লগইন করুন
১০ম হাদীস:
مَنْ حَجَّ وَلَمْ يَزُرْنِيْ فَقَدْ جَفَانِيْ ... مَنْ لَمْ يَزُرْنِيْ فَقَدْ جَفَانِيْ
‘‘যে ব্যক্তি হজ্জ করল, কিন্তু আমার যিয়ারত করল না, সে আমার সাথে আন্তরিকতাবিহীন আচরণ করল।’’ অন্য ভাষায়: ‘‘যে ব্যক্তি আমার যিয়ারত বা সাক্ষাত করল না সে আমার সাথে অসৌহার্দপূর্ণ আচরণ করল।’’
হাদীসটি কোনো হাদীস সংকলক কোনো হাদীস গ্রন্থে সংকলন করেন নি। দুর্বল ও মিথ্যাবাদী রাবীদের জীবনীগ্রন্থসমূহে কোনো কোনো মুহাদ্দিস হাদীসটি সংকলন করেছেন। তারা হাদীসটি একটি মাত্র সনদে সংকলিত করেছেন। তাঁরা উল্লেখ করেছেন যে, মুহাম্মাদ ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু আন-নু’মান নামক এক ব্যক্তি বলেন, আমাকে আমার দাদা আন-নু’মান ইবনু শিব্ল বলেছেন, মালিক ইবনু আনাস আমাকে বলেছেন, তিনি নাফি’ থেকে, তিনি আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রা) থেকে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন ....।’’
এ সনদের দুইজন রাবী অত্যন্ত দুর্বল ও মিথ্যা হাদীস বর্ণনায় অভিযুক্ত। প্রথম ইমাম মালিক থেকে বর্ণনাকারী আন-নু’মান ইবনু শিবল নামক এ ব্যক্তি অত্যন্ত দুর্বল রাবী ছিলেন। কোনো কোনো মুহাদ্দিস তাকে মিথ্যাবাদী বলে উল্লেখ করেছেন। দ্বিতীয় তার পৌত্র মুহাম্মাদ ইবনু মুহাম্মাদও মিথ্যাবাদী ও জালিয়াত হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন। ইমাম দারাকুতনী, ইবনু হিববান, ইবনুল জাওযী, সাগানী, যাহাবী, ইবনু হাজার, দরবেশ হূত, শাওকানী, আলবানী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস হাদীসটিকে জাল বলে উল্লেখ করেছেন। দারাকুতনী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস উল্লেখ করেছেন যে, এর জালিয়াতির জন্য দায়ী মুহাম্মাদ ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু আন-নু’মান, তার দাদা নুমান ইবনু শিবল নন।[1]
১১শ হাদীস:
مَا مِنْ أحَدٍ مِنْ أُمَّتِيْ لَهُ سَعَةٌ ثُمَّ لَمْ يَزُرْنِيْ إِلاَّ وَلَيْسَ لَهُ عُذْرٌ
‘‘আমার উম্মতের কোনো ব্যক্তির যদি সচ্ছলতা বা সুযোগ থাকে, তা সত্ত্বেও সে আমার সাথে সাক্ষাত বা যিয়ারত না করে, তাহলে তার কোনো ওযর থাকে না।’’
হাদীসটি ইবনু নাজ্জার তার ‘তারীখুল মাদীনা’ নামক গ্রন্থে সংকলিত করেছেন।[2] তার সনদটি নিম্নরূপ: ‘‘মহাম্মাদ ইবনু মুকাতিল থেকে, তিনি জা’ফর ইবনু হারূন থেকে, তিনি সাম‘আন ইবনু মাহদী থেকে, তিনি আনাস (রা) থেকে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন...।’’[3]
এ সনদটি মাউদূ সনদ হিসাবে প্রসিদ্ধ। মুহাম্মাদ ইবনু মুকাতিল রাযী (২৪৮হি) কিছুটা দুর্বল হলেও পরিত্যক্ত ছিলেন না।[4] এ সনদে তিনি যার কাছ থেকে হাদীসটি শুনেছেন, জা’ফর ইবনু হারূন নামক এ ব্যক্তি মিথ্যা হাদীস বর্ণনাকারী ও জাল হাদীস প্রচারকারী হিসাবে পরিচিত।[5] তার উস্তাদ হিসাবে উল্লিখিত ‘সাম‘আন ইবনু মাহদী’ সম্পর্কে যাহাবী ও ইবনু হাজার বলেছেন, এ লোকটি সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না বললে চলে। তার নামে আনাস ইবনু মালিক (রা) থেকে একটি বানোয়াট পান্ডুলিপি প্রচারিত। এতে প্রায় ৩০০ হাদীস আছে। মুহাম্মাদ ইবনু মুকাতিল রাযী, জা’ফর ইবনু হারূন আল-ওয়াসিতীর মাধ্যমে এই সাম‘আন থেকে সেই হাদীসগুলো বর্ণনা করেছেন। এই হাদীসগুলোর জালিয়াতকে আল্লাহ লাঞ্চিত করুন।[6]
বাহ্যত এ হাদীসটিও উপর্যুক্ত জাল পান্ডুলিপির অংশ। সর্বাবস্থায় হাদীসটির সনদে একাধিক মিথ্যাবাদী রাবী রয়েছে।
১২শ হাদীস:
مَنْ وَجَدَ سَعَةً وَلَمْ يَغْدُ إِلَيَّ فَقَدْ جَفَانِيْ
‘‘যে ব্যক্তি প্রশস্ততা বা সচ্ছলতা পেল, কিন্তু আমার কাছে আগমন করল না, সে আমার সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ বা বেয়াদবী করল।’’
হাদীসটি হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাযালী তার ‘এহইয়াউ উলূমিদ্দীন’ গ্রন্থে সনদ বিহীনভাবে উল্লেখ করেছেন। কোথাও কোনো গ্রন্থেই তা সনদ-সহ পাওয়া যায় না। আল্লামা সুবকী, ইরাকী, সাখাবী, আজলূনী, শাওকানী প্রমুখ মুহাদ্দিস নিশ্চিত করেছেন যে, এ বাক্যটি ভিত্তিহীন ও বানোয়াট।[7]
উপরের তিনটি হাদীস থেকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর সাথে -তাঁর জীবদ্দশায় বা ইন্তিকালের পরে- যিয়ারত বা সাক্ষাত না করার অপরাধ বুঝা যায়। তবে আমরা দেখেছি যে, ৩য় হাদীসটি একেবারেই ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কথা এবং প্রথম ও দ্বিতীয় হাদীসের সনদের একাধিক মিথ্যাবাদী রয়েছে।
উপরের আলোচনা থেকে আমরা দেখছি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বরকতময় কবর যিয়ারতের ফযীলত বিষয়ক সকল হাদীসই দুর্বল সনদে বর্ণিত হয়েছে। সম্ভবত এ কারণেই প্রসিদ্ধ ছয়টি গ্রন্থের লেখকগণ, অন্যান্য সহীহ গ্রন্থের সংকলকগণ, ইমাম মালিক, ইমাম আহমাদ প্রমুখ মুহাদ্দিস এ সকল হাদীস তাঁদের গ্রন্থসমূহে সংকলন করেন নি। এ সকল হাদীসের সনদগত দুর্বলতার কারণে কোনো কোনো মুহাদ্দিস ঢালাওভাবে এ সকল হাদীসকে জাল বা অত্যন্ত দুর্বল ও একেবারে অগ্রহণযোগ্য বলে মত প্রকাশ করেছেন। অপরদিকে কোনো কোনো মুহাদ্দিস এগুলোর সবগুলোকে একত্রিত ভাবে সহীহ বা হাসান বলে গ্রহণ করার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। ইবনু তাইমিয়া, ইবনুল জাওযী, ইবনু আব্দুল হাদী প্রমুখ মুহাদ্দিস রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পবিত্র কবর যিয়ারত বিষয়ক সকল হাদীসকেই জাল অথবা একেবারেই দুর্বল ও অগ্রহণযোগ্য বলে উল্লেখ করেছেন। পক্ষান্তরে আল্লামা আবূ আলী ইবনুস সাকান, আব্দুল হক ইশবিলী, সুবকী, সাখাবী, ইবনু হাজার মাক্কী প্রমুখ মুহাদ্দিস এ অর্থের হাদীসগুলোকে গ্রহণযোগ্য বলে গণ্য করেছেন।[8]
তবে উপরের আলোচনার মত অর্থগত পার্থক্য করে কেউ সনদগুলো আলোচনা করেছেন বলে জানতে পারি নি। একজন নগন্য তালিব ইলম হিসেবে আমার কাছে প্রতীয়মান হয়েছে যে, তৃতীয় অর্থে, অর্থাৎ যিয়ারত পরিত্যাগকারীর প্রতি অসন্তুষ্টি প্রকাশের অর্থে বর্ণিত সকল হাদীসই জাল ও ভিত্তিহীন। দ্বিতীয় অর্থে, অর্থাৎ ওফাতের পরে কবর যিয়ারতকারীকে জীবদ্দশায় যিয়ারতকারীর মর্যাদা প্রদান বিষয়ক হাদীসগুলো অত্যন্ত দুর্বল বা জাল।
প্রথম অর্থে, অর্থাৎ যিয়ারতকারীর জন্য শাফায়াতের সুসংবাদ প্রদানমূলক হাদীসগুলো ‘হাসান’ গণ্য হতে পারে। কারণ একই অর্থে ৫টি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে তিনটির সনদের দুর্বলতা সম্পূরণযোগ্য। ১ম হাদীসের ২য় সনদ, ৪র্থ হাদীস এবং ৫ম হাদীসের সনদে কোনো মিথ্যায় অভিযুক্ত বা পরিত্যক্ত রাবী নেই। কাজেই একাধিক সনদের কারণে তা ‘হাসান লি গাইরিহী’ বলে গণ্য হতে পারে। আল্লাহই ভাল জানেন।
[2] ইরাকী, আল-মুগনী, এহইয়াউ উলূমিদ্দীন-সহ ১/৩০৬; সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ. ৪২৪; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/১৭২; তাহির পাটনী, তাযকিরা, পৃ. ৭৫; আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৩৬৬।
[3] ইবনু আব্দুল হাদী, আস-সারিম, পৃ. ২৩৪; আলবানী, ইরওয়াউল গালীল ৪/৩৪০।
[4] যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৬/৩৪৪; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ৫/৩৮৮।
[5] যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ২/১৫১; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ২/১৩১, ৩/১১৪।
[6] যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৩/৩২৮; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ৩/১১৪; মোল্লা কারী, আল-মাসনূ, পৃ. ১৯৬-১৯৭।
[7] সুবকী, আল-আহাদীস আল্লাতি লা আসলা লাহা ফী কিতাবিল ইহইয়া, পৃ. ৩০১; ইরাকী, আল-মুগনী, এহইয়াউ উলূমিদ্দীন-সহ ১/৩০৬; সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ. ৪২৪; তাহির পাটনী, তাযকিরা, পৃ. ৭৫; আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৩৬৬; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ১/১৫৩।
[8] ইবনু তাইমিয়া, মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ২৭/২৯-৩৬, ১১৪-২৮৮; কিতাবুর রাদ্দি ‘আলাল আখনাঈ, পৃ. ২৮-৮৬; ইবনু আব্দুল হাদী, আস-সারিম আল-মানকী, পৃ. ২৯-২৪৬; ইবনু হাজার, তালখীসুল হাবীর ২/২৬৬-২৬৭; সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ. ৪১০, ৪২৪; আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৩২৯, ৩৬৬; শাওকানী, নাইলুল আউতার ৫/১৭৮-১৭৯; আলবানী, ইরওয়াউল গালীল ৪/৩৩৫-৩৪১; যায়ীফাহ ১/১১৯-১২৪।