লগইন করুন
১. মুমিনের জমিতে খারাজ ও উশর একত্রিত হয় না
একজন মুসলিমকে তার ভূসম্পদের উৎপাদনের ১০% বা ৫% অংশ যাকাত প্রদান করতে হয়। ফল ও ফসলের যাকাতকে ‘উশর’ বলা হয়। অমুসলিমদেকে ‘যাকাত’ দিতে হয় না। এজন্য মুসলিম রাষ্ট্রের অমুসলিম নাগরিককে তার ভূ-সম্পত্তির ‘খারাজ’ প্রদান করতে হয়। ‘খারাজ’ সাধারণত উশরের দ্বিগুণ হয়। কোনো অমুসলিমের জমি যদি কোনো মুসলিম ক্রয় করেন তাহলে তাকে খারাজ ও উশর উভয়ই প্রদান করতে হবে, নাকি শুধুমাত্র খারাজ প্রদান করতে হবে সে বিষয়ে তাবিয়ীগণের যুগ থেকে ফকীহগণের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। অধিকাংশ তাবিয়ী ও ইমাম বলেছেন, তাকে খারাজ ও উশর উভয়ই প্রদান করতে হবে। তাবিয়ী ইকরিমাহ, ইবরাহীম নাখয়ী ও ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) বলেছেন, তাকে শুধুমাত্র খারাজ প্রদান করতে হবে।[1]
এ বিষয়ে একটি হাদীস আলিমদের মধ্যে প্রচলিত। ৫ম হিজরী শতক ও তার পরের কিছু ফকীহ হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। এ হাদীসটিতে ইবনু মাসঊদ (রা) এর সূত্রে বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
لاَ يَجْتَمِعُ الْعُشْرُ وَالْخَرَاجُ فِيْ أَرْضِ رَجُلٍ مُسْلِمٍ
‘‘একজন মুসলিমের ভূমিতে উশর এবং খারাজ একত্রিত হবে না।’’[2]
কিন্তু ইমাম যাইলায়ী ও হানাফী মাযহাবের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিসগণ-সহ সকল মুহাদ্দিস বলেছেন যে, এ হাদীসটি বানোয়াট। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বা ইবনু মাস‘ঊদের (রা) কথা হিসাবে এ বাক্যটি বানোয়াট। প্রকৃতপক্ষে এ বাক্যটি তাবিয়ী ইবরাহীম নাখয়ীর (রাহ) কথা ও তাঁর মত। ইবরাহীম নাখয়ী ছাড়া আরো অন্যান্য তাবিয়ী থেকেও এ মতটি বর্ণিত হয়েছে।[3]
ইমাম আবু হানীফা (রাহ) এ কথাটি ইবরাহীম নাখয়ী থেকে তাঁর নিজের মত হিসাবে বর্ণনা করেছেন এবং তা গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন: আমাকে হাম্মাদ ইবনু আবী সুলাইমান বলেছেন, ইবরাহীম নাখয়ী বলেছেন: ‘‘একজন মুসলিমের ভূমিতে উশর এবং খারাজ একত্রিত হবে না।’’ এ পর্যন্ত কথাটি সহীহ। অর্থাৎ কথাটি ‘মাকতু‘য় হাদীস’ বা তাবিয়ীর কথা হিসাবে সহীহ।
কিন্তু পরবর্তী যুগের একজন রাবী ইয়াহইয়া ইবনু আনবাসাহ ইমাম আবু হানীফার নামে বানোয়াটভাবে এ কথাটিকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথা হিসাবে বর্ণনা করে। ইয়াহইয়া ইবনু আনবাসাহ বলেন: আবু হানীফা আমাদেরকে বলেছেন: হাম্মাদ ইবনু আবী সুলাইমান ইবরাহীম নাখয়ী থেকে, তিনি ‘আলকামাহ থেকে, তিনি আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: ‘‘একজন মুসলিমের ভূমিতে উশর এবং খারাজ একত্রিত হবে না।’’
এভাবে ইয়াহইয়া ইবনু আনবাসাহ একজন তাবিয়ীর বাণীকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বাণী বলে বর্ণনা করেছেন। মুহাদ্দিসগণ খুব সহজেই তাঁর এ জালিয়াতি বা ভুল ধরে ফেলেছেন।
তাঁরা লক্ষ্য করেন যে, ইমাম আবূ হানীফার (রাহ) অগণিত ছাত্রের কেউই এ হাদীসটি তাঁর কাছ থেকে বর্ণনা করেন নি। তাঁর অন্যতম ছাত্র ইমাম আবু ইউসূফ ও মুহাম্মাদ (রাহ) তাঁদের বিভিন্ন গ্রন্থে এ মাসআলাটির উপরে অনেক আলোচনা করেছেন, কিন্তু কোথাও উল্লেখ করেন নি যে, ইমাম আবু হানীফা তাঁদেরকে এ হাদীসটি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে বর্ণনা করেছেন অথবা তিনি এ বিষয়ে কোনো হাদীসে নাবাবীর উপর নির্ভর করেছেন।
এখানেই মুহাদ্দিসগণের সন্দেহের শুরু। যদি একজন হাদীস বর্ণনাকারী কোনো প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস বা ফকীহ থেকে এমন একটি হাদীস বর্ণনা করেন যা তাঁর অন্য কোনো ছাত্র, বিশেষত যারা আজীবন তাঁর সাথে থেকেছেন তাঁরা কেউ বর্ণনা না করেন, তাহলে তাঁরা হাদীসটির বিশুদ্ধতার বিষয়ে সন্দিহান হন। দ্বিতীয় পদক্ষেপ হিসাবে তাঁরা দেখেন, যে বর্ণনাকারী একাই এ হাদীসটি বলেছেন তাঁর বর্ণিত অন্যান্য হাদীসের ও তাঁর ব্যক্তিচরিত্রের কী অবস্থা।
এখানে তাঁরা দেখলেন যে, ইয়াহইয়া ইবনু ‘আনবাসাহ জীবনে যতগুলো হাদীস বর্ণনা করেছেন সবই ভুল বা বানোয়াট। তিনি বিভিন্ন প্রখ্যাত ও বিশ্বস্ত আলিম ও মুহাদ্দিসের নামে অনেক হাদীস বর্ণনা করেছেন যা অন্য কেউ করেন নি। তিনি অনেক মিথ্যা ও বানোয়াট হাদীস এভাবে বিভিন্ন বানোয়াট সনদে বর্ণনা করেছেন। তাঁর বর্ণিত সকল হাদীসকে অন্যান্য মুহাদ্দিসগণের বর্ণিত হাদীসের সাথে তুলানামূলক নিরীক্ষা করে এবং তাঁর ব্যক্তি জীবন পর্যালোচনা করে মুহাদ্দিসগণ নিশ্চিত হয়েছেন যে, এ হাদীসটিও তিনি ইমাম আবু হানীফার নামে বানিয়েছেন। এজন্যই ৩য় ও ৪র্থ হিজরী শতকের কোন হানাফী ইমাম বা ফকীহ এ হাদীসটিকে দলীল হিসাবে পেশ করেন নি।[4]
২. অলঙ্কারের যাকাত নেই
ব্যবহৃত অলঙ্কারের যাকাত প্রদান করতে হবে কি না সে বিষয়ে সাহাবীগণের যুগ থেকে মতভেদ রয়েছে। জাবির (রা) ও অন্য কয়েকজন সাহাবী বলতেন যে, অলঙ্কারের যাকাত প্রদান করতে হবে না। অপর দিকে অন্য অনেক সাহাবী বলতেন যে, অলঙ্কারের যাকাত প্রদান করতে হবে।[5]
এ ক্ষেত্রে যারা অলঙ্কারের যাকাত ফরয নয় বলে মত প্রকাশ করেন, তাদের পক্ষে একটি হাদীস বর্ণিত ও প্রচলিত। জাবির (রা)-এর নামে বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
لَيْسَ فِى الْحُلِىِّ زَكَاةٌ
‘‘অলঙ্কারের মধ্যে যাকাত নেই।’’
এটি রাসূলুল্লাহর (ﷺ) কথা নয়। একে হাদীসে নাবাবী হিসাবে বাতিল বলে ঘোষণা করেছেন বাইহাকী, ইবনু হাজার, আলবানী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস। এ বাক্যটি মূলত জাবির (রা.)- এর নিজের কথা।। একজন অত্যন্ত দুর্বল বর্ণনাকারী ভুলবশত একে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথা বলে বর্ণনা করেছেন।[6]
[2] ইবনু আদী, আল-কামিল ৯/১২৭, বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ৪/২২২।
[3] বিস্তারিত দেখন, ‘বাংলাদেশে উশর বা ফসলের যাকাত: গুরুত্ব ও প্রয়োগ, পৃ. ৮৬-৮৭।
[4] ইবনু আদী, কামিল ৯/১২৭, ইবনু হিববান, আল-মাজরুহীন ৩/১২৪, বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ৪/২২২, ড: খালদূন আ‘হদাব, যাওয়াইদু তারীখি বাগদাদ ৯/৪১৯-৪২২, ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ‘আত ২/৬৯-৭০, যাইলায়ী, নাসবুর রাইয়াহ ৩/৪৪২, সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/৭০, ইবনু আর্রাক, তানযীাহ ২/১২৮, শাওকানী, আল-ফাওয়াইদু ১/৮৭-৮৮।
[5] বিস্তারিত দেখুন, বাংলাদেশে উশর বা ফসলের যাকাত: গুরুত্ব ও প্রয়োগ, পৃ. ৩১-৩২।
[6] ইবনু হাজার, আদ দিরাইয়াতু ১/২৬০, আলবানী, ইরওয়াউল গালীল ৩/২৯৪-২৯৬।