ছোট শিরক তাওহীদের মধ্যে ঘাটতি আনয়ন করে এবং সেটাকে ত্রুটিযুক্ত করে দেয়। মানুষের মধ্যে এমন অনেক ছোট শিরক রয়েছে, যা থেকে আল্লাহ তা‘আলা এবং তার রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে সতর্ক করেছেন। যাতে করে আকীদার সংরক্ষণ করা যায় এবং তাওহীদের হেফাযত করা হয়। কেননা এ ছোট শিরকগুলো তাওহীদে ঘাটতি আনয়ন করে। কখনো কখনো এগুলো বড় শিরকের দিকে নিয়ে যায়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فَلاَ تَجْعَلُواْ لِلّهِ أَندَاداً وَأَنتُمْ تَعْلَمُونَ﴾
‘‘অতএব তোমরা জেনে শুনে আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ স্থাপন করো না’’। (সূরা আল বাকারা: ২২)
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, অত্র আয়াতে الأنداد বলতে এমন শিরক উদ্দেশ্য, যা আঁধার রাতে কালো পাথরের উপর দিয়ে পীপড়ার চলাচলের অপেক্ষা অধিক গোপনে সংঘটিত হয়। যেমন লোকেরা বলে থাকে আল্লাহর শপথ এবং তোমার জীবনের শপথ, হে অমুক! আমার জীবনের শপথ! এ ছোট্ট কুকুরটি ঘেউ ঘেউ না করলে আমাদের ঘরে চোর প্রবেশ করতো, ঘরে হাঁসগুলো তই তই না করলে আজ রাতে চোর আসতো, কেউ তার সাথীকে বলে থাকে, তুমি যা চাও এবং আল্লাহ তা‘আলা যা চান এবং কোনো কোনো মানুষ বলে থাকে আল্লাহ না থাকলে এবং অমুক না থাকলে এমন হতো না। ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, তুমি কোনো ব্যাপারে অমুক অমুক বলবে না। এসবই শিরকের অন্তর্ভুক্ত। ইমাম ইবনে আবী হাতিম হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।
ইবনে আব্বাসের মতে উপরোক্ত বিষয়গুলো শিরকের মধ্যে গণ্য। আর শিরক বলতে ছোট শিরক উদ্দেশ্য। তবে আয়াত ছোট ও বড় উভয় প্রকার শির্কেই শামিল করে। ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু এসব বিষয় থেকে সর্বাধিক ছোট শিরক সম্পর্কে সতর্ক করার মাধ্যমে সবচেয়ে বড় শিরক থেকে সতর্ক করেছেন। কেননা এ শব্দগুলো অনেক মানুষের জবানে উচ্চারিত হতে দেখা যায়। তাদের কেউ অজ্ঞতা বশত আবার কেউ তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে এগুলো উচ্চারণ করে থাকে। এ ছোট শিরকগুলোর মধ্যে রয়েছে, ..
আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে শপথ করা শিরক। আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত আছে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালাম বলেছেন, مَنْ حَلَفَ بِغَيْرِ اللَّهِ فَقَدْكَفَرَ أَوْ أَشْرَك ‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে শপথ করল, সে কুফুরী করলো অথবা শিরক করল’’। ইমাম তিরমিযী হাদীছটি বর্ণনা করার পর হাসান বলেছেন এবং আবু আব্দুল্লাহ আল-হাকেম এটিকে সহীহ বলেছেন।
‘‘সে কুফুরী করলো অথবা শিরক করলো’’: এখানে বর্ণনাকারী সন্দেহ পোষণ করেছেন। অথবা শব্দটি এবং অর্থেও ব্যবহৃত হতে পারে। তখন অর্থ হবে সে কুফুরী করলো এবং শিরক করলো। তবে এটি বড় কুফুরীর চেয়ে কম মানের কুফুরী। এটি ছোট শিরকও বটে।
বর্তমান সময়ের অনেক মানুষই আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নামে শপথ করে। তারা আমানতের নামে কসম খায়, নবীর নামে শপথ করে, কেউ কেউ বলে আমার জীবনের কসম, হে অমুক! তোমার জীবনের শপথ! এ ধরণের আরো অনেক শব্দ তারা ব্যবহার করে। আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে শপথ করার নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে যেসব হাদীছ বর্ণিত হয়েছে, আমরা তা শুনলাম। আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্যের নামে শপথ করাকে কুফুরী অথবা শিরক হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। কেননা কোনো জিনিষের শপথ করার অর্থ হলো উক্ত জিনিসকে সম্মান করা। সুতরাং যাকে সম্মান করা আবশ্যক এবং যার নামে শপথ করা যায় তিনি হলেন আল্লাহ তা‘আলা। আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে শপথ করা শিরক এবং বিরাট অপরাধ।
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন,
لَأَنْ أَحْلِفَ بِاللهِ كَاذِبًا أحَبَّ إليَّ مِنْ أحْلِفَ بِغَيْرِهِ صَادِقًا
‘‘আল্লাহর নামে মিথ্যা কসম করা আমার কাছে আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে সত্য কসম করার চেয়ে বেশী পছন্দনীয়। ইহা জানা কথা যে, আল্লাহর নামে মিথ্যা শপথ করা কবীরা গুনাহ। কিন্তু শিরক করা যেমন আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে শপথ করা সমস্ত কবীরা গুনাহর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ কবীরা গুনাহ। যদিও তা শির্কে আসগার বা ছোট শিরক হয়।
সুতরাং মুসলিমদের সতর্ক হওয়া আবশ্যক। জাহেলী যুগের অভ্যাস যেন পুনরায় তাদের কাছে ফিরে না আসে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালাম বলেন,
لاَ تَحْلِفُوا بِآبَائِكُمْ ‘‘তোমরা তোমাদের বাপ-দাদার নামে কসম করো না’’। এ ছাড়া আরো অনেক দলীল রয়েছে। যা আমাদেরকে আদেশ করে যে, আমরা যখন শপথ করার ইচ্ছা করবো, তখন যেন একমাত্র আল্লাহর নামের সাথেই কসমকে সীমিত রাখি এবং তিনি ছাড়া অন্যের নামে শপথ না করি।
যে ব্যক্তি আল্লাহর নামে কসম করার পরও সন্তুষ্ট হয় না, তার ব্যাপারে যা বর্ণিত হয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালাম বলেছেন,
مَنْ حَلَفَ بِاللَّهِ فَلْيَصْدُقْ وَمَنْ حُلِفَ لَهُ بِاللَّهِ فَلْيَرْضَ وَمَنْ لَمْ يَرْضَ بِاللَّهِ فَلَيْسَ مِنَ اللَّهِ
‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর নামে কসম করে, সে যেন সত্য বলে। আর যে ব্যক্তির জন্য আল্লাহর নামে কসম করা হবে, সে যেন উক্ত কসমে সন্তুষ্ট থাকে। আল্লাহর কসমে যে ব্যক্তি সন্তুষ্ট হলো না, তার সাথে আল্লাহর কোনো সম্পর্ক নেই’’। ইমাম ইবনে মাজাহ হাসান সনদে এটি বর্ণনা করেছেন।[1]
[1]. এ হাদীছের সনদে দুর্বলতা থাকলেও তার মর্মার্থ গ্রহণ করতে কোন অসুবিধা নেই। কেননা সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফে এ বিষয়ে একাধিক হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«أَلا مَنْ كَانَ حَالِفًا فَلا يَحْلِفْ إِلاَّ بِاللَّهِ فَكَانَتْ قُرَيْشٌ تَحْلِفُ بِآبَائِهَا، فَقَالَ:«لاَ تَحْلِفُوا بِآبَائِكُمْ»
‘‘খবরদার যে ব্যক্তি শপথ করতে চায়, সে যেন আল্লাহর নাম ছাড়া অন্য কারো নামে শপথ না করে। কুরাইশরা তাদের বাপদাদার নামে শপথ করতো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের কথার প্রতিবাদ করে বললেন, তোমরা তোমাদের বাপদাদাদের নামে শপথ করো না’’। (বুখারী, হাদীছ নং- ৩৮৩৬)
যেমন কেউ বললো, ماشاء الله وشئت ‘‘আল্লাহ এবং আপনি যা চেয়েছেন’’। ইমাম আহমাদ ও নাসাঈ কুতাইলা হতে বর্ণনা করেন যে, এক ইয়াহূদী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম এর কাছে এসে বললোঃ ‘‘আপনারাও আল্লাহর সাথে শিরক করে থাকেন। কারণ আপনারা বলে থাকেন, ماشاء الله وشئت ‘‘আল্লাহ এবং আপনি যা চেয়েছেন’’। আপনারা আরো বলে থাকেন, والكعبة অর্থাৎ কাবার কসম। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম তখন সাহাবীদেরকে আদেশ করলেন, তারা যখন কসম করতে চায়, তখন তারা যেন বলে, ورب الكعبة ‘কাবার রবের কসম। আর যেন এ কথা বলে, ماشاء الله ثم شئت আল্লাহ যা চেয়েছেন অতঃপর আপনি যা চেয়েছেন।
ইমাম নাসাঈ আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণনা করেন যে, এক ব্যক্তি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালাম এর উদ্দেশ্যে বললো ماشاء الله وشئت ‘‘আপনি এবং আল্লাহ যা ইচ্ছা করেছেন’’। তখন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, أجعلتنى لله ندا؟ ‘‘তুমি কি আল্লাহর সাথে আমাকে শরীক বানিয়ে ফেললে? বরং তুমি বলো, আল্লাহ একাই যা ইচ্ছা করেছেন, তাই হয়েছে’’।[1]
উপরোক্ত হাদীছ দু’টি এবং এ মর্মে বর্ণিত অন্যান্য হাদীছগুলো প্রমাণ করে যে, ماشاء الله وشئت ‘‘আপনি এবং আল্লাহ যা ইচ্ছা করেছেন বলা এবং অনুরূপ অন্যান্য বাক্য উচ্চারণ করা নিষেধ। যেমন লোকেরা বলে থাকে, لولا الله وأنت আপনি এবং আল্লাহ না থাকলে এমন হওয়ার সম্ভাবনা ছিল, مالي إلا الله وأنت আমার জন্য আল্লাহ এবং আপনি ছাড়া আর কেউ নেই। কেননা واو দ্বারা একটি বিষয়কে অন্য বিষয়ের উপর আতফ করলে তথা দু’টি শব্দের মধ্যে واو আনয়ন করলে এর দ্বারা দু’টি বস্তুকে সমান করে দেয়া উদ্দেশ্য হয়। আর واو এর মাধ্যমে কোনো বিষয়ে স্রষ্টাকে সৃষ্টির সমান করে দেয়া শিরক। তবে এটি এবং অনুরূপ বিষয় ছোট শিরকের অন্তর্ভুক্ত।
সুতরাং এ ক্ষেত্রে واو এর বদলে ثم দিয়ে আতফ করা আবশ্যক। সুতরাং এভাবে বলা উচিত যে ما شاء الله ثم شئت আল্লাহ যা চান অতঃপর আপনি যা চান, আল্লাহ যা চান অতঃপর অমুক যা চায়, আল্লাহ না থাকলে অতঃপর আপনি না থাকলে, আল্লাহ না থাকলে অতঃপর অমুক না থাকলে, আমার জন্য আল্লাহ অতঃপর আপনি ছাড়া আর কেই নেই। কেননা ثم দ্বারা এক শব্দকে অন্য শব্দের উপর আত্ফ করা হলে সেটা ধারাবাহিকতা ও বিলম্ব অর্থ প্রদান করে। আর বান্দার ইচ্ছা কেবল আল্লাহর ইচ্ছার অনুগামী ও পরেই হয়ে থাকে এবং কেবল আল্লাহর ইচ্ছার পরেই কার্যকরী হয়। এতে করে আল্লাহর ইচ্ছা এবং বান্দার ইচ্ছা বরাবর হয়ে যায় না।
আল্লাহ তা‘আলা সূরা তাকবীরের ২৯ আয়াতে বলেন, وَمَا تَشَاءُونَ إِلَّا أَنْ يَشَاءَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ ‘‘তোমরা আল্লাহ রাববুল আলামীনের ইচ্ছার বাইরে অন্য কিছুই ইচ্ছা করতে পারো না’’।
সুতরাং বান্দার ইচ্ছা আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছার অধীনস্থ। বান্দার যদিও ইচ্ছা রয়েছে, কিন্তু তার ইচ্ছা আল্লাহর ইচ্ছার অনুগামী। বান্দা কোনো কিছুর ইচ্ছাই করতে পারে না, তবে আল্লাহ যখন ইচ্ছা করেন, তখনই কেবল বান্দার ইচ্ছা কার্যকর হয়। জাবরীয়ারা এ মতের বিরোধিতা করেছে। তারা বলে বান্দার কোনো ইচ্ছা ও স্বাধীনতা নেই।
ঐদিকে কাদারীয়া সম্প্রদায় এবং অন্যান্য লোকেরাও এ মাসআলায় আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের বিরোধিতা করেছে। কাদারীয়ারা বান্দার জন্য এমন ইচ্ছা সাব্যস্ত করে, যারা আল্লাহর ইচ্ছার বিপরীত। আল্লাহ তাদের কথার বহু উর্ধ্বে।
[1]. হাদীছটির একাধিক শাওয়াহেদ থাকার কারণে সহীহ। দেখুন: কুররাতুল উয়ুন, পৃষ্ঠা নং- ৩৪৭।
নিয়ত ও উদ্দেশ্যের মধ্যে যে শিরক হয়, সেটাকে গোপন শিরক বলা হয়। যেমন الرياء বা লোক দেখানো আমল। গোপন শিরক দুই প্রকার।
ক) الرياء বা লোক দেখানো আমল: الرياء শব্দটি الرؤية শব্দ থেকে বের হয়েছে। মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্যে ইবাদত প্রকাশ করাকে রিয়া বলা হয়। যাতে করে লোকেরা ইবাদতকারী লোকটির প্রশংসা করে। الرياء এবং السمعة এর মধ্যে পার্থক্য হলো মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্যে যে আমল করা হয় এবং যা চোখ দিয়ে দেখা যায় তাকে الرياء বলা হয় যেমন সালাত দান-খয়রাত ইত্যাদি এবং যে আমল মানুষকে শুনানোর উদ্দেশ্যে করা হয় এবং যা কান দিয়ে শুনা যায়, তাকে السمعة বলা হয় যেমন কুরআন পাঠ করা, ওয়ায করা যিকির-আযকার করা ইত্যাদি। যেসব আমল মানুষ তাদের কথা-বার্তায় উল্লেখ করে এবং অন্যদেরকে জানায় তাও السمعة-এর মধ্যে গণ্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ يُوحَى إِلَيَّ أَنَّمَا إِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ فَمَنْ كَانَ يَرْجُو لِقَاءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا وَلَا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا﴾
‘‘হে নবী! বলোঃ আমি তোমাদের মতই একজন মানুষ। আমার নিকট অহী পাঠানো হয় এই মর্মে যে, তোমাদের ইলাহ মাত্র এক। অতএব যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সাক্ষাত কামনা করে সে যেন সৎ আমল করে এবং তার পালনকর্তার এবাদতে অন্য কাউকে শরীক না করে’’। (সূরা কাহাফ: ১১০)
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রহিমাহুল্লাহ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, আল্লাহ তা‘আলা যেমন এক, তিনি ছাড়া অন্য কোনো সত্য মাবুদ নেই, ঠিক তেমনি ইবাদত একমাত্র তার জন্যই হওয়া চাই, তিনি এক এবং তার কোনো শরীক নেই। সুতরাং তিনিই যেহেতু একমাত্র ইলাহ তাই একমাত্র তারই ইবাদত করা উচিত। রিয়া থেকে যে আমল মুক্ত হয় এবং যা সুন্নাত মোতাবেক হয়, সেটাকেই সৎ আমল হিসাবে গণ্য করা হয়। ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহর কথা এখানেই শেষ।
যারা লোকদেরকে দেখানোর উদ্দেশ্যে আমল করে, আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে শাস্তির ভয় দেখিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فَوَيْلٌ لِلْمُصَلِّينَ الَّذِينَ هُمْ عَنْ صَلَاتِهِمْ سَاهُونَ الَّذِينَ هُمْ يُرَاءُونَ (৬) وَيَمْنَعُونَ الْمَاعُونَ﴾
‘‘ধ্বংস ঐ সমস্ত সালাত আদায়কারীদের জন্য যারা সালাতের ব্যাপারে উদাসীন। যারা লোকদেরকে দেখানোর উদ্দেশ্যে সালাত পড়ে এবং যারা গৃহস্থালীর প্রয়োজনীয় ছোটখাটো জিনিস সাহায্য দেয়া থেকে বিরত থাকে’’। (সূরা আল মাউন: ৪-৫) আল্লাহ তা‘আলা আরো সংবাদ দিয়েছেন যে, রিয়া হলো মুনাফেকদের লক্ষণ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿إِنَّ الْمُنَافِقِينَ يُخَادِعُونَ اللَّهَ وَهُوَ خَادِعُهُمْ وَإِذَا قَامُوا إِلَى الصَّلَاةِ قَامُوا كُسَالَى يُرَاءُونَ النَّاسَ وَلَا يَذْكُرُونَ اللَّهَ إِلَّا قَلِيلًا﴾
‘‘অবশ্যই মুনাফেকরা ধোঁকাবাজি করছে আল্লাহর সাথে, অথচ আল্লাহই তাদেরকে ধোঁকার মধ্যে ফেলে রেখেছেন। তারা যখন সালাতে দাঁড়ায় তখন একান্ত শিথিলভাবে লোক দেখানোর জন্যই দাঁড়ায়। আর তারা আল্লাহ্কে অল্পই স্মরণ করে’’। (সূরা আন নিসা: ১৪২)
আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে ‘মারফু’ হাদীসে বর্ণিত আছে, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
أَنَا أَغْنَى الشُّرَكَاءِ عَنِ الشِّرْكِ مَنْ عَمِلَ عَمَلاً أَشْرَكَ فِيهِ مَعِى غَيْرِى تَرَكْتُهُ وَشِرْكَهُ
‘‘যেসব মাবুদকে আমার সাথে শরীক ধারণা করা হয়, আমি তাদের সকলের শিরক থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। যে ব্যক্তি কোনো আমল করে এবং ঐ আমলে আমার সাথে অন্য কাউকে শরীক করে, আমি ঐ ব্যক্তিকে এবং তার শিরককে প্রত্যাখ্যান করি’’।[1]
অর্থাৎ যে ব্যক্তি তার আমলের মাধ্যমে আমাকে বাদ দিয়ে অন্য কোনো সৃষ্টির সন্তুষ্টি তালাশ করবে, আমি তাকে বর্জন করি এবং শিরককেও বর্জন করি। ইবনে মাজার অন্য বর্ণনায় এসেছে, সে আমলের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। যাকে সে আমার সাথে শরীক করেছে, সেটা তার জন্যই।
ইমাম ইবনে রজব রহিমাহুল্লাহ বলেন, জেনে রাখুন যে, আল্লাহ ছাড়া অন্যের উদ্দেশ্যে কৃত আমলগুলো কয়েক প্রকার। কখনো কখনো আমলের মধ্যে শুধু রিয়াই থাকে। এ রকমই হলো মুনাফেকদের অবস্থা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَإِذَا قَامُوا إِلَى الصَّلَاةِ قَامُوا كُسَالَى يُرَاءُونَ النَّاسَ وَلَا يَذْكُرُونَ اللَّهَ إِلَّا قَلِيلًا﴾
‘‘তারা যখন সালাতে দাঁড়ায় তখন একান্ত শিথিলভাবে লোক দেখানোর জন্যই দাঁড়ায়। আর তারা আল্লাহ্কে অল্পই স্মরণ করে’’। (সূরা আন নিসা: ১৪২)
এ ধরণের রিয়া মুমিনদের থেকে প্রকাশিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। বিশেষ করে ফরয সালাত ও ফরয রোযার মধ্যে এ ধরণের রিয়া মুমিনদের থেকে হওয়ার আশঙ্কা নেই। তবে সাদকা, ফরয হজ্জ ইত্যাদি প্রকাশ্য আমলের মধ্যে কিংবা যেসব আমল দ্বারা অন্য লোক উপকৃত হয়, তাতে কখনো কখনো মুমিনদের থেকে এ ধরণের আমলের মধ্যে রিয়া আসতে পারে। এতে ইখলাস ধরে রাখা কঠিন। এ জাতিয় আমল বাতিল হওয়ার ব্যাপারে কোনো মুসলিম সন্দেহ পোষণ করতে পারে না। রিয়াকারীগণ আল্লাহর অসন্তুষ্টি এবং শাস্তি পাওয়ার হকদার।
কখনো কখনো আল্লাহর জন্যই আমল শুরু করা হয়, কিন্তু পরবর্তীতে তার মধ্যে রিয়া প্রবেশ করে। আমলের শুরুতেই যদি রিয়া প্রবেশ করে, তাহলে কুরআন-সুন্নাহর দলীলসমূহ প্রমাণ করে যে, সে আমলটি সম্পূর্ণরূপে বাতিল হবে। আর যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য আমল শুরু করা হয়, অতঃপর তাতে রিয়া প্রবেশ করে, তাহলে রিয়াটি যদি মনের কল্পনার মধ্যেই সীমিত থাকে এবং আমলকারী সেটাকে প্রতিহত করে ফেলে, তাহলে আলেমদের ঐক্যমতে এ রিয়া ক্ষতিকর নয়। আর আমলের সাথে সাথে যদি রিয়া অব্যাহত থাকে, তাহলে তার আমলটি বাতিল হয়ে যাবে কি না এবং বাতিল না হলে শুরুতে নিয়ত বিশুদ্ধ হওয়ার কারণে বিনিময় দেয়া হবে কি না, সে ব্যাপারে সালাফদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল এবং ইবনে জারীর রাহিমাহুমাল্লাহ আলেমদের মতভেদ উল্লেখ করার পর প্রাধান্য দিয়েছেন যে, তার আমল বাতিল হবে না। শুরুতে নিয়ত বিশুদ্ধ হওয়ার কারণে সে আমলের ছাওয়াবও প্রাপ্ত হবে। হাসান বসরী এবং অন্যান্য আলেম থেকে এটি বর্ণিত হয়েছে। ইবনে রজব রাহিমাহুল্লাহর বক্তব্য এখানেই শেষ।
প্রিয় দীনি ভাইগণ! শত্রুর আক্রমণ থেকে নিজেদের জান হেফাযত করা এবং চোরদের কবল থেকে নিজেদের মাল হেফাযত করার চেয়ে শিরক থেকে আমল হেফাযত করার গুরুত্ব অনেক বেশী। কেননা শিরকের পরিণাম খুবই ভয়াবহ। আমরা আমাদের নিজেদের জন্য এবং আপনাদের সকলের জন্য আল্লাহর কাছে নিরাপত্তা এবং কথায় ও কাজে এখলাস প্রার্থনা করছি।
খ) মানুষের নেক আমল দ্বারা নিছক পার্থিব স্বার্থ হাসিলের নিয়ত করা ছোট শিরক:
নেক আমলের মাধ্যমে পার্থিব উদ্দেশ্য হাসিলের নিয়ত করা এক প্রকার শিরক। নিয়ত ও উদ্দেশ্যের মধ্যে এ প্রকার শিরক হয়ে থাকে। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনুল কারীমে এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার সুন্নাতে এ প্রকার শিরক থেকে সতর্ক করেছেন। যেমন কেউ দুনিয়ার স্বার্থ হাসিলের লোভে এমন নেক আমল করলো, যা দ্বারা আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি কামনা করা হয়। এটি এমন শিরক, যা তাওহীদের পূর্ণতার পরিপন্থী। সেই সঙ্গে ইহা মানুষের সৎ আমলগুলোকেও বরবাদ করে দেয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿مَنْ كَانَ يُرِيدُ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا وَزِينَتَهَا نُوَفِّ إِلَيْهِمْ أَعْمَالَهُمْ فِيهَا وَهُمْ فِيهَا لَا يُبْخَسُونَ أُولَئِكَ الَّذِينَ لَيْسَ لَهُمْ فِي الْآَخِرَةِ إِلَّا النَّارُ وَحَبِطَ مَا صَنَعُوا فِيهَا وَبَاطِلٌ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ﴾
‘‘যারা শুধু দুনিয়ার জীবন এবং এর চাকচিক্য কামনা করে, আমি তাদের সব কাজের প্রতিদান দুনিয়াতেই দিয়ে থাকি এবং তাতে তাদের প্রতি কিছুমাত্র কমতি করা হয় না। এরাই হলো সেসব লোক আখিরাতে যাদের জন্য আগুন ছাড়া অন্য কিছু নেই। তারা এখানে যা কিছু করেছিল সবই বরবাদ হয়েছে; আর যা কিছু উপার্জন করেছিল, সবই বিনষ্ট হল’’। (সূরা হুদ: ১৫-১৬)
আল্লাহ তা‘আলা উপরোক্ত আয়াত দু’টিতে সংবাদ দিয়েছেন, যে ব্যক্তি তার আমলের মাধ্যমে শুধু পার্থিব উদ্দেশ্য হাসিলের নিয়ত করবে আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়াতেই তার আমলের ছাওয়াব পরিপূর্ণরূপে দান করবেন। তাকে সুস্বাস্থ্য এবং ধন-সম্পদ, পরিবার-পরিজন ও সন্তান-সন্ততির মাধ্যমে প্রচুর সুখ-শান্তি দান করবেন। আর এটিও আল্লাহর ইচ্ছাধীন। আল্লাহ তা‘আলা যাকে ইচ্ছা দুনিয়ার নিয়ামত দান করেন। যেমন তিনি অন্য আয়াতে বলেন,
﴿مَنْ كَانَ يُرِيدُ الْعَاجِلَةَ عَجَّلْنَا لَهُ فِيهَا مَا نَشَاءُ لِمَنْ نُرِيدُ ثُمَّ جَعَلْنَا لَهُ جَهَنَّمَ يَصْلَاهَا مَذْمُومًا مَدْحُورًا﴾
‘‘যে কেউ ইহকাল কামনা করে, আমি সেসব লোককে যা ইচ্ছা সত্তর দিয়ে দেই। অতঃপর তাদের জন্য জাহান্নাম নির্ধারণ করি। ওরা তাতে নিন্দিত-বিতাড়িত অবস্থায় প্রবেশ করবে’’। (সূরা বানী ইসরাঈল: ১৮)
যারা দুনিয়ার নিয়ামত হাসিলের উদ্দেশ্যে সৎ আমল করবে, তারা জাহান্নামের আগুন ছাড়া আর কিছুই পাবে না। কেননা তারা জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে সৎ আমল করেনি। সুতরাং আখিরাতে তাদের আমলগুলো বাতিল হবে এবং এর কোনো ছাওয়াব পাবে না। কেননা তারা আখিরাতের উদ্দেশ্যে আমল করেনি।
প্রখ্যাত তাবেঈ কাতাদাহ বলেন, আল্লাহ তা‘আলা এখানে বলেছেন, দুনিয়া হাসিল করা যার উদ্দেশ্য হয় এবং দুনিয়া কামাই করার জন্য যে আমল করে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে দুনিয়াতেই তার সৎ আমলের বিনিময় প্রদান করবেন। অতঃপর সে আখিরাতে গিয়ে এমন কোনো সৎ আমল খুঁজে পাবেনা, যার বিনিময় দেয়া যেতে পারে। আর মুমিন ব্যক্তির ব্যাপারে কথা হলো, আল্লাহ তা‘আলা তাকে দুনিয়াতে সৎ আমলের ছাওয়াব প্রদান করবেন এবং আখিরাতেও তাকে উত্তম বিনিময় প্রদান করবেন।
শাইখ মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাব রাহিমাহুল্লাহ বলেন, সালাফদের থেকে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় অনেক আমলের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আজকাল মানুষ এগুলো করে থাকে, কিন্তু তারা এগুলোর অর্থ বুঝে না। তার মধ্যে,
(ক) অনেক মানুষ আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য সৎ কাজ করে থাকে। যেমন তারা দান-সাদকা করে, সালাত কায়েম করে, আত্মীয়-স্বজনের প্রতি সদাচরণ করে, মানুষের প্রতি অনুগ্রহ করে, যুলুম-অত্যাচার পরিহার করে এবং অনুরূপ অন্যান্য যেসব সৎ আমল মানুষ করে থাকে কিংবা যেসব অন্যায় কাজ আল্লাহর জন্য পরিহার করে থাকে তাতে যদি তারা আখিরাতে ছাওয়াবের নিয়ত না করে; বরং এ নিয়ত করে যে, আল্লাহ তা‘আলা যেন এর বিনিময়ে তাদের ধন-সম্পদ হেফাযত করেন, সেটা আরো বাড়িয়ে দেন, তাদের পরিবার-পরিজনের হেফাযত করেন অথবা তাদের পার্থিব নিয়ামত দীর্ঘস্থায়ী করেন, তাহলে তারা দুনিয়াতেই মিনিময় পেয়ে যাবে। আখিরাতে জান্নাত লাভ কিংবা জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার কোনো চিন্তাই যেহেতু তাদের মাথায় থাকেনা, তাই এ শ্রেণীর লোকদের সৎ আমলের ছাওয়াব দুনিয়াতেই প্রদান করা হয়। আখিরাতের নিয়ামত ও সুখ-শান্তিতে তাদের কোনো হিস্সা থাকবে না। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা এ শ্রেণীর মানুষ থাকার কথা উল্লেখ করেছেন।
(খ) এটি প্রথমটির চেয়ে গুরুতর এবং ভয়ানক। ইমাম মুজাহিদ উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় উল্লেখ করেছেন যে, একে কেন্দ্র করেই আয়াতটি নাযিল হয়েছে। তা হলো কিছু মানুষ এমন সৎ আমল করে থাকে, যাতে তার নিয়ত হলো মানুষকে দেখানো; আখিরাতে ছাওয়াব অর্জন করার নিয়ত তার মধ্যে মোটেই থাকে না।
(গ) কিছুলোক রয়েছে, যারা ধন-সম্পদ অর্জনের উদ্দেশ্যে সৎ আমল করে। যেমন সম্পদ কামানোর উদ্দেশ্যে হজ্জে যায়, দুনিয়ার স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে অথবা বিবাহ করার জন্য হিজরত করে কিংবা গণীমতের মাল লাভ করার জন্য জিহাদ করে। উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় এ শ্রেণীর আমলের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। অনুরূপ মানুষ নিজের পরিবারকে শিক্ষা দেয়ার জন্য অথবা তাদের জন্য জীবিকা উপার্জন করার উদ্দেশ্যে কিংবা নেতৃত্ব হাসিল করার জন্য ইলম অর্জন করে থাকে। এমনি কোনো কোনো মানুষ ইমামতি করার জন্য কুরআন শিক্ষা করে এবং যথাসময়ে মসজিদে গিয়ে সালাত কায়েম করে। এ রকম উদাহরণ অনেক রয়েছে।
(ঘ) এমন লোকও রয়েছে, যারা নিষ্ঠাবান হয়ে একমাত্র আল্লাহর আনুগত্য করে যে, তার কোনো শরীক নেই। কিন্তু আল্লাহর আনুগত্য করার সাথে সাথে এমন আমলও করে, যা তাদেরকে কাফের বানিয়ে ফেলে এবং ইসলাম থেকে সম্পূর্ণরূপে বের করে দেয়। যেমন ইয়াহূদী-নাসারাগণ যখন আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি লাভের আশা এবং আখিরাতের কল্যাণের আশায় তার ইবাদত করে, দান-সাদকা করে এবং রোযা রাখে তেমনি এ উম্মতের মধ্যেও অনেক লোক রয়েছে, যারা খালেসভাবে আল্লাহর আনুগত্য করে, তারা এর মাধ্যমে আল্লাহর কাছে আখিরাতে ছাওয়াব কামনা করে, কিন্তু তাদের মধ্যে শিরক ও কুফুরী রয়েছে, যা তাদেরকে ইসলাম থেকে সম্পূর্ণ বের করে দেয়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, তারা একদিকে যেমন আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সৎ আমল করে অন্যদিকে তারা এমন আমলও করে যা তাদেরকে ইসলাম থেকে বের করে দেয় এবং তাদের সৎ আমলগুলো কবুলের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আনাস ইবনে মালেক রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং অন্যান্য সাহাবী থেকে এ শ্রেণীর লোক ও তাদের আমলের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। সালাফগণ এ শ্রেনীর আমলের ভয় করতেন। শাইখ মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাব রাহিমাহুল্লাহর কথা এখানেই শেষ।
উপরোক্ত আয়াত দু’টি এ চার শ্রেণীর মানুষ ও তাদের আচরণকে শামিল করেছে। কেননা তাতে উল্লেখিত শব্দগুলো ব্যাপকার্থবোধক। বিষয়টি অত্যন্ত ভয়াবহ। সুতরাং প্রত্যেক মুসলিমের উচিত আখিরাতের আমলের মাধ্যমে দুনিয়ার লোভ-লালসা বাস্তবায়ন করা থেকে সতর্ক হওয়া।
সহীহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে, যে ব্যক্তি শুধু দুনিয়া লাভের উদ্দেশ্যে আমল করবে, সে তার সকল প্রচেষ্টাসহ দুনিয়ার পিছনেই ছুটবে। এমনকি সে দুনিয়ার গোলামে পরিণত হবে।
সহীহ বুখারীতে আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
تَعِسَ عَبْدُ الدِّينَارِ تَعِسَ عَبْدُ الدِّرْهَمِ تَعِسَ عَبْدُ الْخَمِيصَةِ تَعِسَ عَبْدُ الْخَمِيْلَةِ إِنْ أُعْطِيَ رَضِيَ وَإِنْ لَمْ يُعْطَ سَخِطَ تَعِسَ وَانْتَكَسَ وَإِذَا شِيكَ فَلا انْتَقَشَ طُوبَى لِعَبْدٍ آخِذٍ بِعِنَانِ فَرَسِهِ فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَشْعَثَ رَأْسُهُ مُغْبَرَّةٍ قَدَمَاهُ إِنْ كَانَ فِي الْحِرَاسَةِ كَانَ فِي الْحِرَاسَةِ وَإِنْ كَانَ فِي السَّاقَةِ كَانَ فِي السَّاقَةِ إِنِ اسْتَأْذَنَ لَمْ يُؤْذَنْ لَهُ وَإِنْ شَفَعَ لَمْ يُشَفَّع
‘‘ধ্বংস হোক দীনারের গোলাম, ধ্বংস হোক দিরহামের গোলাম, ধ্বংস হোক উত্তম চাদরের দাস, ধ্বংস হোক নরম পোষাকের গোলাম! তাকে কিছু দেয়া হলে সন্তুষ্ট হয়। আর না দেয়া হলে অসন্তুষ্ট হয়। সে ধ্বংস হোক, উল্টে পড়ুক। সে যখন কাঁটাবিদ্ধ হবে তখন তা খুলতে না পারুক। সুখবর ঐ ব্যক্তির জন্য, যে আল্লাহর পথে জিহাদের জন্য ঘোড়ার লাগাম ধরে আছে। তার মাথা ধুলোমলিন এবং পা দু’টি ধূলোয় ধুসরিত। তাকে সেনাবাহিনীর পাহারায় নিয়োজিত করা হলে সেখানেই নিয়োজিত থাকে। আর তাকে সেনাবাহিনীর পশ্চাতে রাখা হলে সে তাতেই সন্তুষ্ট থাকে। সে অনুমতি প্রার্থনা করলে তাকে অনুমতি দেয়া হয় না। কারো জন্য সুপারিশ করলে তার সুপারিশ গ্রহণ করা হয় না’’।[2]
تعِس শব্দের অর্থ সে হুচট খেয়ে পড়ে গেল। এখানে উদ্দেশ্য হচ্ছে, সে ধ্বংস হলো। এখানে সৎ কাজের মাধ্যমে দুনিয়ার সম্পদ উপার্জনে আগ্রহীকে দিনার ও দিরহামের গোলাম বলার কারণ হচ্ছে, পার্থিব স্বার্থ হাসিল করা ছাড়া সে অন্য কোনো উদ্দেশ্যে আমল করে না। তাই সে অর্থের গোলামে পরিণত হয়েছে। কেননা সে আমলের মাধ্যমে অর্থেরই ইবাদত করেছে। সুতরাং যে ব্যক্তি ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহ ছাড়া অন্যকে উদ্দেশ্য করবে, সে আল্লাহর এবাদতে অন্যকে শরীক সাব্যস্ত করলো। অধিকাংশ মানুষের অবস্থা ঠিক এরকমই। যে ব্যক্তি তার চিন্তা-চেতনা ও প্রচেষ্টাকে দুনিয়া উপার্জন করার পথে ব্যয় করবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উপরোক্ত হাদীছে তার উপর বদ দু‘আ করেছেন সে যেন দুর্ভাগ্যবান হয়, দুর্দশাগ্রস্থ হয়, পতনমুখী হয় এবং সে যেন কাঁটাবিদ্ধ হওয়ার পর সেটা বের করতে অক্ষম হয় অর্থাৎ দুনিয়ার ফিতনায় আক্রান্ত হলে সে যেন তা থেকে পরিত্রাণ না পায়। মোটকথা হাদীছে বর্ণিত নিকৃষ্ট স্বভাবগুলো যার মধ্যে থাকবে তার উপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ বদ দু’আর প্রভাব অবশ্যই পড়বে। ফলে সে দুনিয়া ও আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া রহিমাহুল্লাহ বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ হাদীছে দুনিয়া লিপ্সু ব্যক্তিকে দীনার, দিরহাম ও পোশাক পরিচ্ছদের গোলাম বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং সংবাদ প্রদানের শব্দ ব্যবহার করে বদ দু‘আর উদ্দেশ্য করেছেন। শব্দগুলো হলো, تَعِسَ وَانْتَكَسَ وَإِذَا شِيكَ فَلا انْتَقَشَ। যারা নিজস্ব উদ্যোগে অকল্যাণ ও ফিতনার দিকে অগ্রসর হয়, তারা তাতে আক্রান্ত হয়। তাদের অবস্থা ঠিক এ রকমই। তারা তাতে আক্রান্ত হলে তা থেকে বের হতে পারে না। কেননা সে ব্যর্থ হয় এবং ক্ষতিগ্রস্থ হয়। মূলতঃ সে উদ্দেশ্য হাসিল তো করতে পারেই না; বরং তা হাসিল করতে গিয়ে যে বিপদে পড়ে, তা থেকে বের হওয়ার কোনো সুযোগ পায় না। যারা ধন-সম্পদের মোহে পড়ে তাদের অবস্থা ঠিক এ রকমই। দুনিয়া পূজারীর অবস্থা হলো, তাকে যখন দেয়া হয় তখন খুশি হয় এবং দেয়া না হলে অসন্তুষ্ট হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمِنْهُمْ مَنْ يَلْمِزُكَ فِي الصَّدَقَاتِ فَإِنْ أُعْطُوا مِنْهَا رَضُوا وَإِنْ لَمْ يُعْطَوْا مِنْهَا إِذَا هُمْ يَسْخَطُونَ﴾
‘‘হে নবী! তাদের কেউ কেউ সাদকাহ বণ্টনের ব্যাপারে তোমার বিরুদ্ধে আপত্তি জানাচ্ছে। এ সম্পদ থেকে যদি তাদের কিছু দেয়া হয় তাহলে তারা খুশি হয়, আর না দেয়া হলে অসন্তুষ্ট হয়’’। (সূরা আত তাওবা: ৫৮)
সুতরাং তারা আল্লাহ ছাড়া অন্যের জন্য সন্তুষ্ট হয় এবং আল্লাহ ছাড়া অন্যের জন্য অসন্তুষ্ট হয়। এমনি যারা কোনো পদমর্যাদা কিংবা প্রশংসা অর্জনের পিছনে লেগে থাকে অথবা অনুরূপ প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণে ব্যস্ত থাকে, তাদের অবস্থা হলো তারা যদি উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারে, তাহলে তারা সন্তুষ্ট হয় এবং উদ্দেশ্য হাসিল না হলে অসন্তুষ্ট হয়। উপরোক্ত জিনিসগুলো থেকে এদের নফ্স যা চায়, তারা তার গোলামী করে এবং তারই ক্রীতদাসে পরিণত হয়। কেননা অন্তর-মন দিয়ে গোলামী করা এবং ইবাদত করাই প্রকৃত গোলামী ও ইবাদত। যে জিনিস কারো অন্তরকে গোলাম ও দাস বানিয়ে ফেলে অন্তর ওয়ালা তারই বান্দায় রূপান্তরিত হয়।
দুনিয়ার সম্পদ অন্বেষণকারীরা ঠিক এ রকমই। যে সবসময় মাল উপার্জনের পিছনে লেগে থাকে, মাল তাকে দাসে পরিণত করে এবং গোলাম বানিয়ে ফেলে। ধন-সম্পদ মূলত দুই প্রকার।
(ক) এমন সম্পদ, যার প্রতি বান্দার প্রয়োজন রয়েছে। পানাহার, বিবাহ-সাদি, বসতবাড়ী ইত্যাদির জন্য বান্দা মালের প্রতি মুখাপেক্ষী। এ জাতিয় প্রয়োজন মিটাতে বান্দার মালের প্রয়োজন হয়। সুতরাং সে আল্লাহর কাছে প্রয়োজন মোতাবেক মাল চাইবে এবং সেটা পাওয়ার জন্য আগ্রহী হবে। নিজের প্রয়োজন মোতাবেক মাল সংগ্রহ করার পর বান্দা সেটাকে নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করবে। মালকে ঠিক সেভাবেই ব্যবহার করবে, যেভাবে সে নিজের গাধাকে বশীভূত করে তার উপর আরোহন করে এবং সেটাকে স্বীয় বিছানার মতো মনে করবে, যার উপর সে বসে। তবে মাল যেন তাকেই দাসে পরিণত না করে এবং মাল উপার্জনের জন্য সে যেন অস্থির না হয়।
(খ) আরেক প্রকার মাল হলো, যার প্রতি বান্দার কোনো প্রয়োজন পড়ে না। এ শ্রেণীর মালের প্রতি যেন বান্দার অন্তর ঝুকে না পড়ে। তার মন যখন এর প্রতি ঝুকে পড়ে, তখন সে মালের বান্দা হয়ে যায় এবং আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এতে করে আল্লাহর ইবাদতের হাকীকত এবং তার উপর ভরসা করার হাকীকত তার সাথে বিদ্যমান থাকে না। বরং আল্লাহ ছাড়া অন্যের ইবাদতের একটি শাখা তার মধ্যে ঢুকে পড়ে এবং আল্লাহ ছাড়া অন্যের উপর ভরসা করার একটি প্রবণতা তার মধ্যে এসে যায়।
এ শ্রেণীর লোকের উপরই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিম্নের বাণীটি প্রযোজ্য হয়। তিনি বলেছেন,
تَعِسَ عَبْدُ الدِّينَارِ تَعِسَ عَبْدُ الدِّرْهَمِ تَعِسَ عَبْدُ الْخَمِيصَةِ تَعِسَ عَبْدُ الْخَمِيْلَةِ
‘‘ধ্বংস হোক দীনারের গোলাম, ধ্বংস হোক দিরহামের গোলাম, ধ্বংস হোক উত্তম চাদরের দাস, ধ্বংস হোক নরম পোষাকের গোলাম!’’
দুনিয়া লোভী লোকেরা উপরোক্ত জিনিসগুলোর বান্দায় পরিণত হয়। যদিও তারা এগুলো আল্লাহর কাছেই চায়, কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা যখন এগুলো তাদেরকে দান করেন, তখন খুশি হয় আর না দিলে অসন্তুষ্ট হয়। অপর দিকে আল্লাহ তা‘আলা যা পছন্দ করেন, তা পেয়েই যারা সন্তুষ্ট থাকে, তিনি যা অপছন্দ করেন, তারা তা অপছন্দ করে, তিনি ও তার রসূল যা ভালোবাসেন, যারা তা ভালোবাসে, তিনি ও তার রসূল যা ঘৃণা করেন, যারা তা ঘৃণা করে এবং তার বন্ধুদেরকে যারা বন্ধু বানায় তারাই আল্লাহর খাঁটি বান্দা। তারাই পরিপূর্ণ ঈমানদার। শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়ার কথা এখানেই শেষ।
গ্রন্থকার বলেন, আমি বলছি, বর্তমান সময়ে যারা ধন-সম্পদের মোহে পড়ে হারাম লেন-দেন করে এবং অবৈধ ইনকামের দিকে ঝুঁকে পড়ছে, তারা অর্থের গোলাম। যেমন সুদী ব্যাংক এবং সুদ ভিত্তিক অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সাথে যারা লেন-দেন করে, যারা ঘুষ, জুয়া খেলা, লেনদেনে প্রতারণা করে এবং মামলা-মুকাদ্দমায় মিথ্যা শপথ করার মাধ্যমে যারা অর্থ উপার্জন করে, তারাও অর্থের গোলাম। কেননা তারা জানে যে, এসব উপার্জন হারাম। কিন্তু অর্থের লোভ তাদেরকে অন্ধ করে রেখেছে এবং সেটা তাদেরকে দাসে পরিণত করেছে। এর ফলে তারা যে কোনো উপায়ে অর্থ উপার্জন করার চেষ্টা করে।
আমরা আল্লাহ তা‘আলার কাছে আমাদের জন্য এবং আমাদের মুসলিম ভাইদের জন্য পার্থিব স্বার্থান্বেষণ, প্রবৃত্তির অনুসরণ এবং নিজস্ব মতকেই প্রাধান্য দেয়ার ফিতনা থেকে নিরাপত্তা কামনা করছি।
[1]. সহীহ মুসলিম ২৯৮৫, অধ্যায়: যে ব্যক্তি আমলে শিরক করলো।
[2]. সহীহ বুখারী ২৮৮৭।
অভ্যাসগতভাবে কতিপয় মানুষ যেসব ভুল-ভ্রান্তিতে লিপ্ত হয়, আমরা তা থেকে আরো কতিপয় ভুল-ভ্রান্তি এখানে উল্লেখ করবো। এগুলো মানুষের তাওহীদকে ত্রুটিপূর্ণ করে দেয় এবং আকীদাকে নষ্ট করে ফেলে। যামানা, বাতাস এবং এ ধরণের অন্যান্য জিনিসকে গালি দেয়াও প্রচলিত ভুল-ত্রুটিগুলোর মধ্যে গণ্য। যেসব বিষয়ে সৃষ্টির কোনো ক্ষমতা নেই, ঐসব বিষয়ে সৃষ্টিকে দোষারোপ করা মানুষের অভ্যাসগত প্রচলিত ভুলের অন্তর্ভুক্ত। প্রকৃতপক্ষে এ দোষারোপ আল্লাহ তা‘আলাকেই করা হয়। কেননা তিনিই এগুলোর একমাত্র স্রষ্টা এবং সবকিছুর পরিচালক। আল্লাহ তা‘আলা মুশরিকদের সম্পর্কে বলেন,
﴿وَقَالُوا مَا هِيَ إِلَّا حَيَاتُنَا الدُّنْيَا نَمُوتُ وَنَحْيَا وَمَا يُهْلِكُنَا إِلَّا الدَّهْرُ وَمَا لَهُمْ بِذَلِكَ مِنْ عِلْمٍ إِنْ هُمْ إِلَّا يَظُنُّونَ﴾
‘‘অবিশ্বাসীরা বলে, ‘শুধু দুনিয়ার জীবনই আমাদের আসল জীবন। আমরা এখানেই মরি ও বাঁচি। যামানা ব্যতীত অন্য কিছুই আমাদেরকে ধ্বংস করে না। তাদের কাছে এ ব্যাপারে কোনো জ্ঞান নেই। তারা কেবল অনুমান করে কথা বলে’’। (সূরা জাসিয়া: ২৪)
যারা পুনরুত্থানকে অস্বীকার করেছে তারা বলেছে, পার্থিব জীবনই আসল জীবন। আমরা বর্তমানে যে জীবনে আছি, তাই আসল জীবন। এ ছাড়া আর কোনো জীবন নেই। আমরা এতেই জীবিত থাকি এবং এতেই মৃত্যু বরণ করি। একদল লোক মৃত্যু বরণ করার পর আরেক দল লোক এখানে বসবাস করে। এ কথার মাধ্যমে তারা সৃষ্টিজগতের স্রষ্টা ও পরিচালকের অস্তিত্বকে অস্বীকার করেছে এবং মহাবিশ্বের সব ঘটনাকে তারা প্রকৃতির দিকে সম্বন্ধ করেছে। এ জন্যই তারা বলেছে, ﴿وَمَا يُهْلِكُنَا إِلَّا الدَّهْرُ﴾ ‘‘মহাকাল ব্যতীত অন্য কিছুই আমাদেরকে ধ্বংস করে না’’। দিবারাত্রির আবর্তন-বিবর্তনই আমাদেরকে নিঃশেষ করে ফেলে। তাই যামানাকে দোষারোপ করে তার দিকেই তারা নিজেদের ধ্বংসের সম্বন্ধ করেছিল। তারা মূর্খতা বশতঃ অনুমান করে এ কথা বলেছিল। ইলম এবং দলীলের ভিত্তিতে তারা এটি বলেনি।
সুতরাং এটি একটি বাতিল কথা। দলীল-প্রমাণ দ্বারা সাব্যস্ত যে, সৃষ্টিজগতে যা কিছু ঘটে তার জন্য এক প্রজ্ঞাবান ও সক্ষম পরিচালক থাকা আবশ্যক। তিনি হলেন মহান স্রষ্টা আল্লাহ তা‘আলা। সুতরাং যে ব্যক্তি যামানাকে গালি দিলো এবং সৃষ্টিজগতের কোনো কিছু তার দিকে সম্বন্ধ করলো, সে এ নিকৃষ্ট স্বভাবের ক্ষেত্রে মুশরিক ও বস্তুবাদীদের সাথে অংশগ্রহণ করলো। যদিও সে আকীদার মৌলিক বিষয়সমূহে তাদের অংশীদার নয়।
সহীহ বুখারী (৪৮২৬), সহীহ মুসলিম এবং অন্যান্য কিতাবে আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালাম বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
(يُؤْذِينِي ابْنُ آدَمَ يَسُبُّ الدَّهْرَ وَأَنَا الدَّهْرُ بِيَدِي الأَمْرُ أُقَلِّبُ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ
‘‘বনী আদম আমাকে কষ্ট দেয়। তারা যামানাকে গালি দেয়। অথচ আমিই যামানা। আমার হাতেই সকল ক্ষমতা। রাত-দিনকে আমিই পরিবর্তন করি’’।[1] অন্য বর্ণনায় আছে, তোমরা যামানাকে গালি দিয়ো না। কারণ আল্লাহই হচ্ছেন যামানা।
হাদীছটি প্রমাণ করে, যে ব্যক্তি যামানাকে গালি দিলো, সে আল্লাহ তা‘আলাকে কষ্ট দিলো। কেননা এতে করে সমস্ত সৃষ্টির স্রষ্টা ও ব্যবস্থাপকের দিকেই গালি চলে যায়। যুগ কেবল সবকিছু ঘটার সময় এবং আজ্ঞাবহ সৃষ্টি মাত্র। পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় যামানার কোনো অংশ নেই। এ জন্যই আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, আমিই যামানা বা মহাকাল।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী, أنا الدهر ‘‘অথচ আমিই যামানা’’ -এ কথার ব্যাখ্যা হলো আমিই রাত ও দিন পরিবর্তন করি। فإن الله هو الدهر এ কথার অর্থও অনুরূপ। মোটকথা আল্লাহ তা‘আলাই যামানা এবং অন্যান্য সৃষ্টির পরিচালক ও ব্যবস্থাপক। সুতরাং যে ব্যক্তি যামানাকে গালি দেয় সে মূলত যামানার স্রষ্টাকেই গালি দেয়। তিনি হলেন আল্লাহ তা‘আলা। কতিপয় সালাফ বলেছেন, জাহেলী যুগের আরবগণের অভ্যাস এই ছিল যে, তারা যামানাকে দোষারোপ করতো। বিভিন্ন রকম বিপদাপদের সময় যামানাকে গালি দিতো। তারা যখন কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতো অথবা বালা মুছীবতে পড়তো, তখন বলতো যে, কালের দুর্বিপাক তাদেরকে মুছীবতে ফেলেছে এবং যামানা তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছে। তারা আরো বলতো, হে কালের ব্যর্থতা! এসব কথা কলে তারা নিজেদের ব্যর্থতাকে যামানার দিকে সম্বন্ধ করতো এবং যামানাকে গালি দিতো। অথচ যামানার স্রষ্টা কেবল আল্লাহ তা‘আলা। তাদের দুঃখ-কষ্টকে যখন তারা যামানার দিকে সম্বন্ধ করলো, তখন তারা মূলত আল্লাহ তা‘আলাকেই গালি দিলো। কেননা যামানার স্রষ্টা আল্লাহ তা‘আলা।
শাইখ আব্দুর রাহমান ইবনে হাসান রহিমাহুল্লাহ বলেন, ইমাম ইবনে হায্ম এবং তার মতো যারা এ হাদীছের বাহ্যিক অর্থের উপর নির্ভর করে الدهر কে আল্লাহ তা‘আলার অতি সুন্দর নামের মধ্যে গণ্য করেছেন, তারা মারাত্মক ভুল করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা الدهر এর অর্থ এভাবে বর্ণনা করেছেন যে, আমিই দিবারাত্রির পরিবর্তনকারী। দিবারাত্রি পরিবর্তন করার অর্থ হলো আল্লাহ তা‘আলা তাতে মানুষ যা পছন্দ করে কিংবা যা অপছন্দ করে, তা সবই তিনি ঘটিয়ে থাকেন। মুসলিমদের উচিত এ ধরণের শব্দ পরিহার করা। যদিও সে বিশ্বাস করে, আল্লাহ তা‘আলাই একমাত্র সবকিছুর পরিচালক ও ব্যবস্থাপক। কিন্তু এ ধরণের শব্দমালা ব্যবহার করা থেকে বেঁচে থাকার মাধ্যমেই কাফেরদের সাদৃশ্য করা থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব। এর মাধ্যমেই আকীদা সংরক্ষণ করা এবং আল্লাহ তা‘আলার সাথে আদব রক্ষা করে চলা সম্ভব। বাতাসকে গালি দেয়াও যামানাকে গালি দেয়ার মতোই।
তিরমিযীতে বর্ণিত হাদীছে বাতাসকে গালি দেয়ার নিষেধাজ্ঞা এসেছে। ইমাম তিরমিযী উবাই ইবনে কা’ব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে হাদীছটি বর্ণনা করার পর সেটাকে সহীহ বলেছেন। উবাই ইবনে কা’ব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা বাতাসকে গালি দিও না। তোমরা যখন অপছন্দনীয় কিছু দেখবে, তখন বলবে,
اللَّهُمَّ إِنَّا نَسْأَلُكَ مِنْ خَيْرِ هَذِهِ الرِّيحِ وَخَيْرِ مَا فِيهَا وَخَيْرِ مَا أُمِرَتْ بِهِ وَنَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ هَذِهِ الرِّيحِ وَشَرِّ مَا فِيهَا وَشَرِّ مَا أُمِرَتْ بِهِ
‘‘হে আল্লাহ! এ বাতাসের যা কল্যাণকর, এতে যে মঙ্গল নিহিত আছে এবং যতটুকু কল্যাণ করার জন্য সে অদিষ্ট হয়েছে ততটুকু কল্যাণ ও মঙ্গল আমরা তোমার কাছে প্রার্থনা করছি। আর এ বাতাসের যা অনিষ্টকর, তাতে যে অমঙ্গল লুকায়িত আছে এবং যতটুকু অনিষ্ট সাধনের ব্যাপারে সে আদিষ্ট হয়েছে তা থেকে আমরা তোমার কাছে আশ্রয় চাচ্ছি’’।[2]
বাতাসের কল্যাণ প্রার্থনা করা এবং বাতাসের অকল্যাণ থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করার কারণ হলো, বাতাস আল্লাহর আদেশ এবং তারই ব্যবস্থাপনায় প্রবাহিত হয়। তিনি বাতাস সৃষ্টি করেছেন এবং তিনিই বাতাসকে প্রবাহিত হওয়ার আদেশ দিয়েছেন। সুতরাং বাতাসকে গালি দেয়া এবং বাতাসের স্রষ্টাকে গালি দেয়া একই কথা। আল্লাহর আনুগত্য করা ও তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার মাধ্যমেই নিয়ামত আগমন করে। আর আল্লাহর দিকে ফিরে যাওয়া এবং তার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করার মাধ্যমে শাস্তি বিদূরিত হয়। এসব সৃষ্টিকে গালি দেয়ার মধ্যে অনেক ক্ষতি রয়েছে।
(ক) এতে করে যে গালির উপযুক্ত নয়, তাকে গালি দেয়া হয়ে থাকে। কেননা বাতাস সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর তা‘আলার বশীভূত ও পরিচালনাধীন।
(খ) বাতাস বা অন্যান্য সৃষ্টিকে গালি দেয়ার মাধ্যমে শিরক হয়ে যায়। কারণ সে বাতাসকে এই মনে করে গালি দিয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত সেটা নিজস্ব ক্ষমতা বলে কারো ক্ষতি করতে পারে কিংবা উপকার করতে পারে।
(গ) সৃষ্টিকে গালি দেয়া হলে যিনি এগুলো সৃষ্টি করেছেন, তার উপর গিয়েই গালি পতিত হয়। তিনি হলেন মহান আল্লাহ তা‘আলা।
অপর দিকে বাতাস প্রবাহিত হওয়ার সময় বান্দা যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরামর্শ মেনে চলবে, যেখানে তিনি বলেছেন, তোমরা যখন বাতাস প্রবাহিত হতে দেখো, তখন বলবে,
اللَّهُمَّ إِنَّا نَسْأَلُكَ مِنْ خَيْرِ هَذِهِ الرِّيحِ وَخَيْرِ مَا فِيهَا وَخَيْرِ مَا أُمِرَتْ بِهِ وَنَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ هَذِهِ الرِّيحِ وَشَرِّ مَا فِيهَا وَشَرِّ مَا أُمِرَتْ بِهِ
‘‘হে আল্লাহ! এ বাতাসের যা কল্যাণকর, এতে যে মঙ্গল নিহিত আছে এবং যতটুকু কল্যাণ করার জন্য সে অদিষ্ট হয়েছে ততটুকু কল্যাণ ও মঙ্গল আমরা তোমার কাছে প্রার্থনা করছি। আর এ বাতাসের যা ক্ষতিকর, তাতে যে অমঙ্গল নিহিত আছে এবং যতটুকু ক্ষতি সাধনের ব্যাপারে সে আদিষ্ট হয়েছে তা থেকে আমরা তোমার কাছে আশ্রয় চাই’’। বান্দা এভাবে বাতাসের ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য তার স্রষ্টা, পরিচালক ও পরিবর্তনকারীর দিকে এভাবে আশ্রয় নিবে। এটিই হলো প্রকৃত তাওহীদ ও জাহেলী যামানার লোকদের আকীদা-বিশ্বাসের পরিপন্থী সঠিক আকীদা।
সকল ক্ষেত্রেই সদাসর্বদা মুমিনের অবস্থা এমন হওয়া চাই। সবকিছুই সে আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে দিবে। আল্লাহর কাছে সে সেটার কল্যাণ চাইবে এবং সেটার অকল্যাণ থেকে বাঁচার জন্য তার কাছেই আশ্রয় প্রার্থনা করবে। কিন্তু বাতাসকে দোষারোপ করবে না, গালি দিবে না এবং বাতাসের সঠিক ব্যাখ্যা বাদ দিয়ে অন্য কোনো ব্যাখ্যাও করবে না।
বান্দা জেনে রাখবে যে, সৃষ্টি থেকে সে অপ্রিয় যা কিছুর সম্মুখীন হয়, তা কেবল আল্লাহ তা‘আলার নির্ধারণ অনুযায়ী এবং বান্দার পাপ অনুযায়ী হয়ে থাকে। বান্দার পাপের কারণে আল্লাহ তা‘আলা তার বান্দার উপর বিপদা-পদ ও মুছীবত চাপিয়ে দেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন,
﴿وَمَا أَصَابَكُم مِّن مُّصِيبَةٍ فَبِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيكُمْ وَيَعْفُو عَن كَثِيرٍ﴾
‘‘তোমাদের উপর যে মসিবতই এসেছে তা তোমাদের কৃতকর্মের কারণে এসেছে। বহু সংখ্যক অপরাধকে তো আল্লাহ ক্ষমা করে দিয়ে থাকেন’’ (সূরা শূরা: ৩০) আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿اللَّهُ الَّذِي يُرْسِلُ الرِّيَاحَ فَتُثِيرُ سَحَابًا فَيَبْسُطُهُ فِي السَّمَاءِ كَيْفَ يَشَاءُ وَيَجْعَلُهُ كِسَفًا فَتَرَى الْوَدْقَ يَخْرُجُ مِنْ خِلَالِهِ﴾
‘‘আল্লাহ, যিনি বায়ু প্রেরণ করেন। ফলে তা মেঘমালাকে সঞ্চালিত করে। অতঃপর তিনি যেমন ইচ্ছা আকাশে ছড়িয়ে দেন। পরে একে খ--বিখ- করেন এবং তুমি দেখতে পাও তা থেকে বারিধারা নির্গত হয়’’। (সূরা আর রূম: ৪৮)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
وَتِلْكَ الْأَيَّامُ نُدَاوِلُهَا بَيْنَ النَّاسِ
‘‘আর এ দিনগুলোকে আমি মানুষের মধ্যে পালাক্রমে আবর্তন ঘটিয়ে থাকি’’। (সূরা আলে-ইমরান: ১৪০) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
يُقَلِّبُ اللَّهُ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَعِبْرَةً لِأُولِي الْأَبْصَارِ
‘‘আল্লাহ দিন ও রাতের পরিবর্তন ঘটান। অন্তদৃষ্টি সম্পন্ন লোকদের জন্য এতে শিক্ষা রয়েছে’’। (সূরা আন নূর: ৪৪)
আসলে ভালো-মন্দ, কল্যাণ-অকল্যাণ সবকিছুই আল্লাহর পক্ষ হতে। সুখ-দুঃখ উভয় অবস্থাতেই আল্লাহর প্রশংসা করা, আল্লাহর প্রতি ভালো ধারণা রাখা এবং তাওবা করার মাধ্যমে আল্লাহর দিকে ফিরে আসা আবশ্যক।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَبَلَوْنَاهُمْ بِالْحَسَنَاتِ وَالسَّيِّئَاتِ لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ‘‘আমি ভালো ও খারাপ অবস্থায় নিক্ষেপ করার মাধ্যমে তাদেরকে পরীক্ষা করতে থাকি, হয়তো তারা ফিরে আসবে’’। (সূরা আল আরাফ: ১৬৮) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَلَقَدْ أَخَذْنَا آلَ فِرْعَوْنَ بِالسِّنِينَ وَنَقْصٍ مِّنَ الثَّمَرَاتِ لَعَلَّهُمْ يَذَّكَّرُونَ﴾
‘‘ফেরাউনের লোকদেরকে আমি কয়েক বছর পর্যন্ত দুর্ভিক্ষ ও ফসল হানিতে আক্রান্ত করেছি। এ উদ্দেশ্যে যে, হয়তো তারা উপদেশ গ্রহণ করবে’’। (সূরা আরাফ: ১৩০)
পৃথিবীতে অকল্যাণকর যা কিছু ঘটে, তার এটিই সঠিক ব্যাখ্যা। সুতরাং ভালোভাবে জেনে রাখবে, যেসব অপ্রিয় বস্তুর সম্মুখীন সে হয়ে থাকে, তা কেবল তার গুনাহর কারণেই। এতে তার নিজেকেই দোষারোপ করা উচিত। যামানাকে কিংবা বাতাসকে দোষারোপ করা ঠিক নয়। অতঃপর আল্লাহর নিকট তাওবা করা আবশ্যক। কিন্তু কাফের, ফাসেক এবং মূর্খরা সৃষ্টিজগতের এসব বস্তুকে দোষারোপ করে থাকে। নিজের নাফ্সের হিসাব নেয় না এবং গুনাহ থেকে তাওবা করে না। যামানাকে দোষারোপ করে কোনো এক কবি বলেছেন,
يا دهــر ويحك ما أبقيت لي أحــدا وأنت والــد سوء تأكـل الولــــدا
ওহে মহাকাল! অকল্যাণ হোক তোমার! তুমি আমার স্বজনদের মধ্যে কাউকে অবশিষ্ট রাখোনি। তুমিই অকল্যাণের মূল। তুমি এমন নিকৃষ্ট পিতা, যে তার সন্তানকে খেয়ে ফেলে। আরেক কবি বলেন,
قبحا لوجـهك يـا زمان كـــأنه وجـه لــه من كـل قــبح بــــرقع
ওহে যামানা! বিভৎস হোক তোমার চেহারা। তোমার চেহারা এত কুৎসিত, যাকে সমস্ত কুৎসিত পর্দা দ্বারা ঢেকে রাখা হয়েছে।
আমরা আল্লাহর কাছে এ ধরণের কথা বলা থেকে নিরাপত্তা কামনা করছি এবং দীনের সঠিক জ্ঞান প্রার্থনা করছি।
[1]. আমিই যুগ বা মহাকাল- এ কথা থেকে বুঝা যায় না যে, الدهر দাহর আল্লাহর একটি নাম। কেননা হাদীছের শেষাংশে এর ব্যাখ্যা বলে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহর হাতেই যুগের পরিবর্তনসহ সকল কিছুর ব্যবস্থাপনা, তিনিই দিন-রাত পরিবর্তন করেন।
[2]. সহীহ: তিরমিযী, অধ্যায়: বাতাসকে গালি দেয়া নিষেধ। হাদীছ নং-২২৫২।
এমন কিছু শব্দ রয়েছে, যা উচ্চারণ করা মোটেই ঠিক নয়। কারণ এটি মানুষের আকীদা নষ্ট করে। বিশেষ করে কিছু কিছু ক্ষেত্রে لَوْ শব্দটি ব্যবহার করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। মানুষ যখন অপ্রিয় পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় কিংবা মুছীবতে পড়ে তখন সে যেন এমন না বলে, আমি যদি এমন করতাম, তাহলে আমার এ বিপদ হতো না! আমি যদি এমন না করতাম, তাহলে আমার এমন হতো না। কেননা এ ধরণের কথার মধ্যে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, বান্দার যা হাতছাড়া হলো এবং যা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয় তাতে তার ধৈর্য নেই। সেই সঙ্গে যে ব্যক্তি لو শব্দটি উচ্চারণ করে, তার কথার মধ্যে আরো ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, তাক্বদীর ও আল্লাহ তা‘আলার ফায়ছালার প্রতি তার ঈমান নেই। এতে নিজের নফস্কে দোষারোপ করা এবং কুমন্ত্রণা ও দুশ্চিন্তা প্রদানের জন্য শয়তানকে সুযোগ করে দেয়া হয়।
কোনো মুসলিমের উপর মুছীবত নেমে আসলে তাক্বদীরকে মেনে নেয়া এবং মুছীবতে সবর করা আবশ্যক। তবে নিজের নফস্কে দোষারোপ না করে কল্যাণ আনয়নকারী উপায়-উপকরণ সংগ্রহ করা এবং অকল্যাণ প্রতিহতকারী ও অপ্রিয় বস্তু বিদূরিতকারী উপায়-উপকরণ অবলম্বন করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা জরুরী।
উহুদ যুদ্ধে মুসলিমদের উপর যে বিপদাপদ নেমে এসেছিল, তার কারণে যারা لو শব্দটি ব্যবহার করেছিল, তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা দোষারোপ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿يَقُولُونَ لَوْ كَانَ لَنَا مِنَ الْأَمْرِ شَيْءٌ مَا قُتِلْنَا هَاهُنَا﴾
‘‘তারা বলে, এ ব্যাপারে যদি আমাদের করণীয় কিছু থাকতো, তাহলে আমরা এখানে নিহত হতাম না’’। (সূরা আলে-ইমরান: ১৫৪)
উহুদ যুদ্ধের দিন মুসলিমদের উপর যখন মুছীবত নেমে আসলো, তখন কতিপয় মুনাফেক তাক্বদীরের বিরোধীতা করে উপরোক্ত কথা বলেছে। শত্রুদের মোকাবেলা করার জন্য বের হওয়ার কারণে তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও মুসলিমদেরকে দোষারোপ করছিল। তাই আল্লাহ তা‘আলা তাদের কথার জবাব দিতে গিয়ে বলেছেন,
﴿قُل لَّوْ كُنتُمْ فِي بُيُوتِكُمْ لَبَرَزَ الَّذِينَ كُتِبَ عَلَيْهِمُ الْقَتْلُ إِلَىٰ مَضَاجِعِهِمْ﴾
‘‘ওদেরকে বলে দাও, তোমরা যদি নিজেদের গৃহে অবস্থান করতে তাহলেও যাদের মৃত্যু লেখা হয়েছিল, তারা নিজেরাই নিজেদের বধ্যভূমির দিকে এগিয়ে আসতো’’। (সূরা আলে-ইমরান: ১৫৪) এটি হলো আল্লাহর পক্ষ হতে নির্ধারিত তাক্বদীর, যা সংঘটিত হবেই। গৃহে অবস্থান করে এ থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই।
মুছীবত আসার পর لو শব্দ ব্যবহার করলে আফসোস করলে দুঃশ্চিন্তা, নিজের নফ্সকে দোষারোপ করা এবং দুর্বলতা বৃদ্ধি করে। এতে করে মানুষের আকীদার উপর বিরূপ প্রভাব পড়ে এবং তাদের মধ্যে তাক্বদীর না মানার প্রবণতা সৃষ্টি হয়। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা এসব মুনাফেকদের সম্পর্কে আরেকটি কথা বলেছেন। আল্লাহ তা‘আলার এ বাণীর মধ্যে তাদের কথা ব্যক্ত করা হয়েছে। তিনি বলেন,
﴿الَّذِينَ قَالُوا لِإِخْوَانِهِمْ وَقَعَدُوا لَوْ أَطَاعُونَا مَا قُتِلُوا﴾
‘‘এরা নিজেরা বসে থাকলো এবং এদের ভাই বন্ধুদের সম্পর্কে বললো, তারা যদি আমাদের কথা মেনে নিতো, তাহলে তারা নিহত হতো না’’ (সূরা আলে ইমরান:১৬৮)।
মুনাফেকরা উহুদ যুদ্ধের দিন এ কথা বলেছিল। বর্ণনা করা হয় যে, আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই তাক্বদীরের উপর আপত্তি করে বলেছিল, তারা যদি আমাদের পরামর্শ মেনে নিয়ে নিজ নিজ গৃহে বসে থাকতো এবং উহুদের দিকে বেরিয়ে না যেতো, তাহলে তারা নিহত হতো না। আল্লাহ তা‘আলা তাদের কথার প্রতিবাদ করে বলেছেন,
﴿قُلْ فَادْرَءُوا عَنْ أَنفُسِكُمُ الْمَوْتَ إِن كُنتُمْ صَادِقِينَ﴾
‘‘তোমরা নিজেদের কথায় যদি সত্যবাদী হয়ে থাকো, তাহলে তোমাদের নিজেদের মৃত্যু যখন আসবে তখন তা থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করো’’(সূরা আলে ইমরান:১৬৮)।
অর্থাৎ ঘরে বসে থাকা এবং যুদ্ধের ময়দানে না যাওয়াই যখন কারো মৃত্যু বরণ করা কিংবা নিহত হওয়া থেকে বেঁচে যাওয়ার কারণ, তাই তোমাদের মৃত্যু বরণ করা উচিত নয়। আসল কথা হলো তোমরা যেখানেই থাকো না কেন মৃত্যু তোমাদের কাছে আসবেই। সুতরাং তোমাদের দাবিতে যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাকো যে, যারা তোমাদের কথা মেনে নিবে, তারা মৃত্যু থেকে বেঁচে যাবে, তাহলে নিজেদের উপর থেকে মৃত্যু ঠেকিয়ে রাখো।
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া রহিমাহুল্লাহ বলেন, ইবনে উবাই উহুদ যুদ্ধের দিন মুসলিমদের জামা‘আত থেকে কেটে পড়ার সময় বলল, মুহাম্মাদ আমার মত ও তার নিজের মত পরিহার করে শিশুদের মত গ্রহণ করে। এ কথা বলে সে নিজে কেটে পড়ল এবং তার সাথে আরো অনেকেই কেটে পড়ল। এসব মুনাফেকদের অনেকেই ইতিপূর্বে মুনাফেক ছিল না। তারা ছিল মুসলিম। তাদের ঈমানের আলো এত উজ্জ্বল ছিল যে, আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে তার দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন। তারা যদি উহুদ যুদ্ধের পূর্বে অথবা নিফাকী প্রকাশ পাওয়ার পূর্বে মারা যেতো, তাহলে তারা ইসলামের উপরেই মৃত্যু বরণ করতো। আর এ মুনাফেকরা কখনো প্রকৃত মুমিন ছিল না। প্রকৃত মুমিনদেরকে পরীক্ষায় ফেলার পরও তারা ঈমানের উপর টিকে ছিল। তারা ঐসব মুনাফেকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না, যারা ফিতনায় নিপতিত হয়ে ঈমান ছেড়ে দিয়ে মুরতাদ হয়ে গিয়েছিল। শাইখের কথা এখানেই শেষ।
মোটকথা মুছীবতের সময় لو শব্দ উচ্চারণ করা ঐসব মুনাফেকদের স্বভাবের অন্তর্ভুক্ত, যারা তাক্বদীরের ফায়ছালার উপর ঈমান আনে না। মুসলিম যখন বিপদাপদ ও মুছীবতে আক্রান্ত হবে, তখন সে যেন এ শব্দটি উচ্চারণ করা থেকে দূরে থাকে। সে যেন এ শব্দের পরিবর্তে এমন ভালো শব্দ উচ্চারণ করে, যাতে আল্লাহর নির্ধারণের প্রতি সন্তুষ্ট থাকা, ধৈর্য ধারণ করা ও ছাওয়াবের আশা করার অর্থ বিদ্যমান থাকে।
মুসলিম শরীফে আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ধরণের শব্দের প্রতিই নির্দেশ প্রদান করেছেন। তিনি বলেছেন,
الْمُؤْمِنُ الْقَوِىُّ خَيْرٌ وَأَحَبُّ إِلَى اللَّهِ مِنَ الْمُؤْمِنِ الضَّعِيفِ وَفِى كُلٍّ خَيْرٌ احْرِصْ عَلَى مَا يَنْفَعُكَ وَاسْتَعِنْ بِاللَّهِ وَلاَ تَعْجِزْ وَإِنْ أَصَابَكَ شَىْءٌ فَلاَ تَقُلْ لَوْ أَنِّى فَعَلْتُ كَانَ كَذَا وَكَذَا. وَلَكِنْ قُلْ قَدَرُ اللَّهِ وَمَا شَاءَ فَعَلَ فَإِنَّ لَوْ تَفْتَحُ عَمَلَ الشَّيْطَانِ
‘‘শক্তিশালী মুমিন আল্লাহর নিকট দুর্বল মুমিনের চেয়ে অধিক ভালো ও প্রিয়। তবে প্রত্যেকের মধ্যেই কল্যাণ রয়েছে। যে জিনিস তোমার উপকার সাধন করবে, তা অর্জন করার জন্য আগ্রহী হও এবং কেবল আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাও। আর এ রকম যেন না হয় যে, তাক্বদীরের উপর ভরসা করে হাত গুটিয়ে অপারগ-অক্ষম হয়ে বসে থাকবে। কল্যাণকর ও উপকারী জিনিস অর্জনে সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করার পরও যদি তোমার উপর কোনো বিপদ এসে পড়ে, তবে কখনো এ কথা বলো না, যদি আমি এ রকম করতাম, তাহলে অবশ্যই এমন হতো; বরং তুমি বলো, আল্লাহ যা তাক্বদীরে রেখেছেন এবং আল্লাহ যা ইচ্ছা করেছেন তাই হয়েছে। কেননা ‘যদি’ কথাটি শয়তানের কুমন্ত্রণার পথ খুলে দেয়’’।[1]
আল্লাহ তা‘আলা তার বান্দাদের জন্য যেসব আমল ওয়াজিব, মুস্তাহাব কিংবা বৈধ করেছেন, তা থেকে যা করলে বান্দার দুনিয়া ও আখিরাতে উপকার হবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার প্রতি নির্দেশ প্রদান করেছেন। এসব কাজ করার সময় বান্দা আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করবে। যাতে করে আল্লাহ তা‘আলা বান্দার কাজ পূর্ণ করেন এবং তিনি তার মঙ্গল করেন। কেননা আল্লাহ তা‘আলাই বান্দার কর্মের স্রষ্টা এবং তিনি কর্মের ফলাফলেরও স্রষ্টা। উপায়-উপকরণ অবলম্বন করে কর্ম সম্পাদন করা এবং আল্লাহ তা‘আলার উপর পূর্ণরূপে ভরসা করার মধ্যে রয়েছে তাওহীদের বাস্তবায়ন। অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অপারগ, অক্ষম ও দুর্বল হতে নিষেধ করেছেন। উপকারী আমল বর্জন করার মাধ্যমেই বান্দা অপারগতা ও অক্ষমতা প্রকাশ করে থাকে। উপকারী আমলের বিপরীত করার নামই অপারগতা-অক্ষমতা। উপকারী আমল করতে আগ্রহী হওয়া এবং এর জন্য পরিশ্রম করার পরও যদি তার উদ্দেশ্যের বিপরীত হয় অথবা অপ্রিয় কিছু অর্জিত হয়, তাহলে সে যেন না বলে, আমি যদি এমন করতাম, তাহলে অবশ্যই এমন হতো। কেননা এ ধরণের কথা কোনো উপকারে আসে না। এগুলো কেবল শয়তানের পথই সহজ করে দেয়। সেই সঙ্গে আফসোস করা এবং তাক্বদীরকে দোষারোপ করার প্রবণতা সৃষ্টি করে। আর এটি ধৈর্য ধারণ করা ও তাক্বদীরের প্রতি সন্তুষ্ট থাকার পরিপন্থী।
মোটকথা মুছীবতে সবর করা ওয়াজিব। তাক্বদীরের প্রতি ঈমান আনয়ন করা ফরয। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাক্বদীরের প্রতি ঈমান আনয়নের প্রতি নির্দেশনা প্রদানকারী এবং উপকারী শব্দ উচ্চারণ করার আদেশ দিয়েছেন। বান্দা বলবে, قدر الله ما شاء فعل ‘‘এটিই আল্লাহর নির্ধারণ, তিনি যা ইচ্ছা করেছেন, তাই করেছেন। কেননা আল্লাহ তা‘আলা যা নির্ধারণ করেছেন, তা হবেই। এ ক্ষেত্রে আবশ্যক হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার নির্ধারিত ফায়ছালা মেনে নেয়া। আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন, তা সম্পন্ন করেন। আর আল্লাহ তা‘আলার কাজসমূহ হিকমত থেকে খালী নয়।
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রহিমাহুল্লাহ বলেন, বান্দার কোনো জিনিস যখন হাতছাড়া হয়ে যায়, তখন তার দু’টি অবস্থা হতে পারে।
(ক) দুর্বলতা, অসহায়ত্ব ও অপারগতা এবং অক্ষমতার প্রকাশ করার অবস্থা। এটি শয়তানের রাস্তা খুলে দেয়। দুর্বলতা, অসহায়ত্ব ও অক্ষমতা-অপারগতা প্রকাশ করার কারণেই لو শব্দ উচ্চারিত হয়। আসলে لو শব্দ উচ্চারণে কোনো উপকারীতা নেই। বরং এটি দোষারোপের পথ উন্মুক্ত করে দেয়। আর দ্বিতীয়
(খ) অবস্থা হলো উদ্দিষ্ট বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি দেয়া এবং তার প্রতি খেয়াল করা। কাম্য বস্তুটি যদি তার জন্য নির্ধারণ করা হতো, তাহলে তাা কখনো তার হাতছাড়া হতো না এবং তাতে কেউ তাকে পরাভূত করতে পারতো না।
সুতরাং কাম্যবস্তু পাওয়া কিংবা না পাওয়ার অবস্থায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি আলাইহি ওয়া সাল্লাম বান্দাকে উপকারী কথা বলার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু তিনি لو বলতে নিষেধ করেছেন। সেই সঙ্গে তিনি সংবাদ দিয়েছেন যে, সেটা শয়তানের পথ খুলে দেয়। সেই সঙ্গে তাতে রয়েছে হাত ছাড়া হওয়া জিনিসের জন্য অযথা আফসোস, দুঃখ-বেদনা, দুঃশ্চিন্তা-উদ্বেগ প্রকাশ করা এবং তাক্বদীরকে দোষারোপ করার প্রবণতা। এতে করে বান্দা গুনাহগার হয়। আর এটি শয়তানের কাজও বটে। এখানে স্মরণ রাখা আবশ্যক যে, শুধু لو শব্দ ব্যবহার করার কারণেই যে গুনাহগার হবে, তা নয়; বরং এর সাথে বান্দার অন্তরে ঈমানের পরিপন্থী যেসব বিষয় বিদ্যমান থাকে এবং যেসব বিষয় শয়তানের পথ উন্মুক্ত করে, তার কারণেই বান্দা গুনাহগার হয়।
যদি বলা হয়, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন তার সাহাবীদেরকে বিদায় হজ্জের বছর হজ্জের ইহরাম ভঙ্গ করে উমরায় পরিণত করার আদেশ করেছিলেন, তখন তিনিও তো لو শব্দটি উচ্চারণ করেছিলেন। কিন্তু তিনি নিজে ইহরাম ভঙ্গ করেননি। কারণ তিনি কুরবানীর জন্তু সাথে নিয়ে এসেছিলেন। এ কথার জবাব হলো, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
لَوِ اسْتَقْبَلْتُ مِنْ أَمْرِي مَا اسْتَدْبَرْتُ مَا أَهْدَيْتُ
‘‘আমি এখন যা জানতে পেরেছি তা যদি পূর্বেই জানতে পারতাম তাহলে আমি কোরবানীর জন্তু সাথে আনতাম না’’।[2]
ভবিষ্যতে তিনি সুযোগ পেলে যা করবেন, সে সম্পর্কে এখানে একটি খবর দেয়া হয়েছে। তাক্বদীরের উপর কোনোভাবেই আপত্তি করা হয়নি। বরং এখানে তিনি তার সাথীদেরকে সংবাদ দিয়েছেন যে, তিনি যদি আগে শুধু হজ্জের ইহরাম বাঁধতেন, তাহলে কুরবানীর জন্তু সাথে আনতেন না। বরং শুধু উমরার ইহরাম বাঁধতেন। তিনি যখন সাহাবীদেরকে হজ্জের ইহরাম ভঙ্গ করে উমরা করার পর হালাল হয়ে যাওয়ার আদেশ দিলেন, তখন তিনি দেখলেন যে তারা এ নির্দেশ পালনে বিরত রয়েছে। তাই তিনি উৎসাহ দিয়ে তাদের মনকে খুশী করার জন্যই উপরোক্ত কথা বলেছেন।
সুতরাং এখানে لو শব্দ ব্যবহার করা মোটেই দোষণীয় ছিল না। বরং ভবিষ্যতে সুযোগ পেলে যা করবেন, এখানে সাহাবীদের জন্য তিনি তাই ব্যক্ত করেছেন। সুতরাং এ অর্থে لو ব্যবহার করা বৈধ হওয়াতে কোনো মতভেদ নেই। তাক্বদীরের প্রতি আপত্তি করতে গিয়েই কেবল لو ব্যবহার করার নিষেধাজ্ঞা এসেছে। আল্লাহ তা‘আলাই সর্বাধিক অবগত রয়েছেন।
[1]. সহীহ মুসলিম ২৬৬৪, অধ্যায়: শক্তিশালী হওয়া এবং অপারগতা প্রকাশ বর্জনের আদেশ।
[2]. সহীহ বুখারী ১৬৫১, সুনানুল কুবরা বাইহাকী।
ইতিপূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম لو (যদি) শব্দ ব্যবহার করতে নিষেধ করেছেন। বিশেষ করে মানুষ যখন মুছীবতে আক্রান্ত হয়। মুছীবতের সময় মানুষের উপর আবশ্যক হলো সবর করা এবং এর বিনিময়ে ছাওয়াবের আশা করা। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহিমাহুল্লাহ বলেন, আল্লাহ তা‘আলা তার কিতাবের নববই স্থানে সবরের কথা উল্লেখ করেছেন। সহীহ হাদীছে এসেছে, الصَّبْرُ ضِيَاءٌ ‘‘সবর জ্যোতিস্বরূপ’’।[1]
উমার রদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, وَجَدْنَا خَيْرَ عَيْشِنَا بِالصَّبِرِ ‘‘সবরের মাধ্যমেই আমরা সর্বোত্তম জীবন লাভ করেছি’’।[2]
আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, দেহের মধ্যে মাথার মর্যাদা যেমন, ঈমানের মধ্যে সবরের মর্যাদা ঠিক সেরকমই। অতঃপর তিনি আওয়াজ উঁচু করে বললেন, জেনে রাখো! যার সবর নেই, তার ঈমান নেই’’। ইমাম বুখারী ও মুসলিম মারফু সূত্রে বর্ণনা করেছেন, সবরের চেয়ে উত্তম অনুদান কাউকে প্রদান করা হয়নি।
الصبر শব্দটি صَبَرَ থেকে গৃহীত হয়েছে। এর আভিধানিক অর্থ বাধা প্রদান করা ও বিরত রাখা। যখন বাধা প্রদান করা হয় ও বিরত রাখা হয় তখন আরবীতে বলা হয় صبر। অধৈযর্তা-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করা থেকে নফ্সকে বিরত রাখা, অভিযোগ পেশ করা, বিরক্তি প্রকাশ করা থেকে জবানকে বিরত রাখা এবং মুছীবতে পড়ে গালে চপেটাঘাত করা এবং জামা ছিড়ে ফেলা থেকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সমূহকে বিরত রাখাকে الصبر বলা হয়। সুতরাং সবর তিন প্রকার। আল্লাহ তা‘আলা যা আদেশ করেছেন, তা পালন করতে গিয়ে সবর করা, তিনি যা থেকে নিষেধ করেছেন তা বর্জন করার ক্ষেত্রে সবর করা এবং তাক্বদীর অনুযায়ী যেসব মুছীবত আসে তাতে সবর করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿مَا أَصَابَ مِنْ مُصِيبَةٍ إِلا بِإِذْنِ اللَّهِ وَمَنْ يُؤْمِنْ بِاللَّهِ يَهْدِ قَلْبَهُ وَاللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ﴾
‘‘আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কোনো বিপদ আসে না। যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস করে, তিনি তার অন্তরকে সুপথ প্রদর্শন করেন। আল্লাহ সর্ব বিষয়ে সম্যক অবগত’’। (সূরা তাগাবুন: ১১)
আলকামা রহিমাহুল্লাহ বলেন, আয়াতে এমন ব্যক্তির কথা বলা হয়েছে, যে মুছীবতের সময় বিশ্বাস করে, এটি আল্লাহর পক্ষ হতেই। অতঃপর তাতে সন্তুষ্ট থাকে এবং তাক্বদীরকে মেনে নেয়। অন্যরা আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, মুছীবতে আক্রান্ত হয়ে যে ব্যক্তি বিশ্বাস করে, এটি আল্লাহ নির্ধারণ অনুযায়ী হয়েছে অতঃপর সে সবর করে, ছাওয়াব কামনা করে এবং আল্লাহর ফায়ছালার সামনে আত্মসমর্পন করে, আল্লাহ তার অন্তরকে হিদায়াত করেন। সেই সঙ্গে দুনিয়ার সম্পদ থেকে যা তার হাত ছাড়া হয়ে যায়, তার বিনিময়ে আল্লাহ তা‘আলা তার অন্তরে হিদায়াত এবং সুদৃঢ় বিশ্বাস প্রদান করেন। কখনো কখনো তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া জিনিস ফেরত দেয়া হয়।
সাঈদ ইবনে জুবাইর রাহিমাহুল্লাহ বলেন, وَمَنْ يُؤْمِنْ بِاللَّهِ يَهْدِ قَلْبَهُ ‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস করে, তিনি তার অন্তরকে সুপথ প্রদর্শন করেন’’, এর অর্থ হলো হাতছাড়া হওয়া জিনিস কেবল সে আল্লাহ তা‘আলার কাছেই ফেরত চায় এবং ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাযিউন পাঠ করে।
উপরোক্ত আয়াতে দলীল পাওয়া যায় যে, আমলসমূহ ঈমানের অন্তর্ভুক্ত এবং ধৈর্যধারণ করা অন্তরের হিদায়াত লাভের মাধ্যম। মুমিন ব্যক্তি প্রত্যেক ক্ষেত্রেই সবরের প্রতি মুহতাজ। আল্লাহর আদেশগুলো বাস্তবায়ন করা এবং তার নিষেধগুলো থেকে দূরে থাকার ক্ষেত্রে তার নফসকে ধৈর্যধারণ করার উপর বাধ্য করা আবশ্যক।
আল্লাহ তা‘আলার দিকে দাওয়াত দিতে গিয়ে বান্দা যেসব কষ্টের সম্মুখীন হয়, তাতে সে সবরের প্রতি মুখাপেক্ষী। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ادْعُ إِلَىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُم بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَن ضَلَّ عَن سَبِيلِهِ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ وَإِنْ عَاقَبْتُمْ فَعَاقِبُوا بِمِثْلِ مَا عُوقِبْتُمْ بِهِ وَلَئِنْ صَبَرْتُمْ لَهُوَ خَيْرٌ لِلصَّابِرِينَ (১২৬) وَاصْبِرْ وَمَا صَبْرُكَ إِلَّا بِاللَّهِ﴾
‘‘হে নবী! প্রজ্ঞা এবং উত্তম উপদেশের মাধ্যমে তোমার রবের পথে মানুষকে দাওয়াত দাও এবং লোকদের সাথে বিতর্ক করো সর্বোত্তম পদ্ধতিতে। তোমার রবই অধিক জানেন কে তার পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে এবং কারা সঠিক পথে রয়েছে, এ বিষয়ে তিনিই সর্বাধিক অবগত রয়েছেন। তোমরা যদি প্রতিশোধ গ্রহণ করো, তাহলে ঠিক ততটুকু গ্রহণ করবে যতটুকু অন্যায় তোমাদের প্রতি করা হয়েছে। আর তোমরা যদি ধৈর্যধারণ করো, তাহলে অবশ্যই ধৈর্যশীলদের জন্য সেটিই উত্তম। তুমি ধৈর্যধারণ করো। তোমার ধৈর্যধারণ তো হবে আল্লাহর সাহায্যেই’’। (সূরা আন নাহাল: ১২৫-১২৭)
সৎ কাজের আদেশ এবং অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করতে গিয়ে মানুষের তরফ থেকে যেসব যুলুম-নির্যাতন আসে তাতেও সবর করা আবশ্যক। আল্লাহ তা‘আলা লুকমান আলাইহিস সালাম সম্পর্কে বলেন যে, তিনি তার ছেলেকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছিলেন,
﴿يَا بُنَيَّ أَقِمِ الصَّلَاةَ وَأْمُرْ بِالْمَعْرُوفِ وَانْهَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَاصْبِرْ عَلَى مَا أَصَابَكَ إِنَّ ذَلِكَ مِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ﴾
‘‘হে বৎস! যথারীতি সালাত কায়েম করো। সৎকাজের নির্দেষ দাও, অসৎকাজে বাধা দান করো এবং আপদে-বিপদে ধৈর্যধারণ করো। নিশ্চয় এটি দৃঢ় সংকল্পের কাজ’’। (সূরা লুকমান: ১৭)
পার্থিব জগতে মুমিন বান্দা যেসব মুছীবতের সম্মুখীন হয়, তাতে সে সবরের মুখাপেক্ষী। এ ক্ষেত্রে তাকে জানতে হবে যে, এগুলো আল্লাহর পক্ষ হতেই। অতঃপর সে সন্তুষ্ট থাকবে ও তাক্বদীরকে মেনে নিবে। বিরক্তি ও অসন্তোষ প্রকাশ করা থেকে নিজের নফ্সকে বিরত রাখবে। বিশেষ করে যখন জবান ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে তা প্রকাশিত হওয়ার উপক্রম হবে, তখন জবান ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে নিয়ন্ত্রণ করবে।
এটি আকীদার অন্যতম মূল বিষয়। তাক্বদীরের প্রতি বিশ্বাস করা ঈমানের ছয় রুকনের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি রুকন। আপদে-বিপদে ধৈর্যধারণ করা এর সুফল। মুছীবতে পড়ে বান্দার ধৈর্যধারণ করতে না পারা ঈমানের এ রুকনের প্রতি তার ঈমান না থাকার প্রমাণ কিংবা এর প্রতি তার ঈমানী দুর্বলতার পরিচয়। পরিণামে সে আপদে-বিপদে অধৈর্যতা, অস্থিরতা ও বিরক্তি প্রকাশ করবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে সংবাদ দিয়েছেন যে, এটি এমন কুফুরী, যা ইসলামী আকীদাকে নষ্ট করে ফেলে।
সহীহ মুসলিমে আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
اِثْنَتَانِ فِيْ النَّاس هُمَا بِهِمْ كُفْرٌ الطَّعْنُ فِى الأَنْسَابِ وَالنِّيَاحَةُ عَلَى الْمَيِّتِ
‘‘মানুষের মধ্যে এমন দু’টি মন্দ স্বভাব রয়েছে যা দ্বারা তাদের কুফুরী প্রকাশ পায়। একটি হচ্ছে মানুষের বংশের মধ্যে দোষ লাগানো, অপরটি হচ্ছে মৃত ব্যক্তির জন্য বিলাপ করা’’।[3]
এ দু’টি স্বভাব কুফুরীর অন্তর্ভুক্ত। কেননা তা জাহেলী যামানার লোকদের স্বভাব ছিল। তবে যার মধ্যে কুফুরীর কোনো স্বভাব পাওয়া যায় সে সম্পূর্ণরূপে কাফের হয়ে যায়না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর বাণী:ليس بين العبد وبين الكفر أوالشرك إلا ترك الصلاة এর মধ্যে আলিফ-লামযুক্ত মারেফা (নির্দিষ্ট) الكفر শব্দটি এবং আলিফ-লাম ছাড়া নাকেরা (অনির্দিষ্ট) كفر শব্দটির মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। যেখানে كفر শব্দটির সাথে আলিফ-লাম যুক্ত হয়ে الكفر হবে, সেখানে উদ্দেশ্য হবে ইসলাম থেকে সম্পূর্ণ বের হয়ে যাওয়া। আর আলিফ-লাম ছাড়া আসলে সেরকম অর্থ হবে না এবং সেই কুফুরী মুসলিমকে ইসলাম থেকে বের করে দেয় না।
বুখারী ও মুসলিমে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে মারফু সূত্রে বর্ণিত আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
لَيْسَ مِنَّا مَنْ لَطَمَ الْخُدُودَ وَشَقَّ الْجُيُوبَ وَدَعَا بِدَعْوَى الْجَاهِلِيَّةِ
‘‘যে ব্যক্তি মুছীবতে পড়ে স্বীয় গালে চপেটাঘাত করে, বুকের জামা ছিড়ে এবং জাহেলী যুগের ন্যায় চিৎকার করে সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়’’।[4]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী: وَدَعَا بِدَعْوَى الْجَاهِلِيَّةِ ‘‘জাহেলী যুগের ন্যায় চিৎকার করে’’ এর ব্যাখ্যায় আল্লামা ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রহিমাহুল্লাহ বলেন: জাহেলী যামানার চিৎকার বলতে এখানে জাতীয়তাবাদ এবং গোত্র প্রীতির দিকে আহবান করার কথা বলা হয়েছে। এমনি মাযহাব, দল এবং শাইখদের জন্য গোঁড়ামি করাও জাহেলিয়াতের আহবানের অন্তর্ভুক্ত। অনুরূপ কোনো শাইখকে অন্য কারো উপর প্রাধান্য দিয়ে তার দিকে আহবান করা, এর উপর ভিত্তি করেই কাউকে বন্ধু বানানো, কাউকে শত্রু বানানো। এ সবগুলোই জাহেলিয়াতের দাওয়াতের অন্তর্ভুক্ত।
আল্লাহ তা‘আলা এক মহান উদ্দেশ্যে তার বান্দাদেরকে বিভিন্ন আপদ-বিপদ ও মুছীবত দ্বারা আক্রান্ত করে থাকেন।
(১) এর মাধ্যমে মানুষের গুনাহ-খাতা মাফ হয়। আনাস ইবনে মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
إِذَا أَرَادَ اللَّهُ بِعَبْدِهِ الْخَيْرَ عَجَّلَ لَهُ الْعُقُوبَةَ فِى الدُّنْيَا وَإِذَا أَرَادَ اللَّهُ بِعَبْدِهِ الشَّرَّ أَمْسَكَ عَنْهُ بِذَنْبِهِ حَتَّى يُوَفَّى بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
‘‘আল্লাহ তা‘আলা যখন তার কোনো বান্দার মঙ্গল করতে চান, তখন দুনিয়াতেই তার অপরাধের শাস্তি দিয়ে থাকেন। পক্ষান্তরে তিনি যখন তার কোনো বান্দার অমঙ্গল করতে চান, তখন দুনিয়াতে তার পাপের শাস্তি দেয়া হতে বিরত থাকেন, যেন কিয়ামতের দিন তাকে পূর্ণরূপে শাস্তি দেন’’।[5] ইমাম তিরমিযী হাদীছটি বর্ণনা করেছেন এবং হাকেম হাসান বলেছেন।
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া রহিমাহুল্লাহ বলেন, বিপদ-আপদ এক প্রকার নিয়ামত। কেননা এটি বান্দার গুনাহসমূহ মোচন করে দেয়। আর এটি সবরের আহবান জানায়। সবর করলে ছাওয়াব প্রদান করা হয়। মুছীবত মানুষকে আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে আনে, তার জন্য নতি স্বীকার করায় এবং সৃষ্টি থেকে তাদেরকে ফিরিয়ে এনে আল্লাহ তা‘আলার দিকে ধাবিত করে। এ ছাড়াও মুছীবতের মাধ্যমে আরো অনেক স্বার্থ হাসিল হয়। সুতরাং বালা-মুছীবতের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা গুনাহ-খাতা ও ভুল-ভ্রান্তি মিটিয়ে দেন। এটি একটি বিরাট নিয়ামত। সুতরাং মুছীবত সমস্ত সৃষ্টির জন্যই বিরাট একটি রহমত ও নিয়ামত। কিন্তু বিপদগ্রস্থ বান্দা বিপদে পড়ে পূর্বের চেয়ে বড় গুনাহয় লিপ্ত হলে বান্দা দীনের দিক থেকে যে ক্ষতির মধ্যে পড়ে, সে কারণে আপদ-বিপদ তার জন্য ক্ষতিকর হয়। কেননা কতক মানুষ বালা- মুছীবতে পড়ে যখন ফকীর হয় অথবা অসুস্থ হয় কিংবা ব্যথিত হয়, তখন সে মুনাফেকী করে, অধৈর্য হয়, তার অন্তর অসুস্থ হয় এবং তার থেকে প্রকাশ্য কুফুরী দেখা দেয়। সেই সঙ্গে সে বেশ কিছু ওয়াজিব আমলও ছেড়ে দেয় এবং এমন কিছু হারাম কাজে লিপ্ত হয়, যা তার দীনকে ক্ষতিগ্রস্থ করে দেয়।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে মুছীবতের কারণে যে ফলাফল অর্জিত হয়, তা বান্দার জন্য ভালো হয়। বিশেষ করে যখন সে দীনের ব্যাপারে ফিতনায় পড়া থেকে নিরাপদ থাকে। কিন্তু নিছক মুছীবত ভালো নয়; বরং ভালো ফলাফল অর্জিত হওয়ার দিক থেকে ভালো। যেমন মুছীবতে পড়ে কেউ ধৈর্যধারণ করতে পারলে ও আনুগত্যের পথে অগ্রসর হতে পারলে তার জন্য মুছীবত দীনি নেয়ামতে পরিণত হয়। সুতরাং মুছীবত সৃষ্টি করা যেহেতু আল্লাহর কাজ সে হিসাবে সেটা সমস্ত মাখলুকের জন্য রহমত স্বরূপ। এর কারণে আল্লাহ তা‘আলা প্রশংসিত হন। বালা- মুছীবতে পড়ে যে ধৈর্য ধারণ করতে পারে, তার জন্য তা দীনি নেয়ামতে পরিণত হয়। বালা-মুছীবত তার গুনাহর কাফফারা হওয়ার সাথে সাথে সেটা রহমত স্বরূপ হয় এবং আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে সে প্রশংসার পাত্র হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿أُولَئِكَ عَلَيْهِمْ صَلَوَاتٌ مِنْ رَبِّهِمْ وَرَحْمَةٌ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُهْتَدُونَ﴾
‘‘তারা সে সমস্ত লোক, যাদের প্রতি আল্লাহর অফুরন্ত অনুগ্রহ ও রহমত রয়েছে এবং এসব লোকই হিদায়াতপ্রাপ্ত’’। (সূরা আল বাকারা: ১৫৭)
সুতরাং মুছীবত গুনাহ মাফের কারণ এবং বান্দার মর্যাদা বৃদ্ধির মাধ্যম। যেসব ক্ষেত্রে সবর করা ওয়াজিব সেসব ক্ষেত্রে যে ব্যক্তি ধৈর্যধারণ করে তার জন্য উপরোক্ত ফযীলত অর্জিত হয়। পৃথিবীতে বালা- মুছীবত ও আপদ-বিপদ প্রেরণের পিছনে আল্লাহ তা‘আলার হিকমত হলো এগুলোর মাধ্যমে বান্দাদেরকে পরীক্ষা করা। তিনি দেখতে চান কে সবর করে এবং সন্তুষ্ট থাকে আর কে অসন্তুষ্ট হয় এবং বিরক্তি প্রকাশ করে।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
إِنَّ عِظَمَ الْجَزَاءِ مَعَ عِظَمِ الْبَلاَءِ وَإِنَّ اللَّهَ إِذَا أَحَبَّ قَوْمًا ابْتَلاَهُمْ فَمَنْ رَضِىَ فَلَهُ الرِّضَا وَمَنْ سَخِطَ فَلَهُ السَّخَطُ
‘‘পরীক্ষা যত কঠিন হয়, পুরস্কারও তত বড় হয়। আল্লাহ তা‘আলা যখন কোনো জাতিকে ভালোবাসেন, তখন তিনি তাদেরকে পরীক্ষা করেন। এতে যে ব্যক্তি সন্তুষ্ট থাকে, তার জন্য রয়েছে সন্তুষ্টি। আর যে ব্যক্তি অসন্তুষ্ট হয়, তার প্রতিও রয়েছে অসন্তুষ্টি’’।[6] ইমাম তিরমিযী রহি. হাদীছটি বর্ণনা করেছেন এবং তিনি হাসান বলেছেন।
মুছীবতে পড়ে সন্তুষ্ট থাকার অর্থ হলো বান্দা তার ব্যাপারটি আল্লাহর নিকট সোপর্দ করবে, আল্লাহর প্রতি ভালো ধারণা পোষণ করবে এবং তার নিকট ছাওয়াব কামনা করবে। আর তাতে অসন্তুষ্ট হওয়ার অর্থ হলো কোনো জিনিসকে অপছন্দ করা এবং তাতে সন্তুষ্ট না থাকা। যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার ব্যবস্থা ও পরিচালনাধীন কোনো জিনিষের প্রতি অসন্তুষ্ট হলো, তার জন্য আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে অসন্তুষ্টি রয়েছে।
এ হাদীছে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, বান্দার কর্ম যেমন হয়, ফলাফল তেমনই হয়ে থাকে। এতে আরো প্রমাণ পাওয়া যায় যে, আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলার জন্য শোভনীয় পদ্ধতিতে অন্যান্য ছিফাতের মতই সন্তুষ্ট হওয়া বিশেষণ সাব্যস্ত। এখান থেকে বালা- মুছীবত ও আপদ-বিপদ আসার পিছনে আল্লাহ তা‘আলার হিকমত থাকার কথাও জানা গেল। সে সঙ্গে ক্বদ্বা ও ক্বদর তথা আল্লাহ তা‘আলার নির্ধারণ এবং ফায়ছালার কথাও জানা গেলো। তার নির্ধারণ অনুপাতেই বিপদ-আপদ ও মুছীবত আসে। মুছীবতের সময় সবর করা, আল্লাহর দিকে ফিরে যাওয়া, এবং তার উপর ভরসা করা আবশ্যক। মোটকথা সমস্ত বিপর্যয়, দুর্ঘটনা ও অপ্রীতিকর বিষয় প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে কেবল আল্লাহর উপরই ভরসা করা আবশ্যক। পার্থিব জীবনে মানুষ যেসব দুঃখ-কষ্টের সম্মুখীন হয়, তাতে আল্লাহ তা‘আলা সবর ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করার আদেশ করেছেন। কেননা এর পিছনে শুভ পরিণাম রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা সংবাদ দিয়েছেন যে, তিনি সাহায্য ও সমর্থনের মাধ্যমে ধৈর্যশীলদের সাথে রয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلاةِ إِنَّ اللَّهَ مَعَ الصَّابِرِينَ﴾
‘‘হে মুমিনগণ! তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো। নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে রয়েছেন’’। (সূরা বাকারা: ১৫৩)
এ রকম আরো দলীল রয়েছে, যাতে সবরের প্রতি গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। মুমিন বান্দার রয়েছে এর বিশেষ প্রয়োজন। কেননা সবর মুমিনের আকীদাকে শক্তিশালী করে। আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদেরকে সবর করা এবং আখিরাতে ছাওয়াবের উদ্দেশ্যে আমল করার তাওফীক দেন।
[1]. মুসনাদে আহমাদ, সহীহ মুসলিম হা/২২৩।
[2]. সহীহ বুখারী, ৬৪৭০ নং হাদীছের অধ্যায়ে।
[3]. সহীহ মুসলিম হা/৬৭, অধ্যায়: বিলাপ করার ভয়াবহতা।
[4]. বুখারী, অধ্যায়: যে ব্যক্তি মুছীবতে পড়ে গাল চাপড়ায় সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।
[5] . তিরমিযী, ইমাম আলবানী (রহি.) এ হাদীছকে হাসান বলেছেন। দেখুন: সিলসিলা ছহীহা, হা/১২২০।
[6]. তিরমিযী, হা/২৩৯৬। ইমাম আলবানী (রহি.) এ হাদীছকে সহীহ বলেছেন। দেখুন: সিলসিলা ছহীহা, হা/১৪৬।
আল্লাহ তা‘আলা সবচেয়ে মহান ও সবচেয়ে বড়। তার প্রতি বড়ত্ব ও মর্যাদা প্রদর্শন করা আবশ্যক। এমন কিছু শব্দ আছে, যা তার প্রতি সম্মান, মর্যাদা ও বড়ত্ব প্রদর্শনের জন্যই তার শানে ব্যবহার করা বৈধ নয়। তাই আল্লাহ তা‘আলার জন্য এসব শব্দ ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়েছে।
(১) এ কথা বলা যাবে না যে, السلام على الله‘‘আল্লাহর উপর শান্তি বর্ষিত হোক’’। কেননা সালাম দেয়ার মাধ্যমে একজন মুসলিম আরেক মুসলিমের জন্য দু‘আ করে। সালামের মাধ্যমে মুসলিমের জন্য অকল্যাণ থেকে নিরাপত্তা কামনা করা হয়। আর আল্লাহর কাছেই ইহা প্রার্থনা করা হয়; আল্লাহর জন্য নয়। আল্লাহর কাছে দু‘আ করা হয়; আল্লাহর জন্য নয়। কেননা তিনিই সৃষ্টির প্রয়োজন পূরণকারী, আসমান-যমীনের সবকিছুই তার হাতে। তিনি প্রত্যেক দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত এবং শান্তি ও নিরাপত্তা দানকারী। তিনিই সালাম এবং তার নিকট থেকে শান্তি ও নিরাপত্তা আগমন করে।
সহীহ বুখারীতে ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেন,
كُنَّا إِذَا كُنَّا مَعَ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فِى الصَّلاَةِ قُلْنَا السَّلاَمُ عَلَى اللَّهِ مِنْ عِبَادِهِ السَّلاَمُ عَلَى فُلاَنٍ وَفُلاَنٍ فَقَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم لاَ تَقُولُوا السَّلاَمُ عَلَى اللَّهِ فَإِنَّ اللَّهَ هُوَ السَّلاَمُ
‘‘আমরা যখন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সালাতে থাকতাম, তখন বলতাম, আল্লাহর উপর তার বান্দাদের পক্ষ থেকে সালাম, অমুক অমুকের উপর সালাম এবং অমুক ব্যক্তির উপর সালাম। তখন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আল্লাহর উপর সালাম, এমন কথা বলো না। কেননা আল্লাহ নিজেই সালাম।[1] অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা সকল দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত।
আল্লামা ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রহিমাহুল্লাহ বলেন, السلام শব্দটি মাসদার বা ক্রিয়ামূল। যেসব শব্দের মাধ্যমে দু‘আ করা হয়, السلام তার অন্তর্ভুক্ত। এতে দু‘আ করা এবং সংবাদ প্রদান করা উভয় অর্থই বিদ্যমান রয়েছে। তবে সংবাদ প্রদান করা উদ্দেশ্য হলে কামনা করা অর্থে ব্যবহৃত হয় না। সম্ভাষণ বিনিময় করার সময় এ শব্দ দ্বারা দু‘আ করা ও নিরাপত্তা কামনা করা অর্থই উদ্দেশ্য হয়।
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম আরো বলেন, সালাম দেয়ার সময় যেহেতু শান্তি ও নিরাপত্তা কামনা করা হয় এবং এদুটো বিষয়ই যেহেতু বান্দার নিকট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তাই ইহা কামনা করার সময় আল্লাহ তা‘আলার এমন একটি নাম বাছাই করা হয়েছে যাতে শান্তি ও নিরাপত্তার অর্থ বিদ্যমান। এটি হচ্ছে السلام। আমরা আল্লাহ তা‘আলার এ অতি সুন্দর নামের মাধ্যমে নিরাপত্তা কামনা করি। এটি উচ্চারণ করার মাধ্যমে এক সঙ্গে দু’টি কাজ সম্পন্ন হয়। প্রথমত: আল্লাহর যিকির করা হয়, দ্বিতীয়ত: তার নিকট নিরাপত্তা প্রার্থনা করা হয়। মুসলিমের এটিই কাম্য হওয়া চাই।
আরো যেসব শব্দ আল্লাহ তা‘আলার শানে ব্যবহার করা জায়েয নয়, তা হলো এভাবে বলা যে, اللهم اغفر لي إن شئت ‘‘হে আল্লাহ! তুমি চাইলে আমাকে মাফ করো’’। সুতরাং আল্লাহর কাছে কোনো প্রয়োজন পূরণার্থে দু‘আ করার সময় দু‘আ কবুল হওয়ার বিষয়টি তার ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেয়া যাবে না; বরং দৃঢ়তার সাথে দু‘আ করতে হবে।
সহীহ বুখারীতে আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
لا يَقُولَنَّ أَحَدُكُمُ: اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِي إِنْ شِئتَ، اللَّهُمَّ ارْحَمْنِي إِنْ شِئتَ لِيَعْزِمِ الْمَسْأَلَةَ فَإِنَّهُ لا مُكْرِهَ لَهُ
‘‘তোমাদের কেউ যেন দু‘আ করার সময় এভাবে না বলে, হে আল্লাহ! তুমি যদি চাও তাহলে আমাকে ক্ষমা করো, হে আল্লাহ! তুমি যদি চাও তাহলে আমার উপর রহমত নাযিল করো; বরং সে যেন দৃঢ়তার সাথে দু’আ করে। কেননা আল্লাহ্কে বাধ্য করার কেউ নেই’’।[2] মুসলিমের উচিত, বড় আশা নিয়ে আল্লাহর কাছে চাওয়া। কেননা আল্লাহ তা‘আলা যা দেন তা কখনো তার নিকট বেশী বলে গণ্য হয় না। দুই কারণে আল্লাহ তা‘আলার কাছে দু‘আ করার সময় উপরোক্ত কথা বলা নিষেধ।
(১) আল্লাহ তা‘আলার কাজে তাকে বাধ্য করার কেউ নেই। বরং তিনি যা করেন, তার ইচ্ছাতেই করেন। তিনি বান্দার বিপরীত। কেননা বান্দারা কখনো অপছন্দ সত্ত্বেও কোনো কোনো কাজ করে। তারা কখনো অন্যের ক্ষতির আশঙ্কায় কিংবা অন্যের কাছ থেকে কিছু পাওয়ার আশায় কাজ করে। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা এমন নন।
(২) বান্দার প্রয়োজন পূরণ করার জন্য দু‘আ করতে গিয়ে আল্লাহর ইচ্ছার উপর কাম্যবস্তু ছেড়ে দেয়া প্রমাণ করে যে, আসলে কাম্যবস্তুটি চাওয়ার মধ্যে বান্দার দুর্বলতা রয়েছে এবং তাতে তার আগ্রহ কম। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, বান্দা যা চাচ্ছে, তা পেলে ভালো, অন্যথায় সেটাতে তার কোনো প্রয়োজন নেই। দু‘আর মধ্যে এ ধরণের বাক্য ব্যবহার করা প্রমাণ করে যে, বান্দা আল্লাহ থেকে সম্পূর্ণ অমুখাপেক্ষী।
উপরে অতিক্রান্ত সহীহ মুসলিমের বর্ণনা থেকে বুঝা যায় যে, আল্লাহর কাছে বড় বড় জিনিস চাওয়ার আদেশ দেয়া হয়েছে। বান্দা যত জিনিসই প্রার্থনা করুক, আল্লাহ তা‘আলার কাছে তা মোটেই বড় নয়। আল্লাহ তা‘আলা বান্দাকে যাই দান করেন, তার কাছে সেটা বড় বলে গণ্য হয় না এবং সেটা দান করা তার উপর মোটেই কঠিন নয়। তার নিকট কোনো কিছুই বড় নয়। যদিও তা সৃষ্টির নিকট বড় বলে বিবেচিত হয়। কেননা আল্লাহ তা‘আলার অনুগ্রহ ও দান পূর্ণতম এবং তার ধন-ভান্ডার অফুরন্ত। তিনি বড় বড় জিনিস বান্দাদেরকে দান করেন। কোনো কিছুই তাকে অক্ষম করতে পারে না। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿إِنَّمَا أَمْرُهُ إِذَا أَرَادَ شَيْئًا أَنْ يَقُولَ لَهُ كُنْ فَيَكُونُ﴾
‘‘তিনি যখন কিছু সৃষ্টি করতে ইচ্ছা করেন, তখন কেবল বলেন, হও তখনই তা হয়ে যায়’’।[3] (সূরা ইয়াসীন: ৮২)
আরো যেসব শব্দ আল্লাহ তা‘আলার শানে ব্যবহার করা ঠিক নয়, তা হলো আল্লাহর নামে এ বলে শপথ করা যে, তিনি অমুক ভালো কাজটি করবেন না কিংবা তিনি অমুক কাজটি করবেন না অথবা অমুক অপরাধীকে ক্ষমা করবেন না। এভাবে আল্লাহর নামে শপথ করে তার অনুগ্রহকে সংকীর্ণ করে দেয়া বৈধ নয়।
জুনদুব ইবনে আব্দুলাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
قال رَجُلٌ وَاَللَّه لَا يَغْفِر اللَّه لِفُلَانٍ وَإِنَّ اللَّه تَعَالَى قَالَ مَنْ ذَا الَّذِي يَتَأَلَّى عَلَيَّ أَلَّا أَغْفِر لِفُلَانٍ؟ فَإِنِّي قَدْ غَفَرْت لِفُلَانٍ وَأَحْبَطْت عَمَلك
‘‘এক ব্যক্তি বললো, আল্লাহর কসম, অমুক ব্যক্তিকে আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। তখন আল্লাহ তা‘আলা বললেন, কে এ ব্যক্তি, যে আমার নামে কসম করে বলে যে, আমি অমুককে ক্ষমা করবো না? আমি অমুককেই ক্ষমা করে দিলাম। আর তোমার আমল বাতিল করে দিলাম’’। ইমাম মুসলিম হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।[4]
التأَلِّيْ শব্দটি الألية থেকে নেয়া হয়েছে। الألية এর ‘ইয়া’ বর্ণে তাক্বদীদ দিয়ে পড়া হয়েছে। এর অর্থ হলো শপথ করা। সুতরাং يتأَلَّى অর্থ يحلف (সে শপথ করে। আল্লাহ তা‘আলার বাণী, من ذا الذي يتَأَلَّى ‘‘কে এ ব্যক্তি, যে আমার নামে কসম করে?’’ এখানে প্রশ্নবোধক বাক্যের মাধ্যমে উপরোক্ত পদ্ধতিতে আল্লাহর নামে কসম করার দুঃসাহসিকতা দেখানোর প্রতিবাদ করা হয়েছে।
যে লোকটি আল্লাহর নামে শপথ করে বলেছিল, অমুক ব্যক্তিকে তিনি ক্ষমা করবেন না, সে আল্লাহর সাথে বেয়াদবী করেছে। সে আল্লাহর উপর অকাট্যভাবে হুকুম লাগিয়ে দিয়েছে যে, তিনি অমুক অপরাধীকে ক্ষমা করবেন না। সে আল্লাহ তা‘আলার রুবুবীয়াতের মর্যাদা সম্পর্কে অজ্ঞ থাকা, নিজের নফ্সের প্ররোচনা, স্বীয় আমল নিয়ে গর্ব করার কারণেই এ কথা বলেছে। এ কারণে তার উদ্দেশ্যের বিপরীত ফলাফল প্রদান করা হয়েছে এবং তার কথার কারণেই অপরাধী লোকটিকে ক্ষমা করা হয়েছে। ঐদিকে নিকৃষ্ট কথার কারণে তার আমল বরবাদ করে দেয়া হয়েছে। অথচ সে একজন ইবাদতকারী বান্দা ছিল।
আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, সে এমন কথা বলেছে, যার কারণে তার দুনিয়া ও আখেরাত উভয়টি নষ্ট হয়ে গেছে। উপরোক্ত হাদীছ থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, কথায় ও কাজে আল্লাহ তা‘আলার সাথে আদব রক্ষা করে চলা ওয়াজিব। হাদীছ থেকে আরো জানা যাচ্ছে যে, আল্লাহর উপর বাহাদুরি করা, নফ্সের দাম্ভিকতা প্রদর্শন করা এবং অন্যদেরকে তুচ্ছ মনে করা হারাম।
আল্লাহ তা‘আলার নামে কেবল তখনই কসম করা হারাম হবে, যখন কসমে তার উপর কোনো বিষয়কে হারাম ও সীমাদ্ধ করে দিয়ে এভাবে বলা হবে যে, তিনি তার অমুক বান্দার কল্যাণ করবেন না। তবে আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ভালো ধারণা পোষণ করে এবং তার নিকট থেকে কল্যাণের আশা করে যদি কসম করা হয়, তাহলে জায়েয আছে। হাদীছে এসেছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
إِنَّ مِنْ عِبَادِ اللَّهِ مَنْ لَوْ أَقْسَمَ عَلَى اللَّهِ لأَبَرَّهُ
‘‘আল্লাহর কিছু বান্দা এমন আছে যে, তারা কেনো বিষয়ে আল্লাহর নামে শপথ করলে তিনি তা পূরণ করার ব্যবস্থা করেন’’।[5]
ঐদিকে জুনদুব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীছে জবানের ভয়াবহ আপদ বর্ণনা করা হয়েছে এবং তা থেকে জবানকে হেফাযত করার আদেশ এসেছে। মুআয ইবনে জাবাল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, আমি বললাম, ইয়া রসূলাল্লাহ!
্রوَإِنَّا لَمُؤَاخَذُونَ بِمَا نَتَكَلَّمُ بِهِ فَقَالَ ثَكِلَتْكَ أُمُّكَ يَا مُعَاذُ وَهَلْ يَكُبُّ النَّاسَ فِي النَّارِ عَلَى وُجُوهِهِمْ أَوْ عَلَى مَنَاخِرِهِمْ إِلَّا حَصَائِدُ أَلْسِنَتِهِمْ
‘‘আমরা জবান দিয়ে যেসব কথা বলি, তার জন্যও কি আমাদেরকে পাকড়াও করা হবে? তিনি বললেন, হে মুআয! আফসোস তোমার জন্য। লোকদের জবানের অসংযত কথা-বার্তাই তাদেরকে নাক এবং মুখের উপর উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে’’।[6] ইমাম তিরমিযী হাদীছটি বর্ণনা করার পর সেটাকে সহীহ বলেছেন।
উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে প্রমাণিত হলো যে, কথা-বার্তায় সংযমী হওয়া আবশ্যক এবং যেসব কথার মধ্যে আল্লাহ তা‘আলার শানে বেয়াদবী রয়েছে, তা থেকে দূরে থাকা ওয়াজিব। কেননা এ জাতিয় কথা মানুষের আকীদা নষ্ট করে ফেলে এবং তাওহীদে ঘাটতি আনয়ন করে।
সুতরাং السلام على الله বলা যাবে না। কেননা আল্লাহ তা‘আলাই সালাম। কেননা কাউকে সালাম দেয়া মানে তার জন্য শান্তি ও নিরাপত্তার দু‘আ করা। আল্লাহর কাছেই দু‘আ করা হয়, তার জন্য নয়। এ কথাও বলা যাবে না যে,
اللهم اغفر لي وارحمني إن شئت
‘‘হে আল্লাহ তুমি চাইলে আমাকে ক্ষমা করো এবং আমার উপর রহম করো। অনুরূপ অন্যান্য বাক্যও ব্যবহার করা যাবে না’’।
বরং প্রত্যেক দু‘আ দৃঢ়তার সাথে কবুলের আশা নিয়ে করতে হবে। কবুল করা বা না করার বিষয়টি আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছার উপর ছেড়ে দিলে হবেনা। কেননা আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেকটি কাজ নিজ ইচ্ছায় সম্পন্ন করেন। তার উপর কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। সেই সঙ্গে আল্লাহর নামে শপথ করে বলা যাবে না যে, তিনি অমুকের উপর রহম করবেন না কিংবা অমুককে ক্ষমা করবেন না। কেননা এরূপ কথা বিপদজনক এবং আল্লাহর রহমতকে আটকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা ও তার প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ করার অন্তর্ভুক্ত।
অনুরূপ ما شاء الله وشاء فلان ‘‘যা আল্লাহ চান এবং অমুক যা চায়’’ বলাও বৈধ নয়। বরং বলা উচিতما شاء الله ثم شاء فلان ‘‘আল্লাহ যা চান অতঃপর অমুক যা চায়’’।
কেননা واو দ্বারা একটি বিষয়কে অন্য একটি বিষয়ের উপর আতফ করলে তথা দু’টি শব্দের মাঝখানে واو আনয়ন করলে এর দ্বারা দু’টি বস্তুকে সমান করে দেয়া উদ্দেশ্য হয়।
আর কেউ কোনো বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলার সাথে সমান নয় কিংবা তার সমকক্ষ কেউ নেই। واو এর বদলে ثم দ্বারা আতফ করা হলে কোনো দোষ নেই। কেননা ثم শব্দটি একই সঙ্গে ধারাবাহিকতা ও বিলম্বের অর্থ প্রদান করে। সুতরাং উপরোক্ত পদ্ধতি বর্জন করে যদি বলা হয়্র
ماشاء الله ثم شاء فلان
‘‘আল্লাহ যা চেয়েছেন অতঃপর অমুক ব্যক্তি যা চেয়েছে’’, তাহলে বুঝা যাবে যে, আল্লাহর ইচ্ছার পর বান্দার ইচ্ছা হয়েছে। এভাবে বললে কোনো অসুবিধা নেই। এতে সুস্পষ্ট বুঝা যায় যে, বান্দার ইচ্ছা আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছার অনুগামী এবং আল্লাহর ইচ্ছার পরেই বান্দার ইচ্ছা কার্যকর হয়ে থাকে।
বান্দার ইচ্ছা আল্লাহর ইচ্ছার সাথে অংশগ্রহণকারী নয়। কেননা গঠণের দিক থেকে ثم শব্দটির মাধ্যমে দু’টি বিষয়কে একত্রিত করা উদ্দেশ্য হলেও তাতে সময়ের ব্যবধান থাকে। বান্দার ইচ্ছা আর আল্লাহর ইচ্ছা সমান হওয়া তো দূরের কথা; আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত বান্দার ইচ্ছার কল্পনাও করা যায়না।
উপরোক্ত বিষয় থেকে আমরা বুঝতে পারলাম যে, মুসলিমদের সহীহ আকীদা জানা আবশ্যক। যেসব জিনিস আকীদাকে সংশোধন করে এবং যা আকীদা নষ্ট করে ফেলে তাও ভালোভাবে জানা আবশ্যক। এতে দীনের ব্যাপারে সে সুস্পষ্ট ধারণার উপর থাকতে পারবে এবং না জানার কারণে কোনো নিষিদ্ধ বিষয়ে লিপ্ত হবেনা। হে আল্লাহ তুমি আমাদেরকে উপকারী ইলম এবং সৎ আমলের তাওফীক দাও।
[1]. সহীহ বুখারী হা/৬৩২৮, অধ্যায়: সালাতে দু‘আ করা।
[2]. বুখারী, অধ্যায়: দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে দুআ করবে, হাদীছ নং- ৬৩৩৯।
[3]. ইরাদায়ে কাদরীয়া তথা আল্লাহর যেই ইচ্ছা কোনো কিছু সৃষ্টি করার সাথে সম্পৃক্ত, তা অবশ্যই সংঘটিত হবে। ইরাদায়ে কাদরীয়ার অপর নাম ইরাদায়ে কাওনীয়া। এতে আল্লাহর পছন্দ ও ভালোবাসার সম্পর্ক নেই। যেমন আল্লাহর ইরাদায়ে কাওনীয়ার দ্বারা তিনি কুফরী ও পাপাচার সৃষ্টি করেছেন। অথচ তিনি স্বীয় বান্দাদের জন্য এটি পছন্দ করেন না। অপর পক্ষে ইরাদায়ে শরঈয়ার সাথে পছন্দ ও ভালোবাসার সম্পর্ক রয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা তাঁর যেই ইচ্ছার দ্বারা শরীয়াতের আদেশ করেন, তার সাথে পছন্দ ও ভালোবাসার সম্পর্ক রয়েছে। তিনি যেই কাজকে ভালোবাসেন ও পছন্দ করেন, স্বীয় বান্দাকে তাই আদেশ করেছেন। তবে ইরাদায়ে শরঈয়া কখনো বাস্তবায়ন হয় আবার কখনো তা বাস্তবায়ন হয় না। মুমিনের ক্ষেত্রে আল্লাহর ইরাদায়ে কাওনীয়া ও শরঈয়া উভয়ই বাস্তবায়িত হয়েছে। অপর পক্ষে আল্লাহ তা‘আলা যেখানে কাফেরকে ঈমান আনয়নের আদেশ দিয়েছেন, কিন্তু কাফের ঈমান আনয়ন করেনি, সেখানে আল্লাহর ইরাদায়ে কাওনীয়ার বাস্তবায়ন হয়েছে, শরঈয়া বাস্তবায়ন হয়নি। যদিও তিনি ঈমানকে পছন্দ করেন এবং কুফুরীকে অপছন্দ করেন।
[4]. সহীহ মুসলিম ২৬২১।
[5]. সহীহ বুখারী ২৭০৩, সহীহ মুসলিম ১৬৭৫, ইবনে মাজাহ ২৬৪৯, আবূ দাউদ ৪৫৯৫, মুসনাদে আহমাদ।
[6]. সহীহ: তিরমিযী ২৬১৬।