হাদীসের নামে জালিয়াতি মীলাদুন্নবী (ﷺ) উদযাপন ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.)

আমি ‘এহইয়াউস সুনান’‘রাহে বেলায়াত’ পুস্তকদ্বয়ে মীলাদের উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ, আলিমগণের মতামত ও সুন্নাত পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।[1] আমরা দেখেছি যে, মীলাদ মাহফিলের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ ()-এর মীলাদ, সীরাত, শামাইল ও হাদীস আলোচনা করা, দরুদ-সালাম পাঠ করা, মহববত বৃদ্ধি করা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত-সম্মত ইবাদত পালন করা হয়। নাম ও পদ্ধতিগত কারণে বিভিন্ন মতভেদ দেখা দিয়েছে। তবে পক্ষ-বিপক্ষ সকলেই একমত যে, ইসলামের প্রথম শতাব্দীগুলোতে ‘‘মীলাদুন্নবী’’ বা রাসূলুল্লাহ -এর জন্ম পালনের প্রচলন ছিল না। মীলাদুন্নবীর সমর্থক কয়েকজন প্রসিদ্ধ আলিমের বক্তব্য দেখুন:

(ক) নবম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও ফকীহ আল্লামা ইবনু হাজর আসকালানী (৮৫২ হি) মীলাদুন্নবী উদ্যাপন সমর্থন করেছেন। তিনি লিখেছেন: ‘‘মাওলিদ পালন মূলত বিদ‘আত। ইসলামের সম্মানিত প্রথম তিন শতাব্দীর সালফে সালেহীনের কোনো একজনও এই কাজ করেন নি।’’[2]

(খ) এ শতকের অন্য একজন প্রসিদ্ধ আলিম আল্লামা আবুল খাইর মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুর রহমান সাখাবী (৯০২ হি.)। তিনিও মীলাদুন্নবী উদ্যাপনের সমর্থক। তিনি লিখেছেন : ‘‘ইসলামের সম্মানিত প্রথম তিন যুগের সালফে সালেহীনের কোনো একজন থেকেও মাওলিদ পালনের কোনো ঘটনা খুঁজে পাওয়া যায় না। মাওলিদ পালন বা উদ্যাপন পরবর্তী যুগে উদ্ভাবিত হয়েছে। এরপর থেকে সকল দেশের ও সকল বড় বড় শহরের মুসলিমগণ রাসূলুল্লাহ -এর জন্মমাস পালন করছেন... বরকত লাভ করছেন। ’’[3]

(গ) নবম-দশম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধতম মুহাদ্দিস ও ফকীহ ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী মীলাদের সমর্থনে অনেক পুস্তিকা রচনা করেন। ‘হুসনুল মাকদাস ফী আমালিল মাওলিদ’ পুস্তিকায় তিনি মীলাদের সমর্থনে বলেন:

عندي أن أصل عمل المولد الذي هو اجتماع الناس وقراءة ما تيسر من القرآن ورواية الأخبار الواردة في مبدأ أمر النبي وما وقع في مولده من الآيات ثم يمد لهم سماط يأكلونه وينصرفون من غير زيادة على ذلك هو من البدع الحسنة التي يثاب عليها صاحبها لما فيه من تعظيم قدر النبي وإظهار الفرح والاستبشار بمولده الشريف، وأول من أحدث فعل ذلك صاحب اربل الملك المظفر أبو سعيد كوكبري...

‘‘মীলাদ পালন হলো: মানুষদের একত্রিত হওয়া, সাধ্যমত কুরআন তিলাওয়াত করা, রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর জন্ম এবং জন্মের সময় যে সকল অলৌকিক নিদর্শন প্রকাশিত হয়েছিল তা আলোচনা করা, এরপর দস্তরখান বিছানো হলে খাদ্য গ্রহণ করে প্রস্থান করা। এর অতিরিক্ত কিছুই করা হয় না। আমার মতে এরূপ কর্ম বিদআতে হাসানা, এর জন্য সাওয়াব পাওয়া যাবে; কারণ এতে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর তাযীম, তাঁর পবিত্র জন্মে খুশি ও আনন্দ প্রকাশ করা হয়। সর্বপ্রথম যে ব্যক্তি এ বিষয়টি উদ্ভাবন করেন তিনি ইরবিলের শাসক আল-মালিকুল মুযাফ্ফর আবূ সায়ীদ কুকবূরী (মৃত্যু ৬৩০ হি)...।’’[4]

(ঘ) দশম হিজরীর অন্যতম প্রসিদ্ধ সীরাতুন্নবী ও মীলাদুন্নবী গবেষক মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিক আল্লামা মুহাম্মাদ ইবন ইউসূফ সালিহী শামী (৯৪২ হি)। তিনি তাঁর সুপ্রসিদ্ধ ‘সীরাহ শামিয়্যাহ’ গ্রন্থে মীলাদুন্নবী উদযাপনের গুরুত্ব প্রমাণের জন্য আলিমগণের বক্তব্য, যুক্তি, স্বপ্ন ও কাশফ উদ্ধৃত করে দীর্ঘ অধ্যায় রচনা করেছেন। তিনিও সুস্পষ্টত উল্লেখ করেছেন যে, মীলাদুন্নবী পূর্ববর্তী যুগে ছিল না, সর্বপ্রথম ইরবিলের শাসক কুকবূরী তা প্রচলন করেন।[5]

(ঙ) মীলাদের সমর্থক লাহোরের প্রখ্যাত আলিম সাইয়্যিদ দিলদার আলী (১৯৩৫ খৃ) মীলাদের পক্ষে আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন: ‘‘মীলাদের কোনো আসল বা সূত্র প্রথম তিন যুগের কোনো সালফে সালেহীন থেকে বর্ণিত হয় নি; বরং তাঁদের যুগের পরে এর উদ্ভাবন ঘটেছে।’’[6]

(ছ) মীলাদের সমর্থনে বিগত ৮০০ বৎসরে অনেক প্রসিদ্ধ আলিম অনেক দলীল, যুক্তি, মত, কাশফ, স্বপ্ন ইত্যাদির কথা লিখেছেন। তবে তাঁরা সকলেই উল্লেখ করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও সাহাবী-তাবিয়ীগণের যুগে মীলাদ ছিল না। এজন্য তা বিদআতে হাসানা।

(জ) মীলাদের সমর্থক সকল আলিমই আনুষঙ্গিক দলীলের উপর নির্ভর করেছেন। যেমন, মীলাদের মধ্যে কুরআন তিলাওয়াত, দরুদ-সালাম পাঠ, দান-সাদকা ইত্যাদি নেক আমল করা হয়, কাজেই তা মন্দ হবে কেন? আবূ লাহাব রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর জন্মের সংবাদ পেয়ে খুশি হয়ে তার দাসীকে মুক্ত করে, এজন্য তিনি কাফির হয়েও কবরে উপকার লাভ করেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ নিজের জন্ম বিষয়ে কথা বলেছেন, সাহাবীগণ একে অপরের কাছে তাঁর গুণাবলি শুনতে চাইতেন, তাঁরা সালাতে দাঁড়িয়ে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর আগমন বিষয়ক কুরআনের আয়াত পাঠ করতেন.... কাজেই মীলাদ-কিয়াম কুরআন-সুন্নাহ সম্মত ...। আমরা স্বভাবতই বুঝি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও সাহাবীগণ মীলাদুন্নবী পালন করেছেন মর্মে কোনো একটি যয়ীফ বা জাল হাদীসও যদি থাকতো তাহলে কেউই এ সকল আনুষঙ্গিক বা অপ্রাসঙ্গিক দলীল দিয়ে মীলাদ প্রমাণের চেষ্টা করতেন না। বরং সরাসরি উক্ত দলীল পেশ করতেন।

এভাবে আমরা দেখছি যে, হিজরী ষষ্ঠ-সপ্তম শতকে ‘ঈদ মীলাদুন্নবী’ উদ্ভাবন ও প্রচলন হওয়ার পরে বিগত প্রায় ৮০০ বৎসর যাবৎ মুসলিম উম্মাহর অগণিত আলিম মীলাদকে পছন্দ করেছেন এবং এর পক্ষে বিভিন্ন দলীল-প্রমাণ পেশ করেছেন। কিন্তু তাঁরা কেউই এর পক্ষে জালিয়াতি করেন নি। বরং মীলাদের সমর্থক আলিমগণও মীলাদ প্রসঙ্গে জাল হাদীস বর্ণনা কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। কিন্তু বর্তমান যুগে কিছু নির্লজ্জ জালিয়াত এ বিষয়ে জাল হাদীস ও জাল পুস্তক প্রকাশ করেছে।

কিছু অংশে লেখকের লেখা আমাদের কাছে স্পষ্ট বোধগম্য হয়নি যে তিনি কি বুঝাতে চেয়েছেন। আমরা লেখকের সাথে অচিরেই এই বিষয়ে কথা বলে অস্পষ্ট বিষয়গুলিকে স্পষ্ট করার চেষ্টা করব ইনশাল্লাহ --- বাংলা হাদিস
----------------------------------------------------------------------------------------------
[1] দেখুন: এহইয়াউস সুনান, পৃ. ৫১৬-৫৫৫; রাহে বেলায়াত, পৃ. ৬৩৮-৬৪০।

[2] শামী, মুহাম্মাদ ইবন ইউসুফ, সুবুলুল হুদা (সীরাহ শামিয়্যাহ) ১/৩৬৬

[3] শামী, সীরাহ শামিয়্যাহ ১/৩৬২

[4] সুয়ীতী, আল-হাবী ফিল ফাতাওয়া ১/১৮১-১৮২।

[5] শামী, সীরাত শামিয়্যাহ ১/৩৬২।

[6] সাইয়িদ দিলদার আলী, রাসূলুল কালাম ফিল মাওলিদ ওয়াল কিয়াম, ১৫ পৃ।