হাদীসের নামে জালিয়াতি মীলাদুন্নবী (ﷺ) উদযাপন ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ৫ টি

আমি ‘এহইয়াউস সুনান’‘রাহে বেলায়াত’ পুস্তকদ্বয়ে মীলাদের উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ, আলিমগণের মতামত ও সুন্নাত পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।[1] আমরা দেখেছি যে, মীলাদ মাহফিলের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ ()-এর মীলাদ, সীরাত, শামাইল ও হাদীস আলোচনা করা, দরুদ-সালাম পাঠ করা, মহববত বৃদ্ধি করা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত-সম্মত ইবাদত পালন করা হয়। নাম ও পদ্ধতিগত কারণে বিভিন্ন মতভেদ দেখা দিয়েছে। তবে পক্ষ-বিপক্ষ সকলেই একমত যে, ইসলামের প্রথম শতাব্দীগুলোতে ‘‘মীলাদুন্নবী’’ বা রাসূলুল্লাহ -এর জন্ম পালনের প্রচলন ছিল না। মীলাদুন্নবীর সমর্থক কয়েকজন প্রসিদ্ধ আলিমের বক্তব্য দেখুন:

(ক) নবম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও ফকীহ আল্লামা ইবনু হাজর আসকালানী (৮৫২ হি) মীলাদুন্নবী উদ্যাপন সমর্থন করেছেন। তিনি লিখেছেন: ‘‘মাওলিদ পালন মূলত বিদ‘আত। ইসলামের সম্মানিত প্রথম তিন শতাব্দীর সালফে সালেহীনের কোনো একজনও এই কাজ করেন নি।’’[2]

(খ) এ শতকের অন্য একজন প্রসিদ্ধ আলিম আল্লামা আবুল খাইর মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুর রহমান সাখাবী (৯০২ হি.)। তিনিও মীলাদুন্নবী উদ্যাপনের সমর্থক। তিনি লিখেছেন : ‘‘ইসলামের সম্মানিত প্রথম তিন যুগের সালফে সালেহীনের কোনো একজন থেকেও মাওলিদ পালনের কোনো ঘটনা খুঁজে পাওয়া যায় না। মাওলিদ পালন বা উদ্যাপন পরবর্তী যুগে উদ্ভাবিত হয়েছে। এরপর থেকে সকল দেশের ও সকল বড় বড় শহরের মুসলিমগণ রাসূলুল্লাহ -এর জন্মমাস পালন করছেন... বরকত লাভ করছেন। ’’[3]

(গ) নবম-দশম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধতম মুহাদ্দিস ও ফকীহ ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী মীলাদের সমর্থনে অনেক পুস্তিকা রচনা করেন। ‘হুসনুল মাকদাস ফী আমালিল মাওলিদ’ পুস্তিকায় তিনি মীলাদের সমর্থনে বলেন:

عندي أن أصل عمل المولد الذي هو اجتماع الناس وقراءة ما تيسر من القرآن ورواية الأخبار الواردة في مبدأ أمر النبي وما وقع في مولده من الآيات ثم يمد لهم سماط يأكلونه وينصرفون من غير زيادة على ذلك هو من البدع الحسنة التي يثاب عليها صاحبها لما فيه من تعظيم قدر النبي وإظهار الفرح والاستبشار بمولده الشريف، وأول من أحدث فعل ذلك صاحب اربل الملك المظفر أبو سعيد كوكبري...

‘‘মীলাদ পালন হলো: মানুষদের একত্রিত হওয়া, সাধ্যমত কুরআন তিলাওয়াত করা, রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর জন্ম এবং জন্মের সময় যে সকল অলৌকিক নিদর্শন প্রকাশিত হয়েছিল তা আলোচনা করা, এরপর দস্তরখান বিছানো হলে খাদ্য গ্রহণ করে প্রস্থান করা। এর অতিরিক্ত কিছুই করা হয় না। আমার মতে এরূপ কর্ম বিদআতে হাসানা, এর জন্য সাওয়াব পাওয়া যাবে; কারণ এতে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর তাযীম, তাঁর পবিত্র জন্মে খুশি ও আনন্দ প্রকাশ করা হয়। সর্বপ্রথম যে ব্যক্তি এ বিষয়টি উদ্ভাবন করেন তিনি ইরবিলের শাসক আল-মালিকুল মুযাফ্ফর আবূ সায়ীদ কুকবূরী (মৃত্যু ৬৩০ হি)...।’’[4]

(ঘ) দশম হিজরীর অন্যতম প্রসিদ্ধ সীরাতুন্নবী ও মীলাদুন্নবী গবেষক মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিক আল্লামা মুহাম্মাদ ইবন ইউসূফ সালিহী শামী (৯৪২ হি)। তিনি তাঁর সুপ্রসিদ্ধ ‘সীরাহ শামিয়্যাহ’ গ্রন্থে মীলাদুন্নবী উদযাপনের গুরুত্ব প্রমাণের জন্য আলিমগণের বক্তব্য, যুক্তি, স্বপ্ন ও কাশফ উদ্ধৃত করে দীর্ঘ অধ্যায় রচনা করেছেন। তিনিও সুস্পষ্টত উল্লেখ করেছেন যে, মীলাদুন্নবী পূর্ববর্তী যুগে ছিল না, সর্বপ্রথম ইরবিলের শাসক কুকবূরী তা প্রচলন করেন।[5]

(ঙ) মীলাদের সমর্থক লাহোরের প্রখ্যাত আলিম সাইয়্যিদ দিলদার আলী (১৯৩৫ খৃ) মীলাদের পক্ষে আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন: ‘‘মীলাদের কোনো আসল বা সূত্র প্রথম তিন যুগের কোনো সালফে সালেহীন থেকে বর্ণিত হয় নি; বরং তাঁদের যুগের পরে এর উদ্ভাবন ঘটেছে।’’[6]

(ছ) মীলাদের সমর্থনে বিগত ৮০০ বৎসরে অনেক প্রসিদ্ধ আলিম অনেক দলীল, যুক্তি, মত, কাশফ, স্বপ্ন ইত্যাদির কথা লিখেছেন। তবে তাঁরা সকলেই উল্লেখ করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও সাহাবী-তাবিয়ীগণের যুগে মীলাদ ছিল না। এজন্য তা বিদআতে হাসানা।

(জ) মীলাদের সমর্থক সকল আলিমই আনুষঙ্গিক দলীলের উপর নির্ভর করেছেন। যেমন, মীলাদের মধ্যে কুরআন তিলাওয়াত, দরুদ-সালাম পাঠ, দান-সাদকা ইত্যাদি নেক আমল করা হয়, কাজেই তা মন্দ হবে কেন? আবূ লাহাব রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর জন্মের সংবাদ পেয়ে খুশি হয়ে তার দাসীকে মুক্ত করে, এজন্য তিনি কাফির হয়েও কবরে উপকার লাভ করেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ নিজের জন্ম বিষয়ে কথা বলেছেন, সাহাবীগণ একে অপরের কাছে তাঁর গুণাবলি শুনতে চাইতেন, তাঁরা সালাতে দাঁড়িয়ে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর আগমন বিষয়ক কুরআনের আয়াত পাঠ করতেন.... কাজেই মীলাদ-কিয়াম কুরআন-সুন্নাহ সম্মত ...। আমরা স্বভাবতই বুঝি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও সাহাবীগণ মীলাদুন্নবী পালন করেছেন মর্মে কোনো একটি যয়ীফ বা জাল হাদীসও যদি থাকতো তাহলে কেউই এ সকল আনুষঙ্গিক বা অপ্রাসঙ্গিক দলীল দিয়ে মীলাদ প্রমাণের চেষ্টা করতেন না। বরং সরাসরি উক্ত দলীল পেশ করতেন।

এভাবে আমরা দেখছি যে, হিজরী ষষ্ঠ-সপ্তম শতকে ‘ঈদ মীলাদুন্নবী’ উদ্ভাবন ও প্রচলন হওয়ার পরে বিগত প্রায় ৮০০ বৎসর যাবৎ মুসলিম উম্মাহর অগণিত আলিম মীলাদকে পছন্দ করেছেন এবং এর পক্ষে বিভিন্ন দলীল-প্রমাণ পেশ করেছেন। কিন্তু তাঁরা কেউই এর পক্ষে জালিয়াতি করেন নি। বরং মীলাদের সমর্থক আলিমগণও মীলাদ প্রসঙ্গে জাল হাদীস বর্ণনা কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। কিন্তু বর্তমান যুগে কিছু নির্লজ্জ জালিয়াত এ বিষয়ে জাল হাদীস ও জাল পুস্তক প্রকাশ করেছে।

কিছু অংশে লেখকের লেখা আমাদের কাছে স্পষ্ট বোধগম্য হয়নি যে তিনি কি বুঝাতে চেয়েছেন। আমরা লেখকের সাথে অচিরেই এই বিষয়ে কথা বলে অস্পষ্ট বিষয়গুলিকে স্পষ্ট করার চেষ্টা করব ইনশাল্লাহ --- বাংলা হাদিস
----------------------------------------------------------------------------------------------
[1] দেখুন: এহইয়াউস সুনান, পৃ. ৫১৬-৫৫৫; রাহে বেলায়াত, পৃ. ৬৩৮-৬৪০।

[2] শামী, মুহাম্মাদ ইবন ইউসুফ, সুবুলুল হুদা (সীরাহ শামিয়্যাহ) ১/৩৬৬

[3] শামী, সীরাহ শামিয়্যাহ ১/৩৬২

[4] সুয়ীতী, আল-হাবী ফিল ফাতাওয়া ১/১৮১-১৮২।

[5] শামী, সীরাত শামিয়্যাহ ১/৩৬২।

[6] সাইয়িদ দিলদার আলী, রাসূলুল কালাম ফিল মাওলিদ ওয়াল কিয়াম, ১৫ পৃ।

হিজরী দশম শতকের প্রসিদ্ধ আলিম ইবন হাজার হাইতামী মাক্কী (৮৯৯-৯৭৪/১৪৯৪-১৫৬৬ হি)-এর নামে তুরস্কের মাকতাবাতুল হাকীকাহ নামক একটি প্রকাশনা সংস্থা গত ১৯৯৩ খৃ (১৪১৪ হি) ‘‘আন-নি’মাতুল কুবরা আলাল আলাম ফী মাওলিদি সাইয়িদি ওয়ালাদি আদাম’’ (বিশ্বের উপর শ্রেষ্ঠ নিয়ামত আদম সন্তানদের নেতার জন্মের মধ্যে) নামে একটি বই প্রকাশ করেছে। এ বইটির মধ্যে মীলাদের পক্ষে সাহাবীগণের নামে অনেকগুলো সনদ বিহীন জাল হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে। এ জাল বইটির প্রথম অধ্যায় নিম্নরূপ:

فصل في بيان فضل مولد النبي . قال أبو بكر الصديق مَنْ أَنْفَقَ دِرْهَماً عَلَى قِرَاءَةِ مَوْلِدِ النَّبِيِّ ﷺ كَانَ رَفِيْقِيْ فِيْ الْجَنَّةِ. وقال عمر : مَنْ عَظَّمَ مَوْلِدَ النَّبِيِّ ﷺ فَقَدْ أَحْيَا الإِسْلاَمَ. وقال عثمان : من أنفق درهما على قراءة مَوْلِدَ النَّبِيِّ ﷺ فَكَأَنَّماَ شَهِدَ غَزْوَةَ بَدْرٍ أَوْ حُنَيْنٍ. وقال علي رضي الله عنه وكرم الله وجهه: مَنْ عَظَّمَ مَوْلِدَ النَّبِيِّ ﷺ وَكَانَ سَبَباً فِيْ قِرَاءَتِهِ لاَ يَخْرُجُ مِنَ الدُّنْيَا إِلاَّ بِالإِيْمَانِ ويدخل الجنة بغير حساب. وقال الحسن البصري رضي الله عنه وددت لو كان لي مثل جبل أحد ذهبا فأنفقته على قراءة مولد النبي .... وقال الإمام الشافعي رحمه الله: من جمع لمولد النبي إخواناً وهيَّأ طعاما وأخلى مكانا وعمل إحسانا وصار سببا لقراءته بعثه الله يوم القيامة مع الصديقين والشهداء والصالحين ويكون في جنات النعيم....

‘‘প্রথম পরিচ্ছেদ মীলাদুন্নবী (ﷺ)-এর মর্যাদা বর্ণনায়। আবু বকর সিদ্দীক (রা) বলেন, যে ব্যক্তি মীলাদুন্নবী পাঠের জন্য এক দিরহাম ব্যয় করবে সে জান্নাতে আমার সাথী হবে। উমার (রা) বলেন: যে ব্যক্তি মীলাদুন্নবীর তা’যীম করবে সে ইসলামকে জীবিত করবে। উসমান (রা) বলেন: যে ব্যক্তি মীলাদুন্নবী পাঠের জন্য এক দিরহাম ব্যয় করবে সে যেন বদর বা হুনাইনের যুদ্ধে যোগদান করলো। আলী (রা) বলেন: ‘‘যে ব্যক্তি মীলাদুন্নবীর তা’যীম করবে এবং মীলাদুন্নবী পাঠের কারণ হবে, সে দুনিয়া হতে ঈমানের সাথে মৃত্যুবরণ করবে এবং বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। হাসান বসরী (রাহ) বলেন: আমার কামনা হয় যে, যদি আমার উহদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণ থাকত তবে আমি তা মীলাদুন্নবী পড়ার জন্য ব্যয় করতাম। ... ইমাম শাফিয়ী (রাহ) বলেন: যদি কেউ মীলাদুন্নবীর জন্য বন্ধুদেরকে জমায়েত করে, খাবার প্রস্ত্তত করে, স্থান খালি করে দেয়, দান-খয়রাত করে এবং তার কারণে মীলাদুন্নবী পড়া হয় তবে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে সিদ্দীক, শহীদ ও সালিহগণের সাথে উত্থিত করবেন এবং সে জান্নাতে থাকবে।...’’

এভাবে আরো অনেক তাবিয়ী, তাবি তাবিয়ী ও পরবর্তী বুজুর্গগণের নামে মীলাদুন্নবী ‘পড়া’-র ফযীলতে অনেক বক্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা এখানে দুটি বিষয় আলোচনা করব: (১) বইটি ইবন হাজার হাইসামীর নামে একটি জাল বই এবং (২) এ সকল হাদীস ও বক্তব্য সবই নির্লজ্জ জালিয়াতদের বানানো মিথ্যা কথা। নিম্নের বিষয়গুলো লক্ষ্য করুন:

(ক) আল্লামা ইবনু হাজার হাইতামীর পুরো নাম: আহমাদ ইবন মুহাম্মাদ ইবন মুহাম্মাদ ইবন হাজার শিহাবুদ্দীন মাক্কী শাফিয়ী। তিনি মীলাদুন্নবী উদযাপন ও মীলাদ পালনের সমর্থক ছিলেন। মীলাদুন্নবী বিষয়ক তাঁর রচিত একটি গ্রন্থের নাম ‘‘ইতমামুন নি’মাতিল কুবরা আলাল আলাম বিমাওলিদি সাইয়িদি ওয়লাদি আদাম’’, সংক্ষেপে: ‘আন-নি’মাতুল কুবরা’। গ্রন্থটি প্রসিদ্ধ। বিগত ৪০০ বৎসরে অনেক আলিম এ গ্রন্থের উদ্ধৃতি প্রদান করেছেন এবং গ্রন্থটির অনেক পান্ডুলিপি বিশ্বের বিভিন্ন গ্রন্থাগারে বিদ্যমান।

এখানে আরব বিশ্বের কয়েকটি গ্রন্থাগার ও পান্ডুলিপি নম্বর উল্লেখ করছি। ইরাকের সুলাইমানিয়া প্রদেশের ওয়াকফ গ্রন্থাগার (মাকতাবাতুল আওকাফ), নং ১৩/৪৫৬-আইন এবং পান্ডুলিপি নং তা/মাজামী/২১৫-২১৮। সৌদি আরবের রিয়াদস্থ বাদশাহ ফয়সল গবেষণা কেন্দ্র, পান্ডুলিপি নং- ০২৬৩৩, ১৫২২-ফা-কাফ এবং পান্ডুলিপি বিষয়ক অধিদপ্তর, পান্ডুলিপি গ্রন্থাগার, নং ১৫৮৫, ৭০৩০, ১৪৪৬। মরক্কোর খাযানাতু তাতওয়ান গ্রন্থাগারে, পান্ডুলিপি নং ১৩/৪৫৬-আইন। ইয়ামানের সানআ শহরের বড় মসজিদের প্রাচীন গ্রন্থাগার: মাকতাবাতুল জামিয়িল কাবীর, পান্ডুলিপি নং ২২-মীম-জীম। সিরিয়ার দামেশক শহরের যাহিরিয়া গ্রন্থাগার, পান্ডুলিপি নং ৮৭২২, ৮১৬৪, ১১৩০১, ১১৩৪১, ৮৫৭১, ১১৩৬১, ৯৪৮৩, ৯৫৫৩। এ সকল পান্ডুলিপির ভিত্তিতে এ বইটি ইদানিং বৈরুত থেকে ছাপা হয়েছে।

(২) তুরস্কের মাকতাবাতুল হাকীকাহ প্রকাশিত ‘আন-নি’মাতুল কুবরা’ গ্রন্থটির সাথে এ সকল পান্ডুলিপির কোনোরূপ মিল নেই। বস্ত্তত বইটির কভারের নাম ও লেখকের নাম ছাড়া ভিতরের সবই জাল।

(৩) ‘আন-নি’মাতুল কুবরা’-র মূল পান্ডুলিপিগুলোর বক্তব্য নিম্নরূপ:

أحمد الله أتم الحمد كله وأشكره أفضل الشكر وأشمله ... أكتب ورقات في بيان أصل عمل المولد النبوي... دعاني إلى ذلك اختلاف الناس في أصل عمل المولد وهل هو بدعة أو لا وإكثار القصاص والوعاظ في ذكر أخبار موضوعة وحكايات وأشعار مصنوعة غير مستحيين من الله ورسوله في الكذب عليهما عمدا تارة وجهلا أخرى، ومن ثم قال الأئمة يجب على كل عارف الإنكار عليهم باليد فاللسان فالقلب.... الفصل الأول في أصل عمل المولد. إعلم أنه بدعة لأنه لم ينقل عن أحد من السلف في القرون الثلاثة التي شهد النبي بخيريتها؛ لكنها بدعة حسنة لما اشتملت عليه من الإحسان الكبير للفقراء ومن قراءة القرآن وإكثار الذكر والصلاة على النبي ..... إذا كان أهل الصليب اتخذوا ليلة مولد نبيهم عيدا أكبر فأهل الإسلام أولى بذلك وأجدر...

‘‘আল্লাহর প্রশংসা করছি সকল পরিপূর্ণ প্রশংসা এবং তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি সর্বোত্তম ও পূর্ণতম কৃতজ্ঞতা... মীলাদুন্নবী পালনের মূলভিত্তি বর্ণনা করার জন্য আমি একটি পুস্তিকা লেখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলাম....। এটি লিখতে আমি উদ্বুদ্ধ হলাম তার কারণ মীলাদ পালনের মূলভিত্তি বিষয়ে মানুষেরা মতভেদ করেছে যে তা বিদআত কি না। আর গল্পকার বক্তা ও ওয়ায়িজগণ ব্যাপকভাবে জাল হাদীস এবং ভিত্তিহীন গল্প ও কবিতা বলছেন। তারা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (ﷺ) থেকে একটুও লজ্জাবোধ করেন না- নির্লজ্জভাবে তাঁদের নামে মিথ্যা বলেন- কখনো ইচ্ছাকৃতভাবে এবং কখনো মুর্খতার কারণে। এজন্যই ইমামগণ বলেছেন: প্রত্যেক সচেতন ব্যক্তির জন্য ওয়াজিব দায়িত্ব হাত দিয়ে, জিহবা দিয়ে বা অন্তর দিয়ে এদের প্রতিবাদ করা।... প্রথম পরিচ্ছেদ মীলাদ পালনের মূল ভিত্তি বর্ণনার জন্য। পাঠক জেনে রাখুন যে, মীলাদ পালন বিদআত; কারণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যে তিন যুগের কল্যাণের সাক্ষ্য দিয়েছেন সে তিন যুগের সালফ সালিহীন কোনো ব্যক্তি থেকে এ কর্ম বর্ণিত হয় নি। তবে তা বিদআতে হাসানা বা ভাল বিদআত। কারণ এর মধ্যে অনেক ভাল কাজ অন্তর্ভুক্ত। যেমন দরিদ্রদের ব্যাপক কল্যাণ ও সহযোগিতা করা, কুরআন তিলাওয়াত করা, বেশি বেশি যিকর ও দরুদ পাঠ.....। ক্রুশের অনুসারী খৃস্টানগণ যদি তাদের নবীর জন্মের রাতকে সবচেয়ে বড় ঈদ হিসেবে গ্রহণ করতে পারে তবে এ কাজে ইসলামের অনুসারীদের অধিকার অধিকতর। .....।’’[1]

(৪) আমরা দেখছি যে, মূল ‘নি’মাতুল কুবরা’ গ্রন্থের প্রথমেই ইবন হাজার হাইতামী সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করছেন যে, সাহাবী, তাবিয়ী ও তাবি-তাবিয়ীগণের যুগের একজন মানুষও মীলাদুন্নবী পালনের কথা জানতেন না। খৃস্টান সম্প্রদায় ২৫ ডিসেম্বর যীশুখৃস্টের জন্মদিনকে বড়দিন বা ‘ঈদে মীলাদুল মাসীহ’ হিসেবে পালন করেন। বিশেষত ৫ম হিজরী শতকের শেষে ৪৯১ হি/ ১০৯৭ খৃ থেকে খৃস্টান ক্রুসেডারগণ সিরিয়া, ফিলিস্তিন, ইরাক ও মিসরের বিভিন্ন দেশ দখল করে খৃস্টান রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। এ সকল দেশে দখলদার খৃস্টানগণ মহাসমারোহে বড়দিন বা ‘ঈদে মীলাদুল মাসীহ’ পালন করতেন। বিষয়টি মুসলিমদেরকে ‘ঈদে মীলাদুন্নবী’ পালনের প্রেরণা দেয়। শতবর্ষ পরে ষষ্ঠ হিজরী শতকের শেষ প্রান্তে এসে মুসলিম সমাজও ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপন শুরু করে।

পক্ষান্তরে জাল ‘নি’মাতুল কুবরা’ বইয়ের প্রথম পরিচ্ছেদের মূল বক্তব্য যে, খুলাফায়ে রাশেদীন সকলেই মীলাদ পালন করতেন এবং মীলাদ পালনকেই দীনের সবচেয়ে বড় বিষয় বলে প্রচার করতেন। চার খলীফা যখন এভাবে মীলাদের মহাগুরুত্ব প্রচার করতেন তখন স্বভাবতই তাঁদের যুগের সকল সাহাবী-তাবিয়ী প্রতিদিনই মহাসমারোহে তা পালন করতেন!!

(৫) আলিমদের উদ্ধৃতিও জাল ‘নিমাতুল কুবরা’-র জালিয়াতি প্রমাণ করে। সীরাহ হালাবিয়্যাহর লেখক আল্লামা হালাবী (১০৪৪ হি), তাফসীর রুহুল বায়ানের লেখক আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী (১১২৭ হি), ‘জা’আল হক্ক’ গ্রন্থের লেখক মুফতি আহমাদ ইয়ার খান প্রমুখ আলিম মীলাদের পক্ষে ইবন হাজার হাইতামী থেকে উদ্ধৃত করেছেন যে, তিনি তা বিদআতে হাসানা বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি মীলাদের পক্ষে সাহাবী-তাবিয়ীগণ থেকে কোনো হাদীস উদ্ধৃত করেছেন বলে কেউই উল্লেখ করেন নি। পান্ডুলিপির বর্ণনায় রচিত গ্রন্থগুলোতেও উপরে উদ্ধৃত মূল পান্ডুলিপির বক্তব্য উদ্ধৃত করা হয়েছে।[2]

(৬) এভাবে আমরা নিশ্চিত যে, মাকতাবাতুল হাকীকাহ প্রকাশিত এ বইটি ইবন হাজার হাইসামীর নি’মাতুল কুবরার নাম চুরি করে প্রকাশিত একটি জাল বই। তবে লক্ষ্যণীয় যে, এ জাল বইটি যদি জাল না হয়ে ইবন হাজার হাইতামী মাক্কী শাফিয়ীর নিজের লেখা বলে প্রমাণ হতো তাতেও এ গ্রন্থে উদ্ধৃত হাদীসগুলোর বিশুদ্ধতা প্রমাণ হতো না। ইবন হাজার মাক্কী শাফিয়ী তো দূরের কথা, স্বয়ং ইমাম মুহাম্মাদ ইবন ইদরীস মাক্কী শাফিয়ীও বা অন্য কোনো ইমাম, মুজতাহিদ, পীরানে পীর বা বুজুর্গও যদি এভাবে সনদবিহীন কোনো কথা উদ্ধৃত করেন তবে তা সনদ অনুসন্ধান ও যাচাই না করে কোনো মুসলিম কখনোই গ্রহণ করবেন না। ইমাম শাফিয়ী উদ্ধৃত অনেক হাদীস পরবর্তী শাফিয়ী ফকীহগণ দুর্বল বা জাল বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন। হানাফী, মালিকী, হাম্বালী, কাদিরী, চিশতী, শাযিলী... সকল মাযহাব ও তরীকার আলিমগণ একই পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। প্রথম পর্বে আমরা এ সকল বিষয় আলোচনা করেছি।

(৭) রাসূলুল্লাহ () ও সাহাবীগণের হাদীসের ভাষা, শব্দ ও পরিভাষা সম্পর্কে যার সামান্যতম জ্ঞান আছে তিনিও বুঝতে পারবেন যে, এগুলো সবই জাল কথা। কোনো ইংরেজি ডকুমেন্ট জাল করতে যেয়ে পানি খাওয়ার ইংরেজি (eating water), অথবা আরবী ডকুমেন্ট জাল করতে যেয়ে ‘‘নামায পড়া’’-র আরবী ‘‘قراءة الصلاة’’ লিখলে কোনো যাচাই ছাড়াই বুঝা যায় যে, ডকুমেন্টটি জাল এবং জালিয়াত একজন বাঙালী। তেমনি ‘মীলাদ পাঠের’ আরবী (قراءة المولد/ قراءة الميلاد) শুনলে কুরআন-হাদীসের আরবী বিষয়ে অভিজ্ঞ যে কেউ নিশ্চিত বুঝবেন যে, কথাটি কখনোই সাহাবীদের যুগের কারো কথা নয়; বরং সুনিশ্চিত জাল কথা এবং এ জালিয়াত তুর্কী বা তুর্কী যুগের তুর্কী ভাষা দ্বারা প্রভাবিত কোনো আরব জালিয়াত। ৬০০ হিজরীর দিকে মীলাদ উদযাপন শুরু হলে প্রথম কয়েক শত বৎসর একে (الاحتفال بالمولد) ‘মীলাদ উদযাপন, (عمل المولد) মীলাদ পালন ইত্যাদি বলা হতো। বিগত ২/৩ শত বৎসর যাবৎ মধ্যপ্রাচ্যে মীলাদ মাহফিলে মীলাদ বিষয়ক পুস্তিকা পাঠের প্রচলন হয়েছে। এজন্য বিগত ১/২ শত বৎসর যাবৎ মীলাদ অনুষ্ঠানকে অনেক সময় ‘‘মীলদুন্নবী পাঠ’’ বলা হয়। জালিয়াতগণ এ পরিভাষা ব্যবহার করেছেন।

[1] ইবন হাজার হাইতামী, আন-নি’মাতুল কুবরা (মিসরের জাতীয় গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত পান্ডুলিপি, নং ৪৪৯) পৃষ্ঠা ১-৩।

[2] হালাবী, আস-সীরাহ আল-হালাবিয়্যাহ ১/১৩৭; ইসমাঈল হাক্কী, রুহুল বায়ান ৯/২, ৪৭; ইসমাঈল পাশা বাবাতী বাগদাদী, ঈযাহুল মাকনূন ২/৬৬১; হাদিয়্যাতুল আরিফীন ১/৭৮; মুফতি আহমাদ ইয়ার খান, জা‘আল হক (অনুবাদ অধ্যাপক লুৎফুর রহমান, মোহাম্মদী কুতুবখানা, চট্রগ্রাম, ১৯৮৮), দ্বিতীয়াংশ ৩৯-৪০।

মীলাদ পালনের পক্ষে জালিয়াতদের বানানো আরো দুটি হাদীস:

عن ابن عباس رضي الله عنهما أنه كان يحدث ذات يوم في بيته وقائع ولادته إذ جاء النبي وقال: حلَّت لكم شفاعتي.

‘‘ইবন আববাস বলেন, একদিন তিনি নিজ বাড়িতে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর জন্মের ঘটনাবলি বর্ণনা করছিলেন। তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ আগমন করেন এবং বলেন: তোমাদের জন্য আমার শাফাআত পাওনা হলো।’’ (জালিয়াত লক্ষ্য করে নি যে, ইবন আববাসের বয়স ৮ বৎসর পূর্ণ হওয়ার আগেই রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর ইন্তেকাল হয়। তিনি কি ৫/৬ বৎসর বয়সে ছেলেমেয়েদের হাদীস শুনাচ্ছিলেন!)

عن أبي الدرداء رضي الله عنه قال: مررت مع النبي إلى بيت عامر الأنصاري يعلم وقائع ولادته لأبنائه وعشيرته ويقول: هذا اليوم، فقال النبي : إن الله فتح عليكم أبواب الرحمة وملائكته يستغفرون لكم.

আবূ দারদা (রা) বলেন, ‘‘আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর সাথে আমির আনসারীর (রা) বাড়ির পার্শ্ব দিয়ে যাচ্ছিলাম। তিনি তাঁর সন্তান ও পরিবারের মানুষদের তাঁর জন্মের ঘটনাবলি শেখাচ্ছিলেন এবং বলছিলেন: আজই সেই দিন। তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন: নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের জন্য রহমতের দরজাগুলো খুলে দিয়েছেন এবং ফিরিশতাগণ তোমাদের জন্য ক্ষমা চাচ্ছে।’’

বর্তমানে মীলাদের পক্ষের কোনো কোনো আলিম জালালুদ্দীন সুয়ূতী (৯১১ হি), আব্দুল হক্ক ইলাহাবাদী ও অন্যান্য আলিমের নামে এ সকল হাদীস উদ্ধৃত করছেন। এগুলোর কোনোরূপ সনদ কেউ উল্লেখ করেন নি। এমনকি ইসলামের প্রথম ৫০০ বৎসরে সংকলিত কোনো গ্রন্থে এগুলো সনদসহ বা সনদ ছাড়া সংকলিত হয়েছে বলেও কেউ প্রমাণ বা দাবি করেন নি।

৪৬. ৬০০ বছর যাবৎ সকল ইমাম ও বুজুর্গই কি মীলাদ বিরোধী?

 সম্মানিত পাঠক, ইহূদী-খৃস্টানগণ তাওরাত, ইঞ্জিল ইত্যাদি কিতাবের নামে জালিয়াতি করে তাদের ধর্মকেই বিকৃত করতে সক্ষম হয়েছে। মুসলিম উম্মাহও ইহূদী-খৃস্টানদের হুবহু অনুকরণ করে বিভ্রান্তির গভীরে নিমজ্জিত হবে বলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উম্মাতকে বারবার সাবধান করেছেন।[1] আমরা দেখি যে, মুসলিম উম্মাহর মধ্যে হাদীসের নামে জালিয়াতির প্রবণতা ইহূদী-খৃস্টানদের মতই ব্যাপকতা লাভ করে। তবে মহান আল্লাহ দীন ইসলামকে বিকৃতি থেকে রক্ষা করেছেন। সাহাবীদের যুগ থেকে উম্মাতকে সনদ সংরক্ষণ ও সনদ-যাচাইয়ের তাওফীক দিয়ে সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য করার পথটি রক্ষা করেছেন। ইহূদী-খৃস্টান ও অন্যান্য ধর্মের সাথে ইসলামের মৌলিক পার্থক্য এখানেই। অন্যান্য ধর্মের ধর্মগ্রন্থগুলোতে সনদ সংরক্ষণ ও বিচারের ব্যবস্থা না থাকায় সহীহ ও জাল এমনভাবে মিশে গিয়েছে যে, পার্থক্য করার কোনো যুক্তিসম্মত পদ্ধতি নেই, ফলে প্রত্যেকে নিজ নিজ যুক্তি-বুদ্ধি ও পছন্দ অনুসারে কিছু সহীহ ও কিছু জাল বলে দাবি করেন। আর ইসলামের মধ্যে জালিয়াতগণ অনেক জালিয়াতি করলেও যাচাই করার পদ্ধতি রয়েছে। কিন্তু যদি কেউ জালিয়াতি করতে চান বা জাল কথা গ্রহণ করতে চান তবে তার কথা ভিন্ন।

সম্মানিত পাঠক, ন্যূনতম পর্যায়ের সাধারণ জ্ঞানের যে কোনো মুসলিম বুঝতে পারেন যে, এ কথাগুলো জাল। কারণ এগুলোর কোনো সনদ নেই। ইসলামের প্রথম ৬/৭ শত বছরের মধ্যে লিখিত কোনো গ্রন্থে সনদ-বিহীনভাবেও এ মিথ্যা কথাগুলো উল্লেখ করা হয় নি। তবে এ সকল হাদীসকে সহীহ বলে গ্রহণ করা আরো ভয়ঙ্কর বিষয়। নিম্নের বিষয়গুলো লক্ষ্য করুন:

(ক) মীলাদের সমর্থকগণ নিশ্চিত করেছেন যে, প্রথম তিন প্রজন্মের কেউ মীলাদ উদযাপন করেন নি। পাকিস্তানের প্রসিদ্ধ গবেষক প্রফেসর ড. তাহির কাদিরী রচিত ‘মীলাদুন্নবী’ গ্রন্থটি পাঠ করলে পাঠক দেখবেন যে, তিনি নিজেও নিশ্চিত করেছেন যে, বাদশাহ কুকবূরী (মৃত্যু ৬৩০ হি) প্রথম মীলাদ উদযাপন শুরু করেন। এছাড়া তিনি মীলাদের সমর্থনে গত ৮০০ বৎসরের অনেক প্রসিদ্ধ আলিমের বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। তাঁরা সকলেই বলেছেন, প্রথম তিন প্রজন্মের কেউ মীলাদ পালন করেন নি।[2] এখন উপরের জাল হাদীসগুলোকে সহীহ বলে দাবি করার অর্থ সাহাবী, তাবিয়ী ও তাবি-তাবিয়ী তিন প্রজন্মের সকলকে বিভ্রান্ত বলে দাবি করা (নাউযূ বিল্লাহ)। কারণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও খুলাফায়ে রাশেদীনের এতগুলো বক্তব্য জানার পরেও যারা মীলাদ পালন করেন নি তাদের চেয়ে হতভাগা-বদকার ও রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মর্যাদার শত্রু আর কে হতে পারে!! (নাঊযু বিল্লাহ)

(খ) এ সকল হাদীসকে সহীহ বলে মানতে হলে হাজার বৎসরের সকল হাদীস সংকলক মুহাদ্দিসকে নবীজী (ﷺ)-এর দুশমন (!!) বলে গণ্য করতেই হবে। কারণ, ইবন আববাস (রা), আবূ দারদা (রা) থেকে বর্ণিত মীলাদের মর্যাদা বিষয়ক রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাদীস এবং আবূ বকর (রা), উমার (রা), উসমান (রা) ও আলী (রা) থেকে বর্ণিত মীলাদের হাদীসগুলো তাঁরা গোপন করেছেন। এ সকল সাহাবী (রা) থেকে সহীহ, যয়ীফ বা জাল সনদে বর্ণিত অতি সাধারণ বিষয়ে অগণিত হাদীস তাঁরা সংকলন করলেন, অথচ এত গুরুত্বপূর্ণ হাদীসগুলো তাঁরা কেউ কোনোভাবে সংকলন করলেন না!!

ইসলামের প্রথম হাজার বৎসরে সংকলিত হাদীসগ্রন্থগুলোতে হাঁটাচলা, পানাহার, মলমূত্র ইত্যাদি বিষয়ে অগণিত অধ্যায়, পরিচ্ছেদ ও অনুচ্ছেদ বিদ্যমান। কিন্তু ‘কিরাআতুল মাওলিদ’ (মীলাদ পাঠ), ‘আমালুল মাওলিদ’ (মীলাদ পালন), ‘ইহতিফালুল মাওলিদ’ (মীলাদ উদযাপন) ইত্যাদি নামে এ সকল হাদীসের গ্রন্থে একটি অধ্যায় তো দূরের কথা, একটি পরিচ্ছেদ, অনুচ্ছেদও তারা লিখেন নি এবং একটি হাদীসও তাঁরা সংকলন করেন নি।

(খ) ইমাম আবূ হানীফাসহ চার ইমাম ও ইসলামের প্রথম ৬০০ বৎসরের সকল ফকীহ একইভাবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মর্যাদা ও মীলাদের দুশমন বলে গণ্য হবেন। কারণ, তাঁরা তাঁদের ফিকহী গ্রন্থগুলোতে অতি সামান্য বিষয় নিয়েও আলোচনা করেছেন। কিন্তু তাঁদের কারো গ্রন্থে ‘কিরাআতুল মাওলিদ’ (মীলাদ পাঠ), ‘আমালুল মাওলিদ’ (মীলাদ পালন), ‘তাযীমুল মাওলিদ’ (মীলাদের তাযীম) ইত্যাদি নামে কোনো একটি অধ্যায়, পরিচ্ছেদ, অনুচ্ছেদ বা মাসআলা তাঁরা লিখলেন না। এর গুরুত্বও বললেন না!

(গ) উম্মাতের প্রথম ৬০০ বৎসরের সকল আলিমই মীলাদ-বিরোধী ও রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মর্যাদার দুশমন (!!!) বলে গণ্য হবেন। কারণ, ৬০৪ হিজরী সালে মীলাদুন্নবী পালনের উদ্ভব হওয়ার পর থেকে বিগত ৮০০ বৎসরে উম্মাতের আলিম ও বুজুর্গগণ মীলাদুন্নবী বিষয়ে হাজার হাজার পুস্তক-পুস্তিকা রচনা করেছেন। কিন্তু এর আগের ৬০০ বৎসরে একজন আলিম বা বুজুর্গ মীলাদুন্নবী বিষয়ে একটি পুস্তিকাও রচনা করেন নি। মীলাদের সমর্থক আলিমগণও বারবার উল্লেখ করেছেন যে, মীলাদ বিষয়ক প্রথম বই রচনা করেন আল্লামা আবুল খাত্তাব ইবনু দেহিয়া (৬৩৩ হি.)। তাঁর রচিত এ বইয়ের নাম: ‘‘আত-তানবীর ফী মাওলিদিল বাশির আন নাযীর’’।[3] পূর্ববর্তী ৬০০ বৎসরের ইমাম, ফকীহ, মুজতাহিদ, মুজাদ্দিদ, পীরানে পীর, বুজুর্গ কেউ মীলাদ বিষয়ে একটি পুস্তিকাও লিখেন নি। তাঁরা অনেক বই লিখেছেন, কিন্তু তাঁদের লেখা বইয়ের মধ্যে ‘কিরাআতুল মাওলিদ’ (মীলাদ পাঠ) বা ‘আমালুল মাওলিদ’ (মীলাদ পালন) বিষয়ে একটি ছোট্ট অনুচ্ছেদ বা বাক্যও লিখেন নি!

আমরা যখন বলি যে, ইসলামের প্রথম ৬০০ বৎসর মীলাদ পালন ছিল না, পরে উদ্ভব হয়েছে তখন বিষয়টি খুবই সহজ হয়ে যায়। যেহেতু তাঁদের সময়ে কেউ মীলাদ পালন করার বিষয়টি জানতই না সেহেতু তাঁরা এ বিষয়ে কিছু লিখেন নি। কিন্তু যখন প্রমাণ হয় যে, হাদীসে নববী এবং সাহাবী-তাবিয়ীগণের বক্তব্যে মীলাদের গুরুত্ব বিদ্যমান তখন বিষয়টি ভিন্ন হয়ে যায়। হাদীসে মীলাদের এত গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও তাঁরা মীলাদের বিষয়ে একটি লাইন লিখলেন না! জীবনে মীলাদ পালন করলেন না! তাঁরা কেমন মুসলমান???

বিষয়টি কী প্রমাণ করে? স্বভাবতই প্রমাণ করে যে, উম্মাতের প্রথম ৬০০ বৎসরে মুসলিমগণ ‘কিরাআতুল মাওলিদ’ (মীলাদ পাঠ), ‘আমালুল মাওলিদ’ (মীলাদ পালন) ইত্যাদি কিছুই জানতেন না। কিন্তু যদি কেউ উপরের হাদীসগুলোকে সহীহ বলে দাবি করেন তবে তাকে মানতেই হবে যে, উম্মাতের প্রথম ৬০০ বৎসরের সকল ইমাম, মুজাদ্দিদ, পীরানে পীর, বুজুর্গ সকলেই মীলাদ বিরোধী ছিলেন। শুধু তাই নয়, উপরন্তু তাঁরা মীলাদ বিষয়ক হাদীস গোপনের মত মহাপাপ করেছেন।

(ঘ) ইমাম শাফিয়ীর প্রতিটি বক্তব্য সংকলন ও আলোচনা করেছেন বাইহাকী, নাবাবী ও অন্যান্য শাফিয়ী মুহাদ্দিস-ফকীহ। ইবন হাজার হাইতামী শাফিয়ীর নামে জালকৃত এ বইয়ে মীলাদের গুরুত্ব বিষয়ে তাঁর এ মহান বক্তব্যটি তাঁরা সকলেই গায়েব করে দিয়েছেন! শাফিয়ী মাযহাবের কোনো গ্রন্থে এ বক্তব্য নেই। এমনকি ইবন হাজার হাইতামীর লেখা শাফিয়ী মাযহাবের বড়বড় ফিকহী গ্রন্থেও তিনি মীলাদ বিষয়ে ইমাম শাফিয়ীর এ বক্তব্য উদ্ধৃত করেন নি। আমাদের মানতে হবে যে, এ বক্তব্য জাল অথবা নাবাবী, বাইহাকী, গাযালী, সুয়ূতী, ইবন হাজার আসকালানী, ইবন হাজার হাইতামী ও সকল শাফিয়ী ফকীহ তাঁদের ঈমানী ত্রুটির কারণে মীলাদের প্রসঙ্গ গোপন করেছেন!!

[1] খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা, পৃ. ৫৪১-৫৬০।

[2] ড. তাহির কাদিরী, মীলাদুন্নবী (লাহোর, মিনহাজুল কুরআন পাবলিকেশন্স ২০০৪) পৃ ৫০৩, ৬১৫, ৬২৬-৬৩১, ৬৩৮-৬৩৯, ৯২৬।

[3] ইবন খাল্লিকান, ওয়াফায়াতুল আ’ইয়ান ৩/৪৪৯; সুয়ূতী, আল-হাবী (শামিলা) ১/২৭২, ১/১৮১-১৮২; ইবন হাজার হাইতামী, তুহফাতুল মুহতাজ ফী শরাহিল মিনহাজ (শামিলা) ৩১/৩৭৬-৩৭৭, ৩৮১; মুফতি আহমাদ ইয়ার খান, জা‘আল হক ২/৪০-৪১।
৪৭. ৮০০ বছরের সকল মীলাদ-পন্থীই কি সত্যগোপনকারী?

সম্মানিত পাঠক, এখানে আরো একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। বিগত ৮০০ বৎসর যাবৎ অগণিত আলিম মীলাদের পক্ষে বইপত্র লিখেছেন। তাঁরা সকলেই মীলাদকে বিদআতে হাসানা বলেছেন এবং ইসলামের প্রথম তিন যুগে কেউ মীলাদ পালন করেন নি বলে বারবার নিশ্চিত করেছেন। উপরের জাল হাদীসগুলোকে সহীহ মানতে হলে আমাদের মানতে হবে যে, তাঁরা সকলেই সত্য গোপন করেছেন এবং মীলাদের অবমর্যাদা করেছেন। তাঁরা আবূ লাহাবের আমল দিয়ে মীলাদ প্রমাণের চেষ্টা করেছেন, অথচ রাসূলুল্লাহ ﷺ ও খুলাফায়ে রাশেদীনের সুস্পষ্ট হাদীসগুলো গোপন করেছেন। হাদীস, তাফসীর, ফিকহ, ইতিহাস, তাসাউফ ইত্যাদি বিষয়ে সকল দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ সংগ্রহ ও অধ্যয়ন করে পানাহার, শয়ন-নিদ্রা, মলমূত্র এবং অন্যান্য অতি সাধারণ বিষয়ের হাদীসগুলো তারা সংগ্রহ, সংকলন ও যাচাই-বাছাই করলেন, অথচ মীলাদের গুরুত্ব বিষয়ে এত গুরুত্বপূর্ণ হাদীসগুলো তারা সংকলন বা মূল্যায়ন কিছুই করলেন না!!

সম্মানিত পাঠক, খৃস্টান প্রচারকণ বাংলাদেশের মুসলিমদের নানাবিধ প্রতারণার মাধ্যমে ধর্মান্তরিত করছেন। জালিয়াতিতে ভরা ‘কিতাবুল মোকাদ্দস’, ইঞ্জিল শরীফ ইত্যাদিকে ‘আল্লাহর কালাম’ হিসেবে পেশ করে তারা মুসলিমদের প্রতারণা করছেন। আমরা যখন ময়দানে তাদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে জালিয়াতি প্রমাণ করতে যাই তখন তারা বিভিন্ন অযুহাতে পালিয়ে যান বা এড়িয়ে যান। কিন্তু ময়দান ফাঁকা হলেই তারা সরল মুসলিমদের বলেন, কুরআনেই তো আছে তাওরাত-ইঞ্জিল আল্লাহর কালাম, সেগুলোকে বিশ্বাস করতে হবে। আর আমাদের হাতের এগুলোই আদি-অকৃত্রিম তাওরাত-ইঞ্জিল। কাজেই এগুলো বিশ্বাস না করলে মুসলমান থাকা যাবে না!!

জাল হাদীসের বিষয়টিও একইরূপ। বিগত দেড় হাজার বছর যাবৎ যত জাল হাদীস ও জাল পুস্তক প্রকাশ পেয়েছে, উম্মাতের আলিমগণ সেগুলোর জালিয়াতি উন্মোচন করেছেন। কিন্তু যারা যে কোনোভাবে নিজের মত প্রমাণ করতে বদ্ধপরিকর তারা জালিয়াতির এ সকল প্রমাণ খন্ডনের চেষ্টা না করে এবং হাদীসগুলোর সনদ অনুসন্ধান না করেই সাধারণ মুসলিমদের সামনে এগুলোকে হাদীস হিসেবে পেশ করে নিজেদের মত প্রমাণের চেষ্টা করছেন। জাল ‘নি’মাতুল কুবরা’ গ্রন্থের ও মীলাদ বিষয়ক অন্যান্য জাল হাদীসের একই অবস্থা।

জালিয়াতি ও বিকৃতির অগণিত অকাট্য প্রমাণ জানার পরেও ইহূদী-খৃস্টানগণ বিভিন্ন অজুহাতে তাদের জাল ধর্মগ্রন্থগুলো প্রচার করে চলেছেন। মুসলিম উম্মাহর মধ্যেও কিছু মানুষ এরূপই করছেন। তুরস্কের মাকতাবাতুল হাকীকাহ প্রকাশিত এ জাল বইটির জালিয়াতি সুস্পষ্ট হওয়া সত্ত্বেও এবং এতে উল্লেখিত হাদীসগুলো সনদবিহীন ও ভিত্তিহীন হওয়া সত্ত্বেও মীলাদ সমর্থক কিছু আলিম এ বইটির অনুবাদ ও প্রচার করছেন। হাদীসগুলোর সনদ অনুসন্ধানের কোনোরূপ চেষ্টাও করছেন না। ইহূদী-খৃস্টান ধর্মে জাল কথাগুলো সহীহ কথার সাথে মিশে গিয়েছে। তবে সনদ ব্যবস্থার মাধ্যমে আল্লাহ উম্মাতে মুহাম্মাদীর জন্য যাচাইয়ের পথ খোলা রেখেছেন। হাজার বছর চলে গেলেও এবং হাজার হাজার প্রসিদ্ধ ইমাম আলিমের নামে জালিয়াতি করলেও কোনো জাল কথাই ইসলামের মধ্যে অনুপ্রবেশ করতে পারে না। সত্যানুসন্ধানীর জন্য নিরপেক্ষ ও বস্ত্তনিষ্ঠ যাচাইয়ের পথ উন্মুক্ত।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে বা সাহাবী-তাবিয়ীগণের নামে মীলাদের পক্ষে এতগুলো হাদীস দেখে মুমিনের জন্য আনন্দিত হওয়াই স্বাভাবিক। তবে তাঁর ঈমানের দাবি যে, তিনি প্রথমেই এগুলোর সনদ ও সূত্র উদ্ধার করার চেষ্টা করবেন। নয়শত বা হাজার বছর পরে একজন আলিম একটি হাদীস বলছেন, তাহলে নিশ্চয় পুরাতন কোনো গ্রন্থে তা রয়েছে। মীলাদের পক্ষের বা বিপক্ষের প্রত্যেক আলিমের দায়িত্ব এগুলোর সনদ অনুসন্ধান ও যাচাই। যদি সনদ পাওয়া যায় ও গ্রহণযোগ্য হয় তবে সেগুলো মেনে নেওয়া প্রত্যেক মুমিনের ঈমানের দাবি। আর যদি সনদ না পাওয়া যায় বা সনদ জাল বলে প্রমাণ হয় তবে এগুলোকে প্রত্যাখ্যান করা প্রত্যেক মুমিনের দায়িত্ব। ইবন হাজার হাইতামী এবং অন্যান্য ইমাম ও মুহাদ্দিস উল্লেখ করেছেন যে, হাদীসের সনদ না জেনে বা অন্তত হাদীসের কোন গ্রন্থে তা সংকলিত তা নিশ্চিত না হয়ে সনদ-বিহীন হাদীস উল্লেখ করা ভয়ঙ্কর হারাম কর্ম এবং কোনো খতীব, ওয়ায়িজ বা লেখক এরূপ করলে তাকে রাষ্ট্রীয় ভাবে শাস্তি দেওয়া জরুরী।[1]

সম্মানিত পাঠক, মীলাদ ও অন্য যে কোনো বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে ভিন্ন মত পোষণ করা, ইজতিহাদ করা ও প্রমাণ পেশ করার অধিকার সকলেরই রয়েছে। কিন্তু তাই বলে জালিয়াতি!! মহান আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন।

[1] ইবন হাজার হাইতামী, আল-ফাতাওয়া আল-হাদীসিয়্যাহ (বৈরুত, তুরাস), পৃষ্ঠা ৬৩-৬৪ ও ১২১-১২২।
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ৫ পর্যন্ত, সর্বমোট ৫ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে