রমযান মাসে সাওম পালনের ফযীলত - ১

সহীহাইনে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«كُلُّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ يُضَاعَفُ، الْحَسَنَةُ عَشْرُ أَمْثَالِهَا إِلَى سَبْعمِائَة ضِعْفٍ، قَالَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ: إِلَّا الصَّوْمَ، فَإِنَّهُ لِي وَأَنَا أَجْزِي بِهِ، يَدَعُ شَهْوَتَهُ وَطَعَامَهُ مِنْ أَجْلِي. لِلصَّائِمِ فَرْحَتَانِ: فَرْحَةٌ عِنْدَ فِطْرِهِ، وَفَرْحَةٌ عِنْدَ لِقَاءِ رَبِّهِ، ولَخُلُوفُ فَمِ الصَّائِمِ أَطْيَبُ عِنْدَ اللَّهِ مِنْ رِيحِ المِسْكِ».

“আদম সন্তানের প্রতিটি কাজই দশগুণ থেকে সাতশত গুণ বৃদ্ধি করা হয়। মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন, কিন্তু সাওম ব্যতীত। কেননা তা আমার জন্য, তাই আমি এর প্রতিদান দেবো। সে আমার সন্তুষ্টির জন্য কামাচার ও পানাহার পরিত্যাগ করে। সাওম পালনকারীর জন্য রয়েছে দু’টি খুশী যা তাঁকে খুশী করে। যখন সে ইফতার করে, সে খুশী হয় এবং যখন সে তাঁর রবের সাথে সাক্ষাৎ করবে, তখন সাওমের বিনিময়ে আনন্দিত হবে। সাওম পালনকারীর মুখের (না খাওয়াজনিত) ঘ্রাণ আল্লাহর নিকট মিসকের ঘ্রাণের চেয়েও উত্তম”।[1]

অন্য বর্ণনায় এসেছে,

«قَالَ اللَّهُ: كُلُّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ لَهُ إِلَّا الصِّيَامَ، فَإِنَّهُ لِي».

“সাওম ব্যতীত আদম সন্তানের প্রতিটি কাজই তাঁর নিজের জন্য; কিন্তু সাওম আমার জন্য”।[2]

বুখারীর বর্ণনায় এসেছে,

«لِكُلِّ عَمَلٍ كَفَّارَةٌ، وَالصَّوْمُ لِي وَأَنَا أَجْزِي بِهِ».

“প্রত্যেক আমলেরই কাফফারা আছে। সাওম আমার জন্য, তাই আমি এর প্রতিদান দেবো”।[3]

মুসনাদে আহমাদের বর্ণনায় এসেছে,

«لِكُلِّ عَمَلٍ كَفَّارَةٌ، وَالصَّوْمُ لِي وَأَنَا أَجْزِي بِهِ».

“প্রত্যেক আমলেরই কাফফারা আছে। সাওম আমার জন্য, তাই আমি এর প্রতিদান দেবো”।[4]

প্রথম বর্ণনায় সাওমকে অন্যান্য আমলের বর্ধিত সাওয়াব থেকে আলাদা করা হয়েছে। অন্যান্য আমলের সাওয়াব দশ গুণ থেকে সাতশত গুণ করার কথা বলা হলেও সাওমের ব্যাপারটি আলাদা। কেননা এর সাওয়াব সীমাবদ্ধ নয়; বরং আল্লাহ সাওমের সাওয়াব বহু গুণে দান করবেন। কেননা সাওম সবর তথা ধৈর্য থেকে এসেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

﴿إِنَّمَا يُوَفَّى ٱلصَّٰبِرُونَ أَجۡرَهُم بِغَيۡرِ حِسَابٖ ١٠﴾ [الزمر: ١٠]

“কেবল ধৈর্যশীলদেরকেই তাদের প্রতিদান পূর্ণরূপে দেওয়া হবে কোনো হিসাব ছাড়াই”। [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ১০]

এ কারণে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«شَهْرُ رمضان شهر الصَّبْرِ».

“রমযান মাস ধৈর্যের মাস”।[5]

ধৈর্য তিন প্রকার। আল্লাহর আনুগত্যের ওপর ধৈর্যধারণ করা, আল্লাহর হারাম জিনিস থেকে বিরত থাকতে ধৈর্যধারণ করা এবং আল্লাহর ফয়সালাকৃত কষ্টের উপর ধৈর্যধারণ করা। এ তিন ধরণের ধৈর্য সাওমের মধ্যে একত্রিত হয়। সালমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে,

«وَهُوَ شَهْرُ الصَّبْرِ، وَالصَّبْرُ ثَوَابُهُ الْجَنَّةُ».

“রমযান মাস ধৈর্যের মাস। আর ধৈর্যের প্রতিদান জান্নাত”।[6]

.....

জেনে রাখুন আমলের সাওয়াব দ্বিগুণ থেকে বহুগুণ হওয়ার বেশ কিছু কারণ আছে। সেগুলো হলো:

প্রথমত: কাজটি করার স্থানটি মর্যাদাবান হওয়ার কারণে কাজের প্রতিদান বহুগুণে বেড়ে যায়। যেমন, হারাম শরীফের মর্যাদা। এ কারণেই মসজিদুল হারাম ও মসজিদ নববীতে সালাত আদায়ের সাওয়াব অনেকগুণ। যেমনটি হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।

«صَلاَةٌ فِي مَسْجِدِي هَذَا خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ صَلاَةٍ فِيمَا سِوَاهُ، إِلَّا المَسْجِدَ الحَرَامَ»

“আমার এ মসজিদে এক রাকাত সালাত আদায় করা অন্য মসজিদে একহাজার রাকাত সালাত আদায়ের চেয়েও উত্তম; তবে মসজিদুল হারাম ব্যতীত”।[7]

মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে,

«صَلَاةٌ فِي مَسْجِدِي هَذَا أَفْضَلُ».

“আমার এ মসজিদে সালাত আদায় করা উত্তম”।[8]

...

দ্বিতীয়ত: সময়ের মর্যাদার কারণে আমলে সাওয়াব অনেকগুণ বৃদ্ধি পায়। যেমন, রমযান মাস, যিলহজ মাসের প্রথম দশ দিন। ইবন ‘আব্বাসরাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমাথেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

« عمرة في رمضان تَعْدِلُ حَجَّةً أو حجة مَعِي يَعْنِي عُمْرَةً فِي رَمَضَانَ».

“রমযানে উমরা পালন হজের সমতুল্য অথবা আমার সাথে হজ পালনের সওয়াবের সমতুল্য হবে”।[9]

...

যেহেতু সাওমের সাওয়াব অন্যান্য আমলের চেয়ে বহুগুণ, সেহেতু রমযান মাসে সময়ের মর্যাদার কারণে সাওম পালন অন্যান্য সময় সাওম পালনের চেয়ে অনেকগুণ সাওয়াব। যেহেতু রমযানের সাওম আল্লাহ তাঁর বান্দার ওপর ফরয করেছেন এবং সাওমকে ইসলামের রুকনসমূহের অন্যতম একটি রুকন করেছেন।

আরো অন্য কারণে সাওয়াব দ্বিগুণ থেকে বহুগুণ করা হয়। যেমন, আল্লাহর কাছে আমলকারীর মর্যাদা, তার কাছে নৈকট্য ও তার তাকওয়ার কারণে। যেমন এ উম্মাতের সাওয়াব পূর্ববর্তী অন্যান্য উম্মাতের চেয়ে অনেকগুণ বেশি।

দ্বিতীয় বর্ণনায় বান্দার জন্য অন্যান্য আমলের থেকে সাওমের আলাদা সাওয়াবের কথা বলা হয়েছে। কেননা সাওমকে আল্লাহ নিজের জন্য নির্দিষ্ট করেছেন। এ ব্যাপারে সামনে আরো আলোচনা আসছে।

তৃতীয় বর্ণনায় আমলের দ্বারা কাফফারা থেকে সাওমকে আলাদা করা হয়েছে।

এখানে সুফইয়ান ইবন ‘উয়াইনাহ রহ. এর বাণীটি খুবই চমৎকার। তিনি বলেছেন: নিম্নোক্ত হাদীসটি সবচেয়ে সুন্দর ও প্রজ্ঞাময়, কিয়ামতের দিন আল্লাহ বান্দার হিসেব নিবেন। তাকে সমস্ত আমলের সাওয়াব থেকে যুলুমের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, তবে সাওম ব্যতীত। তার অবশিষ্ট যুলুমের গুনাহ আল্লাহ নিজে বহন করে সাওমের কারণে তাকে তিনি জান্নাত দান করবেন।[10] এ হাদীস থেকে বুঝা গেল, আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে সাওম পালনকারীর সাওয়াব অন্য কেউ নেওয়ার সুযোগ নেই, বরং আল্লাহ তা ব্যক্তির জন্য সংরক্ষণ করে রাখেন। এ কারণেই বলা হয়, সমস্ত আমল ব্যক্তির গুনাহ কাফফারা। তখন তার আর কোন সাওয়াব অবশিষ্ট থাকবে না। যেমন বর্ণিত আছে, “কিয়ামতের দিনে ব্যক্তির ভালো ও মন্দ আমল ওজন করা হবে এবং একটির দ্বারা অন্যটির ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কিসাস তথা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার পরে সৎ আমল অবশিষ্ট থাকলে ব্যক্তি জান্নাতে যাবে”। এ ব্যাপারে মারফু‘ সূত্রে বর্ণিত হাদীস রয়েছে। অতএব, সাওমের ব্যাপারে বলা যায় যে, কোন গুনাহের কাফফারাস্বরূপ বা অন্য কোন কারণে সাওমের সাওয়াব কর্তন করা হবে না; বরং সাওমের সাওয়াব ব্যক্তিকে পরিপূর্ণ দেওয়া হবে, এমনকি এ কারণে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। তখন জান্নাতে তার পরিপূর্ণ প্রতিদান দেওয়া হবে।

>
[1] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯০৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১৫১।

[2] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯০৪।

[3] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৭৫৩৮।

[4] মুসনাদ আহমাদ, হাদীস নং ১০৫৫৪। হাদীসের সনদটি শাইখাইনের শর্তানুযায়ী সহীহ।

[5] নাসাঈ, হাদীস নং ২৪০৮, আলবানী রহ. বলেছেন, হাদীসটি সহীহ। ইবন হিব্বান, ৩৬৫৯।

[6] সহীহ ইবন খুযাইমা, হাদীস নং ১৮৮৭। মুহাক্কীক মুহাম্মাদ মুস্তফা আল-‘আযামী রহ. হাদীসটিকে দ‘ঈফ বলেছেন।

[7] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১১৯০; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৩৯৪।

[8] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৩৯৪।

[9] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮৬৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১২৫৬; আবু দাউদ, হাদীস নং ১৯৯০।

[10] সুনান আল-কুবরা, বাইহাকী, হাদীস নং ৮৩৩৫।