হাদীসের নামে জালিয়াতি যাকাত, সিয়াম ও হজ্জ ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ৯ টি

১. মুমিনের জমিতে খারাজ ও উশর একত্রিত হয় না

একজন মুসলিমকে তার ভূসম্পদের উৎপাদনের ১০% বা ৫% অংশ যাকাত প্রদান করতে হয়। ফল ও ফসলের যাকাতকে ‘উশর’ বলা হয়। অমুসলিমদেকে ‘যাকাত’ দিতে হয় না। এজন্য মুসলিম রাষ্ট্রের অমুসলিম নাগরিককে তার ভূ-সম্পত্তির ‘খারাজ’ প্রদান করতে হয়। ‘খারাজ’ সাধারণত উশরের দ্বিগুণ হয়। কোনো অমুসলিমের জমি যদি কোনো মুসলিম ক্রয় করেন তাহলে তাকে খারাজ ও উশর উভয়ই প্রদান করতে হবে, নাকি শুধুমাত্র খারাজ প্রদান করতে হবে সে বিষয়ে তাবিয়ীগণের যুগ থেকে ফকীহগণের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। অধিকাংশ তাবিয়ী ও ইমাম বলেছেন, তাকে খারাজ ও উশর উভয়ই প্রদান করতে হবে। তাবিয়ী ইকরিমাহ, ইবরাহীম নাখয়ী ও ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) বলেছেন, তাকে শুধুমাত্র খারাজ প্রদান করতে হবে।[1]

এ বিষয়ে একটি হাদীস আলিমদের মধ্যে প্রচলিত। ৫ম হিজরী শতক ও তার পরের কিছু ফকীহ হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। এ হাদীসটিতে ইবনু মাসঊদ (রা) এর সূত্রে বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ () বলেছেন:

لاَ يَجْتَمِعُ الْعُشْرُ وَالْخَرَاجُ فِيْ أَرْضِ رَجُلٍ مُسْلِمٍ

‘‘একজন মুসলিমের ভূমিতে উশর এবং খারাজ একত্রিত হবে না।’’[2]

কিন্তু ইমাম যাইলায়ী ও হানাফী মাযহাবের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিসগণ-সহ সকল মুহাদ্দিস বলেছেন যে, এ হাদীসটি বানোয়াট। রাসূলুল্লাহ () বা ইবনু মাস‘ঊদের (রা) কথা হিসাবে এ বাক্যটি বানোয়াট। প্রকৃতপক্ষে এ বাক্যটি তাবিয়ী ইবরাহীম নাখয়ীর (রাহ) কথা ও তাঁর মত। ইবরাহীম নাখয়ী ছাড়া আরো অন্যান্য তাবিয়ী থেকেও এ মতটি বর্ণিত হয়েছে।[3]

ইমাম আবু হানীফা (রাহ) এ কথাটি ইবরাহীম নাখয়ী থেকে তাঁর নিজের মত হিসাবে বর্ণনা করেছেন এবং তা গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন: আমাকে হাম্মাদ ইবনু আবী সুলাইমান বলেছেন, ইবরাহীম নাখয়ী বলেছেন: ‘‘একজন মুসলিমের ভূমিতে উশর এবং খারাজ একত্রিত হবে না।’’ এ পর্যন্ত কথাটি সহীহ। অর্থাৎ কথাটি ‘মাকতু‘য় হাদীস’ বা তাবিয়ীর কথা হিসাবে সহীহ।

কিন্তু পরবর্তী যুগের একজন রাবী ইয়াহইয়া ইবনু আনবাসাহ ইমাম আবু হানীফার নামে বানোয়াটভাবে এ কথাটিকে রাসূলুল্লাহ ()-এর কথা হিসাবে বর্ণনা করে। ইয়াহইয়া ইবনু আনবাসাহ বলেন: আবু হানীফা আমাদেরকে বলেছেন: হাম্মাদ ইবনু আবী সুলাইমান ইবরাহীম নাখয়ী থেকে, তিনি ‘আলকামাহ থেকে, তিনি আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ বলেছেন: ‘‘একজন মুসলিমের ভূমিতে উশর এবং খারাজ একত্রিত হবে না।’’

এভাবে ইয়াহইয়া ইবনু আনবাসাহ একজন তাবিয়ীর বাণীকে রাসূলুল্লাহ ()-এর বাণী বলে বর্ণনা করেছেন। মুহাদ্দিসগণ খুব সহজেই তাঁর এ জালিয়াতি বা ভুল ধরে ফেলেছেন।

তাঁরা লক্ষ্য করেন যে, ইমাম আবূ হানীফার (রাহ) অগণিত ছাত্রের কেউই এ হাদীসটি তাঁর কাছ থেকে বর্ণনা করেন নি। তাঁর অন্যতম ছাত্র ইমাম আবু ইউসূফ ও মুহাম্মাদ (রাহ) তাঁদের বিভিন্ন গ্রন্থে এ মাসআলাটির উপরে অনেক আলোচনা করেছেন, কিন্তু কোথাও উল্লেখ করেন নি যে, ইমাম আবু হানীফা তাঁদেরকে এ হাদীসটি রাসূলুল্লাহ () থেকে বর্ণনা করেছেন অথবা তিনি এ বিষয়ে কোনো হাদীসে নাবাবীর উপর নির্ভর করেছেন।

এখানেই মুহাদ্দিসগণের সন্দেহের শুরু। যদি একজন হাদীস বর্ণনাকারী কোনো প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস বা ফকীহ থেকে এমন একটি হাদীস বর্ণনা করেন যা তাঁর অন্য কোনো ছাত্র, বিশেষত যারা আজীবন তাঁর সাথে থেকেছেন তাঁরা কেউ বর্ণনা না করেন, তাহলে তাঁরা হাদীসটির বিশুদ্ধতার বিষয়ে সন্দিহান হন। দ্বিতীয় পদক্ষেপ হিসাবে তাঁরা দেখেন, যে বর্ণনাকারী একাই এ হাদীসটি বলেছেন তাঁর বর্ণিত অন্যান্য হাদীসের ও তাঁর ব্যক্তিচরিত্রের কী অবস্থা।

এখানে তাঁরা দেখলেন যে, ইয়াহইয়া ইবনু ‘আনবাসাহ জীবনে যতগুলো হাদীস বর্ণনা করেছেন সবই ভুল বা বানোয়াট। তিনি বিভিন্ন প্রখ্যাত ও বিশ্বস্ত আলিম ও মুহাদ্দিসের নামে অনেক হাদীস বর্ণনা করেছেন যা অন্য কেউ করেন নি। তিনি অনেক মিথ্যা ও বানোয়াট হাদীস এভাবে বিভিন্ন বানোয়াট সনদে বর্ণনা করেছেন। তাঁর বর্ণিত সকল হাদীসকে অন্যান্য মুহাদ্দিসগণের বর্ণিত হাদীসের সাথে তুলানামূলক নিরীক্ষা করে এবং তাঁর ব্যক্তি জীবন পর্যালোচনা করে মুহাদ্দিসগণ নিশ্চিত হয়েছেন যে, এ হাদীসটিও তিনি ইমাম আবু হানীফার নামে বানিয়েছেন। এজন্যই ৩য় ও ৪র্থ হিজরী শতকের কোন হানাফী ইমাম বা ফকীহ এ হাদীসটিকে দলীল হিসাবে পেশ করেন নি।[4]

২. অলঙ্কারের যাকাত নেই

ব্যবহৃত অলঙ্কারের যাকাত প্রদান করতে হবে কি না সে বিষয়ে সাহাবীগণের যুগ থেকে মতভেদ রয়েছে। জাবির (রা) ও অন্য কয়েকজন সাহাবী বলতেন যে, অলঙ্কারের যাকাত প্রদান করতে হবে না। অপর দিকে অন্য অনেক সাহাবী বলতেন যে, অলঙ্কারের যাকাত প্রদান করতে হবে।[5]

এ ক্ষেত্রে যারা অলঙ্কারের যাকাত ফরয নয় বলে মত প্রকাশ করেন, তাদের পক্ষে একটি হাদীস বর্ণিত ও প্রচলিত। জাবির (রা)-এর নামে বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ () বলেছেন:

لَيْسَ فِى الْحُلِىِّ زَكَاةٌ

‘‘অলঙ্কারের মধ্যে যাকাত নেই।’’

এটি রাসূলুল্লাহর () কথা নয়। একে হাদীসে নাবাবী হিসাবে বাতিল বলে ঘোষণা করেছেন বাইহাকী, ইবনু হাজার, আলবানী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস। এ বাক্যটি মূলত জাবির (রা.)- এর নিজের কথা।। একজন অত্যন্ত দুর্বল বর্ণনাকারী ভুলবশত একে রাসূলুল্লাহ ()-এর কথা বলে বর্ণনা করেছেন।[6]

[1] বিস্তারিত জানতে ‘বাংলাদেশে উশর বা ফসলের যাকাত: গুরুত্ব ও প্রয়োগ’ বইটি পড়ুন।

[2] ইবনু আদী, আল-কামিল ৯/১২৭, বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ৪/২২২।

[3] বিস্তারিত দেখন, ‘বাংলাদেশে উশর বা ফসলের যাকাত: গুরুত্ব ও প্রয়োগ, পৃ. ৮৬-৮৭।

[4] ইবনু আদী, কামিল ৯/১২৭, ইবনু হিববান, আল-মাজরুহীন ৩/১২৪, বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ৪/২২২, ড: খালদূন আ‘হদাব, যাওয়াইদু তারীখি বাগদাদ ৯/৪১৯-৪২২, ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ‘আত ২/৬৯-৭০, যাইলায়ী, নাসবুর রাইয়াহ ৩/৪৪২, সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/৭০, ইবনু আর্রাক, তানযীাহ ২/১২৮, শাওকানী, আল-ফাওয়াইদু ১/৮৭-৮৮।

[5] বিস্তারিত দেখুন, বাংলাদেশে উশর বা ফসলের যাকাত: গুরুত্ব ও প্রয়োগ, পৃ. ৩১-৩২।

[6] ইবনু হাজার, আদ দিরাইয়াতু ১/২৬০, আলবানী, ইরওয়াউল গালীল ৩/২৯৪-২৯৬।

সিয়াম বিষয়ক অনেক জাল হাদীস ও মনগড়া কথা ‘বার চান্দের ফযীলত’ প্রসঙ্গে আলোচিত হয়েছে। আরো দু একটি ভিত্তিহীন বিষয় নিম্নরূপ:

১. সিয়ামের নিয়্যাত

আমরা দেখেছি, ‘নাওয়াইতু আন’ বলে যত ‘নিয়্যত’ সবই ‘বানোয়াট’। কোনো ইবাদতে এরূপ নিয়্যাত পাঠের কথা কোনো হাদীসে বলা হয় নি।

২. ৩০ দিন সিয়াম ফরয হওয়ার কারণ

বিভিন্ন ইবাদতের কারণ নির্ণয় করা একটি বিশেষ বাতুল আগ্রহ। ফলে জালিয়াতগণ এ বিষয়ে অনেক কথা বানিয়েছে। রামাদানের ফরয সিয়ামের বিষয়ে জালিয়াতগণ বানিয়েছে:

اِفْتَرَضَ اللهُ عَلَى أُمَّتِيْ الصَّوْمَ ثَلاَثِيْنَ يَوْماً ... وَذَلِكَ أَنَّ آَدَمَ لَمَّا أَكَلَ الشَّجَرَةَ بَقِيَ فِيْ جَوْفِهِ مِقْدَارَ ثَلاَثِيْنَ يَوْماً، فَلَمَّا تَابَ اللهُ عَلَيْهِ أَمَرَهُ بِصِيَامِ ثَلاَثِيْنَ يَوْماً بِلَيَالِيْهِنَّ، وَافْتَرَضَ عَلَى أُمَّتِيْ بِالنَّهَارِ.

‘‘আমার উম্মতের উপরে ৩০ দিনের সিয়াম ফরয করা হয়েছে। কারণ আদম যখন গাছ (ফল) খেয়েছিলেন তখন তা তাঁর পেটের মধ্যে ৩০ দিন বিদ্যমান থাকে। যখন আল্লাহ আদমের তাওবা কবুল করলেন তখন তাকে ত্রিশ দিন ও ত্রিশ রাত একটানা সিয়াম পালনের নির্দেশ দেন। আমার উম্মতের উপরে শুধু দিবসে সিয়াম পালনের নির্দেশ দেন। ...’’[1]

৩. ইফতার, সাহরী ইত্যাদি খানার হিসাব না হওয়া

সমাজে প্রচলিত আছে যে, ইফতার, সাহরী ইত্যাদি খাওয়ার হিসাব নেই। এ অর্থের বানোয়াট হাদীসগুলোর মধ্যে রয়েছে:

ثَلاَثَةٌ لاَ يُسْأَلُوْنَ عَنْ نَعِيْمِ الْمَطْعَمِ وَالْمَشْرَبِ: الْمُفْطِرُ، وَالْمُتَسَحِّرُ، وَصَاحِبُ الضَّيْفِ.

‘‘তিন ব্যক্তির পানাহারের নেয়ামতের হিসাব গ্রহণ করা হবে না: ইফতার-কারী, সাহরীর খাদ্যগ্রহণকারী ও মেহমান-সহ খাদ্য গ্রহণকারী।’’[2]

এ সকল ভিত্তিহীন কথাবার্তার কারণে রামাদান মাসকে আমরা ‘নিজে খাওয়ার’ মাসে পরিণত করেছি। অথচ রামাদান হলো অন্যকে খাওয়ানোর ও সহমর্মিতার মাস। এছাড়া আমাদের ‘হিসাব হবে কিনা’ তা বিবেচনা না করে ‘সাওয়াব বেশি হবে কিনা’ তা বিবেচনা করা উচিত।

৪. আইয়াম বীযের নামকরণ

চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখকে ‘আইয়ামুল বিদ’ বা শুভ্র রাতের দিনগুলো’ বলা হয়; কারণ এ তারিখগুলোতে পূর্ণ চাঁদের কারণে প্রায় সারারতই শুভ্রতা বা আলো বিরাজমান থাকে।[3] কিন্তু জালিয়াতগণ ‘আইয়াম বীয’-এর নামকরণ বিষয়ে অনেক জাল হাদীস প্রচার করেছে। যেমন:

‘‘নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল ভক্ষণের পরে যখন আদম (আঃ) পৃথিবীতে অবতরণ করেন তখন তাঁর দেহ কাল হয়ে গিয়েছিল। ফলে ফিরিশতাগণ তাঁর জন্য কাঁদতে থাকেন। ...তখন আল্লাহ আদমকে বলেন, তুমি আমার জন্য ১৩ তারিখ সিয়াম পালন কর। তিনি ১৩ তারিখ সিয়াম পালন করেন এবং এতে তাঁর একতৃতীয়াংশ শুভ্র হয়ে যায়। অতঃপর মহান আল্লাহ তাঁকে বলেন, তুমি আজকের দিন ১৪ তারিখও সিয়াম পালন কর। তখন তিনি ১৪ তারিখ সিয়াম পালন করেন এবং তাঁর দুই তৃতীয়াংশ শুভ্র হয়ে যায়। অতঃপর মহান আল্লাহ তাকে বলেন, তুমি আজকের দিন ১৫ তারিখও সিয়াম পালন কর। তখন তিনি ১৫ তারিখ সিয়াম পালন করেন এবং তাঁর পুরো দেহ শুভ্র হয়ে যায়। এজন্য এই দিনগুলিকে ‘আইয়ামুল বীয’ বা ‘‘শুভ্রতার দিনগুলি’’ নাম রাখা হয়।’’[4]

৫. আইয়াম বীযের সিয়াম পালনের ফযীলত

বিভিন্ন সহীহ হাদীসে রাসূলুল্লাহ () মুমিনগণকে সকল নফল ইবাদত অল্প হলেও নিয়মিত পালন করার উৎসাহ দিয়েছেন। নফল সিয়ামের ক্ষেত্রে প্রতি চান্দ্র বা আরবী মাসে অন্তত তিন দিন সিয়াম পালনের উৎসাহ দিয়েছেন। কোনো কোনো হাদীসে বিশেষ করে প্রত্যেক চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ নফল সিয়াম পালনের জন্য উৎসাহ দিয়েছেন।[5]

এ দিনগুলোতে সিয়াম পালনের বিশেষত্ব তিনটি: প্রথম, রাসূলুল্লাহ () বিভিন্ন হাদীসে এ তিন দিন সিয়াম পালনের নির্দেশ দিয়েছেন।[6] দ্বিতীয়, তিনি নিজে সর্বদা এ তিন দিন সিয়াম পালন করতেন।[7] তৃতীয়, এ তিন দিন সিয়াম পালন করলে বা প্রতি মাসে অন্তত তিন দিন সিয়াম পালন করলে সারা বছর সিয়াম পালনের সাওয়াব হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।[8]

মুমিনের জন্য এগুলোই যথেষ্ট। কিন্তু জালিয়াতগণ ‘আইয়াম বীয’-এর ফযীলতের বিষয়ে অনেক জাল হাদীস প্রচার করেছে। যেমন, ‘‘যদি কেউ আইয়াম বিযের সিয়াম পালন করে তবে ১ম দিনে (তের তারিখ) তাকে ১০ হাজার বছরের পুরস্কার প্রদান করা হবে, দ্বিতীয় দিনে (১৪ তারিখ) তাকে ১ লাখ বছরের পুরস্কার প্রদান করা হবে এবং তৃতীয় দিনে (১৫ তারিখে) তাকে তিন লাখ বছরের সাওয়াব প্রদান করা হবে।’’ কোনো কোনো জালিয়াত একটু কমিয়ে বলেছে: ‘‘১ম দিনে ৩ হাজার বৎসরের সাওয়াব, দ্বিতীয় দিনে ১০ হাজার বছরের এবং তৃতীয় দিনে ২০ হাজার বছরের সাওয়াব পাবে...।’’[9]

এরূপ আরো অনেক বানোয়াট কথা তারা প্রচার করেছে।

[1] ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ‘আত ২/১০১; সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/৯৭; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/১৪৫; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ১/১১৯।

[2] সুয়ূতী, যাইলুল লাআলী, পৃ. ১২১; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/১৬৬; তাহির পাটনী, তাযকিরা, পৃ. ৭০; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ১/১২৪।

[3] ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ৪/২২৬; আব্দুর রাঊফ মুনাবী, ফাইদুল কাদীর ৪/২২৯।

[4] ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ‘আত ১/৩৭৫; সুয়ূতী, আল-লাআলী ১/৪৮৩-৪৮৪; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/৫৪-৫৫; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ১/১২৫।

[5] বুখারী, আস-সহীহ ১/৩৯৫, ২/৬৯৭-৬৯৯, ৩/১২৫৬, ১২৫৭; মুসলিম ১/৪৯৯, ২/৮১২-৮১৮; মুনযিরী, আত-তারগীব ২/৭৪-৭৯।

[6] বুখারী, আস-সহীহ ১/৩৯৫, ২/৬৯৭-৬৯৯, ৩/১২৫৬, ১২৫৭; মুসলিম ১/৪৯৯, ২/৮১২-৮১৮; বাইহাকী, শু‘আবুল ঈমান ৩/৩৮৯-৩৯০; মুনযিরী, আত-তারগীব ২/৭৪-৭৯।

[7] আলবানী, সহীহুল জামি ২/৮৭৬।

[8] বুখারী, আস-সহীহ ১/৩৯৫, ২/৬৯৭-৬৯৯, ৩/১২৫৬, ১২৫৭; মুসলিম ১/৪৯৯, ২/৮১২-৮১৮; বাইহাকী, শু‘আবুল ঈমান, ৩/৩৮৯-৩৯০; মুনযিরী, আত-তারগীব ২/৭৪-৭৯।

[9] সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/১০৬-১০৭; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/১৪৮; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ১/১২৮।
(গ) হজ্জ - ১. সাধ্য হলেও হজ্জ না করলে ইহূদী বা খৃস্টান হয়ে মরা

আমাদের সমাজে অতি পরিচিত একটি হাদীস, হজ্জ বিষয়ক যে কোনো ওয়ায, আলোচনা বা লেখালেখিতে যে হাদীসটি উল্লেখ করা হয়:

مَنْ مَلَكَ زَادًا وَرَاحِلَةً تُبَلِّغُهُ إِلَى بَيْتِ اللَّهِ وَلَمْ يَحُجَّ فَلا عَلَيْهِ أَنْ يَمُوتَ يَهُودِيًّا أَوْ نَصْرَانِيًّا

‘‘যে ব্যক্তি বাইতুল্লাহ পৌঁছার মত পাথেয় ও বাহনের মালিক হলো, অথচ হজ্জ করল না, সে ইহূদী অবস্থায় মৃত্যু বরণ করলে অথবা খৃস্টান অবস্থায় মৃত্যু বরণ করলে তার কোনো অসুবিধা হবে না।’’

হাদীসটির প্রসিদ্ধির অন্যতম কারণ হলো, প্রসিদ্ধ ৬টি হাদীস গ্রন্থের অন্যতম গ্রন্থ সুনান তিরমিযীতে এ হাদীসটি সংকলিত। ইমাম তিরমিযী বলেন: আমাকে মুহাম্মাদ ইবনু ইয়াহইয়া বলেন, আমাদেরকে মুসলিম ইবনু ইবরাহীম বলেছেন, আমাদেরকে হেলাল ইবনু আব্দুল্লাহ বলেছেন, আমাদেরকে আবূ ইসহাক হামদানী বলেছেন, হারিস থেকে, তিনি আলী থেকে, রাসূলুল্লাহ () বলেন....। হাদীসটি উদ্ধৃত করার পরে ইমাম তিরমিযী বলেন:

هَذَا حَدِيثٌ غَرِيبٌ لا نَعْرِفُهُ إِلا مِنْ هَذَا الْوَجْهِ وَفِي إِسْنَادِهِ مَقَالٌ وَهِلَالُ بْنُ عَبْدِ اللَّهِ مَجْهُولٌ وَالْحَارِثُ يُضَعَّفُ فِي الْحَدِيثِ

‘‘এটি একটি গরীব হাদীস। হাদীসটি একমাত্র এ সনদ ছাড়া অন্য কোনো সূত্রে আমার জানতে পারি নি। এর সনদে আপত্তি রয়েছে। হেলাল ইবনু আব্দুল্লাহ অজ্ঞাত পরিচয়। আর হারিস হাদীস বর্ণনায় দুর্বল’’[1]

হারিস নামক এ রাবীর পূর্ণ নাম ‘হারিস ইবনু আব্দুল্লাহ আল-আ‘ওয়ার আল-হামদানী। তিনি কূফার একজন কট্টরপন্থী শিয়া ছিলেন। তিনি আলী (রা) এর সহচর ছিলেন এবং ৬৫ হিজরীর দিকে ইন্তিকাল করেন। আলী (রা) ও আহলু বাইতদের বিষয়ে অনেক জঘন্য মিথ্যা কথা তিনি বলতেন। এজন্য সমসাময়িক মুহাদ্দিসগণ এবং পরবর্তী মুহাদ্দিসগণ প্রায় সকলেই তাকে মিথ্যাবাদী ও জাল হাদীস বর্ণনাকারী বলে উল্লেখ করেছেন।

আমির ইবনু শারাহীল শা’বী বলেন, হারিস আমাকে হাদীস বলেন এবং তিনি একজন বড় মিথ্যাবাদী ছিলেন। আবূ ইসহাক সুবাইয়ী বলেন, হারিস একজন বড় মিথ্যাবাদী ছিলেন। যে সকল মুহাদ্দিস হারিসকে মিথ্যবাদী বলে উল্লেখ করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন: ইবরাহীম নাখয়ী, শু’বা ইবনুল হাজ্জাজ, আলী ইবনুল মাদীনী, ইবনু হিববান প্রমুখ। পক্ষান্তরে ইমাম নাসাঈ, ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন প্রমুখ মুহাদ্দিস হারিসকে দুর্বল বলে গণ্য করেছেন।[2]

এছাড়াও এ হাদীসটির সনদে আরো দুটি কঠিন দুর্বলতা রয়েছে:

প্রথম, আবূ ইসহাক মুদাল্লিস ছিলেন। এখানে তিনি বলেন নি যে, হারিস তাকে হাদীসটি বলেছেন বা তিনি তার কাছ থেকে হাদীস শুনেছেন। তার বর্ণনাভঙ্গি থেকে বুঝা যায় তিনি সরাসরি হারিস থেকে শুনেন নি।

দ্বিতীয়, হাদীসের পরবর্তী বর্ণনাকারী হিলাল ইবনু আব্দুল্লাহ অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি। হাদীসটি আদৌ আবূ ইসহাক বলেছেন, নাকি এ লোকটি বানিয়ে বলছে, তা কিছুই জানার উপায় নেই।

এখানে উল্লেখ্য যে, এ অর্থে আরো কয়েকটি সনদে হাদীস বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু সে সকল সনদের অবস্থা এ সনদের চেয়েও খারাপ। এ সকল কারণে কোনো কোনো মুহাদ্দিস এ হাদীসটিকে জাল ও বানোয়াট বলে গণ্য করেছেন। পক্ষান্তরে কেউ কেউ একে যয়ীফ বলে গণ্য করেছেন। আল্লামা ইবনু হাজার আসকালানী সকল সনদ আলোচনা করে বলেন, রাসূলুল্লাহ () থেকে এ কথাটি কোনো গ্রহণযোগ্য সনদে বর্ণিত হয় নি। সবগুলো সনদই অত্যন্ত দুর্বল বা বাতিল। তবে সহীহ সনদে তা উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) থেকে তাঁর নিজের বক্তব্য হিসাবে বর্ণিত হয়েছে।[3]

[1] তিরমিযী, আস-সুনান ৩/১৭৬।

[2] ইবনু হাজার, তাহযীবুত তাহযীব ২/১২৬।

[3] ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ‘আত ২/১২১-১২২; ইবনু হাজার, তালখীসুল হাবীর ২/২২২-২২৩; সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/১১৮-১১৯; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/১৬৭; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ১/১৩৭-১৩৮।
২. রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর কবর যিয়ারত বিষয়ক হাদীসসমূহ

যিয়ারত শব্দের অর্থ সাক্ষাত করা, দেখা করা, বেড়ান (visit, call) ইত্যাদি। জীবিত মানুষদের, বিশেষত আত্মীয় স্বজন ও নেককার মানুষদের যিয়ারত করা বা সাক্ষাত করা একটি হাদীস নির্দেশিত নেক কাজ। বিভিন্ন হাদীসে মুমিনদেরকে ‘তাযাউর ফিল্লাহ’ (التزاور في الله) বা আল্লাহর ওয়াস্তে একে অপরের যিয়ারত বা দেখা সাক্ষাত করতে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে।[1]

অনুরূপভাবে মৃত মানুষদের ‘কবর’ যিয়ারত করা, অর্থাৎ সাক্ষাত করা বা বেড়ানোও হাদীস সম্মত একটি মুস্তাহাব ইবাদত। রাসূলুল্লাহ () কবর শরীফ যিয়ারত নিঃসন্দেহে অন্যতম শ্রেষ্ঠ যিয়ারত। এছাড়া তাঁকে ভালবাসা ঈমানের অংশ ও অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইবাদত। আর সুন্নাত সম্মত যিয়ারতের মাধ্যমে এ মহববত বৃদ্ধি পায়। এছাড়া তাঁর পবিত্র কবরের পাশে দাঁড়িয়ে দরুদ-সালাম প্রদানের মর্যাদা হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। এভাবে আমরা দেখতে পাই যে, কবর শরীফ যিয়ারত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত।

তবে এ ইবাদতের জন্য বিশেষ কোনো হাদীস আছে কিনা তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কেউ কেউ এ বিষয়ক সকল হাদীস জাল ও ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করেছেন। কেউ কেউ সেগুলোকে দুর্বল বা মোটামুটি গ্রহণযোগ্য বলে উল্লেখ করেছেন। এখানে সে বিষয়ে কিছুটা বিস্তারিত আলোচনা করতে চাই।

এ বিষয়ক হাদীসগুলোকে অর্থের দিক থেকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমত, রাসূলুল্লাহ ()-এর যিয়ারতকারী অথবা তাঁর বরকতময় কবর যিয়ারতকারীর জন্য শাফা‘আত বা রহমতের সুসংবাদ। দ্বিতীয়, রাসূলুল্লাহ ()-এর ইন্তিকালের পরে তাঁর পবিত্র কবর যিয়ারতকারীকে তাঁর জীবদ্দশাতেই তাঁর সাথে সাক্ষাতকারীর মর্যাদার সুসংবাদ প্রদান। তৃতীয়, যিয়ারত পরিত্যাগকারীর প্রতি অসন্তুষ্টি প্রকাশ।

[1] মুনযিরী, আত-তারগীব ৩/২৪৭-২৪৯।

১ম হাদীস:

مَنْ زَارَ قَبْرِيْ وَجَبَتْ لَهُ شَفَاعَتِيْ

‘‘যে আমার কবর যিয়ারত করবে, আমার শাফা‘আত তার প্রাপ্য হবে।’’

হাদীসটি ইবনু খুযাইমা, বায্যার, দারাকুতনী, বাইহাকী প্রমুখ মুহাদ্দিস সংকলন করেছেন। হাদীসটির ২টি সনদ রয়েছে:

১ম সনদ: বায্যার বলেন, আমাকে কুতাইবা বলেছেন, আমাকে আব্দুল্লাহ ইবনু ইবরাহীম বলেছেন, আমাকে আব্দুর রাহমান ইবনু যাইদ ইবনু আসলাম বলেছেন, তার পিতা থেকে, ইবনু উমার থেকে, রাসূলুল্লাহ () বলেছেন..।[1]

আমরা অন্যত্র ‘আব্দুর রাহমান ইবনু যাইদ ইবনু আসলাম’ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। আমরা দেখেছি যে, মুহাদ্দিসগণ তাকে অত্যন্ত দুর্বল বলে উল্লেখ করেছেন। কেউ কেউ তাকে মিথ্যা হাদীস বর্ণনাকারী বলে উল্লেখ করেছেন। এ সনদে তার ছাত্র ‘আব্দুল্লাহ ইবনু ইবরাহীম’ নামক এ ব্যক্তিও অত্যন্ত দুর্বল। তিনি আব্দুর রাহমান ইবনু যাইদ ও অন্যান্য অনেক মুহাদ্দিসের নামে এমন অনেক হাদীস বর্ণনা করেছেন, যেগুলো সে সকল মুহাদ্দিসের অন্য কোনো ছা্ত্র বর্ণনা করেন না বা অন্য কোনো সূত্রে পাওয়া যায় না। মুহাদ্দিসগণ একমত যে, তিনি অত্যন্ত দুর্বল ও পরিত্যক্ত রাবী। ইবনু হিববান তাকে হাদীস জালিয়াতকারী বলে উল্লেখ করেছেন।[2]

আমরা দেখেছি যে, আব্দুর রাহমান বর্ণিত হাদীসই অত্যন্ত দুর্বল বা জাল বলে গণ্য। এ সনদে তার ছাত্রের অবস্থা তাঁর চেয়েও খারাপ।

দ্বিতীয় সনদ: ইমাম দারাকুতনী বলেন, আমাদেরকে কাযী মুহামিলী বলেন, আমাদেরকে উবাইদুল্লাহ ইবনু মুহাম্মাদ আল-ওয়ার্রাক বলেছেন, আমাদেরকে মূসা ইবনু হিলাল বলেছেন, আমাদেরকে আব্দুল্লাহ্ (অথবা উবাইদুল্লাহ) ইবনু উমার আল-উমারী বলেছেন, তিনি নাফি’ থেকে, তিনি আব্দুল্লাহ ইবনু উমার থেকে, রাসূলুল্লাহ () বলেছেন ...।’’[3]

ইমাম বাইহাকীও একই সনদে মূসা ইবনু হিলাল থেকে, আব্দুল্লাহ ইবনু উমার আল-উমারী থেকে নাফি’ থেকে আব্দুল্লাহ ইবনু উমার থেকে এই হাদীসটি সংকলিত করেছেন। হাদীসটি উদ্ধৃত করে বাইহাকী বলেন: হাদীসটি নাফি’ থেকে ইবনু উমার থেকে একটি মুনকার বা অত্যন্ত আপত্তিকর হাদীস। এ ব্যক্তি (মূসা ইবনু হিলাল) ছাড়া অন্য কেউ এ হাদীসটি বর্ণনা করে নি।’’[4]

ইমাম ইবনু খুযাইমাও একই সনদে হাদীসটি সংকলন করেছেন এবং বলেছেন, ‘হাদীসটির সনদের গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে।... হাদীসটি মুনকার, অর্থাৎ আপত্তিকর বা অত্যন্ত দুর্বল।’[5]

এ সনদেও দুজন বর্ণনাকারী দুর্বল। মূসা ইবনু হিলাল নামক একজন অজ্ঞাত পরিচয় বা স্বল্প পরিচিত রাবী। আবূ হাতিম রাযী তাকে অজ্ঞাত পরিচয় বলেছেন। ইবনু আদী বলেছেন, আশা করি তার হাদীস মোটামুটি গ্রহণযোগ্য। যাহাবী বলেন, এ ব্যক্তির হাদীস মোটামুটি গ্রহণযোগ্য। ... তার বর্ণিত হাদীসগুলোর মধ্যে সবেচেয়ে আপত্তিকর বা দুর্বল হলো এ হাদীসটি।[6]

মূসা নামক এ রাবীর উস্তাদ আব্দুল্লাহ ইবনু উমার ইবনু হাফস আল-উমারী (১৭১ হি) দ্বিতীয় শতকের একজন তাবি-তাবিয়ী। তিনি হাদীস বর্ণনায় দুর্বল হলেও পরিত্যক্ত ছিলেন না। ইয়াহইয়া ইবনু মায়ীন তাকে দুর্বল বা মোটামুটি গ্রহণযোগ্য বলে উল্লেখ করেছেন। আহমাদ ইবনু হাম্বাল, ইবনু আদী, যাহাবী প্রমুখ মুহাদ্দিস তাকে মোটামুটি গ্রহণযোগ্য বলেছেন। নাসাঈ ও অন্য কেউ কেউ তাকে দুর্বল বলেছেন। ইবনু হাজার আসকালানী সকল মতামতের সমন্বয় করে বলেন ‘‘তিনি দুর্বল রাবী। ইমাম মুসলিম তার বর্ণনাকে সহায়ক বর্ণনা হিসাবে উল্লেখ করেছেন। তিরমিযী, নাসাঈ, আবু দায়ূদ ও ইবনু মাজাহ তার বর্ণনা গ্রহণ করেছেন।’’[7]

কোনো কোনো বর্ণনায় মূসা ইবনু হিলাল তার উস্তাদ হিসাবে ‘উবাইদুল্লাহ ইবনু উমারের’ নাম উল্লেখ করেছেন। ‘উবাইদুল্লাহ’ নির্ভরযোগ্য রাবী। তবে ইবনু খুযাইমা, বাইহাকী, যাহাবী প্রমুখ মুহাদ্দিস বলেছেন, এখানে ‘উবাইদুল্লাহর উল্লেখ ভুল। হাদীসটি আব্দুল্লাহর বর্ণনা।[8]

সর্বাবস্থায় এ সনদটি দুর্বল হলেও এতে কোনো মিথ্যাবাদি বা মিথ্যা বর্ণনার অভিযোগে অভিযুক্ত বা পরিত্যক্ত রাবী নেই।

২য় হাদীস:

مَنْ زَارَ قَبْرِيْ أَوْ قَالَ مَنْ زَارَنِيْ كُنْتُ لَهُ شَفِيْعاً أَوْ شَهِيْداً

‘‘যে ব্যক্তি আমার কবর যিয়ারত করবে, অথবা তিনি বলেন, যে ব্যক্তি আমার যিয়ারত করবে, কেয়ামতের দিন আমি তার জন্য শাফা‘আত-কারী অথবা সাক্ষ্যদানকারী হব।’’

হাদীসটি আবূ দায়ূদ তায়ালিসী ও বাইহাকী সংকলন করেছেন। তাঁরা সিওয়ার ইবনু মাইমূন নামক এক ব্যক্তির সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। এ সিওয়ার ইবনু মাইমূন বলেন, তাকে উমার ইবনুল খাত্তাবের বংশের একব্যক্তি বলেছেন, উমার থেকে, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ () বলেছেন ...।[9]

এ হাদীসের রাবী সিওয়ার ইবনু মাইমূন অজ্ঞাত পরিচয় বর্ণনাকারী। রিজাল শাস্ত্রের কোনো গ্রন্থে তার উল্লেখ পাওয়া যায় না। তার উসতাদ ‘উমারের বংশের এক ব্যক্তি’ সম্পূর্ণ পরিচয়হীন। এজন্য ইমাম বাইহাকী হাদীসটি উদ্ধৃত করে বলেন (هذا إسناد مجهول) ‘‘এ সনদটি অজ্ঞাত’’।[10]

৩য় হাদীস:

مَنْ زَارَنِيْ مُتَعَمِّداً كَانَ فِيْ جِوَارِيْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ

‘‘যে ব্যক্তি ইচ্ছাপূর্বক আমার যিয়ারত করবে; কিয়ামতের দিন সে আমার প্রতিবেশী হয়ে বা আমার আশ্রয়ে থাকবে।’’[11]

হাদীসটি বাইহাকী, যাহাবী, ইবনু হাজার প্রমুখ মুহাদ্দিস উদ্ধৃত করেছেন। তারা হাদীসটি ৩য় শতকের মুহাদ্দিস আব্দুল মালিক ইবনু ইবরাহীম আল-জুদ্দী (২০৫ হি)-এর সূত্রে বর্ণনা করেছেন। আব্দুল মালিক বলেন, আমাদেরকে শু’বা ইবনুল হাজ্জাজ (১৬২ হি) বলেছেন, সিওয়ার ইবনু মাইমূন থেকে, তিনি বলেন, আমাদেরকে হারূন ইবনু কুযা‘আহ বলেছেন, খাত্তাবের বংশের জনৈক ব্যক্তি থেকে, রাসূলুল্লাহ () থেকে, তিনি বলেছেন...।

এ হাদীসটির সনদ পূর্বের হাদীসের চেয়েও দুর্বল। উপরের সনদের দুইটি দুর্বলতা ছাড়াও এ সনদে আরো দুটি দুর্বলতা রয়েছে। প্রথম, এ সনদে সিওয়ার-এর উস্তাদ হারূন আবূ কুযা‘আহর সঠিক পরিচয় জানা যায় না। একে হারূন আবূ কুযা‘আহ বা হারূন ইবনু কুযা‘আহ বলা হয়। তার সম্পর্কে ইমাম বুখারী বলেন, এ ব্যক্তির হাদীস ভিত্তিহীন, অন্য কেউ তা বলে না। আযদী বলেন, এ ব্যক্তি পরিত্যক্ত।[12] দ্বিতীয়, এ সনদে সাহাবীর নাম উল্লেখ করা হয় নি, ফলে সনদটি মুরসাল বা বিচ্ছিন্ন।

৪র্থ হাদীস:

مَنْ جَاءَنِيْ زَائِراً لاَ تُعْمِلُهُ حَاجَةٌ إِلاَّ زِيَارَتِيْ كَانَ حَقًّا عَلَيَّ أَنْ أَكُوْنَ لَهُ شَفِيْعاً يَوْمَ الْقِيَامَةِ

‘‘যে ব্যক্তি আমার কাছে যিয়ারতকারী হিসাবে আগমন করবে, আমার যিয়ারত ছাড়া অন্য কোনো প্রয়োজন তাকে ধাবিত করবে না, তার জন্য আমার দায়িত্ব হবে যে, আমি কিয়ামতের দিন তার জন্য শাফা‘আত করব।’’

হাদীসটি, দারাকুতনী, তাবারানী, যাহাবী প্রমুখ মুহাদ্দিস সংকলন করেছেন। তাঁরা তাঁদের সনদে আব্দুল্লাহ ইবনু মুহাম্মাদ আল-আববাদীর সূত্রে বলেন, তিনি বলেছেন, আমাদেরকে মুসলিম (মাসলামা) ইবনু সালিম আল-জুহানী বলেছেন, আমাকে আব্দুল্লাহ (অথবা উবাইদুল্লাহ) ইবনু উমার বলেছেন, তিনি নাফি থেকে, তিনি সালিম থেকে, তিনি আব্দুল্লাহ ইবনু উমার থেকে, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ () বলেছেন ....’’[13]

এ হাদীসের বর্ণনাকারী মুসলিম ইবনু সালিম আল-জুহানী দুর্বল ও অনির্ভরযোগ্য রাবী ছিলেন। কেউ কেউ তার নাম ‘মাসলামা’ বলে উল্লেখ করেছেন। আবূ দায়ূদ সিজিসতানী বলেন, এ লোকটি ‘সিকাহ’ বা বিশ্বস্ত নয়। ইমাম হাইসামী বলেন, এ ব্যক্তি দুর্বল।’’[14]

৫ম হাদীস:

مَنْ زَارَنِيْ بِالْمَدِيْنَةِ مُحْتَسِباً كُنْتُ لَهُ شَهِيْداً وَشَفِيْعاً يَوْمَ الْقِيَامَةِ

‘‘যে ব্যক্তি সাওয়াবের উদ্দেশ্যে মদীনায় আমার সাথে সাক্ষাত করবে, কেয়ামতের দিন আমি তার সাক্ষী এবং শাফায়তকারী হব।’’

হাদীসটি ইবনু আবি দুনিয়া, বাইহাকী প্রমুখ মুহাদ্দিস সংকলন করেছেন। তারা একাধিক সনদে মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈল ইবনু আবী ফুদাইক-এর সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, আমাদেরকে আবুল মুসান্না সুলাইমান ইবনু ইয়াযিদ আল-কা’বী বলেছেন, আনাস ইবনু মালিক (রা) থেকে, রাসূলুল্লাহ () বলেছেন ....।’’[15]

এ সনদে আবুল মুসান্না সুলাইমান ইবনু ইয়াযিদ নামক এ রাবীকে মুহাদ্দিসগণ দুর্বল বলেছেন। আবূ হাতিম রাযী বলেন, লোকটি শক্তিশালী ছিলেন না, আপত্তিকর হাদীস বর্ণনা করতেন। দারাকুতনীও তাকে দুর্বল বলেছেন। তবে ইবনু হিববান তাকে ‘সিকাহ’ বা বিশ্বস্ত রাবীদের তালিকাভুক্ত করছেন। ইমাম তিরমিযীও তাকে গ্রহণযোগ্য বলে গণ্য করেছেন। মুহাদ্দিসগণের মতামতের সমন্বয় করে ইবনু হাজার তাকে দুর্বল বলে উল্লেখ করেছেন। এখানে লক্ষণীয় যে, আবুল মুসান্না তাবিয়ী ছিলেন না, তাবি-তাবিয়ী ছিলেন। ইবনু হিববান, ইবনু হাজার প্রমুখ মুহাদ্দিস উল্লেখ করেছেন যে, তিনি কোনো সাহাবী থেকে হাদীস শিক্ষা করেন নি। বরং তাবিয়ীগণ থেকে হাদীস শুনেছেন। এজন্য হাদীসটির সনদ বিচ্ছিন্ন বা মুনকাতি’।[16]

৬ষ্ঠ হাদীস:

رَحِمَ اللهُ مَنْ زَارَنِيْ وَزِمَامُ نَاقَتِهِ بِيَدِهِ

‘‘আল্লাহ রহমত করুন সে ব্যক্তিকে, যে তার উটের রশি তার হাতে নিয়ে আমার যিয়ারত করেছে।’’

এ বাক্যটির বিষয়ে ইবনু হাজার আসকালানী, সাখাবী, সুয়ূতী, ইবনু আর্রাক, মোল্লা আলী কারী, শাওকানী, দরবেশ হূত প্রমুখ মুহাদ্দিস বলেছেন যে, বাক্যটি ভিত্তিহীন বানোয়াট।[17]

উপরের ৬টি হাদীসের মধ্যে ৬ষ্ঠ হাদীস সর্বসম্মতিক্রমে ভিত্তিহীন বানোয়াট বাক্য। বাকী পাঁচটি হাদীস থেকে রাসূলুল্লাহ () এর যিয়ারত করা বা তাঁর সাথে সাক্ষাত করার ফযীলত অবগত হওয়া যায়। প্রথম হাদীসে ‘কবর’ যিয়ারতের কথা স্পষ্ট বলা হয়েছে। তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম হাদীসে রাসূলুল্লাহ () -কে যিয়ারত করার কথা বলা হয়েছে। দ্বিতীয় হাদীসে উভয়ের যে কোনো একটি কথা বলা হয়েছে। আর রাসূলুল্লাহ ()-এর ইন্তিকালের পরে তার পবিত্র কবর যিয়ারতও তাঁরই যিয়ারত বলে গণ্য হতে পারে।

আমরা দেখছি যে, এ অর্থের হাদীসগুলোর সবগুলোর সনদই দুর্বল। ইবনু তাইমিয়া, ইবনু আব্দুল হাদী প্রমুখ মুহাদ্দিস এ অর্থের হাদীসগুলোকে একেবারেই ভিত্তিহীন বলে গণ্য করেছেন। আলবানী একে যয়ীফ বা দুর্বল বলে উল্লেখ করেছেন।[18] তবে আমরা দেখতে পাই যে, প্রথম হাদীসের দ্বিতীয় সনদ, ৪র্থ হাদীস এবং ৫ম হাদীসের সনদে কোনো মিথ্যাবাদী বা একেবারে ‘মাজহূল’ বা অজ্ঞাতনামা কেউ নেই। কাজেই এই সনদগুলো পরস্পরের শক্তি বৃদ্ধি করে এবং একাধিক সনদের কারণে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে।

[1] হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/২; আলবানী, ইরওয়া ৪/৩৩৯।

[2] ইবনু আদী, আল-কামিল ৪/১৯০-১৯১; যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৪/৫৫-৫৬; ইবনু হাজার, তাকরীবুত তাহযীব, পৃ. ২৯৫।

[3] দারাকুতনী, আস-সুনান ২/২৭৮।

[4] বাইহাকী, শু‘আবুল ঈমান ৩/৪৯০।

[5] যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৬/৫৬৬-৫৬৭; ইবনু হাজার, তালখীসুল হাবীর ২/২৬৬-২৬৭; আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৩২৮-৩২৯; আলবানী, ইরওয়াউল গালীল ৪/৩৩৮।

[6] উকাইলী, আদ-দু‘আফা ৪/১৭০; ইবনু আদী, আল-কামিল ৬/৩৫১; যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৬/৫৬৬-৫৬৭।

[7] ইবনু আদী, আল-কামিল ৪/১৪১; যাহাবী, আল-মুগনী ১/৩৪৮-৩৪৯; মীযানুল ইতিদাল ৪/১৫১-১৫৩; ইবনু হাজার, তাকরীব, পৃ. ৩১৪।

[8] দারাকুতনী, আস-সুনান ২/২৭৮; বাইহাকী, শু‘আবুল ঈমান ৩/৪৯০; ইবনু হাজার, তালখীসুল হাবীর ২/২৬৬-২৬৭।

[9] তাইয়ালীসী, আল-মুসনাদ ১/১২; বাইহাকী, শু‘আবুল ঈমান ৩/৪৮৮-৪৮৯; আস-সুনানুল কুবরা ৫/২৪৫।

[10] বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ৫/২৪৫।

[11] বাইহাকী, শু‘আবুল ঈমান ৪/৪৮৮; যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৭/৬৩; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ৬/১৮০।

[12] ইবনু আদী, আল-কামিল ৭/১২৮; ইবনুল জাওযী, আদ-দু‘আফা ওয়াল মাতরূকীন ৩/১৬৯; যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৭/৬৩, ৬৭; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ৬/১৮০, ১৮৩।

[13] তাবারানী, আল-মু’জামুল কাবীর ১২/২৯১।

[14] যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৬/৪১৫; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/২; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ৬/২৯।

[15] হামযা ইবনু ইউসূফ, তারীখু জুরজান ১/২২০; বাইহাকী, শু‘আবুল ঈমান ৩/৪৮৯-৪৯০; ইবনু হাজার, তালখীসুল হাবীর ২/২৬৭; শাওকানী, নাইলুল আউতার ৫/১৭৯।

[16] ইবনু হিববান আস-সিকাত ৬/৩৯৫; যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৩/৩২১; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ৭/৪৮১; ইবনু হাজার, তাহযীবুত তাহযীব ১২/২৪২; তাকরীব, পৃ. ৬৭০; তালখীসুল হাবীর ২/২৬৬-২৬৭; শাওকানী, নাইলুল আউতার ৫/১৭৯; আলবানী, যায়ীফুল জামি, পৃ. ৮০৮।

[17] ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/১৭৬; সাখাবী, মাকাসিদ, পৃ. ২৩৫; মোল্লা কারী, আসরার, পৃ. ১২৮; মাসনূ, পৃ. ৭৪; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ১/১৫৩; দরবেশ হূত, আসনাল মাতালিব, পৃ. ১১৪।

[18] ইবনু আব্দুল হাদী, আস-সারিম আল-মানকী পৃ. ২৯-২৪৬; আলবানী, ইরওয়াউল গালীল ৪/৩৩৩-৩৩৫।
৪. ওফাত-পরবর্তী যিয়ারতে জীবদ্দশার যিয়ারতের মর্যাদা

৭ম হাদীস:

مَنْ حَجَّ فَزَارَ قَبْرِيْ فِيْ مَمَاتِيْ كَانَ كَمَنْ زَارَنِيْ فِيْ حَيَاتِيْ

‘‘যে ব্যক্তি হজ্জ করে আমার মৃত্যুর পরে আমার কবর যিয়ারত করল, সে যেন আমার জীবদ্দশাতেই আমার যিয়ারত করল।’’

হাদীসটি দারাকুতনী, তাবারানী, বাইহাকী প্রমুখ মুহাদ্দিস সংকলন করেছেন। তাঁরা সকলেই হাদীসটি হাফস ইবনু সুলাইমান নামক রাবীর মাধ্যমে বর্ণনা করেছেন। হাফস বলেন, তাকে লাইস ইবনু আবী সুলাইম বলেছেন, তাকে মুজাহিদ বলেছেন, আব্দুল্লাহ ইবনু উমার থেকে, রাসূলুল্লাহ () বলেছেন...।[1] বাইহাকী হাদীসটি উদ্ধৃত করে বলেন, ‘‘একমাত্র হাফসই এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তিনি দুর্বল।’’[2]

এ হাদীসের একমাত্র বর্ণনাকারী হাফ্স ইবনু সুলাইমান (১৮০হি) প্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য কারী ছিলেন। তবে তিনি হাদীস বর্ণনায় অত্যন্ত দুর্বল ছিলেন। কুরআনের কিরা‘আত ও আনুষঙ্গিক বিষয়ে তিনি এত ব্যস্ত থাকতেন যে, হাদীস মুখস্থ, পুনরালোচনা ও বিশুদ্ধ বর্ণনায় তিনি মোটেও সময় দিতেন না। ফলে তার বর্ণিত হাদীসে এত বেশি ভুল পাওয়া যায় যে, ইমাম আহমাদ ছাড়া অন্য সকল মুহাদ্দিস তাকে অত্যন্ত দুর্বল ও পরিত্যক্ত বলে গণ্য করেছেন। ইমাম আহমাদ তাকে মোটামুটি চলনসই বলে মনে করতেন। যাহাবী, ইবনু হাজার ও অন্যান্য মুহাদ্দিস বলেছেন যে, তিনি নিজে সত্যবাদী ছিলেন, তবে হাদীস বলতে অত্যন্ত বেশি ভুল করতেন, সনদ উল্টে ফেলতেন, রাবীর নাম বদলে দিতেন, মতন পাল্টে দিতেন... এবং সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য করতে পারতেন না; এজন্য তিনি পরিত্যক্ত রাবী হিসাবে গণ্য। ইমাম বুখারী তাঁকে পরিত্যক্ত বলে উল্লেখ করেছেন। আর তিনি মিথ্যায় অভিযুক্তদেরকেই পরিত্যক্ত বলেন। আবূ হাতিম রাযী, ইবনু আদী, ইবনু হিববান ও অন্যান্য মুহাদ্দিসও তাঁকে অত্যন্ত দুর্বল বলেছেন। ইবনু খিরাশ তাকে মিথ্যা হাদীস বর্ণনাকারী বলে উল্লেখ করেছেন।[3]

এ সনদে হাফসের উস্তাদ লাইস ইবনু আবী সুলাইমও কিছুটা দুর্বল রাবী ছিলেন। তিনি একজন বড় আলিম, আবিদ ও সত্যপরায়ন রাবী ছিলেন। তবে শেষ জীবনে তার স্মৃতি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ইমাম মুসলিম তার বর্ণনা সহায়ক বর্ণনা হিসাবে গ্রহণ করেছেন। সুনান চতুষ্টয়ের সংকলকগণ: তিরমিযী, নাসাঈ, আবূ দায়ূদ ও ইবনু মাজাহ তার বর্ণনা গ্রহণ করেছেন।[4]

৮ম হাদীস:

مَنْ زَارَ قَبْرِيْ بَعْدَ مَوْتِيْ كَانَ كَمَنْ زَارَنِيْ فِيْ حَيَاتِيْ

‘‘আমার মৃত্যুর পরে আমার কবর যে ব্যক্তি যিয়ারত করল, সে যেন আমার জীবদ্দশায় আমার যিয়ারত করল।’’[5]

ইমাম তাবারানী হাদীসটি উদ্ধৃত করে বলেন, আমাকে আহমাদ ইবনু রিশদীন বলেছেন, আমাদেরকে আলী ইবনুল হাসান ইবনু হারূন আনসারী বলেছেন, আমাকে লাইস ইবনু আবী সুলাইমের মেয়ের পুত্র লাইস বলেছেন, আমাকে লাইস ইবনু আবী সুলাইমের স্ত্রী আয়েশা বিনতু ইউনূস বলেছেন, তাকে মুজাহিদ বলেছেন, ইবনু উমার থেকে, রাসূলুল্লাহ () বলেছেন...।

এ সনদের প্রায় সকল রাবীই অজ্ঞাত পরিচয় বা দুর্বল। তাবারানীর উস্তাদ আহমাদ ইবনু রিশদীন (২৯২হি) দুর্বল ছিলেন। কোনো কোনো মুহাদ্দিস তাকে মিথ্যাবাদী বলে উল্লেখ করেছেন।[6] তাঁর উস্তাদ ‘‘আলী ইবনুল হাসান’’ নামক এ ব্যক্তির কোনোরূপ পরিচয় জানা যায় না। অনুরূপভাবে তার উস্তাদ লাইস নামক এ ব্যক্তি, তার উস্তাদ আয়েশা নামক এ মহিলা এরাও একেবারেই অপরিচিত। এ জন্য সনদটি একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।[7]

৯ম হাদীস:

مَنْ زَارَنِيْ بَعْدَ مَوْتِيْ فَكَأَنَّمَا زَارَنِيْ فِيْ حَيَاتِيْ

‘‘যে ব্যক্তি আমার মৃত্যুর পর আমার যিয়ারত করল, সে যেন আমার জীবদ্দশাতেই আমার যিয়ারত করল।’’

হাদীসটি ইমাম দারাকুতনী, বাইহাকী প্রমুখ মুহাদ্দিস সংকলন করেছেন। এই হাদীসের সনদ বর্ণনায় মুহাদ্দিসগণ বৈপরীত্য ও বিক্ষিপ্ততা দেখতে পেয়েছেন। দুই ভাবে এই হাদীসটির সনদ ও মতন বলা হয়েছে:

প্রথম সনদ: ২য় হিজরী শতকের মুহাদ্দিস ওকী’ ইবনুল জার্রাহ (১৯৭ হি) বলেছেন, আমাদেরক বলেছেন খালিদ ইবনু আবূ খালিদ ও আবূ আউন উভয়ে শা’বী ও আসওয়াদ ইবনু মাইমূন থেকে, তিনি হারূন আবূ কুযা‘আহ থেকে, তিনি হাতিব-এর বংশের জনৈক ব্যক্তি থেকে, তিনি হাতিব (রা) থেকে, হাতিব (রা) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ () বলেছেন ....।’’[8]

ইতোপূর্বে ৩ নং হাদীসের সনদ আলোচনার সময় আমরা দেখতে পেয়েছি যে, হারূন আবূ কুযা‘আহ অপরিচিত, অগ্রহণযোগ্য ও পরিত্যক্ত রাবী। এ সনদে হারূন-এর উস্তাদ ‘হাতিব-এর বংশের জনৈক ব্যক্তি’ শুধু অজ্ঞাত পরিচয়ই নন, তিনি অজ্ঞাতনামাও বটে।

দ্বিতীয় সনদ: ৩য় শতকের মুহাদ্দিস ইউসূফ ইবনু মূসা বলেন, আমাদেরকে ওকী’ বলেছেন, আমাদেরকে মাইমূন ইবনু সিওয়ার (সিওয়ার ইবনু মাইমূন) বলেছেন, আমাকে হারূন আবূ কুযা‘আহ বলেছেন...। [9]

এ সনদটি প্রথম সনদের চেয়েও দুর্বল। কারণ উপরে ৩ নং হাদীসের আলোচনা থেকে আমরা দেখেছি যে, সিওয়ার ইবনু মাইমূন অজ্ঞাত পরিচয়।

উপরের তিনটি হাদীস থেকে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ ()-এর ওফাতের পরেও যে মুমিন তাঁর কবর যিয়ারত করবে, সে জীবদ্দশায় তাঁর সাথে সাক্ষাতের মর্যাদা লাভ করবে। আমরা দেখেছি যে, তিনটি সনদই অত্যন্ত দুর্বল। প্রথম ও দ্বিতীয় সনদে ‘মিথ্যায় অভিযুক্ত’ রাবী রয়েছেন। তৃতীয় সনদের পরিত্যাক্ত রাবী রয়েছে। এছাড়া সনদগুলোতে সম্পূর্ণ অজ্ঞাতনামা ও অজ্ঞাত পরিচয় রাবী রয়েছে। এ কারণে ইবনু তাইমিয়া, ইবনু আব্দুল হাদী, আলবানী প্রমুখ মুহাদ্দিস এ হাদীসগুলোকে ‘মাউদূ’ বা জাল বলে গণ্য করেছেন।

সনদগত অগ্রহণযোগ্যতা ছাড়াও অর্থগতভাবেও হাদীসগুলো ইসলামের মূল চেতনার বিরোধী বলে তাঁরা দাবী করেছেন। ইবনু তাইমিয়া বলেন, এ কথা যে মিথ্যা তা স্পষ্ট। এ কথা মুসলিমদের ধর্মের বিরোধী। কারণ যে মুমিন ব্যক্তি জীবদ্দশায় রাসূলুল্লাহ () -এর যিয়ারত বা সাক্ষাত করবেন তিনি তাঁর সাহাবী বলে গণ্য হবেন। .... পরবর্তী যুগের একজন মুমিন বড় বড় ফরয ওয়াজিব আমলগুলি বেশি বেশি পালন করেও কখনোই একজন সাহাবীর সমমর্যাদা-সম্পন্ন হতে পারেন না। তাহলে একটি মুস্তাহাব ইবাদত পালনের মাধ্যমে কিভাবে তিনি একজন সাহাবীর সমমর্যাদা লাভ করবেন?![10]

[1] দারাকুতনী, আস-সুনান ২/২৭৮; বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ৫/২৪৬; শু‘আবুল ঈমান ৩/৪৮৯; তাবারানী, আল-মু’জামুল আউসাত ১/৯৪; আল-মু’জামুল কাবীর ১২/৪০৬।

[2] বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ৫/২৪৬; শু‘আবুল ঈমান ৩/৪৮৯।

[3] যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ২/৩১৯-৩২১; ইবনু হাজার, তাকরীব, পৃ. ১৭২।

[4] যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৫/৫০৯; ইবনু হাজার, তাকরীব, পৃ. ৪৬৪।

[5] তাবারানী, আল-মু’জামুল কাবীর ১২/৪০৬; আল-মু’জামুল আউসাত ১/৯৪।

[6] ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ১/২৫৭।

[7] হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/২; ইবনু হাজার, তালখীসুল হাবীর ২/২৬৬-২৬৭; আলবানী, যায়ীফাহ ১/১২৩-১২৪।

[8] দারাকুতনী, আস-সুনান ২/২৭৮; বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ৫/২৪৫; শু‘আবুল ঈমান ৪/৪৮৮; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ৬/১৮০।

[9] বাইহাকী, শু‘আবুল ঈমান ৪/৪৮৮; যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৭/৬৩; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ৬/১৮০।

[10] আলবানী, যায়ীফাহ ১/১২০-১২৪; ইরওয়াউল গালীল ৪/৩৩৫-৩৪১।
৫. যিয়ারত পরিত্যাগকারীর প্রতি অসন্তুষ্টি প্রকাশ

১০ম হাদীস:

مَنْ حَجَّ وَلَمْ يَزُرْنِيْ فَقَدْ جَفَانِيْ ... مَنْ لَمْ يَزُرْنِيْ فَقَدْ جَفَانِيْ

‘‘যে ব্যক্তি হজ্জ করল, কিন্তু আমার যিয়ারত করল না, সে আমার সাথে আন্তরিকতাবিহীন আচরণ করল।’’ অন্য ভাষায়: ‘‘যে ব্যক্তি আমার যিয়ারত বা সাক্ষাত করল না সে আমার সাথে অসৌহার্দপূর্ণ আচরণ করল।’’

হাদীসটি কোনো হাদীস সংকলক কোনো হাদীস গ্রন্থে সংকলন করেন নি। দুর্বল ও মিথ্যাবাদী রাবীদের জীবনীগ্রন্থসমূহে কোনো কোনো মুহাদ্দিস হাদীসটি সংকলন করেছেন। তারা হাদীসটি একটি মাত্র সনদে সংকলিত করেছেন। তাঁরা উল্লেখ করেছেন যে, মুহাম্মাদ ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু আন-নু’মান নামক এক ব্যক্তি বলেন, আমাকে আমার দাদা আন-নু’মান ইবনু শিব্ল বলেছেন, মালিক ইবনু আনাস আমাকে বলেছেন, তিনি নাফি’ থেকে, তিনি আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রা) থেকে, রাসূলুল্লাহ () বলেছেন ....।’’

এ সনদের দুইজন রাবী অত্যন্ত দুর্বল ও মিথ্যা হাদীস বর্ণনায় অভিযুক্ত। প্রথম ইমাম মালিক থেকে বর্ণনাকারী আন-নু’মান ইবনু শিবল নামক এ ব্যক্তি অত্যন্ত দুর্বল রাবী ছিলেন। কোনো কোনো মুহাদ্দিস তাকে মিথ্যাবাদী বলে উল্লেখ করেছেন। দ্বিতীয় তার পৌত্র মুহাম্মাদ ইবনু মুহাম্মাদও মিথ্যাবাদী ও জালিয়াত হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন। ইমাম দারাকুতনী, ইবনু হিববান, ইবনুল জাওযী, সাগানী, যাহাবী, ইবনু হাজার, দরবেশ হূত, শাওকানী, আলবানী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস হাদীসটিকে জাল বলে উল্লেখ করেছেন। দারাকুতনী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস উল্লেখ করেছেন যে, এর জালিয়াতির জন্য দায়ী মুহাম্মাদ ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু আন-নু’মান, তার দাদা নুমান ইবনু শিবল নন।[1]

১১শ হাদীস:

مَا مِنْ أحَدٍ مِنْ أُمَّتِيْ لَهُ سَعَةٌ ثُمَّ لَمْ يَزُرْنِيْ إِلاَّ وَلَيْسَ لَهُ عُذْرٌ

‘‘আমার উম্মতের কোনো ব্যক্তির যদি সচ্ছলতা বা সুযোগ থাকে, তা সত্ত্বেও সে আমার সাথে সাক্ষাত বা যিয়ারত না করে, তাহলে তার কোনো ওযর থাকে না।’’

হাদীসটি ইবনু নাজ্জার তার ‘তারীখুল মাদীনা’ নামক গ্রন্থে সংকলিত করেছেন।[2] তার সনদটি নিম্নরূপ: ‘‘মহাম্মাদ ইবনু মুকাতিল থেকে, তিনি জা’ফর ইবনু হারূন থেকে, তিনি সাম‘আন ইবনু মাহদী থেকে, তিনি আনাস (রা) থেকে, রাসূলুল্লাহ () বলেছেন...।’’[3]

এ সনদটি মাউদূ সনদ হিসাবে প্রসিদ্ধ। মুহাম্মাদ ইবনু মুকাতিল রাযী (২৪৮হি) কিছুটা দুর্বল হলেও পরিত্যক্ত ছিলেন না।[4] এ সনদে তিনি যার কাছ থেকে হাদীসটি শুনেছেন, জা’ফর ইবনু হারূন নামক এ ব্যক্তি মিথ্যা হাদীস বর্ণনাকারী ও জাল হাদীস প্রচারকারী হিসাবে পরিচিত।[5] তার উস্তাদ হিসাবে উল্লিখিত ‘সাম‘আন ইবনু মাহদী’ সম্পর্কে যাহাবী ও ইবনু হাজার বলেছেন, এ লোকটি সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না বললে চলে। তার নামে আনাস ইবনু মালিক (রা) থেকে একটি বানোয়াট পান্ডুলিপি প্রচারিত। এতে প্রায় ৩০০ হাদীস আছে। মুহাম্মাদ ইবনু মুকাতিল রাযী, জা’ফর ইবনু হারূন আল-ওয়াসিতীর মাধ্যমে এই সাম‘আন থেকে সেই হাদীসগুলো বর্ণনা করেছেন। এই হাদীসগুলোর জালিয়াতকে আল্লাহ লাঞ্চিত করুন।[6]

বাহ্যত এ হাদীসটিও উপর্যুক্ত জাল পান্ডুলিপির অংশ। সর্বাবস্থায় হাদীসটির সনদে একাধিক মিথ্যাবাদী রাবী রয়েছে।

১২শ হাদীস:

مَنْ وَجَدَ سَعَةً وَلَمْ يَغْدُ إِلَيَّ فَقَدْ جَفَانِيْ

‘‘যে ব্যক্তি প্রশস্ততা বা সচ্ছলতা পেল, কিন্তু আমার কাছে আগমন করল না, সে আমার সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ বা বেয়াদবী করল।’’

হাদীসটি হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাযালী তার ‘এহইয়াউ উলূমিদ্দীন’ গ্রন্থে সনদ বিহীনভাবে উল্লেখ করেছেন। কোথাও কোনো গ্রন্থেই তা সনদ-সহ পাওয়া যায় না। আল্লামা সুবকী, ইরাকী, সাখাবী, আজলূনী, শাওকানী প্রমুখ মুহাদ্দিস নিশ্চিত করেছেন যে, এ বাক্যটি ভিত্তিহীন ও বানোয়াট।[7]

উপরের তিনটি হাদীস থেকে রাসূলুল্লাহ () এর সাথে -তাঁর জীবদ্দশায় বা ইন্তিকালের পরে- যিয়ারত বা সাক্ষাত না করার অপরাধ বুঝা যায়। তবে আমরা দেখেছি যে, ৩য় হাদীসটি একেবারেই ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কথা এবং প্রথম ও দ্বিতীয় হাদীসের সনদের একাধিক মিথ্যাবাদী রয়েছে।

উপরের আলোচনা থেকে আমরা দেখছি যে, রাসূলুল্লাহ ()-এর বরকতময় কবর যিয়ারতের ফযীলত বিষয়ক সকল হাদীসই দুর্বল সনদে বর্ণিত হয়েছে। সম্ভবত এ কারণেই প্রসিদ্ধ ছয়টি গ্রন্থের লেখকগণ, অন্যান্য সহীহ গ্রন্থের সংকলকগণ, ইমাম মালিক, ইমাম আহমাদ প্রমুখ মুহাদ্দিস এ সকল হাদীস তাঁদের গ্রন্থসমূহে সংকলন করেন নি। এ সকল হাদীসের সনদগত দুর্বলতার কারণে কোনো কোনো মুহাদ্দিস ঢালাওভাবে এ সকল হাদীসকে জাল বা অত্যন্ত দুর্বল ও একেবারে অগ্রহণযোগ্য বলে মত প্রকাশ করেছেন। অপরদিকে কোনো কোনো মুহাদ্দিস এগুলোর সবগুলোকে একত্রিত ভাবে সহীহ বা হাসান বলে গ্রহণ করার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। ইবনু তাইমিয়া, ইবনুল জাওযী, ইবনু আব্দুল হাদী প্রমুখ মুহাদ্দিস রাসূলুল্লাহ ()-এর পবিত্র কবর যিয়ারত বিষয়ক সকল হাদীসকেই জাল অথবা একেবারেই দুর্বল ও অগ্রহণযোগ্য বলে উল্লেখ করেছেন। পক্ষান্তরে আল্লামা আবূ আলী ইবনুস সাকান, আব্দুল হক ইশবিলী, সুবকী, সাখাবী, ইবনু হাজার মাক্কী প্রমুখ মুহাদ্দিস এ অর্থের হাদীসগুলোকে গ্রহণযোগ্য বলে গণ্য করেছেন।[8]

তবে উপরের আলোচনার মত অর্থগত পার্থক্য করে কেউ সনদগুলো আলোচনা করেছেন বলে জানতে পারি নি। একজন নগন্য তালিব ইলম হিসেবে আমার কাছে প্রতীয়মান হয়েছে যে, তৃতীয় অর্থে, অর্থাৎ যিয়ারত পরিত্যাগকারীর প্রতি অসন্তুষ্টি প্রকাশের অর্থে বর্ণিত সকল হাদীসই জাল ও ভিত্তিহীন। দ্বিতীয় অর্থে, অর্থাৎ ওফাতের পরে কবর যিয়ারতকারীকে জীবদ্দশায় যিয়ারতকারীর মর্যাদা প্রদান বিষয়ক হাদীসগুলো অত্যন্ত দুর্বল বা জাল।

প্রথম অর্থে, অর্থাৎ যিয়ারতকারীর জন্য শাফায়াতের সুসংবাদ প্রদানমূলক হাদীসগুলো ‘হাসান’ গণ্য হতে পারে। কারণ একই অর্থে ৫টি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে তিনটির সনদের দুর্বলতা সম্পূরণযোগ্য। ১ম হাদীসের ২য় সনদ, ৪র্থ হাদীস এবং ৫ম হাদীসের সনদে কোনো মিথ্যায় অভিযুক্ত বা পরিত্যক্ত রাবী নেই। কাজেই একাধিক সনদের কারণে তা ‘হাসান লি গাইরিহী’ বলে গণ্য হতে পারে। আল্লাহই ভাল জানেন।

[1] ইবনু হিববান, আল-মাজরূহীন ৪/৭৪; ইবনু আদী, আল-কামিল ৭/১৪; ইবনুল জাওযী, আদ-দু‘আফা ওয়াল মাতরূকীন ৩/৯৭, ১৬৪; আল-মাউদূ‘আত ২/১২৭-১২৮; যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ৬/৩২০, ৭/৩৯; তারতীবুল মাউদূ‘আত, পৃ. ১৮৫-১৮৬; ইবরাহীম ইবনু মুহাম্মাদ, সাবতু ইবনুল আজমী, আল-কাশফুল হাসীস পৃ. ২৪৬, ২৬৭; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ৫/৩৫৮, ৬/১৬৭, তালখীসুল হাবীর ২/২৬৭; আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৩২০; শাওকানী, নাইলুল আউতার ৫/১৭৯; আল-ফাওয়াইদ ১/১৫৪; দরবেশ হূত, আসনাল মাতালিব, পৃ. ২২৯; আলবানী, যায়ীফাহ ১/১১৯।

[2] ইরাকী, আল-মুগনী, এহইয়াউ উলূমিদ্দীন-সহ ১/৩০৬; সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ. ৪২৪; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/১৭২; তাহির পাটনী, তাযকিরা, পৃ. ৭৫; আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৩৬৬।

[3] ইবনু আব্দুল হাদী, আস-সারিম, পৃ. ২৩৪; আলবানী, ইরওয়াউল গালীল ৪/৩৪০।

[4] যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৬/৩৪৪; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ৫/৩৮৮।

[5] যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ২/১৫১; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ২/১৩১, ৩/১১৪।

[6] যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৩/৩২৮; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ৩/১১৪; মোল্লা কারী, আল-মাসনূ, পৃ. ১৯৬-১৯৭।

[7] সুবকী, আল-আহাদীস আল্লাতি লা আসলা লাহা ফী কিতাবিল ইহইয়া, পৃ. ৩০১; ইরাকী, আল-মুগনী, এহইয়াউ উলূমিদ্দীন-সহ ১/৩০৬; সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ. ৪২৪; তাহির পাটনী, তাযকিরা, পৃ. ৭৫; আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৩৬৬; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ১/১৫৩।

[8] ইবনু তাইমিয়া, মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ২৭/২৯-৩৬, ১১৪-২৮৮; কিতাবুর রাদ্দি ‘আলাল আখনাঈ, পৃ. ২৮-৮৬; ইবনু আব্দুল হাদী, আস-সারিম আল-মানকী, পৃ. ২৯-২৪৬; ইবনু হাজার, তালখীসুল হাবীর ২/২৬৬-২৬৭; সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ. ৪১০, ৪২৪; আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৩২৯, ৩৬৬; শাওকানী, নাইলুল আউতার ৫/১৭৮-১৭৯; আলবানী, ইরওয়াউল গালীল ৪/৩৩৫-৩৪১; যায়ীফাহ ১/১১৯-১২৪।
৬. বিবাহের আগে হজ্জ পালনের প্রয়োজনীয়তা

আমাদের দেশে ‘হজ্জ রাখতে পারবে কিনা’, ‘হজ্জের আগে ছেলেমেয়ে বিবাহ দিতে হবে’, ‘হজ্জের আগে পিতামাতার হজ্জ করাতে হবে’, বা ‘পিতামাতার অনুমতি লাগবে’... ইত্যাদি কিছু ভিত্তিহীন ধারণা ও কুসংস্কারের কারণে সাধারণত মুসলিমগণ বার্ধক্যের আগে হজ্জ করেন না, যদিও হজ্জ ফরয হওয়ার পরে দেরি করা মোটেও উচিত নয়। ইন্দোনেশিয়ায় বিষয়টি উল্টো। যৌবনের শুরুতে, বিবাহের পূর্বে হজ্জ আদায় না করলে মনে হয় হজ্জ হলো না। একটি জাল হাদীস এর কারণ। এই জাল হাদীসটিতে বলা হয়েছে:

مَنْ تَزَوَّجَ قَبْلَ أَنْ يَحُجَّ، فَقَدْ بَدَأَ بِالْمَعْصِيَةِ

‘‘যে ব্যক্তি হজ্জ পালনের আগে বিবাহ করল, সে পাপ দিয়ে শুরু করল।’’

মুহাদ্দিসগণ একমত যে, এ কথাটি জাল।[1]

[1] ইবনু আদী, আল-কামিল ১/৩৬৪; ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ‘আত ২/১২৪; যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ১/৪৫৮; তারতীবুল মাউদূ‘আত, পৃ. ১৮৫; সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/১২০; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/১৬৭; তাহির পাটনী, তাযকিরা, পৃ. ৭৩; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ১/১৩৮।
৭. হজ্জের কারণে বান্দার হক্ক ক্ষমা হওয়া

হজ্জ বিষয়ক প্রচলিত কিছু হাদীসে বলা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ () বিদায় হজ্জের সময় হাজীদের সকল পাপের মার্জনার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন। মহান আল্লাহ প্রথমে জানান যে বান্দার হক ছাড়া হাজীর সকল পাপ ক্ষমা করা হবে। বারংবার দোয়ার পর আল্লাহ জানান যে, হাজীর সকল পাপ, এমনকি বান্দার হক্ক বিষয়ক পাপও ক্ষমা করা হবে ...।

এ মর্মে একাধিক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। প্রত্যেকটি হাদীসের সনদই অত্যন্ত দুর্বল। প্রত্যেক সনদেই মিথ্যাবাদী অথবা অত্যন্ত দুর্বল রাবী অথবা অজ্ঞাতনামা ও অজ্ঞাত পরিচয় রাবী রয়েছে। কোনো কোনো মুহাদ্দিস একাধিক সনদের কারণে সেগুলোকে ‘দুর্বল’ হলেও সরাসরি ‘জাল’ নয় বলে মত প্রকাশ করেছেন। পক্ষান্তরে কোনো কোনো মুহাদ্দিস এ অর্থের সকল হাদীসই জাল ও ভিত্তিহীন বলে গণ্য করেছেন। কারণ প্রত্যেক সনদেই মিথ্যাবাদী বা পরিত্যক্ত রাবী রয়েছে। এছাড়া তা বিভিন্ন সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত সত্যের বিপরীত অর্থ প্রকাশ করে। বিভিন্ন সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, হক্কুল ইবাদ বা বান্দার অধিকার বা প্রাপ্য সংশ্লিষ্ট বান্দা ক্ষমা না করলে আল্লাহ ক্ষমা করেন না। এমনকি জিহাদ ও শাহাদতের দ্বারাও তার ক্ষমা হয় না।[1]

[1] ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ‘আত ২/১২৪-১২৭; যাহাবী, তারতীবুল মাউদূ‘আত, পৃ. ১৮৫; আল-মুনযিরী, আত-তারগীব ২/১২৯-১৩১; সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/১২০-১২৪; আন-নুকাতুল বাদী‘আত, পৃ. ১৩১-১৩৪; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/১৬৯-১৭০; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ১/১৩৯-১৪১।
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ৯ পর্যন্ত, সর্বমোট ৯ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে