পরিচ্ছেদঃ ৬. প্রথম অনুচ্ছেদ - আশ্রয় প্রার্থনা করা
২৪৫৭-[১] আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা বিপদাপদে কষ্ট-ক্লিষ্ট ও দুর্ভাগ্যের আক্রমণ, ভাগ্যের অনিষ্টতা এবং বিপদগ্রস্তে শত্রুর উপহাস থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করো। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
بَابُ الْإِسْتِعَاذَةِ
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ «تَعَوَّذُوا بِاللَّهِ مِنْ جَهْدِ الْبَلَاءِ وَدَرَكِ الشَّقَاءِ وَسُوءِ القضاءِ وشَماتة الْأَعْدَاء»
ব্যাখ্যা: এখানে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাওয়ার আদেশ করার দ্বারা এর বৈধতা সাব্যস্ত হয়। বিপদ থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাওয়া তাকদীর (ভাগ্যের)-এর বিশ্বাসে পরিপন্থী নয়। আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাওয়া ও দু‘আ করাও ভাগ্যের বহিঃপ্রকাশ। যেমন কোন ব্যক্তির বিপদে পতিত হলো আর তার ভাগ্যে লেখা ছিল- যে এর থেকে মুক্তির জন্য আল্লাহর নিকট দু‘আ করবে তাই সে দু‘আ করল এবং মুক্তি লাভ করল। আর আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাওয়া ও দু‘আ করার মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি বান্দার প্রয়োজন ও ভীত-সন্ত্রস্ত ভাব প্রকাশ পায় (যা আল্লাহর কাম্য)।
অত্র হাদীসে যে বিষয় বা অবস্থাসমূহ থেকে আশ্রয় চাওয়ার কথা বলা হয়েছে সেগুলোর প্রথমটি হলো বিপদের কষ্ট। এখানে এমন বিপদের অবস্থা থেকে আশ্রয় চাইতে বলা হয়েছে- যে অবস্থায় বান্দাকে পরীক্ষা করা হয় এবং মৃত্যু কামনা করার মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ- এমন অবস্থা যখন মৃত্যু ও ঐ কঠিন অবস্থার মধ্যে যে কোন একটিকে বেছে নিতে বলা হয়, তাহলে সে ব্যক্তি ঐ কঠিন অবস্থা থেকে বাঁচতে মৃত্যুকে বেছে নেবে। কেউ কেউ বলেছেনঃ কঠিন বিপদ দ্বারা এমন বিপদ বুঝানো হয়েছে যা সহ্য করার কিংবা প্রতিরোধ করার ক্ষমতা ব্যক্তির নেই। কারো মতে এর দ্বারা স্বল্প অর্থ সম্পদ ও অধিক পরিবার-পরিজন বুঝানো হয়েছে।
মূলত এটি একটি ব্যাপক অবস্থা। এর মধ্যে সকল বিপদই অন্তর্ভুক্ত। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর থেকে আশ্রয় চেয়েছেন এজন্য যে, এ অবস্থা ব্যক্তিকে দীনের অনেক বিষয় পালনে অপারগ করে এবং বিপদ সহ্য করতে বাধা দেয়। ফলে সে বিপদে ধৈর্য ধারণ করতে না পেরে গুনাহে লিপ্ত হয়।
দুর্ভাগ্যের আক্রমণ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো খারাপ। ইমাম আশ্ শাওকানী (রহঃ) বলেন, দুর্ভাগ্যের আক্রমণ হলো পার্থিব বিষয়াবলীর ক্ষেত্রে কঠিন অবস্থার মুখোমুখি হওয়া ও সংকীর্ণ জীবন-যাপন করা। নিজের শরীরের, পরিবারের কিংবা সম্পদের অনিষ্ট সাধিত হওয়া। এটা কখনো পরকালীন বিষয়ের সাথে সম্পৃক্তও হয়। পার্থিব জীবনে কৃত গুনাহের কারণেও এরূপ শাস্তি দেয়া হতে পারে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর থেকে আশ্রয় চেয়েছেন এজন্য যে, এটি বিপদ-আপদ বা পরীক্ষার সর্বশেষ অবস্থা। এক্ষেত্রে যাকে পরীক্ষা করা হয় সে সাধারণত ধৈর্য ধারণ করতে পারে না। কারো কারো মতে, (وَدَرْكِ الشَّقَاءِ) বলতে জাহান্নামের একটি স্তরকে বুঝানো হয়েছে। এর অর্থ হলো দুর্ভাগ্যবানদের আবাসস্থল; জাহান্নামের এমন স্তর যেখানে দুর্ভাগ্যবানরা বসবাস করবে।
আশ্রয় চাওয়া তৃতীয় বিষয়টি হলো, ব্যক্তির ভাগ্যে নির্ধারিত এমন বিষয় যা তাকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে। এটা হতে পারে তার দীনের পার্থিব, ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা অর্থনৈতিক বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক ভাগ্যের খারাপী থেকে আশ্রয় চাওয়া দ্বারা ভাগ্যের প্রতি অসন্তুষ্টি প্রমাণ হয় না। কেননা ভাগ্যের খারাপ দিকগুলো থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাওয়ার বিষয়টিও আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত ভাগ্যের অন্তর্ভুক্ত। এজন্যই আল্লাহ তার বান্দাদের জন্য এটিকে বৈধ করেছেন। একই প্রেক্ষিতে বিতরের সালাতের কুনূতে পড়া হয় (وَقِنِىْ شَرَّ مَا قَضَيْتُ) ‘‘এবং তোমার নির্ধারিত ভাগ্যের খারাপ দিক থেকে আমাকে রক্ষা করো’’।
বান্দার ক্ষেত্রে ভাগ্য (কাযা) দু’ ভাগে বিভক্ত; ভাল ও মন্দ। আর আল্লাহ মন্দ ভাগ্য থেকে আশ্রয় চাইতে বলেছেন। এটি ঈমানের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। তাই ভাগ্যের ভাল-মন্দের প্রতি বিশ্বাসী মু’মিন ব্যক্তি ভাগ্যের মন্দ দিক থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করতে কোন নিষেধ নেই। কারণ ভাগ্যের ভাল-মন্দের প্রতি বিশ্বাস সম্পর্কিত হাদীস দ্বারা ভাগ্যের দু’টো দিকের প্রতি বিশ্বাসের কথাই বলা হয়েছে।
অপরদিকে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক ভাগ্যের মন্দ দিক থেকে আশ্রয় চাওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় বুঝা যায় যে, আমাদের ঈমান ও আশ্রয় চাওয়া উভয়টিই শারী‘আত প্রণেতা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদেশের অধীন। ‘আল্লামা সিন্দী (রহঃ) বলেন, এখানে ভাগ্য পরিবর্তন দ্বারা অস্থায়ী ভাগ্য উদ্দেশ্য করা হয়েছে; চিরস্থায়ী ভাগ্য নয়। চতুর্থ বিষয় হলো, শত্রুর হাসা বা খুশি হতে আশ্রয় চাওয়া। এখানে শত্রু দ্বারা দীনের এবং দীনের সাথে সম্পৃক্ত দুনিয়ার শত্রু বুঝানো হয়েছে। শত্রুর আনন্দ থেকে আশ্রয় চাওয়ার কথা বলা হয়েছে এজন্য যে, শত্রুর আনন্দ মানবমনে কঠিন প্রভাব বিস্তার করে।
এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, অন্ত্যমিলযুক্ত বাক্য রচনা করা মাকরূহ নয়।
পরিচ্ছেদঃ ৬. প্রথম অনুচ্ছেদ - আশ্রয় প্রার্থনা করা
২৪৫৮-[২] আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেনঃ ’’আল্ল-হুম্মা ইন্নী আ’ঊযুবিকা মিনাল হাম্মি ওয়াল হুযনি ওয়াল ’আজযি ওয়াল কাসালি ওয়াল জুবনি ওয়াল বুখলি, ওয়া যলা’ইদ্ দায়নি ওয়া গলাবাতির্ রিজা-ল’’ (অর্থাৎ- হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে দুশ্চিন্তা, শোক-তাপ, অক্ষমতা-অলসতা, কাপুরুষতা, কৃপণতা, ঋণের বোঝা ও মানুষের জোর-জবরদস্তি হতে আশ্রয় চাই)। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
بَابُ الْإِسْتِعَاذَةِ
وَعَنْ أَنَسٍ قَالَ كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: «اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْهَمِّ وَالْحُزْنِ وَالْعَجْزِ وَالْكَسَلِ وَالْجُبْنِ وَالْبُخْلِ وَضَلَعِ الدَّيْنِ وَغَلَبَةِ الرِّجَالِ»
ব্যাখ্যা: (اَلْعَجْزِ) বা অক্ষমতা বলতে ইমাম নাবাবী (রহঃ) কল্যাণকর কাজ করার ক্ষমতা না থাকাকে বুঝিয়েছেন। (اَلْكَسَلِ) বা অলসতা দ্বারা মূলত কল্যাণকর কাজ করতে উদ্দীপনা অনুভব না করা এবং তা করার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তা করতে আগ্রহ না থাকা। (اَلْجُبْنِ) বা কাপুরুষতা দ্বারা সাহসহীনতা বুঝানো হয়েছে। কারো মতে এর দ্বারা প্রাণভয়ে যুদ্ধে যেতে না চাওয়া কিংবা আবশ্যক অধিকার আদায় থেকে নিজের জীবন ও সম্পদকে বিরত রাখা। (اَلْبُخْلِ) বা কৃপণতা দ্বারা দানশীলতার বিপরীত স্বভাবকে বুঝানো হয়েছে। শারী‘আতের দৃষ্টিতে কৃপণতা বলতে আবশ্যক দান না করাকে বুঝায়।
ইমাম নাবাবী (রহঃ) বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাপুরুষতা ও কৃপণতা থেকে আশ্রয় চেয়েছেন এজন্য যে, এগুলো ইসলামের ওয়াজিব কাজগুলো আদায় করতে, আল্লাহর হকসমূহ পালন করতে, অন্যায় দূরীকরণে, আল্লাহদ্রোহীদের বিরুদ্ধে কঠোর হতে অক্ষম করে। সাহসিকতার দ্বারা ব্যক্তি ‘ইবাদাতসমূহ সঠিকভাবে পালন করতে পারে, মাযলূমকে সহযোগিতা করতে ও জিহাদে অংশগ্রহণ করতে পারে এবং কৃপণতা থেকে নিরাপদ থাকলে ব্যক্তি আর্থিক হকসমূহ আদায় করতে পারে এবং আল্লাহর পথে খরচ করতে, দানশীল হতে ও চারিত্রিক উৎকর্ষ সাধনে উদ্দীপ্ত হয়। নিজের নয় এমন জিনিসের প্রতি লোভ করা থেকে বিরত হয়।
(ضَلَعِ الدَّيْنِ) বা ঋণের বোঝা দ্বারা ঋণের ভারে জর্জরিত হওয়া এবং এর কাঠিন্যকে বুঝানো হয়েছে। এর দ্বারা মূলত এমন অবস্থাকে বুঝানো হয়েছে যখন কোন ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি ঋণ পরিশোধের জন্য কিছুই পায় না; বিশেষ করে মানুষের কাছে সাহায্যের আবেদন করার পরও। এজন্যই পূর্ববর্তী অনেক পণ্ডিত বলেছেন, (ما دخل هم الدين قلبًا إلا أذهب من العقل ما لا يعود إليه) অর্থাৎ- ‘‘ঋণের দুশ্চিন্তা ঋণী ব্যক্তির অন্তরে প্রবেশ করে জ্ঞান-বুদ্ধির এমন কিছু দূর করে দেয় যা তার নিকট আর ফেরত আসে না।’’
পরিচ্ছেদঃ ৬. প্রথম অনুচ্ছেদ - আশ্রয় প্রার্থনা করা
২৪৫৯-[৩] ’আয়িশাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেনঃ
’’আল্ল-হুম্মা ইন্নী আ’ঊযুবিকা মিনাল কাসালি ওয়াল হারামি ওয়াল মাগ্রামি ওয়াল মা’সামি, আল্ল-হুম্মা ইন্নী আ’ঊযুবিকা মিন্ ’আযা-বিন্ না-রি ওয়া ফিত্নাতিন্ না-রি ওয়া ওয়া ফিতনাতিল কব্রি ’আযা-বিল কব্রি ওয়ামিন্ শার্রি ফিত্নাতিল গিনা-, ওয়ামিন্ শার্রি ফিত্নাতিল ফাকরি ওয়ামিন্ শার্রি ফিত্নাতিল মাসীহিদ্ দাজ্জা-লি, আল্ল-হুম্মাগসিল খত্বা-ইয়া-ইয়া বিমা-য়িস্ সালজি ওয়াল বারাদি ওয়া নাক্কি কলবী কামা- ইউনাক্কাস্ সাওবুল আবয়াযু মিনাদ্দানাসি ওয়াবা-’ইদ্ বায়নী ওয়াবায়না খত্বা-ইয়া-ইয়া কামা- বা’আদ্তা বায়নাল মাশরিকি ওয়াল মাগ্রিব’’
(অর্থাৎ- হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে অলসতা, বার্ধক্য, ঋণ ও গুনাহ থেকে আশ্রয় চাই। হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে জাহান্নামের আগুন, জাহান্নামের পরীক্ষা, কবরের পরীক্ষা ও শাস্তি হতে, স্বচ্ছলতার পরীক্ষার মন্দাভাব ও দারিদ্রের পরীক্ষার মন্দাভাব হতে এবং মাসীহুদ (কানা) দাজ্জালের পরীক্ষার অনিষ্টতা হতে আশ্রয় চাই। হে আল্লাহ! তুমি আমার গুনাহসমূহ বরফের ও শিলার পানি দিয়ে ধুয়ে দাও। আমার অন্তরকে পরিষ্কার করে দাও যেভাবে সাদা কাপড়, ময়লা হতে পরিষ্কার করা হয় এবং আমার ও আমার গুনাহের মধ্যে এমন ব্যবধান তৈরি করে দাও যেমনভাবে পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে রেখেছো।)। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
بَابُ الْإِسْتِعَاذَةِ
وَعَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ: كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: «اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْكَسَلِ وَالْهَرَمِ وَالْمَغْرَمِ وَالْمَأْثَمِ اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ عَذَابِ النَّارِ وَفِتْنَةِ النَّارِ وَفِتْنَةِ الْقَبْرِ وَعَذَابِ الْقَبْرِ وَمِنْ شَرِّ فِتْنَةِ الْغِنَى وَمِنْ شَرِّ فِتْنَةِ الْفَقْرِ وَمِنْ شَرِّ فِتْنَةِ الْمَسِيحِ الدَّجَّالِ اللَّهُمَّ اغْسِلْ خَطَايَايَ بِمَاءِ الثَّلْجِ وَالْبَرَدِ وَنَقِّ قَلْبِي كَمَا يُنَقَّى الثَّوْبُ الْأَبْيَضُ مِنَ الدَّنَسِ وَبَاعِدْ بَيْنِي وَبَيْنَ خَطَايَايَ كَمَا بَاعَدْتَ بَيْنَ الْمَشْرِقِ وَالْمغْرب»
ব্যাখ্যা: অত্র হাদীসের (اَلْهَرَمِ) ‘‘আল হারাম’’ বলতে বার্ধক্যকে বুঝানো হয়েছে। যখন মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি ক্রমশ লোপ পেতে থাকে, আল্লাহর আনুগত্যমূলক কাজকর্ম পালনে অক্ষমতা আসে, কিছু ‘ইবাদাত পালনে অলসতা আসে, ইন্দ্রিয় শক্তি দুর্বল হতে থাকে। এমতাবস্থায় ইন্দ্রিয় শক্তির সুস্থতা ও সঠিক বুঝ ক্ষমতা থাকাসহ দীর্ঘ বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকার প্রতি এ হাদীসে দু‘আ করতে বলা হয়েছে।
এখানে আগুনের শাস্তি দ্বারা এর ফিতনা থেকে আশ্রয় চাওয়ার কথা বলা হয়েছে। ‘আল্লামা কারী বলেছেনঃ এর অর্থ হলো আমি জাহান্নামী বা আগুনের অধিবাসী হওয়া থেকে আপনার নিকট আশ্রয় চাই। (فِتْنَةِ النَّارِ) বা আগুনের ফিতনা দ্বারা এমন ফিতনাহ্ বা পরীক্ষাকে বুঝানো হয়েছে যা আগুনের শাস্তির দিকে নিয়ে যায়। এর দ্বারা জাহান্নামের প্রহরীদের প্রশ্নকেও বুঝানো হতে পারে, যার কথা ৬৭ নং সূরার ৮ নং আয়াতে বলা হয়েছে। ফিতনা দ্বারা মূলত পরীক্ষা, কাঙ্ক্ষিত বহু অর্জনে গাফলতি, দীন থেকে প্রত্যাবর্তন করার জন্য বাধ্য করা; বিভ্রান্তি, গুনাহ, কুফর, ‘আযাব ইত্যাদি বুঝানো হয়। কবরের ফিতনা বলতে কবরে নিয়োজিত দু’জন মালাকের (ফেরেশতার) করা প্রশ্নের উত্তরে বেদিশা হয়ে যাওয়া।
ইমাম শাওকানী (রহঃ) বলেন, শয়তান মৃত ব্যক্তিকে তার কবরে কুমন্ত্রণা দেয় যাতে করে সে মালায়িকাহ্’র (ফেরেশতাগণের) করা প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে না পারে।
ধনীর ফিতনার অনিষ্টতা হচ্ছে অহংকার, অবাধ্যতা, হারাম পন্থায় সম্পদ উপার্জন ও গুনাহের কাজে তা খরচ করা, সম্পদের ও সম্মানের অহংকার করা, সম্পদের যে ফরয ও নফল হক রয়েছে তা হকদারকে প্রদান করতে কৃপণতা করা।
দারিদ্র্যতার ফিতনার অনিষ্টতা হচ্ছে বিরক্ত হওয়া, অধৈর্য হওয়া, প্রয়োজনে হারাম কিংবা এর সদৃশ কোন কর্মে পতিত হওয়া। কারীর মতে, এটা হচ্ছে ধনীদের হিংসা করা, তাদের ধন-সম্পদ কামনা করা, আল্লাহ তার জন্য যা বণ্টন করেছেন তাতে অসন্তুষ্ট হওয়া ইত্যাদি সহ এমন সকল কর্ম যার শেষ পরিণতি প্রশংসনীয় নয়।
পরিচ্ছেদঃ ৬. প্রথম অনুচ্ছেদ - আশ্রয় প্রার্থনা করা
২৪৬০-[৪] যায়দ ইবনু আরক্বম (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেনঃ
’’আল্ল-হুম্মা ইন্নী আ’ঊযুবিকা মিনাল ’আজযি ওয়াল কাসালি ওয়াল জুবনি ওয়াল বুখলি ওয়াল হারামি ওয়া ’আযা-বিল কবরি, ’আল্ল-হুম্মা আ-তি নাফসী তাকওয়া-হা- ওয়াযাক্কিহা- আন্তা খয়রু মিন্ যাক্কা-হা- আন্তা ওয়ালিয়্যুহা- ওয়ামাও লা- হা-, আল্ল-হুম্মা ইন্নী আ’ঊযুবিকা মিন্ ’ইল্মিন লা- ইয়ানফা’উ ওয়ামিন্ কলবিন লা- ইয়াখশা’উ ওয়ামিন্ নাফসিন লা- তাশবা’উ ওয়ামিন্ দা’ওয়াতিন্ লা- ইউসতাজা-বু লাহা-’’
(অর্থাৎ- হে আল্লাহ! আমি অক্ষমতা, অলসতা, কাপুরুষতা, কৃপণতা, বার্ধক্য ও কবরের ’আযাব হতে তোমার কাছে আশ্রয় চাই। হে আল্লাহ! তুমি আমার আত্মাকে সংযমী করো ও একে পবিত্র করো। তুমিই শ্রেষ্ঠ পুতঃপবিত্রকারী, তুমি তার অভিভাবক ও রব। হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে ঐ জ্ঞান লাভ হতে আশ্রয় চাই, যে জ্ঞান (আত্মার) কোন উপকারে আসে না, ঐ অন্তর হতে মুক্তি চাই যে অন্তর তোমার ভয়ে ভীত হয় না। ঐ মন হতে আশ্রয় চাই যে মন তৃপ্তি লাভ করে না এবং ঐ দু’আ হতে, যে দু’আ কবূল করা হয় না।)। (মুসলিম)[1]
بَابُ الْإِسْتِعَاذَةِ
وَعَنْ زَيْدِ بْنِ أَرْقَمَ قَالَ: كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: «اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْعَجْزِ وَالْكَسَلِ وَالْجُبْنِ وَالْبُخْلِ وَالْهَرَمِ وَعَذَابِ الْقَبْرِ اللَّهُمَّ آتِ نَفْسِي تَقْوَاهَا وَزَكِّهَا أَنْتَ خَيْرُ مَنْ زَكَّاهَا أَنْتَ وَلِيُّهَا وَمَوْلَاهَا اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ عِلْمٍ لَا يَنْفَعُ وَمِنْ قَلْبٍ لَا يَخْشَعُ وَمِنْ نَفْسٍ لَا تَشْبَعُ وَمِنْ دَعْوَةٍ لَا يُسْتَجَاب لَهَا» . رَوَاهُ مُسلم
ব্যাখ্যা: অত্র হাদীসে (الْجُبْنُ) ‘‘জুবন’’ বা কাপুরুষতা বলতে মূলত আল্লাহর সন্তুষ্টিমূলক শার‘ঈ বড় বড় ও কষ্টসাধ্য কাজ যেমন ফাতাওয়া ও নেতৃত্ব দেয়ার মতপর্যায়ের শার‘ঈ জ্ঞান অর্জন করার যোগ্যতাকে বুঝানো হয়েছে। তবে কারো যদি মেধা, বুঝ-ব্যবস্থা, মুখস্থশক্তি কম থাকে কিংবা দৈনন্দিন জীবিকা অর্জনের কাজে ব্যস্ত থাকতে হয় তাহলে তার ক্ষেত্রে ঐ পর্যায়ে না পৌঁছতে পারাটা কাপুরুষতা বলে গণ্য হবে না। আর এখানে (الْبُخْلُ) ‘‘বুখল’’ বা কৃপণতা বলতে মানুষের দীনী কোন বিষয়ে মানুষ কিছু জানতে চাইলে তা তাদেরকে না জানানোকে বুঝানো হয়েছে।
কবরের ‘আযাব বলতে কবর সংকীর্ণ হওয়া, অন্ধকারাচ্ছন্ন হওয়া, নিঃসঙ্গতা, হাতুড়ির পিটুনি, সাপ-বিচ্ছুর দংশন ও এ জাতীয় অন্যান্য শাস্তিকে বুঝানো হয়েছে। তবে এখানে কবরের আযাব থেকে আশ্রয় চাওয়ার দ্বারা যেসব কাজ কবরের ‘আযাবের কারণ। যেমন- চোগলখোরী, একের কথা অপরের কাছে বলা (নেতিবাচক অর্থে), প্রসাব থেকে যথাযথভাবে পবিত্র না হওয়া ইত্যাদি থেকে আশ্রয় চাওয়ার কথা বলা হয়েছে।
আত্মার তাকওয়া বা সংযম দ্বারা মূলত সকল বর্জনীয় কথা ও কর্ম থেকে আত্মাকে সংরক্ষিত রাখাকে বুঝানো হয়েছে। আর অন্তরকে পবিত্র করার দ্বারা একে সকল গুনাহ থেকে পবিত্র করা, সকল দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত করা এবং অন্তরকে ঈমানের আলোয় পূর্ণভাবে আলোকিত করে পবিত্র করার আহবান জানানো হয়েছে।
ওলী বলতে ব্যবস্থাপক, সংস্কারক, সৌন্দর্যকারক বা সাহায্যকারী বুঝানো হয়েছে। মাওলা অর্থও একই।
অত্র হাদীসে এমন জ্ঞান যা উপকারে আসে না সে জ্ঞান থেকে আশ্রয় চাওয়ার কথা বলা হয়েছে। আর সে জ্ঞান হলো ঐ জ্ঞান যে জ্ঞান অনুযায়ী বাস্তব কর্ম সম্পাদিত হয় না। অর্থাৎ- ‘আমলে পরিণত হয় না, যা মানুষকে শিক্ষা দেয়া হয় না, যে জ্ঞানের বারাকাত আমার অন্তরে প্রবেশ করে না; যে জ্ঞান আমার কর্ম, কথা, খারাপ চরিত্রকে পরিবর্তন করে আল্লাহর দিকে ধাবিত করে না এবং চরিত্রকে সভ্য ও মার্জিত করে না।
ঐ জ্ঞান দ্বারা এটাও বুঝানো হতে পারে, যে জ্ঞান অর্জনের কোন প্রয়োজন দীনে নেই কিংবা যে জ্ঞান অর্জনে শারী‘আত অনুমতি দেয় না।
এমন অন্তর থেকে আশ্রয় চাওয়ার কথা বলা হয়েছে, যে অন্তর আল্লাহকে ভয় করে না, আল্লাহর স্মরণে বা তাঁর কালাম তথা কথা শুনে ভীত হয় না। এ অন্তর হলো কঠোর অন্তর। কারী বলেনঃ এ অন্তর হলো ঐ অন্তর যা আল্লাহর যিকিরের মাধ্যমে প্রশান্ত হয় না।
এমন আত্মা থেকেও আশ্রয় চাওয়ার কথা বলা হয়েছে, যে আত্মা তার প্রতি আল্লাহর দেয়া রিযক-এর প্রতি সন্তুষ্টি হতে পারে না। অর্থ-সম্পদের অধিক লোভ থেকে যে মুক্ত হতে পারে না। এমন ব্যক্তি, যে বেশি বেশি খায় এবং বেশি খাওয়ার কারণে বেশি বেশি ঘুমায়, অলস থাকে, শায়ত্বনী কুমন্ত্রণা অন্তরে উদিত হয়, অন্তরের ব্যাধি সৃষ্টি হয় যা ক্রমশ তাকে দুনিয়া ও আখিরাতের ক্ষতির দিকে নিয়ে যায়। ইবনুল মালিক বলেনঃ এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, দুনিয়ার সকল সম্পদের প্রতি লোভ (যা দেখে তাই সংগ্রহ করতে চায়) এবং দুনিয়ার বিভিন্ন পদ পদবী অর্জনের লোভ। এখানে ঐসব অন্তর থেকে আশ্রয় চাওয়ার কথা বলা হয়েছে যেগুলোর পেটের ক্ষুধার চেয়ে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষুধা (চোখের ক্ষুধা) বেশি।
এমন দু‘আ থেকেও আশ্রয় চাওয়ার কথা বলা হয়েছে যে দু‘আ কবূল হয় না এজন্য যে, ঐ দু‘আর মধ্যে গুনাহ থাকে অথবা সত্যের অনুকূলে থাকে না। তবে এখানে সাধারণভাবে সকল দু‘আ কবূল না হওয়ার কথাই বলা হয়েছে।
ইমাম শাওকানী (রহঃ) বলেনঃ নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে জ্ঞান উপকারে আসে না সে জ্ঞান থেকে আশ্রয় চেয়েছেন এজন্য যে, ঐ জ্ঞান জ্ঞানীর জন্য বিপদের কারণ হবে এবং তার বিরুদ্ধে দলীল হিসেবে দাঁড়াবে। যে অন্তর আল্লাহর ভয়ে ভীত হয় না তা থেকে আশ্রয় চেয়েছেন এজন্য যে, এ অন্তর হয় কঠিন ও শক্ত। কোন ওয়াজ, নাসীহাত, ভয়-ভীতি, আশার বাণী কোন কিছুই এ অন্তরের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। যে আত্মা পরিতৃপ্ত হয় না না থেকে আশ্রয় চেয়েছেন এজন্য যে, এ আত্মা সামান্য তুচ্ছ বস্ত্ত অর্জনেও কুকুরের মতো ঝাঁপিয়ে পরে এবং হারাম অর্থ-সম্পদ অর্জনে দুঃসাহস দেখায়, আল্লাহ তা‘আলার দেয়া রিযক্বে তুষ্ট থাকে না, সে দুনিয়ার পরিশ্রমে সর্বদা ডুবে থাকে এবং আখিরাতের শাস্তিতে নিমজ্জিত থাকবে।
নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে দু‘আ কবূল হয় না তা থেকে আশ্রয় চেয়েছেন এজন্য যে, আল্লাহ এমন রব যিনি দানকারী, প্রশস্ত হাতের অধিকারী এবং বান্দার উপকার সাধনকারী। বান্দা যখন তাঁর কাছে দু‘আ করে আর সে দু‘আ যদি কবূল না হয় তাহলে ঐ দু‘আকারীর জন্য ধ্বংস ছাড়া আর কোন পথ নেই। কারণ সে এমন সত্তার নিকট থেকে খালি হাতে বিতাড়িত হয়েছে যে ছাড়া আর কারো কাছ থেকে কল্যাণ আশা করা যায় না এবং সে ছাড়া কারো কাছ থেকে অনিষ্টের প্রতিরোধ আশা করা যায় না। হে আল্লাহ! আমরাও তোমার কাছে ঐসব জিনিস ও বিষয় থেকে আশ্রয় চাই যেগুলো থেকে তোমার নিকট আশ্রয় চেয়েছেন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
পরিচ্ছেদঃ ৬. প্রথম অনুচ্ছেদ - আশ্রয় প্রার্থনা করা
২৪৬১-[৫] ’আবদুল্লাহ ইবনু ’উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দু’আগুলোর মধ্যে এটাও ছিল, ’’আল্ল-হুম্মা ইন্নী আ’ঊযুবিকা মিন্ যাওয়া-লি নি’মাতিকা ওয়া তাহাওউলি ’আ-ফিয়াতিকা ওয়া ফুজা-আতি নিকমাতিকা ওয়া জামী’ই সাখাত্বিকা’’ (অর্থাৎ- হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে আশ্রয় চাই [আমার ওপর] তোমার নিয়ামতের ঘাটতি, [আমার ওপর হতে] তোমার নিরাপত্তার ধারাবাহিকতা, [আমার ওপর] তোমার শাস্তির অকস্মাৎ আক্রমণ এবং তোমার সমস্ত অসন্তুষ্ট হতে।)। (মুসলিম)[1]
بَابُ الْإِسْتِعَاذَةِ
وَعَن عبد بنِ عمرَ قَالَ: كَانَ مِنْ دُعَاءِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى الله عَلَيْهِ سوسلم: «اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ زَوَالِ نِعْمَتِكَ وَتَحَوُّلِ عَافِيَتِكَ وَفُجَاءَةِ نِقْمَتِكَ وَجَمِيعِ سَخَطِكَ» . رَوَاهُ مُسلم
ব্যাখ্যা: অত্র হাদীসে বান্দার ওপর আল্লাহর দেয়া দীনী ও পার্থিব অনুগ্রহ যেগুলো আখিরাতের কাজের জন্য উপকারী এবং সেগুলোর পরিবর্তে ভাল কিছু দেয়া ছাড়া তা উঠিয়ে নেয়া থেকে আশ্রয় চাওয়ার কথা বলা হয়েছে। এ অনুগ্রহ প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য হতে পারে। ইমাম শাওকানী (রহঃ) বলেছেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর অনুগ্রহ চলে যাওয়া থেকে আশ্রয় চেয়েছেন এজন্য যে, এরূপ অবস্থা তখনই হয় যখন বান্দা নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করে না এবং যে কাজ করলে নিয়ামত আসে তার চর্চা করে না। (এটা খুবই খারাপ অবস্থা।)
(تَحَوُّلِ عَافِيَتِكَ)-এর অর্থ হলো- কান, চোখসহ সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সুস্থতা চলে গিয়ে সেগুলো অসুস্থ হয়ে যাওয়া।
হঠাৎ শাস্তি বলতে এমন অবস্থায় শাস্তি আসা যে, যার ওপর শাস্তি আসছে সে শাস্তি আসার পূর্বে জানছে না যে, তার ওপর শাস্তি আসছে। এখানে শাস্তি বলতে সাধারণভাবে আল্লাহর অসন্তোষ ও শাস্তি বুঝানো হলেও বিশেষভাবে ‘‘হঠাৎ শাস্তি’’ শব্দের উল্লেখের মাধ্যমে এটা বুঝানো হচ্ছে যে, ধীরে ধীরে শাস্তি আসার থেকে হঠাৎ শাস্তি চলে আসা বেশি বিপজ্জনক।
নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হঠাৎ শাস্তি থেকে এজন্য আশ্রয় চেয়েছেন যে, শাস্তি হঠাৎ চলে আসলে সে ব্যক্তি তাওবাহ্ করার কোন সুযোগ পায় না। আল্লাহ যখন কোন বান্দা থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করতে চান তখন তিনি ঐ বান্দার ওপর এমন শাস্তি দেন যা প্রতিরোধ করার কোন ক্ষমতা কারো থাকে না। এমনকি সারা দুনিয়ার সমস্ত সৃষ্টি মিলে চেষ্টা করলেও তা প্রতিরোধ করতে পারবে না। যেমন কথা সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।
আল্লাহর রাগ থেকে আশ্রয় চাওয়ার মাধ্যমে ঐ সমস্ত কাজ থেকে আশ্রয় চাওয়ার কথা বলা হয়েছে যেগুলো আল্লাহর রাগের কারণ হয়। এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহর রাগের প্রভাব থেকে আশ্রয় চাওয়া। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাগ থেকে এজন্য আশ্রয় চেয়েছেন যে, আল্লাহ সুবহানাহূ ওয়াতা‘আলা যখন কোন বান্দার ওপর রাগান্বিত হন তখন ঐ বান্দার ধ্বংস অনিবার্য। যদিও তা কোন তুচ্ছ বিষয়ে অথবা কোন ছোট কারণে হয়ে থাকে।
পরিচ্ছেদঃ ৬. প্রথম অনুচ্ছেদ - আশ্রয় প্রার্থনা করা
২৪৬২-[৬] ’আয়িশাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে দু’আ করতেন, ’’আল্ল-হুম্মা ইন্নী আ’ঊযুবিকা মিন শাররি মা- ’আমিলতু ওয়ামিন্ শাররি মা-লাম আ’মাল’’ (অর্থাৎ- হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে আশ্রয় চাই যা আমি করেছি এবং যা আমি করিনি তার অনিষ্টতা বা অপকারিতা হতে)। (মুসলিম)[1]
بَابُ الْإِسْتِعَاذَةِ
وَعَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ: كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: «اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا عَمِلْتُ وَمِنْ شَرِّ مَا لَمْ أعمَلْ» . رَوَاهُ مُسلم
ব্যাখ্যা: ইমাম ত্বীবী (রহঃ) বলেন, যেসব জিনিস থেকে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে মুক্ত রাখা হয়েছে সেসব জিনিস থেকে আশ্রয় চাওয়ার কারণ হলো, এর দ্বারা তিনি বুঝাচ্ছেন যে, আল্লাহকে যেন ভয় করা হয়, তাঁর মহত্ব ঘোষণা করা হয়, তাঁর প্রতি মুখাপেক্ষী হয়, তাকে যেন অনুসরণ করা হয় এবং আল্লাহর নিকট কিভাবে, কোন্ দু‘আ করতে হয় তা বর্ণনা করা।
ইমাম শাওকানীও বলেছেনঃ নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দু‘আগুলো এজন্য বলেছেন যে, তিনি তাঁর উম্মাতকে দু‘আ শিক্ষা দিচ্ছেন। তাছাড়া তার সমস্ত ‘আমলের মধ্যেই ভাল রয়েছে; কোন খারাপ নেই।
হাদীসে ব্যক্তির কৃতকর্মের মধ্য থেকে যেসব কাজ থেকে আল্লাহর নিকট মাফ চাওয়া প্রয়োজন হয় সেগুলো থেকে আশ্রয় চাইতে বলা হয়েছে।
তারপর আল্লাহর অসন্তুষ্টিমূলক যেসব কাজ ভবিষ্যতে করা হবে তার অনিষ্ট থেকেও আশ্রয় চাওয়া হচ্ছে। যাতে করে ভবিষ্যতে করা হবে এমন খারাপ কাজ থেকে আল্লাহ হিফাযাত করেন। কারণ ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন ছাড়া কেউ নিজেকে আল্লাহর কৌশল থেকে নিরাপদ মনে করে না। তাই প্রত্যেকের উচিত অতীত ও ভবিষ্যতের খারাপ কাজ থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাওয়া। ইমাম সিন্দী (রহঃ) বলেনঃ ‘‘কৃতকর্মের খারাপী থেকে’’ বলতে অতীতে যেসব গুনাহের কাজ করা হয়েছে এবং যেসব সাওয়াবের কাজ বর্জন করেছে তার অনিষ্ট থেকে আশ্রয় চাওয়ার কথা বলা হয়েছে।
পরিচ্ছেদঃ ৬. প্রথম অনুচ্ছেদ - আশ্রয় প্রার্থনা করা
২৪৬৩-[৭] ’আবদুল্লাহ ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (দু’আ) বলতেন,
’’আল্ল-হুম্মা লাকা আস্লাম্তু, ওয়াবিকা আ-মান্তু, ওয়া ’আলায়কা তাওয়াক্কালতু, ওয়া ইলায়কা আনাবতু, ওয়াবিকা খ-সমতু, আল্ল-হুম্মা ইন্নী আ’ঊযু বি’ইয্যাতিকা লা- ইলা-হা ইল্লা- আন্তা, আন্ তুযিল্লানী। আন্তাল হাইয়্যুল্লাযী লা- ইয়ামূতু, ওয়াল জিন্নু ওয়াল ইন্সু ইয়ামূতূনা’’
(অর্থাৎ- হে আল্লাহ! আমি তোমারই কাছে সমর্পণ করলাম, তোমারই ওপর বিশ্বাস স্থাপন করলাম, তোমারই ওপর ভরসা করলাম এবং তোমারই দিকে নিজকে ফিরালাম এবং তোমারই সাহায্যে [শত্রুর সাথে] লড়লাম। হে আল্লাহ! আমি পথভ্রষ্টতা হতে তোমার মর্যাদার আশ্রয় গ্রহণ করছি। তুমি ছাড়া সত্য আর কোন মা’বূদ নেই, তুমি চিরঞ্জীব, তুমি মৃত্যুবরণ করবে না, আর মানুষ আর জিন্ মৃত্যুবরণ করবে।)। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
بَابُ الْإِسْتِعَاذَةِ
وَعَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَقُولُ: «اللَّهُمَّ لَكَ أَسْلَمْتُ وَبِكَ آمَنْتُ وَعَلَيْكَ تَوَكَّلْتُ وَإِلَيْكَ أَنَبْتُ وَبِكَ خَاصَمْتُ اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِعِزَّتِكَ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ أَنْ تُضِلَّنِي أَنْتَ الْحَيُّ الَّذِي لَا يَمُوتُ وَالْجِنُّ وَالْإِنْسُ يموتون»
ব্যাখ্যা: অত্র হাদীসে আল্লাহ কর্তৃক পথভ্রষ্ট হওয়া থেকে আশ্রয় চাওয়া হয়েছে। এর অর্থ হলো দীনের সরল, সঠিক পথ তথা হিদায়াতের পথ থেকে ও ভ্রষ্ট হওয়া থেকে আশ্রয় চাওয়া হচ্ছে। ইমাম কারী বলেনঃ এ দু‘আর অর্থ হলো ‘‘হে আল্লাহ! তুমি আমাকে হিদায়াত দেয়ার পর এবং তোমার বিধি-বিধান ও সিদ্ধান্তসমূহের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের তাওফীক দেয়ার পর তা থেকে ভ্রষ্ট হওয়া থেকে তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি।’’ এদিকেই ইশারা দেয়া হয়েছে কুরআনে বর্ণিত নিম্নোক্ত দু‘আতে। আল্লাহ বলেনঃ
رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا
‘‘হে আমাদের রব! তুমি আমাদের হিদায়াত দেয়ার পর আমাদের অন্তরকে বক্র করে দিও না।’’ (সূরা আ-লি ‘ইমরান ৩ : ৮)
‘‘জিন্ ও মানুষ মৃত্যুবরণ করবে’’- এ কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে এজন্য যে, এ দু’ জাতিই শারী‘আতের বিধান পালনে দায়িত্বপ্রাপ্ত। অনেকে এর দ্বারা দলীল পেশ করেন যে, মালাক (ফেরেশতা) মারা যাবেন না। তবে এখানে মালায়িকাহর (ফেরেশতাদের) কথা পৃথকভাবে উল্লেখ না করা হলেও আল্লাহর বাণী ‘‘আল্লাহ ব্যতীত সবকিছুই ধ্বংসশীল’’- (সূরা আল কাসাস ২৮ : ২৮৮) দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মালায়িকাহ্ও (ফেরেশতাগণও) মারা যাবেন।