কুরআন মাজীদ মুসলিম জীবনের জীবন-সংবিধান। এতে রয়েছে পথহারা মানুষের জন্য পথের দিশা, ইহ-পরকালে সুখ ও সমৃদ্ধির পথের সন্ধান।
এই কুরআনের যে সকল বৈশিষ্ট্য আছে তার মধ্যে কতিপয় এই যে-
এই কুরআন হল, মহান আল্লাহর মজবুত রশি।
এই কুরআন হল, সকল কিছুর বিবরণী-গ্রন্থ।
এই কুরআন হল, যুগান্তকারী আলোড়ন সৃষ্টিকারী।
এই কুরআন হল, তার অনুসারীর গৌরববৃদ্ধিকারী এবং তার বিরোধীর গৌরব ক্ষুণ্ণকারী।
এই কুরআন হল, সর্ব যুগের চ্যালেঞ্জ স্বরূপ।
এই কুরআন হল, অপরিবর্তিত ও অপরিবর্ধিত অবস্থায় কিয়ামত অবধি মানুষের পথপ্রদর্শক।
এই কুরআন হল, এমন গ্রন্থ; যার হিফাযতের দায়িত্ব নিয়েছেন খোদ তার অবতীর্ণকারী মহান আল্লাহ।
এই কুরআন হল, বিজ্ঞানময়; যার সাথে সঠিক জ্ঞান ও বিজ্ঞানের কোন সংঘর্ষ নেই।
এই কুরআন হল, সমস্ত গ্রন্থের সর্দার, গ্রন্থসম্রাট।
এই কুরআন হল, এমন গ্রন্থ; যার সত্যতায় কোন প্রকার সন্দেহ নেই।
এই কুরআন হল, মানুষের দৈহিক ও হার্দিক আধি ও ব্যাধির মহৌষধ।
এই কিতাবের দুটি আয়াত দুটি উষ্ট্রী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ! অনুরূপ ৩টি আয়াত ৩টি উষ্ট্রী, ৪টি আয়াত ৪টি উষ্ট্রী এবং এর চেয়ে অধিক সংখ্যক আয়াত ঐরূপ অধিক সংখ্যক উষ্ট্রী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ!’’[1]
নামাযের মধ্যে তিনটি আয়াত পাঠ করা তিনটি বড় বড় হৃষ্টপুষ্ট গাভিন উষ্ট্রী অপেক্ষা উত্তম!’’[2]
যখনই কোন জন-গোষ্ঠী আল্লাহর গৃহসমূহের কোন গৃহে (মসজিদে) সমবেত হয়ে আল্লাহর এই কিতাব তিলাওয়াত করে ও আপোসে অধ্যয়ন করে তখনই তাদের উপর প্রশান্তি অবতীর্ণ হয়, করুণা তাদেরকে আচ্ছাদিত করে, ফিরিশ্তাম-লী তাদেরকে বেষ্টন করে নেয়। আর আল্লাহ তাঁর নিকটবর্তী ফিরিশ্তাবর্গের নিকট তাদের কথা উল্লেখ করে থাকেন----।[3]
এ কুরআন যে শিখে ও শিক্ষা দেয় সেই হল শ্রেষ্ঠ মানুষ। আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেন, ‘‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি সর্বশ্রেষ্ঠ, যে কুরআন শিখেছে এবং অপরকে শিক্ষা দিয়েছে।’’[4]
এই কুরআনের (শুদ্ধপাঠকারী ও পানির মত হিফয্কারী পাকা) হাফেয মহাসম্মানিত পূতচরিত্র লিপিকার (ফিরিশ্তাবর্গের) সঙ্গী হবে। আর যে ব্যক্তি (পাকা হিফয না থাকার কারণে) কুরআন পাঠে ‘ওঁ-ওঁ’ করে এবং পড়তে কষ্টবোধ করে তার জন্য রয়েছে দুটি সওয়াব।[5]
মানবম-লীর মধ্য হতে আল্লাহর কিছু বিশিষ্ট লোক আছে; আহ্লে কুরআন (কুরআন বুঝে পাঠকারী ও তদনুযায়ী আমলকারী ব্যক্তিরাই) হল আল্লাহর বিশেষ ও খাস লোক।’’[6]
কিয়ামতের দিন কুরআন উপস্থিত হয়ে বলবে, হে প্রভু! কুরআন পাঠকারীকে অলংকৃত করুন।’ সুতরাং তাকে সম্মানের মুকুট পরানো হবে। পুনরায় কুরআন বলবে, ‘হে প্রভু! ওকে আরো অলংকার প্রদান করুন।’ সুতরাং তাকে সম্মানের পোশাক পরানো হবে। অতঃপর বলবে, ‘হে প্রভু! আপনি ওর উপর সন্তুষ্ট হয়ে যান।’ সুতরাং আল্লাহ তার উপর সন্তুষ্ট হবেন। অতঃপর তাকে বলা হবে, ‘তুমি পাঠ করতে থাক আর মর্যাদায় উন্নীত হতে থাক।’ আর প্রত্যেকটি আয়াতের বিনিময়ে তার একটি করে সওয়াব বৃদ্ধি করা হবে।[7]
কুরআন তিলাওয়াতকারীকে বলা হবে, ‘পড়তে থাক ও মর্যাদায় উন্নীত হতে থাক। আর (ধীরে-ধীরে, শুদ্ধ ও সুন্দরভাবে কুরআন) আবৃত্তি কর; যেমন দুনিয়ায় অবস্থানকালে আবৃত্তি করতে যেহেতু যা তুমি পাঠ করতে তার সর্বশেষ আয়াতের নিকট তোমার স্থান হবে।’[8]
কুরআন তিলাওয়াতকারী যখন জান্নাতে প্রবেশ করবে তখন তাকে বলা হবে, ‘(কুরআন) পাঠ কর ও (জান্নাতের) মর্যাদায় উন্নীত হতে থাক। সুতরাং সে পাঠ করবে এবং প্রত্যেক আয়াতের বিনিময়ে একটি করে মর্যাদায় উন্নীত হবে। এই ভাবে সে তার (মুখস্ত করা) শেষ আয়াতটুকুও পড়ে ফেলবে।’’[9]
রাসুল (ﷺ) বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি এক রাতে একশ’টি আয়াত পাঠ করবে, সে ব্যক্তির আমলনামায় ঐ রাত্রির কিয়াম (নামাযের) সওয়াব লিপিবদ্ধ করা হবে।’’[10]
এ কিতাবের একটি হরফ পাঠ করলে পাওয়া যায় দশটি সওয়াব।[11]
রাসুল (ﷺ) বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি চায় যে, সে আল্লাহ ও তাঁর রসূলকে (অধিক) ভালবাসুক অথবা আল্লাহ ও তাঁর রসূল তাকে ভালবাসুন, সে যেন কুরআন দেখে পাঠ করে।’’[12]
এই মহাগ্রন্থ তিলাওয়াত ও অধ্যয়নের বিভিন্ন আদব রয়েছে। সেই সকল আদব মান্য করা মুসলিমের কর্তব্য।
[2]. মুসলিম আল-মাকতাবাতুশ-শামেলা হা/৫৫২
[3]. মুসলিম আল-মাকতাবাতুশ-শামেলা হা/২৬৯৯
[4]. বুখারী তাওহীদ পাবঃ হা/ ৫০২৭
[5]. একটি তিলাওয়াত ও দ্বিতীয়টি কষ্টের দরুন। মুসলিম আল-মাকতাবাতুশ-শামেলা হা/৭৯৮
[6]. আহমদ, নাসাঈ, বাইহাক্বী, হাকেম, সহীহুল জামে ২১৬৫
[7]. তিরমিযী, সহীহুল জামে ৮০৩০
[8]. আবু দাঊদ নাসাঈ, তিরমিযী, সহীহুল জামে ৮১২২
[9]. আহমদ, বাইহাকী, সহীহুল জামে ৮১২১
[10]. আহমদ, নাসাঈ, দারেমী, সিলসিলাহ সহীহাহ আল-মাকতাবাতুশ-শামেলা. হা/৬৪৪
[11]. তিরমিযী, সহীহুল জা’মে হা/৬৪৬৯
[12]. সিলসিলাহ সহীহাহ আল-মাকতাবাতুশ-শামেলা. হা/২৩৪২
যেহেতু কুরআন তিলাওয়াত একটি ইবাদত। আর প্রত্যেক ইবাদত কবুল হয় দুটি শর্তে; ইখলাস ও তরীকায়ে মুহাম্মাদীর পথ অনুসরণ করে।
সুতরাং কুরআন শিক্ষা ও পাঠের সময় আপনার মনে যেন আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্য না থাকে। নচেৎ তা শির্কে পরিণত হতে পারে, আর তার পরিণতি অবশ্যই ভালো নয়।
কিয়ামতের দিন অন্যান্য লোকেদের পূর্বে যে তিন ব্যক্তির প্রথম বিচার হবে, তাদের মধ্যে দ্বিতীয় হচ্ছে এমন ব্যক্তি, যে ইল্ম শিক্ষা করেছে, অপরকে শিক্ষা দিয়েছে এবং কুরআন পাঠ করেছে। তাকে আল্লাহর দরবারে উপস্থিত করা হবে। আল্লাহ তাকে (পৃথিবীতে প্রদত্ত) তাঁর সকল নেয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দেবেন। সেও সব কিছু স্মরণ করবে। অতঃপর আল্লাহ বলবেন, ‘এই সকল নেয়ামতের বিনিময়ে তুমি কি আমল করে এসেছ?’ সে বলবে, ‘আমি ইল্ম শিখেছি, অপরকে শিখিয়েছি এবং তোমার সন্তুষ্টিলাভের জন্য কুরআন পাঠ করেছি।’ আল্লাহ বলবেন, ‘মিথ্যা বলছ তুমি। বরং তুমি এই উদ্দেশ্যে ইল্ম শিখেছ; যাতে লোকেরা তোমাকে আলেম বলে এবং এই উদ্দেশ্যে কুরআন পড়েছ, যাতে লোকেরা তোমাকে ক্বারী বলে। আর (দুনিয়াতে) তা বলা হয়েছে।’ অতঃপর ফিরিশ্তাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হবে। তাঁরা তাকে উবুড় করে টেনে নিয়ে গিয়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।[1]
যেহেতু কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে এবং আমাদেরকে তা তিলাওয়াত করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে তার উপর আমল করার জন্যই। সুতরাং কুরআন যাকে হালাল বলে তা হালাল, যাকে হারাম বলে তা হারাম বলে মেনে নিন। কুরআন যা করতে নিষেধ করে তা খবরদার করবেন না। যা করতে আদেশ করে তা অবশ্যই পালন করুন। কুরআনের স্পষ্ট-অস্পষ্ট সকল আয়াতের উপর যথার্থ ঈমান রাখুন। এই গ্রন্থে দেওয়া সমস্ত খবরকে সন্দেহহীন মনে বিশ্বাস করুন। দ্বিধাহীন চিত্তে এর ফায়সালা ঘাড় পেতে মেনে নিন। তবেই হবে যথাযথভাবে কুরআন তিলাওয়াত। আমল না করে কুরআন তিলাওয়াতের কি কোন লাভ থাকতে পারে?
যার কাছে কুরআনী ইল্ম আছে (আলেম, ক্বারী) অথচ তার প্রতি অবহেলা করে রাত্রে নিদ্রায় বিভোর থাকে এবং দিনে তার উপর আমল করে না তাকে (এবং যে ফরয নামায না পড়ে ঘুমিয়ে থাকে তাকে) বারযাখে (কবর-জগতে) চিৎ করে শায়িত করা হয়। তার শীর্ষদেশে দণ্ডায়মান একজন (ফিরিশ্তা) তার মস্তকে (ছোট) পাথর ছুঁড়ে মারেন। তাতে তার মস্তক বিদীর্ণ হয়ে যায় এবং ছুঁড়া পাথরটি পুনরায় কুড়িয়ে এনে পুনরায় ছুঁড়ে মারার পূর্বেই তার মস্তক অক্ষত অবস্থায় প্রত্যাবৃত্ত হয়। আর পুনঃ পুনঃ কিয়ামত অবধি এইভাবে তার আযাব হতে থাকে।[1]
কুরআন শিখার পর তা ভুলে যাবেন না। যে সূরা মুখস্থ আছে, তা যেন মুখস্থ থাকে সেই চেষ্টাই করবেন। মুখস্থ সূরা নামাযে পড়ুন, তাহলে অনুশীলনের ফলে তা মনে থাকবে। প্রত্যহ কিছু কিছু করে তিলাওয়াত করুন। নামাযের আযান হওয়া মাত্র মসজিদে এসে তাহিয়্যাতুল মাসজিদ পড়ে বসে না থেকে নিয়মিত কুরআন পাঠ করুন। প্রতীক্ষার দীর্ঘ সময়কে কুরআন পাঠ করে কাজে লাগান। গাড়িতে ও বাড়িতে কুরআনের ক্যাসেট শুনুন।
তা না করতে পারলে কুরআন মুখস্থ থাকবে না। রাসুল (ﷺ) বলেন, ‘‘তোমরা নিয়মিত কুরআন পাঠ কর। নচেৎ সেই সত্তার কসম যাঁর হাতে আমার প্রাণ আছে! বাঁধা উট যেমন তার রশি থেকে অতর্কিতে বের হয়ে যায়, তার চেয়ে অধিক অতর্কিতে কুরআন (স্মৃতি থেকে) বের হয়ে (বিস্মৃত হয়ে) যায়।’’[1]
তিনি বলেন, ‘‘কুরআন-ওয়ালা হল বাঁধা উট-ওয়ালার মত। সে যদি তা বাঁধার পর তার যথারীতি দেখাশোনা করে, তাহলে বাঁধাই থাকবে। নচেৎ ঢিল দিলেই উট পালিয়ে যাবে।’’[2]
তিনি আরো বলেন, ‘‘তোমরা আল্লাহর কিতাব শিক্ষা কর, (পাঠ করার মাধ্যমে) তার যত্ন কর, তা ঘরে রাখ এবং সুরেলা কণ্ঠে তা তিলাওয়াত কর। কারণ, উট যেমন রশির বন্ধন থেকে অতর্কিতে বের হয়ে যায়, তার চেয়ে অধিক অতর্কিতে কুরআন (স্মৃতি থেকে) বের হয়ে (বিস্মৃত হয়ে) যায়।’’[3]
সুতরাং বারবার যথা নিয়মে পুনরাবৃত্তি করলে তবেই কুরআন মনে থাকবে। নচেৎ অনায়াসেই তা মন থেকে মুছে যাবে। ফাল্লাহুল মুস্তাআন।
[2]. বুখারী তাওহীদ পাবঃ হা/ ৫০৩১, মুসলিম আল-মাকতাবাতুশ-শামেলা হা/৭৮৯
[3]. দারেমী, আহমাদ ৪/১৪৬, ১৫০, ১৫৩, ৩৯৭
মুখস্থ কুরআন ভুলে গেলে ‘ভুলে গেছি’ বলা মকরূহ। কারণ তাতে গাফলতি ও অবজ্ঞা প্রকাশ পায়। বরং সেই সময় বলতে হয়, ‘আমাকে কুরআন ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ রাসুল (ﷺ) বলেন, ‘‘কারো এ কথা বলা নিকৃষ্ট যে, ‘আমি অমুক অমুক আয়াত ভুলে গেছি।’ বরং তাকে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।’’[1]
অবসর সময়ে কুরআনে মন বসবে ভালো।অতএব রাতের তিলাওয়াত সবচেয়ে উত্তম। মহান আল্লাহ বলেন,
إِنَّ نَاشِئَةَ اللَّيْلِ هِيَ أَشَدُّ وَطْئًا وَأَقْوَمُ قِيلًا - إِنَّ لَكَ فِي النَّهَارِ سَبْحًا طَوِيلًا
অর্থাৎ, নিশ্চয়ই রাত্রির জাগরণ (কুরআন) হৃদয়ঙ্গমের জন্য অধিক সহায়ক এবং সঠিক তিলাওয়াতের পক্ষে অধিক অনুকূল। অবশ্যই দিবাভাগে রয়েছে তোমার দীর্ঘ কর্মব্যস্ততা।[1]
বিশেষ করে ফজরের সময় কুরআন তিলাওয়াত বড় ফযীলতপূর্ণ। মহান আল্লাহ বলেন,
أَقِمِ الصَّلَاةَ لِدُلُوكِ الشَّمْسِ إِلَى غَسَقِ اللَّيْلِ وَقُرْآنَ الْفَجْرِ إِنَّ قُرْآنَ الْفَجْرِ كَانَ مَشْهُودًا
অর্থাৎ, সূর্য হেলে পড়ার সময় থেকে রাতের অন্ধকার পর্যন্ত স্বলাত কায়েম কর এবং ফজরের কুরআন (নামাযের সময় ফিরিশ্তা) উপস্থিত থাকে।[2]
[2]. সূরা ইসরা-১৭:৭৮
টিয়া পাখীর মত কুরআন মুখস্থ বা দেখে পড়লে সওয়াব হতে পারে, তবে বিশেষ লাভ নেই। কারণ কুরআন বুঝা ও তা নিয়ে জ্ঞান-গবেষণা করা তথা তার উপর আমল করা ওয়াজেব। মহান আল্লাহ বলেন,
أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآنَ وَلَوْ كَانَ مِنْ عِنْدِ غَيْرِ اللَّهِ لَوَجَدُوا فِيهِ اخْتِلَافًا كَثِيرًا
অর্থাৎ, তারা কুরআনের প্রতি মনঃসংযোগ করে না কেন? যদি ওটা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নিকট হতে হতো, তাহলে তারা ওতে বহু মতানৈক্য প্রাপ্ত হতো।[1]
আসলে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে তা বুঝে তার দ্বারা উপদেশ গ্রহণ করার জন্যই। মহান আল্লাহ বলেন,
كِتَابٌ أَنْزَلْنَاهُ إِلَيْكَ مُبَارَكٌ لِيَدَّبَّرُوا آيَاتِهِ وَلِيَتَذَكَّرَ أُولُو الْأَلْبَابِ
অর্থাৎ, এ এক কল্যাণময় কিতাব, এটা আমি তোমার উপর অবতীর্ণ করেছি, যাতে মানুষ এর আয়াতসমূহ অনুধাবন করে এবং বোধশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিরা উপদেশ গ্রহণ করে। (সূরা স্বাদ ২৯ আয়াত)
তিনি আরো বলেন,
الَّذِينَ آتَيْنَاهُمُ الْكِتَابَ يَتْلُونَهُ حَقَّ تِلَاوَتِهِ أُولَئِكَ يُؤْمِنُونَ بِهِ وَمَنْ يَكْفُرْ بِهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْخَاسِرُونَ
অর্থাৎ, আমি যাদেরকে কিতাব দান করেছি, তারা তা যথার্থরূপে তিলাওয়াত করে। তারাই এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে। আর যারা তা অবিশ্বাস করে ফলতঃ তারাই হল ক্ষতিগ্রস্ত।[2]
আর যথার্থরূপে (তিলাওয়াতের হক আদায় করে) তিলাওয়াত তখনই হবে, যখন তা শুদ্ধভাবে ও বুঝে পড়ে আমল করা হবে। তিনি নিজ বান্দার গুণ বর্ণনা করে বলেন,
وَالَّذِينَ إِذَا ذُكِّرُوا بِآيَاتِ رَبِّهِمْ لَمْ يَخِرُّوا عَلَيْهَا صُمًّا وَعُمْيَانًا
অর্থাৎ, আর যারা তাদের প্রতিপালকের আয়াত স্মরণ করিয়ে দিলে ওর প্রতি অন্ধ ও বধির সদৃশ আচরণ করে না।[3]
বলাই বাহুল্য যে, যারা না বুঝে কুরআন পড়ে এবং কুরআনের উপর আমল করে না, তারাই তার প্রতি অন্ধ ও বধির সদৃশ আচরণ করে।
সালাফে সালেহীনগণের অভ্যাস ছিল কুরআন বুঝে পড়ে তার নির্দেশ অনুযায়ী আমল করা। আবু আব্দুর রহমান সুলামী (রঃ) বলেন, ‘আমাদেরকে আমাদের ওস্তাদগণ বর্ণনা করেছেন যে, যাঁরা রসূল (ﷺ) এর ছাত্র ছিলেন তাঁরা দশটি আয়াত শিখলে ততক্ষণ পর্যন্ত আর আগে বাড়তেন না যতক্ষণ পর্যন্ত ঐ দশ আয়াতের বর্ণিত ইল্ম ও আমল শিক্ষা করেছেন। তাঁরা বলেছেন, আমরা ইল্ম ও আমল উভয়ই (একই সময়ে) শিক্ষা করেছি।’[4]
আল্লাহর কিতাব বুঝে পড়তে হয় বলেই তাড়াহুড়া করে তা খতম করা বিধেয় নয়। রাসুল (ﷺ) বলেন, ‘‘সে ব্যক্তি কুরআন বুঝে না, যে তিন দিনের কম সময়ে তা খতম করে।’’[5]
[2]. সূরা বাকারাহ-২:১২১
[3]. সূরা ফুরকান-২৫:৭৩
[4]. মুসনাদে আহমাদ আল-মাকতাবাতুশ-শামেলা. হা/ ২২৯৭১
[5]. আবূ দাঊদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ প্রমুখ, সহীহুল জা’মে হা/৭৭৪৩
যেহেতু মহান আল্লাহ চিন্তাশীল বান্দাদের প্রশংসা করে বলেন, ‘‘তারা দাঁড়িয়ে থাকা, বসে থাকা এবং শুয়ে থাকা অবস্থায় আল্লাহর জিকির করে।’’[1] সওয়ারীর পিঠে চড়ে আয়াত পড়ার নির্দেশ রয়েছে কুরআনে। (সূরা যুখরুফ ১৩ আয়াত) মক্কা বিজয়ের দিন তিনি সওয়ারী উটের পিঠে চড়ে সূরা ফাত্হ পাঠ করেছেন।[2]
যেমন কোন অপবিত্র ব্যক্তির পাশে বসে, তার দেহে দেহ লাগিয়ে অথবা তার কোলে মাথা রেখে কুরআন তিলাওয়াত করা দোষাবহ নয়। কেননা, রাসুল (ﷺ) মা আয়েশার কোলে মাথা রেখে কুরআন পড়েছেন। অথচ মা আয়েশা তখন মাসিক অবস্থায় থাকতেন।[3] আর এখান থেকে এ কথাও বুঝা যায় যে, কোন অপবিত্র জায়গার ধারে-পাশে (আড়ালে) কুরআন পড়া যায়।[4]
[2]. বুখারী তাওহীদ পাবঃ হা/ ৫০৩৪, মুসলিম আল-মাকতাবাতুশ-শামেলা হা/৭৯৪
[3]. বুখারী তাওহীদ পাবঃ হা/ ২৯৭, মুসলিম আল-মাকতাবাতুশ-শামেলা হা/৩০১
[4]. ফাতহুল বারী ১/৪৭৯
যেহেতু মহান আল্লাহ বলেন, لَا يَمَسُّهُ إِلَّا الْمُطَهَّرُونَ
অর্থাৎ, যারা পূত-পবিত্র তারা ব্যতীত অন্য কেউ তা স্পর্শ করে না। (অথবা যেন না করে।)[1]
রাসুল (ﷺ) বলেন, ‘‘আর পবিত্র ব্যক্তি ছাড়া কেউ যেন কুরআন স্পর্শ না করে।’’[2]
মুসআব বিন সা’দ বিন আবী অক্কাস বলেন, আমি সা’দ বিন আবী অক্কাসের জন্য মুসহাফ ধারণ করতাম। একদা আমি চুলকালাম। তা দেখে সা’দ বললেন, সম্ভবতঃ তুমি তোমার পেশাব-দ্বার স্পর্শ করলে? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, তুমি ওঠো এবং ওযূ করে এসো। অতঃপর আমি উঠে ওযূ করে এলাম।[3]
প্রকাশ থাকে যে, কাপড়, জুযদান, রেহেল বা ছোট বাক্সে কুরআন রেখে অপবিত্র ব্যক্তি সরাসরি হাত না লাগিয়ে তা বহন করতে পারে।
পক্ষান্তরে অপবিত্র অবস্থায় কুরআনের ক্যাসেট বা সিডি সরাসরি স্পর্শ করা দোষাবহ নয়।[4]
যেমন (পবিত্র ব্যক্তির) পকেটে কুরআন রাখা বৈধ। অবশ্য তা পকেটে রেখে পেশাব-পায়খানা করা বা বাথরুম বা অপবিত্র জায়গায় প্রবেশ করা বৈধ নয়। যেহেতু তাতে আল্লাহর কিতাবের সম্মান-হানি হয়। দরকার হলে কুরআন বাইরে কোন পবিত্র জায়গায় রেখে পেশাব-পায়খানা করতে হবে। অবশ্য চুরি হয়ে যাওয়ার ভয় হলে নিরুপায় অবস্থায় সঙ্গে নিয়েই নাপাক জায়গায় প্রবেশ করা বৈধ হবে।[5]
[2]. মালেক ৪৬৮, ইরওয়াউল গালীল ১২২
[3]. মুঅত্ত্বা, বাইহাক্বী, ইরওয়াউল গালীল ১/১৬১
[4]. ফাতাওয়া উলামাইল বালাদিল হারাম ১৪৩পৃঃ
[5]. ফাতাওয়াল লাজনাতিদ দায়েমাহ ৪/৪০
যে নাপাকীতে গোসলের প্রয়োজন সে নাপাকী অবস্থায় কুরআন তিলাওয়াত (মুখস্থ পড়া অথবা কুরআন স্পর্শ না করে দূরে রেখে দেখে পড়া) বৈধ নয়। আলী (রাঃ) বলেন, ‘বড় নাপাকীর অবস্থা ছাড়া অন্যান্য অবস্থায় আল্লাহর রসূল (ﷺ) আমাদেরকে কুরআন পড়াতেন।’[1]
অবশ্য যে নাপাকীতে গোসলের দরকার হয় না বরং কেবল ওযূর দরকার হয়, সে নাপাকী অবস্থায় কুরআন মুখস্থ পড়া যায়। যেহেতু রাসুল (ﷺ) একদা তাহাজ্জুদ নামাযের জন্য উঠে সূরা আলে ইমরানের শেষের ১০টি আয়াত পাঠ করার পর ওযূ করেছেন।
একদা উমার (রাঃ) এক সম্প্রদায়ের নিকট এলেন; তখন তারা কুরআন পড়ছিল। সেখান থেকে তিনি (পেশাব অথবা পায়খানার) প্রয়োজনে গেলেন এবং কুরআন পড়তে পড়তে ফিরে এলেন। তা দেখে এক ব্যক্তি তাঁর উদ্দেশ্যে বলল, ‘হে আমীরুল মু’মেনীন! ওযূ না করেই আপনি কুরআন পাঠ করছেন?’ তার এ কথা শুনে তিনি বললেন, ‘তোমাকে এ ফতোয়া কে দিয়েছে (যে, বিনা ওযূতে কুরআন পড়া যাবে না)? (ঝুটা নবী) মুসাইলিমাহ নাকি?’[2] অবশ্য ওযূ অবস্থাতেই কুরআন (মুখস্থ) পড়া উত্তম।
সুযোগ ও সুবিধা অনুযায়ী কুরআন মুখস্থ অথবা দেখে পড়া যায়। তবে দেখে পড়া উত্তম, যেমন পূর্বে এক হাদীসে উল্লেখ হয়েছে। অনুরূপ যার কুরআন আছে, সে হাফেয হলেও মাঝে মাঝে তা দেখে পড়া দরকার। যাতে তা একেবারে পরিত্যক্ত না হয়ে যায়।
[2]. মুঅত্ত্বা ৪৬৯