কোর’আন ও হাদীসের ব্যাপারে চরম মূর্খতা শির্ক বিস্তারের সর্বপ্রথম ও সর্ববৃহৎ কারণ। এ কারণেই মানুষ অতি সহজভাবেই পিতৃপুরুষ কর্তৃক প্রচলিত নীতি ও রসম-রেওয়াজের অন্ধ অনুসারী হয়ে যায় এবং এ কারণেই মানুষ ওলী-বুযুর্গদের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করতে শিখে।
উক্ত কারণেই এমন কিছু মাজারের পূজা করা হয় যেখানে কোন পীর-ফকির শায়িত নেই এবং এ কারণেই কোন পীর-ফকির যেনা-ব্যভিচার করলেও তা মুখ বুজে সহ্য করা হয়। প্রকাশ্যে মদের আড্ডা জমানোর পরও তাকে বরাবর ভক্তি করা হয়। উলঙ্গ হয়ে সবার সম্মুখে দিন-রাত ঘুরে বেড়ালেও তার বুযুর্গীর মধ্যে এতটুকুও কমতি আসে না।
বিদ্যা-বুদ্ধির এহেন অপমৃত্যু, বিচার-বিবেচনার এ দীনতা, চরিত্রের এ অবক্ষয়-অবনতি, মানবিক আত্মমর্যাদাবোধের এ খোলা অপমান এবং আক্বীদা-বিশ্বাসের এমন অস্তিত্ব হনন কোর’আন ও হাদীসের ব্যাপারে চরম মূর্খতার ফল বৈ আর কি?
সবাই এ কথা এক বাক্যে স্বীকার করেন যে, কোন জাতির আক্বীদা-বিশ্বাস, মন ও মনন, শিক্ষা ও সংস্কৃতির পুনর্গঠনে একমাত্র জাতীয় শিক্ষা সিলেবাসই মৌলিক ভূমিকা রেখে থাকে। কিন্তু আপসোসের বিষয় হলো এই যে, আমাদের শিক্ষা সিলেবাস সম্পূর্ণরূপে তাওহীদ বিরোধী। তাতে মাযার পূজা ও পীর পূজার প্রতি সরাসরি উৎসাহ দেয়া হচ্ছে। পীর-ফকিরদের ব্যাপারে অনেক ধরনের বানানো কারামত শুনিয়ে মানুষকে তাদের অন্ধ ভক্ত বানানো হচ্ছে। তাতে করে সাধারণ শিক্ষিতদের মধ্যে যে মানসিকতা জন্ম নিচ্ছে তা নিম্নরূপঃ
ক. বুযুর্গদের কবরের উপর ঘর বানানো বা মাযার তৈরী করা এবং সে কবরকে উদ্দেশ্য করে উরস করা বা মেলা বসানো প্রচুর সাওয়াবের কাজ।
খ. উরস বা মেলা উপলক্ষে গান-বাদ্যের বিশেষ আয়োজন করা হলে বুযুর্গদের যথাযথ সম্মান রক্ষা ও বৃদ্ধি পায়।
গ. বুযুর্গদের মাযারের উপর ফুল ছড়িয়ে দেয়া, মাযারকে আলোকিত করা, উরস উপলক্ষে খানা বা তাবার্রুকের আয়োজন করা এবং মাযারে বসে ইবাদাত করা প্রচুর সাওয়াবের কাজ।
ঘ. বুযুর্গদের মাযারের পার্শ্বে গিয়ে দো’আ করা দো’আ কবুল হওয়ার একমাত্র বিশেষ উপায়।
ঙ. ওলীদের মাযারে গেলে মনের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয়, গুনাহ্ মাফ হয় বা পরকালে নাজাত পাওয়া যায়।
চ. বুযুর্গদের মাযারে গিয়ে ফয়েয-বরকত হাসিল করা বিশেষ সাওয়াবের কাজ।
এ কারণেই এ জাতীয় সিলেবাস পড়ুয়াদের মুখ থেকে সে যত বড় শিক্ষিতই হোক না কেন আপনি কখনো তাওহীদের কথা শুনতে পাবেন না। কারণ, তারা তাওহীদের শিক্ষা গ্রহণ করেনি। বরং তারা এর বিপরীতে শির্ক ও বিদ্’আতের প্রশিক্ষণ নিয়েছে।
এ কারণেই কবি ইকবাল ঠিকই বলেছেন যার মর্মার্থ নিম্নরূপ:
মাদ্রাসাওয়ালারা তাওহীদকে গলা টিপে হত্যা করেছে। অতএব আমরা আর কোথা থেকে খাঁটি তাওহীদের ডাক শুনতে পাবো?
পীরদের আস্তানা, দরবার বা তথাকথিত খান্ক্বা শরীফ ইসলামের বিরুদ্ধে একটি প্রকাশ্য বিদ্রোহ। শুধু আক্বীদা-বিশ্বাসের ক্ষেত্রেই নয় বরং তারা আমলের ক্ষেত্রেও রাসূল (সা.) আনীত বিধানের সাথে বিদ্রোহ করেছে। বাস্তব কথা এইযে, খান্ক্বা, মাযার, দরবার বা পীরদের আস্তানায় ইসলামের যতটুকু অসম্মান হয়েছে ততটুকু অসম্মান মন্দির, গির্জা বা চার্চেও হয়নি।
পীর-বুযুর্গদের কবরের উপর ঘর বা গুম্বজ তৈরী করা, কবরকে সাজ-সজ্জা বা আলোকিত করা, কবরের উপর ফুল ছড়ানো, কবরকে গোসল দেয়া, কবরের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কবরের খাদিম হয়ে তার পার্শ্বে অবস্থান করা, কবরের জন্য কোন কিছু মানত করা, কবরকে উপলক্ষ করে খানা বা শিরনি বিতরণ করা, পশু জবাই করা, কবরের জন্য রুকূ’-সিজ্দাহ্ করা, কবরের সামনে দু’ হাত বেঁধে বিনম্রভাবে দাঁড়ানো, কবরে শায়িত ব্যক্তির নিকট কোন কিছু চাওয়া, তাদের নামে চুলের বেণী রাখা বা শরীরের কোথাও সুতা বেঁধে দেয়া, তাদের নামের দোহাই দেয়া বা বিপদের সময় তাদেরকে ডাকা, মাযারের চতুষ্পার্শ্বে তাওয়াফ করা, তাওয়াফ শেষে কুরবানী করা বা মাথা মুন্ডানো, মাযারের দেয়ালে চুমু খাওয়া, বরকতের জন্য কবরের মাটি যত্ন সহকারে সংগ্রহ করা, খালি পায়ে কবর পর্যন্ত পায়ে হেঁটে যাওয়া এবং উল্টো পায়ে ফিরে আসা ইত্যাদি ইত্যাদি তো যে কোন কবরের জন্যই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। যা শির্ক ও বিদ্’আত ছাড়া আর অন্য কিছু নয়।
কোন কোন খান্ক্বার খিদমতের জন্য তো ছোট বাচ্চা বা যুবতী মেয়েও ওয়াক্ফ করা হয় এবং নিঃসন্তান মহিলাদেরকে নয় রাতের জন্য খাদিমদের খিদমতে রাখা হয়। তথাকথিত যমযমের পানি পান করানো হয়। আবার কোন কোন মাযারে তো মদ, গাঁজা ও আফিমের আড্ডা জমে। কোন কোন মাযাওে তো যেনা-ব্যভিচার বা সমকামিতার মতো নিকৃষ্ট কাজও চর্চা করা হয়। আবার কোন কোন মাযারকে তো হত্যাকারী ও সন্ত্রাসীদের আশ্রয়স্থলও মনে করা হয়।
উরস উপলক্ষে পুরুষ ও মহিলাদের সহাবস্থান, নাচ-গান তো নিত্য দিনেরই ব্যাপার। পাকিস্তানের সরকারী হিসেবে যখন সেখানে প্রতি বছর ৬৩৪ টি উরস তথা প্রতি মাসে ৫৩ টি উরস সংঘটিত হয়ে থাকে তখন বাংলাদেশে প্রতি মাসে বিশ-ত্রিশটা উরস তো হয়েই থাকবে এর মধ্যে কোন সন্দেহ নেই। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে, লাহোরের মুসলমানরা ‘‘মধু লাল’’ নামক এক ব্রাহ্মণের কবরের উপরও মাযার বানিয়েছে যার উপর শেখ হুসাইন নামক এক বুযুর্গ আশিক হয়েছিলেন। মধু লালের মৃত্যুর পর শেখ হুসাইনের ভক্তরা মধু লালকে তার আশিকের পাশেই দাফন করে দেয় এবং উভয় নামকে মিলিয়ে তাদের মাযারকে মধু লাল হুসাইনের মাযার বলে আখ্যায়িত করে।
অনেকেই এমন ধারণা পোষণ করেন যে, মানুষ ইবাদাত করতে করতে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, সে তখন দুনিয়ার প্রতিটি বস্ত্তর মধ্যে আল্লাহ্ তা’আলাকে স্বয়ং দেখতে পায় অথবা দুনিয়ার প্রতিটি বস্ত্তকে আল্লাহ্ তা’আলার অস্তিত্বের বিশেষ অংশ হিসেবে মনে করে। এ পর্যায়কে সূফীদের পরিভাষায় ‘‘ওয়াহদাতুল্ উজূদ্’’ বলা হয়।
এভাবে মানুষ আরো বেশি বেশি আল্লাহ্ তা’আলার ইবাদাত করতে থাকলে সে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, তখন তার অস্তিতব আল্লাহ্ তা’আলার অস্তিত্বের মধ্যে বিলীন হয়ে যায়। তখন আল্লাহ্ তা’আলা ও তাঁর বান্দাহ্’র মাঝে আর কোন ব্যবধানই থাকে না। এ পর্যায়কে সূফীদের পরিভাষায় ‘‘ওয়াহদাতুশ্ শুহূদ্’’ বা ‘‘ফানা ফিল্লাহ্’’ বলা হয়।
এভাবে মানুষ আরো বেশি বেশি আল্লাহ্ তা’আলার ইবাদাত করতে থাকলে সে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, তখন আল্লাহ্ তা’আলার অস্তিত্ব তার অস্তিত্বের মধ্যে বিলীন হয়ে যায়। এ পর্যায়কে সূফীদের পরিভাষায় ‘‘হুলূল্’’ বলা হয়।
মূল কথা বিবেচনা করলে দেখা যাবে যে, এ পরিভাষাগুলোর মাঝে কোন ফারাকই নেই। কারণ, সবগুলোর মূল কথা হচ্ছে, মানুষ তথা আল্লাহ্ তা’আলার সকল সৃষ্টি তাঁরই অংশ বিশেষ মাত্র। হিন্দুদের পরিভাষায় এ বিশ্বাসকে অবতার বলা হয়।
উক্ত বিশ্বাসের কারণেই ইহুদীরা উযাইর (আ.) কে এবং খ্রিস্টানরা ঈসা (আ.) কে আল্লাহ্ তা’আলার ছেলে বলে আখ্যায়িত করেছে। শিয়াদের মধ্যেও এ বিশ্বাস চালু রয়েছে এবং উক্ত কারণেই সূফী সম্রাট মনসূর হাল্লাজ নিজকে আল্লাহ্ তা’আলা তথা ‘‘আনাল্ হক্ব’’ বলে দাবি করেছিলেন। হযরত বায়যীদ বোস্তামীও বলেছিলেন: ‘‘সুব্হানী মা আ’যামা শা’নী’’ (আমি পবিত্র এবং আমি কতই না সুমহান!)। একদা জনৈক ব্যক্তি তাঁর ঘরের দরোজায় গিয়ে তাঁকে ডাক দিলে তিনি বলেন: কাকে চাও। সে বললো: আমি বায়যীদ বোস্তামীকে চাই। তখন তিনি লোকটিকে বললেন: ঘরে আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া আর কেউ নেই। পরবর্তীতে এ দাবির সমর্থন জানিয়েছেন সর্বজনাব ’আলী হাজুইরী, শাইখ আব্দুল কাদের জিলানী, খাজা নিজামুদ্দীন আউলিয়া, মাওলানা আশ্রাফ আলী থানুভী ও রশীদ আহমাদ গঙ্গূহী সাহেবগণ।
এ দিকে অনেক নতুন ও পুরাতন সূফী সাহেবগণ উক্ত বিশ্বাসকে সঠিক প্রমাণ করতে গিয়ে বড় বড় অনেক কিতাব ও প্রবন্ধ লিখেছেন। তবে আমাদের প্রশ্ন হলো এই যে, আল্লাহ্ তা’আলা এবং তাঁর বান্দাহ্ যদি একই হয়ে যায় তা হলে ইবাদাতই বা করবে কে এবং কার ইবাদাত করা হবে? সিজ্দাহ্ই বা করবে কে এবং কাকে সিজ্দাহ্ করা হবে? স্রষ্টাই বা কে এবং সৃষ্টি বলতে কোন বস্ত্তটিকে বুঝানো হবে? মুখাপেক্ষীই বা কে এবং সমস্যা দূর করবেন কে? মরবেই বা কে এবং মৃত্যু দিবেন কে? জীবিতই বা কে এবং জীবন দিচ্ছেন কে? গুনাহ্গারই বা কে এবং ক্ষমা করবেন কে? কিয়ামতের দিন হিসেব দিবেই বা কে এবং হিসেব নিবেন কে? জান্নাত ও জাহান্নামে যাবেই বা কে এবং পাঠাবেন কে?
উক্ত দর্শন মেনে নিলে মানুষ ও মানুষের সৃষ্টি এবং আখিরাত সবই অর্থহীন হতে বাধ্য। উক্ত দর্শন ঠিক হলে খ্রিস্টানদের দর্শনও ঠিক হতে বাধ্য। তারা তো শুধু এতটুকুই বলে যে, ঈসা (আ.) আল্লাহ্ তা’আলার সন্তান বা সরাসরি আল্লাহ্ তা’আলা। তাদের দর্শন ও উক্ত দর্শনের মধ্যে কোন পার্থক্যই নেই; অথচ আল্লাহ্ তা’আলা কোর’আন মাজীদের মধ্যে তাদেরকে কাফির বলেছেন।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
«لَقَدْ كَفَرَ الَّذِيْنَ قَالُوْآ إِنَّ اللهَ هُوَ الْـمَسِيْحُ ابْنُ مَرْيَمَ، قُلْ فَمَنْ يَّمْلِكُ مِنَ اللهِ شَيْئًا إِنْ أَرَادَ أَنْ يُّهْلِكَ الْـمَسِيْحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَأُمَّهُ وَمَنْ فِيْ الْأَرْضِ جَمِيْعًا، وَلِلهِ مُلْكُ السَّمٰوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا، يَخْلُقُ مَا يَشَآءُ، وَاللهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ»
‘‘তারা অবশ্যই কাফির যারা বলে: নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা’আলা হচ্ছেন স্বয়ং মার্ইয়াম এর ছেলে মাসীহ্ বা ঈসা (আ.)। হে নবী! আপনি তাদেরকে বলে দিন: আল্লাহ্ তা’আলা যদি মার্ইয়াম এর ছেলে মাসীহ্ বা ঈসা (আ.) কে এবং তাঁর মাকে ও দুনিয়ার সবাইকে ধ্বংস করে দিতে চান তখন তাদেরকে আল্লাহ্ তা’আলার হাত থেকে রক্ষা করবেন কে? ভূমন্ডল-নভোমন্ডল এবং এতদুভয়ের মধ্যে যা কিছু রয়েছে সবগুলোর কর্তৃত্ব একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলারই হাতে। তিনি যা চান তাই সৃষ্টি করেন। আর আল্লাহ্ তা’আলা সকল বস্ত্তর উপর পূর্ণ ক্ষমতাবান’’। (মা’য়িদাহ্ : ১৭)
আল্লাহ্ তা’আলা আরো বলেন:
«وَقَالُوْا اتَّخَذَ الرَّحْمَنْ وَلَدًا، لَقَدْ جِئْتُمْ شَيْئًا إِدًّا، تَكَادُ السَّمَاوَاتُ يَتَفَطَّرْنَ مِنْهُ وَتَنْشَقُّ الْأَرْضُ وَتَخِرُّ الْـجِبَالُ هَدًّا، أَنْ دَعَوْا لِلرَّحْمَنِ وَلَدًا»
‘‘তারা বলে: দয়াময় আল্লাহ্ তা’আলা সন্তান গ্রহণ করেছেন। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন: মূলতঃ তোমরা এক মারাত্মক কথার অবতারণা করলে। যে কথার ভয়ঙ্করতায় আকাশ ফেটে যাবে। পৃথিবী খন্ড-বিখন্ড হয়ে যাবে। চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে পাহাড়ও ভেঙ্গে পড়বে। যেহেতু তারা দয়াময় আল্লাহ্ তা’আলার সন্তান আছে বলে দাবি করেছে’’। (মার্ইয়াম : ৮৮-৯১)
উক্ত ব্যাপারটি এতো মারাত্মক হওয়ার একমাত্র কারণ এই যে, যখন কেউ আল্লাহ্ তা’আলার সন্তান অথবা কারোর অস্তিত্বের মধ্যে আল্লাহ্ তা’আলার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে বলে মনে করা হবে তখন এটাও মনে করতে হবে যে, তার মধ্যে আল্লাহ্ তা’আলার সকল বৈশিষ্ট্য এসে গিয়েছে। আর যখন তার মধ্যে আল্লাহ্ তা’আলার সকল বৈশিষ্ট্য আছে বলে মনে করা হবে তখন স্বাভাবিকভাবেই তার সন্তুষ্টির জন্য সকল ধরনের ইবাদাত ব্যয় করা হবে। তা হলে বুঝা গেলো, আল্লাহ্ তা’আলার অস্তিত্বে শির্ক করা এবং তাঁর গুণাবলী ও ইবাদাতে শির্ক করার মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। এ কারণেই আল্লাহ্ তা’আলা উক্ত আয়াতে তাঁর অস্তিত্বের মধ্যে শির্ক করার ব্যাপারে এতো কঠিন মন্তব্য করেছেন।
উক্ত ঈমান বিধ্বংসী বিশ্বাসের কারণেই সূফীরা নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর ব্যাপারে কঠিন কঠিন ঈমান বিধ্বংসী মন্তব্য করতে এতটুকুও লজ্জা পায়নি। বিষয়গুলো নিম্নরূপ:
ক. রাসূল ও রিসালাত:
নবু’ওয়াত ও রিসালাত সম্পর্কে সূফীদের ঈমান বিধ্বংসী ধারণার কিয়দাংশ নিম্নে উপস্থাপন করা হলো:
সূফীদের নিকট ‘‘বিলায়াত’’ তথা বুযুর্গী নবু’ওয়াত এবং রিসালাত চাইতেও উত্তম।
শাইখ মুহয়ুদ্দীন ইবনু ’আরাবী বলেন:
‘‘নবু’ওয়াতের অবস্থান মধ্যম পর্যায়ের। বিলায়াতের নীচে ও রিসালাতের উপরে’’। (শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ১১৮)
বায়েযীদ বুস্তামী বলেন:
‘‘আমি (মা’রিফাতের) সাগরে ডুব দিয়েছি; অথচ নবীরা আশ্চর্য হয়ে পাড়ে দাঁড়িয়ে আছেন’’। তিনি আরো বলেন:
‘‘আমার পতাকা কিয়ামতের দিন মুহাম্মাদ (সা.) এর পতাকা চাইতেও অনেক উঁচু হবে’’। আমার পতাকা হবে নূরের। যার নিচে থাকবেন সকল নবী ও রাসূলগণ। সুতরাং আমাকে একবার দেখা আল্লাহ্ তা’আলাকে এক হাজার বার দেখার চাইতেও উত্তম।
সূফীদের কেউ কেউ ধারণা করেন: রাসূল (সা.) হচ্ছেন বিশ্বের কেন্দ্র স্থল। তিনিই হচ্ছেন স্বয়ং আল্লাহ্। যিনি আর্শের উপর রয়েছেন। আকাশ ও জমিন, আর্শ এবং কুর্সী এমনকি বিশ্বের তাঁর নূর থেকেই তৈরি করা হয়েছে। তাঁর অস্তিত্বই সর্ব প্রথম। আল্লাহ্’র আর্শের উপর তিনিই সমাসীন। (সূফিয়্যাত, শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ১২০)
নিযামুদ্দীন আউলিয়া বলেন: ‘‘পীরের কথা রাসূল (সা.) এর কথার সম পর্যায়ের’’। (সূফীবাদের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ কিতাব, পৃষ্ঠা: ৬৯)
’হাফিয শীরাযী বলেন: ‘‘যদি তোমাকে তোমার পীর সাহেব নিজ জায়নামায মদে ডুবিয়ে দিতে বলে তাহলে তুমি তাই করবে। কারণ, বুযুর্গীর রাস্তায় চলন্ত ব্যক্তি সে রাস্তার আদব-কায়দা সম্পর্কে ভালোই জানেন’’। (শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ১৫২)
খ. কোর’আন ও হাদীস:
কোর’আন ও হাদীস সম্পর্কে সূফীদের ধারণা:
সূফী ’আফীফুদ্দীন তিলমাসানী বলেন:
‘‘কোর’আন মাজীদের মধ্যে তাওহীদ কোথায়? তা তো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শির্ক দিয়েই পরিপূর্ণ। যে ব্যক্তি সরাসরি কোর’আনকে অনুসরণ করবে সে কখনো তাওহীদের উচ্চ শিখরে পৌঁছুতে পারবে না’’। (শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ১৫২)
জনাব বায়েযীদ বোস্তামী বলেন: ‘‘তোমরা (শরীয়তপন্থীরা) নিজেদের জ্ঞান মৃত ব্যক্তিদের থেকে (মুহাদ্দিসীনদের থেকে) সংগ্রহ করে থাকো। আর আমরা নিজেদের জ্ঞান সরাসরি আল্লাহ্ তা’আলা থেকে সংগ্রহ করি যিনি চিরঞ্জীব। আমরা বলি: আমার অন্তর আমার প্রভু থেকে বর্ণনা করেছে। আর তোমরা বলো: অমুক বর্ণনাকারী আমার নিকট বর্ণনা করেছে। যদি প্রশ্ন করা হয়, ওই বর্ণনাকারী কোথায়? উত্তর দেয়া হয়, সে মৃত্যু বরণ করেছে। যদি বলা হয়: সে বর্ণনাকারী কার থেকে বর্ণনা করেছে এবং সে কোথায়? বলা হবে: সেও মৃত্যু বরণ করেছে। (শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ১৫২)
গ. ইবলিস ও ফির’আউন:
অভিশপ্ত ইবলিস সম্পর্কে সূফীদের ধারণা হচ্ছে এই যে, সে আল্লাহ্ তা’আলার কামিল বান্দাহ্। সর্ব শ্রেষ্ঠ আল্লাহ্’র সৃষ্টি। খাঁটি তাওহীদ পন্থী। কারণ, সে একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া আর কাউকে সিজদাহ্ করেনি। আল্লাহ্ তা’আলা তার সকল গুনাহ্ ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং তাকে জান্নাতে প্রবেশ করিয়েছেন।
ফির’আউন সম্পর্কে তাদের ধারণা হচ্ছে এই যে, সে একজন শ্রেষ্ঠ তাওহীদ পন্থী। কারণ, সে ঠিকই বলেছে: ‘‘আনা রাব্বুকুমুল-আ’লা’’ (আমিই তো তোমাদের সুমহান প্রভু)। মূলতঃ সেই তো হাক্বীক্বতে পৌঁছেছে। কারণ, সব কিছুই তো স্বয়ং আল্লাহ্। তাই সে খাঁটি ঈমানদার এবং জান্নাতী।
ঘ. ইবাদাত ও মুজাহাদাহ্:
সূফীদের পরিভাষায় নামায বলতে আল্লাহ্ তা’আলার সাথে আন্তরিক সাক্ষাতকেই বুঝানো হয়। আবার কারো কারোর নিকট পীরের প্রতিচ্ছবি কাল্পনিকভাবে নামাযীর চোখের সামনে উপস্থিত না হলে সে নামায পরিপূর্ণই হয় না। রোযা বলতে হৃদয়ে গায়রুল্লাহ্’র চিন্তা (একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া দুনিয়াতে অন্য কিছু আছে বলে মনে করা) না আসাকেই বুঝানো হয় এবং হজ্জ বলতে নিজ পীর সাহেবের সাথে বিশেষভাবে সাক্ষাৎ করাকেই বুঝানো হয়। ইত্যাদি ইত্যাদি। তারা প্রচলিত নামায, রোযা, হজ্জ ও যাকাতকে সাধারণ লোকের ইবাদাত বলে আখ্যায়িত করে। যা বিশেষ ও অতি বিশেষ লোকদের জন্য প্রযোজ্য নয়। বরং তাদের জন্য রয়েছে বিশেষ যিকির, নিতান্ত একা জীবন যাপন, নির্দিষ্ট খাবার, নির্দিষ্ট পোষাক ও নির্দিষ্ট বৈঠক।
ইসলামে ইবাদাতের উদ্দেশ্য ব্যক্তি বা সমাজ শুদ্ধি হয়ে থাকলেও সূফীদের ইবাদাতের উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহ্ তা’আলার সাথে অন্তরের বিশেষ বন্ধন সৃষ্টি যার দরুন তাঁর থেকেই সরাসরি কিছু শিখা যায় এবং তাঁর মধ্যে বিলীন হওয়া যায়। তাঁর রাসূল থেকে গায়েবের জ্ঞান সংগ্রহ করা যায়। এমনকি আল্লাহ্ তা’আলার একান্ত চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্য মন্ডিত হওয়া যায়। তা হলে সূফী সাহেবও কোন কিছুকে হতে বললে তা হয়ে যাবে। মানুসের গুপ্ত রহস্যও তিনি বলতে পারবেন। এমনকি আকাশ ও জমিনের সব কিছুই তিনি সচক্ষে দেখতে পাবেন।
এ ছাড়াও সূফীরা ইবাদাত ও মুজাহাদাহ্’র ক্ষেত্রে এমন কিছু পন্থা আবিষ্কার করেছে যা কুর’আন ও হাদীসের সম্পূর্ণ বিরোধী। নিম্নে উহার কিছু দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করা হলো:
১. বলা হয়: আব্দুল কাদির জিলানী পনেরো বছর যাবৎ এক পায়ে দাঁড়িয়ে ’ইশা থেকে ফজর পর্যন্ত এক খতম কোর’আন মাজীদ তিলাওয়াত করেছেন। (শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ৪৯১)
একদা তিনি নিজেই বলেন: আমি পঁচিশ বছর যাবৎ ইরাকের জঙ্গলে একা একা ঘুরে বেড়িয়েছি। এমনকি আমি এক বছর পর্যন্ত তো শুধু ঘাস ও মানুষের পরিত্যক্ত বস্ত্ত খেয়েই জীবন যাপন করেছি। পুরো বছর একটুও পানি পান করিনি। তবে এর পরের বছর পানিও পান করতাম। তৃতীয় বছর তো শুধু পানি পান করেই জীবন যাপন করেছি। চতুর্থ বছর না কিছু খেয়েছি না কিছু পান করেছি না শুয়েছি।
(গাউসুস্ সাক্বালাইন, পৃষ্ঠা: ৮৩ শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ৪৩১)
২. বায়েযীদ বোস্তামী তিন বছর যাবৎ সিরিয়ার জঙ্গলে রিয়াযাত (সূফীবাদের প্রশিক্ষণ) ও মুজাহাদাহ্ করেছেন। একদা তিনি হজ্জে রওয়ানা করলেন। যাত্রাপথে তিনি প্রতি কদমে কদমে দু’ রাক্’আত দু’ রাক্’আত নামায আদায় করেছেন। এতে করে তিনি বারো বছরে মক্কা পৌঁছেন। (সূফিয়ায়ে নক্বশেবন্দী, পৃষ্ঠা: ৮৯ শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ৪৩১)
৩. মু’ঈনুদ্দীন চিশতী আজমীরি বেশি বেশি মুজাহাদাহ্ করতেন। তিনি সত্তর বছর যাবৎ পুরো রাত এতটুকুও ঘুমাননি।
(তারীখে মাশায়েখে চিশ্ত, পৃষ্ঠা: ১৫৫ শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ৫৯১)
৪. ফরীদুদ্দীন গাঞ্জে শুক্র চল্লিশ দিন যাবৎ কুয়ায় বসে চিল্লা পালন করেছেন।
(তারীখে মাশায়েখে চিশ্ত, পৃষ্ঠা: ১৭৮ শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ৩৪০)
৫. জুনাইদ বাগ্দাদী ত্রিশ বছর যাবৎ ’ইশার নামায পড়ার পর এক পায়ে দাঁড়িয়ে আল্লাহ্ আল্লাহ্ করেছেন।
(সূফিয়ায়ে নক্বশেবন্দী, পৃষ্ঠা: ৮৯ শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ৪৯১)
৬. খাজা মুহাম্মাদ্ চিশ্তী নিজ ঘরে এক গভীর কুয়া খনন করেছেন। তাতে তিনি উল্টোভাবে ঝুলে থেকে আল্লাহ্’র স্মরণে ব্যস্ত থাকতেন।
(সিয়ারুল আউলিয়া, পৃষ্ঠা: ৪৬ শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ৪৩১)
৭. মোল্লা শাহ্ কাদেরী বলতেন: পুরো জীবনে আমার স্বপ্নদোষ বা সহবাসের গোসলের কোন প্রয়োজন দেখা দেয়নি। কারণ, এগুলোর সম্পর্ক বিবাহ্ ও ঘুমের সঙ্গে। আর আমি না বিবাহ্ করেছি না কখনো ঘুমিয়েছি। (হাদীক্বাতুল আউলিয়া, পৃষ্ঠা: ৫৭ শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ২৭১)
রাসূল (সা.) এর আদর্শের সঙ্গে উক্ত আদর্শের কোন মিল নেই। বরং তা রাসূল (সা.) প্রদর্শিত আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত।
আব্দুল্লাহ্ বিন্ ’আমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
دَخَلَ عَلَيَّ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ: أَلَمْ أُخْبَرْ أَنَّكَ تَقُوْمُ اللَّيْلَ وَتَصُوْمُ النَّهَارَ؟ قُلْتُ: بَلَى، قَالَ: فَلاَ تَفْعَلْ، قُمْ وَنَمْ ، وَصُمْ وَأَفْطِرْ ، فَإِنَّ لِـجَسَـدِكَ عَلَيْكَ حَقًّا، وَإِنَّ لِعَيْنِكَ عَلَيْكَ حَقًّا، وَإِنَّ لِزَوْرِكَ عَلَيْكَ حَقًّا، وَإِنَّ لِزَوْجِكَ عَلَيْكَ حَقًّا، وَإِنَّكَ عَسَى أَنْ يَطُوْلَ بِكَ عُمُرٌ، وَإِنَّ مِنْ حَسْبِكَ أَنْ تَصُوْمَ مِنْ كُلِّ شَهْرٍ ثَلاَثَةَ أَيَّامٍ، فَإِنَّ بِكُلِّ حَسَنَةٍ عَشْرَ أَمْثَالِهَا، فَذَلِكَ الدَّهْرُ كُلُّهُ، قَالَ: فَشَدَّدْتُ فَشُدِّدَ عَلَيَّ، فَقُلْتُ: فَإِنِّيْ أُطِيْقُ غَيْرَ ذَلِكَ، قَالَ: فَصُمْ مِنْ كُلِّ جُمُعَةٍ ثَلاَثَةَ أَيَّامٍ، قَالَ: فَشَدَّدْتُ فَشُدِّدَ عَلَيَّ، فَقُلْتُ: أُطِيْقُ غَيْرَ ذَلِكَ، قَالَ: فَصُمْ صَوْمَ نَبِيِّ اللهِ دَاوُدَ، قُلْتُ: وَمَا صَوْمُ نَبِيِّ اللهِ دَاوُدَ؟ قَالَ: نِصْفُ الدَّهْرِ، وَفِيْ رِوَايَةٍ: قُلْتُ: فَإِنِّيْ أُطِيْقُ أَفْضَلَ مِنْ ذَلِكَ، قَالَ: لاَ أَفْضَلَ مِنْ ذَلِكَ، قَالَ عَبْدُ اللهِ: لَأَنْ أَكُوْنَ قَبِلْتُ الثَّلاَثَةَ الْأَيَّامَ الَّتِيْ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَحَبُّ إِلَيَّ مِنْ أَهْلِيْ وَمَالِيْ
‘‘রাসূল (সা.) আমার নিকট এসে বললেন: আমাকে সংবাদ দেয়া হয়েছে তুমি পুরো রাত নামায পড়ো এবং প্রতিদিন রোযা রাখো। এ সংবাদ কি সঠিক নয়? আমি বললাম: অবশ্যই। তিনি বললেন: তাহলে তুমি আর এমন করোনা। তুমি রাত্রে নামাযও পড়বে এবং ঘুমুবে। রোযা রাখবে এবং কখনো কখনো আবার রাখবেনা। কারণ, তোমার উপর তোমার শরীরেরও অধিকার আছে। তেমনিভাবে চোখ, মেহমান এবং স্ত্রীরও। হয়তোবা তুমি বেশি দিন বেঁচে থাকবে। তাই তোমার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, তুমি প্রতি মাসে তিনটি রোযা রাখবে। কারণ, তুমি একটি নেকি করলে দশটি নেকির সাওয়াব পাবে। এ হিসেবে প্রতি মাসে তিনটি রোযা রাখলে পুরো বছর রোযা রাখার সাওয়াব পাবে। আব্দুল্লাহ্ বলেন: আমি কঠোরতা দেখিয়েছি। তাই আমার উপর কঠিন করা হয়েছে। আমি বললাম: আমি এর চাইতেও বেশি পারি। তিনি বললেন: তাহলে প্রতি সপ্তাহে তিনটি রোযা রাখবে। আব্দুল্লাহ্ বলেন: আমি কঠোরতা দেখিয়েছি। তাই আমার উপর কঠিন করা হয়েছে। আমি বললাম: আমি এর চাইতেও বেশি পারি। তিনি বললেন: তাহলে আল্লাহ্’র নবী দাঊদ (আ.) এর ন্যায় রোযা রাখবে। আমি বললাম: দাঊদ (আ.) এর রোযা কেমন? তিনি বললেন: অর্ধ বছর। অর্থাৎ একদিন পর একদিন। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, আমি এর চাইতেও ভালো পারি। তিনি বললেন: এর চাইতে আর ভালো হয় না। শেষ জীবনে আব্দুল্লাহ্ বলেন: এখন তিন দিন মেনে নেয়াই আমার নিকট বেশি পছন্দনীয় যা রাসূল (সা.) বলেছিলেন আমার পরিবার, ধন-সম্পদ চাইতেও। (বুখারী, হাদীস ৬১৩৪ মুসলিম, হাদীস ১১৫৯)
অন্য বর্ণনায় তিনি বলেন: রাসূল (সা.) আমাকে বলেছেন:
وَاقْرَأِ الْقُرْآنَ فِيْ كُلِّ شَهْرٍ، قَالَ: قُلْتُ: يَا نَبِيَّ اللهِ! إِنِّيْ أُطِيْقُ أَفْضَلَ مِنْ ذَلِكَ، قَالَ: فَاقْرَأْهُ فِيْ كُلِّ عِشْرِيْنَ، قَالَ: قُلْتُ: يَا نَبِيَّ اللهِ! إِنِّيْ أُطِيْقُ أَفْضَلَ مِنْ ذَلِكَ، قَالَ: فَاقْرَأْهُ فِيْ كُلِّ عَشْرٍ، قَالَ: قُلْتُ: يَا نَبِيَّ اللهِ! إِنِّيْ أُطِيْقُ أَفْضَلَ مِنْ ذَلِكَ، قَالَ: فَاقْرَأْهُ فِيْ كُلِّ سَبْعٍ وَلاَ تَزِدْ عَلَى ذَلِكَ وَفِيْ رِوَايَةٍ: قَالَ: إِنِّيْ أَقْوَى مِنْ ذَلِكَ، قَالَ: اقْرَأْهُ فِيْ ثَلاثٍ أَوْ قَالَ: لَمْ يَفْقَهْ مَنْ قَرَأَ الْقُرْآنَ فِيْ أَقَلَّ مِنْ ثَلاَثٍ
‘‘তুমি প্রতি মাসে কোর’আন মাজীদ এক খতম দিবে। আব্দুল্লাহ্ বলেন: আমি বললাম: হে আল্লাহ্’র নবী! আমি আরো ভালো পারি। তিনি বললেন: তাহলে প্রতি বিশ দিনে এক খতম দিবে। আমি বললাম: হে আল্লাহ্’র নবী! আমি আরো ভালো পারি। তিনি বললেন: তাহলে প্রতি দশ দিনে এক খতম দিবে। আমি বললাম: হে আল্লাহ্’র নবী! আমি আরো ভালো পারি। তিনি বললেন: তাহলে প্রতি সপ্তাহে এক খতম দিবে। কিন্তু এর চাইতে আর বেশি পড়বেনা। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, আব্দুল্লাহ্ বিন্ ’আমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন: আমি এর চাইতেও বেশি পড়তে সক্ষম। তখন রাসূল (সা.) বললেন: তাহলে তুমি তিন দিনে এক খতম দিবে। ওব্যক্তি কোর’আন কিছুই বুঝেনি যে তিন দিনের কমে কোর’আন খতম করেছে’’। (মুসলিম, হাদীস ১১৫৯ আবু দাউদ, হাদীস ১৩৯০, ১৩৯১, ১৩৯৪ তিরমিযী, হাদীস ২৯৪৯ ইবনু মাজাহ্, হাদীস ১৩৬৪)
একদা সাল্মান (রা.) তাঁর আন্সারী ভাই আবুদ্দারদা’ (রা.) এর সাক্ষাতে তাঁর বাড়ি গেলেন। দেখলেন, উম্মুদ্দারদা’ (রাযিয়াল্লাহু আন্হা) ময়লা কাপড় পরিহিতা। তখন তিনি তাঁকে বললেন: তুমি এমন কাপড়ে কেন? তোমার তো স্বামী আছে। তিনি বললেন: তোমার ভাই আবূদ্দারদা’র দুনিয়ার ভোগ-বিলাসের প্রতি কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। ইতিমধ্যে আবূদ্দারদা’ ঘরে ফিরে সাল্মান (রা.) এর জন্য খানা প্রস্ত্তত করে বললেন: তুমি খাও। আমি এখন খাবোনা। কারণ, আমি রোযাদার। সাল্মান (রা.) বললেন: আমি খাবোনা যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি না খাবে। অতএব আবূদ্দারদা’ (রা.) খানা খেলেন। যখন রাত্র হয়ে গেল তখন আবূদ্দারদা’ (রা.) নফল নামায পড়তে গেলেন। এমন সময় সাল্মান (রা.) বললেন: ঘুমাও। তখন আবূদ্দারদা’ (রা.) ঘুমিয়ে গেলেন। অতঃপর আবারো আবূদ্দারদা’ (রা.) নফল নামায পড়তে গেলেন। এমন সময় সাল্মান (রা.) বললেন: ঘুমাও। তবে রাত্রের শেষ ভাগে সাল্মান (রা.) আবূদ্দারদা’ (রা.) কে বললেন: এখন উঠতে পারো। অতএব উভয়ে উঠে নামায পড়লেন। অতঃপর সাল্মান (রা.) আবূদ্দারদা’ (রা.) কে উদ্দেশ্য করে বললেন: নিশ্চয়ই তোমার উপর তোমার প্রভুর অধিকার আছে। তেমনিভাবে তোমার এবং তোমার পরিবারেরও। অতএব প্রত্যেক অধিকার পাওনাদারকে তার অধিকার অবশ্যই দিতে হবে। ভোর বেলায় আবুদ্দারদা’ (রা.) নবী (সা.) কে উক্ত ঘটনা জানালে তিনি বলেন:
صَدَقَ سَلْمَانُ
‘‘সালমান (রা.) সত্যই বলেছে’’। (বুখারী, হাদীস ৬১৩৯)
আনাস্ (রা.) বলেন: একদা তিন ব্যক্তি নবী (সা.) এর স্ত্রীদের নিকট এসে তাঁর ইবাদাত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তাদেরকে সে সম্পর্কে জানিয়ে দেয়া হলো। তারা তা সামান্য মনে করলো এবং বললো: নবী (সা.) এর সাথে আমাদের কোন তুলনাই হয়না। তাঁর আগ-পর সকল গুনাহ্ ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে। অতঃপর তাদের এক জন বললো: আমি কিন্তু যত দিন বেঁচে থাকবো সর্বদা পুরো রাত নফল নামায আদায় করবো। দ্বিতীয় জন বললো: আমি কিন্তু পুরো জীবন রোযা রাখবো। কখনো রোযা ছাড়বোনা। তৃতীয় জন বললো: আমি আদৌ বিবাহ করবোনা এমনকি কখনো মহিলাদের সংস্পর্শেও যাবোনা। রাসূল (সা.) কে এ সম্পর্কে জানানো হলে তিনি বলেন:
أَنْتُمُ الَّذِيْنَ قُلْتُمْ كَذَا وَكَذَا؟ أَمَا وَاللهِ إِنِّيْ لَأَخْشَاكُمْ لِلهِ وَأَتْقَاكُمْ لَهُ، لَكِنِّيْ أَصُوْمُ وَأُفْطِرُ، وَأُصَلِّيْ وَأَرْقُدُ، وَأَتَزَوَّجُ النِّسَاءَ، فَمَنْ رَغِبَ عَنْ سُنَّتِيْ فَلَيْسَ مِنِّيْ
‘‘তোমরাই কি এমন এমন বলেছো? জেনে রাখো, আল্লাহ্’র কসম! নিশ্চয়ই আমি তোমাদের চাইতেও অনেক অনেক বেশি আল্লাহ্ তা’আলাকে ভয় করি। তবুও আমি কখনো কখনো রোযা রাখি। আবার কখনো রাখিনা। রাত্রে নফল নামাযও পড়ি। আবার ঘুমও যাই। বিবাহও করি। অতএব যে ব্যক্তি আমার আদর্শ বিমুখ হলো সে আমার উম্মত নয়’’।
(বুখারী, হাদীস ৫০৬৩ মুসলিম, হাদীস ১৪০১)
ঙ. পুণ্য ও শাস্তি:
‘‘হুলূল’’ ও ‘‘ওয়াহ্দাতুল্ উজূদ্’’ এর দর্শন অনুযায়ী মানুষতো কিছুই নয়। বরং তার মধ্যে আল্লাহ্ তা’আলাই অবস্থান করছেন বলে (না’ঊযু বিল্লাহ্) সে যাই করুক না কেন তা একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার ইচ্ছায়ই করে থাকে। মানুষের না কোন ইচ্ছা আছে না অভিরুচি। যার দরুন সূফীবাদীদের নিকট ভালো-খারাপ, হালাল-হারাম, আনুগত্য-নাফরমানি, পুণ্য ও শাস্তি বলতে কিছুই নেই। তাই তো তাদের মধ্যে রয়েছে বহু যিন্দীক্ব ও প্রচুর সমকামী। বরং তাদের কেউ কেউ তো প্রকাশ্য দিবালোকে গাধার সাথেও সঙ্গমে লিপ্ত হয়েছে। আবার কেউ কেউ তো মনে করেন, তাঁদের আর শরীয়ত মানতে হবে না। আল্লাহ্ তা’আলা তাঁদের জন্য সব কিছুই হালাল করে দিয়েছেন। এ কারণেই অধিকাংশ সূফীগণ জান্নাত ও জাহান্নাম নিয়ে ঠাট্টা-উপহাস করেছেন। বরং তাঁরা জান্নাত কামনা করাকে একজন সূফীর জন্য মারাত্মক অপরাধ মনে করেন। তাঁদের চাওয়া-পাওয়া হচ্ছে, ফানা ফিল্লাহ্, গায়েব জানা ও বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ এবং এটাই তাঁদের বানানো জান্নাত। তেমনিভাবে জাহান্নামকে ভয় পাওয়াও একজন সূফীর জন্য মারাত্মক অপরাধ। কারণ, তা গোলামের অভ্যাস ; স্বাধীন লোকের নয়। বরং তাঁদের কেউ কেউ তো দাম্ভিকতা দেখিয়ে এমনো বলেছেন যে, আমি যদি চাই জাহান্নামের জ্বলন্ত আগুনকে মুখের সামান্য থুতু দিয়েই নিভিয়ে দিতে পারি। আরেক ক্বুতুব বলেনঃ আমি যদি আল্লাহ্ তা’আলাকে লজ্জা না করতাম তা হলে মুখের সামান্য থুতু দিয়েই জাহান্নামকে জান্নাত বানিয়ে দিতাম।
নিযামুদ্দীন আওলিয়া তাঁর সংকলিত বাণী ‘‘ফাওয়ায়িদুল্ ফুওয়াদ্’’ কিতাবে বলেন:
’’কিয়ামতের দিন মা’রূফ কার্খীকে জান্নাতে যাওয়ার জন্য আদেশ করা হবে। কিন্তু তিনি তখন বলবেনঃ আমি জান্নাতে যাবো না। আপনার জান্নাতের জন্য আমি ইবাদাত করিনি। অতএব ফিরিশ্তাদেরকে আদেশ করা হবে, একে নূরের শিকলে মজবুত করে বেঁধে টেনে হেঁচড়ে জান্নাতে নিয়ে যাও’’।
বায়েযীদ বোস্তামী বলেন: জান্নাত তো বাচ্চাদের খেলনা ছাড়া আর কিছুই নয়। পাপী আবার কারা ? কার অধিকার আছে মানুষকে জাহান্নামে ঢুকাবে? (শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ৫০০)
রাবে’আ বস্রী সম্পর্কে বলা হয়, তিনি একদা ডান হাতে পানির পেয়ালা এবং বাম হাতে আগুনের জ্বলন্ত কয়লা নিয়ে বলেন: আমার ডান হাতে জান্নাত এবং বাম হাতে জাহান্নাম। অতএব আমি জান্নাতকে জাহান্নামের উপর ঢেলে দিচ্ছি। যাতে করে জান্নাতও না থাকে এবং জাহান্নামও। তাহলে মানুষ একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার ইবাদাত করবে।
চ. কারামাত:
সূফীগণ ‘‘’হুলূল’’ ও ‘‘ওয়াহ্দাতুল্ উজূদে’’ বিশ্বাস করার দরুন তাঁরা মনে করেন যে, আল্লাহ্ তা’আলা এককভাবে যা করতে পারেন তাঁরাও তা করতে পারেন। তাই তো মনে করা হয়, তাঁরা বিশ্ব পরিচালনা করেন। গাউসের নিকট রয়েছে সব কিছুর চাবিকাঠি। চার জন ক্বুতুব গাউসেরই আদেশে বিশ্বের চার কোণ ধরে রেখেছেন। সাত জন আব্দাল গাউসেরই আদেশে বিশ্বের সাতটি মহাদেশ পরিচালনা করেন। আর নজীবগণ নিয়ন্ত্রণ করেন বিশ্বের প্রতিটি শহর। প্রত্যেক শহরে একজন করে নজীব রয়েছেন। হেরা গুহায় তাঁরা প্রতি রাত্রে একত্রিত হন এবং সৃষ্টিকুলের ভাগ্য নিয়ে খুব নিবিড়ভাবে তাঁরা চিন্তা করেন। তাঁরা জীবিতকে মারতে পারেন এবং মৃতকে জীবিত করতে পারেন। বাতাসে উড়তে পারেন এবং মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারেন ; অথচ কোর’আন ও হাদীসের দৃষ্টিতে এ সবগুলো একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলাই করতে বা করাতে পারেন। অন্য কেউ নয়।
নিম্নে সূফীদের কিছু বানানো কাহিনী উল্লেখ করা হলো:
১. একদা আব্দুল কাদের জিলানী মুরগীর তরকারি খেয়ে হাড়গুলো পাশে রেখেছেন। অতঃপর হাড়গুলোর উপর হাত রেখে বললেন: আল্লাহ্’র আদেশে দাঁড়িয়ে যাও। ততক্ষণাতই মুরগীটি জীবিত হয়ে গেলো।
(সীরাতে গাউস্, পৃষ্ঠা: ১৯১ শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ৪১১)
২. একদা আব্দুল কাদের জিলানী জনৈক গায়কের কবরে গিয়ে তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন: আমার আদেশে দাঁড়িয়ে যাও। তখন কবর ফেটে লোকটি গাইতে গাইতে কবর থেকে বের হয়ে আসলো।
(তাফরীজুল্ খা’ত্বির, পৃষ্ঠা: ১৯ শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ৪১২)
৩. খাজা আবু ইস্হাক্ব চিশ্তী যখনই সফর করতে চাইতেন তখনই দু’ শত মানুষকে সাথে নিয়ে চোখ বন্ধ করলেই সাথে সাথে গন্তব্যস্থানে পৌঁছে যেতেন। (তা’রীখে মাশায়িখে চিশ্ত, পৃষ্ঠা: ১৯২ শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ৪১৮)
৪. সাইয়েদ মাওদূদ চিশ্তী ৯৭ বছর বয়সে মৃত্যু বরণ করেন। তাঁর প্রথম জানাযা মৃত বুযুর্গরা পড়েছেন। দ্বিতীয় জানাযা সাধারণ লোকেরা। অতঃপর জানাযাটি একা একা উড়তে থাকে। এ কারামত দেখে অগণিত মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে।
(তা’রীখে মাশায়িখে চিশ্ত, পৃষ্ঠা: ১৬০ শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ৭৪)
৫. খাজা ’উস্মান হারুনী দু’ রাক’আত তাহিয়্যাতুল্ ওযু নামায পড়ে একটি ছোট বাচ্চাকে কোলে নিয়ে অগ্নিকুন্ডে ঢুকে পড়লেন। উভয়ে দু’ ঘন্টা পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেন। আগুন তাদের একটি পশমও জ্বালাতে পারেনি। তা দেখে অনেক অগ্নিপূজক মুসলমান হয়ে যায়।
(তা’রীখে মাশায়িখে চিশ্ত, পৃষ্ঠা: ১২৪ শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ৩৭৫)
৬. জনৈকা মহিলা কাঁদতে কাঁদতে খাজা ফরীদুদ্দীন গাঞ্জে শুক্রের নিকট এসে বললোঃ রাষ্ট্রপতি আমার বেকসুর ছেলেকে ফাঁসি দিয়েছে। এ কথা শুনে তিনি নিজ সাথীদেরকে নিয়ে ওখানে পৌঁছে বললেনঃ হে আল্লাহ্! যদি ছেলেটি বেকসুর হয়ে থাকে তাহলে আপনি তাকে জীবিত করে দিন। এ কথা বলার সাথে সাথেই ছেলেটি জীবিত হয়ে তাঁর সাথেই রওয়ানা করলো। তা দেখে এক হাজার হিন্দু মুসলমান হয়ে যায়।
(আস্রারুল আউলিয়া, পৃষ্টা: ১১০-১১১ শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ৩৭৬)
৭. জনৈক ব্যক্তি আব্দুল কাদির জিলানীর দরবারে একজন ছেলে
সন্তান ছেয়েছিলো। অতএব তিনি তাঁর জন্য দো’আ করেন। ঘটনাক্রমে লোকটির মেয়ে সন্তান জন্ম নেয়। অতএব তিনি লোকটিকে বললেন: তাকে ঘরে নিয়ে যাও এবং কুদরতের খেলা দেখো। যখন লোকটি ঘরে ফিরলো তখন মেয়েটি ছেলে হয়ে গেলো।
(সাফীনাতুল্ আউলিয়া, পৃষ্ঠা: ১৭ শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ২৯৯)
৮. আব্দুল কাদির জিলানী মদীনা যিয়ারত শেষে খালি পায়ে বাগদাদ ফিরছিলেন। পথিমধ্যে তাঁর সাথে জনৈক চোরের সাক্ষাৎ হয়। লোকটি চুরি ছাড়তে চাচ্ছিলো। অতএব লোকটি গাউসে আ’জমকে চিনতে পেরে তাঁর পায়ে পড়ে বলতে শুরু করলো: হে আব্দুল কাদির! আমাকে বাঁচান। তিনি তার এ অবস্থা দেখে তার উপর দয়ার্দ্র হয়ে তার ইস্লাহের জন্য আল্লাহ্ তা’আলার দরবারে দো’আ করলেন। গায়েব থেকে আওয়াজ আসলো, তুমি চোরকে হিদায়াত করতে যাচ্ছো। তা হলে তুমি তাকে ক্বুতুব বানিয়ে দাও। অতএব চোরটি তাঁর এক দৃষ্টিতেই ক্বুতুব হয়ে গেলো।
(সীরাতে গাউসিয়া, পৃষ্ঠা: ৬৪০ শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ১৭৩)
৯. মিয়া ইসমাঈল লাহোরী ফজরের নামাযের পর সালাম ফেরানোর সময় ডান দিকে দয়ার দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে সঙ্গে সঙ্গে ডান দিকের সকল মুসল্লী কোর’আন মাজীদের হাফিজ হয়ে যায় এবং বাম দিকের সকল মুসল্লী কোর’আন শরীফ দেখে দেখে পড়তে পারে।
(হাদীক্বাতুল্ আউলিয়া, পৃষ্ঠা: ১৭৬ শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ৩০৪)
১০. খাজা আলাউদ্দীন সাবের কালীরিকে খাজা ফরীদুদ্দীন গাঞ্জে শুক্র ‘‘কালীর’’ পাঠিয়েছেন। এক দিন খাজা সাহেব ইমামের নামাযের জায়গায় বসে গেলেন। লোকেরা তাতে বাধা প্রদান করলে তিনি বললেন: ক্বুতুবের মর্যাদা কাজীর চাইতেও বেশি। অতঃপর সবাই তাঁকে জোর করে সেখান থেকে উঠিয়ে দিলে তিনি মসজিদে নামায পড়ার জন্য কোন জায়গা পাননি। তখন তিনি মসজিদকে উদ্দেশ্য করে বললেন: সবাই সিজদাহ্ করছে। সুতরাং তুমিও সিজদাহ্ করো। সাথে সাথে মসজিদটি ছাদ ও দেয়াল সহ ভেঙ্গে পড়লো এবং সবাই মরে গেলো।
(হাদীক্বাতুল্ আউলিয়া, পৃষ্ঠা: ৭০ শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ১৯৬)
১১. একদা কা’বা শরীফের প্রতিটি পাথর শায়েখ ইব্রাহীম মাত্বূলীর চতুর্দিকে তাওয়াফ করে পুনরায় নিজ জায়গায় ফিরে আসে।
১২. ইব্রাহীম আল-আ’যাব সম্পর্কে বলা হয়, আগুনকে বেশি ভয় পায় এমন লোককে তিনি বলতেন: আগুনে ঢুকে পড়ো। এ কথা বলেই তিনি আগুনে প্রবেশ করে সেখানে দীর্ঘক্ষণ থাকতেন ; অথচ তাঁর জামা-কাপড় এতটুকুও পুড়তো না এবং তাঁর কোন ক্ষতিও হতো না। এমনিভাবে তিনি নির্ভয়ে সিংহের পিঠে চড়ে এ দিক ও দিক ঘুরে বেড়াতেন।
১৩. ইব্রাহীম আল-মাজ্যূব সম্পর্কে বলা হয়, তিনি কখনো কোন জিনিসের প্রয়োজন অনুভব করলেই তা পূরণ হয়ে যেতো। তাঁর জামাগুলো গলা কাটা থাকতো। গলাটি সঙ্কীর্ণ হলে সকল মানুষই খুব কষ্টে জীবন যাপন করতো। আর গলাটি প্রশস্ত হলে সকল মানুষই খুব আরাম অনুভব করতো।
১৪. ইব্রাহীম ’উস্বাইফীর সম্পর্কে বলা হয়, তিনি সাধারণত শহরের বাইরে গিয়ে নিচু ও গভীর জায়গায় ঘুমুতেন। বাঘের পিঠে চড়ে তিনি শহরে ঢুকতেন। পানির উপর দিয়ে তিনি হাঁটতেন। তাঁর নৌকার কোন প্রয়োজন ছিলো না।
১৫. ইব্রাহীম মাত্বূলী সম্পর্কে আরো বলা হয়, তিনি যখন কোন বাগানে ঢুকতেন তখন সেখানকার সকল গাছ ও উদ্ভিদগুলো নিজেদের সকল গুণাগুণ তাঁকে ডেকে ডেকে বলতো।
১৬. ইব্রাহীম মাত্বূলী সম্পর্কে আরো বলা হয়, তিনি কখনো মিসরে জোহরের নামায পড়তেন না। একদা জনৈক মুফতী সাহেব তাঁকে তিরস্কার করেন। অতঃপর তিনি ফিলিস্তিন সফর করে দেখেন, ইব্রাহীম মাত্বূলী রামাল্লাহ্’র সাদা মসজিদে জেহরের নামায আদায় করছেন। মসজিদের ইমাম সাহেবকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেনঃ এ তো সর্বদা এখানেই নামায পড়ে।
১৭. শায়েখ ইব্রাহীম ’উরয়ান সম্পর্কে বলা হয়, যখন তিনি কোন শহরে ঢুকতেন তখন সেখানকার ছোট-বড়ো সবাইকে তিনি তাদের নাম ধরে ডাকতেন। যেন তিনি এখনকার দীর্ঘ দিনের বাসিন্দা। অতঃপর তিনি মিম্বরে উঠে উলঙ্গ অবস্থায় খুতবা দিতেন।
১৮. শায়েখ আবু ’আলী সম্পর্কে বলা হয়, তিনি ছিলেন বহু রূপী। কখনো তাঁকে সৈন্য রূপে দেখা যেতো। আবার কখনো নেকড়ে বাঘ রূপে। কখনো হাতী রূপে। আবার কখনো ছোট ছেলের রূপে। তিনি মানুষকে মুষ্ঠি ভরে মাটি দিলে তা স্বর্ণ বা রুপা হয়ে যেতো।
১৯. ইউসুফ আজ্মী সম্পর্কে বলা হয়, একদা হঠাৎ তাঁর চোখ একটি কুকুরের উপর পড়ে গেলে সকল কুকুর তার পিছু নেয়। কুকুরটি হাঁটলে সেগুলোও হাঁটে। আর কুকুরটি থেমে গেলে সেগুলোও থেমে যায়। মানুষ এ ব্যাপারটি তাঁকে জানালে তিনি কুকুরটির নিকট খবর পাঠিয়ে বললেন: তুমি ধ্বংস হয়ে যাও। তখন সকল কুকুর কুকুরটিকে কামড়াতে শুরু করলো। অন্য দিন আরেকটি কুকুরের উপর তাঁর হঠাৎ দৃষ্টি পড়লে সকল কুকুর আবার তার পিছু নেয়। তখন মানুষ কুকুরটির নিকট গেলে তাদের সকল প্রয়োজন সমাধা হয়ে যেতো। কুকুরটি একদা রোগাক্রান্ত হলে সকল কুকুর একত্রিত হয়ে কাঁদতে শুরু করলো। তারা কুকুরটির জন্য আপসোস করতে লাগলো। একদা কুকুরটি মরে গেলে সকল কুকুর চিৎকার দিয়ে কাঁদতে লাগলো। আল্লাহ্ তা’আলার ইলহামে কিছু মানুষ কুকুরটিকে দাপন করে দিলো। কুকুরগুলো যতোদিন বেঁচে ছিলো তারা উক্ত কুকুরটির যিয়ারত করতো।
২০. আবুল খায়ের মাগরিবী সম্পর্কে বলা হয়, তিনি একদা মদীনায় গেলেন। তিনি পাঁচ দিন যাবত কিছুই খাননি। নবী (সা.), আবু বকর ও ’উমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) কে সালাম দিয়ে তিনি রাসূল (সা.) কে আবদার করে বললেনঃ হে আল্লাহ্’র রাসূল (সা.)! আমি আজ রাত আপনারই মেহমান। এ কথা বলে তিনি মিম্বরের পেছনে শুয়ে পড়লেন। স্বপ্নে দেখেন স্বয়ং রাসূল (সা.) আবু বকর, ’উমর ও ’আলী কে নিয়ে তাঁর সামনেই উপস্থিত। আলী (রা.) তাঁকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বললেন: উঠো, রাসূল (সা.) এসেছেন। অতঃপর তিনি দাঁড়িয়ে রাসূল (সা.) এর দু’ চোখের মাঝে চুমু খেলেন। রাসূল (সা.) তাঁকে একটি রুটি দিলেন। যার অর্ধেক তিনি স্বপ্নে খেয়েছেন। আর বাকি অর্ধেক ঘুম থেকে উঠে নিজের হাতেই দেখতে পেলেন।
২১. বায়েযীদ বোস্তামী সম্পর্কে বলা হয়, তিনি এক বছর যাবত ঘুমাননি এবং পানিও পান করেননি।
২২. শায়েখ মুহাম্মাদ আহমাদ ফারগালী সম্পর্কে শুনা যায়, একদা একটি কুমির মুখাইমির নাক্বীবের মেয়েকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। তখন সে কাঁদতে কাঁদতে তাঁর নিকট আসলে তিনি বললেন: যেখান থেকে তোমার মেয়েটিকে কুমির ছিনিয়ে নিলো সেখানে গিয়ে উচ্চ স্বরে ডাক দিয়ে বলবে: হে কুমির! ফারগালীর সাথে কথা বলে যাও। তখন কুমিরটি সাগর থেকে উঠে সোজা ফারগালীর বাড়িতে চলে আসলো। আর মানুষ তা দেখে এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছিলো। তখন তিনি কামারকে বললেন: এর দাঁতগুলো উপড়ে ফেলো। তখন সে তাই করলো। অতঃপর তিনি কুমিরকে মেয়েটি উগলে দিতে বললেন। কিছুক্ষণের মধ্যে মেয়েটি জীবিতাবস্থায় কুমিরের পেট থেকে বের হয়ে আসলো। তখন তিনি কুমিরটিকে এ মর্মে অঙ্গিকার করালেন যে, যতোদিন সে বেঁচে থাকবে কাউকে আর এ এলাকা থেকে ছিনিয়ে নিবে না। তখন কুমিরটি কাঁদতে কাঁদতে সাগরের দিকে নেমে গেলো।
২৩. শায়েখ আব্দুর রহীম ক্বান্নাভী সম্পর্কে বলা হয়, একদা তাঁর বৈঠকে আকাশ থেকে একটি মূর্তি নেমে আসলো। কেউ চিনলো না মূর্তিটি কি? ক্বান্নাভী সাহেব কিছুক্ষণ পর্যন্ত তাঁর মাথাটি নিচু করে রাখলেন। অতঃপর মূর্তিটি উঠে গেলো। লোকেরা এ ব্যাপারে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন: একজন ফিরিশ্তা দোষ করে বসলো। তাই সে আমার নিকট সুপারিশ কামনা করলো। আমি সুপারিশ করলে আল্লাহ্ তা’আলা তা কবুল করেন। অতঃপর ফিরিশ্তাটি চলে গেলো।
২৪. সাইয়েদ আহমাদ স্বাইয়াদী সম্পর্কে বলা হয়, তিনি যখনই নদীর পাড়ে যেতেন তখন নদীর মাছগুলো তাঁর পায়ে লুটিয়ে পড়তো। কোন মরুভূমি দিয়ে তিনি চলতে থাকলে সকল পশু তাঁর পায়ে গড়াগড়ি করতো। এমনকি তাঁর স্বাভাবিক চলার পথেও রাস্তার দু’ পার্শ্বে পশুরা তাঁর সম্মানে দাঁড়িয়ে যেতো।
তাঁর সম্পর্কে আরো বলা হয়: তিনি একটি সিজ্দায় পূর্ণ একটি বছর কাটিয়ে দিলো। একটি বারের জন্যও তিনি সিজ্দাহ্ থেকে মাথাটি উঠাননি। যার দরুন তাঁর পিঠে গাস জন্মে গেলো।
২৫. সাইয়েদ বাদাভী সম্পর্কে বলা হয়, তিনি আল্লাহ্ তা’আলার নিকট তিনটি দো’আ করেন। যার মধ্যে দু’টি দো’আ আল্লাহ্ তা’আলা কবুল করেছেন। আরেকটি দো’আ কবুল করেননি। তিনি আল্লাহ্ তা’আলার নিকট এ মর্মে দো’আ করেছেন যে, কেউ যদি তাঁর কবর যিয়ারত করে তা হলে আল্লাহ্ তা’আলা যেন তার ব্যাপারে তাঁর পক্ষ থেকে যে কোন সুপারিশ কবুল করেন। আল্লাহ্ তা’আলা তা কবুল করলেন। তিনি আল্লাহ্ তা’আলার নিকট এ মর্মেও দো’আ করেছেন যে, কেউ যদি তাঁর কবর যিয়ারত করে তা হলে আল্লাহ্ তা’আলা যেন তাকে একটি হজ্জ ও একটি ’উমরাহ্’র পূর্ণ সাওয়াব দেন। আল্লাহ্ তা’আলা তাও কবুল করলেন। তিনি আল্লাহ্ তা’আলার নিকট এ মর্মেও দো’আ করেছেন যে, আল্লাহ্ তা’আলা যেন তাঁকে জাহান্নামে প্রবেশ করান। আল্লাহ্ তা’আলা কিন্তু তা কবুল করলেন না। লোকেরা এ সম্পর্কে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেনঃ আমি যদি জাহান্নামে ঢুকে গড়াগড়ি করি তা হলে জাহান্নাম সবুজ বাগানে পরিণত হবে। আর আল্লাহ্ তা’আলার তো এ অধিকার অবশ্যই রয়েছে যে, তিনি কাফিরদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করে তাদের যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করবেন।
আরো জানার জন্য দেখতে পারেন শা’রানী রচিত আত-ত্বাবাক্বাতুল-কুবরা’।
ছ. জা’হির ও বা’তিন শব্দদ্বয়ের আবিষ্কার:
সূফীদের আক্বীদা-বিশ্বাস কোর’আন ও হাদীসের সরাসরি বিরোধী হওয়ার দরুন মানুষ যেন সেগুলো বিনা প্রশ্নে মেনে নিতে পারে সে জন্য তারা বা’তিন শব্দের আবিষ্কার করে। তারা বলে: কুর’আন ও হাদীসের দু’ ধরনের অর্থ রয়েছে। একটি জা’হিরী। আরেকটি বা’তিনী এবং বা’তিনী অর্থই মূল ও সঠিক অর্থ। তারা এ বলে দৃষ্টান্ত দেয় যে, জা’হিরী অর্থ খোসা বা খোলসের ন্যায় এবং বা’তিনী অর্থ সার, মজ্জা ও মূল শরীরের ন্যায়। জা’হিরী অর্থ আলিমরা জানে। কিন্তু বা’তিনী অর্থ শুধু ওলী-বুযুর্গরাই জানে। অন্য কেউ নয় এবং এ বা’তিনী জ্ঞান শুধুমাত্র কাশ্ফ, মুরাক্বাবাহ্, মুশাহাদাহ্, ইল্হাম অথবা বুযুর্গদের ফয়েয বা সুদৃষ্টির মাধ্যমেই অর্জিত হয়। আর এ গুলোর মাধ্যমেই তারা শরীয়তের মনমতো অপব্যাখ্যা দিয়ে থাকে।
যেমন: তারা কোর’আন মাজীদের নিম্নোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলে:
«وَاعْبُدْ رَبَّكَ حَتَّى يَأْتِيَكَ الْيَقِيْنُ»
‘‘তুমি তোমার প্রভুর ইবাদাত করো এক্বীন বা মা’রিফাত হাসিল হওয়া পর্যন্ত। যখন মা’রিফাত হাসিল হয়ে যাবে তথা আল্লাহ্ তা’আলাকে চিনে যাবে তখন নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত ও তিলাওয়াতের কোন প্রয়োজন হবেনা। অথচ মূল অর্থ এই যে, তুমি তোমার প্রভুর ইবাদাত করো মৃত্যু আসা পর্যন্ত’’। (’হিজ্র : ৯৯)
তেমনিভাবে তারা নিম্নোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলে:
«وَقَضَى رَبُّكَ أَنْ لاَ تَعْبُدُوْا إِلاَّ إِيَّاهُ»
‘‘তোমরা যারই ইবাদাত করোনা কেন তা একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার ইবাদাত হিসেবেই গণ্য করা হবে। ব্যক্তি পূজা, পীর পূজা, কবর পূজা ও মূর্তি পূজা সবই আল্লাহ্ তা’আলার ইবাদাত। প্রকাশ্যে অন্য কারোর ইবাদাত মনে হলেও তা তাঁরই ইবাদাত হিসেবে গণ্য করা হবে। অথচ মূল অর্থ এই যে, আপনার প্রভু এ বলে আদেশ করেছেন যে, তোমরা তিনি (আল্লাহ্) ছাড়া অন্য কারোর ইবাদাত করবে না’’। (বানী ইস্রাঈল : ২৩)
তারা কালিমায়ে তাওহীদের অর্থ করতে গিয়ে বলে থাকে, দুনিয়াতে যা কিছু আছে সবই আল্লাহ্। তিনি ভিন্ন অন্য কিছু কল্পনাই করা যায় না।
সূফীরা কোন হালাল বস্ত্তকে হারাম এবং হারাম বস্ত্তকে হালাল করার জন্য বা’তিন শব্দ ছাড়াও আরো কিছু পরিভাষা আবাষ্কিার করেছে যা নিম্নরূপ:
‘‘অবস্থা’’, ‘‘জযবা’’, ‘‘পাগলামি’’, ‘‘মত্ততা’’, ‘‘চেতনা’’ ও ‘‘অবচেতনা’’।
তারা আরো বলে: ঈমান বলতে আল্লাহ্ তা’আলার খাঁটি প্রেমকে বুঝানো হয়। আর নকল প্রেম ছাড়া খাঁটি প্রেম কখনো অর্জিত হয়না। তাই তারা নকল প্রেমের সকল উপকরণ তথা নাচ, গান, বাদ্য, সুর, তাল, মদ, গাঁজা, রূপ-সৌন্দর্য ও প্রেমের কাহিনী শুনে মত্ত হওয়াকে হালাল মনে করে।
খ্রিস্টপূর্ব পনেরো শত বছর আগে আর্যরা মধ্য এশিয়া থেকে এসে ‘‘সিন্ধু’’ তথা ‘‘হড়প্পা’’ ও ‘‘মহেঞ্জুদাড়ু’’ এলাকায় বসবাস শুরু করে। তখন এ সকল এলাকাকে উপমহাদেশের সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করা হতো। হিন্দুদের প্রথম গ্রন্থ ‘‘ঋগ্বেদ’’ এ আর্যদেরই লেখা। যা ওদের দেব-দেবীদের সম্মানগাথায় পরিপূর্ণ। এখান থেকেই হিন্দু ধর্মের উৎপত্তি।
এ ছাড়াও খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ শত বছর আগে উপমহাদেশে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের প্রচলন ছিলো। অতএব নিশ্চিতভাবে এ কথা বলা যায় যে, আড়াই বা সাড়ে তিন হাজার বছর পূর্ব থেকে এ উপমহাদেশের সভ্যতা, সংস্কৃতি, চাল-চলন ও ধর্মে-কর্মে উক্ত ধর্মমতগুলো অবর্ণনীয় প্রভাব বিস্তার করে চলছে। (আর্য শাস্ত্রের ভূমিকা, পৃষ্ঠা: ৫৯)
উক্ত তিনটি ধর্ম ‘‘ওয়াহ্দাতুল্ উজূদ্’’ ও ‘‘’হুলূলে’’ বিশ্বাস করতো। বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীরা গৌতম বুদ্ধকে আল্লাহ্ তা’আলার অবতার বলে মনে করে তার মূর্তি পূজা করে। জৈন ধর্মের অনুসারীরা মহাবীরের মূর্তি ছাড়াও সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র, গাছ, পাথর, নদী, সাগর, অগ্নি, বায়ু ইত্যাদির পূজা করে। হিন্দু ধর্মের অনুসারীরা নিজ ধর্মের বড় বড় ব্যক্তিদের (পুরুষ-মহিলা) মূর্তি ছাড়াও পূর্বোক্ত বস্ত্তগুলোর পূজা করে। তাদের পূজার বস্ত্তগুলোর মধ্যে বলদ, গাভী, হাতি, সিংহ, সাপ, ইঁদুর, শুকর, বানরের মূর্তিও রয়েছে। এমনকি তারা পুরুষ বা মহিলার লজ্জাস্থান পূজা করতেও দ্বিধা করেনা। তারা শিবজী মহারাজের পুরুষাঙ্গ এবং শক্তিদেবীর স্ত্রী লিঙ্গ পূজা করে তাদের প্রতি ভক্তি-সম্মান প্রদর্শন করে।
ধর্ম তিনটির সংক্ষিপ্ত পরিচয়ের পর আমরা এখন হিন্দু ধর্মের কিছু আচার-অনুষ্ঠানের কথা আলোচনা করতে যাচ্ছি। যাতে আপনারা বুঝতে পারবেন যে, উপমহাদেশে শির্ক ও বিদ্’আত বিস্তারে হিন্দু ধর্মের কতটুকু প্রভাব রয়েছে।
ক. হিন্দু ধর্মের ইবাদাত ও তপস্যা পদ্ধতি:
হিন্দু ধর্মের শিক্ষানুযায়ী তার অনুসারীরা পরকালের মুক্তি ও শান্তির জন্য জঙ্গলে বা গিরি গুহায় বসবাস করতো। তারা নিজ শরীরকে হরেক রকমের কষ্ট দেয়ায় সর্বদা ব্যস্ত থাকতো। গরম, ঠান্ডা, বৃষ্টি ও বালুকাময় জমিনে উলঙ্গ শরীরে থাকাকে তারা পবিত্র তপস্যা বলে বিশ্বাস করতো। নিজকে পাগলের ন্যায় কষ্ট দিয়ে, উত্তপ্ত অগ্নিস্ফুলিঙ্গের উপর উপুড় হয়ে, টাটানো সূর্যতাপে উলঙ্গ শরীরে বসে, কাঁটার উপর শুয়ে, গাছের ডালে ঘন্টার পর ঘন্টা ঝুলে অথবা মাথার উপর উভয় হাত দীর্ঘক্ষণ উঁচিয়ে রেখে অনুভূতিহীন করে বা শুকিয়ে কাঁটা বানিয়ে তপস্যা করতো। এ শারীরিক কষ্ট ছাড়াও তারা নিজ মস্তিষ্ক এবং রূহ্কে কষ্ট দেয়া নাজাতের কাজ বলে মনে করতো। এ কারণেই হিন্দুরা মানব জনপদের বাইরে একা একা ধ্যান করতো। তাদের কেউ কেউ ঝোপ-ঝাড়ে কয়েক জন একত্রে মিলে বসবাস করতো। আবার কেউ কেউ ভিক্ষার উপর নির্ভর করে দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াতো। কেউ কেউ উলঙ্গ থাকতো। আবার কেউ কেউ লেংটি পরতো। পুরো ভারত ঘুরলে এখনো আপনি জঙ্গল, নদী ও পাহাড়ে অনেক জটাধারী, উলঙ্গ ও ময়লাযুক্ত সাধুর সাক্ষাৎ পাবেন। সাধারণ হিন্দু সমাজে এদেরকে আবার পূজাও করা হয়। (আর্য শাস্ত্রের ভূমিকা, পৃষ্ঠা: ৯৯)
রূহানী শক্তি ও সংযম অর্জনের জন্য ‘‘যোগ সাধন’’ নামক তপস্যার এক অভিনব পদ্ধতিও হিন্দু সমাজে আবিষ্কৃত হয়েছিলো। যে পদ্ধতি হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের সকলেই সমভাবে পালন করতো। এ পদ্ধতি অনুযায়ী যোগী ব্যক্তি এতো বেশি সময় পর্যন্ত নিঃশ্বাস বন্ধ করে রাখতো যে তা দেখে মনে হতো, সে মরে গেছে। এমনকি তখন হৃদকম্পনও বুঝা যেতোনা। গরম-ঠান্ডা তাদের উপর সামান্যটুকুও প্রভাব বিস্তার করতে পারতোনা। যোগী ব্যক্তি উক্ত সাধনার কারণে অনেক দিন পর্যন্ত না খেয়ে থাকতে পারতো। (আর্য শাস্ত্রের ভূমিকা, পৃষ্ঠা: ১২৯)
যোগ সাধনের এক ভয়ানক চিত্র এই যে, সাধু ও যোগীরা ফুলকি ঝরা জ্বলন্ত কয়লার উপর হেঁটে যেতো। অথচ তাদের পা একটুও জ্বলতোনা। এ ছাড়া ধারালো ফলক বিশিষ্ট খঞ্জর দিয়ে এক গন্ড থেকে আরেক গন্ড পর্যন্ত, নাকের উভয় অংশ এবং উভয় ঠোঁট এপার ওপার চিঁড়ে দেয়া, ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকা, তরতাজা কাঁটা এবং ফলক বিশিষ্ট কয়লার উপর শুয়ে থাকা, দিন-রাত উভয় পা অথবা এক পায়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকা, এক পা অথবা এক হাতকে দীর্ঘ দিন পর্যন্ত অকেজো রাখা যাতে তা শুকিয়ে যায়, লাগাতার উল্টোভাবে ঝুলে থাকা, পুরো জীবন অথবা বর্ষাকালে উলঙ্গ থাকা, পুরো জীবন বিবাহ না করে সন্ন্যাসী সেজে থাকা, নিজ পরিবারবর্গ ছেড়ে একা উঁচু গিরি গুহায় ধ্যানে মগ্ন থাকাও যোগীদের ইবাদাতের অন্তর্ভুক্ত। (আর্য শাস্ত্রের ভূমিকা, পৃষ্ঠা: ১৩০)
হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মে যাদু-মন্ত্রের মাধ্যমেও ইবাদাত করা হয়। এ জাতীয় ইবাদাতে লিপ্ত ব্যক্তিদেরকে তান্ত্রিক বলা হয়। এরা জ্ঞান-ধ্যানকে পরকালের নিষ্কৃতির বিশেষ কারণ বলে মনে করে। পুরাণ বেদীয় আলোচনায় পাওয়া যায় যে, সাধুরা যাদু ও নিম্ন কর্মে লিপ্ত থাকতো। এ দলের লোকেরা কড়া নেশাকর মদ্য পান করা, গোস্ত এবং মাছ খাওয়া, অস্বাভাবিক যৌন কর্ম করা, নাপাক বস্ত্ত সামগ্রীকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের নামে মানব হত্যা করার মতো নিকৃষ্ট কাজও ইবাদাত হিসেবে পালন করতো। (আর্য শাস্ত্রের ভূমিকা, পৃষ্ঠা: ১১৭)
খ. হিন্দু বুযুর্গদের অলৌকিক ক্ষমতা:
মুসলমানদের মধ্যে যেমন গাউস, ক্বুতুব, নাজীব, আব্দাল, ওলী, ফকির, দরবেশকে বড় বড় বুযুর্গ ও অলৌকিক ক্ষমতার উৎস বলে মনে করা হয় তেমনিভাবে হিন্দুদের মধ্যে মুনি, ঋষি, মহাত্মা, অবতার, সাধু, সন্ত, যোগী, সন্ন্যাসী, শাস্ত্রীকেও বড় বড় বুযুর্গ এবং অলৌকিক ক্ষমতার উৎস বলে মনে করা হয়। হিন্দুদের পবিত্র কিতাবাদির ভাষ্যানুযায়ী এ সকল বুযুর্গরা গত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বলতে পারে। জান্নাতে দৌড়ে যেতে পারে। দেবতাদের দরবারে তাদের বিশেষ সম্মান রয়েছে। তারা এমন যাদুশক্তি রাখে যে, মনে চাইলে দুনিয়ার পাহাড়গুলোকে এক নিমিষে উঠিয়ে নিয়ে নদীতে ফেলে দিতে পারে। নিজ শত্রুকে চোখের পলকে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দিতে পারে। ঋতুগুলোকে এলোমেলো করে দিতে পারে। এরা খুশি হলে পুরো শহরকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে পারে। ধন-দৌলত বাড়িয়ে দিতে পারে। দুর্ভিক্ষ থেকে বাঁচাতে পারে। শত্রুর আক্রমণ নস্যাৎ করে দিতে পারে। (আর্য শাস্ত্রের ভূমিকা, পৃষ্ঠা: ৯৯-১০০)
তাদের ধারণা মতে মুনি এমন পবিত্র ব্যক্তি যে কোন কাপড় পরেনা। বায়ুকে পোশাক মনে করে। চুপ থাকাই তার খাদ্য। সে বাতাসে উড়তে পারে। এমনকি পাখিদেরও অনেক উপরে যেতে পারে। মানুষের সকল লুক্কায়িত কথা বলতে পারে। কারণ, তারা এমন পানীয় পান করে যা সাধারণ মানুষের জন্য বিষ সমতুল্য। (আর্য শাস্ত্রের ভূমিকা, পৃষ্ঠা: ৯৮)
শিবজীর ছেলে লর্ড গনেশ সম্পর্কে ধারণা করা হয়, সে ইচ্ছে করলে যে কোন সমস্যা দূরীভূত করতে পারে। ইচ্ছে করলে কারোর জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। উক্ত কারণেই হিন্দুদের যে কোন ছেলে পড়ার বয়সের হলে তাকে সর্বপ্রথম গনেশের পূজাই শিক্ষা দেয়া হয়। (রোজনামায়ে সিয়াসাত: কালাম, ফিক্র ও নযর ; তারিখঃ ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৯১ হায়দারাবাদ, ভারত)
গ. হিন্দু বুযুর্গদের কিছু কারামাত:
হিন্দুদের পবিত্র কিতাবসমূহে তাদের বুযুর্গদের অনেক অনেক কারামাতের সংবাদ পাওয়া যায়। আমরা দৃষ্টান্ত স্বরূপ কয়েকটি কারামাত সবার সম্মুখে তুলে ধরছি।
১. হিন্দুদের ধর্মীয় পুস্তক রামায়ণে রাম ও রাবণের লম্বা ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। রাম নিজ স্ত্রী সীতাকে নিয়ে জঙ্গলে বসবাস করতো। লঙ্কার রাজা রাবণ তার স্ত্রীকে ফুসলিয়ে নিয়ে গেলো। রাম হনুমানের সহযোগিতায় কঠিন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর নিজ স্ত্রীকে ফেরত পায়। কিন্তু রাম এরপর তার স্ত্রীকে তাদের পবিত্র বিধি-বিধানানুযায়ী পরিত্যাগ করে। সীতা তা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার জন্য আগুনে ঝাঁপ দেয়। কিন্তু অগ্নি দেবতা আগুনকে নিবে যাওয়ার আদেশ করলেন। সুতরাং সীতা জ্বলন্ত আগুন থেকে সুস্থ বের হয়ে আসলো।
২. একদা বৌদ্ধ ধর্মের ভক্শু দরবেশ একটি অলৌকিক কান্ড দেখালেন। তিনি একটি পাথর থেকে একই রাতে হাজার শাখা বিশিষ্ট একটি আম গাছ তৈরী করেন। (আর্য শাস্ত্রের ভূমিকা, পৃষ্ঠা: ১১৬-১১৭)
৩. কামদেব, কামদেবী ও তাদের বিশেষ বন্ধু বসন্তের খোদা যখন পরস্পর খেলাধুলা করতো তখন কামদেব নিজের ফুলের তীর দিয়ে শিবদেবের উপর বৃষ্টি বর্ষণ করতো এবং শিবদেব নিজের তৃতীয় চক্ষু দিয়ে সে তীরগুলোর উপর দৃষ্টি দিতেই তা নির্বাপিত মাটির ন্যায় ভস্ম হয়ে যেতো। এভাবে শিবদেব সব ধরনের ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতো। কারণ, তার কোন শরীর ছিলো না। (আর্য শাস্ত্রের ভূমিকা, পৃষ্ঠা: ৯০)
৪. হিন্দুদেব লর্ড গনেশের পিতা শিবজী সম্পর্কে বলা হয়, লর্ড শিব পার্বতী দেবীকে গোসলের সময় গোসলখানায় ঢুকে কষ্ট দিতো। তাই পার্বতী দেবী (শিবের স্ত্রী) এ ঝামেলা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য একদা এক মানব মূর্তি তৈরী করে তার মধ্যে জীবন দিয়ে গোসলখানার গেইটে প্রহরী হিসেবে বসিয়ে দিলো। অতঃপর অন্য দিনের মতো শিবজী পার্বতীকে কষ্ট দেয়ার জন্য গোসলখানার দিকে রওয়ানা করলো। শিবজী গোসলখানায় ঢুকতে চাইলে প্রহরী মানব মূর্তি সুন্দর ছেলেটি তার পথ রুদ্ধ করে দেয়। শিবজী ক্রদ্ধ হয়ে ত্রিশূল দিয়ে ছেলেটির মাথা কেটে দেয়। পার্বতী দেবী এতে অসন্তুষ্ট হলে শিবজী তার কর্মচারীদেরকে অতি তাড়াতাড়ি যে কারোর একটি মাথা কেটে নিয়ে আসার জন্য আদেশ করলো। কর্মচারীরা তড়িঘড়ি একটি হাতীর মাথা কেটে নিয়ে আসলে শিবজী ছেলেটির ধড়ের সাথে হাতীর মাথা লাগিয়ে তাতে জীবন দিয়ে দিলো। পার্বতী দেবী তাতে খুব খুশি হলো। (রোজনামায়ে সিয়াসাত: কালাম, ফিকর ও নযর ; তারিখঃ ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৯১ হায়দারাবাদ, ভারত)
হিন্দু ধর্মের কিছু শিক্ষাদীক্ষা শুনার পর আপনারা এ কথা ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছেন যে, সূফীদের আক্বীদা-বিশ্বাস, শিক্ষাদীক্ষা হিন্দু ধর্ম কর্তৃক কতটুকু প্রভাবিত হয়েছে। ‘‘ওয়াহ্দাতুল্ উজূদ্’’ ও ‘‘’হুলূল’’ এর বিশ্বাস একই। ইবাদাত ও তপস্যা পদ্ধতি একই। বুযুর্গদের অলৌকিক ক্ষমতা একই। কারামাতও একই। ব্যবধান শুধু নামেরই। অন্য কিছুর নয়।
উক্ত আলোচনার পর যখন আমরা শুনবো যে, ভারতের অমুক পীর বা ফকিরের মুরীদ হিন্দুও ছিলো এবং অমুক মুসলমান হিন্দু সাধু ও যোগীর জ্ঞান-ধ্যানে অংশ গ্রহণ করেছে তখন আমাদের আশ্চর্যের কিছুই থাকবে না।
বলা হয়, হাফিয গোলাম কাদির নিজ যুগের একজন গাউস ও ক্বুতুব ছিলেন। তাঁর রূহানী ফয়েয প্রত্যেক বিশেষ অবিশেষের জন্য এখনো চালু রয়েছে। এ কারণেই হিন্দু, শিখ, খ্রিস্টান তথা প্রত্যেক দল ও ধর্মের লোক তাঁর কাছ থেকে ফয়েয হাসিল করতো।
(রিয়াযুস্ সা’লিকীন, পৃষ্ঠা: ২৭২ শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ৪৭৭)
পীর স্বাদ্রুদ্দীন ইস্মাঈলী ভারতে এসে নিজের নাম শাহ্দেব রাখলেন এবং জনগণকে বললেনঃ বিষ্ণুর দশম অবতার ’আলী (রা.) এর ছবিতে প্রকাশ পেয়েছে। তার অনুসারী সূফীরা মুহাম্মাদ্ (সা.) এবং ’আলী (রা.) এর প্রশংসায় ভজন গাইতো। (ইসলামী সূফীবাদে ইসলাম বিরোধী সূফীবাদের সংমিশ্রণ, পৃষ্ঠা: ৩২-৩৩)
পাক-ভারতে শির্ক ও বিদ’আত প্রচলনের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে অনেকেই এ কথা বলে থাকেন যে, ভারতবর্ষে ইসলাম পৌঁছে প্রথম হিজরী শতাব্দীর শেষ ভাগে। যখন মুহাম্মদ বিন্ ক্বাসিম (রাহিমাহুল্লাহ্) ৯৩ হিজরী সনে সিন্ধু বিজয় করেন। সে সময় তিনি ও তাঁর সৈন্যরা ভারত থেকে তড়িঘড়ি চলে গিয়েছিলেন বলে কোর’আন ও হাদীস নির্ভরশীল খাঁটি ইসলাম প্রচার ও প্রসার লাভ করতে পারেনি। দ্বিতীয়তঃ ইসলামের এ দা’ওয়াত খুব সীমিত পরিসরে ছিলো বলে মুসলমানদের মধ্যে অধিকাংশই হিন্দু ও মুশ্রিকদের রীতি-নীতি চালু রয়েছে।
ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণানুযায়ী এ কথা সঠিক নয়। বরং ’উমর ফারূক্ব (রা.) এর যুগেই সর্বপ্রথম ভারতবর্ষে ইসলাম প্রবেশ করে। ’উমর ফারূক্ব ও ’উসমান (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) এর যুগে ইসলামী খিলাফতের অধীনে যে যে এলাকাগুলো ছিলো তম্মধ্যে শাম (বৃহত্তর সিরিয়া), মিশর, ইরাক, ইয়েমেন, তুর্কিস্তান, সমরকন্দ, বুখারা, তুরস্ক, আফ্রিকা এবং হিন্দুস্তানের মালাবার, মালদ্বীপ, চরণদ্বীপ, গুজরাত ও সিন্ধু এলাকা বিশেষভাবে উল্লেখ্য। সে যুগে ভারতে আসা সাহাবাদের সংখ্যা ২৫, তাবিয়ীর সংখ্যা ৩৭ এবং তাব্য়ে তাবিয়ীনের সংখ্যা ১৫ জন ছিলো। (ভারতবর্ষে ইসলাম প্রচার, গাজী আজীজ)
অতএব বলতে হবে, প্রথম হিজরী শতাব্দীর শুরুতেই ভারতবর্ষে খাঁটি ইসলাম পৌঁছে গেছে।
তবে ঐতিহাসিক একটি নিশ্চিত সত্য এই যে, যখনই কোন ঈমানদার ব্যক্তি ক্ষমতায় আরোহণ করে তখনই ইসলামের প্রচার-প্রসার ও মর্যাদা-সম্মান বৃদ্ধি পায়। উক্ত কারণেই হযরত মুহাম্মদ বিন্ ক্বাসিমের পর সুলতান সবক্তগীন, সুলতান মাহমূদ গজনভী, সুলতান শিহাবুদ্দীন মুহাম্মদ গুরীর যুগে (৯৮৬-১১৭৫ খ্রিঃ) ভারত উপমহাদেশে ইসলাম একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছিলো। ঠিক এর বিপরীতেই যখন কোন মুল্’হিদ্ ও বেদ্বীন ব্যক্তি ক্ষমতায় আরোহণ করে তখন ইসলাম তারই কারণে লাঞ্ছিত ও পশ্চাৎপদ হতে বাধ্য। ভারত উপমহাদেশে এর উৎকৃষ্ট প্রমাণ হচ্ছে আকবরী যুগ। সে যুগে সরকারীভাবে মুসলমানদের জন্য কালিমা ঠিক করে দেয়া হলো:
لاَ إِلٰهَ إِلاَّ اللهُ أَكْبَرُ خَلِيْفَةُ اللهِ
‘‘আল্লাহ্ ছাড়া কোন মা’বূদ নেই। আকবর বাদশাহ্ আল্লাহ্’র খলীফা’’।
সে যুগে আকবরের দরবারে তার সম্মুখে সিজদাহ্ করা হতো, নবুওয়াত, ওহী, হাশর-নশর, জান্নাত-জাহান্নাম নিয়ে ঠাট্টা করা হতো। নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত ও অন্যান্য বিষয়ের উপর প্রকাশ্যভাবে প্রশ্ন উত্থাপন করা হতো। সে যুগে সুদ, জুয়া, মদ ইত্যাদি হালাল করে দেয়া হয়েছিলো। শুকরকে পবিত্র পশু বলে আখ্যায়িত করা হয়েছিলো। হিন্দুদের সন্তুষ্টির জন্য গরুর গোস্তকে হারাম করে দেয়া হয়েছিলো। দেয়ালী, রাখি, দশাবতার, পূর্ণিমা, শিবরাত্রির মতো হিন্দু আচার-অনুষ্ঠানগুলো সরকারীভাবে পালন করা হতো। (ঈমান নবায়ন, পৃষ্ঠা: ৮০)
বর্তমান যুগের প্রশাসকরাও ইসলামের খিদমতের নামে শির্ক ও বিদ্’আত বিস্তারে বিপুল সহযোগিতা করে যাচ্ছে। পীর ফকিরদের প্রতি অঢেল ভক্তি-শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হচ্ছে। তাদের মাযারগুলো রক্ষণাবেক্ষণের ইসলাম বিধ্বংসী মুবারক দায়িত্ব পালন করা হচ্ছে। শুধু এতেই ক্ষান্ত নয়। বরং দু’ একটি রাজনৈতিক দল ছাড়া প্রত্যেক ছোট-বড় রাজনৈতিক দলেরই এক একজন নির্দিষ্ট পীর সাহেব রয়েছেন। যাঁরা তাদেরকে নিয়মিত বা অনিয়মিতভাবে শির্ক ও বিদ্’আতের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন। প্রত্যেক জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে প্রতিটি দলই নিজ নিজ পীর সাহেবের দরবারে গিয়ে তাঁদের দো’আ ও বরকত হাসিল করে থাকে। আর যাঁদের নিজস্ব কোন পীর সাহেব নেই তারাও পীর ধরাকে ভালো চোখেই দেখে থাকেন। অথচ পীর ও ফকিররা বিশ্বের বুকে ইসলামের নামে এতো কঠিন কঠিন শির্ক ও বিদ্’আত চালু করেছে যা অন্য কোন মানুষ কর্তৃক সম্ভব হয়নি।
আমাদের দেশের সাধারণ ওয়ায মাহ্ফিলগুলোও শির্ক এবং বিদ্’আত বিস্তারে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। কারণ, কোর’আন ও হাদীস নির্ভরশীল ওয়াযের সংখ্যা খুবই কম। গণা কয়েকজন ছাড়া যে কোন ওয়ায়িয কোর’আন ও হাদীস সম্পর্কে আলোচনা না করে বরং বুযুর্গদের নামে বানানো কাহিনী বলতে খুবই পছন্দ করেন। যে গুলোর অধিকাংশই শির্ক ও বিদ্’আত নির্ভরশীল। পীর সাহেবদের ওয়ায মাহফিলের তো কোন কথাই নেই। তা তো শির্ক ও বিদ্’আতের বিশেষ আড্ডাই বলা চলে। তাতে শির্ক ও বিদ্’আতের সরাসরি প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। তাই এক বাক্যে বলা চলে, বর্তমান যুগে কোর’আন ও হাদীস নির্ভরশীল ওয়াযের খুবই অকাল।
বর্তমান যুগের তাবলীগ জামাতও শির্ক এবং বিদ্’আত বিস্তারে কম ভূমিকা রাখছেনা। বরং তা ওয়ায মাহফিল চাইতেও আরো ভয়ঙ্কর। কারণ, ওয়ায মাহফিল তো সাধারণত আলিমরাই করে থাকেন। যদিও তাদের কেউ নামধারী আলিম হোকনা কেন। কোন গন্ড মূর্খ ওয়ায মাহফিল করতে সাহস পায়না। তবে ইলিয়াস (রাহিমাহুল্লাহ্) এর আবিষ্কৃত তাবলীগ জামাত মূর্খদের নসীব ভালোভাবেই খুলে দিয়েছে। কারণ, যে কোন গন্ড মূর্খ যে কোন কথা ‘‘মুরুববীরা বলেছেন’’ বলে ইসলামের নামে চালিয়ে দিতে পারে। কেউ তাতে কোন বাধা দিচ্ছেনা। মূর্খদেরকে দাওয়াতী কাম শিক্ষা দেয়ার নামে ধর্মীয় ব্যাপারে কথা বানানোর খুব শক্ত তা’লীম দেয়া হচ্ছে। অথচ রাসূল (সা.) নিজ উম্মতকে সুস্পষ্টভাবেই সতর্ক করে বলেন:
مَنْ كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّدًا فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ
‘‘যে ব্যক্তি ইচ্ছে করে আমার উপর মিথ্যে বলেছে (আমার নামে এমন কথা বলেছে যা আমি বলিনি) সে যেন জাহান্নামে নিজের ঠিকানা বানিয়ে নেয় (সে জাহান্নামী)’’। (বুখারী, হাদীস ১০৭, ১১০, ১২৯১, ৩৪৬১, ৬১৯৭)
এ ছাড়া তারা ‘‘তাবলীগী নেসাব’’ বা ‘‘ফাযায়িলে আ’মাল’’ নামে যে কিতাবগুলো নিয়মিতভাবে মানুষকে পড়ে পড়ে শুনাচ্ছে সেগুলোকে শির্ক, বিদ্’আত ও কেচ্ছা-কাহিনীর কিতাব বললেই চলে। এ কিতাবগুলো তাবলীগী ভাইদেরকে কেচ্ছা নির্ভরশীল একটি জামাতে পরিণত করেছে। এ ছাড়া আর অন্য কিছু নয়। যা শির্ক ও বিদ্’আতে ভরপুর। এ কিতাবগুলোর বেশির ভাগ জায়গাটুকুই দখল করে আছে দুর্বল ও জাল হাদীস এমনকি অহেতুক ও যুক্তিহীন কেচ্ছা-কাহিনী। হয়তোবা তাবলীগের মুরুববীগণ একদা অতি সরলতার দরুন কিংবা মূর্খদেরকে নেক আমল ও কল্যাণের কাজে অতি দ্রুত উৎসাহিত করার নেশায় পড়ে ফাযায়েল সাপ্লাই দিতে গিয়ে সত্যতা ও বিশুদ্ধতার তোয়াক্কা করেননি। তবে যেখানে এ আমলগুলোর অধিকাংশই বিশুদ্ধ হাদীস কর্তৃক প্রমাণিত সেখানে এ দীর্ঘকাল পর্যন্ত তাদের এ জাতীয় অশুদ্ধ হাদীস ও অযুক্তিক কেচ্ছা-কাহিনীর উপর নির্ভরশীল হওয়া এমনকি কখনো কখনো দা’ওয়াতের ফযীলত বুঝাতে গিয়ে তাদের বিশিষ্টজনদের মুখ থেকে বিশুদ্ধ কুর’আন ও হাদীসের অপব্যাখ্যা দেয়া সত্যিই তাদের মূর্খতা ও অন্ধত্বের বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। বস্ত্ততঃ তাদের দা’ওয়াত কর্তৃক বিপুল সংখ্যক অমোসলমানের মোসলমান হওয়া কিংবা আল্লাহ্ তা’আলার অবাধ্যতার পথ ছেড়ে বাধ্যতার পথে ফিরে আসা সত্যিই অনস্বীকার্য। তবে দ্বীনের উপর উঠার পর দ্বীনের নামে বদ্দ্বীনির উপর অটলতা ও অন্ধত্ব কোন বিজ্ঞজনের নিকট কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারেনা। আশা করি বুদ্ধিমান ও ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত পরিপক্ক আলিম মুরুববীগণ এ ব্যাপারটি অতি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করবেন।
সকল ইবাদাত তা যাই হোক না কেন তা একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার জন্যই। অন্য কারোর জন্য নয়। সে যে কেউই হোক না কেন। এ স্বীকৃতিটুকুই আমরা আল্লাহ্ তা’আলার নিকট প্রতি দিন প্রতি নামাযের প্রতি রাক্’আতে এবং প্রতি বৈঠকেই দিয়ে থাকি। এ তাওহীদী চেতনাটুকু যেন সর্বদা সকলের অন্তরে জাগরূক থাকে যাতে করে তা সকলের বাস্তব জীবনে প্রতিষ্ঠিত করা সহজ হয়ে যায় সে জন্যই আল্লাহ্ তা’আলা প্রতি দিনই বহুবার করে প্রতি বান্দাহ্’র মুখ থেকে বাধ্যতামূলকভাবে এ গুরুত্বপূর্ণ স্বীকারোক্তিটুকু আদায় করে ছাড়ছেন। হায়! আমরা যদি তা বুঝতে পারতাম।
সূরা ফা’তিহার মধ্যে আল্লাহ্ তা’আলা যে বাক্যটি প্রতি দিন আমাদের মুখ থেকে স্বীকার করিয়ে নিচ্ছেন তা হচ্ছে:
«إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِيْنُ»
‘‘আমরা আপনারই ইবাদাত করি এবং আপনারই নিকট সাহায্য প্রার্থনা করি’’। (ফাতি’হা : ৫)
আব্দুল্লাহ্ বিন্ মাসঊদ্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: আমরা রাসূল (সা.) এর পেছনে নামায পড়ার সময় বলতাম: আল্লাহ্ তা’আলার উপর শান্তি বর্ষিত হোক। অমুকের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। তখন একদা রাসূল (সা.) আমাদেরকে বললেন: আল্লাহ্ তা’আলা নিজেই শান্তি ও নিরাপত্তাদাতা। তাঁর জন্য শান্তি কামনা করার কোন মানে হয় না। তাই তোমরা যখন নামাযে বসবে তখন বলবে:
التَّحِيَّاتُ لِلهِ وَالصَّلَوَاتُ وَالطَّيِّبَاتُ ...
‘‘সকল মৌখিক, শারীরিক ও আর্থিক ইবাদাত একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলারই জন্য। অন্য কারোর জন্য নয়’’। (মুসলিম, হাদীস ৪০২)
সুতরাং যে কোন ইবাদাত তা যত সামান্যই হোকনা কেন তা একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া অন্য কারোর জন্য ব্যয় করা যাবে না এবং তা অন্য কারোর জন্য ব্যয় করার নামই শির্ক।
শির্ক একটি মহা পাপ, বড় যুলুম ও মারাত্মক অপরাধ। যাকে রাসূল (সা.) নিজ ভাষায় সর্বনাশা ব্যাধি বলে আখ্যায়িত করেছেন।
আবু হুরাইরাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
اِجْتَنِبُوْا السَّبْعَ الْـمُوْبِقَاتِ، قَالُوْا: يَا رَسُوْلَ اللهِ! وَمَا هُنَّ؟ قَالَ: الشِّرْكُ بِاللهِ، وَالسِّحْرُ، وَقَتْلُ النَّفْسِ الَّتِيْ حَرَّمَ اللهُ إِلاَّ بِالْـحَقِّ، وَأَكْلُ الرِّبَا، وَأَكْلُ مَالِ الْيَتِيْمِ، وَالتَّوَلِّيْ يَوْمَ الزَّحْفِ، وَقَذْفُ الْـمُحْصَنَاتِ الْـمُؤْمِنَاتِ الْغَافِلاَتِ
‘‘তোমরা বিধ্বংসী সাতটি গুনাহ্ থেকে বিরত থাকো। সাহাবাগণ বললেন: হে আল্লাহ্’র রাসূল! ওগুলো কি? রাসূল (সা.) বললেন: সেগুলো হচ্ছে, আল্লাহ্ তা’আলার সাথে কাউকে শরীক বা অংশীদার করা, যাদু আদান-প্রদান, অবৈধভাবে কাউকে হত্যা করা, সুদ খাওয়া, ইয়াতীম-অনাথের সম্পদ ভক্ষণ, সম্মুখযুদ্ধ থেকে পলায়ন ও সতী-সাধ্বী মু’মিন মহিলাদের ব্যাপারে কুৎসা রটানো’’। (বুখারী, হাদীস ২৭৬৬, ৬৮৫৭ মুসলিম, হাদীস ৮৯)
আল্লাহ্ তা’আলার সাথে কাউকে শরীক করা (তা প্রতিপালন, উপাসনা, আল্লাহ্ তা’আলার নাম ও গুণাবলীর যে কোনটিরই ক্ষেত্রে হোক না কেন) নিঃসন্দেহে তা সকল গুনাহ্’র শীর্ষে অবস্থিত।
আবু বাক্রাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী (সা.) ইরশাদ করেন:
أَلاَ أُنَبِّئُكُمْ بِأَكْبَرِ الْكَبَائِرِ؟ ثَلاَثًا، قَالُوْا: بَلَى يَا رَسُوْلَ اللهِ! قَالَ: الإِشْرَاكُ بِاللهِ ...
‘‘আমি কি তোমাদেরকে সর্ববৃহৎ গুনাহ্’র কথা বলবো না? রাসূল (সা.) এ কথাটি সাহাবাদেরকে তিন বার জিজ্ঞাসা করেছেন। সাহাবাগণ বললেন: হাঁ, বলুন হে আল্লাহ্’র রাসূল! রাসূল (সা.) বললেন: তা হচ্ছে, আল্লাহ্ তা’আলার সাথে কাউকে শরীক করা’’।
(বুখারী, হাদীস ২৬৫৪, ৫৯৭৬ মুসলিম, হাদীস ৮৭)
শির্ক বলতেই তা সকল ধরনের আমলকে একেবারেই বিনষ্ট করে দেয়।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
«وَلَوْ أَشْرَكُوْا لَـحَبِطَ عَنْهُمْ مَّا كَانُوْا يَعْمَلُوْنَ»
‘‘তারা (নবীগণ) যদি আল্লাহ্ তা’আলার সাথে কাউকে শরীক করতো তাহলে তাদের সকল আমল পন্ড হয়ে যেতো’’। (আন’আম: ৮৮)
আল্লাহ্ তা’আলা আরো বলেন:
«وَلَقَدْ أُوْحِيَ إِلَيْكَ وَإِلَى الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِكَ، لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُوْنَنَّ مِنَ الْـخَاسِرِيْنَ»
‘‘নিশ্চয়ই তুমি ও তোমার পূর্ববর্তীদের প্রতি এ ওহী পাঠানো হয়েছে যে, তুমি যদি শির্ক করো তা হলে নিশ্চয়ই তোমার সকল আমল নিষ্ফল হয়ে যাবে এবং নিশ্চয়ই তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’’। (যুমার : ৬৫)
শির্কের প্রকারভেদ:
শির্ক দু’ প্রকার: বড় শির্ক ও ছোট শির্ক। প্রকারদ্বয়ের বিস্তারিত বিবরণ নিম্নে দেয়া হলো:
নিম্নে প্রথম পরিচেছদে বড় শির্কের আলোচনা এবং দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে ছোট শির্কের বিস্তারিত আলোচনা তুলে ধরা হলো।