত হোক, কৃপণতা ইত্যাদি কথা এসেছে।
* যে সকল স্থানে পড়া ওয়াজিব- এ বিষয়ে মতভেদ রয়েছে।
প্রথম তাশাহুদে, জুমু’আর খুতবাহ্, জুমু’আর খুতবাহ্ ছাড়াও সকল খুত্বায়, জানাযার সালাতে পড়া সহীহ সানাদে প্রমাণিত।
আযানের জবাবের পরে, দু’আর শুরুতে মাঝখানে, শেষে, কুনূতের শেষে তাহাজ্জুদ সালাতে দাঁড়ানোর সময় কুরআনুল কারীম পাঠ শেষ করলে বিপদ মুসীবাতের সময় গুনাহ থেকে তাওবার সময়, হাদীস পড়ার সময়।
ঈদের তাকবীর পাঠ করার সময়ে মাসজিদ প্রবেশের ও বের হওয়ার সময়, একত্রিত হওয়ার সময়, সফরের সময় দরূদ পাঠ করার কথা এসেছে সবগুলো দুর্বল হাদীস।
বিশেষ করে জুমু’আর দিনে বেশী বেশি দরূদ পড়ার কথা সহীহ হাদীসে এসেছে।
দরূদের নিয়ম-কানুন হলো সবচেয়ে উত্তম দরূদ যা সালাতে পড়া হয় এটি কা’ব ইবনু ’উজরাহ্-এর হাদীস এবং সবচেয়ে সহীহ হাদীস।
৯১৯-[১] ’আবদুর রহমান ইবনু আবূ লায়লা (রহঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, কা’ব ইবনু ’উজরাহ্ (রাঃ)-এর সাথে আমার দেখা হলে তিনি বললেন, হে ’আবদুর রহমান! আমি কি তোমাকে একটি কথা উপহার দিব যা আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে শুনেছি? উত্তরে আমি বললাম, হাঁ আমাকে তা উপহার দিন। তিনি বললেন, আমরা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করে বললাম, হে আল্লাহর রসূল! আপনার প্রতি আমরা ’সালাম’ কিভাবে পাঠ করবো তা আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন। আমরা আপানার ও আপনার পরিবারে প্রতি ’সালাত’ কিভাবে পাঠ করবো? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তোমরা বলো,
’’আল্লা-হুম্মা সল্লি ’আলা- মুহাম্মাদিও ওয়া ’আলা- আ-লি মুহাম্মাদিন কামা- সল্লায়তা ’আলা- ইবরা-হীমা ওয়া ’আল- আ-লি ইবরা-হীমা ইননাকা হামীদুম মাজীদ। আল্লা-হুম্মা বা-রিক ’আলা- মুহাম্মাদিওঁ ওয়া ’আলা- আ-লি মুহাম্মাদিন কামা- বা-রাকতা ’আলা- ইবরা-হীমা ওয়া ’আলা- আ-লি ইবরা-হীমা ইন্নাকা হামীদুম মাজীদ’’-
(অর্থাৎ- হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মাদ ও মুহাম্মাদের পরিবার-পরিজনের প্রতি রহমত বর্ষণ কর, যেভাবে তুমি রহমত বর্ষণ করেছো ইবরাহীম ও ইবরাহীমের পরিবার-পরিজনের প্রতি। নিশ্চয় তুমি প্রশংসিত ও সম্মানিত। হে আল্লাহ! তুমি বারাকাত নাযিল কর মুহাম্মাদ ও মুহাম্মাদের পরিবার-পরিজনের প্রতি, যেভাবে তুমি বারাকাত নাযিল করেছো ইব্রাহীম ও ইব্রাহীমের পরিবার-পরিজনের প্রতি। তুমি বড় প্রশংসিত ও সম্মানিত।)। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
কিন্তু ইমাম মুসলিম-এর বর্ণনায় ’আলা- ইবরা-হীম’ শব্দ দু’ স্থানে উল্লিখিত হয়নি।
بَابُ الصَّلَوةِ عَلَى النَّبِىِّ ﷺ وَفَضْلِهَا
وَعَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ أَبِي لَيْلَى قَالَ: لَقِيَنِي كَعْبُ بْنُ عُجْرَةَ فَقَالَ أَلَا أُهْدِي لَكَ هَدِيَّةً سَمِعْتُهَا مِنَ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقُلْتُ بَلَى فَأَهْدِهَا لِي فَقَالَ سَأَلْنَا رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقُلْنَا يَا رَسُولَ اللَّهِ كَيْفَ الصَّلَاةُ عَلَيْكُمْ أَهْلَ الْبَيْتِ فَإِنَّ اللَّهَ قَدْ عَلَّمَنَا كَيْفَ نُسَلِّمُ عَلَيْكُم قَالَ: «قُولُوا اللَّهُمَّ صل عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حُمَيْدٌ مجيد اللَّهُمَّ بَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّك حميد مجيد» . إِلَّا أَنَّ مُسْلِمًا لَمْ يَذْكُرْ عَلَى إِبْرَاهِيمَ فِي الْمَوْضِعَيْنِ
ব্যাখ্যা: বায়হাক্বীতে কা‘ব ইবনু ‘উজরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত যখন কুরআনের আয়াত নাযিল হলো-
اِنَّ اللّهَ وَمَلَائِكَتَهٗ يُصَلُّونَ عَلَى النَّبِيِّ
‘‘নিশ্চয় আল্লাহ ও মালায়িকাহ্ (ফেরেশতারা) নাবীর ওপর দরূদ বা রহমাত প্রেরণ করেন।’’ (সূরাহ্ আহযাব ৩৩ : ৫৬)
তখন সাহাবীরা বলেনঃ হে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দরূদটি কিরূপ তথা সালাতে তাশাহুদের পরে দরূদের শব্দ কিরূপ?
(كَيْفَ الصَّلَاةُ عَلَيْكُمْ أَهْلَ الْبَيْتِ) : আমরা কিভাবে আপনার ও পরিবারের ওপর দরূদ পাঠ করবো?
শাইখ ‘আবদুল হক দেহলবী বলেনঃ প্রশ্নকারীর উদ্দেশ্য রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর দরূদ পাঠের পাশাপাশি তার পরিবারের প্রসঙ্গকে টেনে তাদের ওপরও দরূদ কিরূপ হবে।
(فَإِنَّ اللّهَ قَدْ عَلَّمَنَا كَيْفَ نُسَلِّمُ عَلَيْكَ) : আল্লাহ আমাদেরকে শিখিয়েছে কিভাবে আপনাকে সালাম দিব, আর এটা সালাত (সালাত/নামায/নামাজ) আদায়কারী তাশাহুদে বলে- হে নাবী! আপনার প্রতি সালাম।
আমরা কিভাবে দরূদ প্রেরণ করবো আপনার প্রতি?
অন্য রিওয়ায়াতে আছে, আপনার ওপর সালাম আমরা জেনেছি, সুতরাং আপনার ওপর দরূদ কিরূপ হবে অথচ আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে দরূদ ও সালাম প্রেরণের আদেশ দিয়েছেন যেমন আল্লাহ বলেন, ‘‘তোমরা তার ওপর দরূদ ও সালাম প্রেরণ কর’’- (সূরাহ্ আল আহযাব ৩৩ : ৫৬)। আমরা সালামের পদ্ধতি জেনেছি যেমনটি আপনি আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন আত্তাহিয়্যাতু সেখানে আমরা বলি, হে নাবী! আপনার ওপর সালাম বর্ষিত হোক।
সুতরাং আপনি আমাদের দরূদের শব্দ শিক্ষা দিন।
কুসতুলানী বলেছেনঃ قُوْلُوْ ‘‘তোমরা বল’’ এ বাক্যে প্রমাণ করে পড়াটা ওয়াজিব সবাই ঐকমত্য পোষণ করেছেন।
আর শাওকানী বলেনঃ নায়লুল আওত্বারে হাদীসের বাক্য قُوْلُوْ ‘‘তোমরা বল’’ তাশাহুদের পরে দরূদ পাঠ করা ওয়াজিব।
এ মতের স্বপক্ষে বলেছেন, ‘উমার (রাঃ), ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার (রাঃ), ইবনু মাস্‘ঊদ, জাবির (রাঃ) ইবনু যায়দ, শা‘বী মুহাম্মাদ ইবনু কা‘ব আল কুরযী আবূ জা‘ফার বাকির আর শাফি‘ঈ আহমাদ ইবনু হাম্বাল ইসহাক ইবনুল মাওয়াজ আর কাজী আবূ বাকর ইবনু ‘আরাবী।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সালাত (সালাত/নামায/নামাজ) দ্বারা উদ্দেশ্য আল্লাহর আদেশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য অর্জন করা, অনুরূপ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অধিকার আমাদের ওপর তা আদায় করা।
ইবনু ‘আবদুস্ সালাম বলেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর দরূদ প্রেরণ তার জন্য শাফা‘আত স্বরূপ না যেমনি তাঁর শাফা‘আত আমাদের ওপর। বরং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের প্রতি যে ইহসান করেছেন (শারী‘আতের বিধান আনার মাধ্যমে) তার প্রতিদানে আল্লাহ আমাদের অপারগতা জেনে তাঁর ওপর দরূদ পাঠের মাধ্যমে প্রতিদানের ব্যবস্থা করেছেন।
ইবনুল ‘আরাবী বলেন, দরূদ পাঠের উপকার পাঠকারীর ওপর ‘আক্বীদার খাঁটিত্ব, নিয়্যাতের বিশুদ্ধতা, ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ আর আনুগত্যের উপর অবিচল প্রমাণ করে।
মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পূর্বে سَيِّدْ (সাইয়্যিদ) যার অর্থ ‘নেতা’ এ শব্দটি প্রয়োগের ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। ইবনু ‘আবদুস সালাম বলেন, এটা বলাই শিষ্টাচারের বৈশিষ্ট্য। আর ইমাম শাওকানী নায়লুল ‘আওত্বার’-এ বলেন ‘‘উত্তম’’। আসনাবী বলেন سَيِّدَنَا (সাইয়্যিদিনা) শব্দটি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পূর্বে অধিকাংশ সালাত (সালাত/নামায/নামাজ) আদায়কারীর নিকট ব্যাপক প্রসিদ্ধ পেয়েছে। তবে এ উত্তমের বিষয়টি চিন্তাসাপেক্ষ।
আমি (ভাষ্যকার) বলি, সালাত অবস্থায় যে ‘‘সাইয়্যিদিনা’’ শব্দটি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদেশ বাস্তবায়নে ও হুবহু দু‘আ মাসূরার শব্দ আদায়ে পরিত্যাগ করা উত্তম।
সালাত ব্যতিরেকে অন্য স্থানে ‘সাইয়্যিদিনা’ শব্দটি বলা কোন সমস্যা না তথা বৈধ।
সুয়ূত্বী দুর্রে মানসূরে বলেনঃ ‘আবদুর রাযযাক্ব, ‘আবদ ইবনু হুমায়দ ও ইবনু মাজাহ্ তাঁরা ‘আবদুল্লাহ ইবনু মাস্‘ঊদ থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেনঃ যখন তোমরা রসূলের ওপর দরূদ পাঠ করবে তা সুন্দর, ভালোভাবে পাঠ করবে। তখন তারা বললেন, আপনি আমাদেরকে শিক্ষা দিন। তখন তিনি বললেন তোমরা বলো, হে আল্লাহ! তোমার সম্মান, রহমাত, বারাকাত সকল রসূলের নেতা ও মুত্তাক্বীদের ইমামের ওপর ধার্য করুন।
ইমাম যাহাবী বলেন, প্রচুর সংখ্যক মানুষ বলেনঃ ‘‘হে আল্লাহ! তুমি রহমাত বর্ষণ করো আমাদের নেতা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর’’- এ বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা রয়েছে তবে উত্তম হলো অবিকল শব্দ অনুসরণে ‘সাইয়্যিদান’ শব্দ না বলা। আর সালাত ব্যতিরেকে সরাসরি এ সম্বোধন করাকে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অপছন্দ করেছেন যা প্রসিদ্ধ হাদীস হতে প্রমাণিত।
এ হাদীসটি প্রমাণ করে দরূদের ক্ষেত্রে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীগণকে যে শব্দ শিক্ষা দিয়েছেন অবিকল সেই শব্দ বলতে হবে তাঁর আদেশ বাস্তবায়নে। চাই তা খাসভাবে ওয়াজিব বলি আর সালাতে নির্ধারণ করি।
ইমাম আহমাদ-এর নিকট সালাতে দরূদের শব্দ অবিকল বলতে হবে তবে সহীহ কথা তার অনুসারীদের নিকট ওয়াজিব বা আবশ্যক না।
আর ইমাম শাফি‘ঈ বলেছেন, اللّهُمَّ صَلِّ عَلى مُحَمَّدٍ ‘‘হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর রহমাত বর্ষণ করুন।’’ এতটুকু বলাই যথেষ্ট হবে।
হাফিয ইবনু হাজার বলেনঃ আমাদের সাথীরা ঐকমত্য হয়েছেন اَلصَّلَاةُ عَلى مُحَمَّدٍ এর ওপর সংক্ষিপ্ত করা যাবে না আর এ ব্যাপারে সহীহ সানাদ নেই তবে গুণের উপর তথা ﷺ اَلصَّلَاةُ عَلَى النَّبِيِّ -এর উপর সংক্ষিপ্ত করা যাবে আর জমহূরের নিকট, যে কোন শব্দ দিয়ে যা দরূদ বুঝায় তাই বৈধ।
পরিচ্ছেদঃ ১৬. প্রথম অনুচ্ছেদ - নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর দরূদ পাঠ ও তার মর্যাদা
৯২০-[২] আবূ হুমায়দ আস্ সা’ইদী (রাঃ)হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রসূল! আমরা আপনার প্রতি কিভাবে দরূদ পাঠ করব? রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তোমরা বল,
’’আল্লা-হুম্মা সল্লি ’আলা- মুহাম্মাদিওঁ ওয়া আয্ওয়া-জিহী ওয়া যুররিইয়্যাতিহী কামা- সল্লায়তা ’আলা- আ-লি ইব্র-হীমা ওয়াবা-রিক ’আলা- মুহাম্মাদিওঁ ওয়া আয্ওয়া-জিহী ওয়া যুররিইয়্যাতিহী কামা- বা-রকতা ’আলা- আ-লি ইব্র-হীমা ইন্নাকা হামীদুম্ মাজীদ’’
(অর্থাৎ- হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মাদ এবং তাঁর পত্নীগণ ও বংশধরগণের প্রতি অনুগ্রহ বর্ষণ করো, যেভাবে তুমি ইবরাহীম (আঃ)-এর পরিজনের প্রতি অনুগ্রহ বর্ষণ করেছো এবং মুহাম্মাদ এবং তাঁর পত্নীগণ ও বংশধরগণের প্রতি তোমার কল্যাণ নাযিল করো, যেভাবে তুমি ইবরাহীম (আঃ)-এর পরিবার-পরিজনের প্রতি কল্যাণ নাযিল করেছো। অবশ্যই তুমি খুব প্রশংসিত এবং খুব সম্মানিত।)। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
بَابُ الصَّلَوةِ عَلَى النَّبِىِّ ﷺ وَفَضْلِهَا
وَعَن أبي حميد السَّاعِدِيِّ قَالَ: قَالُوا: يَا رَسُولَ اللَّهِ كَيْفَ نصلي عَلَيْك؟ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: قُولُوا: اللَّهُمَّ صلى الله عَلَيْهِ وَسلم عَلَى مُحَمَّدٍ وَأَزْوَاجِهِ وَذُرِّيَّتِهِ كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ وَبَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَأَزْوَاجِهِ وَذُرِّيَّتِهِ كَمَا بَارَكْتَ عَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حُمَيْدٌ مجيد
ব্যাখ্যা: (وَأَزْوَاجِه) দ্বারা উদ্দেশ্য উম্মাহাতুল মু’মিনীন যেমন সামনে আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হাদীস আসছে।
(وَذُرِّيَّتِه) দ্বারা উদ্দেশ্য তাঁর বংশধর, ফাত্বিমাহ্ (রাঃ)-এর সন্তানেরা।
আজওয়ায তথা স্ত্রীগণ প্রসিদ্ধ আর ذُرِّيَّةٌ দ্বারা বংশকুল তথা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বংশধর তারা যারা তাঁর সন্তানের প্রজন্ম আর তাঁর সন্তান তারাই যারা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনুগত্য করে।
আর নাবাবী মুহাজ্জাব-এর শারাহ্তে উল্লেখ করেছেন সহীহ হাদীসগুলোর আলোকে (শব্দের) সমন্বয় করা যাবে।
اَللّهُمَّ صَلِّ عَلى مُحَمَّدِ النَّبِىِّ الْأَمِّىْ، وَعَلى الِ مُحَمَّدٍ، وَأَزْوَاجِه، وَذُرِّيَّتِه، كَمَا صَلَّيْتَ عَلى إِبْرَاهِيْمَ، وَعَلى الِ إِبْرَاهِيْمَ، وَبَارِكْ عَلى مُحَمَّدٍ وَعَلى الِ مُحَمَّدٍ وَأَزْوَاجِه وَذُرِّيَّتِه كَمَا بَارَكْتَ عَلى إِبْرَاهِيْمَ وَعَلى الِ إِبْرَاهِيْمَ فِى الْعَالَمِيْنَ إِنَّكَ حَمِيْدٌ مَّجِيْدٌ.
হে আল্লাহ! তুমি রহমাত বর্ষণ করো নিরক্ষর নাবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর ও তাঁর পরিবার, স্ত্রীগণ ও সন্তানদের ওপর যেরূপ রহমাত বর্ষণ করেছো ইব্রাহীম (আঃ) ও তাঁর ইব্রাহীম (আঃ)-এর পরিজনের ওপর, তুমি বারাকাত দান করো মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পরিজনের ওপর যেরূপ বারাকাত দান করেছো ইব্রাহীম (আঃ) ও ইব্রাহীম (আঃ) পরিজনের ওপর সারা বিশ্বে। নিশ্চয় তুমি প্রশংসিত ও মর্যাদাশীল আর ‘ইরাক্বী বলেন আরো অন্য শব্দেও সহীহ হাদীস এসেছে-
اَللّهُمَّ صَلِّ عَلى مُحَمَّدٍ عَبْدُكَ وَرَسُوْلُكَ النَّبِىَ الْأُمِّىْ، وَعَلى الِ مُحَمَّدً، وَأَزْوَاجِه أُمَّهَاتُ الْمُؤْمِنِيْنَ، وَذُرِّيَّتِه، وَأَهْلُ بَيْتِه كَمَا صَلَّيْتَ عَلى إِبْرَاهِيْمَ وَعَلى الِ إِبْرَاهِيْمَ، إِنَّكَ حَمِيْدٌ مَّجِيْدٌ. اَللّهُمَّ بَارِكْ عَلى مُحَمَّدٍ النَّبِيِّ الْأّمِّىْ، وَعَلى الِ مُحَمَّدٍ، وَأَزْوَاجِه، وَذُرِّيَّتِه، كَمَا بَارَكْتَ عَلى إِبْرَاهِيْمَ، وَعَلى الِ إِبْرَاهِيْمَ فِى الْعَالَمِيْنَ إِنَّكَ حَمِيْدٌ مَّجِيْدٌ.
হে আল্লাহ! তুমি রহমাত বর্ষণ করো মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর যিনি তোমার বান্দা এবং তোমার রসূল, নিরক্ষর নাবী এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র পরিবার-পরিজনের ওপর তাঁর স্ত্রীগণ, সকল মু’মিনদের মা এবং তাঁর বংশকূলের ওপর আর পরিবারের ওপর যেমন রহমাত বর্ষণ করেছো ইব্রাহীম (আঃ) এবং ইব্রাহীম (আঃ)-এর পরিবারের ওপর। নিশ্চয় তুমি প্রশংসিত ও মর্যাদাশীল।
হে আল্লাহ! তুমি বারাকাত দান করো মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পরিজনের ওপর, তাঁর স্ত্রীগণ ও সন্তান-সন্ততির ওপর যেমন বারাকাত দান করেছো ইব্রাহীম (আঃ) ও ইব্রাহীম (আঃ) -এর পরিজনের ওপর সারাবিশ্বে, নিশ্চয় তুমি প্রশংসিত ও মর্যাদাশীল।
পরিচ্ছেদঃ ১৬. প্রথম অনুচ্ছেদ - নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর দরূদ পাঠ ও তার মর্যাদা
৯২১-[৩] আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আমার প্রতি একবার দরূদ পাঠ করে আল্লাহ তা’আলা তার প্রতি দশবার রহমত বর্ষণ করেন। (মুসলিম)[1]
بَابُ الصَّلَوةِ عَلَى النَّبِىِّ ﷺ وَفَضْلِهَا
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَنْ صَلَّى عَلَيَّ وَاحِدَةً صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ عشرا» . رَوَاهُ مُسلم
ব্যাখ্যা: তিরমিযীর বর্ণনায় এভাবে এসেছে- ‘‘যে ব্যক্তি আমার ওপর একবার দরূদ পাঠ করে আল্লাহ তা‘আলা তার ওপর দশবার রহমাত বর্ষণ করেন অথবা তার জন্য দশটি পুণ্য বা নেকী লিখে দিবেন এর বিনিময়ে।’’
কিন্তু আত্ তিরমিযী’র এ রিওয়ায়াত আমি (ভাষ্যকার) কোথাও পাইনি।
সালাতের উদ্দেশ্য হলোঃ আল্লাহর পক্ষ হতে তার বান্দার ওপর রহমাত বর্ষিত হওয়া আর তিনি তাদের ওপর রহমাতের বারিধারা বর্ষণ করেন, ফলে রহমাতের পরিমাণ অনেক হয়।
ক্বাযী ‘ইয়ায বলেনঃ আল্লাহর দয়া ও প্রতিদান বৃদ্ধি পাবে, যেমন আল্লাহর বাণীঃ ‘‘যে একটি সৎ কাজ করবে সে দশগুণ পাবে।’’ (সূরাহ্ আল আন্‘আম ৬ : ১৬০)
মুল্লা ‘আলী কারী বলেনঃ দশটি প্রতিদান বৃদ্ধি এটি সর্বনিম্ন।
যদি প্রশ্ন করা হয়, কিভাবে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর একবার দরূদ পড়লে দরূদ পাঠকারীর ওপর দশবার পাঠ করার সমতুল্য হয় বিষয়টি বুঝতে কঠিন হয়।
জওয়াবঃ একবার দরূদ প্রেরণ দরূদ পাঠকারীর কাজের একটি বৈশিষ্ট্য আর প্রতিদান দশগুণ এটি আল্লাহর পক্ষ হতে, যেমন আল্লাহ বলেনঃ
مَن جَآءَ بِالْحَسَنَةِ فَلَه عَشْرُ اَمْثَالِهَا
আবার হাদীস হতে এটা বুঝে আসে না যে, আল্লাহর পক্ষ হতে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর মাত্র একবার রহমাত প্রেরণ করেন, আল্লাহর অনুগ্রহ প্রশস্ত ও বিস্তৃত।
উল্লিখিত হাদীস আর ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘আমর (রাঃ) -এর হাদীস যেখানে এসেছে, ‘‘যে ব্যক্তি একবার নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর দরূদ পাঠ করবে আল্লাহ ও তাঁর মালাক (ফেরেশতা) সত্তরবার রহমাত করবে। [অর্থাৎ- এ হাদীসে সত্তরের কথা এসেছে আর উল্লিখিত হাদীসে ১০ (দশ) বারের কথা এসেছে]
দু’ হাদীসে দ্বন্দ্ব সমাধানে জবাব হবে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ফাযীলাতের ব্যাপারে কিছু বিষয় ধাপে ধাপে জেনেছেন, যখনই তিনি জেনেছেন (আল্লাহর পক্ষ হতে) তখনই বলে দিয়েছেন।
প্রথম হাদীসের ফাযীলাতে বিষয় যখন জেনেছে বলেছেন। আবার যখন বেশি ফাযীলাত জেনেছেন তা বলে দিয়েছেন।