ইতিপূর্বে আলোচিত হয়েছে যে, তাওহীদ তিন প্রকার:
(১) তাওহীদুর রুবুবীয়া,
(২) তাওহীদুল উলুহীয়া এবং
(৩) তাওহীদুল আসমা ওয়াছ ছিফাত।
উপরোক্ত তিন প্রকার তাওহীদের মধ্য থেকে প্রথম দুই প্রকারের আলোচনা আমরা ইতিপূর্বে করেছি। তাওহীদুর রুবুবীয়া ও তাওহীদুল উলুহীয়া সম্পর্কে ইতিপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। এ দুই প্রকার তাওহীদের প্রত্যেক প্রকারকেই বনী আদমের কোনো কোনো সম্প্রদায় অস্বীকার করেছে।
নাস্তিকরা তাওহীদুর রুবুবীয়াকে অস্বীকার করেছে। মূলত তারা আল্লাহ তা‘আলার অস্তিত্বকেই অস্বীকার করেছে। যেমন বস্তুবাদী ও ধর্মত্যাগীরা স্রষ্টার অস্তিত্বকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করেছে। আমাদের বর্তমান সময়ে সাম্যবাদীরাও তাদের অন্তর্ভুক্ত। যদিও তারা কেবল বাহ্যিকভাবেই অহংকার বশত অস্বীকার করেছে। অন্যথায় তারা গোপনে এবং মনের গহীনে স্রষ্টার অস্তিত্বকে স্বীকার করে থাকে। কেননা স্রষ্টা ব্যতীত সৃষ্টির অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকা অকল্পনীয়।
তাওহীদের দ্বিতীয় প্রকার হলো তাওহীদুল উলুহীয়া। অধিকাংশ সৃষ্টিই এটিকে অস্বীকার করেছে। এ প্রকার তাওহীদের দাওয়াত দেয়ার জন্য আল্লাহ তা‘আলা নবী-রসূলদেরকে পাঠিয়েছেন। প্রাচীন ও বর্তমানকালের মুশরিকরা এই প্রকার তাওহীদকে অস্বীকার করেছে। গাছ, পাথর, মূর্তি, কবর, সমাধি এবং সুফী শাইখদের ইবাদতের মাধ্যমে তাদের তাওহীদুল উলুহীয়া অস্বীকারের বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়েছে। এক শ্রেণীর নামধারী মিথ্যুক মুসলিম বিশ্বাস করে যে, সুফীদের শাইখরা আল্লাহর পরিবর্তে মানুষের উপকার করার ক্ষমতা রাখে।
তৃতীয় প্রকার তাওহীদ হচ্ছে তাওহীদুল আসমা ওয়াছ ছিফাত। আল্লাহ তা‘আলা তার নিজের সত্তার জন্য অথবা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার রবের জন্য পূর্ণতার যেসব গুণাবলী সাব্যস্ত করেছেন, তা সাব্যস্ত করা এবং আল্লাহ তা‘আলা তার নিজের সত্তা থেকে অথবা তার রসূল তার থেকে অপূর্ণতার যেসব দোষ-ত্রুটি নাকোচ করেছেন, তা নাকোচ করাকে তাওহীদুল আসমা ওয়াছ ছিফাত বলা হয়। পূর্ণতার ছিফাতগুলো সাব্যস্ত এবং অপূর্ণতার ছিফাতগুলো নাকোচ করার ক্ষেত্রে তাদের মূলনীতি হলো, যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ﴾
‘‘তার সদৃশ কোনো কিছুই নেই। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’’।[1] (সূরা শুরা: ১১)
জাহমীয়া সম্প্রদায় এবং তাদের অনুসরণকারী মু‘তাযিলা ও আশায়েরাগণ এ প্রকার তাওহীদ অস্বীকার করেছে। তাওহীদুল আসমা ওয়াছ ছিফাত তাওহীদুর রুবুবীয়াতেরই অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু এর অস্বীকার কারীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়া এবং এ সম্পর্কে প্রচুর সন্দেহ ছড়ানোর কারণে স্বতন্ত্র একটি প্রকার সিসাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। এ সম্পর্কে অনেক কিতাবও লেখা হয়েছে।
ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রাহিমাহুল্লাহ তার প্রসিদ্ধ একটি কিতাবে জাহমীয়াদের প্রতিবাদ করেছেন। তার ছেলে আব্দুল্লাহ ইবনে আহমাদ আস্ সুন্নাহ’ নামে একটি কিতাব রচনা করেছেন, আব্দুল আযীয আলকিনানী লিখেছেন, الحيدة في الرد على بشر المريسي নামে একটি কিতাব, আবু আব্দুল্লাহ আলমিরওয়াযী লিখেছেন, السنة নামে একটি কিতাব, উছমান ইবনে সাঈদ আদ্দারামী লিখেছেন, الرد على بشر المريسي নামে একটি কিতাব এবং এ ব্যাপারে সকল ইমামের সরদার মুহাম্মাদ ইবনে খুযায়মা লিখেছেন التوحيد নামে একটি কিতাব। উপরোক্ত ইমামগণ ছাড়াও শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া এবং তার সুযোগ্য ছাত্র ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহ জাহমীয়াদের প্রতিবাদে কিতাব রচনা করেছেন। এসব ইমাম এবং তাদের পরবর্তীতে আগমনকারী ইমামগণ পূর্ববর্তী ইমামগণের পথ অবলম্বন করেছেন। সত্য সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হওয়া এবং বাতিল পরাভূত হওয়ার জন্য আল্লাহর প্রশংসা করছি।
কতিপয় আরব মুশরিকদের থেকে সর্বপ্রথম আল্লাহর ছিফাত অস্বীকার করার বিষয়টি জানা যায়। তাদের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াতটি নাযিল করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿كَذَلِكَ أَرْسَلْنَاكَ فِي أُمَّةٍ قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِهَا أُمَمٌ لِتَتْلُوَ عَلَيْهِمُ الَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَهُمْ يَكْفُرُونَ بِالرَّحْمَنِ قُلْ هُوَ رَبِّي لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ وَإِلَيْهِ مَتَابِ﴾
‘‘এভাবে আমি তোমাকে পাঠিয়েছি এমন এক জাতির প্রতি, যার পূর্বে বহু জাতি গত হয়েছে। যাতে আমি তোমার প্রতি যা প্রত্যাদেশ করেছি, তাদের নিকট তা পাঠ করতে পারো। তারা রাহমানকে তথা পরম দয়াময়কে অস্বীকার করে। বলোঃ তিনিই আমার প্রতিপালক। তিনি ব্যতীত অন্য কোনো সত্য উপাস্য নেই। আমি তার উপরই ভরসা করেছি এবং তার দিকেই আমার প্রত্যাবর্তন’’। (সূরা আর রা’দ: ৩০)
এ আয়াতটি নাযিল হওয়ার কারণ হলো কুরাইশরা যখন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহ তা‘আলার الرحمن নাম উচ্চারণ করতে শুনলো, তখন তারা সেটাকে অস্বীকার করলো। তাদের জবাবে আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত নাযিল করেছেন,
﴿وَهُمْ يَكْفُرُونَ بِالرَّحْمَنِ﴾
‘‘এবং তারা রহমানকে অস্বীকার করে’’ (সূরা আর রা‘দ ১৩:৩০)।
ইমাম ইবনে জারীর উল্লেখ করেছেন যে, এটি ছিল হুদায়বিয়ার ঘটনা। হুদায়বিয়ার সন্ধির লেখক যখন بسم الله الرحمن الرحيم লিখলেন, তখন কুরাইশরা বললো, আমরা রাহমানকে চিনি না’’।
ইমাম ইবনে জারীর আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে আরো বর্ণনা করেছেন যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সিজদায় يا رحمن এবং يا رحيم বলে দু‘আ করতেন। মুশরিকরা এতে বলতে লাগলো, মুহাম্মাদ বলে যে, সে মাত্র এক মাবুদকে ডাকে। অথচ দেখছি সে দুই মাবুদকেই ডাকে। তখন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿قُلْ ادْعُوا اللَّهَ أَوْ ادْعُوا الرَّحْمنَ أَيًّا مَا تَدْعُوا فَلَهُ الأَسْمَاءُ الْحُسْنَى﴾
‘‘বলো, তোমরা আল্লাহ্কে ‘আল্লাহ’ নামে আহবান করো কিংবা ‘রাহমান’ নামে আহবান করো, তোমরা যে নামেই আহবান করো না কেন, তার রয়েছে অনেক অতি সুন্দর নাম’’। (সূরা বানী ইসরাঈল: ১১০) আল্লাহ তা‘আলা সূরা ফুরকানে বলেন,
﴿وَإِذَا قِيلَ لَهُمُ اسْجُدُوا لِلرَّحْمَنِ قَالُوا وَمَا الرَّحْمَنُ﴾
‘‘তোমরা যখন রাহমান বা পরম দয়াময়ের নামে সিজদাবনত হও, তখন ওরা বলে, রাহমান আবার কে?। (সূরা আল ফুরকান: ৬০)
সুতরাং আল্লাহ তা‘আলার অতি সুন্দর নাম ও সুমহান গুণাবলী অস্বীকার করার ক্ষেত্রে মুশরেকরাই জাহমীয়া এবং আশায়েরাদের উস্তাদ। নিকৃষ্ট ছাত্রদের নিকৃষ্ট উস্তাদ।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿أَفَتَتَّخِذُونَهُ وَذُرِّيَّتَهُ أَوْلِيَاءَ مِنْ دُونِي وَهُمْ لَكُمْ عَدُوٌّ بِئْسَ لِلظَّالِمِينَ بَدَلًا﴾
‘‘তবে কি তোমরা আমার পরিবর্তে তাকে ও তার বংশধরকে অভিভাবক রূপে গ্রহণ করবে? অথচ তারা তোমাদের শত্রু? বড়ই খারাপ বিনিময় যালেমরা গ্রহণ করছে! (সূরা কাহাফ: ৫০)
আর নবী-রসূলগণ এবং তাদের অনুসারীগণ বিশেষ করে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তার সম্মানিত সাহাবীগণ ও উত্তমভাবে তাদের অনুসারীগণ আল্লাহ তা‘আলাকে ঐসব গুণে গুণান্বিত করেছেন, যা দিয়ে স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা নিজেকে গুণান্বিত করেছেন এবং তার থেকে ঐসব দোষ-ত্রুটি নাকোচ করেছেন, যা স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা নিজের সত্তা থেকে নাকোচ করেছেন। সেই সঙ্গে যারা এ মানহাজের বিরোধিতা করে তারা তাদেরও প্রতিবাদ করেছেন।
আব্দুর রাজ্জাক মা’মার থেকে, মা’মার তাউস থেকে, তাউস তার পিতা থেকে, তার পিতা আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহ আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি দেখলেন একজন লোক আল্লাহর ছিফাত সংক্রান্ত একটি হাদীছ শুনে কেঁপে উঠছে। সে এটিকে অপছন্দ করেই কেঁপে উঠছিল। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তখন বললেন, এরা আল্লাহ তা‘আলাকে কেমন ভয় করে? কুরআনের সুস্পষ্ট আয়াত শুনে নরম হয়। আর যখন কোনো অস্পষ্ট আয়াত শুনে তখন ধ্বংস হয় এবং তা অস্বীকার করে?’’
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর মজলিসে যেসব সাধারণ লোক উপস্থিত হতো, এখানে তিনি তাদের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। তারা যখন আল্লাহর ছিফাত সংক্রান্ত কোনো মুহকাম আয়াত শুনতো তখন তারা ভয় করতো এবং তারা আল্লাহর ছিফাতসমূহকে অস্বীকারকারীদের মতো কেঁপে উঠতো। তারা ঐসব লোকদের মতো যাদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فَأَمَّا الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ زَيْغٌ فَيَتَّبِعُونَ مَا تَشَابَهَ مِنْهُ ابْتِغَاءَ الْفِتْنَةِ وَابْتِغَاءَ تَأْوِيلِهِ وَمَا يَعْلَمُ تَأْوِيلَهُ إِلَّا اللَّهُ وَالرَّاسِخُونَ فِي الْعِلْمِ يَقُولُونَ آمَنَّا بِهِ كُلٌّ مِّنْ عِندِ رَبِّنَا وَمَا يَذَّكَّرُ إِلَّا أُولُو الْأَلْبَابِ﴾
‘‘যাদের মনে বক্রতা আছে তারা ফিতনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সবসময় মুতাশাবিহার পিছনে লেগে থাকে এবং তার অর্থ করার চেষ্টা করে। অথচ সেগুলোর আসল অর্থ আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ জানে না। অপর পক্ষে পরিপক্ক জ্ঞানের অধিকারীরা বলেঃ আমরা এর প্রতি ঈমান এনেছি, এসব আমাদের রবের পক্ষ থেকেই এসেছে। আর প্রকৃতপক্ষে জ্ঞানবান লোকেরাই শিক্ষা গ্রহণ করে’’। (সূরা আলে-ইমরান: ৭)
সুতরাং বাঁকা অন্তর বিশিষ্ট লোকেরা মুহকাম আয়াতগুলো বাদ দিয়ে মুতাশাবিহাতের পিছনে লেগে থাকে এবং তারা কিতাবের কিছু অংশে বিশ্বাস করে এবং অপর অংশ অস্বীকার করে।
আর আল্লাহর ছিফাত সংক্রান্ত আয়াতগুলো মুহকামাতের অন্তর্ভুক্ত, মুতাশাবিহাতের অন্তর্ভুক্ত নয়। উম্মতের প্রথম সারির আনসার ও মুহাজির মুসলিমগণ, উত্তমভাবে তাদের অনুসরণকারী তাবেঈগণ এবং তাদের পরবর্তীকালের মুজতাহিদ ইমামগণ তা পড়েছেন এবং তার অর্থ বুঝেছেন। তারা এগুলোর প্রতিবাদ করেননি। বর্তমানেও উম্মতের বিজ্ঞ আলেমগণ তা পড়ছেন, অনুধাবন করছেন এবং তা অন্যদেরকে পড়াচ্ছেন। এগুলো বুঝতে তাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।
সুপ্রসিদ্ধ ইমাম অকী বলেন, আমরা আ’মাশ এবং সুফিয়ান রাহিমাহুল্লাহকে পেয়েছি যে, তারা আল্লাহ তা‘আলার ছিফাত সংক্রান্ত হাদীছগুলো বর্ণনা করতেন। তারা এগুলো বর্ণনা করাকে অপছন্দ করতেন না কিংবা এগুলোর প্রতিবাদ করতেন না।
বিদআতী মু‘তাযিলা, জাহমীয়া এবং আশায়েরা সম্প্রদায়ের লোকেরাই কেবল ছিফাত সংক্রান্ত হাদীছগুলো অস্বীকার করে। এ ক্ষেত্রে তারা কুরাইশদের ঐসব মুশরিকদের পথ অনুসরণ করেছে, যারা আল্লাহ তা‘আলার রাহমান নামকে অস্বীকার করেছিল এবং আল্লাহ তা‘আলার নামের বিকৃতি ঘটিয়েছিল।
আল্লাহ তা‘আলা সূরা আরাফের ১৮০ নং আয়াতে বলেন,
﴿وَلِلَّهِ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَىٰ فَادْعُوهُ بِهَا وَذَرُوا الَّذِينَ يُلْحِدُونَ فِي أَسْمَائِهِ سَيُجْزَوْنَ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ﴾
‘‘আল্লাহ তা‘আলার অনেকগুলো অতি সুন্দর নাম রয়েছে। সুতরাং তাকে সে নামেই ডাকো এবং তার নামসমূহের মধ্যে যারা বিকৃতি করে, তোমরা তাদেরকে বর্জন করো। তারা যা করে আসছে, তার ফল তারা অবশ্যই পাবে’’।[2]
আল্লাহ তা‘আলা এখানে নিজের জন্য অতি সুন্দর নাম সাব্যস্ত করেছেন এবং সেটার মাধ্যমে তাকে ডাকার আদেশ দিয়েছেন। এদের ধারণা মোতাবেক আল্লাহ তা‘আলার যদি নামই না থাকে এবং নামগুলোর অর্থ বোধগম্য না হয় তাহলে তাকে কিভাবে ডাকা হবে? আল্লাহ তা‘আলার নামের মধ্যে যারা বিকৃতি করে এবং তার নামগুলোকে নাকোচ করে অথবা সেটার সঠিক অর্থ বাদ দিয়ে এভাবে ব্যাখ্যা করে যে, শাস্তি ও আযাবের মাধ্যমে তিনি তাদের আমলের বদলা দিবেন। আল্লাহ তা‘আলার বাণী
﴿وَهُمْ يَكْفُرُونَ بِالرَّحْمَنِ﴾
‘‘এবং তারা রহমানকে অস্বীকার করে’’ (সূরা আর রা‘দ ১৩:৩০)।
এর মধ্যে আল্লাহ তা‘আলা মক্কার কুরাইশদেরকে কাফের বলে আখ্যায়িত করেছেন। কারণ তারা আল্লাহ তা‘আলার রাহমান নামকে অস্বীকার করেছিল। এ জন্যই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অনেক আলেম জাহমীয়াদেরকে কাফের বলেছেন।
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহ বলেন,
ولقد تقلد كفرهم خمسون في ... عشر من العلماء في البلدان
واللالكائي الإمام حكاه عنهم ... بل قد حكاه قبله الطبراني
বিভিন্ন দেশের পাঁচশত আলেম জাহমীয়াদেরকে কাফের বলেছেন এবং তাদের কাফের হওয়ার বিষয়টি সুস্পষ্ট করে উল্লেখ করেছেন। ইমাম লালাকায়ী আলেমদের থেকে তাদের কাফের হওয়ার ফতোয়া উল্লেখ করেছেন এবং তার পূর্বে ইমাম তাবারানীও উল্লেখ করেছেন।[3]
[1]. আল্লাহ তা‘আলা বলেন,لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ ‘‘তার সদৃশ কোনো কিছুই নেই। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’’। (সূরা শুরা: ১১) এখানে নাকোচ করা হয়েছে এবং সাব্যস্ত করা হয়েছে। সৃষ্টির মধ্য থেকে কোনো কিছু আল্লাহর সদৃশ হওয়ার ধারণা নাকোচ করা হয়েছে এবং তাঁর জন্য শ্রবণ ও দৃষ্টি সাব্যস্ত করা হয়েছে। আলেমগণ বলেন, আরবদের সুপ্রসিদ্ধ একটি প্রবাদ বাক্য ও মূলনীতি অনুসারে এখানে নফীকে ইছবাতের উপর প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ প্রথমে আল্লাহ তা‘আলা থেকে অপূর্ণতার বিশেষণ ও দোষত্রুটি নাকোচ করা হয়েছে অতঃপর তাঁর জন্য পূর্ণতার গুণাবলী সাব্যস্ত করা হয়েছে। আরবরা বলে থাকে, التخلية تسبق التحلية‘‘সাজসজ্জার পূর্বে পরিস্কার করা আবশ্যক’’। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলাকে পূর্ণতার বিশেষণের মাধ্যমে বিশেষিত করার আগে অন্তর থেকে স্রষ্টাকে সৃষ্টির সাথে তুলনা করা কিংবা সৃষ্টির সাথে স্রষ্টাকে তুলনা করার দোষ-ত্রুটি থেকে খালি করা আবশ্যক। অন্তর যখন তাশবীহ ও তামছীলের দোষ থেকে খালি হবে, তখনই আল্লাহ তা‘আলার জন্য শোভনীয় পদ্ধতিতে পূর্ণতার গুণাবলী সাব্যস্ত করা হবে। উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলার জন্য দু’টি ছিফাত সাব্যস্ত করা হয়েছে। একটি শ্রবণ এবং অন্যটি দৃষ্টি।
আলেমগণ আরো বলেন, আল্লাহ তা‘আলার ছিফাত সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে উক্ত আয়াতে অন্যান্য ছিফাত বাদ দিয়ে শ্রবণ ও দৃষ্টিকে একসাথে উল্লেখ করার কারণ হলো, শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রাণবিশিষ্ট অধিকাংশ সৃষ্টির মধ্যেই রয়েছে। যেসব সৃষ্টির মধ্যে বৃদ্ধি প্রাপ্ত হওয়ার শক্তি থাকার সাথে সাথে প্রাণ বা রূহ আছে, তাদের সবগুলোর মধ্যেই শ্রবণ ও দৃষ্টি শক্তি রয়েছে। মানুষের রয়েছে শ্রবণ ও দৃষ্টি এবং সমস্ত প্রাণীর রয়েছে শ্রবণ ও দৃষ্টি। মাছির রয়েছে তার জন্য শোভনীয় শ্রবণ ও দৃষ্টি। উটের রয়েছে শোভনীয় শ্রবণ ও দৃষ্টি। এমনি সমস্ত পাখি, মাছ, ভূপৃষ্ঠে বিচরণকারী অন্যান্য জীব-জন্তু এবং কীটপতঙ্গের রয়েছে শোভনীয় শ্রবণ ও দৃষ্টি।
আর জ্ঞানীদের কাছে সুস্পষ্ট যে, সমস্ত প্রাণীর শ্রবণ ও দৃষ্টি একরকম নয়। মানুষের শ্রবণ-দৃষ্টি প্রানীর শ্রবণ-দৃষ্টির অনুরূপ নয়। মানুষের শ্রবণ-দৃষ্টি সমস্ত প্রাণীর শ্রবণ-দৃষ্টির চেয়ে পূর্ণতম। তবে মানুষ এবং অন্যান্য সকল প্রাণীর জন্য শ্রবণ ও দৃষ্টি বিশেষণের মূল অংশ যৌথভাবে সাব্যস্ত। তবে প্রত্যেক প্রাণীর জন্য যতটুকু শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রয়োজন তার মধ্যে শোভনীয় পদ্ধতিতে কেবল ততটুকুই স্থাপন করা হয়েছে। সুতরাং প্রাণী ও জীব-জন্তুর মধ্যে শ্রবণ ও দৃষ্টি আছে। মানুষের মধ্যেও শ্রবণ-দৃষ্টি আছে। মানুষের মধ্যে শ্রবণ ও দৃষ্টি আছে বলেই তা প্রাণী ও জীব-জন্তুর শ্রবণের মতো নয়।
সুতরাং মহান মালিক, চিরঞ্জীব সত্তা ও সবকিছুর ধারক আল্লাহ তা‘আলার জন্য শ্রবণ ও দৃষ্টি বিশেষণ সাব্যস্ত করলে তা সৃষ্টির গুণের সাদৃশ্য হয়ে যায় কিভাবে!! আসল কথা হলো মহান স্রষ্টার রয়েছে এমন শ্রবণ ও দৃষ্টি, যা তাঁর বড়ত্ব ও মর্যাদার জন্য শোভনীয়। যেমন রয়েছে নগণ্য মাখলুকের জন্য প্রয়োজনীয় ও শোভনীয় শ্রবণ ও দৃষ্টি। আল্লাহ তা‘আলার শ্রবণ ও দৃষ্টি বিশেষণ সকল দিক মূল্যায়নে পূর্ণতম এবং সকল দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত। কিন্তু কোনো মাখলুকের শ্রবণ ও দৃষ্টি সকল দিক মূল্যায়নে পূর্ণতম নয় এবং তা দোষ-ত্রুটি থেকে একেবারে মুক্তও নয়। আল্লাহ তা‘আলার বাকীসব সিফাতের ক্ষেত্রেও একই কথা। যদিও সকল সিফাতের মূল অংশ আল্লাহ তা‘আলা এবং বান্দার জন্য যৌথভাবে সাব্যস্ত। পার্থক্য হবে শুধু পরিমাণ ও পদ্ধতির ক্ষেত্রে। অর্থাৎ নগণ্য মাখলুকের ছিফাত নগণ্য এবং সেটার অনেক সিফাতের ধরণ আমাদের জানা আছে। আর মহান ও অসীম স্রষ্টার সিফাতের পরিমাণ তাঁর মতোই অসীম এবং তার পদ্ধতিও আমাদের জানা নেই।
সুতরাং মুমিন বান্দাদের উপর আবশ্যক হলো আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নিজের সত্তার জন্য পূর্ণতার যেসব গুণাবলী সাব্যস্ত করেছেন কুরআন-সুন্নাহর মূলনীতি ও সালাফে সালেহীনদের মানহাজ অনুযায়ী তা তাঁর পবিত্র সত্তার জন্য সাব্যস্ত করা এবং তিনি তাঁর নিজের সত্তা থেকে যেসব অপূর্ণতা ও দোষ-ত্রুটি নাকোচ করেছেন, তা নাকোচ করা। সেই সঙ্গে আরো বিশ্বাস করা আবশ্যক যে, স্রষ্টার জন্য পূর্ণতার বিশেষণ সাব্যস্ত করলে তা সৃষ্টির সিফাতের মত হয়ে যায় না।
[2]. إلحاد (ইলহাদ) শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে বাঁকা হওয়া, একদিকে ঝুকে পড়া, কোন জিনিস থেকে সরে আসা, ইত্যাদি। এখান থেকেই কবরকে লাহাদ বলা হয়। কবরকে লাহাদ বলার কারণ হলো, সেটাকে খনন করার সময় গর্ত খননের সাধারণ রীতি ও পদ্ধতির ব্যতিক্রম করে কিবলার দিকে বাঁকা করে দেয়া হয়।
আর আল্লাহর অতি সুন্দর নাম, তাঁর সুউচ্চ গুণাবলী এবং আয়াতসমূহের মধ্যে ইলহাদ হচ্ছে সেটার প্রকৃত ও সঠিক অর্থ বাদ দিয়ে বাতিল অর্থের দিকে নিয়ে যাওয়া। আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর মধ্যে ইলহাদ কয়েক প্রকার।
(১) আল্লাহর নামে দেবতার নাম রাখা: আল্লাহর অন্যতম নাম الإله থেকে মুশরেকরা তাদের এক দেবতার নাম রেখেছে اللات (লাত), আল্লাহর নাম العزيز থেকে তারা তাদের আরেক মূর্তির নাম রেখেছে العزى (উয্যা) এবং আল্লাহর নাম المنان থেকে তারা তাদের আরেক বাতিল মাবুদের নাম রেখেছে مناة (মানাত)।
(২) আল্লাহর এমন নাম রাখা, যা তার মর্যাদা ও বড়ত্বের শানে শোভনীয় নয়: যেমন খ্রিষ্টানরা আল্লাহকে أب (FATHER বা পিতা) বলে। দার্শনিকরা আল্লাহকে موجب (আসল সংঘটক) কিংবা علة فاعلة (সক্রিয় কারণ) বলে থাকে।
(৩) আল্লাহকে এমন ত্রুটিযুক্ত বিশেষণে বিশেষিত করা, যা থেকে তিনি নিজেকে পবিত্র রেখেছেন: যেমন অভিশপ্ত ইয়াহূদীরা বলে থাকে ﴿إِنَّ اللَّهَ فَقِيرٌ وَنَحْنُ أَغْنِيَاءُ﴾ ‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ গরীব আর আমরা ধনী’’। তারা আরো বলে,
﴿يَدُ اللَّهِ مَغْلُولَةٌ غُلَّتْ أَيْدِيهِمْ وَلُعِنُوا بِمَا قَالُوا ۘ بَلْ يَدَاهُ مَبْسُوطَتَانِ يُنفِقُ كَيْفَ يَشَاءُ﴾
‘‘আল্লাহর হাত বাঁধা। আসলে বাঁধা হয়েছে ওদেরই হাত এবং তারা যে কথা বলছে সে জন্য তাদের উপর অভিশাপ বর্ষিত হয়েছে। আল্লাহর দুই হাত সদা প্রসারিত। যেভাবে চান তিনি খরচ করেন’’। (সূরা মায়িদা: ৬৪)
তারা আরো বলে থাকে আল্লাহ তা‘আলা ছয়দিনে আসমান-যমীন এবং সেটার মধ্যকার সকল বস্তু সৃষ্টি করার পর শনিবারে বিশ্রাম নিয়েছেন। মূলতঃ আল্লাহ তাদের কথার অনেক উর্ধ্বে।
(৪) আল্লাহ তা‘আলার অতি সুন্দর নাম ও সুউচ্চ ছিফাতগুলোর অর্থ ও হাকীকত অস্বীকার করা: যেমন জাহমীয়ারা বলে আল্লাহর নামগুলো শুধু শব্দের মধ্যেই সীমিত। এগুলো কোনো গুণ বা অর্থকে নিজের মধ্যে শামিল করে না। তারা বলে আল্লাহর অন্যতম নাম হচ্ছে, السميع (সর্বশ্রোতা), কিন্তু এই নামটি প্রমাণ করে না যে, তিনি শুনেন কিংবা এটি প্রমাণ করে না যে, শ্রবণ করা তাঁর অন্যতম একটি বৈশিষ্ট। আল্লাহর অন্যতম নাম হচ্ছে البصير (সর্বদ্রষ্টা), কিন্তু এই নামটি প্রমাণ করে না যে, তিনি দেখেন কিংবা দেখা তাঁর গুণ এবং আল্লাহ তা‘আলার আরেকটি নাম হচ্ছে الحي (চিরজীবন্ত), কিন্তু ইহা প্রমাণ করে না যে, তাঁর হায়াত বা জীবন আছে। আল্লাহর অন্যান্য নাম ও সিফাতের ক্ষেত্রেও তারা একই রকম কথা বলে থাকে।[2]
(৫) আল্লাহর ছিফাতসমূহকে মাখলুকের সিফাতের সাথে তুলনা করা: যেমন মুশাবেবহা (আল্লাহর ছিফাতকে সৃষ্টির সিফাতের সাথে তুলনাকারী) সম্প্রদায়ের লোকেরা করে থাকে। তারা বলে থাকে, আল্লাহর হাত আমার দুই হাতের মতোই। অন্যান্য সিফাতের বেলাতেও তারা একই রকম কথা বলে। আল্লাহ তাদের এই ধরণের কথার অনেক উর্ধ্বে।
যারা আল্লাহর অতি সুন্দর নাম ও আয়াতের মধ্যে ইলহাদ করে, তাদেরকে তিনি কঠোর আযাবের ধমক দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা সূরা আরাফের ১৮০ নং আয়াতে বলেন,
﴿وَلِلَّهِ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَىٰ فَادْعُوهُ بِهَا وَذَرُوا الَّذِينَ يُلْحِدُونَ فِي أَسْمَائِهِ ۚسَيُجْزَوْنَ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ﴾
‘‘আল্লাহ তা‘আলার অনেকগুলো সুন্দরতম নাম রয়েছে। সুতরাং তাঁকে সেই নামেই ডাকো এবং তাঁর নামসমূহের মধ্যে যারা বিকৃতি করে, তোমরা তাদেরকে বর্জন করো৷ তারা যা করে আসছে, তার ফল অবশ্যই তারা পাবে’’। আল্লাহ তা‘আলা সূরা ফুস্সিলাতের ৪০ নং আয়াতে আরো বলেন,
﴿إِنَّ الَّذِينَ يُلْحِدُونَ فِي آيَاتِنَا لَا يَخْفَوْنَ عَلَيْنَا أَفَمَن يُلْقَىٰ فِي النَّارِ خَيْرٌ أَم مَّن يَأْتِي آمِنًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ ۚ اعْمَلُوا مَا شِئْتُمْ إِنَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ﴾
‘‘যারা আমার আয়াতসমূহের বিকৃতি (উল্টা অর্থ) করে, তারা আমার অগোচরে নয়৷ যাকে আগুনে নিক্ষেপ করা হবে সে উত্তম? না যে কিয়ামতের দিন নিরাপদ অবস্থায় হাজির হবে সে উত্তম? তোমরা যা চাও করতে থাকো, আল্লাহ তোমাদের সব কাজ দেখছেন’’।
[3]. ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহ তার আকীদা বিষয়ক কাসিদাহ নুনিয়ার মধ্যে এ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। এক অধ্যায়ে তিনি বলেছেন যে, জাহমিয়রা মুশরিকদের চেয়েও নিকৃষ্ট। নুনিয়ার অন্য একটি অনুচ্ছেদে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, তাদের বিদআতগুলো কুফুরী পর্যন্ত পৌছে গেছে। নিঃসন্দেহে তাদের আকীদা ও আমলগুলো প্রমাণ করে যে, তারা মুসলিমদের আলেমদের সম্পূর্ণ বিরোধিতা করেছে। তাদের নিকৃষ্ট আকীদার মধ্যে রয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলা কথা বলেন না। আমাদের প্রশ্ন হলো, আল্লাহ তা‘আলা যদি কথা না বলেন, তাহলে কুরআন কার কালাম? জবাবে তারা বলেছে যে, কুরআন হলো অন্যান্য সৃষ্টির মতই একটি সৃষ্টি। যেমন মানুষ এক প্রকার সৃষ্টি। সুতরাং তারা আল্লাহ তা‘আলার কথা বলা বিশেষণ নাকোচ করার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার সমস্ত প্রত্যাদেশকে মাখলুক বলেছে।
প্রকৃত কথা হলো কুরআন-হাদীছের বহু দলীল এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আলেমদের ঐক্যমতে কুরআন মাখলুক নয়; বরং তা আল্লাহর কালাম। আল্লাহ তা‘আলা এর মাধ্যমে কথা বলেছেন। তার থেকেই কুরআন এসেছে এবং তার নিকটই ফিরে যাবে।
আল্লাহ তা‘আলা সূরা আরাফের ১৮০ নং আয়াতে বলেন,
﴿وَلِلَّهِ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَىٰ فَادْعُوهُ بِهَا وَذَرُوا الَّذِينَ يُلْحِدُونَ فِي أَسْمَائِهِ سَيُجْزَوْنَ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ﴾
‘‘আল্লাহ তা‘আলার অনেক সুন্দর নাম রয়েছে। সুতরাং তাকে সেই নামেই ডাকো এবং তার নামসমূহের মধ্যে যারা বিকৃতি করে, তোমরা তাদেরকে বর্জন করো। তারা যা করে আসছে, তার ফল অবশ্যই পাবে’’। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿اللَّهُ لَا لاَ إِلَهَ إِلَّا هُوَ لَهُ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَى﴾
‘‘তিনি আল্লাহ, তিনি ছাড়া আর কোনো সত্য ইলাহ নেই, তার জন্য রয়েছে সর্বোত্তম নামসমূহ’’। (সূরা তোহা: ৮) আল্লাহ তা‘আলা আয়াতদ্বয়ে সংবাদ দিয়েছেন যে, তার অনেক নাম রয়েছে। নামগুলো অতি সুন্দর। অর্থাৎ তার নামগুলো সৌন্দর্যের সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত হয়েছে। তার নামগুলোর চেয়ে অধিক সুন্দর আর কোনো নাম নেই। এ নামগুলোই প্রমাণ করে যে, তার গুণাবলী পরিপূর্ণ এবং তার বিশেষণগুলো মহান। সুতরাং তার নামগুলো সবচেয়ে সুন্দর এবং সবচেয়ে পরিপূর্ণ।
এখানে বিশেষভাবে স্মরণ রাখা আবশ্যক যে, আল্লাহ তা‘আলার নামগুলো তাওকীফী। অর্থাৎ কুরআন ও হাদীছের দলীলের নির্ভর করেই সেগুলো সাব্যস্ত করতে হবে। কিয়াস ও ইজতেহাদ করে আল্লাহ তা‘আলার জন্য কোনো নাম নির্বাচন করা যাবেনা। সুতরাং আমাদের জন্য বৈধ নয় যে, তিনি নিজের সত্তাকে যেসব নামে নামকরণ করেছেন অথবা তার রসূল তাকে যেসব নামে নামকরণ করেছেন তা বাদ দিয়ে অন্য নামে নামকরণ করবো। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তোমরা তাকে সেটার মাধ্যমে ডাকো। অর্থাৎ তার কাছে সেটার মাধ্যমে প্রার্থনা করো এবং তার উসীলা দাও। যেমন আপনি এভাবে বলবেন,
اللهم اغفر لي وارحمني إنك أنت الغفور الرحيم
‘‘হে আল্লাহ! তুমি আমাকে ক্ষমা করো এবং আমার উপর রহম করো। নিশ্চয়ই তুমি ক্ষমাকারী ও দয়াশীল।
আল্লাহ তা‘আলার রয়েছে অনেক অতি সুন্দর নাম, যা গণনা করে শেষ করা যাবে না। এগুলোর মধ্যে কিছু নাম রয়েছে, যা কেবল আল্লাহ তা‘আলাই অবগত রয়েছেন। তা কোনো নৈকট্যশীল ফেরেশতা কিংবা কোনো প্রেরিত নবীও অবগত নন।
সহীহ হাদীছে এসেছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার দু‘আয় বলেছেন, ্র
اللَّهُمَّ إنِّى عَبْدُكَ ابنُ عَبْدِكَ ابنُ أمتِكَ ناصِيَتى بيَدِكَ مَاضٍ فِىَّ حُكْمُكَ عَدْلٌْ فىَّ قضاؤكَ أَسْأَلُكَ أللَّهُمَّ بِكُلِّ اسْمٍ هُوَ لَكَ سَمَّيْتَ بِهِ نَفْسَكَ أَوْ أَنْزَلْتَهُ فِي كِتَابِكَ أَوْ عَلَّمْتَهُ أَحَدًا مِنْ خَلْقِكَ أَوِ اسْتَأْثَرْتَ بِهِ فِي عِلْمِ الْغَيْبِ عِنْدَكَ
‘‘হে আল্লাহ! আমি তোমার বান্দা। আমি তোমার এক বান্দা ও এক বান্দীর পুত্র। আমার কপাল তোমার হাতে। আমার ব্যাপারে তোমার হুকুম কার্যকর হয়। আমার ব্যাপারে তোমার ফায়ছালা ইনসাফপূর্ণ হয়। আমি তোমার সেই প্রত্যেক নামের উসীলা দিয়ে তোমার কাছে প্রার্থনা করছি, যে নামে তুমি নিজেকে নামকরণ করেছো বা তোমার কিতাবে অবতীর্ণ করেছো অথবা তোমার কোনো বান্দাকে শিক্ষা দিয়েছ অথবা যে নামগুলোকে তুমি নিজের জ্ঞান ভান্ডারে সংরক্ষিত করে রেখেছো’’।[1]
আল্লামা ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রহিমাহুল্লাহ বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তা‘আলার অতি সুন্দর নামগুলোকে তিনভাগে ভাগ করেছেন।
(১) এক শ্রেণীর নাম হলো যা দিয়ে তিনি নিজের নামকরণ করেছেন। অতঃপর তার ফেরেশতাগণ এবং অন্যান্য সৃষ্টিকে সেটা শিক্ষা দিয়েছেন। এ নামগুলো তিনি তার কোনো কিতাবে অবতীর্ণ করেন নি।
(২) আরেক শ্রেণীর নামগুলোকে তিনি তার কিতাবে নাযিল করেছেন এবং তার বান্দাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন।
(৩) আরেক শ্রেণীর নাম তিনি তার ইলমুল গায়েবের মধ্যে রেখে দিয়েছেন। তিনি তার কোনো সৃষ্টিকেই সেটা শিক্ষা দেন নি।[2]
আল্লাহ তা‘আলার বাণী, وَذَرُوا الَّذِينَ يُلْحِدُونَ فِي أَسْمَائِهِ ‘‘তার নামসমূহের মধ্যে যারা বিকৃতি করে, তোমরা তাদেরকে বর্জন করো’’। অর্থাৎ তাদের থেকে বিমুখ হও এবং তাদেরকে বর্জন করো। আল্লাহ তা‘আলা অচিরেই তাদেরকে উপযুক্ত সাজা দিবেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘‘তার ফল অবশ্যই তারা পাবে’’।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী, يُلْحِدُونَ فِي أَسْمَائِهِ ‘‘তার নামসমূহের মধ্যে যারা বিকৃতি সাধন করে’’। অর্থাৎ তারা সেগুলোর প্রকৃত ও সঠিক অর্থ বাদ দিয়ে বাতিল অর্থের দিকে নিয়ে যায়। আল্লাহর অতি সুন্দর নাম ও সুউচ্চ গুণাবলীর মধ্যে ইলহাদ-বিকৃতি কয়েক প্রকার।
(১) আল্লাহর নামে দেবতার নাম রাখা: আল্লাহর অন্যতম নাম الإله থেকে মুশরেকরা তাদের এক দেবতার নাম রেখেছে اللات (লাত), আল্লাহর নাম العزيز থেকে তারা তাদের আরেক মূর্তির নাম রেখেছে العزى (উয্যা) এবং আল্লাহর নাম المنان থেকে তারা আরেক বাতিল মাবুদের নাম রেখেছে مناة (মানাত)। মূর্তির নাম মাবুদ রাখাও আল্লাহর নাম বিকৃতি করার মধ্যে গণ্য।
(২) আল্লাহর এমন নাম রাখা, যা তার মর্যাদা ও বড়ত্বের শানে শোভনীয় নয়: যেমন খ্রিষ্টানরা আল্লাহকে أب বা পিতা বলে। দার্শনিকরা আল্লাহকে موجب বা আসল সংঘটক কিংবা علة فاعلة (স্বভাবগত কার্যকর কারণ) বলে থাকে।
(৩) আল্লাহ তা‘আলাকে এমন ত্রুটিযুক্ত বিশেষণে বিশেষিত করা, যা থেকে তিনি নিজেকে পবিত্র রেখেছেন: যেমন অভিশপ্ত ইয়াহূদীরা বলে থাকে আল্লাহ তা‘আলা সবকিছু সৃষ্টি করার পর শনিবারে বিশ্রাম নিয়েছেন। তারা আরো বলে ﴿إِنَّ اللَّهَ فَقِيرٌ وَنَحْنُ أَغْنِيَاءُ﴾ ‘‘নিশ্চয় আল্লাহ গরীব আর আমরা ধনী’’। তারা আরো বলে,
﴿يَدُ اللَّهِ مَغْلُولَةٌ غُلَّتْ أَيْدِيهِمْ وَلُعِنُوا بِمَا قَالُوا ۘ بَلْ يَدَاهُ مَبْسُوطَتَانِ يُنفِقُ كَيْفَ يَشَاءُ﴾
‘‘আল্লাহর হাত বাঁধা। আসলে বাঁধা হয়েছে ওদের হাত এবং তারা যে কথা বলছে সে জন্য তাদের উপর অভিশাপ বর্ষিত হয়েছে। আল্লাহর দুই হাত সদা প্রসারিত। যেভাবে চান তিনি খরচ করেন’’। (সূরা মায়িদা: ৬৪)
তারা আরো বলে থাকে আল্লাহ তা‘আলা ছয়দিনে আসমান-যমীন এবং সেটার মধ্যকার সমস্ত বস্তু সৃষ্টি করার পর শনিবারে বিশ্রাম নিয়েছেন। মূলত আল্লাহ তাদের কথার অনেক উর্ধ্বে।
(৪) আল্লাহ তা‘আলার অতি সুন্দর নাম ও সুউচ্চ ছিফাতগুলোর অর্থ অস্বীকার করা: যেমন জাহমীয়ারা বলে আল্লাহর নামগুলো শুধু শব্দের মধ্যেই সীমিত। এগুলো কোনো গুণ বা অর্থকে নিজের মধ্যে শামিল করে না। উদাহরণ স্বরূপ তারা আল্লাহর অন্যতম নাম السميع البصير (সর্বশো্রতা- সর্বদ্রষ্টা) সম্পর্কে তারা বলে থাকে শ্রবণ করা বিশেষণ ছাড়াই তিনি শ্রবণকারী এবং দেখা বিশেষণ ছাড়াই তিনি দ্রষ্টা।[3]
শরী‘আত ও বিবেক-বুদ্ধির দলীল দ্বারা সাব্যস্ত যে, এটি আল্লাহর অতি সুন্দর নামসমূহের মধ্যে সর্ববৃহৎ ইলহাদ বা বিকৃতি। এটি আরবের মুশরিকদের ইলহাদের বিপরীত। মুশরিকরা আল্লাহ তা‘আলার নামসমূহ ও গুণাবলীসমূহ তাদের মাবুদসমূহকে প্রদান করেছে। আর এসব জাহমীয়া আল্লাহ তা‘আলাকে তার পূর্ণতার গুণাবলী থেকে খালি করে ফেলেছে এবং তার অতি সুন্দর নাম ও সুউচ্চ গুণাবলীকে বাতিল করে দিয়েছে।
আমাদের উপর আবশ্যক হলো, আল্লাহ তা‘আলার অতি সুন্দর নাম ও সুউচ্চ গুণাবলী সাব্যস্ত করা এবং এগুলো যেসব পরিপূর্ণ বিশেষণ ও মর্যাদার প্রমাণ বহন করে তা পরিবর্তন, বাতিল, ধরণ, কায়া কিংবা উপমা পেশ করা ছাড়াই বিশ্বাস করা। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ﴾
‘‘তার সদৃশ কোনো কিছুই নেই। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’’। (সূরা শুরা: ১১)
সে সঙ্গে আল্লাহ তা‘আলার অতি সুন্দর নামসমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা আবশ্যক। এ নামগুলোর মাধ্যমে অন্যকে নামকরণ করা আল্লাহ তা‘আলার প্রতি মর্যাদা প্রদর্শনের পরিপন্থী। আল্লাহর নামগুলোর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা তাওহীদ বাস্তবায়নের অন্তর্ভুক্ত।
আবু শুরাইহ হতে বর্ণিত আছে যে, এক সময় তার কুনিয়াত ছিল আবুল হাকাম বা মহা বিচারক। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
إِنَّ اللَّهَ هُوَ الْحَكَمُ وَإِلَيْهِ الْحُكْمُ فَلِمَ تُكْنَى أَبَا الْحَكَمِ فَقَالَ إِنَّ قَوْمِى إِذَا اخْتَلَفُوا فِى شَىْءٍ أَتَوْنِى فَحَكَمْتُ بَيْنَهُمْ فَرَضِىَ كِلاَ الْفَرِيقَيْنِ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم্مَا أَحْسَنَ هَذَا فَمَا لَكَ مِنَ الْوَلَدِ قَالَ لِى شُرَيْحٌ وَمُسْلِمٌ وَعَبْدُ اللَّهِ قَال্َ فَمَنْ أَكْبَرُهُمْ قُلْتُ شُرَيْحٌ قَال্َ فَأَنْتَ أَبُو شُرَيْحٍ
‘‘আল্লাহ তা‘আলাই হচ্ছেন হাকাম বা মহাবিচারক এবং ফায়ছালা একমাত্র তারই। সুতরাং তুমি আবুল হাকাম কুনিয়ত গ্রহণ করেছ কেন? তখন আবু শুরাইহ বললেন, আমার গোত্রের লোকেরা যখন কোনো বিষয়ে মতবিরোধ করে, তখন ফায়ছালার জন্য আমার কাছে চলে আসে। অতঃপর আমি তাদের মধ্যে ফায়ছালা করে দেই। এতে উভয় পক্ষই সন্তুষ্ট হয়ে যায়। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এটা কতই না ভালো! তোমার কি সন্তানাদি আছে? আবু শুরাইহ বললেন, শুরাইহ, মুসলিম এবং আবদুল্লাহ নামে আমার তিনটি ছেলে সন্তান আছে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তাদের মধ্যে সবার বড় কে? আমি বললাম, শুরাইহ। তিনি বললেন তাহলে তুমি আবু শুরাইহ’’। ইমাম আবু দাউদ এবং অন্যরা হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।[4]
উপরোক্ত হাদীছের মাধ্যমে জানা গেলো যে, আল্লাহর অতি সুন্দর নামসমূহের সম্মানার্থে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার কুনিয়ত পালটিয়ে ফেলেছেন। কেননা আল্লাহ তা‘আলাই হাকাম বা সর্ববিষয়ে মহা বিচারক। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَاللَّهُ يَحْكُمُ لَا مُعَقِّبَ لِحُكْمِهِ ‘‘আল্লাহ আদেশ করেন। তার আদেশ প্রতিহত করার কেউ নেই’’। (সূরা রা’দ: ৪১)
তিনি দুনিয়া ও আখিরাতে হুকুমকারী। দুনিয়াতে তিনি তার বান্দাদের মধ্যে নবী-রসূলদের নিকট প্রেরিত অহীর মাধ্যমে হুকুম ও ফায়ছালা করেন। তারা যে বিষয়ে মতভেদ করেছিল কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা তাদের মাঝে সে বিষয়ে স্বীয় ইলম অনুযায়ী ফায়ছালা করবেন এবং যালেম থেকে মাযলুমের হক আদায় করবেন।
উপরোক্ত হাদীছে দলীল পাওয়া যাচ্ছে যে, আল্লাহ তা‘আলার জন্য নির্দিষ্ট নামে কোনো মানুষের নাম রাখা নিষেধ। আল্লাহর নামের মর্যাদা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকার কারণেই নিষেধ করা হয়েছে। যেমন আবুল হাকাম কিংবা অনুরূপ নাম রাখা নিষেধ।
আল্লাহর নামের সম্মানার্থেই কোনো মানুষের জন্য তার ক্রীতদাসকে আমার বান্দা কিংবা আমার বান্দী বলা যাবে না। কেননা এতে আল্লাহর রুবুবীয়াতের ক্ষেত্রে মানুষের অংশগ্রহণের সন্দেহ রয়েছে।
সহীহ বুখারীতে আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
لاَ يَقُلْ أَحَدُكُمْ أَطْعِمْ رَبَّكَ وَضِّئْ رَبَّكَ اسْقِ رَبَّكَ وَلْيَقُلْ سَيِّدِى مَوْلاَىَ وَلاَ يَقُلْ أَحَدُكُمْ عَبْدِى وأَمَتِى وَلْيَقُلْ فَتَاىَ وَفَتَاتِى وَغُلاَمِى
‘‘তোমাদের কেউ যেন না বলে, তোমার প্রভুকে খাবার দাও, তোমার প্রভুকে অযু করাও, তোমার প্রভুকে পান করাও; বরং সে যেন বলে, আমার সরদার, আমার মনিব। তোমাদের কেউ যেন না বলে, আমার বান্দা, আমার বান্দী; বরং সে যেন বলে, আমার সেবক, আমার সেবিকা, আমার চাকর’’।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একজন অন্যজনকে উদ্দেশ্য করে তোমার প্রভু, আমার প্রভু, আমার বান্দা, তোমার বান্দা-বান্দী ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করতে নিষেধ করেছেন। কেননা এতে আল্লাহ তা‘আলার শরীক হওয়ার ধারণা রয়েছে। এ পথ বন্ধ করার জন্য এবং শিরকের মূলোৎপাটনের জন্য নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চাকরের মনিবদেরকে আমার বান্দা বলার পরিবর্তে আমার সেবক, সেবিকা, খাদেম ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করার আদেশ দিয়েছেন। আর চাকর ও সেবকদেরকে তাদের মালিকদের উদ্দেশ্যে আমার প্রভু বলার পরিবর্তে আমার নেতা, অভিভাবক, মনিব ইত্যাদি শব্দ প্রয়োগ করার আদেশ দিয়েছেন। আর আল্লাহর অতি সুন্দর নাম নিয়ে কেউ কিছু চাইলে তাকে খালি হাতে ফেরত না দেয়াও আল্লাহ তা‘আলার নামসমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মধ্যে গণ্য।
আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্নিত আছে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
مَنِ اسْتَعَاذَ بِاللَّهِ فَأَعِيذُوهُ وَمَنْ سَأَلَ بِاللَّهِ فَأَعْطُوهُ وَمَنْ دَعَاكُمْ فَأَجِيبُوهُ وَمَنْ صَنَعَ إِلَيْكُمْ مَعْرُوفًا فَكَافِئُوهُ فَإِنْ لَمْ تَجِدُوا مَا تُكَافِئُونَهُ فَادْعُوا لَهُ حَتَّى تَرَوْا أَنَّكُمْ قَدْ كَافَأْتُمُوهُ
‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর নাম নিয়ে আশ্রয় প্রার্থনা করে, তাকে তোমরা আশ্রয় দাও। যে ব্যক্তি আল্লাহর নামে সাহায্য চায় তাকে দান করো। যে তোমাদেরকে ডাকে তার দাওয়াত কবুল করো। যে ব্যক্তি তোমাদের জন্য ভালো কাজ করে, তার প্রতিদান দাও। তার প্রতিদানের জন্য যদি তোমরা কিছুই না পাও, তাহলে তার জন্য দু‘আ করো, যাতে তোমরা বুঝতে পার যে, তোমরা তার প্রতিদান দিতে পেরেছো’’। ইমাম আবু দাউদ ও নাসায়ী হাদীছটি সহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন’’।[5]
কেননা আল্লাহর নাম নিয়ে ভিক্ষারীকে মাহরুম করলে আল্লাহর নামের অবমাননা করা হয়। আর আল্লাহর নাম নিয়ে কেউ কিছু চাইলে তাকে দান করার মধ্যে আল্লাহ তা‘আলাকে তা’যীম করার দলীল পাওয়া যায় এবং দানকারী এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য অর্জন করতে পারে। আল্লাহর নামের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের আরেকটি পদ্ধতি হলো, আল্লাহ তা‘আলার চেহারার উসীলা দিয়ে জান্নাত ব্যতীত অন্য কিছু চাওয়া যাবে না। আল্লাহ তা‘আলার প্রতি বড়ত্ব, মর্যাদা ও সম্মান প্রদর্শনের জন্যই তার নামের উসীলায় জান্নাত ছাড়া অন্য কিছু চাওয়া উচিত নয়।
জাবের রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
لاَ يُسْأَلُ بِوَجْهِ اللَّهِ إِلاَّ الْجَنَّةُ
‘‘আল্লাহর চেহারার উসীলা দিয়ে একমাত্র জান্নাত ছাড়া অন্য কিছু চাওয়া যাবেনা’’। ইমাম আবু দাউদ (রহি.) হাদীছটি বর্ণনা করেছেন’’।[6]
সুতরাং আল্লাহর চেহারার উসীলায় দুনিয়ার নগণ্য কোনো জিনিস চাওয়া যাবে না। তার চেহারার উসীলা দিয়ে কেবল সর্বোচ্চ উদ্দেশ্য হাসিলের প্রার্থনা করা যাবে। আর তা হলো জান্নাত অথবা যা জান্নাতে যাওয়ার উপায়। যেমন ঐসব মৌখিক ও কর্মগত আমলের তাওফীক চাওয়া যাবে, যা মানুষকে জান্নাতের নিকটবর্তী করে দেয়।
আল্লাহ তা‘আলার অতি সুন্দর নামসমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের আরেকটি পদ্ধতি হলো তার নামে বেশী বেশী কসম করা যাবেনা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَاحْفَظُوا أَيْمَانَكُمْ ‘‘তোমরা তোমাদের শপথসমূহ সংরক্ষণ করো’’। (সূরা মায়েদা: ৮৯)
ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন এখানে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন যে, তোমরা শপথ করোনা। কেননা বেশি বেশি শপথ করলে আল্লাহ তা‘আলার প্রতি অবজ্ঞা করা হয় এবং তাতে আল্লাহর প্রতি তা’যীম নষ্ট হয়। এটি তাওহীদের পূর্ণতার পরিপন্থী।
সালমান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
্রثَلاَثَةٌ لاَ يُكَلِّمُهُمُ اللَّهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلاَ يُزَكِّيهِمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ أُشَيْمِطٌ زَانٍ، وَعَائِلٌ مُسْتَكْبِرٌ، وَرَجُلٌ جَعَلَ اللَّهَ بِضَاعَتَهُ و لا يَشْتَرِي إِلا بِيَمِينِهِ وَلا يَبِيعُ إِلا بِيَمِينِهِ
‘‘তিন শ্রেণীর লোকদের সাথে আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন কথা বলবেন না, তাদেরকে গুনাহ হতে পবিত্র করবেন না; বরং তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। তারা হলো বৃদ্ধ ব্যভিচারী, অহংকারী গরীব, আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে ব্যবসার পণ্য বানিয়েছে। আল্লাহর নামে কসম করা ব্যতীত সে পণ্য ক্রয় করে না, কসম করা ব্যতীত পণ্য বিক্রিও করে না’’। ইমাম তাবারানী সহীহ সনদে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন’’।[7]
আল্লাহকে ব্যবসার পণ্য বানিয়েছে: অর্থাৎ আল্লাহর নামে শপথ করাকে পণ্যের প্রসার ঘটানোর মাধ্যম বানিয়েছে। এখানে বেশি বেশি শপথ করার ব্যাপারে কঠিন শাস্তির ধমক এসেছে। কেননা বেশি বেশি শপথ করার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করা হয় এবং তার অতি সুন্দর নামসমূহের সম্মান নষ্ট হয়। আল্লাহর প্রতি বড়ত্ব ও সম্মান প্রদর্শনের দাবি হলো আল্লাহর সুপারিশ পেশ করে কোনো মাখলুকের কাছে কিছু চাওয়া যাবে না। এতে আল্লাহ তা‘আলার মান হানি হয়। সেই সঙ্গে এতে বুঝা যায়, যার নিকট আল্লাহর সুপারিশ পেশ করা হচ্ছে তিনি আল্লাহর তুলনায় বেশি মর্যাদাবান! নাউযুবিল্লাহ
ইমাম শাফেঈ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, কেননা সুপারিশকারী তার চেয়ে উচু মর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তির নিকটই সুপারিশ করে থাকে। সুতরাং আল্লাহ এত মহান যে, তার সুপারিশ অন্য কারো নিকট পেশ করা হবে, তিনি এর বহু উর্ধ্বে। এক গ্রাম্য লোক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট এসে অনাবৃষ্টি এবং ধন-সম্পদ ধ্বংস হওয়ার অভিযোগ করে তার কাছে আল্লাহর নিকট বৃষ্টির প্রার্থনার দু’আ করার আবেদন করলো। সে আরো বললো,
্রفَإِنَّا نَسْتَشْفِعُ بِاللَّهِ عَلَيْكَ وَبِكَ عَلَى اللَّهِ فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ سُبْحَانَ اللَّهِ ، سُبْحَانَ اللَّهِ فَمَا زَالَ يُسَبِّحُ حَتَّى عُرِفَ ذَلِكَ فِي وُجُوهِ أَصْحَابِهِ ثُمَّ قَالَ: وَيْحَكَ أَتَدْرِي مَا اللَّهُ؟ إِنَّ شأْنَهُ أَعْظَمُ مِنْ ذَلِكَ إِنَّهُ لا يُسْتَشْفَعُ بِالله عَلَى أَحَدٍ من خلقه
‘‘আমরা আপনার কাছে আল্লাহর সুপারিশ পেশ করছি এবং আল্লাহর কাছে আপনার সুপারিশ পেশ করছি। এ কথা শুনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বার বার বলতে লাগলেন, সুবহানাল্লাহ্! সুবহানাল্লাহ্! এভাবে তিনি আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করতেই থাকলেন। এতে তার সাহাবীদের চেহারায় বিষণ্ণতার ছাপ দেখা গেল। অতঃপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমার ধ্বংস হোক, আল্লাহর মর্যাদা কত বড় তা কি তুমি জানো? তুমি যা মনে করছো আল্লাহর মর্যাদা তার চেয়ে অনেক বেশি। কোনো সৃষ্টির কাছেই আল্লাহর সুপারিশ পেশ করা যায় না। ইমাম আবু দাউদ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।[8] সুতরাং আল্লাহ তা‘আলার মর্যাদা অনেক বড়। তার অনুমতিক্রমেই তার নিকট সুপারিশ করা হবে।
[1]. মুসনাদে আহমাদ, ইমাম আলবানী হাদীছটিকে সহীহ বলেছেন। দেখুনঃ সিলসিলা ছহীহা, হাদীছ নং- (১/১৯৯)।
[2]. সুতরাং আল্লাহর অতি সুন্দর নামগুলো নিরা নববইয়ের মধ্যে সীমিত নয়। হতে পারে শত শত, হাজার হাজার, হতে পারে লক্ষ লক্ষ, হতে পারে কোটি কোটি, হতে পারে আরো বেশী....। তবে যে হাদীছে ৯৯টি নামের উল্লেখ আছে, তার অর্থ হলো, আল্লাহ তা‘আলার এমন নিরা নববইটি নাম আছে, যা মুখস্ত করলে, তার অর্থ ভালোভাবে বুঝলে এবং নামগুলোর দাবি অনুযায়ী আমল করলে জান্নাতে যাওয়া যাবে। এতে তাঁর অন্য কোনো নাম থাকাকে নাকোচ করা হয়নি।
[3]. আশআরী ও মাতুরীদিগণ হুবহু উক্ত আকীদা পোষণ করেন। আশআরীগণ আল্লাহ তা‘আলার মাত্র সাতটি সিফত এবং মাতুরীদিগণ মাত্র আটটি ছিফাত স্বীকার করে। বাকীগুলোর তাবীল করে। আশআরীগণ যেসব ছিফাত সাব্যস্ত করে, তা হলো, الحياة (জীবন) العلم (জ্ঞান), الإرادة (ইচ্ছা),القدرة (ক্ষমতা), السمع (শ্রবণ করা), البصر (দেখা) এবং الكلام (কথা বলা)। মাতুরীদিগণ অষ্টম যেই ছিফাতটি সাব্যস্ত করে, তা হলো, التكوين (আকৃতি দান করা বা গঠন করা)। তবে তারা এ ছিফাতগুলো আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের তরীকায় সাব্যস্ত করে না। তারা বলে তিনি সর্বশ্রোতা ঠিকই; কিন্তু শ্রবণ করা বিশেষণ ছাড়াই, সর্বদ্রষ্টা ঠিকই; কিন্তু দেখা বিশেষণ ছাড়াই....। ঐদিকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের লোকেরা এসব সিফাতের প্রকৃত অর্থ সাব্যস্ত করেন। কিন্তু আশায়েরা সম্প্রদায়ের লোকেরা বলে এগুলো আল্লাহ তা‘আলার সত্তার সাথে যুক্ত। তাঁর পবিত্র সত্তার বাইরে এগুলোর কোনো প্রভাব আসেনা। অর্থাৎ এমন নয় যে, আল্লাহ তা‘আলার সত্তা থেকে বহু কালাম নির্গত হয়েছে এবং তা জিবরীল আলাইহিস সালাম শুনেছেন। অতঃপর জিবরীল তা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে পৌছিয়ে দিয়েছেন এবং তিনিও তা শুনেছেন। বরং তারা বলে আল্লাহর সত্তার সাথে মাত্র একটি কালাম যুক্ত আছে,। অর্থাৎ তা অসংখ্য নয়। ঐদিকে তাদের মতে কুরআনের অক্ষর, শব্দ ও অর্থগুলোও আল্লাহর কালাম নয়; বরং সেটা আল্লাহ তা‘আলার সেই একটি মাত্র কালামের ব্যাখ্যা। তাদের এই মত সত্যের সম্পূর্ণ বিপরীত। কুরআন-সুন্নাহর অনেক দলীল তাদের কথাকে প্রতিবাদ করে। আল্লাহ তা‘আলার রয়েছে অসংখ্য ও সীমাহীন কালাম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿قُل لَّوْ كَانَ الْبَحْرُ مِدَادًا لِّكَلِمَاتِ رَبِّي لَنَفِدَ الْبَحْرُ قَبْلَ أَن تَنفَدَ كَلِمَاتُ رَبِّي وَلَوْ جِئْنَا بِمِثْلِهِ مَدَدًا﴾
‘‘হে মুহাম্মাদ! বলো, যদি আমার রবের কথা লেখার জন্য সমুদ্র কালিতে পরিণত হয় তাহলে সেই সমুদ্র নিঃশেষ হয়ে যাবে, কিন্তু আমার রবের কালাম শেষ হবে না। বরং যদি এ পরিমাণ কালি আবারও আনয়ন করি তাহলে তাও যথেষ্ট হবে না’’। (সূরা কাহাফ: ১০৯)
[4]. আবু দাউদ, অধ্যায়: মন্দ নাম পরিবর্তন করা। ইমাম আলবানী হাদীছটিকে সহীহ বলেছেন। দেখুন: শাইখের তাহকীকসহ মিশকাতুল মাসাবীহ, হাদীছ নং- ৪৭৬৬।
[5]. সহীহ: আবু দাউদ, অধ্যায়: সায়েলকে দান করা, হাদীছ নং- ১৬৭২।
[6]. আবু দাউদ, হা/১৬৭৩। ইমাম আলবানী হাদীছটিকে যঈফ বলেছেন, দেখুন: শাইখের তাহকীকসহ মিশকাত, হাদীছ নং- ১৯৪৪।
[7]. হাদীছের সনদ সহীহ, দেখুন: সহীহুত্ তারগীব ও তারহীব, হাদীছ নং- ১৭৮৮।
[8]. ইমাম আলবানী (রহি.) হাদীছটিকে যঈফ বলেছেন। দেখুন: শাইখের তাহকীকসহ মিশকাতুল মাসাবীহ, হা/৫৭২৭।
আল্লাহ তা‘আলার অতি সুন্দর নাম ও সুউচ্চ গুণাবলীর ক্ষেত্রে নাজাতপ্রাপ্ত দল আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আকীদা হলো কুরআন ও সুন্নাহয় সেগুলো যেভাবে এসেছে সেভাবেই সাব্যস্ত করা। সেই সঙ্গে এগুলো যে অর্থ প্রদান করে তাও বিশ্বাস করা এবং তার বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করা।
আল্লাহ তা‘আলার জন্য অতি সুন্দর নাম ও সুউচ্চ ছিফাত সাব্যস্ত করলেই আল্লাহ তা‘আলাকে সৃষ্টির সাথে তুলনা হয়ে যায় না। কেননা স্রষ্টার ছিফাত তার জন্যই খাস এবং তার জন্যই শোভনীয়। আর সৃষ্টির ছিফাত সৃষ্টির জন্যই শোভনীয় এবং তার জন্যই খাস। স্রষ্টার ছিফাত ও সৃষ্টির ছিফাতের মধ্যে কোনো সাদৃশ্য নেই। যেমন নেই আল্লাহ তা‘আলার সত্তা এবং সৃষ্টির সত্তার মধ্যে কোনো প্রকার সাদৃশ্য। আল্লাহ তা‘আলার অতি সুন্দর নাম ও সুউচ্চ গুণাবলীর ক্ষেত্রে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মাযহাব সঠিক মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। আর এ মূলনীতিগুলো হচ্ছে,
প্রথমত মূলনীতি: আল্লাহ তা‘আলার অতি সুন্দর নামসমূহ ও সু্উচ্চ গুণাবলী তাওকীফি। অর্থাৎ তিনি তার নিজের সত্তার জন্য পবিত্র কুরআনে যেসব অতি সুন্দর নাম ও সুউচ্চ গুণাবলী সাব্যস্ত করেছেন অথবা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সহীহ সুন্নাতে তার প্রভুর জন্য যা সাব্যস্ত করেছেন, আহলে সুন্নাতের লোকেরা আল্লাহর জন্য কেবল তাই সাব্যস্ত করেন। তারা তাদের বিবেক-বুদ্ধি ও চিন্তা-ভাবনা-অনুমানের উপর ভিত্তি করে আল্লাহ তা‘আলার জন্য কিছুই সাব্যস্ত করেন না। সেই সঙ্গে তারা আল্লাহ তা‘আলার সত্তা থেকে কেবল সেটাই নাকোচ করেন যা আল্লাহ তা‘আলা তার কিতাবে নাকোচ করেছেন অথবা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার পবিত্র সুন্নাতে নাকোচ করেছেন। তারা তাদের বিবেক-বুদ্ধি ও চিন্তা-ভাবনা-অনুমানের উপর নির্ভর করে আল্লাহ তা‘আলা থেকে কিছুই নাকোচ করেন না। তারা সাব্যস্ত করণ কিংবা নাকোচ করণ, কোনো ক্ষেত্রেই কুরআন-সুন্নাহর সীমা লংঘণ করেন না। আর আল্লাহ তা‘আলার কিতাব যা নাকোচ কিংবা সাব্যস্ত কোনোটাই করেনি, তারা উপরোক্ত মূলনীতির উপর নির্ভর করে নীরবতা অবলম্বন করেন। যেমন যুক্তিবাদী ও দার্শনিকদের পরিভাষা জিসিম, আরয, জাওহার ইত্যাদি সম্পর্কে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের লোকেরা কিছুই বলেন না। কারণ কুরআন ও সুন্নাহয় আল্লাহ তা‘আলার সত্তার জন্য এগুলো সাব্যস্ত করা হয়নি এবং নাকোচও করা হয়নি।
দ্বিতীয় মূলনীতি: আল্লাহ তা‘আলা তার নিজের সত্তাকে যেসব পূর্ণতার বিশেষণ দিয়ে বিশেষিত করেছেন অথবা তার রসূল তাকে যে বিশেষণে বিশেষিত করেছেন তা সত্য এবং তা বাহ্যিক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এগুলো অনর্থক উল্লেখ করা হয়নি এবং এর মাধ্যমে মানুষকে ধাঁধায় ফেলা হয়নি; বরং মানুষ সাধারণ কথা বললে যেমন তার কথা বুঝা যায়, এগুলোর অর্থও সেরকম বুঝা যায়।
সুতরাং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের লোকেরা আল্লাহ তা‘আলার ছিফাত সমূহের শব্দ এবং সেটার অর্থ উভয়টিই সাব্যস্ত করেন। আল্লাহ তা‘আলা নিজেকে যা দ্বারা বিশেষিত করেছেন অথবা তার রসূল তাকে যা দ্বারা বিশেষিত করেছেন, তা ঐসব মুতাশাবেহ আয়াতের অন্তর্ভুক্ত নয়, যার শব্দগুলো সাব্যস্ত করে সেটার অর্থ আল্লাহর কাছে সোপর্দ করে দিতে হবে। কেননা আল্লাহর ছিফাত সংক্রান্ত আয়াতগুলোকে অবোধগম্য বক্তব্য হিসাবে গণ্য করা হলে আল্লাহর কালামকে অনারবদের ঐসব দুর্বোধ্য বক্তব্যের পর্যায়ে রাখা হয়ে যায়, যার অর্থ বুঝা যায় না।
আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে সমগ্র কুরআনের মধ্যে চিন্তা-গবেষণা করার আদেশ দিয়েছেন এবং তা ভালোভাবে উপলব্ধি করা ও বুঝার উৎসাহ দিয়েছেন। যদি বলা হয় যে, ছিফাত সংক্রান্ত বক্তব্যগুলো বোধগম্য নয়, তাহলে এমন ধারণার আশঙ্কা রয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে কুরআনে এমন বিষয়ে চিন্তা-গবেষণা করার আদেশ দিয়েছেন, যা নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করা সম্ভব নয় এবং এমন কিছু বুঝার উপদেশ দিয়েছেন, যা বুঝা অসম্ভব। সেই সঙ্গে আরো আবশ্যক হয় যে, আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে এমন বিষয়ে বিশ্বাস স্থাপন করতে বলেছেন, যা তিনি আমাদেরকে খোলাসা করে বলেন নি। তিনি এমন করার বহু উর্ধ্বে।
সুতরাং আল্লাহ তা‘আলার ছিফাতসমূহের অর্থ একটি জ্ঞাত বিষয় এবং তাতে বিশ্বাস করা আবশ্যক। কিন্তু এর কোনো চিত্র আমাদের জানা নেই। আল্লাহ ছাড়া তার ছিফাতের ধরণ অন্য কেউ জানে না। এ জন্যই ইমাম মালেক (রহি.) কে যখনالرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى ‘‘দয়াময় আল্লাহ আরশের উপরে সমুন্নত হয়েছেন’’- এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলো كيف استوى আল্লাহ তা‘আলা কিভাবে আরশের উপর সমুন্নত হয়েছেন? তখন জবাবে ইমাম মালেক (রহি.) বলেছেন,الاستواء معلوم والكيف مجهول والإيمان به واجب والسؤال عنه بدعة ‘আরশের উপরে আল্লাহর সমুন্নত হওয়া একটি জানা বিষয়। এর পদ্ধতি কেউ অবগত নয়। তার উপর ঈমান আনয়ন করা ওয়াজিব। তবে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা বিদ্আত।[1]
ইমাম মালেক রাহিমাহুল্লাহর এই কথা আল্লাহ তা‘আলার সমস্ত ছিফাতের ক্ষেত্রেই একটি মূলনীতিতে পরিণত হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলার ছিফাতের ক্ষেত্রে আহলে সুন্নাতের লোকদের বক্তব্য এটিই। সুতরাং যে ব্যক্তি সালাফদের প্রতি এই কথার সম্বন্ধ করলো যে, তারা আল্লাহ তা‘আলার অতি সুন্দর নাম ও সুমহান গুণাবলীর কোনো অর্থ সাব্যস্ত না করে শুধু শব্দ সাব্যস্ত করে সেটার অর্থ আল্লাহর কাছে সোপর্দ করতেন এবং তারা ছিফাত সংক্রান্ত বক্তব্যগুলোকে ঐসব মুতাশাবেহ আয়াতের মধ্যে গণ্য করতেন, যার অর্থ আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ জানে না, তারা সালাফদের নামে মিথ্যা রচনা করলো। কেননা সালাফদের কথা এই মিথ্যুকের কথার সম্পূর্ণ বিপরীত।
তৃতীয় মূলনীতি: সালাফগণ সৃষ্টির ছিফাতের সাথে তুলনা না করেই আল্লাহ তা‘আলার ছিফাত সাব্যস্ত করতেন। সুতরাং তারা আল্লাহ তা‘আলার ছিফাতগুলো সৃষ্টির ছিফাতসমূহের সাথে তুলনা করতেন না। কেননা আল্লাহ তা‘আলার সদৃশ আর কিছুই নেই। সুতরাং তার কোনো সমকক্ষ নেই, তার কোনো শরীক নেই এবং তার সমতুল্য কেউ নেই। আল্লাহর ছিফাতের উপমা-উদাহরণ পেশ করা এবং সেগুলোকে সৃষ্টির ছিফাতের সাথে তাশবীহ দেয়া তার ছিফাত সমূহের পদ্ধতি ও ধরণ সম্পর্কে জ্ঞান রাখার দাবি করার অন্তর্ভুক্ত। আর আল্লাহ তা‘আলার ছিফাতসমূহের ধরণ-পদ্ধতি ও কায়া আমাদের কাছে তার সত্তার কাইফিয়াতের মতোই অজানা। ছিফাতের কাইফিয়াত সম্পর্কে জ্ঞান রাখার জন্য মাওসুফ তথা বিশেষিত সত্তা সম্পর্কে জ্ঞান রাখা আবশ্যক। আল্লাহ তা‘আলার সত্তার ধরণ সম্পর্কে তিনি ছাড়া অন্য কেউ জ্ঞান রাখে না। সুতরাং ছিফাত সম্পর্কে কথা বলা সত্তা সম্পর্কে কথা বলার শাখা বিশেষ। তাই বিশ্বাস করা আবশ্যক যে, আল্লাহ তা‘আলার সত্তা যেহেতু কোনো সৃষ্টির সত্তার সদৃশ নয়, অনুরূপ তার ছিফাতও কোনো সৃষ্টির ছিফাতের সদৃশ নয়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَالسَّمِيعُ البَصِيرُ﴾ ‘‘তার সদৃশ কোনো কিছুই নেই, তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’’। অর্থাৎ কেউ আল্লাহর সাদৃশ্য রাখেনা। তার সত্তার সাথেও না, তার ছিফাতের সাথেও না এবং তার কোনো কর্মের সাথেও না।
সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা তার নিজের সত্তাকে যেসব ছিফাতের মাধ্যমে বিশেষিত করেছেন তার উপর ঈমান আনয়ন করা আবশ্যক। আল্লাহ সম্পর্কে আল্লাহর চেয়ে অধিক জ্ঞানী আর কেউ নেই।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,أَأَنْتُمْ أَعْلَمٌ أَمِ اللَّهٌ ‘‘তোমরা অধিক জ্ঞানী না আল্লাহ?’’ সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা তার নিজের সম্পর্কে এবং অন্যদের সম্পর্কে সর্বাধিক অবগত রয়েছেন। অনুরূপ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে যেসব গুণাবলীর মাধ্যমে বিশেষিত করেছেন, তার উপরও ঈমান আনয়ন করা আবশ্যক। কেননা আল্লাহর পরে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চেয়ে আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কে অধিক জ্ঞানী আর কেউ নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى إِنْ هُوَ إِلا وَحْيٌ يُوحَى﴾
‘‘এবং তিনি প্রবৃত্তির তাড়নায় কোনো কথা বলেন না। তা অহী ছাড়া অন্য কিছু নয়, যা তার প্রতি প্রত্যাদেশ করা হয়। (সূরা আন নাজম: ৩-৪)
সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা তার নিজের সত্তাকে যেসব গুণাবলীতে গুণান্বিত করেছেন এবং তার রসূল তাকে যেসব গুণাবলীতে বিশেষিত করেছেন প্রাপ্ত বয়স্ক প্রত্যেক মুসলিমের তার উপর ঈমান আনয়ন করা আবশ্যক। অনুরূপ একই সঙ্গে মুসলিমের উপর আবশ্যক হলো আল্লাহ তা‘আলার ছিফাতকে সৃষ্টির ছিফাতের সাথে তাশবীহ তুলনা করা থেকে মহান আল্লাহ রাববুল আলামীনের পবিত্রতা বজায় রাখা।
সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলা ও তার রসূলের অগ্রণী হবে এবং আল্লাহ তা‘আলার উপর দুঃসাহস দেখিয়ে তার সত্তা থেকে ঐসব মহৎ গুণাবলী নাকোচ করবে, যা তিনি নিজের জন্য সাব্যস্ত করেছেন অথবা তার রসূল যেসব গুণাবলী দ্বারা তার প্রভুকে বিশেষিত করেছেন, তা নাকোচ করবে সে কি আল্লাহর প্রতি, তার কিতাবের প্রতি এবং তার নবীর সুন্নাতের প্রতি ঈমানদার বলে গণ্য হবে? অনুরূপ যে ব্যক্তি বলবে, হে আমার প্রভু! তুমি নিজেকে যেসব গুণাবলীতে গুণান্বিত করেছো অথবা তোমার রসূল তোমাকে যা দ্বারা বিশেষিত করেছেন, তা দ্বারা গুণান্বিত হওয়া তোমার জন্য শোভনীয় নয়! তাতে রয়েছে এই এই দোষ! সুতরাং আমি এগুলোর তাবীল করছি এবং তা বাতিল করে তার স্থলে আমার নিজের পক্ষ হতে অন্যান্য বিশেষণ সাব্যস্ত করছি, যে ব্যক্তি একথাগুলো বলবে, সে কি মুমিন হওয়ার আশা করতে পারে? কখনো নয়। যেমন মুতাযেলী কিংবা আশআরী মাযহাবের কোনো এক কবি বলেছেন,
وكُل نص أوهم التشبيها ... أَوَّله أو فوَّض وَرُم تَنزِيها
‘‘হে বন্ধু! কুরআন ও সুন্নাহর যেসব উক্তিতে আল্লাহর সাথে সৃষ্টির তাশবীহ (তুলনা) হওয়ার সন্দেহ রয়েছে, তাকে তার বাহ্যিক অর্থ পরিহার করে অন্য অর্থে ব্যাখ্যা করো অথবা কেবল উক্তির অর্থ বিহীন শব্দমালা সাব্যস্ত করো এবং সৃষ্টির সাথে আল্লাহ তা‘আলার সাদৃশ্য হওয়ার ধারণা থেকে তাকে পবিত্র করো’’।[2]
সুতরাং এ বিষয়ে আমি তোমার কিতাব এবং তোমার রসূলের সুন্নাতের স্মরণাপন্ন হবোনা। কেননা সৃষ্টির সাথে তোমার তাশবীহ বা সাদৃশ্য হয়ে যাওয়ার সন্দেহ রয়েছে। বরং আমি তোমার নাম ও ছিফাতসমূহ সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে তর্কশাস্ত্রবিদদের মূলনীতি, জাহমীয়া, মু‘তাযিলা, আশায়েরা এবং মাতুরীদিয়াদের মতবাদের স্মরণাপন্ন হবো। যে ব্যক্তি এরকম কথা বলবে, সে কি আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী বলে গণ্য হবে? সে কি তার প্রভুকে সম্মানকারী হিসাবে গণ্য হবে? এটি নিঃসন্দেহে বিরাট এক অপবাদ! হে আল্লাহ! তারা তোমার প্রতি যেসব বাতিল কথার সম্বন্ধ করে, আমরা তা থেকে তোমার পবিত্রতা বর্ণনা করছি।
চতুর্থ মূলনীতি: আল্লাহ তা‘আলা নিজেকে যেসব ছিফাত দ্বারা বিশেষিত করেছেন অথবা তার রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে যেসব গুণাবলী দ্বারা গুণান্বিত করেছেন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের লোকেরা যেমন সেটা আল্লাহ তা‘আলার বড়ত্ব ও মর্যাদার জন্য শোভনীয় পদ্ধতিতে সাব্যস্ত করেন ঠিক তেমনি তারা তাকে সমস্ত দোষ-ত্রুটি থেকে পবিত্র বলে ঘোষণা করেন। তাকে দোষ-ত্রুটি থেকে পবিত্র ও মুক্ত ঘোষণা করার দলীল পেশ করতে গিয়ে ছিফাত সংক্রান্ত উক্তিগুলোর এমন কোনো তাবীল করেন না কিংবা সেটার শব্দগুলোকে তার আসল মর্মার্থ থেকে বিকৃত করেন না, যা তাদেরকে তা’তীল বা আল্লাহ তা‘আলার ছিফাতগুলোকে বাতিল করার দিকে নিয়ে যায়; বরং তারা এ ব্যাপারে মুশাবেবহা সম্প্রদায় এবং মুআত্তেলা সম্প্রদায়ের মাঝামাঝি অবস্থানে রয়েছেন। তারা আল্লাহ তা‘আলা থেকে অপূর্ণতার দোষ-ত্রুটি নাকোচ করতে গিয়ে পূণর্তার গুণাবলীকে অর্থহীন, অকেজো ও বাতিল করা থেকে দূরে থাকেন এবং পূর্ণতার বিশেষণ সাব্যস্ত করতে গিয়ে তার সাদৃশ্য প্রদান করা থেকেও বেঁচে থাকেন।
পঞ্চম মূলনীতি: আহলে সুন্নাতের লোকেরা আল্লাহ তা‘আলার জন্য যেসব পূর্ণতার গুণাবলী সাব্যস্ত করেন এবং যেসব অপূর্ণতার দোষ-ত্রুটি তার থেকে নাকোচ করেন, তাতে তারা কুরআন-সুন্নাহর পথ অবলম্বন করেন। আর তা এভাবে যে, তারা নাকোচ করতে গিয়ে সংক্ষিপ্ত কথা বলেন এবং সাব্যস্ত করতে গিয়ে বিস্তারিতভাবে বলেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَ هُوَ السَّميْعُ الْبَصِيْر﴾
‘‘তার সদৃশ কোনো কিছুই নেই। তিনি সর্বশ্রোতা এবং সর্বদ্রষ্টা’’। (সূরা শুরা: ১১)
‘‘তার সদৃশ কোনো কিছুই নেই।’’ এ অংশের মাধ্যমে সংক্ষেপে সৃষ্টি থেকে কোনো কিছু আল্লাহর সদৃশ হওয়ার নাকোচ করা হয়েছে এবং ‘‘তিনি সর্বশ্রোতা এবং সর্বদ্রষ্টা’’ এ অংশের মাধ্যমে বিস্তারিতভাবে তার জন্য পূর্ণতার গুণাবলী সাব্যস্ত করা হয়েছে।
না বাচক বাক্যের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা থেকে যা কিছুই নাকোচ করা হয়েছে, একই সঙ্গে তাতে আল্লাহ তা‘আলার কামাল তথা পূর্ণতার বিশেষণ সাব্যস্ত করা হয়েছে। নাকোচ সংক্রান্ত বক্তব্য দ্বারা শুধু নাকোচই উদ্দেশ্য নয়। কেননা শুধু না বাচক বাক্যের মধ্যে কোনো প্রশংসা থাকেনা। শুধুমাত্র নাকোচের মাধ্যমে অস্তিত্বহীন বিষয় উদ্দেশ্য হয়। আর অস্তত্বহীনকে কোনো জিনিসই বলা হয় না।
আল্লাহ তা‘আলার ছিফাতের ব্যাপারে নাকোচের মাধ্যমেও তার জন্য কামাল বা পূর্ণতার বিশেষণ সাব্যস্ত করা হয়েছে। এর অনেক উদাহরণ রয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَلاَيَظْلِمُ رَبٌّكَ أَحَدًا ‘‘তোমার রব কাউকে যুলুম করেন না’’। (সূরা কাহাফ: ৪৯) অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার আদল বা ন্যায়বিচার যেহেতু সর্বোচ্চ, চূড়ান্ত ও পূর্ণতম, তাই তিনি কারো প্রতি অবিচার করেন না।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَلَا يَئُودُهُ حِفْظُهُمَا ‘‘আর আসমান ও যমীনকে ধারণ করা তার জন্য মোটেই কঠিন নয়’’। তার শক্তি ও ক্ষমতা যেহেতু পরিপূর্ণ, তাই আসমান-যমীনের হেফাযত করা তার পক্ষে মোটেই কঠিন নয়। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
لاَ تَأْخُذُهُ سِنَةٌ وَلَا نَوْمٌ ‘‘তন্দ্রা ও নিদ্রা তাকে স্পর্শ করতে পারে না’’। কেননা তার জীবন পরিপূর্ণ, তিনি চির জাগ্রত এবং তার ধারণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করার ক্ষমতা অবিনশ্বর।
অনুরূপভাবে আল্লাহ তা‘আলা থেকে যেখানেই কিছু নাকোচ করা হয়েছে, সেখানে নাকোচকৃত বিষয়ের বিপরীত পূর্ণতা ও মহত্ত্বের বিশেষণ সাব্যস্ত করা হয়েছে। আমরা আল্লাহর কাছে দীনের সঠিক জ্ঞান প্রার্থনা করছি, তার আনুগত্যমূলক কাজের তাওফীক চাচ্ছি এবং সত্য জানা ও সে অনুযায়ী আমল করার শক্তি প্রার্থনা করছি।
[1]. অতঃপর সেই বিদআতী লোককে ইমাম মালেক (রহি.)এর নির্দেশে তাঁর মজলিস থেকে বের করে দেয়া হলো। কেননা এটি এমন প্রশ্ন, যা সালাফে সালেহীনের কোনো লোক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে করেননি।
[2]. আল্লাহ তা‘আলার অতি সুন্দর নাম ও সুউচ্চ গুণাবলী সম্পর্কিত অধ্যায় ইলমের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ শাখা। কেননা এ সম্পর্কে ইলম অর্জন করা ব্যতীত তাঁর মারেফত হাসিল করা অসম্ভব। এতে যদি আল্লাহ তা‘আলার কথা এবং আল্লাহর রাসূলের কথা যথার্থ ও গ্রহণযোগ্য না হয়, তাহলে এ ক্ষেত্রে কার উক্তি গ্রহণযোগ্য হবে? ইমামুল হারামাইন আবুল মাআলী আল-জুওয়াইনী রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, আমি দীর্ঘদিন আল্লাহ তা‘আলার ছিফাত সংক্রান্ত বিষয়ে অপব্যাখ্যা কারীদের মাযহাবের উপর ছিলাম। অতঃপর আমি এ বিষয়ে চিন্তা-গবেষণা করলাম। চিন্তা-ভাবনা করে দেখতে পেলাম যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমনসব কথা বলতেন, যাতে আল্লাহ তা‘আলার ছিফাতসমূহের খবর রয়েছে। তিনি তাঁর মজলিসে, ভাষণে, ভ্রমণে এবং নিজ শহরে আল্লাহ তা‘আলার ছিফাত সংক্রান্ত বিষয়ে কথা বলতেন। তার নিকট থেকে জ্ঞানী-মূর্খ, শহরবাসী ও গ্রাম্য লোক, আনসার-মুহাজির সকলেই সেটা শুনতেন। কিন্তু এ সম্পর্কিত কথা চলাকালে কেউ তাঁর কোনো প্রতিবাদ করেন নি অথবা তিনি এ সম্পর্কিত কথা বলার পর এমন কিছু উল্লেখ করেন নি, যাতে বুঝা যায় তাঁর কথার বাহ্যিক অর্থ উদ্দেশ্য নয়। এ থেকে আমরা নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারি যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তা‘আলার ছিফাত সংক্রান্ত বিষয়ে অথবা অন্যান্য গায়েবী বিষয়ে সাধারণভাবে যা বলেছেন, তার বাহ্যিক অর্থই উদ্দেশ্য। এতে প্রমাণিত হয় যে, ইমামুল হারামাইন দীর্ঘদিন কালাম (তর্কশাস্ত্র) বিদদের মাযহাবের উপর থাকার পর আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মাযহাবের দিকে ফিরে এসেছেন এবং এর উপরেই মৃত্যু বরণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলাই সর্বাধিক অবগত রয়েছেন।
আল্লাহ তা‘আলার কিতাব ও রসূলের সুন্নাতে আল্লাহ তা‘আলার অতি সুন্দর নাম ও সুমহান গুণাবলী যেভাবে এসেছে, মুসলিমদের উপর আবশ্যক হলো তার বড়ত্ব ও মর্যাদার জন্য শোভনীয় পদ্ধতিতে সেটা সাব্যস্ত করা। কেননা এটি আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ঈমান আনয়নের অন্তর্ভুক্ত। এটিই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মাযহাব। তারা এ ব্যাপারে আল্লাহর কিতাব ও রসূলের সুন্নাতকে দলীল ও মূলনীতি হিসাবে গ্রহণ করেছেন। এ বিষয়ে তাদের মাযহাব জাহমীয়া এবং তাদের ছাত্র মু‘তাযিলা ও আশায়েরাদের মাযহাবের বিপরীত। আল্লাহ তা‘আলা তার নিজের সত্তার জন্য যেসব অতি সুন্দর নাম ও সুউচ্চ গুণাবলী সাব্যস্ত করেছেন তারা তা নাকোচ করে অথবা নিজেদের মনমত তা থেকে কতিপয় ছিফাত নাকোচ করে এবং কতিপয় ছিফাত সাব্যস্ত করে। তাদের সীমিত বিবেক-বুদ্ধি অথবা গোমরাহ ইমামদেরকে এ ব্যাপারে দলীল হিসাবে গ্রহণ করে তাদের মাযহাব রচনা করেছে। সুতরাং যারা কুরআন-সুন্নাহ থেকে দলীল নিয়েছে এবং যারা চিন্তার ফসল ও মস্তিস্কের আবর্জনাকে দলীল বানিয়ে নিয়েছে, তাদের মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। যেমন বিদআতীদের কোনো এক কবি বলেছেন,
وكُل نص أوهم التشبيها ... أَوَّله أو فوَّض وَرُم تَنزِيها
‘‘হে বন্ধু! কুরআন ও সুন্নাহর যেসব উক্তিতে আল্লাহর সাথে সৃষ্টির তাশবীহ (তুলনা) হওয়ার সন্দেহ রয়েছে, তার বাহ্যিক অর্থ পরিহার করে অন্য অর্থে ব্যাখ্যা করো অথবা কেবল উক্তির অর্থ বিহীন শব্দমালা সাব্যস্ত করো এবং সৃষ্টির সাথে আল্লাহ তা‘আলার সাদৃশ্য হওয়ার ধারণা থেকে তাকে পবিত্র করো’’।
আল্লাহ তা‘আলার অতি সুন্দর নাম ও সুউচ্চ ছিফাতসমূহের ব্যাপারে কুরআন ও সুন্নাহর দলীলের ক্ষেত্রে এ হলো তাদের আচরণ। কুরআন-সুন্নাহর উক্তিগুলো যে গুরুত্বপূর্ণ অর্থ প্রদান করে তা পরিহার করে তাদের অকেজো বিবেক-বুদ্ধি এবং বাতিল মতবাদ যা নির্ধারণ করে, তা গ্রহণ করাকে التأويل বলা হয়। আর তাদের বিবেক-বুদ্ধি যা বুঝতে ও গ্রহণ করতে অক্ষম তারা তা সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করে কুরআন-সুন্নাহ এর বিপরীত আকীদা পোষণ করেছে।
হে আমার রব! আমি তোমার পবিত্রতা বর্ণনা করছি। কতইনা উঁচু তোমার শান! বান্দাদের ব্যাপারে তুমি কতইনা সহনশীল! তুমি তোমার নিজের সত্তার জন্য যেসব পূর্ণতার গুণাবলী ও মহত্ত্বের বিশেষণ সাব্যস্ত করেছো, এরা তা অস্বীকার করেছে। তারা তোমার কিতাবের বিরোধিতা করেছে। তুমি তোমার কিতাবে যা অবতীর্ণ করেছো, তার উপর তারা নিজেদের বিবেক-বুদ্ধির সিদ্বান্তকে প্রাধান্য দিয়েছে। তারা তোমার অতি সুন্দর নাম ও সুউচ্চ গুণাবলীকে নাকোচ করে দিয়েছে এবং তোমার দলীল-প্রমাণ ও হিদায়াতকেও নাকোচ করেছে।
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহ জাহমীয়া, মু‘তাযিলা এবং তাদের শিষ্যদের ব্যাপারে বলেছেন, যে ব্যক্তি ধারণা করলো যে, আল্লাহ তা‘আলা নিজের সত্তা, ছিফাত ও কর্ম সম্পর্কে যে সংবাদ দিয়েছেন, তার বাহ্যিক অর্থ বাতিল, কারণ এতে সৃষ্টির সাথে তার তাশবীহ (সাদৃশ্য দেয়া) এবং তামছীল (তুলনা করা) হয়ে যায়, তাই এ বিষয়ে মূল সত্যটি এড়িয়ে চলা হয়েছে, সে সম্পর্কে সংবাদ প্রদান করা হয়নি; বরং সেদিকে দূর থেকে রহস্যময় ইঙ্গিত প্রদান করা হয়েছে, ধাঁধায় ফেলা হয়েছে, সুস্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়নি, এ সম্পর্কে সবসময় সাদৃশ্য এবং বাতিল উপমা পেশ করা হয়েছে, আল্লাহ তা‘আলা তাদের মেধা, বোধশক্তি, চিন্তা-ভাবনা ও বিবেক-বুদ্ধি খাঁটিয়ে তার কালামকে স্বীয় অর্থ থেকে সরানো এবং সেটার আসল ব্যাখ্যা বাদ দিয়ে অন্য ব্যাখ্যা করার আদেশ করেছেন, তাদেরকে আরো আদেশ করা হয়েছে, তারা যেন আল্লাহর কালামের তাবীল করার কঠিন কঠিন পদ্ধতি বের করে, যারা এ ধরণের কথা বলল, তারা আল্লাহ তা‘আলার প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ করলো।
এমনি যারা মনে করে, কুরআন মজীদে সর্বদা অর্থহীন শব্দ ও উপমা পেশ করা হয়েছে, আল্লাহর কালামের তাবীলগুলোর মাধ্যমে মানুষকে ধাঁধায় ফেলা হয়েছে এবং সেগুলো অনেকটা খোলাখুলি বর্ণনার মতোই তারাও আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ করলো।
এমনি যারা মনে করে আল্লাহ তা‘আলার অতি সুন্দর নাম ও সুউচ্চ গুণাবলীর পরিচয় জানার জন্য তিনি তাদেরকে বিবেকের উপর ছেড়ে দিয়েছেন; তার কিতাবের উপর নির্ভর করতে বলেননি, তারাও আল্লাহর ব্যাপারে খারাপ ধারণা পোষণ করল। যারা মনে করে, আল্লাহ তাদেরকে তার কালামের এমন অর্থ গ্রহণ করতে বলেছেন, যা তাদের ভাষা ও বক্তব্যে পরিচিত ছিল না। অথচ যেই সত্যটি খুলে বলা উচিত ছিল, আল্লাহ তা‘আলা খোলাখুলিভাবে তা প্রকাশ করতে সম্পূর্ণ সক্ষম এবং ঐ সমস্ত শব্দ দূর করতে সক্ষম, যেগুলো মানুষকে বাতিল আকীদার দিকে নিয়ে যায়, কিন্তু তিনি তা না করে হেদায়াতের সুস্পষ্ট পথের বিপরীত পথে তাদেরকে নিয়ে গেছেন। যারা এরূপ ধারণা করলো, তারাও আল্লাহর ব্যাপারে খারাপ ধারণা পোষণ করল।
এমনি যে ব্যক্তি ধারণা করলো, আল্লাহ তা‘আলা সুস্পষ্ট শব্দের মাধ্যমে সত্য প্রকাশ করতে সক্ষম নন; বরং তার উস্তাদরাই তা করতে সক্ষম, সে আল্লাহ তা‘আলার ক্ষমতার মধ্যে অপারগতার ধারণা পোষণ করলো। কিন্তু যে বললো, তিনি তা করতে সক্ষম, কিন্তু করেননি; বরং সত্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট বর্ণনা না দিয়ে অস্পষ্ট ধারণার দিকে নিয়ে গেছেন, শুধু তাই নয়; বরং অবাস্তব, বাতিল ও ভ্রান্ত আকীদার দিকে নিয়ে গেছেন, সেও আল্লাহ তা‘আলার হিকমত ও রহমত সম্পর্কে বাতিল ধারণা পোষণ করলো।
যে ব্যক্তি বিশ্বাস করল, আল্লাহ এবং আল্লাহর রসূল ব্যতীত সে নিজে এবং তার উস্তাদরাই সত্য বলেছেন এবং তাদের কথাতেই রয়েছে সুস্পষ্ট হিদায়াত, সত্য, আল্লাহর কালামের বাহ্যিক অর্থের মধ্যে কেবল তাশবীহ, তামছীল এবং গোমরাহী ছাড়া অন্য কিছু নেই, তাদের ধারণা আল্লাহর প্রতি খুবই মন্দ। যারা মনে করে দিশেহারা কালাম শাস্ত্রবিদ ও যুক্তিবিদদের কথার মধ্যেই রয়েছে সত্য ও হিদায়াত আল্লাহর প্রতি তাদের ধারণা সর্বাধিক নিকৃষ্ট।
যারা বিশ্বাস করল, আল্লাহ শুনেন না, দেখেন না, জানেন না, তার কোনো ইচ্ছা নেই, তার সত্তার সাথে যুক্ত কালাম ছাড়া আর কোনো কালাম নেই, কোনো সৃষ্টির সাথে কথা বলেন না, কখনো বলবেন না, কোনো আদেশ বা নিষেধও করেন না, তারাও আল্লাহর প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করলো।
এমনি যারা ধারণা করল যে, আল্লাহ তা‘আলা আসমানসমূহের উপর আরশে সমুন্নত হন না এবং সৃষ্টি থেকে আলাদা নন; বরং আরশের দিকে তার সত্তার সম্বন্ধ করা সর্বনিম্ন স্থানের প্রতি সেটার সম্বন্ধ করার মতোই, তারা আল্লাহ তা‘আলার প্রতি অত্যন্ত নিকৃষ্ট ধারণা পোষণ করলো। ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহর কথা এখানেই শেষ।
অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা তার নিজের সত্তার জন্য পূর্ণতার যেসব গুণাবলী সাব্যস্ত করেছেন, জাহমীয়া, মু‘তাযিলা ও আশআরী সম্প্রদায়ের লোকেরা তা নাকোচ করে থাকে। আর এ কথা বাস্তব যে, যারাই আল্লাহ তা‘আলার পবিত্র সত্তা থেকে পূর্ণতার গুণাবলী নাকোচ করেছে, তারাই তার জন্য সেটার বিপরীতে ত্রুটিযুক্ত বিশেষণ সাব্যস্ত করেছে। আল্লাহ তা‘আলা এসব যালেমের কথার বহু উর্ধ্বে।
উপরোক্ত কথা গ্রহণ করা হলে এটি আবশ্যক হয় যে, এ গোমরাহ লোকেরাই আল্লাহ সম্পর্কে অধিক জ্ঞানী এবং আল্লাহর জন্য যা শোভনীয় তা সাব্যস্ত করার জন্য তারাই তার চেয়ে বেশি হকদার। কেননা তিনি নিজের জন্য যা সাব্যস্ত করেছেন, তারা তা নাকোচ করেছে। তারা বলেছে, সেটা আল্লাহ তা‘আলার জন্য শোভনীয় নয়। এর চেয়ে অধিক গোমরাহী আর কী হতে পারে? আল্লাহ তা‘আলার সত্তা সম্পর্কে এত জঘন্য কথা বলার চেয়ে দুঃসাহসিকতা আর কী হতে পারে।
তাদের কথা থেকে আরো আবশ্যক হয় যে, তারা আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকেও অধিক জানে। কেননা তিনিও আল্লাহ তা‘আলার জন্য এ ছিফাতগুলো সাব্যস্ত করেছেন। আর এসব জাহমীয়া ও মু‘তাযিলারা তা নাকোচ করেছে এবং বলেছে এগুলো তার জন্য শোভনীয় নয়। সুতরাং এদের চেয়ে অধিক গোমরাহ আর কে হতে পারে? আফসোস! যদি তারা বুঝতে পারতো!
আল্লাহ তা‘আলা তার নিজের সত্তা সম্পর্কে যত জ্ঞান রাখেন এ গোমরাহ মূর্খ লোকেরা কিভাবে তার চেয়ে অধিক জ্ঞান রাখার দাবি করতে পারে। তিনি তাদের কথার বহু উর্ধ্বে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ وَلَا يُحِيطُونَ بِهِ عِلْمًا﴾
‘‘তিনি লোকদের সামনের ও পেছনের সব অবস্থা জানেন। তারা তাদের জ্ঞান দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান অর্জন করতে পারবেনা’’। (সূরা ত্বহা: ১১০)
সুতরাং সৃষ্টির মধ্য থেকে আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কে তিনি ছাড়া অন্য কেউ অধিক জানেনা। আল্লাহ তা‘আলা যা দ্বারা বিশেষিত হওয়ার উপযুক্ত এবং যা কিছু তার জন্য শোভনীয়, সে সম্পর্কে তিনি এবং তার রসূল ব্যতীত অন্য কেউ অধিক জানে না।
আল্লাহ সম্পর্কে অজ্ঞতা ও জ্ঞান-বুদ্ধির ত্রুটির কারণেই জাহমীয়া এবং তাদের অনুসারীরা আল্লাহ তা‘আলার ছিফাত অস্বীকার করেছে। তারা মনে করেছে, এ ছিফাতগুলো আল্লাহ তা‘আলার জন্য সাব্যস্ত করা হলে তা থেকে তাশবীহ বা তার সদৃশ সাব্যস্ত করা আবশ্যক হয়। কেননা তারা এ ছিফাতগুলো সৃষ্টির মধ্যে প্রত্যক্ষ করে থাকে। তারা স্রষ্টার ছিফাত এবং সৃষ্টির ছিফাতের মধ্যে পার্থক্য করে না এবং স্রষ্টার ছিফাত থেকে কেবল ঐ পরিমাণই বুঝে থাকে, যে পরিমাণ বুঝে থাকে সৃষ্টির ছিফাত থেকে। তারা জানে না যে, মহান স্রষ্টার জন্য রয়েছে খাস ও শোভনীয় ছিফাত এবং সৃষ্টির জন্য রয়েছে খাস ও শোভনীয় ছিফাত। স্রষ্টার সত্তা ও সৃষ্টির সত্তার মধ্যে যেমন কোনো সাদৃশ্য নেই ঠিক তেমনি স্রষ্টার ছিফাত ও সৃষ্টির ছিফাতের মধ্যে কোনো সাদৃশ্য নেই। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ﴾
‘‘তার সদৃশ কোনো কিছুই নেই। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’’ (সূরা শুরা:১১)।
এখানে আল্লাহ নিজের জন্য শ্রবণ ও দৃষ্টি সাব্যস্ত করেছেন। একই সঙ্গে নিজের সত্তার সাথে কোনো কিছুর সাদৃশ্য হওয়াকেও নাকোচ করেছেন। এতে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, আল্লাহর জন্য ছিফাত সাব্যস্ত করলে স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে সাদৃশ্য থাকা আবশ্যক হয় না।
আল্লাহ তা‘আলার জন্য অতি সুন্দর নাম ও সুউচ্চ গুণাবলী সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে এটি হলো আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মূলনীতি। এর উপরই তারা রয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা তার নিজের সত্তার জন্য যা সাব্যস্ত করেছেন, উদাহরণ-উপমা পেশ করা ছাড়াই তারা তার জন্য সেটা সাব্যস্ত করেন এবং তিনি তার নিজের সত্তা থেকে যা নাকোচ করেছেন, তার মহান গুণাবলী বাতিল করা ব্যাতীত কেবল তাই নাকোচ করেন।
কিন্তু জাহমীয়া, আশায়েরা এবং তাদের শিষ্যরা একটি বাতিল মূলনীতির উপর তাদের মাযহাব নির্মাণ করেছে, যা নিজেরাই তৈরী করেছে। তাদের মতে আল্লাহর জন্য ছিফাত সাব্যস্ত করা হলে সৃষ্টির সাথে তাশবীহ বা সাদৃশ্য আবশ্যক হয়। তাই ছিফাত সংক্রান্ত বক্তব্যগুলোর ক্ষেত্রে তারা নিন্মোক্ত দু’টি বিষয়ের যে কোনো একটি আবশ্যক মনে করে।
(১) ছিফাত সংক্রান্ত বক্তব্যগুলোর বাহ্যিক অর্থ পরিহার করে অন্য অর্থে তাবীল করা। অথবা (২) কেবল বক্তব্যগুলোর অর্থবিহীন শব্দমালা সাব্যস্ত করা। সেই সঙ্গে এ বিশ্বাস করা যে, তাতে বাহ্যিক অর্থ উদ্দেশ্য নয়। এ জন্যই তাদের আকীদায় বিশ্বাসী কোনো এক কবি বলেছেন
وكل نص أوهم التشبيها ... أوله أو فوض ورم تنزيها
‘‘হে বন্ধু! কুরআন ও সুন্নাহর যেসব বক্তব্যে আল্লাহর সাথে সৃষ্টির তাশবীহ হওয়ার সন্দেহ রয়েছে, তার বাহ্যিক অর্থ পরিহার করে অন্য অর্থে ব্যাখ্যা করো অথবা কেবল বক্তব্যগুলোর অর্থ বিহীন শব্দমালা সাব্যস্ত করো এবং সৃষ্টির সাথে আল্লাহ তা‘আলার সাদৃশ্য হওয়ার ধারণা থেকে তাকে পবিত্র করো’’।
হে আমার রব! এসব যালেম এবং নাস্তিক যা বলছে তা থেকে আমি তোমার পবিত্রতা ঘোষণা করছি। তুমি তাদের কথার বহু উর্ধ্বে।
উপরোক্ত কবির জবান থেকে আল্লাহ তা‘আলা সত্য বের করেছেন। তিনি বলেছেন, "وكل نص أوهم التشبيها" কুরআন ও সুন্নাহর যেসব বক্তব্যে আল্লাহর সাথে সৃষ্টির তাশবীহ হওয়ার সন্দেহ রয়েছে.....। এতে প্রমাণ মিলে যে, তাদের মাযহাবের ভিত্তি হচ্ছে সন্দেহের উপর, সুপ্রাণিত সত্যের উপর নয়। কেননা তারা ধারণা করেছে যে, এ বক্তব্যগুলোতে তাশবীহ বা সাদৃশ্যের সম্ভাবনা রয়েছে। তাই তারা এগুলোর তাবীল করেছে। হে আল্লাহর বান্দাগণ! সন্দেহের বশবতী হয়ে কি কখনো আল্লাহর কিতাব ও রসূলের সুন্নাতের বিরোধিতা করা বৈধ? সন্দেহের উপর কি আকীদা নির্মাণ করা জায়েয? আসলে সন্দেহের স্তর ধারণার চেয়ে নিম্নে। আল্লাহ তা‘আলা ধারণা সম্পর্কে বলেন,
﴿وَإِنَّ الظَّنَّ لا يُغْنِي مِنَ الْحَقِّ شَيْئاً﴾
‘‘সত্যের মোকাবেলায় অনুমানের কোনো মূল্য নেই’’। (সূরা নাযম: ২৮)
দু’টি সম্প্রদায় আল্লাহ তা‘আলার অতি সুন্দর নাম ও সুউচ্চ গুণাবলীর ক্ষেত্রে সালাফদের মানহাজ থেকে বিচ্যুত হয়েছে। তারা হলো মুশাবেবহা এবং মুআত্তেলা সম্প্রদায়।
(১) মুশাবেবহা (المشبهة): এরা আল্লাহকে সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্য করে দেয় ও তাকে সৃষ্টির সাথে তুলনা করে। এরা আল্লাহর ছিফাতগুলোকে সৃষ্টির ছিফাতসমূহের হিসাবে নির্ধারণ করেছে। এ জন্যই তাদেরকে মুশাবেবহা বলা হয়।
হিশাম ইবনে হাকাম রাফেযী এবং বয়ান ইবনে সামআন তামিমী সর্বপ্রথম আল্লাহ তা‘আলার ছিফাতকে সৃষ্টির ছিফাতের সাথে সাদৃশ্য দেয়ার মাযহাব প্রচার করেছে। এই বয়ান ইবনে সামআনকে শিয়াদের সীমালংঘনকারী বয়ানীয়া মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে গণ্য করা হয়। সুতরাং মুশাবেবহারা আল্লাহর ছিফাত সাব্যস্ত করতে গিয়ে বাড়াবাড়ি করেছে। এমনকি আল্লাহ তা‘আলা তার নিজের সত্তা থেকে ত্রুটিযুক্ত ও অশোভনীয় যেসব ছিফাত নাকোচ করেছেন এবং তার রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা নাকোচ করেছেন, এরা তার জন্য তাও সাব্যস্ত করেছে। মুশাবেবহা সম্প্রদায়ের ইমামদের মধ্যে রয়েছে হিশাম ইবনে সালেম আল-জাওয়ালেকী এবং দাউদ আল-যাহেবী। আল্লাহ তা‘আলা তাদের কথার বহু উর্ধ্বে।
সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্য রাখার কথা আল্লাহ তা‘আলা তার কিতাবে নাকোচ করেছেন এবং তার জন্য সৃষ্টির মধ্য থেকে উপমা ও দৃষ্টান্ত পেশ করা থেকে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন, ﴿لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ﴾ ‘‘তার সদৃশ কোনো কিছুই নেই’’।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,﴿هَلْ تَعْلَمُ لَهُ سَمِيًّا﴾ ‘‘তোমার জানা মতে তার সমকক্ষ কেউ আছে কি?’’ (সূরা মারইয়াম: ৬৫)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,﴿وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ﴾ ‘‘তার সমতুল্য কেউ নেই’’। (সূরা ইখলাস: ৪)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, ﴿فَلَا تَضْرِبُوا لِلَّهِ الْأَمْثَالَ﴾ ‘‘আল্লাহর জন্য দৃষ্টান্ত পেশ করো না’’। (সূরা নাহাল: ৭৪)
সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহর ছিফাতকে সৃষ্টির ছিফাতের সাথে তাশবীহ দিবে সে আল্লাহ তা‘আলার প্রকৃত ইবাদতকারী হিসাবে গণ্য হবে না। সে কেবল এমন মূর্তির পূজা করে, যাকে তার মনের কল্পনা আকৃতি প্রদান করেছে এবং তার অসুস্থ বিবেক রূপদান করেছে। সে মূলত মূর্তিপূজক, আল্লাহর ইবাদতকারী নয়। ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহ বলেন,
لسنا نشبه وصفه بصفاتنا ... إن المشبه عابد الأوثان
আমরা আল্লাহর ছিফাতকে আমাদের ছিফাতের সাথে তুলনা করিনা। নিশ্চয় যে ব্যক্তি স্রষ্টার ছিফাতকে সৃষ্টির ছিফাতের সাথে তুলনা করে সে কেবল মূর্তির ইবাদত করে। যে ব্যক্তি আল্লাহর ছিফাতসমূহকে তার সৃষ্টির ছিফাতের সাথে তাশবীহ দেয়, সে ঐসব খ্রিষ্টানদের অন্তর্ভুক্ত, যারা ঈসা ইবনে মারইয়াম আলাইহিস সালামের ইবাদত করে। ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহ আরো বলেন,
من مثل الله العظيم بخلقه ... فهو النسيب لمشرك نصراني
যে ব্যক্তি মহান আল্লাহকে তার সৃষ্টির সাথে তুলনা করে, সে খৃষ্টান মুশরেকের কুটুম্ব।
ইমাম বুখারীর উস্তাদ নাঈম ইবনে হাম্মাদ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলাকে সৃষ্টির সাথে তাশবীহ দিলো, সে কুফুরী করলো। আল্লাহ তা‘আলা যা দিয়ে নিজেকে কিংবা তার রসূল তাকে যা দিয়ে বিশেষিত করেছেন, যে তা নাকোচ করলো, সেও কুফুরী করলো। আর আল্লাহ তা‘আলা নিজেকে যে বিশেষণে বিশেষিত করেছেন অথবা তার রসূল তাকে যা দ্বারা বিশেষিত করেছেন, তাতে কোনো তাশবীহ নেই।
(২) মুআত্তেলা (المعطلة): আল্লাহ তা‘আলা তার পবিত্র সত্তাকে যেসব পূর্ণতার গুণাবলী দ্বারা বিশেষিত করেছেন অথবা তার রসূল তাকে পূর্ণতার যেসব ছিফাত দ্বারা গুণান্বিত করেছেন, যারা সেগুলো অস্বীকার করে তারাই মুআত্তেলা। তাদের ধারণা হলো আল্লাহর জন্য ছিফাত সাব্যস্ত করা হলে তাশবীহ ও তাজসীম তথা সৃষ্টির সাথে তার সাদৃশ্য এবং তার জন্য দেহ সাব্যস্ত হওয়া আবশ্যক হয়। এরা মুশাবেবহাদের সম্পূর্ণ বিপরীত।
ইয়াহূদীদের অনুসারী, মুশরেক এবং পথভ্রষ্ট বে-দীনদের থেকে আল্লাহ তা‘আলার ছিফাত অস্বীকার করার মাযহাব এসেছে। হিজরী দ্বিতীয় শতকের গোড়ার দিকে জা’দ ইবনে দিরহাম সর্বপ্রথম মুসলিম জাতির মধ্যে তা’তীল তথা আল্লাহর ছিফাত অস্বীকার করার মাযহাব প্রচার করে। তার থেকে এ মাযহাব গ্রহণ করে নিকৃষ্ট জাহাম ইবনে সাফওয়ান এবং তা প্রকাশ্যে প্রচার ও প্রসার ঘটায়। জাহাম ইবনে সাফওয়ানের দিকেই জাহমীয়া মাযহাবের সম্বন্ধ করা হয়। অতঃপর মু‘তাযিলা ও আশআরীগণ এ মাযহাব গ্রহণ করে।
এ হলো তাদের মাযহাবের সনদ। তাদের মাযহাবের সনদের গোড়ার দিকে রয়েছে ইয়াহূদী, বে-দীন, মুশরেক এবং দার্শনিক। মুআত্তেলারা বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত। জাহমীয়ারা এক বাক্যে আল্লাহর অতি সুন্দর নাম ও সুউচ্চ ছিফাতসমূহ অস্বীকার করে। মু‘তাযিলারা আল্লাহ তা‘আলার শুধু নামগুলো সাব্যস্ত করে। তবে তারা এ নামগুলোর মধ্যে যেসব সুমহান অর্থ রয়েছে তা অস্বীকার করে এবং তারা আল্লাহ তা‘আলার সমস্ত ছিফাত অস্বীকার করে। ঐদিকে আশায়েরাগণ আল্লাহ তা‘আলার অতি সুন্দর নামগুলো এবং মাত্র সাতটি ছিফাত সাব্যস্ত করে। আশআরীগণ যেসব ছিফাত সাব্যস্ত করে, তা হলো, الحياة (আল্লাহর জীবন) العلم (তার জ্ঞান), الإرادة (তার ইচ্ছা),القدرة (তার ক্ষমতা), السمع (তার শ্রবণ), البصر (তার দৃষ্টি) এবং الكلام (তার কথা)। বাকী ছিফাতগুলো তারা নাকোচ করে অথবা তাবীল করে।
আল্লাহ তা‘আলার ছিফাত নাকোচ করার ক্ষেত্রে জাহমীয়া, মু‘তাযিলা ও আশায়েরাদের দলীল হলো, তাদের মতে আল্লাহ তা‘আলার জন্য ছিফাত সাব্যস্ত করা হলে তাশবীহ ও তাজসীম আবশ্যক হয়। অর্থাৎ সৃষ্টির সাথে স্রষ্টার সাদৃশ্য হয়ে যায় এবং স্রষ্টার জন্য দেহ সাব্যস্ত করা আবশ্যক হয়। তাদের মতে দেহ বিশিষ্ট সৃষ্টিই কেবল এসব ছিফাত দ্বারা বিশেষিত হয়।
আল্লাহ তা‘আলার ব্যাপারে কথা হলো, ﴿لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ﴾ ‘‘তার সদৃশ কোনো কিছুই নেই’’। সুতরাং তাদের মতে আল্লাহর ছিফাত নাকোচ করা আবশ্যক এবং সৃষ্টির সাথে তার সাদৃশ্য হওয়ার ধারণা থেকে তাকে পবিত্র রাখার জন্য তাকে ছিফাতশূণ্য রাখা জরুরী। এ জন্যই তারা আল্লাহ তা‘আলার সুমহান ছিফাতগুলো সাব্যস্ত কারীদেরকে জাহমীয়ারা মুশাবেবহা বলে নামকরণ করে।
কুরআন-সুন্নাহর যেসব বক্তব্য আল্লাহর ছিফাত সাব্যস্ত করে, সে ব্যাপারে তাদের দুই ধরনের মত রয়েছে।
প্রথম মত: ছিফাত সংক্রান্ত বক্তব্যগুলোর শব্দগুলোর প্রতি তারা ঈমান আনয়ন করে থাকে এবং শব্দগুলোর অর্থসমূহ আল্লাহর নিকট সোপর্দ করে দেয়। তারা এগুলোর ব্যাখ্যা করা থেকে বিরত থাকে এবং আল্লাহর নিকট এগুলোর ব্যাখ্যা সোপর্দ করে দেয়। সেই সঙ্গে ছিফাতগুলো সেসব অর্থ প্রদান করে সেগুলোর কিছুই আল্লাহ তা‘আলার জন্য সাব্যস্ত করে না। তারা এই পদ্ধতিকেই সালাফদের তরীকা মনে করে এবং বলে এটিই সর্বাধিক বিশুদ্ধ তরীকা।
দ্বিতীয় মত: ছিফাত সংক্রান্ত বক্তব্যগুলোকে সেটার সঠিক অর্থ থেকে সরিয়ে ফেলে অন্যান্য এমন অর্থে ব্যাখ্যা করা, যা তারা নিজেদের পক্ষ থেকে আবিষ্কার করেছে। এটিকে তারা তাবীল বা ব্যাখ্যা হিসাবে নামকরণ করে থাকে এবং খালাফ তথা পরবর্তীদের তরীকা বলে থাকে। তারা এ তরীকাকে সর্বাধিক প্রজ্ঞাপূর্ণ বলে থাকে।
তাদের উপরোক্ত দলীলের জবাব:
সন্দেহাতীতভাবেই কুরআনুল কারীম সৃষ্টির মধ্যে আল্লাহ তা‘আলার সদৃশ ও উপমা থাকার কথা নাকোচ করেছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ﴿لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ﴾ ‘‘তার সদৃশ কোনো কিছুই নেই। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’’। (সূরা শুরা: ১১) আল্লাহ তা‘আলা বলেন,﴿هَلْ تَعْلَمُ لَهُ سَمِيًّا﴾ ‘‘তোমার জানা মতে তার সমকক্ষ কোন সত্তা আছে কি’’? (সূরা মারইয়াম: ৬৫)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, ﴿وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ﴾ ‘‘এবং তার সমতুল্য কেউ নেই’’। (সূরা ইখলাস: ৪) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, ﴿فَلَا تَضْرِبُوا لِلَّهِ الْأَمْثَالَ﴾ ‘‘কাজেই আল্লাহর জন্য দৃষ্টান্ত পেশ করো না’’। (সূরা নাহাল: ৭৪) তবে সৃষ্টির সাথে আল্লাহ তা‘আলার সাদৃশ্য নাকোচ করার সাথে সাথে তিনি তার নিজের সত্তার জন্য পূর্ণতার গুণাবলী সাব্যস্ত করেছেন।
যেমন তিনি বলেছেন, ﴿لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ﴾ ‘‘তার সদৃশ কোনো কিছুই নেই। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’’। এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা দু’টি বিষয় একসাথে একত্র করেছেন। তিনি নিজের সত্তা থেকে তাশবীহ নাকোচ করেছেন এবং একই সঙ্গে তিনি নিজের জন্য দু’টি ছিফাত তথা শ্রবণ ও দৃষ্টি সাব্যস্ত করেছেন। এতে প্রমাণিত হলো যে, আল্লাহ তা‘আলার জন্য ছিফাত সাব্যস্ত করা হলেই তিনি সৃষ্টির সদৃশ হয়ে যান না কিংবা সৃষ্টির সাথে তার তুলনা হয়ে যায় না। কেননা ছিফাত সাব্যস্ত করার জন্য তাশবীহ দেয়া আবশ্যক নয়। অর্থাৎ সাব্যস্ত করা এবং সাদৃশ্য করা একই বিষয় নয়।
অনুরূপ আমরা কুরআনুল কারীমের অনেক আয়াতে দেখতে পাই যে, সৃষ্টির সাথে আল্লাহ তা‘আলার সাদৃশ্য নাকোচ করার পাশাপাশি তার জন্য পূর্ণতার গুণাবলী সাব্যস্ত করা হয়েছে। এটিই হলো সালাফদের মাযহাব। তারা আল্লাহ তা‘আলার জন্য ছিফাত সাব্যস্ত করেন এবং তার থেকে তাশবীহ এবং দৃষ্টান্ত-উপমা-উদাহরণ নাকোচ করেন। অর্থাৎ সৃষ্টির মধ্যে তার কোনো সদৃশ, দৃষ্টান্ত, উপমা, উদাহরণ ও সমকক্ষ নেই।
যারা মনে করে আল্লাহর জন্য ছিফাত সাব্যস্ত করা শোভনীয় নয়, কারণ ছিফাত সাব্যস্ত করা হলে সৃষ্টির সাথে স্রষ্টার তাশবীহ আবশ্যক হয়, তাদের বোধশক্তির মধ্যে ত্রুটি রয়েছে। এ ত্রুটিযুক্ত বোধশক্তিও তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলার ছিফাত অস্বীকার করার দিকে টেনে নিয়েছে। অপূর্ণ বোধশক্তির কারণেই তারা বুঝেছে যে, আল্লাহ তা‘আলার জন্য ছিফাত সাব্যস্ত করলে তাশবীহ আবশ্যক হয়ে যায়। এই অপূর্ণ বোধশক্তি ও ভুল ধারণাই তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলার ঐসব ছিফাতকে অস্বীকারের দিকে নিয়ে গেছে, যা তিনি তার নিজের সত্তার জন্য সাব্যস্ত করেছেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, এসব মূর্খ প্রথমত আল্লাহর ছিফাতকে সৃষ্টির ছিফাতের সাথে তুলনা করেছে দ্বিতীয়তঃ তার ছিফাতকে অস্বীকার করেছে। তারা প্রথম ও শেষ উভয় পর্যায়ে আল্লাহ তা‘আলার শানে অশোভনীয় অন্যায় কথা বলেছে। তাদের অন্তরগুলো যদি তাশবীহর আবর্জনা থেকে পবিত্র হতো, তাহলে সহজেই বুঝতে পারতো যে, আল্লাহ তা‘আলার ছিফাতগুলো পূর্ণতা ও মহত্ত্বের এমন উচ্চ শিখরে, যা স্রষ্টার ছিফাত ও সৃষ্টির ছিফাতের মধ্যে সাদৃশ্য ও সম্পর্ক থাকার ধারণাকে সম্পূর্ণরূপে নাকোচ করে দেয়।
সুতরাং যার অন্তর পবিত্র হবে, সে আল্লাহ তা‘আলার ছিফাতগুলোর প্রতি শোভনীয় পদ্ধতিতে ঈমান আনয়নের জন্য সম্পূর্ণরূপে প্রস্ত্তত থাকবে। ঐ দিকে অন্তর অসুস্থ থাকার কারণে যে ব্যক্তি ধারণা করে আল্লাহর ছিফাতগুলো সৃষ্টির ছিফাতের মতোই সে আল্লাহকে যথাযথভাবে চিনতে পারেনি এবং তার যথাযথ কদরও করতে পারেনি। অসুস্থ অন্তরের লোকেরাই আল্লাহর ছিফাতগুলো সৃষ্টির ছিফাতের মতো কল্পনা করেছে। এর ফলশ্রুতিতে তারা তার ছিফাতগুলো অস্বীকার করার সমস্যায় পড়েছে। অতঃপর তাদের অভ্যাস এ হয়েছে যে, যারাই কুরআন ও সহীহ সুন্নাহর আলোকে আল্লাহ তা‘আলার জন্য পূর্ণতার বিশেষণগুলো সাব্যস্ত করে এবং তার পবিত্র সত্তা থেকে অপূর্ণতার বিশেষণগুলো নাকোচ করে, তাদেরকে তারা মুশাবেবহা ও মুজাস্সেমা বলে গালি দেয়। কেননা তাদের অন্তরে একটি খারাপ ধারণা গেঁথে আছে যে, আল্লাহ তা‘আলার জন্য ছিফাত সাব্যস্ত করা হলে সৃষ্টির সাথে তাশবীহ হয়ে যায়। কারণ এগুলো সৃষ্টির মধ্যেও রয়েছে। এসব মূর্খ লোকেরা জানে না যে, সৃষ্টির মধ্যে যেসব দোষমুক্ত পূর্ণতার বিশেষ রয়েছে, স্রষ্টা তা দ্বারা বিশেষিত হওয়ার আরো বেশি হকদার। সুতরাং তারা স্রষ্টাকে প্রথমে সৃষ্টির সাথে তুলনা করেছে। অতঃপর যখন দেখলো যে, এতে করে স্রষ্টা আর সৃষ্টি একরকম হয়ে যায়, তাই তারা তাশবীহ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় স্রষ্টার ছিফাতকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করেছে।
জাহমীয়া ও তাদের যেসব শিষ্য মনে করে আল্লাহ তা‘আলার জন্য ছিফাত সাব্যস্ত করা হলে স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির তাশবীহ হয়ে যায়, তাদের জবাবে সুন্নাতের সাহায্যকারী ইমামদের ইমাম আবু বকর মুহাম্মাদ ইবনে খুযায়মা রাহিমাহুল্লাহ যা বলেছেন, আমরা সংক্ষিপ্তভাবে তা এখানে উল্লেখ করছি। তিনি বলেন, অভিশপ্ত জাহমীয়ারা বলে থাকে, সুন্নাতের অনুসরণকারী আহলুস্ সুন্নাতের যেসব লোক দাবি করে যে, তারা তাদের রবের কিতাব ও নবীর সুন্নাত মোতাবেক আল্লাহ তা‘আলার জন্য ঐসব ছিফাত সাব্যস্ত করেন, যা দ্বারা তিনি নিজেকে কুরআনুল কারীমে বিশেষিত করেছেন এবং যা দ্বারা তার নবী মোস্তফা ন্যায়পরায়ন রাবীদের মুত্তাসেল সনদে বর্ণিত হাদীছে বিশেষিত করেছেন তারা মুশাবেবহা। আমাদের কিতাব ও আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাত সম্পর্কে জাহমীয়াদের অজ্ঞতা থাকার কারণে এবং আরবদের ভাষা সম্পর্কে তাদের জ্ঞানের স্বল্পতার কারণেই উপরোক্ত কথা বলেছে।
ইমাম ইবনে খুজায়মা রাহিমাহুল্লাহ আরো বলেন, আমরা এবং পৃথিবীর সমস্ত প্রামেত্ম আমাদের আলেমগণ বলেছেন যে, আল্লাহ তা‘আলা তার নির্ভুল কিতাবে আমাদেরকে জানিয়েছেন যে, তার চেহারা রয়েছে। অতঃপর সেই চেহারাকে বিশেষিত করা হয়েছেذُوالْجَلَالِ والإكرام ‘‘মহিয়ান ও দয়াবান’’ -এ দু’টি বিশেষণের মাধ্যমে। অতঃপর চেহারাকে অবিনশ্বর বিশেষণ প্রদান করা হয়েছে এবং সেটা কখনো ধ্বংস হবে না বলে ঘোষণা করা হয়েছে। আমরা আরো বলি, আমাদের রবের চেহারার এমন আলো, জ্যোতি এবং উজ্জ্বলতা রয়েছে, যার পর্দা উন্মুক্ত করা হলে তার চেহারার আলো যতোদূর পৌঁছাবে ততোদূরের সবকিছুকে জ্বালিয়ে ফেলবে।
আমরা আরো বলি, বনী আদমের এমন চেহারা রয়েছে, যার জন্য আল্লাহ তা‘আলা ধ্বংস নির্ধারণ করে রেখেছেন। বনী আদমের চেহারার অস্তিত্ব এক সময় বিদ্যমান ছিলনা, পরে সৃষ্টি করা হয়েছে। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা অস্তিত্বহীনতা থেকে অস্তিত্বে আনয়ন করেছেন। সমস্ত বনী আদমের সমস্ত চেহারা ধ্বংসশীল, এগুলোর কোনো স্থায়িত্ব নেই। সমস্ত বনী আদম মারা যাবে অতঃপর ক্ষয়প্রাপ্ত হবে ও পঁচে যাবে। অতঃপর পঁচে-গলে শেষ হয়ে যাওয়ার পর আল্লাহ তা‘আলা নতুনভাবে সৃষ্টি করবেন। তখন কেউ যাবে জান্নাতের নেয়ামতে আবার কেউ যাবে জাহান্নামের আযাবে।
সুতরাং হে জ্ঞানী সম্প্রদায়! যে জ্ঞানবান লোক আরবদের ভাষা বুঝে, আরবী ভাষার সম্বোধন বুঝে এবং এক জিনিসকে অন্য জিনিষের সাথে সাদৃশ্য দেয়ার বিভিন্ন নিয়ম-কানুন ও রীতি-নীতি বুঝে, তার অন্তরে কিভাবে এ ধারণা উদয় হতে পারে যে, আল্লাহর জন্য চেহারা সাব্যস্ত করা হলে তার অনন্ত-অবিনশ্বর ও চিরস্থায়ী চেহারা সৃষ্টির ধ্বংসশীল চেহারার সদৃশ হয়ে যায়?
হে জ্ঞানী সম্প্রদায়! আল্লাহর কিতাব ও রসূলের সুন্নাতের দলীলের মাধ্যমে আমাদের মহান প্রভুর চেহারার যে বিশেষণ আমরা বর্ণনা করলাম, তা কি বনী আদমের ঐসব চেহারার অনুরূপ হতে পারে, যার বিবরণ উপরে প্রদান করা হয়েছে?
আল্লাহ তা‘আলার চেহারা সাব্যস্ত করা থেকে যদি আমাদের আলেমগণ এটি বুঝতেন যে, তার চেহারা বনী আদমের চেহারার মতোই, তাহলে প্রত্যেকের জন্য এ কথা বলা বৈধ হতো যে, বনী আদমের যেহেতু চেহারা আছে এবং শুকর, বানর, হিংস্র জীব-জন্তু, গাধা, খচ্চর, সাপ-বিচ্ছু ও কীট-পতঙ্গেরও যেহেতু চেহারা আছে, তাই বনী আদমের চেহারাসমূহ শুকর, বানর, কুকুর এবং অন্যান্য জীব-জন্তুর চেহারার মতোই। আমি মনে করি আল্লাহর ছিফাত অস্বীকারকারী জাহমীয়াদের কারো নিকট যদি তার সর্বাধিক প্রিয় ব্যক্তিও বলে যে, তোমার চেহারাটি শুকর, বানর, কুকুর, গাধা কিংবা খচ্চর কিংবা অন্য কোনো প্রাণীর চেহারার মতোই, তাহলে সে অবশ্যই রাগ করবে।
ইমাম ইবনে খুযায়মা রাহিমাহুল্লাহ আরো বলেন, আমাদের উপরোক্ত আলোচনা থেকে আলেমদের নিকট সাব্যস্ত হলো, যারা আল্লাহর কিতাব ও রসূলের সুন্নাতের অনুসারীদেরকে মুশাবেবহা বলে গালি দেয়, তারা বাতিল, মিথ্যা এবং অন্যায় কথা বলে। সেই সঙ্গে তারা আল্লাহর কিতাব, রসূলের সুন্নাত এবং আরবদের ভাষার দাবি বহির্ভুত কথাও বলে।
ইমাম ইবনে খুযায়মা রাহিমাহুল্লাহ আরো বলেন, আল্লাহ তা‘আলা তার নির্ভুল কিতাবে নিজেকে যেসব বিশেষণে বিশেষিত করেছেন এবং তার রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সহীহ সুন্নাতে তার প্রভুর যেসব গুণাবলী বর্ণনা করেছেন, জাহমীয়াদের মুআত্তেলা সম্প্রদায় তার প্রত্যেকটিই অস্বীকার করে। ইসলামী শরী‘আত সম্পর্কে অজ্ঞতা তাদেরকে এটি করতে প্রেরণা দিয়েছে। এর কারণ হলো তারা কুরআনুল কারীমে পেয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলা তার নিজের নাম ও ছিফাতসমূহ থেকে কিছু কিছু নাম ও ছিফাত দ্বারা কতিপয় সৃষ্টিকে বিশেষিত করেছেন। তাই মূর্খতার কারণে তারা ধারণা করেছে, যারা উক্ত বিশেষগুণগুলো দ্বারা আল্লাহ তা‘আলাকে বিশেষিত করলো, সে তাকে সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্য প্রদান করলো!! হে জ্ঞানী সম্প্রদায় আপনারা এ জাহমীয়াদের মূর্খতার প্রতি খেয়াল করুন।
গ্রন্থকার বলেন, আল্লাহ তা‘আলা তার কিতাবের অনেক স্থানে নিজেকে বিভিন্ন বিশেষণে বিশেষিত করেছেন। তিনি তার বান্দাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন যে,﴿وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ﴾ ‘‘তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’’। আল্লাহ তা‘আলা মানুষের বিশেষণ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ﴿فَجَعَلْنَاهُ سَمِيعًا بَصِيرًا﴾ ‘‘আমি তাকে শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তির অধিকারী করেছি’’। (সূরা ইনসান: ২)
আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে আরো জানিয়েছেন যে, তিনি দেখেন। যেমন তিনি বলেন,﴿وَقُلِ اعْمَلُوا فَسَيَرَى اللَّهُ عَمَلَكُمْ وَرَسُولُهُ وَالْمُؤْمِنُونَ﴾ ‘‘আর হে নবী! তাদেরকে বলো, তোমরা আমল করতে থাকো। আল্লাহ, তার রসূল ও মুমিনগণ তোমাদের আমল দেখবেন’’।
আল্লাহ তা‘আলা মূসা ও হারুনকে উদ্দেশ্য করে আরো বলেছেন, ﴿ لَا تَخَافَا إِنَّنِي مَعَكُمَا أَسْمَعُ وَأَرَىٰ﴾ ‘‘ভয় করো না, আমি তোমাদের সাথে আছি, সবকিছু শুনছি ও দেখছি’’। (সূরা তোহা: ৪৬) আল্লাহ তা‘আলা এখানে সংবাদ দিয়েছেন যে, তিনি বনী আদমের আমলসমূহ দেখেন এবং তার রসূল মানুষ হওয়া সত্ত্বেও মানুষের আমলসমূহ দেখেন। আল্লাহ আরো বলেন,
﴿أَلَمْ يَرَوْا إِلَى الطَّيْرِ مُسَخَّرَاتٍ فِي جَوِّ السَّمَاءِ مَا يُمْسِكُهُنَّ إِلَّا اللَّهُ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ﴾
‘‘এরা কি পাখিদের দেখেনি, আকাশে কিভাবে তারা নিয়ন্ত্রিত রয়েছে? আল্লাহ ছাড়া কে তাদেরকে ধরে রেখেছে? এর মধ্যে মুমিনদের জন্য বহু নিদর্শন রয়েছে’’। (সূরা নাহাল: ৭৯)
সুতরাং বনী আদম দেখতে পায় যে পাখিরা আকাশে বশীভূত রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, ﴿وَاصْنَعِ الْفُلْكَ بِأَعْيُنِنَا﴾ ‘‘তুমি আমার চোখের সামনে ও আমার অহী অনুযায়ী নৌকা বানাও’’। (সূরা হুদ: ৩৭) আল্লাহ তা‘আলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে লক্ষ্য করে বলেন,
﴿وَاصْبِرْ لِحُكْمِ رَبِّكَ فَإِنَّكَ بِأَعْيُنِنَا وَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ حِينَ تَقُومُ﴾
‘‘হে নবী! তোমার রবের ফায়ছালা আসা পর্যন্ত ধৈর্য ধারণ করো। নিশ্চয়ই তুমি আমার চোখে চোখেই আছো। তুমি যখন উঠবে তখন তোমার রবের প্রশংসাসহ তাসবীহ পাঠ করো’’। (সূরা তূর: ৪৮) আল্লাহ তা‘আলা তার নিজের সত্তার জন্য চোখ সাব্যস্ত করেছেন এবং বনী আদমের জন্যও চোখ সাব্যস্ত করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَإِذَا سَمِعُوا مَا أُنزِلَ إِلَى الرَّسُولِ تَرَىٰ أَعْيُنَهُمْ تَفِيضُ مِنَ الدَّمْعِ مِمَّا عَرَفُوا مِنَ الْحَقِّ يَقُولُونَ رَبَّنَا آمَنَّا فَاكْتُبْنَا مَعَ الشَّاهِدِينَ﴾
‘‘যখন তারা রসূলের উপর অবতীর্ণ কালাম শুনতে পায় তখন তুমি দেখতে পাও যে, সত্যকে চিনতে পারার কারণে তাদের চোখসমূহ অশ্রম্নবিগলিত হয়ে ওঠে। তারা বলে, হে আমাদের রব! আমরা ঈমান এনেছি, সাক্ষ্যদাতাদের মধ্যে আমাদের নাম লিখে নাও’’। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে সংবাদ দিয়েছেন যে, তার চোখ রয়েছে। বনী আদমেরও চোখ রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা অভিশপ্ত ইবলীস সম্পর্কে বলেন,
﴿ مَا مَنَعَكَ أَنْ تَسْجُدَ لِمَا خَلَقْتُ بِيَدَيَّ أَاسْتَكْبَرْتَ أَمْ كُنتَ مِنْ الْعَالِينَ﴾
‘‘হে ইবলীস! যাকে আমি নিজের দুই হাতে সৃষ্টি করেছি তার সম্মুখে সেজদা করতে তোমাকে কিসে বাধা দিল? তুমি কি অহংকার করলে? না তুমি তার চেয়ে উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন?’’ (সূরা সোয়াদ: ৭৫) আল্লাহ আরো বলেন,
﴿وَقَالَتْ الْيَهُودُ يَدُ اللَّهِ مَغْلُولَةٌ غُلَّتْ أَيْدِيهِمْ وَلُعِنُوا بِمَا قَالُوا بَلْ يَدَاهُ مَبْسُوطَتَانِ يُنفِقُ كَيْفَ يَشَاءُ﴾
‘‘আর ইয়াহূদীরা বলে, আল্লাহর হাত বাঁধা হয়ে গেছে। তাদের হাতই বাঁধা হয়ে গেছে। এ কথা বলার কারণে তাদের উপর অভিসম্পাত করা হয়েছে; বরং তার উভয় হস্ত সদা উন্মুক্ত। তিনি যেভাবে ইচ্ছা ব্যয় করেন’’। (সূরা মায়িদা: ৬৪)
আল্লাহ তা‘আলা এখানে তার নিজের জন্য দু’টি হাত সাব্যস্ত করেছেন। তিনি আরো সংবাদ দিয়েছেন যে, বনী আদমেরও দু’টি হাত রয়েছে। এ থেকে কোনোভাবেই তাশবীহ আবশ্যক হয় না। আল্লাহর জন্য রয়েছে তার বড়ত্ব ও মর্যাদা অনুযায়ী শোভনীয় হাত। সৃষ্টির জন্যও রয়েছে শোভনীয় ও মানানসই হাত।
সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা তার নিজের সত্তার জন্য যা সাব্যস্ত করেছেন, তা সাব্যস্তকারীকে স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির সাদৃশ্য প্রদানকারী হিসাবে নামকরণ করা ফাসেক জাহমীয়াদের জন্য কিভাবে বৈধ হতে পারে। ইমাম ইবনে খুযায়মা রাহিমাহুল্লাহর বক্তব্য এখানেই শেষ। ইমাম ইবনে খুযায়মা রাহিমাহুল্লাহ এভাবেই জাহমীয়া ও তাদের শিষ্যদের জবাব দিয়ে তাদেরকে নির্বাক করে দিয়েছেন। এর কোনো জবাব তারা দিতে পারেনি। ইমাম ইবনে তাইমীয়া এবং ইমাম ইবনুল কাইয়্যিমের মত আরো বিজ্ঞ ইমাম তাদের প্রতিবাদ করেছেন। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের ইমামগণ এখনো তাদের বিদআতগুলোর জবাব দিয়ে যাচ্ছেন।
জাহমীয়া, আশায়েরা এবং অন্যান্যদের প্রতিবাদে শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহ যা বলেছে আমরা এখন তা থেকে কিছু নমুনা আপনাদের সামনে তুলে ধরছি। এরা মনে করেছে যে আল্লাহ তা‘আলার ছিফাতের ব্যাপারে কুরআন ও হাদীছের যেসব বক্তব্য রয়েছে তা ঐসব মুতাশাবেহার অন্তর্ভুক্ত, যার ইলম কেবল আল্লাহর নিকটই রয়েছে। তিনি ব্যতীত অন্য কেউ এগুলোর অর্থ জানে না। তাদের মতে এসব বক্তব্যের বাহ্যিক অর্থ উদ্দেশ্য নয়। এগুলোর বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করতে গেলে তাশবীহ হয়ে যায়। তাই এগুলোর এমন অর্থ রয়েছে, যা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই জানেন। এ কারণেই তারা এগুলোর অর্থ বর্ণনা না করে আল্লাহর নিকট সোপর্দ করে দেয় এবং মনে করে এটিই সালাফদের পদ্ধতি। মূলতঃ তারা সালাফদের নামে মিথ্যা বলছে। তারা সালাফদের প্রতি এমন কথার সম্বন্ধ করছে, যা থেকে তারা সম্পূর্ণ পবিত্র। কেননা তাদের আকীদা হলো আল্লাহর সম্মানিত কিতাব ও রসূলের পবিত্র সুন্নাতে তার ছিফাতগুলো যেভাবে বর্ণিত হয়েছে সেভাবেই সাব্যস্ত করা। এগুলো বাহ্যিক অর্থেই সাব্যস্ত করা। আল্লাহ তা‘আলার জন্য শোভনীয় পদ্ধতিতেই তারা এগুলোর ব্যাখ্যা করেন। তারা এগুলোর অর্থ আল্লাহর নিকট সোপর্দ করে দেন না। বরং তাদের মতে আল্লাহ তা‘আলার ছিফাত সংক্রান্ত বক্তব্যগুলো মুহকাম আয়াতের অন্তর্ভুক্ত; মুতাশাবেহার অন্তর্ভুক্ত নয়।
ইমাম ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহ আরো বলেন, আল্লাহ তা‘আলার ছিফাত অস্বীকার নাকোচকারী প--তদের মতে আল্লাহ তা‘আলার ছিফাত সংক্রান্ত বিষয়গুলোর অর্থ আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ জানে না। তারা আরো বলে এগুলোর যে অর্থ আল্লাহ তা‘আলা উদ্দেশ্য করেছেন, তা হলো এগুলোর বাহ্যিক অর্থ পরিহার করে অন্য অর্থে ব্যাখ্যা করা। তাদের কথার অর্থ থেকে আবশ্যক হয় যে, নবী-রসূলগণ তাদের উপর আল্লাহর পক্ষ হতে অবতীর্ণ কিতাবের অর্থ জানতেন না। আল্লাহ তা‘আলার ফেরেশতাগণ এবং উম্মতের প্রথম যুগের সম্মানিত সাহাবীগণও জানতেন না। সুতরাং তাদের কথা মত আল্লাহ তা‘আলা কুরআনুল কারীমে যেসব বিশেষণে নিজেকে বিশেষিত করেছেন তার নবী তা বুঝতেন না অথবা অন্যান্য নবীগণ আল্লাহ তা‘আলার ছিফাত সংক্রান্ত বক্তব্যগুলো বুঝতেন না। নবীগণ এমন কথা বলতেন, যা তারা নিজেরাই বুঝতেন না।
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া তাদের জবাবে বলেন, নিঃসন্দেহে এটি কুরআন ও নবীদের ব্যাপারে মিথ্যা অপবাদ দেয়ার শামিল। কেননা আল্লাহ তা‘আলাই কুরআন অবতীর্ণ করেছেন। তিনি তাতে সংবাদ দিয়েছেন যে, কুরআন হলো মানুষের জন্য হিদায়াত ও সুস্পষ্ট বর্ণনা স্বরূপ। তিনি রসূলকে মানুষের নিকট কুরআনের বাণী সুস্পষ্টরূপে পৌঁছে দেয়ার আদেশ করেছেন এবং তিনি যা তাদের জন্য নাযিল করেছেন, তা মানুষের জন্য খোলাখুলিভাবে বর্ণনা করার আদেশ করেছেন। তিনি কুরআন নিয়ে গবেষণা করা ও তা হৃদয়ঙ্গম করার আদেশ দিয়েছেন। সেই সঙ্গে তিনি কুরআনে তার সুউচ্চ গুণাবলী সম্পর্কে সংবাদ দিয়েছেন। তিনি সংবাদ দিয়েছেন যে, তিনিই সবকিছুর স্রষ্টা, তিনি সর্ববিষয়ে অবগত রয়েছেন, তিনি আদেশ দিয়েছেন, নিষেধ করেছেন, সৎ আমলের বিনিময়ে জান্নাতের ওয়াদা-অঙ্গীকার করেছে, পাপাচারীদেরকে ভীতি প্রদর্শন করেছেন এবং আখেরাত দিবস সম্পর্কে বিভিন্ন সংবাদ দিয়েছেন। সুতরাং কিভাবে এমন ধারণা পোষণ করা যেতে পারে যে, কেউ এগুলোর অর্থ জানে না!! কিভাবে বলা যেতে পারে যে, কুরআন বুঝা সম্ভব নয়, তাতে চিন্তা-গবেষণা করা সম্ভব নয়, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর মানুষের জন্য যা নাযিল করা হয়েছে তার বর্ণনা দেননি এবং তা সুস্পষ্টরূপে বর্ণনাও প্রদান করেননি।
যারা বলে সালাফদের মতে আল্লাহ তা‘আলার অতি সুন্দর নাম ও সুউচ্চ গুণাবলী অথবা তার কিয়দাংশ ঐসব মুতাশাবেহার অন্তর্ভুক্ত, যার ইলম একমাত্র আল্লাহর কাছেই রয়েছে, তাদের কথাকে নাকোচ করতে গিয়ে শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহ বলেন, সালাফগণ এ কথা বলেছেন তার দলীল কী? আমি জানিনা এ উম্মতের কোনো সালাফ কিংবা কোনো ইমাম যেমন আহমাদ ইবনে হাম্বল কিংবা অন্য কোনো ইমাম থেকে এ কথা বর্ণিত হয়নি যে, তারা ছিফাত সংক্রান্ত আয়াতগুলোকে মুতাশাবেহার অন্তর্ভুক্ত মনে করেছেন। তারা ছিফাত সংক্রান্ত আয়াতগুলোকে সূরা আল-ইমরানের ৭ নং আয়াতের অন্তর্ভুক্ত মনে করেননি, যেখানে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿هُوَ الَّذِي أَنْزَلَ عَلَيْكَ الْكِتَابَ مِنْهُ آيَاتٌ مُحْكَمَاتٌ هُنَّ أُمُّ الْكِتَابِ وَأُخَرُ مُتَشَابِهَاتٌ﴾
‘‘তিনিই তোমার প্রতি কিতাব নাযিল করেছেন। তাতে কিছু আয়াত রয়েছে মুহকাম (সুস্পষ্ট), সেগুলোই কিতাবের আসল অংশ। আর অন্যগুলো মতাশাবেহ (অস্পষ্ট)’’ (সূরা আলে ইমরান ৩:৭)। এখানে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন যে, তিনি ছাড়া অন্য কেউ মুতাশাবেহ আয়াতের অর্থ জানে না। জাহমীয়া এবং তাদের শিষ্যরা আল্লাহ তা‘আলার অতি সুন্দর নামসমূহ এবং সুউচ্চ ছিফাতগুলোকে অনারবদের ঐসব কালামের মধ্যে গণ্য করেছে, যা বোধগম্য নয়।
আসল কথা হলো সালাফগণ আল্লাহ তা‘আলার অতি সুন্দর নাম ও সুউচ্চ ছিফাত সংক্রান্ত বক্তব্যের ব্যাখ্যায় এমন কথা বলেছেন, যার সঠিক অর্থ রয়েছে। ছিফাত সংক্রান্ত হাদীছগুলোর ক্ষেত্রে তারা বলেছেন, تمر كما جاءت ‘‘এগুলো যেভাবে এসেছে সেভাবেই রেখে দিতে হবে’’। একই সঙ্গে তারা জাহমীয়াদের তাবীলসমূহ গ্রহণ করা থেকে নিষেধ করেছেন, সেগুলোর প্রতিবাদ করেছেন এবং সেগুলোকে বাতিল বলে ঘোষণা করেছেন। জাহমীয়াদের তাবীলের সারসংক্ষেপ হলো, তারা ছিফাত সংক্রান্ত আয়াতগুলোর সঠিক অর্থকে বাতিল করে দেয়। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রাহিমাহুল্লাহ এবং তার পূর্বেকার ইমামদের সুস্পষ্ট বক্তব্য থেকে বুঝা যায় যে, তারা জাহমীয়াদের তাবীলসমূহকে বাতিল ঘোষণা করতেন। এ সংক্রান্ত বক্তব্যগুলো যে অর্থ বহন করে তারা সেগুলোকে অর্থসহ সাব্যস্ত করতেন। সুতরাং ইমামগণ ঐক্যমত পোষণ করেছেন যে, তারা ছিফাত সংক্রান্ত বক্তব্যগুলোর অর্থ জানতেন। এগুলোর অর্থ ও ব্যাখ্যা বর্ণনা করা থেকে তারা নিরব থাকতেন না। বরং ইমামদের ঐক্যমতে কোনো প্রকার তাহরীফ বা বক্তব্যগুলোকে তার সঠিক স্থান থেকে সরানো ছাড়াই তারা এগুলোর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতেন এবং তারা আল্লাহ তা‘আলার নাম ও গুণাবলীর ক্ষেত্রে বিকৃতি সাধন করা ব্যতীত সেটা তার জন্য সাব্যস্ত করতেন।
সালাফ এবং ইমামদের থেকে এ মাযহাবই শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া বর্ণনা করেছেন। তারা ছিফাত সংক্রান্ত বক্তব্যগুলোকে এমন মুতাশাবেহার অন্তর্ভুক্ত মনে করতেন না, যার অর্থ বোধগম্য নয় এবং যার কোনো অর্থ বর্ণনা করা ছাড়াই আল্লাহর নিকট সোপর্দ করে দেয়া আবশ্যক। বরং তারা এগুলোর অর্থ জানতেন এবং ব্যাখ্যা করতেন। তারা কেবল আল্লাহ তা‘আলার সিফাতে ধরণ, পদ্ধতি, কাইফিয়্যতের জ্ঞান আল্লাহ তা‘আলার নিকট সোপর্দ করে দিতেন। যেমন ইমাম মালেক (রহি.) বলেছেন, الاستواء معلوم والكيف مجهول والإيمان به واجب والسؤال عنه بدعة ‘আরশের উপরে আল্লাহর সমুন্নত হওয়া জানা বিষয়। এর পদ্ধতি কেউ অবগত নয়। তার উপর ঈমান আনয়ন করা ওয়াজিব। তবে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা বিদআত।[1] ইমাম ইবনে কাছীর রাহিমাহুল্লাহ বলেন, আল্লাহ তা‘আলার বাণী, ﴿ ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ ﴾ ‘‘অতঃপর দয়াময় আল্লাহ আরশের উপরে সমুন্নত হয়েছেন’’- এ সম্পর্কে লোকদের অনেক মতভেদ রয়েছে। সেগুলো বিস্তারিত আলোচনা করার স্থান এটি নয়। তবে এ ব্যাপারে আমরা সালাফে সালেহীন, ইমাম মালেক, আওযাঈ, লাইছ ইবনে সা’দ, ইমাম শাফেঈ, ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল, ইসহাক ইবনে রাহওয়াই এবং মুসলিম উম্মাহর পূর্ববর্তী ও সমসাময়িক অন্যান্য ইমামদের পথ অবলম্বন করবো। আল্লাহ তা‘আলার ছিফাত সংক্রান্ত আয়াত ও হাদীছগুলোর ব্যাপারে তাদের মাযহাব হলো, যেভাবে এগুলো এসেছে কোনো প্রকার ধরণ, পদ্ধতি-কায়া বর্ণনা করা, সৃষ্টির সাথে তাশবীহ দেয়া এবং বাতিল করা ছাড়া সেভাবেই রেখে দেয়া। মুশাবেবহাদের মস্তিস্কে এগুলোর বাহ্যিক যে তাশবীহর ধারণা প্রবেশ করে, তা আল্লাহ তা‘আলা থেকে সম্পূর্ণরূপে নাকোচ করতে হবে। কেননা সৃষ্টির কোনো কিছুই আল্লাহ তা‘আলার সাথে সাদৃশ্য রাখে না। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ﴾ ‘‘তার সদৃশ কোনো কিছুই নেই। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’’। (সূরা শুরা: ১১)
মুসলিমদের ইমামগণ একথাই বলেছেন। ইমাম বুখারীর উস্তাদ নুআইম ইবনে হাম্মাদ আল-খুযাঈ রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলাকে তার সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্য দিলো, সে কুফুরী করলো এবং আল্লাহ তা‘আলা যা দ্বারা নিজেকে বিশেষিত করেছেন, যে তা অস্বীকার করলো, সেও কুফুরী করলো। আর আল্লাহ তা‘আলা যা দ্বারা নিজেকে বিশেষিত করেছেন এবং তার রসূল যেসব বিশেষণ দ্বারা তার প্রভুকে বিশেষিত করেছেন, তাতে কোনো তাশবীহ বা সাদৃশ্য নেই। সুতরাং সুস্পষ্ট আয়াত ও সহীহ হাদীছে আল্লাহ তা‘আলার যেসব গুণাবলী বর্ণিত হয়েছে, যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার জন্য সেগুলোকে তার বড়ত্ব, শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার জন্য শোভনীয় পদ্ধতিতে সাব্যস্ত করলো এবং অপূর্ণতার বিশেষণগুলো তার থেকে নাকোচ করলো, সে হেদায়াতের পথেই চললো। ইমাম ইবনে কাছীরের বক্তব্য এখানেই শেষ।
আল্লাহ তা‘আলার অতি সুন্দর নামগুলো এবং তার সুউচ্চ ছিফাতগুলোর ক্ষেত্রে এ হলো সালাফদের মাযহাব। সৃষ্টির ছিফাতের সাথে তাশবীহ না দিয়ে এবং এগুলোর অর্থকে বাতিল না করে যেভাবে আল্লাহর কিতাব ও রসূলের সুন্নাতে এগুলো এসেছে,