পরিচ্ছেদঃ ৮. প্রথম অনুচ্ছেদ - মাথার চুল মুণ্ডন করার প্রসঙ্গে
এ অধ্যায়ে ছয়টি বিষয়ের আলোচনা রয়েছে ইমাম বাজী মুয়াত্ত্বার ব্যাখ্যায় যার বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
প্রথমত حَلْقُ (হলক) বা মাথা মুন্ডানোর হুকুম। দ্বিতীয়ত এর নিয়মাবলী। তৃতীয়ত এর স্থান। চতুর্থত এর সময়। পঞ্চমত এর সাথে সংশ্লিষ্ট বিধানাবলী। ষষ্ঠত এটি কি নুসুক্ব (বিধানাবলী) না ইহরাম থেকে মুক্ত হওয়া।
’আয়নী (রহঃ) বলেন, আমাদের শায়খ যায়নুদ্দীন আল ’ইরাকী তিরমিযীর ব্যাখ্যায় বলেছেন, হলক বা মাথা মুন্ডানো হলো হজের একটি অন্যতম কাজ। ইমাম নাবাবী (রহঃ) এটিই বলেছেন। এটিই অধিকাংশ আহলে ’ইলমের মত এবং ইমাম শাফি’ঈর সঠিক অভিমত। তবে এ বিষয়ে পাঁচ ধরনের বক্তব্য রয়েছে যার মধ্যে সবচেয়ে সঠিক বক্তব্য হলো এটি হজ্জ/হজ এবং ’উমরার একটি রুকন যা ব্যতীত হজ্জ/হজ এবং ’উমরা বিশুদ্ধ হবে না।
সহীহ মুসলিমের ভাষ্যকার ইমাম নাবাবী (রহঃ) বলেন, আমাদের প্রসিদ্ধ অভিমত হলো হলক (মাথা মুন্ডানো) বা ক্বসর (চুল খাটো করা) হজের এবং ’উমরার কাজ এবং উভয়ের রুকনসমূহের মাঝে একটি অন্যতম রুকন যা ব্যতীত হজ্জ/হজ এবং ’উমরা সম্পূর্ণ হবে না। সকল ’উলামা এ অভিমতই ব্যক্ত করেছেন।
ইমাম বুখারী (রহঃ) সহীহুল বুখারীতে অধ্যায় রচনা করেছেন,(بَابُ الْحَلْقِ وَالتَّقْصِيْرِ عِنْدَ الْإِحْلَالِ) (ইহরাম থেকে মুক্ত হওয়ার সময় মাথা মুন্ডানো এবং মাথার চুল খাটো করা) ইবনু মুনযীর তার হাশিয়াতে বলেছেন, ইমাম বুখারী এ অধ্যায় রচনার দ্বারা বুঝিয়েছেন যে, মাথা মুন্ডানো নুসুক্ব বা হজের এবং ’উমরার কাজ। যেমন ইমাম বুখারী (রহঃ) এ বিষয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাথা মুণ্ডনকারীর জন্য যে দু’আ করেছেন তার দ্বারা দলীল পেশ করেছেন। দু’আ তো সাওয়াবের ইঙ্গিতবাহী। আর ’ইবাদাতের জন্য সাওয়াব পাওয়া যায় মুবাহ কাজের জন্য নয়। অনুরূপ তার হলককে তাক্বসীরের উপর প্রাধান্য দানটি এ বিষয়ের ইঙ্গিতবাহী। কেননা মুবাহ কর্মের একটির উপর অপরটিকে প্রাধান্য দেয়া হয় না।
হলক তথা মাথা মুন্ডানো যে নুসুক্ব তথা হজ্জ/হজ এবং ’উমরার একটি অত্যাবশ্যকীয় কর্ম এটি জমহূরের বক্তব্য। এ বিষয়ে তারা কুরআন এবং সুন্নাহ থেকে বেশ কিছু দলীল প্রদান করে এর প্রমাণ করেছেন যে, তা নুসুক্ব।
২৬৪৬-[১] ’আব্দুল্লাহ ইবনু ’উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর কিছু সাহাবী বিদায় হজে মাথা মুণ্ডন করেছিলেন। আবার (সাহাবীগণের) কেউ কেউ মাথার চুল ছেটে (ছোট করে) ছিলেন। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
بَابُ الْحَلْقِ
عَنِ ابْنِ عُمَرَ: أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حَلَقَ رَأْسَهُ فِي حَجَّةِ الْوَدَاعِ وَأُنَاسٌ مِنْ أَصْحَابِهِ وَقَصَّرَ بَعْضُهُمْ
ব্যাখ্যা: হাদীসের ভাষ্য হলো বিদায় হজ্জে তার মাথা মুন্ডিয়েছেন এবং তার কিছু সাহাবীও প্রথমত তার অনুসরণ করণার্থে, দ্বিতীয়ত তিনি মাথা মুণ্ডনকারীদের জন্য দুইবার বা তিনবার যে দু‘আ করেছেন সে দু‘আর বারাকাত লাভের উদ্দেশে মাথা মুণ্ডন করেছেন। আর কতিপয় সাহাবী তিনি মাথার চুল খাটো করার যে ছাড় দিয়েছেন তা গ্রহণার্থে মাথার চুল ছোট করেছেন। যেহেতু তিনি শেষের বার যারা মাথার চুল ছোট করে তাদের জন্যও দু‘আ করেছেন। যে সাহাবী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মাথা মুন্ডিয়ে দিয়েছিলেন সঠিক মতানুসারে তিনি হলেন মা‘মার বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন নাযলাহ্। আর যিনি হুদায়বিয়ার সময় তার মাথা মুন্ডিয়ে ছিলেন তিনি হলেন খারাশ বিন উমাইয়্যাহ্ আল খুযা‘ঈ।
পরিচ্ছেদঃ ৮. প্রথম অনুচ্ছেদ - মাথার চুল মুণ্ডন করার প্রসঙ্গে
২৬৪৭-[২] ’আব্দুল্লাহ ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, মু’আবিয়াহ্(রাঃ) আমাকে বলেছেন, আমি মারওয়ার কাছে কাঁচি দিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মাথার চুল ছেঁটেছি। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
بَابُ الْحَلْقِ
وَعَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ: قَالَ لِي مُعَاوِيَةُ: إِنِّي قَصَّرْتُ مِنْ رَأْسِ النَّبِيِّ صلى الله عَلَيْهِ وَسلم عِنْد الْمَرْوَة بمشقص
ব্যাখ্যা: হাদীসের ভাষ্য হলো মু‘আবিয়াহ্ (রাঃ) ইবুন ‘আব্বাস (রাঃ) কে বললেন যে, তিনি মারওয়াতে কাঁচি দ্বারা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চুল ছোট করে দিয়েছেন। এ হাদীস দ্বারা ঐ সকল ব্যক্তিগণ দলীল পেশ করেছেন যারা মাথা মুন্ডানোর ন্যায় মাথার কিছু চুল ছোট করাকে যথেষ্ট মনে করেন। কেননা, (قَصَّرْتُ مِنْ رَأْسِ) বাহ্যিকভাবে কিছু অর্থ বোঝাচ্ছে। এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো চুল ছোট করার ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি না করা এমনভাবে যাতে চুলের গোড়া পর্যন্ত কেটে নেয়া হয়। এটি উদ্দেশ্য নয় যে, মাথার কিছু অংশ কেটে এবং কিছু অংশ ছেড়ে দিলেই যথেষ্ট হবে।
ইমাম নাবাবী (রহঃ) বলেন, এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, চুল শুধুমাত্র ছোট করাও বৈধ যদিও মাথা মুন্ডানো উত্তম। আর এ ক্ষেত্রে হজ্জ/হজ এবং ‘উমরা পালনকারী উভয়েই সমান। তবে তামাত্তু' হজ্জ/হজ পালনকারীর জন্য মুস্তাহাব হল ‘উমরাতে মাথার চুল ছোট করা আর হজ্জে মাথা মুন্ডানো যাতে হজ্জ/হজ মাথা মুন্ডানোটা দু’টি ‘ইবাদাতের মধ্যে যেটি পূর্ণাঙ্গ সেটির ক্ষেত্রে সংঘটিত হয়। ‘উমরা পালনকারী মারওয়াতে তার মাথার চুল ছোট করবে বা মাথা মুন্ডাবে যেহেতু সেটি তার হালাল হওয়ার স্থান। আর হজ্জ/হজ পালনকারী মিনা প্রান্তরে তার মাথা মুন্ডাবে বা মাথার চুল ছোট করবে। যেহেতু সেটি তার হালাল হওয়ার স্থান। অতঃপর এ হাদীসে একটি জটিলতা রয়েছে যে, মু‘আবিয়াহ্ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চুল ছোট করেছেন মর্মে যে সংবাদ দিয়েছেন তা হজ্জে ছিল, না ‘উমরায় ছিল। কারণ হজ্জে মাথা মুন্ডানো বা মাথার চুল ছোট করা হয়, মিনায় মারওয়ায় নয়। তাহলে তা ছিল ‘উমরায়। তবে তা কোন্ ‘উমরায় ছিল এ নিয়ে মুহাদ্দিসগণ মতবিরোধ করেছেন এবং প্রত্যেকে তার বক্তব্যের পিছনে দলীল দিয়েছেন। তবে সঠিক বক্তব্য হলো তা ছিল ‘উমরাতুল জি‘রানাহ্-তে যেমনটি ইমাম নাবাবী, ইমাম ত্ববারী ও ইমাম ইবনুল ক্বইয়্যিম (রহঃ) বলেছেন।
পরিচ্ছেদঃ ৮. প্রথম অনুচ্ছেদ - মাথার চুল মুণ্ডন করার প্রসঙ্গে
২৬৪৮-[৩] ’আব্দুল্লাহ ইবনু ’উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজে বলেছেনঃ হে আল্লাহ! যারা মাথার চুল মুন্ডিয়েছে তাদের ওপর তুমি রহমত করো। সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! মাথা ছেঁটেছে যারা তাদের প্রতিও। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, হে আল্লাহ! যারা মাথার চুল মুন্ডিয়েছে তাদের প্রতি তুমি রহমত বর্ষণ করো। সাহাবীগণ করলেন, হে আল্লাহর রসূল! যারা মাতা ছেঁটেছে তাদের প্রতিও। এবার তৃতীয়বার তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, যারা মাথা ছেঁটেছে তাদের প্রতিও। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
بَابُ الْحَلْقِ
وَعَنِ ابْنِ عُمَرَ: أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ فِي حَجَّةِ الْوَدَاعِ: «اللَّهُمَّ ارْحَمِ الْمُحَلِّقِينَ» . قَالُوا: وَالْمُقَصِّرِينَ يَا رَسُولَ اللَّهِ؟ قَالَ: «اللَّهُمَّ ارْحَمِ الْمُحَلِّقِينَ» . قَالُوا: وَالْمُقَصِّرِينَ يَا رَسُولَ اللَّهِ؟ قَالَ: «وَالْمُقَصِّرِينَ»
ব্যাখ্যা: হাদীসের ভাষ্য হলো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজ্জে বললেন, হে আল্লাহ! তুমি মাথা মুণ্ডনকারীদের প্রতি করুণা করুন। সাহাবীদের আরযের প্রেক্ষিতে তিনি তৃতীয় বা চতুর্থবার বললেন, মাথার চুল ছোটকারীদের প্রতিও করুণা করুন। কোন সময় নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু‘আ করেছেন বিদায় হজ্জে নাকি হুদায়বিয়ায় এ নিয়ে ‘উলামাগণ মতবিরোধ করেছেন। যেহেতু এ বিষয়ে বর্ণিত বর্ণনাগুলোর মাঝে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়েছে। ইমাম ইবনু ‘আবদুল বার (রহঃ) বলেছেন, এটি হুদায়বিয়ার সময় হয়েছে। ইমাম নাবাবী (রহঃ) বলেছেন, বিশুদ্ধ বহুল প্রচলিত বক্তব্য হলো এটি বিদায় হজ্জে ছিল। কাযী ‘ইয়ায বলেন, এটি খুব দূরবর্তী বক্তব্য নয় যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটি উভয় স্থানেই বলেছেন। এ মতভেদের কারণ হলো, এক্ষেত্রে যে বর্ণনাগুলো এসেছে তার কিছুতে বিদায় হজ্জের কথা এসেছে আর কিছুতে হুদায়বিয়ার কথা এসেছে।
ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেন, উভয় স্থানে বলেছেন এ বক্তব্যটি সুনির্দিষ্ট। তবে উভয় স্থানে বলার কারণটি ভিন্ন। হুদায়বিয়ায় এ দু‘আ করেছেন, কারণ কাফিররা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবীদের মক্কায় প্রবেশে বাধা দিলে উভয় পক্ষের মাঝে এ মর্মে সন্ধি হয় যে, আগামী বছর তারা ‘উমরা করবে। ফলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের ইহরাম মুক্ত হওয়ার আদেশ দিলে তারা মনের দুঃখে তা থেকে বিরত থাকে। তখন উম্মু সালামাহ (রাঃ) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে তাদের পূর্বে নিজের মাথা মুণ্ডন করার পরামর্শ দিলে তিনি তাই করেন। অতঃপর তারা তার অনুসরণ করে ফলে কেউ মাথা মুণ্ডন করেন আবার কেউ মাথার চুল ছোট করেন। যেহেতু যারা মাথা মুণ্ডন করেছেন তারা তার আদেশ পালনে দ্রুত অগ্রসর হয়েছে, তাই তাদের জন্য বেশি দু‘আ করেছেন আর যারা মাথার চুল ছোট করেছেন তারা একটু দ্বিধা করেছেন, তাই তাদের জন্য একবার হয়েছে।
আর বিদায় হজ্জে মাথা মুণ্ডনকারীদের জন্য বারবার দু‘আ করার কারণ সম্পর্কে ইবনুল আসীর ‘‘আন নিহায়াহ্’’ গ্রন্থে বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে হজ্জ/হজকারী অধিকাংশ সাহাবী সাথে হাদী বা কুরবানীর পশু আনেননি। অতঃপর যখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাদেরকে হজ্জের নিয়্যাত বাতিল করে ইহরাম মুক্ত হয়ে মাথা মুন্ডানোর আদেশ দিলেন তখন তা তাদের উপর কঠিন হয়ে গেল। আর আনুগত্য ভিন্ন অন্য কোন পথ না থাকায় মাথার চুল ছোট করাটাই তাদের মনে অধিক হালকা মনে হল মাথা মুন্ডানোর চেয়ে, তাই অধিকাংশ সাহাবী মাথার চুল ছোট করলেন। আর আদেশ পালনে পরিপূর্ণ হওয়ায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাথা মুণ্ডনকারীদের কাজকে প্রাধান্য দিলেন।
মাথার চুল মুণ্ডন বা ছোট করার পরিমাণ নিয়ে ‘উলামাগণ মতবিরোধ করেছেন। এ মর্মে ইমামদের বক্তব্যগুলো উল্লেখ করে ‘আল্লামা শানক্বীত্বী (রহঃ) বলেন, আমার নিকট সবচেয়ে শক্তিশালী বক্তব্য হলো মাথার চুল ছোট করার ক্ষেত্রে প্রতিটি চুল বেছে বেছে ছোট করা আবশ্যক নয়। কারণ এতে বড় ধরনের অসুবিধা রয়েছে। মাথার সকল প্রান্তের চুল ছোট করাই যথেষ্ট তবে মাথার একচতুর্থাংশ বা একতৃতীয়াংশ চুল ছোট করা যথেষ্ট নয় যেটি হানাফী ও শাফি‘ঈদের বক্তব্য। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, رؤوسكم তিনি বলেননি যে, তোমাদের মাথার কিছু দিকের চুল মুণ্ডন কর।
আয়াতের বাহ্যিক অর্থ সমস্তটুকু মুন্ডানো বা সমস্তটাই ছোট করা। আর আয়াতের বাহ্যিক অর্থ থেকে দলীল ছাড়া অন্য অর্থ নেয়া বৈধ নয়। কেননা, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সন্দেহজনক বিষয় ছেড়ে সন্দেহহীন বিষয়ে ধাবিত হও। হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, মাথা মুণ্ডন না করে চুল ছোট করাও যথেষ্ট বা বৈধ।
পরিচ্ছেদঃ ৮. প্রথম অনুচ্ছেদ - মাথার চুল মুণ্ডন করার প্রসঙ্গে
২৬৪৯-[৪] ইয়াহ্ইয়া ইবনু হুসায়ন তাঁর দাদী হতে বর্ণনা করেছেন। তাঁর দাদী বলেছেন, আমি বিদায় হজে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে মাথার চুল মুণ্ডনকারীদের জন্য তিনবার এবং যারা ছেঁটেছেন তাদের জন্য একবার দু’আ করতে শুনেছি। (মুসলিম)[1]
بَابُ الْحَلْقِ
وَعَن يحيى بن الْحصين عَن جدته أَنَّهَا سَمِعَتِ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي حَجَّةِ الْوَدَاعِ دَعَا لِلْمُحَلِّقِينَ ثَلَاثًا وَلِلْمُقَصِّرِينَ مرّة وَاحِدَة. رَوَاهُ مُسلم
ব্যাখ্যা: (عَنْ جَدَّتِه) তিনি হলেন উম্মুল হুসায়ন বিনতু ইসহাক মহিলা সাহাবী। এখানে তার নাম উল্লেখ করা হয়নি। ইবনু ‘আবদুল বার (রাহঃ) বলেন, উম্মুল হুসায়ন বিনতু ইসহাক-এর নিকট থেকে তারই নাতি ইয়াহ্ইয়া বিন হুসায়ন ও আল ‘আয়যার বিন হারিস হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং তিনি বিদায় হজ্জে উপস্থিত ছিলেন। হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী বলেন, ইবনু ‘আবদুল বার এ মহিলা সাহাবীর পিতার নাম উল্লেখ করেছেন ‘‘ইসহাক’’। আমিও তাই মনে করি। আর তার থেকে আল ‘আয়যার বিন হারিস-এর বর্ণনা করার বিষয়টি ইবনু মানদূহ (রহঃ)-এর নিকট প্রমাণিত। এমনকি ইমাম আহমাদ-এর নিকটও প্রমাণিত। তবে সেখানে ত্বরিক বিন ইউনুস-এর মধ্যস্থতা বিদ্যমান। (আহমাদ ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪০২)
এ পর্যায়ে আল ‘আয়যার ইবনু হারিস এর বর্ণনাটি নিম্নে উল্লেখ করছিঃ তিনি বলেন, আমি উম্মুল হুসায়ন বিনতু ইসহাককে বলতে শুনেছি। তিনি (উম্মুল হুসায়ন) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে চাদর গায়ে দেখেছি।
(أَنَّهَا سَمِعَتِ النَّبِىَّ ﷺ فِىْ حَجَّةِ الْوَدَاعِ) হাদীসের এ অংশটুকু প্রমাণ করছে যে, উম্মুল হুসায়ন (রাঃ) বিদায় হজ্জে উপস্থিত ছিলেন। অপরদিকে মাথা মুণ্ডনকারীদের জন্য তিনবার আর চুল খাটোকারীদের জন্য একবার দু‘আর সময়টি ছিল ‘‘হাজ্জাতুল ওয়াদা’’ তথা বিদায় হজ্জের সময়।
পরিচ্ছেদঃ ৮. প্রথম অনুচ্ছেদ - মাথার চুল মুণ্ডন করার প্রসঙ্গে
২৬৫০-[৫] আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিনায় পৌঁছে প্রথমে জামারাতে গেলেন এবং কংকর মারলেন। অতঃপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মিনায় উপস্থিত তাঁর তাবুতে এলেন এবং নিজের কুরবানীর পশুগুলো যাবাহ করলেন। তারপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নাপিত ডেকে এনে তাঁর মাথার ডানদিক (তার দিকে) বাড়িয়ে দিলেন। নাপিত তা মুগুন করলো। তারপর তিনি আবূ তলহা আল আনসারীকে ডেকে এনে তা (চুলগুলো) দিলেন। এরপর (নাপিতের দিকে) মাথার বামদিক বাড়িয়ে দিলেন এবং বললেন, মুণ্ডন করো। সে তা মুণ্ডন করলো। এটাও তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মুন্ডিত চুল আবূ ত্বলহাহকে দিয়ে বললেন, যাও মানুষের মাঝে এগুলো বিলিয়ে দাও। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
بَابُ الْحَلْقِ
وَعَنْ أَنَسٍ: أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَتَى مِنًى فَأَتَى الْجَمْرَةَ فَرَمَاهَا ثُمَّ أَتَى مَنْزِلَهُ بِمِنًى وَنَحَرَ نُسُكَهُ ثُمَّ دَعَا بِالْحَلَّاقِ وَنَاوَلَ الْحَالِقَ شِقَّهُ الْأَيْمَنَ ثُمَّ دَعَا أَبَا طَلْحَةَ الْأَنْصَارِيَّ فَأَعْطَاهُ إِيَّاهُ ثُمَّ نَاوَلَ الشِّقَّ الْأَيْسَرَ فَقَالَ «احْلِقْ» فَحَلَقَهُ فَأعْطَاهُ طَلْحَةَ فَقَالَ: «اقْسِمْهُ بَيْنَ النَّاسِ»
ব্যাখ্যা: (فَرَمَاهَا ثُمَّ أَتٰى مَنْزِلَه بِمِنًى) হাদীসের এ অংশটি দ্বারা বুঝা যায় যে, জামারায় ‘আক্বাবাতে ‘আসর আদায়ের পর সর্বপ্রথম কাজ হচ্ছে পাথর নিক্ষেপ করা আর এটা হচ্ছে মুস্তাহাব। অতঃপর তিনি মিনাতে নামবেন।
(وَنَحَرَ نُسُكَه) এবং তার কুরবানীর পশুটি কুরবানী দিবে। এখানে নুসুক দ্বারা উদ্দেশ্য হলো সেই উট যে উটটি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিয়ে এসেছিলেন কুরবানীর উদ্দেশে। অবশ্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ হাতে ৬৩টি কুরবানী দিয়ে অবশিষ্টগুলো কুরবানী করার জন্য ‘আলী (রাঃ)-কে আদেশ করেছেন সর্বমোট কুরবানীর সংখ্যা ছিল ১০০টি। হাদীসের এ অংশটি থেকে বুঝা যায়, মিনাতে কুরবানী দেয়া মুস্তাহাব (ভাল), তবে হারাম এলাকার যে কোন স্থানে কুরবানী দেয়া যায়। যেহেতু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, (كل منى منحر وكل نجاج مكة منحر) মিনার প্রতিটি স্থানে ও মক্কার প্রতিটি গলি কুরবানীর স্থান হিসেবে বিবেচিত।
(ثُمَّ دَعَا بِالْحَلَّاقِ) অতঃপর তিনি মুণ্ডনকারীদেরকে ডাকলেন আর তার নাম ছিল মা‘মার বিন ‘আবদুল্লাহ আল ‘আদাবী। (وَنَاوَلَ الْحَالِقَ شِقَّهُ) এবং মাথা হালক্বকারী তার পার্শ্ব নাগালে নিয়ে আসলো। (الْأَيْمَنَ) ডান পার্শ্ব দেশ। অর্থাৎ- মাথা মুণ্ডনকারী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মাথা ডান পার্শ্বদেশ হলক করে দিয়েছিলেন।
(فَحَلَقَه) হাদীসের এ অংশটি দ্বারা বুঝা যায় যে, মাথার ডান পাশ থেকে হলক করা মুস্তাহাব (ভাল) আর এটাই (জমহূর) অধিকাংশ ‘আলিমের মত। তবে ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ) বলেন, বাম পাশের কথা।
‘আল্লামা ত্বীবী (রগঃ) বলেন, এ হাদীসই প্রমাণ করছে যে, ডান দিক থেকে হলক করা মুস্তাহাব। তবে কোন কোন ‘আলিম বলেন, বাম দিক থেকে হলক করাই মুস্তাহাব।
‘আল্লামা মুল্লা ‘আলী কারী বলেন, বাম দিক থেকে হলক করা উত্তম হওয়ার কারণ হলো যাতে করে হলককারী ডান দিক হয়। মূলত এ মতটি ইমাম আবূ হানীফার। ‘আল্লামা মুল্লা ‘আলী কারী হানাফী (রহঃ)-এর নয়। কারণ তিনি এ মত থেকে ফিরে এসেছেন। ঘটনাটি এমন যে, তিনি প্রথমে হলককারীর ডান দিকের কথা বিবেচনা করে বাম দিক থেকে মুন্ডানো শুরু করার কথা বলেছেন, কিন্তু যখন তিনি বুঝতে পারলেন যে, তার বুঝ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীসের সাথে বিপরীত হয়ে গেছে তখন হাদীস গ্রহণ করতঃ নিজের মত বর্জন করেছেন।
তবে মাথা মুন্ডনের সময় মুণ্ডনকারী মুণ্ডনকৃত ব্যক্তির পিছনে দাঁড়াবে তাহলে দু' জনের মাঝে সমন্বয় করা সম্ভব হয় এবং অত্র মাস্আলাতে দৃশ্যমান যে মতবিরোধ রয়েছে তা বিদূরিত হয়। আর যদি সমন্বয় অসম্ভব হয় তাহলে হাদীসে আনাস -কে কিয়াসের উপর প্রাধান্য দেয়া আবশ্যক।
ইবনু ‘আবিদীন তাঁর ‘রদ্দুল মুহতার’ কিতাবের ২য় খণ্ডে ২৪৯ পৃষ্ঠায় বলেন, হানাফী ‘আলিমরা মতামত দিয়েছেন যে, ডান বলতে এখানে মুণ্ডনকারীর ডানকে বুঝানো হয়েছে, যার মুণ্ডন করা হচ্ছে তার ডান এখানে উদ্দেশ্য নয়।
তবে সহীহায়নে বর্ণিত হাদীস এ মতের বিপরীত অর্থ বহন করছে। আর সে হাদীসটি হচ্ছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুন্ডনকারীকে বললেন, তুমি শুরু কর ডান পাশ থেকে, অতঃপর বাম পাশে করবে। এ হাদীসের সমর্থন করে হানাফী ‘আলিম ইবনুল হুমাম তার ‘‘আল ফাত্হ’’ কিতাবে বলেছেন, হ্যাঁ এটাই সঠিক যদিও তা আমাদের মাযহাবের খেলাফ।
(ثُمَّ دَعَا أَبَا طَلْحَةَ الْأَنْصَارِىَّ) আবূ তলহা আল আনসারী তিনি হলেন, উম্মু সালামার স্বামী আনাস এর যিনি মাতা এবং আনাস (রাঃ) হলেন অত্র হাদীসটির বর্ণনাকারী। আবূ ত্বলহার নাম হচ্ছে যায়দ বিন সাহল আন্ নাজারী।
‘আল্লামা মুল্লা ‘আলী কারী হানাফী (রহঃ) বলেন, আবূ তলহা এবং তার পরিবার-পরিজনের সাথে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সম্পর্ক অন্যান্যদের তুলনায় একটু বেশি ছিল। এত গভীর মুহাববাত সম্পর্ক তাদের মাঝে গড়ে উঠেছিল যা অন্যান্য মুহাজির আনসারদের সাথে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হয়নি।
ইমাম নাবাবী (রহঃ) বলেন, অত্র হাদীসটিতে শিক্ষণীয় নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়-
মুযদালাফাহ্ থেকে মিনায় ফিরে এসে কুরবানীর দিনে হজ্জের কার্যাবলী চারটি, যথাঃ
১. জামারায়ে ‘আক্বাবাতে কংকর নিক্ষেপ করা।
২. কুরবানী করা।
৩. মাথা মুন্ডানো অথবা চুল খাটো করা।
৪. মক্কায় প্রবেশ করা এবং তাওয়াফে ওয়াদা' তথা বিদায়ী তাওয়াফ করা। এগুলোর প্রত্যেকটিই অত্র হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে তাওয়াফে ইফাযাহ্ ব্যতীত।
এগুলো কাজের ক্ষেত্রে নিয়ম হলো তা করতে হবে ধারাবাহিকতা বজায় রেখে। তবে যদি ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে না পারে তাহলে কোন অসুবিধা নেই। যেহেতু নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, (افعل ولا حرج) ধারাবাহিকতা বজায় না রেখেও করতে পার কোন সমস্যা নেই।
অত্র হাদীসের আরো কয়েকটি উপকারিতা নিম্নরূপঃ
১. মানুষের চুল পাক আর এটাই জমহূর ‘উলামায়ে কিরামের অভিমত।
২. নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চুলের মাধ্যমে বারাকাত নেয়া বৈধ এবং বারাকাতের উদ্দেশে তা সংগ্রহ করা বৈধ।
৩. ইমাম অথবা নেতৃজনের উচিত অধীনস্থদের প্রতি কোন কিছু বণ্টনের সময়ে পরস্পর সহমর্মিতা বজায় রাখা।
৪. হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেন, (المواساة) তথা সহমর্মিতা المساواة-কে আবশ্যক করে না। অর্থাৎ- সহমর্মিতার অর্থ এটা নয় যে, উপঢৌকন বা হাদিয়্যাহ্ প্রাপ্তির দৃষ্টিকোণ থেকে সবাই সমান হাক্বদার হবে। এ ক্ষেত্রে কিছু বেশি কম হতে পারে।
৫. যারা দলের নেতৃত্ব দিবেন তাদেরকে একটু অতিরিক্ত কিছু দেয়া বৈধ।
৬. ‘আল্লামা ‘আয়নী (রহঃ) বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসরণ করে কেউ যদি মাথা মুণ্ডন করেন তাহলে তা সুন্নাত বা মুস্তাহাব বলে গণ্য হবে।
‘আল্লামা যুরক্বানী (রহঃ) বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার চুল সহাবায়ে কিরামের মাঝে এ জন্য বণ্টন করে দিয়েছিলেন যাতে করে তা তাদের জন্য বারাকাত বয়ে নিয়ে আসে এবং তারা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে স্মরণে রাখতে পারে। আর এটা যেন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মৃত্যুর সময় সন্নিকটের কথার প্রতি ইঙ্গিত করছে। আর আবূ তলহা (রাঃ)-কে বণ্টনের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট করার কারণ হলো আবূ তলহা-ই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কবর খনন করেছিলেন।
পরিচ্ছেদঃ ৮. প্রথম অনুচ্ছেদ - মাথার চুল মুণ্ডন করার প্রসঙ্গে
২৬৫১-[৬] ’আয়িশাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ইহরাম বাঁধার আগে এবং কুরবানীর দিন বায়তুল্লাহ তাওয়াফের আগে এমন সুগন্ধি লাগিয়েছি যাতে মিশক (কস্ত্তরী) ছিল। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
بَابُ الْحَلْقِ
وَعَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا قَالَتْ: كُنْتُ أُطَيِّبُ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قِبَلَ أَنْ يُحْرِمَ وَيَوْمَ النَّحْرِ قَبْلَ أَنْ يَطُوفَ بِالْبَيْتِ بِطِيبٍ فِيهِ مِسْكٌ
ব্যাখ্যা: (كُنْتُ أُطَيِّبُ رَسُولِ اللّٰهِ ﷺ قِبَلَ أَنْ يُحْرِمَ) হাদীসের এ অংশটি থেকে বুঝা যায় যে, ইহরামের পূর্বে সুগন্ধি ব্যবহার শুধু বৈধই নয় বরং মুস্তাহাব। ইহরামের পরে সুগন্ধির রং, আলামাত (চিহ্ন) অবশিষ্ট থাকুক বা না থাকুক। এ মতই পেশ করেছেন ইমাম শাফি‘ঈ, আহমাদ, আবূ হানীফা, সাওরী (রহঃ) আর এটাই জমহূর ‘উলামায়ে কিরামের অভিমত। কিন্তু ইমাম মালিক (রহঃ) বলেছেন, ইহরামের সময় ইচ্ছা করলে সুগন্ধি ব্যবহার করা মাকরূহ যদি ইহরামের পরে তার চিহ্ন, দাগ ইত্যাদি বাকি থাকো। এ মতকে পছন্দ করেছেন মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান ও ইমাম ত্বহাবী (রহঃ)।
(وَيَوْمَ النَّحْرِ قَبْلَ أَنْ يَطُوفَ بِالْبَيْتِ) এখানে তাওয়াফ বলতে প্রথম হালাল যেটা মাথা হলকের মাধ্যমে হতে হয় সেই তাওয়াফে ইফাযাহ্ উদ্দেশ্য।
(مِسْكٌ) অত্র হাদীস থেকে বুঝা যায় তাওয়াফে ইফাযাহ্-এর পূর্বে এবং কংকর নিক্ষেপ, মাথা মুন্ডনের পরে সুগন্ধি ব্যবহার বৈধ। আর এ কথাই বলেছেন, ইমাম শাফি‘ঈ, আহমাদ ও আবূ হানীফা (রহঃ)। তবে ইমা মালিক এটাকে মাকরূহ বলেছেন।
পরিচ্ছেদঃ ৮. প্রথম অনুচ্ছেদ - মাথার চুল মুণ্ডন করার প্রসঙ্গে
২৬৫২-[৭] ’আব্দুল্লাহ ইবনু ’উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানীর দিন মক্কায় গিয়ে তাওয়াফে ইফাযাহ্ (তাওয়াফে যিয়ারা) করলেন। এরপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মিনায় ফিরে যুহরের সালাত (সালাত/নামাজ/নামায) আদায় করলেন। (মুসলিম)[1]
بَابُ الْحَلْقِ
وَعَنِ ابْنِ عُمَرَ: أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَفَاضَ يَوْمَ النَّحْرِ ثُمَّ رجعَ فصلّى الظهْرَ بمنى. رَوَاهُ مُسلم
ব্যাখ্যা: (أَفَاضَ يَوْمَ النَّحْرِ) অর্থাৎ- নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কংকর নিক্ষেপ ও মাথা মুণ্ডন করার পর ফরয তাওয়াফ তবওয়াফে যিয়ারহ্ ও তাওয়াফে ইফাযাহ্ করেছেন সকালে, অতঃপর তিনি মিনা থেকে মক্কায় অবতরণ করেছেন।
(فَصَلَّى الظُّهْرَ بِمِنٰى) এখান থেকে পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাওয়াফে ইফাযাহ্ করেছিলেন দুপুরে। আর মক্কা থেকে ফিরে আসার পর মিনায় সালাতে যুহর আদায় করেছেন। এ মতের সমর্থনে অপর একটি দীর্ঘ হাদীসও আছে যা জাবির (রাঃ) বর্ণনা করেছেন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হজ্জের বিষয় বর্ণনা প্রসঙ্গে। তবে সালাতের স্থান নিয়ে মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে এমনি একটি হাদীস রয়েছে যেমন বর্ণিত আছে,
ثم ركب رسول الله صلى الله عليه وسلم فافاض إلى البيت فصلى بمكة الظهر অর্থাৎ- রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সওয়ারীতে আরোহণ করলেন, অতঃপর বায়তুল্লাহ গেলেন এবং মক্কায় সালাতে যুহর আদায় করলেন।
এখানে স্পষ্ট হলো যে, আল্লাহর নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে দ্বিপ্রহরে মক্কা অভিমুখী হয়েছিলেন তা হচ্ছে ইয়াওমুন্ নাহরের দ্বিপ্রহরে এবং ইয়াওমুন্ নাহরের যুহর সালাত (সালাত/নামাজ/নামায) তিনি মক্কায় আদায় করেছেন। তদ্রূপ ‘আয়িশাহ্ (রাঃ) বলেছেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইয়াওমুন্ নাহরে তাওয়াফ করেছেন এবং সালাতুয্ যুহর আদায় করেছেন মক্কায়।
সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি, হাদীস দু’টিতে তাওয়াফের সময় নিয়ে কোন মতপার্থক্য নেই, মতপার্থক্য আছে শুধু সালাতের স্থান নিয়ে।
সালাতের স্থান সংক্রান্ত মতবিরোধের সমাধানঃ নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুহরের সালাত (সালাত/নামাজ/নামায) মক্কায় আদায় করেছেন যেমনটা বলেছেন জাবির (রাঃ) ও ‘আয়িশাহ্ (রাঃ)। অতঃপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মিনায় প্রত্যাবর্তন করে সাহাবীদের নিয়ে পুনরায় সালাত আদায় করেছেন। যেমনি তিনি সাহাবীগণের নিয়ে সালাতুল খাওফ (শত্রুর ভয়ের মুহূর্তে যে সালাত আদায় করা হয়ে থাকে) আদায় করেছেন দু’বার।
প্রথমবার সাহাবীগণের একদল নিয়ে দ্বিতীয়বার সাহাবীগণের অপর দল নিয়ে বাতনে নাখলে। তাই, ‘আয়িশাহ্ (রাঃ) ও জাবির (রাঃ) মক্কাতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সালাত আদায় করতে দেখে তাই বর্ণনা করেছেন যা দেখেছেন তাই তারা সত্য বলেছেন আবার অপরদিকে ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার (রাঃ) নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে মিনায় সালাত আদায় করতে দেখেছেন, তাই বর্ণনা করেছেন তিনিও সত্য বলেছেন। ইমাম নাবাবী (রহঃ) সহ অনেকেই উক্ত বিষয়টির সমাধান এভাবে পেশ করেছেন। তবে অপরদিকে কিছু কিছু ‘উলামায়ে কিরাম উপরোক্ত মত বিরোধপূর্ণ মাস্আলাটির সমাধানে অন্য পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন। তাই তাদের কতকে একটি বর্ণনাকে অপরটির উপর অগ্রাধিকার দিয়েছেন।
উপরোক্ত বর্ণনায় তো বুঝা গেল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুপুরে তাওয়াফ করেছেন কিন্তু অন্যান্য কিছু বর্ণনাতে আবার রাতের কথাও এসেছে। ইমাম বুখারী তাঁর সহীহাহ্-তে বলেন, আবুয্ যুবায়র ‘আয়িশাহ্ (রাঃ) থেকে, ‘আয়িশাহ্ (রাঃ) ইবনে ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন, (أخر النبى صلى الله عليه وسلم الزيارة إلى الليل) অর্থাৎ- নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাওয়াফকে রাত পর্যন্ত বিলম্ব করলেন।
এ কথা সর্বজনবিদিত যে, ইমাম বুখারীর তা‘লীক্ব সবই সহীহ প্রমাণিত। এতদসত্ত্বেও অত্র বর্ণনাটিকে ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল, আবূ দাঊদ, তিরমিযী সহ অন্যান্যরা সুফিয়ান সাওরী আবুয্ যুবায়র-এর মাধ্যমে মুত্তাসিল সনদে বর্ণনা করেছেন। আর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রাতে তাওয়াফ করার বর্ণনাটি ‘আয়িশাহ্ (রাঃ), ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত যা পূর্বোক্ত বর্ণনার সাথে সাংঘর্ষিক, যে বর্ণনাটি জাবির ও ইবনু ‘উমার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন।
এ মতবিরোধের অনেকগুলো সমাধান রয়েছে যার কয়েকটি নিম্নরূপঃ
নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাওয়াফে যিয়ারহ্ করেছেন ইয়াওমুন্ নাহরের দিনে যেমনটি পাওয়া যায় জাবির, ‘আয়িশাহ্ ও ইবনু ‘উমার (রাঃ) এর বর্ণনায়। অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় রাতে ফিরে এসেছেন, অতঃপর মিনায় ফিরে গিয়ে সেখানে রাতযাপন করেছেন। মিনার রাতগুলোতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মক্কা আগমনটাই ‘আয়িশাহ্ (রাঃ) ও ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ)-এর উদ্দেশ্য।