পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ
مناسك শব্দটি বহুবচন, এর একবচন منسك। ইবনু জারীর বলেনঃ ’আরাবী منسك ঐ স্থানকে বলা হয় যেখানে লোকজন কল্যাণের উদ্দেশে একত্রিত হয়। হজের কার্যসমূহকে مناسك এজন্যই বলা হয়ে থাকে যে, হজ্জের কাজ সম্পাদনের জন্য লোকজন একই জায়গায় বারবার একত্রিত হয়।
الحج-এর শাব্দিক অর্থ হলো ’কোন কিছুকে উদ্দেশ্য করা’। ইসলামী শারী’আতের পরিভাষায় নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে, নির্দিষ্ট কাজের মাধ্যমে, কাবা ঘরের সম্মানের উদ্দেশে তা যিয়ারত করাকে হজ্জ/হজ বলে।
কুরআন-সুন্নাহ ও ইজমা দ্বারা হজ্জ/হজ ফরয হওয়া প্রমাণিত। এর অস্বীকারকারী কাফির এতে কোন দ্বিমত নেই। জীবনে তা শর্তসাপেক্ষে মাত্র একবারই ফরয।
হজ্জ/হজ ফরয হওয়ামাত্রই তা সম্পাদন করা ওয়াজিব না-কি তা বিলম্বে পালন করার অবকাশ রয়েছে- এ বিষয়ে ’উলামাগণের মাঝে মতপার্থক্য রয়েছে। ইমাম মালিক, আহমাদ, আবূ ইউসুফ এবং মুযানী-এর মতে তা ফরয হওয়ামাত্রই আদায় করা ওয়াজিব, বিলম্ব করার অবকাশ নেই। পক্ষান্তরে ইমাম শাফি’ঈ, সাওরী, আওযা’ঈ ও মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান এর মতে তা বিলম্বে আদায় করার অবকাশ রয়েছে। ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ)-এর মতে ওজর ব্যতীত বিলম্বকারী গুনাহগার হবে।
উত্তম কথা হলো এই যে, যথাসম্ভব দ্রুত হজ্জ/হজ সম্পাদন করা উচিত। কেননা মৃত্যু কখন আসবে তা কেউ জানে না, তাই ফরয হওয়ার পরে তা বিলম্বে আদায় করতে গিয়ে তা আদায় করার পূর্বেই মৃত্যু উপস্থিত হলে, আর তার পক্ষ থেকে তা আদায় করা না হলে নিশ্চিত গুনাহের মধ্যে নিপতিত হতে হবে। আর তা দ্রুত আদায় করা মধ্যেই তা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার একমাত্র উপায়। হজ্জ কখন ফরয হয়েছে তা নিয়েও ’আলিমদের মাঝে মতভেদ রয়েছে। তবে প্রসিদ্ধ অভিমত হলো নবম হিজরী সালে হজ্জ ফরয করা হয়েছে।
২৫০৫-[১] আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের উদ্দেশে ভাষণ দানকালে বললেন, হে মানবমণ্ডলী! আল্লাহ তা’আলা তোমাদের ওপর হজ্জ/হজ ফরয করেছেন, সুতরাং তোমরা হজ্জ/হজ পালন করবে। তখন এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলো, হে আল্লাহর রসূল! এটা (হজ্জ পালন) কি প্রত্যেক বছরই? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) চুপ থাকলেন। লোকটি এভাবে তিনবার জিজ্ঞেস করলো। অতঃপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, আমি যদি হ্যাঁ বলতাম, তবে তা (হজ্জ প্রতি বছর) ফরয হয়ে যেতো, যা তোমরা (প্রতি বছর হজ্জ পালন করতে) পারতে না। অতঃপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, যে ব্যাপারে আমি তোমাদেরকে কিছু বলিনি সে ব্যাপারটি সেভাবে থাকতে দাও। কেননা তোমাদের পূর্বের লোকেরা বেশি বেশি প্রশ্ন করে ও তাদের নবীদের সাথে মতবিরোধ করার কারণে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। তাই আমি যখন তোমাদেরকে কোন বিষয়ে নির্দেশ করবো তা যথাসাধ্য পালন করবে এবং যে বিষয়ে নিষেধ করবো তা পরিত্যাগ করবে। (মুসলিম)[1]
اَلْفَصْلُ الْأَوَّلُ
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ:: خَطَبَنَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ: «يَا أَيُّهَا النَّاسُ قَدْ فُرِضَ عَلَيْكُمُ الْحَجُّ فَحُجُّوا» فَقَالَ رَجُلٌ: أَكُلَّ عَامٍ يَا رَسُولَ اللَّهِ؟ فَسَكَتَ حَتَّى قَالَهَا ثَلَاثًا فَقَالَ: لَوْ قُلْتُ: نَعَمْ لَوَجَبَتْ وَلَمَا اسْتَطَعْتُمْ ثُمَّ قَالَ: ذَرُونِي مَا تَرَكْتُكُمْ فَإِنَّمَا هَلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ بِكَثْرَةِ سُؤَالِهِمْ وَاخْتِلَافِهِمْ عَلَى أَنْبِيَائِهِمْ فَإِذَا أَمَرْتُكُمْ بِشَيْءٍ فَأْتُوا مِنْهُ مَا اسْتَطَعْتُمْ وَإِذَا نَهَيْتُكُمْ عَنْ شَيْء فدَعُوه . رَوَاهُ مُسلم
ব্যাখ্যা: (فُرِضَ عَلَيْكُمُ الْحَجُّ فَحُجُّوْا) ‘‘তোমাদের ওপর হজ্জ/হজ ফরয করা হয়েছে। অতএব তোমরা হজ্জ সম্পাদন করো।’’ এ কথা শ্রবণ করে একব্যক্তি প্রশ্ন করল- (أَكُلَّ عَامٍ) প্রত্যেক বৎসরই কি?
অর্থাৎ- আপনি কি আমাদেরকে প্রত্যেক বৎসরই হজ্জ/হজ সম্পাদন করতে আদেশ দিচ্ছেন?
(لَوْ قُلْتُ: نَعَمْ لَوَجَبَتْ) ‘‘আমি হ্যাঁ বললেই তা প্রতি বৎসরের জন্যই ওয়াজিব হয়ে যেত।
ইমাম সিন্দী বলেনঃ এটা অসম্ভব নয় যে, হজ্জ/হজ প্রতি বৎসর ওয়াজিব করা বা না করার বিষয় নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর ন্যাস্ত ছিল। তাই তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হ্যাঁ বললেই তা প্রতি বৎসরের জন্যই ওয়াজিব হয়ে যেত। কেননা আল্লাহর পক্ষে তাঁর নাবীকে কোন ব্যাপারে সাধারণভাবে নির্দেশ দেয়ার পর তার ব্যাখ্যার বিষয়টি তার ওপর ন্যাস্ত করা বৈধ।
(ذَرُوْنِىْ مَا تَرَكْتُكُمْ) ‘‘যে বিষয়ের উপর আমি তোমাদেরকে ছেড়ে দিয়েছি তোমরাও সে বিষয়ে আমাকে ছেড়ে দাও।’’ অর্থাৎ- আমাকে প্রেরণ করা হয়েছে হয়েছে শারী‘আতের নিয়মাবলী বর্ণনা করা এবং তা লোকদের নিকট পৌঁছানোর জন্য। অতএব শারী‘আতের বিধান আমি তোমাদের নিকট অবশ্যই বর্ণনা করব, সে বিষয়ে আমাকে প্রশ্ন করার কোন প্রয়োজন নেই।
(فَإِنَّمَا هَلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ بِكَثْرَةِ سُؤَالِهِمْ) ‘‘তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মাতগণ অধিক প্রশ্ন করার কারণে ধ্বংস হয়েছে।’’
ইমাম বাগাবী শারহে সুন্নাতে উল্লেখ করেছেন যে, প্রশ্ন দু’ ধরনের। যথা-
(১) ধর্মীয় কোন বিষয়ে প্রয়োজনের খাতিরে শিখার উদ্দেশে প্রশ্ন করা, আর এ ধরনের প্রশ্ন করা বৈধ। যেমন- আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ ‘‘যারা জানে তোমরা তাদের নিকট জিজ্ঞেস করো’’- (সূরা আন্ নাহল ১৬ : ৪৫ আয়াত, সূরা আল আম্বিয়া ২১ : ৬ আয়াত)। সাহাবীগণের প্রশ্নাবলী এ ধরনেরই ছিল।
(২) হতবুদ্ধি ও বিহ্বল করার জন্য অনর্থক প্রশ্ন করা। আর এ ধরনের প্রশ্ন করতে হাদীসে নিষেধ করা হয়েছে। আল্লাহ অধিক ভাল জানেন।
(إِذَا نَهَيْتُكُمْ عَنْ شَىْءٍ فَدَعُوْهُ) ‘‘যখন আমি তোমাদেরকে কোন বিষয়ে নিষেধ করি তা পরিত্যাগ করো।’’
যেহেতু নিষিদ্ধ বস্ত্ত পরিত্যাগ করতে সকলেই সক্ষম তাই বলা হয়নি যে, সক্ষম হলে তা পরিত্যাগ করো। পক্ষান্তরে আদিষ্ট কোন বিষয় কার্যকর করতে সক্ষমতার প্রয়োজন রয়েছে। তাই সেক্ষেত্রে বলা হয়েছে ‘‘আমি যে বিষয়ে আদেশ করি সাধ্যমত তা পালন করো।’’
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ
২৫০৬-[২] উক্ত রাবী [আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ)] হতে এ হাদীসটিও বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করা হলো, কোন্ ’আমল সর্বোত্তম? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রসূলের ওপর বিশ্বাস স্থাপন। আবার জিজ্ঞেস করা হলো, তারপরে কোন্ ’আমল? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, আল্লাহর পথে জিহাদ করা। আবারও জিজ্ঞেস করা হলো, এরপর কোনটি? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, ’হজ্জে মাবরুর’ অর্থাৎ- কবূলযোগ্য হজ্জ। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
اَلْفَصْلُ الْأَوَّلُ
وَعَنْهُ قَالَ: سُئِلَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَيُّ الْعَمَلِ أَفْضَلُ؟ قَالَ: «إِيمَانٌ بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ» قِيلَ: ثُمَّ مَاذَا؟ قَالَ: «الْجِهَادُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ» . قِيلَ: ثُمَّ مَاذَا؟ قَالَ: «حَجٌّ مبرورٌ»
ব্যাখ্যা: (ثُمَّ مَاذَا؟) ‘‘অতঃপর কোন ‘আমল উত্তম।’’ অর্থাৎ- আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করার পর কোন কাজ উত্তম?’’ (الْجِهَادُ فِىْ سَبِيلِ اللّٰهِ) ‘‘আল্লাহর পথে জিহাদ করা’’। অর্থাৎ- আল্লাহর বিধানকে বিজয়ী করার জন্য কাফিরদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা সর্বোত্তম ‘আমল।
(حَجٌّ مَبْرُوْرٌ) ‘‘কবূলযোগ্য হজ্জ/হজ’’। অর্থাৎ- আল্লাহর নিকট গৃহীত হজ্জ। হজ্জ কবূল হওয়ার আলামাত হলোঃ হজ্জ থেকে ফিরে আসার পর তার অবস্থা পূর্বের চাইতে ভাল হওয়া এবং গুনাহের কাজে পুনরায় লিপ্ত না হওয়া। ইমাম কুরতুবী বলেনঃ মাকবূল-এর বিভিন্ন অর্থ করা হয়ে থাকে যার সারমর্ম প্রায় একই, অতএব মাকবূল হজ্জ বলতে তাই বুঝায় যে হজে তার সকল নিয়মাবলী যথার্থ পালিত হয়েছে এবং হজ্জ সম্পাদনকারী ব্যক্তি তার ওপর করণীয় কার্যসমূহ পূর্ণাঙ্গভাবে সম্পাদন করেছে তাই হজ্জে মাবরূর তথা মাকবূল হজ্জ।
অত্র হাদীসে জিহাদকে হজ্জের পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে অথচ জিহাদ হলো ফারযে কিফায়াহ্ আর হজ্জ হলো ফারযে ‘আইন। এর কারণ এই যে, জিহাদের উপকারিতা ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে সমস্ত মুসলিম সমাজে প্রভাব ফেলে, পক্ষান্তরে হজের উপকারিতা শুধুমাত্র ব্যক্তির জন্যই প্রযোজ্য। তাছাড়া জিহাদের মধ্যে প্রাণ বিসর্জন দেয়ার বিষয়টি সংযুক্ত যা হজের মধ্যে নেই। তাই জিহাদের গুরুত্ব হজের তুলনায় অধিক। এজন্যই অত্র হাদীসে জিহাদকে আগে উল্লেখ করা হয়েছে লোকদেরকে ঐ কাজে উদ্বুদ্ধ করার জন্য।
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ
২৫০৭-[৩] উক্ত রাবী [আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ)] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে লোক আল্লাহরই (সন্তুষ্টির) জন্য হজ্জ/হজ করেছে এবং অশ্লীল কথাবার্তা বলেনি বা অশ্লীল কাজকর্ম করেনি। সে লোক হজ্জ/হজ হতে এমনভাবে বাড়ী (নিস্পাপ হয়ে) ফিরবে যেন সেদিনই তার মা তাকে প্রসব করেছে। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
اَلْفَصْلُ الْأَوَّلُ
وَعَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسلم: «مِنْ حَجَّ فَلَمْ يَرْفُثْ وَلَمْ يَفْسُقْ رَجَعَ كَيَوْمِ وَلَدَتْهُ أمه»
ব্যাখ্যা: (فَلَمْ يَرْفُثْ) ‘‘আর সে অশ্লীল কথা বলেনি’’। হাফিয ইবনু হাজার বলেনঃ الرفث শব্দের অর্থ সহবাস করা। সহবাসের প্রতি ইঙ্গিত করা এবং অশ্লীল কথাকেও الرفث বলা হয়। وَلَمْ يَرْفُثْ আর ফাসিক্বী না করে। কামূসের লেখক বলেনঃ الرفث শব্দের অর্থ- আল্লাহর নির্দেশ পরিত্যাগ করা, তার অবাধ্য হওয়া এবং সঠিক ও সত্য পথ থেকে বেরিয়ে যাওয়া। رَجَعَ প্রত্যাবর্তন করল। অর্থাৎ- সে পরিণত হলো, অথবা গুনাহ থেকে ফিরে এলো অথবা হজ্জ/হজ সম্পাদন করে সে ফিরে এলো।
(كَيَوْمِ وَلَدَتْهُ أُمُّه) ‘‘সেদিনের ন্যায় যেদিন তার মা তাকে প্রসব করেছিল’’। অর্থাৎ- হজ্জ/হজ সম্পাদনকারী ব্যক্তি হজ্জের কার্য সম্পাদন করে জন্মদিনের ন্যায় নিষ্পাপ হয়ে গেল। এ হাদীস থেকে বুঝা যায় হজ্জ সম্পাদনকারীর কাবীরাহ্ ও সগীরাহ্ সকল প্রকার গুনাহ মাফ হয়ে যায়।
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ
২৫০৮-[৪] উক্ত রাবী [আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ)] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ এক ’উমরা হতে অপর ’উমরা পর্যন্ত সময়ের জন্য (গুনাহের) কাফফারাহ স্বরূপ আর কবূলযোগ্য হজের প্রতিদান জান্নাত ব্যতীত আর কিছু নয়। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
اَلْفَصْلُ الْأَوَّلُ
وَعَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «الْعُمْرَةُ إِلَى الْعُمْرَةِ كَفَّارَةٌ لِمَا بَيْنَهُمَا وَالْحَجُّ الْمَبْرُورُ لَيْسَ لَهُ جَزاءٌ إِلا الجنَّةُ»
ব্যাখ্যা: (كَفَّارَةٌ لِمَا بَيْنَهُمَا) ‘‘দু’ উমরা-এর মাঝের গুনাহ মোচনকারী’’। হাদীসের এ অংশটুকুতে ‘উমরা-এর ফাযীলাত বুঝানো হয়েছে। আর তা হলো এক ‘উমরা থেকে অপর ‘উমরা-এর মাঝখানে কোন গুনাহের কাজ হয়ে থাকলে ‘উমরা-এর কারণে তা মোচন হয়ে যাবে। ইবনু ‘আবদুল বার বলেনঃ এখানে গুনাহ দ্বারা সগীরাহ্ গুনাহ উদ্দেশ্য। হাফিয ইবনু হাজার বলেনঃ এ হাদীসটি বেশী বেশী ‘উমরা করা মুস্তাহাব হওয়ার দলীল।
(الْحَجُّ الْمَبْرُوْرُ) ‘মাকবূল হজ্জ/হজ’’। ইবনুল ‘আরাবী বলেনঃ যে হজ্জের পরে গুনাহের কাজ করা হয়নি তাই হজে মাবরুর তথা মাকবূল হজ্জ/হজ।
‘আলিমগণ বলেনঃ হজ্জে মাবরুর-এর শর্ত হলো হজ্জে ব্যয়কৃত মাল হালাল পন্থায় অর্জিত হতে হবে। হারাম পন্থায় অর্জিত মাল দ্বারা সম্পাদিত হজ্জ হজ্জে মাবরুর নয়। যদিও এ হজ্জ দ্বারা তার ওপর নির্ধারিত ফরয হজ্জ সম্পাদন হয়েছে বলে গণ্য কিন্তু এ হজ্জ/হজ দ্বারা তার কোন সাওয়াব অর্জিত হবে না। এটাই ইমাম আবূ হানীফা, মালিক ও শাফি‘ঈর অভিমত। পক্ষান্তরে ইমাম আহমাদ বলেনঃ হারাম মাল দ্বারা সম্পাদিত হজ্জের মাধ্যমে তার ওপর নির্ধারিত ফরয হজ্জ/হজ সম্পাদন হবে না।
(لَيْسَ لَه جَزَاءٌ إِلَّا الْجَنَّةُ) ‘‘জান্নাতই তার একমাত্র প্রতিদান’’। ইমাম নাবাবী (রহঃ) বলেনঃ এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো তার শুধুমাত্র আংশিক গুনাহ ক্ষমা হবে না বরং অবশ্য সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ
২৫০৯-[৫] ’আব্দুল্লাহ ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ রমাযান মাসে ’উমরা পালন (সাওয়াবের দিক দিয়ে) হজের সমতুল্য। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
اَلْفَصْلُ الْأَوَّلُ
وَعَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسلم: «إِن عمْرَة فِي رَمَضَان تعدل حجَّة»
ব্যাখ্যা: (إِنَّ عُمْرَةً فِىْ رَمَضَانَ تَعْدِلُ حَجَّةً) ‘‘রমাযান মাসে ‘উমরা হজ্জের সমতুল্য’’। অর্থাৎ- রমাযান মাসে সম্পাদিত ‘উমরা-এর সাওয়াব হজ্জের সাওয়াবের সমতুল্য। এর অর্থ এ নয় যে, রমাযান মাসে ‘উমরা পালন করলে তার ওপর ফরয হজ্জ/হজ পালন হয়ে যাবে। কেননা বস্ত্তকে কোন বস্ত্তর সাথে তুলনা করার অর্থ এ নয় যে, এ বস্ত্তটি সর্বাংশে তুল্য বস্ত্তর সমান বরং এক বস্ত্তর সাথে অন্য বস্ত্তর কোন দিক দিয়ে মিল থাকলেই তাকে ঐ বস্ত্তর সাথে তুলনা করা যায়। যদিও সব দিক দিয়ে তার সমতুল্য নয়। এ হাদীস বর্ণনার কারণ এই যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন বিদায় হজ্জ/হজ থেকে ফিরে এলেন তখন তিনি উম্মু সিনান আল আনসারী এক মহিলাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের সাথে হজ্জ/হজ সম্পাদন করতে তোমাকে কিসে বাধা প্রদান করল? জবাবে উক্ত মহিলা বলল যে, আমাদের মাত্র দু’টি উট আছে। একটির বাহনে তার স্বামী ও তার ছেলে হজ্জ/হজ গমন করেছিলেন। আরেকটি উট তিনি রেখে গেলেন যার দ্বারা আমরা পানি সরবরাহ করেছি। আর অন্য কোন বাহন না থাকায় আমি আপনাদের সাথে হজে যেতে পারিনি। তখন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ যখন রমাযান মাস আসবে তখন তুমি ‘উমরা করবে। কেননা রমাযান মাসে ‘উমরা সম্পাদন করা হজ্জ/হজ সম্পাদনের সমান সাওয়াব। বুখারীর বর্ণনায় রয়েছে, রমাযান মাসে ‘উমরা সমপাদন করা আমার সাথে হজ্জ/হজ সম্পাদন করার সমান সাওয়াব।
বিভিন্ন বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায়, উক্ত মহিলা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে হজ্জ/হজ সম্পাদন করতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু তিনি যখন তা করতে পারলেন না তখন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ রমাযান মাসে ‘উমরা সম্পাদন করলে আমার সাথে হজ্জ/হজ সম্পাদন করার মতো সাওয়াব অর্জিত হবে।
ইবনুল জাওযী বলেনঃ অত্র হাদীস প্রমাণ করে যে, সময়ের মর্যাদার কারণে কার্যের মর্যাদা বৃদ্ধি পায় যেমন মনোযোগ সহকারে ও ইখলাসের সাথে ‘আমল করার কারণে কাজের মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়ে থাকে।
যেহেতু নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকল ‘উমরা সম্পাদন করেছেন যিলকদ মাসে, তাই ‘আলিমগণ এ বিষয়ে সন্দেহে পতিত হয়েছেন যে, রমাযান মাসে ‘উমরা পালন উত্তম না-কি হজের মাসসমূহে ‘উমরা পালন করা উত্তম? অত্র হাদীস প্রমাণ করে যে, রমাযান মাসে ‘উমরা পালন করা উত্তম। হাফিয ইবনু হাজার বলেনঃ নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যতীত অন্য যে কোন লোকের জন্য রমাযান মাসে ‘উমরা পালন করা উত্তম। পক্ষান্তরে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং যা করেছেন তার জন্য তাই উত্তম। কেননা জাহিলী যুগের লোকেরা মনে করত যে, হজের মাসসমূহে ‘উমরা করা বৈধ নয়। তাই নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজ্জের মাসে ‘উমরা পালন করে দেখিয়ে দিলেন যে, হজ্জের মাসে ‘উমরা পালন করা বৈধ।
অত্র হাদীসে রমাযান মাসে ‘উমরা পালন করতে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। এতে এটাও প্রতীয়মান হয় যে, একাধিকবার ‘উমরা করা বৈধ তথা মুস্তাহাব, আর এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন ইমাম আবূ হানীফা এবং ইমাম শাফি‘ঈ।
ইমাম মালিক বৎসরে একাধিক ‘উমরা করা মাকরূহ মনে করেন। ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল দশদিনের কমে ‘উমরা করা মাকরূহ্ মনে করেন।
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ
২৫১০-[৬] উক্ত রাবী [’আব্দুল্লাহ ইবনু ’আব্বাস (রাঃ)] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (হজের সফরে) ’রওহা’ নামক জায়গায় এক আরোহী দলের সাক্ষাৎ পেলেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জিজ্ঞেস করলেন, এরা কারা? তারা বললো, ’আমরা মুসলিম’। অতঃপর তারা জিজ্ঞেস করলো, ’আপনি কে?’ তিনি বললেন, (আমি) আল্লাহর রসূল! তখন একজন মহিলা একটি শিশুকে উঠিয়ে ধরলেন এবং বললেন, (হে আল্লাহর রসূল!) এর কি হজ্জ/হজ হবে? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, হ্যাঁ, তবে সাওয়াব হবে তোমার। (মুসলিম)[1]
اَلْفَصْلُ الْأَوَّلُ
وَعَنْهُ قَالَ: إِنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَقِيَ رَكْبًا بِالرَّوْحَاءِ فَقَالَ: «مَنِ الْقَوْمُ؟» قَالُوا: الْمُسْلِمُونَ. فَقَالُوا: مَنْ أَنْتَ؟ قَالَ: «رَسُولُ اللَّهِ» فَرَفَعَتْ إِلَيْهِ امْرَأَةٌ صَبِيًّا فَقَالَتْ: أَلِهَذَا حَجٌّ؟ قَالَ: «نَعَمْ وَلَكِ أَجَرٌ» . رَوَاهُ مُسْلِمٌ
ব্যাখ্যা: (أَلِهٰذَا حَجٌّ) ‘‘এ শিশুটির হজ্জ হবে কি?’’ অর্থাৎ- এ শিশুটি যদি হজ্জ/হজ পালন করে তাহলে সে হজের সাওয়াব পাবে কি? (قَالَ: نَعَمْ) ‘‘তিনি বললেনঃ হ্যাঁ (وَلَكِ أَجَرٌ) ‘‘তোমারও সাওয়াব হবে’’। ইমাম নাবাবী বলেনঃ এর অর্থ হলো ঐ শিশুকে বহন করার জন্য এবং তাকে ঐ সমস্ত কাজ থেকে বিরত রাখার জন্য তিনি সাওয়াব পাবেন যে সমস্ত কাজ থেকে ইহরামধারী ব্যক্তি বিরত থাকেন।
অত্র হাদীস প্রমাণ করে যে, শিশুকে সাথে নিয়ে হজ্জ/হজ করা বিধিসম্মত। এতে ‘উলামাগণের মাঝে কোন বিরোধ নেই। এতে এটাও জানা গেল যে, শিশু ছোট হোক বা বড় হোক তার হজ্জ/হজ বিশুদ্ধ। তবে শিশুর পক্ষ থেকে এ হজ্জটি নফল হজ্জ বলে গণ্য হবে। বালেগ হওয়ার পর হজ্জ ফরয হওয়ার শর্তসমূহ পাওয়া গেলে তাকে পুনরায় হজ্জ করতে হবে।
কোন শিশু হজ্জের জন্য ইহরাম বাঁধার পর ‘আরাফাতে অবস্থান করার পূর্বে বালেগ হলে তার বিধান কি? এ নিয়ে ‘উলামাগণের মাঝে মতভেদ রয়েছে।
ইমাম মালিক-এর মতে ইহরাম বাঁধার পর ‘আরাফাতে অবস্থানের পূর্বে শিশু বালেগ হলে অনুরূপভাবে গোলামকে আযাদ করা হলে তারা ঐ অবস্থায় হজের কাজ সম্পাদন করবে। তবে তাদের উভয়কে পুনরায় ফরয হজ্জ/হজ সম্পাদন করতে হবে।
ইমাম আবূ হানীফার মতে তারা যদি নতুন করে ইহরাম বেঁধে হজের বাকী কাজ সম্পন্ন করে তাহলে এটিই তাদের জন্য ফরয হজ্জ/হজ বলে গণ্য হবে।
ইমাম শাফি‘ঈর মতে শিশু ইহরাম বাঁধার পর ‘আরাফাতে অবস্থানের পূর্বে বালেগ হলে অনুরূপভাবে গোলাম ইহরাম বাঁধার পর তাকে আযাদ করা হলে ঐ ইহরামেই তারা ‘আরাফাতে অবস্থানসহ হজ্জের বাকী কাজ সম্পাদন করলে এ হজ্জই তাদের জন্য যথেষ্ট হবে। তাদের পুনরায় ফরয হজ্জ/হজ করতে হবে না।
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ
২৫১১-[৭] উক্ত রাবী [’আব্দুল্লাহ ইবনু ’আব্বাস (রাঃ)] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার খাস্’আম গোত্রের এক মহিলা জিজ্ঞেস করলো, হে আল্লাহর রসূল! বান্দাদের ওপর আল্লাহ তা’আলার ফরয করা হজ্জ/হজ আমার পিতার ওপরও বর্তেছে, কিন্তু আমার পিতা অতিশয় বৃদ্ধ, যিনি সওয়ারীর উপরে বসে থাকতে পারে না। তাই আমি কি তার পক্ষ হতে হজ্জ/হজ আদায় করতে পারি? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, হ্যাঁ, পারো। এটা বিদায় হজের ঘটনা। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
اَلْفَصْلُ الْأَوَّلُ
وَعَنْهُ قَالَ: إِنَّ امْرَأَةً مِنْ خَثْعَمَ قَالَتْ: يَا رَسُول الله إِن فَرِيضَة الله عِبَادِهِ فِي الْحَجِّ أَدْرَكَتْ أَبِي شَيْخًا كَبِيرًا لَا يَثْبُتُ عَلَى الرَّاحِلَةِ أَفَأَحُجُّ عَنْهُ؟ قَالَ: «نعم» ذَلِك حجَّة الْوَدَاع
ব্যাখ্যা: (أَفَأَحُجُّ عَنْهُ) ‘‘আমি কি তার পক্ষ থেকে হজ্জ/হজ সম্পাদন করব?’’ অর্থাৎ- আমার জন্য কি এটা বৈধ হবে যে, ঐ বৃদ্ধের পক্ষ হতে তার পরিবর্তে আমি তার হজ্জের কাজ সম্পাদন করব। (قَالَ: نَعَمْ) ‘‘তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ হ্যাঁ।’’ অর্থাৎ- তুমি তার পক্ষ থেকে হজ্জ সম্পাদন করলে তা তার জন্য যথেষ্ট হবে।
অত্র হাদীস প্রমাণ করে যে, পুরুষের পক্ষ হতে কোন মহিলা অনুরূপভাবে মহিলার পক্ষ থেকে কোন পুরুষ হজ্জ/হজ করলে তা বৈধ ও বিশুদ্ধ। ইবনু বাত্ত্বাল বলেনঃ এতে কোন মতভেদ নেই যে, পুরুষের পক্ষ থেকে মহিলার এবং মহিলার পক্ষ থেকে পুরুষের হজ্জ/হজ করা বৈধ। তবে হাসান বাসরীর মতে পুরুষের পক্ষ থেকে মহিলার হজ্জ/হজ সম্পাদন করা বৈধ নয়। কেননা হজ্জে মহিলার জন্য এমন পোষাক পরিধান করা বৈধ যা পুরুষের জন্য বৈধ নয়। অতএব পুরুষের পক্ষ থেকে পুরুষকেই হজ্জ করতে হবে। অত্র হাদীস তার এ মত প্রত্যাখ্যান করে। অত্র হাদীস আরো প্রমাণ করে যে, অপারগ ব্যক্তির ওপর হজ্জের অন্যান্য শর্ত পাওয়া গেলে এবং তার পক্ষ থেকে হজ্জ/হজ সম্পাদন করার লোক পাওয়া গেলে তাকে হজ্জ/হজ পালন করতে অর্থাৎ- অন্য লোক দিয়ে তার পক্ষ থেকে হজ্জ/হজ করাতে হবে। ইমাম আবূ হানীফা ও ইমাম শাফি‘ঈর অভিমত এটাই।
পক্ষান্তরে ইমাম মালিক-এর মতে স্বয়ং হজ্জ/হজ সম্পাদনে সক্ষম না হলে তার পক্ষ থেকে অন্যকে দিয়ে হজ্জ/হজ করানো ফরয নয়। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيْلًا ‘‘যে ব্যক্তি তাতে পৌঁছতে সক্ষম’’- (সূরা আ-লি ‘ইমরান ৩ : ৯৭)। আর অপারগ ব্যক্তি সক্ষম নয়। ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) বর্ণিত খাস্‘আমিয়াহ্ মহিলার হাদীসটি ইমাম মালিক-এর এ মতকে প্রত্যাখ্যান করে।
তবে এ বিষয়ে কোন মতভেদ নেই যে, কোন ব্যক্তির ওপর সুস্থ অবস্থায় হজ্জ/হজ ফরয হওয়ার পর যদি তিনি অসুস্থ হন যার ফলে তিনি স্বয়ং হজ্জ/হজ সম্পাদন করতে অক্ষম হন তাহলে তার পক্ষ থেকে অবশ্যই হজ্জ/হজ সম্পাদন করতে হবে।
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ
২৫১২-[৮] উক্ত রাবী [’আব্দুল্লাহ ইবনু ’আব্বাস (রাঃ)] হতে এ হাদীসটিও বর্ণিত। তিনি বলেন, এক লোক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এসে জিজ্ঞেস করলো, হে আল্লাহর রসূল! আমার বোন হজ্জ/হজ পালন করার জন্য মানৎ করেছিলেন; কিন্তু (তা আদায় করার আগেই) তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার বোনের কোন ঋণ থাকলে তুমি তা পরিশোধ করতে কিনা? সে বললো, হ্যাঁ আদায় করতাম। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তবে তুমি আল্লাহর ঋণ পরিশোধ করো; কেননা তা আদায় করা অধিক উপযোগী। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
اَلْفَصْلُ الْأَوَّلُ
وَعَنْهُ قَالَ: أَتَى رَجُلٌ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ: إِنَّ أُخْتِي نَذَرَتْ أَنْ تَحُجَّ وَإِنَّهَا مَاتَتْ فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَوْ كَانَ عَلَيْهَا دَيْنٌ أَكَنْتَ قَاضِيَهُ؟» قَالَ: نَعَمْ قَالَ: «فَاقْضِ دَيْنَ اللَّهِ فَهُوَ أَحَقُّ بِالْقَضَاءِ»
ব্যাখ্যা: (لَوْ كَانَ عَلَيْهَا دَيْنٌ أَكَنْتَ قَاضِيَه) ‘‘তার ওপর কারো পাওনা থাকলে তা কি তুমি আদায় করতে?’’ (قَالَ: نَعَمْ) ‘‘লোকটি বললঃ হ্যাঁ।’’ (قَالَ: فَاقْضِ دَيْنَ اللّٰهِ فَهُوَ أَحَقُّ بِالْقَضَاء) ‘‘নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি (তার পক্ষ থেকে) আল্লাহর পাওনা পরিশোধ করো। কেননা তা পরিশোধ করার ক্ষেত্রে অধিক হাক্বদার।’’ অত্র হাদীসে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, কোন ব্যক্তির যিম্মাতে আল্লাহর কোন হাক্ব থাকাবস্থায় সে মারা গেলে যেমন হজ্জ/হজ, কাফফারাহ অথবা মানৎ তার পক্ষ থেকে তা আদায় করা ওয়াজিব। এতে এ প্রমাণও পাওয়া যায় হজ্জের মানৎ করে তা আদায় না করে কেউ মারা গেলে তার পক্ষ থেকে ওয়ারিস বা অন্য কেউ হজ্জ/হজ সম্পাদন করলে তা যথেষ্ট হবে। এতে এটাও জানা যায় যে, মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে ঋণ পরিশোধ করার বিষয়টি সমাজে প্রচলিত ছিল। এজন্যই মানুষের প্রাপ্যের সাথে আল্লাহর প্রাপ্যকে তুলনা করা হয়েছে। মৃত ব্যক্তি ওয়াসিয়্যাত না করা সত্ত্বেও তার পক্ষ থেকে হজ্জ/হজ করা বিধিসম্মত, অত্র হাদীসে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। অনুরূপভাবে সকল প্রকার আর্থিক পাওনা মৃতের পক্ষ থেকে পরিশোধ করা বৈধ। হাফিয ইবনু হাজার বলেনঃ কোন ব্যক্তির ওপর হজ্জ/হজ ফরয হওয়ার পর হজ্জ/হজ সম্পাদন করার পূর্বে মারা গেলে তার রেখে যাওয়া সম্পদ বণ্টনের পূর্বেই তার মাল দ্বারা হজ্জ/হজ করানো ওয়াজিব যেমনটি ঋণগ্রস্থ ব্যক্তির সম্পদ বণ্টনের পূর্বে তার মাল থেকে ঋণ পরিশোধ করা ওয়াজিব।
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ
২৫১৩-[৯] উক্ত রাবী [’আব্দুল্লাহ ইবনু ’আব্বাস (রাঃ)] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কোন পুরুষ যেন কক্ষনো কোন স্ত্রীলোকের সাথে এক জায়গায় নির্জনে একত্র না হয়, আর কোন স্ত্রীলোক যেন কক্ষনো আপন কোন মাহরাম ব্যতীত একাকিনী সফর না করে। তখন এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলো, হে আল্লাহর রসূল! অমুক অমুক যুদ্ধে আমার নাম লেখানো হয়েছে। আর আমার স্ত্রী একাকিনী হজের উদ্দেশে বের হয়েছে। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, যাও তুমি তোমার স্ত্রীর সাথে হজ্জ/হজ করো। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
اَلْفَصْلُ الْأَوَّلُ
وَعَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَا يَخْلُوَنَّ رَجُلٌ بِامْرَأَةٍ وَلَا تُسَافِرَنَّ امْرَأَةٌ إِلَّا وَمَعَهَا مَحْرَمٌ» . فَقَالَ رَجُلٌ: يَا رَسُولَ اللَّهِ اكْتُتِبْتُ فِي غَزْوَةِ كَذَا وَكَذَا وَخَرَجَتِ امْرَأَتِي حَاجَّةً قَالَ: «اذهبْ فاحجُجْ مَعَ امرأتِكَ»
ব্যাখ্যা: ‘‘মাহরাম ব্যক্তি ছাড়া কোন মহিলা পর-পুরুষের সাথে মিলিত হবে না এবং সফরও করবে না’’। অত্র হাদীসে স্বামীর কথা উল্লেখ নেই। আবূ সা‘ঈদ আল খুদরী (রাঃ)-এর বরাতে বুখারী, মুসলিমে স্বামীর কথা উল্লেখ রয়েছে। অর্থাৎ- স্বামী অথবা মাহরাম ছাড়া কোন মহিলা পর-পুরুষের সাথে মিলিত হবে না এবং সফর করবে না। মাহরাম বলা হয় এমন পুরুষকে উক্ত মহিলার জন্য যাকে বিবাহ করা চিরস্থায়ীভাবে হারাম, যেমন- ছেলে, বাবা, ভাই, চাচা, মামা, দাদা, নানা ইত্যাদি। অত্র হাদীসটি প্রমাণ করে যে, স্বামী অথবা মাহরাম ছাড়া কোন মহিলার জন্য সফর করা হারাম। এ হাদীসে কোন দূরত্ব অথবা সময়ের কথা উল্লেখ নেই। কোন হাদীসে তিনদিন, কোন হাদীসে দু’দিন, কোন হাদীসে একদিন, কোন হাদীসে তিন মাইলের অধিক সফর না করার উল্লেখ রয়েছে। উল্লিখিত সকল বর্ণনার দিকে লক্ষ্য করলে প্রতীয়মান হয় যে, কোন মহিলার পক্ষে স্বামী অথবা মাহরাম ব্যতীত তিন মাইলের অধিক ভ্রমণ করা বৈধ নয়।
(اِذْهَبْ فَاحْجُجْ مَعَ اِمْرَأَتِكَ) ‘‘তুমি গিয়ে তোমার স্ত্রীর সাথে হজ্জ/হজ সম্পাদন করো’’। হাদীসের এ অংশ প্রমাণ করে যে, স্বামী অথবা মাহরাম ব্যতীত কোন মহিলার জন্য হজের সফর বৈধ নয় যদি এর দূরত্ব তিন মাইলের বেশী হয়। দারাকুত্বনী ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ)-এর সূত্রে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কোন মহিলা মাহরাম ব্যতীত কখনো হজ্জ/হজ করবে না। অতএব যারা বলেন যে, হজ্জের সফরের জন্য মাহরাম শর্ত নয়- এটা তাদের মনগড়া উক্তি। যা গ্রহণযোগ্য নয়।
অত্র হাদীস এও প্রমাণ করে যে, কোন মহিলার ওপর হজ্জ/হজ ফরয হলে তাকে হজ্জ/হজ করতে বাধা দেয়া স্বামীর জন্য বৈধ নয় যদি তার সাথে মাহরাম ব্যক্তি সফর করে।
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ
২৫১৪-[১০] ’আয়িশাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট জিহাদে যাবার জন্য অনুমতি চাইলাম, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তোমাদের জিহাদ হলো হজ্জ/হজ। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
اَلْفَصْلُ الْأَوَّلُ
وَعَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ: اسْتَأْذَنْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي الْجِهَادِ. فَقَالَ: «جهادكن الْحَج»
ব্যাখ্যা: (جِهَادُكُنَّ الْحَجُّ) ‘‘তোমাদের জিহাদ হলো হজ্জ/হজ’’। অর্থাৎ- তোমাদের ওপর জিহাদ করা ফরয নয়। সক্ষম হলে, অর্থাৎ- হজ্জের শর্তসমূহ পূর্ণ হলে তোমার ওপর হজ্জ/হজ করা ফরয। অত্র হাদীসে হজ্জকে জিহাদ বলা হয়েছে। এজন্য যে, হজ্জ সম্পাদন করার জন্য নাফসের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে হয়। তাছাড়া জিহাদে, যেমন- সফরের কষ্ট স্বীকার করতে হয় অনুরূপভাবে হজ্জের জন্য সফরের কষ্ট এবং শারীরিক কষ্ট স্বীকার করতে, আর পরিবার-পরিজন ও স্বীয় মাতৃভূমি ত্যাগ করে কষ্ট সহ্য করতে হয়। আর এ কাজগুলো জিহাদের মধ্যেও করতে হয়।
ইবনু বাত্ত্বাল বলেনঃ ‘আয়িশাহ্ (রাঃ) বর্ণিত হাদীস প্রমাণ করে যে, মহিলাদের ওপর জিহাদ ফরয নয় বরং তারা আল্লাহ তা‘আলার বাণীঃ انْفِرُواْ خِفَافاً وَثِقَالًا (সূরা আত্ তাওবাহ্ ৯ : ৪১ আয়াত)-এর অন্তর্ভুক্ত নয়। এটি সর্বসম্মত বিষয়। তবে (جِهَادُكُنَّ الْحَجُّ) এর অর্থ এ নয় যে, তারা নফল জিহাদও করতে পারবে না। বরং হাদীসের মর্ম হলো মহিলাদের জন্য জিহাদের চাইতে হজ্জ/হজ উত্তম। তাদের উপর জিহাদ এ জন্য ফরয নয় যে, মহিলাদের পুরুষদের থেকে পৃথক থাকা এবং তাদের থেকে পর্দা করা জরুরী। অথচ জিহাদ এর বিপরীত। তাই তাদের উপর জিহাদ ফরয নয়।
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ
২৫১৫-[১১] আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কোন মহিলা কোন মাহরাম ব্যতীত একদিন ও এক রাতের পথও সফর করবে না। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
اَلْفَصْلُ الْأَوَّلُ
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَا تُسَافِرُ امْرَأَةٌ مَسِيرَةَ يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ إِلَّا وَمَعَهَا ذُو محرم»
ব্যাখ্যা: (لَا تُسَافِرُ امْرَأَةٌ) ‘‘কোন মহিলা সফর করবে না’’। চাই সে সফর হজ্জের জন্য হোক অথবা অন্য কোন কারণে হোক। আর সফর মটর গাড়ীতে হোক, উড়োজাহাজে হোক অথবা রেলগাড়ীতেই হোক, যে কোন পন্থায়ই হোক। মাহরাম ব্যতীত মহিলার জন্য সকল প্রকার সফরই হারাম। আর মহিলা যুবতীই হোক আর বৃদ্ধাই হোক সবার ক্ষেত্রে একই হুকুম প্রযোজ্য।
‘উলামাগণের মধ্যে এ বিষয়ে মতভেদ রয়েছে যে, কোন মহিলা যখন সম্পদশালী হয় এবং তার যদি মাহরাম বা স্বামী না থাকে তাহলে তার ওপর কি হজ্জ/হজ ফরয? সঠিক কথা এই যে, কোন মহিলার পক্ষেই কোন সফরের জন্য মাহরাম অথবা স্বামী ব্যতীত সফর করা বৈধ নয়। অতএব যে মহিলার স্বামী বা মাহরাম নেই এ ওজর থাকার কারণে তার উওপর হজ্জ/হজ ফরয নয়।
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ
২৫১৬-[১২] ’আব্দুল্লাহ ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনাবাসীদের জন্যে ’যুলহুলায়ফাহ্’-কে, শাম বা সিরিয়াবাসীদের জন্য ’জুহফাহ্’-কে আর নাজদবাসীদের জন্য ’ক্বরনুল মানাযিল’-কে এবং ইয়ামানবাসীদের জন্য ’ইয়ালাম্লাম্’-কে মীকাত নির্দিষ্ট করেছেন। এসব স্থানগুলো এ সকল স্থানের লোকজনের জন্য আর অন্য স্থানের লোকেরা যখন এ স্থান দিয়ে আসবে তাদের জন্য, যারা হজ্জ/হজ বা ’উমরার ইচ্ছা করে। আর যারা এ সীমার ভিতরে অবস্থান করবে, তাদের ইহরামের স্থান হবে তাদের ঘর- এভাবে ক্রমান্বয়ে কাছাকাছি লোকেরা স্বীয় বাড়ি হতে এমনকি মক্কাবাসীরা ইহরাম বাঁধবে মক্কা হতেই। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
اَلْفَصْلُ الْأَوَّلُ
وَعَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ: وَقَّتَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِأَهْلِ الْمَدِينَةِ: ذَا الْحُلَيْفَةِ وَلِأَهْلِ الشَّامِ: الْجُحْفَةَ وَلِأَهْلِ نَجْدٍ: قَرْنَ الْمَنَازِلِ وَلِأَهْلِ الْيَمَنِ: يَلَمْلَمَ فَهُنَّ لَهُنَّ وَلِمَنْ أَتَى عَلَيْهِنَّ مِنْ غَيْرِ أَهْلِهِنَّ لِمَنْ كَانَ يُرِيدُ الْحَجَّ وَالْعُمْرَةَ فَمَنْ كَانَ دُونَهُنَّ فَمُهَلُّهُ مِنْ أَهْلِهِ وَكَذَاكَ وَكَذَاكَ حَتَّى أهل مَكَّة يهلون مِنْهَا
ব্যাখ্যা: যুলহুলায়ফাহ্ঃ মদীনার নিকটবর্তী একটি প্রসিদ্ধ স্থান। ইমাম নাবাবীর মতে মসজিদে নাবাবী হতে এর দূরত্ব ছয় মাইল। ইবনু হাযম-এর মতে এর দূরত্ব মদীনাহ্ হতে চার মাইল। এখানে ‘‘বী’রে ‘আলী’’ নামক একটি কূপ রয়েছে। বর্তমানে এ স্থানটি আব্ ইয়ারে ‘আলী নামে পরিচিত। এটিই মদীনাহবাসীদের মীকাত।
জুহফাহ্ঃ মক্কা হতে উত্তর-পশ্চিম দিকে ১২০ মাইল দূরে অবস্থিত একটি স্থান। মরক্কো, মিসর ও সিরিয়ার অধিবাসীগণের এটি মীকাত। বর্তমানে উক্ত স্থানটি চেনার বিশেষ কোন নিদর্শন না থাকার কারণে লোকজন রাবেগ নামক স্থান থেকে ইহরাম বেঁধে থাকেন।
ক্বরনুল মানাযিলঃ মক্কা হতে ৪২ মাইল পূর্বে একটি পাহাড়ী এলাকার নাম। এটি নাজদবাসীদের মীকাত।
ইয়ালামলাম্ঃ মক্কা থেকে ৩০ মাইল দক্ষিণে অবস্থিত একটি পাহাড়। এটি ইয়ামানবাসীদের মীকাত। পাকভারত উপমহাদেশের সমুদ্রপথে গমনকারী যাত্রীগণও ইয়ামানে উপনীত হয়ে এ ইয়ালামলাম পাহাড়ের দক্ষিণে অবস্থানকালে ইহরাম বাঁধেন।
(هُنَّ لَهُنَّ وَلِمَنْ أَتٰى عَلَيْهِنَّ مِنْ غَيْرِ أَهْلِهِنَّ) উক্ত বর্ণিত মীকাত তাদের জন্য যাদের জন্য তা উল্লেখ করা হয়েছে এবং তাদেরও জন্য এগুলো মীকাত যারা এর অধিবাসী নয় অথচ এ পথেই তারা অতিক্রম করে। যেমন- একজন বাংলাদেশী যিনি মদীনাতে অবস্থান করছেন তিনি যদি হজ্জ/হজ করতে চান তাহলে তার মীকাত যুলহুলায়ফাহ্। অথচ তার প্রকৃত মীকাত উড়োজাহাজে ক্বরনুল মানাযিল আর সমুদ্র পথে ইয়ালামলাম্।
(لِمَنْ كَانَ يُرِيدُ الْحَجَّ وَالْعُمْرَةَ) ‘‘যে ব্যক্তি হজ্জ/হজ অথবা ‘উমরা করতে চায়’’। এতে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, হজ্জ/হজ অথবা ‘উমরাতে গমনেচ্ছু ব্যক্তির জন্য ইহরাম না বেঁধে মীকাত অতিক্রম করা বৈধ নয়। তবে কোন ব্যক্তি যদি হজ্জ/হজ অথবা ‘উমরা করার ইচ্ছা ব্যতিরেকে সফরে গমন করে তার জন্য ইহরাম ছাড়াই এ মীকাতগুলো অতিক্রম করা বৈধ। তবে এ বিষয়ে ‘উলামাগণের মাঝে মতভেদ রয়েছে।
(১) ইমাম যুহরী, হাসান বাসরী, ইমাম শাফি‘ঈ-এর একটি ক্বওল, ইবনু ওয়াহ্ব-এর বর্ণনা অনুযায়ী ইমাম মালিক এবং দাঊদ ইবনু ‘আলী ও তাদের অনুসারীদের মতে ইহরাম ব্যতীত মক্কাতে প্রবেশে কোন ক্ষতি নেই।
(২) ‘আত্বা ইবনু আবী রবাহ, লায়স ইবনু সা‘দ, সাওরী, আবূ হানীফা এবং তার অনুসারীবৃন্দ, বিশুদ্ধ বর্ণনানুযায়ী ইমাম মালিক, শাফি‘ঈ-এর প্রসিদ্ধ মত, আহমাদ, আবূ সাওর প্রমুখদের মতে মীকাতের বাইরে অবস্থানকারীদের জন্য ইহরাম ব্যতিরেকে মক্কাতে প্রবেশ করা বৈধ নয়।
কেউ যদি ইহরাম ছাড়াই প্রবেশ করে তবে খারাপ কাজ করল তবে এজন্য ইমাম শাফি‘ঈর মতে কোন প্রকার কাফফারা নেই। আর ইমাম আবূ হানীফার মতে কাফফারাহ স্বরূপ হজ্জ/হজ অথবা ‘উমরা করতে হবে।
(فَمَنْ كَانَ دُونَهُنَّ فَمُهَلُّه مِنْ أَهْلِه) আর যে ব্যক্তি মীকাতের অভ্যন্তরের অধিবাসী স্বীয় আবাসই তার ইহরাম বাঁধার স্থান। অর্থাৎ- তাকে মীকাতের বাইরে যেয়ে ইহরাম বাঁধতে হবে না বরং স্বীয় আবাসস্থল থেকেই ইহরাম বাঁধবে।
(وَأَهْلُ مَكَّةَ مِنْ مَكَّةَ) আর মক্কাবাসীগণ মক্কা থেকেই ইহরাম বাঁধবে। এ বিধান হজের জন্য খাস।
মক্কাহ্বাসী যদি ‘উমরা করতে চায় তবে হারাম এলাকার বাইরে গিয়ে ইহরাম বাঁধতে হবে। যেমনটি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘আয়িশাহ্ (রাঃ)-কে তান্‘ঈমে প্রেরণ করেছিলেন ‘উমরা-এর ইহরাম বাঁধার জন্য।
মীকাতে যাওয়াব পূর্বেই ইহরাম বাঁধা যাবে কি-না? এ বিষয়ে ‘উলামাগণের মাঝে ভিন্নমত রয়েছে।
ইবনু হাযম বলেনঃ কারো জন্য বৈধ নয় যে, মীকাতে পৌঁছার পূর্বেই হজ্জ/হজ অথবা ‘উমরার জন্য ইহরাম বাঁধবে। কেউ যদি মীকাতে পৌঁছার পূর্বেই ইহরাম বাঁধে। অতঃপর মীকাত অতিক্রম করে তবে তার হজ্জ/হজ বা ‘উমরা কোনটাই হবে না। তবে মীকাতে পৌঁছার পর যদি নতুন করে ইহরামের নিয়্যাত করে তাহলে তার ইহরাম বিশুদ্ধ হবে।
জমহূর ‘উলামাগণের মতে মীকাতে পৌঁছাবার পূর্বেই ইহরাম বাঁধলে তা বৈধ হবে বরং হানাফী এবং শাফি‘ঈ উলামাগণের মতে, মীকাতে পৌঁছার পূর্বে ইহরাম বাঁধা উত্তম। ইমাম মালিক-এর মতে মীকাতে পৌঁছাবার পূর্বে ইহরাম বাঁধা মাকরূহ। আর এ অভিমতটিই অধিক সঠিক। আল্লাহই ভাল জানেন।
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ
২৫১৭-[১৩] জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করেছেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ মদীনাবাসীদের মীকাত হলো ’যুলহুলায়ফাহ্’। অন্য পথে (সিরিয়ার পথে) প্রবেশ করলে ’জুহফাহ্’, ইরাকবাসীদের মীকাত হলো ’যা-তু ’ইরক্ব’ এবং নাজদবাসীদের মীকাত হলো ’ক্বরনুল মানাযিল’ এবং ইয়ামানবাসীদের মীকাত হলো ’ইয়ালাম্লাম্। (মুসলিম)[1]
اَلْفَصْلُ الْأَوَّلُ
وَعَنْ جَابِرٍ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «مُهَلُّ أَهْلِ الْمَدِينَةِ مِنْ ذِي الْحُلَيْفَةِ وَالطَّرِيقُ الْآخَرُ الْجُحْفَةُ وَمُهَلُّ أَهْلِ الْعِرَاقِ مِنْ ذَاتِ عِرْقٍ وَمُهَلُّ أَهْلِ نَجْدٍ قَرْنٌ وَمُهَلُّ أَهْلِ الْيَمَنِ يَلَمْلَمُ» . رَوَاهُ مُسْلِمٌ
ব্যাখ্যা: (وَمُهَلُّ أَهْلِ الْعِرَاقِ مِنْ ذَاتِ عِرْقٍ) ‘ইরাকবাসীদের ইহরাম বাঁধার স্থান যাতু ‘ইরক্ব। যাতু ‘ইরক্ব মক্কা হতে ৪৮ মাইল দূরে অবস্থিত যা তিহামা ও নাজদের মধ্যবর্তী জায়গায় অবস্থিত। এটা ‘ইরক্ব ও ইরানবাসীদের মীকাত। অত্র হাদীস প্রমাণ করে যে, ‘ইরাকবাসীদের মীকাত যাতু ‘ইরক্ব। এর স্বপক্ষে ‘আয়িশাহ্ (রাঃ) থেকে আহমাদ, আবূ দাঊদ, নাসায়ী, ত্বহাবী ও দারাকুত্বনীতে সহীহ সনদে হাদীস বর্ণিত রয়েছে।
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ
২৫১৮-[১৪] আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মোট চারবার ’উমরা পালন করেছেন। হজের সাথে ’উমরা ছাড়া প্রত্যেকটি ’উমরা পালন করেছেন যিলকদ মাসে। এক ’উমরা করেছেন হুদায়বিয়াহ্ নামক স্থান হতে যিলকদ মাসে (আগমনকারী বৎসরে), আর এক ’উমরা করেছেন জি’রানাহ্ নামক স্থান থেকে, যেখানে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হুনায়ন যুদ্ধেলব্ধ গনীমাতের মাল বণ্টন করেছিলেন যিলকদ মাসে। আর এক ’উমরা তিনি পালন করেছেন (দশম হিজরীতে তাঁর বিদায়) হজের মাসে। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
اَلْفَصْلُ الْأَوَّلُ
وَعَنْ أَنَسٍ قَالَ: اعْتَمَرَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَرْبَعٌ عُمَرٍ كُلُّهُنَّ فِي ذِي الْقَعْدَةِ إِلَّا الَّتِي كَانَتْ مَعَ حَجَّتِهِ: عُمْرَةً مِنَ الْحُدَيْبِيَةِ فِي ذِي الْقَعْدَةِ وَعُمْرَةً مِنَ الْعَامِ الْمُقْبِلِ فِي ذِي الْقَعْدَةِ وَعُمْرَةً مِنَ الْجِعْرَانَةِ حَيْثُ قَسَّمَ غَنَائِمَ حُنَيْنٍ فِي ذِي الْقَعْدَةِ وَعُمْرَةً مَعَ حَجَّتِهِ
ব্যাখ্যা: অত্র হাদীস প্রমাণ করে যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরতের পর চারটি ‘উমরা করেছেন। এর সবগুলোই যিলকদ মাসে করেছেন। বিদায় হজের ‘উমরাটি যদিও যিলহজ্জ মাসে করেছেন তথাপি তার জন্য ইহরাম বাঁধা হয় যিলকদ মাসেই। তাই বলা হয়ে থাকে যে, এ চারটি ‘উমরাই তিনি যিলকদ মাসে করেছেন। এর কারণ এই যে, জাহিলী যুগের লোকেরা মনে করত যে, হজ্জের মাসসমূহে (শা‘বান, যিলকদ, যিলহাজ্জ) ‘উমরা করা সবচাইতে গর্হিত কাজ। তাই নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চারটি ‘উমরা হজ্জের মাসে সম্পাদন করেছেন যাতে বুঝতে পারা যায় যে, জাহিলী যুগের লোকেরা যা বলত তা বাতিল।
বারা ও ইবনু ‘উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু’বার ‘উমরা করেছেন। ‘আয়িশাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু’টি ‘উমরা করেছেন যিলকদ মাসে এবং একটি ‘উমরা করেছেন শাও্ওয়াল মাসে।
‘উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজ্জের পূর্বে যিলকদ মাসে তিনটি ‘উমরা করেছেন।
আনাস (রাঃ) বর্ণিত অত্র হাদীস এবং যে সমস্ত হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি দু’বার ‘উমরা করেছেন এর সমন্বয় এই যে, তারা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হজ্জের সাথে ‘উমরা গণ্য করেননি। আর তা ছিল যিলহজ্জ মাসে। অনুরূপভাবে হুদায়বিয়ার ‘উমরাকেও তারা গণ্য করেননি। এজন্য যে, তা পূর্ণতা পায়নি মুশরিকদের বাধা দেয়ার কারণে। আর যারা বলেছেন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিনবার ‘উমরা করেছেন তারা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হজ্জের সাথে ‘উমরাটি গণ্য করেননি তা যিলহজ্জ মাসে হজ্জের সাথে হওয়ার কারণে, যেমনটি ‘উমার (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে। ‘আয়িশাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত শাও্ওয়াল মাসের ‘উমরার সমন্বয় এই যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা শুরু করেছিলেন শাও্ওয়াল মাসের শেষের দিকে আর তা সমাপ্তি ঘটেছে যিলকদ মাসে।
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ
২৫১৯-[১৫] বারা ইবনু ’আযিব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (দশম হিজরীতে তাঁর বিদায়) হজ্জ/হজ পালন করার আগে যিলকদ মাসে দু’বার ’উমরা করেছিলেন। (বুখারী)[1]
اَلْفَصْلُ الْأَوَّلُ
وَعَنِ الْبَرَاءِ بْنِ عَازِبٍ قَالَ: اعْتَمَرَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي ذِي الْقَعْدَةِ قَبْلَ أَنْ يَحُجَّ مَرَّتَيْنِ . رَوَاهُ الْبُخَارِيُّ
ব্যাখ্যা: ‘আল্লামা কুসতুলানী বলেনঃ বারা ইবনু ‘আযিব (রাঃ)-এর বক্তব্য প্রমাণ করে না যে, অন্য ‘উমরা পালন করেননি। অথবা বারা (রাঃ) হুদায়বিয়ার ‘উমরাহকে গণ্য করেননি এজন্য যে, তা পূর্ণতা পায়নি। তেমনিভাবে হজ্জের সাথের ‘উমরাটিও গণ্য করেননি এজন্য যে, তা হজ্জের কার্যসমূহের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ‘আয়িশাহ্ (রাঃ) এবং ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ)-এর বক্তব্য নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যিলকদ মাস ছাড়া ‘উমরা করেননি। এটি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হজ্জের সাথের ‘উমরা-এর বিরোধী নয়। কেননা এ ‘উমরাটি শুরু হয়েছিল যিলকদ মাসে শেষ হয়েছে যিলহজ্জ মাসে।