আল্লাহ তা‘আলার অতি সুন্দর নাম ও সুউচ্চ গুণাবলীর ক্ষেত্রে নাজাতপ্রাপ্ত দল আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আকীদা হলো কুরআন ও সুন্নাহয় সেগুলো যেভাবে এসেছে সেভাবেই সাব্যস্ত করা। সেই সঙ্গে এগুলো যে অর্থ প্রদান করে তাও বিশ্বাস করা এবং তার বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করা।
আল্লাহ তা‘আলার জন্য অতি সুন্দর নাম ও সুউচ্চ ছিফাত সাব্যস্ত করলেই আল্লাহ তা‘আলাকে সৃষ্টির সাথে তুলনা হয়ে যায় না। কেননা স্রষ্টার ছিফাত তার জন্যই খাস এবং তার জন্যই শোভনীয়। আর সৃষ্টির ছিফাত সৃষ্টির জন্যই শোভনীয় এবং তার জন্যই খাস। স্রষ্টার ছিফাত ও সৃষ্টির ছিফাতের মধ্যে কোনো সাদৃশ্য নেই। যেমন নেই আল্লাহ তা‘আলার সত্তা এবং সৃষ্টির সত্তার মধ্যে কোনো প্রকার সাদৃশ্য। আল্লাহ তা‘আলার অতি সুন্দর নাম ও সুউচ্চ গুণাবলীর ক্ষেত্রে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মাযহাব সঠিক মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। আর এ মূলনীতিগুলো হচ্ছে,
প্রথমত মূলনীতি: আল্লাহ তা‘আলার অতি সুন্দর নামসমূহ ও সু্উচ্চ গুণাবলী তাওকীফি। অর্থাৎ তিনি তার নিজের সত্তার জন্য পবিত্র কুরআনে যেসব অতি সুন্দর নাম ও সুউচ্চ গুণাবলী সাব্যস্ত করেছেন অথবা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সহীহ সুন্নাতে তার প্রভুর জন্য যা সাব্যস্ত করেছেন, আহলে সুন্নাতের লোকেরা আল্লাহর জন্য কেবল তাই সাব্যস্ত করেন। তারা তাদের বিবেক-বুদ্ধি ও চিন্তা-ভাবনা-অনুমানের উপর ভিত্তি করে আল্লাহ তা‘আলার জন্য কিছুই সাব্যস্ত করেন না। সেই সঙ্গে তারা আল্লাহ তা‘আলার সত্তা থেকে কেবল সেটাই নাকোচ করেন যা আল্লাহ তা‘আলা তার কিতাবে নাকোচ করেছেন অথবা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার পবিত্র সুন্নাতে নাকোচ করেছেন। তারা তাদের বিবেক-বুদ্ধি ও চিন্তা-ভাবনা-অনুমানের উপর নির্ভর করে আল্লাহ তা‘আলা থেকে কিছুই নাকোচ করেন না। তারা সাব্যস্ত করণ কিংবা নাকোচ করণ, কোনো ক্ষেত্রেই কুরআন-সুন্নাহর সীমা লংঘণ করেন না। আর আল্লাহ তা‘আলার কিতাব যা নাকোচ কিংবা সাব্যস্ত কোনোটাই করেনি, তারা উপরোক্ত মূলনীতির উপর নির্ভর করে নীরবতা অবলম্বন করেন। যেমন যুক্তিবাদী ও দার্শনিকদের পরিভাষা জিসিম, আরয, জাওহার ইত্যাদি সম্পর্কে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের লোকেরা কিছুই বলেন না। কারণ কুরআন ও সুন্নাহয় আল্লাহ তা‘আলার সত্তার জন্য এগুলো সাব্যস্ত করা হয়নি এবং নাকোচও করা হয়নি।
দ্বিতীয় মূলনীতি: আল্লাহ তা‘আলা তার নিজের সত্তাকে যেসব পূর্ণতার বিশেষণ দিয়ে বিশেষিত করেছেন অথবা তার রসূল তাকে যে বিশেষণে বিশেষিত করেছেন তা সত্য এবং তা বাহ্যিক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এগুলো অনর্থক উল্লেখ করা হয়নি এবং এর মাধ্যমে মানুষকে ধাঁধায় ফেলা হয়নি; বরং মানুষ সাধারণ কথা বললে যেমন তার কথা বুঝা যায়, এগুলোর অর্থও সেরকম বুঝা যায়।
সুতরাং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের লোকেরা আল্লাহ তা‘আলার ছিফাত সমূহের শব্দ এবং সেটার অর্থ উভয়টিই সাব্যস্ত করেন। আল্লাহ তা‘আলা নিজেকে যা দ্বারা বিশেষিত করেছেন অথবা তার রসূল তাকে যা দ্বারা বিশেষিত করেছেন, তা ঐসব মুতাশাবেহ আয়াতের অন্তর্ভুক্ত নয়, যার শব্দগুলো সাব্যস্ত করে সেটার অর্থ আল্লাহর কাছে সোপর্দ করে দিতে হবে। কেননা আল্লাহর ছিফাত সংক্রান্ত আয়াতগুলোকে অবোধগম্য বক্তব্য হিসাবে গণ্য করা হলে আল্লাহর কালামকে অনারবদের ঐসব দুর্বোধ্য বক্তব্যের পর্যায়ে রাখা হয়ে যায়, যার অর্থ বুঝা যায় না।
আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে সমগ্র কুরআনের মধ্যে চিন্তা-গবেষণা করার আদেশ দিয়েছেন এবং তা ভালোভাবে উপলব্ধি করা ও বুঝার উৎসাহ দিয়েছেন। যদি বলা হয় যে, ছিফাত সংক্রান্ত বক্তব্যগুলো বোধগম্য নয়, তাহলে এমন ধারণার আশঙ্কা রয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে কুরআনে এমন বিষয়ে চিন্তা-গবেষণা করার আদেশ দিয়েছেন, যা নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করা সম্ভব নয় এবং এমন কিছু বুঝার উপদেশ দিয়েছেন, যা বুঝা অসম্ভব। সেই সঙ্গে আরো আবশ্যক হয় যে, আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে এমন বিষয়ে বিশ্বাস স্থাপন করতে বলেছেন, যা তিনি আমাদেরকে খোলাসা করে বলেন নি। তিনি এমন করার বহু উর্ধ্বে।
সুতরাং আল্লাহ তা‘আলার ছিফাতসমূহের অর্থ একটি জ্ঞাত বিষয় এবং তাতে বিশ্বাস করা আবশ্যক। কিন্তু এর কোনো চিত্র আমাদের জানা নেই। আল্লাহ ছাড়া তার ছিফাতের ধরণ অন্য কেউ জানে না। এ জন্যই ইমাম মালেক (রহি.) কে যখনالرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى ‘‘দয়াময় আল্লাহ আরশের উপরে সমুন্নত হয়েছেন’’- এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলো كيف استوى আল্লাহ তা‘আলা কিভাবে আরশের উপর সমুন্নত হয়েছেন? তখন জবাবে ইমাম মালেক (রহি.) বলেছেন,الاستواء معلوم والكيف مجهول والإيمان به واجب والسؤال عنه بدعة ‘আরশের উপরে আল্লাহর সমুন্নত হওয়া একটি জানা বিষয়। এর পদ্ধতি কেউ অবগত নয়। তার উপর ঈমান আনয়ন করা ওয়াজিব। তবে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা বিদ্আত।[1]
ইমাম মালেক রাহিমাহুল্লাহর এই কথা আল্লাহ তা‘আলার সমস্ত ছিফাতের ক্ষেত্রেই একটি মূলনীতিতে পরিণত হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলার ছিফাতের ক্ষেত্রে আহলে সুন্নাতের লোকদের বক্তব্য এটিই। সুতরাং যে ব্যক্তি সালাফদের প্রতি এই কথার সম্বন্ধ করলো যে, তারা আল্লাহ তা‘আলার অতি সুন্দর নাম ও সুমহান গুণাবলীর কোনো অর্থ সাব্যস্ত না করে শুধু শব্দ সাব্যস্ত করে সেটার অর্থ আল্লাহর কাছে সোপর্দ করতেন এবং তারা ছিফাত সংক্রান্ত বক্তব্যগুলোকে ঐসব মুতাশাবেহ আয়াতের মধ্যে গণ্য করতেন, যার অর্থ আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ জানে না, তারা সালাফদের নামে মিথ্যা রচনা করলো। কেননা সালাফদের কথা এই মিথ্যুকের কথার সম্পূর্ণ বিপরীত।
তৃতীয় মূলনীতি: সালাফগণ সৃষ্টির ছিফাতের সাথে তুলনা না করেই আল্লাহ তা‘আলার ছিফাত সাব্যস্ত করতেন। সুতরাং তারা আল্লাহ তা‘আলার ছিফাতগুলো সৃষ্টির ছিফাতসমূহের সাথে তুলনা করতেন না। কেননা আল্লাহ তা‘আলার সদৃশ আর কিছুই নেই। সুতরাং তার কোনো সমকক্ষ নেই, তার কোনো শরীক নেই এবং তার সমতুল্য কেউ নেই। আল্লাহর ছিফাতের উপমা-উদাহরণ পেশ করা এবং সেগুলোকে সৃষ্টির ছিফাতের সাথে তাশবীহ দেয়া তার ছিফাত সমূহের পদ্ধতি ও ধরণ সম্পর্কে জ্ঞান রাখার দাবি করার অন্তর্ভুক্ত। আর আল্লাহ তা‘আলার ছিফাতসমূহের ধরণ-পদ্ধতি ও কায়া আমাদের কাছে তার সত্তার কাইফিয়াতের মতোই অজানা। ছিফাতের কাইফিয়াত সম্পর্কে জ্ঞান রাখার জন্য মাওসুফ তথা বিশেষিত সত্তা সম্পর্কে জ্ঞান রাখা আবশ্যক। আল্লাহ তা‘আলার সত্তার ধরণ সম্পর্কে তিনি ছাড়া অন্য কেউ জ্ঞান রাখে না। সুতরাং ছিফাত সম্পর্কে কথা বলা সত্তা সম্পর্কে কথা বলার শাখা বিশেষ। তাই বিশ্বাস করা আবশ্যক যে, আল্লাহ তা‘আলার সত্তা যেহেতু কোনো সৃষ্টির সত্তার সদৃশ নয়, অনুরূপ তার ছিফাতও কোনো সৃষ্টির ছিফাতের সদৃশ নয়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَالسَّمِيعُ البَصِيرُ﴾ ‘‘তার সদৃশ কোনো কিছুই নেই, তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’’। অর্থাৎ কেউ আল্লাহর সাদৃশ্য রাখেনা। তার সত্তার সাথেও না, তার ছিফাতের সাথেও না এবং তার কোনো কর্মের সাথেও না।
সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা তার নিজের সত্তাকে যেসব ছিফাতের মাধ্যমে বিশেষিত করেছেন তার উপর ঈমান আনয়ন করা আবশ্যক। আল্লাহ সম্পর্কে আল্লাহর চেয়ে অধিক জ্ঞানী আর কেউ নেই।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,أَأَنْتُمْ أَعْلَمٌ أَمِ اللَّهٌ ‘‘তোমরা অধিক জ্ঞানী না আল্লাহ?’’ সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা তার নিজের সম্পর্কে এবং অন্যদের সম্পর্কে সর্বাধিক অবগত রয়েছেন। অনুরূপ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে যেসব গুণাবলীর মাধ্যমে বিশেষিত করেছেন, তার উপরও ঈমান আনয়ন করা আবশ্যক। কেননা আল্লাহর পরে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চেয়ে আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কে অধিক জ্ঞানী আর কেউ নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى إِنْ هُوَ إِلا وَحْيٌ يُوحَى﴾
‘‘এবং তিনি প্রবৃত্তির তাড়নায় কোনো কথা বলেন না। তা অহী ছাড়া অন্য কিছু নয়, যা তার প্রতি প্রত্যাদেশ করা হয়। (সূরা আন নাজম: ৩-৪)
সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা তার নিজের সত্তাকে যেসব গুণাবলীতে গুণান্বিত করেছেন এবং তার রসূল তাকে যেসব গুণাবলীতে বিশেষিত করেছেন প্রাপ্ত বয়স্ক প্রত্যেক মুসলিমের তার উপর ঈমান আনয়ন করা আবশ্যক। অনুরূপ একই সঙ্গে মুসলিমের উপর আবশ্যক হলো আল্লাহ তা‘আলার ছিফাতকে সৃষ্টির ছিফাতের সাথে তাশবীহ তুলনা করা থেকে মহান আল্লাহ রাববুল আলামীনের পবিত্রতা বজায় রাখা।
সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলা ও তার রসূলের অগ্রণী হবে এবং আল্লাহ তা‘আলার উপর দুঃসাহস দেখিয়ে তার সত্তা থেকে ঐসব মহৎ গুণাবলী নাকোচ করবে, যা তিনি নিজের জন্য সাব্যস্ত করেছেন অথবা তার রসূল যেসব গুণাবলী দ্বারা তার প্রভুকে বিশেষিত করেছেন, তা নাকোচ করবে সে কি আল্লাহর প্রতি, তার কিতাবের প্রতি এবং তার নবীর সুন্নাতের প্রতি ঈমানদার বলে গণ্য হবে? অনুরূপ যে ব্যক্তি বলবে, হে আমার প্রভু! তুমি নিজেকে যেসব গুণাবলীতে গুণান্বিত করেছো অথবা তোমার রসূল তোমাকে যা দ্বারা বিশেষিত করেছেন, তা দ্বারা গুণান্বিত হওয়া তোমার জন্য শোভনীয় নয়! তাতে রয়েছে এই এই দোষ! সুতরাং আমি এগুলোর তাবীল করছি এবং তা বাতিল করে তার স্থলে আমার নিজের পক্ষ হতে অন্যান্য বিশেষণ সাব্যস্ত করছি, যে ব্যক্তি একথাগুলো বলবে, সে কি মুমিন হওয়ার আশা করতে পারে? কখনো নয়। যেমন মুতাযেলী কিংবা আশআরী মাযহাবের কোনো এক কবি বলেছেন,
وكُل نص أوهم التشبيها ... أَوَّله أو فوَّض وَرُم تَنزِيها
‘‘হে বন্ধু! কুরআন ও সুন্নাহর যেসব উক্তিতে আল্লাহর সাথে সৃষ্টির তাশবীহ (তুলনা) হওয়ার সন্দেহ রয়েছে, তাকে তার বাহ্যিক অর্থ পরিহার করে অন্য অর্থে ব্যাখ্যা করো অথবা কেবল উক্তির অর্থ বিহীন শব্দমালা সাব্যস্ত করো এবং সৃষ্টির সাথে আল্লাহ তা‘আলার সাদৃশ্য হওয়ার ধারণা থেকে তাকে পবিত্র করো’’।[2]
সুতরাং এ বিষয়ে আমি তোমার কিতাব এবং তোমার রসূলের সুন্নাতের স্মরণাপন্ন হবোনা। কেননা সৃষ্টির সাথে তোমার তাশবীহ বা সাদৃশ্য হয়ে যাওয়ার সন্দেহ রয়েছে। বরং আমি তোমার নাম ও ছিফাতসমূহ সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে তর্কশাস্ত্রবিদদের মূলনীতি, জাহমীয়া, মু‘তাযিলা, আশায়েরা এবং মাতুরীদিয়াদের মতবাদের স্মরণাপন্ন হবো। যে ব্যক্তি এরকম কথা বলবে, সে কি আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী বলে গণ্য হবে? সে কি তার প্রভুকে সম্মানকারী হিসাবে গণ্য হবে? এটি নিঃসন্দেহে বিরাট এক অপবাদ! হে আল্লাহ! তারা তোমার প্রতি যেসব বাতিল কথার সম্বন্ধ করে, আমরা তা থেকে তোমার পবিত্রতা বর্ণনা করছি।
চতুর্থ মূলনীতি: আল্লাহ তা‘আলা নিজেকে যেসব ছিফাত দ্বারা বিশেষিত করেছেন অথবা তার রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে যেসব গুণাবলী দ্বারা গুণান্বিত করেছেন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের লোকেরা যেমন সেটা আল্লাহ তা‘আলার বড়ত্ব ও মর্যাদার জন্য শোভনীয় পদ্ধতিতে সাব্যস্ত করেন ঠিক তেমনি তারা তাকে সমস্ত দোষ-ত্রুটি থেকে পবিত্র বলে ঘোষণা করেন। তাকে দোষ-ত্রুটি থেকে পবিত্র ও মুক্ত ঘোষণা করার দলীল পেশ করতে গিয়ে ছিফাত সংক্রান্ত উক্তিগুলোর এমন কোনো তাবীল করেন না কিংবা সেটার শব্দগুলোকে তার আসল মর্মার্থ থেকে বিকৃত করেন না, যা তাদেরকে তা’তীল বা আল্লাহ তা‘আলার ছিফাতগুলোকে বাতিল করার দিকে নিয়ে যায়; বরং তারা এ ব্যাপারে মুশাবেবহা সম্প্রদায় এবং মুআত্তেলা সম্প্রদায়ের মাঝামাঝি অবস্থানে রয়েছেন। তারা আল্লাহ তা‘আলা থেকে অপূর্ণতার দোষ-ত্রুটি নাকোচ করতে গিয়ে পূণর্তার গুণাবলীকে অর্থহীন, অকেজো ও বাতিল করা থেকে দূরে থাকেন এবং পূর্ণতার বিশেষণ সাব্যস্ত করতে গিয়ে তার সাদৃশ্য প্রদান করা থেকেও বেঁচে থাকেন।
পঞ্চম মূলনীতি: আহলে সুন্নাতের লোকেরা আল্লাহ তা‘আলার জন্য যেসব পূর্ণতার গুণাবলী সাব্যস্ত করেন এবং যেসব অপূর্ণতার দোষ-ত্রুটি তার থেকে নাকোচ করেন, তাতে তারা কুরআন-সুন্নাহর পথ অবলম্বন করেন। আর তা এভাবে যে, তারা নাকোচ করতে গিয়ে সংক্ষিপ্ত কথা বলেন এবং সাব্যস্ত করতে গিয়ে বিস্তারিতভাবে বলেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَ هُوَ السَّميْعُ الْبَصِيْر﴾
‘‘তার সদৃশ কোনো কিছুই নেই। তিনি সর্বশ্রোতা এবং সর্বদ্রষ্টা’’। (সূরা শুরা: ১১)
‘‘তার সদৃশ কোনো কিছুই নেই।’’ এ অংশের মাধ্যমে সংক্ষেপে সৃষ্টি থেকে কোনো কিছু আল্লাহর সদৃশ হওয়ার নাকোচ করা হয়েছে এবং ‘‘তিনি সর্বশ্রোতা এবং সর্বদ্রষ্টা’’ এ অংশের মাধ্যমে বিস্তারিতভাবে তার জন্য পূর্ণতার গুণাবলী সাব্যস্ত করা হয়েছে।
না বাচক বাক্যের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা থেকে যা কিছুই নাকোচ করা হয়েছে, একই সঙ্গে তাতে আল্লাহ তা‘আলার কামাল তথা পূর্ণতার বিশেষণ সাব্যস্ত করা হয়েছে। নাকোচ সংক্রান্ত বক্তব্য দ্বারা শুধু নাকোচই উদ্দেশ্য নয়। কেননা শুধু না বাচক বাক্যের মধ্যে কোনো প্রশংসা থাকেনা। শুধুমাত্র নাকোচের মাধ্যমে অস্তিত্বহীন বিষয় উদ্দেশ্য হয়। আর অস্তত্বহীনকে কোনো জিনিসই বলা হয় না।
আল্লাহ তা‘আলার ছিফাতের ব্যাপারে নাকোচের মাধ্যমেও তার জন্য কামাল বা পূর্ণতার বিশেষণ সাব্যস্ত করা হয়েছে। এর অনেক উদাহরণ রয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَلاَيَظْلِمُ رَبٌّكَ أَحَدًا ‘‘তোমার রব কাউকে যুলুম করেন না’’। (সূরা কাহাফ: ৪৯) অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার আদল বা ন্যায়বিচার যেহেতু সর্বোচ্চ, চূড়ান্ত ও পূর্ণতম, তাই তিনি কারো প্রতি অবিচার করেন না।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَلَا يَئُودُهُ حِفْظُهُمَا ‘‘আর আসমান ও যমীনকে ধারণ করা তার জন্য মোটেই কঠিন নয়’’। তার শক্তি ও ক্ষমতা যেহেতু পরিপূর্ণ, তাই আসমান-যমীনের হেফাযত করা তার পক্ষে মোটেই কঠিন নয়। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
لاَ تَأْخُذُهُ سِنَةٌ وَلَا نَوْمٌ ‘‘তন্দ্রা ও নিদ্রা তাকে স্পর্শ করতে পারে না’’। কেননা তার জীবন পরিপূর্ণ, তিনি চির জাগ্রত এবং তার ধারণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করার ক্ষমতা অবিনশ্বর।
অনুরূপভাবে আল্লাহ তা‘আলা থেকে যেখানেই কিছু নাকোচ করা হয়েছে, সেখানে নাকোচকৃত বিষয়ের বিপরীত পূর্ণতা ও মহত্ত্বের বিশেষণ সাব্যস্ত করা হয়েছে। আমরা আল্লাহর কাছে দীনের সঠিক জ্ঞান প্রার্থনা করছি, তার আনুগত্যমূলক কাজের তাওফীক চাচ্ছি এবং সত্য জানা ও সে অনুযায়ী আমল করার শক্তি প্রার্থনা করছি।
[1]. অতঃপর সেই বিদআতী লোককে ইমাম মালেক (রহি.)এর নির্দেশে তাঁর মজলিস থেকে বের করে দেয়া হলো। কেননা এটি এমন প্রশ্ন, যা সালাফে সালেহীনের কোনো লোক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে করেননি।
[2]. আল্লাহ তা‘আলার অতি সুন্দর নাম ও সুউচ্চ গুণাবলী সম্পর্কিত অধ্যায় ইলমের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ শাখা। কেননা এ সম্পর্কে ইলম অর্জন করা ব্যতীত তাঁর মারেফত হাসিল করা অসম্ভব। এতে যদি আল্লাহ তা‘আলার কথা এবং আল্লাহর রাসূলের কথা যথার্থ ও গ্রহণযোগ্য না হয়, তাহলে এ ক্ষেত্রে কার উক্তি গ্রহণযোগ্য হবে? ইমামুল হারামাইন আবুল মাআলী আল-জুওয়াইনী রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, আমি দীর্ঘদিন আল্লাহ তা‘আলার ছিফাত সংক্রান্ত বিষয়ে অপব্যাখ্যা কারীদের মাযহাবের উপর ছিলাম। অতঃপর আমি এ বিষয়ে চিন্তা-গবেষণা করলাম। চিন্তা-ভাবনা করে দেখতে পেলাম যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমনসব কথা বলতেন, যাতে আল্লাহ তা‘আলার ছিফাতসমূহের খবর রয়েছে। তিনি তাঁর মজলিসে, ভাষণে, ভ্রমণে এবং নিজ শহরে আল্লাহ তা‘আলার ছিফাত সংক্রান্ত বিষয়ে কথা বলতেন। তার নিকট থেকে জ্ঞানী-মূর্খ, শহরবাসী ও গ্রাম্য লোক, আনসার-মুহাজির সকলেই সেটা শুনতেন। কিন্তু এ সম্পর্কিত কথা চলাকালে কেউ তাঁর কোনো প্রতিবাদ করেন নি অথবা তিনি এ সম্পর্কিত কথা বলার পর এমন কিছু উল্লেখ করেন নি, যাতে বুঝা যায় তাঁর কথার বাহ্যিক অর্থ উদ্দেশ্য নয়। এ থেকে আমরা নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারি যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তা‘আলার ছিফাত সংক্রান্ত বিষয়ে অথবা অন্যান্য গায়েবী বিষয়ে সাধারণভাবে যা বলেছেন, তার বাহ্যিক অর্থই উদ্দেশ্য। এতে প্রমাণিত হয় যে, ইমামুল হারামাইন দীর্ঘদিন কালাম (তর্কশাস্ত্র) বিদদের মাযহাবের উপর থাকার পর আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মাযহাবের দিকে ফিরে এসেছেন এবং এর উপরেই মৃত্যু বরণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলাই সর্বাধিক অবগত রয়েছেন।