২৬৫০

পরিচ্ছেদঃ ৮. প্রথম অনুচ্ছেদ - মাথার চুল মুণ্ডন করার প্রসঙ্গে

২৬৫০-[৫] আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিনায় পৌঁছে প্রথমে জামারাতে গেলেন এবং কংকর মারলেন। অতঃপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মিনায় উপস্থিত তাঁর তাবুতে এলেন এবং নিজের কুরবানীর পশুগুলো যাবাহ করলেন। তারপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নাপিত ডেকে এনে তাঁর মাথার ডানদিক (তার দিকে) বাড়িয়ে দিলেন। নাপিত তা মুগুন করলো। তারপর তিনি আবূ তলহা আল আনসারীকে ডেকে এনে তা (চুলগুলো) দিলেন। এরপর (নাপিতের দিকে) মাথার বামদিক বাড়িয়ে দিলেন এবং বললেন, মুণ্ডন করো। সে তা মুণ্ডন করলো। এটাও তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মুন্ডিত চুল আবূ ত্বলহাহকে দিয়ে বললেন, যাও মানুষের মাঝে এগুলো বিলিয়ে দাও। (বুখারী ও মুসলিম)[1]

بَابُ الْحَلْقِ

وَعَنْ أَنَسٍ: أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَتَى مِنًى فَأَتَى الْجَمْرَةَ فَرَمَاهَا ثُمَّ أَتَى مَنْزِلَهُ بِمِنًى وَنَحَرَ نُسُكَهُ ثُمَّ دَعَا بِالْحَلَّاقِ وَنَاوَلَ الْحَالِقَ شِقَّهُ الْأَيْمَنَ ثُمَّ دَعَا أَبَا طَلْحَةَ الْأَنْصَارِيَّ فَأَعْطَاهُ إِيَّاهُ ثُمَّ نَاوَلَ الشِّقَّ الْأَيْسَرَ فَقَالَ «احْلِقْ» فَحَلَقَهُ فَأعْطَاهُ طَلْحَةَ فَقَالَ: «اقْسِمْهُ بَيْنَ النَّاسِ»

وعن انس: ان النبي صلى الله عليه وسلم اتى منى فاتى الجمرة فرماها ثم اتى منزله بمنى ونحر نسكه ثم دعا بالحلاق وناول الحالق شقه الايمن ثم دعا ابا طلحة الانصاري فاعطاه اياه ثم ناول الشق الايسر فقال «احلق» فحلقه فاعطاه طلحة فقال: «اقسمه بين الناس»

ব্যাখ্যা: (فَرَمَاهَا ثُمَّ أَتٰى مَنْزِلَه بِمِنًى) হাদীসের এ অংশটি দ্বারা বুঝা যায় যে, জামারায় ‘আক্বাবাতে ‘আসর আদায়ের পর সর্বপ্রথম কাজ হচ্ছে পাথর নিক্ষেপ করা আর এটা হচ্ছে মুস্তাহাব। অতঃপর তিনি মিনাতে নামবেন।

(وَنَحَرَ نُسُكَه) এবং তার কুরবানীর পশুটি কুরবানী দিবে। এখানে নুসুক দ্বারা উদ্দেশ্য হলো সেই উট যে উটটি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিয়ে এসেছিলেন কুরবানীর উদ্দেশে। অবশ্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ হাতে ৬৩টি কুরবানী দিয়ে অবশিষ্টগুলো কুরবানী করার জন্য ‘আলী (রাঃ)-কে আদেশ করেছেন সর্বমোট কুরবানীর সংখ্যা ছিল ১০০টি। হাদীসের এ অংশটি থেকে বুঝা যায়, মিনাতে কুরবানী দেয়া মুস্তাহাব (ভাল), তবে হারাম এলাকার যে কোন স্থানে কুরবানী দেয়া যায়। যেহেতু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, (كل منى منحر وكل نجاج مكة منحر) মিনার প্রতিটি স্থানে ও মক্কার প্রতিটি গলি কুরবানীর স্থান হিসেবে বিবেচিত।

(ثُمَّ دَعَا بِالْحَلَّاقِ) অতঃপর তিনি মুণ্ডনকারীদেরকে ডাকলেন আর তার নাম ছিল মা‘মার বিন ‘আবদুল্লাহ আল ‘আদাবী। (وَنَاوَلَ الْحَالِقَ شِقَّهُ) এবং মাথা হালক্বকারী তার পার্শ্ব নাগালে নিয়ে আসলো। (الْأَيْمَنَ) ডান পার্শ্ব দেশ। অর্থাৎ- মাথা মুণ্ডনকারী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মাথা ডান পার্শ্বদেশ হলক করে দিয়েছিলেন।

(فَحَلَقَه) হাদীসের এ অংশটি দ্বারা বুঝা যায় যে, মাথার ডান পাশ থেকে হলক করা মুস্তাহাব (ভাল) আর এটাই (জমহূর) অধিকাংশ ‘আলিমের মত। তবে ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ) বলেন, বাম পাশের কথা।

‘আল্লামা ত্বীবী (রগঃ) বলেন, এ হাদীসই প্রমাণ করছে যে, ডান দিক থেকে হলক করা মুস্তাহাব। তবে কোন কোন ‘আলিম বলেন, বাম দিক থেকে হলক করাই মুস্তাহাব।

‘আল্লামা মুল্লা ‘আলী কারী বলেন, বাম দিক থেকে হলক করা উত্তম হওয়ার কারণ হলো যাতে করে হলককারী ডান দিক হয়। মূলত এ মতটি ইমাম আবূ হানীফার। ‘আল্লামা মুল্লা ‘আলী কারী হানাফী (রহঃ)-এর নয়। কারণ তিনি এ মত থেকে ফিরে এসেছেন। ঘটনাটি এমন যে, তিনি প্রথমে হলককারীর ডান দিকের কথা বিবেচনা করে বাম দিক থেকে মুন্ডানো শুরু করার কথা বলেছেন, কিন্তু যখন তিনি বুঝতে পারলেন যে, তার বুঝ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীসের সাথে বিপরীত হয়ে গেছে তখন হাদীস গ্রহণ করতঃ নিজের মত বর্জন করেছেন।

তবে মাথা মুন্ডনের সময় মুণ্ডনকারী মুণ্ডনকৃত ব্যক্তির পিছনে দাঁড়াবে তাহলে দু' জনের মাঝে সমন্বয় করা সম্ভব হয় এবং অত্র মাস্আলাতে দৃশ্যমান যে মতবিরোধ রয়েছে তা বিদূরিত হয়। আর যদি সমন্বয় অসম্ভব হয় তাহলে হাদীসে আনাস -কে কিয়াসের উপর প্রাধান্য দেয়া আবশ্যক।

ইবনু ‘আবিদীন তাঁর ‘রদ্দুল মুহতার’ কিতাবের ২য় খণ্ডে ২৪৯ পৃষ্ঠায় বলেন, হানাফী ‘আলিমরা মতামত দিয়েছেন যে, ডান বলতে এখানে মুণ্ডনকারীর ডানকে বুঝানো হয়েছে, যার মুণ্ডন করা হচ্ছে তার ডান এখানে উদ্দেশ্য নয়।

তবে সহীহায়নে বর্ণিত হাদীস এ মতের বিপরীত অর্থ বহন করছে। আর সে হাদীসটি হচ্ছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুন্ডনকারীকে বললেন, তুমি শুরু কর ডান পাশ থেকে, অতঃপর বাম পাশে করবে। এ হাদীসের সমর্থন করে হানাফী ‘আলিম ইবনুল হুমাম তার ‘‘আল ফাত্হ’’ কিতাবে বলেছেন, হ্যাঁ এটাই সঠিক যদিও তা আমাদের মাযহাবের খেলাফ।

(ثُمَّ دَعَا أَبَا طَلْحَةَ الْأَنْصَارِىَّ) আবূ তলহা আল আনসারী  তিনি হলেন, উম্মু সালামার স্বামী আনাস এর যিনি মাতা এবং আনাস (রাঃ) হলেন অত্র হাদীসটির বর্ণনাকারী। আবূ ত্বলহার নাম হচ্ছে যায়দ বিন সাহল আন্ নাজারী।

‘আল্লামা মুল্লা ‘আলী কারী হানাফী (রহঃ) বলেন, আবূ তলহা এবং তার পরিবার-পরিজনের সাথে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সম্পর্ক অন্যান্যদের তুলনায় একটু বেশি ছিল। এত গভীর মুহাববাত সম্পর্ক তাদের মাঝে গড়ে উঠেছিল যা অন্যান্য মুহাজির আনসারদের সাথে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হয়নি।

ইমাম নাবাবী (রহঃ) বলেন, অত্র হাদীসটিতে শিক্ষণীয় নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়-

মুযদালাফাহ্ থেকে মিনায় ফিরে এসে কুরবানীর দিনে হজ্জের কার্যাবলী চারটি, যথাঃ

১. জামারায়ে ‘আক্বাবাতে কংকর নিক্ষেপ করা।

২. কুরবানী করা।

৩. মাথা মুন্ডানো অথবা চুল খাটো করা।

৪. মক্কায় প্রবেশ করা এবং তাওয়াফে ওয়াদা' তথা বিদায়ী তাওয়াফ করা। এগুলোর প্রত্যেকটিই অত্র হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে তাওয়াফে ইফাযাহ্ ব্যতীত।

এগুলো কাজের ক্ষেত্রে নিয়ম হলো তা করতে হবে ধারাবাহিকতা বজায় রেখে। তবে যদি ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে না পারে তাহলে কোন অসুবিধা নেই। যেহেতু নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, (افعل ولا حرج) ধারাবাহিকতা বজায় না রেখেও করতে পার কোন সমস্যা নেই।

অত্র হাদীসের আরো কয়েকটি উপকারিতা নিম্নরূপঃ

১. মানুষের চুল পাক আর এটাই জমহূর ‘উলামায়ে কিরামের অভিমত।

২. নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চুলের মাধ্যমে বারাকাত নেয়া বৈধ এবং বারাকাতের উদ্দেশে তা সংগ্রহ করা বৈধ।

৩. ইমাম অথবা নেতৃজনের উচিত অধীনস্থদের প্রতি কোন কিছু বণ্টনের সময়ে পরস্পর সহমর্মিতা বজায় রাখা।

৪. হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেন, (المواساة) তথা সহমর্মিতা المساواة-কে আবশ্যক করে না। অর্থাৎ- সহমর্মিতার অর্থ এটা নয় যে, উপঢৌকন বা হাদিয়্যাহ্ প্রাপ্তির দৃষ্টিকোণ থেকে সবাই সমান হাক্বদার হবে। এ ক্ষেত্রে কিছু বেশি কম হতে পারে।

৫. যারা দলের নেতৃত্ব দিবেন তাদেরকে একটু অতিরিক্ত কিছু দেয়া বৈধ।

৬. ‘আল্লামা ‘আয়নী (রহঃ) বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসরণ করে কেউ যদি মাথা মুণ্ডন করেন তাহলে তা সুন্নাত বা মুস্তাহাব বলে গণ্য হবে।

‘আল্লামা যুরক্বানী (রহঃ) বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার চুল সহাবায়ে কিরামের মাঝে এ জন্য বণ্টন করে দিয়েছিলেন যাতে করে তা তাদের জন্য বারাকাত বয়ে নিয়ে আসে এবং তারা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে স্মরণে রাখতে পারে। আর এটা যেন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মৃত্যুর সময় সন্নিকটের কথার প্রতি ইঙ্গিত করছে। আর আবূ তলহা (রাঃ)-কে বণ্টনের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট করার কারণ হলো আবূ তলহা-ই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কবর খনন করেছিলেন।


হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
পুনঃনিরীক্ষণঃ
মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত)
পর্ব-১১: হজ্জ (كتاب المناسك)