পরিচ্ছেদঃ ২. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - প্রশাসনিক কর্মস্থলে কাজ করা এবং তা গ্রহণের দায়িত্বে ভয় করা
৩৭৩৩-[৩] আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তিকে জনগণের মাঝে কাযী (বিচারক) নিয়োগ দেয়া হলো, মূলত তাকে যেন চাকু ছাড়া যাবাহ করা হলো। (আহমাদ, তিরমিযী, আবূ দাঊদ ও ইবনু মাজাহ্)[1]
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مِنْ جُعِلَ قَاضِيًا بَيْنَ النَّاسِ فَقَدْ ذُبِحَ بِغَيْرِ سِكِّينٍ» . رَوَاهُ أَحْمَدُ وَالتِّرْمِذِيُّ وَأَبُو دَاوُدَ وَابْنُ مَاجَهْ
ব্যাখ্যা: (قَاضِيًا بَيْنَ النَّاسِ فَقَدْ ذُبِحَ بِغَيْرِ سِكِّينٍ) অত্র হাদীসে বলা হয়েছে যাকে মানুষের বিচারক বানানো হলো তাকে যেন ছুরিবিহীন যাবাহ করা হলো।
‘আল্লামা ত্বীবী (রহঃ) বলেছেনঃ এর কয়েকটি দিক হতে পারে।
১) কাযী ‘ইয়ায বলেনঃ এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো ছুরিবিহীন হত্যা। যেমন : শ্বাসরুদ্ধ করে, পানিতে ডুবিয়ে, আগুনে জ্বালিয়ে ও খানা খাদ্য বন্ধের মাধ্যমে হত্যা করা, কেননা এভাবে হত্যা করা ছুরি দ্বারা হত্যার চেয়ে বেশী কষ্টকর।
২) যাবাহ সাধারণত ছুরি দ্বারাই হয় কিন্তু এখানে ছুরি ব্যতীত যাবাহের কথা এজন্য বলা হয়েছে যে, যাতে করে বুঝা যায় তার শাস্তি আরো বেশী মারাত্মক, যেমন : তার দীন নষ্ট হওয়া। এখানে শারীরিক শাস্তি উদ্দেশ্য নয়।
আল আশরাফ (রহঃ) গ্রন্থকার বলেন, তূরিবিশতী (রহঃ) বলেছেনঃ ছুরি দ্বারা ছুরিবিহীন যাবাহ এ দু’য়ের মাঝে ব্যাপক পার্থক্য বিরাজমান। কেননা ছুরি দ্বারা যাবাহের কষ্ট ক্ষণিকের আর ছুরি ছাড়া যাবাহের কষ্ট আমরণ, এমনকি পরকালেও এর জন্য অপমানিত হতে হবে।
৩) আল আশরাফ (রহঃ) গ্রন্থকার বলেনঃ এর দ্বারা উদ্দেশ্য হতে পারে যে, যাকে মানুষের বিচারপতি বানানো হলো তার ওপর আবশ্যক হয়ে গেল সকল প্রকার খারাপ প্রবৃত্তি থেকে বিরত থাকা এটাই যেন তাকে ছুরিবিহীন যাবাহের মতো। ‘আল্লামা ত্বীবী (রহঃ) বলেনঃ তৃতীয় নং অর্থে বিচার ফায়সালার কাজ উৎসাহমূলক কাজ হলো অপরদিকে পূর্বে দু’আর্থে বিচার কাজের প্রতি আগ্রহ থাকাকে অনুৎসাহিত করা হয়েছে, কেননা সেখানে রয়েছে অনেক ক্ষতিকর দিক।
আল মুযহির বলেনঃ বিচার ব্যবস্থার দায়িত্ব একটি ভয়ানক দায়িত্ব, এর ভয়াবহতা খুব বেশী এবং তার অনিষ্টতা খুবই মারাত্মক। কেননা খুব কম বিচারপতিই আছেন যারা বাদী-বিবাদীর মাঝে ইনসাফ করতে পারেন। এর কারণ হলো আত্মার সমস্যা যে, সে যাকে ভালোবাসে বিচার তার পক্ষেই দিতে চায় অথবা যার বিপক্ষে রায় যাবে সে খুব প্রতাপশালী হওয়ায় বিচার তার বিপক্ষে না করে থাকেন। আবার মাঝে মধ্যে দেখা যায় ঘুষ গ্রহণের মাধ্যমে বিচার সুষ্ঠু হয় না, এটা এক দুরারোগ্য ব্যাধি।
(তুহফাতুল আহওয়াযী ৪র্থ খন্ড, হাঃ ১৩২৫; ‘আওনুল মা‘বূদ ৬ষ্ঠ খন্ড, হাঃ ৩৫৬৮; মিরকাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ ২. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - প্রশাসনিক কর্মস্থলে কাজ করা এবং তা গ্রহণের দায়িত্বে ভয় করা
৩৭৩৪-[৪] আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি বিচারকের পদ কামনা করে এবং তা চেয়ে নেয়, সে পদ যেন তার নিজের দিকে (স্বীয় বোঝা) সোপর্দ করা হয়। আর যে ব্যক্তিকে উক্ত পদে বাধ্য-বাধকতাভাবে দেয়া হয়, আল্লাহ তা’আলা তার সাহায্যার্থে একজন মালাক (ফেরেশ্তা) অবতরণ করেন। তিনি তার কাজ-কর্মগুলো সুষ্ঠু-সুন্দরভাবে পরিচালনা করেন। (তিরমিযী, আবূ দাঊদ, ইবনু মাজাহ্)[1]
وَعَنْ أَنَسٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَنِ ابْتَغَى الْقَضَاءَ وَسَأَلَ وُكِلَ إِلَى نَفْسِهِ وَمَنْ أُكْرِهَ عَلَيْهِ أَنْزَلَ اللَّهُ عَلَيْهِ مَلَكًا يُسَدِّدُهُ» . رَوَاهُ التِّرْمِذِيُّ وَأَبُو دَاوُد وَابْن مَاجَه
ব্যাখ্যা: ‘আল্লামা ত্বীবী (রহঃ) বলেনঃ অত্র হাদীসে ابْتَغٰى তথা চাওয়া এবং سَأَلَ তথা আবেদন করা, একই জাতীয় দু’টি শব্দ একত্রে আসার কারণ হলো সে নেতৃত্ব চায় প্রকাশ্যে জনসম্মুখে এটা বুঝাবার জন্য। কেননা নেতৃত্বের প্রতি মানুষের ওপর কর্তৃত্বের প্রতি অন্তর সর্বদা আশান্বিত থাকে। সুতরাং যারা এগুলো থেকে বিরত থাকলো তারা নিরাপদে থাকলো আর যারা তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করলো তারা ধ্বংস হলো। সুতরাং বাধ্যবাধকতা না থাকলে নেতৃত্বের সাথে সংশ্লিষ্ট হওয়া ঠিক নয় আর যদি বাধ্য করা হয় তাহলে সেখানে অন্তরের প্রবৃত্তিকে দমানো হলো আর যখন প্রবৃত্তিকে দমানো সম্ভব হবে তখন সঠিকতায় পৌঁছানো সম্ভব হবে। যারা বলে থাকেন যাকে বিচারপতি বানানো হলো তার ওপর আবশ্যক হলো তার সব খারাপ চিন্তাধারা, কুপ্রবৃত্তি মন থেকে মুছে ফেলা এ কথা ঠিক না, তাদের প্রতিউত্তরে আমি বলবো না, কথা ঠিক কারণ ইমাম দারাকুত্বনী, বায়হাক্বী ও ত্ববারানী মারফূ‘ সূত্রে যে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন তা এ কথারই সমার্থক। সেখানে বলা হয়েছে, ‘‘যাকে মুসলিমদের বিচারপতি বানানো হলো সে যেন তার আচার-ব্যবহার, ইশারা ইঙ্গিতে, উঠা-বসা সবক্ষেত্রেই ইনসাফ বজায় রাখে।’’
ত্ববারানী ও বায়হাক্বী-এর অন্য বর্ণনা উম্মু সালামাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণনা এসেছে, ‘‘যাকে মুসলিমদের বিচারপতি বানিয়ে পরীক্ষা করা হচ্ছে সে যেন বাদী-বিবাদীর কারো ওপরই তার কন্ঠস্বর উঁচু না করে। ইমাম আবূ দাঊদ, ইমাম তিরমিযী ও ইমাম ইবনু মাজাহ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। (তুহফাতুল আহওয়াযী ৪র্থ খন্ড, হাঃ ১৩৩৪; ‘আওনুল মা‘বূদ ৬ষ্ঠ খন্ড, হাঃ ৩৫৭৫; মিরকাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ ২. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - প্রশাসনিক কর্মস্থলে কাজ করা এবং তা গ্রহণের দায়িত্বে ভয় করা
৩৭৩৫-[৫] আবূ বুরায়দাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ বিচারক তিন শ্রেণীর হয়। তন্মধ্যে এক প্রকারের (বিচারকদের) জন্য জান্নাত আর দু’ প্রকারের জন্য রয়েছে জাহান্নাম। সে বিচারক জান্নাতে যাবেন, যিনি হক চিনলেন এবং তদানুযায়ী ফায়সালা করেন। আর যে বিচারক হক উপলব্ধি করেও বিচার-ফায়সালার মধ্যে অন্যায়-অবিচার করে, সে বিচারক জাহান্নামী এবং যে বিচারক অজ্ঞতার সাথে বিচার-ফায়সালা করে, সেও জাহান্নামী। (আবূ দাঊদ ও ইবনু মাজাহ্)[1]
وَعَنْ بُرَيْدَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: الْقُضَاةُ ثَلَاثَةٌ: وَاحِدٌ فِي الْجَنَّةِ وَاثْنَانِ فِي النَّارِ فَأَمَّا الَّذِي فِي الْجَنَّةِ فَرَجُلٌ عَرَفَ الْحَقَّ فَقَضَى بِهِ وَرَجُلٌ عَرَفَ الْحَقَّ فَجَارَ فِي الْحُكْمِ فَهُوَ فِي النَّارِ وَرَجُلٌ قَضَى لِلنَّاسِ عَلَى جَهْلٍ فَهُوَ فِي النَّارِ . رَوَاهُ أَبُو دَاوُدَ وَابْنُ مَاجَهْ
ব্যাখ্যা: বিচারপতি তিন শ্রেণীর, একশ্রেণী জান্নাতী বাকী দু’শ্রেণী জাহান্নামী।
‘আল্লামা ত্বীবী (রহঃ) এ হাদীসের ব্যাখ্যায় গুরুত্বপূর্ণ মতামত ব্যক্ত করেছেন, তিনি বলেছেনঃ হাদীসটির মধ্যে (فَأَمَّا الَّذِىْ فِى الْجَنَّةِ) এ অংশটিকে পূর্বের অংশের সাথে মিলানো বা সম্পৃক্ত করা হয়েছে এবং স্পষ্ট কোনো প্রকার বিশ্লেষণমূলক অধ্যায় ব্যবহার থেকে বিরত থাকা হয়েছে যাতে করে তাদের সম্পৃক্ততা আরো প্রগাঢ় হয়। আমরা এখানে স্পষ্ট শব্দটি এজন্য বলেছি যে, হাদীসের ইবারতে فَهُوَ فِى النَّارِ না হয়ে فَأَمَّا الَّذِي فِي النَّارِ হলে তখন এভাবে ব্যবহারটাই বেশী শ্রুতিমধুর, এরূপ ব্যবহারের একটি দৃষ্টান্ত আমরা কুরআন থেকে দিতে পারি।
আ-লি ‘ইমরান এর ৭ নং আয়াত فَأَمَّا الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ زَيْغٌ فَيَتَّبِعُونَ مَا تَشَابَهَ مِنْهُ এখানে পরবর্তী وَالرَّاسِخُونَ فِي الْعِلْمِ অংশটি فَأَمَّا لرَّاسِخُونَ فِي الْعِلْمِ হওয়া প্রয়োজন ছিল তা কিন্তু হয়নি এটাই হলো ভাষার শৈথিলতা। হাদীসটি ইমাম আবূ দাঊদ ও ইমাম ইবনু মাজাহ বর্ণনা করেছেন।
আল জামি‘ আস্ সগীরে এসেছে,
الْقُضَاةُ ثَلَاثَةٌ اثْنَانِ فِي النَّارِ وَوَاحِدٌ فِي الْجَنَّةِ رَجُلٌ عَلِمَ الْحَقَّ فَقَضٰى بِه فَهُوَ فِي الْجَنَّةِ وَرَجُلٌ قَضٰى لِلنَّاسِ عَلٰى جَهْلٍ فَهُوَ فِي النَّارِ وَرَجُلٌ عَرَفَ الْحَقَّ فَجَارَ فِي الْحُكْمِ فَهُوَ فِي النَّارِ
অর্থাৎ বিচারক তিন শ্রেণীর, দু’শ্রেণী জাহান্নামী আর এক শ্রেণী জান্নাতী- যে সত্য জানলো সে অনুযায়ী ফায়সালা করলো সে জান্নাতী, যে না জেনে বিচার করলো সে জাহান্নামী আর যে জানলো কিন্তু বিচার কাজে জুলুম করলো সেও জাহান্নামী। (‘আওনুল মা‘বূদ ৬ষ্ঠ খন্ড, হাঃ ৩৫৭০; মিরকাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ ২. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - প্রশাসনিক কর্মস্থলে কাজ করা এবং তা গ্রহণের দায়িত্বে ভয় করা
৩৭৩৬-[৬] আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি মুসলিমদের বিচারক হওয়ার মনোষ্কামনা করবে, এমনকি সে তা পেয়েও যাবে। এমতাবস্থায় তার ইনসাফ যদি জুলুম ও অন্যায়ের উপর প্রাধান্য লাভ করে, তাহলে তার জন্য জান্নাত সুনির্ধারিত। আর যার জুলুম ও অন্যায় তার ইনসাফের উপর প্রাধান্য লাভ করে, তবে তার জন্য জাহান্নাম। (আবূ দাঊদ)[1]
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَنْ طَلَبَ قَضَاءَ الْمُسْلِمِينَ حَتَّى يَنَالَهُ ثُمَّ غَلَبَ عَدْلُهُ جَوْرَهُ فَلَهُ الْجَنَّةُ وَمَنْ غَلَبَ جَوْرُهُ عَدْلَهُ فَلَهُ النَّار» . رَوَاهُ أَبُو دَاوُد
ব্যাখ্যা: এ হাদীসে বলা হয়েছে, যারা নেতৃত্ব চাইবে এবং এক পর্যায়ে তা পেয়ে যাবে, অতঃপর তার ইনসাফ জুলুমের উপর বিজয় হবে তার জন্য রয়েছে জান্নাত আর যার জুলুম ইনসাফের উপর বিজয় হবে তার জন্য রয়েছে জাহান্নাম।
‘আল্লামা ত্বীবী (রহঃ) বলেনঃ হাদীসে উল্লেখিত حَتّٰى শব্দটি যদি আকাঙ্ক্ষার চূড়ান্ত পর্যায়ের অর্থের জন্য ব্যবহৃত হয় তাহলে এখান থেকে বুঝতে হবে যে, সে নেতৃত্ব চাওয়াতে খুবই আগ্রহী ছিল। অতঃপর এক পর্যায়ে সে নেতৃত্ব পায় এ শ্রেণীর বিচারকদের সাহায্যের জন্য কোনো মালাক (ফেরেশতা) অবতীর্ণ হয় না বরং তার নিজের দায়িত্বশীল তাকেই করা হয়, সুতরাং এমতাবস্থায় কিভাবে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করবে পূর্বের হাদীসে বলা হয়েছে। যে ক্ষমতা চায় তার জন্য আশান্বিত থাকে তাকে তার দিকেই সোপর্দ করা হয়, আল্লাহ তাকে সাহায্য করেন না। তাহলে এ দু’ হাদীসের মতপার্থক্যের সমাধান কিভাবে? সমাধান এভাবে সম্ভব যে, এখানে ক্ষমতাপ্রার্থী লোকের সংখ্যা দু’জন তার মধ্যে একজন যাকে আল্লাহ তার নিজস্ব শক্তির মাধ্যমে শক্তিশালী করেন যেমন সাহাবীগণ এবং তৎপরবর্তী তাবি‘ঈগণ যেহেতু তিনি তার প্রাপ্য চেয়েছেন আর অন্যজন এরূপ নন। তাকে তার নিজের ওপর সোপর্দ করা হবে, ফলে সে ইনসাফ করতে পারবে না, এটাই হলো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কথা তথা (وَمَنْ غَلَبَ جَوْرُه عَدْلَه فَلَهُ النَّار) এর অর্থ।
‘আল্লামা তূরিবিশতী বলেনঃ কোনো কোনো লোক এ হাদীসের অর্থ বিশ্লেষণ ছাড়াই এ কথা বলেন যে, হাদীসে বলা হয়েছে যার ইনসাফ জুলুমের উপর বিজয় হবে তার জন্য জান্নাত। সুতরাং যদি মাঝে মাঝে জুলুম করে তাহলে কোনো অসুবিধা নেই, কারণ ‘বিজয়’ শব্দটি ব্যবহৃত হয় তুলনামূলক সংখ্যাধিক্যের জন্য।
যদি এমন কথা বা এমন মতামত কেউ পেশ করে থাকেন তাহলে তা ভুল হবে। ‘আল্লামা ত্বীবী (রহঃ) বলেন, এর ব্যাখ্যা কয়েকভাবে হতে পারে। ১ম নম্বর ব্যাখ্যা তা যা বলেছেন তূরিবিশতী যে, এখানে বিজয় দ্বারা উদ্দেশ্য হলো সে কখনোই জুলুম করবে না। আমি আরো একটু বাড়িয়ে বলতে পারি যে, যার জুলুমের পরিমাণ ইনসাফের তুলনায় বেশী হবে সেও তো জাহান্নামী, সুতরাং এখানে আর কোনো সমস্যা রইল না। (‘আওনুল মা‘বূদ ৬ষ্ঠ খন্ড, হাঃ ৩৫৭২; মিরকাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ ২. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - প্রশাসনিক কর্মস্থলে কাজ করা এবং তা গ্রহণের দায়িত্বে ভয় করা
৩৭৩৭-[৭] মু’আয ইবনু জাবাল (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তাকে (শাসক নিযুক্ত করে) ইয়ামানে পাঠালেন, তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমার নিকট যদি কোনো মুকদ্দামা পেশ করা হয়, তখন তুমি কিভাবে বিচার-ফায়সালা পরিচালনা করবে? তিনি (মু’আয) বললেনঃ আমি আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী বিচার-ফায়সালা করব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুনরায় জিজ্ঞেস করলেনঃ আল্লাহর কিতাবের মধ্যে যদি (তার সুষ্ঠু সমাধান বুঝতে) না পাও, তখন কিভাবে করবে? তিনি (মু’আয) বলেনঃ তাহলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাত (হাদীস) অনুযায়ী সমাধান করব। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আবার জিজ্ঞেস করলেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাতের মাঝেও যদি (তার সুষ্ঠু সমাধান বুঝতে) না পাও, তখন কি করবে? এর জবাবে তিনি (মু’আয) বললেনঃ তখন আমি আমার ন্যায়-নিষ্ঠার সাথে ইজতিহাদ করব এবং সামান্য পরিমাণও ত্রুটি করব না। তিনি (মু’আয ) বলেন : আমার এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার বুকে হাত মেরে বললেন, সমস্ত প্রশংসা একমাত্র সে আল্লাহর জন্য যিনি আল্লাহর রসূল-এর প্রতিনিধিরূপে সে কাজটি করার তাওফীক দিয়েছেন, যে সকল কাজে আল্লাহর রসূল সন্তুষ্ট আছেন। (তিরমিযী, আবূ দাঊদ ও দারিমী)[1]
وَعَنْ مُعَاذِ بْنِ جَبَلٍ: أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَمَّا بَعَثَهُ إِلَى الْيَمين قَالَ: «كَيْفَ تَقْضِي إِذَا عَرَضَ لَكَ قَضَاءٌ؟» قَالَ: أَقْضِي بِكِتَابِ اللَّهِ قَالَ: «فَإِنْ لَمْ تَجِدْ فِي كِتَابِ اللَّهِ؟» قَالَ: فَبِسُنَّةِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «فَإِنْ لَمْ تَجِدْ فِي سُنَّةِ رَسُولِ اللَّهِ؟» قَالَ: أَجْتَهِدُ رَأْيِي وَلَا آلُو قَالَ: فَضَرَبَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى صَدْرِهِ وَقَالَ: «الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي وَفَّقَ رَسُولَ رَسُولِ اللَّهِ لِمَا يَرْضَى بِهِ رَسُولُ اللَّهِ» . رَوَاهُ التِّرْمِذِيّ وَأَبُو دَاوُد والدارمي
ব্যাখ্যা: অত্র হাদীসে বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মু‘আয বিন জাবাল -কে ইয়ামানে বিচারপতি হিসেবে পাঠানোর সময় প্রশ্ন করলেন, কি দ্বারা ফায়সালা করবে? মু‘আয বললেন, আল্লাহর কিতাব দ্বারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহর কিতাবে স্পষ্ট না পেলে কি দ্বারা করবে? মু‘আয বললেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাত দ্বারা। নাবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাত যদি না পাও তাহলে কিভাবে? মু‘আয বললেন, ‘আমি ইজতিহাদ করবো’ এর অর্থ হলো আমি ঐ মাসআলার উত্তর অনুসন্ধান করবো। ইজতিহাদের মাধ্যমে এবং অনুরূপ মাসআলাহ্ অনুসন্ধান করবো যাতে শারী‘আতের পক্ষ থেকে স্পষ্ট দলীল বিদ্যমান এবং একটি মাসআলাকে আরেকটির সাথে তুলনা করবো।
‘আল্লামা ত্বীবী (রহঃ) বলেনঃ মু‘আয (রাঃ)-এর কথা (أَجْتَهِدُ رَائِىْ) এর মধ্যে দৃঢ়তা বিরাজমান। إجْتهاد (ইজতিহাদ) শব্দটির অর্থ হলো প্রচেষ্টা চালানো, আবার তাকে رَائِىْ এর দিক সম্পৃক্ত করার কারণে অর্থের মধ্যে আরো দৃঢ়তা এসেছে। ইমাম রাগিব আস্ ইস্পাহানী বলেনঃ الْجُهْدُ ‘‘আল জুহ্দ’’ শব্দের অর্থ হলো শক্তি সামর্থ্য আর ইজতিহাদ অর্থ কষ্ট করা, পরিশ্রম করা। ইমাম খত্ত্বাবী (রহঃ) বলেনঃ এখানে রায় বলতে নিজের মনগড়া কথা যার কুরআন-হাদীসের সাথে নূন্যতম সম্পর্ক নেই এমন নয় বরং কুরআন ও হাদীসের সাথে মিল রেখে গবেষণার মাধ্যমে বিচার করতে হবে এটা উদ্দেশ্য।
অত্র হাদীস থেকে বুঝা যায়, ক্বিয়াস তথা ইজতিহাদের মাধ্যেমে ফতোয়া প্রদান করা যায়। আল-মাযহাব বলেন, যদি এমন মাসাআলাহ্ আসে যার কুরআন ও হাদীসের সরাসরি কোনো দলীল পাওয়া যাচ্ছে না তাহলে অনুরূপ আরেকটি মাসআলাহ্ দেখতে হবে যার দলীল সরাসরি কুরআন-হাদীসে রয়েছে এবং একটির সাথে আরেকটির সমতা বিধান করে ফতোয়া দিতে হবে। একটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি পরিষ্কার হতে পারে, যেমন : গমে সুদ হয়, এটা সরাসরি হাদীসে উল্লেখ আছে কিন্তু তরমুজে সুদ হয় এটা হাদীসে উল্লেখ নেই। তাই তরমুজে সুদ হয় কি না? এমন প্রশ্নের উত্তরে বলা হলো, হ্যাঁ, তরমুজেও সুদ হয় কারণ গম যেমন খাবার বস্তু, তেমনি তরমুজও খাওয়ার বস্তু তাই গমে সুদ হলে তরমুজেও সুদ হবে এটাই স্বাভাবিক। এমনটাই বলেছেন ইমাম শাফি‘ঈ (রহঃ)। (‘আওনূল মা‘বূদ ৬ষ্ঠ খন্ড, হাঃ ৩৫৮৯; তুহফাতুল আহওয়াযী ৪র্থ খন্ড, হাঃ ১৩২৭; মিরকাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ ২. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - প্রশাসনিক কর্মস্থলে কাজ করা এবং তা গ্রহণের দায়িত্বে ভয় করা
৩৭৩৮-[৮] ’আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে শাসক নিযুক্ত করে যখন ইয়ামানে পাঠালেন, তখন আমি জিজ্ঞেস করলামঃ হে আল্লাহর রসূল! আপনি আমাকে পাঠাচ্ছেন অথচ আমি একজন যুবক, আর বিচারকার্য বা শাসনভার পরিচালনায় আমি অনভিজ্ঞ। তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ আল্লাহ তা’আলা তোমার অন্তরকে শীঘ্রই সৎপথ দেখাবেন এবং তোমার জবানকেও হিফাযাত করবেন। যদি দু’ ব্যক্তি তাদের মুকদ্দামা নিয়ে তোমার নিকট উপস্থিত হয়, তখন অপর পক্ষের কথা না শুনা পর্যন্ত প্রথম ব্যক্তির পক্ষে কোনো ফায়সালা দিও না। কেননা প্রতিপক্ষের বর্ণনা থেকে মুকদ্দামার ফায়সালা দিতে তোমার সহজসাধ্য হবে। তিনি [’আলী (রাঃ)] বলেনঃ অতঃপর আমি আর কোনো মুকদ্দামায় দ্বিধাগ্রস্ত হইনি। (তিরমিযী, আবূ দাঊদ ও ইবনু মাজাহ্)[1]
গ্রন্থকার বলেনঃ ’’আকযিয়াহ্ ও শাহাদাত’’ (সাক্ষী ও ফায়সালা প্রদান) অধ্যায়ে আমরা উম্মু সালামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত اِنَّمَا اَقْضِىْ بَيْنَكُمْ رَائِىْ হাদীসটি বর্ণনা করব ইনশা-আল্লা-হু তা’আলা।
عَن عَلِيٍّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: بَعَثَنِي رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِلَى الْيَمَنِ قَاضِيًا فَقُلْتُ: يَا رَسُولَ اللَّهِ تُرْسِلُنِي وَأَنَا حَدِيثُ السِّنِّ وَلَا عِلْمَ لِي بِالْقَضَاءِ؟ فَقَالَ: «إِنَّ اللَّهَ سَيَهْدِي قَلْبَكَ وَيُثَبِّتُ لِسَانَكَ إِذَا تَقَاضَى إِلَيْكَ رَجُلَانِ فَلَا تَقْضِ لِلْأَوَّلِ حَتَّى تَسْمَعَ كَلَامَ الْآخَرِ فَإِنَّهُ أَحْرَى أَنْ يَتَبَيَّنَ لَكَ الْقَضَاءُ» . قَالَ: فَمَا شَكَكْتُ فِي قَضَاءٍ بَعْدُ. رَوَاهُ التِّرْمِذِيُّ وَأَبُو دَاوُدَ وَابْنُ مَاجَهْ
وَسَنَذْكُرُ حَدِيثَ أُمِّ سَلَمَةَ: «إِنَّمَا أَقْضِي بَيْنَكُمْ برأيي» فِي بَابِ «الْأَقْضِيَةِ وَالشَّهَادَاتِ» إِنْ شَاءَ اللَّهُ تَعَالَى
ব্যাখ্যা: অত্র হাদীসে বলা হয়েছে, ‘আলী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বললেন, নাবীজী! আপনি আমাকে বিচারপতি হিসেবে পাঠাচ্ছেন অথচ আমি অল্পবয়সী এবং বিচার ফায়সালা সম্পর্কে আমার কোনো জ্ঞান নেই। এখানে ‘আলী -এর কথাগুলো একটু ব্যাখ্যা করতে হবে এভাবে যে, জ্ঞান নেই অর্থ পূর্ণ জ্ঞান নেই আর অল্পবয়সী অর্থ অনভিজ্ঞ। এ রকম ভাষা দেখতে পাওয়া যায় মূসা ও হারূন (আঃ)-এর ঘটনায় যেখানে আল্লাহ বললেন, ‘‘তোমরা ফির্‘আওনের নিকট যাও নিশ্চয় সে সীমালঙ্ঘন করেছে’’- (সূরা ত্ব-হা ২০ : ৪৩)। আল্লাহ তা‘আলার এ নির্দেশ শুনে তারা বললেন, হে আমাদের রব! নিশ্চয় আমরা ভয় করছি আমাদের প্রতি তারা জুলুম করবে অথবা সীমালঙ্ঘন করবে। আল্লাহ বললেন, তোমরা ভয় পেও না আমি তোমাদের সাথে আছি, শুনছি ও দেখছি।
অত্র হাদীসে ‘আলী -এর বিনয় প্রকাশমান যে, তিনি সব উঁচু নেতৃত্বের চেয়ে আল্লাহ এবং তার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহচর্যকে বেশী গুরুত্বারোপ করেছেন। এ বিনয়ের কারণেই সুলতান মাহমূদ যখন তার বিশেষ দূতকে তার সমস্ত মসনদ দিতে চেয়েছিলেন তখন বিশেষ দূত তা প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ লোকেদের সাহচর্যকে পছন্দ করলেন। আল মুযহির বলেন, এখানে ‘‘ইলম নেই’’ অর্থ হলো অনভিজ্ঞ, অর্থাৎ দু’জনের মধ্যে বাদানুবাদ হলে তা শান্ত করার পর্যাপ্ত জ্ঞান আমার নেই। (‘আওনূল মা‘বূদ ৬ষ্ঠ খন্ড, হাঃ ৩৫৭৯; তুহফাতুল আহওয়াযী ৪র্থ খন্ড, হাঃ ১৩৩১; মিরকাতুল মাফাতীহ)