রমযানের দায়িত্ব-কর্তব্য (ইবন রজব আল-হাম্বলী রহ. এর ‘লাতায়িফুল মা‘আরিফ’ অবলম্বনে) পরিচ্ছেদ: রমযান মাসে সাওম পালনের ফযীলত ইসলামহাউজ.কম
রমযান মাসে সাওম পালনের ফযীলত - ৪

 সাওম পালনকারীগণ দু’টি শ্রেণিতে বিভক্ত:

প্রথম প্রকার: যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পানাহার ও কামভাব ত্যাগ করেছে বিনিময়ে জান্নাত পাওয়ার আশায়। এ শ্রেণির লোকেরা আল্লাহর সাথে ব্যবসা করেছে। আর যারা উত্তম কাজ করেন তাদের প্রতিদান আল্লাহ নষ্ট করেন না। যারা আল্লাহর সাথে ব্যবসা করবে তারা বিফল হবে না, বরং তারা বিরাট লাভবান হবে।

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«إِنَّكَ لَنْ تَدَعَ شَيْئًا اتِّقَاءَ اللهِ إِلَّا أَعْطَاكَ اللهُ خَيْرًا مِنْه».

“আল্লাহর তাকওয়ার উদ্দেশ্যে যা কিছুই তুমি পরিহার করো, তিনি তার চেয়ে উত্তম প্রতিদান দিবেন”।[1] এসব সাওম পালনকারীকে জান্নাতে তাদের ইচ্ছামত খাদ্য, পানীয় ও নারী দান করা হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

﴿كُلُواْ وَٱشۡرَبُواْ هَنِيٓ‍َٔۢا بِمَآ أَسۡلَفۡتُمۡ فِي ٱلۡأَيَّامِ ٱلۡخَالِيَةِ٢٤﴾ [الحاقة: ٢٤]

“(তাদেরকে বলা হবে) বিগত দিনসমূহে তোমরা যা অগ্রে প্রেরণ করেছ তার বিনিময়ে তোমরা তৃপ্তি সহকারে খাও ও পান করো। [সূরা আল-হাক্কাহ, আয়াত: ২৪] মুজাহিদ রহ. বলেছেন: এ আয়াতটি সাওম পালনকারীদের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে।

ইয়াকূব ইবন ইউসুফ রহ. বলেন, আমার কাছে এ মর্মে সংবাদ পৌঁছেছে যে, আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিনে তার অলীদের (বন্ধুদেরকে) বলবেন, হে আমার বন্ধুগণ, আমি যখনই তোমাদের দিকে তাকাতাম তখনই তোমাদের ঠোঁট খাদ্যাভাবে শুষ্ক (কুঁচকানো) দেখতাম, তোমাদের চক্ষু বিনিদ্র দেখতাম, পেট ক্ষুধায় কাঁপত, আজকের দিনে তোমরা তোমাদের নি‘আমতে থাকো, তোমরা পরস্পরে পেয়ালা ভরা শরাব পান করো, তোমরা তোমাদের জন্য যা অগ্রে প্রেরণ করেছ তার বিনিময়ে তৃপ্তি সহকারে খাও ও পান করো।

হাসান রহ. বলেন, নারী হুর মধুর নদীতে তার সাথে হেলান দিয়ে বসা আল্লাহর বন্ধুকে বলবেন, তুমি পান পেয়ালার পানীয় গ্রহণ করো। আল্লাহ তোমার প্রতি কঠিন গরমের দিনে তাকাতেন, তুমি প্রচণ্ড তৃষ্ণা থাকা সত্ত্বেও পিপাসিত ছিলে। তখন আল্লাহ তোমাকে নিয়ে ফিরিশতাদের সাথে গর্ববোধ করতেন। তিনি বলতেন, হে ফিরিশতাগণ তোমরা আমার বান্দাকে দেখো, সে তার স্ত্রী, কামভাব, খাদ্য ও পানীয় আমার সন্তুষ্টির জন্য আমার কাছে যা কিছু আছে তার বিনিময়ে ত্যাগ করেছে। তোমরা সাক্ষ্য থাকো, আমি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। তিনি সেদিনই তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং আমাকে তোমার সাথে বিবাহ দিয়েছেন।

সহীহাইনে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«إِنَّ فِي الجَنَّةِ بَابًا يُقَالُ لَهُ الرَّيَّانُ، يَدْخُلُ مِنْهُ الصَّائِمُونَ يَوْمَ القِيَامَةِ، لاَ يَدْخُلُ مِنْهُ أَحَدٌ غَيْرُهُمْ، يُقَالُ: أَيْنَ الصَّائِمُونَ؟ فَيَقُومُونَ لاَ يَدْخُلُ مِنْهُ أَحَدٌ غَيْرُهُمْ، فَإِذَا دَخَلُوا أُغْلِقَ فَلَمْ يَدْخُلْ مِنْهُ أَحَدٌ».

“জান্নাতে রাইয়্যান নামক একটি দরজা আছে। এ দরজা দিয়ে কিয়ামতের দিন সাওম পালনকারীরাই প্রবেশ করবে। তাঁদের ছাড়া আর কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। ঘোষণা দেওয়া হবে, সাওম পালনকারীরা কোথায়? তখন তারা দাঁড়াবে। তাঁরা ছাড়া আর কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে না। তাঁদের প্রবেশের পরই দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে। যাতে এ দরজা দিয়ে আর কেউ প্রবেশ না করে”।[2]

....

কোনো এক সৎপূর্বসূরী বলেছেন: আমার কাছে এ মর্মে সংবাদ পৌঁছেছে যে, হাশরের দিনে তাদের (সায়িমদের) জন্য দস্তরখানা বিছানো হবে, তারা সেখান থেকে খাবে আর অন্যান্য লোকদের হিসেব চলবে। তখন লোকজন বলবেন, হে আমাদের রব! আপনি আমাদের হিসেব নিচ্ছেন অথচ তারা খাচ্ছে। তখন তাদেরকে বলা হবে, দুনিয়াতে তারা সাওম পালন করছিল আর তোমরা তখন খাচ্ছিলে। তারা রাতে সালাতে দণ্ডায়মান ছিল আর তোমরা ঘুমিয়েছিলে।

কোন এক আল্লাহর ওলী স্বপ্নে দেখেন, তিনি যেন জান্নাতে প্রবেশ করেছেন। তিনি একজনকে বলতে শুনলেন, তোমার কী মনে আছে তুমি অমুক দিন আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সাওম পালন করছিলে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তিনি বলেন, অতঃপর তিনি (ফিরিশতা) আমাকে উপর ফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে দিয়ে সংবর্ধনা দিলেন। দুনিয়াতে কেউ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সামান্য সময় পানাহার ত্যাগ করলে আখিরাতে আল্লাহ এর বিনিময় এমন খাদ্য ও পানীয় দান করবেন যা কখনও নিঃশেষ হবে না এবং এমন সহধর্মীনী দান করবেন যারা কখনও মারা যাবে না।

....

রমযান মাসে সাওম পালনকারীদেরকে জান্নাতে বিবাহ দেওয়া হয়।

....

জান্নাতের হুরদের মহর হলো দীর্ঘ সময় ধরে তাহাজ্জুদের সালাত। আর এ সালাত রমযান মাসে অধিক হারে আদায় করা হয়।

দ্বিতীয় প্রকার: কতিপয় সাওম পালনকারী দুনিয়াতে আল্লাহ ব্যতীত সবকিছু থেকেই সাওম পালন তথা বিরত থাকে। তারা তাদের মস্তিষ্ক ও এর চিন্তাধারাকে হিফাযত করে, পেট ও পেটে যা কিছু ধরে সবকিছু সংরক্ষণ করে, মৃত্যু ও মৃত্যুপরবর্তী পরীক্ষাকে স্মরণ করে, তারা আখিরাত কামনা করে এবং দুনিয়ার সমস্ত চাকচিক্য বর্জন করে। এ ধরণের লোকদের ঈদুল ফিতর হবে তাদের রবের সাথে সাক্ষাতের দিন, তাঁকে দর্শন হবে তাদের আনন্দ-উল্লাস। হে সাওম পালনকারীগণ! আজকে তোমাদের প্রবৃত্তিকে দমন করে সাওম পালন করো যাতে আল্লাহর সাথে মিলিত হওয়ার দিবস ঈদুল ফিতর হিসেবে পাও। দীর্ঘ জীবনের কারণে বেশি দিন বাঁচার প্রত্যাশা করবে না। তোমার জীবনে অধিকাংশ সাওম পালনের দিন শেষ হয়ে গেছে। তোমার ঈদের দিন তোমার রবের সাথে মিলিত হওয়ার দিন নিকটবর্তী হয়ে গেছে।

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী:

«ولَخُلُوفُ فَمِ الصَّائِمِ أَطْيَبُ عِنْدَ اللَّهِ مِنْ رِيحِ المِسْكِ».

“সাওম পালনকারীর মুখের (না খাওয়াজনিত) ঘ্রাণ আল্লাহর নিকট মিসকের ঘ্রাণের চেয়েও উত্তম”।[3] خلُوفُ الفم হলো সাওম অবস্থায় না খাওয়ার কারণে মুখের ঘ্রাণ। এ ঘ্রাণ দুনিয়াতে মানুষের কাছে অছন্দনীয়; কিন্তু আল্লাহর কাছে মিসকের ঘ্রাণের চেয়েও অধিক প্রিয়। যেহেতু বান্দা আল্লাহর আনুগত্য ও তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের কারণেই তার এ গন্ধের সৃষ্টি হয়। এখানে দু’টি অর্থ হতে পারে:

প্রথম অর্থ: দুনিয়াতে সিয়াম যেহেতু বান্দা ও তার রবের মধ্যকার গোপনীয় বিষয়, তাই তিনি আখিরাতে সিয়াম পালনকারীদের মর্যাদা সুউচ্চ করতে সৃষ্টিকুলের কাছে সিয়ামের মর্যাদা স্পষ্ট করেছেন ও দুনিয়াতে মানুষের মাঝে সিয়াম পালনকারীগণ তাদের সিয়াম গোপন রাখার প্রতিদানে আল্লাহ আখিরাতে তাদেরকে মানুষের মাঝে সুপরিচিত করবেন।

...

মাকহূল রহ. বলেন, জান্নাতীগণ জান্নাতে সুঘ্রাণ পাবে। তখন তারা বলবেন, হে আমাদের রব! জান্নাতে প্রবেশের পর থেকে এত সুন্দর সুঘ্রাণ আর কখনও পাইনি। তখন তাদেরকে বলা হবে: এ হলো সিয়াম পালনকারীগণের মুখের সুঘ্রাণ।

দুনিয়াতে সাওম পালনকারীর মুখের দুর্গন্ধ তীব্র হয় তাই আখিরাতে তাদের মুখ থেকে সুঘ্রাণ বের হবে। এ সুঘ্রাণ দুভাবে হতে পারে।

প্রথমত: যা বাহ্যিক অনুভুতি দ্বারা বুঝা যায়। যেমন, আব্দুল্লাহ ইবন গালিব সালাত ও সাওম পালনকারী একজন একনিষ্ঠ ইবাদতকারী ছিলেন। তিনি মারা গেলে তাকে দাফন করা হলে তার কবরের মাটি থেকে মিসকের মত সুঘ্রাণ বের হতে লাগল। একজনকে স্বপ্নে দেখানো হলো তার কবর থেকে এত সুঘ্রাণ আসার কারণ কী? তাকে বলল, এগুলো কুরআন তিলাওয়াত ও সাওমের সু-ঘ্রাণ।

দ্বিতীয়ত: রূহ ও ক্বলব থেকে যে সুঘ্রাণ বের হয়। অতএব, যারা ইখলাসের সাথে ভালোবাসা নিয়ে সাওম পালন করবে তাদের অন্তর ও রূহ থেকে সুগন্ধি বের হবে। যেমন, হারিস আল-আশ‘আরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: যাকারিয়া আলাইহিস সালাম বনী ইসরাঈলদেরকে বললেন,

«وَآمُرُكُمْ بِالصِّيَامِ، فَإِنَّ مَثَلَ ذَلِكَ كَمَثَلِ رَجُلٍ فِي عِصَابَةٍ مَعَهُ صُرَّةٌ فِيهَا مِسْكٌ، فَكُلُّهُمْ يَعْجَبُ أَوْ يُعْجِبُهُ رِيحُهَا، وَإِنَّ رِيحَ الصَّائِمِ أَطْيَبُ عِنْدَ اللَّهِ مِنْ رِيحِ المِسْكِ».

“তোমাদের আমি সিয়ামের নির্দেশ দিচ্ছি। এর উদাহরণ হল সেই ব্যক্তির মত, যে ব্যক্তি একটি দলে অবস্থান করছে। তার সঙ্গে আছে মিশক ভর্তি একটি থলে। দলের প্রত্যেকের কাছেই এ সুগন্ধি ভালো লাগে। আল্লাহ তা‘আলার কাছে মিশকের সুগন্ধি অপেক্ষা সিয়াম পালনকারীর (মুখের) গন্ধ অনেক বেশি সুগন্ধময়।”[4]

.....

দ্বিতীয় অর্থ: কেউ দুনিয়াতে আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্য করার কারণে তা থেকে অপছন্দের কিছু সৃষ্টি হয়, আল্লাহর কাছে তা অপছন্দনীয় থাকে না। বরং সেটি তার কাছে হয়ে যায় অত্যন্ত পছন্দনীয়, খুবই প্রিয় ও পবিত্রতম। কেননা তাঁর আনুগত্য ও অনুসরণের কারণেই উক্ত অপছন্দনীয় জিনিসের সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং এ ধরণের আমলকারীদেরকে দুনিয়াতে তাদের পুরষ্কারের ঘোষণা দিয়ে তাদের অন্তরে প্রশান্তি দিয়েছেন যাতে দুনিয়াতে কেউ তাদেরকে অপছন্দ না করেন।

...সাওম পালনকারীর মুখের ঘ্রাণ আল্লাহর কাছে মিশকের চেয়েও অধিক সু-ঘ্রাণ। আল্লাহর ভয়ে কোনো অপরাধীর বিলাপ তাঁর তাসবীহর চেয়েও উত্তম, তাঁর মহত্ব ও বড়ত্বের ভয়ে কেউ ভেঙ্গে পড়াই হলো প্রকৃত পূর্ণতা, তাঁর ভয়ে অপমানিত হওয়াই প্রকৃত সম্মান, তাঁর সন্তুষ্টির জন্য সাওম পালন করে ক্ষুধার্ত থাকা প্রকৃত পরিতৃপ্তি, তাঁর সন্তুষ্টির অন্বেষণে পিপাসার্ত থাকা প্রকৃত তৃষ্ণা নিবারণ ও তাঁর কাজে নিজেকে নিবেদিত করে দেওয়াই হলো প্রকৃত আরাম-আয়েশ। রমযান মাসে শয়তানকে যেহেতু শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয় এবং সাওমের মাধ্যমে প্রবৃত্তিকে দমন করা হয় তখন তার প্রবৃত্তির শক্তি দূরীভূত হয়ে যায় এবং বিবেকের জন্যই সবকিছু হয়ে যায়। তাই অপরাধীর আর কোনো ওযর থাকল না। অতএব, হে ঘুমন্ত আত্মা জেগে ওঠ। হে তাকওয়া ও ঈমানের সূর্য তুমি উদিত হও, হে সৎকর্মকারীদের আমলনামাসমূহ, তোমরা উত্থিত হও, হে সৎকর্মকারীদের আত্মাগণ, তোমরা আল্লাহর জন্য বিনয়ী হও, হে কঠোর পরিশ্রমীগণের পাসমূহ তোমরা তোমাদের রবের জন্য রুকু-সাজদাহ করো, হে তাহাজ্জুদ আদায়কারীদের চক্ষু আর ঘুমিও না, হে তাওবাকারীগণের গুনাহ তুমি আর ফিরে এসো না।

[1] মুসনাদ আহমাদ, হাদীস নং ২০৭৩৯, শু‘আইব আরনাঊত হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।

[2] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮৯৬।

[3] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯০৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১৫১।

[4] তিরমিযী, হাদীস নং ২৮৬৩, ইমাম তিরমিযী হাদীসটিকে হাসান সহীহ গরীব বলেছেন। আলবানী রহ. হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।