আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীদেরকে সুসংবাদ দিয়ে বলেন,
«قَدْ جَاءَكُمْ شَهر رَمَضَانُ، شَهْرٌ مُبَارَكٌ، كَتَب اللهُ عَلَيْكُمْ صِيَامَهُ، فِيهِ تُفْتَحُ أَبْوَابُ الْجَنَّةِ، وَتُغْلَقُ فِيهِ أَبْوَابُ الْجَحِيمِ، وَتُغَلُّ فِيهِ الشَّيَاطِينُ، فِيهِ لَيْلَةٌ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ، مَنْ حُرِمَ خَيْرَهَا فَقَدْ حُرِمَ».
“তোমাদের নিকট রমযান মাস উপস্থিত হয়েছে, যা একটি বরকতময় মাস। তোমাদের ওপর আল্লাহ তা‘আলা এ মাসের সাওম ফরয করেছেন। এ মাস আগমনের কারণে জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়, জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয়, আর আল্লাহর অবাধ্য শয়তানদের গলায় লোহার বেড়ী পরানো হয়। এ মাসে একটি রাত রয়েছে যা এক হাজার মাস অপেক্ষাও উত্তম। যে ব্যক্তি সে রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত রয়ে গেল সে প্রকৃত বঞ্চিত রয়ে গেল।”[1]
কবি বলেছেন:
সাওমের মাস বরকত নিয়ে এসেছে দুয়ারে। অতএব, তোমরা অতিথিকে সম্মান করো, সে আসছে।
‘উবাদা ইবন সামিত রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু মারফু‘ সূত্রে বর্ণনা করেন,
«أَتَاكُمْ رَمَضَانُ شَهْرُ بَرَكَةٍ، فِيهِ خَيْرٌ يُغَشِّيكُمُ اللَّهُ فِيهِ، فَتَنْزِلُ الرَّحْمَةَ، وَتُحَطُّ الْخَطَايَا، وَيُسْتَجَابُ فِيهِ الدُّعَاءُ، فَيَنْظُرُ اللَّهُ إِلَى تَنَافُسِكُمْ، وَيُبَاهِي بِكُمْ مَلَائِكَتَهُ، فَأَرُوا اللَّهَ مِنْ أَنْفُسِكُمْ خَيْرًا، فَإِنَّ الشَّقِيَّ منْ حُرِمَ فِيهِ رَحْمَةَ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ».
“তোমাদের কাছে রমযান মাস এসেছে, বরকতের মাস। এ মাসে রয়েছে কল্যাণ, আল্লাহ তোমাদেরকে সে কল্যাণে আবৃত করে দেন। ফলে তিনি রহমত নাযিল করেন, গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয় এবং এ মাসে দো‘আ কবুল করা হয়। আল্লাহ তোমাদের (সৎ কাজের) প্রতিযোগিতার দিকে তাকান এবং তিনি তোমাদেরকে নিয়ে ফিরিশতাদের কাছে গর্ব করেন। সুতরাং তোমরা তোমাদের নিজেদের কল্যাণ আল্লাহকে দেখাও। কেননা হতভাগা তো সে ব্যক্তি যে এ মাসে মহান আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হয়।”[2]
সহীহাইনে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«إِذَا دَخَلَ شَهْرُ رَمَضَانَ فُتِّحَتْ أَبْوَابُ السَّمَاءِ، وَغُلِّقَتْ أَبْوَابُ جَهَنَّمَ، وَسُلْسِلَتِ الشَّيَاطِينُ».
“রমযান মাস আসলে আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয় আর শয়তানকে শৃঙ্খলিত করে দেওয়া হয়।”[3]
সহীহ মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে,
«فُتِّحَتْ أَبْوَابُ الرَّحْمَةِ».
“রহমাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়।”[4]
সহীহ মুসলিমে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে মারফু‘ সূত্রে আরও বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«إِذَا جَاءَ رَمَضَانُ فُتِّحَتْ أَبْوَابُ الْجَنَّةِ، وَغُلِّقَتْ أَبْوَابُ النَّارِ، وَصُفِّدَتِ الشَّيَاطِينُ».
“যখন রমযান আসে তখন জান্নাতের দরজাসমূহ উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়, জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং শয়তানকে শিকলে বন্দী করা হয়”।[5]
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«إِذَا كَانَ أَوَّلُ لَيْلَةٍ مِنْ شَهْرِ رَمَضَانَ صُفِّدَتِ الشَّيَاطِينُ، وَمَرَدَةُ الجِنِّ، وَغُلِّقَتْ أَبْوَابُ النَّارِ، فَلَمْ يُفْتَحْ مِنْهَا بَابٌ، وَفُتِّحَتْ أَبْوَابُ الجَنَّةِ، فَلَمْ يُغْلَقْ مِنْهَا بَابٌ، وَيُنَادِي مُنَادٍ: يَا بَاغِيَ الخَيْرِ أَقْبِلْ، وَيَا بَاغِيَ الشَّرِّ أَقْصِرْ، وَلِلَّهِ عُتَقَاءُ مِنَ النَّارِ، وَذَلكَ كُلُّ لَيْلَةٍ».
“শয়তান ও দুষ্ট জিন্নদেরকে রমযান মাসের প্রথম রাতেই শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়, জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং এর একটি দরজাও তখন আর খোলা হয় না। জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয় এবং এর একটি দরজাও তখন আর বন্ধ করা হয় না। (এ মাসে) একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা দিতে থাকেন, হে কল্যাণ অন্বেষণকারী! অগ্রসর হও। হে পাপাসক্ত! বিরত হও। আর বহু লোককে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে এ মাসে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করে দেওয়া হয় এবং প্রত্যেক রাতেই এরূপ থেকে থাকে।”[6]
....
‘আমর ইবন মুররাহ আল-জুহানী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«جَاءَ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَجُلٌ مِنْ قُضَاعَةَ، فَقَالَ لَهُ: يَا رَسُولَ اللَّهِ أَرَأَيْتَ إِنْ شَهِدْتُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَأَنَّكَ رَسُولُ اللَّهِ، وَصَلَّيْتُ الصَّلَوَاتِ الْخَمْسَ، وَصُمْتُ الشَّهْرَ، وَقُمْتُ رَمَضَانَ، وَآتَيْتُ الزَّكَاةَ، فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَنْ مَاتَ عَلَى هَذَا كَانَ مِنَ الصِّدِّيقِينَ وَالشُّهَدَاءِ».
“কুযা‘আ থেকে এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমি যদি সাক্ষ্য দেই যে, আল্লাহ ব্যতীত আর কোনো (সত্য) ইলাহ নেই, আপনি আল্লাহর রাসূল, পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করি, রমযান মাসের সাওম পালন করি ও রমযানের রাতে সালাত আদায় করি এবং যাকাত আদায় করি তাহলে আমার ব্যাপারে আপনি কী মনে করেন? রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “যে ব্যক্তি এরূপ আমল করে মারা যাবে সে সিদ্দীক ও শহীদগণের সাথে থাকবেন”।[7]
আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযান মাস পর্যন্ত পৌঁছার দো‘আ করতেন। তিনি রজব মাস আসলে বলতেন,
«اللَّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِي رَجَبٍ وَشَعْبَانَ، وَبَلِّغْنَا رَمَضَانَ».
“হে আল্লাহ আমাদেরকে রজব ও শা‘বান মাসে বরকত দান করুন এবং রমযান মাস পর্যন্ত আমাদেরকে পৌঁছান (হায়াত দান করুন)।”[8]
‘আব্দুল ‘আযীয ইবন মারওয়ান রহ. বলেন, রমযান মাস আগমন করলে মুসলিমগণ বলত, হে আল্লাহ! রমযান মাস আমাদের উপর ছায়ার মত এসে যাচ্ছে। অতএব, তাকে আমাদের মাঝে পৌঁছে দাও এবং আমাদেরকে তার কাছে সোপর্দ করুন। আমাদেরকে রমযানের সাওম ও সালাত আদায়ের তাওফিক দান করুন। এ মাসে কঠোর পরিশ্রম ও ইজতিহাদ, শক্তি ও কর্ম তৎপরতা দান করুন এবং ফিতনা থেকে আমাদেরকে রক্ষা করুন।
মু‘আল্লা ইবন ফযল রহ. বলেন, আগেকার মুসলিমগণ রমযানের আগের ছয়মাস রমযান পাওয়ার জন্য দো‘আ করতেন। আর বাকী ছয়মাস তাদের আমল কবুল হওয়ার দো‘আ করতেন।
ইয়াহইয়া ইবন আবু কাসীর রহ. বলেন, তাদের দো‘আ ছিলো, হে আল্লাহ আমাকে রমযানের জন্য সুস্থ রাখুন, রমযানকে আমার কাছে সোপর্দ করুন এবং আমার আমল কবুল হওয়াসহ রমযানকে আপনি গ্রহণ করুন।
রমযান মাস পাওয়া ও এতে সাওম পালন করা অনেক বড় নি‘আমত। একথার দলীল হলো তিন ব্যক্তির হাদীস, যারা জিহাদে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। তাদের দু’জন শহীদ হন এবং আরেকজন তাদের পরে বিছানায় স্বাভাবিকভাবে মারা যান। আগে মারা যাওয়া দু’জনকে স্বপ্নে দেখানো হলো। তাদের ব্যাপারে শুনে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
«أَلَيْسَ قَدْ مَكَثَ هَذَا بَعْدَهُ سَنَةً؟ " قَالُوا: بَلَى. قال: " وَأَدْرَكَ رَمَضَانَ فَصَامَهُ؟ " قَالُوا: بَلَى قال: " وَصَلَّى كَذَا وَكَذَا سَجْدَةً فِي السَّنَةِ؟ " قَالُوا: بَلَى، قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: " فَلَمَا بَيْنَهُمَا أَبْعَدُ مَا بَيْنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ».
“সে কি তার পরে একবছর বেঁচে ছিল না? তারা বললেন, হ্যাঁ। তিনি বললেন, সে কি রমযান পায় নি এবং এর সাওম পালন করে নি? তারা বললেন, জি হ্যাঁ। তিনি বললেন, সে কি বিগত একবছর এত এত রাকাত সালাত আদায় করে নি ও সিজদা করে নি? তারা বললেন, হ্যাঁ। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাহলে তাদের মধ্যে আসমান ও জমিন সম পার্থক্য হবে।”[9]
‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! রমযান মাস এসেছে, তবে কী দো‘আ পড়বো? তিনি বলেন, তুমি বলবে,
«اللَّهُمَّ إِنَّكَ عَفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّي».
“হে আল্লাহ! তুমি ক্ষমাকারী, তুমি ক্ষমা করতে ভালোবাসো। অতএব, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও।”[10]
রমযান এসেছে। এতে রয়েছে নিরাপত্তা, জাহান্নাম থেকে মুক্তি এবং জান্নাতে ঘর পাওয়ার মহাসফলতা। যে ব্যক্তি এ মাসে লাভবান হতে পারবে না তাহলে সে আর কখন লাভবান হবে? যে ব্যক্তি এ মাসে তার মাওলার (আল্লাহর) নৈকট্য লাভ করতে পারবে না সে এরপরে তাঁর নৈকট্য লাভ করতে পারবে না। যে ব্যক্তির ওপর আল্লাহ এ মাসে রহম করবেন সে তাঁর রহমতপ্রাপ্ত হবে আর যে ব্যক্তি তাঁর রহমত থেকে বঞ্চিত হবে সে প্রকৃতপক্ষেই বঞ্চিত।
কবি বলেছেন:
لتطهير القلوب من الفساد
أتى رمضـــان مزرعة العباد
وزادَك فاتخذه للمعــــــاد
فأدِّ حقوقــــــه قولا وفعلا
تأوه نادمًا عند الحصـــــاد
فمن زرع الحبوب وما سقاها
বান্দার ইবাদতের শস্যক্ষেতস্বরূপ রমযান এসেছে ফিতনা-ফ্যাসাদ থেকে তাদের অন্তরকে পবিত্র করতে। অতএব, কথা ও কাজে এর হক আদায় করো, এটি তোমার জন্য পাথেয়স্বরূপ। অতএব, কিয়ামতের দিনের পাথেয় হিসেবে একে গ্রহণ করো। যে ব্যক্তি শস্য চাষ করল অথচ সেচ দিলো না সে ফসল তোলার সময় লজ্জিত হবে।
[2] মুসনাদুশ শামিয়্যীন, তাবরানী, ৩/২৭১, হাদীস নং ২২৩৮। কিতাবটির লেখক আব্দুর রহমান ইবন মুহাম্মাদ ইবন কাসেম বলেন, হাদীসটির বর্ণনাকারীগণ সিকাহ; তারতীবুল আমালিল খামীসিয়্যাহ লিশশাজারী, ইয়াহইয়া ইবন হুসাইন আশ-শাজারী আল-জুরজানী, ১/৩৫০, হাদীস নং ১২৩৪।
[3] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮৯৯।
[4] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০৭৯।
[5] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০৭৯।
[6] তিরমিযী, হাদীস নং ৬৮২, ইমাম তিরমিযী রহ. বলেছেন, এ পরিচ্ছেদে আব্দুর রহমান ইবন ‘আউফ, ইবন মাস‘ঊদ ও সালমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম থেকে হাদীস বর্ণিত আছে। ইবন মাজাহ, হাদীস নং ১৬৪২। আলবানী রহ. বলেছেন, হাদীসটি সহীহ। নাসাঈ, হাদীস নং ২১০৭। মুসতাদরাক হাকিম, হাদীস নং ১৫৩২, তিনি হাদীসটিকে বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুযায়ী সহীহ বলেছেন।
[7] ইবন খুযাইমাহ, হাদীস নং ২২১২, আলবানী রহ. হাদীসের সনদটি সহীহ বলেছেন। সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীস নং ৩৪৩৮, শু‘আইব আরনাঊত হাদীসের সনদটিকে শাইখাইনের শর্তানুযায়ী সহীহ বলেছেন।
[8] মু‘জামুল আওসাত, তাবরানী, ৪/১৮৯, হাদীস নং ৩৯৩৯, তাবরানী রহ. বলেন, এ সনদ ব্যতীত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এ হাদীসটি বর্ণিত হয় নি, যায়েদ ইবন আবু রুকাদ এককভাবে বর্ণনা করেছেন। শু‘আবুল ঈমান, বাইহাকী, ৫/৩৪৮, হাদীস নং ৩৫৩৪। ইমাম হাইসামী রহ. মাজমা‘উয যাওয়ায়েদে (৩/১৪০) বলেন, হাদীসটি ইমাম তাবরানী রহ. আল-আওসাতে যায়েদ ইবন আবু রুকাদ থেকে বর্ণনা করেছেন। তার ব্যাপারে ইমামগণ মতানৈক্য করেছেন। কেউ কেউ তাকে সিকাহ বলেছেন।
[9] মুসনাদ আহমাদ, হাদীস নং ১৪০৩, শু‘আইব আরনুঊত হাদীসটিকে হাসান লিগাইরিহি বলেছেন। সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীস নং ২৯৮২, আলবানী রহ. ‘আততা‘লীক আততারগীব’ (১/১৪২) এ হাদীসটি সহীহ বলেছেন।
[10] তিরমিযী, ৩৫৩১, ইমাম তিরমিযী রহ. বলেছেন, হাদীসটি হাসান সহীহ। ইবন মাজাহ, ৩৮৫০, আলবানী রহ. বলেছেন, হাদীসটি সহীহ। মুসতাদরাক হাকিম, ১৯৪২, ইমাম হাকিম রহ. বলেছেন, হাদিসটি বুখারী ও মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী সহীহ, তবে তারা কেউ তাখরিজ করেননি।
সহীহাইনে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«كُلُّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ يُضَاعَفُ، الْحَسَنَةُ عَشْرُ أَمْثَالِهَا إِلَى سَبْعمِائَة ضِعْفٍ، قَالَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ: إِلَّا الصَّوْمَ، فَإِنَّهُ لِي وَأَنَا أَجْزِي بِهِ، يَدَعُ شَهْوَتَهُ وَطَعَامَهُ مِنْ أَجْلِي. لِلصَّائِمِ فَرْحَتَانِ: فَرْحَةٌ عِنْدَ فِطْرِهِ، وَفَرْحَةٌ عِنْدَ لِقَاءِ رَبِّهِ، ولَخُلُوفُ فَمِ الصَّائِمِ أَطْيَبُ عِنْدَ اللَّهِ مِنْ رِيحِ المِسْكِ».
“আদম সন্তানের প্রতিটি কাজই দশগুণ থেকে সাতশত গুণ বৃদ্ধি করা হয়। মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন, কিন্তু সাওম ব্যতীত। কেননা তা আমার জন্য, তাই আমি এর প্রতিদান দেবো। সে আমার সন্তুষ্টির জন্য কামাচার ও পানাহার পরিত্যাগ করে। সাওম পালনকারীর জন্য রয়েছে দু’টি খুশী যা তাঁকে খুশী করে। যখন সে ইফতার করে, সে খুশী হয় এবং যখন সে তাঁর রবের সাথে সাক্ষাৎ করবে, তখন সাওমের বিনিময়ে আনন্দিত হবে। সাওম পালনকারীর মুখের (না খাওয়াজনিত) ঘ্রাণ আল্লাহর নিকট মিসকের ঘ্রাণের চেয়েও উত্তম”।[1]
অন্য বর্ণনায় এসেছে,
«قَالَ اللَّهُ: كُلُّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ لَهُ إِلَّا الصِّيَامَ، فَإِنَّهُ لِي».
“সাওম ব্যতীত আদম সন্তানের প্রতিটি কাজই তাঁর নিজের জন্য; কিন্তু সাওম আমার জন্য”।[2]
বুখারীর বর্ণনায় এসেছে,
«لِكُلِّ عَمَلٍ كَفَّارَةٌ، وَالصَّوْمُ لِي وَأَنَا أَجْزِي بِهِ».
“প্রত্যেক আমলেরই কাফফারা আছে। সাওম আমার জন্য, তাই আমি এর প্রতিদান দেবো”।[3]
মুসনাদে আহমাদের বর্ণনায় এসেছে,
«لِكُلِّ عَمَلٍ كَفَّارَةٌ، وَالصَّوْمُ لِي وَأَنَا أَجْزِي بِهِ».
“প্রত্যেক আমলেরই কাফফারা আছে। সাওম আমার জন্য, তাই আমি এর প্রতিদান দেবো”।[4]
প্রথম বর্ণনায় সাওমকে অন্যান্য আমলের বর্ধিত সাওয়াব থেকে আলাদা করা হয়েছে। অন্যান্য আমলের সাওয়াব দশ গুণ থেকে সাতশত গুণ করার কথা বলা হলেও সাওমের ব্যাপারটি আলাদা। কেননা এর সাওয়াব সীমাবদ্ধ নয়; বরং আল্লাহ সাওমের সাওয়াব বহু গুণে দান করবেন। কেননা সাওম সবর তথা ধৈর্য থেকে এসেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿إِنَّمَا يُوَفَّى ٱلصَّٰبِرُونَ أَجۡرَهُم بِغَيۡرِ حِسَابٖ ١٠﴾ [الزمر: ١٠]
“কেবল ধৈর্যশীলদেরকেই তাদের প্রতিদান পূর্ণরূপে দেওয়া হবে কোনো হিসাব ছাড়াই”। [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ১০]
এ কারণে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«شَهْرُ رمضان شهر الصَّبْرِ».
“রমযান মাস ধৈর্যের মাস”।[5]
ধৈর্য তিন প্রকার। আল্লাহর আনুগত্যের ওপর ধৈর্যধারণ করা, আল্লাহর হারাম জিনিস থেকে বিরত থাকতে ধৈর্যধারণ করা এবং আল্লাহর ফয়সালাকৃত কষ্টের উপর ধৈর্যধারণ করা। এ তিন ধরণের ধৈর্য সাওমের মধ্যে একত্রিত হয়। সালমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে,
«وَهُوَ شَهْرُ الصَّبْرِ، وَالصَّبْرُ ثَوَابُهُ الْجَنَّةُ».
“রমযান মাস ধৈর্যের মাস। আর ধৈর্যের প্রতিদান জান্নাত”।[6]
.....
জেনে রাখুন আমলের সাওয়াব দ্বিগুণ থেকে বহুগুণ হওয়ার বেশ কিছু কারণ আছে। সেগুলো হলো:
প্রথমত: কাজটি করার স্থানটি মর্যাদাবান হওয়ার কারণে কাজের প্রতিদান বহুগুণে বেড়ে যায়। যেমন, হারাম শরীফের মর্যাদা। এ কারণেই মসজিদুল হারাম ও মসজিদ নববীতে সালাত আদায়ের সাওয়াব অনেকগুণ। যেমনটি হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।
«صَلاَةٌ فِي مَسْجِدِي هَذَا خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ صَلاَةٍ فِيمَا سِوَاهُ، إِلَّا المَسْجِدَ الحَرَامَ»
“আমার এ মসজিদে এক রাকাত সালাত আদায় করা অন্য মসজিদে একহাজার রাকাত সালাত আদায়ের চেয়েও উত্তম; তবে মসজিদুল হারাম ব্যতীত”।[7]
মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে,
«صَلَاةٌ فِي مَسْجِدِي هَذَا أَفْضَلُ».
“আমার এ মসজিদে সালাত আদায় করা উত্তম”।[8]
...
দ্বিতীয়ত: সময়ের মর্যাদার কারণে আমলে সাওয়াব অনেকগুণ বৃদ্ধি পায়। যেমন, রমযান মাস, যিলহজ মাসের প্রথম দশ দিন। ইবন ‘আব্বাসরাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমাথেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
« عمرة في رمضان تَعْدِلُ حَجَّةً أو حجة مَعِي يَعْنِي عُمْرَةً فِي رَمَضَانَ».
“রমযানে উমরা পালন হজের সমতুল্য অথবা আমার সাথে হজ পালনের সওয়াবের সমতুল্য হবে”।[9]
...
যেহেতু সাওমের সাওয়াব অন্যান্য আমলের চেয়ে বহুগুণ, সেহেতু রমযান মাসে সময়ের মর্যাদার কারণে সাওম পালন অন্যান্য সময় সাওম পালনের চেয়ে অনেকগুণ সাওয়াব। যেহেতু রমযানের সাওম আল্লাহ তাঁর বান্দার ওপর ফরয করেছেন এবং সাওমকে ইসলামের রুকনসমূহের অন্যতম একটি রুকন করেছেন।
আরো অন্য কারণে সাওয়াব দ্বিগুণ থেকে বহুগুণ করা হয়। যেমন, আল্লাহর কাছে আমলকারীর মর্যাদা, তার কাছে নৈকট্য ও তার তাকওয়ার কারণে। যেমন এ উম্মাতের সাওয়াব পূর্ববর্তী অন্যান্য উম্মাতের চেয়ে অনেকগুণ বেশি।
দ্বিতীয় বর্ণনায় বান্দার জন্য অন্যান্য আমলের থেকে সাওমের আলাদা সাওয়াবের কথা বলা হয়েছে। কেননা সাওমকে আল্লাহ নিজের জন্য নির্দিষ্ট করেছেন। এ ব্যাপারে সামনে আরো আলোচনা আসছে।
তৃতীয় বর্ণনায় আমলের দ্বারা কাফফারা থেকে সাওমকে আলাদা করা হয়েছে।
এখানে সুফইয়ান ইবন ‘উয়াইনাহ রহ. এর বাণীটি খুবই চমৎকার। তিনি বলেছেন: নিম্নোক্ত হাদীসটি সবচেয়ে সুন্দর ও প্রজ্ঞাময়, কিয়ামতের দিন আল্লাহ বান্দার হিসেব নিবেন। তাকে সমস্ত আমলের সাওয়াব থেকে যুলুমের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, তবে সাওম ব্যতীত। তার অবশিষ্ট যুলুমের গুনাহ আল্লাহ নিজে বহন করে সাওমের কারণে তাকে তিনি জান্নাত দান করবেন।[10] এ হাদীস থেকে বুঝা গেল, আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে সাওম পালনকারীর সাওয়াব অন্য কেউ নেওয়ার সুযোগ নেই, বরং আল্লাহ তা ব্যক্তির জন্য সংরক্ষণ করে রাখেন। এ কারণেই বলা হয়, সমস্ত আমল ব্যক্তির গুনাহ কাফফারা। তখন তার আর কোন সাওয়াব অবশিষ্ট থাকবে না। যেমন বর্ণিত আছে, “কিয়ামতের দিনে ব্যক্তির ভালো ও মন্দ আমল ওজন করা হবে এবং একটির দ্বারা অন্যটির ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কিসাস তথা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার পরে সৎ আমল অবশিষ্ট থাকলে ব্যক্তি জান্নাতে যাবে”। এ ব্যাপারে মারফু‘ সূত্রে বর্ণিত হাদীস রয়েছে। অতএব, সাওমের ব্যাপারে বলা যায় যে, কোন গুনাহের কাফফারাস্বরূপ বা অন্য কোন কারণে সাওমের সাওয়াব কর্তন করা হবে না; বরং সাওমের সাওয়াব ব্যক্তিকে পরিপূর্ণ দেওয়া হবে, এমনকি এ কারণে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। তখন জান্নাতে তার পরিপূর্ণ প্রতিদান দেওয়া হবে।
>[2] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯০৪।
[3] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৭৫৩৮।
[4] মুসনাদ আহমাদ, হাদীস নং ১০৫৫৪। হাদীসের সনদটি শাইখাইনের শর্তানুযায়ী সহীহ।
[5] নাসাঈ, হাদীস নং ২৪০৮, আলবানী রহ. বলেছেন, হাদীসটি সহীহ। ইবন হিব্বান, ৩৬৫৯।
[6] সহীহ ইবন খুযাইমা, হাদীস নং ১৮৮৭। মুহাক্কীক মুহাম্মাদ মুস্তফা আল-‘আযামী রহ. হাদীসটিকে দ‘ঈফ বলেছেন।
[7] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১১৯০; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৩৯৪।
[8] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৩৯৪।
[9] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮৬৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১২৫৬; আবু দাউদ, হাদীস নং ১৯৯০।
[10] সুনান আল-কুবরা, বাইহাকী, হাদীস নং ৮৩৩৫।
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামেরবাণী «فإنه لي» “সাওম আমার জন্য” এর ব্যাখ্যা হলো, আল্লাহ সাওমকে তাঁর নিজের দিকে সম্বন্ধযুক্ত করেছেন যা তিনি অন্যান্য ইবাদতের ক্ষেত্রে করেন নি। এর কয়েক ধরণের অর্থ হতে পারে। সবচেয়ে সুন্দর দু’টি ব্যাখ্যা নিম্নরূপ:
প্রথমত: যখন প্রবৃত্তির চাহিদা চরম আকার ধারণ করে এবং তার সে চাহিদা পূরণের শক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে এমন স্থানে সে চাহিদা পূরণ করা থেকে বিরত থাকে যেখানে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ তাকে দেখে না। এটি বান্দার সঠিক ঈমানের প্রমাণ। কেননা সাওম পালনকারী জানে যে, তার রয়েছ এমন একজন রব যিনি তার নির্জনের সব অবগত আছেন। তিনি নির্জনে তার স্বভাবজাত প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণ করতে হারাম করেছেন। ফলে বান্দা তার রবের শাস্তি থেকে রেহাই পেতে ও সাওয়াবের প্রত্যাশায় তাঁর আনুগত্য করল ও তাঁর আদেশ মান্য করল এবং তারঁ নিষেধ থেকে বিরত থাকল। এভাবে সে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল। তিনি তার অন্যান্য আমলের থেকে সাওমকে নিজের জন্য খাস করলেন। এ কারণেই তিনি এর পরে বলেছেন:
«يَتْرُكُ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ وَشَهْوَتَهُ مِنْ أَجْلِي».
“সে আমার জন্য আহার, পান ও কামাচার পরিত্যাগ করে”।[1]
একজন সৎপূর্বসূরী বলেছেন: ঐ ব্যক্তির জন্য সুসংবাদ যে গায়েবী প্রতিশ্রুতি পাওয়ার জন্য বর্তমানের প্রবৃত্তি পরিহার করল। মুমিন যেহেতু জানে যে, প্রবৃত্তির চাহিদা থেকে বিরত থেকে সাওম পালনে তার প্রভুর সন্তুষ্টি রয়েছে, তাই সে নিজের প্রবৃত্তির ওপর তার মাওলা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টিকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। ফলে সে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজের প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। যেহেতু তার দৃঢ় ঈমান আছে যে, আল্লাহর দেওয়া সাওয়াব ও শাস্তি নির্জনে তার প্রবৃত্তির আনন্দের চেয়ে অধিক বেশি ও ভয়ানক। তাই সে তার প্রবৃত্তির ওপর তার রবের সন্তুষ্টিকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। বরং মুমিন কঠোর প্রহরের আঘাতের চেয়েও নির্জনে তার রবের অসন্তুষ্টিমূলক কাজ করতে বেশি অপছন্দ করে। এ কারণেই অনেক মুমিনকে বিনা ওযরে সাওম ভঙ্গ করতে বাধ্য করে প্রহর করলেও সে সাওম ভঙ্গ করতে রাজি হয় না। কেননা সে জানে, এ মাসে সাওম ভঙ্গ করা আল্লাহর অপছন্দ। আর এটির ঈমানের নিদর্শন। মুমিন প্রবৃত্তির চাহিদার কাজসমূহ অপছন্দ করে, যেহেতু সে জানে যে, এগুলো আল্লাহর অপছন্দ। তখন আল্লাহর সন্তুষ্টি মূলক কাজই তার আনন্দময়; যদিও তা তার প্রবৃত্তির বিপরীত। সাওমের কারণে যেহেতু নিম্নোক্ত কাজসমূহ হারাম যেমন, পানাহার, স্ত্রী সহবাস ইত্যাদি, অতএব যেসব কাজ সর্বদা ও সর্বত্রে চিরতরে হারাম সেগুলো থেকেও বিরত থাকা জরুরী যেমন, যিনা, মদপান, অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করা, অন্যায়ভাবে অন্যের মান-সম্মান হানী করা, নিষিদ্ধ রক্তপাত করা ইত্যাদি। কেননা আল্লাহ এসব কাজ সর্বাবস্থায়, সর্বত্রে ও সর্বকালেই অপছন্দ করেন।
দ্বিতীয়ত: সাওম বান্দা ও তার রবের মধ্যকার গোপন ব্যাপার যা অন্য কেউ জানে না। কেননা সাওম সংঘটিত হয় গোপন নিয়াতের দ্বারা যা আল্লাহ ব্যতীত কেউ জানে না এবং প্রবৃত্তির চাহিদা বর্জন করার মাধ্যমে যা বান্দা ইচ্ছা করলে গোপনে সেসব চাহিদা পূরণ করতে পারে। এ কারণেই বলা হয়ে থাকে, সাওমের সাওয়াব সংরক্ষণকারী ফিরিশতা লিপিবদ্ধ করেন না। আরও বলা হয়, এ ইবাদতের মধ্যে কোনো রিয়া তথা লৌকিকতা নেই। এটি প্রথম প্রকার তথা সঠিক ঈমানের প্রমাণের সাথে মিলে। কেননা যে ব্যক্তি তার নফসের কামনাকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ত্যাগ করে, যা আল্লাহ ব্যতীত কেউ জানেন না এটি তার সঠিক ঈমানের প্রমাণ। আর আল্লাহ তাঁর ও বান্দার মধ্যকার গোপন আমলসমূহ পছন্দ করেন যা তিনি ব্যতীত কেউ জানে না।
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী, «ترك شهوتهُ وطعامه من أجلي» “সে আমার জন্য কামাচার ও পানাহার পরিত্যাগ করে”। এতে ঈঙ্গিত বহন করে যে, সাওম পালনকারী নিজের প্রবৃত্তির চাহিদা যেমন, পানাহার ও কামাচার ইত্যাদি সর্বোচ্চ প্রবৃত্তির কামনা পরিহার করে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করেন।
আর সাওমের মাধ্যমে প্রবৃত্তির খাম-খেয়ালী পরিহার করে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে রয়েছে অনেক উপকারিতা। সেগুলো নিম্নরূপ:
১- প্রবৃত্তিকে বিনষ্ট করে দেওয়া। কেননা উদরপূর্তি করে পানাহার ও স্ত্রী সহবাস করলে প্রবৃত্তি ব্যক্তিকে অন্যায় কাজ, অকর্মণ্যতা ও অলসতার দিকে ঠেলে দেয়।
২- অন্তরকে চিন্তা-গবেষণা ও আল্লাহর যিকিরের জন্য খালি করা। কেননা এসব প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণ করলে অন্তর কঠিন ও অন্ধ হয়ে যায়। তখন তা অন্তর ও আল্লাহর যিকির ও তাঁর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা-গবেষণার মাঝে বাধা সৃষ্টি করে এবং অলসতায় পেয়ে বসে। আর পানাহার ত্যাগ করে উদরশূণ্য করলে অন্তর আলোকিত হয়, নরম হয়, কঠোরতা দূরীভূত হয় এবং আল্লাহর যিকির ও তাঁর সৃষ্টি নিয়ে গবেষণার জন্য খালি হয়।
৩- ধন-ঐশ্বর্যবানরা তার ওপর আল্লাহর নি‘আমতের পরিমাণ বুঝতে পারে। সে গরীবের তুলনায় তার যথেষ্ট পরিমাণ পানাহার ও বিয়ে-শাদীর সামর্থ দেখতে পায় যা আল্লাহ তাকে দান করেছেন। আর সাওমের মাধ্যমে আল্লাহ তাকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তা গ্রহণ করা থেকে বিরত রাখেন। এতে তার কষ্ট অনুভব হয় এবং যাদেরকে আল্লাহ এ নি‘আমত থেকে বঞ্চিত করেছেন তখন সে উক্ত নি‘আমতের কথা স্মরণ করে। তখন তার ধন-ঐশ্বর্যের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত নি‘আমতের শুকরিয়া আদায় করে এবং এ কাজ তাকে অভাবী দুঃখী ভাইয়ের প্রতি সহযোগিতা ও সাধ্যমত সমবেদনা প্রকাশে অত্যাবশ্যকীয় করে তোলে।
৪- সাওম রক্ত চলাচলের রাস্তা সংকুচিত করে যা আদম সন্তানের মধ্যে শয়তানের চলাচলের পথ। কেননা শয়তান বনী আদমের রক্ত চলাচলের রাস্তায় চলে। ফলে সাওমের দ্বারা শয়তানের সে ধোঁকা বন্ধ হয়, মানুষের প্রবৃত্তি ও ক্রোধ চূর্ণ বিচূর্ণ হয়। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাওমকে প্রবৃত্তির দমককারী বলেছেন। কেননা সাওম বিবাহের প্রবৃত্তিকে নি:শেষ করে দেয়।
জেনে রাখুন, সাওম পালন ছাড়া শুধু এসব বৈধ প্রবৃত্তি ত্যাগের দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য অর্জিত হয় না যতক্ষণ সে সর্বাবস্থায় হারাম কাজ পরিহার না করবে। যেমন, মিথ্যা বলা, যুলুম করা, মানুষের জীবন, সম্পদ ও সম্মানের ওপর সীমালঙ্ঘন করা ইত্যাদি পরিহার করা। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«مَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ الزُّورِ وَالعَمَلَ بِهِ، فَلَيْسَ لِلَّهِ حَاجَةٌ فِي أَنْ يَدَعَ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ».
“যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও সে অনুযায়ী আমল বর্জন করেনি, তাঁর এ পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই”।[2]
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেন:
«لَيْسَ الصِّيَامُ مِنَ الطَّعَامِ وَالشَّرَابِ فَقَطْ وَلَكِنَّ الصِّيَامَ مِنَ اللَّغْوِ وَالرَّفَثِ».
“সাওম শুধু পানাহার ত্যাগ করা নয়; বরং অনর্থক ও অশ্লীল কথা-কাজ পরিহার করাই সাওম।”[3]
সহীহাইনে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«َالصِّيَامُ جُنَّةٌ، وَإِذَا كَانَ يَوْمُ صَوْمِ أَحَدِكُمْ فَلاَ يَرْفُثْ وَلاَ يَصْخَبْ، فَإِنْ سَابَّهُ أَحَدٌ أَوْ قَاتَلَهُ، فَلْيَقُلْ إِنِّي امْرُؤٌ صَائِمٌ».
“সাওম ঢালস্বরূপ। তোমাদের কেউ যেন সাওম পালনের দিন অশ্লীলতায় লিপ্ত না হয় এবং ঝগড়া-বিবাদ না করে। কেউ যদি তাঁকে গালি দেয় অথবা তাঁর সঙ্গে ঝগড়া করে, তাহলে সে যেন বলে, আমি একজন সাওম পালনকারী”।[4] রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী «الجُنةُ» অর্থ ঢাল, যা দ্বারা ব্যক্তি আত্মরক্ষা করে, নিজেকে আড়াল করে এবং গুনাহে পতিত হওয়া থেকে তাকে রক্ষা করে। «والرَّفثُ» অর্থ অশ্লীলতা ও মন্দ কথাবার্তা।
মুসনাদে আহমাদ ও নাসাঈতে আবু ‘উবাইদাহ রহ. থেকে মারফু‘ সূত্রে বর্ণিত,
«الصَّوْمُ جُنَّةٌ مَا لَمْ يَخْرِقْهَا».
“সাওম ঢালস্বরুপ যতক্ষণ পর্যন্ত তা ভেঙ্গে না ফেলে।”[5]
....
কতিপয় সৎপূর্বসূরী বলেছেন: সবচেয়ে দুর্বল সাওম হলো পানাহার পরিহার করা। জাবির রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেছেন: তুমি যখন সাওম পালন করবে তখন তোমার শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি ও জিহ্বাকে মিথ্যা ও হারাম কাজ থেকে সাওম (বিরত) রাখিও, প্রতিবেশিকে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকো, তোমার যেন গম্ভীরতা ও প্রশান্তি থাকে, তুমি সাওমের দিন ও সাওম ব্যতীত দিনকে সমান করো না।
আমার শ্রবণ যদি হিফাযতকারী না হয়, আমার দৃষ্টি যদি অবনত না হয়, আমার কথা যদি চুপ না হয় তাহলে আমার সাওম শুধু ক্ষুধা ও তৃষ্ণা ছাড়া কিছুই হবে না। যদিও তুমি বলো, আজকে আমি সাওম পালন করছি, অথচ তুমি সায়িম নও।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«رُبَّ صَائِمٍ حَظُّهُ مِنْ صِيَامِهِ الْجُوعُ وَالْعَطَشُ، وَرُبَّ قَائِمٍ حَظُّهُ مِنْ قِيَامِهِ السَّهَرُ».
“কিছু সাওম পালনকারীর সাওমের বিনিময়ে ক্ষুধা ও পিপাসা ছাড়া কিছুই পায় না, আবার রাতে জাগরণকারী কিছু সালাত আদায়কারীর রাত্রি জাগরণ ব্যতীত কিছুই পায় না”।[6]
এর রহস্য হলো, বৈধ জিনিস পরিহার করে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করার পদ্ধতি হলো, উক্ত সে বৈধ জিনিস পরিহার করে আল্লাহর নৈকট্য লাভের পরে ততক্ষণ তা পরিপূর্ণ হয় না যতক্ষণ হারাম জিনিস পরিহার করে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা না হয়। সুতরাং যে ব্যক্তি হারামে পতিত হয়ে মুবাহ জিনিস পরিহার করে আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করে তার উদাহরণ এরূপ যে ফরয ত্যাগ করে নফলের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করে।
....
«لِلصَّائِمِ فَرْحَتَانِ يَفْرَحُهُمَا: إِذَا أَفْطَرَ فَرِحَ، وَإِذَا لَقِيَ رَبَّهُ فَرِحَ بِصَوْمِهِ».
“সাওম পালনকারীর জন্য রয়েছে দু’টি খুশী যা তাকে খুশী করে। যখন সে ইফতার করে, সে খুশী হয় এবং যখন সে তাঁর রবের সাথে সাক্ষাৎ করবে, তখন সাওমের বিনিময়ে আনন্দিত হবে।”[7]
[2] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯০৩।
[3] আততারগীর ওয়াততারহীব, ২/৩৬২, হাদীস নং ১৭৭৪। ইবনুল মাদীনী হাদীসের সনদটিকে মুসলিমের শর্তানুযায়ী সহীহ বলেছেন।
[4] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯০৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১৫১।
[5] নাসাঈ, হাদীস নং ২২৩৫; আলবানী রহ. হাদীসটির সনদটিকে সহীহ ও মাকতু‘ বলেছেন। মুসনাদ আহমাদ, হাদীস নং ১৬৯০, মুহাক্কীক শু‘আইব আরনাঊত হাদীসটিকে হাসান বলেছেন।
[6] ইবন মাজাহ, হাদীস নং ১৬৯০, ইবন খুযাইমা, হাদীস নং ১৯৯৭, ইবন হিব্বান, হাদীস নং ৩৪৮১। হাদীসটির সনদ সহীহ।
[7] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯০৪।
ইফতারের সময় সাওম পালনকারীর আনন্দ হলো, মানুষ সর্বদা তার উপযোগী জিনিস যেমন, খাদ্য, পানীয় ও সহবাস ইত্যাদির প্রতি আকৃষ্ট থাকে। এগুলো যখন নির্দিষ্ট সময় তার জন্য নিষিদ্ধ করা হয় অতঃপর অন্য সময় তা আবার হালাল করা হয় তখন সে নিষিদ্ধ হওয়ার পরে হালাল হওয়ার কারণে আনন্দিত হয়, বিশেষ করে উক্ত জিনিসের প্রতি যখন তার তীব্র প্রয়োজন দেখা দেয়।
অতএব, মানুষের অন্তর স্বাভাবিকভাবেই তখন আনন্দিত হয়, যখন সে কাজটি আল্লাহর প্রিয় কাজ হবে এবং শরী‘আতের দৃষ্টিতেও পছন্দনীয়। সায়িমের ইফতার এমনই একটি কাজ। দিনের বেলায় আল্লাহ তার জন্য প্রবৃত্তির সেসব কাজ করা হারাম করেছেন কিন্তু তিনি রাতের বেলায় উক্ত কাজগুলো হালাল করেছেন; বরং রাতের প্রথমভাগে ও শেষভাগে সেগুলো (ইফতার) তাড়াতাড়ি গ্রহণ করা তাঁর কাছে খুবই পছন্দনীয়। এমনকি তাঁর কাছে সর্বাধিক পছন্দনীয় বান্দা সে ব্যক্তি যে দ্রুত ইফতার গ্রহণ করে। কেননা সহীহাইনে সাহল রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে মারফু‘ সূত্রে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছন,
«لاَ يَزَالُ النَّاسُ بِخَيْرٍ مَا عَجَّلُوا الفِطْرَ».
“লোকেরা যতদিন যাবৎ ওয়াক্ত হওয়া মাত্র ইফতার করবে, ততদিন তারা কল্যাণের ওপর থাকবে”।[1]
....
ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত , রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«إِنَّ اللَّهَ وَمَلَائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى الْمُتَسَحِّرِينَ».
“আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর ফিরিশতাগণ সাহরী গ্রহণকারীদের ওপর সালাত পেশ করেন, অর্থাৎ তাদের কথা আলোচনা করেন”।[2]
সায়িম আল্লাহর নৈকট্য লাভ ও তাঁর আনুগত্য করতে দিনের বেলায় নিজের প্রবৃত্তিকে দমন করেছে এবং আবার তাঁর সন্তুষ্টি ও আনুগত্যের জন্যই রাতের বেলায় সেসব প্রবৃত্তির দিকে দ্রুত এগিয়ে যায়। সুতরাং সে যা কিছু পরিহার করে তা তার রবেরই সন্তুষ্টি ও আদেশের জন্য আবার যখন সে সেসব বৈধ প্রবৃত্তির দিকে ফিরে যায় তখনও তার রবের আদেশেই ফিরে যায়। সুতরাং সে দু’ অবস্থায়ই তার রবের অনুগত। তাই সে যখন তার রবের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পানাহার করতে দ্রুত এগিয়ে যায় এবং তাঁর প্রশংসা করে তখন তার মাগফিরাত ও সর্বোচ্চ সন্তুষ্টি আশা করা যায়।
হাদীসে এসেছে,
«إِنَّ اللهَ لَيَرْضَى عَنِ الْعَبْدِ أَنْ يَأْكُلَ الْأَكْلَةَ فَيَحْمَدَهُ عَلَيْهَا أَوْ يَشْرَبَ الشَّرْبَةَ فَيَحْمَدَهُ عَلَيْهَا».
“আল্লাহ তা‘আলা সে বান্দার প্রতি অবশ্যই সন্তুষ্ট হন যে বান্দা কোন খানা খেয়ে এর জন্য আল্লাহর প্রশংসা করে অথবা পানীয় পান করে এর জন্য আল্লাহর হামদ ও প্রশংসা করে”।[3] হয়ত তখন তার দো‘আ কবুল করা হয়। ... আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«ثَلَاثَةٌ لَا تُرَدُّ دَعْوَتُهُمْ: الصَّائِمُ حَتَّى يُفْطِرَ».
“তিন ব্যক্তির দো‘আ ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। সাওম পালনকারী যতক্ষণ না ইফতার করে।”[4]
.....
ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ইফতার করতেন তখন বলতেন,
«ذَهَبَ الظَّمَأُ وَابْتَلَّتِ الْعُرُوقُ، وَثَبَتَ الْأَجْرُ إِنْ شَاءَ اللَّهُ».
“তৃষ্ণা চলে গেছে, শিরাগুলো আদ্র হয়েছে আর ছাওয়াব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে”।[5]
সাওম পালনকারী যদি রাতে সালাত আদায় ও দিনের বেলায় সাওম পালনের উদ্দেশ্যে শরীরিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য পানাহার করে তাহলে তা তার জন্য সাওয়াব হিসেবে ধর্তব্য হবে যেমনিভাবে সে রাতে ও দিনে কাজের জন্য শক্তি বৃদ্ধি করতে ঘুমালে সেটি তার জন্য ইবাদত হবে। .....
আবু ‘আলিয়াহ রহ. বলেছেন: সাওম পালনকারী গীবত না করা পর্যন্ত ইবাদতে থাকে, যদিও সে বিছানায় ঘুমায়”।
অতএব, সায়িম রাত-দিন সব সময়ই ইবাদতে থাকে এবং সাওম অবস্থায় ও ইফতারির সময় তার দো‘আ কবুল করা হয়। সে দিনের বেলায় সাওম পালনকারী ও ধৈর্যশীল এবং রাতের বেলায় আহার গ্রহণকারী ও আল্লাহর শুকরিয়া আদায়কারী। ইমাম তিরমিযী ও অন্যান্যরা বর্ণনা করেন,
«الطَّاعِمُ الشَّاكِرُ بِمَنْزِلَةِ الصَّائِمِ الصَّابِرِ».
“আল্লাহর শুকরিয়া আদায়কারী আহারকারীর মর্যাদা হলো ধৈর্যশীল সাওম পালনকারীর মতো”।[6] সুতরাং যে ব্যক্তি উপরোক্ত অর্থ বুঝবে সে সাওম পালনকারীর ইফতারের সময়ের আনন্দের অর্থও বুঝতে পারবে। কেননা ইফতার আল-কুরআনে বর্ণিত আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ ও দয়ার অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿قُلۡ بِفَضۡلِ ٱللَّهِ وَبِرَحۡمَتِهِۦ فَبِذَٰلِكَ فَلۡيَفۡرَحُواْ هُوَ خَيۡرٞ مِّمَّا يَجۡمَعُونَ٥٨﴾ [يونس : ٥٨]
“বলুন ‘আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমতে। সুতরাং এ নিয়েই যেন তারা খুশি হয়’। এটি যা তারা জমা করে তা থেকে উত্তম”। [সূরা ইউনুস, আয়াত: ৫৮] তবে এ আনন্দের পূর্বশর্ত হচ্ছে হালাল ইফতার। কিন্তু তার ইফতার যদি হারাম হয় তাহলে সে ঐসব লোকদের অন্তর্ভুক্ত হবে যারা আল্লাহর হালালকৃত বস্তু থেকে সাওম পালন করে; কিন্তু আল্লাহর হারামকৃত বস্তু দ্বারা ইফতার করে। তাদের দো‘আ কবুল করা হবে না।
আর তার রবের সাথে মিলিত হওয়ার সময় তার আনন্দ হলো, তার সাওমের গচ্ছিত সাওয়াব আল্লাহর কাছ থেকে অত্যন্ত প্রয়োজনের সময় প্রাপ্ত হবে। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿وَمَا تُقَدِّمُواْ لِأَنفُسِكُم مِّنۡ خَيۡرٖ تَجِدُوهُ عِندَ ٱللَّهِ هُوَ خَيۡرٗا وَأَعۡظَمَ أَجۡرٗا٢٠﴾ [المزمل: ٢٠]
“আর তোমরা নিজদের জন্য মঙ্গলজনক যা কিছু অগ্রে পাঠাবে তোমরা তা আল্লাহর কাছে পাবে প্রতিদান হিসেবে উৎকৃষ্টতর ও মহত্তর রূপে”। [সূরা আল-মুয্যাম্মিল, আয়াত: ২০]
«فَإِذَا لَقِيَ رَبَّهُ فَرِحَ بِصَوْمِهِ».
“(সাওম পালনকারীর জন্য রয়েছে দু’টি খুশী যা তাঁকে খুশী করে) এবং যখন সে তাঁর রবের সাথে সাক্ষাৎ করবে, তখন সাওমের বিনিময়ে আনন্দিত হবে”।[7]
... ‘ঈসা ‘আলাইহিস সালাম বলেছেন: নিশ্চয় এ রাত-দিন দু’টি খাজাঞ্চি। তাই লক্ষ্য করো এ দু’টি ভাণ্ডারে তোমরা কী জমা করছ? দিনসমূহ মানুষের ভালো-মন্দ দ্বারা ভর্তি ভাণ্ডার। কিয়ামতের দিনে ব্যক্তির জন্য এ ভাণ্ডার খোলা হবে। মুত্তাকীরা তাদের ভাণ্ডারে ইজ্জত ও সম্মান পাবে আর অপরাধীরা তাতে পাবে আফসোস ও লাঞ্ছনা।
>[2] মুসনাদ আহমাদ, হাদীস নং ১১৩৯৬; ইবন হিব্বান, হাদীস নং ৩৪৬৭, শু‘আইব আরনাঊত হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। তবে গ্রন্থকারের বর্ণিত হাদীসের নস হুবহু পাওয়া যায়নি।
[3] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৭৩৪।
[4] তিরমিযী, হাদীস নং ৩৪৯৮, ইমাম তিরমিযী হাদীসটিকে হাসান বলেছেন। আলবানী রহ. হাদীসটিকে দ‘ঈফ বলেছেন, তবে তিনি হাদীসের প্রথম অংশ ইমামুল ‘আদিলের পরিবর্তে মুসাফিরের কথা বা অন্য বর্ণনায় আল-ওয়ালিদের কথা উল্লেখ পূর্বক সহীহ বলেছেন। মুসনাদ আহমাদ, হাদীস নং ৮০৪৩, শু‘আইব আরনাঊত হাদীসটিকে তার অন্যান্য বর্ণনাসূত্র ও শাওয়াহেদের ভিত্তিতে সহীহ বলেছেন।
[5] আবু দাউদ, হাদীস নং ২৩৫৭। আলবানী রহ. হাদীসটিকে হাসান বলেছেন।
[6] তিরমিযী, হাদীস নং ২৪৮৬, তিরমিযী রহ. হাদীসটিকে হাসান গরীব বলেছেন। আলবানী রহ. হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।
[7] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯০৪; ইবন খুযাইমাহ, হাদীস নং ১৮৯৬।
সাওম পালনকারীগণ দু’টি শ্রেণিতে বিভক্ত:
প্রথম প্রকার: যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পানাহার ও কামভাব ত্যাগ করেছে বিনিময়ে জান্নাত পাওয়ার আশায়। এ শ্রেণির লোকেরা আল্লাহর সাথে ব্যবসা করেছে। আর যারা উত্তম কাজ করেন তাদের প্রতিদান আল্লাহ নষ্ট করেন না। যারা আল্লাহর সাথে ব্যবসা করবে তারা বিফল হবে না, বরং তারা বিরাট লাভবান হবে।
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«إِنَّكَ لَنْ تَدَعَ شَيْئًا اتِّقَاءَ اللهِ إِلَّا أَعْطَاكَ اللهُ خَيْرًا مِنْه».
“আল্লাহর তাকওয়ার উদ্দেশ্যে যা কিছুই তুমি পরিহার করো, তিনি তার চেয়ে উত্তম প্রতিদান দিবেন”।[1] এসব সাওম পালনকারীকে জান্নাতে তাদের ইচ্ছামত খাদ্য, পানীয় ও নারী দান করা হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿كُلُواْ وَٱشۡرَبُواْ هَنِيَٓٔۢا بِمَآ أَسۡلَفۡتُمۡ فِي ٱلۡأَيَّامِ ٱلۡخَالِيَةِ٢٤﴾ [الحاقة: ٢٤]
“(তাদেরকে বলা হবে) বিগত দিনসমূহে তোমরা যা অগ্রে প্রেরণ করেছ তার বিনিময়ে তোমরা তৃপ্তি সহকারে খাও ও পান করো। [সূরা আল-হাক্কাহ, আয়াত: ২৪] মুজাহিদ রহ. বলেছেন: এ আয়াতটি সাওম পালনকারীদের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে।
ইয়াকূব ইবন ইউসুফ রহ. বলেন, আমার কাছে এ মর্মে সংবাদ পৌঁছেছে যে, আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিনে তার অলীদের (বন্ধুদেরকে) বলবেন, হে আমার বন্ধুগণ, আমি যখনই তোমাদের দিকে তাকাতাম তখনই তোমাদের ঠোঁট খাদ্যাভাবে শুষ্ক (কুঁচকানো) দেখতাম, তোমাদের চক্ষু বিনিদ্র দেখতাম, পেট ক্ষুধায় কাঁপত, আজকের দিনে তোমরা তোমাদের নি‘আমতে থাকো, তোমরা পরস্পরে পেয়ালা ভরা শরাব পান করো, তোমরা তোমাদের জন্য যা অগ্রে প্রেরণ করেছ তার বিনিময়ে তৃপ্তি সহকারে খাও ও পান করো।
হাসান রহ. বলেন, নারী হুর মধুর নদীতে তার সাথে হেলান দিয়ে বসা আল্লাহর বন্ধুকে বলবেন, তুমি পান পেয়ালার পানীয় গ্রহণ করো। আল্লাহ তোমার প্রতি কঠিন গরমের দিনে তাকাতেন, তুমি প্রচণ্ড তৃষ্ণা থাকা সত্ত্বেও পিপাসিত ছিলে। তখন আল্লাহ তোমাকে নিয়ে ফিরিশতাদের সাথে গর্ববোধ করতেন। তিনি বলতেন, হে ফিরিশতাগণ তোমরা আমার বান্দাকে দেখো, সে তার স্ত্রী, কামভাব, খাদ্য ও পানীয় আমার সন্তুষ্টির জন্য আমার কাছে যা কিছু আছে তার বিনিময়ে ত্যাগ করেছে। তোমরা সাক্ষ্য থাকো, আমি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। তিনি সেদিনই তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং আমাকে তোমার সাথে বিবাহ দিয়েছেন।
সহীহাইনে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«إِنَّ فِي الجَنَّةِ بَابًا يُقَالُ لَهُ الرَّيَّانُ، يَدْخُلُ مِنْهُ الصَّائِمُونَ يَوْمَ القِيَامَةِ، لاَ يَدْخُلُ مِنْهُ أَحَدٌ غَيْرُهُمْ، يُقَالُ: أَيْنَ الصَّائِمُونَ؟ فَيَقُومُونَ لاَ يَدْخُلُ مِنْهُ أَحَدٌ غَيْرُهُمْ، فَإِذَا دَخَلُوا أُغْلِقَ فَلَمْ يَدْخُلْ مِنْهُ أَحَدٌ».
“জান্নাতে রাইয়্যান নামক একটি দরজা আছে। এ দরজা দিয়ে কিয়ামতের দিন সাওম পালনকারীরাই প্রবেশ করবে। তাঁদের ছাড়া আর কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। ঘোষণা দেওয়া হবে, সাওম পালনকারীরা কোথায়? তখন তারা দাঁড়াবে। তাঁরা ছাড়া আর কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে না। তাঁদের প্রবেশের পরই দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে। যাতে এ দরজা দিয়ে আর কেউ প্রবেশ না করে”।[2]
....
কোনো এক সৎপূর্বসূরী বলেছেন: আমার কাছে এ মর্মে সংবাদ পৌঁছেছে যে, হাশরের দিনে তাদের (সায়িমদের) জন্য দস্তরখানা বিছানো হবে, তারা সেখান থেকে খাবে আর অন্যান্য লোকদের হিসেব চলবে। তখন লোকজন বলবেন, হে আমাদের রব! আপনি আমাদের হিসেব নিচ্ছেন অথচ তারা খাচ্ছে। তখন তাদেরকে বলা হবে, দুনিয়াতে তারা সাওম পালন করছিল আর তোমরা তখন খাচ্ছিলে। তারা রাতে সালাতে দণ্ডায়মান ছিল আর তোমরা ঘুমিয়েছিলে।
কোন এক আল্লাহর ওলী স্বপ্নে দেখেন, তিনি যেন জান্নাতে প্রবেশ করেছেন। তিনি একজনকে বলতে শুনলেন, তোমার কী মনে আছে তুমি অমুক দিন আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সাওম পালন করছিলে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তিনি বলেন, অতঃপর তিনি (ফিরিশতা) আমাকে উপর ফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে দিয়ে সংবর্ধনা দিলেন। দুনিয়াতে কেউ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সামান্য সময় পানাহার ত্যাগ করলে আখিরাতে আল্লাহ এর বিনিময় এমন খাদ্য ও পানীয় দান করবেন যা কখনও নিঃশেষ হবে না এবং এমন সহধর্মীনী দান করবেন যারা কখনও মারা যাবে না।
....
রমযান মাসে সাওম পালনকারীদেরকে জান্নাতে বিবাহ দেওয়া হয়।
....
জান্নাতের হুরদের মহর হলো দীর্ঘ সময় ধরে তাহাজ্জুদের সালাত। আর এ সালাত রমযান মাসে অধিক হারে আদায় করা হয়।
দ্বিতীয় প্রকার: কতিপয় সাওম পালনকারী দুনিয়াতে আল্লাহ ব্যতীত সবকিছু থেকেই সাওম পালন তথা বিরত থাকে। তারা তাদের মস্তিষ্ক ও এর চিন্তাধারাকে হিফাযত করে, পেট ও পেটে যা কিছু ধরে সবকিছু সংরক্ষণ করে, মৃত্যু ও মৃত্যুপরবর্তী পরীক্ষাকে স্মরণ করে, তারা আখিরাত কামনা করে এবং দুনিয়ার সমস্ত চাকচিক্য বর্জন করে। এ ধরণের লোকদের ঈদুল ফিতর হবে তাদের রবের সাথে সাক্ষাতের দিন, তাঁকে দর্শন হবে তাদের আনন্দ-উল্লাস। হে সাওম পালনকারীগণ! আজকে তোমাদের প্রবৃত্তিকে দমন করে সাওম পালন করো যাতে আল্লাহর সাথে মিলিত হওয়ার দিবস ঈদুল ফিতর হিসেবে পাও। দীর্ঘ জীবনের কারণে বেশি দিন বাঁচার প্রত্যাশা করবে না। তোমার জীবনে অধিকাংশ সাওম পালনের দিন শেষ হয়ে গেছে। তোমার ঈদের দিন তোমার রবের সাথে মিলিত হওয়ার দিন নিকটবর্তী হয়ে গেছে।
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী:
«ولَخُلُوفُ فَمِ الصَّائِمِ أَطْيَبُ عِنْدَ اللَّهِ مِنْ رِيحِ المِسْكِ».
“সাওম পালনকারীর মুখের (না খাওয়াজনিত) ঘ্রাণ আল্লাহর নিকট মিসকের ঘ্রাণের চেয়েও উত্তম”।[3] خلُوفُ الفم হলো সাওম অবস্থায় না খাওয়ার কারণে মুখের ঘ্রাণ। এ ঘ্রাণ দুনিয়াতে মানুষের কাছে অছন্দনীয়; কিন্তু আল্লাহর কাছে মিসকের ঘ্রাণের চেয়েও অধিক প্রিয়। যেহেতু বান্দা আল্লাহর আনুগত্য ও তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের কারণেই তার এ গন্ধের সৃষ্টি হয়। এখানে দু’টি অর্থ হতে পারে:
প্রথম অর্থ: দুনিয়াতে সিয়াম যেহেতু বান্দা ও তার রবের মধ্যকার গোপনীয় বিষয়, তাই তিনি আখিরাতে সিয়াম পালনকারীদের মর্যাদা সুউচ্চ করতে সৃষ্টিকুলের কাছে সিয়ামের মর্যাদা স্পষ্ট করেছেন ও দুনিয়াতে মানুষের মাঝে সিয়াম পালনকারীগণ তাদের সিয়াম গোপন রাখার প্রতিদানে আল্লাহ আখিরাতে তাদেরকে মানুষের মাঝে সুপরিচিত করবেন।
...
মাকহূল রহ. বলেন, জান্নাতীগণ জান্নাতে সুঘ্রাণ পাবে। তখন তারা বলবেন, হে আমাদের রব! জান্নাতে প্রবেশের পর থেকে এত সুন্দর সুঘ্রাণ আর কখনও পাইনি। তখন তাদেরকে বলা হবে: এ হলো সিয়াম পালনকারীগণের মুখের সুঘ্রাণ।
দুনিয়াতে সাওম পালনকারীর মুখের দুর্গন্ধ তীব্র হয় তাই আখিরাতে তাদের মুখ থেকে সুঘ্রাণ বের হবে। এ সুঘ্রাণ দুভাবে হতে পারে।
প্রথমত: যা বাহ্যিক অনুভুতি দ্বারা বুঝা যায়। যেমন, আব্দুল্লাহ ইবন গালিব সালাত ও সাওম পালনকারী একজন একনিষ্ঠ ইবাদতকারী ছিলেন। তিনি মারা গেলে তাকে দাফন করা হলে তার কবরের মাটি থেকে মিসকের মত সুঘ্রাণ বের হতে লাগল। একজনকে স্বপ্নে দেখানো হলো তার কবর থেকে এত সুঘ্রাণ আসার কারণ কী? তাকে বলল, এগুলো কুরআন তিলাওয়াত ও সাওমের সু-ঘ্রাণ।
দ্বিতীয়ত: রূহ ও ক্বলব থেকে যে সুঘ্রাণ বের হয়। অতএব, যারা ইখলাসের সাথে ভালোবাসা নিয়ে সাওম পালন করবে তাদের অন্তর ও রূহ থেকে সুগন্ধি বের হবে। যেমন, হারিস আল-আশ‘আরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: যাকারিয়া আলাইহিস সালাম বনী ইসরাঈলদেরকে বললেন,
«وَآمُرُكُمْ بِالصِّيَامِ، فَإِنَّ مَثَلَ ذَلِكَ كَمَثَلِ رَجُلٍ فِي عِصَابَةٍ مَعَهُ صُرَّةٌ فِيهَا مِسْكٌ، فَكُلُّهُمْ يَعْجَبُ أَوْ يُعْجِبُهُ رِيحُهَا، وَإِنَّ رِيحَ الصَّائِمِ أَطْيَبُ عِنْدَ اللَّهِ مِنْ رِيحِ المِسْكِ».
“তোমাদের আমি সিয়ামের নির্দেশ দিচ্ছি। এর উদাহরণ হল সেই ব্যক্তির মত, যে ব্যক্তি একটি দলে অবস্থান করছে। তার সঙ্গে আছে মিশক ভর্তি একটি থলে। দলের প্রত্যেকের কাছেই এ সুগন্ধি ভালো লাগে। আল্লাহ তা‘আলার কাছে মিশকের সুগন্ধি অপেক্ষা সিয়াম পালনকারীর (মুখের) গন্ধ অনেক বেশি সুগন্ধময়।”[4]
.....
দ্বিতীয় অর্থ: কেউ দুনিয়াতে আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্য করার কারণে তা থেকে অপছন্দের কিছু সৃষ্টি হয়, আল্লাহর কাছে তা অপছন্দনীয় থাকে না। বরং সেটি তার কাছে হয়ে যায় অত্যন্ত পছন্দনীয়, খুবই প্রিয় ও পবিত্রতম। কেননা তাঁর আনুগত্য ও অনুসরণের কারণেই উক্ত অপছন্দনীয় জিনিসের সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং এ ধরণের আমলকারীদেরকে দুনিয়াতে তাদের পুরষ্কারের ঘোষণা দিয়ে তাদের অন্তরে প্রশান্তি দিয়েছেন যাতে দুনিয়াতে কেউ তাদেরকে অপছন্দ না করেন।
...সাওম পালনকারীর মুখের ঘ্রাণ আল্লাহর কাছে মিশকের চেয়েও অধিক সু-ঘ্রাণ। আল্লাহর ভয়ে কোনো অপরাধীর বিলাপ তাঁর তাসবীহর চেয়েও উত্তম, তাঁর মহত্ব ও বড়ত্বের ভয়ে কেউ ভেঙ্গে পড়াই হলো প্রকৃত পূর্ণতা, তাঁর ভয়ে অপমানিত হওয়াই প্রকৃত সম্মান, তাঁর সন্তুষ্টির জন্য সাওম পালন করে ক্ষুধার্ত থাকা প্রকৃত পরিতৃপ্তি, তাঁর সন্তুষ্টির অন্বেষণে পিপাসার্ত থাকা প্রকৃত তৃষ্ণা নিবারণ ও তাঁর কাজে নিজেকে নিবেদিত করে দেওয়াই হলো প্রকৃত আরাম-আয়েশ। রমযান মাসে শয়তানকে যেহেতু শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয় এবং সাওমের মাধ্যমে প্রবৃত্তিকে দমন করা হয় তখন তার প্রবৃত্তির শক্তি দূরীভূত হয়ে যায় এবং বিবেকের জন্যই সবকিছু হয়ে যায়। তাই অপরাধীর আর কোনো ওযর থাকল না। অতএব, হে ঘুমন্ত আত্মা জেগে ওঠ। হে তাকওয়া ও ঈমানের সূর্য তুমি উদিত হও, হে সৎকর্মকারীদের আমলনামাসমূহ, তোমরা উত্থিত হও, হে সৎকর্মকারীদের আত্মাগণ, তোমরা আল্লাহর জন্য বিনয়ী হও, হে কঠোর পরিশ্রমীগণের পাসমূহ তোমরা তোমাদের রবের জন্য রুকু-সাজদাহ করো, হে তাহাজ্জুদ আদায়কারীদের চক্ষু আর ঘুমিও না, হে তাওবাকারীগণের গুনাহ তুমি আর ফিরে এসো না।
[2] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮৯৬।
[3] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯০৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১৫১।
[4] তিরমিযী, হাদীস নং ২৮৬৩, ইমাম তিরমিযী হাদীসটিকে হাসান সহীহ গরীব বলেছেন। আলবানী রহ. হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।
সহীহাইনে ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَجْوَدَ النَّاسِ بِالخَيْرِ، وَكَانَ أَجْوَدُ مَا يَكُونُ فِي رَمَضَانَ حِينَ يَلْقَاهُ جِبْرِيلُ، وَكَانَ جِبْرِيلُ عَلَيْهِ السَّلاَمُ يَلْقَاهُ كُلَّ لَيْلَةٍ فِي رَمَضَانَ، حَتَّى يَنْسَلِخَ، يَعْرِضُ عَلَيْهِ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ القُرْآنَ، فَإِذَا لَقِيَهُ جِبْرِيلُ عَلَيْهِ السَّلاَمُ، كَانَ أَجْوَدَ بِالخَيْرِ مِنَ الرِّيحِ المُرْسَلَةِ».
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ধন-সম্পদ ব্যয় করার ব্যাপারে সকলের চেয়ে দানশীল ছিলেন। রমযানে জিবরীল আলাইহিস সালাম যখন তাঁর সাথে দেখা করতেন, তখন তিনি আরো অধিক দান করতেন। রমযানের প্রতি রাতেই জিবরীল আলাইহিস সালাম তাঁর সাথে একবার সাক্ষাৎ করতেন। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে কুরআন শোনাতেন। জিবরীল আলাইহিস সালাম যখন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন তখন তিনি রহমত প্রেরিত বায়ূর চেয়ে অধিক ধন-সম্পদ দান করতেন”।[1]
মুসনাদে আহমাদে আরও বর্ধিত আছে,
«لَا يُسْأَلُ عَنْ شَيْءٍ إِلا أَعْطَاهُ».
“তার কাছে কোনো কিছু চাওয়া হলেই তাকে তা দিয়ে দিতেন”।[2]
....
হাদীসে বর্ণিত الجودُ শব্দের অর্থ, ব্যাপক দান খয়রাত। আল্লাহ নিজেকে الجودُ গুণে গুণান্বিত করেছেন।
আল্লাহ তা‘আলা হলেন সর্বাধিক দানশীল, তাঁর দান বিশেষ সময় অনেকগুণে বৃদ্ধি পায়। যেমন, রমযান মাসে। এ মাসেই তিনি কুরআন নাযিল করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌۖ أُجِيبُ دَعۡوَةَ ٱلدَّاعِ إِذَا دَعَانِۖ فَلۡيَسۡتَجِيبُواْ لِي وَلۡيُؤۡمِنُواْ بِي لَعَلَّهُمۡ يَرۡشُدُونَ١٨٦﴾ [البقرة: ١٨٦]
“আর যখন আমার বান্দাগণ তোমাকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবে, আমি তো নিশ্চয় নিকটবর্তী। আমি আহবানকারীর ডাকে সাড়া দেই, যখন সে আমাকে ডাকে। সুতরাং তারা যেন আমার ডাকে সাড়া দেয় এবং আমার প্রতি ঈমান আনে। আশা করা যায় তারা সঠিক পথে চলবে”। [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৮৬]
আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সৃষ্টিগতভাবে সর্বাধিক পরিপূর্ণ ও সর্বোৎকৃষ্ট গুণ দিয়ে তৈরী করেছেন। যেমন, আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে,
«بعثت لأتمم مَكَارِم الْأَخْلَاق».
“আমি সচ্চরিত্রকে পরিপূর্ণ করতে প্রেরিত হয়েছি”।[3] তাই রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাধারণভাবেই সকল মানুষের চেয়ে সর্বাধিক দানশীল ব্যক্তি ছিলেন, যেমন তিনি সর্বাধিক সম্মানিত, বীর ও সমস্ত প্রশংসিত গুণাবলীতে পরিপূর্ণ ছিলেন। তার দানশীলতা সব ধরণের দানশীলতাকে অন্তর্ভুক্ত করে। আর রযমান মাসে তার দানশীলতা অন্যান্য মাসের চেয়ে অনেকগুণ বেড়ে যেত, যেমনিভাবে তার রবের দানও রমযানে অনেকগুণ বেড়ে যায়।
রমযান মাসে তিনি ও জিবরীল আলাইহিস সালাম মিলিত হতেন। আর জিবরীল আলাইহিস সালাম হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ ও সম্মানিত ফিরিশতা। তারা উভয়ে মিলে নাযিলকৃত কুরআন পরস্পর পড়ে শুনাতেন। আর কুরআন হলো সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম কিতাব, যা ইহসান ও উত্তম আখলাকের প্রতি উৎসাহিত ও অনুপ্রেরিত করে। আর এ সম্মানিত কিতাবই ছিল রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চরিত্র, যেহেতু তিনি এ কিতাবের সন্তুষ্টিতে সন্তুষ্ট ছিলেন, এ কিতাবের অসন্তুষ্টিতে অসন্তুষ্ট ছিলেন, এ কিতাব সেসব বিষয়ে উৎসাহিত করেছে তিনি সেসব কাজ করতে দ্রুত এগিয়ে আসতেন এবং যা কিছু থেকে বিরত থাকতে ধমক দিয়েছে তিনিও তা থেকে বিরত থাকতেন। তার হায়াত শেষ হওয়া নিকটবর্তী হওয়ার কারণে এ মাসে তার দান-খয়রাত ও দয়া বহুগুণে বৃদ্ধি পেত যখন জিবরীল আলাইহিস সালামের সাথে রমযানে সাক্ষাৎ করতেন ও পরস্পর পরস্পরকে বেশি বেশি কুরআন পড়ে শুনাতেন।
উত্তম চরিত্র ও দানশীলতার প্রতি অনুপ্রেরণা দানকারী এ কিতাব নিঃসন্দেহে জিবরীল আলাইহিস সালামের সাথে সাক্ষাতের কারণে উত্তম আখলাকের এক বিরাট প্রভাব বিস্তার করেছে।
রমযান মাসে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দানশীলতা বহুগুণে বৃদ্ধি পাওয়ার মধ্যে অনেক উপকারিতা রয়েছে। তন্মধ্যে কয়েকটি হলো:
১. সময়ের মর্যাদা ও এতে আমলের সাওয়াব অনেকগুণ বৃদ্ধি পাওয়া।
২. সাওম পালনকারী ও আল্লাহর যিকিরকারীকে তাদের ইবাদতের কাজে সাহায্য করলে তাদের সাওয়াবের অনুরূপ সাওয়াব পাওয়া যায়, যেমনিভাবে কেউ আল্লাহর পথের মুজাহিদকে জিহাদে যাওয়ার উপকরণ প্রস্তুত করে দিলে সেও জিহাদের সাওয়াব পাবে এবং কেউ মুজাহিদের পরিবার-পরিজনের কল্যাণে বাড়ি থাকলেও সে জিহাদের সাওয়াব পাবে।
যায়েদ ইবন খালিদ আল-জুহানী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَنْ فَطَّرَ صَائِمًا كَانَ لَهُ مِثْلُ أَجْرِهِمْ، مِنْ غَيْرِ أَنْ يَنْقُصَ مِنْ أُجُورِهِمْ شَيْئًا».
“কেউ যদি কোনো সাওম পালনকারীকে ইফতার করায় তবে তার জন্যও অনুরূপ (সিয়ামের) সাওয়াব হবে। কিন্তু এতে সাওম পালনকারীর সাওয়াবে কোনো ঘাটতি হবে না”।[4]
৩. রমযান এমন একটি মাস যাতে আল্লাহ তাঁর বান্দার প্রতি রহমত, মাগফিরাত ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন, বিশেষ করে লাইলাতুল কদরে। আল্লাহ এ রাতে তাঁর দয়ালু বান্দার ওপর রহমত বর্ষণ করেন। যেমন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«وَإِنَّمَا يَرْحَمُ اللَّهُ مِنْ عِبَادِهِ الرُّحَمَاءَ».
“আর আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মাঝে যারা দয়ালু, তিনি তাদের প্রতি রহম করেন”।[5] সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহর ইবাদতে কঠোর পরিশ্রমী হবে আল্লাহও তার প্রতি দান, দয়া ও আমলের সাওয়াব সেভাবে পর্যাপ্ত পরিমাণে দান করবেন।
৪. সাওম ও সদাকা একত্রিত হলে জান্নাত পাওয়া অত্যাবশ্যকীয় হয়ে যায়।
«إِنَّ فِي الجَنَّةِ غُرَفًا تُرَى ظُهُورُهَا مِنْ بُطُونِهَا وَبُطُونُهَا مِنْ ظُهُورِهَا» ، فَقَامَ أَعْرَابِيٌّ فَقَالَ: لِمَنْ هِيَ يَا رَسُولَ اللَّهِ؟ قَالَ: «لِمَنْ أَطَابَ الكَلَامَ، وَأَطْعَمَ الطَّعَامَ، وَأَدَامَ الصِّيَامَ، وَصَلَّى بِاللَّيْلِ وَالنَّاسُ نِيَامٌ».
“জান্নাতে একটি প্রাসাদ রয়েছে যার ভিতর থেকে বাহির এবং বাহির থেকে ভিতর পরিদৃষ্ট হবে। তখন এক বেদুঈন উঠে দাঁড়ালেন, বললেন, হে আল্লাহর রাসূল এটি কার হবে? তিনি বললেন, এটি হবে তার যিনি ভালো কথা বলে, অন্যকে খাদ্য খাওয়ায়, সর্বদা সাওম পালন করে এবং যখন রাতে মানুষ ঘুমিয়ে থাকে তখন সে উঠে সালাত আদায় করে”।[6]
এসব গুণাবলীর সবগুলোই রমযান মাসে পাওয়া যায়। ফলে মুমিন এ মাসে সিয়াম, সালাত, সদকা ও উত্তম কথাবার্তা বলে থাকেন। কেননা সাওম তাকে অনর্থক ও অশ্লীল কথা ও কাজ থেকে বিরত রাখে এবং সালাত ও সদকা ব্যক্তিকে আল্লাহর সাথে সম্পর্কযুক্ত করে।
কোনো এক সৎপূর্বসূরী বলেছেন: সালাত ব্যক্তিকে অর্ধেক পথ পর্যন্ত পৌঁছায়, সাওম তাকে মহান মালিকের দরজা পর্যন্ত পৌঁছায়, সদকা তার হাত ধরে মহান মালিকের কাছে প্রবেশ করায়।
সহীহ মুসলিমে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন জিজ্ঞাসা করলেন,
«مَنْ أَصْبَحَ مِنْكُمُ الْيَوْمَ صَائِمًا؟» قَالَ أَبُو بَكْرٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ: أَنَا، قَالَ: «فَمَنْ تَبِعَ مِنْكُمُ الْيَوْمَ جَنَازَةً؟» قَالَ أَبُو بَكْرٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ: أَنَا، قَالَ: «فَمَنْ أَطْعَمَ مِنْكُمُ الْيَوْمَ مِسْكِينًا؟» قَالَ أَبُو بَكْرٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ: أَنَا، قَالَ: «فَمَنْ عَادَ مِنْكُمُ الْيَوْمَ مَرِيضًا؟» قَالَ أَبُو بَكْرٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ: أَنَا، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَا اجْتَمَعْنَ فِي امْرِئٍ، إِلَّا دَخَلَ الْجَنَّةَ».
“তোমাদের মধ্যে আজ কে সিয়াম পালনকারী আছে? আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, আমি সাওম পালনকারী। তিনি বললেন, আজ তোমাদের কে জানাযার সাথে চলেছ? আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, আমি। তিনি বললেন, আজ তোমাদের কে মিসকীনকে খাদ্য খাইয়েছ? আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন আমি। তিনি বললেন, তোমাদের কেউ রোগীর শুশ্রূষা করেছ? আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, আমি। তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যার মধ্যে এই কাজসমূহের সমাবেশ ঘটবে সে নিশ্চয়ই জান্নাতে প্রবেশ করবে”।[7]
[2] মুসনাদ আহমাদ, হাদীস নং ২০৪২, শু‘আইব আরনাঊত হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।
[3] মুসনাদ বাযযার, হাদীস নং ৮৯৪৯; মুসতাদরাক হাকিম, হাদীস নং ৪২২১, ইমাম হাকিম হাদীসটিকে মুসলিমের শর্তানুযায়ী সহীহ বলেছেন। ইমাম যাহাবীও একমত পোষণ করেছেন। আস-সুনান আল-কুবরা লিলবায়হাকী, হাদীস নং ২০৭৮২।
[4] তিরমিযী, হাদীস নং ৮০৭, ইমাম তিরমিযী রহ. বলেছেন, হাদীসটি হাসান সহীহ। ইবন মাজাহ, হাদীস নং ১৭৪৬। ইমাম আলবানী রহ. বলেছেন, হাদীসটি সহীহ। ইবন হিব্বান, ৩৪২৯।
[5] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১২৮৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৯২৩।
[6] তিরমিযী, হাদীস নং ১৯৮৪, ইমাম তিরমিযী হাদীসটিকে গরীব বলেছেন। আলবানী রহ. হাদীসটিকে হাসান বলেছেন।
[7] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০৮২।
৫. সাওম ও সদকা একত্রিত হলে তা গুনাহের কাফফার জন্য সর্বাধিক কার্যকরী, জাহান্নাম থেকে রক্ষাকারী ও জাহান্নাম থেকে দূরে অবস্থানকারী, বিশেষ করে এর সাথে যদি কিয়ামুল লাইল যুক্ত হয়। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত আছে,
«الصِّيَامُ جُنَّةٌ كَجُنَّةِ أَحَدِكُمْ مِنَ الْقِتَالِ».
“সাওম এমন ঢালস্বরূপ, তোমাদের যুদ্ধে ব্যবহৃত ঢালের ন্যায়”।[1]
মুসনাদে আহমাদের বর্ণনায় এসেছে,
«الصِّيَامُ جُنَّةٌ، وَحِصْنٌ حَصِينٌ مِنَ النَّارِ».
“সাওম ঢালস্বরূপ এবং জাহান্নাত থেকে মুক্তির সুদৃঢ় সুরক্ষা”।[2]
মু‘আয ইবন জাবাল রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«وَالصَّدَقَةُ تُطْفِئُ الْخَطِيئَةَ، وَصَلَاةُ الرَّجُلِ فِي جَوْفِ اللَّيْلِ».
“এবং সাদাকা (যাকাত) বা দান খায়রাত) গুনাহসমূহ মিটিয়ে দেয়, যেভাবে পানি আগুনকে নিভিয়ে দেয়। এমনিভাবে গভীর রাতে ব্যক্তির কিয়ামুল লাইল (তাহাজ্জু্র)ও গুনাহসমূহকে মিটিয়ে দেয়।”[3]
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«اتَّقُوا النَّارَ وَلَوْ بِشِقِّ تَمْرَةٍ».
“তোমারা জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচ (নিজেকে রক্ষা কর) যদিও তা খেজুরের টুকরা দ্বারাও হয় (সামান্য বস্তু সদাকা করতে পারলেও তা কর)”।[4]
আবুদ দারদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলতেন, ‘তোমরা রাতের অন্ধকারে দুরাক‘আত সালাত আদায় করো কবরের অন্ধকার থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য, প্রচণ্ড গরমের দিনে সাওম পালন করো হাশরের ময়দানের গরম থেকে বাঁচার জন্য, কিয়ামতের ভয়াবহ দিনের আযাব থেকে রক্ষা পেতে গোপনে সদকা দাও।’
৬. রমযান মাসে সাওম পালন করতে গিয়ে অনেক সময় কিছু ভুল-ত্রুটি ও কমতি দেখা দেয়। সাওম গুনাহের কাফফারা হওয়ার শর্ত হচ্ছে যেসব বিষয় থেকে হিফাযত থাকা অত্যাবশ্যকীয় সেসব বিষয় থেকে বিরত থাকা। যেমন, ইবন হিব্বানে বর্ণিত হাদীসে এসেছে, অধিকাংশ সাওম পালনকারীই যেভাবে সাওম পালন করা দরকার সেভাবে সাওম পালনের শর্তাবলী তাদের মধ্যে একত্রিত হয় না। এ কারণেই কোনো ব্যক্তিকে এভাবে বলতে নিষেধ করা হয়েছে যে, আমি পুরো রমযান সাওম পালন করেছি বা পুরো রাত সালাত আদায় করেছি। অতএব, এসব সদকার দ্বারা সাওম পালনে সংঘটিত ভুল-ত্রুটিসমূহের কাফফারা হয়ে যায়। এ কারণেই রমযান শেষে সাওম পালনকারীকে অনর্থক ও অশ্লীল কথাবার্তা ও কাজ থেকে পবিত্র করতে যাকাতুল ফিতর ওয়াজিব করা হয়েছে।
৭. সাওম পালানকারী সাওম অবস্থায় পানাহার পরিহার করে থাকে। আর কেউ সায়িমদেরকে পানাহার সরবাহ করে তাদেরকে শক্তিশালী করলে তার অবস্থা ঐ ব্যক্তির মতোই যে নিজে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য প্রবৃত্তিকে ত্যাগ করল এবং এর দ্বারা সে সহমর্মিতা দেখালো। এ কারণেই সায়িমের সাথে অন্য সায়িমকে ইফতার করানো শরী‘আতসম্মত হয়েছে। কেননা ইফতারের সময় খাদ্য গ্রহণ তার কাছে অনেক প্রিয়, ফলে সে সহমর্মিতা দেখিয়ে তার সাথে অন্যকে খাওয়ালো, যদিও সে খাদ্যের প্রতি তার নিজেরই ভালোবাসা ছিল। এভাবে কাজটি করার অর্থ হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলা পানাহার হারাম করার পরে তার জন্য হালাল করে তাকে যে নি‘আমত দান করেছেন সে নি‘আমতের শুকরিয়া আদায় করা। কেননা কোনো কিছু নিষেধ করার পরে উক্ত জিনিসের প্রকৃত মর্যাদা বুঝা যায়।
কোনো এক ‘আরিফ বিল্লাহকে জিজ্ঞাসা করা হলো, শরী‘আতে কেন সাওম বিধিবদ্ধ করা হয়েছে? তিনি বললেন, ধনীরা যাতে ক্ষুধার যন্ত্রণা অনুভব করতে পারে, ফলে সে ক্ষুধার্তকে কখনও ভুলবে না। এটি সাওম শরী‘আতসম্মত হওয়ার কিছু উপকারিতা। সালমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে, “রমযান মাস পরস্পর সহমর্মিতার মাস।” যে ব্যক্তি অন্যকে অগ্রাধিকার দেওয়ার পর্যায়ে পৌঁছতে পারবে না সে সহমর্মিতার দলের স্তরে পৌঁছতে পারবে না। অনেক পূর্বসূরীরা ইফতারের সময় সহমর্মিতা ও অন্যকে অগ্রাধিকার দিতেন। ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা মিসকীন ব্যতীত ইফতার করতেন না। পরিবারের কেউ নিষেধ করলে তিনি সে রাতে কিছু খেতেন না। তিনি খাদ্য খাওয়ার সময় কেউ আসলে তিনি তার ভাগের খাবার নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন এবং কোনো প্রার্থনাকারীকে দিতেন। তিনি যখন ঘরে ফিরে আসতেন তখন অন্যদের খাবার খাওয়া শেষ হয়ে যেত। ফলে তিনি না খেয়েই সেদিন সাওম পালন করতেন।
এক সৎব্যক্তি সারাদিন সাওম পালন করে খাবার খাওয়ার ইচ্ছা করল। এমতাবস্থায় তার কাছে আরেকজন সাওম পালনকারী এসে বলল, কে আছ সত্যবাদী ক্ষুধার্ত এক ব্যক্তিকে খাদ্য দিবে? তখন তিনি বললেন, সাওয়াব বিহীন আল্লাহর এ বান্দা খাদ্য দিবে। তখন উক্ত ব্যক্তি খাবারের বাটি নিয়ে চলে গেল আর সৎলোকটি ক্ষুধার্ত থেকেই রাত কাটাল।
একলোক ইমাম আহমাদ রহ.-এর কাছে এসে কিছু চাইল। তিনি তার ইফতারির জন্য প্রস্তুতকৃত দু’টি রুটিই তাকে দান করে দিলেন। অতঃপর তিনি ক্ষুধার্ত অবস্থায়ই সকাল করলেন। হাসান রহ. সাওম পালন করে নিজে না খেয়ে লোকদেরকে খাবার খাওয়াতেন এবং পাশে বসে তাদেরকে খাওয়ার জন্য উৎসাহিত করত।
৮. সাওমের আরও অনেক উপকারিতা রয়েছে। ইমাম শাফে‘ঈ রহ. বলেছেন: রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণে এবং মানুষের কল্যাণ, প্রয়োজনীয়তা ও সালাত-সাওমের ব্যস্ততার কারণে জীবিকা নির্বাহে কম সময় পাওয়ার কারণে রমযান মাসে বেশি বেশি দান-সদকা করা আমি পছন্দ করি। ৯. রমযান মাসে বেশি পরিমাণে পরস্পর কুরআন পাঠ, শিক্ষা দেওয়া, এ জন্য একত্রিত হওয়া ও যিনি ভালো হাফিয তার কাছে কুরআন শুনানো ইত্যাদি হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। এ হাদীসে রমযান মাসে অধিক পরিমাণে কুরআন তিলাওয়াত মুস্তাহাব প্রমাণিত।
>[2] মুসনাদ আহমাদ, হাদীস নং ৯২২৫, শু‘আইব আরনাঊত হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন, তবে এ সনদটিকে হাসান বলেছেন।
[3] মুসনাদ আহমাদ, হাদীস নং ২২০১৬, শু‘আইব আরনাঊত হাদীসটিকে তুরুক ও শাওয়াহেদের ভিত্তিতে সহীহ বলেছেন, তবে এ সনদটি মুনকাতি‘।
[4] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৪১৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০১৬।
ফাতিমা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার হাদীসে এসেছে,
«أَنَّ جِبْرَائِيلَ كَانَ يُعَارِضُهُ بِالْقُرْآنِ فِي كُلِّ عَامٍ مَرَّةً، وَأَنَّهُ عَارَضَهُ بِهِ الْعَامَ مَرَّتَيْنِ».
“জিবরীল আলাইহিস সালাম প্রতি বছর আমাকে একবার কুরআন পড়ে শুনাতেন। এ বছর তিনি তা আমাকে দু’বার পড়ে শুনিয়েছেন”।[1]
ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমার থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও জিবরীল পরস্পর রাতের বেলায় কুরআন পড়ে শুনাতেন।[2] অতএব, রমযানে রাতের বেলায় বেশি পরিমাণে কুরআন তিলাওয়াত করা মুস্তাহাব। কেননা রাতের বেলায় মানুষ ঝামেলা মুক্ত থাকে, সমস্ত হিম্মত একত্রিত হয়, অন্তর ও যবান চিন্তা-গবেষণার জন্য একনিষ্ঠ হয়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿إِنَّ نَاشِئَةَ ٱلَّيۡلِ هِيَ أَشَدُّ وَطۡٔٗا وَأَقۡوَمُ قِيلًا٦﴾ [المزمل: ٦]
“নিশ্চয় রাত জাগরণ আত্মসংযমের জন্য অধিকতর প্রবল এবং স্পষ্ট বলার জন্য অধিকতর উপযোগী”। [সূরা আল-মুয্যাম্মিল, আয়াত: ৬]
কুরআনের সাথে রয়েছে রমযান মাসের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿شَهۡرُ رَمَضَانَ ٱلَّذِيٓ أُنزِلَ فِيهِ ٱلۡقُرۡءَانُ هُدٗى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَٰتٖ مِّنَ ٱلۡهُدَىٰ وَٱلۡفُرۡقَانِ١٨٥﴾ [البقرة: ١٨٥]
“রমযান মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের জন্য হিদায়াতস্বরূপ এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে”। [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৮৫] ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন, আল-কুরআন লাওহে মাহফূয থেকে বাইতুল ইয্যতে কদরের রাত্রিতে একত্রে নাযিল হয়।[3] এ মতের পক্ষে দলীল হলো আল্লাহ তা‘আলার নিম্নোক্ত বাণী,
﴿إِنَّآ أَنزَلۡنَٰهُ فِي لَيۡلَةِ ٱلۡقَدۡرِ١﴾ [القدر: ١]
“নিশ্চয় আমরা এটি (কুরআন) নাযিল করেছি লাইলাতুল কদরে”।[সূরা আল-কাদর, আয়াত: ১]
﴿إِنَّآ أَنزَلۡنَٰهُ فِي لَيۡلَةٖ مُّبَٰرَكَةٍ٣﴾ [الدخان: ٣]
“নিশ্চয় আমরা এটি নাযিল করেছি বরকতময় রাতে।” [সূরা আদ-দুখান, আয়াত: ৩] রমযান মাসেই রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অহীপ্রাপ্ত হন, এ মাসেই তার ওপর কুরআন নাযিল হয় এবং তিনি অন্যান্য সময়ের তুলনায় রমযানে কিয়ামুল লাইলে দীর্ঘ সময় ধরে কুরআন তিলাওয়াত করতেন। হুযাইফা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে রমযান মাসে রাতে সালাত আদায় করেছেন। তিনি বলেন,
«ثُمَّ قَرَأَ الْبَقَرَةَ، ثُمَّ النِّسَاءَ، ثُمَّ آلَ عِمْرَانَ، لَا يَمُرُّ بِآيَةِ تَخْوِيفٍ إِلَّا وَقَفَ عِنْدَهَا... فَمَا صَلَّى إِلَّا رَكْعَتَيْنِ حَتَّى جَاءَ بِلَالٌ فَآذَنَهُ بِالصَّلَاةِ».
“অতঃপর তিনি সূরা আর-বাকারাহ পড়লেন, অতঃপর সূরা আন-নিসা, অতঃপর সূরা আলে ইমরান পড়লেন। ভয়-ভীতির আয়াত আসলেই তিনি থেমে যেতেন (সেখানে চিন্তা-ভাবনা করতেন), এভাবে মাত্র দু’রাকাত সালাত আদায় করতেই বিলাল রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু এসে ফজরের আযান দিলেন”।[4] নাসায়ীর বর্ণনায় এসেছে,
«فَمَا صَلَّى إِلَّا أَرْبَعَ رَكَعَاتٍ».
“এভাবে মাত্র চার রাকাত সালাত আদায় করতেই বিলাল রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু ফজরের আযান দিলেন”।[5]
«وكان عُمر رضي الله عنه: أمر أبيَّ بن كعب، وتميمًا الداريَّ، أن يقوما بالناسِ في شهر رمضان، فكان القارئ يقرأ بالمائتين في الركعة، حتى كانوا يعتمدون على العصي من طول القيام، وما كانوا ينصرفون إلا عند الفجر».
উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু উবাই ইবন কা‘ব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু ও তামীম আদ-দারী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে রমযান মাসে লোকদেরকে জামা‘আতে সালাত আদায় করার জন্য ইমাম নিযুক্ত করেন। তারা এক রাকাতে দু’শ পরিমাণ আয়াত তিলাওয়াত করতেন। এমনকি দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকার কারণে তারা লাঠিতে ভর দিয়ে সালাত আদায় করতেন এবং ফজরের আগে তারা ফিরতেন না।[6] অন্য বর্ণনায় এসেছে, তারা মসজিদের খুঁটির সাথে রশি লাগাতেন, তাতে নিজেদেরকে আটকে রাখতেন।
বর্ণিত আছে যে,
«أن عمر جمع ثلاثة قراء، فأمر أسرعهم قراءة أن يقرأ بالناس بثلاثين، وأوسطهم بخمس وعشرين، وأبطأهم بعشرين».
“উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তিনজন কারীকে একত্রিত করে তাদেরকে নির্দেশ দিলেন, যে ব্যক্তি দ্রুততার সাথে তিলাওয়াত করবে সে এক রাকাতে ত্রিশ আয়াত পরিমাণ পড়বে, মধ্যম গতিতে তিলাওয়াতকারী পঁচিশ আয়াত ও ধীরগতির তিলাওয়াতকারী বিশ আয়াত পরিমাণ তিলাওয়াত করবে”।[7] অতঃপর তাবে‘ঈদের যুগে আট রাকাত তারাবীতে সূরা বাকারা তিলাওয়াত করা হতো। তারা বারো রাকাত তারাবীহ আদায় করলে আরেকটু হালকা তথা আরো কম পরিমাণে তিলাওয়াত করত। ইমাম আহমাদ রহ. কে উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর নির্ধারণকৃত দ্রুত ও ধীর গতির কারীর আয়াতের পরিমাণের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, এ পরিমাণ তিলাওয়াত করা মানুষের জন্য কষ্টকর, বিশেষ করে রাত্রি যখন ছোট হয়। প্রকৃতপক্ষে মানুষ যতটুকু গ্রহণ করতে পারে ততটুকুই তিলাওয়াত করা উচিৎ। ইমাম আহমদ রহ. রমযানে তারাবীর ইমামতি পালনকারী তার এক ছাত্রকে বললেন, তারা দুর্বল লোক। সুতরাং তাদেরকে নিয়ে পাঁচ বা ছয় বা সাত আয়াত পরিমাণ তিলাওয়াত করো। ফলে তিনি এভাবেই তিলাওয়াত করলেন এবং সাতাশ রমযান কুরআন খতম করলেন। হাসান রহ. বলেন, উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু যাদেরকে লোকদের ইমামতির দায়িত্ব দিয়েছেন তাদেরকে পাঁচ ছয় আয়াত পরিমাণ তিলাওয়াত করতে বলেছেন।
অতএব, ইমাম আহমাদ রহ. এর মত দ্বারা এটিই প্রমাণিত হয় যে, মুসল্লীর অবস্থা ভেদে ইমাম তিলাওয়াত করবেন যাতে তাদের কষ্ট না হয়। অনেক ফকীহ এ মতানুযায়ী তাদের মত ব্যক্ত করেছেন।
«فَقُلْنَا لَهُ: يَا رَسُولَ اللهِ، لَوْ نَفَّلْتَنَا بَقِيَّةَ لَيْلَتِنَا هَذِهِ؟ فَقَالَ: إِنَّهُ مَنْ قَامَ مَعَ الإِمَامِ حَتَّى يَنْصَرِفَ كُتِبَ لَهُ قِيَامُ لَيْلَةٍ».
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতের এক তৃতীয়াংশ পর্যন্ত সালাত আদায় করলেন, পরবর্তীতে অর্ধ রাত্রি পর্যন্ত সালাত আদায় করলেন। সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের রাতের অবশিষ্ট অংশটিও যদি নফল আদায় করে অতিবাহিত করে দিতেন! তিনি বললেন, কেউ যদি ইমামের সঙ্গে সালাতে দাঁড়ায় এবং ইমামের শেষ করা পর্যন্ত তার সাথে দাঁড়িয়ে থাকে তবে তার জন্য সারারাত (নফল) সালাত আদায়ের সওয়াব লেখা হয়”।[8]
এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে, রাতের এক তৃতীয়াংশ বা অর্ধরাত কিয়ামুল লাইল আদায় করলে সারারাত নফল সালাত আদায়ের সাওয়াব লিখা হয়, তবে শর্ত হচ্ছে ইমামে সাথে থাকতে হবে। ইমাম আহমাদ রহ. এ হাদীস গ্রহণ করতেন এবং ইমাম শেষ না করা পর্যন্ত তার সাথে থাকতেন। কেউ কেউ বলেছেন: যে ব্যক্তি রাতের অর্ধেক কিয়ামুল লাইল আদায় করে সে যেন সারারাতই সালাত আদায় করল। আব্দুল্লাহ ইবন ‘আমর ইবনুল ‘আস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«مَنْ قَامَ بِعَشْرِ آيَاتٍ لَمْ يُكْتَبْ مِنَ الغَافِلِينَ، وَمَنْ قَامَ بِمِائَةِ آيَةٍ كُتِبَ مِنَ القَانِتِينَ، وَمَنْ قَامَ بِأَلْفِ آيَةٍ كُتِبَ مِنَ المُقَنْطِرِينَ».
“যে ব্যক্তি রাতের বেলায় সালাতে দশ আয়াত পরিমাণ তিলাওয়াত করবে তার নাম গাফিলদের অন্তর্ভুক্ত হবে না, আর যে ব্যক্তি একশত আয়াত পরিমাণ তিলাওয়াত করবে তাকে কানেতীনদের (চির অনুগত) অন্তর্ভুক্ত করা হবে এবং যে ব্যক্তি একহাজার আয়াত পরিমাণ তিলাওয়াত করবে তাকে মুকানতিরীনদের (অঢেল সম্পদশালী) দলভুক্ত করা হবে।”[9]
...যে ব্যক্তি আরও বেশি তিলাওয়াত করতে চায় ও দীর্ঘ সময় ধরে সালাত আদায় করতে আগ্রহী হলে একাকী সালাত আদায় করলে যত ইচ্ছা দীর্ঘ করতে পারবে। এমনিভাবে জামা‘আতের সাথে সালাত আদায় করলেও জামা‘আতে যতটুকু তিলাওয়াত করা হয় ততটুকুর উপর সন্তুষ্ট থাকা উচিৎ। কতিপয় সৎপূর্বসূরী বলেছেন: রমযানে প্রতি তিন রাতে তারাবীহ’তে কুরআন খতম করা যায়, কেউ কেউ সাত রাতের কথা বলেছেন। আবার কেউ দশ রাতের কথাও উল্লেখ করেছেন।
[2] «كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَجْوَدَ النَّاسِ بِالخَيْرِ، وَكَانَ أَجْوَدُ مَا يَكُونُ فِي رَمَضَانَ حِينَ يَلْقَاهُ جِبْرِيلُ، وَكَانَ جِبْرِيلُ عَلَيْهِ السَّلاَمُ يَلْقَاهُ كُلَّ لَيْلَةٍ فِي رَمَضَانَ، حَتَّى يَنْسَلِخَ، يَعْرِضُ عَلَيْهِ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ القُرْآنَ، فَإِذَا لَقِيَهُ جِبْرِيلُ عَلَيْهِ السَّلاَمُ، كَانَ أَجْوَدَ بِالخَيْرِ مِنَ الرِّيحِ المُرْسَلَةِ»
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ধন-সম্পদ ব্যয় করার ব্যাপারে সকলের চেয়ে দানশীল ছিলেন। রমযানে জিবরীল আলাইহিস সালাম যখন তাঁর সাথে দেখা করতেন, তখন তিনি আরো অধিক দান করতেন। রমযান শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রতি রাতেই জিবরীল আলাইহিস সালাম তাঁর একবার সাক্ষাৎ করতেন। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে কুরআন শোনাতেন। জিবরীল আলাইহিস সালাম যখন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন তখন তিনি রহমত প্রেরিত বায়ূর চেয়ে অধিক ধন-সম্পদ দান করতেন।” সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯০২। (অনুবাদক)
[3] আল-আহাদীসুল মুখরাতাহ, যিয়াউদ্দীন আল-মাকদীসী, হাদীস নং ৩৮৭।
[4] নাসাঈ, হাদীস নং ১৬৬৪, আলবানী রহ. হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন; মুসনাদ আহমাদ, হাদীস নং ২৩৩৯, শু‘আইব আরনাঊত হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন, তবে এ সনদটি দ‘ঈফ।
[5] নাসাঈ, হাদীস নং ১৬৬৫, আলবানী রহ. হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।
[6] মুখতাসারু কিয়ামুল লাইল, মুহাম্মাদ ইবন নসর আল-মারওয়াযী, পৃ. ২২০; কিয়ামু রমযান, নাসির উদ্দীন আলবানী রহ. পৃ. ২৪।
[7] মুসাননাফ আব্দুর রাযযাক, ৪/২৬১/৭৭৩১; বায়হাকী, ২/৪৯৭; কিয়ামু রমযান, নাসির উদ্দীন আলবানী রহ. পৃ. ২৪, তিনি এ বর্ণনাগুলোকে সহীহ বলেছেন।
[8] তিরমিযী, হাদীস নং ৮০৬, ইমাম তিরমিযী রহ. বলেন, হাদীসটি হাসান সহীহ। নাসাঈ, হাদীস নং ১৬০৫, আলবানী রহ. বলেছেন, হাদীসটি সহীহ। ইবন খুযাইমা, হাদীস নং ২২০৬, ‘আযামী রহ. বলেছেন, হাদীসের সনদটি সহীহ। ইবন হিব্বান, ২৫৪৭। শু‘আইব আরনাঊত বলেছেন, হাদীসের সনদটি মুসলিমের শর্তে সহীহ।
[9] আবু দাউদ, হাদীস নং ১৩৯৮। আলবানী রহ. হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।
তারাবীহর সালাত আদায় করা সুন্নাত। আর তা জামা‘আতে আদায় করা উত্তম। সাহাবীদের জামা‘আতের সাথে এ সালাত আদায় সর্বজনবিদিত এবং সর্বযুগের উম্মত এ মতটি গ্রহণ করেছেন।
....
শাইখ তাকীউদ্দীন রহ. বলেছেন: কেউ ইচ্ছা করলে বিশ রাকাত তারাবীহ আদায় করতে পারে, এটি হাম্বলী ও শাফে‘ঈ মাযহাবের প্রসিদ্ধ মতামত। আবার কেউ ছত্রিশ রাকাত আদায় করতে পারে, যা মালেকী মাযহাবের প্রসিদ্ধ মতামত। আবার কেউ এগারো বা তেরো রাকাতও আদায় করতে পারে। সবটিই উত্তম। তবে রাকাত সংখ্যা কম বা বেশি নির্ভর করে দীর্ঘ সময় ধরে তিলাওয়াত কম বা বেশির ওপর।
উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু উবাই ইবন কা‘ব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর ইমামতিতে বিশ রাকাতের উপর একত্রিত করেছিলেন। সাহাবীদের কেউ কেউ এরচেয়ে কম বা বেশি করতেন। শরী‘আতে রাকাত সংখ্যা নির্ধারিত নেই।
অনেক ইমাম তারাবীহ সালাতে এত দ্রুত কুরআন তিলাওয়াত করেন যে তারা কি তিলাওয়াত করছেন কিছুই বুঝা যায় না, রুকু ও সিজদাও ধীরস্থিরতার সাথে আদায় করে না অথচ ধীরস্থিরতার সাথে রুকু-সাজদাহ করা সালাতের অন্যতম রুকন। সালাত এমনভাবে আদায় করা উচিৎ যাতে অন্তর আল্লাহর সামনে উপস্থিতি অনুভব করে, তিলাওয়াতকৃত আল্লাহর কালাম বুঝে উপদেশ গ্রহণ করা যায়। আর তাড়াহুড়া করলে এগুলো করা সম্ভবপর হয় না। অতএব, ধীরস্থিরতার সাথে রুকু-সাজদাহ আদায় করে ছোট কিরাত পড়া তাড়াহুড়া করে মাকরূহের সাথে দীর্ঘ কিরাত পড়ার চেয়ে উত্তম।
দীর্ঘ কিরাত ও প্রশান্তির সাথে তেরো রাকাত তারাবীহ আদায় করা মাকরূহসহ তাড়াহুড়া করে পড়ার চেয়ে উত্তম। কেননা সালাতের মূল ও আত্মা হলো আল্লাহর সামনে অন্তরসহ উপস্থিত হওয়া। অনেক সময় অল্প কাজ বেশি কাজের চেয়ে উত্তম। তাছাড়া তারতীলসহ কিরাত তিলাওয়াত বৈধ দ্রুততার সাথে কিরাত তিলাওয়াতের চেয়ে উত্তম। আর কিরাতের বৈধ সীমা হলো তিলাওয়াতের সময় কোনো হরফ বাদ পড়ে না যাওয়া। তাড়াহুড়ার কারণে কোনো হরফ বাদ পড়ে গেলে তার তিলাওয়াত জায়েয হবে না; বরং এ ধরণের তিলাওয়াত করা নিষেধ। কিন্তু স্পষ্টকরে কিরাত পড়লে ইমামের পিছনের মুসল্লীগণ যদি সে কিরাত দ্বারা উপকৃত হতে পারে তাহলে ততটুকু দ্রুত পড়া বৈধ।
যারা কুরআনের অর্থ না বুঝে কুরআন পড়ে তাদেরকে আল্লাহ নিন্দা করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿وَمِنۡهُمۡ أُمِّيُّونَ لَا يَعۡلَمُونَ ٱلۡكِتَٰبَ إِلَّآ أَمَانِيَّ٧٨﴾ [البقرة: ٧٨]
“আর তাদের মধ্যে আছে নিরক্ষর, তারা মিথ্যা আকাঙ্খা ছাড়া কিতাবের কোনো জ্ঞান রাখে না”। [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ৭৮] অর্থাৎ অর্থ না বুঝে তিলাওয়াত করা। কুরআন নাযিলের উদ্দেশ্যই হলো কুরআন বুঝা এবং সে অনুযায়ী আমল করা। শুধু তিলাওয়াতের জন্য কুরআন নাযিল হয় নি।
সুন্দর কণ্ঠে কুরআন তিলাওয়াত মুস্তাহাব। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«لَيْسَ مِنَّا مَنْ لَمْ يَتَغَنَّ بِالقُرْآنِ».
“যে ব্যক্তি সুন্দর আওয়াজে কুরআন পড়ে না, সে আমাদের দলভুক্ত নয়”।[1]
ইমাম যুহুরী রহ. রমযান আগমন করলে বলতেন, এটি কুরআন তিলাওয়াত ও মানুষকে খাদ্য খাওয়ানোর মাস।
ইবন আব্দুল হাকাম রহ. বলেন, রমযান মাস আসলে ইমাম মালিক রহ. হাদীস পাঠ ও আহলে ইলমের মসলিস বন্ধ দিয়ে মুসহাফ থেকে কুরআন তিলাওয়াত করতেন। আব্দুর রাযযাক রহ. বলেন, রমযান মাস আগমন করলে ইমাম সাওরী রহ. অন্যান্য সমস্ত (নফল) ইবাদত বাদ দিয়ে কুরআন তিলাওয়াত করতেন। সুফইয়ান রহ. বলেন, যায়েদ আল-ইয়াম্মী রহ. রমযান আসলে কুরআন তিলাওয়াত করতেন এবং তার সাথীদেরকেও কুরআন তিলাওয়াতে একত্রিত করতেন। সৎপূর্বসূরীগণ রমযান আসলে কুরআন তিলাওয়াত করতেন। তাদের কেউ কেউ সাত দিনে, কেউ তিন দিনে, আবার কেউ দু’রাতে, কেউ আবার শেষ দশকের প্রতি রাতে কুরআন খতম করতেন। হাদীসে তিন দিনের কমে কুরআন খতমের যে নিষেধাজ্ঞা এসেছে তা নিয়মিতভাবে সর্বদা এভাবে খতম করা নিষেধ করা হয়েছে। অন্যদিকে সম্মানিত সময় যেমন রমযান মাসে, বিশেষ করে রমযানের রাতে কদরের রাত তালাশের উদ্দেশ্যে কুরআন তিলাওয়াত এবং মর্যাদাবান স্থানে উক্ত সময় ও স্থানকে কাজে লাগাতে বেশি পরিমাণ কুরআন তিলাওয়াত করা মুস্তাহাব। এটি ইমাম আহমাদ ও অন্যদের মতামত। এ মতানুযায়ীই অধিকাংশ আলেমের আমল দেখা যায়। আবু উমামা আল-বাহেলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি,
: «اقْرَءُوا الْقُرْآنَ فَإِنَّهُ يَأْتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ شَفِيعًا لِأَصْحَابِهِ».
“তোমরা কুরআন তিলাওয়াত করো, কেননা কিয়ামতের দিন তা তার তিলাওয়াতকারীর জন্য শাফায়াতকারী হিসেবে আসবে”।[2]
ইবন মাস‘ঊদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«مَنْ قَرَأَ حَرْفًا مِنْ كِتَابِ اللهِ فَلَهُ بِهِ حَسَنَةٌ، وَالحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا، لاَ أَقُولُ الْم حَرْفٌ، وَلَكِنْ أَلِفٌ حَرْفٌ وَلاَمٌ حَرْفٌ وَمِيمٌ حَرْفٌ».
“যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার কিতাবের একটি হরফ পাঠ করবে তার জন্য একটি নেকী, আর একটি নেকী দশ গুণ হবে। আমি এ কথা বলব না যে, আলিফ লাম মীম একটি হরফ, বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ এবং মীম একটি হরফ।”[3] তাহলে রমযান মাসে এ আমলের সাওয়াব কত বেশি গুণ বর্ধিত হবে তা সহজেই অনুমেয়।
ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«يُقَالُ لِصَاحِبِ الْقُرْآنِ اقْرَأْ وَارْتَقِ وَرَتِّلْ كَمَا كُنْتَ تُرَتِّلُ فِي الدُّنْيَا، فَإِنَّ مَنْزِلَتَكَ عِنْدَ آخِرِ آيَةٍ تَقْرَؤُهَا».
“কুরআন বহনকারীকে কিয়ামতের দিনে বলা হবে তুমি কুরআন পড়তে থাক এবং উপরে উঠতে থাক, তারলীলসহকারে পড়তে থাক, যেমনিভাবে দুনিয়াতে তারলীলসহকারে তিলাওয়াত করতে। কেননা তোমার সর্বশেষ আসন হবে সেখানে, যেখানে তোমার আয়াত তিলাওয়াত শেষ হবে”।[4]
ইমাম আহমাদ ও অন্যদের বর্ণনায় আবু সা‘ঈদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«وَيَصْعَدُ بِكُلِّ آيَةٍ دَرَجَةً حَتَّى يَقْرَأَ آخِرَ شَيْءٍ مَعَهُ».
“(অতঃপর সে পড়তে থাকবে) এবং প্রতিটি আয়াত পড়ার সাথে সাথে একটি স্তর অতিক্রম করবে। এভাবে সে তার সাথে থাকা শেষ আয়াতটি পর্যন্ত পড়বে ও স্তর অতিক্রম করবে।”[5]
জেনে রাখুন, মুমিনের জন্য রমযান মাসে দু’টি জিহাদ একত্রিত হয়। একটি দিনের বেলায় সাওম পালন করে নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ এবং অন্যটি রাতের বেলায় সালাত আদায়। যে ব্যক্তির মধ্যে এ দু’টি জিহাদ একত্রিত হবে, এ দু’টির হক আদায় করবে এবং ধৈর্যধারণ করবে সে-ই অপরিসীম পরিপূর্ণ সাওয়াব পাবে।কা‘ব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, কিয়ামতের দিন একজন আহ্বানকারী ডেকে বলবেন, প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য রয়েছে তার কর্মের প্রতিদান ও আরও বেশি। তবে আহলে কুরআন ও সিয়াম পালনকারীগণ ব্যতীত। তাদের প্রতিদান বে-হিসাব। কুরআন ও সিয়াম আল্লাহর কাছে ব্যক্তির জন্য শাফা‘আত করবে।
>[2] মুসলিম, হাদীস নং ৮০৪।
[3] তিরমিযী, হাদীস নং ২৯১০।
[4] আবু দাউদ, হাদীস নং ১৪৬৪; তিরমিযী, হাদীস নং ২৯১৪। আলবানী রহ. হাদীসটিকে হাসান সহীহ বলেছেন।
[5] ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৩৭৮০; আলবানী রহ. হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন; মুসনাদ আহমাদ, হাদীস নং ১১৩৬০।
সাওম যে ব্যক্তিকে সমস্ত হারাম কাজ থেকে বিরত রেখেছে তার জন্য সাওম কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে শাফা‘আত করবে এবং বলবে, হে আমার রব! আমি তাকে দিনের বেলায় প্রবৃত্তির কামনা থেকে বিরত রেখেছি, সুতরাং আমার শাফা‘আত গ্রহণ করুন। কিন্তু হারাম কাজে লিপ্ত হওয়ার কারণে যার সাওম নষ্ট হয়ে গেছে সাওম তার বিরুদ্ধে উল্টো অভিযোগ করবে এবং বলবে, হে আল্লাহ আমাকে যেভাবে ধ্বংস করেছে তুমিও তাকে সেভাবে ধ্বংস করুন।
কোন এক সৎপূর্বসূরী বলেছেন: কিয়ামতের দিন যখন মুমিনকে উপস্থিত করা হবে তখন আল্লাহ ফিরিশতাকে বলবেন, তার মাথার ঘ্রাণ দেখ। সে বলবে, তার মাথায় কুরআনের ঘ্রাণ পাচ্ছি। অতঃপর বলা হবে, তার ক্বলবের ঘ্রাণ দেখ। ফিরিশতা বলবে, তার ক্বলবে সিয়ামের ঘ্রাণ পাচ্ছি। আবার বলা হবে, তার পায়ের ঘ্রাণ নাও। সে বলবে, তার পায়ে রাত জেগে সালাতের ঘ্রাণ পাচ্ছি। তখন আল্লাহ বলবেন, সে (আমার বান্দা) নিজেকে হিফাযত করেছে, আল্লাহও তাকে হিফাযত করেছেন। এমনিভাবে কুরআন যাকে রাতে ঘুমানো থেকে বিরত রেখেছে কিয়ামতের দিনে তার জন্য শাফা‘আত করবে। সুতরাং যে ব্যক্তি কুরআন তিলাওয়াত করেছে এবং রাতের বেলায় সালাতে দাঁড়িয়ে কুরআন পড়েছে সে-ই যথার্থভাবে কুরআনের হক আদায় করেছে। ফলে কুরআন তার জন্য শাফা‘আত করবে। একবার রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে শুরাইহ আল-হাদরামী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর আলোচনা হলো। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
« ذلك لَا يَتَوَسَّدُ الْقُرْآنَ».
“সে কুরআনকে বালিশ বানায় না (অর্থাৎ সে কুরআনের উপর ঘুমায় না যাতে তা বালিশের মতো হয়ে যায়, বরং সে কুরআন না পড়ে ঘুমায় না এবং যত্নের সঙ্গে রাত্রে কুরআন পড়ে থাকে)।”[1]
ইমাম আহমাদ বুরাইদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে মারফূ‘ সূত্রে বর্ণনা করেন,
«إِنَّ الْقُرْآنَ يَلْقَى صَاحِبَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ حِينَ يَنْشَقُّ عَنْهُ قَبْرُهُ كَالرَّجُلِ الشَّاحِبِ. فَيَقُولُ لَهُ: هَلْ تَعْرِفُنِي؟ فَيَقُولُ: مَا أَعْرِفُكَ فَيَقُولُ: أَنَا صَاحِبُكَ الْقُرْآنُ الَّذِي أَظْمَأْتُكَ فِي الْهَوَاجِرِ وَأَسْهَرْتُ لَيْلَكَ، وَإِنَّ كُلَّ تَاجِرٍ مِنْ وَرَاءِ تِجَارَتِهِ، وَإِنَّكَ الْيَوْمَ مِنْ وَرَاءِ كُلِّ تِجَارَةٍ فَيُعْطَى الْمُلْكَ بِيَمِينِهِ، وَالْخُلْدَ بِشِمَالِهِ، وَيُوضَعُ عَلَى رَأْسِهِ تَاجُ الْوَقَارِ، وَيُكْسَى وَالِدَاهُ حُلَّتَيْنِ لَا يُقَوَّمُ لَهُمَا أَهْلُ الدُّنْيَا فَيَقُولَانِ: بِمَ كُسِينَا هَذَا؟ فَيُقَالُ: بِأَخْذِ وَلَدِكُمَا الْقُرْآنَ. ثُمَّ يُقَالُ لَهُ: اقْرَأْ وَاصْعَدْ فِي دَرَجِ الْجَنَّةِ وَغُرَفِهَا، فَهُوَ فِي صُعُودٍ مَا دَامَ يَقْرَأُ، هَذًّا كَانَ، أَوْ تَرْتِيلًا».
“কিয়ামতের দিন কুরআন ওয়ালা যখন সে কবর থেকে উত্থিত হবে তখন কুরআন তার সাথে ফ্যাকাশে রঙ্গ অবস্থায় মিলিত হয়ে বলবে, তুমি কি আমাকে চেন? সে বলবে, আমি তো আপনাকে চিনি না। তখন কুরআন বলবে, আমি তোমার সাথী কুরআন যে তোমাকে দিনের বেলায় (দ্বিপ্রহরে) তৃষ্ণার্ত রেখেছে এবং রাতের বেলায় জাগিয়ে রেখেছে। আজ প্রত্যেক ব্যক্তি তার পশ্চাতে পাঠানো ফলাফল পাবে। আজ তোমার ব্যবসার ফলাফল গ্রহণ করো। তখন তার ডানে রাজত্ব ও বামে জান্নাতুল খুলদ দেওয়া হবে। তার মাথায় সম্মানের মুকুট পরিয়ে দেওয়া হবে এবং তার পিতামাতাকে দু’টি চাদর পরিধান করানো হবে যার মূল্য দুনিয়াবাসীরা দিতে পারবে না। তারা বলবেন, আমাদেরকে কিসের বিনিময়ে এ চাদর পরিধান করা হলো? তাদেরকে বলা হবে, আপনাদের সন্তানকে কুরআন শিক্ষা দেওয়ার জন্য। অতঃপর তাকে (কুরআনধারী) বলা হবে, তুমি কুরআন পড়তে থাকো আর জান্নাতের এক একটি স্তর ও রুমে উঠতে থাকো। সে যতক্ষণ কুরআন পড়তে থাকবে ততক্ষন উপরে উঠতে থাকবে, চাই সে দ্রুত তিলাওয়াত করুক বা তারতীলের সাথে ধীরে ধীরে তিলাওয়াত করুক।”[2]
...
ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, কুরআনের ধারক-বাহককে যেন রাতে মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন তাকে বিশেষভাবে চেনা যায়, দিনে মানুষ যখন কর্মব্যস্ত থাকে তখন তাকে বিশেষভাবে চেনা যায়, মানুষ যখন বিভিন্ন কথাবার্তায় মগ্ন থাকে তখন তাকে চুপ থাকার কারণে চেনা যায়, মানুষ যখন খুশিতে মত্ত থাকে তখন তাকে চিন্তিত হওয়ার মাধ্যমে চেনা যায়।
উহাইব রহ. বলেন, এক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করা হলো, আপনি কেন ঘুমান না? সে বলল, কুরআনের বিস্ময় আমার ঘুম কেড়ে নিয়েছে।
একলোক তার বন্ধুর সাথে দুমাস একত্রে থাকল; কিন্তু তাকে কখনও ঘুমাতে দেখেনি। তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনাকে কখনও ঘুমাতে দেখি না কেন? তিনি বললেন, কুরআনের বিস্ময় আমার ঘুম কেড়ে নিয়েছে। কুরআনে এক বিস্ময় থেকে বের হলেই আরেক বিস্ময়ে পড়ে যাই (ফলে আর ঘুমাতে পারি না)।
আহমাদ ইবন আবিল-হাওয়ারী রহ. বলেন, আমি যখন কুরআন পড়ি তখন এক আয়াত এক আয়াত করে এতে গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করি। তখন আমার জ্ঞান হয়রান হয়ে যায়। আমি কুরআনের হাফিযদের ব্যাপারে আশ্চর্য হয়ে যাই কিভাবে তাদের ঘুম আসে বা তারা কিভাবে দুনিয়ার কাজ-কর্মে ব্যস্ত হয়ে যায় অথচ তারা কুরআন তিলাওয়াত করে? তারা যদি কুরআন অনুধাবন করত, কুরআনের হক যথাযথ বুঝত, এর স্বাদ পেত এবং এর দ্বারা মুনাজাত করত তাহলে আল্লাহ তাদেরকে (কুরআন বুঝার) যে নি‘আমত দিয়েছেন সে আনন্দে ঘুম চলে যেত।
অন্যদিকে যার কাছে কুরআন আছে; কিন্তু সে কুরআন ছেড়ে রাতের বেলায় শুধু ঘুমিয়েছে এবং দিনের বেলায় কুরআন অনুযায়ী আমল করে নি, কিয়ামতের দিন কুরআন তার প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াবে এবং সে তার নষ্টকৃত অধিকার চাইবে।
ইমাম আহমাদ রহ. সামুরাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন, একবার রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বপ্নে দেখলেন,
«فَإِذَا رَجُلٌ مُسْتَلْقٍ عَلَى قَفَاهُ، وَرَجُلٌ قَائِمٌ بِيَدِهِ فِهْرٌ، أَوْ صَخْرَةٌ، فَيَشْدَخُ بِهَا رَأْسَهُ، فَيَتَدَهْدَى الْحَجَرُ، فَإِذَا ذَهَبَ لِيَأْخُذَهُ عَادَ رَأْسُهُ كَمَا كَانَ، فَيَصْنَعُ مِثْلَ ذَلِكَ، فَقُلْتُ: مَا هَذَا؟.... ، فَرَجُلٌ آتَاهُ اللهُ الْقُرْآنَ، فَنَامَ عَنْهُ بِاللَّيْلِ، وَلَمْ يَعْمَلْ بِمَا فِيهِ بِالنَّهَارِ، فَهُوَ يُفْعَلُ بِهِ مَا رَأَيْتَ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ».
“একলোক চিৎ হয়ে শুয়ে আছে আর আরেক লোক হাতুড়ি বা পাথর দ্বারা তার মাথায় সজোরে আঘাত করছে, এতে পাথর তার মাথা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিচ্ছে। এভাবে তার মাথা চূর্ণ-বিচূর্ণ হলে আবার তা পূর্বের অবস্থায় ফিরে আনা হয়। এভাবে আবার আগের মতোই করা হয়। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, এ ব্যক্তি কে? তিনি বললেন, এ ব্যক্তিকে আল্লাহ কুরআন দান করেছিলেন, কিন্তু সে কুরআন না পড়ে রাতে ঘুমিয়ে থাকত আর দিনের বেলায় সে অনুযায়ী আমল করত না। আপনি তাকে যেভাবে দেখেছেন সেভাবে কিয়ামত পর্যন্ত তাকে শাস্তি দেওয়া হবে”।[3]
আমর ইবন শু‘আইব তার পিতা থেকে, তিনি তার দাদা থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«يُمَثَّلُ الْقُرْآنُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ رَجُلًا، فَيُؤْتَى بِالرَّجُلِ قَدْ حَمَلَهُ فَخَالَفَ أَمْرَهُ، فَيَتَمَثَّلُ خَصْمًا لَهُ فَيَقُولُ: يَا رَبِّ حَمَّلْتَهُ إِيَّايَ فَشَرُّ حَامِلٍ تَعَدَّى حُدُودِي، وَضَيَّعَ فَرَائِضِي، وَرَكِبَ مَعْصِيَتِي، وَتَرَكَ طَاعَتِي، فَمَا يَزَالُ يَقْذِفُ عَلَيْهِ بِالْحُجَجِ حَتَّى يُقَالَ: فَشَأْنُكَ بِهِ فَيَأْخُذُ بِيَدِهِ، فَمَا يُرْسِلُهُ حَتَّى يَكُبَّهُ عَلَى مَنْخِرِهِ فِي النَّارِ، وَيُؤْتَى بِرَجُلٍ صَالِحٍ قَدْ كَانَ حَمَلَهُ، وَحَفِظَ أَمْرَهُ، فَيَتَمَثَّلُ خَصْمًا لَهُ دُونَهُ فَيَقُولُ: يَا رَبِّ حَمَّلْتَهُ إِيَّايَ فَخَيْرُ حَامِلٍ، حَفِظَ حُدُودِي، وَعَمِلَ بِفَرَائِضِي، وَاجْتَنَبَ مَعْصِيَتِي، وَاتَّبَعَ طَاعَتِي، فَمَا يَزَالُ يَقْذِفُ لَهُ بِالْحُجَجِ حَتَّى يُقَالَ: شَأْنُكَ بِهِ، فَيَأْخُذُ بِيَدِهِ فَمَا يُرْسِلُهُ حَتَّى يُلْبِسَهُ حُلَّةَ الْإِسْتَبْرَقِ، وَيَعْقِدَ عَلَيْهِ تَاجَ الْمُلْكِ، وَيَسْقِيَهُ كَأْسَ الْخَمْر».
“কিয়ামতের দিন কুরআনকে মানুষের আকৃতিতে ব্যক্তির সামনে উপস্থিত করা হবে। অতঃপর ঐ ব্যক্তির সামনে উপস্থিত করা হবে যে কুরআন শিক্ষা করে কুরআনের বিপরীত আমল করেছে। তখন তার প্রতিপক্ষ হয়ে কুরআন আল্লাহর কাছে বলবে, হে আমার রব! আপনি আমাকে অমুকের দ্বারা বহন করিয়েছেন; কিন্তু সে অত্যন্ত খারাপ বহনকারী ছিল। সে আমার সীমালঙ্ঘন করেছে, আমার ফরযসমূহ নষ্ট করেছে, আমার অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়েছে, আমার আনুগত্য বাদ দিয়েছে। এভাবে সে তার বিরুদ্ধে অভিযোগের পর অভিযোগ দিতেই থাকবে। এমনকি তাকে (কুরআনকে) বলা হবে, তাহলে উক্ত কুরআন ধারণকারীর ফয়সালা তোমাকেই দিলাম। তখন কুরআন তার হাত ধরে টেনে নিয়ে নাকেসা খত দিয়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে। অন্যদিকে কুরআন ধারণকারী সৎ ব্যক্তির কাছে কুরআনকে উপস্থিত করা হবে যে কুরআনের আদেশ মান্য করেছে। তখন কুরআন তার পক্ষে সাক্ষী হয়ে বলবে, হে আমার রব! আপনি আমাকে এ ব্যক্তির মাধ্যমে ধারণ করিয়েছেন, সে উত্তম ধারণকারী ছিল। সে আমার সীমারেখা সংরক্ষণ করেছে, আমার ফরয অনুযায়ী আমল করেছে, আমার অবাধ্যতা থেকে বিরত থেকেছে, আমার অনুসরণ করেছে, এভাবে তার পক্ষে সাক্ষ্য দিতে থাকবে, এমনকি তাকে (কুরআনকে) বলা হবে, তার সমস্ত ব্যাপার তোমার ওপর ন্যস্ত। তখন সে উক্ত কুরআন ধারণকারীর হাত ধরবে, তাকে জান্নাতের রেশমী কাপড় পরিধান করাবে, তার মাথায় রাজ-মুকুট পরিধান করাবে এবং তাকে মদের কাপ থেকে শরাব পান করাবে।”[4]
>[2] মুসনাদ আহমাদ, হাদীস নং ২২৯৫০। শু‘আইব আরনাঊত হাদীসটির সনদকে মুতাবা‘আত ও শাওয়াহেদের ভিত্তিকে হাসান বলেছেন।
[3] মুসনাদ আহমাদ, হাদীস নং ২০১৬৫, শু‘আইব আরনাঊত হাদীসটিকে শাইখাইনের শর্তানুযায়ী সহীহ বলেছেন।
[4] মুসান্নাফ ইবন আবু শাইবা, হাদীস নং ৩০০৪৪; আল-মাতালিবুল ‘আলিয়্যাহ বিযাওয়ায়িদিল মাসানিদিস সামানিয়্যাহ, ইবন হাজার আসকালালী, ১৪/৩৮২, হাদীস নং ৩৪৯১, ইবন হাজার রহ. হাদীসের সনদটিকে হাসান বলেছেন।