পরিচ্ছেদঃ ৩. প্রথম অনুচ্ছেদ - ক্রয়-বিক্রয়ে পছন্দের স্বাধীনতা (অবকাশ থাকা)
২৮০১-[১] ইবনু ’উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়েরই জন্য অবকাশ থাকে একজন অপরজনের ক্রয়-বিক্রয়কে গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করার, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা পৃথক হয়ে না যায়। তবে পছন্দের শর্তে (গ্রহণ-প্রত্যাখ্যানের) ক্রয়-বিক্রয় ব্যতীত। (বুখারী, মুসলিম)[1]
মুসলিম-এর এক বর্ণনায় রয়েছে, ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ে যখন মূল্য নির্ধারণ করে, তখন তাদের উভয়ের জন্য একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন না হওয়া পর্যন্ত ক্রয়-বিক্রয়কে প্রত্যাখ্যান কিংবা গ্রহণ করার সুযোগ থাকে। বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগেই ক্রয়-বিক্রয়কে গ্রহণ করার কথা বলে নিলে সে সময় ক্রয়-বিক্রয় অবধারিত হয়ে যায় (প্রত্যাখ্যানের সুযোগ থাকে না)।
তিরমিযীর এক বর্ণনায় রয়েছে, ক্রেতা-বিক্রেতার জন্য প্রত্যাখ্যান করার সুযোগ থাকে যে পর্যন্ত একে অপর হতে পৃথক না হয় বা গ্রহণ করার কথা না বলে নেয়। বুখারী মুসলিমের এক বর্ণনায় আছে, ’’অথবা একজন অপরজনকে গ্রহণ করার কথা বলে নেয়’’ বাক্যের পরিবর্তে রয়েছে- ’কিংবা একজন অপরজনকে বলে, গ্রহণ কর (অপরজন বলে, গ্রহণ করলাম)’।
بَابُ الْخِيَارِ
عَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «الْمُتَبَايِعَانِ كُلُّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا بِالْخِيَارِ عَلَى صَاحِبِهِ مَا لَمْ يَتَّفَرَقَا إِلَّا بيع الْخِيَار»
وَفِي رِوَايَةٍ لِمُسْلِمٍ: «إِذَا تَبَايَعَ الْمُتَبَايِعَانِ فَكُلُّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا بِالْخِيَارِ مِنْ بَيْعِهِ مَا لَمْ يَتَفَرَّقَا أَوْ يَكُونَ بَيْعُهُمَا عَنْ خِيَارٍ فَإِذَا كانَ بيعُهما عَن خيارٍ فقد وَجَبَ»
وَفَى رِوَايَةٍ لِلتِّرْمِذِيِّ: «الْبَيِّعَانِ بِالْخِيَارِ مَا لَمْ يَتَفَرَّقَا أَوْ يَخْتَارَا» . وَفِي الْمُتَّفَقِ عَلَيْهِ: أَوْ يَقُولَ أَحَدُهُمَا لِصَاحِبِهِ: اخْتَرْ «بَدَلَ» أَوْ يختارا
ব্যাখ্যা: (مَا لَمْ يَتَفَرَّقَا) ‘‘যতক্ষণ ক্রেতা ও বিক্রেতা একে অপর থেকে পৃথক না হয়ে যায়’’ অর্থাৎ ক্রেতা ও বিক্রেতা বেচা-কেনার চুক্তি সম্পন্ন করার পর যতক্ষণ মাজলিস থেকে পৃথক না হয়ে যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত উভয় পক্ষের জন্য উক্ত চুক্তি বাতিল করার ইখতিয়ার থাকবে। যে কোনো পক্ষ চুক্তি বাতিল করতে পারবে যতক্ষণ না তারা মাজলিস পরিত্যাগ করে। অতএব বুঝা গেল যে, تفرقا ‘‘পৃথক হয়ে গেল’’ এর দ্বারা উদ্দেশ্য মাজলিস পরিত্যাগ করা। এ মত গ্রহণ করেছেন সাহাবীদের মধ্যে ‘আলী ইবনু আবূ ত্বালিব, ইবনু ‘উমার, ইবনু ‘আব্বাস, আবূ হুরায়রাহ্, আবূ বারযাহ্ আসলামী (রাঃ) প্রমুখ। তাবি‘ঈদের মধ্যে তাউস, শা‘বী প্রমুখ। অতঃপর ফুকাহাদের মধ্যে যুহরী, আওযা‘ঈ, ইবনু আবূ যিব, সুফ্ইয়ান ইবনু ‘উয়াইনাহ্, শাফি‘ঈ, ইবনুল মুবারক, ‘আলী ইবনুল মাদীনী, আহমাদ ইবনু হাম্বল, ইসহক ইবনু রহওয়াইহ্, আবূ সাওর, আবূ ‘উবায়দ, ইমাম বুখারী (রহঃ)-সহ মুহাদ্দিসগণ।
পক্ষান্তরে ইমাম আবূ হানীফাহ্ এবং ইমাম মালিক (রহঃ)-এর মতে تفرقا দ্বারা উদ্দেশ্য বেচা-কেনার কথাবার্তা শেষ করা। অর্থাৎ বেচা-কেনার কথাবার্তা শেষ হলেই বিক্রয় কার্যকর হবে। চাই মাজলিসে যাকুক অথবা তা ত্যাগ করুক। কথাবার্তা শেষ করার পর আর কারো ইখতিয়ার থাকবে না।
(إِلَّا بَيْعَ الْخِيَارِ) তবে খিয়ারের (অবকাশের) শর্তে চুক্তি সম্পাদন হলে তার বিধান ভিন্ন। ‘‘তবে অবকাশের শর্তে’’-এর ব্যাখ্যায় তিনটি অভিমত বিদ্যমান।
(১) বিক্রেতা যদি ক্রেতাকে বলে, ইখতিয়ার করুন আর ক্রেতা বলে ইখতিয়ার করলাম, তাহলে চুক্তি কার্যকর হবে। মাজলিস হতে পৃথক হওয়া পর্যন্ত ইখতিয়ার থাকবে না।
(২) ক্রেতা যদি বিক্রেতাকে বলে, এ চুক্তি কার্যকর করা বা তা পরিত্যাগ করার জন্য তিনদিনের মেয়াদ থাকবে। তাহলে মাজলিস পরিত্যাগ করলেও চুক্তি বাতিল করার ইখতিয়ার থাকবে তিনদিন পর্যন্ত।
(৩) চুক্তির সময় শর্তারোপ করল এ চুক্তি বাতিল করার কোনো ইখতিয়ার থাকবে না। তাহলে মাজলিস পরিত্যাগ করা পর্যন্ত ইখতিয়ার বিলম্বিত হবে না। বরং তাৎক্ষণিকভাবে বিক্রয়ের চুক্তি কার্যকর হবে। (শারহে মুসলিম ৯/১০ খন্ড, হাঃ ১৫৩১)
পরিচ্ছেদঃ ৩. প্রথম অনুচ্ছেদ - ক্রয়-বিক্রয়ে পছন্দের স্বাধীনতা (অবকাশ থাকা)
২৮০২-[২] হাকীম ইবনু হিযাম (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ক্রেতা ও বিক্রেতা একজন অপরজন হতে বিচ্ছিন্ন না হওয়া পর্যন্ত উভয়ের জন্যই ক্রয়-বিক্রয়কে প্রত্যাখ্যান করার সুযোগ থাকবে। তারা যদি সততার সাথে ক্রয়-বিক্রয় করে ও পণ্যের দোষ-ত্রুটি প্রকাশ করে দেয় তবে তাদের ক্রয়-বিক্রয়ের মধ্যে বরকত দান করা হবে। আর যদি তারা পণ্যের দোষ-ত্রুটি গোপন করে রাখে ও মিথ্যায় আশ্রয় নেয়, তাহলে তাদের (দোষ-ত্রুটির কারণে) ক্রয়-বিক্রয়ে বরকত দূর করে দেয়। (বুখারী, মুসলিম)[1]
بَابُ الْخِيَارِ
وَعَن حَكِيم بن حزَام قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «الْبَيِّعَانِ بِالْخِيَارِ مَا لَمْ يَتَفَرَّقَا فَإِنْ صَدَقَا وَبَيَّنَا بُوِرَكَ لَهُمَا فِي بَيْعِهِمَا وَإِنْ كَتَمَا وَكَذَبَا مُحِقَتْ بَرَكَةُ بَيْعِهِمَا»
ব্যাখ্যা: (فَإِنْ صَدَقَا وَبَيَّنَا) ‘‘যদি তারা সত্য বলে এবং বর্ণনা করে’’ অর্থাৎ বিক্রেতা দ্রব্যের দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করে এবং এক্ষেত্রে সত্য বলে। আর ক্রেতা তার দেয় মূল্যের মধ্যে কোনো ত্রুটি থাকলে অর্থাৎ ক্রেতার প্রদানকৃত মুদ্রার মধ্যে কোনো ত্রুটি থাকলে তা বর্ণনা করে এবং বর্ণনার ক্ষেত্রে সত্যাশ্রয়ী হয়।
(بُوِرَكَ لَهُمَا فِىْ بَيْعِهِمَا) ‘‘তবে তাদের বেচা-কেনার চুক্তিতে বরকত দেয়া হয়।’’
(وَإِنْ كَتَمَا وَكَذَبَا) ‘‘ক্রেতা ও বিক্রেতা যদি মিথ্যা বলে এবং গোপন করে’’ অর্থাৎ উভয়েই তার দেয় পণ্য ও মূলের মধ্যে কোনো ত্রুটি থাকলে মিথ্যা বলে ও প্রকৃত ব্যাপার গোপন করে।
(مُحِقَتْ بَرَكَةُ بَيْعِهِمَا) ‘‘তাহলে তাদের বেচা-কেনার বরকত দূর করে দেয়া হয়’’ অর্থাৎ এ বেচা-কেনার মধ্যে লাভ হয় না। অর্থাৎ ক্রেতা পণ্য ক্রয় করে ঠকার কারণে লাভবান হতে পারে না। আর বিক্রেতা ও ক্রেতাকে ঠকানোর কারণে তার উপার্জন হারামে পরিণত করে। আর হারাম উপায়ে অর্জিত মাল তার জীবনের কোনো ক্ষেত্রের জন্যই কল্যাণকর নয়। (শারহে মুসলিম ৯/১০ খন্ড, হাঃ ১৫৩২)
পরিচ্ছেদঃ ৩. প্রথম অনুচ্ছেদ - ক্রয়-বিক্রয়ে পছন্দের স্বাধীনতা (অবকাশ থাকা)
২৮০৩-[৩] ’আব্দুল্লাহ ইবনু ’উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, জনৈক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এসে নিবেদন করলো, আমি ক্রয়-বিক্রয়ের সময় ঠকে যাই। তার কথা শুনে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাকে বললেন, ক্রয়-বিক্রয়ের সময় তুমি বলে দিবে, ধোঁকা দেবেন না। এরপর থেকে সে ব্যক্তি ক্রয়-বিক্রয়ে ঐরূপ কথা বলে দিতো। (বুখারী, মুসলিম)[1]
بَابُ الْخِيَارِ
وَعَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ: قَالَ رَجُلٌ لِلنَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنِّي أُخْدَعُ فِي الْبُيُوعِ فَقَالَ: إِذَا بَايَعْتَ فَقُلْ: لَا خلابة فَكَانَ الرجل يَقُوله
ব্যাখ্যা: (إِنِّىْ أُخْدَعُ فِى الْبُيُوْعِ) ‘‘আমি বেচা-কেনাতে ধোঁকাপ্রাপ্ত হই’’ অর্থাৎ বেচা-কেনার নিয়মকানুন সঠিকভাবে জানি না, ফলে লোকজন আমাকে ঠকিয়ে দেয়।
إِذَا بَايَعْتَ فَقُلْ : لَا خَلَابَةَ ‘‘যখন তুমি বেচা-কেনা করবে তখন বলবে ঠকানো চলবে না’’। হাফিয ইবনু হাজার বলেনঃ ‘আলিমগণ বলেছেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাব্বান ইবনু মুনকিয (রাঃ)-কে ঐ বাক্য এজন্য শিখিয়ে দিয়েছেন যে, সে বেচা-কেনাতে পারঙ্গম ছিল না, ফলে পণ্য এবং তার মূল্য নির্ণয় করতে পারত না। বিক্রেতার নিকট ঐ বাক্য বললে সে যেন বুঝতে পারে যে, এ ব্যক্তি বেচা-কেনাতে পারদর্শী নয় এবং তাকে ঠকালে সে আবার ঐ পণ্য ফেরত দিবে। যাতে করে বিক্রেতা তাকে ঠকানোর চেষ্টা না করে, বরং সে নিজের জন্য যা কল্যাণ মনে করে ঐ ক্রেতার জন্য তাই কল্যাণ মনে করে তার সঙ্গে সেরূপ আচরণ করে। (ফাতহুল বারী ৪র্থ খন্ড, হাঃ ২১১৭)