পরিচ্ছেদঃ ৭. প্রথম অনুচ্ছেদ - মৌলিক দু‘আসমূহ
২৪৮২-[১] আবূ মূসা আল আশ্’আরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কোন কোন সময় এরূপ দু’আ করতেন,
’’আল্ল-হুম্মাগ্ ফিরলী খত্বীআতী ওয়া জাহলী ওয়া ইস্রা-ফী ফী আম্রী ওয়ামা- আন্তা আ’লামু বিহী মিন্নী, আল্ল-হুম্মাগ্ ফির্লী জিদ্দী ওয়া হাযলী ওয়া খত্বায়ি ওয়া ’আম্দী ওয়া কুল্লু যা-লিকা ’ইনদী, আল্ল-হুম্মাগ্ ফিরলী মা- কদ্দামতু ওয়ামা- আখখারতু ওয়ামা- আসরারতু ওয়ামা- আ’লানতু ওয়ামা- আনতা বিহী আ’লামু বিহী মিন্নী আনতাল মুকদ্দিমু ওয়া আনতাল মুআখখিরু ওয়া আনতা ’আলা- কুল্লি শাইয়িন কদীর’’
(অর্থাৎ- হে আল্লাহ! তুমি আমার গুনাহসমূহ মাফ করো, আমার অজ্ঞতা ও আমার কাজে সীমালঙ্ঘন, আর যা তুমি আমার চেয়েও বেশি জানো। হে আল্লাহ! আমার গুনাহসমূহ মাফ করো যা আমার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, খামখেয়ালী করা, ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় করা আর যা সবগুলোই আমার মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। হে আল্লাহ! তুমি আমার পূর্বের ও পরের গুনাহ, প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য গুনাহ মাফ করে দাও, আর যা তুমি আমার চেয়েও বেশি জানো। তুমিই আগে বাড়াও, তুমিই পেছনে হটাও এবং প্রত্যেকটি ব্যাপারেই তুমি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী।)। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
بَابُ جَامِعِ الدُّعَاءِ
عَنْ أَبِي مُوسَى الْأَشْعَرِيِّ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَنَّهُ كَانَ يَدْعُو بِهَذَا الدُّعَاءِ: «اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِي خَطِيئَتِي وَجَهْلِي وَإِسْرَافِي فِي أَمْرِي وَمَا أَنْتَ أَعْلَمُ بِهِ مِنِّي اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِي جَدِّي وَهَزْلِي وَخَطَئِي وَعَمْدِي وكلُّ ذلكَ عِنْدِي اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِي مَا قَدَّمْتُ وَمَا أَخَّرْتُ وَمَا أَسْرَرْتُ وَمَا أعلنت وَمَا أَنْت بِهِ أَعْلَمُ بِهِ مِنِّي أَنْتَ الْمُقَدِّمُ وَأَنْتَ الْمُؤَخِّرُ وَأَنت على كل شَيْء قدير»
ব্যাখ্যা: হাদীসে উল্লিখিত দু‘আটি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখন পড়তেন তার নিশ্চিত কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না। তবে বিভিন্ন বর্ণনায় যা পাওয়া যায় তার সারমর্ম হলো, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এ দু‘আটি সালাতের শেষ বৈঠকে পড়তেন। তবে সালামের পূর্বে না পরে পড়তেন তাও নিশ্চিতভাবে জানা যায় না। পূর্বে বা পরে যে কোন সময়ে পড়ার সম্ভাবনার কথাই হাদীসের বর্ণনায় পাওয়া যায়।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পূর্ণ মা‘সূম তথা নিষ্পাপ এবং তার আগের এবং পরের সকল গুনাহ থেকে তাকে মুক্ত বা ক্ষমাপ্রাপ্ত ঘোষণার পরেও তিনি এরূপ দু‘আ কেন করতেন? এর উত্তরে বলা যায়, প্রথমত তিনি আল্লাহর প্রতি বিনয় ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করণার্থে এরূপ দু‘আ করতেন। দ্বিতীয়ত তিনি এর মাধ্যমে তার দ্বারা কৃত অনিচ্ছাকৃত ভুল বা অলসতা থেকে মাফ চাইতেন। তৃতীয়ত তিনি নবূওয়াত প্রাপ্তির পূর্বে কৃতকর্মের প্রতি ইশারা করেছেন। চতুর্থত তিনি শুধু তার উম্মাতকে শিক্ষা দেয়ার জন্য এ দু‘আ করেছিলেন। মূলকথা হলো তিনি এ দু‘আ আল্লাহর প্রতি বিনয় প্রকাশ করণার্থেই করেছিলেন। কারণ দু‘আও ‘ইবাদাত। ইমাম নাবাবী (রহঃ) এরূপ মত পোষণ করেছেন।
এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ তা‘আলা সকল রকমের গুনাহ পূর্বের এবং পরের গোপন ও প্রকাশ্য জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে যেভাবেই সংঘটিত হোক না কেন তা ক্ষমা করার জন্য ক্ষমার ডালি নিয়ে সকল গুনাহকে ঘিরে রেখেছেন। অর্থাৎ- কোন গুনাহই আল্লাহর ক্ষমার আওতার বাইরে নয়।
পরিচ্ছেদঃ ৭. প্রথম অনুচ্ছেদ - মৌলিক দু‘আসমূহ
২৪৮৩-[২] আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (দু’আ) বলতেন,
’’আল্ল-হুম্মা আস্লিহ লী দীনিল্লাযী হুওয়া ’ইস্মাতু আম্রী ওয়া আস্লিহ লী দুন্ইয়া- ইয়াল্লাতী ফীহা- মা’আ-শী ওয়া আস্লিহ লী আ-খিরাতিল্লাতী ফীহা- মা’আ-দী ওয়াজ্’আলিল হায়া-তা যিয়া-দাতান লী ফী কুল্লি খয়রিন ওয়াজ্’আলিল মাওতা রা-হাতান লী মিন কুল্লি শাররিন’’
(অর্থাৎ- হে আল্লাহ! তুমি আমার জন্য আমার দীন [ধর্ম]-কে ঠিক করে দাও, যা ঠিক করে দেবে আমার কার্যাবলী। তুমি ঠিক করে দাও আমার দুনিয়া [ইহকাল], যাতে রয়েছে আমার জীবন। তুমি ঠিক করে দাও আমার আখিরাত [পরকাল], যেখানে আমি [অবশ্যই] ফিরে যাবো। আমার হায়াত [আয়ুষ্কাল] প্রত্যেক কল্যাণকর কাজের জন্য বাড়িয়ে দাও, আর আমার মৃত্যুকে আমার জন্য প্রত্যেক অকল্যাণ হতে শান্তিস্বরূপ কর।)। (মুসলিম)[1]
بَابُ جَامِعِ الدُّعَاءِ
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: «اللَّهُمَّ أَصْلِحْ لِي دِينِي الَّذِي هُوَ عِصْمَةُ أَمْرِي وَأَصْلِحْ لِي دُنْيَايَ الَّتِي فِيهَا مَعَاشِي وَأَصْلِحْ لِي آخِرَتِي الَّتِي فِيهَا مَعَادِي وَاجْعَلِ الْحَيَاةَ زِيَادَةً لِي فِي كُلِّ خَيْرٍ وَاجْعَلِ الْمَوْتَ رَاحَةً لِي مِنْ كُلِّ شَرٍّ» . رَوَاهُ مُسلم
ব্যাখ্যা: আমার দীনকে ঠিক করে দাও যাতে তা আমাকে জাহান্নামের আগুন ও আল্লাহর অসন্তোষ থেকে আমাকে রক্ষা করে। ইমাম মানাবী বলেন, যার দীন-ধর্ম ঠিক থাকে না তার সমস্ত কর্মই নষ্ট হয়ে যায়। ফলে সে দুনিয়া ও আখিরাতে ধ্বংসের মুখোমুখি ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আমার ইহকালকে ঠিক করে দাও যাতে রয়েছে আমার জীবনোপকরণ। এর অর্থ হলো আমার প্রয়োজনীয় বিষয় ও দ্রব্যাদি যথেষ্ট পরিমাণে এবং হালাল উপায়ে প্রদান করে আমার ইহকালকে ঠিক করে দাও। এর অর্থ এও হতে পারে যে, দুনিয়ায় আমার প্রয়োজনীয় বিষয়াদিতে বিদ্যমান সকল অনিষ্ট থেকে রক্ষা করো।
‘ইবাদাত করার তাওফীক (শক্তি), আনুগত্যে ইখলাস ও সুন্দর সম্মতির মাধ্যমে আমার আখিরাতকে ঠিক করে দাও। অর্থাৎ- আমার প্রত্যাবর্তনস্থল তথা আখিরাতের স্বার্থে তোমার আনুগত্য করার তাওফীক আমাকে দান করো।
ইখলাস, আনুগত্য ও ‘ইবাদাতে অধিক কল্যাণ অর্জনে আমার জীবনকে ব্যাপৃত রাখো। অর্থাৎ- যে কাজ তুমি ভালোবাস ও পছন্দ করো সে কাজ আমার জীবনকে ব্যস্ত রাখো আর যে কাজ তুমি অপছন্দ করো তা থেকে আমাকে দূরে রাখো।
আমার মৃত্যুকে আমার পক্ষে প্রত্যেক অকল্যাণ হতে শান্তিস্বরূপ করো। এর অর্থ হলো, আমার মৃত্যুর সময় আমাকে সঠিক বিশ্বাস, সাক্ষ্য ও তাওবার উপরে রাখো। যাতে করে আমার মৃত্যু দুনিয়ার কষ্ট থেকে পরিত্রাণের ও চূড়ান্ত প্রশান্তি অর্জনের উপায় হয়।
ইমাম শাওকানী (রহঃ) তাঁর ‘‘তুহফাতুয যাকিরীন’’ গ্রন্থে (পৃঃ ২৮৪) এ হাদীস সম্পর্কে লিখেছেনঃ
এ হাদীসটি ব্যাপক অর্থবোধক একটি হাদীস। কারণ এর মধ্যে দীন ও দুনিয়া উপকারিতার সকল দিক আলোচিত হয়েছে। দীনের সঠিক বুঝ ও ‘আমল হলো বান্দার সকল সম্পদের মূল এবং তার উদ্দিষ্ট লক্ষ্য। অত্র হাদীসে দুনিয়াকে জীবনোপকরণের ক্ষেত্র হিসেবে উল্লেখ করে আখিরাতের উপকারিতা অর্জনের দু‘আ করা হয়েছে যে, আখিরাতই হচ্ছে চূড়ান্ত প্রত্যাবর্তনস্থল। দীনের সঠিকতার প্রার্থনা এজন্যই করা হয়েছে যে, আল্লাহ যখন কারো দীনকে ঠিক করে দেন তখন তার আখিরাতকেও ঠিক করে দেন। এখানে প্রত্যেক ভাল কাজে জীবনকে বৃদ্ধি করে দেয়ার দু‘আ করা হয়েছে এজন্য যে, যার জীবনকে আল্লাহ অধিক কল্যাণ দ্বারা সমৃদ্ধ করেন তার জীবন কল্যাণ ও সফলতায় ভরপুর হয়। আর মৃত্যুকে সকল অকল্যাণ থেকে পরিত্রাণের উপায় করার অর্থ হলো মৃত্যুর মাধ্যমেই অকল্যাণের দরজা বন্ধ হয়। এর মধ্যে বান্দার জন্যে অনেক কল্যাণ রয়েছে। তবে এ জন্যে সরাসরি মৃত্যু কামনা না করে, বরং এ দু‘আ করা উচিত যা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন,
(اَللّٰهُمَّ أَحْيَنِيْ مَا كَانَتِ الْحَيَاةُ خَيْرًا لِّيْ، وَتَوَفَّنِيْ إِذَا كَانَتِ الْوَفَاةُ خَيْرً لِّيْ)
অর্থাৎ- ‘‘হে আল্লাহ! আমাকে ততক্ষণ জীবিত রাখো যতক্ষণ পর্যন্ত জীবন আমার জন্য কল্যাণকর। আর আমাকে মৃত্যু দান করো যখন আমার জন্য মৃত্যু কল্যাণকর।’’ (সহীহ মুসলিম হাঃ ২৬৮০)
এ দু‘আটি সবকিছুকে শামিল করে। আর এ কথা সবারই জানা যে, যার সারাটা জীবন শুধু অকল্যাণে ভরপুর তার জন্য জীবিত থাকার চেয়ে মৃত্যুই উত্তম ও প্রশান্তিদায়ক।
পরিচ্ছেদঃ ৭. প্রথম অনুচ্ছেদ - মৌলিক দু‘আসমূহ
২৪৮৪-[৩] ’আবদুল্লাহ ইবনু মাস্’ঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (দু’আয়) বলতেন,
’’আল্ল-হুম্মা ইন্নী আস্আলুকাল হুদা- ওয়াত্তুকা- ওয়াল ’আফা-ফা ওয়াল গিনা-’’
(অর্থাৎ- হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে হিদায়াত [সঠিক পথ], তাকওয়া [পরহেযগারিতা], হারাম থেকে বেঁচে থাকা ও অমুখাপেক্ষিতা প্রত্যাশা করি)। (মুসলিম)[1]
بَابُ جَامِعِ الدُّعَاءِ
وَعَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّهُ كَانَ يَقُولُ: «اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ الْهُدَى وَالتُّقَى وَالْعَفَافَ وَالْغِنَى» . رَوَاهُ مُسلم
ব্যাখ্যা: হাদীসে (الْهُدٰى) ‘‘হুদা-’’ বলতে হিদায়াত এবং (التُقٰى) ‘‘তুকা-’’ বলতে তাকওয়া বুঝানো হয়েছে। (الْعَفَافَ) ‘‘আফাফ’’ বলতে গুনাহ ও অনুচিত কর্ম থেকে বিরত থাকাকে বুঝানো হয়েছে। (الْغِنٰى) ‘‘গিনা-’’ বলতে মূলত অন্তরের ধনাঢ্যতা বা প্রাচুর্যতা বুঝানো হয়েছে; সম্পদের ধনাঢ্যতা নয়। অন্তরের প্রাচুর্যতা এমন সম্পদ থেকে ব্যক্তিকে আড়ালে রাখে যে সম্পদ ব্যক্তিকে আল্লাহর আনুগত্য থেকে বিচ্ছিন্ন রাখে এবং আল্লাহ তা‘আলা থেকে ভিন্ন কাজে অন্তরকে ব্যস্ত রাখে। তবে প্রশংসিত ধনাঢ্যতা হলো ঐ ধনাঢ্যতা যা ব্যক্তিকে দুনিয়ামুখী হওয়া ও দুনিয়ার প্রতি বেশি গুরুত্ব প্রদান থেকে বিরত রাখে।
তিনি বলেন, সাধারাণত ‘হুদা-’ ও ‘তুকা’ বলতে দুনিয়ার জীবনোপকরণ, আখিরাতের উপকরণ ও চরিত্রের মহৎ দিকসমূহ যা অর্জন করা উচিত তার সন্ধান পাওয়া এবং শির্ক, অবাধ্যতা ও চরিত্রের খারাপ দিকসমূহ যা বর্জন করা উচিত তা বর্জনে করাকে বুঝায়।
পরিচ্ছেদঃ ৭. প্রথম অনুচ্ছেদ - মৌলিক দু‘আসমূহ
২৪৮৫-[৪] ’আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, তুমি (দু’আ) বল,
’’আল্ল-হুম্মাহদিনী ওয়া সাদ্দিদনী ওয়াযকুর বিলহুদা- হিদা-য়াতাকাত্ব ত্বরীকা ওয়াবিস্ সাদা-দি সাদা-দাস্ সাহমি’’
(অর্থাৎ- ’হে আল্লাহ! আমাকে হিদায়াতের পথ দেখাও এবং আমাকে সরল-সোজা রাখো।’ আর ’হিদায়াত’ বলতে মনে করবে তুমি আল্লাহর পথ, আর ’সোজা’ বলতে খেয়াল করবে তীরের মতো সোজা।)। (মুসলিম)[1]
بَابُ جَامِعِ الدُّعَاءِ
وَعَنْ عَلِيٍّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «قُلْ اللَّهُمَّ اهْدِنِي وَسَدِّدْنِي وَاذْكُرْ بِالْهُدَى هِدَايَتَكَ الطَّرِيقَ وبالسداد سداد السهْم» . رَوَاهُ مُسلم
ব্যাখ্যা: ‘‘হে আল্লাহ! তুমি আমাকে হিদায়াত দান করো’’ এর অর্থ হলো কল্যাণকর কাজে আমাকে পথ দেখাও। এর অর্থ এও হতে পারে সিরাতে মুস্তাক্বীম-এর দিকে হিদায়াতের উপর আমাকে দৃঢ় রাখো অথবা আমাকে কামালিয়্যাত তথা পূর্ণ মু’মিন হওয়ার পথে অতিরিক্ত যোগ্যতা ও গুণাবলী দান করো।
‘‘আমাকে সোজা রাখো’’ এর অর্থ হলো আমার সকল কর্মে দৃঢ়তার সাথে সঠিক পথ অবলম্বনকারী বানাও। ইমাম ত্বীবী (রহঃ) বলেন, এর মধ্যেই আল্লাহর ঐ কথার অর্থ পাওয়া যায় যেখানে আল্লাহ বলেছেন, فَاسْتَقِمْ كَمَا أُمِرْتَ অর্থাৎ- ‘‘সুতরাং তুমি যেভাবে আদিষ্ট হয়েছ তাতে স্থির থাকো’’- (সূরা হূদ ১১ : ১১২)।
আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন, اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ ‘‘আমাদেরকে সরল পথ প্রদর্শন করো’’- (সূরা আল ফাতিহাহ্ ১ : ৫)। অর্থাৎ- আমাকে এমন হিদায়াত দান করো যাতে করে আমি বাড়াবাড়ি বা সীমালঙ্ঘন এবং অতিরিক্ত শৈথিল্য বা অলসতা এ দু’টির কোনটির দিকে ঝুঁকে না পড়ি।
পরিচ্ছেদঃ ৭. প্রথম অনুচ্ছেদ - মৌলিক দু‘আসমূহ
২৪৮৬-[৫] আবূ মালিক আল আশ্’জা’ঈ (রহঃ) হতে বর্ণিত। তিনি তার পিতা হতে বর্ণনা করেন। তার পিতা বলেন, যখন কোন লোক ইসলাম গ্রহণ করতেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে প্রথম সালাত শিক্ষা দিতেন। তারপর তাকে এ পূর্ণ বাক্যগুলো পড়ে দু’আ করতে আদেশ করতেন,
’’আল্ল-হুম্মাগফিরলী, ওয়ারহামনী, ওয়াহদিনী, ওয়া ’আ-ফিনী, ওয়ারযুকনী’’
(অর্থাৎ- হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা করো, আমাকে দয়া করো, আমাকে পথ দেখাও, আমাকে শান্তিতে রাখো এবং আমাকে রিযক দান করো)। (মুসলিম)[1]
بَابُ جَامِعِ الدُّعَاءِ
وَعَنْ أَبِي مَالِكٍ الْأَشْجَعِي عَنْ أَبِيهِ قَالَ: كَانَ الرجل إِذا أسلم علمه النَّبِي صلى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الصَّلَاةَ ثُمَّ أَمَرَهُ أَنْ يَدْعُوَ بِهَؤُلَاءِ الْكَلِمَاتِ: «اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِي وَارْحَمْنِي وَاهْدِنِي وَعَافِنِي وَارْزُقْنِي» . رَوَاهُ مُسلم
ব্যাখ্যা: কোন ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করলে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বপ্রথম তাকে সালাতের শর্ত ও রুকনসমূহ শিক্ষা দিতেন অথবা যে সালাত তার তৎকালে উপস্থিত সে সালাত শিক্ষা দিতেন কারণ তখন সালাত আদায় করা তার জন্য ফারযে আইন। অতঃপর তাকে হাদীসে উল্লিখিত শব্দগুলো শিক্ষা দিতেন এজন্য যে, এ শব্দসমূহ দুনিয়া ও আখিরাতের সমস্ত কল্যাণকে ধারণ করে। সে শব্দসমূহ হলো, হে আল্লাহ! তুমি আমার গুনাহসমূহ মুছে দেয়ার মাধ্যমে আমাকে ক্ষমা করো, আমার দোষ-ত্রুটিসমূহ ঢেকে রাখার মাধ্যমে আমার ওপর দয়া করো, আমাকে শান্তি ও নিরাপত্তার পথে পরিচালিত করো অথবা সরল প্রশস্ত পথের উপর আমাকে দৃঢ় রাখো, সমস্ত বিপদ ও ভুল-ভ্রান্তি থেকে আমাকে মুক্ত রাখো এবং আমাকে হালাল রিযক (জীবিকা) দান করো।
পরিচ্ছেদঃ ৭. প্রথম অনুচ্ছেদ - মৌলিক দু‘আসমূহ
২৪৮৭-[৬] আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অধিকাংশ সময়ই এ দু’আ করতেন, ’’আল্ল-হুম্মা আ-তিনা- ফিদ্দুন্ইয়া- হাসানাতাওঁ ওয়াফিল আ-খিরাতি হাসানাতাওঁ ওয়াকিনা- ’আযা-বান্না-র’’ (অর্থাৎ- হে আল্লাহ! আমাদেরকে দুনিয়ায় এবং আখিরাতে কল্যাণ দান করো। আর জাহান্নামের ’আযাব [শাস্তি] হতে বাঁচাও)। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
بَابُ جَامِعِ الدُّعَاءِ
وَعَن أنسٍ قَالَ: كَانَ أَكْثَرُ دُعَاءِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ «اللَّهُمَّ آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وقنا عَذَاب النَّار»
ব্যাখ্যা: নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দু‘আটি এজন্যে সবচেয়ে বেশি পড়তেন যে, এ দু‘আটি ব্যাপক অর্থবোধক ও কুরআন থেকে চয়নকৃত। দু‘আটির শুরু বিভিন্ন বর্ণনায় বিভিন্ন শব্দে এসেছে। কোথাও ‘‘আল্ল-হুম্মা আ-তিনা-’’, কোথাও ‘‘আল্ল-হুম্মা রব্বানা- আ-তিনা-’’, কোথাও ‘‘রব্বানা- আ-তিনা-’’ শব্দে এসেছে। সবগুলো বর্ণনাই সহীহ।
অত্র হাদীসে মৃত্যুর পূর্বে দুনিয়ায় হাসানাহ্ বলতে এবং মৃত্যুর পরে আখিরাতে হাসানাহ্ বলতে কী বুঝানো হয়েছে তা নিয়ে মুফাসসির ও ‘আলিমগণের বিভিন্ন মত পাওয়া যায়। নিম্নে মতসমূহ সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলোঃ কারো মতে, দুনিয়ায় হাসানাহ্ বলতে দুনিয়ায় ব্যক্তির ইচ্ছা ও স্বভাব অনুযায়ী জীবনোপকরণ, স্বচ্ছলতা, সুস্থতা, সুন্দরী মহিলা; এছাড়াও তার মন হালাল যা চায় ও তার চোখ হালাল যা কিছুর স্বাদ নিতে চায় তা। আর আখিরাতে হাসানাহ্ বলতে ঐসব কিছুকে বুঝানো হচ্ছে যা কোন মাধ্যমে বা মাধ্যম ছাড়াই ব্যক্তি পাবে তা। কারো মতে দুনিয়ায় হাসানাহ্ বলতে নেক্কার স্ত্রী ও আখিরাতে হাসানাহ বলতে জান্নাতী হূর এবং জাহান্নামের আগুনের ‘আযাব বলতে খারাপ নারীকে বুঝানো হয়েছে।
হাসান বাসরী (রহঃ)-এর মতে, দুনিয়াতে হাসানাহ্ বলতে উপকারী জ্ঞান, ‘ইবাদাত, পবিত্র রিযক এবং আখিরাতে হাসানাহ্ বলতে জান্নাত বুঝানো হয়েছে। কাতাদাহ্’র মতে, এর দ্বারা দুনিয়া ও আখিরাতে সুস্থতা ও নিরাপত্তা বুঝানো হয়েছে।
সুদ্দী ও মুকাতিল-এর মতে, দুনিয়ার হাসানাহ্ দ্বারা প্রশস্ত হালাল রিযক (জীবিকা), সৎ ‘আমল এবং আখিরাতের হাসানাহ্ দ্বারা ক্ষমা ও সাওয়াব উদ্দেশ্য। ‘আত্বিয়্যাহ্-এর মতে আখিরাতের হাসানাহ দ্বারা হিসাব সহজকরণ ও জান্নাতে প্রবেশকে বুঝানো হয়েছে। কারো মতে দুনিয়ার হাসানাহ্ হলো, সুস্থতা, ন্যূনতম প্রয়োজন মেটানো ও চারিত্রিক নিষ্কলুষতা এবং আখিরাতের হাসানাহ্ হলো পরকালে আল্লাহর নিকট থেকে সাওয়াব ও রহমাতপ্রাপ্তি।
হাফেয ইবনু কাসীর (রহঃ) তাঁর তাফসীরে বলেন, এ দু‘আটির মধ্যে দুনিয়ার সকল কল্যাণকেও একত্র করা হয়েছে এবং সকল মন্দকে দূর করা হয়েছে। এখানে ‘দুনিয়ার হাসানাহ্’ শব্দ ঐ সবকিছুকেই শামিল করে যা দুনিয়ার কাঙ্ক্ষিত বিষয় ও বস্ত্ত। যেমন- সুস্থতা বা সুস্বাস্থ্য, প্রশস্ত ঘর, সুন্দরী স্ত্রী, সৎকর্মশীল সন্তান, প্রশস্ত রিযক, উপকারী জ্ঞান, সৎ ‘আমল, হালকা বাহন, উত্তম প্রশংসা ইত্যাদি। এর কোনটিই দুনিয়ার হাসানার বাইরে নয়। অপরদিকে আখিরাতের হাসানাহ্ বলতে যা বুঝাচ্ছে তার সর্বোচ্চ হচ্ছে জান্নাতে প্রবেশের সুযোগ। এছাড়াও যা বুঝাচ্ছে তা হলো, খোলা মাঠে সর্বাধিক ভীতিপ্রদ চিৎকার থেকে নিরাপদ থাকা, হিসাব সহজ করা এবং আখিরাতের উত্তম কর্মসমূহ ও জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি। জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষার অর্থ হলো তা থেকে রক্ষাকারী কাজ। যেমন- হারাম ও গুনাহের কাজ থেকে দূরে থাকা এবং হারাম ও সন্দেহপূর্ণ বিষয়াবলী বর্জন করা।
ইমাম কুরতুবী বলেন, বেশিরভাগ ‘আলিমের মতে দুনিয়া ও আখিরাতের হাসানাহ্ বলতে এ দু’ স্থানের নিয়ামতসমূহ বুঝানো হচ্ছে। উল্লেখ্য যে, ‘আল্লামা কারী (রহঃ) বলেন, সম্ভবত নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এজন্য এ দু‘আটি সর্বাধিক পড়তেন যে, এটি ছিল একটি ব্যাপক দু‘আ; যা দুনিয়া ও আখিরাতের সকল কল্যাণকে শামিল করেছে। আর দু‘আর শেষাংশে জাহান্নামের আগুন থেকে আশ্রয় চাওয়ার দু‘আ করা হয়েছে যার অর্থ হচ্ছে হে আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে ঐ আগুন থেকে রক্ষা করো এবং যেসব বিষয় আগুনের নিকটবর্তী করে তা থেকেও আমাদের রক্ষা করো।