ইসলাম যেমন মুসলিমের আভ্যন্তরিক দিক পবিত্র করার তাকীদ দেয়, ঠিক তেমনিই তাকীদ দেয় তার বাহ্যিক দিকটাও পবিত্র ও সুন্দর করার।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ইসলাম মানুষের লজ্জাস্থান ঢাকাকে ফরয ঘোষণা করেছে। সুতরাং কোন মুসলিম একাকী থাকলেও উলঙ্গ থাকতে পারে না। মহান আল্লাহ বলেন,
يَا بَنِي آدَمَ قَدْ أَنْزَلْنَا عَلَيْكُمْ لِبَاسًا يُوَارِي سَوْآتِكُمْ وَرِيشًا وَلِبَاسُ التَّقْوَى ذَلِكَ خَيْرٌ ذَلِكَ مِنْ آيَاتِ اللَّهِ لَعَلَّهُمْ يَذَّكَّرُونَ
‘‘হে মানব জাতি! তোমাদের লজ্জাস্থান ঢাকার ও বেশভূষার জন্য আমি তোমাদেরকে লেবাস দিয়েছি। পরন্তু ‘তাকওয়া’র লেবাসই সর্বোৎকৃষ্ট।[1] মু’মিন বান্দাগণের গুণ বর্ণনা করে তিনি আরো বলেন,
وَالَّذِينَ هُمْ لِفُرُوجِهِمْ حَافِظُونَ - إِلَّا عَلَى أَزْوَاجِهِمْ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُمْ فَإِنَّهُمْ غَيْرُ مَلُومِينَ (المعارج ২৯-৩০)
অর্থাৎ, যারা নিজেদের যৌনাঙ্গ সংযত রাখে, তবে নিজেদের পত্নী অথবা অধিকারভুক্ত দাসিগণের ক্ষেত্রে অন্যথা করলে তারা তিরস্কৃত নয়।[2]
রসূল (ﷺ) বলেন, ‘‘তোমার স্ত্রী ও ক্রীতদাসী ছাড়া অন্য মানুষ থেকে নিজের লজ্জাস্থান হিফাযত কর। নিজেদের আপোসে থাকলেও যথাসাধ্য তা কাউকে দেখাবে না এবং একাকী নির্জনে থাকলেও (উলঙ্গ থাকবে না। কারণ) মানুষ অপেক্ষা আল্লাহ এর বেশী হকদার যে, তাঁকে লজ্জা করা হবে।’’[3] শরীয়তের দৃষ্টিতে ‘‘(পুরুষের) নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত স্থান হল লজ্জাস্থান।’’[4] রাসুল (ﷺ) বলেন, ‘‘তুমি তোমার ঊরু খুলে রেখো না এবং কোন জীবিত অথবা মৃতের ঊরুর দিকে তাকিয়ে দেখো না।’’[5] তিনি অন্যত্র বলেন,
غَطِّ فَخِذَكَ فَإِنَّ فَخِذَ الرَّجُلِ عَوْرَةٌ
তুমি তোমার জাং ঢেকে নাও। কারণ, জাং হল লজ্জাস্থান।’’[6]
যেহেতু গোসল করার সময় লজ্জাস্থান প্রকাশ পাওয়ার ভয় থাকে, তাই সেই সময়ে গোপনীয়তা অবলম্বন করতে শরীয়ত আমাদেরকে নির্দেশ দেয়। রাসুল (ﷺ) বলেন, ‘‘অবশ্যই আল্লাহ আয্যা অজাল্লা অতি লজ্জাশীল ও গোপনকারী। তিনি লজ্জাশীলতা ও গোপনীয়তাকে পছন্দ করেন। সুতরাং তোমাদের কেউ গোসল করলে সে যেন পর্দা করে নেয়।’’[7]
আর সে জন্যই ফাঁকা পুকুর, নদী বা সমুদ্রঘাটে গোসল করা বৈধ নয়। বরং যেমনই হোক বিশেষ করে মহিলাদের জন্য বাড়িতে বাথরুম করা একান্ত জরুরী।
শরীয়তের সভ্য-দৃষ্টিতে সাধারণভাবে লেবাসের কতকগুলি শর্ত ও আদব রয়েছে; যা পালন করতে মুসলিম নরনারী বাধ্য।
[2]. সূরা মু’মিনূন-২৩: ৫-৬, সূরা মাআরিজ-৭০:২৯-৩০
[3]. আবূ দাঊদ হা/৪০১৭, তিরমিযী হা/২৭৯৪, ইবনে মাজাহ আল-মাকতাবাতুশ-শামেলা. হা/১৯২০
[4]. হাকেম, সহীহুল জা’মে হা/৫৫৮৩
[5]. আবূ দাঊদ, সহীহুল জা’মে হা/৭৪৪০
[6]. আহমাদ, আবূ দাঊদ, তিরমিযী, হাকেম, ইবনে হিববান, সহীহুল জা’মে হা/৭৯০৬
[7]. মুসনাদে আহমাদ আল-মাকতাবাতুশ-শামেলা. হা/ ১৭৫০৯, আবূ দাঊদ হা/৪০১২, নাসাঈ হা/ ৪০৬
দেহের কোন অঙ্গ বা সৌন্দর্য যেন কোন বেগানা (যার সাথে কোনও সময়ে বিবাহ বৈধ এমন) পুরুষের সামনে প্রকাশ না পায়। কেন না মহানবী (ﷺ) বলেন, ‘‘মেয়ে মানুষের সবটাই লজ্জাস্থান (গোপনীয়)। আর সে যখন বের হয়, তখন শয়তান তাকে পুরুষের দৃষ্টিতে পরিশোভিতা করে তোলে।’’[2] মহান আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ قُلْ لِأَزْوَاجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَاءِ الْمُؤْمِنِينَ يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِنْ جَلَابِيبِهِنَّ
‘‘হে নবী! তুমি তোমার পত্নীগণকে, কন্যাগণকে এবং মু’মিনদের স্ত্রীগণকে বলে দাও, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের (চেহারার) উপর টেনে নেয়---।’’[3]
হযরত উম্মে সালামাহ (রাঃ) বলেন, ‘উক্ত আয়াত অবতীর্ণ হলে (মদীনার) আনসারদের মহিলারা যখন বের হল, তখন তাদের মাথায় (কালো) চাদর (বা মোটা ওড়না) দেখে মনে হচ্ছিল যেন ওদের মাথায় কালো কাকের ঝাঁক বসে আছে!’[4]
আল্লাহ তাআলার আদেশ, মু’মিন মেয়েরা যেন তাদের ঘাড় ও বুককে মাথার কাপড় দ্বারা ঢেকে নেয়---। (সূরা নূর-২৪:৩১)
হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘পূর্বের মুহাজির মহিলাদের প্রতি আল্লাহ রহম করেন। উক্ত আয়াত অবতীর্ণ হলে তারা তাদের পরিধেয় কাপড়সমূহের মধ্যে সবচেয়ে মোটা কাপড়টিকে ফেড়ে মাথার ওড়না বানিয়ে মাথা (ঘাড়-গলা-বুক) ঢেকেছিল।’[5]
সাহাবাদের মহিলাগণ যখন পথে চলতেন, তখন তাঁদের নিম্নাঙ্গের কাপড়ের শেষ প্রান্ত মাটির উপর ছেঁচড়ে যেত। নাপাক জায়গাতে চলার সময়েও তাদের কেউই পায়ের পাতা বের করতেন না।[6] সুতরাং মাথা ও পায়ের মধ্যবর্তী কোন অঙ্গ যে প্রকাশ করাই যাবে না, তা অনুমেয়।
জ্ঞাতব্য যে, মহিলাদের পায়ের পাতা গোপন করা অনেকের মতে জরুরী না হলেও উত্তম। সুতরাং সে ক্ষেত্রে মোজা ও জুতার মাধ্যমে তা পর্দা করে নিলেও চলবে।[7]
[2]. তিরমিযী, মিশকাত হা:৩১০৯
[3]. সূরা আহযাব-৩৩:৫৯
[4]. আবূ দাঊদ হা/৪১০১
[5]. আবূ দাঊদ হা/৪১০২
[6]. মিশকাত হা/৫০৪, ৫১২, ৪৩৩৫
[7]. ফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন ২/৮৩৮
যেহেতু মহান আল্লাহ বলেন, ‘‘সাধারণতঃ যা প্রকাশ হয়ে থাকে তা ছাড়া তারা যেন তাদের অন্যান্য সৌন্দর্য প্রকাশ না করে।’’[1]
প্রকাশ থাকে যে, যে বোরকা সৌন্দর্যখচিত, সে বোরকাকেও আর একটি বোরকা দিয়ে ঢাকা জরুরী।
নচেৎ ঢাকা থাকলেও খোলার পর্যায়ভুক্ত। এ ব্যাপারে এক হাদীসে আল্লাহর রসূল (ﷺ) হযরত আসমা (রাঃ) কে সতর্ক করেছিলেন।[1]
একদা হাফসা বিন্তে আব্দুর রহমান পাতলা ওড়না পরে হযরত আয়েশা (রাঃ) এর নিকট গেলে তিনি তার ওড়নাকে ছিঁড়ে ফেলে দিলেন এবং তাকে একটি মোটা ওড়না পরতে দিলেন।[2]
রাসুল (ﷺ) বলেন, ‘‘দুই শ্রেণীর মানুষ দোযখবাসী; যাদেরকে আমি (এখনো) দেখিনি। ---(এদের মধ্যে দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষ সেই) মহিলাদল, যারা কাপড় পরেও উলঙ্গ থাকবে, অপর পুরুষকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করবে এবং নিজেও তার দিকে আকৃষ্ট হবে, যাদের মাথা (চুলের খোঁপা) হিলে থাকা উটের কুঁজের মত হবে। তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না। আর তার সুগন্ধও পাবে না; অথচ তার সুগন্ধ এত এত দূরবর্তী স্থান থেকেও পাওয়া যাবে।’’[3]
[2]. মালেক, মিশকাত হা/ ৪৩৭৫
[3]. আহমাদ, মুসলিম, সহীহুল জা’মে হা/৩৭৯৯
যাতে দেহের উঁচু-নিচু ব্যক্ত হয়। কারণ এমন ঢাকাও খোলার পর্যায়ভুক্ত এবং দৃষ্টি-আকর্ষী।
মহানবী (ﷺ) বলেন, ‘‘সেন্ট্ বিলাবার উদ্দেশ্যে কোন মহিলা যদি তা ব্যবহার করে পুরুষদের সামনে যায়, তবে সে বেশ্যা মেয়ে।’’[1]
সেন্ট্ ব্যবহার করে মহিলা মসজিদেও যেতে পারে না। একদা চাশ্তের সময় আবূ হুরাইরা (রাঃ) মসজিদ থেকে বের হলেন। দেখলেন, একটি মহিলা মসজিদ প্রবেশে উদ্যত। তার দেহ বা লেবাস থেকে উৎকৃষ্ট সুগন্ধির সুবাস ছড়াচ্ছিল। আবূ হুরাইরা (রাঃ) মহিলাটির উদ্দেশে বললেন, ‘আলাইকিস্ সালাম।’ মহিলাটি সালামের উত্তর দিল। তিনি তাকে প্রশ্ন করলেন, ‘কোথায় যাবে তুমি?’ সে বলল, ‘মসজিদে।’ বললেন, ‘কি জন্য এমন সুন্দর সুগন্ধি মেখেছ তুমি?’ বলল, ‘মসজিদের জন্য।’ বললেন, ‘আল্লাহর কসম?’ বলল, ‘আল্লাহর কসম।’ পুনরায় বললেন, ‘আল্লাহর কসম?’ বলল, ‘আল্লাহর কসম।’ তখন তিনি বললেন, ‘তবে শোন, আমাকে আমার প্রিয়তম আবুল কাসেম (ﷺ) বলেছেন যে, ‘‘সেই মহিলার কোন নামায কবুল হয় না, যে তার স্বামী ছাড়া অন্য কারোর জন্য সুগন্ধি ব্যবহার করে; যতক্ষণ না সে নাপাকীর গোসল করার মত গোসল করে নেয়।’’ অতএব তুমি ফিরে যাও, গোসল করে সুগন্ধি ধুয়ে ফেল। তারপর ফিরে এসে নামায পড়ো।’[2]
[2]. আবূ দাঊদ, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, বাইহাক্বী, সিলসিলাহ সহীহাহ আল-মাকতাবাতুশ-শামেলা. হা/১০৩১
প্রিয় নবী (ﷺ) বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি যে জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন (লেবাসে-পোশাকে, চাল-চলনে অনুকরণ) করবে সে তাদেরই দলভুক্ত।’’[1]
মহানবী (ﷺ) সেই নারীদেরকে অভিশাপ দিয়েছেন, যারা পুরুষদের বেশ ধারণ করে এবং সেই পুরুষদেরকেও অভিশাপ দিয়েছেন, যারা নারীদের বেশ ধারণ করে।’’[1] তিনি সেই পুরুষকে অভিশাপ দিয়েছেন, যে মহিলার মত লেবাস পরে এবং সেই মহিলাকেও অভিশাপ দিয়েছেন, যে পুরুষের মত লেবাস পরে।[2]
[2]. আবূ দাঊদ হা/৪০৯৮, ইবনে মাজাহ আল-মাকতাবাতুশ-শামেলা. হা/১৯০৩
কারণ, বিরল ধরনের (খুব ভালো অথবা খুব খারাপ) লেবাস পরলে সাধারণতঃ পরিধানকারীর মনে গর্ব সৃষ্টি হয় এবং দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাই রাসুল (ﷺ) বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি দুনিয়াতে প্রসিদ্ধিজনক লেবাস পরবে, আল্লাহ তাকে কিয়ামতে লাঞ্ছনার লেবাস পরাবেন।’’[1]
‘‘যে ব্যক্তি জাঁকজমকপূর্ণ লেবাস পরবে, আল্লাহ তাকে কিয়ামতে অনুরূপ লেবাস পরিয়ে তা অগ্নিদগ্ধ করবেন।’’[2]
প্রকাশ থাকে যে, স্বামীর কাছে মহিলার কোন প্রকার পর্দা নেই। স্বামী-স্ত্রী উভয়েই এক অপরের জন্য লেবাস। বাড়ির এগানাপুরুষ (বাপ-ভাইদের) কাছে হাত, পা, মাথা ও ঘাড় ঢাকা জরুরী নয়। মহিলাদের সামনে নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত ঢাকা জরুরী। তবে মহিলা যদি কাফের হয় অথবা এমন মহিলা বলে আশঙ্কা হয়, যে তার রূপ-লাবণ্য নিজ স্বামী বা অন্য কোন পুরুষের কাছে বয়ান করবে, তাহলে তার সামনেও কেশ ও বক্ষের সৌন্দর্য প্রকাশ করা জায়েয নয়।
[2]. আবূ দাঊদ, বাইহাকী, সহীহুল জা’মে হা/৬৫২৬
১। লেবাস যেন নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত অংশ অবশ্যই আবৃত রাখে। যেহেতু ঐটুকু অঙ্গ পুরুষের লজ্জাস্থান।[1]
২। এমন পাতলা না হয়, যাতে ভিতরের চামড়া নজরে আসে।
৩। এমন আঁট-সাট না হয়, যাতে দেহের উঁচু-নিচু প্রকাশ পায়।
৪। কাফেরদের লেবাসের অনুকরণীয় না হয়।
৫। মহিলাদের লেবাসের অনুরূপ না হয়।
৬। জাঁকজমকপূর্ণ প্রসিদ্ধিজনক না হয়।