পরিচ্ছেদঃ ১৬. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর দরূদ পাঠ ও তার মর্যাদা
৯২২-[৪] আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আমার ওপর একবার দরূদ পাঠ করবে, আল্লাহ তা’আলা তার ওপর দশবার রহমত নাযিল করবেন। তার দশটি গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে, আর আল্লাহর নৈকট্যের জন্য দশটি মর্যাদা বাড়িয়ে দেয়া হবে। (নাসায়ী)[1]
عَنْ أَنَسٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَنْ صَلَّى عَلَيَّ صَلَاةً وَاحِدَةً صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ عَشْرَ صَلَوَاتٍ وَحُطَّتْ عَنْهُ عَشْرُ خَطِيئَاتٍ وَرُفِعَتْ لَهُ عَشْرُ دَرَجَاتٍ» . رَوَاهُ النَّسَائِيّ
ব্যাখ্যা: (وَحُطَّتْ عَنْهُ عَشْرُ خَطِيئَاتٍ وَرُفِعَتْ لَهٗ عَشْرُ دَرَجَاتٍ) তথা গুনাহ মাফ করা হয়, ঢেকে রাখা বা মিটিয়ে দেয়া হয়।
( رُفِعَتْ لَهٗ عَشْرُ دَرَجَاتٍ حُطَّتْ)-এর বিপরীত ব্যবহৃত হয়েছে আর উদ্দেশ্য মর্যাদা বৃদ্ধি করা হবে দুনিয়াতে আল্লাহর আনুগত্যের সুযোগ লাভের মাধ্যমে আর আখিরাতে সৎকর্মের পাল্লায় ভারী হবে এবং জান্নাতে মর্যাদা বৃদ্ধি হবে।
ইমাম ত্বীবী বলেনঃ বান্দার পক্ষ হতে সালাত হলে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য সম্মান ও মর্যাদা কামনা করা।
আর আল্লাহর পক্ষ হতে সালাত হলে প্রতিদানের ক্ষেত্রে দু’টি অর্থ একটি ক্ষমা, অপরটি সম্মান মর্যাদা আর এখানে সম্মান অর্থটিই বেশি প্রযোজ্য।
ইবনু ‘আরাবী বলেনঃ আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ ‘‘যে একটি ভালো কাজ করবে সে দশগুণ পাবে।’’ (সূরাহ্ আল আন্‘আম ৬ : ১০৬)
কুরআনের আয়াত দাবী করে যে ব্যক্তি একটি ভালো কাজ করবে সে এর দশগুণ বেশি প্রতিদান পাবে।
আর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি দরূদ প্রেরণ একটি ভালো কাজ, সুতরাং কুরআনের দাবী অনুযায়ী জান্নাতে দশগুণ বেশি দেয়া হবে।
সুতরাং সুসংবাদ হলো, যে ব্যক্তি রসূলের ওপর একবার দরূদ পাঠ করবে আল্লাহ তাকে দশগুণ দিবেন এবং আল্লাহ তা‘আলা বান্দাকে সর্বোচ্চ প্রতিদান দিয়ে স্মরণ করবেন।
পরিচ্ছেদঃ ১৬. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর দরূদ পাঠ ও তার মর্যাদা
৯২৩-[৫] ইবনু মাস্’ঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যারা আমার প্রতি বেশি বেশি দরূদ পাঠ করবে, তারাই কিয়ামতের (কিয়ামতের) দিন আমার পক্ষ থেকে বেশি নিকটে হবে। (তিরমিযী)[1]
وَعَنِ ابْنِ مَسْعُودٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسلم: «أَوْلَى النَّاسِ بِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَكْثَرُهُمْ عَلَيَّ صَلَاة» . رَوَاهُ التِّرْمِذِيّ
ব্যাখ্যা: (اَوْلَى النَّاسِ بِى يَوْمَ الْقِيَامَةِ) ‘‘ক্বিয়ামাতের (কিয়ামতের) দিন আমার অতি নিকটবর্তী লোক হবে।’’ অর্থাৎ- দুনিয়াতে যারা আমার প্রতি বেশী বেশী দরূদ পাঠ করবে তারাই ক্বিয়ামাতের (কিয়ামতের) দিন আমার নিকটবর্তী হবে।
ইমাম ত্বীবী বলেনঃ তারাই হবে আমার খাস উম্মাত, আমার অতি নিকটবর্তী এবং আমার শাফা‘আতের অধিক হকদার। কেননা তার প্রতি বেশী বেশী দরূদ পাঠ করাতে তার সাথে মুহাব্বাত ও ভালোবাসা সৃষ্টি করে। মা'নাবী (রহঃ) বলেনঃ তার প্রতি অধিক পরিমাণে দরূদ পাঠ করা তাকে সত্যিকারে ভালোবাসার প্রমাণ বহন করে। আর দুনিয়াতে যিনি যাকে ভালোবাসবেন ক্বিয়ামাতের (কিয়ামতের) দিন তাঁর সাথেই তার হাশর হবে।
ইবনু হিব্বান অত্র হাদীস বর্ণনা করার পর বলেনঃ অত্র হাদীস প্রমাণ করে যে, আহলুল হাদীসগণই ক্বিয়ামাতের (কিয়ামতের) দিন তার অতি নিকটবর্তী হবে। কেননা এ উম্মাতের মাঝে আহলুল হাদীসদের চাইতে কেউই তার প্রতি অধিক পরিমাণে দরূদ পাঠ করে না। খত্বীব বাগদাদী বলেন, আবূ নু‘আয়ম বলেছেনঃ এ হাদীসটিতে হাদীস বর্ণনাকারীদের মর্যাদা উল্লেখিত হয়েছে। কেননা লিখনীতে ও যবানীতে তাদের চাইতে আর কোন দলই অধিক পরিমাণে দরূদ পাঠ করে বলে জানা যায় না।
পরিচ্ছেদঃ ১৬. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর দরূদ পাঠ ও তার মর্যাদা
৯২৪-[৬] উক্ত রাবী [আনাস (রাঃ)] থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহর কিছু মালাক (ফেরেশতা) আছেন যারা পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ান। তারা আমার উম্মাতের সালাম আমার কাছে পৌঁছান। (নাসায়ী ও দারিমী)[1]
وَعَنِ ابْنِ مَسْعُودٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «إِنَّ لِلَّهِ مَلَائِكَةً سَيَّاحِينَ فِي الْأَرْضِ يُبَلِّغُونِي مِنْ أُمَّتِيَ السَّلَامَ» . رَوَاهُ النَّسَائِيّ والدارمي
ব্যাখ্যা: (يُبَلِّغُونِيْ مِنْ أُمَّتِي السَّلَامَ) আমার উম্মাতের মধ্য হতে যারা আমাকে সালাম দেয় কম হোক বেশী হোক আর যতই দূর প্রান্ত হতে হোক না কেন এবং শুনার পর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সালামের উত্তর দেন।
এ হাদীস উৎসাহিত করছে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর দরূদ ও সালাম প্রেরণ এবং তাকে সম্মান করা ও তাঁর অবস্থান ও মর্যাদাকে মহিমান্বিতকরণে যে তাঁর এ গর্বিত মর্যাদার দরুন সম্মানিত মালায়িকাহ্-কে নিয়োগ দিয়েছে।
‘আল্লামা শাওকানী বলেনঃ এ হাদীসটি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর বেশি বেশি দরূদ পড়তে উৎসাহিত করছে যা বিশেষ করে যখন কোন ব্যক্তি একবার তাঁর ওপর দরূদ প্রেরণ করে, এটি তাঁর কাছে পৌঁছে দেয়া হয় এটি যেন দরূদ পড়ার ব্যাপারে আরো বেশি তৎপর করে তোলে।
হাসান ইবনু ‘আলী ইবনু আবী ত্বালিব (রাঃ) হতে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে কোন স্থান হতে তোমরা আমার নিকট দরূদ পাঠ করো নিশ্চয় তোমাদের সে দরূদ আমার নিকট পৌঁছে দেয়া হয়।
আনাস (রাঃ)-এর হাদীসে এসেছে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ ‘‘যে আমার ওপর দরূদ পড়ে তবে দরূদ আমার নিকট পৌঁছে এবং আমিও তার ওপর দরূদ পড়ি, এটা ছাড়াও আরো দশটি নেকী লেখা হয়।’’
পরিচ্ছেদঃ ১৬. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর দরূদ পাঠ ও তার মর্যাদা
৯২৫-[৭] আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কেউ আমার ওপর সালাম পাঠ করলে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা আমার কাছে আমার রূহ ফেরত দেন যাতে আমি তার সালামের উত্তর দিতে পারি। (আবূ দাঊদ ও বায়হাক্বী- দা’ওয়াতে কাবীর)[1]
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَا مِنْ أَحَدٍ يُسَلِّمُ عَلَيَّ إِلَّا رَدَّ اللَّهُ عَلَيَّ رُوحِي حَتَّى أَرُدَّ عَلَيْهِ السَّلَامُ» . رَوَاهُ أَبُو دَاوُدَ وَالْبَيْهَقِيُّ فِي الدَّعَوَاتِ الْكَبِيرِ
ব্যাখ্যা: (مَا مِنْ أَحَدٍ يُسَلِّمُ عَلَـيَّ) ‘‘যে কেউ আমাকে সালাম করলে’’ এর প্রকাশ্য ভাব এ অর্থ প্রকাশ করে যে, যে কোন স্থানের ও যে কোন সময়ের সালাম দাতাকে অন্তর্ভুক্ত করে। ফলে দূরবর্তী ও নিকটবর্তী সকল সালাম প্রদানকারী সমান মর্যাদার অধিকারী এবং নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পৃথিবীর যে কোন প্রান্ত হতে সালাম প্রদানকারীর সালামের জওয়াব দিয়ে থাকেন। তবে অনেক ‘আলিম মনে করেন এ হাদীস হতে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কবরের পাশে সালাম প্রদানকারী উদ্দেশ্য। অতএব, কবরের নিকটবর্তী হয়ে সালাম প্রদানকারীর ক্ষেত্রেই এ হাদীসটি প্রযোজ্য। আল্লাহই প্রকৃত বিষয়ে জ্ঞান রাখেন।
এ হাদীসের সালাম দ্বারা দু‘আ উদ্দেশ্য নেয়া যায়। অভিবাদনের সালাম উদ্দেশ্য নয়। অতএব, হাদীসের অর্থ ব্যাপক। সুতরাং সালাম প্রদানকারী দূরবর্তী হোক বা নিকটবর্তী এত কোন পার্থক্য নেই এবং এটি কবর যিয়ারতকারীর জন্য খাসও নয়। বরং এ হাদীসে বর্ণিত মর্যাদা দূরবর্তী ও নিকটবর্তী সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য।
(اِلَّا رَدَّ اللّهُ عَلَـيَّ رُوْحِيْ حَتّى أَرُدَّ عَلَيْهِ السَّلَامَ) আল্লাহ আমার রূহ ফিরিয়ে দেন যাতে আমি তার সালামের প্রতি উত্তর দিতে পারি। এতে বুঝা যায় যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সালাম দেয়ার পর তাঁর শরীরে তাঁর রূহ ফেরত দেয়া হয়। তবে এই ফেরত দেয়া রূহ তাঁর শরীরে অব্যাহতভাবে থাকা বুঝায় না। জেনে রাখা জরুরী যে, সালাম দেয়ার পরে শরীরে রূহ ফিরিয়ে দেয়া এবং মৃত্যুর পরে তা পুনরায় শরীরে ফিরে আসা যেমনভাবে তা শরীরে অব্যাহতভাবে থাকা আবশ্যকীয় নয়। শরীরের সাথে রূহের সম্পর্ক এবং তার সাথে তা মিলিত থাকাটা বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে।
১) ইহজগতে শরীরের সাথে রূহের সম্পর্ক জাগ্রত ও ঘুমন্ত অবস্থায়।
২) আলামে বারযাখে শরীরের সাথে রূহের সম্পর্ক মৃত ব্যক্তির অবস্থা ভেদে বিভিন্ন ধরনের।
৩) পুনরুথান দিবসে শরীরের সাথে রূহের সম্পর্ক। তাই আলামে বারযাখে শরীরে রূহ ফেরত দেয়ার কারণে ইহজগতের ন্যায় জীবন যাপন আবশ্যক নয়।
আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত, এ হাদীসের অনুরূপ অর্থে ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত হাদীসে আছে যা ইবনু ‘আবদুল বার বর্ণনা করেছেন। তাতে আছে, ‘‘যে ব্যক্তি তার মু’মিন ভাইয়ের কবরের কাছ দিয়ে যায় যার সাথে দুনিয়াতে তার পরিচয় ছিল। আর সে তাকে সালাম দেয় তাহলে আল্লাহ ঐ মৃত ব্যক্তিকে তার রূহ ফেরত দেন যাতে সে তার ভাইয়ের সালামের প্রতি উত্তর দিতে পারে। আর কোন ব্যক্তিই এ দাবী করেনি যে, এ ফেরত দেয়ার কারণে তার রূহ তার মধ্যে অব্যাহতভাবেই থাকবে। আর এও বলেনি যে, এই ফেরত দেয়ার ফলে তার জন্য ইহকালীন জীবনের মতো তার জীবন যাপন আবশ্যক হয়ে যায়।
এখানে প্রশ্ন উত্থাপন হতে পারে যে, যেহেতু রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত হতে বিরামহীনভাবে সালাত ও সালাম প্রেরিত হচ্ছে সেহেতু তাঁর রূহ সর্বদাই তাঁর সাথে সম্পৃক্ত থাকা আবশ্যক কিনা? যদিও তা অন্য কারো বেলায় প্রযোজ্য নয়। এর জওয়াব এই যে, পরকালের বিষয়সমূহ সাধারণ জ্ঞান দ্বারা বুঝা সম্ভব নয়। আর আলামে বারযাখের অবস্থা পরকালীন জীবনের সাথে সামঞ্জস্যশীল। অতএব, আমরা হাদীসে বর্ণিত বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবো এবং তাতে বর্ণিত বিষয় সত্য বলে গ্রহণ করবো। এর প্রকৃত অবস্থার জ্ঞান আল্লাহর প্রতি প্রত্যার্পণ করবো। আলামে বারযাখের বিষয়গুলোকে ইহকালীন বিষয়ের সাথে তুলনা করবো না। কেননা আলামে বারযাখের বিষয় যা আমাদের দৃষ্টির বাইরে তা ইহকালীন চাক্ষুষ বিষয়ের সাথে তুলনা করা অজ্ঞতা, নির্বুদ্ধিতা, যুলম ও ভ্রষ্টতার শামিল।
পরিচ্ছেদঃ ১৬. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর দরূদ পাঠ ও তার মর্যাদা
৯২৬-[৮] উক্ত রাবী [আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ)] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছিঃ তোমরা তোমাদের ঘরকে কবরস্থান বানিও না, আর আমার কবরকেও উৎসবস্থলে পরিণত করো না। আমার প্রতি তোমরা দরূদ পাঠ করবে। তোমাদের দরূদ নিশ্চয়ই আমার কাছে পৌঁছে, তোমরা যেখানেই থাক না কেন। (আবূ দাঊদ)[1]
وَعَنْهُ قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: «لَا تَجْعَلُوا بُيُوتَكُمْ قُبُورًا وَلَا تَجْعَلُوا قَبْرِي عِيدًا وَصَلُّوا عَلَيَّ فَإِنَّ صَلَاتكُمْ تبلغني حَيْثُ كُنْتُم» . رَوَاهُ النَّسَائِيّ
ব্যাখ্যা: (لَا تَجْعَلُوْا بُيُوْتَكُمْ قُبُوْرًا) তোমরা তোমাদের ঘরকে কবরস্থানে পরিণত করো না। অর্থাৎ- তোমরা ঘরকে কবরের মতো করে ফেলো না যেখানে কোন ‘ইবাদাত করা যায় না। এমনকি সালাতও আদায় করা যায় না। বরং ঘরেও তোমরা সালাত আদায় কর এবং ‘ইবাদাতের একটি অংশ তাতে আদায় কর। এও বলা হয়ে থাকে যে, হাদীসের এ অংশ দ্বারা ঘরে সালাত (সালাত/নামায/নামাজ) আদায় ও ‘ইবাদাত করার জন্য উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। মৃত ব্যক্তি তাদের ঘরে, অর্থাৎ- কবরে সালাত আদায় করে না। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেন বলতে চেয়েছেন তোমরা মৃত ব্যক্তির মতো হইও না যারা তাদের ঘরে সালাত আদায় করে না। আর তা হলো কবর। অথবা তিনি বলেছেন, তোমরা তোমাদের ঘরে সালাত পরিত্যাগ করো না যাতে তোমরা মৃত ব্যক্তির ন্যায় হয়ে যাও। আর তোমাদের ঘরগুলো কবরের মতো হয়ে যায়। এখানে ‘ইবাদাতহীন ঘরকে কবরের সাথে আর ঘরে ‘ইবাদাত থেকে গাফিল ব্যক্তির সাথে তুলনা করা হয়েছে। মূলত এ হাদীসে কবরে ‘ইবাদাত করতে নিষেধ করা হয়েছে এবং ঘরে ‘ইবাদাত করতে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে।
(لَا تَجْعَلُوْا قَبْرِىْ عِيْدًا) আমার কবরকে ঈদগাহে পরিণত করো না। অর্থাৎ- আমার কবর যিয়ারতের নামে ঈদগাহে সমবেত হওয়ার মতো সমবেত হইও না। ঈদের দিন হচ্ছে আনন্দ ও সাজগোজ করার দিন। আর কবর যিয়ারতের অবস্থা এর বিপরীত। ইমাম মা'নাবী বলেন, এর অর্থ হচ্ছে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কবর যিয়ারতের উদ্দেশে ঈদের দিনের মতো সমবেত হতে বারণ করেছেন। এই নিষেধটা তাঁর উম্মাতকে কষ্ট থেকে পরিত্রাণ দেয়া অথবা কবর যিয়ারত করতে যেয়ে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সম্মান দেয়ার ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘন করাও উদ্দেশ্য হতে পারে। এটা তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) অপছন্দ করেছেন সে কারণেও নিষেধ করে থাকতে পারেন। তিনি আরো বলেন, এ হাদীস থেকে এটাও সাব্যস্ত হয় যে, কোন ওলী বা দরবেশের কবরে বছরের কোন নির্দিষ্ট দিনে বা মাসে একত্র হয়ে তার জন্ম দিবস পালন করা, খানাপিনা করা, নাচ গান করা ইসলামী শারী‘আতে নিষিদ্ধ।
ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ্ (রহঃ) তাঁর ‘ইক্বতিযাউস্ সিরাতিল মুস্তাক্বীম’ নামক গ্রন্থে বলেন, এ হাদীসের অর্থ হলো তোমরা ঘরগুলোতে সালাত আদায়, দু‘আ করা ও কুরআন তিলাওয়াত করা বন্ধ করে দিও না। তাহলে তা কবরের ন্যায় হয়ে যাবে। অতএব তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ঘরে ‘ইবাদাত করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং কবরের পাশে ‘ইবাদাত করতে নিষেধ করেছেন।
পরিচ্ছেদঃ ১৬. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর দরূদ পাঠ ও তার মর্যাদা
৯২৭-[৯] উক্ত রাবী [আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ)] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ লাঞ্ছিত হোক সেই ব্যক্তি, যার নিকট আমার নাম উচ্চারিত হয় কিন্তু সে আমার প্রতি দরূদ পাঠ করে না। লাঞ্ছিত হোক সেই ব্যক্তি, যার কাছে রমাযান মাস আসে আবার তার গুনাহ ক্ষমার আগে সে মাস চলে যায়। লাঞ্ছিত হোক সেই ব্যক্তি, যার নিকট তার বৃদ্ধ মা-বাপ অথবা দু’জনের একজন বেঁচে থাকে অথচ তারা তাকে জান্নাতে পৌঁছায় না। (তিরমিযী)[1]
وَعَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «رَغِمَ أَنْفُ رَجُلٍ ذُكِرْتُ عِنْدَهُ فَلَمْ يُصَلِّ عَلَيَّ وَرَغِمَ أَنْفُ رَجُلٍ دَخَلَ عَلَيْهِ رَمَضَانُ ثُمَّ انْسَلَخَ قَبْلَ أَنْ يُغْفَرَ لَهُ وَرَغِمَ أَنْفُ رَجُلٍ أَدْرَكَ عِنْدَهُ أَبَوَاهُ الْكبر أَو أَحدهمَا فَلم يدْخلَاهُ الْجنَّة» . رَوَاهُ التِّرْمِذِيّ
ব্যাখ্যা: (رَغِمَ أَنْفُ) নাক ধূলায় ধূসরিত হোক রূপক অর্থ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে আর তা লাঞ্ছনা, ধ্বংস, অপমান ইত্যাদি।
(فَلَمْ يُصَلِّ عَلَيَّ) যে আমার ওপর দরূদ পাঠ করলো না। ‘আল্লামা শাওকানী ‘তুহফাতুজ্ জাকিরীন’ কিতাবে ২৫ পৃষ্ঠায় বলেন, হাদীসটি প্রমাণ করে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নাম উল্লেখ করার সময় তাঁর প্রতি দরূদ পাঠ করা আবশ্যক। আবশ্যক না হলে যারা দরূদ পাঠ করে না তাদের জন্য লাঞ্ছনা ও ধ্বংসের বদদু‘আ করতেন না।
আর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর দরূদ পাঠ করা মূলত তাঁর সম্মান ও মর্যাদার ঘোষণা দেয়া। সুতরাং যে ব্যক্তি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সম্মান করবে, আল্লাহ তাকে সম্মানিত করবেন এবং দুনিয়া ও আখিরাতে মর্যাদা বাড়িয়ে দিবেন।
আর যে ব্যক্তি তাঁকে সম্মান করবে না, আল্লাহ তাকে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করবেন। বিবেকবানের নিকট মর্যাদার বিষয়টি বুঝতে সমস্যা হলেও মু’মিনার বিশ্বাস করে একবার দরূদ পাঠ করলে অসংখ্য প্রতিদান পাবে। সুতরাং একবার দরূদ পাঠ করলে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর ওপর দশবার রহমাত করবেন এবং তাঁর দশটি মর্যাদা বাড়িয়ে দিবেন এর দশটি গুনাহ মাফ করে দিবেন যে ব্যক্তি এটা গনীমাত মনে করবে না তথা দরূদ পাঠ করবে না, সে এ সমস্ত ফাযীলাত থেকে বঞ্চিত হবে। বাস্তব হলো আল্লাহ তাকে লাঞ্চিত করবেন। আর তার ওপর দুঃখ-দুর্দশা চেপে বসবে।
অনুরূপ রমাযান মাস, সম্মানিত মাস যে মাসে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। সে কুরআন মানুষের জন্য হিদায়াত এবং সত্য পথযাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথ-নির্দেশক আর ন্যায়-অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য সৃষ্টিকারী। যে ব্যক্তি এ মাসকে সম্মানিত হওয়ার সুযোগ হিসেবে পেল। ঈমান ও প্রতিদানের আশায় সিয়াম ও ক্বিয়ামের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা তাকে সম্মানিত করবেন আর যে ব্যক্তি এ মাসকে সম্মানিত করলো না তথা সিয়াম ও ক্বিয়াম (কিয়াম) সাধনা করলো না আল্লাহ তাকে অপমানিত করবেন।
আর পিতা-মাতাকে সম্মান করার অর্থ হলো আল্লাহ তা‘আলাকে সম্মান করা এজন্য আল্লাহ তা‘আলা তাদের (পিতা-মাতা) প্রতি সদ্ব্যবহার করা ও সম্মানজনক আচরণ করা তার একত্ববাদ ও ‘ইবাদাতের সাথে সংশ্লিষ্ট করেছেন, যেমন আল্লাহ বলেনঃ ‘‘তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, তাকে ছাড়া অন্য কারও ‘ইবাদাত করো না এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করো।’’ (বানী ইসরাঈল ১৭ : ২৩)
সুতরাং যে ব্যক্তি তাদের সাথে সৎ আচরণ ও খিদমাত করা থেকে নিজেদেরকে গুটিয়ে রাখে বিশেষ করে বার্ধক্যে অবস্থায় যখন তারা বাড়ীতে অত্যন্ত দুর্বল অবস্থায় থাকে এবং তাদের তত্ত্বাবধানের আর কোন লোক থাকে না সে ছাড়া এ সময়টাকে যদি গনীমাত মনে না করে তাহলে আল্লাহ তাকে ধ্বংস ও লাঞ্ছিত করবেন।
(لَمْ يُدْخِلَاهُ الْجَنَّةَ) তাকে তারা (পিতা-মাতারা) জান্নাতে প্রবেশ করায়নি। আল্লাহর পক্ষ হতে জান্নাতের প্রবেশ অনুমোদন হবে পিতা-মাতার সাথে সদাচরণ ও সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে। (জান্নাতে যাওয়ার জন্য) পিতা-মাতার সম্বন্ধের বিষয়টি মূলত রূপক যেমন বলা হয় বসন্তকাল শস্য উৎপন্ন করেছে।
পরিচ্ছেদঃ ১৬. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর দরূদ পাঠ ও তার মর্যাদা
৯২৮-[১০] আবূ ত্বলহাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীগণের কাছে তাশরীফ আনলেন। তখন তাঁর চেহারায় বড় হাসি-খুশী ভাব। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, আমার নিকট জিবরীল (আঃ) এসেছিলেন। তিনি আমাকে বললেন, হে মুহাম্মাদ! আপনার রব বলেছেন, আপনি কি এ কথায় সন্তুষ্ট নন যে, আপনার উম্মাতের যে কেউ আপনার ওপর একবার দরূদ পাঠ করবে আমি তার ওপর দশবার রহমত বর্ষণ করবো? আর আপনার উম্মাতের কোন ব্যক্তি আপনার ওপর একবার সালাম পাঠালে আমি তার উপর দশবার সালাম পাঠাবো? (নাসায়ী ও দারিমী)[1]
وَعَن أبي طَلْحَة أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ جَاءَ ذَاتَ يَوْمٍ وَالْبِشْرُ فِي وَجْهِهِ فَقَالَ: إِنَّهُ جَاءَنِي جِبْرِيلُ فَقَالَ: إِنَّ رَبَّكَ يَقُولُ أَمَا يُرْضِيكَ يَا مُحَمَّدُ أَنْ لَا يُصَلِّيَ عَلَيْكَ أَحَدٌ مِنْ أُمَّتِكَ إِلَّا صَلَّيْتُ عَلَيْهِ عَشْرًا وَلَا يُسَلِّمُ عَلَيْكَ أَحَدٌ مِنْ أُمَّتِكَ إِلَّا سَلَّمْتُ عَلَيْهِ عَشْرًا؟ . رَوَاهُ النَّسَائِيُّ وَالدَّارِمِيُّ
ব্যাখ্যা: (وَالْبِشْرُ) হাস্যোজ্জ্বল, আনন্দ ও উৎফুল্লতার চিহ্ন। (فِـىْ وَجْهِه) বাহ্যিক চামড়ায় নাসায়ীর রিওয়ায়াতে এসেছে, ‘‘আমরা (সাহাবীরা) বললাম, আপনার চেহারায় আনন্দ দেখছি।’’
আর দারিমীতে বর্ণিত হয়েছে, ‘‘একদা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসলেন এবং তার চেহারায় আনন্দ দেখা যাচ্ছে। কোন এক সাহাবী বললেন, হে আল্লাহর রসূল! আমরা আপনার চেহারায় উৎফুল্লতা দেখছি ইতিপূর্বে এমনটি দেখিনি।’’
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, জিবরীল (আঃ) আমার নিকট এসেছিলেন। তিনি বলেছেন, হে মুহাম্মাদ! আপনার প্রতিপালক বলেছেন, এটা কি আপনাকে সন্তুষ্ট করবে না?
ইমাম ত্বীবী বলেন, এ সন্তুষ্টি অংশবিশেষ, যেমন আল্লাহ কুরআনে বলেছেনঃ
‘‘আপনার পালনকর্তা অতিসত্ত্বর দান করবেন, অতঃপর আপনি সন্তুষ্ট হবেন।’’ (সূরাহ্ আয্ যুহা ৯৩ : ৫)
আর সত্যিকার অর্থে এ সুসংবাদ উম্মাতের প্রতিও বর্তায় আর হাদীসটি প্রমাণ করে দরূদের মতো সালামও তাঁর ওপর পাঠ করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা সালাম বা শান্তি প্রেরণ করেন। তার ওপর যে ব্যক্তি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর সালাম প্রেরণ করে যেরূপ তিনি দশবার রহমাত বর্ষণ করে ঐ ব্যক্তির ওপর যে ব্যক্তি একবার রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি দরূদ বা রহমাত প্রেরণ করেন।
পরিচ্ছেদঃ ১৬. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর দরূদ পাঠ ও তার মর্যাদা
৯২৯-[১১] উবাই ইবনু কা’ব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে গিয়ে আরয করলাম, হে আল্লাহর রসূল! আমি আপনার উপর অনেক বেশী দরূদ পাঠ করি। আপনি আমাকে বলে দিন আমি (দু’আর জন্য যতটুকু সময় বরাদ্দ করে রেখেছি তার) কতটুকু সময় আপনার উপর দরূদ পাঠাবার জন্য নির্দিষ্ট করব? উত্তরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার মন যা চায়। আমি আরয করলাম, যদি এক-তৃতীয়াংশ করি? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার মন যা চায়, যদি আরো বেশী কর তাহলে তা তোমার জন্য কল্যাণকর। আমি আরয করলাম, যদি অর্ধেক সময় নির্ধারণ করি? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমার মন যতটুকু চায় কর। যদি আরো বেশী নির্ধারণ কর তাহলে তোমর জন্যই ভালো। আমি বললাম, যদি দুই-তুতীয়াংশ করি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার মন যা চায়। যদি আরো বেশি নির্ধারণ কর তোমার জন্যই কল্যাণকর। আমি আরয করলাম, তাহলে আমি আমার দু’আর সবটুকু সবসময়ই আপনার উপর দরূদ পড়ার কাজে নির্দিষ্ট করে দেব। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তবে এটাই তোমার জন্য যথেষ্ট হবে, তোমার দীন-দুনিয়ার মকসুদ পূর্ণ হবে এবং তোমার গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। (তিরমিযী)[1]
وَعَنْ أُبَيِّ بْنِ كَعْبٍ قَالَ: قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنِّي أُكْثِرُ الصَّلَاةَ عَلَيْكَ فَكَمْ أَجْعَلُ لَكَ مِنْ صَلَاتِي؟ فَقَالَ: «مَا شِئْتَ» قُلْتُ: الرُّبُعَ؟ قَالَ: «مَا شِئْتَ فَإِنْ زِدْتَ فَهُوَ خَيْرٌ لَكَ» . قُلْتُ: النِّصْفَ؟ قَالَ: «مَا شِئْتَ فَإِنْ زِدْتَ فَهُوَ خَيْرٌ لَكَ» قُلْتُ: فَالثُّلُثَيْنِ؟ قَالَ: «مَا شِئْتَ فَإِنْ زِدْتَ فَهُوَ خَيْرٌ لَكَ» قُلْتُ: أَجْعَلُ لَكَ صَلَاتِي كُلَّهَا؟ قَالَ: «إِذا يكفى همك وَيكفر لَك ذَنْبك» . رَوَاهُ التِّرْمِذِيّ
ব্যাখ্যা: উবাই ইবনু কা‘ব বলেন, রাতের দু’ তৃতীয়াংশ যখন অতিবাহিত হত তখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাঁড়াতেন এবং বলতেন, হে মানব সকল! তোমরা আল্লাহকে বেশী বেশী স্মরণ কর। অতঃপর সেদিন পশ্চাতে প্রকম্পিত হয়ে মৃত্যু আসবে। উবাই বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রসূল! আমি আপনার প্রতি বেশী বেশী দরূদ পাঠ করি (সালাত তথা দরূদ দ্বারা উদ্দেশ দু‘আ) ‘‘অতএব আমার সালাতের কত সংখ্যা আপনার জন্য নির্ধারণ করব?’’ আমার দু‘আর অধিকাংশ দু‘আ আপনার উপর দরূদ পাঠের জন্য কী পরিমাণ সময় নির্ধারিত করব?
(أَجْعَلُ لَكَ صَلَاتِيْ كُـلَّهَا) আমার দু‘আর পুরা সময়টা আপনার ওপর দরূদ পাঠের মাধ্যমে শেষ করব।
(تُكْفـى هَمَّكَ) তাহলে তোমার সব আশা আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হবে।
(هَمٌّ) ‘হাম্মুন’ দ্বারা উদ্দেশ্য মানুষ দুনিয়া ও আখিরাতের বিষয়ে যা কামনা করে। অর্থাৎ- তুমি যখন তোমার দু‘আর সব সময়টুকু রসূলের প্রতি দরূদে ব্যয় করবে তখন দুনিয়া ও আখিরাতের বিষয়ে সকল চিন্তা দূরীভূত হওয়ার জন্য যথেষ্ট হবে।
আর আকাঙ্ক্ষা পূরণ ও গুনাহ মাফের বিষয়টি দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণের সমষ্টি। নিঃসন্দেহে যার আকাঙ্ক্ষা ও উদ্বিগ্ন পূরণে আল্লাহ যথেষ্ট হোন সে দুনিয়ার সমস্ত কষ্ট-ক্লেশ ও ঝামেলা হতে নিরাপদ হয়। কেননা প্রত্যেক কষ্ট, ক্লেশ পরীক্ষারই একটি চিহ্ন থাকে তা যতই সহজ ও সামান্য হোক না কেন।
আর আল্লাহ যার গুনাহ মাফ করে দিবেন সে আখিরাতের দুশ্চিন্তা ও পরীক্ষা হতে মুক্ত হবে। কেননা সেখানে গুনাহের কারণে বান্দা ধ্বংস হবে।
পরিচ্ছেদঃ ১৬. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর দরূদ পাঠ ও তার মর্যাদা
৯৩০-[১২] ফুযালাহ্ ইবনু ’উবায়দ (রাঃ)হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপবিষ্ট ছিলেন। তখন একজন লোক এলেন। তিনি সালাত (সালাত/নামায/নামাজ) আদায় করলেন এবং এই দু’আ পড়লেন, ’’আল্লা-হুম্মাগফিরলী ওয়ারহামনী’’ (অর্থাৎ- হে আল্লাহ! তুমি আমাকে ক্ষমা কর ও আমার ওপর রহম কর)। এ কথা শুনে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে সালাত আদায়কারী! তুমি তো নিয়ম ভঙ্গ করে বড্ড তাড়াহুড়া করলে। তারপর তিনি বললেন, তুমি সালাত শেষ করে দু’আর জন্য বসবে। আল্লাহর যথাযোগ্য প্রশংসা করবে। আমার ওপর দরূদ পড়। তারপর তুমি যা চাও আল্লাহর কাছে দু’আ করবে।
ফুযালাহ্ (রাঃ)বলেন, এরপর আর এক ব্যক্তি এলো, সালাত আদায় করলো। সে সালাত শেষে আল্লাহর প্রশংসা করলো, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর দরূদ পাঠ করলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে সালাত আদায়কারী! আল্লাহর কাছে দু’আও কর। দু’আ কবূল করা হবে। (তিরমিযী)[1]
আবূ দাঊদ, নাসায়ী-ও এরূপই বর্ণনা করেছেন।
وَعَن فضَالة بن عُبَيْدٍ قَالَ: بَيْنَمَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَاعِدٌ إِذْ دَخَلَ رَجُلٌ فَصَلَّى فَقَالَ: اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِي وَارْحَمْنِي فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «عَجِلْتَ أَيُّهَا الْمُصَلِّي إِذَا صَلَّيْتَ فَقَعَدْتَ فَاحْمَدِ اللَّهَ بِمَا هُوَ أَهْلُهُ وَصَلِّ عَلَيَّ ثُمَّ ادْعُهُ» . قَالَ: ثُمَّ صَلَّى رَجُلٌ آخَرُ بَعْدَ ذَلِكَ فَحَمِدَ اللَّهَ وَصَلَّى عَلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «أَيُّهَا الْمُصَلِّي ادْعُ تُجَبْ» . رَوَاهُ التِّرْمِذِيُّ وَرَوَى أَبُو دَاوُدَ وَالنَّسَائِيّ نَحوه
ব্যাখ্যা: হাদীসটি ইঙ্গিত করে আবেদনকারী তার অভাব পূরণকারীর নিকট প্রয়োজনীয় কিছু আবেদনের পূর্বে এমন কিছু উপস্থাপন করবে যা দ্বারা তাঁর নিকটবর্তী হওয়া সম্ভব হয়।
এ হাদীসকে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলে দিয়েছেন কিভাবে মহান রবের নিকট বান্দা তার প্রয়োজন পূরণের জন্য দু‘আ করবে।
এ হাদীস দ্বারা প্রমাণ হয়, সালাতে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর দরূদ পাঠ করা আবশ্যক।
আর ‘আমীর ইয়ামানী বলেন, শেষ বৈঠকে দু‘আ করাও ওয়াজিব হিসেবে সাব্যস্ত হয়েছে এবং দু‘আর পূর্বে ‘‘রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর দরূদ পাঠ।’’ যেমনটি জানা যায় ফুযালার হাদীস হতে। এজন্য দু‘আ কবূলের পূর্ণাঙ্গতা আসবে, তাশাহুদের পরে দু‘আর পূর্বে রসূলের ওপর দরূদ পাঠ প্রেরণের মাধ্যমে।
পরিচ্ছেদঃ ১৬. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর দরূদ পাঠ ও তার মর্যাদা
৯৩১-[১৩] ’আবদুল্লাহ ইবনু মাস্’ঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি সালাত (সালাত/নামায/নামাজ) আদায় করছিলাম, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ও উপস্থিত ছিলেন। তাঁর কাছে ছিলেন আবূ বকর ও ’উমার (রাঃ)। সালাত শেষে আমি যখন বসলাম, আল্লাহ তা’আলার প্রশংসা করলাম, এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর দরূদ পাঠ করলাম। তারপর আমি আমার নিজের জন্য দু’আ করতে লাগলাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, চাও, তোমাকে দেয়া হবে। চাও, তোমাকে দেয়া হবে। (তিরমিযী)[1]
وَعَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ قَالَ: كُنْتُ أُصَلِّي وَالنَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَأَبُو بَكْرٍ وَعُمَرُ مَعَهُ فَلَمَّا جَلَسْتُ بَدَأْتُ بِالثَّنَاءِ عَلَى اللَّهِ تَعَالَى ثُمَّ الصَّلَاةُ عَلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ثُمَّ دَعَوْتُ لِنَفْسِي فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «سَلْ تعطه سل تعطه» . رَوَاهُ التِّرْمِذِيّ
ব্যাখ্যা: তাশাহুদের বৈঠকে দু‘আর পূর্বে আল্লাহর প্রশংসা ও নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর দরূদ পাঠ করা শারী‘আত সম্মত হিসেবে প্রমাণ করে। যাতে তা দু‘আ কবূলের জন্য ওয়াসীলা স্বরূপ হয়। আর এটা ‘আবদুল্লাহ ইবনু মাস্‘ঊদ (রাঃ)-এর বর্ণিত হাদীসের অনুকূলে। তিনি বলেন, লোকটি তাশাহুদ পড়ল। অতঃপর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর দরূদ পাঠ করলো, এরপর নিজের জন্য দু‘আ করলো। এ হাদীসকে এর পূর্ববর্তী হাদীসের ব্যাখ্যা হিসেবেও গ্রহণ করা যায়।