পরিচ্ছেদঃ ৩. তৃতীয় অনুচ্ছেদ - আল্লাহ তা‘আলার রহমতের ব্যাপকতা
২৩৭৮-[১৫] ’আবদুল্লাহ ইবনু ’উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা কোন এক যুদ্ধে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে ছিলাম। তিনি একদল লোকের পাশ দিয়ে গেলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কোন্ জাতি? তারা উত্তরে বলল, আমরা মুসলিম। জনৈকা মহিলা তখন তার পাতিলের নীচে আগুন ধরাচ্ছিল, তার সাথে ছিল তারই একটি শিশু সন্তান। হঠাৎ আগুনের একটি ফুলকি উপরের দিকে জ্বলে উঠলে তখনই সে তার সন্তানকে দূরে সরিয়ে দিলো। অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে মহিলাটি এসে বলল, আপনিই কী আল্লাহর রসূল? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, হ্যাঁ। তখন সে বলল, আপনার জন্য আমার মাতাপিতা কুরবান হোক। বলুন! আল্লাহ তা’আলা কি সবচেয়ে বড় দয়ালু নন? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, অবশ্যই। মহিলাটি বলল, তবে আল্লাহ তা’আলা কি তাঁর বান্দাদের ওপর সন্তানের প্রতি মায়ের দয়ার চেয়ে বড় দয়ালু নন? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, অবশ্যই। তখন মহিলাটি বলল, মা তো কক্ষনো তার সন্তানকে আগুনে ফেলতে পারে না। মহিলার এ কথা শুনে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নীচের দিকে মাথা নুইয়ে কাঁদতে লাগলেন। তারপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মাথা উঠিয়ে মহিলার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্যে একান্ত অবাধ্য ছাড়া কাউকেও ’আযাব (শাস্তি) দেন না- যে আল্লাহর সাথে অবাধ্যতা করে ও যারা ’’লা- ইলা-হা ইল্লাল্ল-হ’’ (অর্থাৎ- আল্লাহ ছাড়া প্রকৃতপক্ষে কোন মা’বূদ নেই) বলতেও অস্বীকার করে। (ইবনু মাজাহ)[1]
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ قَالَ: كُنَّا مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي بَعْضِ غَزَوَاتِهِ فَمَرَّ بِقَوْمٍ فَقَالَ: «مَنِ الْقَوْمُ؟» قَالُوا: نَحْنُ الْمُسْلِمُونَ وَامْرَأَةٌ تَحْضِبُ بِقِدْرِهَا وَمَعَهَا ابْنٌ لَهَا فَإِذَا ارْتَفَعَ وَهَجٌ تَنَحَّتْ بِهِ فَأَتَتِ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ: أَنْتَ رَسُولُ اللَّهِ؟ قَالَ: «نَعَمْ» قَالَتْ: بِأَبِي أَنْتَ وَأُمِّي أَلَيْسَ اللَّهُ أَرْحَمَ الرَّاحِمِينَ؟ قَالَ: «بَلَى» قَالَتْ: أَلَيْسَ اللَّهُ أَرْحَمَ بِعِبَادِهِ مِنَ الْأُم على وَلَدهَا؟ قَالَ: «بَلَى» قَالَتْ: إِنَّ الْأُمَّ لَا تُلْقِي وَلَدَهَا فِي النَّارِ فَأَكَبَّ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَبْكِي ثُمَّ رَفَعَ رَأْسَهُ إِلَيْهَا فَقَالَ: إِنَّ اللَّهَ لَا يُعَذِّبُ مِنْ عِبَادِهِ إِلَّا الْمَارِدَ الْمُتَمَرِّدَ الَّذِي يَتَمَرَّدُ عَلَى اللَّهِ وَأَبَى أَنْ يَقُولَ: لَا إِلَهَ إِلَّا الله . رَوَاهُ ابْن مَاجَه
ব্যাখ্যা: (فَقَالَ: مَنِ الْقَوْمُ؟ قَالُوا: نَحْنُ الْمُسْلِمُونَ) যেন তারা ধারণা করেছে অথবা আশংকা করেছে যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে অমুসলিম ধারণা করেছেন। ইবনু হাজার ত্বীবীর অনুসরণার্থে বলেন, বাহ্যিক দিক হল, উত্তরে বলা, আমরা মুযার গোত্রের অথবা আমরা কুরায়শী গোত্রের অথবা আমরা ত্বই গোত্রের, অতঃপর তারা বাহ্যিকতা থেকে দূরে সরে পড়েছে এবং তারা সীমাবদ্ধভাবে সংবাদ প্রদান করেছে, অর্থাৎ- আমরা এমন সম্প্রদায় যে, আমরা ইসলামকে অতিক্রম করব না। ধারণাস্বরূপ যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে অমুসলিম ধারণা করেছেন। কারী বলেন, এটা কৃতিমতা। তিনি বলেন, তার উক্তি من القوم অর্থাৎ- তোমরা অথবা তারা কাফির শত্রুদের অন্তর্ভুক্ত নাকি মুসলিম প্রিয় লোকদের অন্তর্ভুক্ত।
(إِنَّ اللّٰهَ لَا يُعَذِّبُ مِنْ عِبَادِه) অর্থাৎ- তার সকল বান্দাদের মধ্য থেকে। সুতরাং এখানে সম্বন্ধ ব্যাপকতা বুঝানোর জন্য। ইমাম সিনদী (রহঃ) বলেন, তাঁর উক্তি لا يعذب অর্থাৎ- স্থায়ীভাবে শাস্তি দিবেন না। বাহ্যিক দিক হল, এরা ছাড়া কেউ জাহান্নামে প্রবেশ করবে না। যেহেতু আলোচনা জাহান্নামে প্রবেশ করানো নিয়ে স্থায়ী হওয়া সম্পর্কে নয়। আর আল্লাহ সর্বাধিক ভাল জানেন। সামষ্টিকভাবে অবাধ্যতা কদর্যতা ও অশ্লীলতাকে বৃদ্ধি করে। আর তা অবাধ্য ব্যক্তির তুচ্ছতা, অবাধ্যতার মাধ্যমে যিনি অবাধ্য করেন তাঁর বড়ত্ব, অবাধ্যতার ক্ষেত্রে তাঁর দয়ার আধিক্যতার পরিমাণ অনুযায়ী হয়ে থাকে। সুতরাং ঐ কারণে তার বদলাও বড় আঁকড়ে দেন। অর্থাৎ- তা অবাধ্য বান্দার পরিস্থিতির দিকে লক্ষ্য করে এবং নিশ্চয়ই সে কোন জিনিস সৃষ্ট ও কোন জিনিস তার নির্ধারণ সে দিক লক্ষ করে। আকাশ জমিনের স্রষ্টার বড়ত্বের প্রতি লক্ষ্য করে যার নির্দেশে আকাশসমূহ প্রতিষ্ঠিত। তার নিয়ামতসমূহ ও দয়ার আধিক্যতার প্রতি লক্ষ্য করে যা সর্বনিম্ন অবাধ্যতাকে বড় করে তোলে পরিশেষে তা পাহাড়, সমুদ্রকে ছাড়িয়ে যায় এবং তা এমন এক বাস্তব অবস্থায় রূপ নেয় যার বদলা জাহান্নামের চিরস্থায়ী হওয়াকে আবশ্যক করে। যদি সম্মানিত, ক্ষমাশীল, অতি ক্ষমাশীল, দয়ালু সত্তার দয়া না হত তাহলে এ অবাধ্যের পরিস্থিতি কি হত যে পাথরসমূহের সাথে সাদৃশ্য যা সৃষ্টির মাঝে সর্বাধিক হীনতর। সুতরাং আল্লাহ এ সকল কিছু থেকে সুউচ্চ। আর এ সমস্ত কিছুর বাস্তবতা অদৃশ্যের জান্তা ছাড়া কেউ জানে না। অতঃপর হাদীসের বাহ্যিক দিক দাবী করছে যে, নবূওয়্যাতের অস্বীকারকারী তাওহীদী কালিমাহ্ যথার্থভাবে স্বীকার করে না। আর এটিই এখানে উদ্দেশ্য।
(أَنْ يَقُولَ: لَا إِلٰهَ إِلَّا اللهُ) ‘‘আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই- এ কথা বলতে যে অস্বীকার করে’’ এ বাণীটুকু ঐ সন্তানের স্থানে হবে, যে তার মাকে বলে তুমি আমার মা না আমার মা অন্য কেউ; এমতাবস্থায় সে মাতার অবাধ্য হয় এবং মাকে কুকুর ও শুকরের আকৃতির সাথে পরিকল্পনা করে। এ মুহূর্তে কোন সন্দেহ নেই যে, মা তার থেকে এমন আচরণের কারণে দায়িত্বমুক্ত হয়ে যায়, তার ব্যাপারে সক্ষম হলে, তাকে শাস্তি দেয়। সারাংশ হল, নিশ্চয়ই কাফির ব্যক্তি দাসত্ব থেকে বহির্ভূত। সে আল্লাহর বান্দার নামে নামকরণ থেকে বহির্ভূত। আর এ কারণেই তাকে শাস্তি দেয়া হবে। আর আল্লাহ মূলত এমন নন যে, তাদের প্রতি অবিচার করবেন কিন্তু তারা নিজেরাই নিজের প্রতি অবিচার করে।
পরিচ্ছেদঃ ৩. তৃতীয় অনুচ্ছেদ - আল্লাহ তা‘আলার রহমতের ব্যাপকতা
২৩৭৯-[১৬] সাওবান (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করেন যে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ বান্দা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে চায় আর সাধ্যাতীত চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। তাই আল্লাহ তা’আলা জিবরীলকে বলেন, আমার অমুক বান্দা আমাকে সন্তুষ্ট করতে চায়। জেনে রাখো, তার প্রতি আমার রহমত আছে। তখন জিবরীল বলেন, অমুকের প্রতি আল্লাহর রহমত আছে, এ কথা বলতে থাকেন ’আরশ বহনকারী মালায়িকাহ্ (ফেরেশতা) (ফেরেশতাগণ), তাদের আশেপাশের মালায়িকাহ্ (ফেরেশতা)-ও। অবশেষে সপ্ত আকাশের অধিবাসীগণও অনুরূপ কথা বলেন। অতঃপর তার জন্য রহমত জমিনের দিকে নেমে আসতে থাকে। (আহমদ)[1]
وَعَنْ ثَوْبَانَ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: إِنَّ الْعَبْدَ لَيَلْتَمِسُ مَرْضَاةَ اللَّهِ فَلَا يَزَالُ بِذَلِكَ فَيَقُولُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ لجبريل: إِن فلَانا عَبدِي يتلمس أَنْ يُرْضِيَنِي أَلَا وَإِنَّ رَحْمَتِي عَلَيْهِ فَيَقُولُ جِبْرِيلُ: رَحْمَةُ اللَّهِ عَلَى فُلَانٍ وَيَقُولُهَا حَمَلَةُ العرشِ ويقولُها مَن حَولهمْ حَتَّى يَقُولُهَا أَهْلُ السَّمَاوَاتِ السَّبْعِ ثُمَّ تَهْبِطُ لَهُ إِلى الأَرْض . رَوَاهُ أَحْمد
ব্যাখ্যা: (مَرْضَاةَ اللّٰهِ) ‘‘আল্লাহর সন্তুষ্টি’’। অর্থাৎ- বিভিন্ন প্রকার আনুগত্যের মাধ্যমে তার সন্তুষ্টি। (عَبْدِىْ) অর্থাৎ- মু’মিন ব্যক্তি (وَإِنَّ رَحْمَتِىْ) অর্থাৎ- আমার পরিপূর্ণ রহমাত।
(ثُمَّ تَهْبِطُ لَه إِلَى الْأَرْضِ) অর্থাৎ- জমিনবাসীর প্রতি রহমাত অবতীর্ণ হয়। কারী বলেন, তার প্রতি আল্লাহর ভালবাসা, অতঃপর জমিনে তার জন্য গ্রহণযোগ্যতা স্থাপন করা হয়। ইমাম ত্বীবী বলেন, এ হাদীসটি এবং ভালবাসার হাদীসটি কাছাকাছি।
ইমাম ত্বীবী ভালোবাসার হাদীস দ্বারা আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে মারফূ' সূত্রে বুখারী, মুসলিমে বর্ণিত হাদীস উদ্দেশ্য করেছেন। আর তা হল, নিশ্চয়ই আল্লাহ যখন কোন বান্দাকে ভালোবাসেন তখন জিবরীলকে আহবান করে বলেন, নিশ্চয়ই আমি অমুককে ভালোবাসি, সুতরাং তুমিও তাকে ভালোবাস। অতঃপর জিবরীল তাকে ভালোবাসেন এরপর আকাশে ঘোষণা করে দেয়া হয় নিশ্চয়ই আল্লাহ অমুককে ভালোবাসেন। সুতরাং তোমরা তাকে ভালোবাস। অতঃপর আকাশবাসীরা তাকে ভালোবাসে, এরপর জমিনে তার জন্য গ্রহণযোগ্যতা স্থাপন করা হয়।
পরিচ্ছেদঃ ৩. তৃতীয় অনুচ্ছেদ - আল্লাহ তা‘আলার রহমতের ব্যাপকতা
২৩৮০-[১৭] উসামাহ্ ইবনু যায়দ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করেন যে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহ তা’আলার এ কালাম, ’’ফামিনহুম যা-লিমুন লিনাফসিহী, ওয়া মিনহুম মুকতাসিদুন্, ওয়া মিনহুম সা-বিকুন বিল্ খইর-ত’’ (অর্থাৎ- বান্দাদের মধ্যে কেউ নিজের প্রতি যুলম করে, তাদের মধ্যে কেউ ভালো মন্দ উভয়ই করে, আবার কেউ কল্যাণের দিকে অগ্রবর্তী হয়।)- (সূরা আল ফা-ত্বির ৩৫ : ৩২)। এরা সকলেই জান্নাতে যাবে। (ইমাম বায়হাক্বী তাঁর ’’কিতাবুল বা’সি ওয়ান্ নুশূর’’ কিতাবে বর্ণনা করেছেন)[1]
وَعَنْ أُسَامَةَ بْنِ زَيْدٍ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي قَوْلِ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ: (فَمِنْهُمْ ظَالِمٌ لِنَفْسِهِ وَمِنْهُمْ مُقْتَصِدٌ وَمِنْهُمْ سابقٌ بالخيراتَ)
قَالَ: كُلُّهُمْ فِي الْجَنَّةِ . رَوَاهُ الْبَيْهَقِيُّ فِي كِتَابِ الْبَعْثِ وَالنُّشُورِ
ব্যাখ্যা: وَمِنْهُمْ مُقْتَصِدٌ অধিকাংশ অবস্থায় এবং অধিকাংশ সময়ে ‘আমল করে।
وَمِنْهُمْ سَابِقٌ بِالْخَيْرَاتَ অর্থাৎ- ‘‘আমলের বিষয়ের প্রতি মানুষকে শিক্ষা এবং দিক-নির্দেশনা দেয়।’’ একমতে বলা হয়েছে, নিজের প্রতি অবিচারকারী বলতে কতক ওয়াজিব কাজে বাড়াবাড়িকারী, কতক হারাম কাজে জড়িত। আর ‘‘মধ্যমপন্থা অবলম্বনকারী’’ বলতে যে ব্যক্তি ওয়াজিবসমূহকে আদায় করে, হারামসমূহকে বর্জন করে, কখনো কতক মুস্তাহাব বিষয়কে বর্জন করে এবং কতক মাকরূহ বিষয় সম্পাদন করে। আর ‘‘কল্যাণে অগ্রগামী’’ বলতে ওয়াজিব ও মুস্তাহাব কাজ সম্পাদনকারী এবং হারাম, মাকরূহ ও কতক বৈধ কাজ বর্জনকারী। এক মতে বলা হয়েছে, অবিচারকারী বলতে যে সৎ ‘আমল ও অসৎ ‘আমলকে মিশিয়ে দেয়। নাসাফী বলেন, এ ব্যাখ্যাটি কুরআনের অনুকূল, কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘‘আর মুহাজিরদের থেকে যারা অগ্রগামী প্রথম’’- (সূরা আত্ তাওবাহ্ ৯ : ১০০)। এরপর বলেন, ‘‘আর অন্যরা তাদের গুনাহসমূহের ব্যাপারে স্বীকৃতি দিল’’- (সূরা আত্ তাওবাহ্ ৯ : ১০২)। অতঃপর বলেন, ‘‘আর অন্যরা আল্লাহর নির্দেশ পালনে বিলম্বকারী’’- (সূরা আত্ তাওবাহ্ ৯ : ১০৬)।
একমতে বলা হয়েছে, ‘‘নিজের প্রতি অবিচার করা’’ বলতে নাফসে্র উপর অবিচার করাকে সমর্থন করা, নাফসকে কেবল প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করা এবং নাফসে্র জন্য যা কল্যাণকর তা নষ্ট করা। সুতরাং অধিক আনুগত্যকে বর্জনকারী বর্জন পরিমাণ সাওয়াব থেকে বঞ্চিত হওয়ার বিবেচনায় নিজের প্রতি অবিচারকারী, আল্লাহ তার ওপর যা আবশ্যক করেছেন যদিও সে তা সম্পাদন করে থাকে এবং যা থেকে আল্লাহ তাকে নিষেধ করেছেন যদিও তা বর্জন করে থাকে। আর (مقتصد) বা মধ্যমপন্থা অবলম্বনকারী বলতে যে ব্যক্তি ধর্মের বিষয়ে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করে, বাড়াবাড়ি ও শিথিলতার দিকে ধাবমান হয় না। পক্ষান্তরে ‘‘অগ্রগামী’’ বলতে ঐ ব্যক্তি যে ধর্মের বিষয়াবলীর ক্ষেত্রে অন্যের অগ্রগামী হয়েছে আর এ ব্যক্তিই তিন ব্যক্তির মাঝে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। এ তিন ব্যক্তির তাফসীরে আরো অনেক উক্তি আছে, সা‘লাবী ও অন্যান্যগণ যা উল্লেখ করেছেন।
(قَالَ: كُلُّهُمْ فِى الْجَنَّةِ) সর্বনামটি তিন ব্যক্তির দিকে প্রত্যাবর্তনশীল। হাদীসটি হাফেয ইবনু কাসীর ত্ববারানীর রিওয়ায়াতে এ অর্থে উল্লেখ করেছেন, অর্থাৎ- ‘‘তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তাদের প্রত্যেকেই এ উম্মাতের অন্তর্ভুক্ত।’’
শাওকানী একে ফাতহুল কদীরে (৪র্থ খণ্ডে ৩৪১ পৃষ্ঠাতে) উল্লেখ করেছেন এবং তিনি এটিকে ত্ববারানী ও ইবনু মারদুওয়াইহি-এর দিকে সম্বন্ধ করেছেন। আর বায়হাক্বী (তাদের প্রত্যেকে এ উম্মাতের অন্তর্ভুক্ত এবং তাদের প্রত্যেকে জান্নাতে যাবে।) এ অর্থে উল্লেখ করেছেন।
ইবনু কাসীর বলেন, ‘আলী বিন আবূ তালহা ثُمَّ أَوْرَثْنَا الْكِتَابَ الَّذِيْنَ اصْطَفَيْنَا مِنْ عِبَادِنَا আল্লাহ তা‘আলার এ বাণীর ক্ষেত্রে ‘আবদুল্লাহ বিন ‘আব্বাস থেকে বলেন, তারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উম্মাত। তাদেরকে আল্লাহ প্রত্যেক এমন কিতাবের উত্তরাধিকারী করেছেন যা তিনি অবতীর্ণ করেছেন। অতঃপর তাদের মাঝে যে অবিচারকারী তাকে তিনি ক্ষমা করবেন এবং তাদের মাঝে যে মধ্যমপন্থা অবলম্বনকারী তার হিসাব সহজভাবে গ্রহণ করা হবে এবং তাদের মাঝে যে কল্যাণে অগ্রগামী সে বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। বিশুদ্ধ কথা হল নিজের প্রতি অবিচারকারী এ উম্মাতের অন্তর্ভুক্ত। এটাই ইবনু জারীর এর নির্বাচন। যেমন তা আয়াতের বাহ্যিক দিক। এ সম্পর্কে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনেক হাদীস এসেছে। আর তা এমন সানাদে যার কতক কতককে শক্তিশালী করে। অতঃপর তিনি তা উল্লেখ করেছেন। তার থেকে একটি হল, উসামাহ্ বিন যায়দ-এর হাদীস যার ব্যাখ্যায় আমরা রত আছি। আরো একটি হল, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে আবূ সাঈ‘দ-এর হাদীস। নিশ্চয়ই তিনি
ثُمَّ أَوْرَثْنَا الْكِتَابَ الَّذِيْنَ اصْطَفَيْنَا مِنْ عِبَادِنَا فَمِنْهُمْ ظَالِمٌ لِنَفْسِه وَمِنْهُمْ مُقْتَصِدٌ وَمِنْهُمْ سَابِقٌ بِالْخَيْرَاتِ بِإِذْنِ اللّٰهِ
এ আয়াতের ব্যাপারে বলেন, এরা প্রত্যেকে একই স্তরের এবং তাদের প্রত্যেকে জান্নাতে যাবে। একে আহমাদ, তিরমিযী, ইবনু জারীর এবং ইবনু আবী হাতিম সংকলন করেছেন, প্রত্যেকের সানাদে এমন বর্ণনাকারী আছে যাদের নাম উল্লেখ করা হয়নি। ইবনু কাসীর বলেন, بمنزلة واحدة উক্তির অর্থ হল, অর্থাৎ- নিশ্চয়ই তারা এ উম্মাতের অন্তর্ভুক্ত এবং তারা জান্নাতের অধিবাসী। যদিও জান্নাতে স্তরসমূহের ক্ষেত্রে তাদের মাঝে পার্থক্য আছে। সেগুলো থেকে আরো একটি হাদীস হল, আবূ দারদা (রাঃ)-এর হাদীস, তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
ثُمَّ أَوْرَثْنَا الْكِتَابَ الَّذِيْنَ اصْطَفَيْنَا مِنْ عِبَادِنَا فَمِنْهُمْ ظَالِمٌ لِنَفْسِه وَمِنْهُمْ مُقْتَصِدٌ وَمِنْهُمْ سَابِقٌ بِالْخَيْرَاتِ بِإِذْنِ اللّٰهِ
সুতরাং যারা কল্যাণে অগ্রগামী তারা বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে, পক্ষান্তরে যারা মধ্যমপন্থা অবলম্বন করেছে তারা ঐ সকল লোক যাদের সহজ হিসাব নেয়া হবে। আর যারা নিজেদের ওপর অবিচার করেছে তারা ঐ সকল লোক হাশরের মাঠে যাদের দীর্ঘ সময় হিসাব নেয়া হবে। অতঃপর আল্লাহ যাদেরকে তার রহমাতের মাধ্যমে সংশোধন করেছেন তারাই বলে থাকে [অর্থাৎ- ‘‘সকল প্রশংসা ঐ আল্লাহর জন্য যিনি আমাদের থেকে চিন্তা দূর করেছেন, নিশ্চয়ই আমাদের প্রভু অত্যন্ত ক্ষমাশীল, বড়ই কৃতজ্ঞ’’- (সূরা আত্ তাওবাহ্ ৯ : ৩৪)] আয়াতের শেষ পর্যন্ত। আহমাদ, ইবনু জারীর, ইবনু আবী হাতিম, ইবনুল মুনযির, ত্ববারানী এবং ইবনু মারদুওয়াইহি একে সংকলন করেছেন, আর বায়হাক্বী একে (البعث) কিতাবে সংকলন করেছেন। এ হাদীসগুলোর কতক কতককে শক্তিশালী করে এবং এ হাদীসগুলোর দিকে প্রত্যাবর্তন করা ওয়াজিব। আর এগুলোর মাধ্যমে ঐ ব্যক্তির উক্তিকে প্রতিহত করা দরকার যে ব্যক্তি ‘‘নিজের প্রতি অবিচারকারী’’ উক্তিকে কাফিরের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। আর অধ্যায়টিতে ‘উমার, ‘উসমান, ‘আলী, ‘আয়িশাহ্, ইবনু মাস্‘ঊদ ও অন্যান্যগণ থেকে অনেক আসার আছে।
হাফেয ইবনু কাসীর এবং শাওকানী তাদের তাফসীরদ্বয়ে এ সকল আসার উল্লেখ করেছেন এবং এগুলোর প্রত্যেকটি আয়াতের তাফসীরে জমহূর যে মত পেশ করেছেন তাকে সমর্থন করছে। নিশ্চয়ই তিনটি স্তর বলতে তারা উদ্দেশ্য করেছে আল্লাহ তাঁর বান্দাদের থেকে যাদেরকে নির্বাচন করেছেন। আর তারাই হল এ উম্মাতের অন্তর্ভুক্ত ঈমানের অধিকারী, তাদের প্রত্যেকেই মুক্তি পাবে, জান্নাতে প্রবেশ করবে।