পরিচ্ছেদঃ ৬. প্রথম অনুচ্ছেদ - ক্রয়-বিক্রয়ের শর্তসমূহ
২৮৭৫-[১] ইবনু ’উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে লোক তা’বীর করার পর কোনো খেজুর বাগান ক্রয় করবে, সেক্ষেত্রে ঐ বাগানের বিক্রেতারা মালিকানা পাবে। তবে যদি ক্রেতা শর্তারোপ করে, তখন ক্রেতাই পাবে। যদি কেউ কোনো ক্রীতদাস ক্রয় করে এবং ঐ ক্রীতদাসের কিছু মাল রয়েছে, সেই মাল বিক্রেতার হবে। অবশ্য যদি ক্রেতা শর্তারোপ করে নেয়। (মুসলিম; আর বুখারী শুধু প্রথম অংশ বর্ণনা করেছেন)[1]
بَابٌ فِى الْبَيْعِ الْمَشْرُوْطِ
عَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَنِ ابْتَاعَ نَخْلًا بَعْدَ أَنْ تُؤَبَّرَ فَثَمَرَتُهَا لِلْبَائِعِ إِلَّا أَنْ يَشْتَرِطَ الْمُبْتَاعُ وَمَنِ ابْتَاعَ عَبْدًا وَلَهُ مَالٌ فَمَالُهُ لِلْبَائِعِ إِلَّا أَنْ يَشْتَرِطَ الْمُبْتَاعُ» . رَوَاهُ مُسلم وروى البُخَارِيّ الْمَعْنى الأول وَحده
ব্যাখ্যা : এ হাদীস থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ব্যবসায়িক চুক্তির চাহিদায় বাধা সৃষ্টি করবে না- এমন শর্তরোপ করা বৈধ। এ হাদীসে দলীল রয়েছে যে, খেজুর কিংবা অন্যান্য ফলের গাছে তা‘বীর করা বৈধ। আর এ বৈধতার উপর ‘উলামাগণের ইজমা রয়েছে। তবে তা‘বীর করার পরে কিংবা পূর্বে খেজুর গাছ বিক্রি করলে উক্ত গাছের ফল বিক্রির অন্তর্ভুক্ত হবে কিনা- এ ব্যাপারে ‘উলামাগণের মাঝে ইখতিলাফ রয়েছে। ইমাম মালিক, শাফি‘ঈ, আল লায়স এবং অধিকাংশ ‘উলামাগণের মতে খেজুর গাছ যদি তা‘বীর করার পর বিক্রি করা হয় তবে ফল বিক্রেতার মালিকানায় থাকবে। আর ক্রেতা যদি এ বলে শর্ত করে যে, আমি গাছ ও গাছের ফলসহ ক্রয় করলাম তবে ফল ক্রেতার বলে গণ্য হবে। আর বিক্রেতা যদি ফল নিজের হওয়ার শর্তরোপ করে, তবে এটা শাফি‘ঈ ও অধিকাংশ ‘আলিমগণের মতে বৈধ হবে। ইমাম আবূ হানীফার মতে গাছ তা‘বীর করার আগে কিংবা পরে বিক্রি করলে ফল সর্বাবস্থায় বিক্রেতার বলে গণ্য হবে। (ফাতহুল বারী ৫ম খন্ড, হাঃ ২৩৭৯; শারহে মুসলিম ১০ম খন্ড, হাঃ ১৫৪৩)
পরিচ্ছেদঃ ৬. প্রথম অনুচ্ছেদ - ক্রয়-বিক্রয়ের শর্তসমূহ
২৮৭৬-[২] জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত। একদিন তিনি তাঁর একটি উটে চড়ে যাচ্ছিলেন, উটটি নিতান্তই ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে পড়েছিল। এমতাবস্থায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উটটির কাছে গেলেন এবং তাকে আঘাত করলেন। এতে করে উটটি এমন দ্রুত গতিতে চলতে লাগলো যে, যেরূপ চলতে (পূর্বে) সে সক্ষম ছিল না। অতঃপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, উটটি আমার কাছে (চল্লিশ দিরহাম বা রৌপ্য-মুদ্রায়) বিক্রি করে ফেল। তিনি বলেন, উক্ত দরে আমি বিক্রি করলাম, কিন্তু এ শর্ত দিলাম যে, আমি বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছতে এর উপর চড়ব। মদীনায় পৌঁছে আমি উটটি নিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট উপস্থিত হলাম; তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাকে এর মূল্য আদায় করে দিলেন। অপর এক বর্ণনায় আছে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাকে এর মূল্য আদায় করে দিলেন এবং উটটিও ফেরত দিয়ে দিলেন। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
বুখারীর এক বর্ণনায় আছে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বিলাল -কে বললেন তাঁকে এর মূল্য দিয়ে দাও এবং কিছু অতিরিক্তও দিয়ে দাও। উক্ত দরে বিলাল জাবির -কে তাঁর প্রাপ্য প্রদান করলেন এবং অতিরিক্ত এক ক্বীরাত্ব দিলেন।
بَابٌ فِى الْبَيْعِ الْمَشْرُوْطِ
وَعَنْ جَابِرٍ: أَنَّهُ كَانَ يَسِيرُ عَلَى جَمَلٍ لَهُ قد أعيي فَمَرَّ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِهِ فَضَرَبَهُ فَسَارَ سَيْرًا لَيْسَ يَسِيرُ مِثْلَهُ ثُمَّ قَالَ: «بِعْنِيهِ بِوُقِيَّةٍ» قَالَ: فَبِعْتُهُ فَاسْتَثْنَيْتُ حُمْلَانَهُ إِلَى أَهْلِي فَلَمَّا قَدِمْتُ الْمَدِينَةَ أَتَيْتُهُ بِالْجَمَلِ وَنَقَدَنِي ثَمَنَهُ وَفِي رِوَايَةٍ فَأَعْطَانِي ثَمَنَهُ وَرَدَّهُ عَلَيَّ. مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ. وَفِي رِوَايَةٍ لِلْبُخَارِيِّ أَنَّهُ قَالَ لِبِلَالٍ: «اقْضِهِ وَزِدْهُ» فَأَعْطَاهُ وَزَادَهُ قِيرَاطًا
ব্যাখ্যা: সহীহ মুসলিম ও মুসনাদে আহমাদ-এর বর্ণনায় রয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একে (উট) পা দ্বারা আঘাত করলেন এবং দু‘আ করলেন। ইউনুস বিন বাকির (রহঃ)-এর বর্ণনায় রয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একে আঘাত করলেন এবং দু‘আ করলেন, অতঃপর উট এমন দ্রুত চলতে লাগল, এর পূর্বে আর কখনো এমন দ্রুত চলেনি। ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে শর্তারোপ বৈধ কিনা- এ মর্মে ইখতিলাফ রয়েছে, তবে মুদ্দা কথা হলো যারা শর্তের বৈধতার কথা উল্লেখ করেছেন তাদের সংখ্যা মুখালিফদের তুলনায় ঢের বেশী এবং এটাই প্রাধান্যযোগ্য হওয়ার একটি দিক। অতঃপর এটাই (শর্তারোপ বৈধ হওয়ার মত) অধিক বিশুদ্ধ এবং এ ব্যাপারে জাবির (রাঃ) হতে অর্থগত শর্তের ব্যাপারে বর্ণিত রয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ উটটি আমার কাছে বিক্রি কর এবং তুমি এর পিঠে সওয়ার হয়ে মদীনায় পৌঁছার শর্ত থাকবে। এছাড়াও এ মর্মে একাধিক হাদীস রয়েছে। (ফাতহুল বারী ৬ষ্ঠ খন্ড, হাঃ ২৭১৮)
পরিচ্ছেদঃ ৬. প্রথম অনুচ্ছেদ - ক্রয়-বিক্রয়ের শর্তসমূহ
২৮৭৭-[৩] ’আয়িশাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন বারীরাহ্ (রাঃ) আমার নিকট এসে বলল, আমি আমার মালিকের সাথে প্রতি বছর এক উক্বিয়্যাহ্ [৪০ দিরহাম] হিসাবে নয় বছরে নয় উক্বিয়্যাহ্ [৩৩৬ দিরহাম] দেয়ার শর্তে লিখিত চুক্তিনামা সম্পাদনা করেছি, এজন্য আপনি আমাকে সাহায্য করুন। ’আয়িশাহ্ (রাঃ) বললেন, তোমার মালিক যদি ইচ্ছাপোষণ করে (আর তোমার যদি সম্মতি থাকে) যে, উল্লেখিত দিরহাম একসাথে আদায় করে আমি তোমাকে মুক্ত করে দিব এবং মুক্তিদান সূত্রে আমি তোমার উত্তরাধিকার তথা স্বত্বের অধিকারিণী বলে গণ্য হবো।
বারীরাহ্ (রাঃ) তার মালিকের কাছে গিয়ে এ কথা ব্যক্ত করলে তারা তা প্রত্যাখ্যান করল এবং বলল, উক্ত উত্তরাধিকার-স্বত্ব আমাদের থাকবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম [’আয়িশাহ্ (রাঃ)-কে] বললেন, তুমি তাকে কিনে নাও এবং মুক্ত করে দাও। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকেদেরকে খুৎবা দিতে গিয়ে আল্লাহর প্রশংসা ও গুণগান করলেন। অতঃপর বললেন, একশ্রেণীর লোকের এই স্বভাব কেন যে, তারা এরূপ শর্তারোপ করে, যা আল্লাহর কিতাবে নেই? আর আল্লাহর কিতাবে নেই, এমন সকল প্রকার শর্তই বাতিল বলে সাব্যস্ত হবে। এভাবে যদি একশ’ শর্তও করে, তবুও আল্লাহ তা’আলার শারী’আতই (বিধানই) অগ্রগণ্য এবং আল্লাহ তা’আলার দেয়া শর্তই সর্বাধিক সুদৃঢ়। তাই উত্তরাধিকার-স্বত্ব একমাত্র মুক্তকারীর বলে গণ্য হবে। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
بَابٌ فِى الْبَيْعِ الْمَشْرُوْطِ
وَعَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ: جَاءَتْ بَرِيرَةُ فَقَالَتْ: إِنِّي كَاتَبْتُ عَلَى تِسْعِ أَوَاقٍ فِي كُلِّ عَامٍ وُقِيَّةٌ فَأَعِينِينِي فَقَالَتْ عَائِشَةُ: إِنْ أَحَبَّ أَهْلُكِ أَنْ أَعُدَّهَا لَهُمْ عُدَّةً وَاحِدَةً وَأُعْتِقَكِ فَعَلْتُ وَيَكُونُ وَلَاؤُكِ لِي فَذَهَبَتْ إِلَى أَهْلِهَا فَأَبَوْا إِلَّا أَنْ يَكُونَ الْوَلَاءُ لَهُمْ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «خُذِيهَا وَأَعْتِقِيهَا» ثُمَّ قَامَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي النَّاسَ فَحَمِدَ اللَّهَ وَأَثْنَى عَلَيْهِ ثُمَّ قَالَ: «أَمَّا أبعد فَمَا بَالُ رِجَالٍ يَشْتَرِطُونَ شُرُوطًا لَيْسَتَ فِي كِتَابِ اللَّهِ مَا كَانَ مِنْ شَرْطٍ لَيْسَ فِي كِتَابِ اللَّهِ فَهُوَ بَاطِلٌ وَإِنْ كَانَ مِائَةَ شَرْطٍ فَقَضَاءُ اللَّهِ أَحَقُّ وَشَرْطُ اللَّهِ أَوْثَقُ وَإِنَّمَا الْوَلَاءُ لِمَنْ أَعْتَقَ»
ব্যাখ্যা: একদল ‘উলামার মতে (اِشْتَرْطٰى) আলোচ্য أمر ইবাহাত বা বৈধতার জন্য। আর ‘আমর-এর উল্লেখ হয়েছে সতর্ক করার জন্য এ মর্মে যে, শর্ত করা বা করাতে কোনো ফায়িদাহ্ নেই। আর সম্ভবত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটাই বলতে চেয়েছেন।
(اشترطى أو لا تشترطى لا يغيرهم) অর্থাৎ শর্ত করা না করা, এতে তাদের কোনো উপকার হবে না। আর এ ব্যাখ্যাটাই অধিক শক্তিশালী ও মজবুত। যা আয়মান-এর বর্ণনায় প্রমাণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘আয়িশাহ্ (রাঃ)-কে বললেন, তুমি শর্তারোপ কর ও তাদেরকেও করতে দাও। তারাও তাদের ইচ্ছানুযায়ী শর্ত করবে। আলোচ্য হাদীসে এটারও বৈধতা রয়েছে যে, লেনদেনের সম্পদ কম হোক বা বেশী হোক তা লিপিবদ্ধ করে রাখা বৈধ। আর ঋণের ক্ষেত্রে তা পরিশোধের বিষয়ে প্রতিমাসের কিস্তিতে মাসের প্রথম, মধ্য উল্লেখ করা ছাড়াই পূর্ণ মাসের সময় নির্ধারণ করা বৈধ। ইবনুল বার এমনটাই বলেছেন। (ফাতহুল বারী ৫ম খন্ড, হাঃ ২৫৬৩)
পরিচ্ছেদঃ ৬. প্রথম অনুচ্ছেদ - ক্রয়-বিক্রয়ের শর্তসমূহ
২৮৭৮-[৪] ইবনু ’উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরাধিকার স্বত্বকে (মুক্তকরণ সূত্রে) বিক্রি করা এবং তা দান করা হতে নিষেধ করেছেন। (বুখারী, মুসলিম)[1]
بَابٌ فِى الْبَيْعِ الْمَشْرُوْطِ
وَعَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ: نَهَى رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَن بيع الْوَلَاء وَعَن هِبته
ব্যাখ্যা: আলোচ্য হাদীস ‘‘আল ওয়ালা-’’ বিক্রি করা কিংবা হেবা করা হারাম হওয়ার উপর প্রমাণ করে। কারণ এ দু’টির কোনটি বৈধ হবে না এবং ‘‘ওয়ালা’’ তার হকদার থেকে স্থানান্তর করা যাবে না। বরং এটি বংশীয় অংশের মতই। জুমহূর ‘উলামাগণসহ পূর্ববর্তী ও পরবর্তী ‘উলামাগণ এমনটাই বলেছেন। (শারহ মুসলিম ১০ম খন্ড, হাঃ ১৫০৬)