পরিচ্ছেদঃ ৯. প্রথম অনুচ্ছেদ - সন্ধি স্থাপন
الصلح দ্বারা উদ্দেশ্য المصالحة অর্থাৎ পরস্পর দু’ দলের মধ্যে সন্ধি স্থাপন। ইবনুল হুমাম বলেনঃ ইমাম যদি মনে করেন যে, শত্রুপক্ষের মালের বিনিময়ে অথবা মাল ব্যতিরেকেই সন্ধি করার মধ্যে কল্যাণ নিহিত আছে তাহলে তিনি সন্ধি করতে পারেন। কেননা আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ ’’তারা যদি শান্তির (সন্ধির) দিকে ঝুঁকে পড়ে তাহলে তুমি সেদিকে ঝুঁকে পড়ো।’’ (সূরা আল আনফাল ৮ : ৬১)
যদিও আয়াতে কল্যাণের কথা উল্লেখ নেই তথাপি ফাকীহগণ একমত যে, মুসলিমদের কল্যাণ আছে বলে ইমামের নিকট সাব্যস্ত হলে তবেই শুধুমাত্র সন্ধি করা বৈধ। আর যদি সন্ধির মধ্যে কোনো কল্যাণ পরিলক্ষিত না হয় তাহলে সন্ধি করা বৈধ নয়।
৪০৪২-[১] মিস্ওয়ার ইবনু মাখরামাহ্ ও মারওয়ান ইবনুল হাকাম (রাঃ) হতে বর্ণিত। তাঁরা উভয়ে বলেনঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুদায়বিয়াহ্-এর বৎসর এক হাজারেরও অধিক সাহাবীসহ মদীনাহ্ হতে (মক্কাভিমুখে) রওয়ানা হলেন এবং যুল হুলায়ফাহ্ নামক স্থানে এসে কুরবানীর পশুর গলায় চামড়ার মালা পরালেন এবং পশুর গলার পাশে ধারালো অস্ত্র দ্বারা হালকা জখম করে উক্ত স্থানে রক্ত মেখে দিলেন আর সেখান হতে ’উমরার ইহরাম বেঁধে অগ্রসর হলেন। পথিমধ্যে তাঁর উষ্ট্রী এক উপত্যকায় বসে পড়ল, যেখান দিয়ে মক্কায় যাতায়াত করে। তখন লোকেরা হাল-হাল বলে উষ্ট্রীকে উঠাতে চেষ্টা করল, কিন্তু উষ্ট্রীকে উঠাতে ব্যর্থ হলো। তারা বলতে লাগল, ’কস্ওয়া’ (উষ্ট্রীর নাম) জিদ করেছে, ’কস্ওয়া’ জিদ করেছে। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ ’কস্ওয়া’ জিদ করেনি এবং এটা তার স্বভাবজাতও নয়; বরং যিনি হাতিকে আটকিয়েছিলেন, তিনি একেও আটকিয়েছেন। অতঃপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ সে সত্তার কসম, যার হাতে আমার জীবন! আল্লাহর পবিত্র স্থানের মর্যাদা রক্ষার্থে তারা (কুরায়শরা) আমার নিকট সম্মানপ্রদর্শনের লক্ষ্যÿ্য যে কোনো শর্তারোপ করতে চাইবে, আমি তা গ্রহণ করে নিব।
অতঃপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) উষ্ট্রীকে ধমকের স্বরে উঠতে বললে তা সঙ্গে সঙ্গেই উঠে দাঁড়াল (দ্রুত চলতে লাগল)। এবার তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মক্কার সরাসরি পথ হতে সরে ভিন্নপথে সম্মুখপানে অগ্রসর হতে লাগলেন। অবশেষে হুদায়বিয়ার প্রান্তে স্বল্প পানির কূপের নিকট এসে অবতরণ করলেন। লোকেরা তা হতে অল্প অল্প করে পানি তুলে নিলেও কিছুক্ষণ পরেই তা শেষ হয়ে গেল এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এসে পিপাসার অভিযোগ করল। এমতাবস্থায় তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) স্বীয় থলি হতে একটি তীর বের করে বললেন, একে কূপটির মধ্যে ফেলে দাও। (বর্ণনাকারী বলেন) আল্লাহর কসম! তীর নিক্ষেপমাত্রই কূপের পানি পরিপূর্ণ হয়ে উপচে পড়তে লাগল। ফলে তারা সকলে উক্ত স্থান ত্যাগ করা পর্যন্ত তা হতে আত্মতৃপ্তির সাথে পানি পান করল। তারা যখন পানি পান করা ইত্যাদিতে মশগুল ঠিক তখন খুযা’ঈ গোত্রপতি বুদায়ল ইবনু ওয়ারাকা স্বীয় খুযা’আহ্ গোত্রের কতিপয় লোকজনসহ সেখানে উপস্থিত হলো। সে চলে গেলে ’উরওয়াহ্ ইবনু মাস্’ঊদ আসলো।
(পরবর্তী ঘটনা) ব্যাখ্যা করে বর্ণনাকারী বলেন, পরিশেষে সুহায়ল ইবনু ’আমর এসে উপস্থিত হলো। অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (’আলী -কে) বললেনঃ ’’লিখো, এটা আল্লাহর রসূল, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পক্ষ থেকে সম্পাদিত সন্ধিপত্র।’’ এ কথা শুনে সুহায়ল বলে উঠল, আল্লাহর কসম! যদি আমরা আপনাকে আল্লাহর রসূল বলে জানতাম, তাহলে কক্ষনো আপনাকে বায়তুল্লাহ যিয়ারত করা হতে বাধা সৃষ্টি করতাম না এবং আপনার সাথে যুদ্ধও করতাম না, বরং আপনি এভাবে লিখুন ’’আবদুল্লাহ-এর পুত্র মুহাম্মাদণ্ডএর পক্ষ হতে’’। তার কথা শুনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ আল্লাহর কসম! আমি নিশ্চয় আল্লাহর রসূল, যদিও তোমরা আমাকে অস্বীকার করো। আচ্ছা! (হে ’আলী!) মুহাম্মাদ ইবনু ’আবদুল্লাহ লিখো। সন্ধিপত্র লেখা হচ্ছিল, তখন সুহায়ল বলে উঠল, অন্যান্য শর্তাবলীর সাথে এটাও লেখা হোক যে, যদি আমাদের কোনো লোক (মক্কা হতে) আপনার নিকট যায় তাকে অবশ্যই মক্কায় ফেরত পাঠিয়ে দিতে হবে, যদিও সে আপনার দীনে (ধর্মে) বিশ্বাসী হয়।
বর্ণনাকারী বলেনঃ সন্ধিপত্র লেখা শেষ হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীগণের উদ্দেশে বললেনঃ উঠো, তোমরা তোমাদের সাথে নিয়ে আসা পশু কুরবানী করে দাও এবং তারপর মাথা মুড়িয়ে ফেলো (তথা ইহরাম হতে হালাল হয়ে যাও)। এরপর কতিপয় মু’মিনাহ্ মহিলা হিজরত করে তার নিকট আসলো, তখন আল্লাহ তা’আলা এ আয়াত নাযিল করলেন, অর্থাৎ- ’’হে মু’মিনগণ! কোনো মু’মিন মুসলিম নারী হিজরত করে তোমাদের নিকট আসলে তাদেরকে ভালোভাবে পরীক্ষা করে নাও।’’ এ আয়াত দ্বারা সে সকল মুসলিম রমণীদেরকে ফেরত পাঠাতে আল্লাহ নিষেধ করে নির্দেশ দিলেন যে, তাদের মোহর ফেরত দাও। অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় ফিরে আসলেন। এ সময় আবূ বাসীর নামে কুরায়শের এক ব্যক্তি মুসলিম হয়ে (মক্কা হতে মদীনায়) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট আসলো। অন্যদিকে কুরায়শরাও তার সন্ধানে মদীনায় দু’জন লোক পাঠাল। (সন্ধির শর্তানুযায়ী) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবূ বাসীরকে তাদের কাছে সোপর্দ করলেন।
তারা আবূ বাসীরকে সঙ্গে নিয়ে রওয়ানা হলো। ’’যুলহুলায়ফাহ্’’ নামক স্থানে পৌঁছে নিজেদের খাদ্য (খেজুর) খাওয়ার জন্য সওয়ারীর হতে নামলো, তখন আবূ বাসীর তাদের একজনকে বললঃ হে অমুক! আল্লাহর কসম! তোমার তরবারি তো দেখছি খুবই আকর্ষণীয় এবং মূল্যবান? আমাকে একটু দাও দেখি, ভালো করে দেখে নেই? লোকটি তরবারিটি আবূ বাসীর-এর হাতে দিলো, সে তাকে ভালোভাবে ধরে তা দ্বারা তাকে এমনভাবে আঘাত করল যে, সে সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্যুবরণ করল। আর অপর লোকটি পালিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে মদীনায় এসে মসজিদে নববীতে আশ্রয় নিলো। তাকে দেখেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ এ লোকটি দেখে মনে হচ্ছে ভীত-সন্ত্রস্ত।
সে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট গিয়ে বললঃ আল্লাহর কসম! আমার সঙ্গীকে হত্যা করা হয়েছে, সুযোগ পেলে হয়ত আমাকেও হত্যা করত। এখন আমাকে বাঁচান! লোকটির পিছনে আবূ বাসীরও এসে সমুপস্থিত হলো। তাকে দেখে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আক্ষেপের সাথে বললেনঃ ’’তার মায়ের প্রতি আক্ষেপ! সে তো যুদ্ধের আগুন জ্বালিয়ে দিতে চায়। যদি তার সাথে আরও লোকজন থাকতো। যখন সে এ কথা শুনলো, তখন আবূ বাসীর বুঝতে পারল যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে পুনরায় কাফিরদের নিকট ফেরত পাঠিয়ে দেবেন। এটা বুঝে সে নীরবে সেখান হতে বের হয়ে সোজা সাগরের উপকূলের দিকে চলে গেল এবং সেখানে আশ্রয় গ্রহণ করল।
বর্ণনাকারী বলেনঃ ইতোমধ্যে সুহায়ল-এর পুত্র আবূ জান্দাল বন্দীমুক্ত হয়ে আবূ বাসীর-এর সাথে মিলিত হলেন। এভাবে মক্কার কুরায়শদের নিকট হতে কোনো মুসলিম পালিয়ে আসতে সক্ষম হলে সেও সরাসরি গিয়ে আবূ বাসীর ও তার সঙ্গীদের সাথে একত্রিত হত। এভাবে ক্রমাগত সেখানে একটি গেরিলা বাহিনী গড়ে উঠল। আল্লাহর কসম, যখনই তারা শুনতে পেত যে, কুরায়শদের কোনো তেজারতি কাফিলা সিরিয়ার অভিমুখে রওয়ানা হয়েছে, তখনই তারা উক্ত কাফিলার ওপর অতর্কিত হামলা চালাত এবং তাদেরকে হত্যা করে তাদের মাল-সম্পদ সবকিছু ছিনিয়ে নিয়ে যেত। এমতাবস্থায় অতিষ্ঠ হয়ে কুরায়শগণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এ প্রস্তাব পাঠাল যে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যেন আত্মীয়তার সহানুভূতি ও আল্লাহর ওয়াস্তে আবূ বাসীর ও তার সঙ্গীদেরকে লুটতরাজ হতে বিরত রাখেন এবং সত্বর আবূ বাসীর-কে সেখান হতে ফিরিয়ে আনেন। সাথে সাথে এটাও জানিয়ে দিলো যে, এখন হতে মক্কার কোনো মুসলিম মদীনায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট আসলে তাকে আর ফেরত দিতে হবে না। অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবূ বাসীর ও তার সাথীদেরকে আনতে লোক পাঠালেন (তখন তারা সবাই মদীনায় প্রত্যাবর্তন করলেন)। (বুখারী)[1]
بَابُ الصُّلْحِ
عَنِ الْمِسْوَرِ بْنِ مَخْرَمَةَ وَمَرْوَانَ بْنِ الْحَكَمِ قَالَا: خَرَجَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَامَ الْحُدَيْبِيَةِ فِي بِضْعَ عَشْرَةَ مِائَةً مِنْ أَصْحَابِهِ فَلَمَّا أَتَى ذَا الْحُلَيْفَةِ قَلَّدَ الْهَدْيَ وَأَشْعَرَ وَأَحْرَمَ مِنْهَا بِعُمْرَةٍ وَسَارَ حَتَّى إِذَا كَانَ بِالثَّنِيَّةِ الَّتِي يُهْبَطُ عَلَيْهِمْ مِنْهَا بَرَكَتْ بِهِ رَاحِلَتُهُ فَقَالَ النَّاسُ: حَلْ حَلْ خَلَأَتِ القَصْواءُ خلأت الْقَصْوَاء فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَا خَلَأَتِ الْقَصْوَاءُ وَمَا ذَاكَ لَهَا بِخُلُقٍ وَلَكِنْ حَبَسَهَا حَابِسُ الْفِيلِ» ثُمَّ قَالَ: «وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَا يَسْأَلُونِي خُطَّةً يُعَظِّمُونَ فِيهَا حُرُمَاتِ اللَّهِ إِلَّا أَعْطَيْتُهُمْ إِيَّاهَا» ثُمَّ زَجَرَهَا فَوَثَبَتْ فَعَدَلَ عَنْهُمْ حَتَّى نَزَلَ بِأَقْصَى الْحُدَيْبِيَةِ عَلَى ثَمَدٍ قَلِيلِ الْمَاءِ يَتَبَرَّضُهُ النَّاسُ تَبَرُّضًا فَلَمْ يَلْبَثْهُ النَّاسُ حَتَّى نَزَحُوهُ وَشُكِيَ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْعَطَشَ فَانْتَزَعَ سَهْمًا مِنْ كِنَانَتِهِ ثُمَّ أَمَرَهُمْ أَنْ يَجْعَلُوهُ فِيهِ فو الله مَا زَالَ يَجِيشُ لَهُمْ بِالرِّيِّ حَتَّى صَدَرُوا عَنْهُ فَبَيْنَا هُمْ كَذَلِكَ إِذْ جَاءَ بُدَيْلُ بْنُ وَرْقَاءَ الخزاعيُّ فِي نفَرٍ منْ خُزَاعَةَ ثُمَّ أَتَاهُ عُرْوَةُ بْنُ مَسْعُودٍ وَسَاقَ الْحَدِيثَ إِلَى أَنْ قَالَ: إِذْ جَاءَ سُهَيْلُ بْنُ عَمْرٍو فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: اكْتُبْ: هَذَا مَا قَاضَى عَلَيْهِ مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللَّهِ . فَقَالَ سُهَيْلٌ: وَاللَّهِ لَوْ كُنَّا نَعْلَمُ أَنَّكَ رَسُولُ اللَّهِ مَا صَدَدْنَاكَ عَنِ الْبَيْتِ وَلَا قَاتَلْنَاكَ وَلَكِنِ اكْتُبْ: مُحَمَّدَ بْنَ عَبْدِ اللَّهِ فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: وَاللَّهِ إِنِّي لَرَسُولُ اللَّهِ وَإِنْ كَذَّبْتُمُونِي اكْتُبْ: مُحَمَّدَ بْنَ عَبْدِ اللَّهِ فَقَالَ سُهَيْلٌ: وَعَلَى أَنْ لَا يَأْتِيَكَ مِنَّا رَجُلٌ وَإِنْ كانَ على دينِكَ إِلاَّ ردَدْتَه علينا فَلَمَّا فَرَغَ مِنْ قَضِيَّةِ الْكِتَابِ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِأَصْحَابِهِ: «قُومُوا فَانْحَرُوا ثُمَّ احْلِقُوا» ثُمَّ جَاءَ نِسْوَةٌ مُؤْمِنَاتٌ فَأَنْزَلَ اللَّهُ تَعَالَى: (يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذا جاءكُم المؤمناتُ مهاجِراتٌ)
الْآيَةَ. فَنَهَاهُمُ اللَّهُ تَعَالَى أَنْ يَرُدُّوهُنَّ وَأَمَرَهُمْ أَنْ يَرُدُّوا الصَّدَاقَ ثُمَّ رَجَعَ إِلَى الْمَدِينَةِ فَجَاءَهُ أَبُو بَصِيرٍ رَجُلٌ مِنْ قُرَيْشٍ وَهُوَ مُسْلِمٌ فَأَرْسَلُوا فِي طَلَبِهِ رَجُلَيْنِ فَدَفَعَهُ إِلَى الرَّجُلَيْنِ فَخَرَجَا بِهِ حَتَّى إِذَا بَلَغَا ذَا الْحُلَيْفَةِ نَزَلُوا يَأْكُلُونَ مِنْ تَمْرٍ لَهُمْ فَقَالَ أَبُو بَصِيرٍ لِأَحَدِ الرَّجُلَيْنِ: وَاللَّهِ إِنِّي لَأَرَى سَيْفَكَ هَذَا يَا فُلَانُ جَيِّدًا أَرِنِي أَنْظُرْ إِلَيْهِ فَأَمْكَنَهُ مِنْهُ فَضَرَبَهُ حَتَّى بَرَدَ وَفَرَّ الْآخَرُ حَتَّى أَتَى الْمَدِينَةَ فَدَخَلَ الْمَسْجِدَ يَعْدُو فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَقَدْ رأى هَذَا ذُعراً» فَقَالَ: قُتِلَ واللَّهِ صَحَابِيّ وَإِنِّي لَمَقْتُولٌ فَجَاءَ أَبُو بَصِيرٍ فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «وَيْلَ أُمِّهِ مِسْعَرَ حَرْبٍ لَوْ كَانَ لَهُ أَحَدٌ» فَلَمَّا سَمِعَ ذَلِكَ عَرَفَ أَنَّهُ سَيَرُدُّهُ إِلَيْهِمْ فَخَرَجَ حَتَّى أَتَى سِيفَ الْبَحْرِ قَالَ: وَانْفَلَتَ أَبُو جَنْدَلِ بْنُ سُهَيْلٍ فَلَحِقَ بِأَبِي بَصِيرٍ فَجَعَلَ لَا يَخْرُجُ مِنْ قُرَيْشٍ رَجُلٌ قَدْ أَسْلَمَ إِلَّا لَحِقَ بِأَبِي بَصِيرٍ حَتَّى اجْتَمَعَتْ مِنْهُمْ عِصَابَةٌ فو الله مَا يَسْمَعُونَ بِعِيرٍ خَرَجَتْ لِقُرَيْشٍ إِلَى الشَّامِ إِلَّا اعْتَرَضُوا لَهَا فَقَتَلُوهُمْ وَأَخَذُوا أَمْوَالَهُمْ فَأَرْسَلَتْ قُرَيْشٌ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ تُنَاشِدُهُ اللَّهَ وَالرَّحِمَ لَمَّا أَرْسَلَ إِلَيْهِمْ فَمَنْ أَتَاهُ فَهُوَ آمِنٌ فَأَرْسَلَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسلم إِلَيْهِم. رَوَاهُ البُخَارِيّ
ব্যাখ্যা: (عَامَ الْحُدَيْبِيَةِ) ‘‘হুদায়বিয়ার বৎসর’’। মুহিববুত্ব ত্ববারী (রহঃ) বলেনঃ হুদায়বিয়াহ্ মক্কার নিকটবর্তী একটি গ্রামের নাম। যার অধিকাংশ এলাকা হারামের অন্তর্ভুক্ত। আর তা মক্কা থেকে নয় মাইল দূরে অবস্থিত। তবে এর কিছু অংশ হারামের বাহিরে। তাই বুখারীর এক বর্ণনায় বলা হয়েছে, হুদায়বিয়াহ্ হারামের বাহিরে অবস্থিত। এ জায়গাকে বৎসরের সাথে সম্বন্ধ করার কারণ এই যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ঐ বৎসর মক্কায় প্রবেশে বাধা প্রদান করা হলে তিনি হুদায়বিয়াতে তার সঙ্গীদেরকে নিয়ে অবস্থান করেছিলেন এবং মক্কার মুশরিকদের সাথে সন্ধি চুক্তি করেছিলেন। (মিরকাতুল মাফাতীহ, ফাতহুল বারী ৫ম খন্ড, হাঃ ২৭৩১, ২৭৩২)
(وَأَحْرَمَ مِنْهَا بِعُمْرَةٍ) সেখানে তিনি ‘উমরাহ্ সম্পাদনের জন্য ইহরাম বাঁধলেন। অর্থাৎ যুল্হুলায়ফাতে পৌঁছানোর পর কুরবানীর পশুর গলায় মালা পড়িয়ে তার চুঁচের ডান অথবা বামপাশে আঘাত করে রক্ত বের করলেন যাতে লোকেরা বুঝতে পারে যে, পশুটি কুরবানীর জন্য নির্ধারিত। অতঃপর তিনি ‘উমরাহ্ পালনের নিমিত্তে ইহরাম বাঁধলেন তথা ‘উমরার নিয়্যাত করলেন।
(خَلَأَتِ الْقَصْوَاءُ) কস্ওয়া উটনীটি কোনো কারণ ছাড়াই বসে পড়েছে অর্থাৎ উটনীটি অসুস্থ বা দুর্বল না হওয়া সত্ত্বেও বসে পড়েছে।
(وَمَا ذَاكَ لَهَا بِخُلُقٍ) ‘‘এটা তার অভ্যাস নয়।’’ অর্থাৎ কস্ওয়া উটনী কখনো অসুস্থতা দুর্বল না হলে বসে পড়ে না।
(وَلٰكِنْ حَبَسَهَا حَابِسُ الْفِيْلِ) বরং হসত্মী বাহিনীকে বাধা দানকারী তাকে বাধাদান করেছেন। অর্থাৎ কা‘বাহ্ ঘর ধ্বংস করতে ইচ্ছুক আবরাহার হসত্মী বাহিনী যিনি থামিয়ে দিয়েছিলেন সেই মহান আল্লাহ তা‘আলাই এ উটনীটিকে থামিয়ে দিয়েছেন। তাই উটনীটি বসে পড়েছে যা তার অভ্যাসের বিপরীত।
(لَا يَسْأَلُوْنِىْ خُطَّةً يُعَظِّمُوْنَ فِيْهَا حُرُمَاتِ اللّٰهِ إِلَّا أَعْطَيْتُهُمْ) ‘‘তারা যদি এমন কোনো পরিকল্পনা উপস্থাপন করে যা দ্বারা আল্লাহর মর্যাদাসম্পন্ন বস্তুকে মর্যাদা দেয়া হয় তাহলে আমি তাদের সে পরিকল্পনা গ্রহণ করবো।’’ কাযী ‘ইয়ায বলেনঃ এর অর্থ হলো এই যে, মক্কাবাসীগণ যদি আমার নিকট এমন কোনো বিষয় উপস্থাপন করে যার মাধ্যমে তারা আল্লাহর দেয়া মর্যাদা পূর্ণ বিষয়ের যেমন ইহরাম ও মুহরিমের মর্যাদা প্রদানের ইচ্ছা পোষণ করে তাহলে আমি তাদের সে বিষয় মেনে নিবো। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
সুহায়লী বলেনঃ (إِلَّا أَعْطَيْتُهُمْ إِيَّاهَا) হাদীসের এই বাক্য বর্ণনার ক্ষেত্রে কোনো বর্ণনাতেই إِنْ شَاءَ اللّٰهُ تَعَالٰى শব্দের উল্লেখ নেই। অথচ ভবিষ্যতের কোনো কাজ করার ক্ষেত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম إِنْ شَاءَ اللّٰهُ تَعَالٰى বলতে নির্দেশিত। অতঃপর তিনি এর জবাব দিয়েছেন এই বলে যে, যেহেতু এ ক্ষেত্রে এমন কোনো কাজ করা আবশ্যক ছিল, তাই তিনি إِنْ شَاءَ اللّٰهُ تَعَالٰى বলেননি। কিন্তু তার এ জবাব সমালোচনামুক্ত নয়। কেননা আল্লাহ তা‘আলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে পূর্বেই জানিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি মক্কাতে প্রবেশ করবেন এই বলে যে, «تَدْخُلُنَّ الْمَسْجِدَ الْحَرَامَ إِنْ شَاءَ اللّٰهُ آمِنِين» ‘‘আল্লাহ চাহে তো তুমি অবশ্যই মসজিদে হারামে নিরাপদে প্রবেশ করবে’’ এখানে তিনি নিশ্চিত প্রবেশ করবেন- এ কথা বলার পরেও বলেছেনঃ إِنْ شَاءَ اللّٰهُ تَعَالٰى অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সর্বাবস্থায় إِنْ شَاءَ اللّٰهُ تَعَالٰى বলা শিক্ষা দিয়েছেন। অতএব জবাব এই যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম إِنْ شَاءَ اللّٰهُ تَعَالٰى বলেছিলেন কিন্তু বর্ণনাকারীগণ তা বর্ণনা করেননি। অথবা এই ঘটনা ঘটেছিল إِنْ شَاءَ اللّٰهُ تَعَالٰى বলার নির্দেশ দেয়ার আগে। যদিও যে সূরাতে এই নির্দেশ দেয়া হয়েছে তা মাক্কী সূরাহ তবুও এটা বিচিত্র নয় যে, এ নির্দেশ সম্বলিত আয়াত পরে নাযিল হয়েছে যা অনেক সূরার ক্ষেত্রেই বিদ্যমান। (ফাতহুল বারী ৫ম খন্ড, হাঃ ২৭৩১, ২৭৩২)
(وَاللّٰهِ لَوْ كُنَّا نَعْلَمُ أَنَّكَ رَسُوْلُ اللّٰهِ مَا صَدَدْنَاكَ عَنِ الْبَيْتِ) ‘‘আল্লাহর কসম! আমরা যদি জানতাম আপনি আল্লাহর রসূল তাহলে আমরা আপনাকে বায়তুল্লাহ ত্বওয়াফ করতে বাধা দিতাম না।’’ অর্থাৎ আমরা যদি এটা জানতাম যে, প্রকৃতপক্ষেই আপনি আল্লাহর রসূল তাহলে ‘উমরার উদ্দেশে বায়তুল্লাহর ত্বওয়াফ করতে আমরা আপনাকে কোনো প্রকার বাধা দিতাম না। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
(وَيْلُ أُمِّه) ‘‘তার মায়ের সর্বনাশ হোক।’’ এটি এমন এক শব্দ যা দ্বারা তিরস্কার করা হয়। তবে ‘আরবরা কারো প্রশংসা জ্ঞাপনের জন্যও এ শব্দটি প্রয়োগ করে থাকে। তখন এর প্রকৃত অর্থ উদ্দেশ্য নেয়া হয় না। বাদীউয্ যামান বলেনঃ ‘আরবগণ تَرِبَتْ يَمِينُه শব্দটি কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ব্যবহার করে থাকে। অনুরূপভাবে তারা (وَيْلُ أُمِّه) শব্দটি ব্যবহার করে থাকে কিন্তু তার প্রকৃত অর্থ অর্থাৎ তিরস্কারের উদ্দেশ্য নয়। অনুরূপ الْوَيْل শব্দটি শাস্তি, যুদ্ধ এবং ধমক দেয়ার উদ্দেশেও ব্যবহার হয়ে থাকে। (ফাতহুল বারী ৫ম খন্ড, হাঃ ২৭৩১, ২৭৩২)
(مِسْعَرُ حَرْبٍ لَوْ كَانَ لَه أَحَدٌ) তার সাথে কেউ থাকলে সে তো যুদ্ধ শুরু করে দিবে। খত্ত্বাবী বলেনঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেন তার এ বিশেষণ বর্ণনা করেছেন যে, এ লোকটিকে যদি কেউ সাহায্য সহযোগিতা করার জন্য এগিয়ে আসে তাহলে অবশ্যই যুদ্ধ বাধিয়ে দিবে। এতে তার প্রতি পালিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত রয়েছে যাতে তাকে কাফিরদের নিকট ফিরিয়ে না দিতে হয়। (মিরকাতুল মাফাতীহ, ‘আওনুল মা‘বূদ ৫ম খন্ড, হাঃ ২৭৬২)
(فَلَمَّا سَمِعَ ذٰلِكَ عَرَفَ أَنَّه سَيَرُدُّه إِلَيْهِمْ) আবূ বাসীর যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উক্ত বক্তব্য শুনলেন তখন তিনি বুঝতে পারলেন যে, তিনি তাকে তাদের কাছেই ফেরত পাঠাবেন।
কাযী ‘ইয়ায বলেনঃ আবূ বাসীর তা বুঝতে পেরেছিলেন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বক্তব্য (مِسْعَرُ حَرْبٍ لَوْ كَانَ لَه أَحَدٌ) থেকে। কেননা তার এ বক্তব্য এটা বুঝায় যে, তিনি তাকে আশ্রয় দিবেন না এবং সাহায্যও করবেন না। মুশরিকদের কবল থেকে তার মুক্তির একটি পথ আর তা হলো তার কোনো সহযোগীকে নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা।
(حَتّٰى اَجْتَمَعَتْ مِنْهُمْ عِصَابَةٌ) এমনি করে পালিয়ে যাওয়া একদল লোক একত্র হলো, عِصَابَةٌ শব্দটি ৪০ জন পর্যন্ত লোকের দলকে বুঝায়। তবে এ হাদীস দ্বারা বুঝা যায় যে, عِصَابَةٌ ৪০-এর অধিক লোক বুঝানোর জন্যও ব্যবহার হয়ে থাকে। কেননা ইবনু ইসহক-এর বর্ণনানুযায়ী আবূ বাসীর-এর সাথে যারা মিলিত হয়েছিল তাদের সংখ্যা ছিল ৭০ জনের মতো। সুহায়লী মনে করেন যে, তাদের সংখ্যা তিনশতে পৌঁছেছিল। (ফাতহুল বারী ৫ম খন্ড, হাঃ ২৭৩১, ২৭৩২; ‘আওনুল মা‘বূদ ৫ম খন্ড, হাঃ ২৭৬২)
পরিচ্ছেদঃ ৯. প্রথম অনুচ্ছেদ - সন্ধি স্থাপন
৪০৪৩-[২] বারা ইবনু ’আযিব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুদায়বিয়ার দিন তিনটি শর্তের উপর মুশরিকদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন- [১] মক্কার কোনো মুশরিক (ইসলাম গ্রহণ করে) তাঁর নিকট (মদীনায়) এসে পড়লে তাকে কুরায়শদের নিকট ফেরত দিতে হবে। আর মদীনাহ্ হতে কোনো মুসলিম (মুরতাদ হয়ে) তাদের নিকট চলে গেলে তাকে মুসলিমদের নিকট ফেরত দিতে হবে না, [২] আগামী বৎসর মুসলিমরা শুধুমাত্র তিনদিনের জন্য মক্কায় আসতে পারবে, [৩] মক্কায় প্রবেশের সময় যুদ্ধাস্ত্র তরবারি এবং তীর, ধনুক ইত্যাদি কোষবদ্ধ রাখতে হবে। সন্ধিপত্র সম্পাদিত হওয়ার পরক্ষণেই (সুহায়ল ইবনু ’আমর-এর পুত্র) আবূ জান্দাল হাত পায়ে শৃঙ্খলাবস্থায় সেখানে এসে উপস্থিত হলো। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (সন্ধিপত্রের শর্তানুযায়ী) তাকে মুশরিকদের নিকট ফেরত দেন। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
بَابُ الصُّلْحِ
وَعَنِ الْبَرَاءِ بْنِ عَازِبٍ قَالَ: صَالَحَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْمُشْرِكِينَ يَوْمَ الْحُدَيْبِيَةِ عَلَى ثَلَاثَةِ أَشْيَاءَ: عَلَى أَنَّ مَنْ أَتَاهُ مِنَ الْمُشْرِكِينَ رَدَّهُ إِلَيْهِمْ وَمَنْ أَتَاهُمْ مِنَ الْمُسْلِمِينَ لَمْ يَرُدُّوهُ وَعَلَى أَنْ يَدْخُلَهَا مِنْ قَابِلٍ وَيُقِيمَ بِهَا ثَلَاثَةَ أَيَّامٍ وَلَا يَدْخُلَهَا إِلَّا بِجُلُبَّانِ السِّلَاحِ وَالسَّيْفِ وَالْقَوْسِ وَنَحْوِهِ فَجَاءَ أَبُو جَنْدَلٍ يَحْجِلُ فِي قُيُودِهِ فَرده إِلَيْهِم
ব্যাখ্যা: (وَلَا يَدْخُلَهَا إِلَّا بِجُلُبَّانِ السِّلَاحِ وَالسَّيْفِ) মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় প্রবেশকালে কোষবদ্ধ তরবারি সাথে রাখতে পারবে। جُلُبَّانِ বলা হয় চামড়ার এমন থলেকে যার মধ্যে কোষবদ্ধ তরবারি চাবুক এবং বিভিন্ন যন্ত্রপাতি রাখা হয়। অতঃপর তা হাওদাজের পিছনের কাঠের সাথে ঝুলিয়ে দেয়া হয়। মোট কথা হচ্ছে, ‘আরবদের এটা অভ্যাস ছিল যে, তারা কখনো তরবারি ব্যতীত সফর করতো না। চাই যুদ্ধাবস্থায় হোক আর নাই হোক। তাই তৃতীয় শর্তারোপ করা হয় যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় প্রবেশকালে তরবারি তো সাথে রাখতে পারবেন তবে তা থাকবে কোষবদ্ধ। তরবারি কোষমুক্ত রাখতে পারবে না।
ইবনুল মালিক বলেনঃ তৃতীয় শর্তের উদ্দেশ্য হলো মুসলিমগণ মক্কাতে তরবারি কোষমুক্ত অবস্থায় প্রবেশ করবে না যা যুদ্ধের প্রস্ত্ততি বুঝায়। আর তারা এ শর্তারোপ এজন্য করে যাতে বুঝা যায় যে, মক্কাবাসী ও মুসলিমগণের মধ্যে কোনো যুদ্ধ নেই। যাতে এ ধারণা না জন্মে যে, তারা মক্কাতে বলপূর্বক প্রবেশ করতে পেরেছে। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সকল শর্ত মেনে চুক্তি সম্পাদনের কারণ ছিল মুসলিমগণের মাঝে তখনো দুর্বলতা ছিল। কারী বলেনঃ ইবনু মালিক-এর এ ব্যাখ্যা ভুল। কেননা মুসলিমদের মাঝে তখন দুর্বলতা ছিল না। কেননা মুসলিমদের সংখ্যা তখন দুই হাজারের কাছাকাছি ছিল। আর তারা সবাই ‘আরবের সাহসী বীর। আর বদরে মাত্র ৩১৩ জন ‘আরবযোদ্ধা মক্কাবাসী ১০০০ মুশরিকের বিরুদ্ধে জয়লাভ করে। বরং এ শর্ত মেনে সন্ধি করার কারণ ছিল এই যে, মুসলিমগণ তখন ইহরাম অবস্থায় হারাম অঞ্চলে ছিলেন। যে অবস্থায় ঐ স্থানে যুদ্ধ করা যায় না। তাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হারাম এলাকার মর্যাদা রক্ষার্থে সন্ধি চুক্তির শর্তগুলো মুসলিমদের প্রতিকূলে হলেও তা মেনে চুক্তি করেছিলেন সুদূরপ্রসারী কল্যাণের জন্য। যা পরবর্তীতে সঠিক বলে প্রমাণিত হয়। (মিরকাতুল মাফাতীহ, ‘আওনুল মা‘বূদ ৩য় খন্ড, হাঃ ১৮২৯)
পরিচ্ছেদঃ ৯. প্রথম অনুচ্ছেদ - সন্ধি স্থাপন
৪০৪৪-[৩] আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। কুরায়শগণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে সন্ধি করল এবং তারা তাতে এ শর্তারোপ করল, যদি তোমাদের (মুসলিমদের) কোনো লোক আমাদের কাছে (মক্কায়) আসে, তবে তাকে আমরা তোমাদের নিকট ফেরত দেব না। আর আমাদের (কুরায়শদের) কোনো লোক (মদীনায়) চলে গেলে তোমরা তাকে আমাদের নিকট ফেরত দিতে বাধ্য থাকবে। এটা শুনে সাহাবীগণ (ক্রোধান্বিত হয়ে) বলে উঠলেন : হে আল্লাহর রসূল! আপনি কি এ শর্তও লিখতে বলছেন? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দৃঢ়কণ্ঠে জবাব দিলেন : হ্যাঁ। কেননা আমাদের নিকট হতে যে ব্যক্তি (স্বেচ্ছায়) তাদের নিকট চলে যাবে, তাকে আল্লাহ তা’আলা স্বীয় রহমত হতে বঞ্চিত করবেন। আর তাদের কোনো ব্যক্তি যদি আমাদের নিকট চলে আসে, আশা করা যায় (তাকে ফেরত দেয়ার দরুন) আল্লাহ তা’আলা শীঘ্রই তার মুক্তির একটা পথ বের করে দেবেন। (মুসলিম)[1]
بَابُ الصُّلْحِ
وَعَن أنس: أَنَّ قُرَيْشًا صَالَحُوا النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَاشْتَرَطُوا عَلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّ مَنْ جَاءَنَا مِنْكُمْ لَمْ نَرُدَّهُ عَلَيْكُمْ وَمَنْ جَاءَكُمْ مِنَّا رَدَدْتُمُوهُ عَلَيْنَا فَقَالُوا: يَا رَسُولَ اللَّهِ أَنَكْتُبُ هَذَا؟ قَالَ: «نَعَمْ إِنه من ذهبَ منَّا إِليهم فَأَبْعَدَهُ اللَّهُ وَمَنْ جَاءَنَا مِنْهُمْ سَيَجْعَلُ اللَّهُ لَهُ فرجا ومخرجاً» . رَوَاهُ مُسلم
ব্যাখ্যা: (إِنَّه مَنْ ذَهَبَ مِنَّا إِلَيْهِمْ فَأَبْعَدَهُ اللّٰهُ وَمَنْ جَاءَنَا مِنْهُمْ سَيَجْعَلُ اللّٰهُ لَه فَرَجًا وَمَخْرَجًا) আমাদের মধ্য থেকে যারা তাদের কাছে যাবে আল্লাহ তা‘আলা তাকে তার রহমাত থেকে বঞ্চিত করবেন। আর যে ব্যক্তি তাদের মধ্য থেকে ইসলাম গ্রহণ করে আমাদের কাছে আসবে আর শর্তানুযায়ী যদি আমরা তাকে তাদের কাছে ফিরিয়ে দেই তাহলেও আল্লাহ তা‘আলা তার মুক্তির ব্যবস্থা করবেন।
ত্বীবী (রহঃ) বলেনঃ (إِنَّه مَنْ ذَهَبَ) ‘‘যে ব্যক্তি আমাদের কাছ থেকে তাদের কাছে চলে যাবে’’ এ বাক্যটি পূর্বে উল্লেখিত نعم শব্দের ব্যাখ্যা। অর্থাৎ সন্ধি চুক্তির এ শর্ত ‘‘মুসলিমদের মধ্য থেকে কেউ যদি মদীনাহ্ থেকে পালিয়ে মক্কা গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে তাহলে মুশরিকগণ তাকে মুসলিমদের কাছে ফেরত পাঠাবে না। পক্ষান্তরে মুশরিকদের মধ্য থেকে কেউ যদি ইসলাম গ্রহণ করে মদীনায় পালিয়ে আসে তাহলে মুসলিমগণ তাকে মক্কায় ফেরত পাঠাতে বাধ্য থাকবে।’’ এ শর্ত শুনার পর মুসলিমগণ বলেছিলেন, আমরা এমন শর্ত লিখবো যা মুসলিমদের স্বার্থের প্রতিকূলে এবং তা একটি অসম চুক্তি? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন বললেনঃ হ্যাঁ, তা লিখো এবং কেন লিখতে রাজী হলেন তার ব্যাখ্যা দিলেন এই বলে যে, আমাদের মধ্য থেকে যারা চলে যাবে.....। সহীহুল বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে, উপরে বর্ণিত শর্তানুসারে চুক্তি হতে যাচ্ছে এমন কথা শুনে ‘উমার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এসে তাকে বললেনঃ আপনি কী সত্য নাবী নন? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ হ্যাঁ (আমি সত্য নাবী)। ‘উমার বললেনঃ আমরা কি সত্যের উপর আর আমাদের শত্রুগণ বাতিলের উপর নয়? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ হ্যাঁ (তোমার কথা সঠিক) ‘উমার তখন বললেনঃ তাহলে আমাদের এ সঠিক ধর্মকে এত নীচে নামাচ্ছেন কেন? কেন এ অসম চুক্তি করছেন? তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ আমি আল্লাহর রসূল, আমি তার অবাধ্য হতে পারি না। আর তিনি অবশ্যই আমাকে সাহায্য করবেন। ‘উমার আবার বললেনঃ আপনি কি আমাদের বলতেন না যে, আমরা অতি সত্বরই বায়তুল্লাহতে যাবো এবং আমরা তা ত্বওয়াফ করবো? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ হ্যাঁ, তবে আমি কি বলেছি যে, এবারই সেখানে যাবো? তখন ‘উমার বললেনঃ না, আপনি তা বলেননি। এবার রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তুমি অবশ্যই বায়তুল্লাহতে যাবে এবং তা ত্বওয়াফ করবে। অতঃপর ‘উমার আবূ বাকর -এর কাছে গিয়ে সে প্রশ্নগুলো করলেন যে প্রশ্ন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে করেছিলেন। আবূ বাকর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মতই জবাব দিলেন। ‘আলিমগণ বলেনঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ‘উমারের এ প্রশ্ন দীনের প্রতি সন্দেহের কারণে ছিল না বরং তার কাছে যে বিষয়টি অস্পষ্ট ছিল তা প্রকাশ করার উদ্দেশেই ছিল এ প্রশ্ন। আর ‘উমার-এর প্রশ্নের উত্তরে আবূ বাকর যা বলেছিলেন তা ছিল আবূ বাকর -এর মহান মর্যাদা ও তার গভীর জ্ঞানের প্রমাণ। এমনকি সকল বিষয়েই তার মর্যাদা অন্যের চাইতে বেশী। কারণ এখানে প্রমাণ পাওয়া যায় ‘উমার যা অনুধাবন করতে পারেননি আবূ বাকর তা অনুধান করতে পেরেছিলেন। তাই তার জবাব রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জবাবের মতই ছিল। তবে এখানে একটা প্রশ্ন থেকে যায়, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ‘উমার -এর প্রশ্নের উত্তরে বললেনঃ আমি আল্লাহর রসূল, আমি তার অবাধ্য হতে পারি না এবং অবশ্যই তিনি আমাকে সাহায্য করবেন। এরপরও ‘উমার কেন আবূ বাকর -এর কাছে গিয়ে তাকে প্রশ্ন করলেন? এর জবাব এই যে, আবূ বাকর -এর নিকট এ বিষয়ে কি জ্ঞান আছে তা জানার জন্য তিনি তাকে প্রশ্ন করেছিলেন। ‘‘আমি আল্লাহর রসূল, আমি তাঁর অবাধ্য হতে পারি না’’ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এ বক্তব্যে স্পষ্ট জানা যায় যে, হুদায়বিয়ার সন্ধিচুক্তি আল্লাহর নির্দেশেই হয়েছিল। মুসলিমদের দুর্বলতার কারণে নয়। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ ৯. প্রথম অনুচ্ছেদ - সন্ধি স্থাপন
৪০৪৫-[৪] ’আয়িশাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীদের বায়’আত গ্রহণকালে কুরআন মাজীদের এ আয়াতের আলোকে পরীÿা করতেন- অর্থাৎ- ’’হে নবী! যখন মু’মিন রমণীগণ আপনার কাছে বায়’আত করতে আসে....’’- তাদের মধ্যে যে রমণী আয়াতে উল্লেখিত শর্তাবলী মেনে চলার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হত তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাকে বলতেনঃ আমি তোমাকে মুখে কথার মাধ্যমে বায়’আত করে নিয়েছি। আল্লাহর কসম! বায়’আত গ্রহণকালে তাঁর হাত কোনো রমণীর হাত স্পর্শ করেনি। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
بَابُ الصُّلْحِ
وَعَن عَائِشَة قَالَتْ فِي بَيْعَةِ النِّسَاءِ: إِنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَمْتَحِنُهُنَّ بِهَذِهِ الْآيَة: (يَا أيُّها النبيُّ صلى الله عَلَيْهِ وَسلم إِذا جاءكَ المؤمناتُ يبايِعنَكَ)
فَمَنْ أَقَرَّتْ بِهَذَا الشَّرْطِ مِنْهُنَّ قَالَ لَهَا: «قَدْ بَايَعْتُكِ» كَلَامًا يُكَلِّمُهَا بِهِ وَاللَّهِ مَا مَسَّتْ يَدُهُ يَدَ امْرَأَةٍ قَطُّ فِي الْمُبَايَعَةِ
ব্যাখ্যা: (إِنَّ رَسُوْلَ اللّٰهِ ﷺ كَانَ يَمْتَحِنُهُنَّ) অবশ্যই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মু’মিনাহ্ মহিলাদের পরীক্ষা নিতেন। ইবনু ‘আব্বাস বলেনঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক মু’মিনাহ্ মহিলাদের পরীক্ষা ছিল এরূপ : তিনি তাদেরকে শপথ করতে বলতেন, তারা তাদের স্বামীদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করেন না। মুসলিম কোনো পুরুষের প্রতি তাদের কোনো আকর্ষণ নেই, কোনো ভূমির বিপরীতে অন্য কোনো ভূমির প্রতি আগ্রহ নেই, স্বীয় আবাস ছেড়ে যাওয়ার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। একমাত্র ইসলামের আকর্ষণে এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি ভালোবাসার কারণে দেশত্যাগ করেছেন। তারা যদি এসব বিষয়ে শপথ করে তা মেনে নিতো তাহলে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে ফেরত পাঠাতেন না। বরং উক্ত মহিলার স্বামীকে তার মুহরানা ফিরিয়ে দিতেন এবং তারা যা ব্যয় করেছে তাও ফিরিয়ে দিতেন।
(فَمَنْ أَقَرَّتْ بِهٰذَا الشَّرْطِ مِنْهُنَّ قَالَ لَهَا : قَدْ بَايَعْتُكِ) যে সকল মহিলা আয়াতে বর্ণিত শর্ত মেনে নিতো তাকে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলতেন, তোমার বায়‘আত আমি গ্রহণ করেছি। বায়‘আত গ্রহণের জন্য তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কোনো মহিলার হাত ধরতেন না। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
হাদীসের শিক্ষা: ১. মহিলাদের বায়‘আত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের সাথে শুধুমাত্র কথায় বায়‘আত গ্রহণ করা হয়। তাদের হাত বায়‘আত গ্রহণকারী ইমামের হাতের সাথে স্পর্শ করবে না।
২. পুরুষের বায়‘আত গ্রহণ করার ক্ষেত্রে ইমাম তাদের হাত ধরবেন।
৩. প্রয়োজনে অপরিচিত মহিলার সাথে কথা বলা এবং তাদের কথা শ্রবণ করা বৈধ।
৪. মহিলাদের কণ্ঠস্বর আওরাতের (পর্দার) অন্তর্ভুক্ত নয়।
৫. বিনা প্রয়োজনে মাহরাম নয় এমন মহিলার শরীর স্পর্শ করা বৈধ নয়। (শারহে মুসলিম ১৩শ খন্ড, হাঃ ১৮৬৬)