পরিচ্ছেদঃ ১৯. প্রথম অনুচ্ছেদ - ফারায়িয (মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি বণ্টন সম্বন্ধীয়) ও অন্তিম উপদেশ বা আদেশ)
৩০৪১-[১] আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমি মু’মিনদের জন্য তাদের নিজেদের চেয়েও অনেক ঘনিষ্ঠতর। তাই যে ঋণগ্রস্ত অবস্থায় মারা যায়, আর যে তা পরিশোধ করার পরিমাণ সম্পত্তি রেখে না যায়, তা পরিশোধের ভার আমার। আর যে ধন-সম্পদ রেখে যায় তা তার ওয়ারিসদের জন্য।
অপর বর্ণনায় আছে- যে ঋণ অথবা অসহায় সন্তান রেখে যায়, সে যেন আমার নিকট আসে, আমিই তার অভিভাবক। অপর এক বর্ণনায় রয়েছে- যে ধন-সম্পদ রেখে যাবে তাতে তার ওয়ারিসদের (অধিকার) হবে; আর যে কোনো (ঋণের) বোঝা রেখে যাবে তা আমার ওপর ন্যস্ত হবে। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
بَابُ الْفَرَائِضِ وَالْوَصَايَا
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «أَنَا أَوْلَى بِالْمُؤْمِنِينَ مِنْ أَنْفُسِهِمْ فَمَنْ مَاتَ وَعَلَيْهِ دَيْنٌ وَلَمْ يَتْرُكْ وَفَاءً فَعَلَيَّ قَضَاؤُهُ. وَمَنْ تَرَكَ مَالًا فَلِوَرَثَتِهِ» . وَفِي رِوَايَة: «من ترك دينا أَو ضيَاعًا فَلْيَأْتِنِي فَأَنَا مَوْلَاهُ» . وَفِي رِوَايَةٍ: «مَنْ تَرَكَ مَالًا فَلِوَرَثَتِهِ وَمَنْ تَرَكَ كَلًّا فَإِلَيْنَا»
ব্যাখ্যা: ইসলামের প্রাথমিককালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট কোনো মৃত ব্যক্তিকে নিয়ে আসা হলে- তিনি ঐ ব্যক্তির ঋণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে নিতেন, এতে যদি মৃত ব্যক্তির ঋণ পরিশোধ করার মতো কোনো সম্পদ না থাকত, তাহলে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জানাযায় ইমামতি না করে সাহাবীদেরকে জানাযা আদায়ের নির্দেশ করতেন। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা ইসলামের বিজয় দান করলে তিনি জানাযার ইমামতি বর্জন না করে বলতেন- ‘‘আমিই মু’মিনদের প্রতি জাগতিক ও ধর্মীয় সকল বিষয়ে তাদের অধিক হকদার। তাদের প্রতি আমার দয়া, অনুগ্রহ ও স্নেহ-ভালোবাসা সকল কিছু থেকে অধিকতর। সুতরাং আমিই তাদের ঋণ পরিশোধে অধিক হকদার।’’
সুতরাং কোনো ব্যক্তি যদি ঋণগ্রস্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে আর তার পরিবার ও সন্তান-সন্ততি নিঃস্ব-অসহায় এবং অভাবগ্রস্ত হয়ে থাকে, তাহলে আমি নিজেই তাদের ভরণ-পোষণ ও যাবতীয় খরচ বাহক।
كَلًّا - শব্দটির ك বর্ণে যবর এবং ل বর্ণে তাশদীদ যোগে অর্থ হলো- ভারী হওয়া, অনাথ হওয়া, পিতৃহীন হওয়া ইত্যাদি। এরূপ ব্যক্তিদের ভরণ-পোষণ এবং দেখাশুনার দায়িত্ব নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে গ্রহণ করেছেন। (ফাতহুল বারী ১২শ খন্ড, হাঃ ৬৭৩১; শারহে মুসলিম ১১/১২শ খন্ড, হাঃ ১৬১৯; মিরকাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ ১৯. প্রথম অনুচ্ছেদ - ফারায়িয (মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি বণ্টন সম্বন্ধীয়) ও অন্তিম উপদেশ বা আদেশ)
৩০৪২-[২] ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ নির্ধারিত (ধন-সম্পদের) অংকসমূহ তাদের হকদারদেরকে পৌঁছিয়ে দেবে। তারপর যা বাঁচবে তা নিকটতম পুরুষ ব্যক্তির জন্য। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
بَابُ الْفَرَائِضِ وَالْوَصَايَا
وَعَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «أَلْحِقُوا الْفَرَائِضَ بِأَهْلِهَا فَمَا بَقِيَ فَهُوَ لِأَوْلَى رَجُلٍ ذكر»
ব্যাখ্যা: মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পদ কুরআনুল মাজীদে বর্ণিত নির্ধারিত অংশ কুরআন ও সুন্নাহতে বর্ণিত ওয়ারিসদের অংশ দেয়ার পর মৃত ব্যক্তির সম্পদের অবশিষ্টাংশ পাওয়ার অধিকতর উপযুক্ত ও নিকটবর্তী হলেন- ঐ পুরুষ যার জন্যে কুরআনুল মাজীদ অংশ নির্ধারণ করেনি আর ঐ সকল পুরুষের মধ্যে সর্বাগ্রে রয়েছেন মৃত ব্যক্তির ছেলে, অতঃপর ভাই। এভাবে সম্পর্কের দিক দিয়ে যে মৃত ব্যক্তির নিকটতর হবে সেই অবশিষ্ট অংশ পাবে। এটাই অবশিষ্টাংশ বণ্টনের মূলনীতি।
যে সকল ওয়ারিসের অংশ কুরআন নির্ধারণ করে দিয়েছে তারা হলেন সর্বমোট বারো জন। তন্মধ্যে চারজন পুরুষ- যথাঃ ১. পিতা, ২. দাদা, ৩. বৈপিত্রেয় ভাই, ৪. স্বামী। এবং আটজন মহিলা- যথাঃ ১. স্ত্রী, ২. কন্যা, ৩. নাতনী (ছেলের কন্যা) ৪. সহোদরা বোন, ৫. বৈপিত্রেয় বোন, ৬. বৈমাত্রেয় বোন, ৭. মা, ৮. দাদী। (ফাতহুল বারী ১২শ খন্ড, হাঃ ৬৭৩২; শারহে মুসলিম ১১/১২ খন্ড, হাঃ ১৬১৫; মিরকাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ ১৯. প্রথম অনুচ্ছেদ - ফারায়িয (মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি বণ্টন সম্বন্ধীয়) ও অন্তিম উপদেশ বা আদেশ)
৩০৪৩-[৩] উসামাহ্ ইবনু যায়দ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মুসলিম কাফিরের ওয়ারিস হবে না, আর কাফিরও মুসলিমের ওয়ারিস হবে না। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
بَابُ الْفَرَائِضِ وَالْوَصَايَا
وَعَنْ أُسَامَةَ بْنِ زَيْدٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَا يَرِثُ الْمُسْلِمُ الْكَافِرَ وَلَا الْكَافِرُ الْمُسْلِمَ»
ব্যাখ্যা: কোনো মুসলিম মৃত্যুবরণ করলে তার সম্পদ ভিন্ন ধর্মাবলম্বী তথা ইয়াহূদী-খ্রিস্টান, অগ্নিপূজকসহ অন্য ধর্মের অনুসারীরা ঐ মুসলিমের সম্পদে ওয়ারিস হবে না। তথা মুসলিম কোনো কাফিরকে ওয়ারিস বানাবে না। এ কথার উপর সকল ফাকীহ ও ‘আলিম ঐকমত্য পোষণ করেছে।
তবে কাফিরের পরিত্যক্ত সম্পদে মুসলিম ওয়ারিস অংশীদার হবে কিনা- এ ব্যাপারে ফাকীহ ও ‘আলিমদের মাঝে মতভেদ রয়েছে।
জুমহূর সাহাবী, তাবি‘ঈ ও তাবি-তাবি‘ঈগণ বলেনঃ কাফিরের সম্পদে মুসলিম ওয়ারিস হবে না।
অপরদিকে মু‘আয ইবনে জাবাল, মু‘আবিয়াহ্ (রাঃ), সা‘ঈদ ইবনে মুসাইয়্যিব ও মাসরূক (রহঃ) সহ অন্যান্যরা বলেন, কাফিরের সম্পদে মুসলিম ওয়ারিস হবে, কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ «الْإِسْلَامُ يَعْلُو وَلَا يُعْلٰى عَلَيْهِ» ‘‘ইসলাম সর্বদাই সমুন্নত, পরাভূত হবার নয়।’’
তাই মুসলিম কাফিরের সম্পদে ওয়ারিস হবে। অমুসলিম মুসলিমের সম্পদে ওয়ারিস হবে না। তবে জুমহূরের প্রামাণ্য হাদীস বিশুদ্ধ।
মুরতাদ কখনো মুসলিমদের সম্পদে ওয়ারিস হবে না। এটা সর্বসম্মত মত। অনুরূপভাবে মুসলিম কি মুরতাদের সম্পদে ওয়ারিস হবে? তা নিয়ে ফাকীহদের মাঝে মতানৈক্য রয়েছে। মালিক, শাফি‘ঈ, রবী‘আহ্ ইবনু আবূ লায়লা প্রমুখসহ অনেকেই মনে করেন মুসলিম ব্যক্তিও মুরতাদের সম্পদের ওয়ারিস হবে না। ইমাম আবূ হানীফাহ্ (রহঃ) বলেন, মুরতাদ হওয়ার পর যে সম্পদ অর্জিত হবে তা বায়তুল মাল (রাষ্ট্রীয় কোষাগারে) জমা হবে, আর ইসলাম অবস্থায় যা অর্জিত হয়েছে মুসলিম তার ওয়ারিস হবে। (ফাতহুল বারী ১২শ খন্ড, হাঃ ৬৭৬৪; শারহে মুসলিম ১১/১২ খন্ড, হাঃ ১৬১৪; মিরকাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ ১৯. প্রথম অনুচ্ছেদ - ফারায়িয (মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি বণ্টন সম্বন্ধীয়) ও অন্তিম উপদেশ বা আদেশ)
৩০৪৪-[৪] আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কোনো সম্প্রদায়ের মুক্ত ক্রীতদাস সে গোত্রেরই একজন। (বুখারী)[1]
بَابُ الْفَرَائِضِ وَالْوَصَايَا
وَعَنْ أَنَسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «مَوْلَى الْقَوْمِ مِنْ أَنْفُسِهِمْ» . رَوَاهُ البُخَارِيّ
ব্যাখ্যা : কোনো ব্যক্তি যদি দাস আযাদ করে, তাহলে ঐ দাসের যদি কোনো রক্ত সম্পর্কিত আসাবা (তথা এমন উত্তরাধিকারী যাদের কোনো নির্ধারিত অংশ কুরআন-হাদীসে বর্ণিত হয়নি) না থাকে তাহলে ঐ দাসের আযাদকারী মুনীব আসাবা সাবাবিয়্যাহ্ হিসেবে তার সম্পদের মালিক হবে।
হাদীসে উল্লেখিত ‘মাওলা’ শব্দটি আযাদকারী এবং আযাদকৃত উভয়ের জন্যই ব্যবহার হয়ে থাকে, তবে এখানে আযাদকারী অর্থেই ব্যবহার বেশী যুক্তিযুক্ত। (ফাতহুল বারী ১২শ খন্ড, হাঃ ৬৭৬১; মিরকাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ ১৯. প্রথম অনুচ্ছেদ - ফারায়িয (মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি বণ্টন সম্বন্ধীয়) ও অন্তিম উপদেশ বা আদেশ)
৩০৪৫-[৫] উক্ত রাবী [আনাস (রাঃ)] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ গোত্রের ভাগিনেও গোত্রেরই একজন। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
’আয়িশাহ্ (রাঃ)-এর বর্ণিত হাদীস ’নিশ্চয় মুক্ত ক্রীতদাসের পরিত্যাজ্য’ অধ্যায়টি ’আগাম বিক্রয়’ অধ্যায়ের পূর্বের অধ্যায়ে বর্ণনা করা হয়েছে। আর বারা (রাঃ)-এর বর্ণিত ’খালা মায়ের মতো’ হাদীসটি ইনশা-আল্লা-হ বর্ণনা করব ’নাবালেগ বালেগ হওয়া ও তার প্রতিপালন’ অধ্যায়ে।
بَابُ الْفَرَائِضِ وَالْوَصَايَا
وَعَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «ابْنُ أُخْتِ الْقَوْمِ مِنْهُم»
وَذُكِرَ حَدِيثُ عَائِشَةَ: «إِنَّمَا الْوَلَاءُ» فِي بَابٍ قبل «بَاب السّلم»
ব্যাখ্যা: আলোচ্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ণনা করেন- কোনো কওমের বোনের পুত্র সে কওমেরই অন্তর্ভুক্ত। তথা বোনের পুত্র মৃত ব্যক্তির রক্ত সম্পর্কীয় ওয়ারিস। তারা কখনো সম্পদ পাবে না যদি মৃত ব্যক্তির যাবিল ফুরুজ বা নির্ধারিত অংশপ্রাপ্ত ওয়ারিস এবং আসাবা বিদ্যমান থাকে। কেননা যাবিল আরহাম মৃত ব্যক্তির তৃতীয় স্তরের ওয়ারিস। যাবিল আরহাম বা রক্ত সম্পর্কীয় ওয়ারিসদের ধারাবাহিক নাম নিম্নরূপ-
১. কন্যার সন্তান। ২. বোনের সন্তান, ৩. ভাতিজা, ৪. চাচাতো বোন, ৫. ফুফাতো বোন, ৬. মামাতো বোন, ৭. খালাতো বোন, ৮. নানা, ৯. বৈ।
উল্লেখিত যাবিল আরহামগণ মৃত ব্যক্তির তৃতীয় স্তরের ওয়ারিস হওয়ার কারণে যাবিল ফুরুজ ও আসাবাদের উপস্থিতিতে মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে মীরাস পাবে না। (ফাতহুল বারী ১২শ খন্ড, হাঃ ৬৭৬২; শারহে মুসলিম ৭/৮ খন্ড, হাঃ ১০৫৯; মিরকতুল মাফাতীহ)